কালসর্পী (ঐন্দ্রজালিক উপন্যাস)
CARLOS (drawing back with amazement) Nay Princess-that’s too much I am betraye’d.–You’re not to be deceived-you are in league With spirits and with demons!
PRINCESS. Are you then surprised at this? What will you wager, Carlos. But I recall some stories to your heart?
CARLOS. Why this is boldly ventured. I accept The wager, Princess. Then you undertake To make discoveries in my secret heart, Unknown e’en to myself.
Schiller–DON CARLOS ACT II:Sc. VIII
উপক্রমণিকা
১
পূজার ছুটী পাইয়া আমি পশ্চিমে বেড়াইতে রওনা হইয়াছি।
রাত্রের গাড়ীতে উঠিয়াছিলাম। মোগলসরাইয়ে আসিয়া ভোর হইল। আমি শেষের দিক্কার একখানা তৃতীয় শ্রেণীর গাড়ীতে উঠিয়াছিলাম। গাড়ীতে পূর্ব্বে দুই ব্যক্তি ছিল, কিন্তু মোগলসরাইয়ে আসিয়া গাড়ীতে আর কেহ রহিল না, আমি মনে মনে সন্তুষ্ট হইলাম। খালি গাড়ীতে একাধিপত্য করিয়া যাইতে পারিলে রেলযাত্রিগণ কেন যে অত্যধিক আনন্দ অনুভব করেন, তাহার কারণ বলা সহজ নহে।
গাড়ী ছাড়ে ছাড়ে এইরূপ সময়ে আর এক ব্যক্তি আসিয়া গাড়ীতে উঠল। আমি তাহাকে দেখিয়া বিরক্তভাবে মুখ বিকৃত করিলাম; কিন্তু উপায় নাই—গাড়ী ত আর আমার একার নহে
লোকটির সঙ্গে একটি ছোট কাঠের বাক্স, তাহার উপরে চামড়ার একটি পেটী বাঁধা, আর একটি চলনসহি চামড়ার ব্যাগ। যাত্রীর সহিত অধিক মাল-পত্র থাকিলে স্বভাবতই রাগ হয়; ইহার সঙ্গে অধিক কিছু নাই দেখিয়া আমি কতকটা আশ্বস্ত হইলাম।
কিন্তু ইহার চেহারা দেখিয়া আমার সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া গেল। স্পষ্টতই দেখিলাম, লোকটা ক্ষয়রোগে একেবারে কঙ্কালসার হইয়াছে—ইহার মৃত্যুর আর অধিক বিলম্ব নাই। শুনিয়াছিলাম, ক্ষয়রোগ বড় সংক্রামক—ক্ষয়রোগীর নিকটে থাকিলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার খুব সম্ভাবনা। আমি মনে মনে স্থির করিলাম, অন্য গাড়ীতে হাজার ভিড় থাকিলেও পরবর্ত্তী ষ্টেশনে এ গাড়ী পরিবর্ত্তন করিয়া অন্য গাড়ীতে গিয়া উঠিব।
বিশেষতঃ লোকটা নিতান্ত অভদ্রের মত—ক্রমান্বয়েই আমার মুখের দিকে চাহিতেছিল। একজন অপরিচিত লোক বিনা কারণে যে মুখের দিকে চাহিবে, ইহা সহ্য করা অসম্ভব—লোকটা এরূপ পীড়িত না হইলে দুই-চারি কথা তাহাকে শুনাইয়া দিতাম। বাঙ্গালী—স্বজাতি—তাহার উপর মৃত্যুমুখগ্রস্ত—এরূপ লোককে কড়া কথা বলা উচিত নহে ভাবিয়া আমি তাহাকে সে যাত্ৰা কিছুই বলিলাম না। পরবর্ত্তী ষ্টেশনের অপেক্ষায় রহিলাম।
গাড়ীর বেগ ক্রমে হ্রাস হইবার উপক্রম করিলে আমি আমার জিনিষ-পত্র গুছাইতে লাগিলাম। গাড়ী থামিলেই নামিয়া গিয়া অন্য গাড়ীতে উঠিব—আর এ গাড়ীতে এক মুহূর্ত্তও নহে।
গাড়ী প্রায় থামে, এই সময়ে সেই ব্যক্তি আমাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, “ভূপেন্দ্রবাবু, আমি আপনাকে দেখিয়াই চিনিয়াছি। দেখিতেছি, আপনি এ গাড়ী হইতে অন্য গাড়ীতে যাইতেছেন, এই গাড়ীতে থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতে পারি কি? বিশেষ কারণ আছে।”
তাহার কথায় আমি মহা বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিলাম, “আপনাকে ঠিক চিনিতে পারিতেছি না, কবে দেখা হইয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”
এই সময়ে গাড়ী দাঁড়াইল। গাড়ী হইতে আমার আর নামা হইল না। একটু পরে আবার গাড়ী ছাড়িয়া দিল। লোকটি বলিল, “ভালই হইল, এ গাড়ীতে কেহ উঠিল না। মনে করিয়া দেখুন দেখি, কোথায় আমায় দেখিয়াছেন? একসময় তিনদিন আপনি আমার বাড়ীতে ছিলেন।”
আমি বিস্মিত হইয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। ইহাকে কোথায় দেখিয়াছি, মনে করিবার জন্য সহস্র চেষ্টা করিতে লাগিলাম। কিন্তু কিছুতেই সে চেষ্টা সফল হইল না; অথচ লোকটা বলিতেছে যে, আমি তাহার বাড়ীতে তিনদিন ছিলাম। বড়ই লজ্জার কথা!
আমি আর কথা কহি না দেখিয়া সে বলিল, “দেখিতেছি; আপনি মনে করিতে পারিতেছেন না। মনে পড়ে কি, গত বৎসর কাশীতে—আমার নাম সুধাংশু – “
আমি বিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, “সুধাংশুবাবু—আপনি সেই সুধাংশুবাবু?”
“হাঁ, ঠিক সেই, আমার চেহারার কি এতই পরিবর্তন হইয়াছে যে, আপনি আমাকে একেবারে চিনিতে পারিতেছেন না।”
“পরিবর্তন! আপনি না বলিলে আপনাকে আমি কখনই সুধাংশুবাবু বলিয়া চিনিতে পারিতাম না।”
২
সত্য কথা বলিতে কি তাঁহার কথা আমার বিশ্বাস হইল না। সুধাংশুবাবু সুপুরুষ যুবক, বলিষ্ঠ, বলবান, কাশীর মধ্যে একজন ধনাঢ্য লোক। তিনদিন তিনি আমাকে ‘রাজার হালে’ তাঁহার বাড়ীতে রাখিয়াছিলেন, আর এই জীর্ণ-শীর্ণ কঙ্কালসার সেই সুধাংশু বাবু? অসম্ভব!
আমি বলিলাম, “আপনি যদি সুধাংশুবাবু হন, তাহা হইলে আপনার এ অবস্থা হইল কিরূপে?”
“সে অনেক কথা, সেই কথা বলিবার জন্যই আপনাকে গাড়ীতে রাখিয়াছি। আপনি ভাবিতেছেন, আমার মৃত্যুর আর বিলম্ব নাই—সে কথা ঠিক; আপনি ভাবিতেছেন—আমার ক্ষয়রোগ হইয়াছে, সেটা ঠিক নয়। মরিবার জন্য পীড়ার প্রয়োজন হয় না।”
আমি বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম; কি বলিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না।
তিনি বলিলেন, “আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।”
আমি বলিলাম, “কি, বলুন।”
তিনি ব্যাগটা তুলিয়া লইয়া একতাড়া কাগজ বাহির করিলেন, তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “ইহাতে যে বৃত্তান্ত আছে, সেরূপ অদ্ভুত বৃত্তান্ত বোধ হয়, জগতে আর নাই; তবে আমার জীবদ্দশায় প্রচার করা যায় না; বিশেষ কারণ না থাকিলে এ কথা বলিতাম না। এখন আপনাকে অনুরোধ করি, আপনি অঙ্গীকার করুন যে, আমার মৃত্যুর পরে আপনি ইহা প্রকাশ করিবেন।”
আমি বলিলাম, “আপনি ত বুঝিতেই পারেন যে, ইহাতে কি আছে, না জানিয়া-শুনিয়া আমি ইহা প্রকাশ করিতে পারি না।”
“অবশ্যই আপনি ইহা পড়িবেন। উপস্থিত আমি বলিতেছি যে, ইহা প্রকাশ করা সম্বন্ধে আপত্তিজনক কিছুই নাই। এখন অঙ্গীকার করুন।”
“এক সময়ে আপনি আমাকে যথেষ্ট যত্ন-আপ্যায়িত করিয়াছিলেন। আমি আপনার জন্য যথাসাধ্য করিব।”
“আমি ইহাতেই সন্তুষ্ট রহিলাম। সময়ে এ কাগজ আপনাকে পাঠাইয়া দিব। এখন কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিব, প্রকৃত উত্তর দিবেন।”
“কি জিজ্ঞাসা করিবেন, বলুন।”
“আপনি কি মনে করেন যে, আমার মস্তিক বিকৃত হইয়াছে?”
এই অত্যদ্ভুত প্রশ্নে আমি বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। এটা স্থির, লোকটা আর যাহাই হউক, পাগল নহে। আমি কতকটা তাহার সন্তোষের জন্য বলিলাম, “আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস, আপনার মস্তিষ্ক বিশেষ সুস্থ অবস্থায় আছে।”
শুনিয়া সুখী হইলাম, এক সময়ে আপনি আমাকে একজন ভয়ানক উন্মত্ত ভাবিতে পারেন।”
আমি তাঁহার কথার কোনই ভাবার্থ গ্রহণ করিতে পারিলাম না। কি বলিব, তাহাও স্থির করিতে পারিলাম না।
সে বলিল, “দেখিতেছি, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না। ভাল, আপনি কতদূর যাইতেছেন?”
“অনেকদূর—পঞ্জাব পৰ্য্যন্ত।”
“তাহা হইলে রাত্রেও গাড়ীতে থাকিবেন?”
“অগত্যা।”
“আমার এই চেহারা এখন যেরূপই হউক, রাত্রের মধ্যে আপনি দেখিবেন যে, আমি পূর্ব্বরূপ সবল, বলিষ্ঠ যুবাপুরুষই আছি। এখন এই পর্য্যন্ত থাক্—একটু বিশ্রাম করি।”
এই বলিয়া সে আপাদমস্তক বস্ত্রাচ্ছাদিত করিয়া সম্মুখস্থ বেঞ্চে লম্বাভাবে শয়ন করিল। অগত্যা আমিও শয়ন করিলাম। তখন গাড়ী তীরবেগে ছুটিতেছে।
.
কখন আমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, তাহা ঠিক জানি না। যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিল, তখন দেখিলাম, রাত্রি হইয়াছে, আমাদের গাড়ীর উপরে আলো জ্বলিতেছে। তাহার পর যাহা দেখিলাম, তাহা কেহই বিশ্বাস করিবে না। আমার মনেও সন্দেহ হয়, তবে জাগ্রত, সজ্ঞান অবস্থায় নিজের চোখে দেখিয়াছিলাম বলিয়াই বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইয়াছি।
আমি উঠিয়া প্রথমে সুধাংশুবাবুর দিকে দৃষ্টিপাত করি নাই। কোন ষ্টেসনের কাছে আসিয়াছি, তাহাই দেখিবার জন্য জানালা দিয়া মুখ বাড়াইলাম; তৎপরে কিছু স্থির করিতে না পারিয়া গাড়ীর ভিতরে মুখ ফিরাইলাম। তাহার পর যাহা দেখিলাম, তাহাতে বিস্মিত, স্তম্ভিত ও ভীত হইয়া বেঞ্চের উপরে বসিয়া পড়িলাম।
পূর্ব্বে যাহাকে জীর্ণ-শীর্ণ, কঙ্কালসার, বিবর্ণ, ক্ষয়রোগগ্রস্ত দেখিয়াছিলাম, সে এখন আর তাহা নাই। এ সেই পূর্ব্বের সুপুরুষ বলিষ্ঠ যুবক সুধাংশুবাবু—সাক্ষাৎ সুধাংশু—এখনও তাঁহার চেহারা আমার মনে স্পষ্ট জাগরুক ছিল, এ সেই সুধাংশুবাবু? কি আশ্চৰ্য্য!
৩
কিয়ৎক্ষণের জন্য আমার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল—মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। ক্ষণপরে আমি সহসা বলিয়া উঠিলাম, “একি পৈশাচিক ব্যাপার—ভৌতিক কাণ্ড!”
সুধাংশুবাবু বলিলেন, “পূৰ্ব্বেই ত আপনাকে বলিয়াছিলাম যে, ক্ষয়রোগ আমার নাই।”
এই বলিয়া তিনি হাসিলেন, সেরূপ হাসি আমি আর কখনও শুনি নাই; শুনিয়া আমার প্রাণ শিহরিয়া উঠল। পিশাচের হাসি কিরূপ, তাহা জানি না, তবে বোধ হয়, এই সেই পৈশাচিক হাসি!
তাহার পর তাঁহার চক্ষু যেভাবে আমার দিকে চাহিয়াছিল, তাহাতে প্রকৃতই আমার ভয় হইল। একদিন রাত্রে এক গোখুরা সাপের চক্ষু জ্বলিতে দেখিয়াছিলাম—তাঁহার চক্ষু ঠিক সেইরূপ জ্বলিতেছে। আমি মুগ্ধের ন্যায় তাঁহার দিকে অবাঙ্মুখে চাহিয়া রহিলাম।
সুধাংশুবাবু বলিলেন “এখন দেখিলেন, আমি সেই সুধাংশুই আছি—তবে সে অন্য কথা, পিশাচ বিশ্বাস করেন?”
আমি সবেগে বলিলাম, “আমি কিছুই বিশ্বাস করি না।”
“ভাল, কিছু দেখিতে চাহেন?”
“না—না–রক্ষা করুন—”
“তাহা হইলে আপনি দেখিতে চাহেন না?”
“না।”
“কেন?”
“না, আমার কিছুই দেখিবার ইচ্ছা নাই।”
“অনেক জ্ঞান লাভ হইত।”
“আমার অধিক জ্ঞানে প্রয়োজন নাই।”
“অঙ্গীকার ভুলিবেন না।”
“পরে দেখিব।”
সুধাংশুবাবু আর কোন কথা কহিলেন না; আমিও আর তাঁহার দিকে চাহিলাম না। না চাহিয়া জানালার দিকে চাহিয়া রহিলাম। প্রকৃত কথা বলিতে কি—এই লোকের সহিত একাকী গাড়ীতে থাকিতে আমার অত্যন্ত ভয় হইতেছিল। লোকটা আমার চোখের উপরে দুই রকম মূৰ্ত্তি ধারণ করিল, ইহার হাসি ভয়ানক—চক্ষু ভয়ানক! পরবর্ত্তী ষ্টেসনেই আমি নামিয়া পড়িব, স্থির করিলাম। আর এ গাড়ীতে—বাপ্!
গাড়ীর বেগ কমিলে আমি সত্বর আমার দ্রব্যাদি গুছাইয়া লইলাম। গাড়ী থামিবার অব্যবহিত পূর্ব্বে সুধাংশু ক্ষুদ্র কাঠের বাক্সটি নিজের কোলের উপরে রাখিয়া তাহার চাবী খুলিল। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিল, “ভূপেন্দ্রবাবু, বোধ হয়, এই বাক্সে কি আছে দেখিতে গেলেও আপনি ষ্টেসনে নামিবার যথেষ্ট সময় পাইবেন—এই দেখুন।”
এই বলিয়া সুধাংশু বাক্সের ডালাটা খুলিল—আমি লম্ফ দিয়া কয়েক পদ সরিয়া দাঁড়াইলাম। আমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়া উঠিল, প্রাণের ভিতরে প্রাণ শিহরিয়া উঠিল।
বাক্সের ভিতরে এক বৃহৎ কৃষ্ণসৰ্প গুটাইয়া গুটাইয়া রহিয়াছে। বাক্সের ডালা খুলিতে সাপ ধীরে ধীরে মাথা তুলিয়া আমার দিকে চাহিল, ঠিক এই দৃষ্টি সুধাংশুবাবুর চোখে!
লাফাইয়া আমি গাড়ী হইতে নামিলাম। সমস্ত দ্রব্যাদি নামাইলাম কিনা জানি না। এক মুহূর্ত্তে আমি গলদঘর্ম্ম হইয়া উঠিলাম।
সৌভাগ্যক্রমে এই সময়ে গাড়ী ছাড়িয়া দিল—সুধাংশু তাহার কালসর্পসহ দিল্লীর দিকে চলিয়া গেল।
বহুদিন আমি তাহার কথা ভুলিতে পারিলাম না। সহস্র চেষ্টা করিলেও সেই ভয়াবহ দেহের পরিবর্তন ও সেই ভয়াবহ হাসি—অধিকন্তু ভয়াবহ চক্ষু আমার মানসপটে উদয় হইতে লাগিল। অনেকদিন রাত্রে আমি এক মুহূর্ত্তের জন্য চক্ষু মুদিত করিতে পারিতাম না।
.
এই ঘটনার পর প্রায় ছয়মাস কাটিয়া গেল—আমি প্রায় সুধাংশুবাবুর কথা ভুলিয়া গিয়াছি, এই সময়ে আমার কলিকাতার বাড়ীর ঠিকানায় ডাকে একতাড়া কাগজ ও একখানি পত্র পাইলাম। পত্রখানি সুধাংশুবাবুর। সে লিখিয়াছে;
“প্রিয় ভূপেন্দ্রবাবু,
আর সময় নাই, শেষ সময় হইয়া আসিয়াছে, সেইজন্য কাগজগুলি পাঠাইলাম। ভাল করিয়া আদ্যোপান্ত পড়িলে, যদি বিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয় করিবেন-অবিশ্বাস করিতে ইচ্ছা হয়, তাহাতেও আপত্তি নাই। তবে আপনার অঙ্গীকার আপনি ভুলিবেন না—তাহা আমি জানি। শীঘ্রই আপনি আমার মৃত্যু সংবাদ পাইবেন। তাহার পর ইহা ছাপাইবেন। ছাপিবার খরচ জন্য যে টাকা লাগিবে, তাহাও আমি ইহার সহিত পাঠাইলাম। এক বৎসর পূর্ব্বে যখন আমরা কাশীতে একত্রে আমোদ প্রমোদ করিয়াছিলাম, তখন কে জানিত, এত শীঘ্র এই ঘটনা ঘটিবে?
আপনার অনুগত
সুধাংশু।
রাত্রে কাগজগুলি পড়িব স্থির করিয়া বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিলাম।
বলা বাহুল্য, যথা সময়ে আমি সুধাংশুবাবুর কাগজগুলি আদ্যোপান্ত পাঠ করিলাম। পাঠ করিয়া একেবারে বিস্মিত হইয়া গেলাম! বিশ্বাস করিয়াছি কিনা বলিতে পারি না। তাহার নিকটে অঙ্গীকার করিয়াছিলাম বলিয়া, আমি ইহা প্রকাশ করিলাম। অপরে ইহা বিশ্বাস করিবে না, ইহাই আমার অনুমান।
প্রথম পরিচ্ছেদ
আমার নাম সুধাংশুকুমার মিত্র—কাশীতে আমার পিতা একজন সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন। তাঁহার অর্থের অভাব ছিল না, দান-ধ্যানও যথেষ্ট ছিল। আমি তাঁহার একমাত্র পুত্র।
সহসা পিতার মৃত্যু হইল। অল্প বয়সেই আমার হাতে অতুল সম্পত্তি আসিয়া পড়িল। পিতা আমাকে বিশেষ যত্নে লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন; সুতরাং আমার হাতে অর্থের অপব্যবহার হইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না।
পিতা আমার বিবাহ দিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার বিশেষ বন্ধু নরোত্তমবাবুর একমাত্র কন্যার সহিত আমার বিবাহ দিবেন, স্থির করিয়াছিলেন; কিন্তু হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার সে ইচ্ছা পূর্ণ হইল না; কিন্তু নরোত্তমবাবুর কন্যার সহিত আমার বিবাহ স্থির রহিল। কালাশৌচ উত্তীর্ণ হইলেই বিবাহ হইবে; কিন্তু ভগবান্ আমার অদৃষ্টে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তখন তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই।
পিতার শ্রাদ্ধাদি চুকিয়া গেলে কৃতান্ত হঠাৎ একদিন আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কৃতান্তের সহিত আমি এক সময়ে এক স্কুলে পড়িতাম। সকল ছেলে অপেক্ষা তাহার সহিত আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। সত্য সত্যই তাহাকে আমি একমাত্র বন্ধু বিবেচনা করিতাম।
স্কুলে থাকিতে থাকিতেই সহসা একদিন কৃতান্ত নিরুদ্দেশ হইয়াছিল। সে কোথায় গেল, কেহ আর তাহার কোন সন্ধান পাইল না। তবে অনেকে বলিল যে, সে এক সন্ন্যাসীর সহিত চলিয়া গিয়াছে।
যাহাই হউক, সাত-আট বৎসর আমি তাহার কোন অনুসন্ধান পাইলাম না। সে নিরুদ্দেশ হওয়ায় আমি হৃদয়ে প্রকৃতই বেদনা পাইয়াছিলাম।
হঠাৎ একদিন কৃতান্ত ফিরিয়া আসিল। ভোরে উঠিয়া আমি বাড়ীর সম্মুখে বেড়াইতেছি, এই সময়ে সে আমার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার বেশ ছিন্ন মলিন, দেখিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, সে অনেক দারিদ্র্য-কষ্ট পাইয়াছে। তাহার অবস্থা দেখিয়া আমার প্রাণে বড়ই কষ্ট হইল। চোখে জল আসিল, আমি কেবলমাত্র বলিলাম, “কৃতান্ত!”
সে মৃদুহাস্য করিয়া বলিল, “হাঁ, কৃতান্ত—চিনিতে পারিলে? আমি ভাবিয়াছিলাম, তুমি আমায় চিনিতে পারিবে না।”
আমি বলিলাম, “এ কথা তোমার বলা উচিত নহে—এস।”
আমি তাহার হাত ধরিয়া তাহাকে গৃহে আনিলাম। বলিলাম, “এতদিন কোথায় ছিলে?”
সে বলিল, “পরে বলিব।”
আমি আর তাহাকে তখন কিছুই জিজ্ঞাসা করিলাম না। আমার কাপড় জামা জুতা তাহাকে পরাইলাম; তাহার পর তাহাকে আহারাদি করাইলাম।
আমি জানিতাম, কাশীতে তাহার এক বৃদ্ধা ঠাকুর-মা ছিলেন। কৃতান্ত তাঁহারই নিকটে ছিল—তিনিই তাহার সমস্ত খরচ-পত্র দিতেন, কৃতান্ত নিরুদ্দেশ হইলে সেই শোকে তাঁহার মৃত্যু হয়; সুতরাং এখন আর কৃতান্তের যাইবার অন্য স্থান ছিল না।
সে-ও কোথাও যাইবার নাম করিল না, সেই পৰ্য্যন্ত সে আমার বাড়ীতে রহিল, আমি যেরূপ ভাবে থাকিতাম, কৃতান্তকে ঠিক সেইরূপ রাখিলাম।
এইরূপে একমাস কাটিয়া গেল। আমি প্রায়ই তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতাম, সে এতদিন কোথায় ছিল, কাহার সহিত গিয়াছিল। সে কেবলই বলিত, “বলিব—পরে বলিব।”
একদিন সে আমাকে বলিল, “ভাই, তোমার গলগ্রহ হইয়া থাকা আমার ইচ্ছা নহে— ইহারই মধ্যে লোকে আমায় নিন্দা করিতেছে। তোমার ত অনেক কাজ-কৰ্ম্ম, আমি লেখাপড়া শিখিয়াছি, আমার গতর আছে, অনর্থক বসিয়া বসিয়া তোমার খাই কেন? তোমাদের কত লোকজন রহিয়াছে, তাহাদেরই মত আমাকে একটা চাকরী দাও, তাহা হইলে তোমার কাছে থাকিতে পারিব; অথচ অনর্থক তোমার গলগ্রহ হইতে হইবে না।”
প্রথম আমি তাহার এ প্রস্তাব হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম; কিন্তু সে প্রত্যহই জেদাজিদি করিতে লাগিল। অবশেষে আমি বাধ্য হইয়া তাহাকে আমার কাজ-কর্ম্ম দেখিবার জন্য পঞ্চাশ টাকা মাহিনার এক চাকরী দিলাম।
তখন সে বলিল, “এখন তুমি আমার মনিব হইলে, এখন তোমার মত একভাবে তোমার বাড়ীতে আমার থাকা ভাল দেখায় না, লোকেই বা কি বলিবে? তোমার বাড়ীর পাশের ছোট বাড়ীটায় আমায় থাকিতে দাও, তাহা হইলে সর্ব্বদাই তোমার কাছে থাকিতে পাইব।”
আমি তাহার এ কথায়ও প্রথমে কান দিলাম না, কিন্তু তাহার পীড়া-পীড়িতে আমি অবশেষে ইহাতেও সম্মত হইলাম। কৃতান্ত সেইদিনই তাহার নূতন বাসায় গিয়া উঠিল।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এইরূপে আরও এক মাস কাটিয়া গেল। কৃতান্ত আমার কাজকর্ম্ম বিশেষ মনোযোগের সহিত করিতে লাগিল। আমি তাহার কার্য্যে দিন দিন বড়ই সন্তুষ্ট হইতে লাগিলাম। সে প্রকৃতই আমার কাজ, নিজের কাজ মনে করিয়া করিতে লাগিল।
একদিন আমার বৃদ্ধ ভৃত্য রঘুনন্দন সন্ধ্যার সময় আমার ঘরে আলো দিতে আসিয়া—বাহির হইবার সময় থপ্ করিয়া দ্বারের বাহিরে বসিয়া পড়িল। আমি তাহাকে কিছুই বলিলাম না। ক্ষণপরে সে নিজেই বলিল, “বাবুসাহেব, একটা কথা বলিব।”
“কি রঘুনন্দন, এমন কথা কি?”
“কৃতান্তবাবু—” বলিয়া রঘু থামিয়া গেল।
“কৃতান্তবাবু—কি হয়েছে?”
“কৃতান্তবাবু—বলিব কি?” আবার রঘু থামিল।
“বল না শুনি।”
“কৃতান্তবাবু—কৃতান্তবাবুর মাথা—মাথা – ঠিক আছে কি?” জড়াইয়া জড়াইয়া কথাটা শেষ করিয়া রঘুনন্দন আমার মুখের দিকে চাহিল।
আমি হাসিয়া উঠিলাম; বুঝিলাম, রঘুনন্দন ইহাতে বিরক্ত হইল। আমি হাসি থামাইয়া বলিলাম, “কিসে বুঝিলে, রঘুনন্দন?”
“বাবু সাহেব আবার হাসিবেন।”
“আরে না, আর আমি হাসিব নাকি হইয়াছে, বল।”
“হয় ত বিশ্বাস করিবেন না।”
“বিশ্বাস করিব—বল।”
“কৃতান্তবাবুর কাছে একটা সাপ আছে।”
আমি প্রকৃতই বিশেষ বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলাম, “কি আছে?”
“একটা সাপ আছে।”
“সে কি, রঘুনন্দন?’
“সত্যই বাবুসাহেব, আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।”
“কি দেখিয়াছ; সব বল।”
প্রকৃতই আমি প্রথমে রঘুনন্দনের কথায় হাসিব মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু বুঝিলাম যে, এ বিষয়টা হাসিবার নহে—গুরুতর কিছু।
আমি পুনরপি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি দেখিয়াছ, সব বল।”
“বিশ্বাস করিবেন না।”
“বিশ্বাস করিব—বল।”
“কৃতান্তবাবুর কাছে একটা ভয়ানক সাপ আছে।”
“কোথায়?”
“বোধ হয়, একটা বাক্সে।”
“কাল রাত্রে—অনেক রাত্রে তাঁহার বাড়ীতে গিয়াছিলাম।”
“তার পর?”
“দেখি—এখনও ভাবিলে ভয় হয়। দেখি, সেই সাপটা তাঁহার সর্ব্বাঙ্গে জড়াইয়া ধরিয়া তাঁহার সহিত খেলা করিতেছে, সে রকম চোখ আর আমি কোথাও দেখি নাই; কৃতান্তবাবুর চোখেও ঠিক সেই রকম—এমন ভয়ানক চোখ আর কখনও দেখি নাই।”
“তার পর?”
“তার পর এই—বলিতে ভয় হয়, তিনি আপনার বন্ধু—”
“তাহা হউক, বল শুনি।”
“রাগ করিবেন না?”
“না, বল।”
“তিনি ভাল লোক নন্।”
“কিসে জানিলে?”
“তাহা ঠিক বলতে পারি না, তবে ইনি ভাল লোক নন্।”
“আচ্ছা, এখন যাও।”
রঘু আর কোন কথা না বলিয়া চলিয়া গেল। সেইদিন হইতে আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও কৃতান্তের বিষয় মনে উদিত হইতে লাগিল। কৃতান্ত এখানে আসা পৰ্য্যন্তই আমি তাহার কথা ভাবিতেছি। বাল্যকালে তাহাকে যেরূপ দেখিয়াছিলাম, এখন আর সে ঠিক সে লোক নাই, তবে সহসা তার এ পরিবর্ত্তন কেহই বুঝিতে পারে না। তাহার ভাব-ভঙ্গিতে সকলে তাহাকে ভাল লোক বলিয়াই জানিত।
এই ঘটনার পরদিবস যাহা ঘটিল, তাহাতে আমার জীবনের এক ঘোরতর পরিবর্ত্তন সংঘটিত হইল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাত্রি তখন নয়টা বাজিয়াছে। আমি আহারাদি করিতে যাইব মনে করিতেছি, এই সময়ে আমার ভাবী-শ্বশুর মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এত রাত্রে তাঁহাকে দেখিয়া, আমি বিস্মিত হইয়া সত্বর উঠিয়া তাঁহাকে সমাদরে বসিতে অনুরোধ করিলাম; কিন্তু তিনি বসিলেন না। তাঁহার গাম্ভীর্য্যে ও বিষণ্ণ ভাবে আমি প্রকৃতই চিন্তিত হইলাম। বুঝিলাম, গুরুতর কি একটা ঘটিয়াছে। আমি কোন কথা কহিলাম না; ভাবিলাম, তিনিই আগে কথা কহিবেন। তাহাই হইল, তিনি অতি গম্ভীরমুখে বলিলেন, “সুধাংশু, আমি বিশেষ দুঃখিত হইয়াছি।”
আমি বলিলাম, “কি জন্য?”
“তুমি কি তাহা জান না?”
“আমি কিরূপে জানিব?”
“অধিক কথা কহিয়া অসন্তোষ বৃদ্ধি করিয়া কোন ফল নাই—মোট কথা, তোমার পিতার অনুরোধসত্ত্বেও আমি আমার কন্যার সহিত এখন আর তোমার বিবাহ দিতে পারি না।”
এ কথায় সহসা আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হইল। আমি তাঁহার কন্যাকে বড়ই ভালবাসিতাম; সুতরাং এ সম্বন্ধে আমি হৃদয়ে বড়ই বেদনা পাইলাম। সহসা তিনি কেন এ কথা বলিতেছেন, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া বিশেষ চিন্তিত হইলাম। আমার কণ্ঠ হইতে বাক্যস্ফুরণ হইল না। ক্রোধে আমার সর্ব্বাঙ্গ কম্পিত হইতেছিল।
তিনি বলিলেন, “তোমাকে বলা উচিত বলিয়াই বলিলাম। তুমি বাপু, বিবাহের অন্য বন্দোবস্ত করিয়ো।”
এই বলিয়া তিনি গমনে উদ্যত হইলেন। আমি আর আত্মসংযমে সক্ষম হইলাম না; বলিয়া উঠিলাম, “আপনি কি জন্য হঠাৎ এ কথা বলিতেছেন, তাহা না বলিলে আমি আপনাকে যাইতে দিব না।”
তিনি বিস্মিতভাবে ফিরিলেন। গম্ভীর মুখে বলিলেন, “সে কথা বলিলে তুমি সুখী হইবে না।”
আমি জেদ করিয়া বলিলাম, “না হই না হইব, তথাপি আমি শুনিতে চাহি।”
তিনি আরও গম্ভীর হইয়া কহিলেন, “আমি বলিতে বাধ্য নহি।”
আমি উত্তেজিত স্বরে কহিলাম, “নিশ্চয়ই বাধ্য। বাবা থাকিতে আপনার কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহ স্থির রহিয়াছে। আমার সন্বন্ধে কোন গুরুতর অপবাদ বা নিন্দা না শুনিলে আপনি কখনই বিবাহ ভাঙ্গিয়া দিতেন না; সুতরাং কেন আপনি এখন এ বিবাহ দিতে অসম্মত হইতেছেন, আমি শুনিতে চাই।”
“শুনিলে কষ্ট হইবে মাত্র।”
“তাহা হউক।”
“তোমার চরিত্র সম্বন্ধে আমি গুরুতর কথা শুনিয়াছি।”
“কে বলিয়াছে?”
“লোকের নাম আমি করিব না।”
“এ আপনার বড় অন্যায়।”
আমরা এত উচ্চকণ্ঠে কথা কহিতেছিলাম যে, বাহির হইতে কেহ শুনিলে তাহার স্পষ্টই অনুমিত হইত, আমাদের মধ্যে কোন কারণে একটা বিশেষ কলহ হইতেছে। অবশেষে তিনি আর কোন কথা না কহিয়া, দ্রুতপদে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। আমি তাঁহার পথরোধ করিতে পারিলাম না।
আমি স্তম্ভিতপ্রায় বসিয়া পড়িলাম। কতক্ষণ আমি এই ভাবে বসিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। পরে সহসা কাহার আর্তনাদে আমি চমকিত হইয়া দণ্ডায়মান হইলাম। আমার বাড়ীর সম্মুখে বিস্তৃত উদ্যান ছিল, উদ্যান উত্তীর্ণ হইয়া গিয়া সদর গেট—আমার স্পষ্ট বোধ হইল, কোন লোক সেই গেটের নিকটে আর্তনাদ করিয়া উঠিল। আমি কান পাতিয়া শুনিতে লাগিলাম; কিন্তু আর কোন শব্দ পাইলাম না।
তখন আমার মনে হইল, আমার ভাবী-শ্বশুর মহাশয় এইমাত্র এখান হইতে গিয়াছেন, তাঁহার কিছু হয় নাই ত? আমি তৎক্ষণাৎ গেটের দিকে ছুটিলাম, কিন্তু অন্ধকারে প্রথমে কিছুই দেখিতে পাইলাম না। পরে এক স্থানে কে পড়িয়া আছে, দেখিলাম। তখন তাঁহার নিকটে গিয়া দেখি, যথার্থই আমার ভাবী-শ্বশুর মহাশয় অজ্ঞান অবস্থায় পড়িয়া আছেন—তাঁহার মস্তকে গুরুতর আঘাত লাগিয়াছে—দেখিলেই স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়, কে পশ্চাৎ হইতে তাঁহার মস্তকে লগুড়াঘাত করিয়াছে।
আমি কি করিব-না-করিব ভাবিতেছি, এই সময়ে নিকটে পদশব্দ শুনিলাম। ফিরিয়া দেখি, আমার একজন দ্বারবান্, তৎপশ্চাতে কৃতান্ত।
কৃতান্ত আমাকে দেখিয়াই বলিয়া উঠিল, “ব্যাপার কি?”
আমি বলিলাম, “এই ত এখানে ইঁহাকে দেখিতেছি। বোধ হয়, মাথায় গুরুতর আঘাত পাইয়া অজ্ঞান হইয়াছেন।”
কৃতান্ত গম্ভীরমুখে কহিল, “তাহাই ত–কে এ কাজ করিল?”
আমি বলিলাম, “কেমন করিয়া বলিব—হঠাৎ শব্দ শুনিয়া ছুটিয়া আসিয়া দেখি, এই ব্যাপার—আর কাহাকেও দেখিতে পাই নাই।”
হতাশ হইয়া কৃতান্ত কহিল, “এখন উপায়?”
আমি বলিলাম, “চল, ধরাধরি করিয়া ইহাকে বাড়ীতে লইয়া যাই।” তৎপরে দ্বারবানের দিকে ফিরিয়া বলিলাম, “এখনই ডাক্তার বাবুকে ডাকিয়া আন।”
সে তখনই ডাক্তার ডাকিতে ছুটিল, আমি ও কৃতান্ত উভয়ে তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া বাড়ীর ভিতরে আনিয়া শয়ন করাইলাম।
কৃতান্ত তাঁহার মস্তক দেখিয়া বলিয়া উঠল, “তাই ত, কি সৰ্ব্বনাশ! মাথার খুলিটা একেবারে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে—বোধ হয়, রক্ষা পাইবার আর আশা নাই!”
আমি কোন কথা কহিতে পারিলাম না; ব্যাকুলভাবে চাহিয়া রহিলাম। কৃতান্ত বলিল, “আর এক মিনিট দেরী করা নহে—দেখি, ডাক্তারবাবু আসিলেন কি না।”
সে যাইবামাত্র, আমার মনে একটা কথা উদিত হইল এবং তৎক্ষণাৎ সেইরূপ কাৰ্য্য করিলাম। কেন করিলাম, তাহা বলিতে পারি না। আমি সত্বর মূর্ছিতের পকেটে হাত দিলাম; দেখিলাম, পকেটে কেবল মাত্র একখানি পত্র রহিয়াছে, আমি সত্বর সেই পত্র নিজের পকেটে রাখিলাম। এই সময়ে ডাক্তারবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
তিনি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে—ব্যাপার কি?”
আমি যাহা জানিতাম, তাহা তাঁহাকে বলিলাম, তিনিও তাঁহাকে বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলেন।
“আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন দেখিতেছেন?”
ডাক্তার দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। আমি আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেমন দেখিলেন?”
ডাক্তার অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “ইনি মারা—”
আমি ভীতভাবে বলিয়া উঠিলাম, “মারা গিয়াছেন?”
“হাঁ, কেহ পশ্চাদ্দিক্ হইতে গুরুভার লাঠীর দ্বারা ইঁহার মস্তকে আঘাত করিয়াছে, সেই আঘাতে ইঁহার মাথার খুলি ভাঙ্গিয়া মস্তিষ্ক আলোড়িত হইয়াছে, সেই আঘাতে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হইয়াছে।”
“তাহা হইলে ইনি খুন হইয়াছেন?”
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”
“ইঁহার বাড়ীতে সংবাদ দেওয়া উচিত?”
“নিশ্চয়ই—বিলম্ব করিবেন না।”
কৃতান্ত বলিল, “আমি ছুটিয়া গিয়া খবর দিতেছি।”
আমি কিছু বলিবার পূৰ্ব্বেই সে দ্রুতপদে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেল।
ডাক্তারবাবু বলিলেন, “তাহা হইলে আমার এখানে আর অপেক্ষা করা বৃথা।”
আমি ব্যাকুলভাবে বলিলাম, “না—না—একটু অপেক্ষা করুন—ইঁহার লোকজন সব আসুক।”
তিনি দাঁড়াইয়া রহিলেন; আমিও নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলাম। আমার কথা কহিতে সাহস হইল না।
কিয়ৎক্ষণ পরে অনেক লোকজন আসিয়া পড়িল। তাহারা খাটসুদ্ধ তাঁহাকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া গেল; আমি কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
আমার জীবনের সুখ চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়াছে। সেই রাত্রি হইতেই পুলিস এই খুনের অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছে। যেখানে দেহ পাওয়া গিয়াছিল, ইনস্পেক্টর তাহা বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছেন। আমার ভৃত্যদিগকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, অবশেষে তিনি আমাকে লইয়া পড়িলেন।
তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কখন তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছিলেন? ঠিক কোন্ সময়?”
“তখন রাত্রি প্রায় নয়টা।”
“কতক্ষণ কথাবার্তা হইয়াছিল?”
“বোধ হয়, পনের মিনিট।”
“তাহার পর তিনি চলিয়া গেলেন?”
“হাঁ।”
“তাহার পর কি হইল?”
যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, আমি সমস্তই তাঁহাকে বলিলাম। তিনি নীরবে শুনিলেন, তৎপরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সে সময়ে আপনাদের দুইজনে ঝগড়া হইয়াছিল?”
“ঝগড়া ঠিক বলিতে পারি না।”
“আপনার চাকরেরা বলে যে, আপনার বিবাহ লইয়া আপনারা দুই জনেই খুব চীৎকার করিয়া কথা কহিয়াছিলেন।”
“হাঁ—তাহা ঠিক—তবে—”
“ইহাকে আপনি কি বলেন?”
“ঠিক ঝগড়া হয় নাই।”
“বচসা হইয়াছিল?”
“কতকটা সেই রকম?”
“আপনার সঙ্গে তিনি তাঁহার কন্যার বিবাহ দিতে অসম্মত হইয়াছিলেন?”
“হ্যাঁ, এরূপ তিনি বলিয়াছিলেন।”
“আপনি তাঁহার কন্যাকে বিবাহ করিতে ব্যগ্র?”
“বরাবর এ বিবাহ স্থির ছিল।”
“ইনি এখন আপত্তি করিতেছিলেন, সুতরাং ইহার মৃত্যুতে আপনার বিবাহের আর কোন বিঘ্ন রহিল না।”
ইনস্পেক্টরের এই কথায় প্রথমে আমার মনে হইল—কি ভয়ানক! তাহা হইলে ইহারা আমাকেই খুনী স্থির করিয়াছে—আমার মুখে আর কথা সরিল না। আমার সর্ব্বাঙ্গের রক্ত যেন জল হইয়া গেল। আমার ভীতভাবে আমার উপকার না হইয়া অনুপকার হইল, আমার উপরে সন্দেহ আরও বৃদ্ধি পাইল।
ইনস্পেক্টর মৃদুহাস্য করিয়া পশ্চাদ্বর্ত্তী পাহারাওয়ালাকে কি বলিলেন, সে তাঁহার হস্তে একগাছি লাঠী দিল। তিনি লাঠীখানি আমার সম্মুখে ধরিয়া বলিলেন, “এ লাঠী কাহার চিনিতে পারেন?”
আমি বলিয়া উঠিলাম, “আমার লাঠী—আপনি কোথায় পাইলেন?”
তিনি মৃদুহাস্য করিয়া বলিলেন, “যেখানে আপনার ভাবী শ্বশুর মহাশয় আহত হইয়াছিলেন।”
আমার কণ্ঠরোধ হইয়া গেল, আমি কোন কথা কহিতে পারিলাম না।
“কাল দেখা হইবে,” বলিয়া ইনস্পেক্টর বিদায় হইলেন। আমি দেখিলাম, তিনি আমার দরজায় পাহারা বসাইয়াছেন। তিনি চলিয়া গেলেও দুইজন কনেষ্টবল আমার দরজায় পাহারায় রহিল।
এ অবস্থায় মানুষের মনের ভাব কি হইতে পারে, তাহা বর্ণনা করিবার চেষ্টা করা বৃথা। আমার দুঃখ কষ্ট কি কোন অভাব ছিল না প্রকৃতপক্ষে আমার মত কেহ সুখী ছিল না—আর এখন এ ত্রিসংসারে বোধ হয়, আমার মত দুঃখী আর কেহ নাই।
কেমন আপনা আপনি আমার মনে কৃতান্তের কথা উদিত হইল। সে যেদিন আমার বাড়ী আসিয়াছে, সেইদিন হইতেই আমার সুখের সংসারে দুঃখের খেলা আরম্ভ হইয়াছে; অথচ আমি স্পষ্ট দেখিতেছি, সে সৰ্ব্বদাই প্রাণপণে আমার হিতসাধনে চেষ্টা পাইতেছে।
সহসা যে পত্র আমি মৃতের পকেট হইতে লইয়াছিলাম, সেই পত্রের কথা মনে হইল। আমি ভাবিলাম, “এই পত্র দেখিলে হয় ত জানিতে পারিব, কে এই ভয়াবহ কাজ করিয়াছে।” আমি সত্বর পকেট হইতে পত্র বাহির করিলাম। দেখিলাম, গুরুগোবিন্দ বলিয়া একটি লোক আমার ভাবি শ্বশুর মহাশয়ের নিকটে পত্র লিখিয়াছেন। পত্রখানি এই;-
“দিল্লী।
“মহাশয়,
আপনি যাহা শুনিয়াছেন, তাহা মিথ্যা শুনেন নাই। প্রকৃতই এখানে মর্জিনা নামে এক সুন্দরী বাইজী আছে, সুধাংশুবাবু এখানে আসিয়া তাহার সহিত আমোদ-প্রমোদ করিয়া থাকেন। তিনি ঘোর মদ্যপ, নিতান্ত উচ্ছৃঙ্খল চরিত্র, একেবারেই ভদ্রসমাজের অনুপযুক্ত। আমি এ কথা সত্য কি না, স্থির করিবার জন্য স্বয়ং মর্জিনার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলাম; সে বলে যে, এখনও সে সুধাংশু বাবুর রক্ষিতা, তিনি তাহাকে মাসে মাসে যথেষ্ট টাকা পাঠাইয়া দিয়া থাকেন। আপনি যাহা জানিতে চাহিয়াছিলেন লিখিলাম। অন্য নূতন সংবাদ আর কিছুই নাই। ইতি।
বশংবদ
গুরুগোবিন্দ।”
এই পত্র পাঠ করিয়া আমার মাথা ঘুরিয়া গেল।
এ পত্রে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা সর্ব্বৈব মিথ্যা। আমি মৰ্জ্জিনা বলিয়া কোন বাইজীকে কখনও চোখে দেখি নাই, তাহার নাম পর্যন্ত শুনি নাই। দিল্লী গিয়াছি বটে, তবে কখনও দুই তিন দিনের অধিক সেখানে থাকি নাই।
আমি জানিতাম, এ জগতে আমার কোন শত্রু নাই, কিন্তু এখন বুঝিলাম, কোন পরম শত্রু আমার অলক্ষ্যে আমার পরম অনিষ্টসাধন করিবার চেষ্টা পাইতেছে। সে কে?
অনেক ভাবিয়াও আমি ইহার কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। ভাবিয়া ভাবিয়া ক্রমে আমি উন্মত্তপ্রায় হইলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতে তখনও আমি শয্যা হইতে উঠি নাই। সমস্ত রাত্রি নিদ্রা হয় নাই, শেষ রাত্রে ভোরের সময় একটু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম। কে আমার দ্বারে আঘাত করায় আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, আমি চমকিত হইয়া উঠিয়া বসিলাম, জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে?”
বাহির হইতে আমার বৃদ্ধ ভৃত্য বলিল, “আমি।”
“কেন—কি হইয়াছে?”
“ইনস্পেক্টর বাবু আসিয়াছেন।”
আমি সত্বর উঠিলাম। মুখ ধুইয়া বেশ-বিন্যাস করিয়া বাহিরে আসিলাম।
আমাকে দেখিয়া তিনি উঠিয়া অতি গম্ভীরভাবে বলিলেন, “সুধাংশুবাবু, বিশেষ দুঃখের সহিত বলিতে হইল যে, আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে—খুন করার অপরাধে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করিলাম। ইহাও আপনাকে বলা আমার কর্তব্য যে, আপনি এ সময়ে আমাকে যাহা বলিবেন, তাহা আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ স্বরূপ গণ্য হইবে।”
আমি অতি কষ্টে আত্মসংযম করিয়া বলিলাম, “তাহা হইলে আমি এখন কিছুই বলিতেছি না—জামিনে খালাস পাইব না কি?”
“খুনী মোকদ্দমা—আমার জামিন দিবার ক্ষমতা নাই, তবে হাকীম ইচ্ছা করিলে দিতে পারেন। আপনি বড় লোক, পয়সায় অসম্ভব সম্ভব হয়।
আমি বলিলাম, “আমাকে হাঁটিয়া যাইতে হইবে কি?”
তিনি বলিলেন, “সে কি? আমার সঙ্গে গাড়ী আছে।”
আমি বুঝিলাম, পয়সা থাকিলে জেলেও রাজার হালে থাকিতে পারা যায়। আমি বাটীর সমস্ত বন্দোবস্ত স্থির করিয়া, আমার উকীলের উপর সমস্ত ভার দিয়া ইনস্পেক্টরের সঙ্গে চলিলাম।
ইনস্পেক্টর আমাকে বিশেষ যত্ন ও সমাদর করিতে লাগিলেন; বলিলেন, “মোকদ্দমা, ফাঁসিয়া যাইবে—কিছুই হইবে না। আপনি যে খুন করেন নাই, তাহা সকলে জানে।”
আমি বলিলাম, “তবে কে খুন করিল?”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “ঐটা বলাই ত কঠিন, কাহারও বিরুদ্ধে প্রমাণ, এমন কি সন্দেহ পৰ্য্যন্ত নাই।”
টাকার জোরে সব হয়, আমি জামিনে খালাস হইলাম। আমার উকীল কৌন্সলি অনেক লড়ালড়ী করিয়া আমাকে জামিনে খালাস করিয়া আনিলেন।
মোকদ্দমায় জলের ন্যায় টাকা ব্যয় হইতে লাগিল, নতুবা রক্ষা পাইবার উপায় নাই। আমার বিরুদ্ধেই যাহা কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, যে লাঠী মৃত ব্যক্তির পার্শ্বে পাওয়া গিয়াছে, সে লাঠী আমার, নিশ্চয়ই সেই লাঠীর আঘাতেই খুন হইয়াছিল। দ্বিতীয়তঃ আমার বাড়ীর গেটে তাঁহার মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে; প্রথমে লোকে আমাকেই মৃতদেহের নিকটে দেখিতে পাইয়াছে, আমার সঙ্গেই একটু পূর্ব্বে তাঁহার বচসা হইয়াছিল; তিনি তাঁহার কন্যার সহিত আমার বিবাহ দিতে অসম্মত হওয়ায় তাঁহার উপরে আমারই জাতক্রোধ হওয়া উচিত।
এই সকল আমার বিরুদ্ধে—আমার সপক্ষেও যে একেবারে কিছু ছিল না, তাহা নহে সপ্রমাণ হইল যে, আমার ঘর হইতে আমার লাঠী খুনের পনের দিন পূর্ব্বে চুরি গিয়াছিল, সেদিন এই লাঠী আমার অধিকারে আদৌ ছিল না। দ্বিতীয়—দ্বারবান্ তাঁহাকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া ছুটিয়া আসিয়াছিল, সে দেখিয়াছিল যে, তখনও আমি আমার ঘরে বসিয়া আছি; গেট হইতে আমার ঘর স্পষ্ট দেখা যায়।
দ্বারবান্ আমার পূর্ব্বেই মৃতদেহের নিকটে উপস্থিত হইতে পারিত, কিন্তু ঠিক এই সময়ে কৃতান্তবাবু তাহার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করেন, “ব্যাপার কি?”
কৃতান্তবাবুকে সমস্ত কথা বলিতে গিয়াই দ্বারবানের আসিতে একটু বিলম্ব হইয়াছিল। এরূপও প্রমাণ পাওয়া গেল যে, চীৎকার শব্দ হইবার পরে আমি আমার গৃহ হইতে ছুটিয়া গেটের দিকে গিয়াছিলাম; সুতরাং আমার দ্বারা এই খুন সম্ভব না।
যাহা হউক, যথা সময়ে আমার বিচার আরম্ভ হইল। ইনস্পেক্টর, ডাক্তার, দ্বারবান, কৃতান্ত প্রভৃতি অনেকেই সাক্ষ্য দিল। এ পর্য্যন্ত কোন দিন এক মুহূর্তের জন্য কৃতান্তের প্রতি আমার অবিশ্বাস বা সন্দেহ হয় নাই, তবে সে বিচারকালে যে ভাবে সাক্ষ্য দিল, তাহাতে তাহার উপরে আমার গুরুতর সন্দেহ জন্মিল।
প্রকাশ্যভাবে সে আমার দিকে টানিয়া বলিতে লাগিল, কিন্তু প্রকারান্তরে সে যেরূপভাবে সাক্ষ্য দিতে লাগিল, তাহাতে অন্যান্য সমস্ত সাক্ষী অপেক্ষা তাহার সাক্ষ্য আমার বিরুদ্ধে যাইতে লাগিল।
যাহা হউক, যথার্থ বলেই হউক, আর আমার পূর্ব্ব জন্মের পুণ্যের বলেই হউক, আমি সে যাত্রা মুক্তি পাইলাম, আমার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন, কিন্তু সেইদিন হইতে এক জনকে আর আমি দেখিতে পাইলাম না।
আদালত হইতে বহির্গত হইয়া আমি সৰ্ব্বাগ্রে কৃতান্তের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। কেহ তাহার সংবাদ দিতে পারিল না। মোকদ্দমা শেষ হইবার পূর্ব্বেই কৃতান্ত আদালত হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল, কিন্তু তাহার পর সে যে কোথায় গিয়াছে, তাহা কেহ বলিতে পারে না।
আমি তাহার অনেক অনুসন্ধান করিলাম। বাসায় তাহার সমস্ত দ্রব্যই পড়িয়া আছে, কেবল সেই কাঠের বাক্সটি নাই। আমার অনুযোগে পুলিশও তাহার বহু অনুসন্ধান করিল, কিন্তু তাহারাও তাহার কোন সন্ধান পাইল না। পূৰ্ব্বে সে একবার যেরূপ নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, এবারও ঠিক তাহাই হইয়াছে। আমার মনে হইতে লাগিল, সেই কৃতান্তই খুব সম্ভব খুন করিয়াছিল, কিন্তু তাহার এরূপ খুন করিবার উদ্দেশ্য কি? আমি তাহার উপকারী বন্ধু—চিরকাল তাহাকে ভালবাসিয়া আসিতেছি, সে কেন অনর্থক আমার অনিষ্ট করিবে?
আর এই সাপের ব্যাপারই বা কি? নিয়তি—নতুবা এই সকল না ভাবিয়া আমি যদি সেইদিন হইতে তাহার কথা ভুলিয়া গিয়া গৃহ-সংসারে মন দিতাম, তাহা হইলে আমার এ দুঃখ, কষ্ট হইত না, কিন্তু সবই নিয়তি-নিয়তির হাত এড়াইতে পারে কে?
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আমি নিশ্চিন্তভাবে বসিয়া থাকিতে পারিলাম না। সর্ব্বদাই কৃতান্তের কথা, মর্জিনার কথা, সাপের কথা মনে পড়িতে লাগিল। ক্রমে আমার স্থির থাকা একেবারেই অসহ্য হইয়া উঠিল, আমি দিল্লী গিয়া মর্জিনার সন্ধান করিব স্থির করিলাম। অনন্তর আমি সেখানে একজন বন্ধুর বাড়ীতে উঠিলাম।
আমি দিল্লীতে আসিয়া গুরুগোবিন্দের নাম করিলাম; কেহ তাহার সংবাদ দিতে পারিল না, তাহার পর মর্জিনার সন্ধান করিতে লাগিলাম।
অনেক অনুসন্ধানের পর মর্জিনা নামী একজন বাইজীর সন্ধান পাইলাম—কিন্তু সে যে বাড়ীতে থাকিতে, সেখানে গিয়া দেখিলাম, সে বাড়ীতে কেহ নাই, বাড়ীটা খালি পড়িয়া আছে। অনুসন্ধান করিলে পার্শ্ববর্তী দোকানদার বলিল, “আমরা অনেকেই তাঁহাকে খুঁজিতেছি, ম’শায়।”
“কেন—সে কি করিয়াছে?”
“আর কি করিয়াছে! আমাদের একেবারে সর্ব্বনাশ করিয়া গিয়াছে!”
“কি করিয়াছে?”
“সব দেনা, কেবল দেনা করিয়া, নবাবী করিয়া সে আর তাহার বাবু রাত্রে কাহাকে কিছু না বলিয়া পলাইয়াছে, আমরা মারা গিয়াছি—এত বড় জুয়াচোর জানিতাম না।”
“তাহার এক বাবু ছিল?”
“বাঙ্গালী বাবু—বাঙ্গালী সব জুয়াচোর।”
“তা ঠিক নয়—এখন তাহারা কোথায় গিয়াছে, বলিতে পার?”
“তাহা যদি জানিতাম ত, তাহাদের কান মলিয়া টাকা আদায় করিয়া ছাড়িতাম।”
“বাবুটির চেহারা কেমন?”
“কে তার চেহারা অত দেখেছে।”
“তবু?”
“সে মাগী কেবলই তীর তুলাইত, তীরওয়ালার কাছে হয় ত তাদের দুজনেরই তীর থাকিতে পারে।”
“কোন্ তীরওয়ালা?”
“চকের দিল মহম্মদ।”
আমি আর কোন কথা না কহিয়া চকে আসিয়া দিল মহম্মদ ফটোগ্রাফারের দোকানে উপস্থিত হইলাম।
মর্জিনার কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনিও সেই ছুঁড়ীটার কাছে কিছু পান নাকি?”
“না—তা’ ঠিক নয়,—তবে আমি অন্য কারণে তাহাকে খুঁজিতেছি।”
“কি কারণ, শুনিতে পাই কি?”
“তাহার বাবুটিকে আমার প্রয়োজন। দেখিতেছি, আপনিও কিছু পান।”
“অনেক—বিস্তর ছবি তুলিয়াছি,—দাম প্রায়ই দেয় না।”
“মর্জিনাকে দেখিবার আমার দরকার নাই। তবে তার বাবুটির চেহারা কেমন, তাহাই আমি জানিতে চাই। তাহা হইলে জানিতে পারিব, আমি যাহাকে খুঁজিতেছি, মর্জিনার বাবু সেই লোক কি না।”
“হাঁ, আমি সে মহাত্মারও অনেক ছবি তুলিয়াছি।”
“একখানা আছে?”
“বোধ হয়, থাকিতে পারে—দেখিতেছি।”
এই বলিয়া দিল মহম্মদ ভিতরে চলিয়া গেলেন; কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া আমার হাতে একখানি ছবি দিলেন। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এই কি সেই মৰ্জ্জিনা?”
“হাঁ, এই সেই মর্জিনার ছবি।”
তিনি আর একখানা ছবি আমার হাতে দিয়া বলিলেন, “এই তাহার বাবুর ছবি।”
আমি বিস্মিত হইয়া দেখিলাম, সে ছবি—কৃতান্তের।
বলা বাহুল্য, আমারই বন্ধু কৃতান্তকে মর্জিনার বাবু দেখিয়া আমি কিরূপ বিস্মিত হইলাম। কিয়ৎক্ষণ আমি স্তম্ভিতপ্রায় হইয়া দণ্ডায়মান রহিলাম! তৎপরে দিল মহম্মদ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিয়াছে দেখিয়া আমি আত্মসংবরণ করিয়া বলিলাম, “হাঁ, আমি ইহাকেই খুঁজিতেছিলাম।”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আমিও তাহাই ভাবিতেছিলাম—কত পান?”
আমি তাঁহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলাম, “এখন ইনি কোথায় আছেন, বলিতে পারেন না?”
“না, তাহা হইলে ত অনেকেরই উপকার হইত।”
“দিল্লীতে আছেন বলিয়া বোধ হয়?”
“কেমন করিয়া বলিব?”
আমি বিভ্রান্তভাবে তাঁহার দোকান হইতে বহির্গত হইলাম। পথে আসিয়া মাথায় সুশীতল হাওয়া লাগায় মাথাটা সুস্থির হইল, আমার চিন্তাশক্তি আবার ফিরিয়া আসিল, আমি তখন ভাবিতে লাগিলাম, “এখন স্পষ্টই জানা যাইতেছে যে, কৃতান্ত কাশী হইতে পলাইয়া এখানে এই মর্জিনার নিকটে আসিয়াছিল; তাহার পর দুই জনে একত্রে পলাইয়াছে; তবে দিল্লী বড় সহর—বোধ হয়, এখানেই কোন স্থানে লুকাইয়া আছে। যেমন করিয়া হয়, তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতেই হইবে।”
এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে আমি বাসায় আসিলাম। কি করিব, তখনও কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না।
সপ্তম পরিচ্ছেদ
আমি আমার যে বন্ধুর বাসায় ছিলাম, তাঁহার সহিত পরামশ করা কর্তব্য বিবেচনা করিয়া তাঁহাকে সমস্তই বলিলাম। তিনি সকল ঘটনা শুনিয়া বলিলেন, “সে কি এখনও আর দিল্লীতে আছে—নিশ্চয়ই কোথায় পলাইয়াছে।”
আমি বলিলাম, “বলা যায় না, দিল্লী বড় সহর—এখানে কোনখানে গা ঢাকা দিয়া থাকিতে পারে। দিল্লীটা ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখা উচিত।”
“কি করিবে—পুলিশে খবর দিবে কি?”
“না, এখন পুলিসে খবর দিবার ইচ্ছা নাই।”
“তবে?”
“এখানকার সকল স্থান জানে-শোনে, এমন একজন লোক পাইলে ভাল হইত- অনুসন্ধানের সুবিধা পাইতাম।”
“তোমার কথা শুনিয়া এক জনের কথা আমার মনে পড়িয়া গেল।”
“কে তিনি?”
“তিনি একজন পেন্সনভোগী পুলিসের লোক—দিল্লী তাঁহার নখদর্পণে।”
“তাহা হইলে তাঁহার কাছেই আমাকে লইয়া চল; যদি কৃতান্ত দিল্লীতে থাকে, তাহা হইলে তিনি তাহাকে নিশ্চয়ই খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিবেন।”
“বেশ, সেই ভাল। তাঁহার কাছে কি এখনই যাইবে?”
“হাঁ—এখনই। ইহার একটা কিছু না হইলে, আমি স্থির হইতে পারিতেছি না।”
কিয়ৎক্ষণ পরে আমরা দুইজনে তাঁহার বাড়ীতে আসিলাম। তিনি একজন প্রৌঢ় হিন্দুস্থানী, নাম বীরবল সিংহ, দেখিলেই লোকটিকে বিচক্ষণ লোক বলিয়া বোধ হয়। তিনি সমস্ত শুনিয়া বলিলেন, “আমি আজ হইতেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিব।”
আমি বলিলাম, “টাকার জন্য ভাবিবেন না, আপনার পারিশ্রমিক—”
তিনি প্রতিবন্ধক দিয়া বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে–আমি যথাসাধ্য চেষ্টা পাইব, এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন।”
সেইদিন হইতে আমি প্রত্যহ তাঁহার বাড়ীতে সন্ধ্যার সময়ে যাইতে লাগিলাম, কিন্তু তাঁহার সেই একই কথা—”এখনও কোন সন্ধান পাই নাই।”
একদিন রাত্রে আমি তাঁহার বাড়ী হইতে ফিরিতেছিলাম, চকের ভিতর দিয়া আসিতেছিলাম—সেখানে লোকে লোকারণ্য; সেই ভিড়ের মধ্যে আমি যেন মুহূর্ত্তের জন্য একবার কৃতান্তকে দেখিলাম। আমি পাগলের মত, ভিড় ঠেলিয়া তাহার দিকে ছুটিলাম; কিন্তু তাহার নিকটস্থ হইবার পূর্ব্বেই সে আমার দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল। আমি বহুক্ষণ ধরিয়া তাহাকে চারিদিকে অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু আর কোথাও তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।
তবে কি আমার ভুল হইল? না, দোকানের আলোকে আমি যে তাহাকে স্পষ্ট দেখিয়াছি! আমি তখনই আবার বীরবল সিংহের বাড়ীতে ফিরিলাম, তাঁহাকে সকল কথা বলিলাম। তিনি বলিলেন, “আপনার ভুলও হইতে পারে। যাহা হউক, আমি কাল আরও ভাল করিয়া সন্ধান লইব।”
তাহার পর আরও দশ দিন কাটিয়া গেল। আমি বীরবল সিংহের সহিত দেখা করিলে তিনি বলিলেন, “দিল্লীর এমন স্থান নাই যে, আমি দেখি নাই, কিন্তু তাহার কোন চিহ্নই কোথায় দেখিতে পাই নাই। যদি আপনি তাহাকে প্রকৃতই দেখিয়া থাকেন—মানুষের অনেক সময়ে এরূপ ভুল হয়, তাহাই বলিতেছি—যদি আপনি সেদিন প্রকৃতই তাহাকে দেখিয়া থাকেন—তাহা হইলে সে এতদিনে অন্যত্র পলাইয়াছে। দিল্লীর চারিদিকেই রেল যাইতেছে, এখান হইতে পলায়ন অতি সহজ।”
তিনি যতই বলুন, আমার প্রাণ বলিতে লাগিল যে, কৃতান্ত এখনও দিল্লীতে আছে। আমি মনের সে ভাব তাঁহাকে বলিলাম না। তিনি বলিলেন, “আমি অনুসন্ধান ত্যাগ করি নাই, সে এখানে থাকিলে নিশ্চয়ই আমি তাহাকে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিব।”
আমি বলিলাম, “অনুসন্ধান ত্যাগ করিবেন না, আমি আরও কয়েক দিন এখানে আছি।”
এই বলিয়া, আমি তাঁহার নিকট হইতে বিদায় হইয়া বাসায় প্রত্যাগমন করিলাম।
আমি ফিরিয়া আসিলে আমার বন্ধু বলিলেন, “একজন লোক তোমার জন্য বসিয়া আছে।”
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “কে সে?”
তিনি হাসিয়া বলিলেন, “দেখিলে চণ্ডুখোর বলিয়া বোধ হয়।”
“কোথায়?”
“ঐ বাহিরের ঘরে বসিয়া আছে।”
আমি সেই ঘরে আসিয়া দেখিলাম, যথার্থই একটি লোক বসিয়া আছে—আমার বন্ধু মিথ্যা বলে নাই, ইহাকে দেখিলে সহজেই চণ্ডুখোর বলিয়া বোধ হয়। আমাকে দেখিয়া সে আমার মুখের দিকে চাহিল।
আমি বলিলাম, “তুমি কি চাও হে বাপু?”
সে লোকটা বলিল, “সুধাংশু বাবুর জন্য একখানা পত্র আছে—আপনি কি সুধাংশুবাবু?”
“হাঁ, কে পত্র দিয়াছে?”
‘পড়িলেই জানিতে পারিবেন,” বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং বস্ত্রমধ্য হইতে একখানা পত্র বাহির করিয়া দিল। আমি শিরোনামা দেখিয়াই চমকিত হইলাম, এ যে সেই কৃতান্তের হাতের লেখা!
সহসা কৃতান্তের পত্র পাইয়া আমার প্রাণের কি অবস্থা হইল, তাহা বলা বাহুল্য—আমার হাত হইতে যে পত্রখানা তখনই পড়িয়া গেল না, ইহাতেই আমি বিস্মিত হইলাম। আমি সত্ত্বর পত্রখানা পাঠ করিলাম:-
“সুধাংশু,
আমি মৃত্যুশয্যায়। বোধ হয়, আজ রাত্রি কাটিবে না। আমি তোমার উপরে যথেষ্ট অন্যায় ব্যবহার করিয়াছি, সময় থাকিতে তাহার যেটুকু প্রায়শ্চিত্ত করিতে পারি, তাহাই ইচ্ছা করিতেছি। একবার আসিবে কি? পত্রবাহক তোমাকে আমার কাছে লইয়া আসিবে। যদি আসিতে ইচ্ছা কর, এক মুহূর্ত্তও বিলম্ব করিয়ো না। যদি পুলিস সঙ্গে লও, তাহা হইলে এই লোক তোমাকে আমার কাছে আনিবে না, ইতি।
কৃতান্ত।”
আমি, পাঁচ-সাত বার এই পাঠ করিলাম, তৎপরে সেই লোকটাকে ঘরের বাহিরে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমার বন্ধুকে ডাকিলাম। তিনি আসিলে আমি তাঁহার হস্তে পত্রখানি দিলাম। তিনি পাঠ করিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি বুঝিলে –কি বল, যাইব।”
তিনি চিন্তিতভাবে বলিলেন, “সুধাংশু, এ বিষয় বিশেষ না ভাবিয়া হঠাৎ কিছু বলিতে পারি না। কৃতান্তের চরিত্র তুমি বেশ জান, সে-ই যে খুন করিয়াছিল, তাহাতে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। সে তোমার সর্ব্বনাশ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, যে একবার এ চেষ্টা করিতে পারে, সে আরও কয়েক বার পারে। যে কারণেই হউক, সে তোমার সঙ্গে দেখা করিতে চায়, অথচ পুলিসকেও খুব ভয়, ইহাতে তুমি নিজেই বিবেচনা করিতে পার—
“আমি মধ্যপথে বাধা দিয়া বলিলাম, “হাঁ, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহা ঠিক; কিন্তু কৃতান্ত লিখিতেছে, মৃত্যুকালে কিছু প্রায়শ্চিত্ত করিতে চায়, এ বিষয়ে তুমি কি বিবেচনা কর?”
“হাঁ, সে এই রকম লিখিয়াছে স্বীকার করি, কিন্তু তাহার যথার্থ উদ্দেশ্য কি তাহাই?”
“মনে কর তাহাই—তাহা হইলে কি আমার যাওয়া উচিত নয়?”
“এ বিষয় তোমার নিজের স্থির করা উচিত।”
“যদি তোমারই উপরে ভার দিই?” তুমি বুঝিয়া দেখ।
“তাহা হইলে হয় ত তোমার মৃতদেহ কাল দিল্লীর কোন ক্ষুদ্র গলির ভিতরে পাওয়া যাইবে।”
“মনে কর, যদি আমি একটা পিস্তল সঙ্গে লই।”
“একটা পিস্তলে কতদূর কি হয়?”
“কিন্তু তুমি ত জান, এই লোকের সঙ্গে দেখা না হইলে আমি কিছুই জানিতে পারিব না, আর যতদিন তাহা না জানিব, ততদিন আমি কিছুতেই স্থির হইতে পারিব না।”
“তাহা ত দেখিতেছি, দেখি লোকটা কি বলে।”
পত্রবাহক লোকটা তখনও বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল। ডাকিবামাত্র উঠিয়া আসিল। আমার বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই চিঠীতে তোমার কথা যখন আছে, তখন তুমি নিশ্চয়ই জান, ইহাতে কি আছে।”
“হাঁ—কিছু কিছু।”
“যিনি পত্র লিখিয়াছেন, যথার্থই কি তিনি পীড়িত?”
“সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই—আজ রাত্রি কাটিবে না।”
“তাহার কি হইয়াছে?”
“তাহা জানি না।”
“এখন কথা হইতেছে, তাহার কাছে যাওয়া নিরাপদ কি না?”
“সম্পূর্ণ—সে বিষয়ে আমি দায়ী থাকিলাম। অন্য বিষয় কিছু জানি না।”
“আমি সঙ্গে যাইতে পারি?”
“যখন মশায় পুলিসের লোক নও, তখন অনায়াসে যাইতে পার।”
“এ ভাল কথা—এইখানে একটু অপেক্ষা কর, আমরা প্রস্তুত হইয়া আসিতেছি।”
তখন আমি ও আমার বন্ধু স্ব স্ব দুই পকেটে চারিটি পিস্তল লইয়া সেই চণ্ডুখোরের সহিত বহির্গত হইলাম। তখন রাত্রি প্রায় এগারটা।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
চণ্ডুখোর লোকটা অন্ধকারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গলির ভিতর দিয়া আমাদের প্রায় অর্দ্ধক্রোশ পথ লইয়া আসিল।
আমার বন্ধু দিল্লীবাসী, তিনি দিল্লীর সমস্ত পথ-ঘাটই অবগত আছেন, তবুও তিনি গলিগুলি বিশেষ লক্ষ্য করিয়া যাইতে লাগিলেন।
অবশেষে সে আমাদিগকে গোরস্থান সংলগ্ন একটা ভাঙ্গা মসজিদের দ্বারে আনিয়া দাঁড় করাইল; বলিল, “তিনি এইখানে আছেন, দুইজনে যাইবেন, কি একজনে যাইবেন?”
কৃতান্ত যাহা বলিবে, তাহা অপরে কেহ যে শুনে, তাহা আমার ইচ্ছা নহে; আমি ব্যগ্রভাবে বলিলাম, “না, আমি একাই যাইব।”
আমার বন্ধু বলিলেন, “তোমার কোন বিপদ্ না ঘটিলেই হইল। ইহাতে আমার কোন আপত্তি নাই, আমি এইখানে অপেক্ষা করিব।”
“ভিতরে কেহ যদি আমাকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে তুমি তখনই গিয়া পড়িতে পারিবে।”
“তাহা নিশ্চয়ই।”
চণ্ডুখোর বলিল, “কোন ভয় নাই—এস। এতক্ষণ তাহার দফারফা হইয়া আসিয়াছে।” বন্ধুকে তথায় রাখিয়া আমি সেই ভগ্ন মসজিদে প্রবেশ করিলাম। আমার হৃদয় যে তখন সভয়ে কম্পিত হইতে ছিল, এ কথা অস্বীকার করিলে মিথ্যাকথা বলা হয়।
লোকটা একটা ঘর দেখাইয়া দিয়া বলিল, “যাও, ঐ ঘরে আছে।”
আমি প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, গৃহের একপার্শ্বে একটি আলো মিট্ মিট্ করিয়া জ্বলিতেছে। এই আলোকে কিছুই ভাল দেখা যায় না, তবুও বুঝিতে পারিলাম, ঘরের একপার্শ্বে কম্বলের উপরে একজন কে পড়িয়া আছে। আমি নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলাম, কৃতান্তই বটে।
কিন্তু সে কৃতান্ত আর নাই। একটি নরকঙ্কাল-চর্ম্মাবৃত মাত্র হইয়া রহিয়াছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। প্রথমে দেখিয়া মনে হইল, তাহার মৃত্যু হইয়াছে। মানুষের যে এরূপ শোচনীয় অবস্থা হইতে পারে, তাহা আমার একেবারেই জ্ঞান ছিল না। তাহার মুখের এমনই শোচনীয় ভয়াবহ ভাব হইয়াছে যে, আমার প্রাণ শিহরিয়া উঠিল। আমি ভাল করিয়া দেখিয়া বুঝিলাম যে, তাহার ধীরে ধীরে নিশ্বাস পড়িতেছে।
কিয়ৎক্ষণ আমার মুখে কথা বাহির হইল না, আমি স্তম্ভিত প্রায় দণ্ডায়মান রহিলাম। তৎপরে ধীরে ধীরে ডাকিলাম, “কৃতান্ত—কৃতান্ত!”
সে চক্ষু মেলিল। আমি বলিলাম, “তুমি আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলে, আমি আসিয়াছি। তুমি আমাকে কি বলিতে চাও?”
সে ব্যাকুলভাবে আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, সে দৃষ্টি আমি জীবনে কখনও ভুলিব না—পাপীর মৃত্যুকালের সে হতাশ, আশাশূন্য, ভীতিপূর্ণ দৃষ্টি কি ভয়ানক
কিয়ৎক্ষণ নীবর থাকিয়া কৃতান্ত বলিল, “কি জন্য তোমায় ডাকিয়াছি? ঠাট্টা করিবার জন্য মনে কর না কি? দেখিতেছ না, আমার মৃত্যুকাল উপস্থিত। নরকে যাইবার পূর্ব্বে আমি তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়াটা মিটাইয়া লইতে চাই।”
আমি তাহার পার্শ্বে বসিয়া তাহার হাত আমার দুই হাতের মধ্যে লইলাম। মৃত্যুমুখে পতিত অনুতপ্তের উপর মহা পাষণ্ডেরও ক্রোধ থাকে না। আমি বলিলাম, “তাহা হইলে তুমি কি বলিতে চাও, বল। আমি তোমার অনেক বিষয় জানিতে পারিয়াছি! মর্জিনার সাহায্যে তুমি আমার ভাবী শ্বশুরের মন যেরূপে ভাঙ্গিয়াছিলে, সে সবই জানিতে পারিয়াছি।”
“পারিয়াছ? তাহা হইলে সত্যকথাই জানিয়াছ। ভগবান্ জানেন, আমি কি যাতনা পাইয়াছি— তুমিও জানিতে পারিবে।”
“আমি—আমি কেন?”
“পরে জানিবে—এখন যাহা বলিবার আছে, বলি—সময় নাই—আমি যে তোমার ভাবী শ্বশুরকে খুন করিয়াছিলাম, বোধ হয়, ইহা তুমি জানিতে পার নাই।”
“আমি ইহা সন্দেহ করিয়াছিলাম, বিশ্বাস হয় নাই।”
“আমার ইচ্ছা ছিল, এই খুন তোমার ঘাড়ে চাপাইয়া তোমাকে ফাঁসী দিই।”
আমি ভীত ও বিস্মিত হইয়া বলিলাম, “কেন, আমি তোমার কি করিয়াছিলাম?”
“তুমি যাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করিয়াছিলে, তাহাকে আমি ভাল বাসিয়াছিলাম।” আমি কোন উত্তর করিতে পারিলাম না—নীরবে রহিলাম।
কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কৃতান্ত ধীরে ধীরে বলিল, “সকলই খুলিয়া বলিলাম—আমি যাইতেছি—আর তোমার অনিষ্ট করিতে আসিব না। এই অন্তিম সময়ে তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিবে না?”
অন্য সময় হইলে এরূপ মহাপাপীকে কি করিতাম, বলিতে পারি না, কিন্তু মৃত্যুশয্যার সে এমনই কাতরভাবে ক্ষমা চাহিল যে, আমি না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না, “আমি সর্ব্বান্তঃকরণে তোমায় ক্ষমা করিলাম।”
তখন সে বলিল, “কেবল ইহাই নহে, মৃত্যুসময়ে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বল, অনুরোধ রক্ষা করিবে।”
“কি অনুরোধ, বল।”
“আমার একটি প্রিয় সামগ্রী আছে—সে-টি আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় হইয়াছে।”
আমি বলিয়া উঠিলাম, “সাপ?”
কৃতান্ত এক রকম ভয়াবহ পৈশাচিক অট্টহাস্য করিয়া বলিল, “হাঁ—সাপ–আমি জানিতাম না যে, তুমি তাহার কথা শুনিয়াছ। বিশ্বাস কর না-কর, সে বড় নিরীহ সাপ–আমাকে বড়ই ভালবাসে। আমি গেলে সে যে অনাথ হয়, আমার তাহা প্রাণে সহিতেছে না। তুমি যদি এটি যত্নে রেখে দাও, তুমিও একে সময়ে ভালবাসিবে। যদি ইহাকে তুমি পোষণ করা ভার বোধ কর, তবে এক মাস পরে কোন জঙ্গলে ছাড়িয়া দিয়ো, এই কাজটি আমার হইয়া করিবে কি? যদি এ অঙ্গীকার কর, আমি এখন সুখে মরিতে পারি।”
আমি কি বলিব, কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। কিন্তু কৃতান্ত এমনই কাতরভাবে আমাকে অনুরোধ করিতে লাগিল যে, শেষে আমি আর অস্বীকার করিতে পারিলাম না। তখন সে মৃদুহাস্য করিল। তৎপরে চক্ষু মুদিত করিল।
আমি কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলাম, তৎপরে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া চমকিত হইলাম; বুঝলাম, কৃতান্ত আর নাই—তাহার মৃত্যু হইয়াছে।
এইরূপে ভগ্ন গোরস্থানের মধ্যে কৃতান্তের প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল। আমি দেখিলাম, সেই কাঠের বাক্সটি তাহার মস্তকের নিকটে রহিয়াছে।
নবম পরিচ্ছেদ
আমি বাহির হইয়া আসিয়া বন্ধুকে বলিলাম, ‘কৃতান্তের মৃত্যু হইয়াছে। সে যতই মহাপাপী হউক, সে স্বজাতি—তাহার নিয়মিত সৎকার হওয়া উচিত।”
চণ্ডুখোর বলিল, “টাকা দিলে আমি ভাল রকম সৎকার করিব।”
আমি বলিলাম, “এস সঙ্গে—টাকা দিতেছি। তবে এখানে কাহারও থাকা উচিত।”
“দাঁড়ান, লোক ডাকিতেছি।”
এই বলিয়া চণ্ডুখোর সত্বর চলিয়া গেল, আমরা দুইজনে অন্ধকারে সেইখানে দাঁড়াইয়া রহিলাম। আমার বন্ধু আমাকে বলিলেন, “কি বলিল—কথা কহিতে পারিয়াছিল?”
আমি অন্যমনস্কভাবে বলিলাম, “আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়ো না, তোমার সে সব শুনিয়া কোন ফল নাই। তবে যাহা বলিয়াছিলে—তাহা ঠিক।”
“কি কথা?”
“কৃতান্তই নিজে খুন করিয়াছিল।”
“কেন, কিছু বলিল?”
“আর কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না। তোমার শুনিয়া কোন ফল নাই।”
কিয়ৎক্ষণ পরে চণ্ডুখোর তিন-চারিজন লোককে সঙ্গে করিয়া তথায় উপস্থিত হইল। বলিল, “ইহারা এখানে থাকিবে।”
আমি বলিলাম, “তবে সঙ্গে এস, বাড়ী গিয়া টাকা দিব। ঘরে একটা ছোট কাঠের বাক্স আছে, সেইটা লইয়া সঙ্গে চল।”
সে ভিতর হইতে বাক্সটা লইয়া আসিয়া আমাদের পশ্চাতে চলিল।
বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাক্সটা কৃতান্তের?”
“হাঁ।”
“ইহাতে কি আছে?”
“আমাকে মাপ করিয়ো, কিছু জিজ্ঞাসা করিয়ো না।”
“আমাকে উভয়ে নীরবে গৃহে আসিলাম। চণ্ডুখোরকে বলিলাম, “বাক্সটা এই ঘরে রাখ।” আমি যে ঘরে শয়ন করিতাম, সে সেই ঘরে বাক্সটি রাখিয়া দিল।
কৃতান্তের ভালরূপ সৎকার করিবে বলিয়া আমি তাহাকে পঁচিশটি টাকা দিলাম। আমার বন্ধু তাহাকে বলিলেন, “বাপু, আমরা কাল সন্ধান লইব। যদি ভাল করিয়া সৎকার না কর, সকলকে পুলিসে পাঠাইয়া দিব।”
সে চলিয়া গেল। রাত্রি অনেক হইয়াছে দেখিয়া আমি শয়ন করিলাম। অত্যন্ত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, শয়ন করিবামাত্র নিদ্রিত হইলাম।
তাহার পর যাহা হইল, তাহা অতি ভয়ানক! কেহ আমার কথা যে বিশ্বাস করিবে, সে ভরসা আমার নাই। তখন কত রাত্রি, তাহা আমি জানি না। সহস্রা আমার নিদ্রাভঙ্গ হইয়া গেল, আমি সভয়ে লম্ফ দিয়া উঠিয়া বসিলাম, এরূপ ভীষণ বিভীষিকা আমি এ জীবনে কখনও দেখি নাই।
আমার যে কি ভাব হইল, তাহা আমি বর্ণন করিতে পারি না। আমার সর্ব্বাঙ্গ অবশ হইয়া পড়িয়াছে, আমার সর্ব্বাঙ্গে গলদঘর্ম্ম ছুটিয়াছে। আমি মনে মনে বলিলাম, “এ কি! আমি কি হঠাৎ পাগল হইয়া যাইতেছি।”
আমার বালিসের নীচে দিয়াশলাই ছিল, আমি অতি কষ্টে কম্পিতহস্তে তাহা বাহির করিয়া আলো জ্বালিলাম, গৃহমধ্যে কিছুই নাই। জানালা খোলা রহিয়াছে, আমি উঠিয়া জানালায় গিয়া বাহিরের দিকে চাহিলাম, কোথায় কেহ নাই। ফিরিয়া আসিয়া বিছানায় বসিলে আমার দৃষ্টি সহসা কৃতান্তের বাক্সের প্রতি পড়িল, অমনই আমার মনে পূর্ব্বের ভাব যেন দ্বিগুণিত হইয়া উঠিল। আমি থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিলাম। তখন আমি সেই বাক্স হইতে চক্ষু ফিরাইতে পারিলাম না, মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় চাহিয়া রহিলাম। কেন জানি না, কে যেন জোর করিয়া আমাকে দাঁড় করাইয়া দিল। আমি ধীরে ধীরে সেই বাক্সের নিকটে আসিলাম। কেন জানি না, সেই বাক্সের উপর যে চামড়ার পাটি ছিল, তাহা খুলিতে আরম্ভ করিলাম; দেখিলাম, বাক্সে চাবি লাগান রহিয়াছে।
তখন আমার আর কোন জ্ঞান নাই, আমি আমার অস্তিত্ব পর্য্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছি। ইচ্ছা হয়, বিশ্বাস কর, না হয় না কর, আমি পাগল হই নাই, যাহা বলিতেছি, সত্য কথা।
আমি বাক্সটির ডালা খুলিলাম, অমনই সেই সাপটা মস্তক তুলিয়া আমার চোখের দিকে চাহিল। আমার বোধ হইল, আমার দেহ সহসা পাষাণে পরিণত হইয়া গেল। আমার নড়িবার- চড়িবার ক্ষমতা একেবারে বিলুপ্ত হইল।
সেই কালসর্পী আমার চোখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া থাকিয়া ধীরে ধীরে কুণ্ডলী খুলিয়া বাক্স হইতে বাহির হইতে লাগিল; কিন্তু একবারও আমার চক্ষু হইতে নিমেষের জন্য তাহার চক্ষু সরাইল না।
ক্রমে বাক্স হইতে সেই কালসর্পী বাহির হইল। প্রাণরক্ষা করিবার জন্যও আমার নড়িবার বা পলাইবার ক্ষমতা নাই; আমার দেহ পাষাণে পরিণত হইয়াছে, অথচ আমার সম্পূর্ণ জ্ঞান রহিয়াছে।
তখন সেই কালসর্পী ধীরে ধীরে আমার অঙ্গ বহিয়া উপরে উঠিতে লাগিল, ক্ৰমে গলা জড়াইয়া আমার মুখে তাহার মুখ সংলগ্ন করিল, সেই ভয়াবহ চক্ষু আমার চক্ষে সম্বদ্ধ। ভয়ে আমার শরীরের রক্ত জল হইয়া গেল; ইহাকে ছুড়িয়া ফেলিবার ক্ষমতা আমার নাই—ইচ্ছাও নাই।
ক্রমে যতই সে আমার অঙ্গ জড়াইয়া মুখে মুখ দিয়া খেলা করিতে লাগিল, ততই আমার প্রাণে একরূপ অভূতপূৰ্ব্ব আনন্দ উপলব্ধি হইতে লাগিল। সে আনন্দ আমার সহ্য হইল না, আমি মুহূৰ্ত্তমধ্যে সংজ্ঞাশূন্য হইলাম। সেই নিঃসংজ্ঞ অবস্থায় দেখিলাম, সৰ্পী—সৰ্পী নহে— কিন্নরলোক-নিষ্ক্রান্ত কোন এক লাবণ্যোজ্জ্বলা দিব্য-অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণী তাহার নিষ্কণ্টক মৃণালবৎ সুকোমল বাহুযুগ দিয়া অত্যন্ত আবেগভরে সপ্রেমে আমার কণ্ঠালিঙ্গন করিতেছে। প্রকৃতই আমি জগৎ-সংসার ভুলিয়া গেলাম। দুঃখ, কষ্ট, ভাবনা, চিন্তা সমস্তই বিস্মৃত হইলাম— আমি এক অনির্ব্বচনীয় নেশায় বিভোর হইলাম। দুই হস্তে আদরে সপ্রেমে আমি তাহাকে বুকে ধরিয়া তাহার মুখে, মন্তকে শত শত চুম্বন করিলাম।
তখন আমি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হইয়া পড়িলাম। আমার বোধ হইল, আমি ত্রিসংসারের অধিপতি হইয়াছি—আমার ন্যায় সুখী কে? এই সর্পীর সঙ্গে যতক্ষণ আমি রহিলাম, সংসারের সকল প্রকার সুখ অনুভব করতে লাগিলাম।
যখন জ্ঞান হইল, দেখিলাম, পূৰ্ব্ব গগনে আলো দেখা দিয়াছে। সাপিনী ধীরে ধীরে আমার ক্রোড় হইতে নামিয়া ক্রমে বাক্সমধ্যে কুণ্ডলী পাকাইয়া প্রবেশ করিল। আমি বাক্সে চাবিবদ্ধ করিয়া মাতালের ন্যায় টলিতে টলিতে বিছানায় আসিয়া পড়িলাম। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হৃদয়ে- যেন কোন বল নাই—আমি অৰ্দ্ধমৃত অবস্থায় শয্যায় পড়িয়া রহিলাম।
দশম পরিচ্ছেদ
বেলা হইল। আমি উঠি নাই দেখিয়া আর বন্ধু আমার নিকটে আসিয়া আমার দিকে চাহিয়াই বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “এ কি হে?”
আমি অন্যমনস্কভাবে বলিলাম “কর কি?”
“এমন চেহারা মানুষের এক রাত্রে হয়? কি সৰ্ব্বনাশ! সমস্ত রাত্রি কি করিতেছিলে?”
আমি কি করিতেছিলাম? সমস্ত রাত্রি পরমানন্দ উপভোগ করিতেছিলাম, এ মূর্খ তাহার কি বুঝিবে?
বন্ধু বলিলেন, “এই আর্শীতে মুখখানা দেখ দেখি।”
আমি গম্ভীরভাবে বলিলাম, “দেখিবার আবশ্যক নাই।”
সহসা তাঁহার দৃষ্টি বাক্সের উপরে পড়িল। তখনই বন্ধু চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “প্রাণ যায়—দম বন্ধ হয়, এ ঘর থেকে শীঘ্র বাহিরে এস।”
পরের কষ্টে আমি চিরকাল প্রাণে ব্যথা পাইতাম, কিন্তু আজ বন্ধুর কষ্টে পৈশাচিক আনন্দ উপলব্ধি করিলাম। বন্ধু আর মুহূর্ত্তমাত্র এই গৃহমধ্যে না থাকিয়া পাগলের ন্যায় ছুটিয়া বাহিরে গিয়া পড়িলেন। আমি হাসিতে হাসিতে পশ্চাতে পশ্চাতে বাহিরে আসিলাম |
বন্ধু বলিলেন, “আর একটু হইলেই দমবন্ধ হইয়াছিল; এখন বুঝিতেছি, কেন তোমার চেহারা একদিনে এ রকম হইয়াছে।”
“কেন—আমি ত ঘরে কিছু টের পাইনি।”
“তোমার চেহারাই তাহার প্রমাণ—আর তোমাকে ও ঘরে আসিতে দিতেছি না।”
“আর থাকিবার আবশ্যক হইবে না। কৃতান্তের সন্ধান পাইয়াছি, আজই বাড়ীতে যাইব।”
আমি সেইদিনই আমার প্রাণাপেক্ষা প্রিয় বাক্সটি লইয়া কাশী রওনা হইলাম।
বাড়ীতে উপস্থিত হইলে সকলেই আমার মুখের দিকে বিস্মিতভাবে চাহিতে লাগিল! তখন আমি বুঝিলাম যে, যথার্থই আমার চেহারার পরিবর্ত্তন হইয়াছে; কিন্তু হৃদয়ে আমার সেই রূপ বল তেজ রহিয়াছে—আমি পূর্ণযৌবনে ভাসিতেছি, তবে বাহিরে আমি দিন দিন কঙ্কালমাত্রে পরিণত হইতেছি।
তাহাতে আসে-যায় কি? দেহ কে চায়? সুপুরুষ হইতে কে চায়? ধন-সম্পত্তি কে চায়? সংসারে আমিই ত একমাত্র সকল সুখের অধিপতি। যখন রাত্রে আমার মনোরমা সাপিনীকে বাক্স হইতে বাহির করিয়া ক্রোড়ে তুলিয়া লই, তখন আমি জগত-সংসার বিস্মৃত হই—সে সুখের বর্ণনা হয় না!
পূর্ব্বে লক্ষ্যও করি নাই—পরে দেখিলাম, দিনে আমি কঙ্কালসার কুরূপ হই, কিন্তু রাত্রে আমি সুপুরুষ বলিষ্ঠ—ঠিক আমার পূর্ব্বের স্বাভাবিক. চেহারা। আমি বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করিলাম, বিবাহের কথা একেবারে ভুলিয়া গেলাম। দুই হস্তে পিতৃ-সম্পত্তি উড়াইয়া দিতে লাগিলাম। দিনে যখন আমি এই সর্পীর নিকটে না থাকিতাম, তখন কি যে করিতাম, তাহা বলিতে পারি না—আমি পশুরও অধম হইয়া গিয়াছি। কেন জানি না, আবার একবার দিল্লী যাইবার ইচ্ছা হইল। কেবল দিল্লী কেন—দেশ-বিদেশে সেই সাপিনীকে বুকে করিয়া লইয়া বেড়াইতে ইচ্ছা হইতে লাগিল—ক্রমে এ ইচ্ছা যতই বলবর্তী হইতে লাগিল, ততই আমি শীঘ্ৰ শীঘ্র বিষয়-সম্পত্তি নষ্ট করিতে আরম্ভ করিলাম। নাচ, গান মদ ভাং সংসারের পাপের সমস্ত সহচরগণ আমার চিরসহচর হইল।
আমার যে বাহ্যজ্ঞান ছিল, তাহা বলিয়া বোধ হয় না, তবে সময়ে সময়ে জ্ঞান হইত—সে সময়ে হৃদয়ে অসহনীয় যন্ত্রণা উপলব্ধি করিতাম, সে যন্ত্রণার বর্ণনা হয় না? তখন মনে হইত—কি ছিলাম, কি হইলাম, কেমনে এই কালসর্পীর কবল হইতে এড়াইব! তখন কৃতান্তের উপরে মর্মান্তিক ক্রোধ হইত। আমি তাহার এমন কি অনিষ্ট করিয়াছিলাম যে, মৃত্যুকালেও আমার উপর তাহার রাগ যায় নাই। মৃত্যুশয্যায় এই ভয়াবহ সাপ আমাকে দিয়া গেল; সে জানিত, এ সাপ হইতে কি হয়। তখন তাহার উপরে নিষ্ফল ক্রোধে আমি উন্মত্তপ্রায় হইয়া উঠিতাম।
কালসর্পীর জন্য আমি সুখ না দুঃখ অধিক উপভোগ করিতাম? যখন না সে কাছে থাকিত, তখন কেবলই দুঃখ—বিশেষতঃ যখন সৰ্পী আমার ক্রোড়ে থাকিত, তখন সে সুখের বর্ণনা হয় না! কিন্তু সে সুখ ক্ষণিক—রৌদ্রোজ্জ্বল প্রভাতে মরকতপ্রভ বালতৃণের শিশিরবিন্দুটির মত দেখিতে দেখিতে ফুরাইত। তাহার পর জ্ঞান আসিত, তখন প্রাণে যে যন্ত্রণা হইত, ভগবান্ করুন—সংসারে আর কাহাকেও যেন সে যন্ত্রণাভোগ করিতে না হয়।
যখন জ্ঞান হইত, তখন ভাবিতাম, এমন অদ্ভুত ব্যাপার বোধ হয়, জগতে আর কাহারও হয় নাই। এ সাপের ব্যাপার কি, তাহা আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। আমি কাহাকেও বলিতাম না; জানিতাম, বলিলেও কেহ আমার কথায় বিশ্বাস করিবে না—বিশেষতঃ সাপের কথা কাহাকে বলিতে আমার প্রাণ চাহিত না।
তবে ভবিষ্যতে সকলে আমার জীবনের এই অপূর্ব্ব রহস্য-কাহিনী শুনিলে কেহ-না-কেহ এ রহস্যভেদ করিতে পারিবেন বলিয়া যখন এক একবার এরূপ জ্ঞান হইত, তখনই আমার জীবনের ঘটনা লিখিয়া রাখিয়াছি। আমার মৃত্যুর পূর্ব্বে কাহারও উপরে ইহার প্রকাশ ও প্রচারভার দিয়া যাইব, তখন বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, সকলে একটা চমৎকার অদ্ভুত ব্যাপার অবগত হইতে পারিবে।
ভূপেন্দ্রবাবু এক সময়ে দিন-কয়েক আমার বাড়ীতে ছিলেন। আমি এখন বাক্স বুকে করিয়া দেশে দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি, একস্থানে স্থির হইয়া থাকিতে পারি না।
এই সময়ে একদিন রেলে ভূপেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়; তিনি আমাকে প্রথমে চিনিতে পারেন নাই—রাত্রে তিনি আমাকে পূর্ব্বরূপে দেখিয়া ভয় পাইয়া গাড়ী হইতে নামিয়া পলান্। কিন্তু তিনি আমার কাহিনী প্রকাশ করিতে অঙ্গীকার করিয়াছেন। আমি জানি, তিনি অঙ্গীকার রক্ষা করিবেন। জ্ঞান হইলে আমার ইচ্ছা হয় না যে, আমি দিল্লীতে যাই, কিন্তু সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দিল্লী যাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়ি।
যাহা হউক, আমি দিল্লী আসিয়ছি। আমার এখনও অর্থের অভাব নাই—আমি ভাল দেখিয়া একটা বাসা লইয়াছি, তবুও কেন জানি না, যে ভগ্ন গোরস্থানে কৃতান্ত মরিয়াছিল, প্রত্যহ সেই গোরস্থানে যাইতে আমার মন ব্যাকুল হইয়া উঠে।
এখন বুঝিয়াছি, আমার কাল পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে। আর বিলম্ব নাই। আমি আজ আমার কাহিনী ভূপেন্দ্রের ঠিকানায় পাঠাইয়া দিয়া গোরস্থানে চলিলাম।
উপসংহার
ভূপেন্দ্রের উক্তি
এই অভূতপূৰ্ব্ব কাহিনী পাঠ করিয়া আমার মনের যে কি অবস্থা হইল, তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন, আমার বর্ণন করিবার চেষ্টা করা বৃথা! যাহা হউক, এ কাহিনী প্রকাশ করিলে আমাকে গুলির আড্ডার লোক ব্যতীত অন্য কোন গুরুতর দোষারোপ কেহ আমার উপরে করিতে পরিবে না। সুতরাং ইহা প্রকাশে কোন আপত্তি নাই! লোকে বিশ্বাস করুক আর নাই করুক, তাহাতে আমার কি?
আমি এখন বুঝিয়াছি, সুধাংশুবাবু যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা যথার্থই ঘটিয়াছিল, তিনি মিথ্যাকথা লেখেন নাই। তবে আমি পুস্তকে পড়িয়াছিলাম যে, মানুষের একরূপ উন্মত্ততা রোগ জন্মে, যাহাতে মানুষ নানারূপ বিষয় কল্পনা-চক্ষে দেখিতে থাকে; যাহা কখনও ঘটে নাই— তাহারা মনে করে, তাহাদের জীবনে সেই সকল ঘটনা ঘটিয়াছে। তবে কি সুধাংশুবাবুর এইরূপ উন্মাদ রোগ জন্মিয়াছে? যাহা হউক, তাহার বিষয় একটু না ভাল করিয়া জানিয়া তাড়াতাড়ি ছাপাইব না। এইরূপ স্থির করিয়া আমি অনুসন্ধান লইলাম যে সুধাংশু এখন কোথায়?
পত্রে কোন ঠিকানা ছিল না—তবে ডাক-মার্কা দেখিলাম—দিল্লীর। তাহাই ভাবিলাম, তিনি যদি মরিয়া থাকেন, তবে দিল্লীতেই মরিয়াছেন, সেখানে গেলে নিশ্চয়ই তাঁহার কোন-না-কোন সন্ধান পাইব। না পাই, সেইখান হইতে সন্ধান করিতে করিতে তাঁহার বাড়ীতে সন্ধান লইব। এইরূপ ভাবিয়া আমি সেইদিন রাত্রেই দিল্লী রওনা হইলাম।
দিল্লীতে আসিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিতে আরম্ভ করিলাম; বিশেষ কষ্ট পাইতে হইল না। এখানে বাঙ্গালী কম, সুতরাং সুধাংশুবাবুর ন্যায় বড়লোকের সন্ধান করা বড় কঠিন নহে। শীঘ্রই সুধাংশুবাবুর বন্ধুর সহিত পরিচিত হইলাম, তখন তাঁহার কাছে সকলই শুনিলাম। তাঁহার কথায় যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাহাও দূর হইল।
তাঁহার নিকটে কৃতান্তবাবুর কথা, গোরস্থানে মৃত্যুর কথা যে মিথ্যা নহে, প্রকৃত তাহা জানিতে পারিলাম। তাহা হইলে সুধাংশু উন্মাদ-রোগগ্রস্ত হইয়া মিথ্যা কল্পনায় যাহা তাহা লিখিয়া যায় নাই।
তাহার পর সুধাংশু মৃত্যুর কথা শুনিলাম!
শেষবার সুধাংশুবাবু আর তিনি বন্ধুর বাড়ী আসেন নাই। কোথায় ছিলেন, তাহা কাহাকেও জানান নাই। তাঁহার মৃতদেহ গোরস্থানে পাওয়া যাওয়ায় চণ্ডুখোর আসিয়া তাঁহার বন্ধুকে সংবাদ দেয়, তিনি পূর্ব্বে কৃতান্তের মৃত্যু সম্বন্ধে সকলই জানিতে।
তিনি বলিলেন, “আমি তাঁহার মুখে এই কথা শুনিয়া সত্বর গোরস্থানে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, গোরস্থান মধ্যে একখানা কম্বলের উপরে প্রকৃতই সুধাংশুর মৃতদেহ পড়িয়া আছে; এবং তাহার সর্ব্বাঙ্গ বেড়িয়া একটা সাপ তাহার মুখের উপরে মুখ দিয়া নিশ্চেষ্টভাবে পড়িয়া আছে। আমি এই ভয়াবহ সাপ দেখিয়া সভয়ে সরিয়া দাঁড়াইলাম; কিন্তু সাপটা নড়ে না দেখিয়া তাহার নিকটস্থ হইলাম, ভাল করিয়া দেখিলাম;—তখন দেখি, সাপটাও মরিয়া পড়িয়া আছে। অবশেষে আমি অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবকে সংবাদ দিলাম, পুলিসও আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা ডাক্তার ডাকিলাম; অনেক অনুসন্ধান অনেক পরীক্ষা হইল–কি রোগে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা কেহই স্থির করিতে পারিল না। তবে কেহ তাহাকে হত্যা করে নাই, এটা স্থির। তাঁহার দেহে কোন আঘাতের চিহ্ন ছিল না। পরীক্ষায় দেখা গেল, বিষ বা অন্য কিছু সেবন করিয়াও তাঁহার মৃত্যু হয় নাই। আমরা তখন পুলিসের অনুমতি পাইয়া তাহার যথাবিহিত সৎকার করিলাম।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “সাপটা?”
“সাপ সম্বন্ধেও অনেক অনুসন্ধান হইয়াছিল—সেটা যে কি সাপ, তাহা কেহ বলিতে পারিল না–সেরূপ সাপ আর কেহ কখনও দেখে নাই।”
“সাপটার কি হইল?”
“আমরা জানিতাম না যে, সাপটাকে চণ্ডুখোর আমাদের পেছনে পেছনে শ্মশানে আনিয়াছিল। চিতা জ্বলিয়া উঠিলে সে হঠাৎ সাপটাকে চিতায় ফেলিয়া দিয়া পলাইল। আমরা কিছুতেই সেই সাপটাকে ‘জ্বলন্ত চিতা হইতে তুলিয়া ফেলিতে পারিলাম না। সে-টা সেই চিতাতেই পুড়িয়া গেল।”
.
এ সাপের রহস্য যে কখনও ভেদ হইবে, তাহা একবারও মনে করি নাই। ঘটনাক্রমে এ ভয়ানক রহস্য সম্বন্ধে পরে আরও কিছু জানিতে পারিলাম।
একদিন দিল্লীর চকে একটি ফকীরের সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল। তাঁহাকে তেজস্বী পুরুষ দেখিয়া আমি তাঁহার সহিত আলাপ করিলাম। কথায় কথায় সুধাংশুর সকল কথাই বলিলাম, তিনি শুনিয়া মৃদুহাস্য করিলেন।
পরে আমি অত্যন্ত জেদ করায় তিনি হাসিয়া বলিলেন, “এক সম্প্রদায় যাদুকর আছে— তাহারাও ফকীর সাজিয়া বেড়ায়, তাহারা যাদুবিদ্যায় সিদ্ধহস্ত। তাহারা সয়তানের চেলা। তাহারা সময়ে সময়ে কোন স্ত্রীলোককে সাপ বানাইয়া শত্রুর উপরে চাপাইয়া দেয়—এই সাপ তিন জনের সর্ব্বনাশ করিয়া তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে মরিয়া যায়। আপনার দুই বন্ধুর পূর্ব্বেও আর একজন ছিলেন, দেখিতেছি।”