বিশ
ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলে পড়তে লাগল রানা।
‘কিছু বুঝতে পেরেছেন?’ মুচকি হেসে বললেন প্রফেসর।
‘ভদ্রমহিলার হাতের লেখা দারুণ সুন্দর,’ বলল রানা।
‘নিজেও ছিলেন খুব রূপসী। তাঁর পোর্ট্রেট দেখেছি। আর কিছু আপনার চোখে পড়েছে?’ রানার বুদ্ধি পরীক্ষা করতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠেছেন প্রফেসর। চকচক করছে দুই মণি।
কী দেখতে হবে সেটাই জানা নেই। প্রফেসরের খেলা একপেশে মনে হওয়ায় টেবিলে খাতা নামিয়ে রাখল রানা। বদলে নিল আরেকটা খাতা। কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে বলল, ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। ডায়েরিতে আসলে কী দেখতে হবে, আপনি সেটা বলে দিলে কৃতজ্ঞ বোধ করব।’
‘পড়ে গেলে প্রথমে মনে হবে এসব ডায়েরি খুব সাধারণ,’ রহস্যময় হাসি হাসলেন প্রফেসর। ‘আয়ারল্যাণ্ডে সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনে বড় ভূমিকা ছিল না লেডির। ডায়েরিতে পাবেন পারিবারিক চিত্র। তাঁর স্বামী ছিলেন গোঁয়ার আর দায়িত্বজ্ঞানহীন নিষ্ঠুর লোক। একসময়ে নিজ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে পুড়ে মরেন। নইলে ইতিহাসে তাঁর নাম থাকার কথা ছিল না। যদিও তখন ছিলেন প্রতিভাবান একজন বিজ্ঞানী।’
‘বোটানিস্ট, তা-ই না?’ বেলার দেয়া তথ্য মনে পড়তেই জানতে চাইল রানা।
‘তাকে বলতে পারেন একজন জাদুকর,’ বললেন কেলি 1 ‘কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে সমবয়সীদের চেয়ে একবছর আগে তুলনাহীন রেযাল্ট করে পাশ করেন। মানুষ হিসেবে ছিলেন জেদী ও উদ্ধত। ছাত্রাবস্থায় হন একজন লর্ড। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আফ্রিকায় বিস্তারের সময় মারা যান তাঁর বাবা ব্রিগেডিয়ার কেড্রিক স্টার্লিংফোর্ড। মা লিসা ছিলেন অর্ধেক স্প্যানিশ, আঠারো শ’ সাঁইত্রিশ সালে মারা যান টাইফয়েডে। তখন মাত্র তারুণ্যে পা রেখেছেন অ্যাঙ্গাস স্টার্লিংফোর্ড। প্যারিসে গিয়ে সে-সময়ের নামকরা বিজ্ঞানী সলোমান ভানানানের শিক্ষানবিশ হন।’
আরও তথ্য পাওয়ার জন্যে চুপ করে আছে রানা।
‘তিনি ছিলেন ফ্রান্সের সেরা উদ্ভিদবিদ। দু’জনের ভেতরে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। বিয়ের পর আঠারো শ’ তেতাল্লিশ ও পঁয়তাল্লিশ সালে দু’বার প্যারিসে গিয়ে ভার্নানানের সঙ্গে দেখা করেন লর্ড। বিশেষ করে ক্রিপ্টোগাস্ গবেষণায় তাঁর ওস্তাদ ছিলেন ফরাসি সেই বিজ্ঞানী।’
‘সিক্রেট সিম্বল?’ বিস্ময় নিয়ে প্রফেসরকে দেখল রানা। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন কেলি। ‘ক্রিপ্টোগ্রাম্স্ নয়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ক্রিপ্টোগাস্ মানে শেওলা, শৈবাল, লাইকেন আর ছত্রাক ধরনের উদ্ভিদ।
‘বুঝলাম,’ মুখে বললেও প্রফেসর কী বোঝাতে চাইছেন তা আঁচ করতে পারছে না রানা। মনের ভেতরে কে যেন বলছে: বোকা, এখানে এসে খামোকা সময় নষ্ট করলে।
‘কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে লর্ড স্টার্লিংফোর্ডের ছিলেন বয়স্ক এক বোটানিস্ট বন্ধু। নাম তার নরম্যান আর্চিবল্ড। পরে হন অক্সফোর্ডের ম্যাগডালেন কলেজের প্রফেসর। আধুনিক বিজ্ঞানে তাঁর তেমন কোন ভূমিকা নেই। যদিও আঠারো শ’ চল্লিশের দশকে একের পর এক রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেন। যাই হোক…’ আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন প্রফেসর।
‘হঠাৎ করে থেমে গেলেন যে?’ বলল রানা।
জবাবে চতুর হাসলেন প্রফেসর। ‘প্রথমে এসব ডায়েরি দেখে কিছু বোঝা না গেলেও তার ভেতরে আছে গোপন বার্তা। গভীরে গেলে বুঝতে পারবেন অকল্পনীয় কিছু ঘটেছিল।’
‘যেমন?’ অধৈর্য বোধ করলেও শান্ত স্বরে বলল রানা। ‘ডায়েরির অবিশ্বাস্য তথ্যটা তা হলে আসলে কী?’
‘আমি এরই ভেতরে আপনাকে সূত্র দিয়েছি। অবাক হচ্ছি যে আপনি এখনও ওটা বুঝতে পারেননি।
আরও তিক্ত হলো রানার মন। লোকটা এত অসুস্থ না হলে ঘাড় ধরে চেয়ার থেকে টেনে তুলে বারকয়েক ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলত, ‘যা বলার জলদি বলুন, নইলে মটকে দেব ঘাড়!’
‘একটা কথা বলুন তো, মিস্টার রানা,’ বললেন প্রফেসর, ‘আঠারো শ’ চল্লিশের দশকের শেষদিকে আয়ারল্যাণ্ডে কী ঘটেছিল? আর এসব ডায়েরির লেখিকা কেন সে-বিষয়ে বারবার উল্লেখ করেছেন?’
‘দুর্ভিক্ষ?’
মাথা দোলালেন প্রফেসর কেলি। ‘ঠিকই ধরেছেন। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে ওটাকে দুর্ভিক্ষ বলব না। ডায়েরি পড়লে আপনি বুঝবেন, ওটা অন্যকিছু ছিল। মিসেস স্টার্লিংফোর্ডের মত আমিও ওটার কথা ভুলব না। আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া আর এর পরের কয়েক বছর যে কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে গেছে আয়ারল্যাণ্ডের মানুষ, সেটা ইতিহাসে খুব কালো এক বাজে অধ্যায়।’
‘মড়ক ধরেছিল দেশের সমস্ত এলাকার আলুর গাছে, বলল রানা। ‘ফলে শুরু হয়েছিল দুর্ভিক্ষ, তা-ই না?’
‘যারা সত্যিটা জানে, তারা অন্য কথা বলবে। সত্য ছিল ভিন্ন রকম।’ রানা কিছু জানে না বুঝতে পেরে চকচক করছে প্রফেসরের চোখ। ‘আপনার যে পরিচিতি পেয়েছি, তাতে ভেবেছি আমার দেয়া তথ্য পেয়ে চট্ করে সব বুঝে নেবেন। ইতিহাসে যা লেখা হয়, সেটা সবসময় সঠিক হবে তা নয়। কোন দেশের সরকার চাইলেও সবসময় সত্যিটা প্রকাশ করতে পারে না।
‘তা হলে আপনিই বরং বলুন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সত্যটা আসলে কী,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।
‘আপনি বোধহয় আলু চেনেন?’ বললেন প্রফেসর কেলি ভদ্রলোকের কথা শুনে বিরক্তি বাড়ল রানার। ‘জী।’
চেয়ারে হেলান দিলেন প্রফেসর। ‘আয়ারল্যাণ্ডে আঠারো শ’ চল্লিশের দশকে জনসংখ্যা ছিল সবমিলিয়ে আশি লাখ। আর তারা ছিল মাত্র একটা সবজির ওপর নির্ভরশীল। আসলে আলু ছাড়া আর কোন খাবার তখনকার মানুষের ক্যালোরি মেটাতে পারত না। আয়ারল্যাণ্ডের গ্রাম্য মানুষ বলতে গেলে তিনবেলা শুধু আলুর তৈরি নানান খাবার খেয়ে বাঁচত। গৃহপালিত বিড়াল থেকে শুরু করে গরু-তাদেরও প্রধান খাবার ছিল সেই একই আলু। পাঁচজনের পরিবারের সপ্তাহে লাগত আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ আলু। ফসলের মাঠে প্রচণ্ড শ্রম দিত বলে শরীর সুস্থ রাখতে বাড়ির কর্তা প্রতিদিন খেত বারো থেকে চোদ্দ পাউণ্ড আলু। আয়ারল্যাণ্ডের নারী-শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবার প্রধান খাবার ছিল সেই একই সবজি। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?’
‘বিকল্প খাবার ছিল না বলে আলুর ফলন ভাল না হলে বিপদে পড়ারই কথা,’ বলল রানা।
‘ঠিকই ধরেছেন,’ মাথা দোলালেন প্রফেসর, ‘তারা ছিল খুব ঝুঁকির ভেতরে। আসলে একটা ঝুড়ির ভেতরে সব ডিম কখনও রাখতে হয় না। আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালে বিশ লাখ একর জমিতে বাম্পার ফলন হলো। তার আগের বছর নষ্ট হয়েছিল হাজার হাজার একর জমির ফসল। তাই পরের বছরে সবাই ভাবল, পেটপুরে খেতে পারবে। ফসলের মাঠ ভরে গেল আলুর গাছের গাঢ় সবুজ পাতা ও বেগুনি ফুলে। কিন্তু জুন মাসের শুরুর দিকে কিছু এলাকায় ফসলের মাঠে দেখা দিল সংক্রমণ। মাত্র কয়েক সপ্তাহে গোটা দেশে ওটা ছড়িয়ে গেল গ্যাংগ্রিনের মত। ইতিহাসবিদেরা বলেন, বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে ঘুমাতে গেল চাষীরা। আর পরদিন জানল সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের। পচে বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে মাঠভরা হাজার হাজার আলুর গাছ। চাষীরা ব্যস্ত হয়ে মাটি খুঁড়ে তুলে আনতে চাইল আলুগুলো। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে দেখল গাছের মতই পচে কালো হয়ে গেছে বেশিরভাগ আলু। কেউ বুঝল না কীভাবে গোটা দেশের কোটি কোটি গাছ একই সময়ে ওভাবে মরল! যে ক’টা আলু বেঁচে গেল, সেগুলো দিয়ে হয়তো দেশের মানুষের খাবারের চাহিদা মিটবে মাত্র কয়েক দিনের।’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন প্রফেসর কেলি। আবারও খেই ধরলেন, ‘এরপর শুরু হলো পশ্চিমা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ। খাবারের অভাবে চোখের সামনে মরতে লাগল লাখে লাখে মানুষ। যারা এতদিন মাছ ধরে বা খরগোশ শিকার করে সবার সঙ্গে ভাগ করে খেত, তারাও যখন দেখতে পেল যে না-খেয়ে আছে তাদের পরিবার, বাধ্য হয়ে প্রতিবেশীর মুখের ওপরে বন্ধ করে দিল দরজা। কিছু দিনের ভেতরে তাদেরকেও খাবার হিসেবে ভুট্টা বা বার্লি কিনতে গিয়ে বিক্রি করতে হলো গৃহপালিত পশু। অথচ, ওগুলো তাদের শেষ সম্বল। অভাব হলে বিক্রি করবে ভেবেছিল। এরপর একে একে বিক্রি হলো চাষের যন্ত্রপাতি। এমন কী বাদ পড়ল না গায়ের পোশাক।’
রানা যেন চোখের সামনে দেখছে দুঃসহ এক সময়।
‘খাবারের অভাবে সবচেয়ে দুর্বল মানুষগুলো আগে মরতে লাগল। কেউ কেউ বাঁচতে চাইল পচা আলু খেয়ে। অন্যরা সৈকতে গিয়ে খুঁজল সামুদ্রিক পাখির ডিম ও শেলফিশ। বিষাক্ত শৈবাল খেয়ে মরল অনেকে। বাঁচার জন্যে ঘাস খেতেও দ্বিধা করেনি মানুষ। আর তখনই শুরু হলো মৃত্যু ঠেলাগাড়ির প্রচলন। স্তূপ করে ওগুলোতে শীর্ণ সব লাশ তুলে দূরে নিয়ে গিয়ে মাটি খুঁড়ে চলল গণকবর দেয়া। কারও আর সাধ্য থাকল না ইংরেজ জমিদারদের খাজনা মিটিয়ে দেবে। আর তার ফলে প্রচণ্ড মারধর খেয়ে করুণভাবে মরতে লাগল গ্রামের আইরিশ মানুষেরা। যারা প্রতিবাদ করতে গেল, তাদের মৃত্যু হলো আরও শোচনীয়ভাবে।’
কথাগুলো শুনে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে গেছে রানার চোয়াল।
‘হরদম চুরি হলো অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধ খামারিদের গরু বা শুয়োর। রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল তাদের। বাধ্য হয়ে পাহারা দিতে লাগল রাইফেল হাতে। আশপাশের গরীব প্রতিবেশীর বাড়িতে মাংসের ঝোলের গন্ধ পেলে সোজা গিয়ে খুন করত তাদেরকে। ধনীরা তাদের মাঠে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে সেগুলো ঢেকে রাখত ঘাস ও ঝোপ দিয়ে। গর্তের নিচে পুঁতে রাখা হতো বর্ণার মত চোখা লাঠি। ক্ষুধার্ত চোর তাদের বাড়ির কাছে লে গর্তে পড়ে নিদারুণ কষ্ট পেয়ে মরত। বাঁচার জন্যে নিষ্ঠুর হয়ে উঠল সবাই। সমাজ থেকে বিদায় নিল বাজনা, নৃত্য, কবিতা বা সাহিত্যের মত কোমল সংস্কৃতি।’ নিজের রক্তাক্ত হাতের দিকে তাকালেন প্রফেসর কেলি।
‘খাবারের অন্য কোন উৎস থাকলে এতবড় দুর্যোগ হতো না, বড় করে শ্বাস ফেলল রানা।
চট করে ওকে দেখলেন প্রফেসর। ‘আমার মনে হয় না আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। বাধ্য হয়েই আলুর চাষ করত চাষীরা। ওটা ছিল সবচেয়ে কমদামে পাওয়া ফসল। দেশের আশি লাখ মানুষের ভেতরে ষাট লাখ মানুষ নির্ভর করত আলুর ওপরে। এ-ছাড়া গরীবদের অন্য কোন উপায়ও ছিল না।’
জাদুঘরে দেখা পচা আলুর কথা মনে পড়তেই বলল রানা, ‘বুঝতে পেরেছি। আপনি বলুন।’
‘তা হলে বোধহয় এটাও বুঝবেন, ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে গেছে বিশ লাখ মানুষ। অথচ ওটা ঈশ্বরের তৈরি দুর্ভিক্ষ নয়। নয় সাধারণ কোন মন্বন্তর। মৃত্যু ঠেলাগাড়িতে তুলে শুধু যে লাশ নিয়ে কবর দেয়া হয়েছে, তা নয়, দাফন করা হয়েছে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকেও। তখনও তারা শ্বাস নিচ্ছে। এর এক শ’ বছর পর জার্মানিতে পাঁচ লাখ ইহুদীকে না খাইয়ে মারল হিটলারের বাহিনী। অথচ ইহুদীরা কিন্তু তখন ছিল সত্যিকারের ধনী। কথাটা বুঝতে পেরেছেন? আসলে যাদের হাতে থাকবে অস্ত্র, তারা যা খুশি করতে পারবে। আইরিশদের গরীব জনগোষ্ঠীরও কিছু করার ছিল না। বার্নার্ড শ’ এ-বিষয়ে নাটক লিখেছিলেন। আপনি হয়তো ম্যান অ্যাণ্ড সুপারম্যান নাটকটি দেখেছেন?’
‘পারতপক্ষে থিয়েটারে যাই না,’ বলল রানা।
‘জার্মানিতে যুদ্ধের সময় মারা যান আমার বাবা;’ বললেন প্রফেসর কেলি। ‘বলুন তো, ওখানে কি দুর্ভিক্ষ হয়েছিল? তা তো নয়! না খাইয়ে মারা হয় লাখ লাখ মানুষকে। খাবারের অভাব ওখানে ছিল না। আসলে খাবার দেয়া হয়নি ক্ষুধার্ত মানুষকে। আয়ারল্যাণ্ডে এই একই কাজ করে ইংরেজরা।’
‘ইতিহাসে এমন কোন তথ্য আমি পাইনি,’ আপত্তি তুলল রানা।
বিকৃত ঠোঁটে হাসলেন প্রফেসর কেলি। ‘ক্ষমতাশালীরা নিজেদের জন্যে লিখিয়ে নেয় ইতিহাস। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে, জেনে-বুঝে আয়ারল্যাণ্ডে তৈরি করা হয় দুর্ভিক্ষ। ওটা আসলে ছিল ভয়ঙ্কর এক গণহত্যা। এর আগে পৃথিবীর বুকে কখনও এতবড় জেনোসাইড করা হয়নি।’
চুপ করে শুনছে রানা।
প্রফেসর শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘অভাব আয়ারল্যাণ্ডে না থাকলেও খাবার দখল করে রেখেছিল ইংরেজরা। আঠারো শত ছিচল্লিশ ও সাতচল্লিশ সালে ফসলের মৌসুমে এই দেশ থেকে রপ্তানী করা হয়েছে পাঁচ শত টনের বেশি ফসল। সেসব থাকলে লাখ লাখ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যেত। এ-ছাড়া রপ্তানী করা হয়েছে প্রচুর পরিমাণে মাখন, ডিম আর গবাদিপশু। আয়ারল্যাণ্ডের বন্দরগুলোর মাধ্যমে এসব খাবার পাঠানো হয়েছে ইংল্যাণ্ডে। বলুন তো, কারা করেছে রপ্তানী? তারা সবাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা। এ-দেশের খেতগুলোর মালিক তখন ছিল ইংরেজ জমিদারেরা। তাদের কাছ থেকে এসব পণ্য কমে কিনত ইংল্যাণ্ডের জনতা। এ- দেশের গরু, শুয়োর আর মাখন মেটাত তাদের আশি ভাগ চাহিদা।’
‘জানতাম না,’ বলল রানা।
‘সাধারণ ইতিহাসের বইয়ে এসব আপনি পাবেন না,’ তিক্ত হাসলেন কেলি। ‘ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিত করে যেন আয়ারল্যাণ্ডের মানুষ এসব পণ্য কোনভাবেই ভোগ করতে না পারে। সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে পাহারা দিয়ে শত শত ওয়্যাগন ভরা খাবার বন্দরে নিয়ে তুলে দেয়া হতো জাহাজে।
আয়ারল্যাণ্ডের কেউ যদি একটা ডিমও চুরি করত, তো ফাঁসি দেয়া হতো তাকে। কারও কপাল ভাল হলে তাকে পাঠানো হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভয়াবহ বাজে কোন এলাকায়।
‘দুর্ভিক্ষের সময় রাস্তায় সারি দিয়ে যেত মৃত্যু ঠেলাগাড়ি। ওটার সঙ্গে রওনা হতো বন্দরের দিকে যাওয়া খাবারে ভরা ওয়্যাগন। ক্ষুধার্ত কাউকে একদানা খাবার দেয়নি ইংরেজ শাসকেরা। তাদের নিষ্ঠুরতা দেখে চমকে গিয়েছিল দুনিয়ার মানুষ। রোম ও আমেরিকা থেকে এসেছিল খাবারে ভরা জাহাজের বহর। এমন কী তুরস্কের সুলতান পাঠিয়ে দেন প্রচুর খাবার। কিন্তু সেসব খাবার দখল করে নেয় ইংল্যাণ্ডের সেনাবাহিনী।’
হাসলেন প্রফেসর কেলি। ‘শুধু তা-ই নয়, ব্রিটিশ সরকার আইন করল: যেন গরীবেরা স্যামন বা ট্রাউট মাছ ধরে খেতে না পারে। বলা হয়েছিল, এসব মাছ ভোগ করবে শুধু ধনী জমিদার ও তাঁদের অতিথিরা। আরও আইন করা হলো, ক্ষুধার্ত কোন পরিবার ফাঁদ পেতে বা গুলি করে খরগোশ মারতে পারবে না। তখন আইরিশদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হলো সব ধরনের অস্ত্র। এমন কী স্কুইরেল মারার ক্ষমতাও আর আইরিশদের থাকল না। ব্রিটিশ সরকার জানাল, বিদ্রোহের আশঙ্কায় কারও হাতে তারা কোন অস্ত্র থাকতে দেবে না। ওদিকে ইংরেজ জমিদারেরা তাদের সঙ্গীদেরকে নিয়ে খরগোশ বা যে-কোন পশু শিকার করতে পারবে। তারা যখন ক্যারিজে ঝুলিয়ে শিকার নিয়ে ফিরত, শুষ্ক চোখে সেটা দেখত ক্ষুধার্ত আইরিশেরা। চাইলে মানুষ আসলে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, সেটা ইংরেজদেরকে না দেখলে কেউ বুঝবে না।’
‘ইংরেজরা কেন এসব করল?’ জানতে চাইল রানা। ‘ফসল ফলাতে হলে আইরিশ চাষীদেরকে লাগবে। তাদেরকে না খাইয়ে মেরে ফেললে ক্ষতি তো ইংরেজদেরই।’
‘বাড়তি মানুষ ইংরেজরা চায়নি,’ বললেন প্রফেসর কেলি। ‘সাম্রাজ্যবাদী বা ব্যবসায়িক সম্প্রদায় সবসময় গরীব মানুষকে মস্তবড় বোঝা বলে মনে করে। বেশি মুনাফা করতে হলে অর্জন করতে হবে আরও সম্পদ। যেমন ধরুন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনদেরকে খোজা করে দিয়ে তাদেরই এলাকার খনিতে কাজ করাত ইংরেজরা। দক্ষিণ আমেরিকার উপজাতিগুলোকে তাদের বনভূমি থেকে উৎখাত করে কোটি, কোটি গরু পালন করে বড়লোক হয়েছে শ্বেতাঙ্গরা। বোর্নিওতে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয়দেরকে, যাতে করে দুনিয়াজুড়ে পাম অয়েলের মার্কেট দখল করতে পারে। গোটা দুনিয়ায় এই একই কাজ করছে তারা।’
কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর কেলি। ‘সংক্ষেপে বললে ব্রিটিশ সরকারের দরকার ছিল প্রচুর জমি। তাদের মনে হয়েছিল গরীব আইরিশেরা পৃথিবীর বুকে না থাকলেও কিছুই যায়-আসবে না। গরীবেরা না খেয়ে মরলে এ-দেশ হাসতে হাসতে লুটেপুটে খেতে পারবে ইংরেজেরা। আর সেটাই করেছে তারা। তখন আরও দশ লাখ মানুষ বাধ্য হয়েছিল আমেরিকার দিকে রওনা হতে। দুর্ভিক্ষ তৈরি করে গোটা এই দেশের মানুষকে ভিক্ষুক করে আরও ধনী হয়েছে. ইংরেজ সরকার।’ রানার চোখে চেয়ে শীতল হাসলেন প্রফেসর।
মানুষের লোভ কত ভয়ঙ্কর হয়, সেটা আরেকবার উপলব্ধি করে তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন। আয়ারল্যাণ্ডের দুর্ভিক্ষের বিষয়ে এ-ধরনের তথ্য ‘আগে কখনও কোথাও পড়েনি। অবশ্য এসবের সঙ্গে বেলা ওয়েসের খুনের কী সম্পর্ক, সেটা এখনও জানা যাচ্ছে না। ‘ধরে নিলাম আপনি যা বলেছেন, এসবই জেনে গিয়েছিল বেলা,’ বলল রানা। ‘কিন্তু এত বছর আগের এক দুর্যোগের কারণে ওকে খুন করা হবে কেন?’
‘ঠিকই ধরেছেন,’ বললেন কেলি। ‘বলতে পারেন এসব এখন প্রাচীন ইতিহাস। কে মরেছে আর কে মরেনি, তা নিয়ে এত ভাববে কেন কেউ? এসবে তো কারও কোন লাভ-ক্ষতি নেই। অবশ্য…’ চুপ হয়ে গেলেন প্রফেসর।
‘অবশ্য বলে থেমে গেলেন কেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘আপনি লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি ঘাঁটলে নিজেই বুঝে যাবেন আসলে কাদের আছে মস্তবড় লাভ ও ক্ষতি।’.
‘ডায়েরিতে মন্বন্তরের বিষয়ে আরও কিছু আছে?’ জানতে চাইল রানা।
গোপন কিছু বিষয় পাবেন, যে-কারণে খুন করা হয়েছে বেলা ওয়েসকে, বললেন প্রফেসর।
একুশ
‘আপনি নিজেই কি একটু খুলে বলবেন?’ ভদ্রতার সঙ্গে বলল রানা। ‘আমি জানার জন্যে বহু দূর থেকে আপনার কাছে এসেছি।’
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন প্রফেসর কেলি। ‘ডায়েরিতে সবই পাবেন। পড়তে এসেছেন। সেটাই বরং করুন। আগেই আপনাকে সেটা করতে বলেছি।’
‘আপনি সত্যিই অত্যন্ত জটিল মনের মানুষ, আগে কখনও সেটা আপনাকে কেউ বলেছে?’ বলল বিরক্ত রানা।
মুচকি হাসলেন প্রফেসর। ‘মৃত্যুপথযাত্রী হওয়ার এটা এক বড় সুবিধা, বুঝলেন? ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে না পারলেও আপনার মত একজন যোগ্য মনোযোগী ছাত্র পেয়ে গেছি!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানতে চাইল রানা, ‘বলুন তো, কেউ কি এসব ডায়েরি কপি করেছে?’
‘না, সে-উপায় ছিল না। আবিষ্কার করার পর আমি ছাড়া আর কেউ পড়েনি।’
‘তা হলে অন্য কারও এসব জানার কথা নয়,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে বেলা জেনেছে অন্য কোন উপায়ে।’
‘আমারও তা-ই ধারণা,’ বললেন প্রফেসর, কখনও কখনও দু’একটা চিঠি পাওয়া গেছে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের। সেসব আছে একাধিক ইতিহাসবিদ বা সংগ্রাহকদের কাছে। কিন্তু এসব চিঠি ডায়েরির মত এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’
‘তা হলে বেলা জানত না আপনার কাছে রয়ে যাওয়া ডায়েরির গোপন তথ্য?’
‘ঠিকই ধরেছেন। সে ডায়েরি পায়নি। তথ্য পেয়েছে অন্য কোন উৎস থেকে। যদিও সে-সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।’
‘আমি একে একে গুছিয়ে নিচ্ছি আমার চিন্তা,’ বলল রানা, ‘প্রথমে কিছুদিন আগে বেলা জানল, আপনার কাছে আছে ডায়েরি। ওগুলো দেখতে চাইল সে। সেজন্যে মেসেজ দিল আপনাকে। আপনি রাজিও হলেন। কিন্তু ততক্ষণে মারা গেছে বেলা।
‘সেজন্যে আমি সত্যিই দুঃখিত,’ বললেন প্রফেসর। ‘ই- মেইল যখন করল, তার অনেক পরে ওটা দেখেছি। আর শেষ মেসেজ বোধহয় দিয়েছে মৃত্যুর দুই বা তিনদিন আগে।’
চট করে তাঁকে দেখল রানা। ‘ই-মেইল করেছিল বেলা?’
‘আমি বোধহয় আপনাকে বলতে ভুলে গেছি। একটা চিঠির বিষয়ে লিখেছিল বেলা ওয়েস।’
‘সেটা কী ধরনের চিঠি?’
‘যে চিঠি দেয়া হয়েছিল হানি ফ্লেচারকে।
আগামাথা বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকল রানা।
দেখি বেলা ওয়েসের ই-মেইল খুঁজে পাই কি না, চেয়ার ছেড়ে আড়ষ্ট পায়ে ডেস্কের পেছনে গেলেন প্রফেসর। ছোট এক ল্যাপটপ নিয়ে ফিরলেন চেয়ারে। হাঁটুর ওপরে মেশিনটা রেখে ডালা খুলে অন করলেন সুইচ। তাঁর চশমার দুই কাঁচে লেগে ঠিকরে গেল স্ক্রিনের নীলচে আলো।
‘এই যে,’ কিছুক্ষণ পর বললেন, ‘পড়ে শোনাচ্ছি: ‘প্রিয় প্রফেসর কেলি, আপনার হয়তো মনে আছে কিছু দিন আগে যোগাযোগ করেছি। জানতে চেয়েছি, আপনার কাছে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের যেসব ডায়েরি আছে, সেগুলো আমি দেখতে পাব কি না। আপনার সঙ্গে যখন যোগাযোগ করি, তারপর রিসার্চের কারণে ডায়েরিগুলো দেখা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। আমার হাতে হানি ফ্লেচারের কাছে লেখা জেনিফার হলওয়ের একটি চিঠি আছে। ওটা লেখা হয়েছে আঠারো শ’ ঊনপঞ্চাশ সালের শেষদিকে। তখন মাত্র ইংল্যাণ্ডে ফিরে গেছেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। যাঁরা আয়ারল্যাণ্ড থেকে তাঁকে দেশে ফিরতে সহায়তা করেন, চিঠিতে তাঁদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ দেন তিনি। তাঁরা হেনরি ফ্লেচার, তাঁর দুই বোন হানি ও এলিজা। এ-ছাড়া লেডি ধন্যবাদ জানান বায়ার্ন কনারকে। এঁরা লেডিকে লর্ড স্টার্লিংফোর্ডের খপ্পর থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেন।’
স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে রানাকে দেখলেন প্রফেসর। ফ্লেচার পরিবার ছিল লেডির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ডায়েরিতে মাঝে মাঝে তিনি লিখেছেন তাঁদের কথা। তখন নামকরা পরিবেশবিদ ও মানবতাবাদী এক সঙ্ঘের সংগঠক ছিলেন ফ্লেচার। দুই যমজ বোনকে নিয়ে বাস করতেন বাথ-এ। লেডি স্টার্লিংফোর্ড যখন এবারডেন হলে ছিলেন, মাঝে মাঝেই আয়ারল্যাণ্ডে এসে তাঁর আতিথ্য নিতেন তাঁরা। দাম্পত্য-কলহ বিশ্রী আকার ধারণ করলে ইংল্যাণ্ডের উঁচু সমাজে লেডি স্টার্লিংফোর্ডকে ঠাঁই করে দেন তাঁরা। ‘রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রচণ্ড প্রভাব ছিল তাঁদের…’
প্রফেসরের কথা আর শুনছে না রানা। চমকে গেছে বায়ার্ন কনার নামটা শুনে। আইরিশ এ-বংশ বিরল নয় এ- দেশে।
বেলা নিজেও নোটবুকে লিখেছে বায়ার্নের কথা। লোকটা জন্ম নিয়েছিল আঠারো শ’ নয় সালে। আর তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে ম্যালাচি চার্চে গিয়েছিল বেলা। ওর মত লোকটার বংশ-পরিচয় জানত না বলে প্যারিশের রেকর্ড থেকে আসল লোকটাকে খুঁজে নিতে পারেনি রানা।
কিন্তু এর অর্থ আসলে কী?
দ্রুত মনে মনে কিছু হিসাব কষল রানা।
বায়ার্ন নামটা কেন নোটবুকে লিখল বেলা, সে এক জটিল রহস্য। তবে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের চিঠি পড়েই তার ব্যাপারে বোধহয় আগ্রহী হয়ে ওঠে বেলা। দেরি না করে আবারও যোগাযোগ করেছিল প্রফেসর কেলির সঙ্গে। ওদিকে চার্চের রেকর্ড ঘেঁটে বের করল বায়ার্ন কনারের বিষয়ে তথ্য। একই সময়ে ফোন দিল লণ্ডনে গ্রেগ কার্সটির কাছে। লোকটা জানাল ওকলাহোমার টুলসা শহরের মেয়র অ্যারন কনারের ফোন নম্বর। এরপর বহুক্ষণ আইরিশ-আমেরিকান লোকটার সঙ্গে আলাপ করেছিল বেলা।
কিন্তু কী ছিল তাদের কথা বলার বিষয়টি?
বংশক্রম জেনে নেয়ার জন্যে ফোন দিয়েছিল বেলা? পকেট থেকে বেলার নোটবুক নিয়ে পাতা উল্টে তথ্যগুলো আবারও পড়ল রানা:
কথা বলেছি সেইণ্ট ম্যালাচি চার্চের ফাদার ও-সুলিভানের সঙ্গে। জানলাম তাঁদের রেকর্ড অনলাইনে নেই।
বায়ার্ন ১৮০৯ সালে জন্মালে কীভাবে ১৮২২!!! এ তো অসম্ভব!!!!!
লোকটার পরিচয় ও জন্ম সাল এখন জানে রানা। কিন্তু শেষদিকের লাইনে এ তো অসম্ভর, এটাই বা কেন লিখেছে?
‘বায়ার্ন কনার সম্পর্কে আপনার কাছে আরও কিছু লিখেছে বেলা?’ প্রফেসরকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইল রানা।
‘শুধু এটুকু,’ বললেন কেলি, ‘ই-মেইলের শেষাংশ পড়ে শোনাচ্ছি: ‘আমি খুবই আগ্রহী রায়ার্ন কনারের বিষয়ে। মনে হচ্ছে লেডির ডায়েরিতে তার সম্পর্কে আরও কিছু পাব। আপনার জবাবের জন্যে অধীর অপেক্ষা করছি, স্যর।’ স্ক্রিন থেকে চোখ তুললেন প্রফেসর। ‘ব্যস, আর কিছুই নেই।’
‘এরপর আর বেলার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়নি?’
দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ‘আমার ধারণা, আমার ই-মেইলের জন্যে অপেক্ষা করেছিল। আর পরে…’ চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
‘তাঁর ডায়েরিতে বায়ার্ন কনারের ব্যাপারে বিশেষ কিছু লিখেছেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড?’ জানতে চাইল রানা।
‘বেশ ক’বার। তবে লেডি কেন তার ব্যাপারে লিখলেন, সেটা জানি না। স্টার্লিংফোর্ড এস্টেটের সামান্য এক আইরিশ চাকর ছিল সে। লেডির ঘোড়া রাখত।’
কথাটা শুনে একটু হতাশই হলো রানা।
চোখ বুজে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘অনেক রাত হলো, মিস্টার রানা। এবার আমাকে ক্ষমা করতে হবে। আশা করি লেডির ডায়েরি পড়ে সবই বুঝবেন। আমি এখন গিয়ে শুয়ে পড়ব। আবার না হয় আলাপ হবে সকালে।’
চেয়ার ছেড়ে টেবিল থেকে চার খণ্ড ডায়েরি হাতে নিল রানা। ‘আপাতত এগুলো আমি নিচ্ছি।’
‘জানতাম তা-ই করবেন, চেয়ার ছেড়ে ডেস্কের ওপরে ল্যাপটপ রাখলেন প্রফেসর। ‘আমার মনে হয় না যে রাত কাটাতে কোন হোটেলরুম বুক করেছেন। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই। ভিলার পাশেই অতিথির জন্যে কোয়ার্টার আছে। আমার সঙ্গে আসুন।’
আলো থেকে সরে দরজা খুলে করিডরে বেরোলেন তিনি। ব্যাগ কাঁধে তুলে তাঁকে অনুসরণ করল রানা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুঝল, কেন রাতের আঁধারকে সঙ্গী করেছেন প্রফেসর। আকাশ থেকে মৃদু আলো বিলিয়ে চলেছে অসংখ্য তারা। তাতে কোন ধরনের অসুবিধা হচ্ছে না তাঁর।
‘একমিনিট, মিস্টার রানা, অ্যাডি ও ন্যানিকে রাতের খাবার দেব, তারপর আপনাকে পৌঁছে দেব গেস্ট-হাউসে।’ উঠনে কেনেলের দিকে গেলেন প্রফেসর। আউট হাউস থেকে ডগ ফুডে ভরা বড় দুটো থালা এনে রাখলেন কেনেলের মুখে। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল দুই জার্মান শেফার্ড। গপগপ করে খেতে লাগল সুস্বাদু খাবার।
আদর করে কুকুরদুটোর মাথা চাপড়ে দিলেন প্রফেসর। রানার কাছে ফিরে বললেন, ‘ভালুকের মত বড় হলেও ওরা খুব নিরীহ। আপনার কোন ক্ষতি করবে না। অবশ্য এই খবর তো আর ডাকাতেরা জানে না। কী রে, ঠিক বলেছি না?’
খাবার থেকে মুখ তুলে তাঁকে দেখল দুই কুকুর।
রানা বুঝতে পারল, প্রফেসর আসলে ওর মতই বড় বেশি একা।
এবার চলুন, গেস্ট-হাউস দেখিয়ে দিই,’ বললেন কেলি। ‘নিশ্চয়ই এরই ভেতরে খিদে লেগেছে আপনার? কিচেনে সবই আছে। যেটা খুশি নেবেন। বেশিরভাগই টিনজাত খাবার। এ-ছাড়া পাবেন মাঝারি মানের কয়েক বোতল ওয়াইন। আরও ভাল কিছু নেই, কারণ আমার কাছে অতিথি আসেন না।’
‘পরিবারের কেউ আপনার সঙ্গে থাকেন না?’ প্রফেসরের পিছু নিল রানা।
‘না,’ মাথা নাড়লেন তিনি। ‘আমি আমার বংশের শেষ মানুষ। বহু বছর লাগে এক মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। তবে তার পছন্দ হয়নি আমাকে। বিয়ে করা আর হয়ে ওঠেনি। তাই ছেলেমেয়েও নেই। নিজেকে বুঝ দিই যে, অ্যাডি আর ন্যানিই আমার সন্তান। তাই ব্যবস্থা করেছি, যাতে আমি মারা গেলেও খাবারের কষ্ট যেন পেতে না হয় ওদেরকে।
কথাগুলো শুনে মন খারাপ হয়ে গেল রানার।
‘আপনি হয়তো ভাবছেন, বুড়ো এক প্রফেসর এমন রাজপ্রাসাদের মত মস্ত বাড়ির মালিক কীভাবে হলো,’ হাসলেন প্রফেসর। ‘রিটায়ার করার পর যে টাকা পেয়েছি, তাতে এমন বাড়ির মালিক হওয়ার কথা নয়। তবে আমার এক অবিবাহিত চাচা মারা গেলে তাঁর করা উইলের কারণে হাতে আসে কয়েক লাখ পাউণ্ড আর এই ভিলা। টাকা খাটিয়েছি ব্যবসায়। তাতে যে মুনাফা আসে, ভালভাবেই চলে যায় আমার।’
ভিলার পাশে ছোট দোতলা বাড়ির সামনে গিয়ে থামল ওরা। দরজা খুলে রানার হাতে চাবি দিলেন প্রফেসর। ভারী গলায় বললেন, ‘নিজের বাড়ি বলে মনে করবেন, মিস্টার রানা। ডায়েরি পড়তে গিয়ে আবার রাত করবেন না। নিশ্চিন্ত ঘুম বোধহয় দুনিয়ায় সেরা প্রাপ্তি। ভাল থাকুন। শুভরাত্রি।’
বিমর্ষ মানুষটাকে ছায়ার ভেতর দিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে দেখল রানা।
বাইশ
বিশাল ভিলার পাশে ছোট দোতলা বাড়িটা চমৎকার এক ছোট কটেজের মত। একতলা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার প্যাসেজে। মাঝে করিডর রেখে মুখোমুখি দুটো বেডরুম। একটার আছে ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো, ওদিকে ব্যালকনি। এ-ঘর পছন্দ করল রানা। অ্যান্টিক খাটের ওপরে ভেলভেটের লাল চাদরে নামিয়ে রাখল লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি রাত হলেও খিদে নেই, তাই কিচেন থেকে কোন খাবার নিল না।
গরম পড়েছে আজ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রফেসর কেলির কথা মনে পড়ল রানার। কিছুক্ষণ পর বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে বসে পড়ল খাটের নরম গদিতে। বিড়বিড় করে বলল,
‘দেখি কী লিখেছেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড!’
মশার অত্যাচার ঠেকাতে জানালায় ঝুলছে ভারী পর্দা। ঘরে ঢুকছে না চাঁদের আলো। খাটের পাশে নিচু টেবিলে ছোট এক ল্যাম্প। ওটা জ্বেলে মৃদু আলোয় প্রথমদিকের ডায়েরি খুলল রানা। ঝাপসা হওয়া কালিতে প্রথম পৃষ্ঠার ওপরে লেখা: আঠারো শ’ বেয়াল্লিশ সাল, মে মাসের তেরো তারিখ।
বিয়ের মাত্র কিছু দিনের ভেতরে এবারডেন হলে এসে ডায়েরি লিখতে শুরু করেন মহিলা। এক এক করে পৃষ্ঠা উল্টে যেতে লাগল রানা।
যেমন সুন্দর লেডির হাতের লেখা, তেমনি দারুণ গুছিয়ে লিখতেন। কোথাও বাড়তি কোন শব্দ নেই। পাঠকের মনে ফুটে ওঠে আঠারো শতকের নির্জন এক মস্ত ম্যানশনে বসে ডায়েরি লিখে চলেছে অদ্ভুত রূপবতী এক নিঃসঙ্গ যুবতী। রানার মনে পড়ল, মাত্র গতকাল দেখে এসেছে সেই ধসে পড়া বাড়ি।
আরও কিছুটা পড়েও চমকে যাওয়ার মত কিছু পেল না ও। অভিজাত এক পরিবারের সাধারণ সব কথা চমৎকার করে লেখা। আঠারো শ’ বেয়াল্লিশ সালে লেডি স্টার্লিংফোর্ডের দৈনন্দিন জীবনে উত্থান-পতন ছিল না। অবশ্য অনুযোগ করেছেন, বাইরের সামাজিক বা বাড়ির কর্মকাণ্ডে তাঁকে জড়াতে চান না তাঁর স্বামী।
‘অবাক লাগে, কীভাবে ষাঁড়ের মত এক গোঁয়ার পুরুষ চাকরকে বাড়ির সব দায়িত্ব দিয়েছে আমার স্বামী। অবশ্য আমার ব্যক্তিগত চাকর পামেলা সত্যিই হাসিখুশি ভাল মেয়ে। সে আর বায়ার্ন এই বাড়িতে না থাকলে হয়তো বিরক্তির কারণে আত্মহত্যা করে বসতাম।
বায়ার্ন কনারের বয়স যখন তেত্রিশ বছর, নতুন বধূ হয়ে এবারডেন হলে পা রাখেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। মিষ্টি আচরণ করে তাঁর মন জয় করে নিয়েছিল কনার। কিন্তু এত বছর পর তার ব্যাপারে এত আগ্রহী হয়ে উঠল কেন বেলা?
ডায়েরি নীরবে পড়তে লাগল রানা। পরের কয়েক পৃষ্ঠার পর লেডি লিখেছেন: ম্যানশনের কর্ত্রী হিসেবে তাঁর কোন ভূমিকাই নেই। বেশিরভাগ সময় তাঁর কাটে পিয়ানো বা হাপ বাজিয়ে, বই পড়ে। যখন খুব বিরক্তি লেগে যায়, এবারডেন হল থেকে বেরিয়ে ঘুরে আসেন দূরের গ্রাম থেকে। তখন সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকে প্রিয় ঘোড়া এলিসা। ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসলেও স্বামীর সঙ্গে শেয়াল শিকারে যেতেন না। কাজটা খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হতো তাঁর। এক জায়গায় লিখেছেন: ‘এমনিতেই শেয়ালের জীবন খুব কষ্টকর, সবসময় পেটে খাবার জোটে না। স্রেফ মজা পাওয়ার জন্যে হিংস্র কুকুর দিয়ে তাদেরকে ভয়ঙ্করভাবে হত্যা করা আর যাই হোক, আনন্দের কিছু হতে পারে না। তবে আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আমার স্বামী এবং তার রক্তলোলুপ বন্ধুরা।’ আরও কয়েক মিনিট ডায়েরি পড়ার পর আঠারো শত বেয়াল্লিশ সালের নভেম্বরে আবারও এল বায়ার্ন কনারের কথা। ভাল আচরণের জন্যে মানুষটাকে সত্যিই পছন্দ করতেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বায়ার্ন ছিল নরম মনের প্রকাণ্ড এক দানব। খুব শ্রদ্ধা করত লেডিকে। যত্নের সঙ্গে দেখভাল করত তাঁর ঘোড়াগুলোকে। আরও কয়েক পাতা পড়ার পর রানা জানল, গোপনে বায়ার্নের কাছ থেকে আয়ারল্যাণ্ডের স্থানীয় গ্যালিক ভাষা শিখছিলেন তিনি। কাজটা আড়ালে করতে হতো, কারণ ইংরেজ সরকারের তরফ থেকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল সেই ভাষা। কোন আইরিশ তার বংশ-পরিচয় জানাবার জন্যে গ্যালিক ভাষা ব্যবহার করতে পারত না। ‘আমার স্বামী যদি একবার জানতে পারে এই ভাষায় কথা বলেছি, তা হলে তুলকালাম করবে সে। আইরিশেরা নাকি আমাদের চেয়ে অনেক নিচু জাতের মানুষ। তাই কাজের মানুষদেরকে জানিয়ে দিয়েছে, তার সামনে গ্যালিক ভাষায় কথা বললে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে মেরে পিঠ ফাটিয়ে দেবে।’ তিক্ত হয়ে পরের বাক্য লিখেছেন লেডি: ‘পারলে আমাকে ওদের মত করে চাবুক পেটা করে দেখুক! আইরিশদের মাতৃভাষা আমার কাছে ওদের দারুণ সুন্দর তৃণভূমি, পাহাড়, উপত্যকা বা গিরিসঙ্কটের মতই মাধুর্যময় বলে মনে হয়।
এবারডেন হলের কর্মচারী পামেলা ও বায়ার্ন ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি লেডির। অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতেন ইংল্যাণ্ড থেকে এবারডেন হলে বেড়াতে আসবেন তাঁর আত্মীয়রা। এঁরা দুই যমজ বোন হানি ও এলিজা ফ্লেচার। বয়সে লেডির এগারো বছরের বড় তাঁরা। এঁদের বড় ভাই নামকরা ডাক্তার ও পরিবেশবিদ হেনরি ফ্লেচার বোনেদের সঙ্গে বেড়াতে আসছেন জেনে খুশি হন জেনিফার। ডায়েরিতে মাঝে মাঝেই লিখেছেন: ‘মানসিকতার দিক থেকে কোথায় আমার খালাত ভাই ভদ্র ও সংযত হেনরি ফ্লেচার, আর কোথায় আমার স্বামীর হৈ-চৈ করা ষাঁড়ের মত খুনি বন্ধুরা! ডিনারে গপ-গপ করে একগাদা খাবার খাওয়ার পর বোতলের পর বোতল পোর্ট গিলে মাতাল হয়ে ওঠে এরা। টেবিল সোফা পুড়িয়ে দেয় চুরুটের আগুনে। লোকগুলোর দস্তু ভরা কথার ভেতরে নগ্নভাবে প্রকাশ পায় টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার লোভ! আজ সন্ধ্যার পর দুনিয়ার আরেক প্রান্তে অদ্ভুত সুন্দর এক দেশের কথা জানিয়েছেন হেনরি ফ্লেচার। তাঁর প্রতিটা কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছে অতিথি ভদ্রমহিলারা।’
মেক্সিকোতে দুর্লভ প্রজাপতি ধরেছেন হেনরি। একা গিয়ে উঠেছেন তুরস্কের দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায়। ডায়েরি পড়ে রানার মনে হলো, লেডি স্টার্লিংফোর্ডের হৃদয়ের বড় এক অংশ জুড়ে ছিলেন খালাত ভাই হেনরি ফ্লেচার। অবশ্য আজ কোনভাবেই প্রমাণ করা সম্ভব হবে না, তাঁরা স্রেফ পরস্পরের বন্ধু ছিলেন না।
চারপাশের সবাইকে মানুষ বলেই গণ্য করতেন লেডি স্টার্লিংফোর্ড। তাঁকে পছন্দ না করার মত কোন কারণ দেখতে পেল না রানা। যদিও এটা বুঝতে পারছে, বহুদূর থেকে এই দ্বীপে এসেও জরুরি কোন সূত্র এখনও পায়নি। পুরো একঘণ্টা ডায়েরি পড়ার পর চোখ তুলে দেখল অন্য তিন ডায়েরি। সব পড়তে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগবে ওর।
এবার দ্রুত পাতা উল্টে গেল রানা। আরও কিছুক্ষণ পর প্রথম ডায়েরি শেষ করে হাতে নিল দ্বিতীয় খণ্ড। লেডি ওটা লিখতে শুরু করেন আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালের সেপ্টেম্বরের বিশ তারিখে। প্রথম এবং এই ডায়েরির মাঝে বোধহয় ছিল বেশ কয়েক খণ্ড। ওগুলো আর খুঁজে পাননি প্রফেসর কেলি।
এবারের ডায়েরি পুরো চার বছর পরের। ওটাতে বায়ার্ন কনারের ব্যাপারে আরও কিছু আছে কি না, সেটা বোঝার জন্যে পড়তে লাগল রানা। ওর কাছে রহস্যময় এক চরিত্র হয়ে উঠেছে আস্তাবলের কর্মচারী। রানা ভাবল, লেডি স্টার্লিংফোর্ড ইংল্যাণ্ডে ফেরার ফলে লোকটার কপালে কী জুটেছিল? আঠারো শ’ একান্ন সালে এবারডেন হল পুড়ে গেলে তখন কোথায় ছিল সে? জটিল এই কাহিনীতেই বা কী ভূমিকা তার?
পরবর্তী তিন লাইন পড়তে না পড়তেই উঠনে হুঙ্কার ছাড়ল দানবীয় দুই জার্মান শেফার্ড। অস্বাভাবিক কিছু দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছে ওরা। ওটা হয়তো পেঁচা বা কোন নিশাচর প্রাণী, ভাবল রানা। পলকের জন্যে ডায়েরি থেকে ছুটে গেছে ওর মনোযোগ। উঠনের কাছে ঘেউ-ঘেউ করছে দুই কুকুর।
পরক্ষণে আবারও মনোযোগ নষ্ট হলো রানার। এবার যে শব্দ শুনতে পেয়েছে, তাতে চমকে গিয়ে তাকাল পর্দা দিয়ে ঢাকা জানালার দিকে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে ওর শরীর।
চারপাশে নেমে এসেছে নীরবতা। তবে তার আগে যা শুনেছে রানা, সেটা খুব অস্বাভাবিক। পর-পর দু’বার চাপা ধুপ আওয়াজে গর্জে উঠেছে সাইলেন্সার্ড পিস্তল। কাতরে উঠে চুপ হয়ে গেছে কুকুরদুটো। এখন কবরের মত নীরব চারপাশ।
রানা বুঝে গেল, কয়েক সেকেণ্ড আগে খুন করা হয়েছে প্রফেসর কেলির বিশ্বস্ত কুকুরদুটোকে!
তেইশ
ধকধক করছে রানার বুক। লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিভিয়ে দিল রিডিং ল্যাম্প। নীরবে চলে গেল ফ্রেঞ্চ জানালার সামনে। পর্দা সামান্য ফাঁক করে তাকাল ব্যালকনির দিকে। চাঁদের আলোয় অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না ওর। আগের মতই ভিলার বাগানের গাছপালা ও ঝোপঝাড় নিথর।
ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে রেইলিঙের এক পিলারের পেছনে বসে পড়ল রানা। চারপাশে শব্দ বলতে ঝিঁঝির টানা সুরতান। একটু পর রেইলিঙের পিলারের পাশ দিয়ে চেয়ে নিচে দেখতে পেল নড়াচড়া। প্রথমজনের পিছু নিয়েছে দ্বিতীয়জন। ট্রেনিং নেয়া চোখ না থাকলে অন্ধকারে তাদেরকে দেখবে না কেউ। উঠন পেরিয়ে ছুটে আসছে ভিলার দিকে অচেনা জায়গায় দক্ষভাবে রয়ে যাচ্ছে ছায়ার ভেতরে। রানা বুঝে গেল, মিলিটারি থেকে প্রশিক্ষিত সৈনিক বা অফিসার এরা। যুদ্ধের এই একই ট্রেনিং আছে ওর। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ভিলার ছায়ায় হারিয়ে গেল তারা।
ব্যালকনি থেকে রানা দেখল, ভিলার দেয়াল ছেয়ে আছে আইভি লতায়। ঝরা ফুলে ভরা মাটি ব্যালকনি থেকে কমপক্ষে পনেরো ফুট নিচে। দ্বিধা না করে রেইলিং টপকে গেল রানা। দু’হাতে ধরেছে পুরু দুই আইভি লতা। দেয়ালে পা রেখে নেমে যেতে লাগল দ্রুত। তিরিশ সেকেণ্ড পেরোবার আগেই নামল ফুলের বেডের ভেজা মাটিতে। সামনেই পোর্টিকোর খোলা দিক, দেয়াল ঘুরে চলে গেছে বাড়ির মূল অংশে। লোকদুটো কোথায় গেছে বুঝতে গিয়ে সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। গভীর রাতে ঝিঁঝির ডাক ছাড়া কোথাও কোন আওয়াজ নেই। একটু পর ওর চোখে পড়ল উঠনে গাঢ় ছায়ায় পড়ে আছে কালো দুটো স্তূপ। নিঃশব্দে ওখানে গেল রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে ওগুলো আসলে কী।
মৃত এক জার্মান শেফার্ডের দিকে ঝুঁকে গেল রানা। চাঁদের ম্লান আলোয় দেখল মাটিতে চকচক করছে কী যেন। বুলেটের আঘাতে কুকুরটার ঘাড় ফুটো হওয়ায় চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত।
ঘাসজমি পেরিয়ে পোর্টিকোতে গেল রানা। ফ্ল্যাগস্টোনের মেঝেতে মৃদু শব্দ তুলছে ওর বুট। ভিলার সামনে পৌঁছে দেখল হাট করে খুলে রাখা হয়েছে দরজা। লোকদু’জন সময় নেয়নি লক খুলতে। এরা যারাই হোক, দক্ষ নিজেদের কাজে। দরজা পেরিয়ে ভিলায় ঢুকল রানা। অন্ধকার মোজাইক করা হলওয়ের সামনেই চওড়া করিডর। আগে সে- পথে প্রফেসরের স্টাডিতে গেছে রানা। ওপরের হলদে বাতির আলোয় দেখতে পেল ডানে উঠে গেছে কারুকাজ করা রেইলিং দেয়া সিঁড়ি। ওটার কাছে থেমে দূর থেকে শুনতে পেল মানুষের গলা।
রাতে পুরনো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা বড় একটা আর্ট। আর বিদ্যাটা কাজে লাগে বলে শিখে নিয়েছে রানা। এ-বাড়ির সিঁড়ির কাঠের ধাপ নরম হলেও মাঝ দিয়ে গেছে মার্বেলের রানার। একেকবারে মার্বেলের দু’ধাপ ডিঙিয়ে দোতলায় উঠে এল রানা। কারুকাজ করা রেইলিং গেঁথে গেছে একদিকের দেয়ালে। পাশেই বড় ল্যাণ্ডিং। নিচে হলওয়ে। আগের চেয়ে স্পষ্টভাবে গলা শুনতে পেল রানা। কর্কশ স্বরে কথা বলছে একাধিক লোক। রানা তিক্ত মনে ভাবল: এরা যারাই হোক, প্রফেসরের ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়!
ল্যাণ্ডিং থেকে সরাসরি গেছে চওড়া এক প্যাসেজ। ওটার একটু দূরে রানা, দেখতে পেল আধখোলা দরজা। ঘরের ভেতরের আলো এসে পড়েছে প্যাসেজের মেঝেতে।
সতর্ক পায়ে এগোল রানা। মন দিয়ে শুনছে গলার আওয়াজ। যদিও বুঝতে পারছে না কী বলা হচ্ছে। করিডরের দেয়ালে ঝুলছে একাধিক পেইণ্টিং। দরজার পাশে প্রাচীন অস্ত্রের ডিসপ্লে!
সেসবের ভেতরে আছে অ্যান্টিক আইরিশ কেল্টিক ঢাল। রানার মনে পড়ল, বৃত্তাকার জিনিসটার ইংরেজি নাম টার্জ। তৈরি করা হয়েছে লোহার ফিতায় বেঁধে কাঠ ও চামড়া দিয়ে। বয়স হবে অন্তত চার শ’ বছর। ওপরের দেয়ালে ঝুলছে বেশ কিছু প্রাচীন ছোরা। নিচেই এক্স অক্ষরের মত আড়াআড়িভাবে লোহার খাপে চওড়া ফলার দুই তলোয়ার। যোদ্ধার মুঠো রক্ষা করতে গিয়ে ওদুটোর হাতল ঘিরে রেখেছে ঝুড়ির মত স্টিলের ভারী তার।
হাত বাড়িয়ে কাছের তলোয়ার দেয়াল থেকে নিল রানা। স্বস্তি বোধ করল শব্দ হয়নি বলে। ঝুড়ির ভেতরে হাতলে চেপে বসল ওর হাত। হাতল হাঙরের চামড়ার মত রুক্ষ। খাপ থেকে তলোয়ার এখন বের করলে ঝং করে শব্দ হবে। তাই খাপ থেকে ওটা বের করল না রানা। পা টিপে টিপে চলে গেল আধখোলা দরজার পাশে। উঁকি দিল ঘরের ভেতরে।
চব্বিশ
অনুপ্রবেশকারীদের বুট থেকে শুরু করে পোশাক ও মুখের স্কি মাস্ক কালো রঙের। রানার চোখ আগে গেল তাদের কোমরে কালো করডিউরা হোলস্টারের ওপরে। প্রথমজনের হোলস্টারে কালো গ্লক, অন্যজনের হাতে উদ্যত একই অস্ত্র।
ঘরে রাজকীয় অ্যান্টিক খাটে ঘুমিয়ে ছিলেন প্রফেসর। ফুলেল চাদর একটু আগে তাঁর গা থেকে সরিয়ে নিয়েছে লোকদু’জন। চমকে গিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসেছেন তিনি। আর তখনই ঘাড় ধরে বিছানা থেকে তুলে দুই কবজি বেঁধে তাঁকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ঘরের মাঝের এক চেয়ারে।
চেয়ারের পেছনে থেমে প্রফেসরের মাথার তালুতে অস্ত্রের নল চেপে ধরেছে একজন। ডাবল স্ট্যাক বক্স-এর বদলে পিস্তলে ডাবল ড্রাম ম্যাগাযিন। একাধারে গুলি করতে পারবে এক শ’ রাউণ্ড। লোকটার সঙ্গীর পিঠ দরজার দিকে। চাপা স্বরে প্রফেসরকে বলল সে, ‘শুয়োরের বাচ্চা, শেষবারের মত বলছি: চুতিয়া বেটির ডায়েরিগুলো এখন কোথায়?’
তার কণ্ঠে আমেরিকার দক্ষিণের সুর স্পষ্ট। রানা ধারণা করল, এরা আলাবামা বা লুইযিয়ানার লোক। দ্বিতীয়জনের স্কি মাস্কের পেছনে পনিটেইল করা তেলতেলে সোনালি চুল। কোমরের বামদিকে হোলস্টারে গ্লক। রানা বুঝে গেল, এরা বেলার সেই দুই খুনি!
‘জলদি বল, নইলে এক গুলিতে ফুটো করে দেব তোর মগজ,’ বলল লোকটা। ‘কী করবি চট্ করে ঠিক কর্!’
দু’হাতের বাঁধন খুলতে চাইছেন প্রফেসর। খুনিদের কাছ থেকে মুক্ত হতে গিয়ে ছিঁড়ে গেছে সিল্কের পায়জামা। রানা দেখল, তাঁর ফাটা ত্বকে দগদগে লাল ঘা। খাটের পাশে টেবিলে উল্টে আছে ফুলদানী। খুনিদের বুটের নিচে থেঁতলে গেছে রঙিন কিছু ফুল। বাতাসে ভাসছে সেগুলোর মিষ্টি সুবাস। এ-ছাড়া ঘরে আছে নিকোটিনে ভরা মিন্ট চুইংগামের দুর্গন্ধ। সৈকতে সেই বিকেলে বেলার খুনিদের একজনের মুখে এই একই গন্ধ পেয়েছিল রানা। আর সেই লোকই এখন দাঁড়িয়ে আছে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে।
বেলার খুনিকে দেখে রেগে গেছে রানা। লোকটার বেল্টে ঝুলছে কা-বার কমব্যাট নাইফ। রানার মনে কোন সন্দেহ থাকল না, এই একই ছোরা দিয়ে খুন করা হয়েছে বেলাকে।
ঘরের পরিবেশ যেন হয়ে গেছে পরাবাস্তব।
কাউকে ঘুম থেকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে হাত বেঁধে দিলে ভয়ে তার প্রস্রাব করে দেয়ার কথা। অথচ তোয়াক্কা নেই প্রফেসরের। খুনিদের দিকে চেয়ে হাসছেন। এইমাত্র যেন শুনেছেন মজার কোন কৌতুক। তাঁর সাহস দেখে বিস্মিত হয়ে গেছে দুই খুনি। ভাবতে পারেনি তাদের মুখের ওপরে কেউ হাসবে।
রানা বুঝে গেল, এখন হামলা করলে হয়তো ওর দিকে হেলে পড়বে ভাগ্যের দাঁড়িপাল্লা। ঘরে ঢুকে খাপ থেকে তলোয়ার বের করে চুইংগামখোরের কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত চিরে দিতে পারবে। কিছু বোঝার আগেই গুরুতর আহত হবে লোকটা। কিন্তু সেখানেই শেষ হবে ভাগ্যদেবীর সহায়তা। রানা আবার তলোয়ার তোলার আগেই গ্লক দিয়ে ওকে ঝাঁঝরা করবে দ্বিতীয় খুনি। সুতরাং বোকার মত আক্রমণে যাওয়া ওর উচিত হবে না।
ঝটকা দিয়ে হোলস্টার থেকে গ্লক নিয়ে অস্ত্রের নল দিয়ে প্রফেসরের মুখে গুঁতো দিল পনিটেইল। মাযল নব্বুই ডিগ্রি ঘুরিয়ে পর পর দু’বার গুলি করল বেডরুমের দেয়ালে। খক- খক করে দুটো শব্দ তুলেছে সাইলেন্সার। ‘শেষবারের মত সুযোগ দিচ্ছি! বল্, বইগুলো কোথায়?’
‘জানি কীসের কথা বলছ,’ বললেন প্রফেসর কেলি। ‘এ-ও জানি, ওগুলো এখন কোথায় আছে। কিন্তু খুন করলেও বলব না। সুতরাং সময় নষ্ট না করে গুলি করো আমার কপালে। শেষ হয়ে যাক দুনিয়ায় আমার কষ্টকর এই সময়।’
কড়া চোখে তাঁকে দেখছে দুই খুনি।
‘বুঝতেই পারছ, মিথ্যা বলছি না,’ বললেন কেলি। ‘আমি এ-ঘটনার একমাত্র সাক্ষী। সুতরাং আমাকে মেরে না ফেলে তোমাদের কোন উপায় নেই। তো গুলি করো। দেরি কীসের?’
ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা।
আপাতত প্রফেসরের জন্যে কিছু করতে পারবে না রানা। জেনে-বুঝেই নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনছেন ভদ্রলোক।
পরস্পরকে দেখল দুই খুনি।
প্রফেসর কেলির পেছনের লোকটা বলল, ‘শালার মাথার নাটবল্টু খুলে গেছে!’
পনিটেইল নিচু গলায় বলল, ‘কাজ শেষ করো।’
প্রফেসরের মাথার তালু ফুটো হলো এক গুলিতে। এত কম রেঞ্জে বুলেটের আঘাতে চেয়ার নিয়ে কাত হয়ে মেঝেতে পড়লেন তিনি। মৃত্যুক্ষণে দেখেছেন শুধু সাদা এক ঝিলিক। ব্যথা পাননি, কারণ মগজ ছিন্ন করে খুলির আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে বুলেট। প্রফেসরের খুনির জানা নেই, ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে নিশ্চিন্ত মৃত্যু চেয়েছেন তিনি। আত্মহত্যা করার সুইস ক্লিনিক তাঁকে এত সহজে মৃত্যু দিতে পারত না।
‘এবার?’ পিস্তলের ধূসর ধোঁয়া থেকে চোখ সরাল প্রফেসরের খুনি। ‘চাইলেও তো এত বড় বাড়ির ভেতরে ডায়েরি খুঁজে নিতে পারব না।’
‘তো?’ হাসল পনিটেইল। ‘প্ল্যান বি তো সবসময় বেশি মজার। চলো, বাড়িতে আগুন দিই।’ সেফটি অন করে হোলস্টারে পিস্তল রেখে দরজার দিকে চলল সে।
এদিকে তার জন্যে খাপে ভরা তলোয়ার নিয়ে করিডরে অপেক্ষা করছে রানা। চওড়া ফলার তলোয়ারের বিরুদ্ধে দুটো গ্লক পিস্তল। লড়াই একদম ভারসাম্যহীন। অবশ্য আগেও বহুবার এ-ধরনের বিপদের মোকাবিলা করেছে রানা। যেহেতু এখনও চমকে দিতে পারবে, তাই বিনা লড়াইয়ে শত্রুকে ছেড়ে দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। দরজা দিয়ে বেরোবার জায়গাটা লড়াইয়ের জন্যে সেরা। খোলা করিডরে এত সুবিধা পাবে না রানা।
মুখে মিন্টের গন্ধ নিয়ে ঘর থেকে আঁধার করিডরে বেরোল বেলার খুনি। আর তখনই তাকে বাগে পেল রানা। দুই খুনির যে-কোন একজনকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। পরে তার কাছ থেকে জেনে নেবে কে তাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে এবং সেটা কী কারণে। আপাতত বেঁচে থাকুক মিণ্টখোর খুনি। খাপে ভরা তলোয়ার দু’হাতে ধরে ওটার ঝুড়িওয়ালা হাতল পনিটেইলের মাথার পেছনে ঠকাস্ করে নামাল রানা। পাকা বাঁধাকপির ওপরে হাতুড়ি পড়লে এমন ধুপ শব্দ হয়।
কুকুরের মত কেঁউ করে উঠে করিডরের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে বসে পড়ল মিণ্টখোর। এরই ফাঁকে তার হাত ছোবল দিয়েছে হোলস্টারে। পিস্তল বের করলেও রানার লাথি খেয়ে ছিটকে গেল ওটা। ঠং-ঠনাৎ শব্দে গিয়ে পড়ল করিডরের দূরে। পরক্ষণে খুনির থুতনির নিচে লাগল রানার কঠিন এক লাথি। লোকটা চিত হয়ে পড়ে যেতেই ঠাস্ করে মেঝেতে বাড়ি খেল তার মাথার পেছনদিক। একই সময়ে ঘরের দরজায় থেমেছে প্রফেসরের খুনি। তার মুখোশের ভেতরে বিস্ফারিত হলো দু’চোখ। এখন তাকে শেষ করতে হলে রানার চাই স্রেফ বাড়তি একসেকেণ্ড সময়।
সামনে বেড়ে খাপ থেকে সড়াৎ করে তলোয়ার নিল রানা। যদিও ওর চেয়েও অনেক দ্রুত সতর্ক শত্রু-ঝট্ করে ঢুকে পড়ল ঘরে। তাড়া করে লোকটার বুক লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল রানা। এদিকে লাথি মেরে ওর নাকের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে প্রফেসরের খুনি। গায়ের জোরে তলোয়ার চালিয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি রানা। দরজার তক্তা ভেদ করে ঢুকে গেছে সতেরো ইঞ্চি ফলা। হ্যাঁচকা টানে ওটা ছোটাতে চাইলেও কাঠের ভেতরে ফেঁসে গেছে চওড়া ফলা। কোনমতেই আর বেরোল না।
একমাত্র অস্ত্রটা হারিয়ে রানার মনে পড়ল, করিডরে তো রয়ে গেছে পিস্তল! তলোয়ারের কথা ভুলে মিণ্টখোরের গ্লকের খোঁজে ছুটল রানা। এদিকে মার খেয়ে দমে যায়নি পনিটেইল। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে চলে গেছে পিস্তলের কাছে। অস্ত্রটা হাতে তুলে নেবে, এমন সময় তার পিঠে ভাঁজ করা হাঁটু গেঁথে দিল রানা। লোকটার চোয়ালে বসাল ডানহাতি জোরাল ঘুষি। হাড়ের সঙ্গে হাড়ের সংঘর্ষে তীব্র ব্যথা পেয়ে আঁৎকে উঠল রানা। পলকের জন্যে ভাবল, চরম অন্যায় হচ্ছে ওর প্রতি! লোকটার ব্যথার বোধ এত কম কেন! এরই ভেতরে আবারও উঠে বসছে! তার মুখে কষে আরেক ঘুষি বসাল রানা। মিণ্টখোরের মুখ থেকে ছিটকে বেরোনো রক্তে ভিজে গেল ওর মুঠো। রানার সন্দেহ হলো, ব্যাটা বোধহয় আবারও উঠে বসবে!
এদিকে মেলা সময় নষ্ট করে বসেছে। ঝট্ করে খুলে গেল প্রফেসরের ঘরের দরজা। কাঠে গেঁথে থাকা তলোয়ারের ফলা ঠং করে লাগল পাশের দেয়ালে। চৌকাঠে এসে থেমেছে দ্বিতীয় খুনি, দু’হাতে শোভা পাচ্ছে টুইন-ড্রাম ম্যাগাযিনসহ গ্লক পিস্তল! অস্ত্রের মাযল রানার দিকে তাক করেছে সে! ওদিকে মেঝেতে পড়ে থাকা গ্লুকের কাছ থেকে এখনও পুরো দু’ফুট দূরে রানার হাত!
সামনে বাড়ল প্রফেসরের খুনি। স্লো মোশনে রানা দেখল, তার বুড়ো আঙুল সরিয়ে দিল অস্ত্রের ফায়ার সিলেক্টর সুইচ। চওড়া হাসি ফুটেছে লোকটার মুখে। নীরবে যেন বলছে: শালা, এইবার তোরে পাইসি!
এক সেকেণ্ডের দশভাগ সময়ে রানা বুঝল, পড়ে গেছে মস্তবড় বিপদে! সাধারণ পিস্তলে ফায়ার সিলেক্টর সুইচ থাকে না! যে অস্ত্রের পেছনে থাকে টুইন-ড্রাম ম্যাগাযিন, ওটা অবশ্যই গ্লক ১৮এস! পিস্তলের মত হলেও ওটাকে অফিশিয়ালি ক্লাস দেয়া হয়েছে সাবমেশিন গানের। লিভার সরিয়ে সেমি-অটো থেকে অটো মোডে নিলে প্রতিমিনিটে বেরোবে বারো শ’ গুলি!
বাঁচতে হলে এখন গ্লক পিস্তলের কথা ভুলে লেজ গুটিয়ে পালাতে হবে! অন্ধকার করিডরে বুলেটের স্রোত এড়াতে মাথা নিচু করে এঁকেবেঁকে ছুট দিল রানা। বোলতার মত ভো-ভো শব্দে চারদিকের দেয়ালে বিধল একরাশ গুলি। নানাদিকে ছিটকে পড়ছে সিমেন্টের টুকরো। হুক থেকে খসে গেল ছবি। ঠুসঠাস শব্দে বিস্ফোরিত হচ্ছে কাঁচ। সামনের মেঝেতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে শরীর গড়িয়ে সরে যেতে চাইল রানা। ঠুকঠাক শব্দে সিমেন্টের টুকরো লাগছে চোখে মুখে। প্রতিমিনিটে অস্ত্র থেকে বেরোবে বারো শ’ রাউণ্ড। অর্থাৎ প্রতি সেকেণ্ডে বিশটা গুলি। তামার জ্যাকেট পরা সীসার অ্যালয়ে ভরে গেল করিডর।
কয়েক গড়ান দিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে রানা বুঝে গেল, ধাপ বেয়ে নামতে গেলে খুন হয়ে যাবে। তাই দেরি না করে ল্যাণ্ডিঙের রেইলিং টপকে খসে পড়ল শূন্যে। মাথার ওপরে দেখল কমলা ছুটন্ত ফুলকি। রেইলিঙের লোহার দণ্ডে লেগে নানাদিকে ছিটকে যাচ্ছে বুলেট।
দ্রুত নেমে যাওয়ার অনুভূতি হচ্ছে রানার। পরক্ষণে সিঁড়ির অন্তত দশ ধাপ নিচে পড়ে প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল। ওর মনে হলো ফেটে গেছে কাঁধ ও পাঁজরের হাড়। ব্যথা এতই বেশি, ভুস করে বুক থেকে বেরিয়ে গেল শ্বাস। কিন্তু এখন ব্যথা নিয়ে ভাবার সময় নয়! কয়েক ধাপ গড়িয়ে নেমে লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল একতলার দিকে। ওপরে দেখা দিয়েছে প্রফেসরের আততায়ী। খালি ম্যাগাযিন ইজেক্ট করে পিস্তলে ভরল নতুন ড্রাম ম্যাগাযিন। খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার পেছনে এল প্রথম লোকটা। গ্লাভ্স্ পরা হাতে পিস্তল, অন্যহাতে টিপে ধরে রেখেছে মাথার পেছনদিক।
নিচের পঞ্চম ধাপ থেকে নিচের মোজাইক করা মেঝেতে লাফিয়ে নেমে তীরবেগে ছুটল রানা। একবার দরজা পেরোতে পারলে পরখ করে দেখবে ওপর থেকে পড়ে হাড় ভেঙেছে কি না।
অবশ্য এখন আর অত সময় নেই রানার হাতে। ওপরের লোকটা চাপা স্বরে বলল, ‘চারপাশে আগুন ধরিয়ে দাও!’
এরা ম্যাচের কাঠির কথা ভাবছে না, ভাল করেই জানে রানা। সিঁড়ি ভরে গেল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলোর বিন্দুতে। দুই আততায়ীর ড্রাম ম্যাগাযিন থেকে বেরোচ্ছে থোকা থোকা বুলেট। ওগুলো ইনসেনডিয়ারি এক্সপ্লোয়িভ অ্যামুনিশন। যুদ্ধে শত্রুর গাড়ি ও বাড়িতে আগুন দিতে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক ছোট অস্ত্রের জন্যে নতুন টেকনোলজি। নিজেও রানা কয়েক ক্রেট ব্লু টিঙ্ এসব বুলেট খরচ করেছে শত্রুর ট্যাকটিকাল টার্গেটে। বুলেটগুলো আকারে ছোট হলেও আগুন ধরিয়ে দেবে রকেট গ্রেনেডের চেয়েও আগে।
এখন আর দরজা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে না রানা। একটা বুলেট লাগলে শুকনো শলাকার মত জ্বলে উঠবে ওর শরীর। চামড়ার জ্যাকেটের কাঁধ ফুটো করল একটা বুলেট। ভীষণ গনগনে তাপে লাল হলো ওর কান। ডাইভ দিয়ে সামনের মেঝেতে পড়ে ক্রল শুরু করল রানা। তারই ফাঁকে দেখল, ট্রেসারের মত মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে জানালার পর্দায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছে ইনসেনডিয়ারি বুলেট। হলওয়ে ভরে গেল ধোঁয়া ও আগুনে। সিঁড়ির ওপর থেকে গুলি করছে দুই খুনি। ঠকঠক করে বুলেট লাগছে দরজায়। ছিটকে যাচ্ছে কাঠের জ্বলন্ত খণ্ড। চারপাশে কটুগন্ধী ধোঁয়া।
দরজার কথা মাথা থেকে দূর করে পালিশ করা মেঝেতে উঠে দাঁড়াল রানা। দিক পরিবর্তন করে উড়ে চলল করিডর ধরে প্রফেসর কেলির স্টাডিরুম লক্ষ্য করে। এদিকে সিঁড়ি বেয়ে নামছে দুই আততায়ী। রানার দিকে অস্ত্র তাক করে উগলে দিল শতখানেক জ্বলন্ত বুলেট। বিস্ফোরিত হলো ‘সাজিয়ে রাখা গাছের বড় একটা টব। নানাদিকে ছিটকে গেল সিরামিকের টুকরো। তখনই পাশের দেয়ালে ঘষা খেয়ে করিডরে বাঁক নিল রানা। ভীষণ জ্বলছে ওর ডান কাঁধ। পেছনের করিডর হয়ে গেছে মৃত্যু টানেল। ছাত চেটে দিচ্ছে আগুনের লকলকে শিখা। বন্ধ করে দিচ্ছে রানার পালিয়ে যাওয়ার সব পথ।
ছুটতে ছুটতে দুটো বিষয় ভাবল রানা। প্রথমত: খুন না হয়ে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত: ওর চাই লেডি স্টার্লিংফোর্ডের ডায়েরি। যেহেতু সূত্র পাওয়ার জন্যে এত দূরে এসেছে, তাই এখন অনুচিত হবে সেসব ফেলে যাওয়া। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে যেতেই ঘন ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ছুটে চলল রানা। চোখে প্রায় কিছুই দেখছে না।