কালবেলা – ২৫ (মাসুদ রানা)

পঁচিশ

দাউ-দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভিলার ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে মাসুদ রানা। নাক-মুখ দিয়ে ঢুকছে কালো ধোঁয়া। চোখের পানি আর ঘামের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে সারামুখ। ‘হঠাৎ রানা টের পেল, বিস্ফোরণের আঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠেছে চারপাশের দেয়াল ও মাথার ওপরের ছাত। আবারও ফাটল শক্তিশালী বোমা। ওটা সম্ভবত কোন গ্রেনেড। এর অর্থ কী, সেটা বুঝতে দেরি হলো না রানার। আগুনে ভরা বাড়ি ধসিয়ে দিচ্ছে খুনিরা। পুড়ে ছাই হওয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে এই বাড়ি থেকে।

ভিলার ভেতরে আছে গোলকধাঁধার মত সব প্যাসেজ। প্রতি ঘরে আছে পাশের কামরায় যাওয়ার দরজা। আগুনের তাড়া খেয়ে একেক দরজা পার হয়ে পরের কামরায় ঢুকছে রানা। এরই ভেতরে আগুন ধরেছে জানালাগুলোর পর্দায়। ছড়িয়ে পড়ছে অসহ্য তাপ। রানা ভাবতে শুরু করেছে, ভুল দিকে বাঁক নিয়ে নিশ্চিত করেছে নিজের মৃত্যু, এমন সময় বাড়ির পেছনে দেখতে পেল ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি। মনে মনে ওটাই খুঁজছিল রানা। লেলিহান আগুনে জ্বলছে সিঁড়ির প্রথম পাঁচ ধাপ। সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের বেগে উঠতে লাগল ও। কমলা শিখা পোড়াচ্ছে হাঁটুর গোছার পেশি ও গোড়ালির হাড়। ব্যথা পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে জ্বলন্ত ধাপ টপকে গেল রানা। বিকট এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। ছাত থেকে ঝরঝর করে ঝরল প্লাস্টার। দু’হাতে মাথা ঢেকে ওপরের দিকে ছুটল রানা।

পরের বিস্ফোরণ হলো আরও প্রচণ্ড। চমকে গিয়ে রানা ভাবল, হয়তো এ-বাড়ির ওপরে আকাশ থেকে ফেলা হচ্ছে ভারী বোমা! অন্ধকার সিঁড়িতে দুই সেকেণ্ডের জন্যে থমকে গেল রানা। ভয়ে শুকিয়ে গেছে গলা। যে-কোন সময়ে মাথার ওপরে নেমে আসবে বিধ্বস্ত ছাত!

ছুটে দোতলায় উঠে এল রানা। সামনের দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে বুঝতে পারল, আগুন জ্বলছে না ঘরের ভেতরে। শীতল হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে ঝড়ের বেগে ছায়াভরা ঘরে ঢুকল রানা। চোখ থেকে ঘাম ঝেড়ে চারপাশে চেয়ে দেখল, এটা বেডরুম হলেও ব্যবহার করা হতো গুদাম হিসেবে। এদিকে-ওদিকে বাক্স ও বইয়ের স্তূপ। ছোট এক জানালা দিয়ে দেখতে পেল উঠন ও আইভি লতায় ভরা প্রাচীর। জানালার সামনে গিয়ে থামতেই হু-হু করে এল শীতল হাওয়া। তাজা বাতাসে ভরে গেল রানার ফুসফুস। মুঠোয় শক্ত করে ধরল কাঁটাযুক্ত আইভি লতা, তারপর বেরিয়ে এল জানালা দিয়ে। নিজেকে দেয়াল বেয়ে চলা কোন মাকড়সা বলে মনে হলো ওর। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ঠিক দিকেই এসেছে। বিশফুট দূরে গেস্ট- হাউসের দোতলার বারান্দা। ওদিকের ঘরেই আছে ডায়েরি। একটু সময় লাগলেও আইভি লতা ধরে ঝুলতে ঝুলতে চলে যেতে পারবে বারান্দায়। বামে নিচে এক জানালা থেকে বেরোচ্ছে কমলা শিখা। এখন গেস্ট-হাউসে আগুন ধরে না গিয়ে থাকলেই বাঁচোয়া!

.

‘গুলি বন্ধ করো! অস্ত্র নামিয়ে বন্ধুর কাঁধ স্পর্শ করল লিয়াম বার্ব। আগুনে ভরা করিডরের ওদিকে হারিয়ে গেছে অচেনা যুবক।

বিরক্তি নিয়ে বন্ধুকে দেখল টনি স্ক্যালেস। ‘মনে হচ্ছে হারামজাদাকে চিনি। আয়ারল্যাণ্ডে মেয়েলোকটাকে খতম করার সময় আমাদের সঙ্গে লাগতে এসেছিল।’

‘হয়তো,’ বলল বার্ব।

থুহ্ করে মুখ থেকে নিকোটিন গাম ফেলল স্ক্যালেস। মুখের রক্তে লাল হয়ে গেছে গাম। ‘আরেকটু হলে আমার মাথা ফাটিয়ে দিত। জানি না শালা এখানে কী করছে। তবে আসল কথা হচ্ছে, হাতের কাছে পেলে আমি ওকে খুন করব।’

‘তুমি তো মেরিন ফোর্সের মেজর,’ বলল বার্ব। ‘তোমরা চিরকাল ধরেই ভয় পাও লড়তে গিয়ে। যাক গে, শুয়োরটাকে ওর মত মরতে দাও। চলো, বেরিয়ে যাই।’

ইনসেনডিয়ারি বুলেট লেগে জ্বলছে সদর দরজা। সামনে বেড়ে কমব্যাট বুট দিয়ে কবাটে লাথি বসাল মেজর বার্ব। ছয়টা লাথি দেয়ার পর খুলে গেল জ্বলন্ত দরজা। ছুটে বেরিয়ে গেল সে, পিছনে স্ক্যালেস। ঘুরে ভিলার দরজা-জানালা লক্ষ্য করে ষাট রাউণ্ড গুলি ছুঁড়ল তারা। নিচতলা ও দোতলার জানালা দিয়ে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া ও কমলা আগুন। হোলস্টারে অস্ত্র রেখে বেল্ট থেকে ইনসেনডিয়ারি গ্রেনেড নিয়ে ভাঙা এক জানালা দিয়ে ভেতরে ছুঁড়ল বার্ব। ঘুরে যে- যার মুখ ঢাকল তারা। তিন সেকেণ্ড পর থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। জানালা ও দরজা দিয়ে বেরোল তপ্ত দমকা হাওয়া।

‘আগুন দিতে আমার ভাল লাগে,’ বলল স্ক্যালেস। নিজেও বেল্ট থেকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ছুঁড়ল একটা গ্রেনেড। প্রচণ্ড আওয়াজে বিস্ফোরিত হলো ওটা। আবারও বাড়ির দিকে ফিরে তারা দেখল, লকলকে আগুনে পুড়ছে ভিলার সামনের দিক। একই কথা ভাবছে স্ক্যালেস ও বার্ব দ্বিতীয় প্ল্যান সবসময় মজাদার হয়। তার ওপরে তাদের বস বলে দিয়েছে, প্রফেসর কেলি ডায়েরি না দিলে যেন পুড়িয়ে দেয়া হয় তার বাড়ি।

এক পলক আগুনে ভরা বাড়ি দেখে নিয়ে অ্যাটলাস ক্রস স্পোর্টস কারের পাশে থামল বার্ব। গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে আছে কিছু কাগজপত্র। ওগুলো কার রেন্টাল ডকুমেন্ট। বেল্ট থেকে অ্যালিউমিনিয়ামের ভারী টর্চ নিয়ে ওটা দিয়ে গাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙল সে। রেন্টাল ডকুমেন্ট নিয়ে চট করে দেখল কার নামে ভাড়া নেয়া হয়েছে গাড়ি। লোকটার নাম মাসুদ রানা। আনমনে ভাবল বার্ব, মাসুদ রানা আবার কে!

কাঁচভাঙা গাড়ির ভেতরে কাগজ ছুঁড়ে ফেলল সে। স্ক্যালাসকে বলল, ‘ব্যাটাকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে।’

‘তুমি নিজেই শেষ করতে যাও না!’ রেগে গিয়ে বলল স্ক্যালাস। মাথা আর মুখের ব্যথায় বমি পাচ্ছে তার

আলাদা হয়ে ভিলার দু’দিকে চলল তারা

একটু পর স্ক্যালাস বুঝল, কারও সাধ্য নেই জ্বলন্ত ভিলার নরকে রয়ে যাবে। নিশ্চয়ই জ্যান্ত পুড়ে মরেছে মাসুদ রানা। যদিও কুকুরটার উচিত ছিল আরও অনেক বেশি কষ্ট পেয়ে মরা।

নিচতলার জানালা দিয়ে ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়া ও কমলা আগুনের শিখা। বেল্ট থেকে নিয়ে দোতলার অন্ধকার এক জানালা লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়ল স্ক্যালাস। চিরকাল নিখুঁত ছিল তার নিশানা। জানালার কাঁচ ভেঙে ভেতরে গিয়ে পড়েছে গ্রেনেড। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো বোমাটা। ভিলার দোতলায় দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে আগুন। একবার ওদিকে চেয়ে ছুটে চলল স্ক্যালাস। একহাতে উদ্যত সাবমেশিন গান কাম পিস্তল। আগুন থেকে কেউ বেরোলে দেরি করবে না তাকে গুলি করে ফেলে দিতে। অবশ্য বাড়িতে কোথাও নেই প্রাণের কোন ছোঁয়া।

কিছুটা যেতেই ভেন্টসহ কাঠের হাউসিঙে এক্সস্ট ফ্যান দেখতে পেল স্ক্যালাস। চট্ করে বুঝে গেল, ঘরটা ভিলার কিচেন। হাউসিঙের ভেতরে আছে বড় দুটো বিউট্যান বল্‌। ওগুলো দেখে খুশি হলো স্ক্যালাস। কয়েক গজ পিছিয়ে ব্লক থেকে দশটা গুলি করতেই বিস্ফোরিত হলো দুই বটল। আরেকটু হলে শক্তিশালী শকওয়েভের ধাক্কায় উড়ে গিয়ে চিত হয়ে মাটিতে পড়ত স্ক্যালাস। চারপাশে ছড়িয়ে গেছে গ্যাসের নীল আগুন। ওটার আওতা থেকে সরে যেতে গিয়ে হুড়মুড় করে পিছাল স্ক্যালাস। বাড়ির ছাত ছাপিয়ে উঠে গেছে গ্যাসের আগুন। লকলক করে চেটে দিচ্ছে ভিলার জানালা। আগেও অনেক বাড়িতে আগুন দিয়েছে স্ক্যালাস। ওর মনে হলো না যে এখন আর ভিলার ভেতরের দাবানলে বেঁচে আছে কেউ।

দু’বছর আগে মেরিন ফোর্স ত্যাগ করার পর থেকেই ফুর্তিতে আছে স্ক্যালাস। আগে যদি জানত অপরাধীর জীবন এত আনন্দের, তো কখনও চাকরি করতেই যেত না। আবার দৌড় শুরু করল সে। ভিলার পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে ভেতরে ছুঁড়ে দিল দুটো গ্রেনেড। বাড়ি ঘুরে ফিরে আসতেই দেখতে পেল দাঁড়িয়ে আছে ওর বন্ধু।

‘বিস্ফোরণটা কীসের?’ তার কাছে জানতে চাইল বার্ব।

‘বিউট্যান বল্‌,’ বলল স্ক্যালাস, ‘ফোর্ট ক্যাম্পবেলে তোমাদেরকে বোধহয় কিছুই শেখায় না, নাকি?’

‘আরেকটু হলে আমার গায়ে শত শত শাপনেল বিধতা’ রেগে গেল বার্ব। ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?’

‘তা হলে বলো, কে আসলে ভয় পেয়েছে?’ মুচকি হাসল স্ক্যানাস। সে আরও কিছু বলার আগেই হুড়মুড় করে অ্যাটলাস ক্রস স্পোর্টস কারের উইগুশিল্ডের ওপরে ধসে পড়ল বাড়ির জ্বলন্ত একটা অংশ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে আগুন গিলে নিল গাড়িটাকে।

‘কাজ শেষ,’ বলল স্ক্যালাস, ‘চলো, বিদায় নিই।’

আরও কয়েক সেকেণ্ড ভিলার দিকে চেয়ে থেকে বলল বার্ব, ‘আসলে কে ছিল লোকটা?’

কে ছিল সেটা জেনে আর লাভ কী?’ বলল স্ক্যালাস। ‘বড় কথা হচ্ছে: শালা কাবাব হয়ে গেছে!’

জ্বলন্ত ভিলার দিকে চেয়ে হঠাৎ করে শ্বাস নিল বার্ব। ‘ওই যে! আবারও সেই শালা!’

.

দেয়ালে পা রেখে সরে যাচ্ছে রানা। মনে মনে আশা করছে পাথুরে দেয়াল থেকে উপড়ে আসবে না আইভি লতা। মিনিটখানেক পর পৌছে গেল ব্যালকনির কাছে। কিন্তু তখনই শুনতে পেল একলোকের চিৎকার। ঘাড় ঘুরিয়ে উঠনে চেয়ে গলা ও বুক শুকিয়ে গেল রানার। উঠন থেকে ওর দিকে অস্ত্র তাক করছে মুখোশধারী দুই খুনি!

মাথার পাশের দেয়ালে ঠক-ঠক করে দুটো বুলেট লাগতেই ব্যস্ত হয়ে উঠল রানা। ঝড়ের বেগে বারান্দার দিকে পেরিয়ে গেল শেষ একফুট জায়গা। পাথুরে রেইলিং টপকে চট্ করে আড়াল নিল এক পিলারের ওদিকে। পাথরে লেগে ঠং-ঠং শব্দে ছিটকে পড়ছে বুলেট। লাথি মেরে ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল রানা। চমকে গেল ভেতরে আগুন দেখে। নরকের মত হয়ে গেছে ঘরের পরিবেশ। ধোঁয়ায় শ্বাস আটকে এল। বিছানার কাছে গিয়ে চোখে পড়ল মেঝেতে আছে জ্যাকেট ও ব্যাগ। ছোঁ দিয়ে তুলে নিল ওগুলো। জ্বলছে বিছানার চার স্ট্যাণ্ড ও দামি পর্দা। কিছু শিখা চাটছে বিছানায় রাখা একটা ডায়েরি। খপ করে ওটা নিয়ে বিছানায় আছড়ে আগুন নিভিয়ে নিল রানা। ধোঁয়ার ভেতরে কাশতে কাশতে ব্যাগে ভরল ডায়েরি। যেজন্যে এসেছে, সেই কাজ করা শেষ। এবার বেরিয়ে যেতে হবে এই ঘর থেকে।

জানালা-পথে ঢুকে ছাতে ঠাস্ ঠাস্ করে লাগছে বুলেট। বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। শেষ ভরসা বাথরুমের জানালা। বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল প্রায় অন্ধ রানা। হাতড়ে হাতড়ে রেইল থেকে নিল তোয়ালে। কল খুলে পানি দিয়ে ওটা ভিজিয়ে পেঁচিয়ে নিল নাকে-মুখে। বুঝে গেল বেরোবার তুলনায় বাথরুমের জানালা অনেক ছোট। আবার এসে ঢুকল বেডরুমে। দাউ-দাউ করে জ্বলছে পুরো খাট। কার্পেটে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আগুনের শিখা। ঘরের দরজা লক্ষ্য করে সামনে বাড়ছে তরল আগুনের ঢেউ, যেন জীবিত বিপজ্জনক প্রাণী। শিখা মাড়িয়ে দরজার দিকে ছুটল রানা। কবাট খুলে বেরিয়ে এল করিডরে। কিন্তু প্যাসেজের দু’দিকে নর্তকীর মত নেচে চলেছে আগুনের হলদে ঢেউ।

মরণফাঁদে পড়েছে রানা। যেতে পারবে না কোনদিকেই। অবশ্য, হয়তো সরাসরি ওঠা যাবে ছাতে। ওপরের দড়ি টেনে হ্যাচ নিচে নামাল রানা। ট্র্যাপডোরের সঙ্গে নেমে এসেছে টেলিস্কোপ ল্যাডার। লোহার রেইলিং স্পর্শ করে চমকে গেল রানা। ওটা যেন তাতানো খুন্তি। ধাপ ডিঙিয়ে অন্ধকার চিলেকোঠায় উঠে এল ও তক্তা দিয়ে। তরি ঘরের মেঝে। দড়ি টেনে কাঠের মই তুলে ট্র্যাপডোর লক করল। বুঝে গেছে, আপাতত রক্ষা পেয়েছে আগুনের হলকা থেকে।

অবশ্য শেষমেশ কাঠে ঠিকই ধরবে আগুন। মেঝের তক্তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে হলদে আভা। ক্রমে ঘন ধোঁয়ায় ভরে উঠছে চিলেকোঠা। ওপরের এই ঘরে আছে ভাঙা আলনা, প্যাকিং ক্রেট, কাঠের টুকরো, পুরনো রকিং চেয়ার ইত্যাদি। ধোঁয়ায় ফুসফুস ভরে যাওয়ায় মাতালের মত টলতে শুরু করেছে রানা। তাজা বাতাস না পেলে যে-কোন সময়ে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়বে। লক্ষ করল চিলেকোঠার ছাত বেশ নিচু। স্পর্শ করা যায় সহজেই। ছাত হাতড়ে স্কাই লাইট খুঁজল রানা। কিন্তু একটু পর বুঝল, ছাতে তেমন ধরনের কোন কিছুই নেই। অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করছে ফুসফুস। কপাল বেয়ে নেমে দু’চোখ জ্বালিয়ে দিচ্ছে নোনা ঘাম। বড়জোর আর একমিনিট, তারপর জ্ঞান হারাবে রানা। এবং সেক্ষেত্রে আজই একটু পর শেষ হবে ওর জীবন!

ঝুঁকে মেঝে হাতড়ে চারফুট দৈর্ঘ্য ও সমান প্রশস্তের এক কাঠের মাচা হাতে ঠেকল রানার। ওটা নিজের দিকে টেনে নিতে গিয়ে বুঝে গেল, ফুরিয়ে যাচ্ছে ওর শক্তি। অক্সিজেনের অভাবে সাড়া দিচ্ছে না পেশি। ভারী মাচা তুলে ছাতে গুঁতো দিতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল রানা। আরেকটু হলে তাল হারিয়ে হুড়মুড় করে পড়ত মেঝেতে। ছাতে গুঁতো দিয়ে কোন লাভ হয়নি। দাঁতে দাঁত চেপে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবারও মাস ঠেলে দিল ছাত্র লক্ষ্য করে। তাতে খটাস্ করে ছুটে গেল কী যেন।

ওপরে চেয়ে ছাতে সরু এক ফাটল দেখল রানা। ওখান থেকে মেঝেতে খসে পড়েছে একটা টাইল্স্। আর হঠাৎ সেই পথে ঢুকেছে একরাশ তাজা বাতাস। আবারও বুক ভরে শ্বাস নিতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রানা। নতুন করে দেহে ফিরছে শক্তি। কয়েক সেকেণ্ড পর সর্বশক্তি দিয়ে ছাতের দিকে মাচা ঠেলল রানা। কড়াৎ শব্দে ছাত ভেঙে বেরিয়ে গেল মাচার একদিক। ঝরঝর করে মেঝেতে পড়ল একগাদা টাইল্স্। মাথার ওপরে এখন এবড়োখেবড়ো বড় একটা গর্ত। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে হাত থেকে মাচা ছেড়ে দিল রানা। ধুপ করে মেঝেতে পড়ল ওটা। গর্তের কিনারা ধরে নিজেকে ছাতে টেনে তুলল রানা। সামান্য এই কাজেই হাঁফিয়ে গেছে। ঘন ঘন ক’বার শ্বাস নেয়ার পর ধীরে ধীরে বিদায় হলো বুকের ব্যথা। নিজের সঙ্গে ব্যাগ এনেছে রানা। ওটা তুলে নিয়ে ঢালু ছাত ধরে এগোল। বামহাতে কচলে নিল জ্বালা ধরা দু’চোখ। ঘুরে দেখল, আগ্নেয়গিরির মত জ্বলছে গোটা ভিলা। রাতের আকাশে বহু দূর থেকে দেখা যাবে এই আগুন।

রানার চোখে পড়ল, প্রাচীরের ছায়ার দিকে ছুটে চলেছে মুখোশ পরা দু’জন লোক। বোধহয় কাছেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে তাদের গাড়ি। দূর থেকে আবছাভাবে এল সাইরেনের আওয়াজ। গ্রামের কেউ রাতের পটভূমিতে কমলা আভা দেখে যোগাযোগ করেছে ইমার্জেন্সি সার্ভিসে। যে-কোন সময়ে পুলিশ আসবে ভেবে এখন পালিয়ে যাচ্ছে দুই আততায়ী।

রানা নিজেও চাইছে না পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিতে। প্রথম সুযোগে ছাত থেকে নেমে উধাও হবে, নইলে ওকেই হয়তো অগ্নিকাণ্ডের জন্যে অপরাধী সাব্যস্ত করবে পুলিশ। টাইলসে পিছলে গেলে অনেক নিচে গিয়ে পড়তে হবে। সাবধানে ঢালু ছাত ধরে এগোল রানা।

কয়েক কদম যেতেই হঠাৎ করে এল প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। নিচে ফেটে গেছে গ্যাসের মোটা কোন পাইপ। লকলক করে উঠে এল লেলিহান আগুন ও তপ্ত হাওয়া। রানার পায়ের নিচে ঠাস্ ঠাস্ করে ফাটল টাইল্স্। শকওয়েভের জোর ধাক্কায় শূন্যে উঠে ধুপ করে ছাতে পড়ল রানা। পরক্ষণে ঢাল বেয়ে পিছলে নেমে যেতে লাগল। রানার জ্যাকেটের বাম কবজিতে ধরে গেছে আগুন। পতন ঠেকাতে গিয়ে হাত থেকে ছেড়ে দিল ব্যাগ। ঢালু ছাতের শেষপ্রান্তে পৌঁছে দেখতে পেল মোটা একটা পাইপ। দু’হাতে ওটা জাপটে ধরল রানা। কিন্তু ওর ওজন নিতে না পেরে মট করে ভাঙল কাঁচা লোহার পাইপ। চার হাত-পা ছড়িয়ে শুরু হলো ওর পতন।

প্যারাশ্যুট ড্রপের মতই শরীর গুটিয়ে নিয়েছে রানা। নিচে ক্যানভাসের ছাউনিতে পড়েই দেখল ঝড়ের বেগে উঠে আসছে জমিন! ভিলার আগুনের আলোয় ওটা প্যাটিয়ো না কংক্রিটের চাতাল, বুঝতে পারল না। পরক্ষণে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে বুক থেকে বেরিয়ে গেল দম। অবশ্য পড়েছে স্পঞ্জের মত কিছুর ওপরে। হঠাৎ চারপাশে আগুনের বদলে থাকল ভেজা কী যেন!

কয়েক সেকেণ্ড পর রানা টের পেল, কংক্রিটে না পড়ে ঝপ্ করে নেমে এসেছে প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে ঢাকা অব্যবহৃত সুইমিংপুলে। শরীরে কাভার জড়িয়ে নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর পানিতে!

নিভে গেছে জ্যাকেটের কবজির আগুন। ওর মনে চেপে বসল মৃত্যুভয়। প্লাস্টিক মোড়ক থেকে ঝটকা দিয়ে বেরোতে চাইলেও দেহের দু’পাশে আটকা পড়েছে ওর দু’হাত। মোড়কে জড়িয়ে আছে দু’পা, লাথি মেরেও সরাতে পারল না কাভার। এরই ভেতরে গিলে নিয়েছে কয়েক ঢোক পানি। দুই কনুই দিয়ে পানির নিচে আবারও ঝটকা দিল রানা। তাতে হাতের ওপর থেকে খসখস শব্দে সরতে লাগল কাভার। ওর আঙুল খপ করে ধরল কী যেন। ওটা সুইমিংপুলের কাভার বেঁধে রাখার দড়ি। রানা আশা করল, শক্ত ভাবে বাঁধা আছে ওটার অন্যপ্রান্ত। দড়ি ধরে নিজেকে টেনে তুলতেই গা থেকে সরে যাচ্ছে প্লাস্টিকের কাভার। একটু পর হঠাৎ ছুটে গেল ওর বামহাত ও দু’পা। দড়ি টেনে সুইমিংপুলের টাইলস করা কিনারায় নিজেকে তুলে নিল রানা। চোখের সামনে দেখতে পেল করুণ গোঙানি ছেড়ে ধসে পড়ল ভিলার দোতলার জ্বলন্ত ছাত। রাতের আঁধার আকাশে ছিটকে গেল হাজার লাল-কমলা-হলদে ফুলকি। আগুনের টুকরো পড়ে দপ করে জ্বলে উঠল প্যাটিয়োর প্লাস্টিকের ছাউনি-একটু পর গলে নামবে কংক্রিট চাতালে। একটু দূরে নিজের ব্যাগ দেখতে পেয়ে চট করে ওটা সরিয়ে নিল রানা, নইলে ব্যাগসহ পুড়ে ছাই হতো লেডির ডায়েরি।

জ্বলন্ত ভিলা থেকে সরে গেল রানা। শীতে কাঁপতে শুরু করেছে ভেজা পোশাকে। মৃত্যুফাঁদ থেকে বেরিয়ে হতক্লান্ত উঠে দাঁড়িয়ে চলে গেল উঠনের কিনারায় ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতরে। প্রাচীরের সামনে থেমে ওদিকে ছুঁড়ে দিল ব্যাগ। দেয়ালের অমসৃণ পাথর বেয়ে উঠে চট করে নেমে পড়ল প্রাচীরের এপাশে।

কাছে চলে এসেছে পুলিশ ও ফায়ার ব্রিগেডের সাইরেন। প্রাচীরের ওপর থেকে জঙ্গুলে পথে ঘুরন্ত আলো দেখেছে রানা। লোকগুলো চলে আসার আগেই ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। গাছের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেল টানা দু’মাইল। তারপর ব্যাগ থেকে নিয়ে পাল্টে ফেলল পোশাক। পানি চিপে গায়ে পরে নিল জ্যাকেট। রাতের শীতল হাওয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে ওকে। অবশ্য দ্রুত হাঁটলে একটু পর এত ঠাণ্ডা লাগবে না। ভেজা বুটের ব্যাপারে কিছু করার নেই। শব্দ তুলছে ফচ ফচ। অস্বস্তি নিয়ে আঁধারে এগিয়ে চলল রানা। ওর জানা নেই লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি থেকে জরুরি কোন সূত্র পাবে কি না। অবশ্য এ-ও ঠিক, মেডেইরায় এসে বেশকিছু বিষয় জানতে পেরেছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বহু দূরে চলে গেছে পেশাদার দুই আমেরিকান খুনি। এবার হয়তো ফিরবে নিজেদের দেশে। দু’জনেই মিলিটারি থেকে প্রশিক্ষিত, স্পেশাল ফোর্সের, নইলে এত দক্ষতা অর্জন করতে পারত না।

আগেও এদের মত মানুষকে পচে যেতে দেখেছে রানা। যদিও দল ত্যাগের আগেই বোঝা গেছে, যে-কোন সময়ে চরম কোন অন্যায় করবে লোকটা। কেউ লাখ লাখ ডলার পেয়ে হয়ে উঠেছে পেশাদার খুনি, আবার কেউ খুন করেছে স্রেফ মজার জন্যে। রানার মনে পড়ল বেলা-হত্যায় ব্যবহৃত কা-বার নাইফের কথা। কয়েক দশক ধরে ওটা ইউএস মেরিন ফোর্সের সৈনিকদের প্রিয় ছোরা। নিজেও ক’বার সেই বাহিনীর হয়ে বিপজ্জনক কিছু মিশনে গেছে রানা। ওর মনে হলো, দুই খুনির মধ্যে পনিটেইল আসলে ছিল মেরিন ফোর্সে।

এরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে গেছে অস্ত্র। টাকা ছাড়া দুনিয়ায় কিছুই হয় না। সুতরাং ধরে নেয়া যায় অস্ত্র কিনে সেটা গোপনে পাচার করা এবং পেশাদার আততায়ী নিয়োগে ব্যয় হয়েছে কয়েক যাখ ডলার। অর্থাৎ যে এসব করাচ্ছে, তার আছে অঢেল টান। বেলার ল্যাপটপে ছিল প্রফেসর কেলির কাছে দেয়া ই-মেইল। ওটা থেকেই লোকটা বোধহয় জেনে গেছে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরির অস্তিত্ব। সে ধরে নিয়েছে এসব ডায়েরি তার জন্যে খুব বিপজ্জনক। তাই দেরি না করে পাঠিয়ে দিয়েছে দুই আততায়ীকে।

আসলে কেন কী ঘটছে তা জানা না থাকলেও রানার মন বলছে: এসবের সঙ্গে জড়িত রহস্যময় সেই বায়ার্ন কনার!

মনে ঠাণ্ডা ক্রোধ নিয়ে জঙ্গলে হেঁটে চলল রানা। ভোরে পুবের আকাশে সূর্য উঠতেই স্থির করল, আজই ত্যাগ করবে এই দ্বীপ।

অদৃশ্য এক তর্জনী যেন ওকে দেখিয়ে দিচ্ছে টুলসা শহর।

ছাব্বিশ

টুলসা, ওকলাহোমা।

ঘড়িতে বাজে সকাল নয়টা।

‘আমার চুল পরিপাটি আছে তো?’ সহকারিণী মাটিল্ডার দিকে তাকাল অ্যারন কনার। নিজের ছোট্ট অফিস তার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে ফ্যাক্টরির ম্যানেজার। আপাতত ঘরটা ব্যবহার করা হচ্ছে মেয়রের ড্রেসিংরুম হিসেবে। কনারের আরও চার কম। এখন ঘরে ব্যস্ত। একটু পর পর হাতঘড়ি দেখছে ম্যাক জোভান। এদিকে শেষবারের মত মেয়রের জন্যে বক্তৃতার খসড়া রীক্ষা করে দেখছে টেরেসা ব্রুকস।

চড়ুই পাখির মত চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কথা বলে মাটিল্ডা টেস, বয়স চৌষট্টি। মেয়রের সেক্রেটারি ও রাজনৈতিক সংগঠক সে। অ্যারন কনারের কপাল থেকে কয়েকটা ধূসর চুল সরিয়ে দিল। মেয়রের প্রতিটি দিকে খেয়াল আছে তার। ‘পেছনের চুল একটু হেঁটে দিতে হবে।’

‘আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে, মাটিল্ডা?’ নার্ভাস হয়ে জিজ্ঞেস করল অ্যারন কনার। সাধারণ বক্তৃতা হলে হাসতে হাসতে বক্তব্য দিত, কিন্তু আজকের ব্যাপার অন্যরকম। তাকে যেন ভাল দেখায়, সেজন্যে স্পারসহ নতুন একজোড়া চামড়ার কাউবয় বুট কিনেছে। বরাবরের মত গলায় ঝুলছে পানারঙের সজ টাই। এটাকে ঠিক জায়গায় রেখেছে সোনা ও হীরার পঞ্চাশ হাজার ডলারের দামি এক টিফানির টাইপিন।

‘আপনাকে দারুণ লাগছে,’ মায়ের আদর ঝরল মাটিল্ডার কণ্ঠ থেকে। গত আট বছরে রীতিমত ঝগড়া করে অ্যারনের ওয়ার্ড্রোবের সব পোশাক বদলে দিয়েছে সে। এখন যা আছে, প্রতিটি দুর্দান্ত রুচিকর ও দামের দিক থেকে দুর্মূল্য।

তোমাকে নির্বোধ গাধার মত দেখাচ্ছে, এবার ফালতু চুলের কথা বাদ দিয়ে বেরিয়ে এসে __ ওঠো!’ ঘরের দরজা থেকে ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল কেউ। থরথর করে কেঁপে উঠেছে চারদিকের দেয়াল। হাজির হয়ে গেছে বিগ রিয়ান কনার। মাথাভরা সাদা চুল। দৈর্ঘ্যে ছয়ফুট তিন ইঞ্চি। দু’কাঁধ যেন বাইসনের কাঁধের মত চওড়া। দৈর্ঘ্যে সে ছেলের চেয়ে পুরো পাঁচ ইঞ্চি বেশি।

চট করে নার্ভাস চোখে বাবাকে দেখল অ্যারন। তার নিজের কর্মচারীর সামনে বহু দিন ধরে অপমানজনক সব কথা বলছে রিয়ান কনার। আর সেটা অসহ্য লাগে অ্যারনের। যদিও, কখনও মুখে কিছু বলার সাহস হয়নি তার। ছোটবেলায় বুঝে গেছে, তর্ক করতে নেই বিগ কনারের সঙ্গে। নইলে এক ঘুষিতে কাটিয়ে দেবে সামনের লোকটার চোষাল।

‘আমি তৈরি,’ মাটিল্ডার দিকে তাকাল অ্যারন। ‘এবার শেষ করা যাক জরুরি বক্তৃতা।’

আর টুলসা শহরের অক্স বিজনেস সেণ্টারের সবচেয়ে বড় অ্যাওনোস্পেস প্ল্যান্ট পার্কস ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বারো শ’ কর্মচারীর সামনে নিজের বক্তব্য তুলে ধরবে অ্যারন কনার। এই কোম্পানি গালফস্ট্রিম জি০০ জেট বিমানের ডানা ও ফিউজেলাজ তৈরি করে। ফ্যাক্টরির শেষমাথায় মস্ত এক ওয়্যারহাউসে মঞ্চ। একটু দূরে গানট্রির পরে ঝুলছে প্রায় তৈরি সব ফিউজেলাজ।

ওয়্যারহাউসের ভেতরে দমবন্ধ ভাগসা পরিবেশ। নিজেকে শান্ত রেখে পডিয়ামে উঠে গেল অ্যারন কনার। তাকে দেখে হৈ-হৈ করে প্রশংসা করল ফ্যাক্টরি কর্মচারীরা। এদিকের এলাকায় মেয়র কন্যার খুব জনপ্রিয়। আর সেজন্যেই নিজের বক্তৃতা এখানে দেবে বলে স্থির করেছে সে। কর্মীদের সবার শার্টের কলার নীল। তাদের ভেতরে নেই কোন মহিলা। দু’চারজন কালোমানুষ ছাড়া অন্যরা শ্বেতাঙ্গ। রাজনৈতিক দিক থেকে সবাই রিপাবলিকান। এ-ধরনের শ্রোতাই পছন্দ করে অ্যারন। টাইপিন ঢিলা করেছে সে। পরনে কোট নেই। কনুইয়ে গুটিয়ে নেয়া দামি শার্টের আস্তিন। এসব দেখে আরও খুশি হবে কর্মীরা।

দর্শক-শ্রোতার প্রশংসার ঝড় কমে এলে মুখ খুলল অ্যারন কার: ‘ভাই সকল, কী খবর তোমাদের?’ তাদের জন্যে স্থানীয় অর্থনীতি কত উপকৃত হচ্ছে, সেটা দু’চার কথায় জানাল সে। এ-ও বলল, তাদের মাঝে আজ এখানে হাজির হতে পেরে কত খুশি সে। মাত্র কয়েকটা কথা বলে অ্যারন বুঝে গেল, এরা এখনও তার পক্ষেই আছে।

‘তোমরা জানো, ভাই সকল, আমি যখন কোর্ট হাউসে কাজ করতাম, তখনও কথা বলতে গিয়ে বেশি সময় নিতাম না। তাতে খুশি হত জুরিরা। কারও দেরি হতো না বাড়িতে ফিরে যেতে। কাজেই আজও বেশিক্ষণ তোমাদেরকে আটকে রাখ না। তোমরা তো জানো, আমি চাইলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বকবক করে যেতে পারতাম। বলতাম মেয়র হিসেবে আমার সময়ে কত ধরনের উন্নতি করেছি এই সমাজ আর শহরের জন্যে। এটাও বুঝিয়ে দিতাম যে আমার সময়ে অনেক কমে গেছে টুলসায় হাজার রকমের অপরাধ। আমরা চাঙ্গা করেছি এ-শহরের অর্থনীতি। তোমাদের জন্যে টুলসার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছি আমি। বিশেষ করে অ্যাওরোস্পেস সেক্টরে আমার সহায়তায় তোমরা করেছ বিশাল এক অগ্রগতি। একই সময়ে আমরা করে গেছি শহরের এবং চারপাশের প্রকৃতির উন্নয়ন। আমার মনে আছে, কীভাবে টর্নেডোর পর ঝড়ের বেগে নতুন করে নব্বুই হাজার টুলসানের জন্যে ব্যবস্থা করেছি বিদ্যুৎ এবং বাসস্থানের। তোমরা জানো, কত কঠিন ছিল সেই বিপর্যয়।

সবার ওপরে চোখ বুলিয়ে অ্যারনের মনে হলো না কেউ তার কথায় অমনোযোগী।

‘কিন্তু তোমাদের কাছে আজ একগাদা ডেটা বা সংখ্যা : উগলে দেয়ার জন্যে আমি আসিনি, জোর দিয়ে বলল সে। ‘তোমরা ভাল করেই জানো, গত এই আট বছরে তোমাদের ছেলেমেয়ে ও নাতিপুতিদের জন্যে আগের চেয়ে অনেক বেশি বাসযোগ্য করে তুলেছি এই শহর। নিজেরাও সেটা অন্তর দিয়ে বুঝতে পারো তোমরা। আর আমার সৌভাগ্য, তোমাদের সঙ্গে এই আনন্দ আমিও ভাগ করে নিতে পেরেছি। তোমরা আমাকে বিশ্বাস করে, সহায়তা দিয়ে আজ প্রায় স্বর্গের মত এক জায়গা করে দিয়েছ টুলসা শহরটাকে। এবং সেজন্যে আমার তরফ থেকে হাজার হাজার সালাম ও ধন্যবাদ তোমাদেরকে।’

বিকট আওয়াজে গর্জে উঠে ওয়্যারহাউস কাঁপিয়ে দিল হাজারখানেক কর্মী। বেশ কিছুক্ষণ লাগল সমর্থনের হুঙ্কার কমে আসতে।

‘এই শহর আর এই শহরের নাগরিকদের জন্যে আমি গর্বিত,’ আবার শুরু করল অ্যারন। ‘তবে গত দুই নির্বাচনেই শেষ হয়ে যায়নি আমার দায়িত্ব। আজ যদি তোমরা আমাকে আবারও নির্বাচিত করো, এটাও ধরে নিয়ো যে টুলসা হবে ওকলাহোমা স্টেটের সেরা এলাকা। আর সেজন্যে এবার মেয়র নয়, আমি নির্বাচন করব গভর্নর হিসেবে। আমি এটা জানি, আমরা চাইলে এই রাজা গড়ে তুলতে পারি স্বর্গের মত করে। আমার এখন শুধু চাই তোমাদের আন্তরিক সহায়তা। তবেই তোমরা দেখবে আগামী নভেম্বর মাসে তোমাদের ভোটে আমি হয়ে উঠেছি গর্ভনর।’

হৈ-হৈ করে উঠল শত শত কর্মী। উল্লাসের প্রচণ্ড এক আওয়াজ হলো ওয়্যারহাউসে।

টুলসার মেয়রের তরফ থেকে এই ধরনের বার্তা আসবে, সেটা অবিশ্বাস্য ছিল না। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই বিষয়ে গু ছড়িয়ে গিয়েছিল শহরে। অবশ্য আজ জানিয়ে দেয়া হলো, সামনের নির্বাচনে গভর্নর হওয়ার লড়াইয়ে অংশ নিচ্ছেন মেয়র অ্যারন কনার।

মৃদু হাসিমুখে দর্শকদের ওপরে চোখ বোলাল মেয়র। ‘ভাই সকল, তোমরা জানো, আমি রুপার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয়ে উঠিনি। মৃদু হাসল অ্যারন। নভেম্বরে ধনা ব্যবস্থানি ল্যামারের সঙ্গে যে প্রতিযোগিতা হবে, সেজন্যে তাকে খোঁচা দিয়েছে সে। বাবার কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার পেয়ে ধনী লোকটি চাইছে দেশজুড়ে কোন আগ্নেয়াস্ত্র যেন আর বিক্রি না করা হয়। সেই সঙ্গে চাইছে তাদের আইনগত অধিকার যেন আদায় করতে পারে সমকামীরা: ‘আমি বহু বছরের পুরনো আইরিশ সংস্কৃতির মানুষ, বলল অ্যারন। ‘তাই আমি চাই না হঠাৎ করে বদলে যাক আমাদের সমাজ।’ থুতনি ওপরে তুলল সে। ‘আমি কাজ করতে চাই সাধারণ কর্মীর জন্যে। তোমরা হৃদয়ে বহন করো আমার মতই শত শত বছরের ঐতিহ্য। আজ থেকে শত বছর আগে আমার বড়আব্বা বায়ার্ন কনার এসেছিলেন আয়ারল্যাণ্ডের গ্লেনফেল গ্রাম থেকে। তখন তিনি ছিলেন উদ্বাস্তু। একটা ডলারও ছিল না তাঁর পকেটে। দু’হাতে শক্তি আর পেটে খিদে নিয়ে লড়াই শুরু করেন তিনি।

বহুবার বক্তৃতা এবং সাক্ষাৎকারে এ-কথাই বলেছে অ্যারন কনার। কথাগুলো গপ করে গেলে শ্রোতা-দর্শকেরা। কখনও ব্যাক ফায়ার করেনি ওটা।

‘আমার বড়আব্বা জানতেন দারিদ্র্য ও চরম খিদে কতটা কষ্টের,’ গম্ভীর মুখে নাটকীয়ভাবে বলল অ্যারন। ‘মনে কোন সন্দেহ রেখো না, হাত থেকে শিকল ছুঁড়ে ফেলে তিনি এসেছিলেন স্বাধীন এক রাজ্যে। তিনি যখন এ-এলাকায় পা রাখেন, তখন ওকলাহোমা নামের কোন রাজ্য ছিল না। এরপর তিনি, আমার দাদা আর আমার বাবার মত মানুষেরা মিলে গড়ে তুলেছে এই ওকলাহোমা। আজ গোটা আমেরিকায় সেরা জায়গা হয়ে উঠেছে এ-এলাকা। আর আমি চাই, এটা যেন স্বর্গের মতই থাকে।’

প্রশংসার ঝড় বইল শ্রোতাদের ভেতরে। মাইকে এবার বলল অ্যারন, ‘এবার কয়েকটা কথা জানাবে বলে মঞ্চে এসো, আমার প্রিয় বাবা!’

বুড়ো কনার মঞ্চে উঠতেই খুশি হয়ে চিৎকার ছাড়ল শ্রোতারা। পডিয়ামে এসে দাঁড়াল দানব। তার ভেতরে দৈহিক কোন আড়ষ্টতা নেই। বড় করে পেট ভরে দম নিয়ে মাইকে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বলল, ‘অ্যাই, আমার ছেলেকে নির্বাচিত করতে ভুল করবে না তোমরা! আমার কথা বুঝতে পেরেছ? ওর চেয়ে যোগ্য আর কেউ আপাতত এই দেশে নেই।’

খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল কর্মীরা। যাইক ছেড়ে ধীর পায়ে পডিয়াম থেকে পেছনের স্টেজে গেল রিয়ান কনার।

খুশিমনে মাইকে অ্যারন বলল, ‘ওই লোক কিন্তু আমার বাবা, বুঝতেই পারছ। অষ্টাশি বছর বয়স হলেও মনে হয় না যে বুড়ো হয়ে গেছেন। আর তা থেকে বুঝতে পারি, আমিও আগামী বহু বছর তোমাদের জন্যে কাজ করে যেতে পারব। তোমরা কী বলো?’

আগের চেয়ে জোরে হাততালি দিল সবাই।

অ্যারন গভর্নর হবে সেটা ভেবে খুশি হয়ে উঠেছে কর্মীরা।

হাসিমুখে ওয়্যারহাউস থেকে বের হলো অ্যারন। আগেই বেরিয়ে গেছে তার বাবা।

‘এবার সল্টারকে খবর দিতে হবে, রোদে বেরিয়ে মাটিল্ডাকে বলল অ্যারন। গত কয়েক সপ্তাহ আগে জনি এফ. সল্টারকে ক্যাম্পেইন ম্যানেজার করেছে সে। কনারকে ভোট দেয়ার ব্যাপারে মিডিয়াকে আগ্রহী করে তুলছে লোকটা।

‘শুরু হলো খেলা,’ বলল অ্যারন। ‘আমরা জানিয়ে দিলাম যে নির্বাচনে আমরা থাকছি। সুতরাং এখন আর কোন সুযোগ নেই ল্যামারের। নভেম্বরে গো হেরে বাড়িতে বসে কাঁদবে সে।’ নিজের গাড়ির কাছে পৌঁছে মনের চোখে অ্যারন দেখল ওকলাহোমা সিটির ৮২০ এনই ২৩ স্ট্রিটের গভর্নর ম্যানসন।

এবার আর আমাদেরকে ঠেকাতে পারবে না কেউ, বলল মাটিল্ডা, ‘তবে কথা হচ্ছে, নির্বাচন করার আগে সব ধরনের খরচ আপনি মেটাতে পারবেন কি না।’

পার্কল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সামনে গালফস্ট্রিম জেটের একটা প্রতিকৃতি দেখছে তারা। একই আসন বিমান ব্যবহার করে অ্যারন। মৃদু হেসে বলল সে, ‘মানি ইয নো প্রবলেম। ল্যামারের দশগুণ টাকা আমরা খরচ করব নির্বাচনের জন্যে। গাধাটা বুঝতেও পারবে না যে কিছুই করার নেই তার।

‘তবে তো ভাল,’ বলল মাটিল্ডা, ‘আমি আসলে হারতে ভালবাসি না।’

‘আমার বুড়ো হাবড়া বাপটা আমাকে হারতে দেবে না,’ বলল অ্যারন।

মেয়রের ক্যাডিলাকের পেছনে আছে কালো তিন মার্সিডিস এসএল-ক্লাস কনভার্টিবল। আর সামনে মস্ত নীল ডজ র‍্যাম, ক্রু-ক্যাব পিকআপ। ওটার সাসপেনশন অনেক উঁচু। নাকে বুল বার। যন্ত্রদানবটা যেন প্রমাণ করছে, ওটার মালিক রিয়ান কনারের মতই সে-ও রাখে প্রচণ্ড শক্তি।

গাড়ির খোলা জানালায় কনুই রেখে দাঁড়িয়ে আছে রিয়ান কনার। তপ্ত হাওয়ায় দুলছে মাথার সাদা চুল। নিজের দিকে বাবার কঠোর চোখ দেখে মনে মনে হোঁচট খেল অ্যারন। আর তখনই পকেটে বেজে উঠল স্মার্টফোন। ওটা বের করে নতুন এক টেক্সট মেসেজ দেখতে পেল। কুঁচকে গেল তার ভুরু। আবারও ফোন পকেটে রেখে মাটিল্ডাকে বলল, ‘পরে অফিসে দেখা হবে।’

‘কখন?’ জানতে চাইল ব্যক্তিগত সেক্রেটারি।

‘কিছু কাজ শেষ করার পর, সহজ সুরে বলল অ্যারন। উঠে পড়ল ক্যাডিলাকে। মার্সিডিস গাড়িগুলোতে চেপে বসল মাটিল্ডা এবং অন্যরা।

‘আর কখনও আমাকে বুড়ো হাবড়া বাপ বলে সম্বোধন করবে না,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে ছেলেকে বলল রিয়ান কনার। ‘নইলে এর পরেরবার লাথিয়ে তোমার পোঁদ ফাটিয়ে দেব!’

বাবা কী বলেছে সেটা অন্তর থেকে বুঝল অ্যারন। ‘কথাটা বলেছি বলে সত্যিই সরি, বাবা। দয়া করে মাফ কোরো।’

তিক্ত চোখে তাকে দেখল রিয়ান কনার। ‘গভর্নর তো দূরের কথা, তুমি তো গাধার গুও হতে পারবে না। এমন কী ভাল একটা গাড়িও তুমি চালাতে শেখোনি।’

‘ক্যাডিলাক তো দামি গাড়ি,’ আপত্তির সুরে বলল অ্যারন।

জবাবে মাথা নাড়ল বুড়ো। ‘লাখ ডলারে কিনতে গেছ বিলাসী গাড়ি। কিন্তু ওটা আসলে টিনের ক্যান।’ মাটিতে থুতু ফেলল সে। ‘আমি যাচ্ছি র‍্যাঞ্চে। আগামী কয়েক দিনের জন্যে যাব টোপেকা। ঘোড়া বিক্রির জন্যে।’

‘ঠিক আছে,’ ঢোক গিলে বলল অ্যারন।

কঠোর চোখে তাকে দেখে নিয়ে গাড়িতে উঠল বুড়ো। একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে রওনা হলো ডজ র‍্যাম পিকআপ। ওদিকে চেয়ে রইল মেয়র কনার। নিচু গলায় বলল, ‘বাপ শালা, বলো তো, শেষমেশ কবে মরবে তুমি!’

ততক্ষণে বহু দূরে চলে গেছে অষ্টাশি বছরবয়সী চিরতরুণ রিয়ান কনার।

সাতাশ

চাপা গোঁ-গোঁ শব্দে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে বোয়িং সেভেন হান্ড্রেড সেভেনটি সেভেন। বিজনেস ক্লাসে নিজের সিটে বসে আছে মাসুদ রানা। দু’ঘণ্টা ধরে দেখছে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে আইলের ওদিকের সিটের যাত্রী। বিরক্তি কাটাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। বিমানের ডানার অনেক তলা দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে ছেঁড়াখোঁড়া সাদা মেঘ। হাজার হাজার ফুট নিচে দিগন্ত বিস্তৃত ধূসর আটলান্টিক মহাসাগর।

সঠিক সময়ে লিসবনে পৌছুতে গিয়ে উন্মাদের মত ছুটতে হয়েছে রানাকে, নইলে ধরতে পারত না নিউ ইয়র্কের আইবেরিয়ার ফ্লাইট। পাঁচঘণ্টা পর বিমান নামবে জেএফকে এয়ারপোর্টে। তখন অপেক্ষা করতে হবে কানেকটিং ফ্লাইটের জন্যে। পরের বিমান টুলসায় ল্যাণ্ড করবে স্থানীয় সময় দুপুর দুটোয়। আপাতত কাজ নেই রানার, তাই ফোল্ডিং টেবিল খুলে পড়তে লাগল লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি।

এপ্রিলের ষোলো তারিখ, আঠারো শ’ সাতচল্লিশ।

‘আজ বড্ড লজ্জা লাগছে, কীভাবে এত স্বার্থপর হয়ে উঠলাম! আমার স্বামীর কথায় দিনের পর দিন আতিথেয়তা করেছি এবারডেন হলে তার বিলাসিতায় তলিয়ে যাওয়া লোভী সব নরপশু বন্ধুদেরকে। তবে এরা বাস্তবে মানুষই নয়!

‘আমি অসুস্থ বোধ করছি, এই মিথ্যা কথা বলে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে এসে ডায়েরি লিখছি। কানে আসছে মদ্যপগুলোর বিকট অট্টহাসি। গলা পর্যন্ত পোর্ট গিলছে তারা। হাতে জ্বলছে দামি হাভানা চুরুট।

‘কখনও কখনও মাথা-ব্যথার কথা বলে এদের কাছ থেকে পালিয়ে আসি। আজ ডিনারে এসেছে চরম স্বার্থপর, অন্ধ বিশজন জানোয়ার! বুঝে পাই না, এদের কেন হৃদয় বলতে কিছুই দেননি পৃথিবীর স্রষ্টা!

‘কখনও কখনও যে কড়া কথা শুনিয়ে দিইনি, তা-ও নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় অ্যাঙ্গাসের গানরুম থেকে অস্ত্র নিয়ে গুলি করে দিই এদের বুকে।

‘আজ আমার বামের চেয়ারে বসে লর্ড কার্লিক্স বলেছে, আয়ারল্যাণ্ডে দুর্ভিক্ষ হওয়ায় সত্যিই কপাল খুলে গেছে তার মত অনেকের।

‘ঝোপের মত গোঁফওয়ালা এক লর্ড বলল, আইরিশেরা যত দ্রুত মরে সাফ হবে, ততই ভাল ইংল্যাণ্ডের। খ্যাকখ্যাক করে হাসতে হাসতে জানাল, ‘লগুম, লিভারপুল আর গ্লাসগো বন্দরে মজুদ করা আছে চার লাখ কোয়ার্টার ভুট্টার দানা। যদিও ইংরেজ সরকারের বড়কর্তারা ভুলেও সেগুলো আইরিশ কুকুরগুলোকে বনা পয়সায় দেবে না।’

‘কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, এদের মুখে বমি করে দেয়া উচিত। আয়ারল্যাণ্ডে প্রতিদিন মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। অথচ সব জেনে-বুঝেও কাউকে চারআনা পয়সাও সাহায্য দেবে না এরা। প্রত্যেকে চারবেলা নষ্ট করছে দামি সব খাবার। যা দিয়ে দূর করা যেত অন্তত পাঁচজনের ক্ষুধা। অ্যাঙ্গাসের বন্ধুরা সবাই বড় জমিদার। নিজেদের প্রজাদেরকে না খাইয়ে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে তারা। যারা খাজনা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতেও দ্বিধা নেই এদের।

‘অথচ, আইরিশ কর্মচারী কাজে যোগ না দিলে পরিত্যক্ত হবে এদের এসব জমিদারী। আমি নিজে গ্রামে গিয়ে দেখেছি কেল্টিক জাতি কত ন্যায়বান, হাসিখুশি ও কঠোর পরিশ্রমী। নিজেদের পরিবারের জন্যে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করে না আয়ারল্যাণ্ডের পুরুষেরা।

‘আজও এবারডেন হলে দাওয়াত পেয়ে আড্ডা দিতে এসেছে ভুঁড়িসর্বস্ব হারামি ইবলিশের একটা দল। একেকজনের থুতনির নিচে তিনটে করে ভাঁজ। দামি খাবার গিলে অথর্ব হয়ে গেছে তারা। যারা এদের জন্যে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, বিপদের সময়ে তাদেরকেই না খাইয়ে মেরে ফেলছে এরা।

গরীবদের সাহায্য করে কোন লাভ হয় না,’ একটু আগে বলেছে নির্লজ্জ লর্ড বেহ্যাম। ‘ওরা পৃথিবীতে এসেছে পাছায় লাথি খাওয়ার জন্যে।’ কথাটা শেষ করে পোর্কের মস্ত এক টুকরো মুখে পুরেছে সে।

‘ঠিকই বলেছেন, লর্ড বেহ্যাম,’ সায় দিল কয়েকজন।

‘চট্ করে দেখলাম আমার স্বামীর মুখ। অন্যদের চেয়ে বেশি জোরে হাততালি দিয়েছে সে।

‘অসুস্থ বোধ করছি, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করবেন,’ বলে ডিনারের টেবিল থেকে উঠে এলাম।

‘আমি যে বিরক্ত হয়ে ডিনার না করে চলে এসেছি, সেটা ভাল করেই বুঝতে পেরেছে আমার স্বামী অ্যাঙ্গাস। বুঝে গেছি আজ রাতে আমার সঙ্গে গায়ে পড়ে দুর্ব্যবহার করবে সে। নতুন করে শোনাবে: আইরিশ কুকুরগুলো মরে গেলেও দুনিয়ার আসলে কিছুই যায়-আসবে না।

‘ওহ্, আজ যদি এবারডেন হলে থাকতেন হেনরি ফ্লেচার! নিশ্চয়ই তাঁর কাছ থেকে পেতাম সমর্থন ও মানসিক সাহায্য। আইরিশদেরকে চোখের সামনে এভাবে মরতে দেখেও কিছুই করতে পারছি না।

‘হায়, ঈশ্বর, তুমি কি সত্যিই আছ?

‘কোন্ আকাশে থাকো তুমি?

‘কে জানে, তুমিও হয়তো নিষ্ঠুর এসব লর্ডের মতই বধির ও অন্ধ!’

ড্রিঙ্ক ট্রলির শব্দে মনোযোগ ছুটে গেল রানার। ওর পাশে থেমে মিষ্টি করে হাসল সুন্দরী এয়ারহোস্টেস। নরম সুরে জানতে চাইল, কোন ড্রিঙ্ক লাগবে কি না। ট্রলির ওপরে খুদে কিছু মল্ট উইস্কির বোতল দেখে খচ্ করে বুকে খোঁচা খেল রানা। মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, শুধু মিনারেল ওঅটর।’

পানির বোতল দিয়ে ট্রলি ঠেলে চলে গেল এয়ারহোস্টেস। টেবিলে পানির বোতল রেখে আবারও ডায়েরিতে ডুব দিল রানা।

সত্যিকারের ভদ্রমহিলা ছিলেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। রানার বন্ধু জনি ওয়াকার বিমানে থাকলে হয়তো হেসে বলে উঠত, ‘পুরুষের তো দুটো, তবে এই মহিলার বোধহয় ছিল চারটে বিচি!’

ডায়েরিতে প্রফেসর কেলির রহস্যময় সেসব সূত্র এখনও খুঁজে পায়নি রানা। এরইমধ্যে পড়ে শেষ করেছে দুটো ডায়েরি। বাকি আছে অন্যদুটো। তৃতীয় ডায়েরি পড়তে লাগল রানা’।

মে মাসের তৃতীয় দিন, আঠারো শ’ সাতচল্লিশ

‘নিজের চোখে দেখছি, আমাদের জমিদারীতে না খেয়ে মরছে শত শত মানুষ। যারা বেঁচে আছে, তাদের শরীর হয়ে গেছে কাঠির মত শীর্ণ। কেউ কেউ আর বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। অক্ষিকোটরে ঢুকে যাওয়া চোখে এখন বোবা, করুণ আর্তি। অথচ, তাদের জন্যে কিছুই করতে পারছি না। আমার স্বামী অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড আজ বলে দিয়েছে: গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে যেন না মিশি।

‘বাচ্চাগুলোর জন্যে বড্ড কষ্ট হয়। দিনের পর দিন না খেয়ে শুকিয়ে গেছে কঙ্কালের মত। কচি মুখ হয়ে গেছে বুড়োর মত ভাঁজ পড়া। খাবারের অভাবে করোটি থেকে খসে পড়ছে গোছা গোছা চুল।

‘গ্রামে আমি গেলে ছুটে আসে ওরা। আমার সাধ্যমত খাবার ওদের জন্যে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার যে সাধ্য নেই শত শত বাচ্চার পেট ভরিয়ে দেবার!

‘যাদের প্রচণ্ড পরিশ্রমে আজ এত বড়লোক হয়ে উঠেছে অ্যাঙ্গাস, তারাই আজ খেতে না পেয়ে একে একে লুটিয়ে পড়ছে মৃত্যুর কোলে।

‘অ্যাঙ্গাস জানিয়ে দিয়েছে, আমি যেন আর কখনও দেখা না করি আইরিশদের সঙ্গে!’

টেবিলে ডায়েরি রেখে পাশের সিটের দিকে তাকাল রান্না। ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দে নাক ডাকছে লোকটা। ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের কথা ডায়েরিতে পড়ে আরও তিক্ত হয়েছে রানার মন। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে মেঘ দেখে নতুন করে ডায়েরিতে চোখ বোলাল।

এক জায়গায় লেডি স্টার্লিংফোর্ড লিখেছেন, বাধ্য হয়ে জাহাজে চেপে আমেরিকায় যাচ্ছে আইরিশেরা। একবার সেই দেশে নেমে যাত্রা করছে পশ্চিমে।

কথাগুলো পড়ে স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনলাইনে গেল রানা। পড়তে শুরু করল বুনো পশ্চিমের ইতিহাস।

বিশাল দেশ আমেরিকা তাদের মত মানুষের জন্যে নতুন ঠাঁই, সেটা বুঝে গিয়েছিল আইরিশেরা। বড় ভূমিকা রেখেছে রেলরোড ও খাল তৈরিতে। সিভিল ওঅরে যুদ্ধ করেছে সবার পাশে দাঁড়িয়ে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছে অসংখ্য কারখানা। কখনও হয়েছে আমেরিকায় পুলিশ, কখনও বা বেসবল খেলোয়াড়। ছেলেমেয়েদেরকে চেষ্টা করেছে ভাল স্কুলে পড়াতে। উনিশ শ’ দশ সালে ডাবলিনের চেয়ে বেশি আইরিশ ছিল শুধু নিউ ইয়র্ক শহরে। আমেরিকার বর্তমান জনসংখ্যার বারো পার্সেন্ট অর্থাৎ তিন কোটি ষাট লাখ মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল আইরিশ। এখন খোদ আয়ারল্যাণ্ডেও এত মানুষ নেই।

আমেরিকান আইরিশেরা গর্বিত জাতি। যেমন আছে তাদের নিজস্ব পতাকা, তেমনি আছে দারুণ সব অনুষ্ঠান। প্রতিবছর নিউ ইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস, ডেট্রয়েট, শিকাগো, সেইণ্ট লুই ও টুলসার আইরিশেরা মেতে ওঠে সেইণ্ট প্যাট্রিকের বিশেষ অনুষ্ঠানের দিনে।

নোটবুকে টুলসার বিষয়ে তথ্য টুকছে রানা।

শহরের মেয়র এখন অ্যারন কনার। চার পুরুষ ধরে আছে আমেরিকায়। দাম্ভিক এক লোক। আইরিশ হিসেবে টুলসায় ভোগ করে নানান ধরনের সুবিধা। দক্ষ রাজনীতিক সে। বহু ভাল কাজ করেছে বলে তার আছে বিপুল মানুষের সমর্থন। টুলসার নাগরিকদের ভোটে পর পর দু’বার নির্বাচিত হয়েছে মেয়র হিসেবে।

রাজনীতিতে বহু পরে এসেছে অ্যারন কনার। তিরিশ বছর বয়সে প্রথমবার হয়েছিল আইনপ্রণেতা। জন্মেছে উনিশ শত সত্তর সালে। তার বড়আব্বা, দাদা আর বাবা অতি ধনী আইরিশ আমেরিকান। বিশেষ করে দাদা। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অয়েল বুমের সময় হয়ে ওঠে বিলিয়নেয়ার। তখন টুলসা ছিল ধুলোভরা কাউ-টাউন। মাত্র কয়েক দিনে ওটা হয়ে গেল দুনিয়া-সেরা অয়েল ক্যাপিটাল। উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সালে বিশ্বের বড় কয়েকটি কোম্পানির একটি হলো অ্যারন কনারের দাদা লকান কনারের স্পিয়ারহেড অয়েল কোম্পানি। পরে ওটার হাল ধরল অ্যারন কনারের বাবা রিয়ান কনার। টুলসায় মানুষ এককথায় তাকে চেনে বিগ কনার হিসেবে। এখনও বেঁচে আছে সে। কুখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা। তার সঙ্গে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে প্রচণ্ড মার খেয়ে আহত হয়েছে বহু লোক। সে ওকলাহোমার প্রথম পাঁচজন ধনীর একজন। উনিশ শ’ নব্বুই সালে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে স্পিয়ারহেড় কোম্পানি বিক্রি করে দেয়। জন্মাবধি টুলসার প্রেয়ারি স্প্রিং-এ পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া স্পিয়ারহেড র‍্যাঞ্চে বাস করে। অনলাইনে তার ছবি দেখল রানা। তাকে বলা চলে চওড়া কাঁধের এক মেরুভালুক। মাথার চুল ধবধবে সাদা। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পরিষ্কার বোঝা যায়, কোনকিছুতে না শুনতে রাজি নয় সে। বয়স অষ্টাশি হলেও এখনও তার প্রচণ্ড প্রভাব আছে একমাত্র ছেলের ওপরে। বাবার নির্দেশে ওকালতি পড়েছে কমবয়সে মা-হারা অ্যারন কনার। তারপর বাবার দেয়া সাহায্য পেয়ে হয়ে উঠেছে টুলসা শহরের মেয়র। সাক্ষাৎকারে নিজেই সে বলেছে, ‘আজ যা হতে পেরেছি, তার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে আমার বাবা। নইলে হয়তো কিছুই হতে পারতাম না।’

অ্যারন কনার আসলে কী ধরনের লোক, সেটা জানার জন্যে মনের ভেতরে জোর তাগিদ অনুভব করছে রানা।

আটাশ

বায়ার্ন কনারের জীবনে বহু কিছুই আছে, যা সাধারণ মানুষের কাছে কখনও প্রকাশ করা যানে না, খুব ভাল করেই জানে টুলসার মেয়র অ্যারন কনার।

আঠারো শ’ একান্ন সালের ভেম্বর মাসে ঝোড়ো এক সকালে জাহাজ থেকে নিউ ইয়র্ক বন্দরে পা রেখেছে বায়ার্ন কনার। এরপর মাত্র ক’দিনে বুঝে গেছে, যেসব আইরিশেরা আমেরিকায় এসেছে, তারা নিজের দেশের মানুষকে সাহায্য করতে মুখিয়ে আছে। ইংল্যাণ্ডের অভিজাত সমাজে গোপন হাত আছে বলে মাত্র কিছু দিনের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত হলো সে নিউ ইয়র্কে। দুঃসাহসী, একগুঁয়ে মানুষটা দ্বিধা করল না কঠোর পরিশ্রম করতে। তা ছাড়া, তার জানা ছিল ভাল ঘোড়া আসলে কোনগুলো। তখন আমেরিকার মানুষ দূরে বা কাছে যে-কোন জায়গায় যাওয়ার জন্যে ব্যবহার করত ঘোড়া। আঠারো শ’ সাতান্ন সালের ভেতরে চারপাশে খবর ছড়িয়ে গেল বায়ার্ন কনার জানে কীভাবে সংগ্রহ করতে হবে দারুণ সব ঘোড়া। আরও বড় কথা, অতিরিক্ত মুনাফাও করে না সে। চমৎকার ঘোড়া বিক্রি করে সুলভ দামে। কিছুদিনের ভেতরে নিউ ইয়র্কে গড়ে তুলল সে তেরোটা বড় আস্তাবল।

এর মাত্র চার বছর পর গোটা আমেরিকা জুড়ে শুরু হলো ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ। ঘোড়া জোগান দিতে গিয়ে ইউনিয়ন আর্মির সঙ্গে চুক্তি করল বায়ার্ন কনার। তাতে কয়েক মাসে রিশগুণ হলো তার সম্পদ। পঁয়ষট্টি সালে গৃহযুদ্ধের ভেতরে ছাপ্পান্ন বছর বয়সে বিয়ে করল পছন্দের মেয়ে ক্যারি ও-রাইলিকে। আয়ারল্যাণ্ড থেকে যেসব মেয়ে এসেছিল, বিশ বছর বয়সী এই তরুণী ছিল তাদের মধ্যে সেরা সুন্দরী। বয়সে ছত্রিশ বছরের বড় স্বামীকে নিয়ে যৌনজীবনে তিক্ততা ছিল না তার। আঠারো শ’ সাতষট্টি সালে জন্মাল এই দম্পতির একমাত্র ছেলে লকান কনার। মসৃণভাবে চলল ছোট্ট এই পরিবারের সবার জীবন।

পুবে সতেরো বছর ব্যবসা করে আঠারো শ’ আটষট্টি সালে স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে ক্যানসাসে চলে গেল বায়ার্ন কনার। লাখ লাখ একর জুড়ে সবুজ ঘাসের অবারিত জমি। সবধরনের সুবিধা বুকে নিয়ে দেশটা উন্মুক্ত ছিল ধনী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষের জন্যে। ঘোড়া বিক্রির পাশাপাশি সীমান্তে অস্ত্র ব্যবসা শুরু করল বায়ার্ন। দেদারসে কিনল কনফেডারেট আর্মির পরিত্যক্ত মাস্কেট, বন্দুক, কোল্ট রিভলভার থেকে শুরু করে হেনরি রিপিটিং রাইফেল। তার ছিল নানাধরনের ক্রেতা। কে ডাকাত আর কে গরুচোর, তা নিয়ে ভাবল না। শেরিফ, মার্শালেরা যেমন তার কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র কিনত, তেমনি তার কাছ থেকে চোরাই অস্ত্র সংগ্রহ করত ডাকাতেরা। ইউরোপ থেকে আসা সেটলাররা যখন ইণ্ডিয়ানদের কাছ থেকে বাঁচতে অস্ত্র কিনছে, সেই একই সময়ে ইণ্ডিয়ানদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করত সে। ফলে মাত্র ক’বছরে বায়ার্ন কনার হয়ে গেল মধ্যপশ্চিম এলাকায় সেরা অস্ত্র ব্যবসায়ী।

বিশ বছর তুমুল ব্যবসা করল সে। পরের বছর আঠারো শ’ ঊননব্বুই সালে হঠাৎ শ্বেতাঙ্গ সরকার পাশ করল ইণ্ডিয়ান অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বিল। এল ওকলাহোমায় দু’মিলিয়ন একর জমি দখল করে নেয়ার বিশাল সুযোগ। যে আগে যাবে, জমি তার। বিশেষ এই সুযোগ পেতে আগ্রহী হলো বায়ার্ন কনার। সরকার থেকে বলা হয়েছিল, যারা আঠারো শ’ ঊননব্বুই সালের বাইশ এপ্রিলের মধ্যে ওকলা ‘হামায় পৌছুবে, তাদের ভেতরে আগে বণ্টন করা হবে সেরা র জমি। অন্যরা কিছু বোঝার আগেই আর্কানসাস নদীর তীরে র‍্যাঞ্চ করতে উর্বর এক লাখের বেশি একর জমি দখল করল, ‘বস’ বায়ার্ন কনার। যারা পরে জমি নিতে এল, দেখল ছোটখাটো এক আর্মি দিয়ে এলাকা পাহারা দেয়াচ্ছে আইরিশ লোকটা। তার দলে আছে শতখানেক পেশাদার ভাড়াটে সশস্ত্র খুনি। সেটলারদের ক’জন খুন হয়ে যেতেই ওদিকের জমি ছেড়ে পালিয়ে গেল অন্যরা।

সেই বছর নিউমোনিয়ায় মরল বায়ার্ন কনারের প্রিয় স্ত্রী। অবশ্য তাতে দমে গেল না সে। সময় তখন তার জন্যে সত্যিই দারুণ। চোখের সামনে দেখল কয়েক ঘণ্টায় গড়ে উঠল বিশাল শহর ওকলাহোমা সিটি। পরের সাত ঘণ্টায় বেড়ে ওটার জনসংখ্যা হলো দশ হাজার। ততক্ষণে জমি ও অস্ত্র বিক্রি করে নতুন রাজ্য ওকলাহোমার সেরা ধনী হয়ে গেছে ‘বস’ বায়ার্ন কনার।

কয়েকটা ইণ্ডিয়ান ছোট দল মানল না শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য। সুতরাং খুনি লেলিয়ে দিয়ে চেরোকিদেরকে খুঁজে বের করে পাইকারীভাবে খুন করাল বায়ার্ন কনার ও তার ছেলে। দখল করে নিল আরও হাজার হাজার একর জমি।

এরপর পঁচাশি বছর বয়েসী বাটপার এক বড় ক্যাটল ব্যারনকে নিজের হাতে পিটিয়ে মারল বায়ার্ন করার। আইনের পক্ষের কেউ বলল না যে খারাপ হয়েছে কাজটা। শেষমেশ এক শ’ আট বছর বয়সে উনিশ শ’ সতেরো সালে মারা গেল সে। তার আগে যাজক ডেকে এনে হাউমাউ করে কেঁদে নিজের চরম সব পাশে 1 জন্যে মাফ চাইল ঈশ্বরের কাছে।

তার মৃত্যুর পর বিশাল রাজ্যের মালিক হলো তার ছেলে লকান কনার। উনিশ শ’ বিশ সালে তেপ্পান্ন বছর বয়সে পরমাসুন্দরী এক জার্মান তরুণীকে বিয়ে করল সে। তবে উনিশ শ’ ঊনত্রিশ সালে আমেরিকায় মহামন্দা এলে নড়ে গেল তার পারিবারিক অর্থনৈতিক ভিত্তি। কয়েক বছর পর উনিশ শ’ পঁয়ত্রিশ সালে জন্ম নিল তাদের একমাত্র সন্তান রিয়ান কনার। আর কী কপাল লকান কনারের, এর ক’দিন পর তার জমির কূপে পাওয়া গেল বিপুল পরিমাণ পেট্রোলিয়াম। বহু বছর ওকলাহোমা স্টেটে সবচেয়ে বেশি তেল উত্তোলন করা হয়েছে সেই কূপ থেকে।

তখন বিংশ শতাব্দীর সে-সময়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে চলছে গাড়ি কেনার হিড়িক। আর গাড়ির জন্যে চাই পেট্রোলিয়াম। হুড়মুড় করে এল লকান কনারের কাছে লাখ লাখ ডলার। কিন্তু উনিশ শ’ চল্লিশ সালে দ্রুতগামী এক ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি গাড়ি সংঘর্ষে স্ত্রীসহ মারা গেল সে।

ওকলাহোমার সবচেয়ে কমবয়সী মিলিয়নেয়ার হয়ে গেল লকান কনারের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে রিয়ান কনার। তার জন্যে আদালত গঠন করল একটি ট্রাস্টি বোর্ড। পরে পঁচিশ বছর বয়সে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি ও স্নাতক হয়ে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরল সে। এ সময় তার কর্মজীবনে অকল্পনীয় সাফল্যের সব কাহিনী হয়ে গেল ওকলাহোমার স্বর্ণখচিত মস্তবড় এক ইতিহাস।

.

রুট সিক্সটি-সিক্স ধরে দক্ষিণে চলেছে অ্যারন কনারের দামি গাড়ি। একটু পর পুবে পিছিয়ে গেল টুলসা বাইবেল চ্যাপেল ও চার্চ অভ গড় অভ দ্য অ্যাপোস্টলিক। এক পঁয়ত্রিশ অ্যাভিন্যুর পরে আরও গেলে হার্ভি ইয়াং এয়ারপোর্ট। শহরের তিন বিমানবন্দরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ওখানে রাখা হয় প্রায় ষাটটি এয়ারক্রাফট। তারই একটি অ্যারনের ব্যক্তিগত গালফস্ট্রিম বিমান। বেশ কিছু দিন হলো শহরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলকে কাঁচকলা দেখিয়ে ওটা নিয়ে দক্ষিণে টেক্সাস ও নিউয়েভো লারেডোতে যাচ্ছে সে। টুলসার মেয়র বলে মুখের ওপরে কথা তুলছে না কেউ। এই এয়ারপোর্টে বিমান থাকলে সুবিধা পাবে, তাই ভাড়া নিয়েছে মাঝারি একটি হ্যাঙার। এ-ছাড়া এই এয়ারপোর্টে আছে আরও কিছু সুবিধা। এর একটি হচ্ছে: হ্যাঙারে বসে নিজের লোকদের সঙ্গে ব্যবসার কথা সেরে নেয় সে। আর দ্রুত শনৈঃ শনৈঃ বড় হচ্ছে তার ব্যবসা। যদিও তার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে ওটার কোন সম্পর্ক নেই। সিটি হলের স্টাফ বা মাটিল্ডা টেস ঘুণাক্ষরেও জানে না তলায় তলায় কী করছে সে।

সাধারণ মানুষ মনে করে বাবা রিয়ান কনারের কাছ থেকে টাকা পেয়ে বড়লোক হয়ে গেছে অ্যারন কনার। যদিও কথাটা একদম মিথ্যা। আজকাল ব্যবসা থেকে তার বাবা যা রোজগার করে, তার চেয়েও বেশি আয় করে সে। আর একবার গভর্নর হতে পারলে হুড়মুড় করে আসবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। মাত্র কিছু দিনের ভেতরে সে হয়ে উঠরে ওকলাহোমার তিনজন ধনীর একজন। আর এরপর একসময়ে বুড়ো খচ্চর রিয়ান কনার যখন পড়ে থাকবে মৃত্যুশয্যায়, সে-সময়ে, গোপন কথাগুলো বলে তাকে ভীষণভাবে চমকে দেবে অ্যারন।

নিজের হ্যাঙারের পাশে ধুলো ভরা ধূসর ফোর্ড ভ্যান দেখে মনে মনে হাসল সে। গাড়িটার পাশে ক্যাডিলাক থামতেই ভ্যানের পেছন-দরজা খুলে নেমে পড়ল লিয়াম বার্ব ও টনি স্ক্যালাস। বার্বের চোখে মিলিটারি ইত্য সানগ্লাস। পরনে কালো পোশাক। স্ক্যালাসের টি-শার্টে লেখা: ইউ ক্যান কিল মি, আদারওয়াইয ইউ উইল বি কিন্তু।

ক্যাডিলাক থেকে নেমে অ্যারন কনার দেখল ধারে-কাছে সন্দেহজনক কেউ নেই। থমথম করছে চারপাশ।

‘খুব সুন্দর বুট, বস,’ মুখে বলল স্ক্যালাস। কনারের দামি পোশাক ও দুর্মূল্য ক্যাডিলাক দেখে তিক্ত হয়ে গেছে তার মন। প্রতিসপ্তাহে অন্তত তিনবার বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে ডিনার করে অ্যারন। প্রতিটি ডিশের দাম অনেক বেশি বলে নিজে সেখানে যেতে পারে না স্ক্যালাস।

‘কার হাতে বেধড়ক মার খেলে? স্ক্যালাসের ফাটা ঠোঁট আর বেগুনি গাল দেখে ভুরু নাচাল অ্যারন।

‘যে লাগতে এসেছিল, তাকে যদি দেখতেন, নিকোটিন গাম চিবুতে লাগল স্ক্যালাস।

‘আমি কিন্তু বেশি সময় দেব না, হ্যাঙারে ঢুকে চট্ করে কথা শেষ করবে,’ জার্নাল মেয়র কনার। হাতের ইশারায় তার পিছু নিল প্রাক্তন দুই মিলিটারি অফিসার। মেডেইরা থেকে ফিরে হ্যাঙারে গালফস্ট্রিম বিমান রেখে বিদায় নিয়ে চলে গেছে পাইলট। বিমানে উঠে আরামদায়ক সিটে মুখোমুখি হয়ে বসল অ্যারন, স্ক্যালাস ও বার্ব। চোখে কৌতূহল নিয়ে দুই স্যাঙাতের দিকে চাল টুলসার মেয়র। ‘এবার বলো, ভাল কোন খবর আনতে পেরেছ?’

‘মেডেইরায় বেশ ঝামেলা হয়েছিল,’ বলল বার্ব।

বিস্ময় নিয়ে তাকে দেখল অ্যারন। ‘কী ধরনের ঝামেলা? তোমাদের কাজ তো খুব সহজ ছিল। নিয়ে আসবে কয়েকটা পুরনো ডায়েরি।’

‘ভয়ের কিছু নেই, বস,’ বলল স্ক্যালাস। ওখানে ঝামেলা হলেও সেটা আমরা মিটিয়ে দিয়ে এসেছি।’

‘সত্যিই সেটা পেরেছ কি না, তোমাদের কথা শুনে বুঝব। বলো, ওখানে কী হয়েছিল?’

‘নিশ্চিন্তে থাকুন, বস,’ বলল বার্ব। ‘আগুনে পুড়িয়ে আপনার সেই ডায়েরিগুলো আমরা ছাই করে দিয়েছি।’

‘প্রফেসর বা সেই লোকও এখন আর বেঁচে নেই,’ বলল স্ক্যালাস।

বিরক্তি নিয়ে ওকে দেখল বার্ব। বেশি কথা বলে স্ক্যালাস।

‘ওই লোক আবার কে?’ জানতে চাইল অ্যারন।

‘আয়ারল্যাণ্ডের সৈকতে মেয়েটাকে যে বাঁচাতে এসেছিল,’ বলল বার্ব। ‘নাম ছিল তার মাসুদ রানা। আমাদেরকে বিপদে ফেলেছিল মেডেইরাতে।’

‘কীসের সৈকত?’ বিস্ময় নিয়ে বলল অ্যারন। ‘গ্যালওয়ের কথা বলছ?’

‘হ্যাঁ। মেডেইরাতে আবারও দেখা হয় লোকটার সঙ্গে।’

‘সে-ই কি পিটিয়েছে টনিকে? আর তার নাম মাসুদ রানা?’

মাথা দোলাল বার্ব। মুখ নিচু করে নিজের পায়ের দিকে তাকাল স্ক্যালাস। ‘দেখে যত ভয়ঙ্কর জখম বলে মনে হচ্ছে, আসলে তেমনটা নয়।’

‘লোকটা ওখানে কী করছিল?’ তেতো সুরে বলল অ্যারন।

‘আমাদের জানা নেই,’ বলল বার্ব, ‘হঠাৎ করেই আসে বাড়িটাতে। এরপর বাড়িসহ তাকে পুড়িয়ে দিই আমরা। কাহিনী খতম।’

দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে অ্যারন। মাথা নাড়ল বিরক্ত হয়ে। ‘সে কি তোমাদের পিছু নিয়ে মেডেইরায় গিয়েছিল? সেক্ষেত্রে এত বড় বোকামি তোমরা করলে কীভাবে? সে কি পুলিশের সদস্য? নাকি প্রাইভেট কোন গোয়েন্দা?’

‘আমাদের পিছু নেয়নি কেউ,’ নিচু গলায় বলল বার্ব।

‘কিছু জেনে গিয়ে পরে হয়তো কথা বলেছে অন্য কারও সঙ্গে,’ বলল অ্যারন। আমি তার সম্পর্কে জানতে চাই।’ মিনি-আইপ্যাড বের করে এক নামকরা নিউয নেটওঅর্কে ডায়াল করল সে। তিন সেকেণ্ড পর গেল পশ্চিম আয়ারল্যাণ্ডে প্রফেসরের ওপরে করা খবর। দ্রুত পড়ল সে। মিনিটখানেক পর মুখ তুলে দেখল স্ক্যালাস ও বাবকে। ‘তোমাদের সে লোক খুনিদেরকে বাধা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। নিউযে তাকে দেখানো হয়েছে হিরো হিসেবে। নাম মাসুদ রানা।’

‘হ্যাঁ, এই একই লোক,’ বলল বার্ব।

‘কীসের হিরো,’ বিড়বিড় করল স্ক্যালাস।

এর ব্যাপারে আর কিছু জানতে পেরেছ?’ কড়া গলায় জানতে চাইল অ্যারন কনার।

‘আমরা এটা জানি যে, সে মারা গেছে আগুনে পুড়ে,’ বলল স্ক্যালাস।

গুগলে মাসুদ রানা নামটা সার্চ করল অ্যারন কনার। মাত্র এক সেকেণ্ডে লাফ দিয়ে স্ক্রিনে এল কয়েকজন মাসুদ রানার নাম ও ঠিকানা। একজন সৌদি আরবের বাঙালি মুদি দোকানদার। দ্বিতীয়জন জর্ডানের রোড কন্ট্রাক্টর। তৃতীয়জন ইণ্ডিয়ার হাশিখুশি এক তরুণ। লিস্টের নিচে চোখ বোলাতে লাগল অ্যারন কনার। মিনিট দুয়েক পর বলল, ‘এই যে আমাদের লোক। গুগলে ছবিও আছে।’

ঝুঁকে স্ক্রিন দেখে বলল বার্ব, ‘হ্যাঁ, এ-ই সেই লোক।’

‘আগে ছিল আর্মির মেজর,’ বলল অ্যারন, ‘এখন এক প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটিং এজেন্সি চালায়। নানান দেশে আছে ওটার শাখা। অনেকে বলে এই লোক নাকি আধুনিক দুনিয়ার প্রথমসারির এক অভিযাত্রী।’

‘তাতে আমাদের কী?’ কাঁধ ঝাঁকাল স্ক্যালাস।

তাকে পাত্তা না দিয়ে ওয়েবসাইট ঘাঁটতে লাগল অ্যারন। ক্রমেই লালচে হলো দুই গাল। বিড়বিড় করে বলল, ‘এই লোক দেখছি সহজ প্ৰাণী নয়!’

‘যদি আমার কাছে জানতে চান, তো বলব: তাতে কী যায় আসে আমাদের?’ বলল স্ক্যালাস।

‘আমি তোমার মতামত চাইনি, টনি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল অ্যারন কনার। ‘আমি জানতে চাই লোকটা আসলে কে।’

‘এখন আর বেঁচে নেই,’ বসকে শুধরে দিল বার্ব। এর মত বহু লোক দেখেছি। তবে মরলে তাদের কোন মূল্য থাকে না। ওকে নিয়ে আপনার আর ভাবতে হবে না। মুখ ফস্কে কথা বলেছিল, তাই আরেকবার তিক্ত চোখে স্ক্যালাসকে দেখল সে।

‘নুমার মত প্রতিষ্ঠানের অনারারি ডিরেক্টর,’ বলল কনার।

হাসল স্ক্যালাস। ‘মেজর হোক বা অনারারি ডিরেক্টর, মরে গেলে কারও মূল্য থাকে না। বোধহয় চিনত প্রফেসরকে।’

‘তা-ই?’ বলল অ্যারন কনার। ‘সেক্ষেত্রে ধরে নিতে পারি তুমি বোধহয় চাঁদের দেশের অদ্ভুত এক গাধা!’

চুপচাপ অপমান হজম করল স্ক্যালাস।

‘সে কে, সেটা নিয়ে আমাদের আর ভাবতে হবে না,’ জোর দিয়ে বলল বার্ব। ‘বেঁচে থাকলে পরেরবার দেখা হলেই খুন হতো আমাদের হাতে।’

‘এ-ধরনের লোক আমার পিছু নেবে, সেটা চাই না,’ বলল মেয়র কনার। আইপ্যাড দেখাল সে। ‘তোমরা শিয়োর যে মারা গেছে সে?’

‘তাতে কোন ভুল নেই,’ বলল স্ক্যালাস।

‘তার কথা ভুলে যান, শুকনো গলায় জানাল বার্ব। ‘সে এখন পুরনো ইতিহাসের অংশ।’

‘মাথায় রেখো, ভুল যেন না হয় তোমাদের,’ বলল অ্যারন, ‘কারণ, আমরা এখন যে ব্যবসা করছি, তাতে হঠাৎ করে কেউ নাক গলিয়ে দিলে মস্ত বিপদ হবে।’ কোটের পকেট থেকে কালো এক কার্ড নিল সে। উল্টো দিকে লেখা এক মেয়ের নাম ও ঠিকানা। কার্ড ধরিয়ে দিল বার্বের হাতে। ‘ক্রসবি হাইটসের এ-মেয়েটাকে ধরে আনবে আমার কাছে। ভুলেও খুন করবে না। আমি তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চাই।’

‘এই কুত্তী আসলে কে?’ কার্ডের দিকে তাকাল বার্ব।

‘বিপজ্জনক। কাজ করে আমার স্ত্রীর অফিসে।’

‘অফিসে কাজ করে, তাতে কী?’ ভুরু কুঁচকাল বার্ব।

‘যে-রাতে উলোগাহ্ লেকের তীরে আমার স্ত্রীর কটেজে খুন করলাম হারামজাদা হিউবার্ট হ্যারল্ডকে, তখন মালকিনের অনুমতি পেয়ে ওখানে থাকতে গিয়েছিল এই মেয়ে।’

‘বলেন কী!’ চমকে গিয়ে সমস্বরে বলল বার্ব ও স্ক্যালাস।

‘হ্যাঁ, আমরা যখন হ্যারল্ডকে খুন করছি, তখন গোপনে আমাদের ভিডিয়ো তুলেছে। তারপর তোমাদের নাকের ডগা টপকে পালিয়ে গেছে। নিজেরাই বলো, সেটা কী করে হতে দিলে তোমরা? অবশ্য কপাল ভাল, প্রমাণগুলো এখন আছে নিরাপদ হাতে। জেনেছি, সেই ভিডিয়োর আর কোন কপি নেই। তবুও মেয়েটাকে জীবিত চাই। বুঝতে পেরেছ?’

বার্বের বুঝতে দেরি হলো না, এখন কার নিরাপদ হাতে আছে সেই ভিডিয়ো। কালো কার্ডের লেখা নাম ও ঠিকানা বন্ধুকে দেখাল সে। চকচক করে উঠল স্ক্যালাসের দু’চোখ। ওদিকের এলাকা ভাল করেই চেনে সে।

স্ক্যালাসের চোখ দেখে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল অ্যারন কনার। ‘আমি চাই না তুমি ওদিকে যাবে। মেয়েটা তোমার চেহারা চেনে। কাজেই পাঠাবে এমন একজনকে, যে গোলমাল না করে তাকে তুলে আনতে পারবে।

‘কোন ধরনের বিপদ হবে না’ কথা দিল বার্ব।

মাথা নাড়ল বিরক্ত অ্যারন। ‘আমি অত নিশ্চিত নই। এরই ভেতরে একবার পালিয়ে গেছে।’

‘আমাকে শুধু একবার সুযোগ দিন,’ অনুরোধের সুরে বলল স্ক্যালাস।

জবাবে মাথা নাড়ল অ্যারন কনার। ‘আগেই বলেছি, তোমরা ওদিকে যাবে না। নিজেদের দলের কাউকে পাঠাও। কাজটা করতে যেন দেরি না করে সে।’

ত্রিশজন খুনে লুঠেরাকে কাজে রেখে অ্যারনের ব্যবসা দেখাশোনা করছে বার্ব। আজকাল মাঝে মাঝেই তার মনে হচ্ছে, যেভাবে বেড়ে উঠছে ব্যবসা, তাতে আরও বেশি লোক লাগবে। মাথার খোঁচা-খোঁচা চুলে হাত বুলিয়ে বলল সে, ‘আমরা কাজটা দেব গ্রিন ক্রমম্যানকে।’

‘ওই লোক আবার সব গুবলেট করে দেবে না তো?’ সন্দেহ নিয়ে জানতে চাইল অ্যারন কনার।

মাথা নাড়ল বার্ব। ‘ভাববেন না।’

‘তা হলে তাকে ডাকো। বলে দেবে, কাজ ঠিকভাবে শেষ হলে বোনাস পাবে তিন হাজার ডলার।’

‘এ-ধরনের কাজে সে নেবে কমপক্ষে পাঁচ হাজার,’ বলল বার্ব। ‘কারও বাড়িতে ডাকাতি করা সহজ। কিন্তু কিডন্যাপিং অন্য কিছু। ধরা পড়লে বিশ বছরেও জেল থেকে বেরোতে পারবে না। তা ছাড়া, সঙ্গে অন্তত আরেকজনকে লাগবে।

অধৈর্য হয়ে বাতাসে হাত নাড়ল কনার। দরকার হলে দশ হাজার ডলার খরচ করবে। ‘আজই মেয়েটাকে তুলে আনবে। তার সঙ্গে আমি নিজে কথা বলব। গ্রুমম্যানকে বলে দিয়ো, লোকসহ সাড়ে সাত হাজার ডলার পাবে।’

‘কথা শেষ হলে, তখন?’ আগ্রহ নিয়ে বলল স্ক্যালাস।

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল অ্যারন। ‘এরপর মেয়েটার কী হবে, সেটা নিয়ে ভাবছি না। কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেয়ার আগে তাকে ভোগ করতে পারো, টনি। তবে পরে যেন চিরকালের জন্যে দুনিয়া থেকে হাওয়া হয়ে যায়। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

ঊনত্রিশ

দু’দিন হলো বাড়িতে বসে আছে জ্যাকি। মনে কাজ করছে গভীর এক ভয়: কে জানে, কখন কী হয়!

ট্রাস্টের সভাপতি লিণ্ডা কনারকে ফোন করে বলেছে, সর্দির ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ও। মহিলা সহৃদয়, তাই এক সপ্তাহের জন্যে ছুটি দিয়েছেন ওকে। ফোন রাখার আগে বলেছেন, ‘এত কাজ জমেছে, তোমাকে ছাড়া কীভাবে সব সামলে নেব বুঝতে পারছি না। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন চট্ করে সুস্থ হয়ে ওঠো।

কত বড় ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে, সেটা বুঝতে পেরে মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হয়েছে জ্যাকির। মন্দার এ সময়ে লিণ্ডা কনারের দেয়া চাকরিটা ওর খুব প্রয়োজন। মহিলাকে পছন্দও করে। কিন্তু গত কয়েক দিনে যা ঘটে গেছে, এরপর কীভাবে যাবে অফিসে? লিণ্ডার চোখে কী করে চোখ রাখবে? আর ট্রাস্টের অফিসে যদি আসে টুলসার মেয়র কনার-তখন? মাঝে মাঝেই আসে সে! একই রুমে তার সঙ্গে মুখোমুখি হলে ওর চেহারা কেমন হবে, স্রেফ খোদা জানেন! যদি ওর মনের কথা ধরা পড়ে যায় লোকটা কাছে? যদি বুঝতে পারে যে খুনের সাক্ষী এখন হাতের মুঠোয়? সেক্ষেত্রে কী হবে?

হাজারো দুশ্চিন্তা ঘুরছে জ্যাকির মনে। একেক ঘণ্টা ওর কাছে এক শ বছরের মত লাগছে। প্রতিদিনের মত একসময় ডুবে গেল সূর্য, নেমে এল কালো রাত। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে কোন খবর এল না। বারবার ভাবল জ্যাকি: আসলে কী করছে পুলিশের লোকেরা?

সারারাত ঘুমাতে না পেরে চেয়ে রইল ছাতের দিকে। সকালে বিছানা ছেড়ে নাস্তা করে নেয়ার পর ভাবতে লাগল পুলিশ চিফ রিপার রিগবি আর ডিটেকটিভ জিম লিয়োনার্ডের সঙ্গে ওর সাক্ষাৎকারের কথা। বারবার মনে হলো, ভাল হতো সেই বিকেলে কটেজে না গেলে। বা খুন না-ই হতো লোকটা! অন্তর থেকে জ্যাকি বুঝতে পারছে, কিছু না কিছু করতে হবে ওকে। কিন্তু সেই কাজটা আসলে কী?

নিজেকে গৃহবন্দি বলে মনে হচ্ছে ওর। খুনের দৃশ্য মুছে দিতে পারছে না মন থেকে। নিজের কাজে যে যাবে, তা-ও সম্ভব নয়। গত কয়েক ভোরে আর্কানসাস নদীর তীরে নিউব্লক পার্ক ট্রেইল ধরে জগিং করেনি। বাড়ি থেকে মাত্র একবার বের হয়ে ক্যাব নিয়ে চলে গেছে মেকানিকের গ্যারাজে। মেরামত করিয়ে এনেছে নিজের পুরনো সুবারু গাড়িটা। ওর স্মার্টফোন এখনও রয়ে গেছে পুলিশ চিফের কাছে, তাই বাড়ি ফেরার আগে এক সুপারশপ থেকে কিনে নিয়েছে কমদামি এক সেলফোন, কিছু পাউরুটি, সব্জি, মাংস ও ডিম।

নানান ভাবনার সাগরের অতলে ডুবে ধীরে ধীরে পেরোল ওর দুপুর। টিভিতে দেখল ইয়ামোটা এক মহিলা নালিশ করছে উকিলের কাছে। ফাস্ট ফুডের এক কোম্পানির জন্যে সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। ফাটা গলায় বলল, ‘নিজেই দেখুন, আমার কী হাল করে ছেড়েছে! লোভনীয় খাবার দেখিয়ে মানুষ খুন করছে এরা!

‘আপনি মা-ই বা খেতেন?’ জানতে চাইল উকিল।

‘তা হলে বাঁচতাম কী করে?’

‘তা হলে কি তাদের খাবার খেয়ে আপনি বেঁচে আছেন, নইলে বাঁচতেন না?’

‘আপনি বেশি কথা বলেন!’ ধমকের সুরে বলল মহিলা।

টিভির অনুষ্ঠান আর ভাল লাগল না জ্যাকির। এক মগ চা হলে মন্দ লাগত না ওর। টিভি অফ করে চলে এল কিচেনে। ওর কিচেন ছোট হলেও গোছানো। চট করে মেলে দরকারি জিনিস। কাউন্টারের এক তাকের নিচে হাঁড়িকুঁড়ি ও বৈদ্যুতিক কেতলি। ওপরের স্টিলের বার থেকে ঝুলছে চকচকে ছোটবড় সসপ্যান। সুইচ অন করে এক মগ পরিমাণ পানি কেতলিতে ভরল জ্যাকি। কাবার্ড থেকে বের করে টি- ব্যাগ নিয়ে রাখল খালি এক মগে। পানি গরম হওয়ায় ফোঁস- ফোঁস শব্দ করছে কেতলি। কট শব্দে অফ হলো প্লাস্টিকের সুইচ। কেতলি থেকে মগে তপ্ত পানি ঢেলে দিতেই কিচেনে ছড়িয়ে গেল দামি চায়ের গন্ধ। এবার চাই এক চামচ চিনি। কৌটার দিকে হাত বাড়াতেই হঠাৎ পেছন থেকে এল কালো গ্লাভস পরা একটা হাত। ভীষণ চমকে গেল জ্যাকি।

আর্তচিৎকার করার আগেই চেপে ধরা হলো ওর মুখ। আরেক হাতে হ্যাঁচকা টানে পিছিয়ে নিল লোকটা। তার শক্ত বুকে ঠেকে গেল জ্যাকির পিঠ। খসখসে চামড়া চেপে বসল ওর নাকের ওপরে। ঝটকা দিয়ে সরে যেতে চাইল জ্যাকি। কিন্তু হামলাকারীর গ্লাভ্স পরা আঙুল যেন স্টিলের তৈরি। পেছন থেকে ধাক্কা আসতেই কিচেন কাউন্টারে সেঁটে গেল জ্যাকি। পেছনে পালোয়ানের মত কোন লোক। সামনে সারি সারি ড্রয়ার, সরে যাওয়ার উপায় নেই। লোকটার পেটে কনুই দিয়ে গুঁতো মারবে বা হাঁটুর বাটির ওপরে লাথি দেবে, সেটাও এখন সম্ভব নয়।

লোকটার গ্লাভ্স পরা হাতে মিলিমিটারের চিহ্নসহ সিরিঞ্জ দেখে ভয়ের মাত্রা বাড়ল জ্যাকির। প্লাস্টিকের স্বচ্ছ খাপটা ঢেকে রেখেছে সুঁই। সিরিঞ্জের ভেতরে হলদে তরল। পিছিয়ে নেয়া হয়েছে প্লাঞ্জার। তর্জনী দিয়ে প্লাস্টিকের খাপ টোকা দিয়ে উড়িয়ে দিল লোকটা। চকচক করছে সরু সুঁই।

জ্যাকি নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও কোনভাবেই সরে যেতে পারল না। ওকে ঠেসে ধরেছে লোকটা। দারুণ কাটছে তার প্রতিটি সেকেণ্ড। ভাল করেই জানে, গায়ের জোরে তার সঙ্গে পারবে না জ্যাকি। সিরিঞ্জের প্লাঞ্জার সামনে ঠেলে দিতেই সুঁইয়ের মুখে দেখা গেল একবিন্দু হলদেটে তরল।

অসহায় জ্যাকি চেয়ে রইল সুঁইটার দিকে। ধীরে ধীরে কাছে এল সুঁই। যে-কোন সময়ে বিধবে ওর ঘাড়ে। খুব ছোট একবিন্দু তরল টলমল করছে সুঁইয়ের মাথায়। যে-কোন সময়ে সিরিঞ্জের পুরো তরল ঢুকবে ওর দেহে।

তখনই হঠাৎ জ্যাকি বুঝল, ওকে খুন করতে আসেনি লোকটা। তা হলে দু’হাতে মটকে দিত ওর ঘাড়, বা পিঠে গেঁথে দিত ছোরা। এই লোক আসলে এসেছে ওকে ড্রাগ দিয়ে অচেতন করে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আর তারপর ভয়ঙ্কর কিছু যে করবে, তা তো বোঝাই যাচ্ছে!

এই হামলার পেছনে আছে অ্যারন কনার। সে বা তার লোক ওকে কোথাও নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করবে। পরে মেরে কটেজের সেই লোকের মত মাথা দেহ-হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে পুঁতে দেবে জঙ্গলে।

প্রচণ্ড আতঙ্কে ঘুরতে শুরু করেছে জ্যাকির মাথা। ওর মনে হলো, যে-কোন সময়ে জ্ঞান হারাবে। লোকটা আর কাউন্টারের মাঝে আটকা পড়ে কাঁপছে ওর সারাশরীর

ঘাড়ের খুব কাছে চলে এল সুঁই।

‘নড়বে না, ডার্লিং,’ জ্যাকির কানের কাছে বলল লোকটা। ‘নইলে কখন ভুল করে তোমার চোখ উপড়ে নেব, তার কি কোন ঠিক আছে!’

টিটকারি শুনে ভীষণ রেগে গেল জ্যাকি। অসহায় পেয়ে ওরই বাড়িতে ওকে নিয়ে যা খুশি করছে কিডন্যাপার!

তবে কুকুরটাকে এভাবে ছেড়ে দেবে না ও!

চিৎকার করে ডানহাত ছুটিয়ে নিয়ে তার হাতের সিরিঞ্জ সরিয়ে দিতে চাইল জ্যাকি। ভয় পাচ্ছে, যে-কোন সময়ে সুঁইয়ের খোঁচায় ফুটো হবে কবজি বা বাহু।

‘কুত্তী!’ ওর কানে হিসহিস করল লোকটা, ‘তুই চাইলেও ছুটতে পারবি না!’

জ্যাকি বুঝে গেল, ঠিক কথাই বলেছে লোকটা। ঘাড়ের কাছে চলে এসেছে সিরিঞ্জ। এমন কোন উপায়ও নেই যে লোকটার কবল থেকে রেহাই পাবে। আর তখনই ওর মনে হলো, এখনও হয়তো রয়ে গেছে একটা সুযোগ।

সামনের কাউন্টারের ওপরে আছে আগুনের মত গরম চা। ধোঁয়া উঠছে ওটা থেকে।

লোকটার হাত ছেড়ে খপ করে মগ নিল জ্যাকি, পরক্ষণে ওর কানের পাশ দিয়ে পিছনে গেল উত্তপ্ত চা। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো ব্যথা-ভরা করুণ আর্তনাদ। হামলাকারীর মুখে ছলাৎ করে গিয়ে পড়েছে মগের গরম তরল।

‘খুন করে ফেলেছে কুত্তী আমাকে! মাগী কোথাকার!’ টলতে টলতে পিছিয়ে গেল লোকটা। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে মুক্ত হয়ে গেছে জ্যাকি। একদিকে সরে গেছে লোকটার হাতের সিরিঞ্জ। এ-সুযোগে ঝটকা দিয়ে সরে গেল জ্যাকি। ভাল করেই জানে, যে-কোন সময়ে নিজেকে সামলে নেবে লোকটা।

ঘুরে প্রথমবারের মত হামলাকারীর মুখ দেখতে পেল জ্যাকি। লোকটা গণ্ডারের মত ভারী ও গাঁট্টাগোট্টা। শ্বেতাঙ্গ। বয়স হবে চল্লিশ। পোড়া ডান গার্ল ও কপাল জ্বলছে বলে আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে কামুক চেহারা। এরই ভেতরে ফুলে বুজে গেছে ডান চোখের পাতা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে যেতে পারবে না জ্যাকি।

কাউন্টারের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে হুক থেকে ভারী একটা সসপ্যান নিল ও। দু’হাতে ওটা শক্ত করে ধরে গায়ের জোরে সাঁই করে চালাল লোকটার মাথা লক্ষ্য করে। খুলির পাশে ভারী ধাতব সসপ্যান লাগতেই জোরাল ঢনাৎ শব্দ শুনতে পেল জ্যাকি। ভীষণ ঝাঁকুনি খেয়ে কেঁপে গেল ওর দুই কাঁধ।

মাথায় বাড়ি খেয়ে আরও রেগে গেল গণ্ডার। লাফ দিয়ে সামনে বেড়ে ঘ্যাঁচ করে সিরিঞ্জের সুঁই গেঁথে দিতে চাইল জ্যাকির গায়ে। কিন্তু সসপ্যান ঢালের মত ব্যবহার করেছে জ্যাকি। চকচকে স্টিলে লেগে পিছলে অন্যদিকে গেল সুঁই। সামনে বেড়ে লোকটার কবজির ওপরে চাঁই করে সসপ্যান নামাতে চাইল জ্যাকি। কিন্তু দ্রুত সরে গেল হামলাকারী। মুখ থেকে বেরোল মুলার মত দুই সারি হলদে দাঁত। মুখে টিটকারির হাসি। ‘তোর আর কোন সুযোগ নেই, কুত্তী! হারামজাদী, এবার তোর পোঁদ দিয়ে ভরে দেব আমার এই সিরিঞ্জ! তাতে বড়জোর জ্ঞান থাকবে পনেরো সেকেণ্ড। তারপর তোর ভেতরে ভরব আমার অন্যকিছু। তাতে দারুণ মজাও পাব।’

আবারও সামনে বেড়ে জ্যাকির গায়ে সিরিঞ্জ গেঁথে দিতে চাইল সে। কিন্তু চট করে সরে গেল জ্যাকি। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, তার পেছনের কাউন্টারে বিধল সিরিঞ্জ।

‘দ্যাখ, কী অকাজটাই না করলি!’ ভুরু কুঁচকে বাঁকা সুঁই দেখল গণ্ডার। বিরক্ত হয়ে ঘরের আরেকদিকে ছুঁড়ে ফেলল সিরিঞ্জ। জ্যাকেটের তলা থেকে বের করল সাত ইঞ্চি ফলার একটা ছোরা। ‘তোর কপাল আসলেই খারাপ রে! তোকে নিয়ে যাব এক লোকের কাছে! ওখানে রেপ হওয়ার পর ধীরে ধারে ধুঁকে ধুঁকে মরবি!’

ধীরপায়ে জ্যাকির দিকে এল গণ্ডার। তবে ধরা পড়ার আগেই বিদ্যুদ্বেগে একপাশে সরে গেল জ্যাকি। তখনই দেখতে পেল সুযোগটা। তেড়চাভাবে আসছে লোকটা। তাতে হয়তো তার ওদিকে চলে যাওয়ার সুযোগ মিলে যেতে পারে। সর্বশক্তি দিয়ে গণ্ডারের বুক লক্ষ্য করে সসপ্যান ছুঁড়ল জ্যাক। লোকটা কিছু বোঝার আগেই ভারী জিনিসটা ঠাস্ করে তার গলায় লেগে ছিটকে পড়ল মেঝেতে। চমকে গেছে কিডন্যাপার। আর এ সুযোগে ঝোড়ো বেগে তাকে পাশ কাটিয়ে খোলা দরজার ওদিকে পৌছে গেল জ্যাকি।

ঘুরেই ওর পিছু নিয়েছে গণ্ডার।

এদিকে ছোট্ট দোতলা বাড়ির সংক্ষিপ্ত করিডর পার করে সিঁড়ির ধাপে পৌঁছে গেছে জ্যাকি। একেকবারে তিনধাপ টপকে উঠে এল ওপরে। হাট করে খোলা বেডরুমের দরজা। ছুটে ঢুকল ঘরে। ওদিকে কিচেন থেকে বেরিয়ে মেইল ট্রেনের গতি তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে হবু কিডন্যাপার, হাতে উদ্যত ছোরা।

কয়েক পা ফেলে বিছানার পাশে চলে গেল জ্যাকি। ছোট টেবিলটার ওপরে হোলস্টারের ভেতরে আছে পিস্তল। খাপ থেকে ছোঁ দিয়ে অস্ত্রটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও।

ততক্ষণে তারী পায়ের ধূপধাপ শব্দ করে ওপরের ল্যাণ্ডিং পেরিয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়েছে গণ্ডার। জ্যাকির হাতে পিস্তল দেখে ভীষণ বিস্মিত হলো সে। ছোরাসহ হাত মাথার ওপরে তুলে কড়া ব্রেক কষে থামল। যাতে তাকে গুলি না করা হয়, সেজন্যে অনুরোধ করতে হাঁ করল মুখ। তবে দেরি করে ফেলেছে সে। সিগ সাওয়ার পি ৩২-এর গ্রিপ দু’হাতে ধরে সরাসরি গণ্ডারের বুক লক্ষ্য করে টিগ টিপে দিল জ্যাকি।

যদিও বুম শব্দে গুলি বেরোবার দল অস্ত্র থেকে এল মৃদু ক্লিক আওয়াজ। তাড়াহুড়োয় চেম্বারে গুলি না ভরেই ট্রিগার টিপে দিয়েছে জ্যাকি।

এখন আর সময় নেই যে স্লাইড টেনে চেম্বারে ভরে নেবে গুলি। ঝড়ের মত ওর দিকে এল দুই শ’ ষাট পাউণ্ডের গণ্ডার।

বিপদ বুঝে ঘুরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীর গড়িয়ে খাটের অন্যদিক দিয়ে সরু জায়গায় নেমে পড়ল জ্যাকি। প্রায় একই সময়ে স্লাইড টেনে ধাতব শব্দে চেম্বারে ভরল বুলেট। সোজা হয়ে সরাসরি গণ্ডারের বুক লক্ষ্য করে পিস্তল তাক করল জ্যাকি।

বিছানায় উঠতে গিয়ে হঠাৎ করে থমকে গেছে গণ্ডার। জ্যাকির চোখে দেখছে শীতল খুনি-দৃষ্টি।

চাপা স্বরে বলল জ্যাকি, ‘শহরের বেশিরভাগ হারামজাদা ড্রাগ্‌খোর। আমার বাবা বলত গুলি করলে সেটা করবে ঠিক দিকে। তবে বাধ্য না হলে কাউকে খুন করবে না। আমি এখন তা-ই করছি।’ সিগ সাওয়ারের নল নিচু করে গণ্ডারের ..হাঁটুর বাটি লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দিল জ্যাকি।

বন্ধ ঘরে প্রচণ্ড গর্জন ছাড়ল নাইন এমএম পিস্তল। মিলে মিশে গেল গুলির শব্দ ও গণ্ডারের আর্তনাদ। জ্যাকির বুলেট বিঁধেছে কিডন্যাপারের ডান হাঁটুর দু’ইঞ্চি ওপরের মাংসে। হঠাৎ করে তার শরীরের ওজন আর নিল না ডান পা। পঙ্গু হয়ে ধপ করে মেঝেতে আছাড় খেল গণ্ডার। হাত থেকে পড়ে গেছে ছোরা। দু’হাতে ক্ষতটা চেপে ধরল সে। তীব্র ব্যথায় মুচড়ে উঠছে কেঁচোর মত। দশ আঙুলে চেপে ধরা ক্ষত থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে রক্ত।

দৌড়ে নিচু বিছানায় উঠল জ্যাকি, পরক্ষণে লাফ দিয়ে টপকে গেল আহত গণ্ডারকে। তীরবেগে বেডরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। ওর মনে পড়ল, পকেটে রাখার আগে ডিকক করতে হবে পিস্তল। দ্রুত ভাবতে শুরু করেছে জ্যাকি। পালিয়ে যাওয়ার আগে করিডর থেকে কিছু জিনিস ওর চাই। পিস্তল কাছেই আছে। ডিকক করে পকেটে রাখল। এবার লাগবে জ্যাকেট, গাড়ির চাবি আর ওর পার্স।

বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বেরোবার সময় ওর মনে পড়ল সিরিঞ্জ রয়ে গেছে কিচেনে। ওটা জোরালো প্রমাণ। সিরিঞ্জ সংগ্রহ করতে ছুটে আবার কিচেনে ঢুকল জ্যাকি। মেঝেতে আছে ভারী সসপ্যান। পাশে কয়েক টুকরো হওয়া ভাঙা মগ। মেঝেতে ছড়িয়ে গেছে চা। কয়েক ফুট দূরে সেই সুঁই বাঁকা সিরিঞ্জ। ভেতরে হলদে তরল। কাউন্টার থেকে টিশ্যু পেপার নিয়ে সিরিঞ্জ জড়িয়ে নিয়ে পার্সে রেখে দিল জ্যাকি। দোতলায় ধুপধাপ শব্দ করছে কিডন্যাপার, গলা থেকে বেরোচ্ছে চাপা গোঙানি।

আর দেরি না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল জ্যাকি। ওর লাল গাড়িটা আছে ধুলোভরা ড্রাইভওয়েতে। দৌড়ে ওটার পাশে চলে গেল জ্যাকি। রাস্তায় চোখ যেতেই দেখল ষাট গজ দূরে সাদা একটা গাড়ি। আগে কখনও ওখানে কাউকে পার্ক করতে দেখেনি। কালো উইওস্ক্রিনের ওদিকে ড্রাইভিং সিটে বসে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে ড্রাইভার।

দ্বিতীয়বার ওদিকে না চেয়ে সুবারু গাড়িতে উঠল জ্যাকি। ইঞ্জিন চালু করে পিছিয়ে গেল ড্রাইভওয়ে ধরে। পথে নেমে এসে চাপ দিল অ্যাক্সেলারেটরে। বনবন করে চাকা পিছলে রওনা হয়ে গেল গাড়ি। ওদিক থেকে এল কালো এক সেডান। আরেকটু হলে ওটার নাকে গুঁতো দিত জ্যাকি। শেষসময়ে নিজের লেনে ফিরে আবারও গতি তুলল।

এখনও জানে না কোথায় যাবে। প্রথম কথা: পালাতে হবে এ-এলাকা থেকে। উন্মাদিনীর মত প্রচণ্ড বেগে পেরোতে লাগল সামনের গাড়িগুলোকে। হর্ন বাজিয়ে আপত্তি জানাল কয়েকজন ড্রাইভার। পরের একমাইলে দু’বার দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেল জ্যাকি। এরপর ওর ধমনী থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিল অ্যাড্রেনালিন। নিজেকে বড় বেশি ক্লান্ত লাগল জ্যাকির। ব্রেক কষে রাস্তার ধারে গাড়ি রেখে দেখল, স্টিয়ারিং হুইলের ওপরে থরথর করে কাঁপছে ওর দু’হাত। বড় করে ক’বার শ্বাস নেয়ার পর হঠাৎ করেই খুব কান্না পেল জ্যাকির। বুঝে গেছে, আর কখনও ফিরে যেতে পারবে না নিজের ভাড়া করা বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *