কালবেলা – ৪৫ (মাসুদ রানা)

পঁয়তাল্লিশ

খিঁচড়ে আছে অ্যারন কনারের মন। মাঝরাতে রানার সঙ্গে কথা শেষ করে দোতালায় গিয়ে আনমনে জ্বেলে দিয়েছে বেডরুমের বাতি। ফলে ভেঙে গেল লিঙার কাঁচা ঘুম। এরপর অ্যারনের ওপর শিলাবৃষ্টির মত বর্ষিত হলো একহাজার একটা প্রশ্ন। কিছুই হয়নি সেটা জানালেও তাকে চেপে ধরল লিঙা। প্রায় সারারাত ধরে চলল আকাশ-পাতাল তর্ক। শেষমেশ পাশের বেডরুমে গিয়ে ঠাঁই নিল অ্যারন। এতে আরও সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেছে তার স্ত্রী।

এরপর সকাল সাড়ে ছয়টায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে অ্যারন। এতই বেড়ে গেছে মাথা-ব্যথা, খেয়াল করতে পারেনি নিচতলায় নেমে এসেছে হলুদ পায়।মা পরে। বরাবরের মত একবারও দেখেনি ল্যাণ্ডিঙে কুমারী মা মেরির প্রমাণ আকারের অপূর্ব সুন্দর মূর্তি, জ্ঞানী আইরিশ পণ্ডিতদের উদ্ধৃতি, আয়ারল্যাণ্ডের তিনরঙা পতাকা, প্রাচীন হার্প এবং অন্যান্য অ্যান্টিক।

সরাসরি এসে ঢুকেছে কিচেনে। কাবার্ড খুলে কৌটা থেকে বের করে নিয়েছে একমুঠো অ্যাসপিরিন। ভেবেছে ওষুধ গেলার সময় ড্রিঙ্ক করবে দুষ্প্রাপ্য মিডলটন উইস্কি কিন্তু শেষে সেটা না করে একগ্লাস পানি দিয়ে গিলে নিয়েছে সাদা বড়ি। ড্রামের ধুবধুর শব্দে মাথার ভেতরে ব্যথা তৈরি করছে মগজ। এবার কী করবে ভাবছে, এমন সময় পকেটে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। ওটা বের করে স্ক্রিন দেখে বুঝতে পারল, ভয়েস মেইল দিয়েছে লিয়াম বার্ব।

প্রোগ্রাম চালু করতেই কথা বলল প্রাক্তন মেজর: দেরি না করে ফোন করুন। বিষয়টি খুব জরুরি।’

মাথা-ব্যথা নিয়ে বার্বকে কল দিল অ্যারন। তাতে যে খবর শুনতে পেল, মনে হলো লাথি এসে লেগেছে তার অণ্ডকোষে। ধপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ারে। বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে মাথা। গতরাতে যা ঘটে গেছে সেটার বিস্তারিত বর্ণনা দিল বার্ব। কটেজে ছিল না মাসুদ রানা। ব্যর্থ হয়েছে তাদের মিশন। তার ওপরে উধাও হয়ে গেছে দলের সদস্য ম্যাট কালাহার। বহু খুঁজেও তাকে আর পাওয়া যায়নি।

‘আর কটেজ?’ প্রায় ফিসফিস করে বলল অ্যারন কনার।

‘ওই কটেজ আর নেই, দুঃখিত। আপনার নির্দেশ অনুযায়ী ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ওটা।’

বড় করে ঢোক গিলল অ্যারন। এবার সত্যিই বোধহয় তাকে গিলতে হবে পুরো এক বোতল মিডলটন রেয়ার উইস্কি। কী জবাব দেবে সে তার স্ত্রীকে? কটেজটা ছিল লিঙার খুব প্রিয়।

‘একঘণ্টা পর আমার সঙ্গে দেখা করো,’ শুকনো গলায় বলল কনার। কল কেটে ফোন করে ঘুম ভাঙাল ব্যক্তিগত সহকারিণী মাটিল্ডা টেসের। কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই জানাল, আজ যে সাক্ষাৎকার দেয়ার কথা ছিল, সেটা অনিবার্য কারণে বাতিল করতে হচ্ছে।

‘কিন্তু রেল ইউনিয়নের নেতারা চরম বিরক্ত হয়ে উঠবে,’ বলল মাটিল্ডা। ‘এরই ভেতরে দু’বার তাদের কাছ থেকে আমরা সময় নিয়েছি।’

‘তারা যা খুশি ভাবুক। দরকার হলে বলতে হবে, আমি নিজেই খুন হয়ে গেছি রেলগাড়ির নিচে চাপা পড়ে।

‘বিষয়টা হাসির নয়, মেয়র কনার!’

‘ঠিক আছে, তো তাদেরকে জানাতে হবে আমি অসুস্থ। তাতে হবে? সত্যিই খুব দুর্বল লাগছে অ্যারনের। ফোন রেখে দিল। ওপরতলায় ধুপধাপ করে দরজা খোলা-বন্ধের আওয়াজে বুঝে গেল, আজও বরাবরের মত ভোরে উঠে পড়েছে লিপ্তা। তারচেয়েও বড় কথা, গতরাতের তর্কের কারণে তিরিক্ষি হয়ে আছে তার মন। এখন কিছু বললে শুরু হবে মুখ থেকে গোলাবর্ষণ। মরুক শালী! কটেজ নিয়ে নিজে থেকে আর একটা কথাও বলবে না অ্যারন। পরে খবর জানার পর লিণ্ডাকে নরম সুরে বলবে, ‘ডার্লিং, জেনে খুব কষ্ট পেলাম। তবে তোমার জন্যে ওটার চেয়ে ভাল কোন কটেজ আমি তৈরি করে দেব।’

লিণ্ডা বাথরুমে ঢুকতেই তাকে এড়াতে গিয়ে প্রায় দৌড়ে দোতলায় গিয়ে উঠল কনার। ঝড়ের বেগে পোশাক ছেড়ে নতুন সুট পরে নেমে এল নিচতলায়। তিন মিনিট পেরোবার আগেই দীর্ঘ ড্রাইভওয়ে পার করে রাস্তায় গিয়ে পড়ল তার ক্যাডিলাক গাড়ি। এত সকালে ভিড় নেই। দ্রুত গতি তুলে এয়ারপোর্টের দিকে চলল মেয়র কনার।

মাঝপথে আবারও বেজে উঠল তার ফোন। কল দিয়েছে লুই গৌরলে। ‘কেমন আছেন?’ জানতে চাইল লোকটা। জমজমাট কোন নাইট ক্লাব থেকে ফোন করেছে সে। চলছে দারুণ পার্টি। বিকট আওয়াজে বাজছে হেভি মেটাল মিউযিক। মেক্সিকান ড্রাগ ডিলারদের অস্ত্র সাপ্লায়ারের কাছে সকাল পৌনে সাতটা মানে এখনও গভীর রাত।

‘ভাল! খুবই ভাল!’ নাক বাঁকা করল অ্যারন কনার।

‘তা হলে মন দিয়ে শুনুন। এবারের শিপমেন্ট দেরি না করে পাঠিয়ে দিতে হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?’

তার কথা শুনে ঝুলে গেল কনারের নিচের চোয়াল। আরেকটু হলে তার ক্যাডিলাক রাস্তার ধারে পার্ক করা এক গাড়ির পেছনে গুঁতো মারত। বড় করে শ্বাস ফেলে বলল সে, ‘ঠিক আছে।’

‘বেশ। পরের সপ্তাহের জন্যে ওরা অপেক্ষা করবে না। বুঝতেই তো পারছেন।’

অধৈর্য হয়ে গেছে ড্রাগস্ কার্টেলের বসেরা। মালপত্র কখন চায় ওরা?’ জানতে চাইল অ্যারন।

‘আপনি হাতে পাচ্ছেন দু’দিন। আশা করি সমস্যা হবে না।’ লুই গৌরলে, এমনভাবে বলেছে, যেন আস্ত দুটো স্টেট পার করে ছয় শ’ মাইল দূরে মিলিয়ন ডলারের অবৈধ অস্ত্র ও গোলাগুলি পৌঁছে দেয়া বড় কোন বিষয় নয়। অথচ, টেক্সাস ও মেক্সিকোর বর্ডার পাহারা দিচ্ছে দু’দেশের শত শত সীমান্ত-রক্ষী।

‘মাত্র দু’দিনের ভেতরে? হায়, যিশু! আপনি তো আমাকে খুন করবেন!’ দুশ্চিন্তা বাড়ল কনারের। দু’দিনের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে হলে আগামীকাল সকালে অস্ত্র- গোলাবারুদ ট্রাকে তুলে রওনা দিতে হবে। অর্থাৎ, আজই ট্রাক-বহরে লোড করতে হবে মালামাল। দলের সবাই প্রচণ্ড পরিশ্রম করলে কাজটা তারা পারবে কি না তাতেও সহে আছে। হাতে একেবারেই সময় নেই। তার ওপরে অ্যারনের ঘাড়ের ওপরে তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘাম ছটিয়ে দিচ্ছে হারামজাদা মাসুদ রানা। ওদিকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি মেয়েলোকটাকে!

‘আপনি খুন হন সেটা চাই না, হাসি-হাসি সুরে বলল লুই গৌরলে। ‘তবে টাকা তো আগেই নিয়েছেন। সুতরাং এখন জিনিস ঠিকভাবে হাতে না পেলে সত্যিই ওরা আপনাকে খতম করে দিতে পারে।’

কথাটা যে চরম সত্যি, সেটা বুঝে গলা শুকিয়ে গেল, অ্যারন কনারের।

‘পরে কথা হবে,’ কল কেটে দিল গৌরলে।

ততক্ষণে ব্যক্তিগত হ্যাঙারের কাছে পৌঁছে গেছে কনার। এরই মধ্যে হাজির হয়েছে নতুন এক সাদা ভ্যান। ওটার- পাশে দাঁড়িয়ে আছে বার্ব ও স্ক্যালেস। বার্বের চেহারায় চরম অস্বস্তি থাকলেও ড্যাম কেয়ার চেহারায় চুইংগাম চিবুচ্ছে স্ক্যালেস। তার টি-শার্টে লেখা: মর, শালা!

গতরাতের মিশন ব্যর্থ হলেও নিজে থেকে কিছু বলল না বার্ব। তাদের দু’জনকে হাতের ইশারা করে হ্যাঙারে ঢুকল অ্যারন। সিঁড়ি বেয়ে গালফস্ট্রিম বিমানে গিয়ে উঠল তারা। মুখোমুখি চেয়ারে বসে বার্ব ও স্ক্যালেসকে দেখল মেয়র। ঝড়ের বেগে প্রশ্ন করল, ‘কটেজে কী হয়েছে? কেন রানাকে খুন করা যায়নি? মেয়েলোকটা কোথায়? আর কোথায় গেছে সেসব ডায়েরি?’

বলার মত কিছু নেই বার্বের।

অ্যারনের মনে কাজ করছে চরম আতঙ্ক। সিট ছেড়ে সরু আইলে পায়চারি করতে লাগল সে। রাগ ও দুশ্চিন্তায় অস্থির বোধ করছে। জানে না এলোমেলো হয়ে গেছে মাথার চুল।

‘ব্যাটা খুব সতর্ক,’ নিজে থেকে বলল স্ক্যালেস। ‘এত ভয় পেয়েছে যে আর মুখোমুখি হওয়ার সাহস পায়নি। শালা আসলে মুরগির ছানা। পরে আমরা যখন সবাই একসঙ্গে থাকব না, তখন বোধহয় আড়াল থেকে হামলা করবে।’ নাক দিয়ে বিরক্তি প্রকাশের আওয়াজ ছাড়ল সে। ‘কালাহার আস্ত গাধা। সুযোগ পেয়েও রানাকে খতম করে দিতে পারেনি। চাইলে আমার দাদীও জবাই করতে পারত বাঙালি ছাগলটাকে।’

ফালতু কথা বাদ দাও, টনি, শান্ত স্বরে বলল বার্ব। ‘মাসুদ রানাকে খুন করা তো দূরের কথা, তাকে দেখতেও পায়নি কালাহার। উল্টে ওকে ধরে নিয়ে গেছে। এবার কালাহারের পেট থেকে আমাদের ব্যাপারে সবই জেনে নেবে। কাজটা শেষ হলে খতম করে দেবে কালাহারকে।’

‘কালাহার জানে যে মুখ খুললে সে বাঁচতে পারবে না।’

‘আমাদের মত রানাও জানে কীভাবে মুখ খোলাতে হয়, বলল বার্ব।

‘অত যদি জানে, তাতেই বা কী?’ মাথা নাড়ল স্ক্যালেস। ‘লাগতে এলে আমাদের দু’জনের যে-কোন একজনের হাতে খুন হবে।’

‘যিশুর কসম, তোমরা ফালতু কথা বন্ধ করো!’ ধমকে উঠল মেয়র কনার। ‘আমাকে একটু ভাবতে দাও!’ পায়চারি করতে করতে দরদর করে ঘামছে সে। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘মনে হচ্ছে ভুলই করে ফেলেছি। আমার উচিত ছিল মাসুদ রানাকে টাকাগুলো দিয়ে দেয়া।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বার্ব। ‘টাকার জন্যে আসলে এসব করছে না সে। টাকার কথা বলেছে ফাঁদে ফেলার জন্যে। ভাল করেই জানত, আপনি কটেজে যাবেন না। বদলে আমরা গেলে তার ফাঁদে পা দেব। আমাদের একজনকে তুলে নিয়ে যাবে সে।’

‘সে কি এতই চালাক?’ দাঁতে দাঁত পিষল অ্যারন। ‘দুনিয়ায় টাকার চেয়ে বেশি কিছু নেই। টাকার অঙ্ক বাড়ালে হয়তো এখনও তাকে কিনে নিতে পারব আমরা।’

‘আপনার টাকার লোভ তার নেই, বস,’ বলল বার্ব। ‘আপনাকে হাতের মুঠোয় চায়। আয়ারল্যাণ্ডে যে মেয়েটাকে আমরা খুন করে এসেছি, তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চায় সে

কথা শুনে পায়চারি থামাল কনার। তার পিঠ বেয়ে নামল শিরশিরে অনুভূতি। ‘সেক্ষেত্রে কুকুরটাকে পুঁতে দিতে হবে বালির নিচে! কী, তোমরা পারবে না? পরেরবার হয়তো কপাল খুলবে তোমাদের? অথবা আর কাউকে কাজটা দেব। ‘মেক্সিকান কুকুরগুলো হয়তো তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতা দেখাতে পারবে। দেরি করবে না রানাকে খুন করতে।’

‘আপনি না বুঝে কথা বলছেন, বস,’ বলল স্ক্যালেস।

কড়া চোখে তাকে দেখল মেয়র। ‘আমি কী ভুল বলেছি?’

সানগ্লাস, খুলে মেয়রের চোখে তাকাল বার্ব। অপমানে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেও জ্বলছে তার দু’চোখ। আরেকটু হলে ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে যেত অ্যারন।

পরেরবার কোন ভুল হবে না আমাদের,’ বলল বার্ব। ‘খুন হবে মাসুদ রানা। কথা দিলাম, আমি নিজে তার হৃৎপিণ্ড কেটে এনে থালায় করে উপহার দেব আপনাকে।’

‘কীভাবে খুন করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার,’ বলল মেয়র কনার। ‘সেজন্যে কত টাকা খরচ হবে, সেটা নিয়েও ভাবছি না। কাজটা যেভাবে হোক শেষ করো। আর কখনও যেন আমার চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে লোকটা।

‘তবে একটা কথা,’ বলল স্ক্যালেস। ‘আমরা এখনও জানি না কোথায় লুকিয়ে আছে সে। যা করার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে করছে। এটা বড় ধরনের একটা সমস্যা।

‘সেই সমস্যা দূর হবে,’ বলল বার্ব, ‘কালাহারের পেট থেকে খবর বের করবে সে। হামলা করবে ব্ল্যাক বেয়ারে। আর তখন আমরা তৈরি থাকব তার জন্যে।’

‘এত সাহস পাবে না, আপত্তির সুরে বলল স্ক্যালেস

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল বার্ব। ‘আমার তা মনে হয় না, টনি। ধরে নাও, ব্ল্যাক বেয়ারে আসবে সে। আর আমাদের উচিত তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া। তারপর মুঠোয় পেয়ে গেলে খতম করে দেব তাকে।

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কী যেন ভাবছে মেয়র কনার। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা নাড়ল। ‘তুমি ভুল ভাবছ, বার্ব। জ্যাকি মেয়েলোকটা আমাদের জন্যে তালার চাবি। তাকে চেনে রানা। ডিভিডিটাও নিজের চোখে দেখেছে। সে জানে কীভাবে মারা গেছে হিউবার্ট হ্যারল্ড। মেয়েলোকটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে রানার। হয়তো প্রথম থেকেই এসবে সে জড়িত। সেজন্যে মনে হচ্ছে, মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় পেলে মাসুদ রানাকেও হাতে পাব আমরা।’

‘আমাদের লোক চোখ রাখবে জ্যাকুলিন সিলভেস্টারের বাড়ির ওপরে, প্রস্তাব দিল স্ক্যালেস। এখনও মনে আশা, খুন করার আগে খায়েস মিটিয়ে ভোগ করবে সুন্দরী মেয়েটাকে।

‘আগেও বাড়িটার ওপরে চোখ রেখে কোন লাভ হয়নি, সেটা ভুলে গেলে তুমি?’ বলল বার্ব।

‘তোমাদের ভুলে হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে মেয়েটা, ‘ অভিযোগ করল স্ক্যালেস। ‘গ্রুমম্যানের বদলে আমি গেলে হাসতে হাসতে ধরে আনতাম।’

‘আবারও নিজের বাড়িতে ফিরে যাবে,’ জোর দিয়ে বলল অ্যারন কনার। ‘ওখানে চোখ রাখো তোমরা। দিনের পর দিন তো আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। এদিকে বলে দেব, যাতে মেয়েটাকে ধরতে টুলসায় নানান জায়গায় ছান দেয় রিপার রিগবির লোক।’

প্ল্যানটা সুবিধার, বলে মনে হচ্ছে না বার্বের। কারও বাড়িতে চোখ রাখার কাজটা দক্ষ একজন প্রাক্তন মেজরের জন্যে খুব ছোট ও অপমানজনক। তা ছাড়া, পড়ে আছে এর চেয়ে ঢের বড় কাজ। সেটাই বলল সে, ‘নিজে থেকে তো আর অস্ত্রে ভরে যাবে না ট্রাক। কাজ শেষ করার জন্যে আমাকে থাকতে হবে ব্ল্যাক বেয়ারে।’

স্ক্যালেসের কথা মনে ধরেছে কনারের। দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল সে। ‘মর্গ্যান আর তার দলের লোকেরা তোমাকে ছাড়াও মাল তুলতে পারবে ট্রাকে। ফোনে তাকে বলে দাও, যাতে আজ সকাল থেকেই কাজে নামে। আমাদের ট্রাক রওনা হবে আগামীকাল সকালে। এদিকে তোমরা যাও ক্রসবি হাইটসে। হাতের মুঠোয় পেলেই ধরে আনবে মেয়েটাকে। আমরা তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করলে নিজেই মরার জন্যে হাজির হবে মাসুদ রানা।’

ছেচল্লিশ

গাড়িতে বসে নয় মিনিট পার করেছে জ্যাকি। এক এক করে গেল আরও পাঁচ মিনিট। কোলে দু’হাত রেখে আঙুলের দিকে চেয়ে রইল জ্যাকি। মনেপ্রাণে চাইছে, যেন মগজে না আসে ভয়ঙ্কর কোন চিন্তা। অবশ্য অন্তর বড় অদ্ভুত এক অচিন পাখি। একটু পর জ্যাকি ভাবতে লাগল, না জানি কত ভয়ঙ্করভাবে লোকটাকে আহত করছে রানা। সেই আর্তনাদের পর থেকে আর কোন আওয়াজ নেই। ইস্পাতের শাটারের ওদিকের নীরবতা বহু কিছুই বলে দিচ্ছে।

আচ্ছা, লোকটাকে কি মেরেই ফেলল রানা?

আসলে কে এই মাসুদ রানা?

প্রায় অচেনা এক মেয়ে খুন হয়ে গেছে বলে কেন অ্যারন কনারের ওপরে প্রতিশোধ নিতে চাইছে সে?

কেন নিচ্ছে এত বড় ঝুঁকি?

আগে ছিল মিলিটারিতে। চেনে নানান আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু জ্যাকির কি উচিত হচ্ছে মাসুদ রানাকে বিশ্বাস করা?

ওর কি উচিত নয় এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া?

ইগনিশনে চাবি আছে। গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে যাবে?

চাবি স্পর্শ করল না জ্যাকি। মনের চোখে ভাসল জনির মায়াভরা চোখ। ঠিক তার চোখের মতই মাসুদ রানার চোখ। অতল গভীর। কখনও কঠোর। কখনও হাসিভরা। মোটেলে সুযোগ পেয়েও ওর দিকে হাত বাড়ায়নি মানুষটা।

না, মাসুদ রানা নিশ্চয়ই ভাল মনের একজন পুরুষ!

আধঘণ্টা পেরোবার পর আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারল না জ্যাকি। এবার কিছু করতে হবে ওকে। গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়বে, এমন সময় ঘড়ঘড় শব্দে উঠল গ্যারাজের শাটার। রোদে বেরিয়ে এসে সরাসরি গাড়ির দিকে এল রানা। হাতে কালাহারের ৪০ ক্যালিবারের অটো। জিন্সের ভেতরে গুঁজে রাখল অস্ত্রটা।

রানার দিকে চেয়ে ওর মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত চোখ বোলাল জ্যাকি। কই, তার গায়ে একফোঁটা রক্ত নেই। হাতে নেই কোন রক্তাক্ত যন্ত্রপাতি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না কাউকে নির্যাতন বা খুন করেছে। অবশ্য এ-ও ঠিক, মানুষ হত্যা করার কী-ই-বা জানে জ্যাকি?

‘কী হলো গ্যারাজের ভেতরে?’ জানতে চাইল ও।

‘কী আর হবে,’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

ভুরু কুঁচকে ফেলল জ্যাকি। ‘কিছু তো বলবে, নাকি?’

‘আমরা আলাপ করেছি,’ বলল রানা।

‘আমি যে ভয়ঙ্কর এক আর্তনাদ শুনতে পেলাম?’

‘তখন কী ভাবলে?’ মৃদু হাসল রানা।

হঠাৎ লজ্জা পেল জ্যাকি। নিচু করে নিল চোখ। রক্তিম হয়ে গেল দু’গাল। মনের ভেতরে বুঝে গেল, ঠাণ্ডা মাথায় কাউকে খুন করার মানুষ হতেই পারে না রানা।

চেয়েছি তুমি যেন আতঙ্কিত হও,’ বলল রানা। ‘তোমার ভয় স্পর্শ করুক ওকে। আর তখনই তোমাকে বললাম বাইরে যেতে। ভয়ানক কিছু করব বলেই কোন সাক্ষী রাখিনি আমি। এরপর আমরা একা হতেই বললাম, এক এক করে কেটে নামিয়ে দেব ওর আঙুল। তারপর বেশিক্ষণ লাগেনি ওর মুখ থেকে সব জেনে নিতে।’

‘তু… তুমি কিছুই কাটোনি?

ওর কড়ে আঙুলে বসিয়ে দিয়েছি বোল্ট-ক্রপার। তবে ত্বকে আঁচড়ও কাটতে হয়নি। ভয়ে আর্তনাদ করার পর থেকে গড়গড় করে সব বলে গেছে।’

গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল জ্যাকি। দৌড়ে গিয়ে ঢুকল গ্যারাজের ভেতরে। আগের মতই চেয়ারে বসে আছে ম্যাট কালাহার। চার হাত-পায়ের আঙুল আর নাক-কান সব আগের মতই আস্ত আছে। অবশ্য কীভাবে যেন হারিয়ে গেছে লোকটার জ্ঞান।

‘সিরিঞ্জে যে ড্রাগ ছিল, তা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া যেত মর্দা গণ্ডারকে,’ জ্যাকির পাশে থামল রানা। ‘তিনভাগের একভাগ পুশ করেছি ওর শরীরে। মনে হয় না একঘণ্টার ভেতরে আর ঘুম থেকে উঠতে পারবে।’

‘তারপর কী করবে লোকটার?’ জানতে চাইল জ্যাকি

‘কোথাও ফেলে রাখব। আর কোন কাজে আসবে না। যা জানার সব জেনে গেছি।’

চুপ হয়ে গেছে রানা।

জ্যাকি দেখতে পেল ওঅর্কবেঞ্চে পড়ে আছে একটা কাগজ। ওটাতে কী যেন লেখা। প্রথম দুটো শব্দ: ব্ল্যাক বেয়ার। জ্যাকির চোখ অনুসরণ করে কাগজটার দিকে তাকাল রানা। চট্ করে গিয়ে ওটা তুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিল।

‘ব্ল্যাক বেয়ার আসলে কী?’ জানতে চাইল জ্যাকি।

‘জরুরি কিছু নয়, বলল রানা। গ্যারাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ড্রাইভিং সিটে উঠে চালু করল ব্যারাকুডার ইঞ্জিন। দরজা বন্ধ করে ব্যাক গিয়ার দিয়ে গাড়িটা নিয়ে এল গ্যারাজের মাঝামাঝি জায়গায়। অর্ধেক গাড়ি বাইরে, ভেতরে অর্ধেক।

‘কাগজে নিশ্চয়ই আছে নতুন কোন তথ্য?’ রানা গাড়ি থেকে নেমে পড়তেই বলল জ্যাকি।

লোকটাকে ট্রাঙ্কে তুলতে সাহায্য করো,’ জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল রানা।

জ্যাকি বুঝে গেল, ওর প্রেমিক জনি স্মিথের মতই একই ধরনের মানুষ মাসুদ রানা। যতই চাপ দেয়া হোক, ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলবে না এই লোক।

দু’জন মিলে চেয়ারসহ কালাহারকে ওপরে তুলল ওরা। ভরে দিল গাড়ির মস্ত ট্রাঙ্কে। ধুপ্ করে ঢাকনি বন্ধ করল রানা। আবার উঠল ড্রাইভিং সিটে। সামনের গিয়ার ফেলে এগিয়ে গেল কয়েক ফুট। গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে এসেছে জ্যাকি। ইঞ্জিন চালু রেখে গাড়ি থেকে নামল রানা। শাটার নামিয়ে তালা মারল। গাড়িতে উঠে পরে নিল জ্যাকেট। ওটা দিয়ে আড়াল করে দিয়েছে বেল্টে গোঁজা পিস্তল।

তুমি কিছুই বলবে না, তা-ই না?’ বলল জ্যাকি।

‘আপাতত নয়। এবার বিদায় নেব এই এলাকা থেকে।’ জ্যাকি গাড়িতে উঠতেই রওনা হয়ে গেল রানা। গ্যারাজ এরিয়া পেছনে ফেলে উঠে এল রাস্তায়। গত দু’দিনে শহরটা সম্পর্কে বেশ ধারণা তৈরি হয়েছে ওর মনে।

‘তুমি গ্যারাজ থেকে আমাকে বের করে দিয়েছিলে, যাতে লোকটার কথা শুনতে না পাই,’ বলল জ্যাকি। ‘এখন মনে হচ্ছে, তুমি জেনে গেছ কোথায় নিজের অস্ত্রের গুদাম করেছে অ্যারন কনার।’ পাশ থেকে রানাকে দেখল জ্যাকি। ‘কাগজে লিখে নিয়েছ, কীভাবে ওখানে যাওয়া যায়।

‘এসব ভুলে যাও,’ নরম সুরে বলল রানা।

‘ব্ল্যাক বেয়ার,’ বলল জ্যাকি। ‘ওটা কি কোন ছোট শহর? আগে কখনও ওটার নাম শুনিনি।’

‘আমি এ-প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু বলবে না কেন? আমিও তো এসবে জড়িয়ে গেছি।’

‘কারণ, যেটা তুমি জানো না, সেটা তোমার কোন ক্ষতি করবে না,’ বলল গম্ভীর রানা।

‘কিন্তু তুমি ওখানে গেলে আমিও যাব।

মাথা নাড়ল রানা। ‘সে-উপায় নেই। আমাকে যেতে হবে একা।’

‘এমন কোরো না, রানা। প্লিয, আমাকে একা ফেলে কোথাও চলে যেয়ো না!’

‘এখন পর্যন্ত তোমার কপাল ছিল ভাল। কিন্তু ভবিষ্যতে সেটা মন্দ হয়ে যেতে পারে। ভেবে দেখো, এরই ভেতরে খুন হয়ে গেছে কয়েকজন মানুষ। আর আমি এরপর যেখানে যাব, সেখানে চাইলেও তোমাকে সঙ্গে নিতে পারব না। যেতে হবে আমাকে একা। তোমার দায়িত্ব তখন আমি নিতে পারব না।’

‘তা হলে আবারও ফিরে যাব ওল্ড ইয়েলার ইনে?’

‘ওখানে নয়। তোমাকে ডাউনটাউনে আরও ভাল কোথাও রাখব। সেখানে নিরাপদে থাকবে। তবে ওখান থেকে বেরিয়ে ঘোরাঘুরি করতে যেয়ো না।’

জবাব না দিয়ে রানার দিকে চেয়ে রইল জ্যাকি। রানা বুঝে গেল, রেগে গেছে মেয়েটা। ডানহাতের বুড়ো আঙুল পেছনে তাক করল রানা। ‘তোমাকে পৌঁছে দিয়ে গাড়ি থেকে বিদায় করে দেব ঘুমন্ত সুন্দরকে। এক বা দু’ঘণ্টা পর জেগে উঠে গুনতে শুরু করবে হাত-পায়ের আঙুল। খুশি মনে ভাববে দুনিয়া আসলে দারুণ জায়গা। বুদ্ধিমান হলে একবার বাঁধন খুলে দিলে পালিয়ে যাবে হাজারো মাইল দূরে

‘ভাল লাগছে, তাকে তুমি খুন করোনি,’ বলল জ্যাকি। ‘তুমি আসলেই ভাল একজন মানুষ।’

‘তুমি তো আমাকে চেনোই না। আমি কিন্তু খুব খারাপ। ঘন ঘন মাথা নাড়ল জ্যাকি। ‘আমি একজন মেয়ে, পুরুষের চোখে চোখ রাখলে আমরা অনেক কিছুই বুঝে যাই। তুমি তো যাবে অ্যারন কনারের বিরুদ্ধে লড়তে। আর সর্বক্ষণ আমি তোমার জন্যে দুশ্চিন্তা করব। নাও না আমাকে তোমার সঙ্গে? আমি হয়তো কোন সাহায্যে এলাম? তুমি জানো, গুলি চালাতে পারি। চোখ রাখতে পারব আড়াল থেকে। রানা…’

‘এবারের কাজ একা আমাকে করতে হবে, জ্যাকি, বল্ল রানা। ‘এ-ছাড়া কোন উপায় নেই।’

‘তোমার যদি কোন ক্ষতি হয়, নিজেকে আমার অপরাধী বলে মনে হবে। ভুলে যাইনি, তুমি না থাকলে শপিং মলের নিচের গ্যারাজে কিডন্যাপ কর হতো আমাকে। তারপর খুন হতাম জানোয়ারগুলোর হাতে। রানা, আমি কি তোমার জন্যে কিছুই করতে পারব না?’

‘তুমি নিরাপদে থাকলে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারব, বলল রানা। এটা তুমি করতে পারো আমার জন্যে।’ চট্‌ করে জ্যাকির দিকে তাকাল ও।

দু’ফোঁটা জল জমেছে মেয়েটার চোখে। নিচু গলায় বলল জ্যাকি, ‘হয়তো আর কখনও তোমাকে দেখতে পাব না।’

‘আমি ঠিকই ফিরব, কথা দিলাম, দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘আর তারপর নিজের বাড়িতে নিরাপদে ফিরতে পারবে তুমি।’

.

টুলসার ডাউনটাউনে হায়াট রিজেন্সি হোটেলের দু’শ’ পাঁচ নম্বর রুম ভাড়া নিয়েছে রানা। কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে, স্ত্রী নিনা হ্যাম্পটনকে নিয়ে তেল ব্যবসার কাজে নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছে। এন্ড ইয়েলার মোটেলের তুলনায় হায়াট রিজেন্সি হোটেল যেন একেবারেই স্বর্গ। বিলাসবহুল বিশাল রুমে পা রেখে খুশি হয়ে গেল জ্যাকি। চওড়া জানালা দিয়ে দেখতে পেল প্রতিবেশীদের সাজানো সব সুন্দর বাগান। রানা বলল, পারতপক্ষে ঘর ছেড়ে যেন বের না হয় জ্যাকি। কাজ শেষ হলে নিজেই যোগাযোগ করবে ও।

জ্যাকির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল রানা। শহরের মাঝ দিয়ে ওর প্লিমাউথ চলল দক্ষিণ- পুবে। মাঝ-সকালে আকাশ থেকে আগুন ঢালছে সোনালি সূর্য। গরমের ভেতরে যাতে দমকা বাতাস ভেতরে ঢোকে, তাই গাড়ির জানালা খুলে দিল রানা। মাস্কোগি টার্নপাইক ধরে চলে গেল ব্রোকেন অ্যারো এলাকায়। কয়েক মাইল যাওয়ার পর সরু হয়ে গেল শাখা রাস্তা। এঁকেবেঁকে গেছে বহু দূরে। কখনও পথের ধারে পড়ল ছোট কিছু খামার। আরও অনেকক্ষণ পর নির্জন রাস্তায় একরাশ ধুলোর মেঘ তৈরি করে গাড়ি থামাল রানা। দরজা খুলে নেমে পড়ল। আশপাশে শুকনো ঝোপঝাড় ছাড়া আর কিছুই নেই। বাদামি ঘাসের প্রান্তরে, পুড়ছে নানারঙের পাথরখণ্ড। বন-বন আওয়াজে উড়ছে হাজার হাজার পতঙ্গ।

গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে টেনেহিচড়ে চেয়ারসহ কালাহারকে বের করল রানা। বড় এক ঝোপের পাশে খিল চেয়ার। এখনও জ্ঞান ফেরেনি লোকটার। কাঁধের ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে মাথা। ঠোঁটের কোণ বেয়ে নামছে লালা। তাকে চেয়ারে এলিয়ে থাকতে দিয়ে গাড়ির কাছে ফিরল রানা। ভেতর থেকে নিল ব্যাগ ও শটগান। আবার ফিরে এল কালাহারের সামনে। ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে লোকটা।

কয়েক গজ দূরে বড় এক পাথরের ওপরে বসল রানা। পায়ের কাছে রেখেছে ব্যাগ। বোল্ডারের ওপরে নামিয়ে রাখল বন্দুক। জ্যাকেট খুলে গুটিয়ে নিল শার্টের হাতা। জোর আওয়াজে ডেকে চলেছে একদল ঝিঁঝি পোকা। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকল রানা। ভেবে নিচ্ছে এরপর কী করবে। ওর মনে পড়ল বার্ব ও স্ক্যালেসের কথা। লোকদুটো দুনিয়ার সেরা সেনাবাহিনী থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অথচ নষ্ট হয়ে গেছে পচা আমের মত। বয়সে রানার সমানই হবে। অবশ্য ওর মত অনিয়ম করেনি তারা। নিয়মিত ব্যায়াম করা শরীর। এরই ভেতরে কয়েকবার মোকাবিলা হলেও লড়াই করতে গিয়ে পিছিয়ে যেতে হয়েছে রানাকে। হয়তো পরেরবার খুনই হবে তাদের হাতে।

চোখ খুলে রানা দেখল, এখনও পূর্ণ সচেতন হয়ে ওঠেনি কালাহার। ব্যাগ থেকে ডায়েরি নিল ও। পাতাল পার্কিং লটে মেশিন পিস্তল সংগ্রহ করার সময়ে একটা গুলি ছিঁড়ে দিয়েছে তৃতীয় ডায়েরিটার মলাট।

এরপর এসব ডায়েরি নিয়ে কী করবে, সেটা নিয়ে ভাবছে রানা। ওর কোন কাজে আসবে না ওগুলো। যা জানতে চেয়েছে, সেটা জেনে গেছে। পুরনো স্মৃতিময় ডায়েরিগুলোর আছে লাখ পাউণ্ডের ঐতিহাসিক মূল্য। গ্রেনফেলের জাদুঘরের কথা মনে পড়তেই রানা বুঝে গেল, সামনের লড়াইয়ে প্রাণে বাঁচলে ওর উচিত হবে ডায়েরিগুলো ওখানে দান করে দেয়া।

আর যদি মরেই যায়, তবে তো আর কিছুই করার নেই। বহু দিন পর কেউ না কেউ হয়তো পাবে ডায়েরিগুলো। তার হয়তো মনে হবে চামড়া দিয়ে মোড়া খাতা কোন কাজে লাগবে না। অথবা, দাম বুঝে কেউ না কেউ কিনে নেবে।

তপ্ত রোদে বসে কালাহারের দিকে চেয়ে রইল রানা। আরও কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে খুলে গেল লোকটার দু’চোখ। চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে বুঝল, এখনও বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। তিক্ত চোখে দেখল রানাকে। কিন্তু রানা ব্যাগ থেকে ইউএস আর্মি ট্রেঞ্চ নাইফ বের করতেই নগ্ন ভীতি ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে।

নাকলডাস্টার হ্যাণ্ডেলে চেপে বসল রানার ডান মুঠো। তাকে মেরে ফেলা হবে ধরে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে ব্যর্থ হলো কালাহার। কয়েক সেকেণ্ড পর অবাক হয়ে দেখতে পেল, এগিয়ে এসেছে রানা। একে একে কেটে দিচ্ছে তার হাত-পায়ের বাঁধন। কাজ শেষ করে কয়েক ফুট পিছিয়ে এসে বোল্ডারের সামনে থামল রানা। ব্যথা-ভরা চেহারায় চেয়ারে বসে আছে কালাহার। একহাতে টিপছে অন্যহাতের আড়ষ্ট কবজি।

‘জ্যাকিকে কথা দিয়েছি, তোমাকে ছেড়ে দেব,’ বলল রানা। ‘ভাল কেউ তা-ই করবে। যদি তার উল্টো করতাম, মেয়েটা মনে কষ্ট পেত। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছ, কালাহার?’

ধীরে ধীরে সম্মতিসূচক মাথা দোলাল লোকটা।

বেল্টে গুঁজে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিল রানা। কক ও লক করা ওটা। চেম্বারে আছে একটা বুলেট। সেফটি অন করা। আলতো হাতে কালাহারের দিকে অস্ত্রটা ছুঁড়ে দিল রানা। খপ করে ওটা ধরল লোকটা।

‘গুলি করার প্রথম সুযোগ তুমিই পেলে,’ বলল রানা।

ম্যাট কালাহারের মুখে ফুটে উঠল হাঙুরে হাসি। অস্ত্রের নল ওপরে তুলতে শুরু করে বলল, ‘তুমি শালা আসলেই পাগল! দু’সেকেণ্ডে খুন হবে আমার হাতে!’

‘আমি ঠাণ্ডা মাথার খুনি নই,’ বলল রানা, ‘ছিলাম না।’

চোখে চোখ রেখে চেয়ে আছে রানা ও কালাহার। থমথম করছে চারপাশ। বন্ধ হয়ে গেছে ঝিঁঝির কর্কশ ডাক। হঠাৎ করেই নড়ে উঠল কালাহার। পিস্তল তুলেই অফ করল সেফটি ক্যাচ। সরাসরি রানার মুখ লক্ষ্য করে তাক করছে পিস্তলের নল। একই সময়ে পাথরের ওপর থেকে ইথাকা শটগান নিয়েছে রানা। বন্দুকের মাযল থেকে ছিটকে বেরোল একরাশ লাল ফুলকি।

প্রচণ্ড ‘বুম!’ শব্দটা হওয়ার আগেই কালাহারের কোমর দু’টুকরো করে দিল ব্রেনেক বুলেট।

মাটি থেকে পিস্তল তুলে ওটার গায়ে লাগা রক্ত ঘাসে মুছে নিল রানা। ব্যাগ, ডায়েরি ও বন্দুক নিয়ে রাখল গাড়ির ভেতরে। পেছনে রোদে পোড়া ঘাসে চিত হয়ে পড়ে আছে দুই ভাগ হওয়া কালাহার। আকাশে উড়ছে বেশ কয়েকটা বায়ার্ড। কিছুক্ষণের মধ্যে লাশ ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে নেয়ার জন্যে নেমে আসবে ওরা।

একমিনিট পেরোবার আগেই গর্জে উঠল প্রিমাউথের ভি- এইট ইঞ্জিন। পেছনে ধুলো উড়িয়ে রওনা হয়ে গেল গাড়িটা।

রানা এবার চলেছে একপাল হিংস্র নরপশু শিকারে।

সাতচল্লিশ

নব্বুই মাইল বেগে কয়েক মিনিটে বারো মাইল দক্ষিণ-পুবে মাস্কোগি কাউন্টির অ্যাডোনিস শহরে পৌঁছে গেল প্লিমাউথ। ওখানে মানুষের দেখা পেল না রানা। প্রধান সড়কের দু’পাশে প্রায় ধসে পড়া কাঠের বাড়ি। জানালাগুলো ভাঙা। উঠনে ঘন ঝোপ। আশি বছর আগেই পরিত্যক্ত হয়েছে শহরটা। দামি কিছু নেই বলে স্থানীয় চোরের দল আর এদিকে আসে না।

সামনে বামে বাঁক নিয়ে ভুতুড়ে শহর পেছনে ফেলে আবারও সমতল প্রেয়ারির বুক চিরে এগিয়ে চলল রানা। নির্জন পথের ধারে তারকাঁটার ওজন বুকে নিয়ে এদিকে- ওদিকে ঝুঁকে আছে একের পর এক শুকনো মোটা খুঁটি। এখানে-ওখানে শুকিয়ে যাওয়া মরা গাছ। দিগন্ত জুড়ে ঘাসের জমিতে নানানদিকে ঝোপঝাড়। কোথাও ধুলো মেখে বড় সব পাথরখণ্ড। এখন আর নিচে পিচঢালা পথ নেই, বদলে রুক্ষ পাথুরে মাটি। তার বুকে এঁকেবেঁকে গেছে ভারী ট্রাকের চাকার গভীর চিহ্ন।

মিথ্যা কথা বলেনি ম্যাট কালাহার। এদিকটা পরিত্যক্ত হলেও ব্যবহার করা হয় কাঁচা এই পথ। একবার গাড়ি থামিয়ে চাকার দাগ দেখে নিল রানা। নতুন চিহ্নগুলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগের। চাপ খাওয়া মাটি থেকে উবে যায়নি শিশির।

সামনেই তাদেরকে দেখতে পাব, ভাবল রানা। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর এক জায়গায় দেখতে পেল পথের পাশে ঘন ঝোপঝাড়। এরপর কাঁচা পথ থেকে বামে গেছে সরু এক ট্র্যাক। দু’চার ঘণ্টা আগেও ওটা ধরে গেছে একাধিক ভারী ট্রাক। চাকার চিহ্ন অনুসরণ করে এগোল রানা। তিন শ’ গজ যেতেই সামনে দেখতে পেল উঁচু তারের বেড়া। ওটার মাঝে তালা দেয়া চওড়া এক ধাতব গেট। দু’পাশে বহু দূরে গেছে তারের বেড়া। গেটের সামনে থেমে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রানা। বেড়ার ওদিকে উঁচু ঢালু জমির বুক চিরে গেছে ট্রাকের চাকার দাগ। ঢালের ওদিকে চার শ’ গজ দূরে টিলার কোলে পুরনো এক খামার বাড়ি ও কিছু দালান। রানা খেয়াল করল, তারের আট ফুট উঁচু বেড়া একদম নতুন। ওটা দিয়ে বোধহয় ঘিরে নেয়া হয়েছে মাইলের পর মাইল জমি। এবং জরুরি কোন কারণ ছাড়া যে এখানে সিকিউরিটি ফেন্স তৈরি করা হয়নি, সেটা যে-কেউ বুঝবে। বড় এক প্যাডলক দিয়ে ভেতর থেকে আটকে দেয়া হয়েছে গেট। কার নির্দেশে সেটা করা হয়েছে, তা বুঝতে সময় লাগল না রানার। এখানেই যে অ্যারন কনারের সেই গোপন অস্ত্রের গুদাম আছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই!

বেড়ার ওদিকে পুরনো একটা গেট দেখতে পেল রানা। ওটার পাশে কাঠের সাইনবোর্ডে কালো কালিতে আঁকা দাঁত খিঁচানো এক ভালুকের বিশাল মুখ। নিচে বড় করে লেখা: ব্ল্যাক বেয়ার ফার্ম।

অবশ্য বহুকাল আগেই বন্ধ হয়ে গেছে খামার।

আবারও প্লিমাউথে এসে উঠল রানা। ব্যাক গিয়ার দিয়ে চলে গেল পেছনের বাঁকে। জলশূন্য শুকনো এক বড় ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে রাখল গাড়ি। গরমের ভেতরেও জ্যাকেট পরে বেল্টে গুঁজে নিল ম্যাট কানাহারের পিস্তল আর ওর ট্রেঞ্চ নাইফ! বিনকিউলার হাতে নেমে পড়ল প্লিমাউথ থেকে। হাত বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নিল ইথাকা বন্দুক। ওটার ম্যাগাযিন থেকে সলিড বুলেট সরিয়ে সেখানে ভরল বাকশট ছররা। মুখোমুখি যুদ্ধে একাধিক শত্রুর বিরুদ্ধে রাইফেলের চেয়ে ঢের বেশি কাজে দেবে বাকশট। চেম্বারে একটা গুলি ভরল রানা। এখন ইথাকার পেটে আছে সবমিলিয়ে পাঁচটা গুলি। জ্যাকেটের পকেটে ভরল আরও কিছু বুলেট, তারপর বন্দুকের স্লিং কাঁধে ঝুলিয়ে হাতঘড়ি দেখে নিল।

বাজে এখন ঠিক দুপুর বারোটা।

সামনে কী ধরনের বাধার মুখে পড়তে হবে, সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবছে না রানা। মনে মনে বলল, কাজ তো কাজই। সুতরাং সেটা শেষ করতে হবে।

কাঁচ তুলে গাড়ির দরজা লক করে দিল রানা। আবার ফিরে এল তারের বেড়ার সামনে। তারের বাধা টপকে নেমে পড়ল ওদিকে। একবার হাত থেকে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল চারপাশ। চাকার চিহ্ন অনুসরণ করলে নির্ঘাৎ গিয়ে পড়বে বিপদে। নিশ্চয়ই এদিকে থাকবে এক বা একাধিক ‘গার্ড। দীর্ঘ ঘাস ও ঘন ঝোপের ভেতর দিয়ে সতর্ক পায়ে ফার্ম হাউসের দিকে চলল রানা। কিছুক্ষণ পর পৌঁছে গেল বাড়িটার এক শ’ গজের ভেতরে। ভাল করেই জানে, যা করার করতে হবে ওকে একা। বিরুদ্ধে হয়তো থাকবে দশ বা বিশজন সশস্ত্র লোক। সুতরাং বেঁচে ফিরতে হলে ট্যাকটিকাল কোন ভুল করার সুযোগ আসলে ওর নেই।

সশস্ত্র গার্ড আছে, আগেই ধারণা করেছে রানা। লোকটা দাঁড়িয়ে আছে হাঁটু সমান ঘাসের ভেতরে। হাতে স্কোপওয়ালা স্কাউট রুগার রাইফেল। সরাসরি চেয়ে আছে নিচের ঢালের ঝোপগুলোর দিকে। চেহারায় চরম বিরক্তি। কী ভাবছে, সেটা সে-ই বলতে পারবে।

ঝোপঝাড় ও গাছের আড়াল নিয়ে এগোতে লাগল রানা। কোমর সমান ঝোপের ভেতর দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেল গার্ডের দশফুট পেছনে। থেমে বুঝে নিল লোকটা ওকে দেখে ফেলেছে কি না। ঝোপের দিকেই চেয়ে আছে সে। এখনও ওর দিকে ঘুরতে শুরু করেনি রাইফেলের স্কোপ।

সাবধানে আবারও সামনে বাড়ল রানা। পরের আধ মিনিটে পৌঁছে গেল গার্ডের দু’ফুট পেছনে। কোমরের বেল্টের খাপ থেকে নিল ট্রেঞ্চ নাইফ। মনে মনে গুনল: এক… দুই… তিন! পরক্ষণে ঝড়ের বেগে ক্ষিপ্র চিতার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল অপ্রস্তুত গার্ডের ওপরে। লোকটাকে মাটিতে পেড়ে ফেলে একটানে ফাঁক করে দিল তার গলা। কমাণ্ডো ট্রেনিঙে রানাকে শেখানো হয়েছে, আক্রমণের সময় দ্বিতীয় কোন চিন্তা মনে আসতে দেবে না। ভারতে শুরু করা মানেই মনে দ্বিধা আসতে দেয়া। আর সেটা তোমাকে খুন করবে।

একমিনিট পর রক্তাক্ত লাশটা দুই হাতে ধরে চিত করল রানা। লোকটার পকেটে আইডি না থাকলেও ফোন ‘ও ওয়ালেট আছে। দুটোই নিজের পকেটে রাখল রানা। গার্ডের রাইফেল ও কোমরের পিস্তল নিয়ে আবারও এগোল খামার- বাড়ির দিকে।

দুটো ভারী অস্ত্র নিয়ে চলা কঠিন। পুরনো খামার বাড়ির বেশ কাছে পৌছে গেছে রানা। মরা দুটো গাছের পেছনে থেমে দাঁড়ান। গাছদুটো দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজি ভি আকৃতি নিয়ে। জায়গাটা আশপাশের জমির চেয়ে উঁচু। কারও চোখে না পড়েই দেখা যাচ্ছে নিচের দৃশ্য। মরা একটা গাছের গায়ে রাইফেল ঠেক দিয়ে রেখে রানা ভাবল, দরকার হলে পরে ফিরে এসে অস্ত্রটা সংগ্রহ করবে। পেটে ভর করে শুয়ে পড়ল মাটিতে। বিনকিউলার দিয়ে দেখতে লাগল খামার বাড়ি ও

অন্যান্য দালান। ওর ধারণা সত্যিই সঠিক, পুরনো খামার বহু বছর আগেই পরিত্যক্ত। খসে গেছে দেয়ালের তক্তা। এখানে-ওখানে ঝোপঝাড়। উঠনে জংধরা তেলের ড্রাম, গাড়ির পুরনো চাকা ও চাষের ভাঙা নানান যন্ত্রপাতি।

আগেও কয়েকবার এমন ধরনের পুরনো খামার দেখেছে রানা। ওগুলো বেআইনি কাজে ব্যবহার করে দুর্নীতিপরায়ণ স্থানীয় লোকেরা। কখনও জায়গাটা হয় ড্রাগসের আখড়া, কখনও পতিতালয় বা চোরাই মালপত্র রাখার গুদাম।

অবশ্য ব্ল্যাক বেয়ার ফার্মে চলছে একেবারেই অন্যকিছু। খামার বাড়ির ধুলোভরা উঠনে তিনটে বড় ট্রাক ও কয়েকটা ফোর-হুইল জিগ। একটু দূরেই অলিম্পিক সাইযের এক সুইমিংপুল। যদিও ওটা আরও গভীর। সেখানে ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে একদল লোক। ভোরেও বোধহয় সুইমিংপুল ঢেকে রাখা হয়েছিল লোহার শিট দিয়ে। পরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে সেসব। একটা ট্রাক্টরের সঙ্গে আটকে নেয়া হয়েছে লোহার দীর্ঘ শেকল। সেটা দিয়ে বেঁধে গর্ত থেকে তুলে পাশের জমিতে রাখা হচ্ছে স্টিলের তৈরি সব ক্রেট। একেকটা ক্রেটের ওজন হবে বোধহয় কয়েক টন।

সুইমিংপুলের ভেতরে আছে অসংখ্য ক্রেট। কোনটা চারকোনা, কোনটা লম্বাটে। কিছু সাদা কাঠের। অন্যগুলো মিলিটারির ব্যবহৃত ম্যাটমেটে সবুজ রঙের। ওপরে ও পাশে স্টেনসিল করে কী যেন লেখা। সুইমিংপুলের ধারে বড় এক ক্রেন লরি। এ-ধরনের যন্ত্রদানব ব্যবহার করা হয় বাড়ি তৈরি করার সময় বালি তুলতে। পাশে দাঁড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোল্ড প্যানেলে কাজ করে চলেছে একলোক। ক্রেন লরির হলদে বাহু গর্ত থেকে তুলে আনছে ভারী ক্রেট। ঘুরে যাচ্ছে লরির বাহু, ওটার হাইড্রলিক লিফট ক্রেটগুলো নামিয়ে দিচ্ছে ট্রাকে কার্টের ওপরে। কার্ট থেকে ক্রেট নিয়ে ট্রাকে গুছিয়ে রাখছে দু’জন।

মই বেয়ে সুইমিংপুলে নেমে অপেক্ষাকৃত হালকা ক্রেট তুলে আনছে কয়েকজন। হাত বদল হয়ে সব চলে যাচ্ছে, ট্রাকের পেছনের বেডে। এরা পরিশ্রম করছে ঘন্টার পর ঘণ্টা। ঘর্মাক্ত মুখে মিহি ধুলোর আস্তরণ। এরই ভেতরে অন্ত দিয়ে ভরে নেয়া হয়েছে প্রথম ট্রাক। লাইনের পেছনে চলে গেছে ওটা। দড়ি দিয়ে তারপুলিন বেঁধে নিচ্ছে দু’জন লোক। এদিকে অস্ত্রের ক্রেটে অর্ধেক ভরে গেছে দু’নম্বর ট্রাকটা পরে অস্ত্র লোড করার জন্যে পেছনেই অপেক্ষা করছে তৃতীয় ট্রাক।

এক এক করে শুনল রানা, ট্রাকে অস্ত্র তুলছে সবমিলিয়ে আঠারোজন লোক। সবার বেল্ট বা কোমরের হোলস্টারে পিস্তল। কাছের দালানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখেছে রাইফেল। তাদের ভেতরে অ্যারন কনারকে দেখতে না পেয়ে বিস্মিত হলো না রানা। অবশ্য তার জন্যে এখানে আসেনি ও। ওর উদ্দেশ্য এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এদের ভেতরে বার্ব ও স্ক্যালেসও নেই। হয়তো কোন দালানে বসে তত্ত্বাবধান করছে গোটা অপারেশন। প্রায় স্বার নজর দ্বিতীয় ট্রাকের ওপরে। দ্রুত ভরা হচ্ছে অস্ত্রের ক্রেট। একনম্বর ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একলোক, হাতে বারো গেজের বেনেলি অটো শটগান। গরমে তাকে কাজ করতে হচ্ছে না বলে চেহারায় প্রশান্তির ছাপ।

বিনকিউলার চোখ থেকে নামিয়ে গাছের আড়াল থেকে সরে এল রানা। পরের তিনমিনিটে চলে গেল দালান ও ট্রাকগুলোর কাছে। হাতে আবারও উঠে এসেছে ট্রেঞ্চ নাইফ। নিঃশব্দে চলে গেল প্রথম ট্রাকের পাশে। বিশেষ কোনদিকে নজর নেই একমাত্র গার্ডের। ফলে টেরও পেল না হাজির হয়ে গেছে সাক্ষাৎ যমদূত। শীতল ইস্পাতের ধারাল পোঁচে ফাঁক হয়ে যেতেই বিশ্রী ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোল লোকটার গলা থেকে। শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরল রানা। দু’মিনিট পর মাটিতে শুইয়ে দিল লাশ। ট্রাকের একপাশ থেকে উঁকি দিয়ে দেখে নিল, কারও খেয়াল নেই যে হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে তাদের গার্ড। ট্রাকের ক্যাবে কেউ নেই। ইগনিশনে ঝুলছে চাবি। ট্রাকের পেছনদিকে গিয়ে তারপুলিন বেঁধে রাখা দুটো দড়ি খুলল রানা। তারপুলিনের ফাঁক গলে উঠে এল লোডিং বে-তে। অসংখ্য ক্রেটের জন্যে নড়াচড়া করা ওর জন্যে কঠিন। ছোরা দিয়ে কেটে দিল প্রথম ক্রেটের স্ট্র্যাপ। ঢাকনি খুলে দেখতে পেল ভেতরে সারি দিয়ে সাজানো আছে ক্রিস ভেক্টর। একেক ক্রেটে দশটা করে। রানা আন্দাজ করে নিল, এই ট্রাকে আছে কমপক্ষে চল্লিশটা ক্রেট। অর্থাৎ, তিন ট্রাকে আঁটবে এক শ বিশটা। কার্টেলের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে একহাজারেরও বেশি ভয়ঙ্কর অস্ত্র ক্রিস ভেক্টর।

অবশ্য পরের ক্রেট আকারে বেশ বড়। ওটার ঢাকনি খুলে রানা দেখতে পেল, ভেতরে আছে রোটারি গ্রেনেড লঞ্চার। গত রাতে লেকের তীরে এই একই জিনিস দেখেছে বার্বের হাতে। ক্রেটের ভেতরে আছে বিশটা অস্ত্র। এই জিনিস পেলে এক ডিভিশন সৈনিকের বিরুদ্ধে সমানে সমানে লড়াই করতে পারবে ড্রাগ কাটেলের নরপশুরা।

কিছু ক্রেটের গায়ে লেখা: হাই এক্সপ্লোসিভ

ছোরা দিয়ে খুঁচিয়ে একটা ক্রেটের ঢাকনি খুলল রানা। ঠোঁট গোল করে মনে মনে শিস বাজাল। বহুদিন পর আবারও দেখতে পাচ্ছে একইসঙ্গে চল্লিশটার বেশি ফোর্টি মিলিমিটার গ্রেনেড। চারপাশে চেয়ে রানা বুঝে গেল, ট্রাকে আছে কমপক্ষে এমন বারোটা ক্রেট। বিস্মিত না হয়ে পারল না ও, কীভাবে এত বেশি অর্ডিন্যান্স চুরি গোপন রাখবে ইউএস কোয়ার্টারমাস্টারেরা?

অবশ্য এখন এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। বাইরে রানা শুনল ক্রেনের শব্দ ও লোকজনের গলা। দ্বিতীয় ক্রেট থেকে . দুটো রোটারি লঞ্চার নিল ও। ও-দুটোর ভেতরে ভরল পাঁচটা করে গ্রেনেড। লোডিং পোর্ট বন্ধ করে দু’হাতে দুই লঞ্চার নিয়ে নেমে পড়ল ট্রাক থেকে। নীরবে গিয়ে খুলল ট্রাকের ক্যাবের দরজা। প্যাসেঞ্জার সিটে রেখে দিল গ্রেনেড লঞ্চার দুটো। নিজে উঠে পড়ল ড্রাইভিং সিটে। বিড়বিড় করে বলল, ‘তো শুরু হোক খেলা!’

ক্যাবের দরজা বন্ধ করে ইগনিশনে মুচড়ে দিল বেডফোর্ড ট্রাকের রুপালি চাবি।

আটচল্লিশ

হায়াট রিজেন্সি বিলাসবহুল রুমে বিচলিত বোধ করছে জ্যাকি। অস্বস্তি নিয়ে ভাবছে, কী যেন মনে পড়ার কথা ওর। ওকে রেখে নরকের মত খারাপ কোথাও গেছে রানা। নিশ্চয়তা নেই যে ফিরে আসতে পারবে! হয়তো মানুষটা আর বেঁচেই নেই? এ-কথাটা ভাবতেই তিক্ততায় ভরে গেল জ্যাকির মন। মগজের এক অংশ বলল: আর দেরি করছ কেন? যাও, গিয়ে সাহায্য করো রানাকে!

কিন্তু মানুষটা কোথায় গেছে, সেটা জানবে কী করে? রানার কথা ভাবতে গিয়ে অস্থির লাগছে জ্যাকির।

রুম লক করে লিফটে উঠে নেমে এল লবিতে। ডেস্ক ক্লার্কের কাছ থেকে জেনে নিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকল হোটেলের বিষনেস সেন্টারে। অতিথিদের জন্যে আছে সুপারফাস্ট ব্রডব্যাও। ফাঁকা এক টার্মিনাল দেখে ওখানে বসে পড়ল জ্যাকি। গুগলে ‘ব্ল্যাক বেয়ার টুলসা’ ফ্রেটি লিখে সার্চ দিল। ম্যাট কালাহারের কাছ থেকে জেনে শব্দগুলো কাগজে লিখেছিল রানা। নিশ্চয়ই এসবের কোন গূঢ় অর্থ আছে?

কিছুক্ষণ সার্চ করার পর বিশেষ এক ওয়েবসাইট খুঁজে পেল জ্যাকি। সেখানে ক্রয়-বিক্রয় হয় ওকলাহোমার পরিত্যক্ত সম্পত্তি। দীর্ঘ লিস্ট আছে ভুতুড়ে শহরের। জ্যাকি আগে জানত না টুলসা শহরের কাছে পড়ে আছে এত পরিত্যক্ত বাড়িঘর। ওয়েবসাইটে দেখল, টুলসা থেকে কাছেই মাস্কোগি কাউন্টিতে আছে অ্যাডোনিস গোস্ট টাউন। অনেক আগে পরিত্যক্ত হয়ে গেলেও উনিশ শ’ ঊনপঞ্চাশ সালে আবারও সেখানে নতুন করে বসতি করে একদল লোক। চালু করা হয় ব্ল্যাক বেয়ার ফার্মস্টিড। ওখানে চাষ করা হতো গম। কিন্তু ষাট সালের আগেই লাভজনক নয় বলে বন্ধ করা হয় খামার। আবারও জনশূন্য হয়ে যায় অ্যাডোনিস টাউন।

‘ব্ল্যাক বেয়ার!’ বিড়বিড় করে বলল জ্যাকি। দেরি না করে গুগল ম্যাপ থেকে জেনে নিল জায়গাটা কোথায়। ঝাপসা স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে বুঝল, ওখানে আছে বড় একটা খামার-বাড়ি আর কিছু দালান। চোখ পিটপিট করে ভাবল জ্যাকি, তা হলে, এফবিআইকে কাঁচকলা দেখিয়ে ওখানেই অস্ত্রের গুদাম করেছে অ্যারন কনার?

‘আমি এবার ওখানে যাব,’ নিচু গলায় বলল জ্যাকি।

একটু দূরের দু’জন হোটেল-অতিথি বিস্মিত চোখে ওকে দেখলেন।

ব্ল্যাক বেয়ার হোমস্টিডে গিয়ে তারপর কী করবে, সেটা ভেবে পেল না জ্যাকি। ওদিকের এলাকায় বাস চলে না। চট্‌ করে বুঝে গেল, অত দূরে যেতে হলে ওর চাই ভাল কোন গাড়ি। মনে মনে বলল: যেভাবে হোক রানার এই বিপদে ওর পাশে আমি থাকব।

নিজের রুমে ফিরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল জ্যাকি। তারপর দরজা লক করে প্রথমতলায় নেমে এসে বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। ভাবল, ভাড়া নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে অ্যাডোনিসে না গিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে ওখানে যাওয়াই ভাল।

প্রচণ্ড রোদে যেন জ্বলছে চারপাশ। সাদা আলো ছিটকে আসছে ফুটপাথ থেকে। ইস্ট সেকেণ্ড স্ট্রিট পার হয়ে গাছের ছায়াভরা পথে ব্যাঙ্ক অভ ওকলাহোমার বিশাল দালানের দিকে হেঁটে চলল জ্যাকি। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে: দয়াময়, ট্যাক্সি জুটিয়ে দাও। আর সেজন্যে বেশি সময় নিয়ো না, প্রভু!’

মাত্র পাঁচ ফুট যেতে না যেতেই ধক করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। এদিকেই আসছে হলদে এক ট্যাক্সি। হাত তুলে ওটাকে থামার ইশারা করল জ্যাকি। চলমান গাড়ির লাইন থেকে বেরিয়ে রাস্তার বাঁকে বিশ গজ দূরে থেমে গেল, ট্যাক্সি। ওটা আছে ব্যাঙ্কের সদর দরজার কাছে। প্রায় দৌড়ে ট্যাক্সির দিকে ছুটে চলল জ্যাকি। নিজের সৌভাগ্যে বিস্মিত। কিন্তু গাড়িটার কাছে যাওয়ার আগেই আঁটসাঁট পোশাক পরা হাতির মত মোটা এক লোক বেরিয়ে এল ব্যাঙ্ক থেকে। ফোনে কথা বলতে বলতে তার চোখ পড়ল ট্যাক্সির ওপরে। জ্যাকির আগেই জায়গামত পৌছে গেল সে

‘দুঃখের কথা, রনির মন খারাপ হবে, বুঝলে, রিচি,’ -জোর গলায় বলল, ‘তবে আজই হিন ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করব। টাকাগুলো সত্যিই আমাদের দরকার।

‘মাফ করবেন, স্যর,’ তার সামনে গিয়ে থামল জ্যাকি। ‘আমিই কিন্তু আগে এই ট্যাক্সি ডেকেছি।’

মোটা ঘাড় ঘুরিয়ে চরম তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে ওকে দেখল হাতি। ‘একমিনিট, রিচি। অ্যাই, মেয়ে, তুমি কী চাও?’

‘বলছি, ট্যাক্সিটা আমি ডেকেছি,’ বলল জ্যাকি, ওটা আমার দরকার।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে কুমিরের মত ভয়ঙ্কর একটুকরো হাসি দিল মোটকু। ‘ভালই বলেছ, সুন্দরী ডার্লিং! তবে কস্মিনকালেও এই ট্যাক্সি তোমার ছিল না! ওটা আসলে আমার!’

‘আমি আগে দেখেছি, ‘ আপত্তি তুলল জ্যাকি।

‘তুমি কি পাঁচ বছরের শিশু নাকি; মেয়ে? এত আমি আমি করে কোন লাভ হবে না। পারলে অন্য ট্যাক্সি জোগাড় করে নাও।’

মোটকু ও ট্যাক্সির মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে গেল জ্যাকি। করুণ চোখে চেয়ে বলল, ‘আমার কাজটা খুব জরুরি, স্যর। তাই ট্যাক্সিটা খুব দরকার। আপনি আসলে ভাবতেও পারবেন না যে…’

‘তুমি যতই সুন্দরী হও, মেয়ে, আমার হাগা পোঁদে চুমু দিলেও ট্যাক্সি বাপু তোমাকে দিতে পারব না, মোটা পেট দিয়ে জ্যাকিকে সরিয়ে দরজা খুলে মস্ত এক চাল কুমড়োর মত ট্যাক্সিতে ঢুকে পড়ল সে। নতুন করে কথা বলতে লাগল ফোনে। ‘আরে, না! কোথাকার এক গাধী এসে বিরক্ত করছে। যা বলছিলাম, রিচি, রনির পোঁদ ফেটে গেলেই বা আমার কী? আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

রাগ নিয়ে তাকে দেখছে জ্যাকি। বুঝে গেছে, নাকের ডগার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সাধের ট্যাক্সি। আর তখনই মগজে বুদ্ধি এল ওর। ব্যাগ থেকে পিস্তল বের করে ঝুঁকে গিয়ে সরাসরি তাক করল হাতির ভুঁড়ির দিকে। ‘হারামি শয়তান কোথাকার! শুয়োরের চর্বির ডিপো! জলদি বেরো আমার ট্যাক্সি থেকে! আর একটা কথা বললে গুলি করে পেট ফুটো করে দেব!’

ঝগড়ার আভাস পেয়ে থেমে গেছে ক’জন পথযাত্রী। কিন্তু পিস্তল দেখে যে যার মত পালিয়ে যেতে চাইল তারা। একজন চিৎকার করে বলল, ‘গুলি! মেয়েটা গুলি করছে!’

ফোন মেঝেতে ফেলে মাথার ওপরে হাত তুলে বোকা বোকা চেহারা করেছে মোটকু। বেসুরো কন্ঠে বলে উঠল, ‘হায়, যিশু, না-না, গুলি কোরো না! আমি নেমে যাচ্ছি! এই ট্যাক্সি তো বাবা চিরকালই তোমার!’ গাড়ির মেঝে থেকে ফোন কুড়িয়ে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে নেমে এল সে। তিন ভাঁজ করা থলথলে থুতনি নেমে এসেছে বুকে। অবাক চোখে জ্যাকিকে দেখছে ট্যাক্সি চালক। কী করবে বুঝে উঠছে না।

তখনই চিৎকার শুনল জ্যাকি। ‘পুলিশ! অস্ত্র ফেলো! নইলে বাধ্য হব গুলি করতে।

মূর্তির মত থমকে গেল ডাকি। কখন যেন মাত্র পাঁচ গজ দূরে হাজির হয়েছে দুই পুলিশ অফিসার। জ্যাকির বুকে তাক করেছে তাদের গ্লক পিস্তল।

হাত থেকে পিস্তল ছেড়ে দিতেই ফুটপাশে পড়ে ঠং-ঠনাৎ আওয়াজ তুলল অস্ত্রটা। জ্যাকি মাথার ওপরে হাত তুলতেই ওকে কাভার করল এক অফিসার। দ্বিতীয়জন এসে কুড়িয়ে নিল পিস্তল। ধমকের সুরে বলল, ‘গাড়িতে বুক ঠেকাও!’

নির্দেশ পালন করল জ্যাকি। একটু পর গ্রেফতার হলো। হাজির হয়ে গেছে পুলিশের ক্রুযার। একদল লোকের সামনে গাড়ির পেছনের সিটে তোলা হলো জ্যাকিকে। দরজা লক হয়ে যেতেই রওনা হয়ে গেল জুয়ার।

জ্যাকি এতই বিস্মিত, বুঝতে পারল না কোথায় নেয়া হচ্ছে ওকে। একটু পর থেমে গেল গাড়ি। খোলা হলো পেছনের দরজা। ওর ঘাড় ধরে গাড়ি থেকে বের করল এক অফিসার। পিঠে ঠেলা দিয়ে নেয়া হলো বড় এক বাড়ির ভেতরে। সেখানে ওর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেয়ার পর ভরে দেয়া হলো ছোট এক সেলে। ধাতব বেঞ্চিতে বসে দু’হাতে কপাল টিপতে লাগল জ্যাকি। তীব্র রাগে ও মানসিক কষ্টে ওর মনে হলো, যে-কোন সময়ে হড়হড় করে বমি করে দেবে।

তিলতিল করে পেরোতে লাগল সময়। অনেকক্ষণ পর সেলের দরজায় লাঠির আওয়াজে মুখ তুলে তাকাল। ওর দিকে চেয়ে টিটকারির হাসি হাসছে এক পুলিশ অফিসার।

‘বাহ্, নিজেই তুমি হাজির?’ বলল পুলিশ চিফ রিগবি। ‘খুবই ভাল!’

ঊনপঞ্চাশ

ট্রাকের ইঞ্জিন সগর্জনে চালু হলেই লোকগুলোর ভেতরে সাড়া পড়বে, ভাল করেই জানত রানা। আর সেটাই হলো। যে-যার হাতের মালপত্র ফেলে হৈ-হৈ করে উঠল তারা। কেউ বের করল পিস্তল, অন্যরা দেয়ালে কাত করে রাখা রাইফেল তুলে ছুটে এল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের দিকে গিয়ার সামনে ঠেলে অ্যাক্সিলারেটর দাবিয়ে দিল রানা।

বারকয়েক হোঁচট খেয়ে এবড়োখেবড়ো জমিতে হেলেদুলে মোটা মহিলার মত এগোল ট্রাক। চাইলেও ট্রাক নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে না রানা। অনায়াসে ধাওয়া করে ওকে ধরবে জিপের ড্রাইভারেরা। অবশ্য ভেগে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ওর নেই।

রানার একমাত্র উদ্দেশ্য অ্যারন কর্নারের সর্বাত্মক ক্ষতি করা। সেটা এমন হতে হবে, যেন কমাণ্ডো আক্রমণে খুব দ্রুত হ্রাস পায় লোকটার দলের শক্তি।

ট্রাক নিয়ে অস্ত্রে অর্ধেক ভরা ট্রাকে দিকে ছুটছে রানা। ক্রমেই বাড়ছে যন্ত্রদানবের গতি। প্রচণ্ড নাকি খেয়ে নড়ছে রানার পাঁজরের হাড়। দু’হাতে শক্ত করে ধরেছে স্টিয়ারিং হুইল। দানবীয় ট্রাক হুড়মুড় করে এসে পিষে দেবে বুঝতে পেরে লাফিয়ে সরে যাচ্ছে অ্যারন কনারের দলের দস্যুরা। ওজনদার ট্রাক নিয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা ট্রাকের ওপরে চড়াও হলো রানা। দ্বিতীয় ট্রাক ছেঁচড়ে সরে গিয়ে ধুম করে গুঁতো মারণ ক্রেন লরির গায়ে। ফলে মস্ত ঘাছের মত টলমল করে কাত হয়ে পড়ে অপারেটরকে চ্যাপটা করে দিল ক্রেন লরি সেখানেই থামল না ওটা, পিছলে হুড়মুড় করে নেমে গেল কংক্রিটের গভীর সুইমিংপুলে। ক্রেনের ওজনে চুরমার হয়ে গেছে কয়েকটা মই, একগাদা ইকুইপমেন্ট ও অস্ত্রের ক্রেট। পরক্ষণে ক্রেন লরির পিছু নিয়ে গর্তে নামল অস্ত্রে অর্ধেক ভরা ট্রাক। পিঠ থেকে ঝরবার করে ঝরছে নানান আকারের ক্রেট।

এদিকে রানার ট্রাকে এসে বিঁধছে শত শত গুলি। গভীর গর্তের পাশে কড়া ব্রেক কষে ট্রাক রাখল রানা। ওর কাঁধে শটগান থাকলেও ওটা ব্যবহার না করে দুই গ্রেনেড লঞ্চার হাতে ট্রাকের দরজা খুলে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শূন্যে ভেসে থাকতেই স্পর্শ করেছে গ্রেনেড লঞ্চারের ট্রিগার। প্রথম গ্রেনেড গিয়ে লাগল এক জিপ গাড়ির গায়ে। বোমার আঘাতে খেলনার মত উড়ে গেল ভারী জিপ। অন্তত পাঁচ ফুট দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল আগুনে ভরা জঞ্জাল। রেঙের ভেতরে ছিল বার এ্যাপনেলের আঘাতে মারা পড়েছে তিন লুঠেরা। চতুর্থজন লাফিয়ে সরে গিয়ে আড়াল নিয়েছে আরেক জিপগাড়ির। গ্রেনেড হামলার জবাব দেয়ার জন্যে গুলি পাঠাল সে। তবে রানার পরের গ্রেনেড সরাসরি লাগল তার বুকে। প্রচণ্ড আঘাতে পো নে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ল লোকটা। আর তখনই সুইমি পুলের ভেতরে ফাটল রানার ছোঁড়া তৃতীয় গ্রেনেড। গভীর গর্তের মধ্যে শুরু হলো গোলাবারুদের একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ভয়ঙ্করভাবে থরথর করে কাঁপতে লাগল মাটি। আকাশের দিকে লকলক করে উঠে গেল ফুটবলের মত বিশাল এক কমলা আগুন। যুদ্ধবিধ্বস্ত কুয়েতের জ্বলন্ত তেলের কূপের চেয়েও বড় হলো লেলিহান শিখা।

এক দালানের আড়ালে সরে গেলেও রানার মনে হলো, প্রাচীন কোন ড্রাগন যেন মুখ থেকে আগুনের হলকা ছুঁড়ে দিচ্ছে ওর দিকে। তাপের তীব্রতা আরও বাড়লে স্রেফ সেদ্ধ হবে ও। গোলাবারুদের নারকীয় বিস্ফোরণে মাত্র দু’সেকেণ্ডে ধসে গেল মস্ত এক কাঠের আস্তাবল। আকাশ থেকে ঝরবার করে নামল কালো হয়ে যাওয়া লোহার মোচড়ানো পাত। ওগুলো চাপা দিল কয়েকটা জিপ গাড়িকে। আগুনের তাপ সহ্য করতে না পেরে পিঁপড়ের মত ছত্রভঙ্গ হয়ে নানানদিকে পালিয়ে যাচ্ছে লোকগুলো।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন: একবার মাটিতে পড়ে গেলে শত্রুকে উঠতে দিয়ো না। একই মতাদর্শ ছিল জেনারেল জর্জ প্যাটনের। এখনও রানার কাছে আছে সাতটা গ্রেনেড। এতবড় দুই ট্যাকটিশিয়ানের বিরু। যাওয়ার ইচ্ছে ওর নেই। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে গ্রেনেড ছুঁড়ে খালি করল দুই লঞ্চার। আগুনে পুড়তে লাগল দুই ট্রাক ও খামারের দালান। একের পর এক বিস্ফোরণে অস্ত্র ও গোলাবারুদের গভীর গর্ত থেকে আকাশে উঠছে বিশাল অগ্নি গোলক। একেক শিখার জিভ দৈর্ঘ্যে তিরিশতলা স্কাই-স্ক্র্যাপারের চেয়েও উঁচু। চারদিকে কালো যে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে, ওটা বোধহয় চোখে পড়বে ওকলাহোমা সিটি থেকে।

গ্রেনেড লঞ্চার ফেলে কাঁধ থেকে বন্দুক নিয়েছে রানা। অস্ত্রের চেম্বারে আছে প্রথম রাউণ্ড। পুরনো এক গাড়ির আড়াল থেকে ওর দিকে পিস্তল তাক করছে একলোক। দেরি না করে তার মুখ লক্ষ্য করে বাকশট পাঠাল রানা। খচ্চরের মত ওর কাঁধে লাখি দিল বন্দুকের কুঁদো। রানা দেখল ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে সরে গেছে লোকটা। কিন্তু গাড়ির তলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার দু’পা। ঝড়ের বেগে শটগান পাম্প করে আবারও গুলি পাঠাল রানা। দু’পা ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ায় গটিতে পড়ল অ্যারন কনারের দলের লুঠেরা। রানার তৃতীয় গুলি ফুটো করল তার হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস।

রানার পায়ের কাছের মাটিতে লেগে অন্যদিকে ছিটকে গেল একটা বুলেট। দুই দালানের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড় দিল রানা। তারই ফাঁকে পকেট থেকে গুলি নিয়ে ভরে নিল বন্দুকের ম্যাগাযিন। না থেমে ছুটে চলেছে ওপরদিকের জমি লক্ষ্য করে। ওখানে ভি-এর মত দাঁড়িয়ে আছে মরা দুই গাছ। তারই একটার গায়ে ঠেক দিয়ে রেখে এসেছে মৃত গার্ডের রাইফেল। ছুটন্ত রানাকে লক্ষ্য করে তাড়াহুড়ো করে গুলি করছে কেউ কেউ। পলকের জন্যে ঘুরে কোমরের কাছ থেকে গুলি ছুঁড়ল রানা। বুলেটের আঘাতে চুরচুর হয়ে ভাঙল এক দালানের কোনা। ওদিকে লুকিয়ে ছিল একলোক, কাত হয়ে উঠনে পড়ল সে। টি-শার্টের বুকে ফুটে উঠল লাল এক বড় গোলাপের মত নকশা।

দ্বিতীয়বার ওদিকে না চেয়ে ছুটছে রানা। মাত্র দশ সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল মরা দুই গাছের পেছনে। রাইফেল নিয়ে, শুয়ে পড়ল মরা ঘাসে ভরা মাটিতে। এত দূর থেকে বন্দুক কাজে না এলেও রাইফেল অন্যকিছু। ওটার আছে শক্তিশালী, ম্যাগনিফিকেশন স্কোপ। হঠাৎ এই আকস্মিক আক্রমণে উঠনে ধোঁয়ার ভেতরে বিশৃঙ্খলভাবে ছুটোছুটি করছে অ্যারন কনারের লোকেরা। তাদের ভেতরে নেই বার্ব ও স্ক্যালেস। অর্থ বিপদের সময়ে তাদের এখানে থাকার কথা!

স্কোপের ক্রস হেয়ারে একজনকে পেয়ে চিগারে মৃদু স্পর্শ করল রানা। ৩০৮ বুলেট লক্ষ্যের দিকে রওনা হতেই কাঁধে লাগল জোরালো গুঁতো। বিকট আওয়াজে ঝনঝন করছে দু’কান। টার্গেটের বুকে ছিটকে উঠল লাল বাষ্প। লোকটা পড়ে যেতেই নতুন টার্গেট খুঁজে নিল রানা। আবারও ট্রিগার স্পর্শ করতেই মাটিতে পড়ে গেল লোকটা। এরপর পাল্টে গেল যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবেশ। অন্যদিকে হাওয়া বইতেই কালো ধোঁয়া ঢেকে দিল প্ৰকাণ্ড উঠন।

স্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে নিল রান্না। এবার সময় হয়েে বিদায় নেয়ার। চরম ক্ষতি করা গেছে অ্যারন কনারের।

আপাতত যথেষ্ট।

উঠে গেটের দিকে ছুটল রানা। পাঁচ মিনিটে তারের বেড়া টপকে পৌঁছে গেল গাড়ির কাছে। এদিকে আসার সময়ে প্রথম গার্ডের ওয়ালেট পরীক্ষা করে দেখেছে। ওটার ভেতরে আছে দু’ শ’ হয় ডলার, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও কয়েকটা কার্ড। লোকটা ছিল ভাড়াটে দস্যু। ব্ল্যাক বেয়ার ফার্মে কাজের জন্যে তাকে আইডি কার্ড দিয়েছিল অ্যারন কনার। লোকটার নাম রেনি এফ. ডান। জরুরি নাম বা নম্বর থাকতে পারে ভেবে তার ফোন দ্রুত চেক করল রানা।

অ্যাডোনিস শহরে ফেরার সময় কল দিল জ্যাকিকে। যদিও ওদিক থেকে সাড়া দিল না কেউ।

অফ করা আছে ডিভাইস।

ফোন চালু করলে জ্যাকি যেন বুঝতে পারে ও ফিবে আসছে, সেজন্যে সংক্ষেপে মেসেজ পাঠান রানা। খচ খচ করছে ওর মন। পথের ধারে গাড়ি রেখে গুগল থেকে নম্বর নিয়ে কল দিল হায়াট রিজেন্সি হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে। রিসেপশনিস্ট হ্যালো বলতেই রানা জানাল, দু’ শ পাঁচ নম্বর • রুমে যেন লাইন দেয়া হয় মিসেস হ্যাম্পটনের কাছে।

একটু পর রিসেপশনের মেয়েটা বলল, বেশ অনেকক্ষণ আগে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন মিসেস হ্যাম্পটন

মনে অস্বস্তি নিয়ে আবারও রওনা হলো রানা। ক্রমেই বাড়ছে গাড়ির গতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *