কালবেলা – ৩০ (মাসুদ রানা)

ত্রিশ

টুলসা ইন্টারন্যাশনালের দিকে উড়ে চলেছে বিশাল বিমান। নামতে শুরু করে ধর্-ধর্ শব্দ ছাড়ছে ওটার এয়ারফ্রেম। জানালা দিয়ে নিচে ঘন সবুজ টিলা, বিস্তৃত জঙ্গল ও রোদে পোড়া বাদামি ঘাসের প্রেয়ারি দেখতে পেল রানা। পেছনে অপূর্ব প্রকৃতি ফেলে বিমান এল শহরের ওপরে। নানাদিকে আকাশে নাক তুলেছে সুউচ্চ সব স্কাইস্ক্র্যাপার। এদিকে- ওদিকে হাইওয়ে, সবুজ পার্ক ও ছোট বাড়ি। নীল জলের আর্কানসাস, নদীতীরে প্রকাও এলাকা নিয়ে, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা। দেখতে না দেখতে সব পেছনে ফেলে টুলসা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের চওড়া রানওয়েতে নেমে এল বিমান। সময় নিল না গতি কমিয়ে নিতে। প্রকাণ্ড শরীর ঘুরিয়ে পৌঁছে গেল টার্মিনাল ভবনের সামনে।

আধঘণ্টা পর কাস্টম্স্ ও ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে পা রাখল রানা। কারেন্সি এক্সচেঞ্জ-এর এক দোকান থেকে ইউরো ভাঙিয়ে বুঝে নিল এক তোড়া ডলার। স্টারবাক কফি কিনে দু’ডলার খরচ করে সংগ্রহ করল টুলসা শহরের একটি ম্যাপ। ওটা জানিয়ে দিল, উত্তর-পুব ডাউনটাউনের পাঁচ মাইল দূরে আছে রানা। একটু পর ‘কাগজপত্র দেখিয়ে টুলসা রেন্টাল থেকে ভাড়া করল একুশ সালের কালো এক ফোর্ড ব্রঙ্কো জিপ। দ্বিতীয়বার চট করে ওটা দেখতে যাবে না কেউ। জিপের ভেতরে যথেষ্ট জায়গা। দরকার হলে ওখানে ঘুমাতে পারবে রানা। অবশ্য জিপটা ভাল লেগেছে অন্য কারণে। ওটার টিন্টেড জানালা গাঢ় কালো। তাতে হয়তো আড়ালে রয়ে যাওয়ার মত বাড়তি সুবিধে পাবে। এরই ভেতরে রানা স্থির করেছে, এবার একে একে কী ধরনের কাজগুলো করবে। জিপ ভাড়া করেছে পুরো এক সপ্তাহের জন্যে। যদিও নিজের কাজ শেষ করতে এতদিন লাগবে বলে ভাবছে না রানা।

ইউরোপের সময় অনুযায়ী চলছে রে, দেহঘড়ি। কাছেই লিনাক্স নামের এক স্টেকহাউস দেখে ওখানে ঢুকল রানা। কিনে নিল বাড়িতে তৈরি গরম চিকেন পাই। ওটা প্রায় কুমারের চাকার মতই বড়। এখন চলছে আগস্ট মাস। দক্ষিণ থেকে ঝিরঝির করে আসছে তপ্ত হাওয়া। স্টেকহাউস থেকে বেরিয়ে গাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শার্টের পিঠ ভিজে গেল ওর।

প্রধান সড়ক ধরে দক্ষিণে এগিয়ে চলল ব্রঙ্কো জিপ। ইউরোপ থেকে এত দিন পর আবারও আমেরিকায় পা রেখে সবই স্বাভাবিকের চেয়ে বড় বলে মনে হচ্ছে রানার। পেছনে পড়ল কাঠ চেরাইয়ের বিশাল এক আড়ত। দু’পাশে পিছিয়ে যাচ্ছে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স, ওয়্যারহাউস ও পুরনো সব গাড়ির স্যালভেজ ইয়ার্ড। একটু পর পছন্দমত এক জেনারেল স্টোর দেখে ওটার সামনে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল রানা।

মস্ত এই জেনারেল স্টোরে বোধহয় এমন কিছু নেই, যেটা পাওয়া যাবে না। দুটো ডেনিম শার্ট ও কালো জিন্স প্যান্ট কিনল রানা। এ ছাড়া কাউন্টারে রাখল বিনকিউলার, সানগ্লাস, বেসবল ক্যাপ ও প্লাস্টিকের পাঁচ লিটারের পানির ক্যান। কাউন্টারের পেছনের চেয়ারে বসে আছে বয়স্ক এক লোক। তার তুলোর মত সাদা চুলের মাঝে লালচে মস্ত এক টাক। মানুষটার পরনে ডুঙ্গারি। লাখখানেক ভাঁজ কুঞ্চিত চেহারায়।

‘এখান থেকে সবচেয়ে কাছে মাঝারি মানের কোন হোটেলটায় উঠতে পারি?’ মালপত্রের বিল মিটিয়ে জানতে চাই রানা।

‘ইংলিশ নাকি?’ তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখল বৃদ্ধ। ইংরেজি উচ্চারণ তো অক্সফোর্ডের। অথচ গায়ের রঙ ময়লা।

‘আমি বাংলাদেশের মানুষ,’ বলল রানা, ‘জাতে বাঙালি।’ গুড। তোমাদের কথা আমি জানি। উনিশ শ একাত্তর সালে যুদ্ধ করে তোমরা দেশ স্বাধীন করেছিলে। তারপর থেকে তোমাদের যেন উন্নতি না হয়, সেজন্যে নানানভাবে বেড়ালের মত খামচে দিত পাকিস্তানি শাসকেরা। আর এখন শুনছি তারা নিজেরাই নাকি ফকির হয়ে গেছে। এদিকে আমার কথা যদি জানতে চাও, তো আমার চোদ্দগুষ্টি আয়ারল্যাণ্ড থেকে এসেছে সিভিল ওঅরের সময়। আমার নাম প্যাডি ফ্ল্যানাগান।’

‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, প্যাডি, বলল রানা। বুঝে গেছে, ইংরেজ হলে লোকটার কাছ থেকে আন্তরিক ব্যবহার পেত না। ‘আমার নাম রানা। মাসুদ রানা।

‘জীবনে প্রথমবার টুলসায় এসেছ, রানা?’

‘ঠিকই ধরেছেন।’

‘ছুটি কাটাতে?’

‘ঠিক তা নয়,’ বলল রানা।

‘আমারও মনে হচ্ছে তুমি টুরিস্ট নও। ক’দিন থাকছ?’

‘কাজ শেষ হলেই বিদায় নেব।’

‘বুঝলাম মিথ্যা বলার মানুষ তুমি নও,’ ঠোঁট কোঁচকানো হাসি দিল প্যাডি ফ্ল্যানাগান। ‘ঠিক আছে, এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে সামনে পাবে ওল্ড ইয়েলার ইন। রুমগুলো খুব দামি না হলেও বেশ আরামদায়ক।’

‘তাতেই আমার চলবে,’ বলল রানা।

‘পরে হয়তো আবার দেখা হবে, কী বলো? দুনিয়ার বেশিরভাগ জিনিস পেয়ে যাবে আমার দোকানে। দিন-রাত খোলা থাকে। ওপরতলায় ঘুমাই। তাই মাঝরাতে এলেও উঠনে এসে হাঁক দিলেই আমাকে পাবে।’

দোকানের ঝুঁকে আসা তাকগুলো দেখল রানা। ‘ঠিকই বলেছেন, আপনার দোকানে অনেক কিছুই আছে।’

একটু পর ওল্ড ইয়েলার ইনে পা রেখে রানার মনে হলো, মোটেলটা যেন আসলে পুরুষদের সাধারণ এক মেস। মালিকের মুখে দেড়হাতি ধূসর দাড়ি, পেটের জায়গায় উল্টে যাওয়া গামলার মত ভুঁড়ি। ওর আইডি দেখতে চাইল না সে। টাকা পেয়ে খুশি হয়ে রেখে দিল ড্রয়ারে। কারও চোখে পড়তে হবে না বুঝে রানাও বেশ সন্তুষ্ট। ঘরে ঢুকে পর্দা টেনে দেয়ায় ছায়াময় হয়ে গেল ভেতরটা। দরজা লক করে শাওয়ার সেরে নতুন প্যান্ট-শার্ট, পরে নিল রানা। মাথায় ক্যাপ চড়িয়ে চোখে সানগ্লাস পরে ব্যাগ হাতে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে উঠল ফোর্ড ব্রঙ্কো জিপে।

টুলসার বাণিজ্যকেন্দ্র লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল রানা। ওর বুঝতে দেরি হলো না, এ-শহরের ওপর কী প্রচণ্ড প্রভাব ছিল অতীতের অয়েল বুম-এর। চারপাশের বাড়িঘর যেন চোখে আঙুল দিয়ে খোঁচা মেরে দেখাচ্ছে: অ্যাই, তোমরা কি জানো যে আমাদের সম্পদের শেষ নেই?

বিশাল পার্কে আছে দামি ফোয়ারা, চমৎকার লেক ও জলপ্রপাত। প্রাচুর্য প্রকাশ করার দিক থেকে সেরা হচ্ছে ব্যাঙ্ক অভ ওকলাহোমার আশপাশের এলাকা। প্রকাণ্ড বাড়িটা এই রাজ্যের সবচেয়ে উঁচু দালান। প্রেয়ারির মাঝে সে-সময়ের শক্তিশালী ডলারের গর্বিত বিশাল এর প্রতীক।

ম্যাপ দেখে ইস্ট সেকেণ্ড স্ট্রিটে সিটি হল খুঁজে নিল রানা। বিশাল দালানের সামনের দিক কাঁচ দিয়ে মোড়ানো। প্রবেশপথ থেকে দূরে রাস্তার ওদিকে জিপ রাখল রানা। চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি। এখন বাজে বিকেল পৌনে পাঁচটা। নির্মেঘ নীলাকাশে ঝলমল করছে সোনালি সূর্য। পকেট থেকে ফোন নিয়ে আয়ারল্যাণ্ডে পাওয়া টুলসার সেই ল্যাণ্ডফোনে ডায়াল করল রানা।

আজ আবারও ধরল একই রিসেপশনিস্ট মেয়েটা। তার কণ্ঠে দক্ষিণী টান। ‘মেয়রের অফিস।’

‘হাই, আমি শেরিস্ ব্যাজ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে টনি ব্র্যাডম্যান,’ বলল রানা।

‘কয়েক দিন আগে কল করেছিলেন, তা-ই না?’ শীতল কণ্ঠে বলল রিসেপশনিস্ট। ‘লণ্ডন থেকে?’

‘ঠিকই ধরেছেন। বিশাল ভবনের জানালাগুলোর দিকে চেয়ে মেয়েটা কোন্ অফিসে আছে, আনমনে ভাবল রানা। ভাল করেই জানে, এক শ’ গজ দূর থেকে দেখতে পাবে না কাউকেই। ‘মিস্টার কনার কি অফিসে আছেন?’

‘অফিসেই আছেন,’ বলল মেয়েটা। ‘কিন্তু এখন তাঁকে বিরক্ত করা যাবে না।’

‘তা হলে পরে যোগাযোগ করব,’ লাইন কেটে দিল রানা। ওর এটা জানা দরকার, ঠিক কখন অফিস থেকে বেরোবে মেয়র। ক’দিন তার পিছু নিয়ে সে কী ধরনের- অপরাধে জড়িত, সেটা জেনে নেবে। তারপর সময়মত কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে গোপন কোথাও। পেট থেকে বের করবে সব। হাতে আছে যথেষ্ট সময়, তাই ধৈর্যের কোন অভাব হবে না ওর।

জিপের জানালার কাঁচ নিচু করে নিল রানা। গরমের ভেতরে বসে মাঝে মাঝে এক ঢোক করে পানি গিলতে লাগল। চোখ সর্বক্ষণ সিটি হলের অফিসের ওপরে। এরই ভেতরে মুখস্থ করেছে ভবনের লেআউট। আরেকদিকে অন্য কোন প্রবেশপথ থাকতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে দু’দিকে চোখ রাখতে পারবে না। অবশ্য ভাল দিক হচ্ছে, এই প্রকাণ্ড ভবনের মেইন কার পার্ক মাত্র একটা। আর সেজন্যেই রানা ভাবছে,

অফিস থেকে বেরোলে সহজেই দেখতে পাবে মেয়র অ্যারন কনারকে।

একটু পর বিকেল পাঁচটায় ভবন থেকে বেরোতে লাগল মেয়রের অফিসের কর্মচারীরা। কেউ কেউ গিয়ে উঠল তাদের গাড়িতে। এরা অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। অন্যরা হেঁটে কমপাউণ্ড থেকে বেরোতেই তাদেরকে পেছনে ফেলে গাড়িতে চেপে চলে গেল কর্মকর্তারা। জিপের টিন্টেড জানালার কাঁচ তুলে দিল রানা। এখন কাছে এলেও কেউ দেখতে পাবে না ওকে। অবশ্য জানালা বন্ধ করতেই দ্রুত গরম হয়ে গেল জিপের ভেতরটা। কিছুক্ষণ পর ঘেমে নেয়ে উঠল রানা। ব্যাগ থেকে নিয়ে চোখে লাগাল কমপ্যাক্ট বিনকিউলার। আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে গোল কব্জা থেকে আদায় করল ম্যাক্সিমাম যুম। সিটি হল থেকে বেরোচ্ছে নানান পদের অফিস স্টাফ।

বেশিরভাগ কর্মচারী মহিলা। ছোট দল তৈরি করে গল্প করতে করতে হাসিমুখে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। খুশি যে আজকের মত অফিস ছুটি। তাদের দিকে মন না দিয়ে পুরুষদের ওপরে চোখ রাখল রানা। কেউ কেউ বয়স্ক হলেও অন্যরা যুবক। কারও পরনে সুট, আবার কারও নেই। অবশ্য এদের ভেতরে নেই মেয়র কনার।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে রানা। ভবনের প্রবেশপথ থেকে সরে গেল না ওর চোখ। ধীরে ধীরে পেরোল আরও আধঘণ্টা। এখন প্রতি পাঁচ মিনিটে সিটি হল থেকে বেরোচ্ছে এক বা দু’জন। সোয়া ছয়টায় থেমে গেল মানুষের বেরোনো। চিন্তায় পড়ে গেল রানা। অন্যদের সঙ্গে চলে গেছে মেয়র কনার? নাকি কাজ শেষ করবে বলে রয়ে গেছে অফিসে?

বড়কর্তারা কখনও দেরিতে বেরোয়। তেমন হলে ক্ষতি নেই রানার। আপাতত কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই ওর।

পৌনে সাতটার পর কেউ আর বেরোল সিটি হল থেকে। রানার মনে হলো আর উচিত হবে না সময় অপচয় করা। বিনকিউলার নামিয়ে রেখে ব্যাগ থেকে নিল তৃতীয় ডায়েরি। দ্রুত পড়তে লাগল। একই সময়ে নজর রাখল সিটি ভবনের ওপরে।

একত্রিশ

চোখদুটো ভিজে গেছে জ্যাকির। আজ বাবা বেঁচে থাকলে এই বিপদে ওকে আগলে রাখত। ওর মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। প্রতিসপ্তাহে আবদার করত ও, আর বাবাও ওকে নিয়ে যেত চিড়িয়াখানায়। ওখানে বাবার হাত ধরে মজা করে ঘুরে বেড়াত জ্যাকি। পুরনো মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়তেই চিড়িয়াখানায় চলে এসেছে ও। তা ছাড়া, এখানে এসেছে এক পরিকল্পনা নিয়ে। বছরের এ সময়ে চিড়িয়াখানায় থাকে শত শত মানুষ। তাদের ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারবে ও। ধরে নেয়া যায় এতজনের ভেতরে ওর ওপরে হামলা করবে না অ্যারন কনারের লোক।

অবশ্য পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর বন্ধ হবে চিড়িয়াখানা। তার আগেই ভেবে বের করতে হবে এরপর কী করবে। এখন শেষ বিকেল। খুব গরম পড়েছে। আকাশে হাসছে সোনালি রোদ। হাতিদের এলাকার বাইরে রেইলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাকি। মস্ত প্রাণীগুলোকে ভাল লাগে ওর। বুড়ো দাদুর মত কেমন ধীরস্থির, সবকিছুতে ধৈর্যের ছাপ। ওদেরকে আটকে রাখা হয়েছে বলে খারাপ লাগে, তবে নিজেদের দেশে পোচারদের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার চেয়ে এখানে নিরাপদে থাকাই ওদের জন্যে ভাল।

হঠাৎ করে হাতিগুলোর প্রতি ভীষণ হিংসা এল জ্যাকির। বুঝে গেছে, ওদের জীবনের চেয়ে ঢের অনিরাপদ হয়ে গেছে ওর নিজের জীবন। যে-কোন সময়ে হয়তো খুন হবে।

বাড়িতে যে-লোক এসে হামলা করেছে, সে ছিল অ্যারন কনারের দলের পাণ্ডা। যদিও কোনভাবেই তা প্রমাণ করতে পারবে না জ্যাকি। একবার ভাবল: আমার কি উচিত ছিল তার মুখ খোলাবার চেষ্টা করা? ক্ষতের ওপরে হাঁটু রেখে পিস্তলের নল তার মুখে ঠেসে ধরলে হয়তো বহু কথা বলত। বা উচিত ছিল নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন দেয়া। কিন্তু তখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল পালিয়ে যেতে। সেটা বোধহয় ছিল ওর বড় ধরনের ভুল। যদিও বাড়ির বাইরে গাড়িতে যে-লোক ঘুমের ভান করে বসে ছিল, সে হয়তো যে-কোন সময়ে এসে হামলা করত।

না, পালিয়ে এসে ভুল করেনি ও। আর এবার ভেবে বের করতে হবে, এরপর কী করবে।

নতুন ফোন পার্স থেকে নিয়ে পুলিশ চিফ রিগবির নম্বরে কল দিল জ্যাকি। ওদিক থেকে ফোন ধরতেই বলল, ‘চিফ রিগবি? জ্যাকুলিন সিলভেস্টার বলছি। আপনি বলেছেন কোন প্রয়োজন হলে যেন আপনার সঙ্গে কথা বলি। তো এখন বাধ্য হয়েই কল দিয়েছি। আমার বাড়িতে ঢুকে হামলা করেছে একলোক।’ দ্রুত বলে গেল জ্যাকি। ওদিক থেকে চুপচাপ শুনল পুলিশ চিফ। বাদ পড়ল না সিরিঞ্জ ও গুলির কথা। ‘বাড়ির সামনে পার্ক করা সাদা গাড়ির ড্রাইভার এসবে জড়িত কি না, বলতে পারব না। তবে আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে অ্যারন কনারের লোকেরা।’

‘মাথা ঠাণ্ডা রাখুন, মিস সিলভেস্টার,’ বলল চিফ রিগবি। ‘আপনি আপাতত কোথায় আছেন?’

‘শহরের চিড়িয়াখানায়। যদিও বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। একটু পর বন্ধ হবে চিড়িয়াখানা।’

‘জানি। আপনি ভাববেন না। ওখানে নিরাপদে আছেন। চিড়িয়াখানার গেট পেরোলে পার্কিং লটে পাবেন পেট্রল কার। ওখানে যান। আমি কথা বলছি অফিসারদের সঙ্গে। ওরা আপনাকে সরাসরি নিয়ে আসবে আমাদের এখানে।’

‘যে-কোন সময়ে আমার ওপরে হামলা হবে,’ জানাল জ্যাকি, ‘পুলিশ কি আমাকে নিরাপত্তা দেবে?’

‘নিশ্চয়ই! দুশ্চিন্তা করবেন না।’ ফোন কেটে দিল পুলিশ চিফ রিগবি।

ভিড় ঠেলে গেটের দিকে চলল জ্যাকি। কিন্তু কয়েক পা যেতেই শিরশির করে উঠল ওর মেরুদণ্ড। আগেও দেখেছে, কেউ আড়াল থেকে ওকে দেখলে এমন অনুভূতি হয়। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি।

যেদিক থেকে চোখ রাখা হচ্ছে, সেদিকে ঘুরে তাকাল জ্যাকি। ভিড়ের ভেতরে কাউকে আলাদা করার উপায় নেই। খিলখিল করে হাসছে ক’টা ছোট মেয়ে। এক পিচ্চির মুখে লেগেছে আইসক্রিম। পেছন থেকে এল বাঘের হুঙ্কার।

হেঁটে চলল জ্যাকি। মাইকে এল কর্তৃপক্ষের ঘোষণা। পনেরো মিনিটের ভেতরে বন্ধ করা হবে চিড়িয়াখানা। চট্‌ করে একবার হাতঘড়ি দেখে নিয়ে হাঁটার গতি বাড়াল জ্যাকি। মনে মনে বলল, ‘আশা করি মেইন গেটে পুলিশের গাড়ি পাব। অফিসাররা নিশ্চয়ই গাড়িতে করে পৌঁছে দেবে তাদের হেডকোয়ার্টারে।

কিন্তু গেটের ওদিকে পার্কিং লটে কোন পেট্রল কার দেখতে পেল না জ্যাকি। তাতে দুশ্চিন্তা বাড়ল ওর। পুলিশের লোক তা হলে কোথায়?

আবারও শিরশির করছে জ্যাকির মেরুদণ্ড। ঘুরে পেছনে তাকাল। পলকের জন্যে ওর মনে হলো, ভিড়ে চট্ করে সরে গেল একলোক। বোধহয় গোপনে পিছু নিয়েছে সে। কিন্তু সেটা করছে কতক্ষণ ধরে? চিড়িয়াখানায় জ্যাকি আসার পর থেকেই কি ওর ওপরে চোখ রেখেছে? এত দ্রুত সরে গেছে, তার মুখ দেখতে পায়নি জ্যাকি। তবে তার পরনে ছিল হলদে টি-শার্টের ওপরে চেক দেয়া শার্ট।

এত গরমেও শীতল এক কাঁপুনি ধরল জ্যাকির বুকে। আবারও দেখল হাতঘড়ি। গেটের এদিকে কোন পুলিশের গাড়ি নেই। ‘কোথায় গেল? তাদের তো এদিকেই থাকার কথা?’

পার্কিং লটের দিকে হনহন করে হেঁটে চলল জ্যাকি। যে- যার মত বাড়ির দিকে রওনা হচ্ছে দর্শকেরা। আগামী পাঁচ মিনিটের ভেতরে ফাঁকা হবে এ-এলাকা। আর এরই ভেতরে পুলিশের লোক না এলে, ওকে একা পাবে অনুসরণকারী শয়তানটা। পিছু যে নেয়া হচ্ছে, তা ওর মনের কোন কল্পনা নয়। হয়তো সেই সাদা গাড়ির লোকটা দলের কাউকে বলেছে এখানে চলে আসতে। জ্যাকি একা হলেই হামলা হবে ওর ওপরে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেও কোন লাভ হলো না। প্রথম সুযোগে এরা ধরে নিয়ে যাবে ওকে অ্যারন কনারের কাছে।

ধীরে ধীরে পেরোল আরেকটা মিনিট। চিন্তাগুলো বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে জ্যাকির। বুঝতে পারছে না এবার কী করা উচিত। ওকে পাশ কাটিয়ে যে-যার গাড়িতে উঠে বিদায় নিচ্ছে দর্শকেরা। গর্জে উঠছে একের পর এক ইঞ্জিন। পার্কিং লট থেকে রাস্তায় গিয়ে পড়ছে তাদের গাড়ি। আশপাশে পুলিশের কোন পেট্রল কার নেই।

ঘুরে পেছনে তাকাল জ্যাকি। চল্লিশ গজ দূরে দেয়ালের ওদিকে চট্ করে সরে গেল চেক শার্ট পরা একলোক। পলকের জন্যে তাকে দেখলেও জ্যাকি বুঝে গেল, ওরই পিছু নিয়েছে সে।

‘কী করবি ভেবে দেখ,’ মনে মনে বলল জ্যাকি। ভয়ে কাঁপছে ওর শরীর। একবার ভাবল, পিস্তল বের করে গুলি শুরু করব? ভয়ে হৈ-চৈ, হুলুস্থুল করবে দর্শকেরা। পরে যদি প্রমাণ হয়ে যায় যে ওর ভুল হয়েছে, তো ব্যাপারটা শেষমেশ গড়াবে আদালতে।

লোকটা কখন হামলা করবে, সেজন্যে অপেক্ষা করব? – ভাবল জ্যাকি। কপাল ভাল হলে প্রথম গুলি লক্ষ্যভেদ করবে। কিন্তু সেটা যদি না হয়? দ্বিতীয় সুযোগ কি আর পাবে ও?

পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করে কোন লাভ হবে না। অফিসাররা হয়তো আছে কয়েক মাইল দূরে। এখন একমাত্র যে-কাজ করতে পারে জ্যাকি, সেটা হচ্ছে পুলিশের হেডকোয়ার্টারে নিজেই পৌছে যাওয়া।

মনস্থির করে ভিড় করা লোকগুলোর সঙ্গে পার্কিং লটে নিজের গাড়ির দিকে চলল জ্যাকি। বারবার দেখে নিচ্ছে পেছনদিকে। কোথাও নেই চেক শার্ট পরা লোকটা। যদিও জ্যাকির পিঠে যেন বিঁধে যাচ্ছে তার চোখ। গাড়ির কাছে পৌছে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও। ইঞ্জিন চালু করে পিছিয়ে গিয়ে ঘুরে এগিয়ে চলল অন্যান্য গাড়ির পেছনে। একটু পর পেরোল এয়ারপোর্ট। চওড়া হাইওয়ে দক্ষিণে গিয়ে সরাসরি ঢুকে পড়েছে শহরে।

পাঁচ মিনিট পর রিয়ারভিউ মিররে চোখ যেতেই ধক করে উঠল জ্যাকির বুক। পেছনে হাজির হয়ে গেছে সেই সাদা গাড়ি। চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল ওটার ড্রাইভার। ওখান থেকে পিছু নিয়েছে আবারও। পথ থেকে চোখ সরাতে পারছে না জ্যাকি। ফলে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না পেছনের গাড়ি। ওটা বোধহয় ড্রাইভ করছে সেই একই লোক। গাড়ির উইণ্ডশিল্ডে রোদ পড়েছে বলে ভেতরে দেখা গেল না কে আছে। পরের জংশানে ডানদিকে বাঁক নিয়ে চেরোকি এক্সপ্রেসওয়ের দিকে চলল জ্যাকি। বুঝতে চাইছে সত্যিই ওর পিছু নিয়েছে কি না লোকটা।

হ্যাঁ, ওর ধারণা বোধহয় সঠিক।

বাঁক ঘুরে পেছনে পেছনে আসছে গাড়িটা। হঠাৎ করেই কোন সিগনাল না দিয়েই বামে বাঁক নিয়ে আবার দক্ষিণে গিয়ে হার্ভার্ড অ্যাভিন্যুতে পড়ল জ্যাকি। সাদা গাড়িটাকে দেখতে পেল রিয়ারভিউ মিররে। এখন আর ওর মনে কোন সন্দেহ নেই যে, ওকেই অনুসরণ করছে লোকটা।

পকেটের পিস্তল স্পর্শ করে মনে মনে বলল জ্যাকি, ‘ভয় কী, আমার সঙ্গে পিস্তল আছে। নিরাপত্তা নিয়ে এত ভাবতে হবে না। এত দূর যখন চলে এসেছি, তো বাকি পথও পার করে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারব।’

নিজেকে যতই শান্ত রাখার চেষ্টা করুক জ্যাকি, আসলে খুব ভয় লাগছে ওর।

বত্রিশ

সিটি হলের ওপরে চোখ রেখেছে রানা। তারই ফাঁকে দেখছে ব্রঙ্কো জিপের স্টিয়ারিং হুইলের ওপরে রাখা লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি। সিগারেটের তৃষ্ণা পেতেই নিজেকে জানিয়ে দিল, ‘ওই জিনিস আর নয়। আঠারো শ’ সাতচল্লিশ সালের ডায়েরিতে আবারও মন দিল।

একটু পর বেড়ে গেল ওর হতাশা। ডায়েরিতে এমন কিছু নেই, যেটা রহস্যজনক। প্রফেসর কেলির ওপরে বিরক্তি বোধ করছে রানা। লোকটা নিজে থেকেই বলতে পারত, দুর্ভিক্ষের সময়ে আসলে কী ঘটেছে। ডায়েরিতে নতুন করে আর কিছু লেখা হয়নি বায়ার্ন কনারের ব্যাপারে। এমন কোন সূত্র নেই, যা থেকে বোঝা যাবে আসলে কী জেনেছিল বেলা।

অবশ্য দক্ষ এক লেখিকা ছিলেন মিসেস স্টার্লিংফোর্ড। এখনও নিজের লেখার মাধ্যমে টেনে রেখেছেন রানাকে।

‘আজ জানলাম, আমার স্বামীর নির্দেশে আইরিশদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র। আমাদের জমিদারীতে ক্ষুধার্ত কয়েকজন লোক দুটো খরগোশকে গুলি করে মেরে আগুনে পুড়িয়ে খেয়েছিল। ফলে প্রহরীদেরকে পাঠিয়ে তাদেরকে ধরে এনে চরম শাস্তি দিয়েছে অ্যাঙ্গাস। আমি আপত্তি তুলেছিলাম। আমাকে শাসিয়ে দিয়েছে সে: আজ মারছে খরগোশ। এরপর হামলা করবে ইংরেজদের ওপরে। এদের হাতে অস্ত্র থাকা মানেই আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাওয়া।

‘আজই সকালে কাছের কয়েকজন ভাড়াটের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেছি। তাদের হাতে দিয়েছি আমার কাছে থাকা সামান্য কিছু টাকা। ওগুলো দিয়ে বাচ্চাদেরকে হয়তো কয়েক দিন খাবার কিনে দিতে পারবে তারা। আমার স্বামী জানে না, আমাকে উপহার দেয়া তার গয়না গোপনে বিক্রি করতে শুরু করেছি আমি। এক বাড়িতে দেখলাম তিনটে ছেলেমেয়ে। পরনে ছেঁড়া পোশাক। চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। এতই দুর্বল যে উঠে বসতে পারে না। উল্টোদিকে খড়ের বিছানায় মৃত্যুপথযাত্রী মধ্যবয়স্ক একলোক। বাড়ির কর্ত্রী অনুরোধ করল যেন তাদেরকে সামান্য খাবার এনে দিই। কিন্তু কিছু টাকা দেয়া ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।

‘মানুষের এই করুণ পরিণতি দেখতে হচ্ছে বলে মানসিকভাবে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিনের পর দিন। পাশের কয়েকটি বাড়িতেও সবারই একই দুরবস্থা। সবাই অপেক্ষা করছে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে। টিলার ওদিকে গিয়ে দেখলাম আগুনে জ্বলছে কুঁড়েঘরগুলো। এ-কাজ করেছে আমার নিজের স্বামী। প্রজারা এলাকা থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, অথবা তারা এখন আর বেঁচে নেই। এই মানুষগুলোর জন্যে কোন কফিনের বরাদ্দ দেয়া হয়। স্রেফ লাশ পুঁতে ফেলা হয় মাটিতে। ইংরেজদের অত্যাচার ও নির্যাতনের নমুনা দেখে ঘোড়া থামিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।

‘গতকাল আস্তাবলে এসেবেলা নামের এক কাজের মেয়ের সঙ্গে আমার কথা হলো। আঁধারে বসে কাঁদছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার কী হয়েছে?’

‘জবাবে মেয়েটা যা বলেছে, তাতে শিউরে উঠেছি ভয়ে। সারারাত আর ঘুমাতে পারিনি। এই যে এখন ডায়েরি লিখছি, তিরতির করে কাঁপছে আমার আঙুল।

পরিবারের মানুষগুলোকে বাঁচাবার জন্যে ইংরেজদের খাবারের বিশাল কনভয়ের ওপরে হামলা করেছিল কয়েকজন আইরিশ যুবক। তাদের হাতে ছিল সামান্য কয়েকটা লাঠি। দুর্বল শরীরে জোর ছিল না তাদের। ইংরেজ সৈনিক দলের হাতে ধরা পড়ে এদের এগারোজন। ডাকাতি করার চেষ্টা ধরে নিয়ে তাদেরকে ফাঁসি দিয়ে খুন করেছে। তাদেরই একজন এসেবেলার আপন বড় ভাই।

‘আজ সকালে অ্যাঙ্গাসকে অনুরোধ করেছি, জমিদারীতে যারা এখনও বেঁচে আছে, তাদেরকে যেন খাবার সরবরাহ করে সে। টাকার তো অভাব নেই তার। কিন্তু আমার মুখের ওপরে টিটকারির হাসি হেসেছে সে। বলেছে, এরপর আইরিশেরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে খরগোশ বা অন্য কোন প্রাণী হত্যা করতে গেলে তাদেরকেও নির্দ্বিধায় হত্যা করা হবে।

ভয়ঙ্কর বাজে লোক অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড, সেটা ভাল করেই বুঝে গেছে রানা। ডায়েরি থেকে চোখ তুলে তাকাল টুলসা সিটি হলের দিকে। গত কয়েক মিনিটে কেউ বেরোয়নি। যে-কারণেই হোক, আজ অফিসে বেশি সময় কাটাচ্ছে অ্যারন কনার। হয়তো গভীর রাতে বেরোবে। অবশ্য তাতে কোন সমস্যা নেই রানার।

আবারও চোখ বোলাতে লাগল ডায়েরির পাতায়। লেডি স্টার্লিংফোর্ড বর্ণনা দিয়েছেন, কত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় কনভয়ের ওপরে হামলা করা আইরিশদেরকে। এলি নামের একজন আহত ছিল। জেলখানা থেকে বের করে ছেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তাকে তোলা হয় ফাঁসির মঞ্চে। তখন লেডির কেমন লেগেছে ভাবতে গিয়ে তিক্ত হয়ে গেল রান্নার মন। মহিলা যদি পারতেন, তো নিজেই যোগ দিতেন আইরিশ, লুঠেরা দলে। এবং সেটা করলে তাঁকেও যে ছেড়ে দেয়া হতো না, সেটা লিখেছেন তিনি।

ইংরেজ সৈনিকরা আহত না হলেও একে একে ফাঁসি দেয়া হয়েছে এগারোজন আইরিশকে। চরম অন্যায় করা হয়েছে দেশটার সাধারণ মানুষের ওপরে। রানার মনে পড়ল, ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের নির্যাতনের নিষ্ঠুর ইতিহাস। নরপশু শ্বেতাঙ্গ শাসকেরা ভাবত ভারতের সাধারণ জনগণ আসলে বড়জোর নেড়ি কুকুর। কাজেই সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের ছিল না কোন অধিকার।

পাতা উল্টে দ্রুত পড়ল রানা। একজায়গায় এসে সরু হয়ে গেল ওর দু’চোখ। বিড়বিড় করে বলল, ‘বলে কী!’ ওর মনে পড়ল প্রফেসর কেলির বক্তব্য: ‘ডায়েরিতে সবই পাবেন। ওগুলো পড়তে এসেছেন। সেটাই বরং করুন। আগেই আপনাকে সেটা করতে বলেছি।’

হঠাৎ করে রানা বুঝেছে, ডায়েরিতে পেয়েছে খুব জরুরি এক তথ্য। লেডি স্টার্লিংফোর্ডের হাতের লেখা অস্পষ্ট হলেও বক্তব্য আগুনের মত জ্বলজ্বলে। দ্বিতীয়বারের মত লেখাগুলো পড়ল রানা।

আগস্টের বাইশ তারিখ, আঠারো শ’ সাতচল্লিশ

‘এমন এক ঘটনা আবিষ্কার করে বসেছি, যেটার কারণে সত্যিই ভীষণভাবে কেঁপে গেছি। এ-ধরনের তথ্যের কারণে হয়তো খুন হব আমি। আজ হেনরি ফ্লেচার এবারডেন হলে থাকলে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে পারতাম। এখন এমন কেউ নেই যাকে এসব কথা বলতে পারব। কাউকে বোঝাতে পারব না কীভাবে দুমড়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়।

‘মাঝে মাঝে ভাবতাম, বাড়ির পুবে আমার স্বামীর ল্যাবোরেটরিতে বসে আসলে কী করে সে। কাজের মানুষকে ওদিকে যেতে দিত না অ্যাঙ্গাস। এমন কী আমারও অনুমতি ছিল না ল্যাবোরেটরিতে পা রাখার। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে-ঘরে কাটাত অ্যাঙ্গাস। কাজ শেষে বেরিয়ে এসে তালা মেরে দিত দরজায়। নিজের কাজের ব্যাপারে কারও সঙ্গে কথা বলত না। আমাকে এ-কথাও বলেছে, সে গাছের ওপরে যে ধরনের জটিল গবেষণা করে চলেছে, তার কিছুই আমি বুঝতে পারব না।

‘বড় কৌতূহল হতো আমার। তাই কখনও কখনও গোপনে চলে যেতাম ল্যাবোরেটরির দরজার কাছে। উকি দিতাম তালার ফুটোর ভেতরে। কিন্তু সবসময় দেখতাম ওদিকের সাদা রঙ করা দেয়াল।

‘নিজের ল্যাবোরেটরিতে মাত্র একজনকে ঢুকতে, দিত অ্যাঙ্গাস। তিনি রয়েল সোসাইটি কলেজের প্রফেসর নরম্যান আর্চিবল্ড। এবারডেন হলে এসে দিনের পর দিন কাটাতেন তিনি। সত্যিকারের একজন সম্মানী মানুষ হিসেবে আমিও তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। যদিও পারতপক্ষে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না তিনি। আমার মনে হতো, কী যেন গোপন করে রেখেছেন। ল্যাবোরেটরিতে ঢুকে নিচু গলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ করতেন অ্যাঙ্গাসের সঙ্গে।

‘এভাবে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। আর তারপর সবই জেনে গেলাম আমি। সংক্ষেপে বলছি, কীভাবে জোগাড় করেছি ল্যাবোরেটরির দরজার চাবি। আমার স্বামীর ডেস্কের ওপরে চুরুটের বাক্সে ছিল ওটা। গতকাল অ্যাঙ্গাস বাসায় নেই দেখে পুব উইঙে গিয়ে ঢুকলাম ওর ল্যাবোরেটরিতে। মনের ভেতরটা খচ খচ করছিল যে অপরাধ করছি।

‘ল্যাবোরেটরি কক্ষ যত বড় ভেবেছি, তার চেয়ে অনেক ছোট। টেবিলে নানান যন্ত্রপাতি, কাগজপত্র আর অনেকগুলো বই। সহজে বুঝে গেলাম, গাছ নিয়ে জটিল কোন গবেষণা করছে অ্যাঙ্গাস। ওর হাতে লেখা কিছু কাগজ পড়েও কিছুই বুঝলাম না। তবে এটা জেনে গেলাম, ‘নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্টের রেযাল্ট টুকে রেখেছে সে। এই কাজটা করেছে আঠারো শত পঁয়তাল্লিশ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত মোটা এক বইয়ে দেখলাম একটা গাছের স্কেচ। একই জিনি এঁকেছে অ্যাঙ্গাস। ওদিকের দেয়ালে কাঠের তাকে কাঁচের জারে সারি সারি করে সাজিয়ে রেখেছে গাছের নমুনা। প্রতিটি জারের ওপরে লেখা সে-সময়ে গাছের কী অবস্থা ছিল! চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, সুস্থ গাছ থেকে শুরু করে অসুস্থ হওয়া গাছ আর শেষে ওটার পচে যাওয়া অবশিষ্টাংশ সংগ্রহ করেছে অ্যাঙ্গাস।

‘বোটানির কিছুই বুঝি না। কিন্তু আয়ারল্যাণ্ডে গত কয়েক বছর ধরে থেকে এটা বুঝেছি, জারগুলোর ভেতরে রয়েছে সাধারণ আলুর গাছ। এ-দেশে যে-কোন খেতে ওটা দেখা যায়। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম: অ্যাঙ্গাস আর তার সঙ্গী প্রফেসর আসলে এসব গাছ নিয়ে কী ধরনের গবেষণা করছে? এর জবাব পেলাম একটু পর।

‘টেবিলের ওপরে ছিল কাঠের ছোট বাক্স। ওটার ভেতরে ভেলভেটের খোপে দেখলাম ছোট ছোট ভায়াল। সেগুলোর ভেতরে থকথকে একধরনের তরল। সাহস করে একটা ভায়ালের ছিপি খুললাম। নাকের কাছে নিতেই বমি চলে এল আমার। চট করে আবারও ছিপি আটকে আগের জায়গায় রেখে দিলাম। প্রতিটা ভায়ালের ওপরে অ্যাঙ্গাস লিখে রেখেছে: ‘ফিটোফোরা ইনফেস্ট্যান্স।

‘জিনিসটা আসলে কী সেটা বোঝার পর দেরি না করে ল্যাবোরেটরির দরজা লক করে পালিয়ে এসেছি। অ্যাঙ্গাসের স্টাডিতে গিয়ে চুরুটের বাক্সে চাবি রেখে দিয়েছি। এরপর ওর লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করলাম গ্রিক ভাষার ওপরে লেখা এক ডিকশনারি। বহুক্ষণ লাগল ফিটোফোরা ইনফেস্ট্যান্স শব্দদুটো খুঁজে নিতে। গ্রিক ভাষায় ফিটো অর্থ ধ্বংস করা বা নষ্ট করে দেয়া। আর ইনফেস্ট্যান্স মানে সংক্রমণ ঘটিয়ে দেয়া।

‘তা হলে কি সংক্রমণ ঘটিয়ে দেয়ার মাধ্যমে আলুর গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে অ্যাঙ্গাস? তা হলে সে এবং তার বন্ধু এই ভয়ঙ্কর গবেষণাই করেছে এতদিন ধরে? হলদেটে তরল আর আলুর গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়া তা হলে কীসের আলামত? তবে কি এই দেশের আলুর খেতের সব গাছ ধ্বংস করে দিয়েছে এই দু’জন মিলে?

কেমন যেন ঘুরতে লাগল আমার মাথা। এ যেন সত্যিকারের দুঃস্বপ্নের মত। নানান সময়ে আলুর গাছের নমুনা জারের ভেতরে সংগ্রহ করেছে অ্যাঙ্গাস। কিন্তু এ যে সত্যিই ভয়াবহ ঘটনা!

‘আমি বিজ্ঞানী নই, তবে এটা বুঝতে দেরি হয়নি যে জেনে-বুঝে এই দেশের সমস্ত আলুর গাছ নষ্ট করে দিয়েছে অ্যাঙ্গাস আর প্রফেসর আর্চিবল্ড। আর তার ফলে এই দেশে দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভিক্ষ।

‘হায় ঈশ্বর, আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন!

‘আমি যে আর কিছুই বুঝতে পারছি না!

‘তবে কি এ-দেশের দুর্ভিক্ষের পেছনে রয়েছে আমার স্বামী?’

বহু বছর আগে কী ধরনের ভয়ঙ্কর অন্যায় করা হয়েছে আয়ারল্যাণ্ডের মানুষের ওপরে, সেটা জেনে হতবাক হয়ে ডায়েরি বন্ধ করল রানা।

মেডেইরা দ্বীপে ‘প্রফেসর কেলি কী বলেছিলেন, সেটা মনে পড়ল ওর। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার পর আঠারো শত চল্লিশের দশকে দু’বার প্যারিসে নামকরা এক ফরাসি বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করে অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। দু’জন তখন গাছের ফিটোফোরা ইনফেস্ট্যান্স বা মহা সংক্রমণের ওপরে গবেষণা করেছে। আর তখন তারা বেছে নিয়েছে আলুর গাছ।

তাদের গবেষণা সফল হওয়ার পর শুরু হয় আয়ারল্যাণ্ডে আলুর গাছে মড়ক গোটা দেশের বড় এক অংশের মানুষ বাধ্য হয় না খেয়ে মরে যেতে। ঊনবিংশ শতকে যদি একদল বিজ্ঞানী এই ধরনের রোগ ছড়িয়ে দিয়ে থাকে, তা হলে তাদের তো এটাও জানার কথা, তাদের ফর্মুলার প্রকোপ কীভাবে ঠেকাতে হবে।

প্রফেসর কেলির কন্ঠস্বর ভেসে এল রানার কানে: ‘আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে ওটাকে দুর্ভিক্ষ বলব না। ডায়েরি পড়লে আপনি বুঝবেন, ওটা অন্যকিছু ছিল।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এক কথা, আর, গোটা এক দেশের ভাগ্যে প্রলয়ঙ্করী দুর্ভিক্ষ ডেকে আনা অন্যকিছু। জেনেবুঝে আয়ারল্যাণ্ডের সাধারণ মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নিয়েছিল শাসক জাতি ইংরেজেরা। ফলে সে-সময়ে বাধ্য হয়ে মৃত্যুবরণ করে কমপক্ষে বিশ লাখ মানুষ।

তৃতীয় ডায়েরিতে রয়ে গেছে কী রহস্য, সেটা এখন বুঝে গেছে রানা। উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে চোখ বোলাল আকাশে। পুরো ব্যাপারটা হজম করতে গিয়ে ওর মনে হলো, আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালে আয়ারল্যাণ্ডের চরম অকাল আসলে ছিল এক শ’ মেগাটন পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের সমান!

আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে পথের ওদিকে নড়াচড়া দেখল রানা। সোজা হয়ে বসল জিপের ড্রাইভিং সিটে। এইমাত্র সিটি হল ভবনের সামনে ব্রেক কষে থেমে গেছে একটা গাড়ি। লাফিয়ে ওটা থেকে নামল দু’জন লোক। দ্রুত পায়ে ঢুকে পড়ল ভবনের ভেতরে।

তার আগে বিনকিউলারে চেহারাদুটো দেখে নিয়েছে রানা। তাদেরকে আগেও দেখেছে মেডেইরাতে। এখন পরনে সাধারণ পোশাক। একজনের মাথায় খোঁচা-খোঁচা চুল, দ্বিতীয়জনের মাথায় পনিটেইল। তার গেঞ্জির ওপরে লেখা: ইউ কিল মি, আদারওয়াইয ইউ উইল বি কিল্ড। ভবনে পা রাখার আগে প্যান্টের পকেট থেকে র‍্যাপার নিয়ে ওটা খুলে মুখে কী যেন পুরেছে।

রানা বুঝল, ওটা নিকোটিন গাম। বিড়বিড় করে বলল ও, ‘আশা করি আমাদের আবারও দেখা হবে।’

তেত্রিশ

এয়ার কণ্ডিশণ্ড অফিসে নিজের সিটে বসে আছে মেয়র অ্যারন কনার। ওদিকের দেয়াল থেকে তাকে দেখছেন বর্তমান পোপ, জেএফকে, আর রবার্ট কেনেডি। মেয়রের অফিসে ডেমোক্রেটিক নেতাদের ছবি দেখলে নাক সিটকাবে কনারের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। আসলে আইরিশ-আমেরিকানদের খুশি করতেই নিজের অফিসে এসব ছবি রেখেছে অ্যারন।

কালো বিশাল চেয়ারে বসে দামি বুট ডেস্কের ওপরে তুলে দিয়েছে সে। আপাতত অফিসের দরজা লক করা। আজকের মত অফিস থেকে বিদায় নিয়েছে মাটিল্ডা টেস ও তার সহকর্মীরা। ফলে এখন আর বেআইনি কুকীর্তিতে নিয়োজিত লোকজনের সঙ্গে ফোনে আলাপ সেরে নেয়ার জন্যে বাথরুম বা গাড়ি ব্যবহার করতে হবে না তাকে। আলাপ করছে নিউভো লারেডোতে পার্টনার লুই গৌরলের সঙ্গে। ওই লোক আছে এখন মরুভূমির ভেতরে। সেজন্যে কড়কড় আওয়াজ করছে অ্যারনের ফোনের স্পিকার। নিচু গলায় কথা বলছে গৌরলে। বেআইনি কাজের আলাপ করার সময় বেশিরভাগ অপরাধীর গলার আওয়াজ নিচুই হয়।

দু’জনের করা আলাপে নেই কারও কোন নাম। মালপত্র লেনদেনের বিষয়েও ব্যবহার করছে ছদ্মনাম। কেউ ফোনে আড়ি পাতলেও কিছুই বুঝবে না। পুরো সাতাশ মিনিট কথা বলার পর তারা স্থির করল, আগামী সপ্তাহে দক্ষিণে যাবে শিপমেন্ট। এবারের চালান আগের চেয়ে অনেক বড়। তাই দু’পক্ষ চাইছে কোথাও যেন কাজে কোন ত্রুটি না থাকে। অ্যারন কনার পুরো আত্মবিশ্বাসী, তার তরফ থেকে কোন ভুল হবে না। সে-রাতে কটেজে খুন হয়েছে হিউবার্ট। পরে গুম করা হয়েছে তার লাশ।

‘এখনও সামান্য কিছু সমস্যা রয়ে গেছে,’ গৌরলেকে বলল অ্যারন।

‘সেটা এখনও কাটানো হয়নি?’ বলল তার পার্টনার।

‘তা করা হয়েছে। আমার মনে হয় না আর কোন ঝামেলা হবে।’ মৃদু হাসল অ্যারন। ‘আমার যা করার, সবই করেছি।’

ফোনালাপের মাঝে হঠাৎ করেই পর পর তিনবার টোকার আওয়াজ হলো মেয়রের অফিসের দরজায়। কথা বলতে গিয়ে থমকে গেছে কনার। নিচে নামছে দরজার হ্যাণ্ডেল। রেগে গেল সে। কোন্ গাধা তাকে বিরক্ত করছে? নিশ্চয়ই কোন কুত্তার বাচ্চা মেথর!

‘আগের কথা অনুযায়ী ঠিক সময়ে স্টেশনে হাজির হব, ‘ বলছে গৌরলে। ‘আশা করি সঠিক সময়ে রওনা হবে ট্রেন।

‘কখনও তো লেট করে না,’ জবাব দিল অ্যারন।

‘যদিও টিকেটের দাম ক্রমে বেড়ে চলেছে।’

‘কিন্তু সঠিক সময়ে পৌঁছে যাচ্ছে যাত্রীরা। আর সেজন্যে তারা খুশি। তা-ই তো?’

ধুপ-ধুপ করে হাত দিয়ে দরজায় বাড়ি দিচ্ছে কে যেন।

বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে তাকাল অ্যারন। মুচড়ে দেয়া হয়েছে হ্যাণ্ডেল। মেথরটা কি ধরে নিয়েছে ফেঁসে গেছে দরজা?

‘পরে আবারও আমাদের কথা হবে,’ বলে লাইন কেটে দিল অ্যারন। আগের চেয়ে জোরে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে কবাটে। চেয়ার ছেড়ে গিয়ে দরজা খুলল অ্যারন কনার। পরক্ষণে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, ‘বিরক্ত করছ কেন! আমি ব্যস্ত!’

কিন্তু দরজায় আসেনি কোন মেথর।

‘ব্যাপারটা কী, তোমরা এখানে!’ বিস্মিত হলো অ্যারন। সামনে দাঁড়িয়ে আছে বার্ব ও স্ক্যালেস। ভয় পেয়ে চট্ করে করিডরে উঁকি দিল মেয়র। কপাল ভাল অফিসে এখন আর কেউ নেই। দাঁতে দাঁত চেপে নিচু গলায় বলল সে, ‘ভেতরে ঢোকো। আমি না তোমাদেরকে বলেছি কখনও এখানে পা রাখবে না?’ দুই খুনি ঘরে ঢুকতেই পেছনে দরজা লক করল সে।

‘আপনি তো আধঘণ্টা ধরে ফোনে কথা বলছেন, বস, বিরক্ত স্বরে বলল বার্ব। ‘অনেকক্ষণ ধরেই আপনাকে ফোনে চেয়েছি। ব্যাপারটা জরুরি। ঝামেলা হয়ে গেছে।

‘কী এত মস্ত বিপদ হয়ে গেল যে আমার অফিসে চলে আসতে হবে? তোমাদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’

‘গুলি খেয়েছে ক্রমম্যান।’

‘কী খেয়েছে?’ চমকে গেল অ্যারন।

‘ওকে গুলি করেছে সিলভেস্টার বেটি,’ চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বলল স্ক্যালেস। তার মুখের নিকোটিনের গন্ধ ভক করে লাগল কনারের নাকে।

‘গ্রুম্যান কি খুন হয়ে গেছে?’ ঢোক গিলল অ্যারন। ‘বহু দিন আর হাঁটতে পারবে না, তাতে ভুল নেই,’ বলল স্ক্যালেস।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল মেয়র। ‘বার্ব, আমি তোমাকে পই পই করে বলেছি, দায়িত্বশীল কাউকে কাজটা দিতে।’

‘নাইন মিলিমিটারের বুলেট দক্ষতার সঙ্গে কাজ শেষ করে,’ নিচু গলায় বলল বার্ব। ‘হাঁটুর ওপরের মাংসে লেগে ক্যানসাসের ম্যাপের মত বড় এক ক্ষত তৈরি হয়েছে ওর। আরেকটু হলে ছিঁড়ে পড়ত পা। মেয়েলোকটা বোধহয় ব্যবহার করে হলো পয়েন্ট বুলেট।’

‘শালার কপাল,’ বিড়বিড় করল কনার। পরক্ষণে রেগে গেল। ‘সহজ এক কাজে এত বড় গোলমাল করলে কী করে?’

‘এত ঘাবড়ে যাবেন না, বস,’ বলল স্ক্যালেস। ‘সবই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। পুলিশ কোনকিছুই জানবে না।’

‘আরে, গাধা, পুলিশ নিয়ে ভাবছি না,’ ধমকে উঠল অ্যারন। ‘তোমাদের তো বোঝার কথা, কীভাবে সেই ভিডিয়োর কথা জানলাম।’ বার্বের দিকে তাকাল সে। ‘ওই মেয়েলোকই ভিডিয়ো করেছিল। বেটি তো আর ইউএস মেরিন নয়! ভেবেছিলাম গ্রুমম্যান নিজের সঙ্গে আরও লোক নেবে।

‘নিয়েছিল তো বেন্টলিকে,’ বলল বার্ব।

‘তা হলে তাকেও গুলি করেছে?’ গর্জে উঠল অ্যারন।

‘সে ছিল বাইরে গাড়ির ভেতরে,’ বলল বার্ব। নিজের পায়ের পাতার দিকে তাকাল। ‘প্ল্যান অনুযায়ী লুকিয়ে ছিল। কথা ছিল মেয়েটাকে তুলবে গাড়ির ট্রাঙ্কে। কিন্তু একটু পর দেখা গেল বাড়ি থেকে ছিটকে বেরোল মেয়েটা। গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন চলে গেল।’

‘বেন্টলি ছিল তার বন্ধুর কাছ থেকে সামান্য দূরে। অথচ গুলির আওয়াজ পেল না? হারামজাদা কি কালা নাকি?’

‘ইয়ারফোনে গান শুনছিল,’ লজ্জিত চেহারায় বলল বার্ব।

‘কীসের গান?’

লালচে হয়ে গেল বার্বের দু’গাল। ‘হেভি মেটাল গান। ফুল ভলিউমে শুনছিল।’

‘এরপর থেকে বেন্টলি কম শুনলে সঙ্গে সঙ্গে ওর মগজে একটা বুলেট গেঁথে দেবে,’ রাগ সামলাতে না পেরে বলল অ্যারন। ‘এটা নির্দেশ! না, বাদ দাও, বরং এখনই ওর মগজে বুলেট গেঁথে দাও। এখন বোধহয় তোমরা বলবে: মেয়েলোকটাকে হারিয়ে ফেলেছে সে, তাই তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?’

এবার মুখ তুলে তাকাল বার্ব। ‘বেন্টলি এরপর ঢুকে পড়ে বাড়ির ভেতরে। সিঁড়িতে দেখে ক্রমম্যানকে। তার পা প্রায় ছিঁড়ে গেছে। ক্ষত থেকে ঝরঝর করে পড়ছিল রক্ত। গ্রুমম্যান জানাল একটু আগে কী ঘটেছে। তখন তাকে গাড়িতে তুলে মেয়েটার পিছু নিল বেন্টলি। তাকে ধরতে পারল গিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে। ততক্ষণে দলের আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়েছে গ্রুমম্যান।’

‘ক্রমম্যান বেঁচে থাকুক বা মরে যাক, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না,’ বলল অ্যারন। ‘আমার দরকার ওই বেটিকে হাতের মুঠোয় পাওয়া। এরপর কোথায় গেল সে?’

‘গ্রুমম্যান বলেছে মেয়েটা সোজা গেছে চিড়িয়াখানায়। তারপর থেকে আর যোগাযোগ করেনি সে। তখন থেকে আপনাকে ফোন করছি, কিন্তু লাইন বিযি ছিল। এরপর বাধ্য হয়ে এখানে এসেছি আমরা।’

‘চিড়িয়াখানা,’ ঘোঁৎ করে উঠল মেয়র কনার।

‘গ্রুমম্যান তো সেটাই বলল।’

‘ওখানে গিয়ে কী করবে বেটি? বাঁদরদের খাঁচার সামনে গিয়ে ভেঙচি কাটবে?’

খিঁক-খিঁক করে হাসল স্ক্যালেস।

তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেবে ভাবল কনার, কিন্তু তখনই পকেটে বাজল ফোন। কল করেছে রিপার রিগবি।

‘বলুন তো দেখি এইমাত্র আমাকে ফোন করেছে কে?’ বলল চিফ অভ পুলিশ। ‘খুব ভয় পেয়ে গেছে সে। বলল: কে যেন তাকে কিডন্যাপ করতে চায়। আপনার ছেলেরা নাকি, মিস্টার মেয়র?’

‘আমি এ-ব্যাপারে কিছুই জানি না,’ বলল অ্যারন। ‘তবে জানতে চাই মেয়েটা এখন কোথায় আছে।’

‘শহরের চিড়িয়াখানায়, বলল রিগবি। ‘তাকে তুলে নেয়ার জন্যে রওনা হয়েছে আমার লোক। ওরা জানতে চায় এরপর কী করতে হবে। আপনি আমাকে কী করতে বলেন, মেয়র?’

‘মেয়েটার কোন ক্ষতি চাই না,’ বলল কনার। ‘অন্তত এখনই নয়। আমার কাছে তাকে ধরে আনুন। জানেনই তো কোথায় যেতে হবে।’ কল কেটে পকেটে ফোন রাখল সে। মুখে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। এখনও সবই আছে তার নিয়ন্ত্রণের ভেতরে। পালিয়ে গেলেও আবারও ফাঁস পরিয়ে দেয়া যাবে বোকা মেয়েটার গলায়।

হঠাৎ বাজল বার্বের ফোন। ‘গ্রুমম্যান,’ স্ক্রিন দেখে নিয়ে কল রিসিভ করে কানে ফোন ঠেকাল সে। নিস্পৃহ চেহারায় শুনল ওদিকের কথা। আধমিনিট পর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে, আপ-ডেট দিয়ো।’ ফোন রেখে মেয়রের দিকে তাকাল বার্ব। ‘এইমাত্র চিড়িয়াখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে।’

‘তার সঙ্গে পুলিশের লোক আছে?’ বলল অ্যারন।

মাথা নাড়ল বার্ব। ‘না, সে একা।’

‘সর্বনাশ!’ বিড়বিড় করল মেয়র। মেয়েটাকে ঠিক সময়ে গিয়ে তুলে নিতে পারেনি পুলিশের লোক। ‘অর্থাৎ, আবারও খপ্পরে পড়ে গেলাম উজবুক বেন্টলির?’

‘সে আর কোন ধরনের ভুল করবে না। মেয়েটা যখন চিড়িয়াখানায়, তখন তার গাড়ির হুইলের ভেতরে জিপিএস ট্র্যাকার রেখে দিয়েছে। সোজা দক্ষিণে আসছে গাড়িটা। বেন্টলি আছে ঠিক পেছনে। ব্যাকআপ হিসেবে সঙ্গে রেখেছে দলের ক’জনকে। আপনি কি এসব জেনেও বেন্টলির মগজে বুলেট গেঁথে দিতে বলছেন?’

‘আমি চাই তোমরা গিয়ে মেয়েটাকে ধরে আনবে, দরজার দিকে আঙুল তাক করে চেঁচিয়ে উঠল মেয়র কনার। ‘আমি তাকে জীবিত চাই। যাতে কথা বলতে পারি। মারধর করে আহত করবে না। আমার কথা কি তোমরা বুঝতে পেরেছ? নোংরা পাছাদুটো নিয়ে এবার এই অফিস থেকে বের হও। আর আরেকটা কথা, ভবিষ্যতে কখনও আমার অফিসে আসবে না তোমরা।’

মেয়রের অফিস থেকে বেরিয়ে বার্ব ও স্ক্যালেসের বেশিক্ষণ লাগল না নিজেদের গাড়িতে উঠতে। বেন্টলিকে ফোন করে বলল বার্ব, ‘আমরা আসছি। মেয়েটার কাছ থেকে দূরে থেকো। নিজে থেকে কিছু করবে না। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

‘কুত্তীটাকে একবার হাতে পেলে ছিঁড়ে নেব ওর দুই স্তন, তিক্ত স্বরে বলল স্ক্যালেস। ইঞ্জিন চালু করে ভ্যান ঘুরিয়ে নিয়ে দ্রুত গতিতে রওনা হলো সে।

বার্ব ও স্ক্যালেস এত তাড়াহুড়ো না করলে দেখতে পেত, তিনটে গাড়ির পেছনে আসছে কালো এক ব্রঙ্কো জিপ।

চৌত্রিশ

টুলসা সিটির ডাউনটাউন লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে জ্যাকির লাল সুবারু। পেছনে আছে সেই সাদা গাড়ি। জ্যাম বেধেছে বলে সামনের গাড়িগুলো ধীর গতিতে চলেছে। আরও কয়েক মিনিট পর পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে যাবে জ্যাকি। বারবার ভেবেছে, একবার ওখানে গেলে পুলিশের ভয়ে হয়তো পেছনের লোকটা পালিয়ে যাবে। আবার তা না-ও হতে পারে। হয়তো অপেক্ষা করবে বাইরে। তারপর পুলিশের হেডকোয়ার্টার থেকে বেরোলেই কিডন্যাপ করবে ওকে। জানার উপায় নেই পুলিশ চিফ কী করবেন। হয়তো পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে পেছনের লোকটাকে ফাঁকি দিয়ে কোন এক মোটেলে গিয়ে উঠবে ও। অবশ্য অ্যারন কনার আর তার লোকদের এড়িয়ে বেশিদিন লুকিয়ে থাকতে পারবে না। ভয়ে কাঁপছে জ্যাকির বুক। হঠাৎ করেই বুঝে গেল, এবার কী করতে হবে ওকে।

বামে বাঁক নিল জ্যাকি। বিশ গজ যেতেই দেখতে পেল, সবুজ থেকে লাল হচ্ছে ডানের ট্রাফিক সিগনাল। ঝোড়ো বেগে ওটা পেরিয়ে মনে মনে হাসল জ্যাকি। এবার পেছনের সিগনালে আটকা পড়বে সাদা গাড়ি। ষাট গজ দূরে পথের ধারে বিশাল এক বহুতল শপিং মল। ওটার পার্কিং লট আণ্ডার গ্রাউণ্ডে। চাকার কর্কশ শব্দ তুলে বাঁক নিয়ে খাড়া র‍্যাম্প বেয়ে নেমে চলল জ্যাকি। পেছনের লোকটা ওকে দেখে থাকলেও চট্ করে হাজির হতে পারবে না লাল বাতির জন্যে। অর্থাৎ অন্তত দু’মিনিট পাচ্ছে ও। সহজেই পার্কিং লটে গাড়ি রেখে উঠে যাবে ওপরের শপিং মলে। ভিড়ের ভেতরে ওকে খুঁজে পাবে না কেউ। শপিং মলের পেছনদিকের রাস্তায় নেমে পড়বে জ্যাকি। টুলসা শহরটা নিউ ইয়র্কের মত নয় যে পাঁচ সেকেণ্ড পর পর ট্যাক্সি আসবে, তবে কপাল ভাল হলে পেয়েও যেতে পারে কোন ক্যাব। আর তা না পেলে দেরি না করে উঠে পড়বে প্রথম বাসে।

অবশ্য ওর জানা নেই, লালবাতি তোয়াক্কা না করে চলে এসেছে খয়েরি রঙের এক লিংকন গাড়ি। পার্কিং লটের পেছনে ছায়ামত জায়গায় ধূসর এক ধুলোভরা মিটসুবিশি মিরাজ গাড়ির পেছনে নিজের গাড়ি রেখে নেমে পড়ল জ্যাকি। মাত্র ছুট দিয়েছে লিফটের দিকে, এমন সময় র‍্যাম্প বেয়ে সাঁই করে নেমে এল খয়েরি গাড়িটা। সরাসরি জ্যাকির দিকে বাঁক নিল ওটা। পাতাল গ্যারাজে গুম-গুম শব্দ তুলছে ইঞ্জিন। জ্যাকি আর লিফটের মাঝে এসে কড়া ব্রেক কষে থামল গাড়িটা। পরক্ষণে দরজা খুলে নামল ওটার ড্রাইভার। পরনে ঢিলা চেক শার্ট। ভেতরে হলদে গেঞ্জি। লোকটার মাথার ওপরের ছাতে জ্বলছে-নিভছে নষ্ট এক টিউব লাইট। ছায়ার ভেতরে লোকটার চেহারা ভালভাবে দেখা গেল না।

ভয় পেয়ে ঘুরেই নিজের গাড়ির দিকে ছুটল জ্যাকি। কিন্তু তখনই পেছন থেকে জোর গলায় বলল লোকটা, ‘থামুন! প্লিয, আগে আমার কথা শুনুন!!

এই কণ্ঠস্বর চেনে বলে থমকে গিয়ে ঘুরে তাকাল জ্যাকি। নিজের গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।

চোখ সরু করে তাকে দেখল জ্যাকি। কিছুই বুঝতে পারছে না। তা হলে কি ও পুলিশে যোগাযোগ করার আগেই ওর পিছু নিয়েছিল এ-লোক?

‘অবাক হয়েছেন?’ দু’হাত ওপরে তুলে ওর দিকে এগোল ডিটেকটিভ। ‘দয়া করে ভয় পাবেন না, আমি আপনার কোন ক্ষতি করতে আসিনি।’

‘আপনি এখানে কী করছেন?’ জানতে চাইল জ্যাকি।

‘সবই খুলে বলছি,’ আরেক পা এগোল লিয়োনার্ড।

সন্দেহের দোলায় দুলছে জ্যাকির মন। দু’পা পিছিয়ে কাঁপা গলায় বলল, ‘যেখানে আছেন, ওখানে দাঁড়িয়েই কথা বলুন। ভুলেও এগিয়ে আসবেন না।

‘আমি আসলে ভাল দলের একজন, বলল ডিটেকটিভ। তার চেহারায় সততার ছাপ দেখতে পেল জ্যাকি। প্রায় অনুরোধের সুরে বলল জিম লিয়োনার্ড, ‘আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’

‘আমার বাড়িতে ঢুকে হামলা করেছে একলোক,’ বলল জ্যাকি, ‘তার কাছে ছিল ইঞ্জেকশন। অজ্ঞান করে কোথাও নিয়ে যেত। আর এরপর আমার পিছু নিয়েছেন আপনি। এখন বলছেন বদমাশদের দলের নন। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে কে যে ভাল আর কে খারাপ, সেটা আর বুঝতে পারছি না।’

‘মিস সিলভেস্টার, বলল ডিটেকটিভ, ‘আমি আপনাকে জ্যাকি নামে ডাকতে পারি?’ আরেক পা এগোল সে।

‘আগেই সাবধান করেছি,’ পকেট থেকে বের করে জিম লিয়োনার্ডের বুকে সিগ সাওয়ার পিস্তল তাক করল জ্যাকি। বাড়িতে ষাঁড়টাকে গুলি করার সময়ে এভাবেই দু’হাতে শক্ত করে ধরেছিল পিস্তলের বাঁট। ‘আর এক পা এগোলে গুলি করব।’

থমকে গেল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। সতর্ক চোখে দেখল পিস্তলটা। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। ‘আমার জন্যে আপনার আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে হবে না।’

‘এরপর বলবেন পুলিশের বুকে পিস্তল তাক করতে নেই, নাকি? এটা ফেডারেল ক্রাইম? সরি, ডিটেকটিভ! আপনাকে আমি বিশ্বাস করছি না। দরকারে গুলি করব আপনার বুকে।’

‘আমি শুধু পুলিশ অফিসার নই,’ বলল লিয়োনার্ড, ‘কাজ করছি এফবিআই-এর সঙ্গে। আর সেজন্যেই আপনার সঙ্গে আলাপ করে নেয়া খুব জরুরি হয়ে উঠেছিল। দয়া করে পিস্তল নামিয়ে রাখুন। অন্তত ওটা তাক করবেন না আমার বুকের দিকে। আমি খুলে বলছি আসলে কী ঘটেছে।’

‘এফবিআই?’ দ্বিধা নিয়ে বলল জ্যাকি।

‘আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।’

দু’বার মাথা নাড়ল জ্যাকি। ‘মরলেও না! আপনি পারলে এফবিআই-এর আইডি দেখান!’

‘পুলিশের ব্যাজ ছাড়া এখন আর কিছুই দেখাতে পারব না। আগেই বলেছি, কাজ করছি এফবিআই-এর হয়ে। তার মানে এমন নয় যে তাদের একজন হয়ে গেছি। সত্যি কথা হচ্ছে, গোপনে এফবিআই-এর হয়ে তদন্ত করছি আমি।’

‘গোপনে? কেন?’

‘আমার কথা বিশ্বাস করুন: আপনি আছেন মস্ত বিপদে।’

‘সেটা জানি,’ পিস্তল নামিয়ে ঊরুর পাশে রাখল জ্যাকি। প্রয়োজনে ঝট্ করে তুলে গুলি করবে। ডানহাতের তর্জনী অস্ত্রের ট্রিগারে। ‘ঠিক আছে। যা বলার ব্যাখ্যা করে বলুন। তবে ভুলেও আর এক পা-ও সামনে বাড়বেন না।’

‘এফবিআই তদন্ত করছে অ্যারন কনারের বিরুদ্ধে। সেটা করা হচ্ছে গোপনে। তাতে আমার সহায়তা চেয়েছে তারা। গত কয়েক মাস ধরেই তাদের হয়ে কাজ করছি। সেজন্যেই আপনি আমার অফিসে এসে খুনের কথা বললে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। তখনও ভাবতে পারিনি যে এভাবে কপাল খুলে যাবে। জ্যাকি, আপনি হতে পারেন আমাদের সেরা সাক্ষী।’

‘তা-ই? কিন্তু আমি সব বলতে গেলে আপনার মুখে ছিল বিরক্তির ছাপ। এরপর নিয়ে এলেন চিফ রিগবিকে। সে বলল, আমার কাছে আসলে প্রমাণ বলতে কিছুই নেই।’

তীক্ষ্ণ চোখে ওকে দেখল ডিটেকটিভ। যেন আশা করছে তার কথা বিশ্বাস করবে জ্যাকি। ‘আমি যদি তখন আপনার সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলতাম, তো বড় ধরনের বিপদ হতো। তা-ই ভাব করেছি বিরক্তি বোধ করছি আমি। আপনাকে আগেই বলেছি, এটা গোপন মিশন। ফলে খুব সতর্কতার সঙ্গে এক পা এক পা করে এগোতে হচ্ছে আমাকে। একবার ভুল হলে হাত ফস্কে বেরিয়ে যাবে অ্যারন কনার। আর সেটা হলে আমাদের জন্যে ব্যাপারটা হবে মারাত্মক ক্ষতিকর।

‘তাকে ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করতে দেখেছি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল জ্যাকি। ‘এর চেয়ে খারাপ কী হবে?’

‘ধরুন, তার জন্যে খুন হবে হাজারো নিরপরাধ মানুষ। সেটা আরও খারাপ নয়? খুন, ড্রাগ্‌স্‌, কিডন্যাপিং, ধর্ষণ আর পতিতালয়ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ ডলার পাচ্ছে সে।’

কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল জ্যাকি।

‘এ-ছাড়া বেআইনি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত অ্যারন কনার,’ বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড, ‘প্রাক্তন দুই মিলিটারি অফিসারের মাধ্যমে সংগ্রহ করছে হাজার হাজার অস্ত্র। আণ্ডার-ওঅর্ল্ডের অপরাধীদের কাছে বিক্রি করছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে। তার খদ্দেরদের মধ্যে আছে হার্ডি লোকো নামের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একটি দল। তাদের হাতেই তুলে দিচ্ছে বেশিরভাগ অস্ত্র। আর এরফলে দ্রুত বড় হচ্ছে দলটা। এরা রক্তপিশাচ। ড্রাগসের জাল বিছিয়ে দিয়েছে মেক্সিকোর পুবে। প্রতিবছর তাদেরকে রুখে দিতে গিয়ে লড়ছে এটিএফ বা ডিইএ। হার্ডি লোকোর ড্রাগসের বেআইনি ব্যবসা বিলিয়ন ডলারের। ভবিষ্যতে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের হাতে খুন হবে বহু নীতিবান অফিসার। আর সে-দায় আসলে অ্যারন কনারের। সুতরাং যেভাবেই হোক আমরা তাকে ঠেকাব।’

ডিটেকটিভের দিকে চেয়ে আছে জ্যাকি। তা হলে সে- রাতে কটেজে যে লোককে খুন করল, সে-ও কি…’

‘আমাদেরই একজন,’ তিক্ত সুরে বলল লিয়োনার্ড। ‘ভাল, নাম হিউবার্ট হ্যারল্ড। কয়েক মাস আগে গোপনে যোগ দেয় এফবিআই-এ। ভেবেছিল অপরাধ জগৎ থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে। এফবিআই তাকে কথা দেয়, অ্যারন কনারের গোটা অপারেশনের ব্যাপারে জানালে আদালতে তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোলা হবে না। তবে কী করে যেন তাকে ধরে ফেলে কনারের দলের লোক। আমরা তাকে উদ্ধার করার আগেই হাওয়া হয়ে যায়। আমার ধারণা হয়েছিল যে তাকে খুন করেছে বার্ব। দলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান অপরাধী সে।’

‘বার্ব?’

মাথা দোলাল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। ‘পুরো নাম লিয়াম বার্ব। কয়েক বছর আগেও আর্মির ফিথ স্পেশাল ফোর্সের দক্ষ মেজর ছিল। গালফ বলুন বা আফগানিস্তান, প্রতিটি যুদ্ধে পেয়েছে মেডেল। তবে এরপর হঠাৎ করে জানা গেল নানা অপরাধে জড়িত সে। চাকরি চলে যাওয়ায় দু’বছর বিভিন্ন দেশে মার্সেনারি অফিসার হিসেবে কাজ করেছে। যেসব নোংরা কুকীর্তি করেছে, সেসব আপনি জানলে হয়তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবেন। বছর খানেক আগে আবার ফিরেছে ওকলাহোমায়। তাকে চিনতে দেরি হয়নি অ্যারন কনারের। নিজের ব্যবসার চিফ অভ স্টাফ করেছে বার্বকে। আপনি এই লোককে আগেও দেখেছেন।’

‘কটেজে যে দু’জন যুবক ছিল, তাদের একজন।’

‘তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু টনি স্ক্যালেস। মেরিন ফোর্সের স্পেশাল অপারেশন্স কমাণ্ডের মেজর। বার্বের মতই হাইলি ট্ৰেইণ্ড। শুধু তা-ই নয়, সে বার্বের চেয়েও হিংস্র। সত্যিকারের এক ভয়ঙ্কর সাইকো। খুন করতে পারলে আর কিছুই চায় না। এদিকে বার্বের মগজ ব্যবসায় তুখোড়। অনায়াসে জটিল সব চ্যানেল ধরে সংগ্রহ করছে আধুনিক সব অস্ত্র। বলতে পারেন টনকে টন। আর সেগুলো এক পার্টনারের মাধ্যমে বিক্রি করছে অ্যারন কনার। সেজন্যে ক’দিন পর পর বিমানে করে মেক্সিকোর সীমান্তে নিউভো লারেডোয় যাচ্ছে সে। তার সেই পার্টনারের নাম আমরা জেনেছি। লুই গৌরলে। কিন্তু তদন্ত করতে গিয়ে জানা গেল নামটা আসলে নকল। হার্ডি লোকো আর মেয়র কনারের মাঝে দালাল হিসেবে কাজ করে সে।’

‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে সবই আপনারা জেনে গেছেন,’ বলল জ্যাকি।

‘আমাদের চাই আরও জোরাল প্রমাণ,’ বলল লিয়োনার্ড। ‘হিউবার্ট হ্যারল্ড জবানবন্দি না দিলে কোনকিছুই প্রমাণ করতে পারতাম না। আইনের কারণে আমাদের হাত-পা বাঁধা। অ্যারন এতই চতুর, কোথাও কোন সূত্র রাখেনি।’ মৃদু হাসল ডিটেকটিভ। ‘এতদিন তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ ছিল না। কিন্তু এখন আমরা পেয়েছি একজন চাক্ষুষ সাক্ষী। আর সে হচ্ছেন আপনি। আমাদের তুরুপের তাস। আপনার করা সেই ভিডিয়ো প্রথম প্রমাণ, যেটার কারণে আদালত, বুঝবে বেআইনি কাজে নিয়োজিত মেয়র কনার। হিউবার্ট হ্যারল্ডকে ছাড়াও আমরা এবার প্রমাণ করতে পারব, ফার্স্ট-ডিগ্রি মার্ডার করেছে লোকটা।’

‘সেক্ষেত্রে ভিডিয়োটা কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?’ বলল জ্যাকি। ‘প্রমাণ হিসেবে আমি ভিডিয়ো হাতে তুলে দেয়ার পরেই আপনারা তাকে গ্রেফতার করতে পারতেন।’

‘বিষয়টা অত সহজ নয়, বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। ‘এমন নয় যে শুধু বেআইনি কাজে অ্যারন জড়িত। তার সঙ্গে আছে বড় পদের সরকারি অনেকে। যেমন ধরুন দুর্নীতিপরায়ণ কোয়ার্টারমাস্টারদের কথা, যারা গোপনে অস্ত্র সরিয়ে নিচ্ছে ইউএস আর্মস্ ডিপো থেকে। তারপর আছে এ-শহরের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের নীতিহীন একদল অফিসার। ওদিকে আছে মেক্সিকো সরকারের অফিসাররা, যারা ঘুষ খেয়ে চোখ বুজে থাকে অস্ত্রের চালান যাওয়ার সময়ে। মস্তবড় র‍্যাকেট তৈরি করেছে এরা। তা-ই জাল না ফেলে কাজে নামবে না এফবিআই। আর যখন তারা তৈরি হবে, বড় ধরনের মিশনে নেমে একসঙ্গে গ্রেফতার করবে এসব অপরাধীদেরকে।’

চোখ বড় করে ডিটেকটিভকে দেখছে জ্যাকি। ‘এমন কী পুলিশের অফিসাররাও দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে গেছে?’

‘ভাবতে গেলে চমকে যেতে হয়, তবে ঘটনা তেমনই। আর সেজন্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি এফবিআই-এর সঙ্গে। বদমাশগুলোর একটা হচ্ছে রিপার রিগবি। সে আবার টুলসার চিফ অভ পুলিশ। বুঝতেই পারছেন এদের শেকড় কতটা গভীরে।’

‘হায়, যিশু!’ বিড়বিড় করল জ্যাকি।

‘গত শরতে যোগাযোগ করল এফবিআই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপের পর জানাল, টুলসার পুলিশের চিফকে সন্দেহ করছে তারা। আরও বলল, পুলিশ ডিপার্টমেন্টে নিজেদের লোক চাই তাদের। আমি কি চোখ রাখব রিগবির ওপরে? কথা শুনে চমকে গিয়েছিলাম। পানিতে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়ব কীভাবে? পরে ভাবলাম, দেশের উপকারের জন্যে মরে যেতেও দ্বিধা করব না। তখন থেকে নিয়মিত নজর রাখছি রিগবির ওপরে। এফবিআইকে দিচ্ছি জরুরি তথ্য।’

‘আর সেজন্যেই রিপার রিগবিকে অফিসে আমার সামনে ডেকে এনেছিলেন?’ বলল জ্যাকি।

মাথা দোলাল লিয়োনার্ড। জেনে নেয়া দরকার ছিল, আপনার কথা শুনে কেমন হয় তার প্রতিক্রিয়া। আর তারপর ভিডিয়ো দেখতে গিয়ে যে চেহারা করল, তাতে পেয়ে গেলাম নিরেট প্রমাণ। আমি এখন জানি, গোপনে অ্যারন কনারকে নানান ধরনের পুলিশি সহায়তা দিচ্ছে সে।’

‘আর আপনি ভাব করছেন যে তার দলেই আছেন?’

‘আশা করি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলার পর আরেকটু হলে বলে উঠতাম: এবার মুঠোর ভেতরে পেয়েছি কুকুরগুলোকে! আপনি কখনও চিফ অভ পুলিশের বাড়িটা দেখেছেন? পুলিশের বেতন দিয়ে কেনা যায় না এত বিলাসবহুল ভিলা।’

‘আপনি বলছেন মেয়র আর পুলিশের চিফ মেক্সিকোর ড্রাগ লর্ডদের কাছে অস্ত্রের চালান পাঠাচ্ছে?’

‘আমার মনে হয় না অস্ত্র চালানে সরাসরি জড়িত রিগবি। ক’দিন পর পর ব্যবসার জন্যে বিমানে করে সীমান্তের কাছে যাচ্ছে অ্যারন। কেউ যেন কিছু বলতে না পারে, সেজন্যে রিগবিকে ঘুষ দিচ্ছে সে। হিউবার্ট হ্যারল্ড হত্যা চাপা দেয়ার জন্যেও নিশ্চয়ই হাজার হাজার ডলার তার পকেটে গেছে। এ-ছাড়া, কনারের গোপন ওয়্যারহাউসে যেন পুলিশ রেইড না দেয়, সেটাও দেখে সে।’

‘কীসের ওয়্যারহাউস?’

‘অ্যারন কনারের অস্ত্রের বড় গুদাম আছে। এসব অস্ত্র সংগ্রহ করে প্রাক্তন মেজর বার্ব। আমরা শুধু এটা জানি, টুলসা কাউন্টিতে কোথাও আছে সেই গুদাম। ওটা থেকে বের করে ট্রাকে অস্ত্র তুলে রাজ্যের বাইরে নিয়ে যায় বার্ব, স্ক্যালেস ও তাদের দলের লুঠেরারা। টেক্সাসের দক্ষিণ দিয়ে ঢুকে চলে যায় মেক্সিকোর সীমান্তে। কার্টেলের হাতে তুলে দেয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। প্রতিবার নানান রুট ব্যবহার করে ট্রাকের বহর থামে আলাদা রদেভু পয়েন্টে। আমাদের পক্ষে এত বড় এলাকায় চোখ রাখা সম্ভব নয়। রিগবির জরুরি আরেক কাজ হচ্ছে ওকলাহোমা থেকে বেরোবার সময় ট্রাক- বহর যেন কোনভাবে থামানো না হয়, সেটা নিশ্চিত করা। এজন্যে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেয় সে। তার দলে আছে আরও অনেকে। নইলে সবকিছু গোপন থাকত না। ধরে নিতে পারেন, প্রচুর টাকায় পুলিশ অফিসারদের অনেকে বিক্রি হয়ে গেছে। প্রতি বছর আরও বাড়ছে দুর্নীতিপরায়ণ অফিসারের সংখ্যা। এফবিআই-এর ধারণা: রিপার রিগবির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে কমপক্ষে ত্রিশজন পুলিশ সদস্য। ক্রমেই আরও খারাপ হচ্ছে পরিস্থিতি। কনার এবার নেমেছে গভর্নর হওয়ার নির্বাচনে। যদি একবার নির্বাচিত হতে পারে, কে জানে, আরও কত বড় হবে তার সংগঠন। …কী হলো? ভুরু কুঁচকে কী ভাবছেন?’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে জ্যাকি। শুকনো গলায় বলল, ‘আমি পুলিশ চিফকে ফোন করে জানিয়েছি চিড়িয়াখানায় আছি। তখন বলল পাঠাবে দু’জন পুলিশ অফিসার। চিড়িয়াখানার গেটের কাছে দাঁড়িয়ে তাদের জন্যে অপেক্ষা করছি, এমন সময় মনে হলো আপনি খুনি বা কিডন্যাপার দলের কেউ। সেজন্যেই গাড়িতে উঠে পালিয়ে এসেছি।’

‘ঠিক কাজই করেছেন। সে আমাদেরকে এখানে খুঁজে পাবে না।

‘আপনি জানলেন কী করে যে কোথায় আছি আমি?’

‘আমি পিছু নিয়েছি আপনার বাড়ি থেকে।’

‘চোখ রেখেছিলেন আমার বাড়ির ওপরে?

মাথা দোলাল লিয়োনার্ড। ‘যখনই সম্ভব হয়েছে, সেটাই করেছি। তবে নিয়মিত ডিউটির জন্যে সবসময় তা পারিনি। তা ছাড়া, আপনার বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করলে সন্দেহ করত রিগবি। যাই হোক, কিডন্যাপার যখন হামলা করল আপনার ওপরে, তখন ওদিকে ছিলাম না। নইলে প্রথমেই তাকে গ্রেফতার করতাম। আমার কথা বিশ্বাস করুন, জ্যাকি। রিগবির কাজ শেষ করে আপনার বাড়ির কাছে ফিরে দেখি গাড়িতে উঠে পালিয়ে যাচ্ছেন আপনি। মনে হলো খারাপ কিছু হয়েছে। কিন্তু আসলে সেটা কী, তা জানতে গিয়ে আর সেখানে অপেক্ষা করিনি। আপনার পিছু নিয়ে বুঝলাম ঠিক কাজই করছি, আপনি আছেন বড় কোন বিপদে।’

‘যা-ই হোক, এখন তো পৌঁছে গেছেন,’ বলল জ্যাকি।

আপনার ওপরে যে-লোক হামলা করেছে, তার চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন?

‘বয়স চল্লিশ হবে। শ্বেতাঙ্গ। আপনার সমানই লম্বা। তবে বেশ মোটা। খুব বিশ্রী চেহারা।’

‘এই বর্ণনা অনেকের সঙ্গে মিলে যাবে। লোকটা হয়তো গ্রিন গ্রুমম্যান। ওদিকের এক মাঝবয়েসী লুটেরা।’

‘সহজেই তাকে চিনে নিতে পারবেন। আত্মরক্ষা করার জন্যে তার পায়ে গুলি করেছি আমি।

‘মাথায় গুলি করলে আরও সহজে তাকে পেতাম। নীচ মনের নোংরা বদমাশ গ্রিন ক্রমম্যান। সে হামলাকারী হয়ে থাকলে খুঁজে নিয়ে তার পেট থেকে সবই বের করব। হয়তো বহু কিছুই জানতে পারব অ্যারন কনারের ব্যাপারে।’

‘আর এদিকে আমার কী হবে?’ জানতে চাইল জ্যাকি। ‘আমার এখন কী করা উচিত?’

‘আপনি নিরাপদ নন। তাই এবার কথা বলব এফবিআই স্পেশাল এজেন্ট ববি হুকের সঙ্গে। রদেভু পয়েন্টে গিয়ে তার হাতে তুলে দেব আপনাকে। তার আগে আপনার নিরাপত্তার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছি আমি।’

‘ববি হুকের হাতে তুলে দেবেন মানে?’

‘এরপর সাক্ষীর নিরাপত্তার সব দায় নেবে এফবিআই।’

‘তার মানে নতুন পরিচয়ে নতুন এলাকায় চাকরি দেবে?’

‘ঠিকই ধরেছেন। আগেই আমার উচিত ছিল কাজটা করা। এরপর কোনভাবেই আপনাকে নাগালে পাবে না মেয়র কনার। আমি বেঁচে থাকলে আপনাকে আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে না।’

মৃদু মাথা দোলাল জ্যাকি। আর তখনই ওরা শুনতে পেল, পাতাল গ্যারাজের র‍্যাম্প বেয়ে নেমে আসছে দুটো গাড়ি। তিন সেকেণ্ড পর ওদের ওপরে এসে পড়ল তিনটে হেডলাইটের আলো।

‘এরই ভেতরে চলে এসেছে এফবিআই-এর লোক?’ বলল জ্যাকি।

‘না,’ শুকনো স্বরে জানাল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড। ‘এরা এফবিআই-এর লোক নয়!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *