পঁয়ত্রিশ
ধূসর ভ্যানের পিছু নিয়েছে রানা। ভারী ট্রাফিকের ভেতরে সামনে রাখছে কমপক্ষে পাঁচটা গাড়ি। ওর মনে হচ্ছে না যে ব্রঙ্কো জিপের ব্যাপারে সচেতন সামনের দুই খুনি। যদিও যে- কোন সময়ে হয়তো সন্দেহ করে বসবে তারা।
দূরে রয়ে গিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকি নিচ্ছে রানা। ট্রাফিকের লাল বাতি জ্বললে যে-কোন সময়ে চোখের সামনে থেকে উধাও হবে টার্গেট। হয়তো কোন লাল সিগনাল না মেনে দ্রুত ইন্টারসেকশন পেরোবে ভ্যানের ড্রাইভার। তখন তাকে নজরে রাখতে গিয়ে রানাকেও বাড়াতে হবে গতি। তাতে চোখে পড়ে যেতে পারে পুলিশের লোকেদের। এজন্যেই অপরাধী ও পুলিশবাহিনী একাধিক গাড়ি, ট্রাক ও মোটর সাইকেল ব্যবহার করে চোখ রাখে টার্গেটের ওপরে। নিজেদের মাঝে থাকে রেডিয়ো যোগাযোগ। আরও ভাল হয় আকাশে হেলিকপ্টার তুলে নজর রাখলে। দলের কেউ যদি মনে করে তাকে সন্দেহ করছে টার্গেট, রেডিয়ো করে পিছিয়ে যায় সে। বদলে পিছু নেয় অন্য কেউ। ঠিকভাবে কাজটা করতে পারলে কেউ বুঝতে পারে না আসলে কী ঘটছে।
অবশ্য রানার উপায় নেই যে কারও কাছ থেকে সাহায্য নেবে। আর সেজন্যেই সতর্ক হয়ে ডাউনটাউনে কয়েকটা গাড়ির পেছনে থেকে এগিয়ে যাচ্ছে রানা। ভ্যানের ধুলোভরা কাঁচের পেছন-দরজার ওপরে ওর চোখ। যে-কোন সময়ে সতর্ক হবে সামনের লোকদুটো। সুযোগ পেলেই ঝড়ের বেগে এগোচ্ছে ধূসর ভ্যান। বারবার লেন বদলে নিয়ম না মেনে বামে বা ডানে সরে ওভারটেক করছে গাড়িগুলোকে। বাধ্য হয়ে রানাকেও তখন বাড়াতে হচ্ছে গতি। ভাল করেই বুঝতে পারছে, কোথাও যাওয়ার তাড়া আছে লোকগুলোর। একটা স্টেশন ওয়্যাগনকে পেরিয়ে গেল তাদের ভ্যান। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। জিপের গতি তুলে ভাবল, খুনিগুলো স্বাভাবিক বেগে গেলে মন্দ হতো না। বেশি গতির কারণে চারপাশের ড্রাইভারদের চোখে পড়ছে তারা।
ঝোড়ো বেগে একের পর এক মোড় পার করছে ঠাণ্ডা মাথার খুনি। সোজা চলেছে শহরের উত্তরদিকে। কয়েক মিনিট পর রানা বুঝল, সাদা এক ফোর্ড গাড়িকে অনুসরণ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে লোকটা। দুই গাড়ির ড্রাইভারের ভেতরে যেন শুরু হয়েছে গোপন কোন প্রতিযোগিতা। এতদূর থেকে রানা আঁচ করতে পারল না সাদা গাড়ির ভেতরে কতজন আছে। তবে ওর মনে হলো দলে তারা কমপক্ষে তিন থেকে চারজন।
সামনের জ্যামে অসংখ্য গাড়ি আটকা পড়তেই গতি হ্রাস করল সাদা ফোর্ড ও ধূসর ভ্যান। রানা দেখল, দুই গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটের লোকদু’জন নামিয়ে নিয়েছে জানালার কাঁচ। ফোর্ডের যাত্রী সাদা গরিলার মত ভারী চেহারার এক লোক। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে চেপে ধরেছে ফোন। একই কাজ করছে ভ্যানের দ্বিতীয় যাত্রী। রানা আন্দাজ করল, জরুরি কোন উদ্দেশ্যে চলেছে এরা। চেহারা খুব গম্ভীর। মেডেইরার অভিজ্ঞতা থেকে রানা জানে, এদের সঙ্গে থাকবে আধুনিক সব আগ্নেয়াস্ত্র। এদিকে ওর নিজের কাছে অস্ত্র বলতে কিছুই নেই!
কথাটা মাত্র ভেবেছে রানা, এমন সময় দ্রুত বদলে গেল সামনের দৃশ্যপট। জ্যামের ভেতরে ধীরগতি গাড়ির মাঝে তৈরি হলো সামান্য ফাঁক। সুযোগটা নিল সাদা ফোর্ডের ড্রাইভার। ডানে সারি সারি গাড়ি পাশ কাটিয়ে ঝড়ের বেগে এগোল। দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে ফোর্ডের পিছু নিল ভ্যান। বিড়বিড় করে ভাগ্যকে দোষ দিল রানা। সামনের দুই গাড়ির মতই মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে জিপের গতি তুলল পঞ্চাশ মাইলে। তুমুল বেগে যেতে যেতে দেখল এক ইন্টারসেকশনের কাছে চলে গেছে সাদা ফোর্ড। ওটার ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলছে ধূসর ভ্যান। একই সময়ে রানা বুঝে গেল এবার কী ঘটবে। বাতি সবুজ থাকতেই ইণ্টারসেকশন পেরোবে ভ্যান ও ফোর্ড। এদিকে নিজে লাল বাতির চক্করে আটকা পড়বে ও। আর তখন কোন নিয়ম না মেনে এগোলে মারাত্মক ঝুঁকি নিতে হবে। তাতে ঘটতে পারে ভয়ঙ্কর কোন দুর্ঘটনা।
অবশ্য ভুল বলে প্রমাণিত হলো রানার ধারণা। সিগনাল পেরোবার আগেই সবুজ থেকে লাল হলো বাতি। যদিও কিছুই পাত্তা না দিয়ে গতিহ্রাস না করে এগিয়ে চলল সাদা ফোর্ডের ড্রাইভার। লেজের কাছে ভ্যান সঙ্গে নিয়ে পার হচ্ছে ব্যস্ত ইন্টারসেকশন। সামনে থেকে এল বড় এক নিসান পেট্রল জিপ। মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে বুঝতে পেরে কড়া ব্রেক কষে একদিকে বাঁক নিল জিপের ড্রাইভার। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চরকির মত ঘুরে গেল ভারী গাড়িটা। ওটার পেছনে আসা এক সুবারু লেক্সাসের নাকে দড়াম করে বসিয়ে দিল জোর একটা গুঁতো। ধাক্কা খেয়ে দ্রুতগামী এক বাসের গতিপথে চলে গেল হালকা সুবারু। চারপাশে বেজে উঠেছে হরেক ধরনের হর্ন, চমকে গেছে ড্রাইভারেরা। নানান সংঘর্ষে তুবড়ে গেল কিছু গাড়ির বড়ি। পথে ছড়িয়ে পড়ল প্লাস্টিকের অসংখ্য টুকরো। এত বিশৃঙ্খলার ভেতরেও আঁচড় ছাড়াই দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেল সাদা ফোর্ড। অবশ্য পিছিয়ে এসে ধূসর ভ্যানের পথ আটকে দিয়েছে লেক্সাস গাড়ি। ওটাকে নাক দিয়ে ঠেলে এগিয়ে গেল ভারী ভ্যান। চারপাশে কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। পরক্ষণে ইন্টারসেকশন পার হয়ে সাদা ফোর্ডের পিছনে ছুটে চলল ধূসর ভ্যান।
জিপের গতিহ্রাস করল রানা। সামনে দেখছে দুর্ঘটনায় পড়া বেশকিছু গাড়ি। জিপ থামিয়ে নেমে পড়ল রানা। দূরে দেখতে পেল সাদা ফোর্ড আর ধূসর ভ্যান চলে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে উধাও হলো গাড়িদুটো। বিরক্ত হয়ে জিপের বনেটে ধুম করে ঘুষি মারল রানা।
যে-যার গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে অনেকে। আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বোকা বনে গেছে কেউ কেউ। জ্যাম হয়ে গেছে কার যেন গাড়ির হর্ন। টানা প্যাঁ-প্যাঁ শব্দে চলছে বিশ্রী আর্তনাদ।
ভ্যানের গুঁতো খেয়ে তুবড়ে গেছে সুবারু লেক্সাসের পেছনদিক। এদিকে সামনের দিক ভচকে গেছে বাসের ধাক্কা লেগে। সুবারুর রেডিয়েটর থেকে ভুশভুশ করে বেরোচ্ছে সাদা বাষ্প। বাসের ড্রাইভার ভারী শরীরের এক কালোমানুষ। পরনে ইউনিফর্ম ও মাথায় ক্যাপ। দুর্ঘটনা কবলিত এলাকার চারপাশে চোখ বুলিয়ে মাথা নাড়ল সে। বাস থেকে নেমে এসেছে প্যাসেঞ্জারেরা, সবার চেহারা ফ্যাকাসে। হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করেছে পিচ্চি এক মেয়ে।
‘আপনারা কাণ্ডটা দেখলেন?’ দূরের রাস্তার দিকে আঙুল তাক করলেন বয়স্কা এক মহিলা। ‘সাদা গাড়ির ড্রাইভার লোকটা আসলে বদ্ধ উন্মাদ!’
‘কেউ আহত হয়েছেন?’ জানতে চাইল রানা। জবাবে মাথা নাড়ল ক’জন। কারও মাথায়, গায়ে বা হাতে-পায়ে রক্ত নেই। ভাঙা এসব গাড়ির ইনশিওরেন্স কোম্পানির মালিকপক্ষ চরম বিরক্ত হবে জরিমানা গুনতে গিয়ে। এবার কী করবে সেটা ভাবতে শুরু করেছে রানা। চাইলেও আর অনুসরণ করতে পারবে না। বহু দূরে কোথাও হারিয়ে গেছে সাদা গাড়ি আর ধূসর ভ্যান।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে নিসান জিপের দিকে তাকাল রানা। অবশ্য তার আগে চোখের কোণে দেখেছে অন্যকিছু। কয়েক পা হেঁটে গেল রানা। ওর পায়ের নিচে কুড়মুড় করে ভাঙল ভাঙা হেডলাইটের কাঁচ। লেক্সাসের ওপরে যেখানে চড়াও হয়েছিল ভ্যান, সেখানের রাস্তায় পড়ে আছে থকথকে কালো তরল। চারপাশে ভাঙা প্লাস্টিকের টুকরো। ধাক্কা লেগে উপড়ে গেছে ধূসর ভ্যানের ডানদিকের হেডলাইট-যেন অক্ষিকোটর থেকে খসে পড়া কোন চোখ। প্রচণ্ড সংঘর্ষে ফাটল ধরে গেছে ভ্যানের রেডিয়েটরে।
ঝুঁকে আঙুলের ডগা দিয়ে রাস্তা থেকে কালো তরল তুলল রানা। ওটা বেশ গরম পানি নয়, ভারী মোবিল। লেক্সাস গাড়ি থেকে পড়েনি। এ থেকে দুটো ব্যাপার বুঝে গেল রানা। প্রথম কথা: হালকা গাড়িটার সামনের দিকে বড় কোন ক্ষতি হয়নি। দ্বিতীয় কথা: দুর্ঘটনার জায়গা থেকে সরাসরি রাস্তার দূরে চলে গেছে কালো তরলের দাগ। ওটা এসেছে ধূসর ভ্যানের ইঞ্জিন থেকে।
দেরি না করে জিপে এসে উঠল রানা।
‘আপনি এখন কোথাও যেতে পারবেন না,’ আপত্তি তুলল বাস ড্রাইভার। ‘আগে পুলিশ আসুক। তাদেরকে খুলে বলবেন আসলে এখানে কী ঘটেছে।’
তাকে পাত্তা না দিয়ে জিপ নিয়ে এগোল রানা। দুটো মার খাওয়া গাড়ির পেছনদিক একসঙ্গে লেগে আছে। জিপের নাক দিয়ে গাড়িদুটোকে ঠেলে সরিয়ে পথ করে নিল রানা। এখন রেন্টাল কার কোম্পানির কাছে ফেরত দিলে তারা বড়জোর পাবে দু’চারটা আঁচড়। তাতে রানাকে গুনতে হবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্রেফ পঞ্চাশ ডলার। কিন্তু ভবিষ্যতে হয়তো ওকে দণ্ডি দিতে হবে হাজার হাজার ডলার!
এসব না ভেবে ঝড়ের বেগে মোবিলের কালো দাগের পিছু নিল রানা।
ছত্রিশ
ছায়াভরা পার্কিং লটে মূর্তি হয়ে গেছে জ্যাকি ও ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। ওরা দেখতে পেল আলোয় বেরিয়ে এসেছে সাদা ফোর্ড গাড়ি। হেডলাইট দেখে ওটা চিনতে পারল জ্যাকি আগে গাড়িটা ছিল ওর বাড়ির কাছে। পার্কিং লটের মেঝেতে সাসপেনশন ঘষা লাগতেই কর্কশ আওয়াজ হলো। সাদা গাড়ির পিছু নিয়ে এল ধূসর এক ভ্যান। জ্যাকি দেখতে পেল, ভেঙে গেছে ওটার হেডলাইট ও রেডিয়েটর গ্রিল। সরাসরি ওদের দিকে আসছে গাড়িদুটো।
‘সাবধান!’ বলে খপ্ করে হাত ধরে জ্যাকিকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিল ডিটেকটিভ। টনক নড়তেই ওর গাড়ি ও সামনের পিকআপের পেছনের সরু ফাঁকে ঢুকে পড়ল জ্যাকি। ওর দেখাদেখি সংকীর্ণ জায়গাটাতে বসে গাড়িদুটোর ওপরে চোখ রাখল ডিটেকটিভ।
তার লিংকন গাড়ির পাশে এসে থামল সাদা গাড়িটা, এদিক-ওদিক দুলছে ভারী স্প্রিঙে ভর করে। আড়াআড়িভাবে লিংকনের পথরুদ্ধ করল ধূসর ভ্যান। ধাতব আওয়াজে খুলে গেল দুই গাড়ির পাঁচটা দরজা। সাদা গাড়ি থেকে নেমে এসেছে তিক্ত চেহারার তিনজন লোক। তাদের একজনকে চিনতে পারল জ্যাকি। বাড়ির বাইরে গাড়ির ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল সে। তার সঙ্গী জ্যাকিকে কিডন্যাপ করে আনলে – গাড়িতে তুলে নেয়ার সময়ে তাকে সাহায্য করত। অন্য
দু’জনকে চিনতে পারল না জ্যাকি।
ধূসর ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দুই বদমাশ। তাদেরকে ভাল করেই চেনে জ্যাকি। সে-রাতে লেকের তীরে কটেজে মানুষ খুনের সঙ্গে জড়িত এরা। প্রতি রাতে তাদেরকে দুঃস্বপ্নে দেখে জ্যাকি। তখন ভয়ে শুকিয়ে যায় ওর বুক। ভাড়াটে খুনিদুটোর একজনের নাম বার্ব, অন্যজনের স্ক্যালেস।
ভ্যানটাও চিনতে পেরেছে জ্যাকি। কটেজের কাছে পার্ক করা ছিল। ওটাতে করেই সরিয়ে নিয়ে গিয়ে গুম করা হয়েছে লাশ।
ডিটেকটিভের দিকে তাকাল জ্যাকি। সতর্ক হয়ে উঠেছে লোকটা। ঢিলা শার্ট সরিয়ে দিয়ে হোলস্টার থেকে বের করল পিস্তল। ভারী ও বড় অস্ত্রটা কোল্ট ১৯১১ গভার্নমেন্ট মডেল। চাপা স্বরে বলল লিয়োনার্ড, ‘মাথা নিচু করে বসে থাকুন।
ওদের দিকে হেঁটে আসছে লোকগুলো। গ্যারাজের ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলছে পদশব্দ। পাঁচজনের বিরুদ্ধে জ্যাকিরা মাত্র দু’জন। চাপা স্বরে নির্দেশ শুনতে পেল জ্যাকি। ওর মন চাইল চোখ বুজে একপলকে গায়েব হয়ে যেতে। কোল্টের চেম্বারে এক রাউণ্ড গুলি ভরল লিয়োনার্ড। জোর গলায় বলল, ‘পুলিশ! থামো! নইলে গুলি করব!’
জবাবে গ্যারাজে গর্জন ছাড়ল কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র। তাতে থরথর করে কাঁপল চারপাশ। ভুরু কুঁচকে হাত দিয়ে কান ঢাকল জ্যাকি। ওর গাড়িতে লাগল কয়েকটা গুলি। অন্যগুলো পেছনের কংক্রিটের দেয়ালে তৈরি করল মুঠোর সমান গর্ত। জবাবে গুলি’ পাঠিয়ে জ্যাকির গাড়ির পেছনদিকে সরে গেল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। জ্যাকির কাছ থেকে আট ফুট দূরে আছে সে। গুডুম গুডুম আওয়াজ করল আরও ক’টা গুলি। সুবারুর ভেতরে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলে যেমন হতো, সেভাবেই শিলাবৃষ্টির মত চারপাশে ছড়িয়ে গেল ভাঙা কাঁচ।
ধুলোভরা মিটসুবিশি মিরাজ গাড়িটার পেছনে লুকিয়ে পড়ল জ্যাকি। হঠাৎ করেই বুঝে গেছে, আসলে গুলি করা হচ্ছে ডিটেকটিভের দিকে। গাড়ির পাশে শুয়ে পাল্টা গুলি করছে সে। পর পর চারবার সাদা ঝিলিক দেখতে পেল জ্যাকি। বদ্ধ জায়গায় বিকট আওয়াজ তুলেছে .৪৫ ক্যালিবারের কোল্ট। জ্যাকির বাহুর নিচে এসে গুঁজল খরচ করা একটা গুলির তপ্ত খোসা।
জিম লিয়োনার্ডের গুলির তোড়ে একদিকে ডাইভ দিল লোকগুলোর দু’জন। ঝনঝন করে ভেঙে পড়েছে সাদা ফোর্ড গাড়ির কাঁচ। ওদিকে আরও দুটো গুলি পাঠাল লিয়োনার্ড। এমনই এক বাজে জায়গায় আছে, কারও গায়ে গুলি করতে পারছে না। তার গুলি লাগছে দূরে সাদা গাড়িটার বড়িতে।
মিটসুবিশির মালিক উঁচু করে নিয়েছে সাসপেনশন। চাকাও স্বাভাবিকের চেয়ে বড়। ভয়ে গাড়িটার তলায় ঢুকে পড়ল জ্যাকি। আড়াল থেকে দেখতে পেল, সামান্য দূরে হালকা ওজনের কমব্যাট বুট পায়ে একজন। ধূসর ভ্যানের পেছনে আড়াল নিয়েছে সে। প্রাথমিক আতঙ্ক কেটে যেতেই আবারও মাথা কাজ করছে জ্যাকির। স্পর্শ করে দেখল, ওর প্যান্টের পকেটে আছে নাইন এমএম সিগ সাওয়ার পিস্তল। বুঝে গেল, ওটা বের করলেও গাড়ির তলা থেকে ঠিক দিকে তাক করতে পারবে না। অবশ্য চুপ করে শুয়ে না থেকে পর পর তিনবার গুলি করল জ্যাকি। নাইন এমএম পিস্তলের রিকয়েলে কুঁচকে গেল ওর ভুরু। কানের ভেতরে ভোঁ-ভোঁ আওয়াজ। জ্যাকি দেখল প্রায় নাচতে নাচতে পালিয়ে গেল কমব্যাট বুটের মালিক। জ্যাকির গুলি বিঁধেছে ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডের খয়েরি লিংকন গাড়ির বডিতে।
লোকগুলোর উদ্দেশে ৪৫ পিস্তল থেকে আরও একটা গুলি পাঠাল ডিটেকটিভ, তারপর খালি হয়ে গেল ম্যাগাযিন। সাত গুলির ম্যাগাযিন দ্রুত শেষ হয় বলে বেশিরভাগ মানুষ আজকাল এমন পিস্তল বেছে নেয়, যেটার থাকে নয় বুলেটের ম্যাগাযিন। মিটসুবিশির নিচে শরীর মুচড়ে ঘুরে তাকাল জ্যাকি। পিস্তল থেকে ম্যাগাযিন খুলে মেঝেতে ফেলেছে ডিটেকটিভ। বাম কোমরের বেল্টের পাউচ থেকে নিল স্পেয়ার ম্যাগাযিন। এই কয়েক সেকেণ্ডের সুযোগ নিয়ে সাদা গাড়ির কাভার থেকে বেরিয়ে এসেছে ওটার ড্রাইভার। ছুটে পৌছে গেল জ্যাকির গাড়ি ও পিলারের মাঝে। জিম লিয়োনার্ডের পেছনে পৌঁছুতে চাইছে সে। ডিটেকটিভ রিলোডের কাজে ব্যস্ত বলে কিছুই টের পায়নি। নিজের কাঁচভাঙা গাড়ির পাশে নড়াচড়া দেখতে পেল জ্যাকি।
‘জিম!’ চিৎকার করে সতর্ক করল। পরক্ষণে মিটসুবিশির তলা থেকে গুলি করল লোকটার পা লক্ষ্য করে। গাড়ির নিচ থেকে বের না হলে লক্ষ্যভেদ প্রায় অসম্ভব। তবুও আন্দাজে আবারও গুলি করল জ্যাকি। ওর হাতে পর পর দু’বার লাফ দিয়েছে সিগ সাওয়ার। সুবারু গাড়ির ভেতর দিয়ে গিয়ে লোকটার কাঁধে বিধেছে বুলেট। আর্তনাদ ছেড়ে বিকৃত চেহারায় ক্ষত চেপে ধরল সে। পেছনের কংক্রিটের পিলারে গিয়ে ছিটকে লেগেছে তাজা রক্ত।
খুশিমনে জ্যাকিকে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখাল ডিটেকটিভ। মুখে ফুটেছে কৃতজ্ঞতার আন্তরিক হাসি। চরম আতঙ্কজনক পরিবেশে দমে গেছে জ্যাকির মন। তবুও ভাবল, হয়তো এই লড়াইয়ে জিতে যাব আমরা। অবশ্য পরের কয়েক সেকেণ্ডে বুঝে গেল, কত বড় ভুল ছিল ওর ধারণা।
সুবারু গাড়ির একদিক ঝাঁঝরা হলো অটোমেটিক অস্ত্রের গুলিতে। কংক্রিটের মেঝেতে লেগে নানাদিকে গেল বুলেট। প্রাণভয়ে মিটসুবিশির নিচে শুয়ে থাকল জ্যাকি। ভ্যানের লোকদু’জনকে পলকের জন্যে দেখতে পেল। তারা চলেছে ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডের দিকে, হাতে অদ্ভুত কোন অ্যাসল্ট পিস্তল। জ্যাকির মনে হলো, এসব বোধহয় ব্যবহার করে শুধু মিলিটারির সদস্যরা। অস্ত্রটা আগেও বহুবার ব্যবহার করেছে বার্ব ও স্ক্যালেস। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ওর গাড়িটা ঝাঁঝরা করে দিল তারা।
হাঁচড়েপাঁচড়ে গাড়ির পেছনে সরে গেল ডিটেকটিভ জিম লিয়োনার্ড। সে যেন অসহায় কোন খরগোশ, আর তাকে ঘিরে ধরেছে একদল হিংস্র হাউণ্ড। গুলির তোড় এত বেশি যে নিজে আর গুলি করতে পারছে না সে। জ্যাকির গাড়ির চাকা ছিঁড়ে যেতেই মেঝেতে বসে পড়ল সুবারু। বডিতে অন্তত এক শ’টা বুলেটের গর্ত। ধীর পায়ে সামনে বেড়ে গুলি করছে স্ক্যালেস ও বার্ব। ঝড়ের বেগে পিস্তল রিলোড করল স্ক্যালেস। তাকে কাভার দিয়েছে তার সঙ্গী। আবারও এগোল তারা। অস্ত্রের একদিক থেকে ছিটকে পড়ছে খরচ করা গুলির খোসা। অসংখ্য বুলেট বেরোচ্ছে বলে নলের মুখে সার্বক্ষণিক জ্বলছে সাদা আগুন। বিকট আওয়াজে আর আতঙ্কে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে জ্যাকির। ভাল করেই বুঝে গেল, মিটসুবিশির তলা থেকে আর সরে যেতে পারবে না। যে- কোন সময়ে চোখের সামনে দেখবে ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডের মৃত্যু। ভাঙা সুবারু গাড়ির পেছনে শুয়ে আছে মানুষটা। তার ভাঁজ করা একটা পা দেখতে পেল জ্যাকি। গাড়ির পাতলা বড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় ক্রমে কাভার হারাচ্ছে ডিটেকটিভ। যে- কোন সময়ে অসংখ্য বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হবে সে। পার্কিং লটের কংক্রিটের দেয়ালে হঠাৎ করেই ছলাৎ করে লাগল একরাশ রক্ত। ভীষণ ঝাঁকি খেল লিয়োনার্ডের ভাঁজ করা পা। শরীরে তৈরি হয়েছে মৃত্যু খিঁচুনি।
এবার বোধহয় আমার মৃত্যুর পালা, ভাবল জ্যাকি। দু’বার গড়ান দিয়ে বেরিয়ে এল মিটসুবিশ্রির তলা থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে না চেয়েই গুলি করল পর পর তিনবার, তারপর দেয়াল আর সারি দেয়া গাড়ির পাশ কেটে তীরবেগে ছুটল শপিং মলের দিকে। বিশ গজ গেলে লিফট বা সিঁড়ি। যদিও সেখানে হয়তো পৌঁছুতে পারবে না জ্যাকি। একবার শপিং মলে উঠলেও রেহাই নেই ওর। পেছন থেকে ধেয়ে আসবে খুনিরা। স্থির করল জ্যাকি: প্রাণ থাকতে হাল ছেড়ে দেবে না। কোনভাবেই ওকে জীবিত পাবে না এরা।
সিঁড়ির দিকে মাত্র দশ গজ যেতেই কঠিন কংক্রিটে মুখ থুবড়ে পড়ল জ্যাকি। হাত থেকে ছুটে গেল পিস্তল। প্রায় অচেতন হয়ে গেছে তীব্র ব্যথায়। কী যেন ফুটো করেছে ওর কাঁধের মাংস। অবশ্য ওটা বুলেট নয়। সেক্ষেত্রে চোখের সামনে দেখতে পেত রক্তের বাষ্প। জ্যাকির শরীর খুঁড়ে যেন তৈরি করা হচ্ছে গভীর কোন লেক। থরথর করে কাঁপছে শরীর। যেন গলে যাবে হাড়-মাংস। দেহ জুড়ে বইছে তীব্র যন্ত্রণার স্রোত। ছিটকে নানানদিকে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন হাত- পা। পেছনে বেঁকে গেল মেরুদণ্ড। যে-কোন সময়ে মট করে ভাঙবে ওটা। জ্যাকির কাঁধে যে ডার্ট গেঁথে গেছে, ওটার পেছনে আছে লম্বা তার। আর মুঠোর মধ্যে একটা ডিভাইস ধরে রেখেছে পনিটেইল করা লোকটা। কাঁধের হোলস্টারে অটোমেটিক পিস্তল রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এল সে।
এখন কেমন লাগছে, মাই ডার্লিং?’ নরম সুরে বলল পশুটা। ‘বলো দেখি, তোমার কি দারুণ লাগবে না টনি স্ক্যালেসের সঙ্গে বিছানায় ফুর্তি করার সুযোগ পেলে?’ জ্যাকির পাশে থেমে ঝুঁকে মুচকি হাসল সে। দু’পাটি দাঁতের মাঝে সাদা একটা চুইংগাম। ভক করে মিন্টের গন্ধ পেল জ্যাকি। চট্ করে ওর মনে পড়ল সেই কটেজে খুনের রাতের কথা।
হাতের যন্ত্রটার সুইচ অফ করল স্ক্যালেস। বিদ্যুৎ তরঙ্গ থেমে গেলেও জ্যাকি এতই বিহ্বল, উঠে বসতে পারল না। আবছাভাবে দেখল ওকে ঘিরে ধরেছে কয়েকজন লোক। শক্ত হাতে হ্যাঁচকা টানে ওকে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। কাঁধের মাংস থেকে টান দিয়ে বের করে নিল ডার্ট। ‘আমার গা থেকে হাত সরান,’ জড়ানো কণ্ঠে বলল জ্যাকি। মুখ থুবড়ে পড়ে ছেঁচে গেছে গাল। ব্যথায় নিজের কণ্ঠস্বর অচেনা মনে হলো ওর। বুঝে গেছে, এরা ব্যবহার করেছে টেইয়ার। লাথি মেরে, দু’হাতে ঘুষি মেরে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইল জ্যাকি। একজনের বুকে লাগল ওর একটা ঘুষি। কিন্তু সেটা এতই দুর্বল, জবাবে মুচকি হাসল লোকটা।
সুবারুর ভাঙা জানালা দিয়ে গিয়ে জ্যাকির গুলি বিধেছে যার কাঁধে, সে নালিশ করল, ‘কুত্তীটা আমাকে গুলি করেছে!’ রক্তে ভিজে গেছে তার শার্টের বুক। ‘সত্যিই গুলি করেছে!’
‘দৌড় দিয়ে দ্যাখ, মাগী, কর্কশ স্বরে বলল স্ক্যালেস। পিস্তলের মাযল ঠেসে ধরল জ্যাকির থুতনির নিচে। ইস্পাতের স্পর্শটা শীতল ও কঠিন। ‘পারলে দৌড় দে! সুযোগ করে দে আমাকে! দেখবি এক গুলিতে ফুটো করব তোর মগজ!’
‘পিস্তল সরাও,’ ধমকের সুরে বলল বার্ব। জ্যাকির মনে পড়ল, এই লোক সেই রাতে কটেজে ছিল। ‘ভুলে যেয়ো না যে এই মেয়েটাকে জীবিত চাইছে বস।’
‘সে তোমার বস! আমার না! আবার বলে মেয়র! এমন একদিন আসবে যে এক গুলিতে তার খুলিও উড়িয়ে দেব আমি!’
‘বাজে কথা বাদ দাও, টনি,’ বলল বার্ব। জ্যাকির দিকে তাকাল। ‘কথা শুনছ? তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে মেয়র। তোমার সম্মানিত বোধ করা উচিত। সে খুব ক্ষমতাশালী লোক।’
‘ভাল করেই জানি তোমরা কারা,’ বলল জ্যাকি। ‘তুমি বার্ব আর এ স্ক্যালেস। নিজেদেরকে ভাবতে মিলিটারির অফিসার। কিন্তু আসলে তোমরা পচে যাওয়া মৃত কুকুর। লজ্জায় তোমাদের মরে যাওয়া উচিত।
‘ডাক্ট টেপ দিয়ে তোর মুখ আটকে দেব,’ বলল স্ক্যালেস, ‘আর একটা কথাও বলবি না।’ বেল্টে পিস্তল গুঁজে শক্ত করে জ্যাকির বাহু ধরল সে।
‘চলো, বিদায় নিই,’ ভ্যানের ড্রাইভিং সিটের দিকে চলল বার্ব। ‘কুত্তীটাকে পেছনের সিটে বসিয়ে দাও। আমি ড্রাইভ করব, টনি। তুমি পাশে থাকবে।’ আহত লোকটার দিকে আঙুল তাক করল সে। রিচি, তুমি বরং স্যামকে ফোর্ড চালাতে দাও। ফিনি, তুমি ভ্যানের ভেতরে বসে কুত্তীটাকে পাহারা দেবে। বেশি তেড়িবেড়ি করলে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখবে। তবে মারধর করবে না।’
‘কনারের সঙ্গে কথা শেষ হলে ফুর্তি করার সুযোগ দেব, ‘ দাঁত বের করে হাসল স্ক্যালেস।
‘মৃত্যুদণ্ড হলে এতগুলো দাঁত বের করে মরতে পারবে না,’ রেগে গিয়ে বলল জ্যাকি।
তিতকুটে হলো স্ক্যালেসের চেহারা। থুহ্ করে মুখ থেকে ফেলে দিল চুইংগাম। ‘তোমার কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে গেছি।’ জ্যাকির বাহু ধরে খামচে ভ্যানের দিকে টেনে নিয়ে চলল সে। তাকে লাথি মারতে গিয়ে পা পিছলে মেঝেতে পড়ে গেল জ্যাকি। ঘাড় চেপে ধরে ব্যথা দিয়ে ওকে টেনে তুলল স্ক্যালেস।
সাদা ফোর্ডে রিচিকে উঠতে সাহায্য করল স্যাম। মেঝেতে তৈরি হয়েছে রক্তের সরু রেখা। ভ্যানের পেছনে চলে গিয়ে দরজা খুলে সরে দাঁড়াল ফিনি। ধাক্কা দিয়ে জ্যাকিকে ভ্যানে তুলে দিতে চাইল স্ক্যালেস। আর তখনই এল ইঞ্জিনের গম্ভীর আওয়াজ। ঘুরে ওদিকে তাকাল সবাই। স্ক্যালেস চমকে গিয়ে বলল, ‘এই শালা আবার কে!’
‘কে জানে কোন্ শালা,’ রিচি গাড়ির ভেতরে বসে পড়তেই বলল স্যাম।
গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজে গমগম করছে পাতাল গ্যারাজ। বাঁক নিয়ে র্যাম্প বেয়ে কালো এক জিপ নেমে আসতে দেখল বার্ব ও স্ক্যালেস। ওটার গতি খুব দ্রুত। পার্কিং লটে সাধারণত কেউ এত জোরে চালায় না। বার্বের দলের ওপরে এসে পড়ল জ্বলজ্বলে সাদা হেডলাইট।
চোখ সরু করে বিড়বিড় করে বলল স্ক্যালেস, ‘ব্যাপার কী!’ ছেড়ে দিয়েছে জ্যাকির বাহু। কোমর থেকে টেনে বের করল অ্যাসল্ট ওয়েপন।
গতি কমছে না জিপের। র্যাম্প বেয়ে নেমে ‘বুম্!’ শব্দে কংক্রিটে লাগল সাসপেনশন। চারদিকে ছিটকে গেল হলদে- কমলা ফুলকি।
গর্জন ছাড়তে ছাড়তে ছুটে আসছে গাড়িটা।
সবাই বুঝে গেল, থামবে না জিপের উন্মাদ ড্রাইভার। ‘ধুশালা!’ চমকে উঠল ফিনি। সরাসরি ভ্যানের পেছনে এসে লাগবে দ্রুতগামী জিপ!
জ্যাকির অন্য হাতটা ছেড়ে দিল বার্ব। কাঁধের হোলস্টার থেকে পিস্তল নিয়ে নল তাক করল জিপের দিকে। দেরি না করে একই কাজ করেছে স্ক্যালেস। গাড়িটার ইঞ্জিন ছাপিয়ে গর্জে উঠল দু’জনের হাতের পিস্তল। গুলির আঘাতে শত শত ফাটল তৈরি হলো জিপের উইণ্ডশিল্ডে। বনেটে বিধল অজস্র বুলেট। তবে রকেট লঞ্চার ব্যবহার না করা হলে কোনভাবেই এখন আর ভ্যানের পেছনে এসে জিপের গুঁতো ঠেকাতে পারবে না কেউ। হঠাৎ করে খুলে গেল ড্রাইভারের দরজা। কে যেন খসে পড়ল জিপ থেকে। মেঝেতে গড়াতে শুরু করেছে লোকটা। নিয়ন্ত্রণহীন তিন হাজার পাউণ্ডের বিশাল মিসাইল হয়ে গেছে জিপ। সোজা যাচ্ছে স্ক্যালেস ও বার্বের দিকে। আর্তনাদ করে উঠে কোমর থেকে মিনি-উযি নিল ফিনি। বুদ্ধিমান কেউ হলে লাফিয়ে অন্যদিকে সরে যেত, কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ নয় সে। কী করবে ভাবতে গিয়ে দ্বিধা করেছে।
নাকে তুলে নিয়ে ভ্যানের পেছনে ফিনিকে পিষে দিল কালো জিপ। হাওয়াইটয়ার ফাটার মত বিকট শব্দ হলো পার্কিং লটে। ভ্যান ও জিপের সংঘর্ষে কোমর থেকে দু’টুকরো হয়েছে ফিনি। ডান বাইসেপ থেকে ছিঁড়ে গেল তার বাহু। ওটা ছিটকে জিপের ছাতের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পড়ল দূরের মেঝেতে।
লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে উঠেছে ভারী দুই গাড়ি। ছিটকে সামনে বেড়ে দশফুট দূরে কংক্রিটের এক পিলারে গিয়ে বাড়ি খেল ভ্যান। সবই যেন ঘটছে স্লো মোশনে। চারদিকে ছিটকাল হাজারো ভাঙা কাঁচ। একফুট পিছিয়ে এসে সাসপেনশনের ওপরে ভর করে মেঝেতে নেমে এল জিপ, তারপর বার দুয়েক দুলে উঠে স্থির হয়ে গেল।
সাঁইত্রিশ
প্যারাশ্যুট ড্রপের প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে জিপ থেকে ডাইভ দিয়ে নেমে এসেছে রানা। পার্কিং লটের কংক্রিটের মেঝেতে দু’বার গড়ান দিয়ে টেনে ছেড়ে দেয়া স্প্রিঙের মত লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বামহাতে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরির ব্যাগ। এদিকে তীব্র বেগে ধূসর ভ্যানের পেছনে গিয়ে ধুম করে লেগেছে ব্রঙ্কো জিপ।
ভ্যানের ইঞ্জিন থেকে পড়া মোবিলের চিহ্ন অনুসরণ করে কোথায় গিয়ে হাজির হবে.. জানা ছিল না রানার। অবশ্য র্যাম্প বেয়ে নেমে আসতে গিয়ে টের পেয়েছে হাজির হয়ে গেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। চারপাশের পরিস্থিতি বুঝে নিতে মাত্র তিন সেকেণ্ড নিয়েছে ও। ধূসর ভ্যান, সাদা ফোর্ড গাড়ি আর খয়েরি লিংকনের কাছে আছে চারজন লোক। তাদের দু’জন আবার মেডেইরার অনেক পুরনো বন্ধু ওর। ফোর্ডের প্যাসেঞ্জার সিটে যে সাদা গরিলা ছিল, এখন গাড়ির পেছনে বসে আছে সে। একহাতে চেপে ধরেছে রক্তাক্ত কাধ। গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ায় এক সুবারু গাড়ির পাশে রক্তের পুকুরে মুখ থুবড়ে আছে এক লোক।
এ-ছাড়া লোকগুলোর মাঝে আছে একমেয়ে। রানা জানে না সে কে এবং কী কারণে এখানে আছে। অবশ্য আপাতত এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই ওর। দুটো পিলারের মাঝে মাত্র বিশ ফুট দূরে আছে ভাঙা গাড়িগুলো। গুলি শুরু হওয়ার আগেই একদৌড়ে কাছের পিলারের আড়াল নিল রানা। ভাল করেই জানে, ওর এই আকস্মিক আগমনের বিস্ময়টুকু সামলে নেবে লোকগুলো। যে পিলারের ওদিকে লুকিয়ে পড়েছে রানা, ভ্যান ও জিপের সংঘর্ষের শব্দের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ওটার গায়ে এসে লাগল একরাশ গুলি। সমস্যা হচ্ছে, বিপদ এলে কী করবে, সেটা আগে থেকে ভাবার সুযোগ হয়নি রানার। এখন চেনা দুই খুনির তরফ থেকে গুলি আসতেই বুঝে গেল, চরম অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেছে ও। নিজে পাল্টা গুলি না করলে খুনিরা চট্ করে বুঝবে প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র। সেক্ষেত্রে হাসিমুখে এসে ঝাঁঝরা করে দেবে ওকে।
এবার কী করবে ভাবতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় ওর চোখ পড়ল কাটা এক বাহুর ওপরে। ওটা আছে এদিকের পিলার ও পরের পিলারের মাঝে। এখনও দরদর করে রক্ত বেরোচ্ছে বাহুর ছেঁড়া মাংসপেশি থেকে। আঙুলগুলো শক্ত করে ধরে রেখেছে আগ্নেয়াস্ত্রের বাঁট। পলকে অস্ত্রটা চিনে গেল রানা। মিনি-উযি সাবমেশিন পিস্তল!
কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে থেমে গেছে গুলি। পিলারের কোনা থেকে উঁকি দিল রানা। পনিটেইল আর তার বন্ধু পাল্টে নিচ্ছে তাদের ম্যাগাযিন। এটাই শেষ সুযোগ, বুঝতে দেরি হলো না রানার। কাভার ছেড়ে ছুটল মিনি-সাবমেশিন পিস্তলের দিকে। ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ল শত্রুদলের একলোক। রানার ডান কান পাশ কাটিয়ে চলে গেল বুলেটটা। দ্বিতীয় গুলি ঢুকে পড়ল ওর ব্যাগের ভেতরে। তীরবেগে ছুটছে রানা। নতুন করে ওর দিকে অস্ত্র তাক করছে দুই খুনির আরেক স্যাঙাত্। তবে সে গুলি করার আগেই ঝুঁকে উযি তুলে নিয়ে একটা পিলারের আড়ালে সরে গেল রানা। চট্ করে দেখে নিল অস্ত্রটা। মৃত লোকটার রক্তে মেখে আছে। ওটা। তবে সাবমেশিনটা নতুন বলেই মনে হলো ওর। অস্ত্রে আছে এক্সটেণ্ডেড ম্যাগাযিন। ভেতরে পঞ্চাশটা গুলি। তবে এই ক’টা গুলিতে যুদ্ধজয় সম্ভব নয়। শত্রুপক্ষের কাছে আছে একাধিক অস্ত্র। নিজেকে কোণঠাসা মানুষ বলেই মনে হলো রানার। পিলারের কোনা থেকে বের করল উযির খাটো নল। মাত্র একবার ট্রিগার স্পর্শ করতেই সাবমেশিন পিস্তলের নল থেকে ছিটকে বেরোল বেশ কয়েকটা গুলি। শুনলে যে-কেউ ভাববে ফড়ফড় করে ছেঁড়া হচ্ছে পুরু কার্ডবোর্ড। তফাৎ হচ্ছে আওয়াজটা খুব জোরে। খরচ করা বুলেটের খোসার হলদে এক স্রোত তৈরি করেছে ইজেক্টর পোর্ট। রানা গুলি করছে বুঝেই কাভার নেয়ার জন্যে নিজেদের গাড়িগুলোর ওদিকে ছিটকে সরে গেল শত্রুপক্ষ।
হঠাৎ করে কালো ধোঁয়ায় ভরা জিপের ভেতরে দেখা দিল আগুনের লকলকে কমলা জিভ। শিখাগুলো মাত্র ক’সেকেণ্ডে গিলে নিল গোটা জিপ। চোখের কোণে রানা দেখল, ধুপ করে খুলে গেছে সাদা ফোর্ড গাড়ির পেছনের দরজা। টলতে টলতে বেরিয়ে এল সেই সাদা গরিলা। একহাতে একটা পিস্তল। তবে সে গুলি করার আগেই পিলারের পাশে উযি রেখে একপশলা বুলেট বর্ষণ করল রানা। আধপাক ঘুরে গাড়ির ওপরে হুমড়ি খেয়ে সেখান থেকে মেঝেতে পড়ল মৃত লোকটা।
পিলারের আড়ালে রয়ে গিয়ে উযির ম্যাগাযিন চেক করল. রানা। এরই ভেতরে খরচ করে ফেলেছে অর্ধেক গুলি। সাবমেশিন পিস্তলের বড় সমস্যা হচ্ছে ঝড়ের বেগে শেষ করে অ্যামুনিশন। তারচেয়েও বড় কথা, স্পেয়ার ম্যাগাযিন নেই রানার কাছে। এদিকে ওর শত্রুদের কাছে অভাব নেই গুলির!
আরও ঘন হয়ে উঠেছে জিপের কালো ধোঁয়া। কুয়াশার মত ঘিরে ধরেছে অন্যান্য গাড়ি। শত্রুপক্ষকে এখন আর দেখতে পাচ্ছে না রানা। হঠাৎ করেই তাদের একজন বেরোল লিংকন গাড়ির পেছন থেকে। প্রথমে রানা ভাবল, হামলা করবে সে, কিন্তু পরক্ষণে দেখল শ্বাসরুদ্ধকর ধোঁয়ার ভেতরে টিকতে না পেরে কাশতে কাশতে দু’ভাঁজ হয়ে গেছে লোকটা, হাতে পিস্তল। একাধিক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় কাউকে বাড়তি সুযোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। দেরি না করে লোকটার মাথায় একটা গুলি গেঁথে দিল রানা। ছিটকে গিয়ে লিংকন গাড়ির পেছনে গিয়ে পড়ল লাশটা। হালকা ওজনের উঠি দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা কঠিন। রানার কয়েকটা গুলি ভেঙে দিয়েছে খয়েরি গাড়ির টেইল লাইট। করডাইটের কটু গন্ধের ওপর দিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে গেছে পেট্রলের ঝাঁঝাল ঘ্রাণ। রানা বুঝে গেল, গুলি করে ফুটো করতে পেরেছে গাড়িটার পেট্রল ট্যাঙ্ক।
কংক্রিটের মেঝেতে গড়াচ্ছে পেট্রলের স্রোত। মৃত লোকটার তলা দিয়ে পৌঁছে গেল একটু দূরের জ্বলন্ত জিপের কাছে। পরক্ষণে পেট্রলে দপ করে ধরল আগুন। লেলিহান শিখা চাটতে লাগল পার্কিং লটের ছাত। গপ করে জিপ ও লিংকন গাড়িটাকে গিলে নিল আগুনের নীল ঢেউ।
‘চলো!’ চিৎকার করে পনিটেইলকে বলল দ্বিতীয় খুনি। আগুনের প্রচণ্ড তাপে পিছিয়ে গিয়ে ভ্যানের কাছে চলে গেছে তারা। সাধারণ এক কাজে এসে এরই ভেতরে খতম হয়ে গেছে তাদের তিনজন। তিক্ত চেহারায় আশপাশে জ্যাকি আছে কি না খুঁজে দেখল দ্বিতীয় খুনি।
কিন্তু কোথাও নেই মেয়েটা!
এখন তাকে খুঁজে নেবে, সেটা সম্ভব নয়। নিচু গলায় কাকে যেন অভিশাপ দিল লোকটা। মেয়েটাকে হাতের মুঠোয় না পেলে রেগে গিয়ে বিশ্রী গালি দেবে ওদের বস। অবশ্য এখন আর এসব ভেবে কোন লাভ নেই। এখানে যেটা ঘটল, আপ্রাণ চেষ্টা করলেও গোপন করতে পারবে না মেয়র অ্যারন কনার। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে যতই লোক থাকুক, তদন্ত না করে রেহাই পাবে না পুলিশ চিফ রিগবি। সুতরাং এখন খুব দ্রুত বিদায় নিতে হবে এখান থেকে।
‘চলো!’ পনিটেইলকে আবারও তাড়া দিল সে। জবাবে তিক্ত চোখে তাকে দেখল ঠাণ্ডা মাথার খুনি। একই সঙ্গে ভ্যানে উঠে পড়ল তারা। পেছনের সিটে ছুঁড়ে ফেলল অস্ত্র। জ্বলন্ত জিপের আগুন এসে চেটে দিচ্ছে ভ্যানের তুবড়ে যাওয়া পেছনদিক। ওটার সামনের দিকটাও ক্ষত-বিক্ষত। অবশ্য পুরনো আমলের জিএমসি কোম্পানির গাড়ি খুব মজবুত। ইগনিশনে চাবি মুচড়ে দিতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। দুই খুনি ‘বুঝে গেছে, ক’মাইল দূরে গিয়ে ভ্যানটা কোথাও রেখে গা ঢাকা দিতে হবে।
ব্যাক গিয়ার ফেলে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল দ্বিতীয় খুনি। ঠেলে জ্বলন্ত জিপটাকে পেছনে নিয়ে গেল ভ্যান। ওটার চাকার নিচে চ্যাপটা হলো ফিনির দু’ভাগ হওয়া মরদেহ। থেমে ঢাকার কর্কশ আওয়াজে ঘুরে ঘন কালো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে র্যাম্পের দিকে ছুটল ভ্যান।
পিস্তলের শেষ ক’টা গুলি ভ্যানের পেছনে পাঠাল রানা। তিক্ত মনে দেখল র্যাম্প বেয়ে উঠে যাচ্ছে গাড়িটা। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বাঁকের ওদিকে যেতেই ওটাকে আর দেখা গেল না।
যে-কোন সময়ে এই পার্কিং লটে হাজির হবে পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের লোক। পিলারের ওদিক থেকে বেরিয়ে এসে গুলিশূন্য পিস্তল হাত থেকে ফেলে দিল রানা। ধোঁয়ার মাঝে দেখতে পেল ওর গুলিতে মারা গেছে দু’জন। তৃতীয় লোকটার দু’ভাগ হওয়া দেহ চ্যাপটা হয়ে গেছে গাড়ির চাকার ভারী চাপে। বিকৃত লাশটা দেখলে ভয়ে চমকে উঠবে যে-কেউ।
আগুনে ভরা ব্রঙ্কো জিপ আর কোন কাজে লাগবে না। তিক্ত মনে ভাবল রানা, আজকাল যে হারে রেন্টাল কোম্পানির গাড়ি ধ্বংস করছে, তাতে ইনশিওরেন্স কোম্পানি দুনিয়ায় না থাকলে জরিমানা দিতে গিয়ে ক’দিনে ফতুর হয়ে যেত ও।
একটু আগে যে মেয়েটাকে দেখেছে, হঠাৎ অক্ষত দুটো গাড়ির মাঝের জায়গা থেকে বেরিয়ে এল সে। রানার কাছ থেকে মাত্র তিন গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কালিঝুলি। দু’চোখ বেয়ে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। মেঝেতে কাটা পড়া লাশ দেখে ভয় পেয়ে হাত দিয়ে চেপে ধরল মুখটা। ঘুরে দৌড়ে চলে গেল ছোট এক সুবারুর কাছে। বসে পড়েছে মৃত এক লোকের পাশে। ফুঁপিয়ে উঠে নিচু গলায় বলল, ‘দুঃখিত। জানতাম না যে আপনি আসলে একজন ভাল মানুষ ছিলেন।’
মেয়েটার পাশে গিয়ে থামল রানা। নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘ইনি কে ছিলেন?’
উঠে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল জ্যাকি। ‘আপনি এটা কী বলছেন! আমি তো ভেবেছি আপনি তাঁর দলের!’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা।
‘তা… তা হলে… আপনি স্পেশাল এজেন্ট ববি হুক নন?’
‘না,’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা।’
‘কথা শুনে ব্রিটিশ মনে হচ্ছে। কিন্তু গায়ের রঙ…’
‘আমি বাংলাদেশি, এদিকের মানুষ নই,’ বলল রানা। ‘এবার এখান থেকে চলে যেতে হবে। একটু পর পৌঁছে যাবে পুলিশের লোক। অন্য কোথাও গিয়ে আলাপ সেরে নেক আমরা। আমার সঙ্গে আসুন।’
কয়েক সেকেণ্ড ওর চোখে চেয়ে রইল জ্যাকি। যেন বুঝে নিতে চাইছে মানুষটাকে বিশ্বাস করা যাবে কি না। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। একমিনিট অপেক্ষা করুন। কয়েক গজ ছুটে গিয়ে মেঝে থেকে একটা পিস্তল নিয়ে আবার ফিরে এল সে।
‘চাইলে আরও অস্ত্র নিতে পারেন,’ আশপাশে কয়েকটা আগ্নেয়াস্ত্র দেখাল রানা।
‘আমার কাছে এটার ঐতিহাসিক মূল্য আছে,’ কথাটা বলেই সরাসরি ওর বুকে সিগ সাওয়ার তাক করল জ্যাকি! ‘আশা করি সত্য বলেছেন, নাকি ধরে নিয়ে যাবেন আমাকে অ্যারন কনারের কাছে?’
‘বুকে হাত রেখে বলতে পারি, প্রাণ থাকতে আপনার কোন ক্ষতি করব না,’ গম্ভীর স্বরে বলল রানা।
আরেকবার ওকে দেখল জ্যাকি। তারপর কোমরে পিস্তল গুঁজে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। তবে মনে রাখবেন আমার কাছে অস্ত্র আছে। আজই দু’জন লোককে গুলি করেছি।’
‘কথা শুনে এবার সত্যিই ভয় পেলাম,’ মৃদু হাসল রানা।
‘আমার গাড়িটা বেশ পুরনো ছিল,’ বলল জ্যাকি। ‘এছাড়া ছিল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডের লিংকন। দুটোতেই কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
‘আগুন ধরিয়ে দেয়ার দায় আসলে আমার,’ বলল রানা। একটু দূরে তর্জনী তাক করল জ্যাকি। ‘তো চলুন, আমরা এলিভেটরে চেপে শপিং মলে উঠি। ধাওয়া খাওয়ার আগে ওদিকেই যাচ্ছিলাম।
দ্রুত এগিয়ে আসছে পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের সাইরেন। জ্যাকিকে বলল রানা, ‘আপনি তো এদিকেরই মানুষ, তা-ই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তা হলে আপনিই বরং পথ দেখান,’ বলল রানা।
আটত্রিশ
লিফটে চেপে শপিং মলে উঠতে দু’মিনিট লাগল জ্যাকি আর রানার। এলিভেটরের ইস্পাতের দরজা খুলে যেতেই ওরা দেখতে পেল, গোলাগুলি ও ফায়ার অ্যালার্মের আওয়াজে ভীত সন্ত্রস্ত একদল বিশৃঙ্খল শপারকে। এরই ভেতরে পৌঁছে গেছে শতখানেক পুলিশ অফিসার। লাইন তৈরি করে শপিং মল থেকে সবাইকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। নিচের পার্কিং লটের প্রবেশপথ দিয়ে বেরিয়ে ঝিরঝিরে হাওয়ায় সন্ধ্যার আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে ঘন কালো ধোঁয়া। হাজির হচ্ছে একের পর এক ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। শপিং মলের ওপরে ভাসছে হেলিকপ্টার। ওটার বিকট আওয়াজের সঙ্গে তাল রাখছে অনেকগুলো সাইরেন। এ ছাড়া মহিলা ও বাচ্চাদের সম্মিলিত হৈ-চৈ আর পুরুষদের হাঁকডাক তো আছেই।
ওপর থেকে রাস্তায় চোখ বোলাল রানা। ওদিকে কোন ধূসর ভ্যান নেই। পুলিশের লোক পৌঁছে যাওয়ার আগেই পালিয়ে গেছে দুই খুনি।
‘আপনার নাম যেন কী?’ জ্যাকির কাছে জানতে চাইল রানা।
‘জ্যাকুলিন সিলভেস্টার, ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল জ্যাকি, কাঁধে ডার্ট বিধে যাওয়ার জায়গাটা টিশটিশ করে ব্যথা করছে ওর। ‘এবার বলুন, আপনি আসলে কে।’
‘আগে, চলুন, এক কাপ কফি নেয়া যাক,’ বলল রানা।
শপিং মল থেকে বেরিয়ে সিকি মাইল দূরে বড় এক কফি শপে ঢুকল ওরা। বিশাল টিভিতে নিউয় কাস্টার গম্ভীর চেহারায় ভারী গলায় বলে চলে শপিং মলে হামলা করেছিল একদল সন্ত্রাসী।
টিভি দেখার জন্যে কফি শপে জড় হয়েছে অনেকে। রানাদের টেবিলের পাশের টেবিল থেকে একজন বলে উঠল, ‘আমার পরিচিত একজন নিজের চোখে সব দেখেছে! সে বলল, হঠাৎ কোথা থেকে এসে গুলি শুরু করেছে একদল মুসলিম জঙ্গি!’
‘দৈত্যের মত বিশাল নিগ্রোগুলোকে দিয়ে শালাদের পোঁদ মারিয়ে নেয়া উচিত!’ বলল উত্তেজিত এক কাস্টমার
‘আরে, থামুন তো!’ ধমক দিল আরেকজন। ‘আপনার চিৎকারে নিউয় কাস্টারের কথাই তো শুনতে পাচ্ছি না!’
সবার চোখ আবারও চলে গেল টিভির পর্দার ওপরে। দুই কাপ কফি কিনে জানালার ধারে ওদের টেবিলে ফিরে এল রানা। চারপাশে চেয়ে নিয়ে বুঝল, কারও খেয়াল নেই ওদের দিকে। দূর থেকে এল হেলিকপ্টার ও সাইরেনের আওয়াজ। পাশের রাস্তা দিয়ে গেল পুলিশের গাড়ি। উদ্বিগ্ন পথযাত্রীরা থমকে দাঁড়িয়ে পুলিশ অফিসারদেরকে দেখছে।
বড় করে এক চুমুক কফি নিয়ে বলল জ্যাকি, ‘তা হলে আপনার নাম মাসুদ রানা?’
‘হ্যাঁ। আপনার, সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, জ্যাকুলিন।’
‘আমাকে জ্যাকি বলে ডাকতে পারেন। আর আপনি আপনি করে কথা না বললেও চলবে। আমি বয়সে আপনার চেয়ে ছোটই হব।’
‘বেশ,’ বলল রান
‘আমার বোধহয় আপনাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। আপনি এসে আমার াণ বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
‘তুমিও আমাকে রানা বলে ডেকো। অত বুড়ো হইনি যে আমাকে আপনি করে বলতে হবে,’ বলল রানা। ‘একটু আগেও আমার দিকে পিস্তল তাক করেছিলে। সত্যি সত্যি যে গুলি করে দাওনি, সেজন্যে তোমাকেও ধন্যবাদ।’
‘কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, তুমি আসলে কে? হঠাৎ করে কোথা থেকে এসে উদয় হলে?’
সে লম্বা এক কাহিনী। পরে হয়তো বলব। এখন বলো, লোকগুলো তোমার কাছে কী চাইছিল?’
হঠাৎ ছলছলে হয়ে গেল জ্যাকির দু’চোখ। কাপতে শুরু করেছে কফির কাপ ধরা হাত। বিপদ কেটে যাওয়ায় ওর ভেতরে কাজ করছে শক। ‘ওরা আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে। কয়েক দিন ধরেই খুঁজছে। আসলে… সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার জীবনের। এবার আমাকে খুন করবে তারা। কেউ নেই যে আমাকে বাঁচাতে পারবে।’
‘এত হতাশ হতে নেই, জ্যাকি,’ বলল রানা। ‘খুলে বলবে কেন এরা তোমার পেছনে লেগেছে?’,
‘আমি এক লোকের নৃশংস হত্যার সাক্ষী,’ বলল জ্যাকি। নিজেকে সামলে নিল। ‘খুব খারাপ কাজ করেছিল তারা আর তাদের বস।’
‘তুমি বোধহয় বলছ অ্যারন কনারের ব্যাপারে?’
চোখ তুলে রানাকে দেখল জ্যাকি। তা হলে তো ভূমি সবই জানো। হঠাৎ করে এসবে জড়িয়ে যাওনি।’
‘আমি কনারের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছি।’ বলল রানা। ‘এটা জেনেছি যে, লোকটা দরকার হলে যে-কাউকে খুন করাতে গিয়ে দ্বিধা করে না।’
মাথা দোলাল জ্যাকি। ‘আমি নিজেও সেটা জানি।’
‘তোমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে কেন? তুমি কি মেয়রের অফিসে চাকরি করো?’
‘টুলসায় তার স্ত্রী লিণ্ডা কনারের একটা চ্যারিটি ফার্ম আছে। আমি সেখানে চাকরি করি। লিণ্ডা আমাকে জুনিয়র বান্ধবী বলেই মনে করেন। তাই বলেছিলেন, আমি চাইলে তাঁর কটেজে গিয়ে কয়েক দিন কাটিয়ে আসতে পারি গেলাম উলোগাহ্ লেকের তীরে সেই কটেজে। কিন্তু সে-রাতে অ্যারন কনার আর তার লোকেরা…’ চোখ সরু করে রানার দিকে তাকাল জ্যাকি। হঠাৎ করে একটা চিন্তা এসেছে ওর মনে। ‘তুমি কি হিউবার্ট হ্যারন্ডের খুনের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছ? তার হয়ে প্রতিশোধ নেবে?’
‘আগে কখনও এই নামের কারও কথা শুনিনি,’ জবাবে বলল রানা। ওর চোখে চেয়ে জ্যাকি বুঝে গেল, মিথ্যা বলছে না মানুষটা। ‘লোকটা আসলে কে?’
‘খুন করেছে তাকে। সে-রাতে তাকেই খুন হতে দেখেছি আমি। এফবিআই-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। চেয়েছিল অ্যারন কনারকে ধরিয়ে দিতে।’
‘হিউবার্ট হ্যারল্ডের জন্যে টুলসায় আমি আসিনি,’ বলল রানা। এসেছি বেলা ওয়েস নামের এক মেয়ের জন্যে। ওকে খুন করিয়েছে অ্যারন কনার।’
‘তুমি কি তা হলে পুলিশ অফিসার? নাকি ডিটেকটিভ?’
‘আমি সাধারণ মানুষ,’ বলল রানা। ‘মেয়েটাকে যখন খুন করা হয়, তখন ওখানে ছিলাম। আহত হয়েছিলাম বলে তাকে বাঁচাতে পারিনি। খুব কষ্ট পেয়ে মারা যায় বেচারি। পরে আমার মনে হয়েছে, খুনিদেরকে শাস্তি দেয়ার কাজটা নিজের কাঁধে তুলে নেয়া উচিত। এরা যা করেছে, সেজন্যে আমার কাছে জবাব দিতে হবে অ্যারন কনারের।’
‘বেলা ওয়েস কি…’
মাথা নাড়ল রানা। ‘কোন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না। সদ্য পরিচিতা নতুন এক বান্ধবী।’
‘ওকে মরে যেতে হলো বলে আমার খারাপ লাগছে।’
‘আমারও খুব খারাপ লেগেছে।’
‘মেয়েটাকে তারা খুন করল কেন?’
‘শুধু এটা জানি, কোন কারণে অ্যারন কনারের জন্যে হুমকি হয়ে উঠেছিল বেলা। আমি এ-ব্যাপারে আরও খোঁজ নিচ্ছি। মনে হচ্ছে, তুমিও হয়তো নতুন কিছু জানাতে পারবে। সেক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারব আমরা। তোমার সঙ্গে যে-লোক ছিল, যাকে খুন করেছে এরা, সে আসলে কে?’
মুখ খোলার আগে দ্বিধা করল জ্যাকি, তারপর নিচু গলায় বলল, ‘তার নাম জিম লিয়োনার্ড। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এক ডিটেকটিভ। গোপনে কাজ করছিল এফবিআই-এর হয়ে। তারা তদন্ত করছিল, কারণ ধারণা করা হচ্ছে অ্যারন কনার…’ চুপ হয়ে সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাল জ্যাকি।
‘আমাদের দিকে কারও মনোযোগ নেই,’ বলল রানা। ‘এফবিআই অ্যারন কনারের ব্যাপারে কী ধরনের তদন্ত করছে?’
সামনে ঝুঁকে নিচু গলায় বলল জ্যাকি, ‘লিয়োনার্ড বলেছেন, মেক্সিকোর ড্রাগস কার্টেলের কাছে হাজার হাজার অস্ত্র বিক্রি করছে অ্যারন কনার। ভয়ঙ্কর সেই দলের নাম হার্ডি লোকো।’
‘খুলে বলো, আমি শুনছি,’ বলল রানা।
‘মিলিটারি থেকে চুরি করা অস্ত্র তাদের কাছে বিক্রি করে কনার। মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের। এবারের নির্বাচনে যদি গভর্নর হয়ে ওঠে, তো আরও বড় পরিসরে শুরু করবে অস্ত্র ব্যবসা।’
আমেরিকার সরকারের যত বড় পদে বসবে অ্যারন কনার, তত বেশি বেআইনি অস্ত্র মেক্সিকোতে পাচার করবে, বুঝে গেল রানা। আর সেসব অস্ত্রের কারণে সাধারণ মানুষ মারা পড়লেই বা তার কী?
‘অ্যারন আগে ছিল উকিল,’ বলল রানা। ‘কোনভাবেই মিলিটারির সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকার কথা নয়। তা হলে এত অস্ত্র কোথা থেকে পাচ্ছে সে?’
‘এফবিআই-এর ধারণা: অস্ত্র জোগাড় করে প্রাক্তন মেজর লিয়াম বার্ব আর তার সহকারী প্রাক্তন মেজর টনি স্ক্যালেস। মিলিটারির চাকরি ছেড়ে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অ্যারন কনারের ভাড়াটে খুনি হিসেবে কাজ করে তারা।’
নিষ্পলক চোখে ওকে দেখল রানা। ‘তাদের নাম তা হলে লিয়াম বার্ব আর টনি স্ক্যালেস?’
‘স্ক্যালেসের মাথায় আছে পনিটেইল। সর্বক্ষণ চুয়িংগাম চিবোয় লোকটা। অন্যজন বার্ব। অ্যারন কনারের ডানহাত। এরা দু’জনই আগে ছিল স্পেশাল ফোর্সের অফিসার।’
কিছুক্ষণ পর বলল রানা, ‘আমিও তা-ই ভেবেছি।’
‘তাদের অস্ত্র ব্যবহার করা দেখে?’
‘না, যতবার আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, প্রত্যেকবার
তাদের কাছে ছিল আধুনিক অস্ত্র।’
‘আগেও তোমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে?’
‘প্রথমবার তাদের হাতে ছিল স্টিলের ব্যাটন ও ছোরা। পরের বার সাবমেশিন পিস্তল। অভাব ছিল না গুলির। আর আজকে ব্যবহার করেছে মিলিটারির অত্যাধুনিক অস্ত্র ক্রিস ভেক্টর। এ-জিনিস চাইলেও সংগ্রহ করতে পারবে না সাধারণ ‘পাবলিক।’
‘লিয়োনার্ড বলেছিলেন মিলিটারির ভেতরে হাত আছে লিয়াম বার্বের,’ বলল জ্যাকি। ‘শুনেছি টুলসা কাউন্টিতে বড় এক ওয়্যারহাউসে হাজার হাজার অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে অ্যারন কনার। তার দলের একদল লুঠেরা ট্রাকে তুলে নিয়ে ওসব টেক্সাস পার করে পৌঁছে দিচ্ছে সীমান্তে। লাখ লাখ ডলার পেয়ে নরকের নরপিশাচ অ্যারন কনার হাসতে হাসতে মিলিটারি থেকে চুরি করা সব অস্ত্র তুলে দিচ্ছে হার্ডি লোকোর হাতে। ড্রাগ্স্ কার্টেল অস্ত্র কিনছে নিজেদের এলাকা আরও বড় করার জন্যে। …আমার কথা থেকে কিছু বুঝলে?’
‘ক্রিস ভেক্টর ৪৫ ক্যালিবারের সাবমেশিন গান। টমি গানের নতুন সংস্করণ। পলিমার দিয়ে তৈরি। খুব আধুনিক ডিলেইড রিকয়েল সিস্টেম। সাইক্লিক রেট প্রতি মিনিটে এক হাজার বুলেটের বেশি। আগে নিজের চোখে দেখিনি। ক্রিস ভেক্টরের বেশ কয়েক ক্রেট হাতে পেলে তার বদলে কোটি ডলার দিতেও হয়তো দ্বিধা করবে না ড্রাগ্স্ কার্টেল।’
‘অস্ত্রের ব্যাপারে তুমি এত কিছু জানলে কীভাবে?’ রানার চোখে তাকাল জ্যাকি।
‘কারণ, আমি নিজেও সৈনিক ছিলাম,’ বলল রানা।
‘তুমি যা-ই হও, ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে ‘না’ বলল জ্যাকি। ‘বার্ব আর স্ক্যাসে তো একা নয়, তাদের নির্দেশে কাজ করে একদল হারামজাদা লুঠেরা। ছোটখাটো একটা আর্মি তৈরি করে নিয়েছে তারা।’
‘তবুও একবার চেষ্টা করব এদেরকে ঠেকাতে, তিক্ত হাসন রানা।
‘ওদের সঙ্গে লাগতে গেলে স্রেফ খুন হয়ে যাবে, মাথা নাড়ল জ্যাকি। ‘কর্তৃপক্ষের কাছে মুখ খুলেছিল বলে খুন হয়ে গেছে হিউবার্ট হ্যারল্ড। তোমার বান্ধবী বেলা ওয়েস বোধহয় গোপন কিছু জেনে গিয়েছিল, তাই তাকেও সরিয়ে দিয়েছে দুনিয়া থেকে। বুঝলে, আমাদেরকে আসলে বাঁচতে দেবে না এরা।’
চুপ করে ভাবছে রানা, আজ কী জেনেছে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি থেকে। অ্যারন কনারের ব্যক্তিগত ফোন নম্বর গ্রেগ কার্সটির কাছ থেকে নিয়েছিল বেলা। রানার মনে পড়ল, বেলা বলেছিল প্ল্যান সফল হলে বাকি জীবনে আর কোন কাজ করতে হবে না ওকে। ‘আমার ধারণা, টাকা আদায় করতে অ্যারন কনারের ওপরে চাপ তৈরি করেছিল বেলা,’ বলল ও। ‘মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।’
‘তার ফল কী ধরনের হয়েছে, সেটা তো বুঝলেই,’ বলল জ্যাকি।
‘বেলা অস্ত্র চোরাচালানের ব্যাপারে কিছু জানত না,’ বলল রানা। ‘অন্য কোন কারণে ব্ল্যাকমেইল করছিল।’
‘বিপদের তো শেষ নেই,’ বলল জ্যাকি। ‘জেনে রাখো, মেয়র অ্যারন কনারের পকেটে আছে টুলসার পুলিশ চিফ রিপার রিগবি।’
‘স্বাভাবিক,’ বিস্মিত হয়নি রানা।
‘এফবিআই-এর হয়ে তার ওপরে চোখ রেখেছিলেন ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, কোনভাবেই আমরা পুলিশের সাহায্য পাব না।’
‘আমি আসলে পুলিশের সাহায্য চাইছি না,’ বলল রানা।
‘কিন্তু কিছু না কিছু তো আমাদেরকে করতে হবে, তা-ই না?’
‘আমরা মানে?’ জ্যাকির চোখে তাকাল রানা।
‘আমার কাছে আছে শক্ত প্রমাণ,’ বলল জ্যাকি। ‘ওটার কারণে মৃত্যুদণ্ড হবে অ্যারন কনারের। সে-রাতে কটেজে যখন মানুষটাকে খুন করল, তখন ওপরতলা থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিয়ো করেছি আমি।’
‘ফোনটা এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।
‘দিয়ে দিতে হয়েছে পুলিশ চিফ রিগবির কাছে। ডিস্কে যে কপি করেছি, সেটাও। তখন তো জানতাম না যে লোকটা নিজেই পাকা অপরাধী। তাকে সবই খুলে বলেছিলাম। তাই অ্যারন কনার যে একজন খুনি, সেটা বলার পর থেকেই হয়ে গেলাম তাদের টার্গেট। কিন্তু তারা জানে না, আমার কাছে রয়ে গেছে ডিস্কের দ্বিতীয় কপি।’
‘ওটা এখন তোমার সঙ্গে আছে?’
‘আমাকে পাগল ভাবো? ডিস্ক এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি, যে ভাবতেও পারবে না কেউ।’
‘তা হলে এবার সেই ডিস্ক দিয়ে কী করবে বলে ভাবছ?’ বলল রানা।
‘সরাসরি যাব এফবিআই-এর কাছে। যা জানি সবই খুলে বলব তাদেরকে।’
‘আর তারপর?’ জানতে চাইল রানা।
ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল জ্যাকি। ‘তুমি কি ভাবছ সব জেনেও কিছুই করবে না ওরা?’
‘হয়তো করবে, আবার না-ও করতে পারে। তুমি হয়তো ভাবছ এফবিআই-এর লোক রাজপুত্রের মত সাদা ঘোড়ায় চেপে এসে গ্রেফতার করবে কনারকে। তাতে শেষ হবে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। বাকি জীবন পচে মরবে জেলে। কিন্তু একবার এটা ভেবেছ, এফবিআই অন্যকিছু করতে পারে হয়তো সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করবে তারা। নইলে জিম লিয়োনার্ড খুনের প্রমাণের ব্যাপারে সব জানিয়ে দেয়ার পরেও তারা গা নাড়াচ্ছে না কেন?’
‘এই শহরে আর বাস করতে পারব না,’ বলল জ্যাকি। ‘চাকরি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এদিকে বাঁচতে হলে অন্য কোন শহরে গিয়ে নতুন একটা পরিচয় চাই আমার। সেটা হয়তো তৈরি করে দেবে এফবিআই। চিরকালের জনে উধাও হবে জ্যাকুলিন সিলভেস্টার। বদলে উদয় হবে নতুন এক মেয়ে। এমন একজন, যে নিরাপদে পার করবে নিজের জীবন।’
‘শুনেছি সাক্ষীকে সবসময় রক্ষা করতে পারে না এফবিআই। আর সেক্ষেত্রে হঠাৎ করে দুনিয়া থেকে উধাও হয় সেই সাক্ষী। সরকারি এজেন্টরাও তো মানুষ, তাই তাদেরও কাজে ভুল হয়। নিজেই তো বুঝতে পারছ, তোমাকে কোন ধরনের নিরাপত্তা দিচ্ছে না এ-দেশের সরকার। হয়তো তাদের ভালর জন্যে ঘাড় পেতে দিলে, কিন্তু ঘাড়ে কোপ যখন আসবে, ঠেকাবে না কেউ। তোমার কি মনে হয় যে, এফবিআই বিশেষ কোন ব্যবস্থা নিয়েছে তোমার জন্যে?’
‘তুমি নিজেই বলেছ অ্যারন কনার থাকবে জেলে। ওখান থেকে তো আর আমার ক্ষতি করতে পারবে না।’
মাথা নাড়ল রানা। ‘গভীরভাবে ভাবো, জ্যাকি। অ্যারন কনার ধনী লোক। আর টাকা-পয়সা যার আছে, সে সেটা খরচ করে যে-কোন জায়গায় তোমাকে খতম করে দিতে পারবে। জেলের বড়কর্তাদের সঙ্গে ডিনারে বসে শ্যাম্পেন আর লবস্টার খেতে খেতে বিরোধী দলের লোকদেরকে খুন করার নির্দেশ দেয় মাফিয়া ডনেরা। এটা তো তোমার জানা থাকার কথা।’
‘তুমি যা বলছ, সেটা অতি নাটকীয় বলে মনে হচ্ছে না?’
‘অবশ্যই অতি নাটকীয়। তবে ওটাই বাস্তব।’
‘তুমি তা হলে আমাকে কী করতে বলো? যদি অনেক দূরে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়ি?’,
‘এফবিআই নতুন পরিচয় তৈরি করে দিলেও বেশি দিন রেহাই পাবে না। যদি সব ঠিকঠাকভাবে চলে, আর অ্যারন কনার এবং তার লোকেরা বুড়ো হয়ে জেল থেকে বেরোয়, তবুও তোমাকে খুঁজে নেবে তারা। আসলে চিরকালের জন্যে উধাও হতে পারে না কেউ। এটা সম্ভব নয়।’
‘তুমি খুব জোর দিয়ে কথাগুলো বললে-কিন্তু সেটা কেন?’
‘কারণ আমি জানি। আগে যে পেশায় ছিলাম, আমাকে অনেক সময়ে লুকিয়ে থাকা মানুষকে খুঁজে নিতে হতো। আগে আর পরে, ধরা তারা পড়তই।’
‘অর্থাৎ তুমি নিজে আগে খুঁজে নিতে মানুষগুলোকে?’
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘কেউ যদি শ্বাস ফেলে, আজ হোক বা কাল তাকে খুঁজে নেয়া যায়। এখন বড় কথা হচ্ছে, তার পক্ষের লোক তাকে খুঁজে নেবে, না বিপক্ষের লোক। আমার মত কেউ হলে প্রাণে মরবে না তুমি। ওদিকে কনারের দলের কেউ তোমাকে পেয়ে গেলে ধরে নাও তুমি আর দুনিয়ায় নেই।’
‘কী মিষ্টি করেই না কথা বলো তুমি!’ তিক্ত স্বরে বলল জ্যাকি। ‘তা হলে? এখন কী করব? এফবিআই যদি আমাকে নিরাপত্তা না দেয়, ধরে নিলাম সেটা তারা দেবে না, তা হলে কাকে বিশ্বাস করে তার হাতে নিজেকে তুলে দেব? এর মানেই তো হচ্ছে, সত্যি সত্যিই খুন হয়ে গেছি আমি!’
‘মোটামুটি তা-ই,’ বলল রানা।
‘এত ভাল কথা আগে শুনিনি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যাকি। ‘আমার দিনটা একেবারে রঙিন করে দিলে, রানা! ধন্যবাদ তোমাকে।’
তোমার খারাপ কিছু হোক, তা চাই না,’ বলল রানা। ‘তবে সত্যি কথা হচ্ছে, আরামদায়ক মিনিমাম সিকিউরিটি জেলে সাধারণ মানুষের চেয়ে ঢের বিলাসে থেকেও সুখী হবে না অ্যারন কনার। আমাদের চেয়ে বেশি নিরাপদে থাকলেও অন্তর জ্বলবে তার। আর যেহেতু তার টাকা আছে, কাজেই বেশিদিন তাকে জেলেও থাকতে হবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’
‘তা হলে আমি আসলে কী করব?’ অসহায় চোখে ওকে দেখল জ্যাকি। ‘আমার তো দেখি বাঁচারই কোন উপায় নেই!
‘কফি শেষ করো।’
‘একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’
নিজের কফি দু’চুমুকে শেষ করল রানা। ‘ঠিক আছে, এবার চলো।’
‘কোথায় যাব?’
‘সবচেয়ে কাছের সেকেণ্ড হ্যাণ্ড গাড়ি বিক্রির দোকানে। যাতায়াতের ব্যবস্থা না হলে কোন কাজই করতে পারব না। গাড়ি কেনার পর তোমাকে নিরাপদ কোথাও রেখে সেরে নেব কিছু কাজ। পরে দু’জন মিলে বসে ভাবব, কী করা যায়।’
‘কোন হোটেল বা মোটেলে উঠবে বলে ভাবছ?’
‘আমার মোটেলটা মন্দ নয়।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল জ্যাকি। ‘ও।’
‘তোমার খারাপ লাগবে না। খুবই স্টাইলিশ। সুযোগ- সুবিধা দেখার মত।’
ডান ভুরু কপালে তুলল জ্যাকি।
ওকে চোখ টিপল রানা। ‘একই রুমে থাকতে হবে। তবে বিশ্বাস করতে পারো আমাকে। রাত-বিরেতে হঠাৎ করে চড়াও হব না।’
‘আর দিনের বেলায়? তখন যদি চড়াও হও?’
‘তুমি দেখছি আমার বুকের পাঁজর ভেঙে চুরচুর করে দিচ্ছ,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘আমি অত খারাপ ছেলেই নই!’
‘আমার তো আসলে কোন উপায়ই নেই তোমার সঙ্গে না গিয়ে, মন খারাপ করে বলল জ্যাকি। ‘তুমি ভাল না খারাপ সেটা যাচাইয়ের সুযোগ কোথায় আমার?’
‘তুমি বাঁচতে না চাইলে না-গিয়ে রয়ে যেতে পারো।’ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জ্যাকি বলল, ‘ঠিক আছে। তবে মনে রেখো, রুমের বিছানা আমার। সোফায় ঘুমাবে তুমি। আর তোমাকে. কোন গাড়ি কিনতে হবে না। আমার আরেকটা গাড়ি আছে। ওটা ব্যবহার করতে পারব আমরা।’
ঊনচল্লিশ
সন্ধ্যার কালচে আকাশে একটা-দুটো করে ফুটছে নক্ষত্র। দূর থেকে এল ঝিঁঝি পোকার ডাক। একসারি গ্যারাজের কাছে পৌঁছে আঙুল তুলে রানাকে একটা শাটার দেখাল জ্যাকি। শাটারের ওপরে ঝাপসা হয়ে গেছে বাজে ছেলেদের আঁকা নোংরা ছবি। বিশাল উঠনে নানাদিকে ঝোপঝাড়। দেখলে যে-কেউ বুঝবে, পরিত্যক্ত হয়ে গেছে জায়গাটা। পার্স থেকে চাবি নিয়ে ঝুঁকে শাটারের ভারী তালা খুলল জ্যাকি। রানাকে বলল, ‘শাটার তুলতে হাত লাগাও। কল-কব্জায় জং ধরে গেছে।’
‘ভেতরের গাড়িটা আবার জংধরা নয়তো?’ বলল রানা।
‘নিজেই দেখবে।’
শাটার ওপরে তুলতেই বিশ্রী কর্কশ ধাতব আওয়াজ শুনল রানা। চট্ করে গ্যারাজে ঢুকল জ্যাকি। ওর পিছু নিয়ে সামনে ঘন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখল না রানা। গ্যারাজের ভেতরে গাড়ি পালিশের মোম, পুরনো মবিল ও লোহার জোরাল গন্ধ।
‘বাতি জ্বেলে নেব,’ বলল জ্যাকি, ‘আগে শাটার নামাও।’
আরেকবার কর্কশ আওয়াজে নেমে এল শাটার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে রানা ও জ্যাকি। অবশ্য তিন সেকেণ্ড পর ক’বার টিপটিপ করে ছাতে জ্বলে উঠল সাদা ফ্লুরোসেন্ট টিউব লাইট। উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ দেখল রানা। বাইরে থেকে যেমন মনে হয়, গ্যারাজ তার চেয়ে বড়। একদিকের দেয়ালে জড় করা হয়েছে বাতিল মালে ভরা বাক্স। এ-ছাড়া আছে কাঠের ওঅর্কবেঞ্চের ওপরে নানান যন্ত্রপাতি। পাশেই তারপুলিনের ক্যানভাসের নিচে লম্বাটে এক বড় গাড়ি। তারপুলিন টেনে সরিয়ে দিল জ্যাকি।
ছোটবেলা থেকেই সত্যিকারের ভাল গাড়ির পাকা সমঝদার রানা। জ্যাকি তারপুলিন সরিয়ে নেয়ায় নিচু সুরে শিস না বাজিয়ে পারল না ও। উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছে কালো রঙের গাড়িটার প্রতিটি নিখুঁত ভাঁজ। চাকার হুইল ক্রোম প্লেটেড। বহু বছর আগে আমেরিকার ভাল কোম্পানিগুলো তৈরি করত এ-ধরনের শক্তিশালী গাড়ি।
‘উনিশ শ’ একাত্তরের প্লিমাউথ ব্যারাকুডা,’ ভালবাসা নিয়ে মস্ত গাড়িটার দিকে তাকাল জ্যাকি। ‘এটা ছিল আমার বাবার গর্ব আর আনন্দের বড় উৎস। নিজেই কম দামে নানান যন্ত্রপাতি একে একে কিনে তৈরি করেছিল।
‘তোমার বাবা তোমাকে দানবটাকে চালাতে দেন?’
‘বাবা আর নেই,’ বলল জ্যাকি, ‘ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে সামান্য পেনশন পেত। তবে মারা যাওয়ার আগে গাড়িটা দিয়ে গেছে আমাকে। এই গাড়ি আর আমি ছাড়া আর কোনকিছুই ছিল না মানুষটার।’ পার্স খুলে গাড়ির দুটো চাবি নিল ও। ‘বাবা চলে গেলে এরপর আর প্রায় ব্যবহার করা হয়নি। নিজে চালিয়েছি বড়জোর দু’চারবার। অবশ্য বাবার স্মৃতি হিসেবে যত্ন করেই রেখেছি।’ রানার চোখে বিস্ময় দেখে মৃদু হাসল জ্যাকি। ‘পিচ্চি মেয়েরা জানবে না এমন বহুকিছুই আমাকে শেখাত বাবা। যেমন ধরো: কীভাবে নামানো যায় হেমি ভি-৮ ইঞ্জিন। অথবা কীভাবে চালাতে হয় পিস্তল। রাইফেল পেলে জঙ্গলে গিয়ে হোয়াইট- টেল হরিণ শিকার করে চামড়া ছিলে মাংস কেটে কাবাব তৈরি করতেও জানি। তোমাকে কথা দেব, খুব খারাপ হবে না রান্না।’
পকেট থেকে সিগ সাওয়ার নাইন এমএম পিস্তল বের করে রানাকে দেখাল জ্যাকি। ‘মারা যাওয়ার দু’দিন আগে এটা আমাকে দেয় বাবা।’
‘এবার বুঝলাম, কেন অস্ত্রটা ফেলে আসতে চাওনি,’ বলল রানা।
‘সামনে খুব খারাপ সময় আসছে, মা, ‘ বাবা বলেছিল। ‘আমি চাই আমার মৃত্যুর পর আমার পিচ্চি মেয়েটা যেন দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করার জন্যে তৈরি থাকে।’’
‘ভাল একজন বাবা পেয়েছিলে,’ বলল রানা।
‘অবশ্যই,’ বলল জ্যাকি। ‘তবে এটা জানি না যে শেষমেশ হিউবার্ট হ্যারল্ডের মত গুলি খেয়ে মরব কি না।’ প্লিমাউথের পেছনে গেল মেয়েটা। ট্রাঙ্ক আনলক করে ডালা খুলে ভেতরে কী যেন খুঁজল। পাঁচ সেকেণ্ড পর সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন ওর হাতে নীল বড় এনভেলপ। ওটার ভেতর থেকে জ্যাকি নিল পলিথিনের একটা ব্যাগ। সেটা থেকে বের করল একটা কমপ্যাক্ট ডিস্ক। ‘এখানে আসার আরেকটা কারণ হচ্ছে, এখানেই এটা রেখেছিলাম,’ বলল জ্যাকি।
‘ভিডিয়োর কপি ওটা?’
‘তোমার মোটেল রুমে ডিভিডি প্লেয়ার আছে?’
‘দৃশ্যগুলো না দেখলেও আমার চলবে,’ বলল গম্ভীর রানা। ‘আমাকে কিছু বিশ্বাস করাতে হবে না তোমার। আমি এরই ভেতরে জেনে গেছি অ্যারন কনারের লোক কী ধরনের পশু।’
‘এরপর কী করবে বলে ভাবছ?’ জানতে চাইল জ্যাকি।
‘আগেও এই একই প্রশ্ন করেছ,’ বলল রানা।
‘হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কোন জবাব দাওনি। তুমি আসলে কী করতে চাও? সোজা হাজির হবে কনারের বাড়ি বা অফিসে? সিনেমার নায়কের মত হুট করে গুলি করে খুন করবে লোকটাকে?
‘এমন কিছু করব, যাতে জিম লিয়োনার্ডের মত করে মরতে না হয় তোমার।’
‘কী করতে চাও বার্ব আর স্ক্যালেসের ব্যাপারে? অ্যারনকে হাতের মুঠোয় পেতে হলে আগে শেষ করতে হবে তাদেরকে।’
জবাবে কিছু বলল না রানা। প্লিমাউথের দিক থেকে ফিরে দেখে নিল কাঠের ওঅর্কবেঞ্চ। রুক্ষ ও দাগে ভরা ওটার পাটাতন। বেঞ্চের একদিকে স্টিলের ভাইসের ওপরে জি- ক্যাম্প। যন্ত্রপাতি ঘাঁটতে লাগল রানা। একমিনিটের ভেতরে বেছে নিল হেভি ডিউটি হ্যাকসও আর ইস্পাতের এক বাঁদা। ‘জিনিসটা ধার চাইলে দেবে? সঙ্গে ভাইসটা?’
‘নাও,’ বলল জ্যাকি। এত অবাক হয়েছে যে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে, কী কারণে যন্ত্রপাতি নিচ্ছে রানা।
‘তুমি গাড়িটা চালাবে, না আমি?’ জানতে চাইল রানা।
‘আমি। তুমি পথ দেখাবে। তোমার মোটেলে তো যাচ্ছি আমরা, তা-ই না?’
‘এখন নয়,’ বলল রানা। ‘আগে শপিঙে যাব।’
.
অন্ধকারে প্যাডি ফ্ল্যানাগানের বাড়ির উঠনে যখন হাজির হলো রানা ও জ্যাকি, ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে জেনারেল স্টোর। অবশ্য প্লিমাউথ থেকে নেমে কাঠের বাড়ির নিচে থেমে দোতলার এক জানালায় বৈদ্যুতিক আলো দেখতে পেল রানা। বাড়ির পেছনে মচমচ আওয়াজ তোলা একটা বারান্দার ওদিকে কাঠের সরু দরজা। দেয়ালের এক ব্র্যাকেটে ঘণ্টি পেয়ে টিং-টিং শব্দে বাজাল রানা।
‘এই লোক কি তোমার বন্ধু নাকি?’ অন্ধকারে ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল জ্যাকি।
‘প্রায় তা-ই বলা চলে,’ বলল রানা। আবারও বাজাল ঘণ্টি। বাড়ির ভেতরে তারস্বরে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল বড় এক কুকুর। মিনিট তিনেক পর দরজার ওদিকে এসে থামল কেউ। ন্যাড়া মেঝেতে খড়খড় আওয়াজ তুলছে কুকুরের নখ। বারান্দার সিলিঙে জ্বলে উঠল বাতি। ভারী গলায় কেউ ধমক দিল, ‘চুপ কর, জো!’ আর কোন আওয়াজ নেই। নড়াচড়া বন্ধ করে মেঝেতে বোধহয় বসে পড়েছে কুকুরটা। এবার দরজায় ড্রিল করা ছোট এক ফুটো দিয়ে কে যেন তাকাল। চোখ পিটপিট করে রানাকে দেখছে লোকটা। তারপর খড়মড় শব্দে ছিটকিনি নামানো হলো। খুলে গেল সরু দরজা।
‘বিষয়টা কী, রানা? এত জলদি আবার ফিরে এলে?’ গাল কোঁচকানো হাসি দিল দোকানদার প্যাডি ফ্ল্যানাগান। তার পায়ে স্যাণ্ডেল বা জুতো নেই। পরনে ডুঙ্গারি। ধুলোভরা হলওয়ে থেকে এল সস্তা উইস্কির বিটকেলে দুর্গন্ধ। মালিকের পাশেই আছে বিশাল এক ডোবারম্যান কুকুর। আধহাত জিভ বের করে দেখছে রানা আর জ্যাকিকে। চোখে গভীর সন্দেহ। ‘আরও কিছু জিনিস কিনব, তাই দেরি না করে চলে এলাম,’ বলল রানা। ‘আপনি তো বলেছিলেন হাঁক দিলেই আপনাকে যে-কোন সময়ে পাব।’
‘আমি মিথ্যা বলি না, রানা,’ বলল ফ্ল্যানাগান। ‘দোকান কখনও বন্ধ করি না। ভেতরে এসো। দেখা যাক প্যাডি ফ্ল্যানাগানের দোকান তোমার চাহিদা মেটাতে পারে কি না।’
‘মনে হচ্ছে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি,’ হাতের ইশারায় জ্যাকিকে পথ দেখাল রানা। দোকানদারকে বলল, ‘ভাল মোটেলের কথা বলেছিলেন। সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ।’
‘শুভ সন্ধ্যা, মিস,’ বলল প্যাডি ফ্ল্যানাগান।
‘জ্যাকি, ইনি প্যাডি,’ দু’জনের পরিচয় করিয়ে দিল রানা।
‘আর এটা আমার দোস্ত জো,’ কুচকুচে কালো কুকুরটাকে দেখাল বৃদ্ধ।
‘তুই ছোটখাটো বাঘ, তা-ই না?’ ডোবারম্যানের মাথায় হালকা চাপড় দিল জ্যাকি। ওকে পছন্দ করে ফেলেছে দানবটা। বিরাট জিভ বের করে হাত চেটে দিল।
‘যাদেরকে কাস্টমার হিসেবে রাতে চাই না, তাদেরকে এদিকে ভিড়তে দেয় না জো,’ বলল দোকানদার। জ্যাকি ও রানা বাড়িতে ঢুকে পড়তেই দরজা আটকে ছিটকিনি মেরে দিল সে। তার পিছু নিয়ে ধুলোভরা করিডর ধরে এগোল ওরা। আরেক দরজা পেরোতেই সামনে পড়ল দোকানের পেছনদিক। জ্যাকির পাশে গর্বিত ভঙ্গিতে হাঁটছে জো।
‘তো এবার বলো, রানা, তোমার জন্যে কী করতে পারি?’ মৃদু হাসল বৃদ্ধ। ‘জরুরি কিছু লাগবে? বিয়ার? বাড়তি আরও মালপত্র?’
‘ভাবছি ব্রাউনিং এ ফাইভ, মসতবার্গ ৫০০… এ ধরনের কিছু জিনিসের কথা,’ বলল রানা।
‘তুমি তা হলে জঙ্গলে যেতে চাও?’ বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই বলল বৃদ্ধ।
‘জী। কয়েক বাক্স গুলিও লাগবে। ডাবল যিরো বাক শট আর ব্রেনেক স্লাগ।’
‘একটু বড় ধরনের টার্কি শিকার করবে বলে মনে হচ্ছে, ‘ রানার চোখে তাকাল প্যাডি ফ্ল্যানাগান।
‘ক্রিসমাসের দেরি আছে, আপাতত টার্কিরা নিরাপদে থাকুক,’ বলল রানা।
‘তুমি বোধহয় তা হলে অনেক বেশি বিপজ্জনক কোন জন্তু শিকার করবে?’
‘বেশিরভাগ সময় তা-ই করি।’
‘ঠিক আছে, বুঝলাম। একটু অপেক্ষা করো।’ পাশের রুমে গিয়ে ঢুকল বৃদ্ধ ফ্ল্যানাগান। মিনিট দুয়েক পর বগলে গুঁজে নিয়ে এল লম্বা একটা বাক্স। ওটা কাউন্টারের ওপরে রেখে ডালা খুলল। ‘ইথাকা ৩৭ ফেদারলাইট,’ বাক্সের ভেতর থেকে বন্দুকটা বের করল সে। ‘পাম্প করলে পর পর গুলি করতে পারবে পাঁচবার। হালকা স্পর্শে কাজ করবে ট্রিগার। চোক বোর সিলিণ্ডার। জিনিসটা প্রায় হাওয়াইট্যার। তোমার কতগুলো শেল লাগবে, রানা?’
‘একাত্তর সালের ব্যারাকুডার ট্রাঙ্কে যতগুলো আঁটে,’ বলল রানা।
এককান থেকে আরেক কানে গেল ফ্ল্যানাগানের হাসি। ‘তা-ই, বাছা? তোমাকে না আগেই বলেছি, বুড়ো প্যাডির কাছে এমন কিছু নেই, যেটা তোমার চাহিদা মেটাতে পারবে না।’ পাশের ঘরে গেল বৃদ্ধ। একটু পর ভারী গুলির বাক্স হাতে প্রায় কুঁজো হয়ে ফিরে এল। ‘বেশিরভাগই ফেডারাল আর হর্নাডি। এসবের ভেতরে কিছু উইনচেস্টারও আছে।’ হাঁফাতে শুরু করে কাউন্টারের ওপর গুলির বাক্স রেখে আরও আনার জন্যে পাশের ঘরে গেল ফ্ল্যানাগান।
একটু পর ফিরে এসে কাউন্টারের ওপরে পাহাড়ের মত উঁচু বাক্সের স্তূপ তৈরি করল সে। রানা জানে, প্রতিটি গুলির ভেতরে আছে অন্তত এক আউন্স সলিড লোড। প্রতি সেকেণ্ডে ছিটকে যাবে বারো শ’ ফুট। রেঞ্জের ভেতরে মর্দা হাতি খতম করতেও সমস্যা হবে না। যদিও হাতি শিকার নিয়ে ভাবছে না রানা। ডাবল যিরো বাক কার্তুজ ছিটকে বেরোবে .৩৩ ইঞ্চি ডায়ামিটারের ব্যারেল থেকে। বলগুলোর আঘাতের শক্তি সাবমেশিন গানের তিনটে গুলির সমান। বন্দুকের আটটা বল একই সঙ্গে লাগলে কব্জা ভেঙে খসে পড়বে যে-কোন দরজা। একে একে বাক্স গুনল রানা। বাকশটের আছে সতেরো বাক্স, আর সলিড বুলেটের চোদ্দটা। প্রতিটায় আছে বিশটা করে রাউণ্ড। বন্দুকের ম্যাগাযিনে থাকবে চারটে আর চেম্বারে একটা। এক শ’ বিশবারের বেশি অস্ত্রটা রিলোড করতে পারবে রানা।
‘মনে হয় এতেই চলবে,’ বলল ও। ‘এবার ভরে নেয়ার জন্যে একটা ব্যাগ লাগবে।’
‘ব্যাগ বিনা পয়সায় দেব,’ বলে দোকানের আরেকদিকে গেল ফ্ল্যানাগান। একটু পর ফিরল কালো রঙের শক্তপোক্ত এক ক্যানভাস হোল্ডঅল হাতে। ভেতরে সোনার অসংখ্য বার রাখলেও ওজনটা নিতে পারবে এই ব্যাগ।
‘আরও একটা জিনিস চাই,’ বলল রানা। ‘ওটা হবে ভাল কোন ছোরা।’
‘ছোরা না থাকলে শিকার জমে, বলো?’ মাথা দোলাল ফ্ল্যানাগান। কাউন্টারের নিচে হাত ভরে বের করল খাপসহ দানবীয় এক সার্ভাইভাল নাইফ। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, এই জিনিস প্রতিদিন দশটা করে বিক্রি করে। বৃদ্ধের হাত থেকে নিয়ে খাপ খুলে ছোরা দেখল রানা। ওর বুঝতে দেরি হলো না, জিনিসটা কমদামি ইস্পাত দিয়ে তৈরি। মাত্র কয়েক পোঁচ দিলেই নষ্ট হবে ফলার ধার। তারচেয়েও বড় কথা: বেকায়দা চাপ পড়লেই মট্ করে ভাঙবে ওটা।
‘পছন্দ হলো না?’ রানার গম্ভীর চেহারা দেখল বৃদ্ধ। ‘বেশ, তা হলে একটু অপেক্ষা করো, অন্যকিছু নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম নিজের কাছেই রেখে দেব। তবে তোমাকে আমার ভাল লেগেছে, বাছা।’ আবারও আলাউদ্দিনের গুহায় সেঁধিয়ে গেল সে। মিনিট তিনেক পর ফিরে এসে চাপা স্বরে বলল, ‘এই যে!’ তেলে ভেজা কম্বলের ফালি সরিয়ে কাউন্টারের ওপরে রাখল খাপসহ একটা ছোরা। ‘অন্য কেউ চাইলে দিতাম না, তবে তোমার জন্যে দু’ শ’ ডলার,’
‘গর্বের সঙ্গে বলল বৃদ্ধ।
খাপ খুলে ছোরাটা হাতে নিল রানা। ওটা অনেক পুরনো হলেও অদ্ভুত সুন্দর। দু’দিকে ধার দেয়া দীর্ঘ ফলা। কাঁটা বসানো নাকলডাস্টারের মত স্টিলের হাতল। আঙুল বসে যায় চারটে ডেবে যাওয়া ফুটোয়। শত্রুর মাথা ভেঙে দেয়ার জন্যে আছে নিখুঁত পমেল ক্যাপ। ধাতব হাতলের ওপরে লেখা: ইউএস. ১৯১৮। রানা বুঝে গেল, এটা সাধারণ হান্টিং বা সার্ভাইভাল নাইফ নয়। জিনিসটা তৈরি করা হয়েছে স্রেফ মানুষ খুন করার জন্যে। মরণপণ যুদ্ধে শত্রুকে হারাতে হলে এমনই ছোরা চাই, আর সেজন্যে বহু বছর আগে মিলিটারির তুখোড় কোন যোদ্ধার মগজ থেকে এসেছিল এই ডিযাইন। রানা বুঝে গেল, আগেও রক্তের স্বাদ পেয়েছে অস্ত্রটা। ফলার ওপরে কালচে যে দাগ, ওটা শুকিয়ে যাওয়া খড়খড়ে রক্ত।
‘এটা মার্ক ওয়ান ইউএস আর্মি ট্রেঞ্চ নাইফ,’ বলল ফ্ল্যানাগান।
‘খুব ভাল জিনিস, সত্যিই আমার কাজে লাগবে,’ বলল রানা।
‘আর কাজে না লাগলে বুঝতে হবে তুমি পড়ে গেছ মস্ত কোন বিপদে। আমার মনে হচ্ছে না যে এমনি এমনি এসব সংগ্রহ করছ তুমি। আমি কি ঠিক বললাম?’
সতর্ক করার জন্যে রানার চোখে তাকাল জ্যাকি। বৃদ্ধের প্রশ্নের কোন জবাব দিল না রানা।
‘আমি কারও বিষয়ে নাক গলাই না,’ বলল ফ্ল্যানাগান। ‘তবে একটা কথা, বাছা-তুমি এত এত অস্ত্র কিনে বড় কোন গোলমাল তৈরি করবে না তো?’
‘কোন গোলমালে যাব না, নিশ্চিন্ত থাকুন,’ বলল রানা। ‘শুনে খুশি হলাম। টাকা কি নগদ দেবে?’ বলল বৃদ্ধ। ‘ওটাই সেরা মাধ্যম।’
বৃদ্ধের বিল নগদ ডলারে মিটিয়ে দিল রানা।
‘আপনার কাছ থেকে মাল কিনে ঠকতে হয়নি,’ বলল ও। ‘ভাল থাকবেন, প্যাডি।’
‘তুমিও ভাল থেকো, বাছা। একই কথা তোমার ক্ষেত্রেও, মিস। আজ তোমরা এলে, তাই চমৎকার কাটল আমার সময়।’
‘আমরাও ভাল সময় কাটিয়েছি,’ বলল জ্যাকি।
ওর হাত চেটে দিল ডোবারম্যান জো। ওটাকে নীরবে বিদায় জানানো বলা যেতে পারে।
প্লিমাউথের ট্রাঙ্ক জ্যাকি খুললে গ্যারাজ থেকে আনা যন্ত্রপাতি ও ডিভিডির নীল এনভেলপ সরিয়ে ইথাকা বন্দুক ও ভারী হোল্ডঅল ভেতরে গুছিয়ে রাখল রানা।
‘মনে হচ্ছে না এসবে আমি জড়িত, মনমরা হয়ে বলল জ্যাকি। রানার হাতে ধরিয়ে দিল গাড়ির চাবি। ‘আমরা এবার খুন হব অ্যারন কনারের লোকেদের হাতে। অথচ কিছু করার নেই! কিন্তু এত আয়োজন করে খুন হতে যাবার মানেই বা কী?’
‘এত মন খারাপ কোরো না,’ বলল রানা। ‘চলো, কোন খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনি। আমার পেটে নাচছে একদল ছুঁচো।
‘কিন্তু এত ভয় পেয়েছি যে আমার খিদে মরে গেছে!’
‘তবুও শরীর সুস্থ রাখতে হলে কিছু না কিছু খেতে হবে।’
জ্যাকি গাড়িতে উঠতেই প্লিমাউথ ঘুরিয়ে ফ্ল্যানাগানের উঠন থেকে বেরিয়ে এল রানা।