কালিকা

কালিকা 

যাহারা সৃষ্টিরহস্যের কিছু কিছু খবর রাখে তাহাদের মতে নটু গোঁসাইয়ের কন্যা রাধারানিকে গড়িতে বিধাতাপুরুষ একটা মস্ত বড় ভুল করিয়া বসিয়া আছেন—মেয়ে না হইয়া রাধারানির বেটাছেলে হইয়া জন্মানো উচিত ছিল। অমন আদর্শ বৈষ্ণব পরিবার, বাড়ির কুকুর-বেড়ালটি পর্যন্ত যেন তৃণাদপি সুনীচ; মাঝখানে তালগাছের মতো খাড়া, রুক্ষ ওই ধিঙ্গি মেয়ে। একেবারে বেমানান। লোকে বলে, নটু তপস্যা করে মেয়ে-পেল্লাদ পেয়েছে—না ডোবে জলে, না পোড়ে আগুনে। 

নূতন কলেবরের প্রহ্লাদটির রূপের পরিচয় এইখানেই একটু দিয়া রাখা ভালো। কালো, বেশ স্পষ্টভাবেই কালো; শ্যামবর্ণ কী ওইরকম কোনও গোলমেলে বিশেষণ হাতড়াইবার দরকারই হয় না। হাড়কাটা মোটা, তাই গড়নটা খুব গোলালো নয়। চওড়া পিঠের উপর একরাশ চুল; অন্যত্র প্রশংসা পাইতো এ মেয়ের কাঁধে-পিঠে সমস্ত দিন নাচিয়া-কুঁদিয়া, ফুলিয়া-ফাঁপিয়া একটা বিশৃঙ্খলা বোঝা হইয়া থাকে। মাত্র চোখ দুইটির নিন্দা করা চলে না,—ডাগর, টানাটানা; তবে যাহারা খুব প্রশংসা করে তাহাদেরও স্বীকায় করিতে হয়— হ্যাঁ, একটু পুরুষালি ভাব আছে বইকি চাউনিতে—তা যা দস্যি মেয়ে! 

বাপ-মায়ের ভাবনার কূলকিনারা নাই, বয়স তো আর মুখ চাহিয়া কথা কহিবে না! মেয়ে ভাবনার কিনারা দিয়াও যায় না। ঘুড়ি উড়ায়, সাঁতার কাটে, জল ছাঁচিয়া, ডিঙি ভাসাইয়া হাল টানে; পূজা আসিলে যাত্রার আসর সাজায়, ভাঙা আসরে দল লইয়া রাবণের অভিনয় করে। যখন বিয়ের লগনসা নামে, সানাইয়ের বাদ্যে গ্রাম মুখরিত হইয়া উঠে, তাহার বাপ-মায়ের মনে আশার শিখাটি নিরাশার ধুমে ক্রমে আচ্ছন্ন হইয়া আসে, রাধারানি সদলবলে বরযাত্রীদের বিপন্ন করিবার নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবনে মনেপ্রাণে মাতিয়া থাকে। 

সন্ধ্যার রঙে রং মিশাইয়া যখন বাড়ি ঢোকে, মায়ের কাছে সেই এক ধরনের বাঁধা অভ্যর্থনা—এলেন গেছো মেয়ে! ওলো, তুই আবার ফিরলি কেন, গাছের ভূত-পেতনি বেহ্মদত্যি ভাগাড়ে গেছে? নিতে পারলে না তোকে? 

অত শান্ত নিরীহ মা, কাহারও কাছে মুখ তুলিয়া কথা কহিতে জানে না; সন্ধ্যায় মেয়ের শ্রীছাঁদ দেখিয়া কিন্তু তাহারও আর ধৈর্য থাকে না। 

মেয়ের কিন্তু এতটুকু খেদ নাই, দুঃখ নাই, গ্রীবাভঙ্গি করিয়া উত্তর দেয়, আহা! কী মেয়েই পর্শ করেছ। ভূত-পেতনিতে দূর থেকে দেখেই পালায়, তারা আবার নিতে আসবে!

হাসিয়া ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে মার হাতের কাজ কাড়িয়া লইয়া অমিত উৎসাহে লাগিয়া যায়—কুটনা কোটা, বাসন মাজা থেকে ভাইয়ের দুধ খাওয়ানো পর্যন্ত যে কাজই হউক না কেন। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দিনের কীর্তি-বিবরণী চলিতে থাকে : বুঝলে মা, বাঁধের ধারে আজ থেকে যাওয়া ঘুচিয়ে দিলে ড্যাকরা নন্তেটা। কুঠির সায়েব তাঁবু ফেলেছে, তুই ওসব করতে গেলি কেন বাপু? আমায় উলটে বলে—তুই তো শিকিয়ে দিয়েছিলি’…বোঝো; হ্যাঁগা, আমার কী দায়টা পড়েছে শেকাতে যাবার? মেয়েমানুষ আমি। মাঝখান থেকে অমন চমৎকার কুলগুলো পাঁচ ভূতের পেটে যাবে। আর এই সময় নদীতে যা গঙ্গার কাঁকড়া আসতে লেগেছে মা! হ্যাঁ, তোমার যেমন কথা, আঁচলে রক্ত লাগতে যাবে কেন? বা রে, কনুই থেঁতলে যাবে কেন সুস্থ শরীরে?—দেখি তাই তো গো!—এ মা, মাখনার কাণ্ড; আমি অত করে পাড়লাম পেঁপেটা আর পোড়ারমুখো কিনা গাছের ওপর গিয়ে কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দিলে, অবলা মেয়েমানুষ পেয়ে। তেমনি, হয়েওছে, তিনমানুষ ওপর থেকে পড়ে গতর চুর হয়ে গেছে বাছাধনের। রাধী বামনীর মুখের গেরাস খাবে—খাও!…

.

গেছো মেয়ের পাকা দেখা হইল গাছের উপরেই। কালিকাপুরের বিষ্ণু ভট্টাচার্য চরণডিহির কালভৈরবীর তলায় মানত পাঁঠা বলি দিয়া ফিরিতেছিলেন—রাস্তার ধারে, পেয়ারা গাছের ডালে একটি বারো-তেরো বৎসরের মেয়ের উপর নজর পড়িল। নজর না পড়িয়া উপায় ছিল না। মেয়েটির গাছকোমর বাঁধা, খালি গা, এলো চুল। ডালের ঊর্ধ্বে উপবিষ্ট একটি ছেলেকে ভূমিসাৎ করিবার শুভ উদ্দেশ্যে সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করিয়া দোলা দিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হাসি। 

বিষ্ণু ভট্টাচার্য কাছাকাছি কয়েক বাড়ি ঘুরিয়া পরিচয় লইলেন, তাহার পর সরাসরি রাধারানিদের গৃহে গিয়া তাহার পিতার নিকট মেয়েটিকে পুত্রবধূ রূপে ভিক্ষা করিলেন। নটু গোঁসাইয়ের কথাটা বুঝিতে এবং বিষ্ণু ভট্টাচার্যের মানসিক সুস্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ মিটিতে যা একটু দেরি হইল, তাহার পর কথাবার্তা স্থির হইয়া গেল। অন্তরের উল্লাস সাধ্যমতো সংযত করিয়া নটু গোঁসাই বলিলেন, তা হলে পাকা দেখাটা কবে সুবিধে–

বিষ্ণু ভট্টাচার্য উত্তর করিলেন, পেয়ারা গাছের মগডালে মাকে আমার পাকা দেখেছি, আর দেখেই চিনেছি; আর দ্বিতীয়বার দেখার দরকার নেই। 

বৈশাখের মাঝামাঝি ঘটনা, জ্যৈষ্ঠ মাসের গোড়ায় বিবাহ হইয়া গেল। শ্বশুরের আগ্রহাতিশয্যে রাধারানি বিয়ের পর আর বেশিদিন বাপের বাড়ি থাকিতে পাইল না, আশ্বিন পড়িলে বিজয়ার শুভদিনে শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। মা মেয়ের চোখের জলের সঙ্গে নিজের চোখের জল মিশাইয়া বলিল, সেখানে গিয়ে আর ওসব যেন করতে যেয়ো না মা, রাধারমণ যখন মুখ তুলে চাইলেন 

মেয়ে, ফোঁপানির মধ্যে যতটা সম্ভব, স্পষ্ট বলিল, ফিরে আসতে দাও, তারপর তোমার রাধারমণকে যদি না… 

মা মুখের উপর হাত দিয়া অমঙ্গলসূচক কথাটা আর শেষ করিতে দিল না। 

.

শ্বশুর কালিকাপুরে আসিয়া বধূকে একবার বাড়ির বিস্তীর্ণ সীমার মধ্যে ঘুরাইয়া আনিলেন, বলিলেন, এই তোমার পেয়ারা গাছ মা; ওই আম, জাম, জামরুলের বাগান; সাঁতার কাটার জন্যেও তোমায় বাইরে যেতে হবে না; দেখছই, মস্ত বড় পুকুর সামনে পড়ে আছে। কাজের দিকে যাবে না, ঢের বয়েস আছে; কাজের মধ্যে কাজ রইল এই মন্দিরটি। নিলে তো মার সেবার ভার?—বেশ!—তোমার শাশুড়ি যাওয়ার পর থেকে মার সেবার ত্রুটি হচ্ছিল বলেই আমায় তোমাকে পাইয়ে দিলেন… 

একটু থামিয়া বধূর মাথায় হাত দিয়া হাসিয়া বলিলেন নিজের কাজ নিজে করবার ইচ্ছে হয়েছে এবার, না গা মা? 

বধূ কথাটা বুঝিল না অতশত, তবু মাথা নাড়িয়া জানাইল, হ্যাঁ। 

ঘোর শাক্ত লোকটি। প্রকাণ্ড দেবোত্তর সম্পত্তির মাঝখানে বাড়ির লাগোয়া শ্যাম—মন্দির। নিকষে পড়া মূর্তি, পায়ের তলে শ্বেত-পাথরের মহাকাল স্তিমিতনেত্রে শয়ন। মূর্তি বেশি উঁচু নয়, চাহিতেই প্রথমে বরাভয়ে তোলা দক্ষিণ হাতটির উপর নজর পড়ে— রক্তাভ করতল, তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দুইটি ঈষৎ লীলায়িত, মুখখানি ডাহিনে একটু তোলা, আকাশ-নিবদ্ধ উন্মনা দৃষ্টি—একটি বারো-তেরো বৎসরের কিশোরী নিজেরই ভাবের সম্মোহনে যেন হঠাৎ নিশ্চল হইয়া গিয়াছে। 

কোথাও এতটুকু পাষাণত্ব নাই, শিল্পী নিজের বাসনাতপ্ত প্রাণ ঢালিয়া দিয়া যেন সব কঠোরতা গলাইয়া লইয়াছে। দিশ্বসন অঙ্গখানির রোম-রোম মাতৃত্বের সুষমায় পূর্ণ। 

এর সঙ্গে সেদিনের পেয়ারা গাছের মেয়েটির কোথায় একটি মিল ছিল—খুব সূক্ষ্ম, শুধু তেমন চোখেই ধরা পড়ে। তাই বিষ্ণু ভট্টাচার্য তাহাকে সযত্নে আনিয়া বাড়িতে তুলিলেন। সবচেয়ে ভালো লাগিল তাহার নামটি—রাধারানি! বিষ্ণু ভট্টাচার্যের মনে হইল, এই রহস্যময়ী মেয়েটির এ যেন ঘোর একটি প্রবঞ্চনা, নামের অন্তরালে আত্মগোপনের প্রয়াস, একটি ছলনা; ওই পাষাণময়ী মায়ের হাতের ছিন্নমুণ্ডে, কটিতটের করমালিকায় যে রকম ছলনার আভাস লুকানো আছে। 

বধু পুরুষ—নাম ধরিয়াছে কোমল। মা মমতাময়ী, হাতে লইয়াছে ছিন্নমুণ্ড। 

যে ধরা দিতে চায় না, সেই মনকে প্রবলতর বেগে টানে। 

বিষ্ণু ভট্টাচার্যের রাধারানিকে পুত্রবধূরূপে ঘরে আনার দরকার ছিল বটে, কিন্তু পুত্রের বিবাহ দেওয়ার মোটেই তাগাদা ছিল না। তাহাকে রাধারানির আসার উপলক্ষরূপে দাঁড় করানো হইল মাত্র। 

কালীপদর বয়স বছর চৌদ্দো হইবে, মাথায় রাধারানির চেয়ে মুঠাখানেকও বেশি হয়, কি না-হয়। বাপের সম্পত্তি আছে, খায় দায়, নিজের খেয়ালখুশি লইয়া থাকে। সকালে একটু সংস্কৃত পড়িয়া আসে, রাত্রে মৌলবি আসিয়া খানিকটা ফারসি পড়াইয়া যায়। যে সময়ের কথা হইতেছে, তখন ইংরাজ সবে এ দেশে পা দিয়াছে, শিক্ষার আসরটা সংস্কৃত ফারসির মধ্যে ভাগাভাগি করা। 

ফল কথা, রাধারানি যে একটা স্বামী-বিভীষিকা লইয়া বাড়ি হইতে বিদায় লইয়াছিল, শ্বশুরবাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে সেটা প্রায় তিরোহিত হইয়া গেল। সে দেখিল—পুঁটে, গোবরা, মাখনা গোছেরই তাহার একটি সঙ্গী জুটিয়া গিয়াছে—বরং আরও একটু বেশি অন্তরঙ্গ। জীবনের এই নূতনত্বটুকু পুরাতন ছাঁচে ঢালিয়া লইতে তাহার মোটেই দেরি হইল না। 

সংসারটি খুব ছোটোখাটো, তাহার গতির পথে কাহারও সহিত ঠেলাঠেলি হইবার সম্ভাবনা নাই। প্রথম—শ্বশুর, তিনি প্রতিমাটি আর মন্দিরটি লইয়াই থাকেন। বাড়িতে পিস্-শাশুড়ি—ঘোর বৈষ্ণব পরিবারের কুলবধূ। অল্পভাষী আর বেজায় রাশভারী মানুষটি— আসিয়া অবধি জগদম্বার পাঁঠা খাওয়া বন্ধ করিয়াছেন। প্রথম একদিন বলির পর এমন কুরুক্ষেত্র কাণ্ড করিয়া তুলেন যে, মা নাকি সেই রাত্রেই বিষ্ণু ভট্টাচার্যের নিকট আবির্ভূত হইয়া কাতরভাবে বলেন, বাবা বিষ্ণু ঢের হয়েছে, এত হেনস্তার চেয়ে বরং আমায় কুমড়ো-বলিই দিস তদ্দিন। 

কথাটা বিষ্ণু ভট্টাচার্য বড় দুঃখের সহিত দুই-একজনের কাছে জাহির করিয়াছেন, ভগ্নিরও কানে উঠিয়াছে, কিন্তু কোনও প্রতিকার হয় নাই। তবে, এমনি তিনি কোনও কথাতেই থাকেন না। ভিতর-বাড়িতে জগন্নাথের বিগ্রহ, নানামতে তাঁহারই সেবায় দিন কাটে। 

একটি ঝি আছে, একটি বামুনের মেয়ে আসিয়া রাঁধিয়া দিয়া যায়। এই সংসার—দুইটি ঠাকুর, আর এই কয়টি মানুষ। প্রকাণ্ড বাড়ি— 

পূজাপার্বণে কাজকর্মে আত্মীয়-স্বজনদের জোয়ার আসে, ভাটার সময় অধিকাংশ ঘরই তালাবন্ধ থাকে। 

রাধারানির কাজ বাঁধা। ভোরে উঠিয়া স্নান সারিয়া, এলোচুলের একটি সরু গোছায় একটা গেরো দিয়া, কালীপদকে ডাকিয়া তোলে। দুইজনে ফুল তুলিতে বাহির হইয়া যায়। গাছে উঠিবার পালা থাকে কালীপদর। অশোক আছে, পলাশ আছে, চাঁপা আছে। সুবিধা পাইলে কালীপদ ফুল তুলিয়া রাধারানির কোঁচড়ে ফেলিয়া দেয়। যখন হাতের কাছে পায় না, কিংবা যখন আগডালের দিকে অগ্রসর হইতে সাহস পায় না, পা দিয়া দুলাইয়া দুলাইয়া রাধারানিকে ধরাইয়া দেয়। রাধারানি হাসিয়া বলে, ঘেন্না ধরালে তুমি পুরুষ নামে, ভয়েই সারা! কী বলব, আমার হাত নিপিস্ করছে, নেহাত নাকি ইয়ে হয়েছি, তাই–—

‘ইয়ে’ হওয়ার জন্য যে বড় একটা আটকায় এমন নয়। গাছটা একটু ঝাঁকড়া হইলে, এদিক ওদিক দেখিয়া লইয়া বধূ কখন উঠিয়াও পড়ে, এ-ডালে ও-ডালে পা দিয়া অসম্ভব অসম্ভব জায়গায় গিয়া কোঁচড় ভরিতে থাকে; কালীপদ ত্রস্তভাবে ডাকিতে থাকে, চলে এসো,—রাধু, শুনছ? তোমার পায়ে পড়ি–এইবার তা হলে আমি চেঁচাব…চেঁচাই?…ও বা–। 

শাসনের ভঙ্গীতে রাধারানির চোখের তারকা আয়ত হইয়া উঠে, বলে, ডাকো বাবাকে, শেষ করেছ কি আমি হাত-পা ছেড়ে নাপিয়ে পড়েছি—বাবা এসে দেখবেন তালগোল পাকিয়ে মরে পড়ে আছি…

যা মেয়ে, ও তা স্বচ্ছন্দে পারে, কালীপদর আর সন্দেহ থাকে না। বেচারি জোর কাকুতি-মিনতি লাগাইয়া দেয়; লোভ দেখায়; লম্বা কিছু একটা আঁটে আঙুলের দ্বারা এই ধরনের একটা মুদ্রা সৃজন করিয়া বলে, দেখ, এই এনে দোব, ঘোষালদের পুকুরপাড় থেকে, পেকে হলদে হয়ে রয়েছে—সত্যি— 

জিনিসটা কামরাঙা। তবে রাজি হওয়া না-হওয়া নির্ভর করে রাধারানির মেজাজের উপর। এক-একদিন যেন কোনও মন্ত্রের আকর্ষণে নামিয়া আসে, কামরাঙার নামে মুখে এত লালা জমিয়া উঠে যে, কথা কহা শক্ত হইয়া পড়ে; সামলাইবার চেষ্টায় মুখে একটা চক্‌চক্‌ শব্দ করিতে করিতে বলে, “ঠিক বলছ? ঠিক? মা কালীর খাঁড়ার দিব্যি –মিথ্যে বললে তেরাত্তির কাটবে না–আচ্ছা, তিন সত্যি গালো…’ 

একেবারে তেরাত্তির লইয়া গালাগাল! মুখটি ভার করিয়া কালীপদ বলে, আমি না তোমার বর হই? 

এ-ধরনের আলাপনে এক-একদিন কথায় কথায় ঝগড়াও হয়, আবার কোনওদিন রাধারানি একটু অপ্রতিভ বা অনুতপ্ত হয়—যেমন মেজাজ থাকে; বলে, হ্যাঁ, তাই আমি বললাম নাকি? বললাম—যদি মিথ্যে বলো—যদি’র কথা… 

চলিতে চলিতেই হয়তো হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে বলে, সে সব কিচ্ছু হবে না, আমি রোজ মা-কালীর কাছে মাথা খুঁড়ি—হে ঠাকুর, দেখো যেন…’ 

ঝোঁকের মাথায় একটু বলিয়া আবার লজ্জা হয়, হাতটা ছাড়িয়া দিয়া বলে, হ্যাঁঃ, মাথা খুঁড়ি, না আরও কিছু, মিছিমিছি বলছিলাম, বয়ে গেছে আমার পরের জন্যে মাথা খুঁড়তে! পুজোর জোগাড় করিবার সময় আর এক রূপ, রাধারানি তখন মহা তাত্ত্বিক একজন।— চন্দন ঘষিতে ঘষিতে কিংবা স্তরে স্তরে বিল্বপত্র গুছাইতে গুছাইতে প্রশ্ন করে, তা হলে গিয়ে কালী কার মেয়ে হলেন, বাবা? 

শ্বশুর হাসিয়া উত্তর দেন, উনি আবার কার মেয়ে হতে যাবেন, মা? বিশ্বপ্রসবিনী, উনিই তো সবার মা। 

তবুও তো কেউ-না-কেউ বাপ-মা ছিলই। শিবঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে দিলে কে? কালী তো আর ফিরিঙ্গি নন, বাবা; তাদের শুনেছি নাকি… 

পাগলি মেয়ে! শ্বশুর বাধা দিয়া বলেন, ওদের কি আবার বিয়ে দেওয়ার জন্যে বাপ—মায়ের দরকার হয় মা? প্রকৃতি আর পুরুষ—অনাদি কাল থেকেই ওদের লীলা… 

আমিও তাই বলি। বাপ-মা থাকলে একটু ব্যবস্থা হতই। দেখ না, গায়ে. একখানি গয়নার পর্যন্ত বালাই নেই;–আহা!…আর রাধারমণের দেখ না বাবা, বাবা হলেন বাসুদেব, না হয় ধরো নন্দই হল, তিনিও তো হাঘরে ছিলেন না? কেমন গয়নাগাঁটি, মোহনচূড়ো, রেশমের কাপড়ে জমজম করছেন ঠাকুর! আর এদিকে দেখ না, কপালগুণে বরটিও তেমন জুটেছেন…আহা! 

হয়তো প্রতিমার দিকে চোখ তুলিয়া চায়! শূন্যদৃষ্টি উদাসিনী প্রতিমার দিকে চাহিয়া চাহিয়া কেমন যেন একটা মায়ায় মনটি সিক্ত হইয়া আসে। ক্রমে অন্যমনস্কতায় হাতটি শিথিল হইয়া আসে—আহা, বড় যেন রূঢ় কথা বলা হইয়াছে; ওর বাপ মা থাক না-থাক, উনি তো সবার মা!—ঠিক হয় নাই বলাটা –হঠাৎ মনে পড়িয়া যায় –বিয়ের কয়েকদিন আগে কী-একটা কড়া কথায় তাহার নিজের মায়ের চোখ দুইটি এই রকমই করুণ হইয়া উঠিয়াছিল–হারুদের মার মুখখানি চোখের সামনে ভাসিয়া উঠে—স্বামী বিছানায় পড়িয়া, একা মেয়েমানুষ বাড়ি বাড়ি পাট সারিয়া দুপুরে ফিরিতেই ছেলে-মেয়েতে সাতটি যখন ঘিরিয়া ফেলিত…আবার ছোট মেয়েটির নিত্য রাঙা কাপড়ের ফরমাশ নিজে এদিকে চিরকুট-পরা সাত জায়গায় তালি..কোলে তুলিয়া লইয়া চুমা খাইতে খাইতে বলিত,—হ্যাঁ, দোব বইকি, দোব না?—এই রকম ঠিক মুখের ভাবটি হইতো! রাধারানির মাতৃবিরহিত মনের সামনে এই রকম কত মার ছবি ফুটিয়া উঠে—যত জায়গায় যত মা দেখিয়াছে, সবার—ওই রকম সব চোখ, বেদনাতুর দৃষ্টি সব ছড়াইয়া যেন কোথায় গিয়া পড়িয়াছে; কেমন যেন একটা অতৃপ্ত ভাব—মা-মা মাখানো। 

ঠাকুরে মানুষে মিশিয়া একাকার হইয়া যায়—হঠাৎ মায়ের জন্য বড় মন কেমন করিয়া উঠে, আর তেমনি আকস্মিকভাবেই প্রতিমার উপর মন করুণায় ভরিয়া উঠে—কোথায় তোমার ব্যথা, মা? তুমি এমন সর্বহারা কেন হতে গেলে?–—

শ্বশুর আড়চোখে দেখেন—বধূ হাঁটুর উপর চোখ ঘষিয়া অশ্রু মুছিতেছে। টোকেন না। স্বামীর কাছে রাধারানি অন্তরের বেদনাটা না জানাইয়া থাকিতে পারে না। বলে, আহা, আমার এত কষ্ট হচ্ছিল দেখে আজ, কে জানে কেন! ঠাকুরেরা হোন ঠাকুর,—কিন্তু এ তো মানুষের মতন!… 

কালীপদ এক কথায় সব উলটাইয়া দেয়, দ্যাখো তো বোকামি মেয়ের? কালীঠাকুর কিনা ভালোমানুষ। অমন ভয়ংকর ঠাকুর নাকি আছে?—পার তুমি স্বামীর বুকে পা দিতে?—ডাকাত যে ডাকাত, তাকেও কালীপুজো করতে হয়… 

 রাধারানি একটু অন্যমনস্ক হইয়া যায়। বলে, তা জানি মশাই; আমায় আর বলতে হবে না।

ছেলেবেলার একটি দৃশ্য মনে পড়িয়া যায়। সে সাজিত কালী, গোবরা সাজিত ডাকাত, নন্তেদের পাকা ফলে রাঙা ‘মোহনভোগ’ আমগাছটা হইতো রাজবাড়ি… 

কতকটা এই সব স্মৃতিতে, কতকটা স্বামীর কালী-গুণকীর্তনে মনের সেই দুর্বল করুণ ভাবটি কাটিয়া যায়। আবার পূর্ণ উৎসাহে গাছে উঠা, জলে ঝাঁপাইঝোড়া, বাগান কাঁপাইয়া হাসি, ছুটাছুটি, দাপাদাপি চলে; স্বামীর বুকে পা উঠে না বটে, তবে ফরমাশে, ধমকানিতে, টানা-হিঁচড়ানিতে সে বেচারিকে যে নির্যাতনটা সহ্য করিতে হয়, তাহার তুলনায় শিবঠাকুরকে ভাগ্যবানই বলা চলে। কালীপদ বড় দুঃখে এক-একদিন বলিয়া ফেলে, তুমি ভাই কালীঠাকুরের বাবা! স্বামী বলে আমায় একটুও মান্য করো না। 

মাঝের পাড়ায় নবনারীতলায় যাত্রা ছিল; ‘সুভদ্রা-হরণ’ পালা; বিকালবেলা শেষ হইল। পিসিমা যে রকম গুছাইয়া-সুছাইয়া নবনারীর মন্দিরে মালায় বসিলেন, শীঘ্র উঠিবার সম্ভাবনা নাই। কালীপদ সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার জন্য থাকিয়া গেল। অর্জুন-সুভদ্রার কেমন একজোটে কাজ! রাধারানির মনে অব্যক্ত কী একটা হইতেছিল, বলিল, তুমি তার চেয়ে চলো না কেন?—ঝি থাক। 

কালীপদর মনে অর্জুনের বীরত্বের আঁচ তখনও লাগিয়া আছে, বলিল, তা কি হয়? একজন বেটাছেলে থাকা ভালো। 

রাধারানি নিচের ঠোটটা একবার উলটাইল-বিদ্রূপে; তাহার পর ঝিয়ের হাত ধরিয়া বাড়িমুখো হইল। 

পথে কথায় কথায় বলিল, সুভদ্রাঠাকরুণ কেমন কড়া হাতে রাশ বাগিয়ে ধরল, ঝি! 

ঝি বলিল, সব মেয়েমানুষেই পারে। তাহার পর রাধারানির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বলিতেছিল, আহা, দিদিঠাকরুন যেন কিছু জানেন না,—কেন মেয়ে-মানুষের ঘোড়া হল সোয়ামি, রাশ মানে হল —

এমন সময় তাদের ঠিক সামনে একটা মাটির ঢেলা পড়িয়া চুর হইয়া গেল এবং তাহার সঙ্গে বাঁধা একটা কাগজের টুকরা ছিটকাইয়া রাস্তার ধারে পড়িল। ঝি ‘ও মাগো!’ বলিয়া গুটাইয়া-সুটাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। 

রাধারানি একবার চারিদিকে দেখিয়া লইল—কেহ কোথাও নাই। একটু আগাইয়া গিয়া কাগজটা তুলিয়া লইল। নিজে পড়িতে জানে না; ঝি পড়িয়া দিল—তাহার পরিবারে সব যাত্রার গান বাঁধে; লেখা আছে—মার মহাপূজায় রক্ত তর্পণ। শনিবার, তিথি শ্রাবণ—অমাবস্যা। ভৈরব। 

দুইজনে মুখ-চাওয়াচাওয়ি করিল। ‘সুভদ্রা-হরণ’ দেখিয়া যে অনুপ্রেরণা জাগিয়াছিল তাহা আর বেশিক্ষণ রহিল না, বিশেষ করিয়া ঝির; জোরে হাঁটিতে হাঁটিতে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল। বিষ্ণু ভট্টাচার্য মন্দিরে ছিলেন, চিঠিটা তাঁহার হাতে পৌঁছিল। 

কথাটা রাষ্ট্র হইতে দেরি হইল না। তিন জায়গায় এই রকম চিঠি পড়িয়াছে পাড়ার ঠিক তিনটি কোণে,—ওদিকে অধর চৌধুরির বাড়ি, গ্রামের অপর প্রান্তে সনাতন চক্রবর্তীর বাড়ি, আর মাঝখানে এই বিষ্ণু ভট্টাচার্যের বাড়ি। ভৈরব-ডাকাতের প্রথাটাই এই; লোকে এই জন্য বলে—ভৈরবু সর্দারের মহাজাল পড়েছে। 

কিন্তু এ তো সকলেরই জানা কথা মার আদেশ না পাইলে ভৈরব বাহির হয় না, তবে এ গ্রামে মার পূজায় কি ত্রুটি হইয়াছে? 

.

বিষ্ণু ভট্টাচার্য সমস্ত রাত মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ধরনা দিয়া পড়িয়া ছিলেন, সকালে রুদ্ধ দ্বারের উপর করাঘাত পড়িল। দ্বার উন্মুক্ত করিয়া তিনি চৌকাঠের উপর দাঁড়াইলেন। সামনে দালান ভরিয়া একদল লোক। মুখপাত্র হিসাবে বৃদ্ধ নিবারণ ঘোষাল আগাইয়া আসিয়া বলিলেন, বিষ্ণু, ধরনা দিয়ে কার কাছে সাড়া পাবে?—মাকে কি রেখেছ? বলি—হীন শক্তি-পুজো—এ অনাচার গ্রামে সইবে না, হয় আজই ন’টি বলিদানের ব্যবস্থা করো, না-হয় মাকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে এস—একের পাপে সারা গ্রাম যে যায়! 

বিষ্ণু ভট্টাচার্য বলিলেন, আমার কী অসাধ কাকা? তবে–—

চারিদিকে রব উঠিল, তবে-টবে নয়, পাঁঠার সব ঠিকঠাক, আমরা নিয়ে আসছি, আজ রক্তের স্রোতে গ্রামের পাপ ভাসিয়ে তবে কথা… 

দলটা আস্তে আস্তে কিছুক্ষণের জন্য একটু পাতলা হইল, তাহার পর ক্রমেই আবার জমাট বাঁধিয়া উঠিতে লাগিল,— লোকের হাঁকডাকে, ‘মা-মা’ শব্দের সঙ্গে একপাল শিশুছাগের ত্রস্ত চিৎকার মিলিয়া জায়গাটাকে সরগরম করিয়া তুলিল। ক্রমে পূজা শুরু হইল, হাঁড়িকাঠ পোঁতা হইল, একটি ছাগশিশুকে স্নান করাইয়া মন্দিরে উঠানোও হইল। মন্দির হইতে গলা বাড়াইয়া একজন প্রশ্ন করিল, বাজনদারেরা তোয়ের আছে? নিক, ঢাকে ঘা দিক এবার–—

কাঁসর, ঘণ্টা আর ঢাকে ঘা পড়িল। 

এমন সময় সিংহাসনসুদ্ধ জগন্নাথকে বুকের কাছে লইয়া, নামাবলি গায়ে একজন গৌরকান্তি বিধবা খুব সহজভাবে ভিড় ঠেলিয়া আসিয়া বারান্দায় উঠিলেন, এবং একটু জলছিটা দিয়া সিংহাসনটি রাখিয়া গম্ভীরভাবে তাহার সম্মুখে জপে বসিয়া গেলেন। 

বাজনার আওয়াজ সঙ্গে সঙ্গে থামিয়া গেল। তাহার অল্পক্ষণের মধ্যেই মানুষের ভিড়ও গেল, পাঁঠার কাতরানিও গেল; মন্দিরের মধ্যে শুধু বিষ্ণু ভট্টাচার্যের পূজার মন্ত্রগুলা শোনা যাইতে লাগিল—খুব সংযত স্বর। 

.

সন্ধ্যার সময় রাধারানি যখন আরতির জোগাড় করিতে আসিল দেখিল মন্দির ভিতর হইতে অর্গলবদ্ধ। দরজায় ঘা দিল, ডাকাডাকি করিল; যখন কিছুতেই দুয়ার খুলিল না, নিতান্ত মনমরা হইয়া চুপিচুপি বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল। ঝি, রাঁধুনি আহারের জন্য ডাকিতে আসিয়া ঝাঁঝ দেখিয়া মানে মানে সরিয়া পড়িল। কালীপদ অনেক সাধাসাধি করিল, সে নিজেও খাইবে না বলিয়া ভয় দেখাইল, কোনও ফল না হওয়ায় ধীরে ধীরে উঠিয়া আহার করিয়া আসিয়া পাশটিতে শুইয়া পড়িল। 

ঘুম আসিতে কালীপদর বোধ হয় রাত হইয়া থাকিবে, সকালবেলা দিব্য ফোঁস ফোঁস করিয়া নিদ্রা দিতেছে। ওঠ, ওঠ, শিগির ওঠ গো—বলিয়া তীব্র ঝাঁকানি দিয়া রাধারানি তাহাকে ঠেলিয়া তুলিল। চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে কাত হইয়া কালীপদ প্রশ্ন করিল, কেন? 

রাধারানি ভীতকণ্ঠে বলিল, ডাকাত পড়েছে যে! তাহার পর কালীপদ ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিতেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। 

কালীপদ রাগিয়া বলিল, বাব্বা কী মেয়ে যে!—এখনও বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে।

রাধারানি হাসিতে দুলিয়া দুলিয়া বলিল, যেমন ভীতু—

কালীপদ রাগতভাবেই বলিল, ভারী বীরপুরুষ আমার! ডাকাতদের ঠেকিও তারা হাজির হলে।

রাধারানি তাচ্ছিল্যের সহিত ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া বলিল, পারি না নাকি?—আহা বড্ড শক্ত! ওরা মেয়েদের কিছু বলে না মশাই, তাতে কালো মেয়ে, তাতে আবার স্বপ্ন দেখেছি, মা-কালী এসে নিজের গায়ের রং আমায় খানিকটা মাখিয়ে দিয়ে গেলেন। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? হাতটা কালীপদর মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, এই দ্যাখো, যায়নি হয়ে আর এক পৌঁছ কালো? 

তাহার পর স্বামীর গায়ে একটু ঢলিয়া কৃত্রিম করুণার স্বরে বলিল, আহা-হা-হা, একজনের কনে আরও কালো হয়ে গেল গো! আহা-হা-হা, মরে যাই, মরে যাই! 

কালীপদ বলিল, হল তো বয়েই গেল! মা-কালী রঙের পৌঁছ দিয়ে কী বললেন? বললেন বুঝি— ডাকিনী-যোগিনী হয়ে আমার সঙ্গে … 

রাধারানির মুখ হঠাৎ কৌতুকচ্ছটায় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল; বলিল, ঠিক কথা গো, স্বপ্নে আর একটা বড় মজা হয়েছে—বড্ড মজা; কিন্তু যা ভীতু তুমি, বলাই বৃথা, শুনলেই ভিমি যাবে। আমার যেন মনে হল, মা-কালী এসে বাবাকে মেঝে থেকে তুলে বললেন,–’ওঠ, আমি বাড়ি জুড়ে রয়েছি ভয় কি?’ তারপর হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে–চলো, ফুল তুলতে তুলতে সব বলছি, চলো না কালীঠাকুর আবার এত নকলও জানেন! কী, আমি নিজেই ঘুমুতে পারিনি, শুয়ে শুয়ে এই সব তন্দ্রায় দেখেছি কে জানে?—বাবার জন্যে মনটা যা ছটফট করছিল…চলো, ওঠ, সব বলছি। 

অনেকক্ষণ ধরিয়া পুকুরধারের ধনুকপানা নারিকেল গাছটার গোড়ায় বসিয়া গল্প চলিল,—শুধু গল্পই নয়, কত সব জল্পনা-কল্পনা, মান-অভিমান, জেদাজেদি, এমন কি ছাড়াছাড়ি পর্যন্ত। শেষ নাগাদ কিন্তু আবার সব ঠিক হইয়া গেল; সাজিভরা ফুল বিশ্বপত্র লইয়া গলাগলি দুইজনে বাড়িমুখো হইল। মন্দিরের সিঁড়ির কাছে আসিয়া কালীপদ বলিল, আমি তা হলে এক্ষুনি আসছি; ভয় করলে… 

তাচ্ছিল্যের সহিত ইস!’ করিয়া রাধারানি মন্দিরে উঠিয়া গেল। 

অমাবস্যা তিথি; সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে? বিষ্ণু ভট্টাচার্য মন্দির হইতে বাহির হইলেন। কী ভাবিলেন তিনিই জানেন—ধীরে ধীরে বাড়িতে গিয়া সমস্ত ঘর সমস্ত দেরাজ—সিন্দুকের তালাচাবি খুলিয়া আবার শান্তভাবে নামিয়া আসিয়া চাবির তাড়াটা প্রতিমার পদমূলে রেখে দিলেন। 

বাবা!—বলিয়া রাধারানি বিমূঢ়ভাবে প্রশ্ন করিতে যাইতেছিল, হাত তুলিয়া বারণ করিলেন। তাহার পর কী ভাবিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া নিজেই বলিলেন, আজ যে মা আসছে, মা! আবার পূজায় বসিলেন। 

রাত্রি যখন প্রায় দুই প্রহর অতীত হইয়াছে, হঠাৎ চক্রবর্তীদের পাড়ায় প্রচণ্ড এক শব্দ উঠিল—রে-রে-রে-রে-রে—

কালীপদ আর রাধারানি পূজার কাছে বসে ছিল; কালীপদ একটু কাঁপা গলায় ডাকিল, বাবা!

উত্তর পাওয়া গেল না। বিষ্ণু ভট্টাচার্য অনেকক্ষণ হইতেই প্রণাম করিতেছিলেন, বুঝা গেল সংজ্ঞা নাই। কালীপদ রাধারানির মুখের পানে চাহিল। 

রাধারানি বলিল, তোমার ভয় করছে নাকি?—বাবার মুখে শুনলে তো? ভয় করলে আমাদের বাড়িতে মা-কালী আর আসবেন কোথা থেকে?—বলিয়া বেশ সহজভাবেই হাসিয়া উঠিল। 

ক্রমে কোলাহল আরও ভীষণ হইয়া উঠিল। ও-পাড়ার গাছপালার মধ্যে পুঞ্জীভূত অন্ধকার মশালের আলোয় খণ্ডিত হইয়া গিয়া বিকশিত দ্রংষ্ট্রা দৈত্যের মতো বিকট হইয়া উঠিল। 

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পরে দলটা এ-মুখো হইল। ভৈরব সর্দার আগে আগে, পিছনে ধ্বংসোন্মত্ত প্রায় শতাবধি লোকের একটা দল, বাগানে প্রবেশ করিয়া সবাই সমস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিল। ভৈরব বলিল, আস্তে রে, এটা মায়ের বাড়ি। 

একজন রুক্ষস্বরে উত্তর করিল, উপোসি মায়ের পুজো দিতে এসেছি, জানিয়ে আসব না?—এই কথার উপর আর একটা উগ্রতর নিনাদ উঠিল। 

দলটা আসিয়া মন্দিরের প্রাঙ্গণে দাঁড়াইল। মন্দির অভ্যন্তরস্থ দীপের স্তিমিত আলোকে দেখা গেল, রক্তচেলি-পরা একটি গৌরকান্তি পুরুষ প্রতিমার সামনে ভূলুণ্ঠিত হইয়া পড়িয়া আছে, অত শব্দের মধ্যেও নিশ্চল। সবাই ঠেলিয়া মন্দিরে উঠিতেছিল, ভৈরব পিছনের চাপে দুই পা অগ্রসর হইল, তাহার পর জমিতে শক্তভাবে পা পুঁতিয়া, দক্ষিণ হাতটা উঠাইয়া বলিল, না, উঠতে দে; অসাড়ের রক্ত মা খায় না; জাগুক, ততক্ষণ ওদিকটা সেরে আসবি চল সব, কিছুর যেন চিহ্ন না থাকে… 

দলের নির্দিষ্ট একটা অংশ বাড়িটা ঘিরিয়া ফেলিল। গগন বিদীর্ণ করিয়া ‘রে-রে’ শব্দ, গ্রামের চতুঃসীমা হইতে তাহার প্রতিধ্বনি উঠিতেছে। সে যুগে ডাকাতরা প্রথমে সমস্ত গ্রামটা ঘিরিয়া ফেলিত। 

মন্দিরের পিছনে, কাঠাকয়েক জমির পরেই বাড়িটা। মশালের ধূমমলিন আলোয় দূর থেকেই দেখা গেল, কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নাই; পুরীর মুক্তদ্বার গৃহগুলার বাহিরে আলো পড়িয়া ভিতরকার অন্ধকারকে স্পষ্ট আর বীভৎস করিয়া তুলিল। 

এ-ধরনের বিরোধহীন অবরোধ ভৈরব সর্দার অভ্যস্ত ছিল না। ডাকাতি করিতে আসিয়া যদি উভয় পক্ষেই দু-চারটা মাথা না পড়ে তো তরোয়ালে আর সিঁধকাটিতে ব্যবধান থাকে কোথায়? পা তুলিয়া তাহার পা দুইটা যেন ভারালস বলিয়া বোধ হইল। নিশ্চল হইয়া একটু দাঁড়াইল, তাহার পর হঠাৎ জোর করিয়া আগাইয়া জোর করিয়াই রাগিয়া বলিল, আয় এগিয়ে, তোরা সব থমকে দাঁড়াস যে! 

অনায়াস লুণ্ঠন। বাড়িটা যেন মুক্তাঞ্জলিতে সমস্ত ধনসম্ভার লইয়া অপেক্ষাই করিতেছিল, শুধু লওয়ার দেরি। ভৈরব সর্দারের একটা অহেতুক অস্বস্তি বোধ হইতেছিল। সে কী ভাবিল বলা যায় না, শুধু একটিমাত্র মশাল আর মাত্র জন পাঁচেক লোক সঙ্গে রাখিয়া বাকি সমস্তই বাহির করিয়া দিল। বোধহয় ভাবিল, অন্ধকার বাড়িতে খুঁজিয়া-পাতিয়া আঘাত খাইয়া লুণ্ঠন করিলে তবুও বিরোধের একটু আস্বাদ পাওয়া যাইবে, তবুও ডাকাতির মর্যাদাটা কতকটা বজায় থাকিবে। মানুষের নিকট নিরাশ হইয়া সে যেন অন্ধকার বাড়িটাকে সজীব করিয়া তাহাকেই যুদ্ধে আহ্বান করিল। 

সবচেয়ে ক্ষীণশিখা মশালটা লইল, নিজের হাতেই লইল। তাহার পর সেই অল্পসংখ্যক সঙ্গী লইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। এ-ঘর ও-ঘরের ভিতর দিয়া, ডালাখোলা বাক্স উজাড় করিয়া বারান্দা দিয়া চলিয়া আসিতে একটা একটু প্রশস্ত জায়গা; তাহার পর সরু এক ফালি গলি, ধূমে আর ছয়টা লোকের বিকট ছায়ায় যেন ভরাট হইয়া গেল। কোনওখানে একটু শব্দ নাই, আর্তনাদ নাই; নিস্তব্ধতার মধ্যেও যে স্তম্ভিত প্রাণের একটা পরিচয় সে পাইয়া আসিয়াছে এই প্রাণহীন পুরীতে, সেটার অভাব তাহাকে পীড়িত করিতে লাগিল। এই অস্বাভাবিক অবস্থায় সর্দারের কেবলই মনে হইতে লাগিল, আজ মায়ের শ্মশানকালীর পায়ে জবাফুল দাঁড়ায় নাই, মা পূজা লন নাই।—মনকে শান্ত করিবার জন্য মনে মনে বলিল, মা, তোমার পুজো আজ এইখানেই; তপ্ত-রক্তে পুজো চাই, তাই জবায় তুষ্ট হওনি। তুমি আজ শ্মশান ছেড়ে এস, ভক্ত তোমার জন্যে আজ এইখানেই শ্মশান সৃষ্টি করে দেবে। 

ভৈরব কোমরে জড়ানো রক্তাম্বরের মধ্য হইতে একটা বোতল বাহির করিয়া তাহার মধ্যের তরল পদার্থ ঢকঢক করিয়া গলায় খানিকটা ঢালিয়া দিল,—কারণ-বারি। পরে চিত্তের দুর্বলতা জয় করিবার জন্যই হোক, বা যে জন্যই হোক, মশাল তুলিয়া একবার ‘জয় মা!’ করিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল—পাঁচজনে যোগ দিল, উন্নত মশালের আলোয় ছায়াগুলা যেন হঠাৎ উচ্চকিত হইয়া উঠিল। 

প্রশস্ত একটা প্রাঙ্গণে আসিয়া পড়িল। ওদিক দিয়া উপরের সিঁড়ি। সিঁড়ি দেখিয়া তাহার মনটা আবার নাচিয়া উঠিল,—সিঁড়ি বাহিয়া উঠিবে না, লাঠিতে ভর দিয়া একেবারে এক লাফে আলিসার উপর,—মশালের শিখা রক্তমাখা জিভের মতো উঠিতেছে লকলকাইয়া— তবুও একটা যা-হোক কিছু হয় তাহাতে। 

ভৈরবের কারণ-মথিত রক্ত শিরায় শিরায় চনচন করিয়া উঠিল, ‘তুলে ধর্’—বলিয়া মশালটা পিছনে একজন সঙ্গীর হাতে দিয়া, একটা হুঙ্কারের সঙ্গে মাথার উপরে ঘুরাইয়া লাঠিটা পাতিতে যাইবে, হঠাৎ সিঁড়ির অন্ধকারে গলির দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া, নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ বিস্ময়ে যেন স্থাণুবৎ হইয়া গেল; তাহার পর লাঠি ফেলিয়া মশাল লইয়া ধীরে ধীরে গলির দিকে অগ্রসর হইল; দুই-একজন সঙ্গে আসিতেছিল, ভৈরব ফিরিয়া দাঁড়াইল। চক্ষু দুইটা আগুনের ভাটার মতো জ্বলিতেছে, চাপা গলায় প্রশ্ন করিল, দেখেছিস? 

দুই-একজন শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাহার চোখের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহারা দেখিয়াছে; দুই-একজন কিছুই বুঝিতে না পারিয়া মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। ভৈরব তাহাদের সবাইকেই ইঙ্গিতে অপেক্ষা করিতে বলিল। ভয়ে, বিস্ময়ে, আশায় তাহার চক্ষু দুইটা যেন ঠেলিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে। অগ্রসর হইল। 

ঠিক যেখান হইতে সিঁড়িটা উঠিয়া গিয়াছে, তাহার পাশে ঈষত্তরলিত অন্ধকারে ছায়াকল্প এক মূর্তির আভাস, মশালের চঞ্চল আলো পড়িতেই পিছনে যেন একটু সংকুচিত হয়ে গেল। কারণ মাথার শিরা-উপশিরায় আগুন ধরাইতেছিল, ভৈরব তখনই নিজের ভুলটা বুঝিতে পারিল—মা আসিয়াছে বটে, শ্মশানবাসিনী ভক্তের আহ্বান শুনিয়াছে; কিন্তু সে যে আঁধারময়ী, স্পষ্ট আলোকের বস্তু তো নয়; আলোক-সম্পাতে লুপ্ত অন্ধকারের সঙ্গে এখনই, এই পরমুহূর্তেই এ কোথায় বিলীন হইয়া যাইবে আর জন্ম-জন্মান্তরের সাধনায়ও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না! এক মুহূর্তেই ভুলটা হইয়া যাইত; কিন্তু ভৈরব সমস্ত চেতনা একত্র করিয়া হাতের মশালটা ক্ষিপ্রগতিতে দূরে ফেলিয়া দিল। বাঁকা গলির ভিতর দিয়া সেই নির্বাণপ্রায় মশালের সামান্য একটু আলো কুণ্ঠিতভাবে প্রবেশ করিল মাত্র। ভৈরব একবার গাঢ় স্বরে ডাকিল, মা! তাহার পর সেই ঘনায়মান অন্ধকার ভেদ করিয়া প্রাণপণ শক্তিতে নিজের উৎসুক দৃষ্টিরেখাকে সম্মুখে চালিত করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। 

ক্রমে তাহার মনে হইল—সেই অতি ক্ষীণভাবে প্রদীপ্ত অন্ধকার স্থানে স্থানে জমাট বাঁধিয়া উঠিল—প্রথম ভূমিতলে এক শয়ান মূর্তি, মাথার দিকটা একটু স্পষ্ট, বাকিটা অল্পে অল্পে গাঢ়তর অন্ধকারে মিশিয়া গিয়াছে। মাথায় জটাজুট—বিসর্পিত, বিক্ষিপ্ত; পাশেই তাহার উপর চরণ তুলিয়া এক দীর্ঘ, অপূর্ব নারীমূর্তি!—সারা দেহ ঘিরিয়া আলুলায়িত চূর্ণ কেশভার; বাম করে খড়্গা, দক্ষিণ কর বরাভয়ে তোলা—ত্রস্ত বিশ্বের উপর মায়ের স্বস্তি যেন করিয়া পড়িতেছে।—ভৈরব চক্ষু মুদিল, আর চাহিয়া থাকিতে সাহস হয় না,—সেই মূর্তি ক্রমেই স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে, ভয় হয়, বুভুক্ষু দৃষ্টির সামনে বুঝিবা বিলীন হইয়া যাইবে; অমানিশার অন্ধকার মূর্তিতে জমাট হইয়া উঠিয়া আবার ওই তমোসমুদ্রে মিশিয়া একাকার হইয়া যাইবে। 

তখনও রাত্রি আছে; অতি সামান্য একটু আলোর আভাস পূর্বাকাশে দেখা গিয়াছে। শঙ্কাদুর্বল গ্রামটা নিস্তব্ধ। রাধারানি উপরে পিশাশুড়ির ঘরে গিয়া ডাকিল, পিসিমা, শিগগির ওঠ। 

বিগ্রহের বেদিতল হইতে ধীরে ধীরে উঠিয়া পিসিমা বিহ্বলভাবে চাহিলেন। রাধারানি বলিল, আর দেরি করো না, শিগগির চলো, ওর কী হয়েছে, কথা কইছে না। 

পিসিমা আচ্ছন্নভাবে প্রশ্ন করিলেন, কার?—কোথায়? 

রাধারানি কোনও উত্তর দিল না এবং আর ক্ষণমাত্রও অপেক্ষা না করিয়া তাঁহাকে জোর করিয়াই তুলিল এবং বাম হস্তে প্রদীপটা লইয়া তাঁহাকে একরকম টানিয়াই লইয়া চলিল। 

সিঁড়ি দিয়া ক্ষিপ্রগতিতে নামিল, তাহার পর সিঁড়ির পাশে মাটির দিকে নির্দেশ করিয়া বলিল, ওই দ্যাখো, কী হয়েছে, নড়েও না, কথাও কইছে না, আমি কিছু বুঝতে পারছি না বাপু! 

পিসিমার ঘুমের ঘোর কাটিয়া গেল, একেবারে শিহরিয়া উঠিয়া বলিলেন, এ যে কালীপদ আমাদের। মাথায় যাত্রার শিবের জটা কেন? টিনের সাপ, ছাপা বাঘছাল? কী এসব ব্যাপার বউমা?—জল দাও, জল দাও শিগগির, অজ্ঞান হয়ে গেছে যে গো? —আর এসব গয়নাপত্র, টাকাকড়ির রাশ! ব্যাপারখানা কী?—কালীপদ এখানে এল কী করে?… 

জল নিকটেই ছিল, রাধারানি তাঁহার হাতে ঢালিয়া দিতে দিতে বলিল, শোনা কথা পিসিমার! কী করে এল তা কি আমি জানি? দেখলাম গোঁ-গোঁ করছে, কথা কয় না, কিছু না, ভালোমানুষি করে তোমায় ডেকে আনতে গেলাম—ভয়ে কি আমারই জ্ঞানগম্যি আছে… কী করে এল!’ আমি যদি সঙ্গে থাকতাম তবে তো বুঝতাম গা—কী করে এল… 

একটু থামিয়া, কী ভাবিয়া গলায় অভিমানের সুর আনিয়া বলিল, তোমার যেমন সন্দেহ দেখছি পিসিমা, জ্ঞান হয়েও যদি বলে—আমিও এর মধ্যে ছিলাম, তুমি নিশ্চয় চট করে বিশ্বাস করে নেবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *