কালাকেষ্টার জীবন বেত্তান্ত

কালাকেষ্টার জীবন বেত্তান্ত

ঘোড়াটা হেলেদুলে হাঁটছে। তার পিঠে ছালার গদির ওপর একদিকেই দুপা ঝুলিয়ে বসেছে কালাকেষ্টা। বসে আরামসে বিড়ি টানছে। আজ ম্যালা খাটনি গেছে। বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। গেছে পাঁচ মাইল দূরে, দিঘলীর হাটে। এখন ধান মৌসুম। পৌষের মাঝামাঝি সময়। হাটে হাটে খেপ দিয়ে বেড়ায় কালাকেষ্টা। ঘোড়ার পিঠে মহাজনের ধান সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি টেনে তবে খালাস। আজ টেনেছে জলিল ভেণ্ডারের ধান। দিঘলীর খালে কাল রাতে গিয়ে লেগেছে ভেণ্ডারের নাও দুখান। আজ বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে সোজা দিঘলীর গেছে কালাকেষ্টা। কাল সন্ধ্যায় ভেণ্ডারের ভাইগ্না দুলাল মিয়ার সঙ্গে দেখা। বলল, কেষ্টা, মামায় কইছে কাইল সারাদিন দিঘলীর আডে থাকতে। নাও থিকা ধান টাইন্না দিবি।

কেষ্টা তো রাজিই। এটা হচ্ছে গিয়ে কাজের সময়। এখন কাজ কাম না করলে সারা বচ্ছর খাইব কী কেষ্টা! ঘোড়ারে খাওয়াইব কী!

দুলাল মিয়ার কাছ থেকে একটা বিড়ি চেয়ে খেয়েছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া গ্রামের মাতব্বর গোছের পোলা। বয়স অল্প। হলে হবে কী, লোকে বড় মান্যিগণ্যি করে তাকে। দুলালরে খেপাইলে রক্ষা নাই। জান কবজ কইরা ফালাইব। রাইতে গিয়া বসতভিটায় আগুন দিব। গরু কোরবানি দেওয়ার চকচকে লম্বা ছুরি হাতে গিয়া খাড়াইব একলাই।

সাহস বটে মানুষটার। পেট ভরা কলিজাখান। গেলবার নয়াকান্দার ওফা মোল্লার ডাগর ডোগর মাইয়াখান তুইল্লা নিয়া গেল রাইতে। পিরীতিটিরীতি আছিল না। তাতে কী। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছে। সারাদিন ঘুরঘুর করত মোল্লাবাড়ির চারদিকে। মাইয়াখান বড় সুন্দর মোল্লার। বড় সোন্দর শরীলটা, য্যান নতুন জোয়াইরা পানি, টলমল করে। চোখ দুইখান শাপলা ফুলের মতন। মুখখান নতুন বরজের পানপাতা। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছিল।

মোল্লা বাড়ির লগেই নিখিল সার বাড়ি। নিখিল সা হিন্দুস্তান চইলা গেছে রায়টের সময়। বাড়িখান এখন ছাড়া। দুলাল মিয়ারা দখল নিছে। একখান ভাংগাচুরা দালান আছে বাড়িটায়, আর দেদার গাছপালা। দুলালমিয়া সারাদিন বইসা থাকত হেই বাড়িতে। মোল্লার মাইয়া ঘাটে আইলে আওয়াজ দিত। সতী মাইয়া। ভয়ে ভয়ে বাপের কাছে কইয়া দিল। মোল্লা নালিশ জানাইল ভেণ্ডারের কাছে। আহা কী কামডা করল মোল্লায়। দুলাল মিয়ারে ঘাটাইল। বুঝল না, দুলাল মিয়ার চোখ পড়ছে। এই চোখ ফিরব না।

নালিশ শুইনা ভেণ্ডারে তো ভাইগ্নারে বকল। দুলাল মিয়ার গেল মাথায় রক্ত উইঠা। গরু কোরবানি দেওনের ছুরি লইয়া রাইতে গিয়া খাড়াইল মোল্লার ঘরের সামনে। একলা মাইয়াডারে তুইল্লা আনল। এখন সেই মাইয়া দুলাল মিয়ার ঘর করে।

বিড়ি টানতে টানতে কেষ্টা গতকাল সাহস করে দুলাল মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিবির খবর কী মিয়া? ভালো নি?

দুলাল মিয়া বলল, পোলা অইব।

অ্যাঁ!

হ। সাত মাস চলছে।

শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসেছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া টানতে টানতে এক হাতে বাবুর হাটের লুঙ্গি বাঁ হাটুর ওপর তুলে কালির খিলের বিশাল মাঠ ভেঙে মিলিয়ে গিয়েছিল।

কেষ্টার তখন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। বয়স হইল দুই কুড়ির ওপর। এখনও ঘর হইল না কেষ্টার, সংসার হইল না। হইব হইব কইরা ভাইংগা গেল।

তারপর বৈচির কথা মনে পড়েছে কেষ্টার। কানা বেলদারের মাইয়া। বেলদার পাড়ার। সর্দার আছিল কানা। বাঁও চক্ষুটা নাই কানার। পদ্মার চর দখল লইতে গিয়া খোয়াইছিল। ডাকাইত একখান। বুড়া বয়সেও তাগদ কী শইল্লে! মাথায় গোল টুপি। লাগাইয়া কানা এখন হাটেবাজারে যায়। কেষ্টার লগে দেখাসাক্ষাৎ হয়। মানুষটারে দেখলে শইলটা কাপে কেষ্টার। বুকের মইধ্যে বাজাইরা খোদাই ষাড় গোঁত্তা দিয়া ওঠে। হইলে অইব কী, মাইনষেরে কিছু কইতে পারে না কেষ্টা। মনের রাগটা মনেই রাখে। জগৎসংসারে একলা মনুষ কেষ্টা। ভাইবেরাদর কেউ নেই। মাইনষের লগে শত্রুতা কইরা ফায়দা কী কেষ্টার! রাইতের আন্ধারে আইসা কেষ্টার কল্লা কাইট্টা থুইয়া গেলে দেখব কেডা! কেষ্টারে বাঁচাইব কেডা!

কানা বেলদার সর্দার মানুষ। ম্যালা জোতজমিনের মালিক। সাতখান আছে কেরাইয়া নাও। এক কুড়ির ওপরে ঘোড়া। খরালিকালে ঘোড়ার কারবার একচেটিয়া কানার। বাইষ্যাকালে কেরাইয়া নাওয়ের কারবার। নাইওর আনে, নাইওর নেয়। পয়সা, খালি পয়সা। কয় বচ্ছর আগে সাতঘইরার গাঙ্গে চর জাগল। কানা বেলদার লাইঠাল লইয়া হেই চরের দখল লইল। বেলদার পাড়াটা তারবাদে উইঠা গেল সাতঘইরার হেই চরে। বেলদাররা এখন কানার পোরজা। কানা হইল চরের মালিক। রাজা মানুষ।

পাড়ার বেবাক বেলদাররা ঐ কানার কথায় পুরানা পাড়া ছাইড়া সাতঘইরার চরে চইলা গেছে। যায় নাই কেবল কেষ্টা। কানা কইছিল, আইয়া পর কেষ্টা। কালীর খিলে বেলদাররা কেওই নাই, তুই একলা পইড়া থাকবি কেন? আয়, আমি তরে জমিন দিমু। বিয়া করাইয়া দিমু। বউবেটি লইয়া সুখে-শান্তিতে থাকবি।

কেষ্টা গেল না। বাপের ভিটা ছাইড়া যাইতে কষ্ট হয়।

ভিটা বলতে ভিটা। দশ কদম মতো জায়গা। একখান খাজুর আর কয়খান বিচ্চাকেলার গাছ। মধ্যিখানে একখান ছাপড়া ঘর। একখান ঘোড়া আর কেষ্টা। এই তো সংসার। হইলে হইব কী, কেষ্টা এসব ছাড়তে রাজি না। তাছাড়া কেষ্টার মনে ভেতর লুকিয়ে। আছে আর এক দুঃখ। কানা বেলদারের ওপর আছে বিশাল এক ক্রোধ। কেষ্টার সেই দুঃখটা বৈচি। কানা বেলদারের মাইয়া।

কানা বেলদারের নাম আছিল রহমত। রহমত বেলদার চর দখল লইতে যাইয়া সরকির পার খাইল চোক্ষে। চক্ষু একখান গেল। সেই থেকে নাম পড়ল কানা বেলদার। দিনে দিনে রহমতের নাম ভুইলা গেল মাইনষে। রহমত বেলদার হইল কানা বেলদার।

কেষ্টা ভোলে নাই। কেষ্টা কিচ্ছু ভোলে নাই। কেষ্টার মনে আছে সব। রহমত বেলদারের কথা, বৈচির কথা।

মনটা বড় নরম আছিল বৈচির। কথায় কথায় কানত। রহমত বেলদারের ঘরে অমুন। মাইয়া! চিনতা করণ যায় না।

ভাবলে কেষ্টার বড় অবাক লাগে। কানা বেলদারের মতন অমুন একখান জালেমের ঘরে বৈচির লাহান মুলাম, চরের নতুন মাটির লাহান মাইয়াখান হইল কেমনে! বৈচি কি হাচাই কানার মাইয়া আছিল না অন্য কেওইর?

কেষ্টা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মাথার মইধ্যে পদ্মার পানি ঢুইকা যায়। ঘোলা হইয়া যায় চিন্তাভাবনা।

মাওয়ার বাজারের কাছে আসতে সাঁঝ বইসা যায়। কেষ্টার খুব খিদে পেয়েছে। দুপুরবেলা দুমঠো চিড়া আর দিঘলীর খালের পানি খাইছে। পেটে থাকে কতক্ষণ। খিদের চোটে কেষ্টার এখন শীত করছে। পৌষের মাঝামাঝি সময়। শীতকাল। শীত তো করবই। কিন্তু কেষ্টার শীতগরম নাই। দিব্বি খালি গায়ে থাকতে পারে কেষ্টা। খরালিকালেও মোটা একখানা কোট গায়ে দিয়ে ঘুইরা বেড়ায়। পেট ভরা থাকলে শীত গরম নাই কেষ্টার। এখন শীতটা করছে খিদের ঠেলায়।

ঘোড়ার পাছায় সিটকির বাড়ি মারে কেষ্টা। আট বেডা হালা, পাও চালাইয়া আট। তাড়াতাড়ি বাইতে গেলে দুইজনেই খাওন।

ঘোড়াটা বুইড়া হইয়া গেছে। মায় মইরা যাওনের লগে লগে বাজানের আমলের ঘোড়া দুইখানও গেল। ঘোড়ার ব্যারাম অইছিল হেইবার। বেলদার পাড়ার বারো আনি ঘোড়া মরল ব্যারামে। কেষ্টার দুইখানও। কেষ্টা তহন পথের ফকির। ভাতপানি জোটে না। বাইষ্যাকাল। কেরাই নাও বাইব, পাইব কই? কেষ্টারে নাও দিব কেডা? ঘরের লগে, ছাইছের দিকে চাইর গণ্ডা জমিন আছিল। হেই জমিন বেচল ওফাজদ্দির কাছে। বাপের কাইল্লা জমিন কেষ্টার। হেই জমিনে ওফাজদ্দি অহন মুলা ক্ষেতি করে। বাগুন ক্ষেতি করে। গোপনে কেষ্টার সালুনের কামডা চইলা যায়।

ওফাজদ্দি যে টের পায় না তা নয়। কিছু যে কয় না তা নয়। হাসতে হাসতে কয়। কম কম খাইছ কেষ্টা। আমারেও দুই চাইর ওরা নিতে দিছ। এতডি দিয়া কিনলাম জাগাড়া। হাচাই। কম টেকা দেয় নাই ওফাজদ্দি।

বাইষ্যা কালডা পুরা বইসা খাইল কেষ্টা। আগন মাসে কিনল ঘোড়াখান। এখন দিন যায় ভালোয় ভালোয়। মৌসুমে নগদ পয়সা-কড়ি কিছু জমে। খরালিকালটা কাটে ভালো। ধানের মৌসুম শেষ হইলেও দুই একখান খেপ পাওয়া যায়। খরালিকালে ঘোড়াটার খাইখরচাও কম। ঘাসবিচালি লাগে না। যেদিন আজাইর থাকে ঘাসি জমিনে গোছর দিয়া রাখলেই হয়। তয় ঘোড়ার আসল খাওন হয় রাইতে। ছাইড়া দিলে দূরে বিলে চইলা যায়। রাইত ভর চইরা বিয়ানে ফিরা আসে। তারপর সারাদিন খাটাও কত খাটাইবা। বোজা বাওয়াও কত বাওয়াইবা।

তয় মইধ্যে কয়দিন ঝামেলা হইছে। মেদিনী মণ্ডলের পোলাপানরা রাইতে ঘোড়া ধরতে যাইত বিলে। একখান কায়দা কইরা ধরতে পারলেই হইছে। সারা রাইত ছয় সাতজনে মিল্লা হেই ঘোড়া দৌড়াইত। বিয়ানে ছাইড়া দিয়া বাইত যাইত। কেষ্টার ঘোড়াডারে ধরছিল একদিন। হায় হায়রে! পুরাডা দিন বোজা টানছে ঘোড়াডা। রাইতে ছাইড়া দিছিল কেষ্টা। হেইডারে রাইতভর দৌড়াইল। কয়জনে দৌড়াইছে কে জানে! বিয়ানে ঘোড়াডা মরো মরো। সারাটা দিন আর কামে গেল না কেষ্টা। ঘোড়াডারে সেবা করল। ঘোড়াডার লেইগা বড় কষ্ট পাইছিল কেষ্টা সেদিন। বৈচির কথা মনে পড়েছিল। সারাদিন আনচান করেছে বুকটা।

যে কোনও কারণে দুঃখ পাইলেই বৈচির কথা মনে পড়ে কেষ্টার। মানুষ আছিল একখান। বৈচি। মনখান চরের নতুন মাটির লাহান। ইট্টু কিছু অইলেই কানত। বড় মায়া করত কেষ্টারে। বড় মহব্বত করত। কেন যে তার জইন্যে এত টান আছিল মাইয়াডার, বুঝতে পারে না কেষ্টা। মাতায় বুদ্দিসুদ্দি ইট্টু কম কেষ্টার। মায় কইত, কেষ্টা আমার বলদা পোলা। কেষ্টারে বড় চোখে চোখে রাখত মায়। আগলে আগলে রাখত। দুদিকে বিশাল ডানা ছড়িয়ে বুড়ো শকুন যেমন ছানাদের আগলায় তেমন করে কেষ্টাকে আগলে রাখত তার মা।

মায় মইরা যাওনের পর আছিল বৈচি। চোক্ষে চোক্ষে রাখত কেষ্টারে। আগলে আগলে রাখত। হেই বৈচির গেল বিয়া অইয়া। তারপর থেকে কেষ্টার কাছে মাইয়া দিবে কে। বিবিরে খাওয়াইব কী কেষ্টা! খরালিকালটা ভালো যায়। বাইষ্যাকালে অনটন। এক ওক্ত খাওন, তিন ওক্ত উপোস। পয়সাকড়ি যা থাকে ঘোড়ার খাওন জোটাইতে খরচ হইয়া যায়। নিজে না খাইয়া মরুক, ঘোরাডারে মারলে চলব কেমনে! দিনে দিনে বিয়ার বয়স পার হইয়া গেল কেষ্টার। বাজারের কাছে আসতে আসতে কেষ্টার আর একবার বৈচির কথা মনে পড়ে। বুকের মইধ্যে আনচান করে ওঠে। একটা ডাউক বুকের মইধ্যে বইসা দুই তিনবার ডাক দেয়। বুক কাঁপাইয়া দীর্ঘশ্বাস পড়ে কেষ্টার। বৈচিরে বিয়া করতে পারলে জীবনডা ধানের মৌসুম অইয়া যাইত। হায়রে পোড়া কপাল, বৈচির জন্যে ধানের মৌসুম হল না জীবন।

বাজারটা পেরিয়ে যেতে কেষ্টার মনে পড়ে বিড়ি নাই। একখান ম্যাচও লাগব। বাইত গিয়া অহনেই আবার রানতে বইব কেষ্টা। এক থাল ভাত আর কাঁচা মুলা। ওফাজদ্দির ক্ষেত থিকা তুইলা আনলে অইব। খাইয়াদাইয়া ঘুম। কাইল গোয়ালীমান্দ্রা যাইতে অইব। ভেণ্ডারে কইছে কলে ধান ভাঙ্গাইব। টানো হারাদিন।

ঘোড়ার পাছায় ছিটকি মাইরা বাজারের দিকে যায় কেষ্টা। একখান আণ্ডাও কিন্না লইব। ভাতের লগে সিদ্ধ করলে খাইতে আরাম হইব।

বাজারের মুখেই করিমের ডাক্তারখানা। ভদ্রলোকের বাড়ির বাংলাঘরের লাহান ডাক্তারখানাডা। চৌচালা পাটাতন ঘর। ঢেউ টিনের বেড়া দেওয়া। ডাক্তারখানা বন্ধ কইরা করিম বিয়ালে বাড়িত চইলা গেছে। বাড়ি হইল দোগাছি। বিয়ানে আইসা আবার দোকান খুলবে। চুরিডাকাতির ডর নাই। চকিদার হারা রাইত পাহারা দেয় বাজার। আর চুরিডাকাতি আইজকাল হয়ও না। কাউল্লা চোরা মইরা যাওনের পর থিকা দেশগেরাম ঠাণ্ডা। চোরডাকাইত নাই।

তয় চোর আছিল একখান কাউল্লা। পুলিশের লগে দুস্তি আছিল তার। হেগ কাছ থনে বিড়ি চাইয়া খাইত। পিডে রুলের পয়লা বাড়ি পড়লে বিসমিল্লা কইত।

হেই কাউল্লারে মারল দশ গেরামের পোলাপানে। তখন জয় বাংলার দিন। চক্ষু বাইন্দা কালীর খিলের মাঠ দিয়া কাউল্লারে আড়াইয়া নিল দুলাল মিয়ার দল। দুইফর বেলা। লইয়া গেল গাংপার। তারবাদে ছুরি দিয়া পাড়াইয়া পাড়াইয়া মারল। চক্ষু দুইখান উড়াইয়া চিলেরে খাওয়াইল। তারবাদে লাশখান দিল পদ্মার পানিতে ভাসাইয়া। দেশগেরাম ঠাণ্ডা। অহন আর চুরিডাকাতি নাই। দুয়ার খুইলা সুখে নিদ্রা যায় দেশ গেরামের মাইনষে।

কাউল্লা চোরার কথা চিন্তা করতে করতে বাজারের মইধ্যে দিয়া ঘোড়া খানরে হাঁটায় কেষ্টা। সাঝ রাইতেই নিটাল হইয়া গেছে বাজারটা। পৌষ মাইসা শীত। মাইনষে খাইয়ালইয়া কাথার নিচে ঢুইকা গেছে। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ কইরা হুইয়া পড়ছে। খালি মাছ বাজারের চালাখানের পুব ধারে রমেশের মনোহারি দোকানটা খোলা। মাথার ওপর হারিকেন লটকাইয়া ছিটকি ঝোপের লাহান বইসা রইছে রমেশ। গায়ে পুরান একখান চাইদ্দর। বইসা বইসা বিড়ি টানতাছে। আর দোকানের সামনে মাটিতে জুবুথুবু হইয়া বইসা রইছে মুচিপাড়ার নেপলা।

জয় বাংলার কালে মেলিটারিরা মুচিপাড়ায় আগুন দিছিল। নেপলার গুষ্টি-গেয়াতি খতম। পাঁচ ছয় বছরের নেপলা বাইচ্চা গেল। অহনে বাজারে থাকে। ভিক মাইগা খায়। দোকানিগো ফুটফরমাইশ খাটে। ভাও বুইজ্জা চুরি চামারি করে। দিন চইল্লা যায়।

ঘোড়াখানরে মাছচালার মইধ্যে খাড়া করাইয়া লাফাইয়া নামে কেষ্টা। শীতে হি হি করতে করতে রমেশের দোকানের সামনে গিয়া খাড়ায়। এক পেক বিড়ি দেও দাদা, এককান মেচ আর একখান আসের আণ্ডা। রমেশ বুইড়া হইয়া গেছে। চিনতে পারে না, কেডা? গলা লম্বা কইরা জিগায়, কেডারে?

নেপলা কয়, কেষ্টা দাদায়।

রমেশ বলল, এত রাইতে কই থিকা আইলি কেষ্টা?

কেষ্টা হি হি করতে করতে কয়, দিগলি গেছিলাম। ভেণ্ডারের ধান টানছি।

রমেশ হারিকেনের আলোয় আস্তে আস্তে সদাই দেয়। খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া পয়সার হিসাব করে।

কেষ্টা জিগায়, বেচাকিনা কেমুন দাদা?

রমেশ কথা কওনের আগেই আগ বাড়াইয়া কথা কয় নেপলা, ভালোই।

শুনে শিয়ালের লাহান খেকায় রমেশ, তুই কতা কইছ না মুচির পো। যা অহনে।

কই যামু। আমার গুম আইতাছে।

যেহেনে ইচ্ছা যা। আমার ঘরে থাকতে পারবি না।

তয় থাকুম কই?

হেইডা আমি জানি? আমি তর কেরে?

গামছায় সদাই বানতে বানতে কেষ্টা কয়, কিরে নেপলা থাকনের জাগা নাই?

না দাদা।

ল আমার লগে।

লন।

নেপলা ভাউয়া ব্যাঙের লাহান একখান লাফ দেয়। আপনের ঘোড়াখান কো?

আছে। ল।

ঘোড়াখান খাড়াইয়া আছিল আন্ধারে। সামনে গিয়ে নেপলারে পয়লা ঘোড়ার পিঠে বসায় কেষ্টা। তার বাদে নিজে ওঠে। আন্ধার ভাইংগা হাঁটে ঘোড়াখান। পুব আসমানে ক্ষয়া চান্দখান উইঠা আসে তখনই।

.

বাড়িত আইয়া ঘোড়াখানরে ছাইড়া দেয় কেষ্টা। যা, খাইয়া আয়। ঘোড়াখান কেষ্টার সব কথা বোঝে। ছাইড়া দিতেই বিলের দিকে চইলা যায়। চিহি শব্দে আল্লাদের একখান ডাক দেয়। শুইনা নেপলা বড় খুশি। কেষ্টারে কয়, তোমার ঘোড়াডা বড় ভালা দাদা।

কেষ্টা ঘরের ঝাঁপ খোলে। কয়, হরে বড় ভালা ঘোড়াখান। আমারে বাচাইয়া রাখছে। ঘোড়াডা না থাকলে কবে না খাইয়া মইরা যাইতাম আমি।

নেপলা আর কোনও কথা কয় না। লম্বা কোটের জেবে দুই হাত ভইরা বাড়ির মইদ্দে চক্কর খায়।

কেষ্টা এখন ঘরের ভেতর। চাউল বাইর করতাছে। রানতে বইব। উঠানের কোণায় একখান চুলা। কয় থাবা নাড়া পইড়া রইছে। কেষ্টা মাইট্টা পাইল্লায় চাউল লইয়া বাইর অয়। মেচখান দেয় নেপলারে। চুলায় আগুন দে নেপলা। ভাত রান্দি, খাইছনে।

শুনে নেপলা বেজায় খুশি। চুলার ভেতরে নাড়া ভইরা ম্যাচ জ্বালায়। কেষ্টা যায় খালের দিকে। চাইল ধুইবে।

ওস পইড়া নাড়াগুলি বেবাক ওদাইয়া রইছে। ফুঁ দিয়া আগুন জ্বালায় নেপলা। তার বাদে চুলার ওপরে নিজের হাত দুইখান ছেকে। বেজায় আরাম লাগতাছে। রাইতখান বড় ভালা কাটব আইজ। খালপাড় থিকা উইঠা আসতে আসতে কেষ্টা যায় ওফাজউদ্দির মুলা ক্ষেতে। দুই তিনখান মুলা উঠাইব। গরম গরম ভাতের লগে কচচাইন্না মুলা, বড় স্বাদের। রসে মুখ ভইরা যায়।

মুলা ক্ষেতের কাছে শিয়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়। শিয়ালের আওয়াজ পাইয়া কেষ্টা দুবার হুরো দেয়। তার বাদে নিজের কামে যায়।

ফিরা দেখে চুলায় আগুন জ্বালাইছে নেপলা। দেইখা কেষ্টা বড় খুশি। কামের আছে ছেমড়াডা। মাইট্টা হাড়িখান চুলায় দেয় কেষ্টা। তার বাদে নাড়ার ওপরে বইসা নতুন প্যাক খুইলা একখান বিড়ি ধরায়। নেপলা তখন কাঁচা মুলা খাইতাছে। কচকচাইয়া মুলা খায় আর হাসে। বড় স্বাদের মুলা কেষ্টা দাদা। খাইয়া দেহ।

কেষ্টা বিড়ি টানতে টানতে কয়, তুই খা। আমি নিত্যি খাই।

নেপলা মুলা খায়, আর কথা কয়। তুমি একখান বিয়া কর কেষ্টা দাদা।

শুনে কেষ্টা একটা নিয়াস ছাড়ে। না বাই, বিয়া আমি করুম না।

ক্যা?

আমারে মাইয়া দিব কেডা?

ক্যা, বেলদারগ মাইয়া নাই?

আছিল একখান। কানা বেলদারের মাইয়া। বৈচি। বিয়া অইয়া গেছে এক যুগ, বারো বচ্ছর।

 হের লগে বিয়া অওনের কতা আছিল নি তোমার?

হ।

অইল না ক্যা?

কথা কইতে বড় আমুদ পায় নেপলা। মুলা খাইতে খাইতে খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া কেষ্টারে বৈচির কথা জিগায়। পাইলায় ভাত ফুটতাছে। আসমান থিকা পৌষ মাইসা শীত নামতাছে। চানখানও ওঠছে আইজ। ফটফইটা চান্নি। খুয়াও পড়ছে। হইলে হইব কী, চান্নিতে দুনিয়া ভাইসা যাইতাছে। খুয়া দেহা যায় না। কেষ্টার খাজুর গাছটায় একখান বাদুড় বহে। আবার উড়াল দেয়। এই সব দেইখা কেষ্টার নিজের জীবনডার কথা মনে অয়। বুকটা আনচান করে।

বৈচির বিয়া অইয়া যাওনের পর থিকা কেষ্টার আর আপন কেওই নাই। ভাই বেরাদর কেওই না। অনেককাল বাদে নেপলারে পাইল আইজ।

বড় আপন লাগে নেপলারে। কত কথা যে কইতে ইচ্ছা করে।

মুলা খাওন শেষ কইরা বিড়ি চায় নেপলা। একখান দেও কেষ্টা দাদা।

নেপলার বিড়ি খাওয়া দেখতে পারে না কেষ্টা। পোলাপান মাইনষে বিড়ি খাইব ক্যা! কিন্তু অহন আর ঐসব মনে হইতাছে না। চাইতেই পেক খুইলা একখান বিড়ি দিল নেপলারে।

বিড়ি পেয়ে নেপলা বড় খুশি। একখান পুরা বিড়ি। নেপলা আমোদে বাঁচে না। চুলার ভিতরে মুখ দিয়া বিড়ি জ্বালায়। টানতে টানতে কয়, কও কেষ্টা দাদা, তোমার বিয়ার কথা কও। কানা বেলদারের মাইয়ার কথা কও।

কেষ্টা আবার একটা নিয়াস ছাড়ে। আর একখান বিড়ি জ্বালায়। তারপর দুঃখী গলায়। কয়, বৈচি আমারে ভাত রাইন্দা খাওয়াইত। কইত আমার লেইগা বড় মায়া লাগে। পালাইয়া পালাইয়া আইত আমার কাছে। আমি কত বকছি বৈচিরে। কত কান্দান কান্দাইছি। হইলে হইব কী, ফাঁক পাইলেই আমার কাছে আইত বৈচি। আমার লেইগা বড় মায়া আছিল মাইয়াডার। কানা বেলদার অর বিয়া ঠিক করল। রাইতে বৈচি পালাইয়া আইল আমার কাছে। কয়, লও আমরা মাতবরের চরে পলাইয়া যাই। গিয়া বিয়াশাদি করি। ঘর বান্দি। আমার সাওস অইল না। কইলাম তর বাপের কাছে আমি যামু। কমু, বৈচিরে আমার লগে বিয়া দিতে অইব। বৈচি কইল, বাজানে তোমার কথা হুনব না। আমি কইলাম, হুনব। গেলাম কানার কাছে। কানা আমারে বাঁশ লইয়া আইল পিডাইতে। বৈচিরে রাখল পাহারায়। তিন দিনের দিন বৈচির বিয়া অইয়া গেল। আমার লগে আর দেহা অইল না। বারো বছর কাইটা গেল। অহন ভিন গায়ে থাকে। পোলাপানের মা অইছে। আমার কথা আর মনে নাই বৈচির।

এই অবদি কইয়া কেষ্টার গলা ভাইঙ্গা আসে। মুখ নিচা কইরা বইসা থাকে কেষ্টা। তার বাদে হাউমাউ কইরা কাইন্দা ওঠে। নেপলারে দুইন্নাইতে আমার কেওই নাই। বাপ আছিল, বাপ গেল। মায় আছিল, মায় গেল। তারবাদে এক বৈচি আছিল বৈচিও গেল। আমি বড় একলারে, এত বড় দুইন্নাইতে আমি বড় একলা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *