কালবেলা – ৫০ (মাসুদ রানা)

পঞ্চাশ

নিজের বাড়িতে আছে টুলসার মেয়র অ্যারন কনার। কিচেন টেবিলে বসে গোগ্রাসে খাচ্ছে ঠাণ্ডা মাংস দিয়ে তৈরি সুস্বাদু স্যাণ্ডউইচ। একটু আগে স্থির করেছে, অফিসে কারও সঙ্গে আপাতত যোগাযোগ করবে না। এমন কী ক্যাম্পেইন ম্যানেজারের সঙ্গেও নয়। স্যাণ্ডউইচ খেতে খেতে এরপর কী করবে সেটা ভাবছে সে, এমন সময় বেজে উঠল তার ফোন। কল রিসিভ করতেই তিক্ত স্বরে বলল বার্ব, ‘আগেই বলেছি, মস্ত ভুল করছেন। কিন্তু আপনি কিছুই শুনলেন না।’

‘তুমি আবার কী বলেছিলে?’ জানতে চাইল কনার।

‘আমি সব খুলে বলার আগে বসে পড়ুন কোন চেয়ারে।’

‘আমি বসেই আছি। দেরি না করে বলো কী হয়েছে!’

‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, বস। এইমাত্র ব্ল্যাক বেয়ার থেকে ফোন করেছে মর্গ্যান। ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ব্ল্যাক বেয়ার। আমাদের ছেলেদের কিছুই করার ছিল না।

কথা শুনে বুকের ভেতরে ধক্ করে উঠল কনারের। স্যান্ডউইচ ফেলে দু’হাতে চেপে ধরল মাথা। মুচড়ে উঠেছে পেটের ভেতরে। টয়লেটে যেতে পারলে ভাল হতো। ‘কাজটা কি মাসুদ রানার?’ বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল সে।

তো আর কে হবে? আপনি আর টনি বাধ্য করলেন, যেন ক্রসবি হাইটসে গিয়ে অপেক্ষা করি। ওদিকে সুযোগ পেয়ে ব্ল্যাক বেয়ারে হামলা করল মাসুদ রানা। আগেই আপনাকে বলেছি, এমনটা ঘটতে পারে।’

‘হায়, ঈশ্বর! এটা কোন সময়ের ঘটনা?’

‘কিছুক্ষণ আগের।‘

‘অস্ত্রগুলো কি রক্ষা পেয়েছে? প্রথমে কটেজটা গেল। আর এখন অস্ত্রের ওদাম ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকলে সর্বনাশ হয়েছে অ্যারনের।

এরচেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। বোমার আঘাতে উড়ে গেছে আমাদের তিনটে ট্রাক। ট্রাকে আর সুইমিংপুলে যত অস্ত্র ছিল, শেষ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত মিলেছে আমাদের দলের বারোজনের লাশ। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তিনজনকে। বেঁচে আছে মাত্র তিনজন। মর্গ্যান, লুকম্যান ও স্টিভেন্স। বিস্ফোরণের আঘাতে বাম কান উড়ে গেছে লুকম্যানের।

কার কান কাটা পড়েছে সেটা নিয়ে ভাবছে না অ্যারন। দ্রুত ছুটন্ত রেলগাড়ির মত বুকে ধিকধিক আওয়াজ করছে হৃৎপিণ্ড। ‘হায়, ঈশ্বর! কিন্তু ব্ল্যাক বেয়ারে কীভাবে ঢুকল সে? গেটে পাহারা দিচ্ছিল কে?’

‘রেনি এফ. ডান। মারা গেছে সে। এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত গলা কেটে দিয়েছে রানা। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে তার ফোন ও ওয়ালেট। রেনির রাইফেল দিয়েই খুন করেছে ব্র্যাড়ি আর স্ট্রংকে।’

স্ট্রং বা অন্যদের জন্যে মনে কোন দুঃখ নেই অ্যারনের। কী যেন উঠে এসেছে গলার কাছে। কয়েকবার চেষ্টার পর ঢোক গিলতে পারল। ‘তুমি বলছ ব্ল্যাক বেয়ারে আমাদের গুদাম ধ্বংস হয়ে গেছে। আসলে কী বলতে চাইছ?’

বার্বের পরের কথায় মনে জেগে থাকা শেষ আশার আলোটাও নিভে গেল অ্যারনের। ‘মন দিয়ে শুনুন, বস। মর্গ্যান বলেছে, এখন আণবিক বোমা পড়া হিরোশিমার মতই ন্যাড়া হয়ে গেছে ব্ল্যাক বেয়ার।’

‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল কনার। পেটের ভেতরে অনুভব করছে জোরাল চাপ। দ্রুত টয়লেটে যেতে হবে তাকে। বেগ সামলে জানতে চাইল, ‘তোমরা দু’জন এখন কোথায়?’

‘এখনও চোখ রাখছি মেয়েটার বাড়ির ওপরে,’ তিক্ত হাসল বার্ব। ‘তবে আপনি অনুমতি দিলে সোজা যাব ব্ল্যাক বেয়ারে। এখন কী করব সেটা আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ কয়েক ‘পলক কেটে গেলেও জবাব দিল না তার বস। বার্ব জানতে চাইল, ‘বস? আপনি কি লাইনে আছেন?’

টেবিলে ফোন রেখে ছুটে গিয়ে কিচেনের সিঙ্কে হড়হড় করে বমি করছে অ্যারন। ভীষণ অসুস্থ। মিনিট তিনেক পর মুখ ধুয়ে একগ্লাস পানি দিয়ে গিলে নিল আটটা অ্যান্টাসিড। সিঙ্কের কাছ থেকে সরে ধুপ করে বসল উইকার চেয়ারে। শীতল ঘামে ভিজে গেছে সর্বাঙ্গ। লাখ লাখ ডলারের অস্ত্র হারিয়ে থরথর করে কাঁপছে চার হাত-পা। শুধু যে ভয়াবহ ক্ষতি, তা নয়, মেক্সিকান ড্রাগ ‘কার্টেলের বস যখন জানবে আর অস্ত্র পাবে না, দেরি না করে আততায়ী পাঠিয়ে দেবে ওকে খুন করতে। এরা যেমন আইনের ভয়ে সতর্ক থাকে, তেমনি ভীষণ নিষ্ঠুর। ধরে নেবে এই হামলা করেছে ডিইএ বা এফবিআই। এবার চারপাশ থেকে কার্টেলের ওপরে আসবে হামলা। ধরা পড়বে আমেরিকান অস্ত্র সরবরাহকারী লোকগুলো। সুতরাং সব ফাঁস হয়ে যাওয়ার আগেই কার্টেলের বসের উচিত হবে অ্যারনকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেয়া। হয়তো ওকে গাড়িসহ তুলে নিয়ে যাবে কার্টেলের লোক। বাড়ি থেকেও কিডন্যাপ করতে পারে। হয়তো ফাঁসি দেবে কলাম্বিয়ানদের স্টাইলে। অথবা এক এক করে কেটে নামিয়ে দেবে হাত-পা। সেক্ষেত্রে খুব কষ্ট পেয়ে মরতে হবে ওকে।

চেয়ার ছেড়ে আবারও সিঙ্কের সামনে গেল অ্যারন। কল ছেড়ে পানির ঝাপটা দিল চোখে-মুখে। গলা চিরে বেরোল করুণ গোঙানি।

ওদিকে আবারও বেজে উঠেছে ফোন। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে টেবিলের দিকে এগোল সে। ভাবছে: এবার কী? বার্ব কি আরও খারাপ কোন খবর দেবে? এরই ভেতরে ওকে খুন করতে রওনা হয়েছে কার্টেলের আততায়ী?

‘আমার এবার কী করা উচিত?’ ভাঙা গলায় কথাটা বলে ফোন তুলে কানে ঠেকাল অ্যারন কনার।

‘আপনার জন্যে সুসংবাদ আছে,’ বলল চিফ অভ পুলিশ রিগবি।

তার কথা শুনতে শুনতে অ্যারনের মনের মেঘলা আকাশে দেখা দিল একফালি সোনালি রোদ। নিজের প্রশংসা না করে পারল না রিগবি, তার হাতে ধরা পড়েছে জ্যাকুলিন সিলভেস্টার। তাকে নেয়া হয়েছে গোপন এক বাড়িতে।

‘তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে?’ জানতে চাইল অ্যারন।

‘না, কাগজে-কলমে তা করা হয়নি। আপাতত হারিয়ে গেছে সে। যারা ধরে এনেছে, তারা আমার দলের লোক।’

‘গুড!’ চাপা শ্বাস ফেলল অ্যারন। তার মনে জন্মে গেছে বেঁচে থাকার নতুন এক আশা। জ্যাকুলিন সিলভেস্টার এখন বড় কোন হুমকি নয়। হয়তো মেয়েটার জন্যেই ধরা পড়বে মাসুদ রানা। সেক্ষেত্রে কষ্ট হলেও সব সামলে নেবে অ্যারন। ড্রাগ কার্টেলের বস সেক্ষেত্রে হামলা করবে না। তাদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করবে সে। এদিকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারলে হয়ে উঠবে স্টেট গভর্নর। তখন হাতের মুঠোয় চলে আসবে অনেক কিছু। ভুলে যাবে ব্ল্যাক বেয়ার দুর্ঘটনা। হয়তো একসময় সে হবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। এখন বড় কথা হচ্ছে, ওর ওপর থেকে কেটে যাচ্ছে বিপদের কালো মেঘ।

‘আপনি আমাকে কী করতে বলেন? মানে, মেয়েটার ব্যাপারে?’ জানতে চাইল রিপার রিগবি।

নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছে পুলিশ চিফ। ধীরে ধীরে ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটল মেয়র অ্যারনের। কটেজ আর ব্ল্যাক বেয়ার খুইয়ে বসে এখন ওর চাই নতুন আস্তানা। সেটা হতে হবে এমন একজায়গা, যেখানে লুকিয়ে রাখা যাবে জিম্মিকে। নিজের বাড়ি বা এয়ারক্রাফট হ্যাঙার নিরাপদ নয়। এখন মাত্র একজায়গায় মেয়েটাকে রাখা যেতে পারে।

‘কুত্তীটাকে র‍্যাঞ্চে নিয়ে যান,’ বলল অ্যারন কনার।

কথা শুনে দ্বিধায় পড়ল রিপার রিগবি। ‘স্পিয়ারহেড? বড় রিয়ানের বাড়িতে? বলেন কী, অ্যারন, আপনার মাথা ঠিক আছে তো?’

বুড়ো শয়তানটা এমন কী পুলিশের চিফকে ঘাবড়ে দেয়, তিক্ত মনে ভাবল অ্যারন। নিচু গলায় বলল, ‘বুড়ো ক’দিনের জন্যে ঘোড়া বিক্রির চুক্তি করতে ক্যানসাসের টোপেকায় গেছে। ভাববেন না। গোটা বাড়িতে কেউ নেই এখন।’

বিগ রিয়ন এখন দু’ শ’ মাইল দূরে আছে শুনে স্বস্তির শ্বাস গোপন করল পুলিশ চিফ রিগবি। ‘ঠিক আছে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে মেয়েটাকে ওখানে পৌছে দেব।

‘দেরি করবেন না, চিফ। সঙ্গে করে আনবেন আপনার দলের কয়েকজনকে।’

ওখানে কোন হামলার ভয় পাচ্ছেন?’ জানতে চাইল রিগবি।

‘আমরা সামলাতে পারব না, এমন কিছু নয়,’ মৃদু হেসে বলল অ্যারন কনার। ‘তবে দলে ভারী হলে ক্ষতি নেই।’

একান্ন

টুলসা কাউন্টির সীমানায় ঢুকে আবারও জ্যাকিকে ফোন দিল রানা। চারপাশে এখন ব্রোকেন অ্যারো এলাকা। ক’বার বাজলেও ফোন ধরল না জ্যাকি।

‘খারাপ কিছু?’ মনে মনে বলল রানা।

কথা না শুনে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে জ্যাকি। এখন ফোন ধরছে না। অথচ, ওর ফোনের জন্যে অপেক্ষা করার কথা মেয়েটার। মনের ভেতরে কু ডাকছে রানার। এ-ছাড়া আরও এক ব্যাপারে ও চিন্তিত। ব্ল্যাক বেয়ার ফার্মে ছিল না বার্ব ও স্ক্যালেস। তারা ওখানে থাকলে এবং মারা পড়লে নতুন কোন ঝামেলা পোহাতে হতো না। এদিকে এখন সবচেয়ে বড় ট্যাকটিকাল সুবিধা হারিয়ে বসেছে রানা।

ব্ল্যাক বেয়ারে হঠাৎ হামলা করে তাদেরকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। তবে এবার পরের হামলার জন্যে তৈরি থাকবে অ্যারন কনার ও তার দলের লোকেরা। রানার জন্যে ‘এটা কঠিন বাস্তবতা। তার ওপরে এখন কোথায় আছে বার্ব ও স্ক্যালেস, সেটা জানতে না পারা ওর জন্যে খুব বিপজ্জনক। তারাই বোধহয় কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে জ্যাকিকে। ফলে এবার তৈরি হবে নানান ধরনের জটিলতা।

চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ করে অ্যাক্সেলারেটরে চাপ আরও বাড়াল রানা। হেমি ভি৮ ইঞ্জিনের ঘড়-ঘড় আওয়াজ তুলে অপেক্ষাকৃত মন্থরগতি গাড়ি ও ট্রাক পিছনে ফেলে ছুটছে ব্যারাকুডা। টার্নপাইকে পৌছে বাঁক নিয়ে রানা চলল টুলসা শহরের দিকে। মাত্র কয়েক মিনিট পর পৌছে যাবে হোটেলে। তখন খোঁজ নিলেই হয়তো জানা যাবে কোথায় গেছে জ্যাকি।

কথাগুলো মাত্র ভেবেছে রানা, এমন সময় পাশের সিটে অচেনা সুরে বেজে উঠল স্মার্টফোন। ব্ল্যাক বেয়ারের মৃত গার্ড রেনির কাছ থেকে ফোন ও ওয়ালেট সংগ্রহ করেছে রানা। তৃতীয়বার ফোন বাজার পর সামান্য দ্বিধা করে রিপ্লাই বাটন টিপে ডিভাইসটা কানে ঠেকাল রানা।

‘কী? ঝলমলে এই দিনে তোমার কেমন লাগছে?’

মেয়র কনারের কণ্ঠ চিনে শক্ত হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরল রানা। লোকটা আছে ফুর্তির মুডে। ভাবটা এমন, ফোন দিয়েছে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর কাছে। কনারের কথায় কেন যেন শিরশির করে উঠল রানার মেরুদণ্ড।

‘কংগ্র্যাচুলেশন্স, রানা। একটু আগে জানলাম আমার খরচে দারুণ মজা করেছ। এ-ও বুঝে গেছি, তাতে খুব খুশিও হয়ে উঠেছ। নাকি আমি ভুল বললাম?’

চুপ করে থাকল রানা।

‘অবশ্য এখন ফোন করেছি অন্য কাজে। যেন ভেবে না বসো যে শেষ হয়ে গেছে সব।’ লোকটা হাসি-হাসি সুরে কথা বললেও সেসব তীরের মত এসে বিঁধছে রানার কানে। ‘সত্যি বলতে, মজা মাত্র শুরু। একটু আগে আমার আতিথ্য নিয়েছে এক মেয়ে। তুমি বোধহয় তাকে চেনো। তা-ই না, রানা?’

ওকে ফোনে দাও,’ বলল রানা। ঘণ্টায় নব্বুই মাইল বেগে পিছিয়ে পড়ছে কালো রাস্তা।

হাসতে শুরু করে বলল অ্যারন কনার, ‘সরি, রানা। আপাতত তোমার সঙ্গে কথা বলার সাধ্য তার নেই।’

ওর কোন ক্ষতি হলে তুমিও আর আস্ত থাকবে না,’ সতর্ক করল রানা।

‘না, না, ওর ক্ষতি হবে কেন? ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। দরকার হলে ওর জন্যে ফুলশয্যার ব্যবস্থা করে দেব।’

‘তুমি আসলে কী চাও, অ্যারন কনার?’

‘আমি চাই তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে। ভাবছি তোমার মত দক্ষ একজন অনুচর পেলে মন্দ হয় না। দু’জন মিলে এ- বিষয়ে একটা জরুরি মিটিং করব। তুমি কী বলো?’

‘আমাকে জানাও কোথায় আসতে হবে, ‘বলল রানা।

‘সরাসরি চলে এসো স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চে। কারও কাছে খোঁজ নিলেই সে দেখিয়ে দেবে কীভাবে আসতে হবে।

‘আমি যত দ্রুত সম্ভব হাজির হব,’ বলল রানা।

আবারও হাসল অ্যারন কনার। তবে সেই হাসির ভেতরে আছে চাপা রাগ। ‘তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। তোমার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। দেখা হলে মনে হবে, বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলো ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর সঙ্গে।

‘হ্যাঁ, দেখা হবে,’ বলে কল কেটে দিল রানা।

জানালা দিয়ে ছুঁড়ে দিল ফোনটা। এখন এক শত বিশ মাইল বেগে শহর লক্ষ্য করে ছুটছে প্লিমাউথ ব্যারাকুডা।

বায়ান্ন

মুচকি হেসে শার্টের পকেটে ফোন রেখে দিল কনার। তার পরনে হাতে সেলাই করা জিন্সের প্যান্ট, সাদা হালকা শার্ট, পায়ে কাউবয় বুট। প্যান্টের কোমরে রুপার বার্কলসহ ঘড়িয়ালের চামড়ার বেল্ট। ঊরুতে জন বিয়াঞ্চি হোলস্টারে .৪৪ ক্যালিবার স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন রিভলভার। অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়েছে ওটা। নিকেল প্লেট চকচক করছে আয়নার মত। কোকোবোলো কাঠের লালচে গ্রিপে মাদার- অভ-পার্ল বসিয়ে খোদাই করা হয়েছে এ এবং সি আদ্যক্ষর। রিভলভারটা সঙ্গে আছে বলে নিজেকে খুব ক্ষমতাশালী বলে মনে হচ্ছে তার।

আজকের দুপুরটা চমৎকার। টিকটিক শব্দ তুলছে একটু আগে বন্ধ করা ক্যাডিলাকের উত্তপ্ত ইঞ্জিন। গাড়ির পাশে থেমে চারপাশে তাকাল অ্যারন। মাথার ওপরে বিশাল আকাশ, নিচে তিনদিকে দূরে গেছে স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চের ঘাসে ভরা প্রকাণ্ড রেঞ্জ। এদিকটা এত প্রশান্তিময় ও নীরব যে মনে হচ্ছে এটাই বুঝি স্বর্গ। বেড়া দেয়া ঘাসের মাঠে চরছে ভাল জাতের নিখুঁত সব ঘোড়া। হোয়াইটউড দিয়ে তৈরি এক শ’ বছরেরও বেশি পুরনো বিশাল র‍্যাঞ্চ হাউসটাকে ছায়া দিচ্ছে কয়েকটা মস্ত আকারের ওক গাছ। ডালে ডালে কাকলি করছে একঝাঁক পাখি। হ্যাঁ, সত্যিই আজ দারুণ একটা দিন। যদিও একটু আগেও সময়টা ছিল খুব দুশ্চিন্তাময়। এরপর হঠাৎ করে পরিস্থিতি চলে এসেছে অ্যারনের মুঠোর ভেতরে।

আগেই বার্বকে বলেছে সে, জ্যাকুলিন সিলভেস্টার হচ্ছে তাদের জন্যে জটিল এক তালা খোলার সহজ চাবি।

আর মাসুদ রানা?

সে চাইছে হাতের মুঠোয় নেবে সেই চাবি।

কিন্তু আর কখনও ওটা পাবে না সে।

আনমনে হাসল মেয়র অ্যারন কনার। এবার এক এক করে সব দিক সামলে নেবে সে। কোথাও কোন খুঁত রাখবে না।

ব্যক্তিগত পথে ভ্যান আসতে দেখে ক্যাডিলাক থেকে সরে কয়েক পা এগোল অ্যারন। তার পাশে এসে থামল ভ্যান। ওটা থেকে নেমে পড়ল বার্ব ও স্ক্যালেস। ভ্যানের স্লাইডিং ডোর খুলে নামল মর্গ্যান, স্টিভেন্স ও লুকম্যান। শেষজনের কানে ভারী ব্যাণ্ডেজ। তাকে দেখাচ্ছে মড়াখেকো ধাড়ি শকুনের মত। আজ স্ক্যালেসের টি-শার্টে লেখা: গড সেভ মি, আই অ্যাম নট আ পুলিস!

‘আরও লোক আনলে না কেন?’ চোখ সরু করে তাদেরকে দেখল অ্যারন। পরক্ষণে ভাবল: মাত্র একজনকে খতম করতে আবার কতজনকে লাগে?

‘আমাদের দলে জীবিত আর কেউ নেই,’ বলল বার্ব। ‘মেয়েটাকে র‍্যাঞ্চে আনা হয়েছে?’

‘একটু পর পৌঁছুবে,’ দিগন্তে চোখ বুলিয়ে বলল অ্যারন। মিনিটখানেক পর দেখতে পেল ধুলোর বড় একটা ঝড় আসছে র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে। তার ভেতরে সামনের গাড়িটা পুলিশ চিফ রিগবির বিএমডাব্লিউ সেভেন সিরিযের সেডান। পেছনে আট সিটের লিংকন ন্যাভিগেটর।

ভ্যান ও ক্যাডিলাকের পাশে এসে থামল গাড়িদুটো।

বিএমডাব্লিউ থেকে নামল রিপার রিগবি, কাঁধের হোলস্টারে রিভলভার। পাশের লিংকন ন্যাভিগেটর থেকে নামল পুলিশ অফিসার র‍্যাণ্ডি পার্সন, মাইক হ্যানোভার, ববি বাইবেল ও ক্যাল অ্যামেট। চারজনই মেয়র অ্যারন কনারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পাচ্ছে।

গাড়ির পেছন-সিট থেকে জ্যাকিকে টেনে নামাল ক্যাল অ্যামেট। তার হাত থেকে ছুটে যেতে চাইল মেয়েটা। তবে গায়ের জোরে পারল না।

‘সাহস আছে মেয়েটার,’ ঘোঁৎ করে উঠল চিফ রিগবি।

জ্যাকি পরীর মত সুন্দরী। ওকে দেখে জিভে লালা চলে এসেছে স্ক্যালেসের।

‘চমৎকার দিন, কী বলো, ‘মিস,’ হাসল অ্যারন কনার। ‘স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চে তোমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছি।’

‘নরকের আগুনে পুড়ে মরবি, হারামখোর!’ মাটিতে থুতু ফেলল জ্যাকি।

‘বলেছি না, ওর সাহস আছে?’ বলল পুলিশ চিফ।

‘পরে ঠাণ্ডা মেরে যাবে,’ ব র্ব ও স্ক্যালেসকে ইশারা করল অ্যারন। ক্যাল অ্যামেটের কাছ থেকে জ্যাকিকে বুঝে নিল দুই খুনি। শক্তহাতে ধরেছে মেয়েটার দু’কনুই। বাড়ির দিকে না গিয়ে আস্তাবলের দিকে চলল অ্যারন। গত ক’বছরে মুনাফা কমে গেছে র‍্যাঞ্চের। ভাড়াটে লোকগুলোকে বিদায় করে দিয়েছে বিগ রিয়ান। বিক্রি করেছে প্রচুর ঘোড়া। ফলে আস্তাবল এখন প্রায় খালি। অ্যারন খুশি, শেষমেশ বয়সের কাছে হেরে যাচ্ছে হারামি বুড়ো। র‍্যাঞ্চ হাউসের পাশে ইঁটের তৈরি আস্তাবলে ঢুকে ছোট এক ঘরের দরজা দেখাল অ্যারন। ‘বার্ব, স্ক্যালেস, ওকে ওখানে আটকে রাখো।’

‘ডার্লিং, আমি কিন্তু পরে তোমার বুকের গোলাপি বোঁটা দুটো কামড়ে ছিঁড়ে নেব। তুমি আবার কিছু মনে কোরো না!’ জ্যাকির দিকে চেয়ে জিভ দিয়ে দু’ঠোঁট চাটল স্ক্যালেস। বন্দিনীকে ঘরের ভেতরে ঠেলে দিয়ে দড়াম করে ঘরের দরজা বন্ধ করল সে। আটকে দিল ছিটকিনি।

‘এখন থেকে তুমি মেয়েটার জেলরক্ষী,’ বলল অ্যারন।

‘সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ,’ চওড়া হাসল স্ক্যালেস।

এদিকে অ্যারনের দস্যুদলের সদস্য আর টুলসা পুলিশ অফিসারদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সন্দেহ ও বিদ্বেষের পরিবেশ। কড়া চোখে একে অপরকে দেখছে তারা। সবাইকে সহজ করতে গিয়ে বলল অ্যারন, ‘মনে হয় না তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ে জিতে যেতে পারবে মাসুদ রানা।’

‘তো ঝামেলার পেছনে সেই হারামজাদা?’ জানতে চাইল পুলিশ চিফ রিগবি।

‘সে কিছুই না,’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল অ্যারন।

তাতে মাথা নাড়ল বার্ব। ‘সে আসলে ভয়ঙ্কর এক টর্নেডোর মত।’

‘একবার তার সামনে প্রিয় বান্ধবীর চামড়া ছিলতে শুরু করলে আর বাড়াবাড়ি করতে পারবে না; বলল মেয়র অ্যারন।

‘আমার মনে হচ্ছে, আপনার এখন কোথাও লুকিয়ে পড়া উচিত,’ বলল বার্ব।

‘তুমি বৃথাই দুশ্চিন্তা করো, শুকনো হাসল অ্যারন।

পুলিশ অফিসারেরা দেখেছে বার্বের কথা শুনে হঠাৎ করে আমসি হয়ে গেছে মেয়রের মুখ। চট্ করে রিভলভারের বাঁটে হাত দিয়েছে লোকটা।

হাতঘড়ি দেখল বার্ব। ‘যে-কোন সময়ে আসবে রানা। মর্গ্যান, সবার হাতে অস্ত্র দাও।’

মাথা দুলিয়ে ভ্যানের পেছনের দরজা খুলল মর্গ্যান পামার। ভ্যানে উঁকি দিয়ে জানতে চাইল অফিসার মাইক হ্যানোভার, ‘তোমরা কী ধরনের অস্ত্র এনেছ?’

মর্গ্যানের কাছ থেকে নিয়ে হ্যানোভারের হাতে এম ফোর ব্যাটল রাইফেল দিল স্ক্যালেস। ‘এটা তোমার কাজে লাগবে। মাসুদ রানা সহজে মরে যাওয়ার বান্দা নয়।’

‘মনে হচ্ছে ভয় পেয়েছ, উনি?’ বলল রিপার রিগবি। আগেও তার সঙ্গে দেখা হয়েছে স্ক্যালেসের। তখন পুলিশ চিফ বুঝে গেছে, প্রাক্তন মেজর আসলে স্বয়ং শয়তানের দোসর।

‘ভয় না পেলেও সতর্ক হচ্ছি,’ মধ্যমা তুলে পুলিশ চিফের পশ্চাদ্দেশ লক্ষ্য করে বিশেষ ইঙ্গিত করল স্ক্যালেস। ‘এই দুনিয়ায় এমন কেউ নেই, যাকে ভয় পাবে টনি স্ক্যালেস।

এরইমধ্যে ভ্যান ও গাড়ি থেকে নামানো হয়েছে সব অস্ত্র। পুলিশদের আনা অস্ত্র বের করেছে ববি বাইবেল ও র‍্যাণ্ডি পার্সন। পুলিশ দলের সবার হাতে দেয়া হলো রেমিংটন টুয়েলভ গেজ পাম্প শটগান আর ০৮৫৫০ মডেলের এআর ফাইভ ফাইভ সিক্স রুগার রাইফেল। এ-ছাড়া সবার সঙ্গে আছে পিস্তল বা রিভলভার। শেষবার অস্ত্র পরীক্ষা করার সময় সবার ভেতরে নামল নীরবতা।

পুলিশ অফিসারদের পেটমোটা কেভলার ভেস্ট পরতে দেখে টিটকারির হাসি হাসল স্ক্যালেস। ‘এবার বলো দেখি, চিফ রিগবি, ভয় পাচ্ছে আসলে কারা?

‘র‍্যাঞ্চ হাউসে যাওয়া যাক,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল অ্যারন।

বিগ রিয়ান চেয়েছে ওকি ডিযাইনে র‍্যাঞ্চ হাউস সাজিয়ে নিতে। প্রকাণ্ড ঘর তার পছন্দ। আসবাবপত্রও স্বাভাবিকের দ্বিগুণ আকারের। চামড়ামোড়া দামি সোফা ও চেয়ারের ক্লাঠের অংশে ভার্নিশ করা। দেয়ালে দেয়ালে শিংওয়ালা হরিণের মাথা। কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে গণ্ডার, বাইসন ও সিংহের লাশের পাশে রাইফেল বা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে বিগ রিয়ান। যৌবনে নানান দেশে গিয়ে শিকার করেছে সে। ছাতে ঝুলছে সত্যিকারের ওয়েল্স্ ফার্গো স্টেজকোচের চাকা। ওটা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ঝাড়বাতি। বিশাল লিভিংরুমের এক অংশ বুনো পশ্চিমের সেলুনের বার-এর মত। ঘরের দেয়ালে ঝুলছে চেরোকি বর্শা, টওমাহক, কাউবয়দের পুরনো সিক্সগান ও উইনচেস্টার রাইফেল। ছোটবেলা থেকে প্রাচীন এ আবহে বড় হয়েছে বলে এই ঘরের সৌন্দর্য দ্বিতীয় বার দেখতে গেল না অ্যারন কনার। বসে পড়ল চামড়া মোড়া গভীর এক কাউচে। চারপাশের চেয়ারে বসল কেউ কেউ। অন্যরা হেলান দিল দেয়ালে। শুরু হলো মাসুদ রানার জন্যে অপেক্ষার পালা।

পেরিয়ে গেল বহুক্ষণ।

ঘণ্টাদুয়েক পর অধৈর্য হয়ে কাউচ ছেড়ে ঘরে পায়চারি করতে লাগল অ্যারন কনার। বহু দূরে ফাঁকা চোখে চেয়ে আছে বার্ব। গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে রাইফেল। চুইংগাম চিবুতে চিবুতে মনের আয়নায় জ্যাকির লোভনীয় নগ্নদেহ দেখছে স্ক্যালেস।

‘ড্রিঙ্ক হলে কেমন হয়?’ স্পিরিট কেবিনেটের দিকে তাকাল মাইক হ্যানোভার। এতক্ষণ ধরে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে এখন গরম লাগছে তার।

‘আমি হলে ভুলেও ড্রিঙ্ক করতাম না,’ মহাশূন্য থেকে চোখ না সরিয়ে বলল বার্ব। ‘সতর্ক থাকতে হবে।

ঘরে আবারও নামল নীরবতা। ধীরে ধীরে পেরোতে লাগল সময়। এক সময়ে পশ্চিমে ঢলে গেল সূর্য। আকাশে ছড়িয়ে দিল সোনালি-লাল আলো। তারপর আকাশ হলো বেগুনি। একটু পর নেমে আসবে সন্ধ্যার কুচকুচে কালো আঁধার।

‘ব্যাটা এল না কেন?’ নিজেকে প্রশ্ন করল ববি বাইবেল। জবাব দিল না কেউ।

আরও কিছুক্ষণ পর নামল সন্ধ্যার আঁধার। আকাশে মিটমিট করতে লাগল লাল-নীল-সাদা কোটি নক্ষত্র। এখনও স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চে পা রাখেনি মাসুদ রানা। যাতে বাড়ির ভেতরে চোখ বোলাতে না পারে সে, সেজন্যে টেনে দেয়া হলো ঘরের পর্দা। কোথায় যেন হাহাকার করল নিঃসঙ্গ এক কয়োটে।

থমথমে নীরবতায় অস্বস্তি নিয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল অফিসার হ্যানোভার ও অ্যামেট। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে . হবে সেটা ভাবতে পারেনি তারা। টেবিলে গরম খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে তাদের স্ত্রীরা। খাবার শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ টিভি দেখে শুয়ে পড়ত তারা।

‘ব্যাটা আসলে ভয় পেয়েছে,’ অনেকক্ষণ পর নীরবতা ভাণ্ডল অ্যারন কনার। ‘হয়তো আর এখানে আসবেই না?’

‘না, সে আসবে,’ চাপা শ্বাস ফেলল বার্ব।

আরও পঁচিশ মিনিট পর পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল, হেডলাইট জ্বেলে র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগিয়ে আসছে একটা গাড়ি।

সবাই ভিড় করল জানালার কাছে। কান পেতে শুনল ভিএইট ইঞ্জিনের ভারী ঘড়ঘড়ে গর্জন।

এসেছে,’ সবাইকে সতর্ক করে দিল রিগবি, ‘এবার সবাই তৈরি হও!’

তেপ্পান্ন

‘ব্যাটার বুকে কি ভয় বলে কিছুই নেই? অবিশ্বাস্য!’ বাড়ির দিকে গাড়ির আলো এগিয়ে আসতে দেখছে র‍্যাণ্ডি পার্সন। ‘সরাসরি আসছে খুন হওয়ার জন্যে!’

‘ওর হয়তো মাথা নষ্ট হয়ে গেছে,’ বলল চিফ রিগবি। হোলস্টার থেকে নিল কোল্ট পাইথন রিভলভার। শ্বাস ফেলে বলল ‘এসো, এবায় কাজ শেষ করি!

স্লিক স্পিক শব্দে পাম্প করে রেমিংটন শটগানের চেম্বারে গুলি ভরল ববি বাইবেল। শব্দটা শুনলে যে-কারও গলা শুকিয়ে যাবে। স্ক্যালেস নিজের এম ফোর কারবাইনের সেফটি ক্যাচ অফ করল। চট করে দেখল বন্ধু বার্বের মুখ। দু’জনই একই কথা ভাবছে। আজ শালার পুলিশের বাচ্চারা একই দলে লড়লেও, এমন কথা নেই যে দু’দিন পর ওদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না তারা। ওরা খুন হলে বাহাদুরির ভঙ্গি নেবে, যেন উদ্ধার করেছে গোটা মানব সভ্যতাটাকে।

আরেক জানালার পর্দা ফাঁক করে চেয়ে আছে অ্যারন। বিড়বিড় করল, ‘লোকটা করছেটা কী?’ র‍্যাঞ্চ হাউসের কাছে চলে এল সাদা আলো। আর তখনই প্রথমবারের মত গাড়িটা চিনতে পারল অ্যারন। এক সেকেণ্ডে শুকিয়ে গেল তার গলা।

গাড়িটা ডজ র‍্যাম!

মাসুদ রানা আসেনি!

বাড়ি ফিরেছে বিগ রিয়ান!

‘হায়, ঈশ্বর!’ বিড়বিড় করে বলল অ্যারন। অবশ হয়ে গেছে তার সারাশরীর। বাড়ির বাইরে এসে থামল পিকআপ ট্রাক। দপ করে নিভে গেল হেডলাইট। বন্ধ হলো ইঞ্জিন। ক্যাব থেকে নেমে এল বুড়ো রিয়ান। ক্যানসাস থেকে ড্রাইভ করে এসেও মোটেই আড়ষ্ট নয় তার হাত-পা। বুড়োর পরনে জিন্সের প্যান্ট, ডেনিম জ্যাকেট, পায়ে কাউবয় বুট। কাঁধে ফিতায় ঝুলছে ব্যাগ। উঠনে চার চারটে গাড়ি দেখে সেদিকে চেয়ে রইল সে। তার দু’ভুরু কুঁচকে যেতে দেখল অ্যারন। এর মানে এবার আসছে ভয়ঙ্কর ঝড়!

মস্ত ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল অ্যারন, ‘সর্বনাশ!’

ধুপ শব্দে খুলে গেল বাড়ির সামনের দরজা। জোরে বন্ধ করা হলো কবাট। করিডরে পায়ের জোরালো আওয়াজ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর লিভিংরুমে ঢুকল বিগ রিয়ান। পাকা ভুরুর তলা দিয়ে কঠোর চোখে দেখছে একমাত্র ছেলেকে। বাড়ির ভেতরে সশস্ত্র কয়েকজনকে দেখে রেগে কাঁই হয়ে গেছে সে।

‘ভেবেছি তুমি টোপেকাতে আছ,’ মগজে আর কোন কথা এল না অ্যারনের।

‘এখানে এসব কী হচ্ছে?’

‘চলো, পাশের ঘরে যাই,’ বাবার কনুই ধরে দরজার দিকে নিয়ে যেতে চাইল অ্যারন। বিগ রিয়ানের গলার ভেতর থেকে বেরোচ্ছে ঘড়ঘড় আওয়াজ। তাকে প্রায় জোর করেই লিভিংরুম থেকে বের করে উল্টোদিকের ঘরে ঢুকল অ্যারন। এ-ঘর ব্যবহার করা হয় টিভি লাউঞ্জ হিসেবে।

ভীষণ গম্ভীর হয়ে বিগ রিয়ান বলল, ‘কাজ শেষ, তাই আগেই বাড়ি ফিরেছি। আর এখন দেখছি এখানে জড় করেছ একদল সশস্ত্র শয়তান বাঁদর। আর সেজন্যে এবার যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা দিতে হবে তোমাকে। শুনি তোমার কী বলার আছে, অ্যারন?’

‘এসবের সঙ্গে তোমার কোন সম্পর্ক নেই, বাবা। জরুরি কাজে এদেরকে ডেকেছি। তুমি এবে জড়িয়ে গেলে যখন- তখন ক্ষতি হবে তোমার।’

‘ফালতু কথা বাদ দাও, অ্যারন। তোমার আবার কীসের জরুরি কাজ? পোঁদে কাজ গুঁজে দিলেও তো কিছুই তোমার মাথায় গিয়ে ঢোকে না!’

‘বাবা, একটু বোঝার চেষ্টা করো…

‘যা বোঝার বুঝেছি! দেরি না করে এক্ষুণি তোমার লোক নিয়ে বিদায় হও!’

রাগে লালচে হয়ে গেল অ্যারনের মুখ। ‘তা এখন সম্ভব নয়।’

‘আমার কথার ওপর দিয়ে কী বললে, অ্যারন?’

‘বলেছি, সেটা এখন সম্ভব নয়। আমরা জরুরি মিটিং করছি। এরা আমার সহযোগী।’

‘সহযোগী?’ দাঁতে দাঁত পিষল বিগ রিয়ান। খপ করে ধরল অ্যারনের বাহু। ‘কীসের সহযোগী? আমাকে গাধা বলে মনে করো তুমি? ভেবেছ সস্তা ক’টা বাটপার দেখলে তাদেরকে আমি চিনতে পারি না?’

‘লিভিংরুমে তুমি কিন্তু নিজেই দেখেছ চিফ অভ পুলিশকে।

‘হ্যাঁ! তো কী? আমাকে অন্ধ মানুষ বলে মনে হয় তোমার? ভাবছ, কিছুই বুঝতে পারছি না?’ অ্যারনের বাহুতে আঁকশির মত এঁটে বসেছে বৃদ্ধের আঙুলগুলো।

‘হাত ছাড়ো!’ হ্যাঁচকা টানে বাহু ছুটিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল মেয়র।

‘কেন এখানে লোক জড় করেছ, কাপুরুষ হারামজাদা?’ চাপা স্বরে বলল বিগ রিয়ান। ‘আবার কোন্ ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ? এজন্যে তোমাকে এত কষ্ট করে বড় করেছি, যাতে একটা ছেঁচড়া ক্রিমিনাল হয়ে ওঠো?’

সত্য কথা হঠাৎ করে শুনে মগজে আগুন ধরে গেল অ্যারনের। হিসহিস করে বলল সে, ‘তোমার সময়ে তুমি ছিলে কিংবদন্তী! তাই সহজেই এসব বলতে পারছ! কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, এ জীবনে আমি কী পেয়েছি? মাথার ওপরে তোমার মত এক দানব থাকলে আমি নিজে কী করে নাম করব? এটা কখনও তোমার মাথায় ঢুকেছে?’

‘ছোটবেলা থেকেই তুমি কাপুরুষ আর বাটপার,’ রাগত স্বরে বলল বিগ রিয়ান। ‘আর এখন দেখছি আমার বাড়িতে বসে গোপনে খুন করতে চাও সাহসী কাউকে! মানুষটাকে অ্যাম্বুশ করবে, এটাই তোমার যোগ্যতা ঠিক কি না!’

‘আমি…’

‘এটাকেই ব্যবসা বলে চালিয়ে দিতে চাইছ? জবাব দাও, আমার চোখের আড়ালে কী করে বেড়াচ্ছ তুমি! মনে রেখো, এখন থেকে আমার কাছ থেকে একফোঁটা সাহায্য পাবে না! রাগে বিস্ফারিত হয়েছে বৃদ্ধের দু’চোখ। ‘এমন বাড় বেড়েছ যে ধরে নিয়েছ বেয়াদবি করে পার পেয়ে যাবে?’

‘বাবা, তুমি কিন্তু নিজেই বেশি বাড়াবাড়ি করছ!’

‘নষ্ট হয়ে গেছে তোর আত্মা, খেঁকিয়ে উঠল বিগ রিয়ান। ‘আমি মনে করি না যে তোর মাথায় ঘোড়ার গুয়ের সমান বুদ্ধি আছে! কখনও ভেবেছিস, আমাদের বংশ কোথা থেকে এসেছে সেটা ফাঁস হয়ে গেলে মুখেও থুতু দেবে না কেউ?’ মস্ত দু’মুঠো বাগিয়ে অ্যারনের দিকে এক পা এগোল বৃদ্ধ।

এতদিন পর বাবার হাতে আবার মার খেতে হবে ভেবে তিরিক্ষি হয়ে গেল অ্যারনের মেজাজ। হ্যাঁচকা টানে হোলস্টার থেকে বের করল রিভলভার। ‘সেই ছোটবেলা থেকেই দেখছি যে নিজেই তুমি অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করছ! বহু কিছু থেকে বঞ্চিত করেছ আমাকে! খবরদার! আর এক পা-ও সামনে বাড়বে না!’

হলদে দাঁত খিঁচিয়ে ছেলেকে পেটাতে সামনে বাড়ল বিগ রিয়ান। ‘পিটিয়ে তোর হাড় ভাঙব, হারামজাদা ছেলে!’

‘আর এক পা-ও এগোবে না! পিছিয়ে যাও!’ বাবার বুকের দিকে অস্ত্রের নল তাক করে হ্যামার কক করল অ্যারন।

তিক্ত চোখে অস্ত্রটা দেখে নিয়ে আরেক পা এগোল বিগ রিয়ান। এখন তাকে আট ফুটি দানব বলে মনে হচ্ছে অ্যারনের। তার বাবা যেন গ্র্যানিটের বিশাল এক পাহাড়। লাখ লাখ টন ওজন নিয়ে ঝুঁকে আসছে চাপা দেবে বলে। ‘আমি তোকে পেটালে তুই কী করবি, শুয়োর কোথাকার? গুলি করবি? বুড়ো একলোককে? সাহস থাকলে সেটাই কর্! জানোয়ার কোথাকার!’ অ্যারনের বুকে বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল বৃদ্ধ। ঠেলা মেরে ছেলেকে পিছিয়ে দিল একফুট।

‘আমি কিন্তু তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাবা!’

ভিক্ত চোখে ছেলেকে দেখল বৃদ্ধ বাবা। রাগে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ‘বুড়ো বাপকে রিভলভার হাতে হুমকি দিস্? তোর লজ্জা লাগে না, অ্যারন? যেদিন তোর মা’র পেট থেকে বেরোলি, সেদিনই আমার উচিত ছিল তোকে মেরে ফেলা! তাতে হয়তো শান্তি পেত তোর মা’র আত্মা!’

পেছাতে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে অ্যারনের। আর- সরে যেতে পারবে না। তার হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নেয়ার জন্যে থাবা দিল বিগ রিয়ান।

আর তখনই ‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল রিভলভার।

ম্যাগনাম বুলেট যেন শুষে নিল ঘরের বাতাস; হতবাক হয়ে তিনসেকেও ছেলেকে দেখল বিগ রিয়ান। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার বুকে গুলি করেছে নিজের ছেলে! চোখ নিচু করে দেখল বুকের ফুটো দিয়ে ছিটকে বেরোচ্ছে টকটকে লাল রক্ত। এক পা পিছিয়ে গেল বৃদ্ধ। ডান হাঁটু ভাঁজ হলো তার। তারপর অন্য পা। কাত হয়ে পলিশ করা কাঠের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল দানবীয় মানুষটা। পতনের ধুপ্ শব্দটা গুলির আওয়াজের চেয়ে কম বলে মনে হলো না অ্যারনের। বাবার দিকে তাকাল সে, পরক্ষণে দেখল হাতের রিভলভার।

দড়াম করে খুলে গেছে আধভেজানো ঘরের দরজা। প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকে মেঝের দিকে তাকাল বার্ব। নিথর হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে বিগ রিয়ান।

‘আমি কিন্তু খুন করিনি,’ নিজের গলা অচেনা লাগল মেয়রের। ‘যা করার করেছে মাসুদ রানা! তোমরা আদালতে সেটা বলবে, বুঝতে পেরেছ? র‍্যাঞ্চ হাউসে ঢুকে নিরস্ত্র এক বুড়ো মানুষকে খুন করেছে সে! মনে রেখো, তুমি এসবের চাক্ষুষ সাক্ষী!’

চুপ করে থাকল বার্ব। কী বলবে মাত্র ভাবতে শুরু করেছে, এমন সময় উল্টোদিকের ঘর থেকে এল গুলির বিকট আওয়াজ।

চুয়ান্ন

ঘুরে করিডরে বেরিয়ে এল বার্ব। পেছনেই অ্যারন কনার, হাতে উদ্যত রিভলভার। উল্টোদিকের ঘরে ঢুকে তারা দেখল, সোফা ও চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে সবাই। সবার চোখ এখন উঠনে। জানালার সামনে আছে ববি বাইবেল, হাতে পাম্প অ্যাকশন শটগান। অস্ত্রটার নলের মুখ থেকে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। গুলি ফুটো করেছে জানালার কাঁচ।

‘এখানে কী হয়েছে?’ জানতে চাইল বার্ব।

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল বাইবেল। জানালার দিকে তাক করেছে বন্দুক। নিচু গলায় বলল, ‘আমি বাইরে কী যেন দেখেছি। নড়ে উঠেই সরে গেল।’

‘তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘাবড়ে গিয়ে গুলি করেছ,’ বলল বার্ব। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বাইবেল। ‘তা নয়। সত্যিই কাউকে দেখেছি। মাত্র একসেকেণ্ডে সরে গেছে।’

‘হয়তো কোন ঘোড়া,’ বিড়বিড় করল রিপার রিগবি।

পিস্তল হাতে জানালায় গিয়ে দাঁড়াল বার্ব। পর্দা সরিয়ে ফাটা কাঁচের ওদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। ভাবছে, এরা ভয় পেয়ে ছায়া দেখলেও গুলি করতে শুরু করেছে। অবশ্য বাইবেলের কথা সঠিকও হতে পারে।

বাইরের পরিবেশ থমথমে। মাসুদ রানা সত্যি এসে থাকলে বাড়ির যে-কোন জায়গায় হামলা করবে সে।

‘পাশের ঘরে কার ওপরে গুলি চালালেন?’ অ্যারনের কাছে জানতে চাইল রিগবি।

‘বাদ দিন,’ কড়া চোখে তাকে দেখল বার্র। ‘এখন থেকে নিচু গলায় কথা বলবেন।’ ঘরের সবাই বুঝে গেল, এখন আর নেতৃত্বে নেই পুলিশ চিফ। একপলকে বার্বের হাতে চলে গেছে দায়িত্ব। ‘মর্গ্যান, বাতি নিভিয়ে দাও। আর তোমরা…’ ববি বাইবেল, র‍্যাণ্ডি পার্সন আর ক্যাল অ্যামেটের দিকে তাকাল সে। ‘তোমরা যাবে বাড়ির সামনের উঠনে। ছায়া থেকে বেরোবে না। কোথাও কোন নড়াচড়া দেখলে দেরি না করে গুলি করবে। তার ফলে যদি গোলাগুলি শুরু হয়, ভুলেও সরে যাবে না পযিশন থেকে।’ মর্গ্যান পামার, গ্যারি লুম্যান ও ম্যাল স্টিভেন্সের দিকে ফিরল বার্ব। ‘এদিকে বাড়ির পেছনদিকে চোখ রাখবে তোমরা।’

‘আমি এই ঘরের জানালার সামনে থাকছি,’ মিচু গলায় বলল রিপার রিগবি। ‘কেউ ভেতরে ঢুকতে চাইলে গুলি করে ফেলে দেব।’

বাতি নিভিয়ে দিল মর্গ্যান পামার। জানালার পর্দা ভেদ করে ঢুকেছে আবছা জ্যোৎস্না। মৃদু আলোয় রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে ছায়াভরা ঘর। চিরকাল অন্ধকারকে ভালবেসে এসেছে বার্ব। এতে সে অভ্যস্ত। ঘুরে হাতের ইশারা করল স্ক্যালেসকে। এবার কী করতে হবে, জেনে গেল ঠাণ্ডা মাথার খুনি। তার বন্ধু নীরবে বুঝিয়ে দিয়েছে, দেখে আসতে হবে আস্তাবলে আছে কি না মেয়েটা।

হ্যানোভারের কাঁধে টোকা দিল স্ক্যালেস। ‘মাইক, আমার সঙ্গে এসো।’

যার যার অস্ত্র নিয়ে বাড়ির সামনের দিক পাহারা দিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাইবেল, পার্সন ও অ্যামেট। ওদিকে বাড়ির পেছনে আস্তাবলের দিকে চলল স্ক্যালেস হ্যানোভার।

নিচু গলায় অ্যারনকে বলল বার্ব, ‘আপনার সঙ্গে থাকতে পারছি না, বস। তাই দেরি না করে কোন ঘরের দরজা বন্ধ করে অপেক্ষা করুন।

‘আমি তা হলে থাকছি বুড়োর স্টাডিরুমে,’ নার্ভাস কণ্ঠে বলল অ্যারন। বুঝে গেছে, বাবাকে খুন করে কী ভয়ঙ্কর কুকীর্তি করে বসেছে। নির্দ্বিধায় নিজেকে ক্ষমাও করে দিল ভাবতে এটা ভাল লাগছে, এখন থেকে গোটা র‍্যাঞ্চ আসলে তার।

‘পথ দেখান,’ তাকে বলল বার্ব।

করিডরে বেরিয়ে চওড়া সিঁড়ির কাছে এল অ্যারন। বার্বকে নিয়ে উঠে এল ওপরতলায়। বিশাল বাড়ির উত্তর দিকের শেষ ঘর বিগ রিয়ানের স্টাডিরুম। জানালা গলে চাঁদের রুপালি আলো পড়েছে বুড়োর ডেস্কে। একটু দূরে ফায়ারপ্লেসের ওপরের দেয়ালে ঝুলছে হরিণের মস্ত এক করোটি।

‘ঘর লক করে রাখবেন,’ বলল বার্ব, ‘গোলাগুলির শব্দ পেলেও বেরোবেন না। কেউ দরজা ভেঙে ঢুকতে চাইলে…’

এক গুলিতে তাকে শেষ করে দেব, কোমরে ঝুলন্ত হোলস্টার থেকে নিয়ে রিভলভার দেখাল অ্যারন। এই অস্ত্র দিয়েই খুন করেছে হিউবার্ট হ্যারল্ডকে।

মেয়র যে ট্রিগার টিপে দিতে দ্বিধা করবে না, ভাল করেই জানে বার্ব। ঘর ছাড়ার আগে বলল, ‘সতর্ক থাকুন।’

‘একবার এদিকে এলে আমার হাতে খুন হবে রানা।’ ঘরের দরজা লক করে ডেস্কের পেছনে গিয়ে বাবার চেয়ারে বসে পড়ল অ্যারন কনার।

.

থমথম করছে র‍্যাঞ্চ হাউস। ঘন কুয়াশার চাদরের জন্যে বাড়ির বাইরের পরিবেশ যেন অন্য জগতের। একটু পর কী ঘটবে উপলব্ধি করে একবার শিউরে উঠল বার্ব। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচতলায়। আর তখনই শুনতে পেল গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ। বাইরে গর্জে উঠেছে তিনটে অস্ত্র। একটু থেমে আবারও গুলি হলো দু’বার।

গোলাগুলি শুরু হয়েছে বাড়ির সামনে থেকে।

করিডর পেরিয়ে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে এল বার্ব। মস্ত এক ওক গাছের ছায়ায় লুকিয়ে আছে ক্যাল অ্যামেট আর র‍্যাণ্ডি পার্সন। অন্ধকারমত জায়গাগুলোর দিকে তাক করছে হাতের অস্ত্র। কয়েক ফুট গিয়ে মাটিতে একটা রেমিংটন ৮৭০ পাম্প শটগান দেখতে পেল বার্ব।

ওটা ববি বাইবেলের।

‘বরি কোথায় যেন গেছে,’ হাঁফাতে শুরু করে বলল র‍্যাণ্ডি পার্সন। ‘একটু আগে পাশেই ছিল। তারপর কীভাবে যেন এক সেকেণ্ডে হারিয়ে গেল!’

‘তুমি কিছুই দেখোনি? কিছু না কিছু তো দেখার কথা।’

অন্ধকারে চেয়ে সশব্দে ঢোক গিলল র‍্যাণ্ডি পার্সন। শব্দটা পেয়ে বিরক্ত হলো বার।

‘না, আমরা কিছুই দেখিনি। একসেকেণ্ড আগে ছিল, পরের সেকেণ্ডে দেখি নেই।’

‘মনে হলো ভূত এসে ওকে নিয়ে গেছে,’ বিড়বিড় করল ক্যাল অ্যামেট।

চারপাশের আঁধারে চোখ বোলাল বার্ব। ভাল করেই বুঝে গেছে, পুলিশ অফিসারকে তুলে নিয়ে গেছে মাসুদ রানা। খুব কাছে কোন ঝোপঝাড়ে এখন আছে বাইবেলের লাশ।

বহুবার নানান দেশে মানুষ শিকার করেছে বার্ব। এমন কেউ নেই, যে রক্ষা পেয়েছে ওর হাত থেকে। চোখ সরু করে দূরে তাকাল সে। একসেকেণ্ডের জন্যে তার মনে হলো, কী যেন নড়ে উঠেছে বাড়ির পাশে। নিষ্পলক চোখে ওদিকে চেয়ে রইল বার্ব। বুঝে গেল, সত্যিই একসেকেণ্ড আগে সরে গেছে একটা ছায়া। ওটা কালোর ভেতরে আরও কালো। ভুলেও ফ্ল্যাশলাইট জ্বালতে গেল না বার্ব। অন্ধকার যেমন কাজের, তেমনি হতে পারে মৃত্যুদূত। আর সেজন্যেই আঁধারকে এত ভালবাসে সে।

ঘুরে ফিসফিস করে র‍্যাণ্ডির কানে বলল বার্ব, ‘আমার পিছু নাও। তিনগজ পেছনে থাকবে। আওয়াজ যেন না হয়।’

বাড়ির পাশে যেখানে নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে বার্ব, সাবধানে চিতার মত নিঃশব্দে ওখানে চলে গেল সে। পিছু নিয়েছে পার্সন ও অ্যামেট। কয়েক ফুট পেছনে পার্সনের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হলো বার্বের। পেছনে শুকনো একটা ডাল ভেঙে যেতেই গাল কুঁচকে মনে মনে গালি দিল পুলিশের লোকদেরকে। পেছনে যারা আছে, কেউ ইউএস স্পেশাল ফোর্সের সৈনিক বা অফিসার নয়। পুলিশবাহিনীর ওপরে বিরক্ত হয়ে ভাবল বার্ব, এই শালারা নিজেদের জাহির করতে পারলে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে যায়। আর আওয়াজ করে গণ্ডারের মত। ঘাড় কাত করে কঠোর চোখে পেছনে তাকাল বার্ব। অন্ধকারে দেখতে পেল পার্সনের ফ্যাকাসে মুখ। ঠোঁটের ওপরে আঙুল রেখে সতর্ক করল বার্ব। জবাবে নীরবে মাথা নেড়ে পার্সন যেন বুঝিয়ে দিল, শব্দটা আসলে তার করা নয়।

সরু হলো বার্বের দু’চোখ। পার্সনের কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল। একটু আগেও ওদিকে ছিল ক্যাল অ্যামেট। কিন্তু এখন উধাও হয়েছে সে!

‘ ঘুরে পার্সনকে পাশ কাটিয়ে ছয়গজ পিছনে গিয়ে থেমে গেল বার্ব। ধুলোর ভেতরে নাক গুঁজে পড়ে আছে অ্যামেট। বসে পড়ে পুলিশ অফিসারকে ধরে চিত করল বার্ব। ভেঙে দেয়া হয়েছে লোকটার কণ্ঠনালী আর ঘাড়।

বুকের ভেতরে শীতল অনুভূতি হচ্ছে বার্বের। বহুদিন এমন ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হয়নি সে। চোখ বোলাল চারপাশের আঁধারে। উল্টে যেন ওকেই দেখছে ঘন সব ছায়া।

‘আমি জানি, তুমি এদিকেই কোথাও আছ,’ মনে মনে বলল বার্ব।

অ্যামেটের লাশ দেখে বড় করে শ্বাস ফেলল পার্সন। বিড়বিড় করে বলল, ‘হায়, যিশু! কোন শালা….

‘রানা আমাদেরকে উল্টো শিকার করছে,’ বলল বার্ব।

হঠাৎ করে বাড়ির ভেতরে জ্বলে উঠল একটা বাতি।

র‍্যাণ্ডি পিছু নিল কি না, সেদিকে নজর না দিয়ে দৌড়ে র‍্যাঞ্চ হাউসের সদর দরজার কাছে গেল বার্ব। করিডরে জ্বলছে বৈদ্যুতিক হলদে আলো। গুলি করে লিভিংরুমের যে জানালার কাঁচ ভাঙা হয়েছে, সেখানে অন্ধকারে বসে পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ চিফ রিগবি। কিন্তু সে জ্বেলে দেয়নি বাতি।

আর্মচেয়ারে বসে আছে লোকটা। পুরনো এক চেরোকি টওমাহক কুঠার প্রায় দু’ভাগ করে দিয়েছে তার করোটি। রিগবির পায়ের কাছে জড় হচ্ছে অগভীর রক্তের পুকুর। গাঢ় লাল রঙের তরল চিকচিক করছে হলদে আলোয়।

বার্ব টের পেল, ঘরে এসে ঢুকেছে র‍্যাণ্ডি। পুলিশ অফিসারের মুখ চিরে বেরোল চাপা আর্তনাদ। এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখার জন্যে মানসিকভাবে তৈরি ছিল না সে।

‘এখান থেকে কোথাও সরে যেয়ো না,’ তাকে বলল বার্ব। মুখ হাঁ করে তার চিফের লাশ দেখছে লোকটা। তাকে পাশ কাটিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল প্রাক্তন মিলিটারি অফিসার। বাতি নিভিয়ে চলে গেল সিঁড়ির মুখে। নিঃশব্দে উঠল দোতলায়। জোরে নক ক ল স্টাডিরুমের দরজায়।

‘বাইরে কে!’ ভেতর থেকে এল ভীত কণ্ঠস্বর।

চেক করে দেখলাম, বস। ভেতরেই থাকুন।

অ্যারন আর কিছু বলার আগেই নিচতলায় ‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। ঘুরে এক দৌড়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল বার্ব। ঝড়ের বেগে নেমে এল নিচতলায়। সতর্ক পায়ে ঢুকে পড়ল লিভিংরুমে।

আগের জায়গা থেকে সরে গেছে র‍্যাণ্ডি। বারকাউন্টারের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তার অর্ধেক মাথা এখন আর নেই। টপটপ করে রক্ত পড়ছে কার্পেটে

করিডরে পায়ের আওয়াজ শুনে চরকির মত ঘুরল বার্ব। রাইফেল তাক করল দরজার দিকে। কিন্তু স্টিভেন্স, লুকম্যান’ আর মর্গ্যানকে ঘরে ঢুকতে দেখে নামিয়ে নিল অস্ত্রটা।

‘শালা আবার মরল কী করে!’ পুলিশ অফিসারের লাশ দেখে নাক কুঁচকাল লুকম্যান।

‘আমি না তোমাদেরকে বলেছি পযিশন থেকে না সরে যেতে,’ বিরক্ত কণ্ঠে বলল বার্ব। ‘টনি কোথায়?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *