কালস্রোত

কালস্রোত

এই কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল আজ থেকে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর আগে। বাংলাদেশের মেয়েরা তখন পর্দা ছেড়ে বেরিয়েছে বটে, কিন্তু এমন ব্যাপকভাবে রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়েনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতা রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

মথুরানাথবাবুর বয়স ছিল তখন অনুমান চল্লিশ বছর। প্রশান্ত মুখ, দৃঢ় শরীর, অত্যন্ত মিতবাক্‌ মানুষ। বছর তিনেক আগে বিপত্নীক হয়ে সংসারযন্ত্রণা থেকে মুক্তিলাভ করেছেন। একলা মানুষ, ছেলেপুলে নেই।

কলকাতার যে-অংশে তিনি থাকতেন সেখান থেকে জাতীয় গ্রন্থাগার, অর্থাৎ তাৎকালিক ইম্পিরিয়ল লাইব্রেরি খুব আছে। ইচ্ছা করেই এখানে বাসা নিয়েছিলেন। তাঁর অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন ছিল না; বিপত্নীক হবার পর তিনি নিজের জীবনকে অত্যন্ত ঋজু এবং অনাড়ম্বর করে ফেলেছিলেন। ঝি-চাকর ছিল না, নিজেই নিজের সমস্ত গৃহকর্ম করতেন।

তাঁর দিনকৃত্য ছিল এইরকম—

সকালে উঠেই তিনি বাড়ি ঝাঁট দিয়ে ফেলতেন। সাড়ে তিনখানা ঘরের বাড়ি, ঝাঁট দিতে বেশী সময় লাগত না। তারপর স্টোভ জ্বেলে রান্না চড়াতেন। রান্না মানে চালে ডালে মিশিয়ে তাতে আলু পটোল কুমড়ো ইত্যাদি দিয়ে ঘ্যাঁটের মতো একটা পদার্থ। ঘ্যাঁট সিদ্ধ হলে তাতে খানিকটা ঘি ঢেলে দিয়ে স্টোভ নিভিয়ে তিনি স্নান করতে যেতেন। স্নানাদি সেরে পরম তৃপ্তির সঙ্গে ঘ্যাঁট উদরস্থ করে বাড়িতে তালা লাগিয়ে জাতীয় গ্রন্থাগারে যেতেন, সেখানে সারাদিন থাকতেন, বই পড়তেন, নোট করতেন, আবার অপরাহ্নে বাড়ি ফিরে আসতেন। রাত্রে রান্নার পাট নেই। রান্নাঘরে তাকের উপর সারি সারি গোয়ালিনী মার্কা গাঢ় দুধের টিন সাজানো থাকত, তারি একটা টিন নিয়ে তাতে ফুটো করে ফুটোতে মুখ লাগিয়ে চোঁ চোঁ করে দুধ খেয়ে টিন ফেলে দিতেন। তারপর পড়ার ঘরে গিয়ে আলো জ্বেলে আবার পড়তে বসতেন। পড়ার ঘরে আর একটি অতিরিক্ত খাটে বিছানা ছিল, প্রয়োজন বোধ করলে বিছানায় শুয়ে পড়তেন।

মথুরানাথ ছিলেন ইতিহাস-প্রেমিক। জীবনে অন্য কোনও প্রকার প্রেম আসেনি; স্ত্রী ছিলেন প্রখরভাষিণী ছিদ্রান্বেষিণী মহিলা, তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন স্বামীকে শান্তি দেননি। তাঁর মৃত্যুর পর মথুরানাথ স্বয়ংসিদ্ধ হয়ে ইতিহাসের গবেষণার মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর গবেষণার ফল বিলিতি অভিজাত পত্রিকায় প্রকাশিত হতে, বিলেতের পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে সাড়া পড়ত। কিন্তু বাংলাদেশে তাঁর বিদ্যাবুদ্ধির খবর বড় কেউ রাখত না।

এই পাড়ায় তিনি ছ-সাত বছর আছেন। সকলের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় ছিল, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা কারুর সঙ্গে ছিল না। তিনি যখন প্রথম এ পাড়ায় আসেন তখন ভদ্র প্রতিবেশীরা তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে মানসিক স্তরভেদ এত বেশী ছিল যে, অন্তরঙ্গতা দানা বাঁধতে পারেনি, মৌখিক শিষ্টতায় আবদ্ধ হয়ে ছিল। তারপর তিনি বিপত্নীক হলে কেউ কেউ তাঁকে কন্যাদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু ন্যাড়া দ্বিতীয়বার বেলতলায় যেতে রাজী হননি; সুখের চেয়ে শান্তিকেই তিনি শ্রেয় মনে করেছিলেন। তাঁর হৃদয়ের স্নেহ-মমতা অর্পিত হয়েছিল অতীতকালের নরনারীর ওপর।

তিনি এইভাবে অতীতকালের নায়ক-নায়িকা নিয়ে মশগুল হয়ে আছেন, একদা রাত্রিকালে হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটল।

পাড়ায় বসন্ত রায় নামে এক ভদ্রলোক বাস করতেন। মধ্যবিত্ত লোক, বয়সে মথুরানাথেরই সমকক্ষ; যা কাজকর্ম করতেন তাতে মোটের ওপর টায়ে টায়ে সংসার চলত। লোকটি অত্যন্ত বিনয়ী এবং মিষ্টভাষী, কিন্তু তাঁর চোখ দু’টি ছিল ভারি ধূর্ত। একদিন সন্ধ্যের পর তিনি মথুরানাথের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, সঙ্গে তাঁর শ্যালক কালীনাথ। কালীনাথের শরীরের গড়ন ও চোখের রক্তাভ চাউনি গুণ্ডার মতো; সে বেশী কথাবার্তা বলে না, তার চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারেই কাজ হয়।

মথুরানাথ তাঁদের নিয়ে গিয়ে পড়বার ঘরে বসালেন। পড়ার ঘরের দেয়ালগুলি বই-এর আলমারি দিয়ে ঢাকা, মাঝখানে টেবিল-চেয়ার, পাশে একটি সরু লোহার খাট।

তিনজনে উপবিষ্ট হবার পর বসন্তবাবু একটু কেশে বিনীতকণ্ঠে বলেন—‘মথুরাবাবু, বড় ঠেকায় পড়ে আপনার কাছে এসেছি। একটু উপকার করতে হবে।’

‘কি ব্যাপার?’

‘আর বলেন কেন! ছা-পোষা মানুষ, কোনোমতে শাক-ভাত খেয়ে বেঁচে আছি, তার ওপর এই বিপদ। আমার মা আর শাশুড়ি দু’জনেই কাশীবাস করেন, একসঙ্গে থাকেন। আজ বিকেলবেলা ‘তার’ পেলাম তাঁরা দু’জনে গঙ্গাস্নান করে ফিরছিলেন, একটা মোটরকার তাঁদের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। দু’জনেরই এখন-তখন অবস্থা। আজ রাত্রেই স্ত্রীকে নিয়ে কাশী যাচ্ছি; এই আমার শালা কালীনাথ, ওকেও সঙ্গে নিচ্ছি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে সুষমাকে নিয়ে।’

মথুরানাথ চোখে উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে চেয়ে রইলেন। বসন্তবাবু তখন বিস্তারিত করে বললেন—‘আমার মেয়ে সুষমা। তাকে আপনি নিশ্চয় দেখেছেন। আমার একমাত্র সন্তান। ভারি ভীতু মেয়ে, ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই না। এমনিতেই তো বিপদের পাহাড় মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে, ওকে তার মধ্যে নিয়ে যেতে মন সরছে না। তাছাড়া খরচের কথাটাও ভাবতে হয়। এই ব্যাপারে কত যে খরচ হবে ভেবে দিশপাশ পাচ্ছি না।’

মথুরানাথ বোধ হয় বসন্তবাবুর অভিপ্রায় অনুমান করতে পেরেছিলেন, শঙ্কিত স্বরে বললেন—‘মেয়েটির বয়স কত?’

বসন্তবাবু তাচ্ছিল্যভরে বললেন—‘কত আর হবে, বড়জোর পনেরো-ষোল; একেবারে ছেলেমানুষ। ওর জন্যেই আপনার কাছে এসেছি মথুরাবাবু। আমরা আজ যাচ্ছি, পরশু নাগাদ আমি কিংবা কালীনাথ ফিরে আসব। এই দুটো রাত্তিরের জন্যে সুষমাকে আপনার বাড়িতে রাখতে হবে।’

মথুরানাথ অত্যন্ত বিব্রত হয়ে বললেন—‘কিন্তু—কিন্তু আমি একলা থাকি, আমার বাসায় আর কেউ নেই—’

যেন ভারি হাসির কথা এমনিভাবে হেসে বসন্তবাবু বললেন—‘কী যে বলেন আপনি! সুষমা আপনার মেয়ের বয়সী। আর, আপনাকে পাড়ার কে না চেনে। দেবতুল্য লোক। সেই জন্যেই তো নিশ্চিন্দি হয়ে আপনার কাছে মেয়ে রেখে যাচ্ছি।’

‘কিন্তু—কিন্তু—পাড়ায় যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকেন তাঁদের কারুর কাছে রেখে গেলেই তো—’

‘তাঁদের কাছে রেখে যেতে সাহস হয় না মথুরাবাবু। সকলের বাড়িতেই উচক্কা বয়সের ছেলে আছে। কার মনে কী আছে কে বলতে পারে।’

‘কিন্তু—কিন্তু—’

সজ্জন ব্যক্তি হবার একটা অসুবিধা এই যে, অন্যায় অনুরোধ-উপরোধ এড়াবার কৌশল জানা থাকে না। মথুরানাথ শেষ পর্যন্ত অপ্রসন্ন মনে রাজী হলেন। বেশ শান্তিতে ছিলেন তিনি, এ আবার কী ফ্যাসাদ!

ফ্যাসাদ যে কতখানি দূরপ্রসারী তা তিনি তখনো ভাবতে পারেননি।

বসন্তবাবু উচ্ছ্বসিত ধন্যবাদ দিতে দিতে শ্যালককে নিয়ে চলে গেলেন এবং অল্পক্ষণ পরেই সুষমাকে নিয়ে ফিরে এলেন। সুষমার হাতে একটি ছোট স্যুট্‌কেস, সম্ভবত তার মধ্যে তার নিত্য ব্যবহারের জামাকাপড় আছে।

সুষমাকে মথুরানাথ রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখেছেন কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করেননি; সে নেহাত কিশোরী নয়, বয়স অন্তত উনিশ কুড়ি। সুন্দরী নয়; আমাদের দেশে প্রকৃত সুন্দরী মেয়ে খুব বেশী নেই, কিন্তু সুশ্রীতার নানা প্রকারভেদ দেখা যায়। সুষমার এক ধরনের সুশ্রীতা আছে যাকে যৌবনসুলভ স্বাস্থ্যের সুশ্রীতা বলা চলে। তার চোখ দু’টিও বেশ কথা কইতে পারে।

সে একবার মথুরানাথের পানে তিরছ নয়নে চেয়ে চোখ নীচু করল। বসন্তবাবু বললেন—‘সুষমা বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছে, আজ রাত্তিরে ওর আর কিছু দরকার হবে না। আচ্ছা, আমি তাহলে আর দেরি করব না, এখনি পোঁটলাপুঁটলি বেঁধে স্টেশনের দিকে রওনা দিতে হবে।’ এক ঝলক হেসে তিনি রওনা দিলেন।

মথুরানাথ সুষমাকে নিয়ে পড়ার ঘরে এসে বসলেন। তাঁর শরীর এবং মন অস্বাচ্ছন্দ্যে ভরে উঠেছে। তিনি স্বভাবতই মেয়েদের কাছে একটু মুখচোরা, তার ওপর বর্তমান পরিস্থিতিকে ঠিক সাধারণ পরিস্থিতি বলা চলে না। বাড়িতে তিনি এবং একটি অনাত্মীয়া যুবতী ছাড়া আর কেউ নেই। এইভাবেই রাত কাটাতে হবে।

সুষমা মথুরানাথের সামনের চেয়ারে বসে আছে, মাঝে টেবিলের ব্যবধান। সুষমার মুখ বেশ প্রফুল্ল, সে থেকে থেকে মথুরানাথের পানে স্মিত-চকিত দৃষ্টি হেনে আবার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। সব মেয়েই অল্পবিস্তর অভিনয় করতে পারে, কিন্তু সুষমার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, এ বিদ্যায় সে বিলক্ষণ পটীয়সী।

মথুরানাথ নিজেকে বোঝালেন যে, মেয়েটা নিতান্তই শিশু, তার সান্নিধ্যে ভয় পাওয়া কাপুরুষতার লক্ষণ। তিনি সহজভাবে কথা বলবার চেষ্টা করলেন।—‘তুমি এই ঘরে এই খাটে শোবে। অসুবিধে হবে না? মানে ভয় করবে না?’

সুষমা ফিক করে হাসল—‘ভয় করবে কেন? আপনার বাড়িতে ভূত আছে নাকি?’

সুষমার গলায় একটি মিষ্টি ঝংকার আছে।

মথুরানাথ বললেন—‘না, ভূত নেই। অন্তত আমি কখনো দেখিনি।’

‘তাহলে ভয় করবে না।’

‘যদি ইচ্ছে কর, আলো জ্বেলে শুতে পারো।’

‘চোখে আলো লাগলে আমি ঘুমোতে পারি না।’

‘বেশ, যেমন তোমার ইচ্ছে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ। মথুরানাথ কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। মেয়েটাকে শিশু মনে করা সম্ভব হচ্ছে না; তার দেহ ও মন সমান পরিপুষ্ট। সে যেন গূঢ়ভাবে তাঁর সঙ্গে রসিকতা করছে। মথুরানাথ ঘড়ি দেখলেন, সাড়ে আটটা বেজেছে। আজ পড়াশুনো হলো না, আরো আধ ঘণ্টা এইভাবে চালাতে হবে।

‘আপনার বাড়িতে কেউ নেই, বিয়ে করেননি বুঝি?’

মথুরানাথ চমকে তাকালেন; দেখলেন, সুষমার চোখে কৌতুক ও কৌতুহল। সে তাঁর অতীত জীবনের কিছু জানে না। কিংবা—

প্রসঙ্গটা রুচিকর নয়, তিনি শুকনো গলায় বললেন—‘বিয়ে করেছিলাম, স্ত্রী বেঁচে নেই।’

‘ও—আমি জানতুম না। আপনি বুঝি ঠিকে বামুন চাকর রেখেছেন?’

বাক্যলাপের একটা নতুন সূত্র পেয়ে মথুরানাথ একটু সজীব হলেন—‘বামুন চাকর নেই, আমি নিজেই সংসারের সব কাজ করি। একলা মানুষ, চলে যায়।’

‘রান্নাও আপনি নিজেই করেন?’

‘রান্না আর কি, চালে ডালে মিলিয়ে খিচুড়ি করি। তাই খেয়ে লাইব্রেরি চলে যাই। রাত্তিরে রান্নার হাঙ্গামা নেই, এক টিন কন্‌ডেন্স্‌ড্‌ মিল্ক খেয়ে নিই।—কিন্তু ও কথা থাক, কাল থেকে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি সকালে ঘুম থেকে উঠে কি খাও বলো দেখি।’

‘চা খাই।’ সঙ্গে মুখটেপা হাসি।

‘চা!’ মথুরানাথ বিব্রতভাবে চারিদিকে তাকালেন—‘চায়ের ব্যবস্থা তো নেই। আচ্ছা, হয়ে যাবে। বিকেলবেলাও চা খাও?’

সুষমা হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল—‘হ্যাঁ।’

‘হুঁ। তুমি রান্না করতে জানো?’

‘ভাত আর আলুভাতে রাঁধতে জানি।’ সুষমার মুখে কপট কৃতিত্বের গর্ব। মথুরানাথ মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে হাসি টেনে আনলেন—‘তোমাদের বাড়িতে রাঁধে কে?’

‘মা রাঁধে। আমাকে শেখায়নি, আমি কি করব!’ সুষমা একটু ঠোঁট ফোলায়।

গেরস্ত ঘরের মেয়েকে মা রাঁধতে শেখায় না এমন বাংলাদেশে দুর্লভ। সুষমা বোধ হয় নিজে ইচ্ছে করেই রাঁধতে শেখেনি। শিখলেই তো রাঁধতে হবে। মথুরানাথের মন সুষমার প্রতি বিরূপ হয়ে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে তিনি প্রশ্ন করলেন—‘বই পড়ার অভ্যেস আছে?’

‘বই!’ সুষমার কণ্ঠস্বরে নৈরাশ্য ফুটে উঠল—‘বাংলা গল্পের বই পড়েছি দু’-চারখানা।’

‘সিনেমা দেখতে ভাল লাগে?’

সুষমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল—‘হ্যাঁ, খুব ভাল লাগে। কিন্তু বেশী দেখতে পাই না, বাবা পয়সা দেয় না।’ সে আশান্বিত চোখে মথুরানাথের পানে চেয়ে রইল, কিন্তু তিনি উচ্চবাচ্য করলেন না।

ন’টা বাজল; মথুরানাথ উঠে পড়লেন—‘আচ্ছা, তুমি এবার শুয়ে পড়। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিতে পারো।’

সুষমাও উঠে দাঁড়িয়েছিল। মথুরানাথ দেখলেন, সে মিটিমিটি হাসছে; তার চোখের মধ্যে একটু দুষ্ট অভিসন্ধি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। মথুরানাথ আর দাঁড়ালেন না, নিজের শোবার ঘরে গিয়ে দোর বন্ধ করলেন। সাধারণত রাত্রি সাড়ে দশটা পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেন, আজ তা হলো না। ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত স্নায়ুমণ্ডল নিয়ে তিনি আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।

বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ করার পর তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু মনটা সতর্ক ছিল; খুটখুট শব্দে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন, বালিশের পাশে হাতঘড়ি রাখা ছিল, তুলে চোখের কাছে এনে দেখলেন সওয়া বারোটা। তিনি উৎকর্ণ হয়ে দোরের পানে চেয়ে রইলেন।

আবার খুটখুট শব্দ। মথুরানাথ উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন, তারপর দোর খুললেন। দোরের সামনে সুষমা দাঁড়িয়ে আছে; তার খোঁপা খুলে গিয়ে কাঁধের ওপর এলিয়ে পড়েছে, পরনের শাড়ি শিথিলভাবে গায়ে জড়ানো। ভর্ৎসনার চোখে চেয়ে সুষমা ঠোঁট ফোলাল। ঠোঁট ফোলালে তাকে ভাল দেখায় তা বোধ হয় সে জানে।

মথুরানাথ বললেন—‘কী?’

‘ঘুম আসছে না।’

‘সেকি! বারোটা বেজে গেছে এখনো ঘুমোওনি।’

‘না, কিছুতেই ঘুম আসছে না।’

স্নায়ুর উত্তেজনা। নতুন জায়গায় নতুন বিছানায় শুলে অনেকের ঘুম আসে না। মথুরানাথ একটি ছোট হোমিওপ্যাথির বাক্স রাখতেন, বললেন—‘দাঁড়াও আমি ওষুধ দিচ্ছি, খেলেই ঘুম আসবে।’

তিনি ঘরে ফিরে গিয়ে ওষুধের বাক্স খুলে দেখছেন ‘কফিয়া’ আছে কিনা, সুষমাও ঘরে ঢুকল, এদিক ওদিক চোখ ফিরিয়ে দেখতে লাগল। এ ঘরের খাট বেশ চওড়া, দু’-জনের শোয়ার উপযোগী; এটি মথুরানাথের অতীত দাম্পত্য জীবনের পরিশিষ্ট।

মথুরানাথ সুষমাকে ঘরের মধ্যে দেখে মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটা যেন কেমনধারা—লজ্জা-সংকোচ নেই। আসলে শিক্ষাদীক্ষার অভাব। কিংবা—

তাঁর বুকের রক্ত সহসা চঞ্চল হয়ে উঠল। সুষমা তাঁর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বাক্স থেকে শিশি বার করে বললেন—‘হাত পাতো।’

সুষমা হাত পাতলো, তিনি তার হাতের তেলোয় কয়েকটি গুলি দিয়ে বললেন—‘নাও, খেয়ে ফেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুম এসে যাবে।’

গুলি মুখে দিয়ে সুষমা ভর্ৎসনার চোখে মথুরানাথের পানে চাইতে চাইতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মথুরানাথ একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। কিন্তু নিশ্বাসটা স্বস্তির কিংবা আক্ষেপের তা তিনি নিজেই বুঝতে পারলেন না।

ভোর পাঁচটার সময় মথুরানাথের ঘুম ভাঙল। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন সুষমার দোর তখনো বন্ধ, ঘরের মধ্যে সাড়াশব্দ নেই। মথুরানাথ ক্ষণেক দাঁড়িয়ে চিন্তা করলেন। আজ আর ঝাঁট দেওয়া চলবে না, ঝাঁটার শব্দে সুষমার ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

তিনি নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে আলমারি খুললেন। আলমারিতে তাঁর কাপড়চোপড় টাকাকড়ি সবই থাকে। তিনি কিছু টাকা এবং একটি থার্মোফ্লাস্ক ভরে নিয়ে নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরুলেন।

অনতিদূরে একটি চায়ের দোকান। সেখানে দু’পেয়ালা চা থার্মোফ্লাস্কে নিয়ে, কিছু কেক ও ক্রীম বিস্কুট কিনে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন।

বাড়ি নিশুতি, সুষমা তখনো ওঠেনি। মথুরানাথ চা বিস্কুট প্রভৃতি রান্নাঘরে রেখে বাথরুমে ঢুকলেন। কাজ এগিয়ে রাখা ভাল। মেয়েটা কখন ঘুম থেকে উঠবে ঠিক নেই।

দাড়ি কামানো স্নান ইত্যাদি সেরে বেরুতে সাড়ে ছ’টা বাজল। সুষমা এখনো ওঠেনি। রাত্রে ঘুম হয়নি বলেই বোধ হয় উঠতে দেরি হচ্ছে।

একটা কথা মনে পড়ে গেল। মথুরানাথ রান্নাঘরে গিয়ে উঁচু তাক থেকে বহুকালের অব্যবহৃত পেয়ালা পিরিচ প্রভৃতি বার করলেন। সেগুলোকে ধুয়ে পরিষ্কার করে আলাদা করে রাখলেন; কেক ও বিস্কুট প্লেটে সাজালেন। তারপর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

সাতটা বাজতে বেশী দেরি নেই। মথুরানাথের মন হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। এত ঘুমোয় কেন মেয়েটা? তিনি গিয়ে সুষমার দোরে টোকা দিলেন।

মিনিটখানেক পরে সুষমা দোর খুলল। ঘুম-ঘোলাটে চোখ, মুখে বিরক্তি আর অসন্তোষ। মথুরানাথ বললেন—‘তুমি উঠছ না দেখে ভাবনা হচ্ছিল। আমি পাঁচটার সময় উঠেছি, তোমার চা এনেছি।’

সুষমা উত্তর দিল না। নিজের ব্যাগটা নিয়ে বাথরুমের দিকে চলল। মথুরানাথ পিছন থেকে ডেকে প্রশ্ন করলেন—‘ওষুধ খাবার পর রাত্তিরে ঘুমিয়েছিলে তো?’

এবারও সুষমা উত্তর দিল না, বাথরুমে ঢুকে সশব্দে দোর বন্ধ করে দিল। অসময়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।

সাড়ে সাতটার সময় সুষমা বাথরুম থেকে বেরুল। ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো, পরনে পাটভাঙা শাড়ি ব্লাউজ, মুখে হাসি। মিষ্টি সুরে বলল—‘কাল ঘুমোতে এত দেরি হলো যে কিছুতেই সকালে ঘুম ভাঙছিল না। আপনি সাতসকালে উঠে আমার জন্যে চা নিয়ে এলেন, আমার ভারি লজ্জা করছে। চা নিশ্চয় জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে।’

মথুরানাথ বললেন—‘চা থার্মোফ্লাস্কে আছে, ঠাণ্ডা হয়নি। তুমি রান্নাঘরে গিয়ে চা-কেক খাও, আমি বাজারে চললাম।’

‘বাজারে যাবেন!’

‘হ্যাঁ। বাড়িতে চাল ডাল ছাড়া আর কিছু নেই?’

কয়েকটা থলি নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সুষমা চায়ের ফ্লাস্ক ও কেকের প্লেট নিয়ে নিজের ঘরে গেল, টেবিলের সামনে বসে তরিবত করে চা ঢেলে খেতে লাগল। বাড়ির চায়ের চেয়ে দোকানের চা সুষমার বেশী ভাল লাগে; বিশেষত তার সঙ্গে যদি কেক থাকে।

এক ঘণ্টা পরে মথুরানাথ বাজার থেকে শাক-সবজি মাছ চায়ের প্যাকেট গুঁড়ো মসলা ইত্যাদি কিনে বাড়ি ফিরলেন; এসেই কুটনো কুটে রান্না চড়িয়ে দিলেন। সুষমা একবার আধমনাভাবে সাহায্য করার প্রস্তাব করল, কিন্তু তিনি কান দিলেন না। সুষমাও বেঁচে গেল।

ডাল ভাত একটা চচ্চড়ি ও মাছের ঝোল রাঁধতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। মথুরানাথ আজ ডাল ভাত খেলেন, নিজের জন্যে আলাদা ঘ্যাঁট রাঁধলেন না। তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে বললেন—‘তুমি ধীরে-সুস্থে খাও, আমি লাইব্রেরি চললাম।’

‘অ্যাঁ—কখন ফিরবেন?’

‘বিকেলবেলা।’

‘সারাদিন আমি একলা থাকব?’ সুষমার স্বরে শঙ্কা ফুটে উঠল।

মথুরানাথ থমকে গেলেন, তারপর সাহস দিয়ে বললেন—‘ভয় কি! সদর দোর বন্ধ রেখো, আমি ফেরা পর্যন্ত খুলো না।’

‘কিন্তু সারাদিন আমি একলা কি করব?’

‘যদি ঘুম পায় ঘুমিও। নয়তো বই পড়তে পারো, আমার আলমারিতে অনেক বই আছে।—আচ্ছা।’

মথুরানাথ লাইব্রেরি চলে গেলেন।

কিন্তু লাইব্রেরিতে গিয়ে তিনি মনে স্বস্তি পেলেন না। বার বার মনটা বাড়ির দিকে ফিরে যেতে লাগল। বসন্তবাবু বিশ্বাস করে মেয়েকে তাঁর জিম্মায় রেখে গেছেন…পাড়ায় দুষ্টু বজ্জাত ছোঁড়া নিশ্চয় দু’চারটে আছে, তারা যদি…মেয়েটার স্বভাব-চরিত্র কেমন তা তিনি আঁচ করতে পারছেন না, কখনো মনে হয় ভাল, কখনো মনে হয় শিকারী মেয়ে…স্ত্রীচরিত্র সম্বন্ধে মথুরানাথের অজ্ঞতা অপরিসীম…মধুরানাথের কটুভাষিণী স্ত্রী পদে পদে ছিদ্রান্বেষণ করতে ভালবাসতেন, তাঁর তুলনায় সুষমা অনেক ভাল…কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিতে কী যেন আছে—

লেখাপড়ায় মন বসল না। চারটে বাজার আগেই তিনি লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

সুষমা তাঁকে দেখে একগাল হাসল—‘আপনি এলেন! বাব্বা বাঁচলুম। চা তৈরি করব?’

‘তুমি চা তৈরি করতে জানো?’

‘জানি। চা তৈরি করা মোটেই শক্ত নয়।’

‘তুমি নিজের জন্যে তৈরি করো। আমি চা খাই না।’

‘একটুও খাবেন না?’

‘আচ্ছা দিও এক পেয়ালা।’

পড়ার ঘরে বসে চা-পর্ব সম্পন্ন হলো। তারপর সুষমা মথুরানাথের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আদুরে সুরে বলল—‘আমাকে সিনেমা দেখতে নিয়ে যাবেন? কতদিন যে ছবি দেখিনি।’

মথুরানাথ এমনভাবে তাকালেন, যেন সিনেমার নাম আগে কখনো শোনেননি—‘সিনেমা! কোথায়?’

সুষমা বলল—‘পাড়াতেই চিত্রালি সিনেমা হাউস, সেখানে একটা খুব ভাল ছবি দেখাচ্ছে। যাবেন?’

‘কিন্তু—রান্নাবান্না করতে হবে না? রাত্রে খাবে কি?’

‘কেন, সিনেমা দেখার পর হোটেলে খেয়ে নিলেই হবে।’

মথুরানাথের মন চাইছিল না, কিন্তু তিনি ভাবলেন, আজকের দিনটা বই তো নয়। বললেন—‘বেশ চলো। আমি সবাক ছবি কখনো দেখিনি, ছেলেবেলায় নির্বাক বায়স্কোপ দু’একবার দেখেছি।’

মথুরানাথ সুষমাকে নিয়ে চিত্রালি সিনেমায় গেলেন। ভেস্টিব্যুলে পাড়ার কয়েকজন চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলো, মথুরানাথ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, যেন অবৈধ কাজে ধরা পড়েছেন। তাড়াতাড়ি টিকিট কিনে সুষমাকে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে বসলেন।

পিছন দিকের সীট, দর্শক বেশী নেই। মথুরানাথ যেখানে বসেছেন তার আশেপাশে অন্য দর্শক নেই।

ঘর অন্ধকার হলো, ছবি আরম্ভ হলো। নানা রসের সমাবেশে ছবিটি বেশ সুস্বাদু হয়েছে। মূলে আছে একটি প্রেমের কাহিনী, দেখতে দেখতে মথুরানাথের মন বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। পর্দার ওপর নায়ক-নায়িকার প্রেম ঘনীভূত হয়ে একটা চরমাবস্থার নিকটবর্তী হচ্ছে এমন সময় মথুরানাথ অনুভব করলেন, সুষমার একটা হাত এসে তাঁর হাতের মধ্যে প্রবেশ করল। মথুরানাথ হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেলেন, তারপর আস্তে আস্তে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে কোলের ওপর রাখলেন। তিনি ছবির পর্দার দিকেই চেয়ে রইলেন বটে, কিন্তু ছবির দৃশ্যগুলি তাঁর চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে গেল, তিনি মোহাচ্ছন্নের মতো শুনতে লাগলেন, একটা গান কে যেন গাইছে—মধুর যুবতিজন সঙ্গ, মধুর মধুর রসরঙ্গ—

ছবি শেষ হলে মথুরানাথ বাইরে এলেন, কিন্তু সুষমার মুখের পানে তাকাতে পারলেন না। সুষমার লজ্জা-সঙ্কোচ নেই, সে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল—‘কি সুন্দর ছবি! একবার দেখে মন ভরে না। আপনার ভাল লেগেছে?’

মথুরানাথ নীরস স্বরে বললেন—‘হ্যাঁ।—হোটেল কোথায়?’

সুষমা বলল—‘এই যে কাছেই। আসুন আমার সঙ্গে।’

হোটেলটি ভাল। সেখানেও দু’একজন পাড়ার লোকের সঙ্গে দেখা হলো, তারা সুষমাকে মথুরানাথের সঙ্গে দেখে ভুরু তুলে চাইল। মথুরানাথ হোটেলে খেতে এসেছেন, সঙ্গে যুবতী—দৃশ্যটা বিস্ময়কর।

আহার শেষ করে বাড়ি ফিরতে দশটা বাজল। বাড়িতে ফিরেই তিনি নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন, দোর বন্ধ করতে করতে অস্পষ্ট স্বরে বললেন—‘শুয়ে পড় গিয়ে। রাত হয়েছে।’

বিছানায় শুয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন, আজ রাত্রিটা কাটলে বাঁচা যায়। কিন্তু কাল যদি ওর বাপ না আসে? যাদের দেখতে গিয়েছে তারা যদি মরে যায় তাহলে কি এত শিগ্‌গির ফিরতে পারবে? এইভাবে কতদিন চলবে…মনের উদ্বেগ বাড়তে লাগল। মেয়েটার চালচলন যেন কেমনধারা।। আজকালকার মেয়েদের ভাবভঙ্গি তিনি কিছুই বুঝতে পারেন না; তাদের পর্দা না থাক, সন্ত্রম শালীনতাও কি থাকবে না! যুবতী মেয়েদের এমন নিরঙ্কুশ গায়ে-পড়া ভাব কি ভাল! আর একটা কথা, সুষমার ঠাকুরমা ও দিদিমা গুরুতর রকম আহত হয়ে মরমর অবস্থায় রয়েছেন, কিন্তু কই, তার তো কোনও উৎকণ্ঠা নেই! একবার তাঁদের নাম উচ্চারণ পর্যন্ত করল না। সুষমা ভদ্রঘরের মেয়ে, কিন্তু তার মন-মেজাজ স্বভাব-চরিত্র কেমন?

এ প্রশ্নের উত্তর মথুরানাথ অবিলম্বে পেলেন। হোটেলের অনভ্যস্ত খাবার খেয়ে তাঁর পেটের মধ্যে কিঞ্চিৎ আন্দোলন শুরু হয়েছিল, মস্তিষ্কও যথেষ্ট উত্তেজিত, তাই ঘুম আসছিল না। সাড়ে এগারোটা বেজে যাবার পর তিনি উঠে জল খেলেন, তারপর শুনতে পেলেন—দরজায় আবার সেই খুটখুট শব্দ। একটু দ্বিধার পর তিনি দরজা খুললেন।

সুষমা দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার বেশবাস আরো শিথিল। আঁচলটা মাটিতে লুটোচ্ছে। ঠোঁট ফুলিয়ে মথুরানাথের পানে চাইল। তাই দৃষ্টির মর্মার্থ এতই স্পষ্ট যে, তা বুঝতে মথুরানাথের তিলমাত্র কষ্ট হলো না। তিনি সশব্দে দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন, তারপর বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। তাঁর মনে হলো কে যেন তাঁর গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধের চেষ্টা করছে।

পরদিন সকালে মথুরানাথ বাজারে চলে গেলেন। ফিরে এসে দেখলেন সুষমা উঠেছে। কেউ কোনও কথা বলল না। মথুরানাথ রন্ধন শেষ করে নিজে আহার করলেন, সুষমার জন্যে খাবার রেখে লাইব্রেরি চলে গেলেন।

লাইব্রেরি থেকে তিনি আজ একটু দেরি করেই ফিরলেন। সুষমা মুখ ভারী করে দোর খুলে দিল। তারপর তিনি মুখ হাত ধুয়ে বেরুতেই সুষমার বাবা বসন্ত রায় এসে উপস্থিত হলেন, সঙ্গে পাড়ার দুটি ভদ্রলোক। বসন্ত রায় একগাল হেসে হাত জোড় করলেন—‘আজ দুপুরবেলা ফিরেছি। আপনার আশীর্বাদে মা এবং শাশুড়ি ঠাকরুন দু’জনেই সামলে গেছেন; কালীনাথকে রেখে আমি ফিরে এলাম। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আপনি খাঁটি সজ্জন তাই বিপদের সময় সাহায্য করলেন।’ সঙ্গীদের দিকে ফিরে বললেন—‘দেখছেন তো, সাক্ষাৎ দেবতুল্য মানুষ। উনি দু’-রাত্তিরের জন্যে জায়গা না দিলে কোথায় রাখতাম মেয়েটাকে বলুন তো। তা আর কষ্ট দেব না, সুষমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’

সুষমা কাছে এসে দাঁড়াল। তার মুখ বিমর্ষ, চোখে ছলছল বিষন্নতা। বসন্তবাবু তার পানে একবার তীক্ষ্ণ চোখে চাইলেন, তারপর আরো খানকিটা মসৃণ চাটুবাক্য বলে মেয়েকে এবং সঙ্গীদের নিয়ে চলে গেলেন।

মথুরানাথ ভাবলেন, ফাঁড়া কাটল। তবু তিনি একটা নিশ্বাস ফেললেন। হঠাৎ দু’দিনের জন্যে তাঁর জীবনে একটা নাটকীয় তীক্ষ্ণতা এসেছিল। নাটক শেষ হবার আগেই যেন পর্দা পড়ে গেল।

তিন দিন নিরুপদ্রবে কাটল। মথুরানাথের জীবন আবার অভ্যস্ত খাতে প্রবাহিত হতে লাগল। কিন্তু তাঁর মনের তপোভঙ্গ হয়েছিল, মন সহজে আশ্বস্ত হলো না।

চতুর্থ দিন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত।

সকালবেলা মথুরানাথ লাইব্রেরি যাবার জন্যে বেরুচ্ছিলেন, দোর খুলে দেখলেন সামনেই চারজন লোক দাঁড়িয়ে আছে : বসন্ত রায়, কালীনাথ এবং পাড়ার সেই দু’জন ভদ্রলোক। সকলের মুখেই প্রলয়ংকর গাম্ভীর্য।

হঠাৎ কালীনাথ লাফিয়ে সামনে এসে মুঠি বাগিয়ে গর্জন ছাড়ল—‘ভণ্ড! লম্পট! তোমাকে খুন করব আমি।’ তার লাল চোখ দুটো থেকে আগুন ঠিকরে পড়তে লাগল।

মথুরানাথ হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন।

বসন্ত রায় শালাকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁর ভাবভঙ্গি অন্যরকম; গভীর ভর্ৎসনাভরা চোখে চেয়ে তিনি হৃদয়বিদারক স্বরে বললেন—‘আপনাকে ভদ্রলোক ভেবে আপনার কাছে আমার কুমারী মেয়েকে রেখে গিয়েছিলাম, আপনি এই করলেন! ছি ছি ছি!’

পাড়ার দু’জন লোক দুঃখিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ, ছি ছি ছি।

এদের ক্রোধ এবং ধিক্কারের অন্তরালে যে অকথিত অভিযোগ আছে, মথুরানাথ হতভম্ব অবস্থাতেও তা অনুভব করলেন, তাঁর মাথার মধ্যে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। এরা শুধু অকৃতজ্ঞই নয়, সাক্ষীসাবুদ এনে তাঁকে মিথ্যে অপরাধের জালে ফাঁসাতে চায়। তিনি কঠোর স্বরে বললেন—‘কি বলতে চান আপনারা?’

কালীনাথ বসন্ত রায়কে সরিয়ে দিয়ে সামনে এল, দু’হাত আস্ফালন করে চিৎকার করল—‘কি বলতে চাই জানো না তুমি, নচ্ছার ছোটলোক কোথাকার! আমার ভাগনীর সর্বনাশ করেছ! যদি ভদ্রলোকের রক্ত শরীরে থাকে তাকে বিয়ে করতে হবে।—নইলে—’ কালীনাথ মথুরানাথের মুখের সামনে মুঠি নাড়তে লাগল।

ভদ্রলোক দু’টি এই সময় গতিক ভাল নয় দেখে গমনোদ্যত হলেন, সম্ভবত দাঙ্গাহাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়তে চান না। তাই দেখে বসন্ত রায় কালীনাথকে বললেন—‘চলে এস ভাই, চলে এস। আমরা যে ভদ্রলোক সে-কথা যেন ভুলে না যাই। প্রকাশ্য কেলেঙ্কারীতে আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে না। যা করবার আমরা আইনসঙ্গতভাবে করব।’ তিনি কালীনাথের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললেন।

কালীনাথ চলে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে তর্জন ছাড়ল—‘রেপ-কেস আনব তোমার নামে, লোচ্চা লম্পট কোথাকার।’

চারজনে চলে গেল। মথুরানাথের আর লাইব্রেরি যাওয়া হলো না, তিনি দোর বন্ধ করে ঘরে এসে বসলেন। তাঁর মাথার মধ্যে এলোমেলো চিন্তা ও রাগের ঝড় বইছে। সুষমা তাঁর নামে মিথ্যে অভিযোগ করেছে। কিন্তু কেন? নিজের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল তাই প্রতিশোধ নিচ্ছে? কিন্তু এ যে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ। সুষমা কেমন মেয়ে? ফাঁদে ফেলে তাঁকে বিয়ে করতে চায়!

হঠাৎ তাঁর মনে হলো, শুধু সুষমা নয়, তার বাপ মামা সবাই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকিয়েছে। সোজাসুজি বিয়ের প্রস্তাব করলে তিনি রাজী হতেন না, তাই তাঁকে ধরবার জন্যে ফাঁদ ফেতেছে। তাঁকে ভয় দেখিয়ে বিনা খরচে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়। কী সাংঘাতিক লোক ওরা!

তবু মথুরানাথের মনের কোণে সুষমার জন্যে একটু নরম স্থান আছে। সুষমা তাঁকে চেয়েছে; হয়তো বাপ এবং মামার ওসকানিতে তাঁর নামে মিথ্যে দুর্নাম দিয়েছে। তবু দুটো রাত্রির কথা তিনি ভুলতে পারেন না। সুষমা তাঁকে চেয়েছিল।—

তাপর কিছুদিন সুষমার বাপ বা মামা আর কোনও হাঙ্গামা করল না। কিন্তু অন্য এক বিপদ হয়েছে। প্রত্যহ রাত্রে মথুরানাথ সুষমাকে স্বপ্ন দেখেন : তাঁর খাটের পাশে সুষমা এসে দাঁড়িয়েছে; তার বুকের আঁচল খসা; চোখে অভিমান-ভরা ভর্ৎসনা। আবার স্বপ্ন দেখেন, তিনি সিনেমা দেখছেন, প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার, সুষমার একটি হাত নিঃশব্দে এসে তাঁর মুঠির মধ্যে প্রবেশ করল…

একটি একটি করে দিন কাটছে। মথুরানাথের লাইব্রেরি যাওয়া বন্ধ হয়েছে, দিনের বেলা বাড়ি থেকে বেরোন না, সন্ধ্যের পর চুপিচুপি বেরিয়ে সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনেন। সর্বদা ভয়, পাছে চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মানসিক দ্বন্দ্বে এবং দৈহিক তৎপরতার অভাবে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগল, মনের দৃঢ়তা যেটুকু ছিল তাও ভেঙে পড়বার উপক্রম করল।

ছ’ হপ্তা পরে একটি চিঠি এল; রেজিষ্ট্রি করা উকিলের চিঠি। খামের উপর ছাপার অক্ষরে সলিসিটারের নাম।

দুরুদুরু বুকে মথুরানাথ খাম খুললেন। চিঠিতে অপ্রত্যাশিত কোনও কথাই নেই, তবু তাঁর মাথায় হাতুড়ির ঘা পড়ল। উকিল মহাশয় আইনসঙ্গত চোস্ত ভাষায় তাঁর মক্কেল বসন্ত রায়ের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন, তাঁর অনূঢ়া কন্যার গর্ভাধানের জন্য মথুরানাথ দায়ী; তিনি যদি অচিরাৎ কন্যাকে বিবাহ না করেন তাঁর নামে দেওয়ানী এবং ফৌজদারী মামলা আনা হবে। ইত্যাদি।

মথুরানাথের মানসিক অবস্থা বর্ণনা করা নিষ্প্রয়োজন। সুষমার চরিত্র এবং তার বাপের অভিসন্ধি এখন তাঁর কাছে স্পষ্ট। নষ্ট মেয়েকে তাঁর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ওরা সব দিক রক্ষে করতে চায়। সুষমার ব্যভিচার বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গেই ধরা পড়ে গিয়েছিল; প্রকৃত অপরাধী বিয়ে করতে রাজী হয়নি। তখন, গর্ভাধানের আশঙ্কা আছে জেনে, সুষমার বাপ অবিলম্বে তাকে তাঁর কাছে রেখে গিয়েছে এবং সুষমাও তাঁর ঘাড়ে দোষ চাপাবার বিধিমত চেষ্টা করেছে। মেয়েটা বিকীর্ণকামা; ইংরেজিতে যাকে বলে নিম্‌ফো, সূর্পণখার জাত।

মথুরানাথ একজন বড় সলিসিটারের অফিসে গেলেন। একটি ঘরে প্রশান্তমূর্তি একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসে আছেন, মথুরানাথ তাঁর সামনে বসে স্খলিতস্বরে নিজের লাঞ্ছনার কাহিনী বয়ান করলেন, উকিলের চিঠি দেখালেন। প্রসন্নমূর্তি উকিলের মুখ তিলমাত্র অপ্রসন্ন হলো না, কিন্তু তিনি যে মথুরানাথের নিষ্কলঙ্কতার কথা একটি বর্ণও বিশ্বাস করেননি তা স্পষ্ট বোঝা গেল। তিনি ধীর মন্থর স্বরে বললেন—‘দেখুন, আপনি মোকদ্দমা লড়তে পারেন কিন্তু জিতের আশা খুব কম। ওরা আটঘাট বেঁধে কাজ করেছে, আপনার নিজের মুখের কথা ছাড়া আর কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। এ অবস্থায় আমার পরামর্শ, মোকদ্দমা লড়তে যাবেন না। ফৌজদারী মামলায় যদি দোষী সাব্যস্ত হন, লম্বা মেয়াদের জন্যে জেলে যেতে হবে। খবরের কাগজে দেশজোড়া ঢিঢিক্কার হবে তার কথা ছেড়ে দিলাম।’

মথুরানাথ টাউরি খেতে খেতে ফিরে এলেন। মনে মনে অনেক তর্জনগর্জন করলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজী হতে হলো।

রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে হলো। সাক্ষী বসন্ত রায় এবং পাড়ায় সেই ভদ্রলোক দু’টি। অন্য কেউ নেই, চুপিচুপি বিয়ে। সুষমার মুখ শান্ত নমিত, তাকে দেখে মনে হয় অনাঘ্রাত ফুল। মথুরানাথের ভাবভঙ্গি ভিজে বেরালের মতো, যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন।

রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে বসন্ত রায় হাসিহাসি মুখে বললেন—‘বাবাজি, যা হবার হয়ে গেছে। এখন তুমি আমার জামাই হলে—’

মথুরানাথের ভিজে-বেরাল ভাব মুহূর্তে অন্তর্হিত হলো। তিনি ক্ষেপে গেলেন; উগ্রস্বরে বললেন—‘জুতো মারব তোমাকে—’

বসন্ত রায় আর মথুরানাথকে ঘাঁটালেন না, একটি বিষগ্ন নিশ্বাস ফেলে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে চলে গেলেন। মথুরানাথ সুষমাকে বললেন—‘তুমিও বাপের সঙ্গে যাও-না। আর কি, কাজ তো হাসিল হয়ে গেছে।’

সুষমা নড়ল না, নির্বিকার মুখে মথুরানাথের পাশে দাঁড়িয়ে রইল।

ট্যাক্সি ডেকে মথুরানাথ নববধূ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

কাম এষ ক্রোধ এষ। শাস্ত্রে বলে, ও দুটো রিপু একই বস্তুর এপিঠ ওপিঠ। মথুরানাথের মনে এই দুই রিপুর সংযোগে যা তৈরি হয়েছিল তা স্বাভাবিক বৃত্তি নয়, উদগ্র পাশবিকতা। সে-রাত্রে সুষমা যখন তাঁর দোরের সামনে এসে দাঁড়াল তখন তিনি রূঢ়ভাবে তার হাত ধরে ঘরের ভিতর টেনে নিলেন।

মথুরানাথের জীবনের ধারা বদলে গেল, তিনি সম্ভোগের ঘোলা জলে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গেলেন।

বিয়ের সাত মাস পরে সুষমা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করল। আইনত মথুরানাথ তার পিতা। তিনি পুত্রমুখ দর্শন করলেন; ছেলে দেখতে ভাল, বয়সকালে সুপুরুষ হবে। সুষমার রুচির নিন্দা করা যায় না। মথুরানাথ ছেলের নাম রাখলেন সত্যকাম। সুষমা নামের ব্যঙ্গার্থ বুঝল না, তাই আপত্তি করল না।

তারপর ধীরে ধীরে মথুরানাথের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলো, তিনি আবার নিয়মিত লেখাপড়া ও লাইব্রেরি যাতায়াত আরম্ভ করলেন। বাড়িতে তিনি সুষমা ও ছেলেকে নিজের ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন, নিজের পড়ার ঘরে শুতেন। সুষমা সন্তানের যত্ন করতে জানে না, তাই দেখে তিনি একটি প্রৌঢ়া স্ত্রীলোককে ধাই-মা রেখেছিলেন। রাইমণি শক্তসমর্থ স্ত্রীলোক, সংসারের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে সে ছেলে মানুষ করা ছাড়াও সংসারের অধিকাংশ কাজ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল।

সত্যকামের বয়স যখন চার মাস তখন একদিন মথুরানাথ লাইব্রেরি থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন সুষমা বাড়িতে নেই। তিনি রাইমণিকে জিজ্ঞেস করলেন—‘সুষমা কোথায়?’

রাইমণি মুখের একটা ভঙ্গি করে বলল—‘সিনেমা দেখতে গেছে গো বাবু। একটি কমবয়সী বাবু ক’দিন ধরেই দুপুরবেলা আসছিল, আজ তার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গেছে।’

এটা নতুন খবর। মথুরানাথ খবরটি পরিপাক করে নীরব রইলেন, রাইমণির কাছে মনের কথা প্রকাশ করলেন না।

সুষমা ফিরল সন্ধ্যের পর। ভাবভঙ্গি অপরাধীর মতো। মথুরানাথ নির্লিপ্তভাবে প্রশ্ন করলেন—‘কার সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে?’

সুষমা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—‘আমার মাসতুত ভাই এসেছিল, তার সঙ্গে।’

মথুরানাথ একটু চুপ করে থেকে বললেন—‘বাপের বাড়ির সঙ্গে যদি সম্পর্ক রাখতে চাও তাহলে এখানে থাকা চলবে না।’

সুষমা কাঁচুমাচু হয়ে বলল—‘আর যাব না।’

সুষমার অন্য যে-দোষই থাক, সে ভাল অভিনেত্রী।

তিন দিন পরে সুষমা প্রেমিকের সঙ্গে উধাও হলো। যাকে সে মাসতুত ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিল, আসলে সে তার প্রণয়ী এবং সত্যকামের জনক। সত্যকামকে সে নিয়ে গেল না, তার বদলে নিয়ে গেল মথুরানাথের আলমারি ভেঙে সমস্ত মজুত টাকাকড়ি। ভাগ্যক্রমে মথুরানাথ বাড়িতে বেশী টাকাকড়ি রাখতেন না, তবু তিন চারশো টাকা গেল।

বিকেলবেলা মথুরানাথ লাইব্রেরি থেকে ফিরে এলে রাইমণি বলল—‘তোমার বৌ তোমাকে ছেড়ে চলে গেল গো বাবু।’

‘সে কি! কোথায় গেল?’

‘তা কি জানি। দুপুরবেলা সেই ভাবের মানুষটি এল, তার সঙ্গে শোবার ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স-পেটরা নিয়ে চলে গেল। আমি শুধোলাম—হ্যাঁ বাছা, কোথায় চললে? বৌ বলল—যেখানে মন চায় সেখানে যাচ্ছি। আমি বললুম—আর ছেলে? বৌ বলল—ছেলে মানুষ করবার জন্যে আমি জন্মাইনি। এই বলে ট্যাক্সিতে চড়ে চলে গেল।’

ছেলেটা দোলায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, মথুরানাথের ইচ্ছে হলো তাকে টান মেরে রাস্তায় ফেলে দেন। কিন্তু তা না করে তিনি নিজের সাবেক শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ঘরের অবস্থা দেখে কিছুই বুঝতে বাকি রইল না; সুষমা হাতের কাছে যা পেয়েছে সব নিয়ে চলে গেছে, আর ফিরবে না।

বিনিদ্র রাত্রি কাটিয়ে মথুরানাথ পরদিন সকালে আবার সেই সলিসিটারের কাছে গেলেন। সলিসিটার মহাশয় এবার তাঁর বয়ান শুনে বললেন—‘ডিভোর্স পাওয়া কঠিন হবে না। আপনি আগে এক কাজ করুন, টাকাকড়ি যা-যা চুরি গিয়েছে তার একটা লিস্ট তৈরি করে থানায় গিয়ে সানা লিখিয়ে আসুন। তাতে আপনার ডিভোর্স কেস আরো মজবুত হবে।’

মাস ছয়েক পরে মথুরানাথ আদালত থেকে ছাড়পত্র পেলেন। পরম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন তাঁর দেহ থেকে যেন একটা ক্লেদাক্ত চর্মরোগ দূর হয়েছে।

বাড়ি ফিরে এসে প্রথমেই তাঁর চোখ পড়ল ছেলেটার ওপর। সত্যকামের বয়স তখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি, বেশ চটপটে হয়েছে, কান্নাকাটি নেই, চোখের দৃষ্টিতে বুদ্ধির প্রখরতা। মথুরানাথ আবার একটু অস্বস্তি অনুভব করলেন; ছেলেটাকে বিদেয় করতে পারলে তিনি পুরোপুরি আগের অবস্থা ফিরে পেতে পারতেন। কিন্তু আইনত তার উপায় নেই। তিনি অনিচ্ছামন্থর পায়ে তার দোলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।

সত্যকাম তাঁর পানে চেয়ে ফোকলা মুখে একমুখ হাসল। তিনি তার মুখের কাছে তর্জনী বাড়িয়ে মনে মনে বললেন—‘তোর অসতী মা’কে বিদেয় করেছি।’ সত্যকাম খপ করে আঙুলটা ধরে মুখে পুরে চুষতে শুরু করে দিল।

রাইমণি চায়ের জল চড়াতে রান্নাঘরে ঢুকেছিল, এই সময় বেরিয়ে এসে বলল—‘হ্যাঁ গো বাবু, ফারখত হয়ে গেল?’

‘হ্যাঁ, পাপ দূর হয়েছে। এখন এই ছেলেটাকে নিয়ে কি করা যায় ভাবছি।’

রাইমণি গালে হাত দিয়ে বলল—‘সে কি কথা গো বাবু! নিজের ছেলেকে পালবে পুষবে মানুষ করবে। মা যেমনই হোক ছেলে তো তোমার।’

মথুরানাথ উত্তর দিলেন না, বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করলেন।

পরদিন ভোরবেলা মথুরানাথ চা খেতে বসলেন। দু’বেলা চা খাওয়ার অভ্যাসটা আবার ফিরে এসেছে। চা খেতে খেতে তিনি রাইমণিকে বললেন—‘এখানে আর আমার থাকবার ইচ্ছে নেই রাইমণি।’

রাইমণি সায় দিয়ে বলল—‘এ পাড়ায় আর না থাকাই ভাল। সবাই গাল কাত করে হাসে। আমার বাবু-সোনা বড় হবে, বুঝতে শিখবে। ওর কথাও তো ভাবতে হবে।’

মথুরানাথ বললেন—‘শুধু পাড়া নয়, কলকাতাতেই আর থাকব না। শুনতে পেলাম সুষমা নাকি সিনেমা করবে বলে স্টুডিওতে ঢুকেছে।’

রাইমণি বলল—‘ওমা তাই বুঝি! তা হবে। কিন্তু তুমি কলকাতা ছেড়ে কোথায় যাবে?’

‘দিল্লী যাব। দিল্লীতে আমার মুখচেনা কেউ নেই, কিন্তু লাইব্রেরি আছে। তুমি যাবে রাইমণি? তুমি যদি না যাও তাহলে আমাকে অন্য লোক দেখতে হবে।’

রাইমণি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—‘না গো বাবু, আমি যাব। কলকাতা ছেড়ে যেতে মন চায় না, কিন্তু যাব। আমার আর কে বা আছে, বাবু-সোনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। হিল্লী-দিল্লী যেখানে হয় নিয়ে চলো।’

মথুরানাথ বললেন—‘বেশ।—আর একটা কথা—সত্যকাম যেন কোনোদিন জানতে না পারে যে তার মা—’

রাইমণি জিভ কেটে বলল—‘ওমা সে কি কথা! বড় হয়ে বাবু-সোনা জানবে তার মা মরে গেছে।’

তারপর মাসখানেকের মধ্যে মথুরানাথ সত্যকাম ও রাইমণিকে নিয়ে দিল্লী গেলেন।

পঁচিশ বছরে কেটে গেছে।

এই পঁচিশ বছরে পৃথিবীতে অনেক রদবদল হয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর মানুষের মন উন্মার্গগামী হয়েছে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান জন্মগ্রহণ করেছে, অ্যাটম্‌ বোমা ফেটেছে, মহাশূন্যে মানুষের পদচিহ্ন অঙ্কিত হয়েছে এবং আরো অনেক বিচিত্র ব্যাপার ঘটেছে।

দিল্লীতে মথুরানাথ সত্যকামকে নিয়ে বাস করছেন। মুথরানাথ বৃদ্ধ হয়েছেন, সত্যকামের বয়স এখন ছাব্বিশ। রাইমণি সংসারের গৃহিণী হয়ে আছে।

দিল্লী আসার পর সত্যকামের প্রতি মথুরানাথের মনের ভাব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে আরম্ভ করেছিল। ছেলেটা একদিকে যেমন বুদ্ধিমান অন্যদিকে তেমনি সুশীল। দুষ্ট পিতামাতার সন্তান সজ্জন হতে পারে ইতিহাস পুরাণে তার অনেক উদাহরণ আছে, মহর্ষি জাবালি তাদের অন্যতম। মথুরানাথ সত্যকামের গুণে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। তাঁর অন্তরে অনেকখানি স্নেহরস পাত্রের অভাবে অব্যবহৃত পড়ে ছিল, সেই বাৎসল্য তিনি সত্যকামকে অর্পণ করলেন। নিজের মনকে বোঝালেন : সুষমা আমার কেউ ছিল না, সে ছিল দুশ্চরিত্রা স্বৈরিণী; তার ছেলেও আমার কেউ নয়; মানুষ যেমন অনাথালয় থেকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করে, আমিও তেমনি সত্যকামকে পোষ্যপুত্র নিয়েছি, সে আমার দত্তকপুত্র।

সত্যকাম যখন স্কুলে ভরতি হলো তখন মথুরানাথ তার নাম বদলে দিলেন, নতুন নাম হলো—সত্যপ্রিয়। নতুন নামই চালু হলো; মথুরানাথ সংক্ষেপে তাকে প্রিয় বলে ডাকেন, রাইমণি বলে সতু-সোনা। স্বভাবতই সে মথুরানাথকে বাবা বলে, আর রাইমণিকে বলে মণি-মা।

স্কুলে ঢোকবার পর থেকে তার লেখাপড়ার ইতিহাস নিষ্কলঙ্ক : প্রত্যেকটি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। বিজ্ঞানের দিকে তারণী ঝোঁক বেশী। কলেজে ঢুকে সে বিজ্ঞানের দিকেই গেল। তারপর যথাসময় জীব-রসায়নবিদ্যায় প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করে রিসার্চ স্কলার হলো।

কলেজে একটি বাঙালী মেয়ের সঙ্গে সত্যপ্রিয়র ভাব হয়েছিল, তার নাম শর্বরী। কুড়ি বছর বয়সে বি. এস্‌সি. পাস করে এম. এস্‌সি. পড়ছিল, সেও জীব-রসায়নের ছাত্রী। যৌবনের স্বাভাবিক আকর্ষণ ছাড়াও একটা গভীরতর আকর্ষণ দু’জনকে পরস্পরের কাছে টেনে এনেছিল। দু’জনের প্রকৃতি একই জাতের : জলের মতো স্বচ্ছ, তীরের মতো ঋজু। দু’জনের বুদ্ধিই বিজ্ঞানভিত্তিক, সংস্কার বা মোহের স্থান সেখানে বেশী নেই। প্রথম সাক্ষাতের দু’চার দিনের মধ্যেই তারা নিজেদের মনের অবস্থা বুঝতে পারল এবং অকপটে পরস্পরের কাছে ধরা দিল।

শর্বরী মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী সুগঠনা শ্যামলী। তার বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের বড় চাকরে, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। মেয়ে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইলে তিনি আপত্তি করতেন না। কিন্তু সত্যপ্রিয় এবং শর্বরী পরামর্শ করে স্থির করল, বিয়ের কোনও তাড়া নেই, পূর্বরাগের মধু পরিপূর্ণভাবে আস্বাদন করে যখন বিয়ের ইচ্ছা দুর্নিবার হবে তখন তারা বিয়ে করবে। তবে খবরটা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে রাখলে ক্ষতি নেই।

একদিন শর্বরী সত্যপ্রিয়কে নিয়ে নিজের বাড়িতে গেল। শর্বরীর মা-বাবা তাকে দেখলেন, তার সঙ্গে কথা কইলেন। চেহারা পিতৃপরিচয় এবং বুদ্ধিসুদ্ধির দিক থেকে পরম সুপাত্র। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতেও তাঁদের কষ্ট হলো না। তাঁরা মনে মনে খুশি হলেন।

তারপর শর্বরী একটা রবিবারে সত্যপ্রিয়র বাড়িতে এল। মথুরানাথ বাড়িতে ছিলেন, ঘরে লেখাপড়া করছিলেন। সত্যপ্রিয় শর্বরীকে নিয়ে গিয়ে বলল—‘বাবা, এর নাম শর্বরী—আমার ছাত্রী।’

শর্বরী প্রণাম করল, মথুরানাথ তাকে সস্নেহে কাছে বসিয়ে বললেন—‘তোমাদের যে বিদ্যা তার আমি কিছুই জানি না। তবু আশীর্বাদ করি তোমার বিদ্যা যেন তোমার বুদ্ধির সহকারী হয়।’

তিনজনে একসঙ্গে বসে চা খেলেন। সাধারণভাবে গল্প করতে করতে মথুরানাথ অনুভব করলেন, এরা শুধু গুরুশিষ্যা নয়, এদের মনের সম্বন্ধ আরো ঘনিষ্ঠ। তিনি অন্তরে অন্তরে একটা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগলেন। মনের অগোচর পাপ নেই। গত দু’তিন বছরে তিনি সত্যপ্রিয়র বিয়ের কথা অনেকবার ভেবেছেন। কিন্তু বিয়ে দিতে গেলেই সত্যপ্রিয়র মিথ্যা পরিচয় দিতে হবে, মিথ্যার জালে জড়িয়ে পড়তে হবে। যদি সত্যের ভগ্নাংশও প্রকাশ হয়ে পড়ে? তাঁর মন বিমুখ হয়ে ফিরে এসেছে।

সন্ধ্যের সময় সত্যপ্রিয় শর্বরীকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল রাইমণি রান্না চড়িয়েছে। সে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল, বলল—‘মণি-মা, আজ যে মেয়েটা এসেছিল তাকে দেখলি?’

রাইমণি ঘাড় বেঁকিয়ে সত্যপ্রিয়র পানে চাইল, তার গালের লোলচর্মে একটা খাঁজ পড়ল; সে আবার রান্নায় মন দিয়ে বলল—‘তা দেখলুম বৈকি।’

‘কেমন দেখলি?’

রাইমণি দন্তহীন মুখে হাসল—‘কী ভাগ্যি, তোর সংসারধম্মে মন হয়েছে। তা কবে হবে?’

‘তোর কেমন লাগল বল্ না!’

‘ভাল রে বাপু ভাল, তোর পছন্দ কখনো মন্দ হয়। রাঙা বরের সঙ্গে কালো বউ মানায় ভাল। কর্তাকে বলেছিস?’

‘এখনো বলিনি। বাবার নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে। মণি-মা, তুই আমার হয়ে বাবাকে বলবি?’

‘কেন, তোর বুঝি লজ্জা করছে?’

‘লজ্জা নয়, লজ্জা কিসের? তবে—’

‘আচ্ছা বলব।’

মথুরানাথকে অবশ্য বলবার দরকার ছিল না, তিনি বুঝেছিলেন। রাইমণির মুখে শুনে তিনি প্রশ্নভরা চোখে তার মুখের পানে চাইলেন; রাইমণি গলা খাটো করে বলল—‘ভয় নেই গো বাবু, সতু-সোনার মায়ের কথা কেউ কিছু জানবে না।’

তবু, মনের মধ্যে নানা সংশয় নিয়ে মথুরানাথ সম্মতি দিলেন। সত্যপ্রিয়র বিয়ে যখন দিতেই হবে। এবং সে যদি নিজে মেয়ে পছন্দ করেছে, তখন—

মাস দুই কেটে যাবার পর একদিন দুপুরবেলা শর্বরী আর সত্যপ্রিয় একসঙ্গে কলেজ থেকে ফিরছিল। কি একটা কারণে হঠাৎ কলেজের ছুটি হয়ে গেছে। ফাল্গুন মাসের আরম্ভে দিল্লীর শীত কমতে আরম্ভ করেছে। দু’জনে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল; দুপুরবেলার মিঠেকড়া রোদ্দুরটি বড় উপভোগ্য। সত্যপ্রিয় শর্বরীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।

দু’জনে সৈনিকের মতো একসঙ্গে পা ফেলে চলেছে। একটা পার্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শর্বরী বলল—‘চলো, পার্কে একটু বসা যাক।’

দুপুরবেলা পার্ক নির্জন। পাতা-ঝরা গাছের তলায় একটা বেঞ্চি, ওরা গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শর্বরী একটু কাছে ঘেঁষে বসল, ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল—‘আর ভাল লাগছে না।’

সত্যপ্রিয় চকিতে ঘাড় ফেরাল—‘কী ভাল লাগছে না?’

শর্বরী চোখ নীচু করে একটু হাসল—‘বাপের বাড়ি।’

সত্যপ্রিয় গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে সহজ জিজ্ঞাসার সুরে বলল—‘বাপের বাড়ি ভাল লাগছে না কেন?’

শর্বরী মুখ টিপে হাসল—‘আহা, যেন বুঝতে পারনি। তোমার অবস্থা কেমন?’

সত্যপ্রিয় হেসে ফেলল, শর্বরীর একটি হাত নিজের মুঠির মধ্যে নিয়ে বলল—‘আমার অবস্থা তোমারি মতো। কিছুক্ষণ চুপ করে ভেবে নিয়ে বলল—‘চলো, আজই তোমার বাবাকে বলি। তোমার বাবা যদি মাথা নাড়েন—’

শর্বরী বলল—‘মাথা নাড়বেন না। মা এরই মধ্যে আমাকে লুকিয়ে বিয়ের গয়না গড়াতে শুরু করে দিয়েছেন।’

‘ব্যস্‌, তবে আর কি!’ সত্যপ্রিয় হাত ধরে শর্বরীকে টেনে তুলল—‘চলো, কর্তব্য কর্ম সেরে ফেলা যাক।’

বাড়ির ফটকের কাছে এসে শর্বরী থমকে দাঁড়াল—‘ওই যা, বাবা তো এখনো অফিস থেকে ফেরেননি।’

‘ঠিক তো। আচ্ছা, তাহলে আমি সন্ধ্যের পর আসব।’

বাড়ি ফিরে এসে সত্যপ্রিয় ভাবল—ভালই হলো, আমার বাবাকে আগে বলা উচিত, তিনি বিয়ের দিন স্থির ঠিক করে দেবেন।

মথুরানাথ তখনো লাইব্রেরী থেকে ফেরেননি। তাঁর ফিরতে পাঁচটা বাজে।

সত্যপ্রিয়র চা খাবার ইচ্ছা হলো। সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল রাইমণি উনুনের পাশে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। সে তাকে জাগাল না, নিজের ঘরে এসে বিছানায় লম্বা হলো। মনের মধ্যে শর্বরীর কথা ঘোরাফেরা করতে লাগল…বাপের বাড়ি আর ভাল লাগছে না…

চমক ভেঙ্গে তার কানে এল, কেউ হালকা হাতে সদর দোরের ঘন্টি বাজাচ্ছে। সত্যপ্রিয় ভাবল, বাবা ফিরেছেন। কিন্তু তাঁর তো এখনো ফেরার সময় হয়নি। তবু সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দোর খুলল।

একটি স্ত্রীলোক। ভদ্ৰশ্রেণীর বাঙালী স্ত্রীলোক, কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ দেখে দুঃস্থ মনে হয়। বয়স আন্দাজ পঁয়তাল্লিশ, যদিও সস্তা প্রসাধনের দ্বারা বয়স কমাবার চেষ্টা আছে। সে উৎকণ্ঠা-ভরা চোখে সত্যপ্রিয়র মুখের পানে চেয়ে রইল। শেষে স্থলিত কণ্ঠে বলল—‘এটা কি মথুরানাথবাবুর বাড়ি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি—তুমি কি তাঁর ছেলে?’

‘হ্যাঁ। কাকে চান?’

স্ত্রীলোকটির চোখ একটু বাষ্পাচ্ছন্ন হলো, সে ঢোক গিলে বলল—‘আমি—আমি তোমার সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাই।’

‘আমার সঙ্গে! কী কথা?’

‘ভেতরে আসতে পারি?’

সত্যপ্রিয়র মন স্ত্রীলোকটিকে দেখে অপ্রসন্ন হয়েছিল, তবু সে শিষ্টভাবেই বলল—‘আসুন।’

সে তাকে বসবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। স্ত্রীলোকটি বলল—‘তোমাকে দেখেই চিনেছি, ঠিক বাপের মতো চেহারা।’

মনে বিরক্তি নিয়ে সত্যপ্রিয় চেয়ে রইল। কে এই স্ত্রীলোকটা? কী চায়?

‘আমাকে তুমি চিনতে পারবে না। আমি বড় বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি। আগে জানতুম না তোমরা দিল্লীতে আছ—’

সত্যপ্রিয়র মনটা কড়া হয়ে উঠেছিল, সে ঈষৎ রুক্ষস্বরে বলল—‘আপনার পরিচয় দিন আগে, তারপর বিপদের কথা শুনব।’

স্ত্রীলোকটির চক্ষু সজল হলো, সে অস্ফুট কণ্ঠে বলল—‘কি বলে পরিচয় দেবো ভেবে পাচ্ছি না। আমি—তোমার মা।’

সত্যপ্রিয় চমকে উঠল, পাগল নাকি!

‘কি বলছেন আপনি!’

‘সত্যি কথাই বলছি বাবা, আমি তোমার মা। আমি তোমাকে পেটে ধরেছি।’

সত্যপ্রিয় নিজেকে সংযত করে বলল—‘আমার মা আমি জন্মাবার পরেই মারা গেছেন। কে আপনি? কি চান?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুষমা বলল—‘তোমার মা মারা যায়নি, ওরা মিছে কথা বলে তোমাকে ভুলিয়েছে। তোমার বাপ আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাকে ডিভোর্স করেছিল।’

সত্যপ্রিয়র রগের শির উঁচু হয়ে উঠল। এত বড় স্পর্ধা, তার ঋষিতুল্য পিতার নামে মিথ্যা কুৎসা করে! কিন্তু সে আত্মসংবরণ করে ধীরভাবে বলল—‘ও কথা যাক। আপনি কি চান বলুন।’

সুষমার আশা হলো হয়তো ছেলের মন ভিজছে, সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—‘আমি বড় অভাবে পড়েছি বাবা, তাই তোমার আছে ভিক্ষে চাইতে এসেছি, তুমি ছেলে, তুমি যদি খেতে না দাও তো কে দেবে?’

‘এতদিন কে খেতে দিচ্ছিল?’

সামান্য চাকরি করে পেট চালিয়েছি, কিন্তু এখন আর সে সামর্থ্যও নেই। দিল্লীতে এসেছিলুম চাকরির খোঁজে, তারপর খবর পেলুম তোমরা এখানে আছ। তাই সন্ধান নিয়ে তোমার কাছে এলুম—’

‘ও—’ সত্যপ্রিয় হঠাৎ প্রশ্ন করল—‘রাইমণিকে আপনি নিশ্চয় চেনেন?’

সুষমা চকিত শঙ্কায় চোখ বিস্ফারিত করল—‘রাইমণি এখনো আছে নাকি?’

‘আছে। তাকে ডাকব?’

‘না না, তাকে ডাকবার দরকার নেই। সে—সে আমাকে দেখতে পারে না, আমার নামে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল।’

‘তাহলে একটু অপেক্ষা করুন, বাবা এখনি লাইব্রেরি থেকে ফিরবেন।’

সুষমা গুণছেঁড়া ধনুকের মতো লাফিয়ে উঠল—‘অ্যাঁ, তিনি তো পাঁচটার সময় ফেরেন।’

সত্যপ্রিয় হাতের ঘড়ি দেখে বলল—‘পাঁচটা বাজতে দেরি নেই। আপনি সব খবর রাখেন দেখছি।’

সুষমা বিচলিতভাবে বলল—‘আমি—আমি আজ যাই, আর একদিন আসব।’

এই সময় সদর দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। সত্যপ্রিয় বলল—‘ওই বাবা এলেন। আপনি বসুন—’

সত্যপ্রিয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুষমা বসল না, কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল; চোখে ভয়ার্ত দিশাহারা দৃষ্টি।

মথুরানাথ ঘরে ঢুকেই সুষমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মুখ সাদা হয়ে গেল। তিনি যে সুষমাকে চিনতে পেরেছেন তাতে সন্দেহ নেই।

সুষমা কিন্তু আর দাঁড়াল না, চোরের মতো পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে ছুটে পালাল।

মথুরানাথের দেহটা টলমল করে উঠেছিল, তিনি অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে ডাকলেন—‘প্রিয়—’

সত্যপ্রিয় ছুটে এসে বাপকে জড়িয়ে ধরল—‘বাবা—’

মথুরানাথ বললেন—‘আমি বসব।’

সত্যপ্রিয় তাঁকে টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। তিনি কিছুক্ষণ ডান হাত দিয়ে বুকের বাঁ দিকটা চেপে বসে রইলেন, তারপর মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন—‘ও তোমাকে কিছু বলেছে?’

সত্যপ্রিয় বাপের কাছে কখনো মিথ্যে কথা বলেনি, সে একটু নীরব থেকে বলল—‘উনি বললেন উনি আমার মা।’

মথুরানাথের মাথা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল। সত্যপ্রিয় ভয় পেয়ে ডাকল—‘বাবা!’ তিনি সাড়া দিলেন না।

সত্যপ্রিয় তখন চিৎকার করে ডাকল—‘মণি-মা, শিগ্‌গির এস বাবা অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। আমি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।’

দু’তিনটে বাড়ির পরে ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তার এলে সকলে ধরাধরি করে মথুরানাথকে তাঁর শয়নঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন—‘হার্ট অ্যাটাক। লক্ষণ ভাল ঠেকছে না। আপনারা প্রস্তুত থাকুন।’ তিনি যথারীতি চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন।

সন্ধ্যের পর শর্বরী টেলিফোন করল—‘কই, তুমি এলে না?’

সত্যপ্রিয় বলল—‘বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এখন জ্ঞান হয়েছে। ডাক্তার কিন্তু ভরসা দিচ্ছেন না। হার্ট স্পেশালিস্ট এসেছিলেন, তিনি স্পষ্টভাবে কিছু বলছেন না। বাবার হার্ট নাকি অনেকদিন থেকেই দুর্বল হয়ে ছিল, উনি কাউকে কিছু বলেননি।’

একটু নীরব থেকে শর্বরী বলল—‘আমি যাব?’

সত্যপ্রিয় একটু ভেবে বলল—‘না, আজ রাত্তিরটা বাবা যদি ভাল থাকেন, কাল সকালে এস।’

‘আচ্ছা।’

রাত্রি এগারোটার সময় মথুরানাথ বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন, সত্যপ্রিয় খাটের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে তাঁর মুখের পানে চেয়ে ছিল। তিনি চোখ খুলে খুব দুর্বল স্বরে বললেন—‘প্রিয়, আমাকে একটা বড়ি দাও।’

ডাক্তার বলে গিয়েছিলেন বেশী দুর্বল বোধ করলে বড়ি দিতে হবে। সত্যপ্রিয় বড়ি খাইয়ে দিল। মথুরানাথ দশ মিনিট চোখ বুজে শুয়ে রইলেন, তারপর বললেন—‘প্রিয়, আমার কাছে এসে বোসো।’ এবার তাঁর কণ্ঠস্বরে কিছু বলসঞ্চার হয়েছে।

প্রিয় খাটের পাশে বসল। মথুরানাথ তার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন—‘আমার সময় হয়েছে। তোমার জন্মবৃত্তান্ত তোমাকে শোনাতে চাই। মিথ্যের বোঝা বুকে নিয়ে যদি মরি আমার সদ্‌গতি হবে না। তুমি বুদ্ধিমান সাহসী ছেলে, নিষ্ঠুর সত্য তুমি সহ্য করতে পারবে।’

থেমে থেমে আধ ঘণ্টা ধরে মথুরানাথ কাহিনী শোনালেন। কাহিনী শেষ করে বললেন—‘প্রিয়, আইনত তুমি আমার ছেলে, আমি তোমাকে ছেলের মতোই ভালবাসি। আমার যা কিছু আছে সব তোমার। আমি যখন থাকব না তুমি নিজের বুদ্ধিতে যা ভাল বুঝবে তাই করবে।’ ঘড়িতে বারোটা বাজল।—এবার আমি ঘুমোব।’

মথুরানাথ চোখ বুজলেন, আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষ রাত্রে তাঁর ক্লান্ত হৃদ্‌যন্ত্র ঘুমের মধ্যেই থেমে গেল।

মথুরনাথের মৃত্যুর পর কয়েস মাস কেটে গেছে। সত্যপ্রিয়র নেড়া মাথায় চুল গজিয়ে এখন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

কিন্তু নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানার পর তার মনে শর্বরী সম্বন্ধে একটা সংকোচ এসেছে যা বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি দিয়ে দূর করা যাচ্ছে না। শর্বরীকে সে ছাড়তে পারবে না, আবার তার কাছে সত্য গোপন করাও তার পক্ষে অসম্ভব। এ অবস্থায় সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। শর্বরীর সঙ্গে প্রায় রোজই কলেজে তার দেখা হয় কিন্তু সে আড়ষ্ট হয়ে থাকে। যে নিবিড় মানসিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তা আর নেই।

শর্বরী ও মন-মরা হয়ে আছে। হঠাৎ এ কী হলো! যে মানুষ এত কাছে এসেছিল সে আবার দূরে সরে যাচ্ছে কেন? পিতার মৃত্যুতে সত্যপ্রিয় দারুণ আঘাত পেয়েছে, কিন্তু তাতে তো তার আরো কাছে আসার কথা, দূরে সরে যাবে কেন? অশান্ত মন নিয়ে শর্বরী একলা ঘুরে বেড়ায়, অদৃশ্য বেড়া পেরিয়ে সত্যপ্রিয়র কাছে আসতে পারে না।

এইভাবে দিন কাটছে, একদিন দুপুরবেলা সুষমা আবার এসে উপস্থিত হলো। মুখের ভাব বেশ আত্মপ্রসন্ন, মথুরানাথের মৃত্যুর খবর নিশ্চয় জানে।

দোর খুলে সুষমাকে দেখে সত্যপ্রিয়র মুখ কঠিন হয়ে উঠল। এই তার মা! সে রূঢ়স্বরে বলল—‘আবার কি চাও?’

সুষমা থতমত খেয়ে গেল, তারপর বলল—‘আমি দিল্লীতে ছিলুম না, ফিরে এসে শুনলাম তোমার বাবা মারা গেছেন।’

‘তাই সহানুভূতি জানাতে এসেছ! যাও, তোমার মুখ দেখতে চাই না।’

‘আমি তোমার মা। আমি খেতে পাচ্ছি না, তুমি আমাকে আশ্রয় দেবে না। এখন তো আর কোনও বাধা নেই।’

‘তোমার জন্যেই বাবা মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে তিনিই আমাকে সব কথা বলে গেছেন।’

সুষমার চোখ সজল হয়ে উঠল, সে বলল—‘তাহলে তুমি জানো যাকে তুমি বাপ বলে মনে করেছ সে তোমার কেউ নয়।’

সত্যপ্রিয় বলল—‘তিনিই আমার সব, তুমি কেউ নয়। যাও, আর কখনো আমার কাছে এস না।’

সুষমা কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘তুই এত নিষ্ঠুর! মাকে খেতে দিবি না!’

সত্যপ্রিয়র গলার স্বর হিংস্র হয়ে উঠল, সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—‘লম্পটের ঔরসে নষ্ট স্ত্রীলোকের গর্ভে যার জন্ম তার কাছে আর কী প্রত্যাশা কর? এখন যাবে, না রাইমণিকে ডাকব? সে তোমাকে চেনে, উপযুক্ত ব্যবস্থা করবে।’

সুষমা আর দাঁড়াল না।

দোর বন্ধ করে দিয়ে সত্যপ্রিয় নিজের মাথায় কয়েক ঘটি জল ঢালল, ভিজে মাথায় অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল। তারপর উঠে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল।

সন্ধ্যে হয়-হয়, তখন সে মনঃস্থির করে শর্বরীকে টেলিফোনে ডাকল—‘একবারটি আসবে, কিছু কথা আছে।’

কী কথা আছে শর্বরী প্রশ্ন করল না, আগ্রহ-শঙ্কামেশা গলায় বলল—‘আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।’

শর্বরী এলে সত্যপ্রিয় তাকে হাত ধরে বসবার ঘরে নিয়ে গেল, বলল—‘বোসো। চা খাবে? কফি? কোকো?’

শর্বরী মাথা নাড়ল—‘না, কি বলবে আগে বলো।’

সত্যপ্রিয় তার সামনাসামনি চেয়ারে বসে ধীরস্বরে বলল—‘আমি আজ তোমাকে যা বলব তার ওপর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সব কথা মন দিয়ে শোনো, তারপর তোমার মতামত জানিও।’

শর্বরী নীরবে জিজ্ঞাসু চোখে তার পানে চেয়ে রইল, সত্যপ্রিয় নির্লিপ্তকণ্ঠে নিজের বৃত্তান্ত তাকে শোনাল; সুষমা যে সম্প্রতি যাতায়াত করছে এবং তাকে কিভাবে সে তাড়িয়ে দিয়েছে তাও গোপন করল না। যেন নিজের কথা নয়, অন্য কারুর কাহিনী সে বলছে। শর্বরী একটি কথা বলল না, চুপ করে অবহিতচিত্তে যেন ক্লাসে বসে প্রবীণ অধ্যাপকের বিজ্ঞানভাষণ শুনছে এমনিভাবে শুনল।

কাহিনী শেষ করে সত্যপ্রিয় উঠে দাঁড়াল, বলল—‘এই হলো আমার ইতিহাস। এখন তুমি সব দিক ভেবে বলো কী করবে।’

মিনিটখানেক শর্বরী কপালে মুঠি ঠেকিয়ে নতমুখে বসে রইল, তারপর উঠে এসে সত্যপ্রিয়র সামনে এসে দাঁড়াল, তার গলা জড়িয়ে বুকে বুক দিয়ে ঠোঁট তুলে ধরে বলল—‘চুমু খাও।’—

কিছুক্ষণ পরে শর্বরী বলল ‘এখন চলো, মা-বাবা অপেক্ষা করে আছেন। ওঁদের এসব কথা কিছু বলে কাজ নেই। হাজার হোক সেকেলে মানুষ।’

৫ জানুয়ারী ১৯৬৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *