কালবেলা – ১০ (মাসুদ রানা)

দশ

টুলসা সিটি।

এখন গভীর রাত। কর্কশ ঐকতান তুলেছে বেশ কিছু ঝিঁঝি। থেমে থেমে হুঙ্কার ছাড়ছে বাঘা দুই কুকুর। ওয়াইল্ড হক মোটেলে নিজের ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালা দিয়ে নিষ্পলক চোখে হাইওয়ে দেখছে জ্যাকি। ওয়েস্ট স্কেলি ড্রাইভ ধরে ছুটে যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি। ওদিকে চেয়ে দু’দিন আগে লিপ্তার কটেজে যা দেখেছে, সেটা নিয়ে ভাবছে জ্যাকি। আচ্ছন্ন হয়ে আছে কেমন এক ঘোরের মাঝে। দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে সবকিছু। সেই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য বোধহ্য অন্তরের অদ্ভুত কোন খেলা! মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন হয়েছে ওর।

যদিও নিজেই বুঝতে পারছে, সবই আসলে নিষ্ঠুর বাস্তবতা। প্রথম সুযোগে কটেজ থেকে বেরিয়ে লুকিয়ে পড়েছিল জঙ্গলে। খুনিগুলো কটেজে ঢুকলে ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটল। নাকে-মুখে লাগল ডালপালা। জঙ্গল পেরোবার পর আরও বাড়ল দৌড়ের গতি। আগুনের মত জ্বলছিল ওর ফুসফুস। একটু পর পর ঘুরে দেখেছে কেউ তেড়ে আসে কি না।

একসময়ে পেছনে গাড়ির আলো দেখে প্রাণভয়ে লুকাল এক গাছের আড়ালে। কিন্তু ওকে দেখে ফেলল ড্রাইভার। গাড়ি এসে থামল গাছের পাশে। জানালার কাঁচ নিচু করে জানতে চাইল মহিলা, ‘তুমি কি কোন বিপদে পড়েছ?’

পিস্তল কোমরে গুঁজে বেরিয়ে এল জ্যাকি। বুঝে গেল, এবারের মত বেঁচে গেছে।

ফয়িল শহরের পুবে ক’মাইল দূরে চব্বিশ ঘণ্টা খোলা এক বার-এ চাকরি করে মহিলা। শিফট শেষে বাড়ি ফিরছে। জানাল রুট ৬৬ ধরে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুমন্ত ক্লেয়ারমোর আর ক্যাটুসা পার করে টুলসা সিটিতে পৌঁছে দেবে জ্যাকিকে। – চলার পথে জিজ্ঞেস করল, বাজে কোন ঝামেলায় পড়েছে কি না। তখন মিথ্যা বলেছে জ্যাকি: ঝগড়া হয়েছে বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে। এ-কথা বিশ্বাস না করার মত যৌক্তিক কোন কারণ খুঁজে পায়নি আগাথা ক্রিস্টি। সে মধ্যবয়স্কা মহিলা, তিন স্বামীকে পাঁচবার ডিভোর্স দিয়ে এখন সুখেই আছে। ক্রসবি হাইটসের বাড়িতে জ্যাকিকে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়েছে সে।

গভীর রাতে দু’বেডরুমের দোতলা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে মেইন গেট লক করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে জ্যাকি। বাথরুমে ব্যথা-ভরা পায়ের তালু ধুয়ে পরে নিয়েছে নতুন মোজা। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে ঢকঢক করে গিলেছে আধগ্লাস গর্ডস্‌ লণ্ডন জিন। সোফায় বসে ভেবেছে, এবার কী করা উচিত?

প্রথম কাজ হবে পুলিশে খবর দেয়া। যদিও এতে ছারখার হবে লিা কনারের সংসার। স্ক্যাণ্ডালের জন্যে ধ্বংস হবে রোয বাড ট্রাস্ট। এরপর এ-শহরের কেউ ওকে আর চাকরি দেবে না। তবুও ওর কর্তব্য হচ্ছে পুলিশে সব জানিয়ে দেয়া।

ওর কাছে আছে অকাট্য প্রমাণ।

ব্যাকপ্যাক থেকে ফোন নিয়ে ভিডিয়ো দেখল জ্যাকি। ওভার এক্সপোষ দৃশ্যে খুনিদেরকে দেখাচ্ছে আবছা সব যমদূতের মত। একটু পর ফোন হাতে ছোট্ট অফিসে ঢু ও। ফোনের সঙ্গে ইউএসবি কেবল যুক্ত করে সংযোগ দিল কমপিউটারে। ফোন থেকে ডাউনলোড করল ভিডিয়ো। বড় স্ক্রিনেও স্পষ্ট ফুটল না দৃশ্যগুলো। মাত্র একবার দেখা গেল লিণ্ডার স্বামীর মাথার পেছনদিক। জট পাকিয়ে বিশ্রী ভোঁ-ভোঁ করছে খুনিদের গলা।

‘সর্বনাশ!’ ভাবল জ্যাকি, ‘পুলিশকে এই ভিডিয়ো দেখালে তারা তো আমার কোন কথাই বিশ্বাস করবে না!’

সিদ্ধান্তহীনতা চেপে ধরল ওকে। ভাবতে শুরু করেছে কী করবে, এমন সময় ডেস্কে বাজল ল্যাও ফোন। চমকে গিয়ে জ্যাকি ভাবল, এত রাতে কে ফোন করছে? দ্বিধা নিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। ‘হ্যালো?’

জবাবে ওদিক থেকে খুট করে কেটে দেয়া, হলো লাইন। নিজেই এবার কল দিল জ্যাকি। ওদিক থেকে ফোন ধরল না কেউ। ওর মনে হলো, এবার ঘটতে শুরু করবে বহুকিছু। হয়তো রং নাম্বারে কল দিয়েছে কেউ। আবার এমনও হতে পারে, খুনিরা জেনে নিল এখন কোথায় আছে ও! –

কটেজে ওর জিনিসপত্র পেলে লিণ্ডার স্বামী বা তার লোক বুঝে গেছে কটেজে কে ছিল! লিণ্ডা নিজেই হয়তো স্বামীকে বলেছে কটেজে ওর ওঠার কথা! একই কথা হয়তো জানিয়ে দিয়েছে ড্রাইভার বব। নানাভাবে ফাঁস হতে পারে তথ্য। সেক্ষেত্রে খুনিরা হয়তো জেনে গেছে টুলসার এই ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে ও। জ্যাকি বুঝে গেল, এ-বাড়ি এখন ওর জন্যে খুব ‘বিপজ্জনক। সুতরাং দেরি না করে ওর উচিত হবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া।

প্রমাণ হিসেবে ভিডিয়ো থাকলেও নিজে খুন হলে ওটা কোন কাজেই আসবে না। দেরি না করে কমপিউটারের মাধ্যমে ভিডিয়ো ক্লিপ তুলে নিল দুটো ডিভিডিতে। ব্যাকআপ হিসেবে রাখল ও-দুটো। এরপর দোতলায় গিয়ে পরে নিল পুরনো জুতোজোড়া। আরও কিছু জিনিসপত্র ভরল ব্যাকপ্যাকে বিছানার নিচে স্টিল অ্যামো কেবিনেট খুলে তিনটে সিগ সাওয়ার ম্যাগাযিন নিয়ে রাখল ব্যাকপ্যাকের পাশের পকেটে। একই জায়গায় ঠাঁই পেল পিস্তল। বেডসাইড ড্রয়ার থেকে সংগ্রহ করল ক্যাড্ মেইস। হামলা হলে শেষ ভরসা হিসেবে রেখেছে ওটা। রাসায়নিকে ভরা ক্যান গুঁজল ব্যাকপ্যাকে। বাড়িতে এখন এমন কিছু নেই, যেটা ওর খুব দরকার হবে।

অ্যাপার্টমেন্টের দরজা লক করে ব্যাকপ্যাক কাঁধে বেরিয়ে এল জ্যাকি। মরুভূমির মত খাঁ-খাঁ করছে রাস্তা। আশপাশে কোন গাড়ি নেই। খুনিদের কেউ নজর রাখছে না বাড়ির ওপরে। ব্যাগ কাঁধে ব্যথা-ভরা পায়ে ছুটতে লাগল জ্যাকি।

এরপর দু’রাত আগে এসে উঠেছে এই মোটেলে। খিদে লাগলে সিকিমাইল দূরে হাইওয়ের এক ডাইনার থেকে এনেছে খাবার। দ্বিতীয়বার আর যায়নি ওর অ্যাপার্টমেন্টে। এলাকার ছেলেদেরকে পছন্দ করত না ওর বাবা। তাই তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি জ্যাকির। ফলে এমন কেউ নেই যার কাছে এখন ঠাঁই পাবে। মায়ের কাছে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। দেবতার মত ওর বাবাকে ছেড়ে এক জানোয়ারের সঙ্গে সংসার করছে সে, কারণ লোকটার আছে দামি মদ কিনে দেয়ার টাকা।

জানালা দিয়ে দূরে চেয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করল জ্যাকি, এ-শহর ছেড়ে কি আমি পালিয়ে যাব? প্রিয় গাড়িটা ওকে দিয়ে গেছে বাবা। ওটা পুরনো হলেও কাজে লাগবে ওকলাহোমা থেকে বেরিয়ে যেতে। পরে খুঁজে নেবে নতুন কোন আশ্রয়। অবশ্য সেক্ষেত্রে একদম প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ওকে। কাজটা অত সহজ হবে না ওর জন্যে।

জ্যাকির বুক চিরে বেরোল কাঁপা দীর্ঘশ্বাস।

এগারো

নিজেকে পুলিশ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর ড্যানিয়েল হকিন্স বলে পরিচয় দিল অফিসার। নার্ভাস টাইপের লোক সে। বয়স হবে পঞ্চাশ। চড়ুই পাখির চোখের মত এদিক-ওদিক ঘুরছে দু’চোখ, পলক পড়ছে না একবারও। কেন যেন তাকে অপছন্দ হলো রানার। যদিও খুঁজে পেল না তার কারণ। লোকটার সহকারী ডিটেকটিভ সার্জেন্ট জোয়ান লিলির বয়স আন্দাজ পঁচিশ। তাকে মানুষ বলেই মনে হলো রানার। বুঝো গেল, কেন তাকে সঙ্গে করে এনেছে ইন্সপেক্টর। সে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ দিলে জখমে মলম দেবে মহিলা সার্জেন্ট।

‘আমি জানতে চাই বেলা খুন হয়েছে, নাকি কিডন্যাপ, তারা কিছু বলার আগেই বলল রানা।

‘কেন ভাবছেন কিডন্যাপ হবে?’ কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল ইন্সপেক্টর।

‘যা বলার সেটা বরং আপনিই বলুন,’ বলল রানা।

‘আমরা ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগেই মারা যান মিস ওয়েস,’ বলল সার্জেন্ট লিলি। ‘ভয়ঙ্করভাবে খুন হন। পরে তাঁর আত্মীয়দের কাছে খবর দিয়েছি আমরা। তাঁরা ইংল্যাণ্ড থেকে রওনা হয়েছেন। মিস্টার রানা, আমি সত্যিই দুঃখিত।’

মেয়েটা খুন হয়েছে ওর নিজের ব্যর্থতার জন্যে, বুঝে গেল রানা। ওর উচিত ছিল শারীরিকভাবে ফিট থাকা। সেক্ষেত্রে হয়তো এখনও বেঁচে থাকত বেলা।

‘কী ধরনের হামলা করেছে ওর ওপরে?’ জানতে চাইল রানা।

ভুরু কুঁচকে ফেলল সার্জেন্ট।

ইন্সপেক্টর হকিন্সের দিকে তাকাল রানা।

হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লোকটার মুখ।

রানা জেনে গেল, বেলার লাশ দেখেছে এরা। শুধু তা-ই নয়, আগে কখনও এত ভয়ঙ্কর বিকৃত হওয়া মৃতদেহ দেখেনি।

‘মিস্টার রানা, আমার মনে হয় না যে এসব নিয়ে আর আলাপ করা উচিত, বলল সার্জেন্ট লিলি।

‘আমি জানতে চাই,’ শুকনো গলায় বলল রানা।

‘মিস ওয়েসের বুক-পেটে ছিল ছোরার গভীর সব ক্ষত,’ বলল মেয়েটা। ‘কেটে নেয়া হয় নাক ও ঠোঁট… চুপ হয়ে গেল সে। যে-কোন সময়ে বমি করে দেবে।

‘উপড়ে নেয় দু’চোখ, তারপর গলা কাটে, ‘ তিক্তস্বরে বলল ‘ইন্সপেক্টর হকিন্স। ‘আরেকটু হলে কাটা পড়ত ঘাড়। মনে হয় না সে-সময়ে বেঁচে ছিল মিস ওয়েস।’

রানার হাতের মুঠোর টানে ফড়ফড় করে ছিড়ে গেল বেডকভার। বেলার মিষ্টি মুখ ভেসে উঠেছে ওর চোখের তারায়। কানে শুনতে পেল মধুর কণ্ঠস্বর। হাসছে মেয়েটা। রানার মনে হলো, নিজেও অসুস্থ হয়ে যাবে সার্জেন্ট লিলির মত।

গলা খাঁকারি দিল ইন্সপেক্টর। ‘এ-ঘটনায় সাক্ষী আছে। তাঁরা এসেছেন লণ্ডন থেকে বেড়াতে। গ্যালওয়ে গেস্ট-হাউস থেকে বেরিয়ে দু’জন লোককে দেখতে পান। তাদের সঙ্গে ছিল জিপগাড়ি। ওটা থেকে নেমে মিস ওয়েসকে ধাওয়া করে খুনিরা। সৈকতে একাই ছিল মেয়েটা। দূর থেকে সব দেখতে পান দুই টুরিস্ট। আপনি কটেজ থেকে বেরিয়ে বাধা দিতে গেলে আপনার মাথায় লাঠির বাড়ি মারে খুনিরা। আপনি পড়ে গেলে ছোরা বের করে তাদের একজন। বিনকিউলারে সব দেখেন পুরুষ টুরিস্ট। তি ন… কী যেন বলে তাঁদেরকে?’

‘অর্নিথোলজিস্ট,’ বলল সার্জেন্ট লিলি, পক্ষিবিজ্ঞানী। ‘বেলাকে ছোরা মারতে দেখেন তিনি?’ বলল রানা।

নড করল সার্জেন্ট লিলি। ‘একটু পর মিস ওয়েসকে খুন করে গাড়িতে উঠে চলে যায় তারা। আমরা পরে জেনেছি গাড়িটা চুরি করা হয়েছিল ক্লিফডেনের এক খামার থেকে।’

‘আজ ভোরে উপকূলীয় এলাকা ন্যাহিঞ্চে পাওয়া গেছে ওটা,’ বলল ইন্সপেক্টর হকিন্স। ‘এক স্থানীয় লোক আগুনে গাড়ি পুড়তে দেখে গার্ডাদের কাছে ফোন দেয়।

‘এরপর খুনিদের কোন তথ্য আপনারা আর পাননি,’ মন্তব্য করল রানা।

‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি সোর্সের মাধ্যমে,’ বলল ইন্সপেক্টর। -এ-ধরনের কেসে কর্তৃপক্ষ ভঙ্গি করে, সবকিছুর ওপরে তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে।

‘আপনাদের তো কিছু করার আছে বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘উধাও হয়ে গেছে তারা।’

‘আমরা ভাবছি, আপনি হয়তো জরুরি সূত্র দেবেন, বলল সার্জেণ্ট লিলি।

যেহেতু আমি তাদেরকে কাছ থেকে দেখেছি-তাই?’

‘দেখলে কি আপনি তাদেরকে চিনতে পারবেন?’ মাথা দোলাল রানা।

‘তা হলে চেহারার বর্ণনা দিন।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল রানা, ‘শ্বেতাঙ্গ। বয়স ত্রিশের নিচে হালকা শরীর। কথা বলেনি, তাই জানার উপায় নেই তারা আইরিশ, ইংলিশ না অন্য দেশের। একজন অন্যজনের চেয়ে সামান্য লম্বা। উচ্চতা ছয় ফুট। আর্মি ছাঁট দেয়া খাটো চুল। একজনের পরনে নেভি জ্যাকেট। ওটা সিন্থেটিক বা নাইলনের।’

প্যাড বের করে নোট মিল সার্জেন্ট লিলি।

‘অন্যজনের পরনে বাদামি হুডি, বলল রানা, ‘ভালভাবে তার মুখ দেখতে না পেলেও সে বামহাতি।’

‘আপনি সেটা কীভাবে জানলেন?’ প্রশ্ন করল ইন্সপেক্টর। তিক্ত চোখে তাকে দেখল রানা। ‘এটা জানতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। ব্যাটন ছিল তার বামহাতে। দু’জনের পায়ে ছিল স্টিলের টোক্যাপসহ বুট। জানি, কারণ এখনও আমার শরীরে ব্যথা আছে।’

‘এটা ভাল সূত্র,’ বলল সার্জেন্ট লিলি।

‘আপনার সেটাই মনে হচ্ছে?’ বিরক্ত হলো রানা। ‘আর কিছু?’ জানতে চাইল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘বাদামি হুডির মুখে মিন্টের গন্ধ ছিল,’ বলল রানা!

নোট নিয়ে বলল সার্জেন্ট লিলি, ‘মিণ্ট?’

‘চুইংগাম। তবে সাধারণ নয়। বিদঘুটে গন্ধ।

‘সেটা কী ধরনের?’ চোখ সরু করল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘নিকোটিন গাম,’ বলল রানা, ‘হয়তো চেনেন? ধূমপান ছাড়তে গিয়ে অনেকে ব্যবহার করে।’

‘আপনি ঠিক জানেন তো?’

‘নিজে ওটা দিয়ে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা করেছি। সুতরাং ভুল বলছি না।

‘ঠিক আছে,’ বলল সার্জেন্ট লিলি। নোট নেয়ার ফাঁকে বলল, ‘আর কিছু?’

‘আমার ধারণা: এরা আগেও মানুষ খুন করেছে, বলল রানা। ‘নিজেদের কাজ বোঝে।’

‘সেটা আপনি কীভাবে জানলেন?’

‘কারণ, আগে আমি আর্মিতে ছিলাম। আপনারা ‘ যাদেরকে খুঁজছেন, তারা মিলিটারি ট্রেইণ্ড সাইকোপ্যাথ। এদেরকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারি।’

পরস্পরের দিকে তাকাল ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্ট।

‘মিস্টার রানা, আমরা এরই ভেতরে জেনে নিয়েছি আপনার ব্যাকগ্রাউণ্ড,’ বলল ইন্সপেক্টর।

মনে মনে বলল রানা, খুব যৎসামান্যই আপনারা জানেন।

‘তা হলে তো আরও বহু তথ্য আপনি দিতে পারবেন, তা-ই না?’ জানতে চাইল সার্জেন্ট লিলি।

মাথা নাড়ল রানা। ‘সরি।’

বিরক্ত হলো ইন্সপেক্টর। ‘ফাইলে দেখলাম আপনি এক ডিটেকটিভ এজেন্সির চিফ। ক’দিন আগে ছিলেন ফ্রান্সে।’

মাথা দোলাল রানা। ‘নরম্যাণ্ডিতে। আপাতত কোন কাজের সঙ্গে জড়িত নই।’

‘কিছুই না?’

মাথা নাড়ল রানা।

ভুরু কোঁচকাল ইন্সপেক্টর। ‘অথচ জেনেছি, আপনি হাইলি ট্ৰেইণ্ড।’

‘আগে তা-ই ছিলাম,’ বলল রানা।

‘আমার ধারণা: যুদ্ধের ট্রেনিং কখনও ভুলে যায় না কেউ।’

‘অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করি,’ স্বীকারোক্তির সুরে বলল রানা। ‘গতকাল যখন হাম হলো, ড্রিঙ্ক করছিলাম কটেজে বসে। সেজন্যে ধীর হয়ে যায় আমার প্রতিক্রিয়া। নইলে সৈকতে বেলার বদলে দেখতে পেতেন লোকদু’জনের লাশ।’

ওকে দেখছে সার্জেন্ট লিলি। ‘আপনি কি তবে বলতে চান যে তাদেরকে খুন করতেন?’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আপনি আসলে কী বলতে চান? কঠোর চোখে ওকে দেখল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘কী বলেছি, সেটা আপনারা শুনেছেন,’ শীতল স্বরে বলল রানা, ‘বরং এই কেসের ব্যাপারে কথা বলুন। আপনাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই হামলার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক আছে।

‘আমরা তা বলছি না,’ চট করে বলল সার্জেন্ট লিলি। দুশ্চিন্তা নিয়ে দেখল ইন্সপেক্টরকে।

‘মনে রাখবেন, মিস্টার রানা, কোথাও হামলা হলে আমরা সিরিয়াস হয়ে যাই,’ বলল ইন্সপেক্টর। ‘সুতরাং নিজে ভুলেও আইন হাতে তুলে নেবেন না। সেটা আপনার জন্যে মঙ্গলজনক হবে না।’

‘আপনি কি তবে চান অন্যায় দেখেও চুপচা’ সব মেনে নেব? তাতে উপকার হবে সমাজের?’ বলল রানা।

‘আমি তা বলছি না। তবে নিজ হাতে আইন তুলে নিলে সেটা কখনও সমাজের জন্যে মঙ্গলজনক হয় না.।’

‘আপনার কি ধারণা যে আমি আইন ভেঙেছি?’ বলল রানা। ‘বেলার মৃত্যু কিন্তু আপনারা ঠেকাতে পারেননি।

‘কেন এমনটা হলো, তা আমরা তদন্ত করে বের করব, বলল ইন্সপেক্টর, ‘আর যেহেতু এসবের সঙ্গে মদ জড়িত, তাই বিষয়টা গভীরভাবে তদন্ত করতে হবে।

‘আমি সৈকতে যাওয়ার আগে প্রায় মাতাল ছিলাম,’ বলল রানা। ‘আর তখন আপনার মত কোন হিরোকে দেখতে পাইনি, যে বিপদ থেকে রক্ষা করবে বেলাকে। আপনারা যখন হাজির হলেন, ততক্ষণে বহু দূরে চলে গেছে খুনিরা।’

‘আপনার আচরণ খুব আপত্তিকর,’ বলল ইন্সপেক্টর; ‘আর সেজন্যে আপনাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দিতে পারি।’

‘আমার আচরণ যে কতটা খারাপ, আপনি ভাবতেও পারবেন না, ইন্সপেক্টর।’ ক্রমেই আরও রেগে উঠছে রানা।

চোখ পাকিয়ে ওকে দেখছে ইন্সপেক্টর।

বদলে শীতল চোখে তাকে মেপে নিচ্ছে রানা। পরিষ্কার বুঝে গেল, বোকা গাধাটা জানে না, যে-কোন সময়ে তার গলা দিয়ে নেমে যাবে একগাদ। ভাঙা দাঁত।

এবার বলুন কীভাবে আপনার সঙ্গে পরিচয় হলো মিস ওয়েসের,’ বুদ্ধিমতীর মত প্রসঙ্গ পাল্টাল সার্জেন্ট লিলি। নার্ভাস চোখে দেখে নিল বসকে। ‘হামলার আগে সৈকতে আপনারা হাঁটছিলেন, সেটা আমরা জেনেছি।’

খুব ধীরে ধীরে হকিসের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েটাকে দেখল রানা। ‘আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল না। গতকালই পরিচয়। আমার ধারণা, মিসেস অ্যাপলউড এরই ভেতরে এ-ব্যাপারে আপনাদেরকে জানিয়েছেন।

‘তার মানে আপনাদের আগে কখনও দেখা হয়নি?’

‘প্রতিটি কথা আবারও বলতে হলে সারাদিন লাগবে, বলল বিরক্ত রানা।

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল সার্জেন্ট লিলি। একটু পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘সাক্ষীদের কথা অনুযায়ী, মিস ওয়েসের কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় খুনিরা। আপনি ওটা সম্পর্কে কিছু জানেন?’

‘কাপড়ের ব্যাগ,’. বলল রানা, ‘রঙ নীল, হলুদ ও বেগুনি। ভেতরে ছিল ল্যাপট।। এ-ছাড়া ছিল নোটবুক, কয়েকটা মোবাইল ফোন, ব্যক্তিগত মেক-আপ আইটেম আর চিরুনির মত সাধারণ জিনিস। অবশ্য এ-বিষয়ে আর কিছু জানি না।’

‘আপনি দেখি মেয়েটার ব্যাগে কী আছে সবই জানতেন, সন্দেহের সুরে বলল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘আমি সবসময় চোখ-কান খোলা রাখি,’ বলল রানা, ‘আপনি নিজেও তা-ই করতে পারেন।’

‘আমরা এসেছি জরুরি তথ্য সংগ্রহ করতে, মিস্টার রানা,’ বলল সার্জেন্ট লিলি।

‘তা-ই করা উচিত,’ বলল রানা, ‘আমি নিজেও তা-ই। করব। যেহেতু গত বিশ বছরে এদিকে কেউ খুন হয়নি, সেক্ষেত্রে কেন খুন করা হলো বেলাকে, সেটা জানতে চাই। কয়েক বছর আগেও সৈকতের ধারে আমার একটা বাড়ি ছিল। পরে বিক্রি করে দিয়েছি। এদিকের প্রতিটি পাব চিনি। প্রতিভাবান ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর হকিন্স এখানে বসে আমার দোষ না খুঁজলে, হয়তো পাব-এ কান পেতে অপরাধীদের ব্যাপারে জরুরি সব তথ্য পেতেন। সেক্ষেত্রে আমিও বুঝতাম, নিজের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।’

‘শুনুন, আপনি কিন্তু…’ রানার বুকের দিকে তর্জনী তাক করল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

যদিও তার কথা কেড়ে নিল রানা, ‘না, হকিন্স, আপনিই বরং আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। ঠাণ্ডা চোখে দেখছে তাকে। ‘পেশাদার দুই অপরাধী গাড়ি চুরি করে এনে বেআইনি ব্যাটন হাতে অচেনা এক মেয়ের ওপরে হামলে পড়বে না। সুতরাং ধরে নিতে পারি, এর পেছনে আছে কোন না কোন জরুরি কারণ। আপনার বদলে আমি হলে ভাবতাম: এসবের পেছনে রয়েছে শক্ত কোন মোটিভ। জেনেবুঝে খুন করা হয়েছে বেলা ওয়েসকে। কাজেই মেয়েটা কীসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল সেটা আগে জানা দরকার। আমার কথাগুলো কি আপনি বুঝতে পেরেছেন, ইন্সপেক্টর?’

রানার দিকে তাক করা তর্জনীটা নামিয়ে চেয়ারে গুঁজে গেল পুলিশ কর্মকর্তা। রেগে গেলেও মুখে কোন কথা নেই।

ভুরু কুঁচকে গেছে সার্জেন্ট লিলির। নোটবুক থেকে মুখ তুলল সে। ‘রেকর্ড অনুযায়ী বেলা ওয়েস ছিলেন সেলফ- এমপ্লয়েড রাইটার। গেস্ট-হাউসের মালিক বলেছেন, বই লিখছিলেন তিনি। এসব থেকে আমরা কোন মোটিভ পাইনি।’

‘সাধারণ বই নয়, আয়ারল্যাণ্ডের ঐতিহাসিক কিছু বিষয় নিয়ে লিখতে শুরু করে বেলা,’ বলল রানা।

‘তো?’

‘ঐতিহাসিক বিষয়ে গবেষণার সময় জরুরি তথ্য গায়। যেটা ছিল গোপন কিছু। আর সেজন্যেই ঝুঁকিতে পড়ে বেলা।’

ভুরু কুঁচকে ফেলল সার্জেন্ট লিলি। ‘কী ধরনের ঝুঁকি?’

‘আমাকে সেটা বলেনি বেলা,’ বলল রানা।

‘এত কিছুই বা আপনাকে বলল কেন?’ বলল ইন্সপেক্টর। ‘আপনারা স্বল্প-পরিচিত, পরস্পরকে ভালমত চিনতেন না।’

‘কারণ, বেলা সাহায্য চেয়েছিল আমার কাছে।’

‘কেন সেটা করল সে?’

‘ও সাহায্য চেয়েছিল আমার কাজের ধরন জেনে।’

‘আপনার সেসব কাজ খুব ক্লাসিফায়েড, নাকি, মিস্টার রানা?’ খোঁচা দিতে চাইছে ইন্সপেক্টর। দু’তর্জনী বাঁকা করে দেখাল ইনভার্টেড কমা।

‘আর্মি থেকে অবসর নেয়ার পর কাজ করেছি সিকিউরিটি ইণ্ডাস্ট্রিতে, সে-কারণে আগ্রহী হয়েছিল বেলা,’ বলল রানা।

‘আপনি কি বডিগার্ড ছিলেন?’ রাগী গলায় বলল হকিন্স।

‘আগে কিডন্যাপড্ মানুষ খুঁজে বের করে উদ্ধার করেছি,’ বলল রানা। ‘তবে কাউকে রক্ষা করতে বডিগার্ডের কাজ খুব কমই করেছি। অবশ্য যখন করেছি সেটা, চেয়েছি দক্ষতার সঙ্গে করতে।’

‘যাই হোক, আপনি মিস ওয়েসের কাছে জানতে চান, তাঁকে কেউ কিডন্যাপ করতে চায় কি না?’ বলল সার্জেন্ট লিলি।

মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ। বেলা জানত, সে আছে মৃত্যু- ঝুঁকিতে। নিরাপত্তা চাইছে শুনে আমি বলেছি, আমার পরিচিত বডিগার্ডের সাহায্য নিতে পারে। কথা হয়েছিল, আজ ভোরে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময় এ-বিষয়ে আমরা আলাপ করব।’

‘আপনাকে কেন এসব বলল সে? কেন যোগাযোগ করল না পুলিশে?’ চেয়ারে পিঠ সোজা করল ইন্সপেক্টর।

তিক্ত হাসল রানা। ‘সেটা আমি জানি না।’

‘অর্থাৎ, আপনার জানা নেই, কে বা কার কাছ থেকে বিপদ হবে বলে ভেবেছিলেন মিস ওয়েস?’ বলল সার্জেন্ট লিলি।

‘আমার সঙ্গে এ-ব্যাপারে ওর কোন কথা হয়নি। সময় পেলে হয়তো খুলে বলত। অবশ্য এটা বুঝেছি, কোন কারণ ছাড়া ওর ওপরে হামলা করা হয়নি। হঠাৎ সৈকতে অচেনা এক মেয়েকে দেখে খুন করেনি খুনিরা। তারা এসেছিল তৈরি হয়ে।’

‘আমরা মিস ওয়েসের খুনিদের আইনের আওতায় আনব,’ বলল সার্জেন্ট লিলি।

ওরা যেমন ধরনের লোক, তাদের গায়ে টোকাও দিতে পারবেন না আপনারা,’ স্পষ্ট করে বলল রানা।

‘হয়তো তা-ই,’ বলল ইন্সপেক্টর, ‘কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনিও কিছুই করতে পারবেন না।’

ওদের জন্যে আমি তৈরি ছিলাম না,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রানা। ‘পরেরবার এই ভুল হবে না।

‘ভুলবেন না, আইন-রক্ষার কাজ পুলিশের, বলল সার্জেন্ট লিলি।

‘খুনিরা এখন কোথায় সেটা আপনারা জানেন?’ বলল রানা।

‘আপনি নিজে তাদেরকে কোথায় পাবেন বলে ভাবছেন?’, টিটকারির হাসি হাসল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘এদিকে যে নেই তা নিশ্চিত ‘ বলল রানা। ‘আমরা যখন কথা বলে সময় নষ্ট করছি, প্রতি সেকেণ্ডে আরও দূরে চলে যাচ্ছে তারা।’

‘আমরা যে তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারব, তাতে মনে কোন সন্দেহ রাখবেন না,’ বলল ইন্সপেক্টর হকিন্স।

‘আপনি আসলে আঁধারে নিজের পোঁদের ফুটোও দুই হাতে খুঁজে পাবেন, সে-ক্ষমতা আপনার নেই,’ সব্জ সুরে বলল রানা।

এ-কথায় একই সময়ে চেয়ার ছাড়ল দুই ডিটেকটিভ। লালচে হয়েছে ইন্সপেক্টরের দুই গাল। মেঝে দেখছে সার্জেন্ট লিলি। মেয়েটার জন্যে খারাপই লাগল রানার।

‘পরে তদন্তের অগ্রগতি আমরা জানিয়ে দেব,’ বলল হকিন্স।

চুপ করে থাকল রানা।

পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্ট।

কিছুক্ষণ বসে বসে বেলার কথা ভাবল রানা। ওর দুঃখ লাগছে এটা ভেবে যে, আর কখনও দেখা হবে না হাসিখুশি। মেয়েটার সঙ্গে। আরও বাড়ল রানার মনের তিক্ততা। মনের আয়নায় দেখতে পেল, বেলার পেট-বুকের ক্ষত থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত। উপড়ে নিয়েছে নীল দুটো চোখ। জবাই হওয়া বেলার রক্ত শুষে নিচ্ছে পাথুরে জমি।

একটু পর নার্সকে ডাকল রানা। ওর কথায় ওয়ার্ড ছেড়ে চলে গেল মেয়েটা। ফিরল পাঁচ মিনিট পর। তার সঙ্গে এসেছে ডাক্তার হাম্বল। সে বলল, ‘আরও একদিন আপনাকে ওয়ার্ডে রাখতে চাই।’

জবাবে রানা বলল, ‘আমি হাসপাতালের পার্কিং লট পেরোতে গিয়ে মরে গেলে আমার সঙ্গে তর্ক জুড়বেন।

রোগী কোন কথা শুনবে না বুঝে শেষবারের মত রানার চুলের ফাঁকে করোটির সেলাই দেখল ডাক্তার হাম্বল। তারপর বিদায় নিল বিমর্ষ মুখে

বাথরুমে পোশাক পাল্টে হাসপাতাল থেকে বেরোল রানা। আগেই মনস্থির করেছে, এবার খুঁজে বের করবে বেলার খুনিদেরকে।

বারো

হাসপাতাল থেকে সরাসরি কটেজে ফিরল না রানা। পায়ে হেঁটে দুটো গ্রাম পার করে তারপর বাস ধরে পৌঁছুল গ্যালওয়ের বড় রাস্তায়। ওখান থেকে সিকিমাইল দূরেই চেনা এক সৈকত। গ্যালওয়ে গেস্ট-হাউসে না গিয়ে সেখানে চলে গেল রানা। কৈশোরে আবিষ্কার করেছিল সৈকতের কাছে ছোট্ট পাহাড়ি গুহাটা। এমনই এক জায়গা, যেখানে ওকে বিরক্ত করতে আসবে না কেউ।

সাগরতীরের পাহাড়ি গুহায় বসে ধূমপান করতে খুব ইচ্ছে হলো ওর। তখনই স্থির করল, আর কখনও সিগারেটের ধারেকাছে যাবে না। ভাবতে লাগল, এরপর কী করবে।

ওর সামনে এখন মাত্র দুটো পথ।

এক: সবকিছু ভুলে ফিরে যেতে পারে ফ্রান্সে। দুই: অথবা খুঁজতে পারে বেলার খুনিদেরকে।

প্রথম কাজটা করলে অপেক্ষা করতে হবে একদিন খুনিদেরকে গ্রেফতার করবে পুলিশ। সেক্ষেত্রে বেলার আত্মীয়দের সান্ত্বনা দেয়াই যথেষ্ট। দরকারে সহায়তা করবে আইনি কর্তপক্ষকে। অর্থাৎ নিজে থেকে কিছুই করতে হবে না ওর।

ওদিকে দ্বিতীয় কাজটা না করলে প্রতিক্ষণে ক্ষয় হবে ওর হৃদয়। আগে কখনও কোন কাজে গাফিলতি করেনি। ফলে বেলার খুনিকে খুঁজে বের না করলে নিজেকে ওর মনে হবে দোষী। মেয়েটার মৃত্যুর দায় কোনভাবেই এড়াতে পারবে না।

এদিকে খুনিদেরকে খুঁজতে গেলে হয়তো লাগবে বহু দিন। চুপ করে সাগরতীরের গুহায় বসে রইল রানা। বহুক্ষণ পর বেরিয়ে এল সৈকতে। দুপুর হলেও খিদে নেই পেটে। হেঁটে যাওয়ার সময় দেখল ওর ভাড়া করা কটেজ। বেলা যেখানে খুন হয়েছে, পেরিয়ে এল জায়গাটা। ওখানে বাতাসে

তপত করে উড়ছে গার্ডার টাঙানো টেপ। একটু দূরে এক ল্যাণ্ড রোভার। পাথরের ভেতরে সূত্র খুঁজছে মোটা দুই গার্ডা। একটু পর হাল ছেড়ে ফিরে যাবে স্টেশনের উষ্ণ পরিবেশে।

গ্যালওয়ে গেস্ট-হাউসে পা রেখে রিসেপশন ডেস্কে কাউকে দেখতে পেল না রানা। চট করে পাতা উল্টে দেখে নিল রেজিস্ট্রি খাতা। এখন যারা আছে গেস্ট-হাউসে, তাদের ভেতরে আছেন বেলজিয়ান এক দম্পতি-মশিয়ো গফিন ও তাঁর স্ত্রী ম্যাডাম জুলিয়ান। আগামীকাল ফিরে যাচ্ছেন তাঁরা লণ্ডনে।

‘রুম নাম্বার নাইন,’ মনে মনে বলল রানা। রওনা হয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। তবে ওখানে পৌঁছাবার আগেই খুলে গেল স্টাফ ওনলি লেখা এক দরজা। আগে ওটা ছিল চাচার স্টাডিরুম। প্যাসেজে বেরিয়ে এলেন মিসেস অ্যাপলউড। লালচে হয়ে আছে তাঁর ফোলা দু’চোখ। অনেক কেঁদেছেন মহিলা। রানার মার খাওয়া চেহারা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে আবারও কাঁদতে লাগলেন তিনি। রানা কিছু বলার আগেই ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, ‘আহা, বেচারি বেলা ওয়েস! কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল!’

রানার মনে হলো, এদিকের সৈকতে খুনের ঘটনা ঘটে যাওয়ায় গেস্ট-হাউসের ওপরে তার বাজে প্রভাব পড়বে কি না, সেটা নিয়ে বেশি ভাবছেন মহিলা। আজ সারা সকাল তাঁকে বিরক্ত করেছে মিডিয়ার লোক। তাদের মন্দ প্রচারণায় যে-কোন সময়ে বন্ধ হবে গেস্ট-হাউস ব্যবসা। টুরিস্টরা ধরে নেবে, যেহেতু সৈকতে ঘুরঘুর করছে খুনি, কাজেই এ-এলাকা খুবই বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে টাকার অভাবে গলফ্ ক্লাবের সদস্যপদ হারাবেন মিস্টার অ্যাপলউড। তাতে মারাও যেতে পারেন মানসিক যন্ত্রণায়।

মহিলাকে সংক্ষেপে সান্ত্বনা দিল রানা। তারপর আঙুল তুলে সিঁড়ি দেখাল। ‘মিস্টার গফিনের ঘর কি নয় নম্বর? আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘হ্যাঁ, ওই রুমেই উঠেছেন,’ টিশ্যু পেপার দিয়ে চোখের কোণ মুছলেন মহিলা। ‘তবে আপাতত তাঁরা লাঞ্চ করছেন কনসার্ভেটরি রুমে। যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল, তারপর আজ আর কিছুই মুখে তুলতে পারছেন না কেউ!’ মহিলা জিজ্ঞেস করলেন না কী কারণে বেলজিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে রানা। নিজে থেকেও কিছু বলল না ও। মিসেস অ্যাপলউডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা ঢুকল কনসার্ভেটরি রুমে।

খুনের ঘটনা খারাপ প্রভাব ফেলেছে অতিথিদের ওপরে। চুপচাপ লাঞ্চ করছে কয়েকজন। পারতপক্ষে কথা বলছে না কেউ। মাঝে মাঝে প্লেটে লেগে টুংটাং শব্দ করছে চামচ। ঘরে চোখ বুলিয়ে মধ্যবয়স্ক এক লোককে মশিয়ো গফিন বলে মনে হলো রানার। ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী হালকা গড়নের। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটান বাইরে। রোদে পোড়া চেহারা। মিস্টার গফিনের উঁচু কপালের ওদিকে ব্যাকব্রাশ করা চুল রুপালি। তাঁর স্ত্রীর চুল সোনালি। ঘরের ‘কোণে টেবিলে বসে লাঞ্চ সেরে চুপচাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছেন তাঁরা। গত সন্ধ্যার ভয়াবহ ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন। তাঁদের টেবিলের সামনে গিয়ে থামার আগে রানাকে লক্ষ করলেন না তাঁরা।

‘মশিয়ো অ্যাণ্ড ম্যাডাম গফিন?’ নরম সুরে বলল রানা।

চমকে উঠে মুখ তুলে ওকে দেখলেন মধ্যবয়স্ক দম্পতি। ‘আমি গ্রাহাম গফিন, ভিনদেশি সুরে ইংরেজি বললেন ভদ্রলোক। ‘আর ইনি আমার স্ত্রী জুলিয়ান। আর আপনি…

‘রানা, মাসুদ রানা,’ নিজের নাম বলল রানা। ‘আপনাদেরকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত।’ চেয়ার দেখিয়ে ফ্রেঞ্চ ভাষায় জানাল, ‘আমি কি কিছুক্ষণের জন্যে আপনাদের পাশে বসতে পারি? বেশি সময় নেব না।

‘আপনি কী বিষয়ে কথা বলতে চান?’

‘গত সন্ধ্যার খুনের ব্যাপারে,’ বলল রানা। ‘কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। এরপর আর বিরক্ত করব না আপনাদেরকে।

পরস্পরকে দেখলেন বেলজিয়ান দম্পতি। তাঁরা কিছু বলার আগেই চেয়ার টেনে বসল রানা।

‘আপনি বোধহয় পুলিশ নন?’ জানতে চাইলেন জুলিয়ান গফিন। ঝিকঝিক করছে নিখুঁত সাদা দাঁত। পোশাক থেকে এল শ্যানেল ফাইভের সুবাস।

‘না, আমি পুলিশ নই,’ বলল রানা, ‘গতকাল বাধা দিতে চেয়েছিলাম খুনিদেরকে।

‘আমি আপনাকে আহত হতে দেখেছি,’ চট্ করে রানার ফোলা মুখ দেখে নিলেন মোশিয়ো গফিন।

এটা বোধহয় জানেন, পুরো ঘটনা আমি দেখতে পাইনি। তাই জানতে চাই আসলে কী ঘটেছিল।’

শুকনো হাসলেন বেলজিয়ান ভদ্রলোক। ‘আয়ারল্যাণ্ডে কি পুলিশের বদলে যার যার তদন্ত করে নিতে হয়?’

তা নয়। তবে একজন মেয়েকে সৈকতে খুন করা হলো, এ-ও তো স্বাভাবিক কিছু নয়। আপনারা ওই ঘটনার সাক্ষী। তাই সে-ঘটনায় অস্বাভাবিক কিছু দেখে থাকলে, সেটা আমাকে বললে উপকৃত হব।

‘আমরা পুলিশকে সবই খুলে বলেছি,’ জানালেন জুলিয়ান গফিন, ‘গ্রাহাম আর আমি বিকেলে হাঁটতে গিয়েছিলাম। গেস্ট-হাউসের দিকে ফিরছি, এমন সময় শুনলাম গর্জে উঠেছে একটা ইঞ্জিন। তখন ঘুরে দেখলাম রুপালি একটা বড় গাড়ি।’

‘ওটা ছিল মাযদা জিপ,’ বললেন মোশিয়ো গফিন।

‘রাস্তা ছেড়ে দ্রুত সৈকতের দিকে এল ওটা। আমরা বুঝে গেলাম কাউকে ধাওয়া করছে ড্রাইভার। বেচারি মেয়েটা তখন দৌড়াতে শুরু করেছে। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ল দু’জন লোক। ছুটে গেল মেয়েটার দিকে। ব্যাগ ফেলে দৌড়াচ্ছিল মেয়েটা। লোকদুটোর একজন তুলে নিল ওর ব্যাগ। আমরা ভাবলাম তারা ছিনতাইকারী। ব্যাগ নিয়ে চলে যাবে। কিন্তু সেটা না করে মেয়েটাকে ধরতে গেল তারা। আর সে-সময়ে দেখলাম কটেজ থেকে বেরোলেন আপনি। আপনার আসলে অনেক সাহস, মোশিয়ো।’

‘আমি একজন পক্ষী-বিশেষজ্ঞ,’ বললেন গ্রাহাম গফিন। ‘বছরের এ-সময়ে এদিকে অনেক পাখি আসে। ওগুলো দেখার জন্যে সঙ্গে বিনকিউলার ছিল। পরিষ্কার দেখলাম দুই খুনির একজন বের করেছে একটা ছোরা।’

‘বাদামি হুডি, নাকি জ্যাকেট পরা লোকটা?’ জানতে চাইল রানা।

‘হুডি পরা লোকটার হাতে ছিল ছোরা। তাকে সৈনিক বলেই মনে হলো আমার। ছোরাটাও ছিল মিলিটারির জন্যে তৈরি।

তাঁর চোখে তাকাল রানা। ‘বলবেন কী, কেন এটা আপনার মনে হলো?’

‘আমার শখ মিলিটারির নানান জিনিস সংগ্রহ করা,’

বললেন গ্রাহাম। ‘ইনসিগনিয়া, মেডেল, বেয়োনেট, ছোরা ইত্যাদি। মেয়েটাকে যে ছোরা দিয়ে খুন করল, ওটা ছিল ইউনাইটেড স্টেটসের মেরিন কর্পসের ফাইটিং অ্যান্ড ইউটিলিটি নাইফ। কালো রঙের সাত ইঞ্চি ফলা। ক্লিপ পয়েন্ট। চামড়া দিয়ে তৈরি হাতল।

‘কা-বার নাইফ,’ বলল রানা।

মৃদু মাথা দোলালেন বেলজিয়ান ভদ্রলোক।

এবার জানতে চাইল রানা, ‘আপনি কি পুলিশকে এই বিষয়ে কিছু বলেছেন?’

‘নিশ্চয়ই,’ বললেন গ্রাহাম। ‘লোকটা ছোরা বের করলে ভয়ে পালিয়ে যেতে চাইল মেয়েটা। তবে এরপর কিছুই আর দেখতে পেলাম না। কারণ, মেয়েটা চলে গেল বড় এক বোল্ডারের ওদিকে। তীরবেগে তার পিছু নিল হুডি পরা লোকটা। তাকে ঠাণ্ডামাথার খুনি বলে মনে হয়েছে আমার। তখনই বুঝলাম খারাপ কিছু ঘটবে। একটু পর হাসতে হাসতে বোল্ডারের ওদিক থেকে ফিরে এল সে।’

‘তার মুখে হাসি ছিল?’ হাতদুটো মুঠো হয়ে গেল রানার।

‘খুশি হয়েছিল মেয়েটাকে জবাই করে। ওটা যেন মজার কোন খেলা। আমি সব দেখলেও তখন আর কিছুই করতে পারিনি। হতভম্ব হয়ে যাই কিছুক্ষণের জন্যে।’

কফির দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। রানার মনে হলো বমি করতে চান। ‘আপনার অচেতন দেহের পাশে গিয়ে থামল হুডি পরা লোকটা, চেহারা খুব শান্ত। আমার মনে হলো, এবার আপনাকেও খুন করবে সে। আর তখনই সচেতন হয়ে হাত নাড়তে নাড়তে তাদের দিকে ছুট দিলাম। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলাম। আমাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জিপে উঠল তারা। দেরি হলো না গাড়ি নিয়ে চলে যেতে।’

‘আমার প্রাণরক্ষা করেছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যর, বলল রানা। ‘তবে বাধা দিতে গেলে খুন হতেন তাদের হাতে।’

‘আরও আগেই আমার উচিত ছিল গার্ডায় ফোন করা, বললেন গফিন। ‘নইলে দেখতে হতো না মেয়েটার বিকৃত ‘লাশ।’

আলতো করে স্বামীর বাহুতে হাত রাখলেন জুলিয়ান। নরম সুরে বললেন, ‘এরপর আমরা পুলিশে যোগাযোগ করি অবশ্য ততক্ষণে সর্বনাশ হয়ে গেছে। কী ভয়াবহভাবেই না খুন করেছে মেয়েটাকে!’

‘আপনাদেরকে তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিয়েছি বলে আমি দুঃখিত,’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা।

‘আপনার জন্যে ড্রিঙ্কের অর্ডার দিই?’ জানতে চাইলেন গ্রাহাম গফিন।

মাথা নাড়ল রানা। ‘ধন্যবাদ, স্যর। লাগবে না। আশা করি নিরাপদে পৌঁছে যাবেন লণ্ডনে।

গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে সৈকতে ফিরে এল রানা। সাগর থেকে হু-হু করে আ হাওয়ায় চেপে আকাশে জড় হয়েছে ঘন কালো মেঘ। কটেজের দিকে পা বাড়াতেই শুরু হলো ঝরঝর করে বৃষ্টি। কনকনে শীতল জলে ভিজে গেল রানা। হাঁটতে হাঁটতে ভাবল: চারদিকে চোখ রাখেন গফিন, নইলে বুঝতেন না কা-বার নাইফ ব্যবহার করেছে খুনি। ইন্সপেক্টর হকিন্স কি বুঝতে পেরেছে তাঁর কথা?

খুনি মিলিটারি থেকে প্রশিক্ষিত। খুনের সময় ব্যবহার করেছে সম্মুখ সমরের ছোরা কা-বার নাইফ। ওটা কিচেন নাইফের মত সস্তা কিছু নয়। এ-থেকে বোঝা যাচ্ছে, মেলা টাকা দিয়ে ভাড়া করা হয়েছে দক্ষ খুনি। কিন্তু সে-টাকা দিল কে বা কারা? কেনই-বা চাইল বেলা খুন হোক?

আয়ারল্যাণ্ডে রিসার্চ করার সময় কারও জন্যে হুমকি হয়ে উঠেছিল বেলা। আজকের দুনিয়ায় গুলির আঘাতে যত মানুষ মারা পড়ে, তারচেয়ে বেশি খুন হয় বিপজ্জনক তথ্যের জন্যে। নিশ্চয়ই জরুরি কোন তথ্য জেনে গিয়েছিল বেলা। রানা নিজে সেটা জানলে উন্মোচিত হবে খুনের মোটিভ তখন এ-ও বেরোবে কোথা থেকে এসেছে টাকা। আর অর্থের উৎস জানিয়ে দেবে বেলাকে খুন করতে নির্দেশ দিয়েছে কে। অবশ্য এখন রানার বড় সমস্যা হচ্ছে জরুরি সূত্র খুঁজে পাওয়া।,

তেরো

কটেজে ফিরে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে নিল রানা। টের পেল কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে দেয়া পেইন কিলারের প্রভাব। শুরু হয়েছে মুখ-মাথা জুড়ে টনটনে ব্যথা। হঠাৎ নিজেকে বড় দুর্বল লাগল ওর। বুঝে গেল, ব্যথা দূর করতে হলে ওষুধের মত কিছু লাগবে। ভেজা পোশাক পাল্টে নেয়ার আগেই ভাবল, এখন এক ঢোক উইস্কি না নিলেই নয়।

ওর চোখ পড়ল ড্রেসারের মাথায় রাখা উইস্কির বোতল ও গ্লাসের ওপরে। বোতল খালি হলেও গ্লাসে আছে আড়াই ইঞ্চি মদ। গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতেই বিদ্যুতের শক খেল রানা। গতকাল ছুটে গিয়েছিল বেলাকে বাঁচাতে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। হাত বাড়িয়েও থমকে গেছে রানা। কয়েক পলক চেয়ে রইল সোনালি তরলের দিকে। মনের ভেতরে কে যেন বলল, ‘যথেষ্ট, রানা! নতুন করে আর মদ গিলতে যেয়ো না।’

হাত বাড়িয়ে উইস্কি ভরা গ্লাস ও খালি বোতল নিল রানা। দ্রুত পায়ে চলে গেল কিচেনে। বোতলটা যেন রিসাইকেল বিনে। তারপর সিঙ্কে ঢেলে দিল গ্লাসের উইস্কি। ফিরে এল পাশের ঘরে। বাক্সে আছে উইস্কির আরও কয়েকটা বোতল। বাস তুলে নিয়ে ফিরে এল কিচেনে। এক এক করে বোতলের মুখ খুলে সিঙ্কে ডাবল সোনালি তরল। তিন মিনিটে মিনিটে – খালি হলো সাতটা বাতল। ততক্ষণে অ্যালকোহলের গন্ধে কিচেনের পরিবেশ। হয়ে গেছে চালু ডিসটিলারির মত।

কিচেন থেকে বেরিয়ে আর্মচেয়ারে গিয়ে বসল রানা। সারা বিকেল ঝরঝর করে ঝরল বৃষ্টি। জানালা দিয়ে সে-দৃশ্য দেখল ও। প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে মাথা ব্যথা। কোনকিছুই পাত্তা দিল না রানা। শেষ বিকেলে জুতো খুলে লাগেজ হাতড়ে বের করল একজোড়া কেস্। ওর মনে পড়ল, গত ছয়মাসে ওগুলো ব্যবহার করেনি। জুতোর ফিতে বেঁধে কটেজ থেকে বেরিয়ে এল রানা। ছুটতে লাগল বৃষ্টির ভেতরে।

কৈশোরে প্রতি ভোরে এই সৈকতে দৌড়াত পাঁচ মাইল। এরপর শুরু হতো প্রেস আপ ও সিট আপ। পরিশ্রান্ত না হয়ে ব্যায়াম করত একঘণ্টার বেশি। আজ রানা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল: যত কষ্ট হোক, নিজেকে আবারও যোগ্য করে তুলবে।

প্রথম মাইল ছুটতে গিয়ে মাংসপেশির ব্যথা ও হাঁফ লাগার জন্যে নিজেকে বারবার দোষ দিল রানা। মনের ভেতরে খুনের দায় নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বৃষ্টির ভেতরে ছুটে চলল সৈকতের শেষপ্রান্তের দিকে। নুড়িপাথরে পড়ছে একেক পা, আর ঝাঁকুনি খেয়ে বাড়ছে ওর মাথা-ব্যথা। মনে হচ্ছে যেন ছিঁড়ে যাবে গেণিগুলো। হাঁসফাঁস করছে যন্ত্রণায় ভরা ফুসফুস। কয়েকবার মনে হলো, এবার একটু থামি, একটু বিশ্রাম নিই।

যদিও একবারের জন্যেও থামল না রানা।

একঘন্টা পর টলতে টলতে ফিরল কটেজে। ততক্ষণে সিধে হয়ে দাঁড়াবার সাধ্যও ফুরিয়ে এসেছে ওর। ভার্নিশ করা লিভিংরুমের মেঝেতে দীর্ঘ জলধারা রেখে বসে পড়ল ড্রেসারের পাশের আর্মচেয়ারে। ফুলে ঢোল হয়েছে পায়ের পাতা ও কাফ মাসল। গুঙিয়ে উঠে এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে এক এক করে খুলল ভেজা কেড্‌স্ ও মোজা। আড়ষ্ট দু’পা মেঝেতে রাখতেই মনে হলো, ওগুলো কোন গাছের মরা গুঁড়ি। কী যেন খচ্ করে বিধল ডানপায়ের পাতার নিচে। ব্যথা পেয়ে পা তুলে রানা দেখল, মাংসে গেঁথে গেছে একটুকরো ক্রিস্টাল। বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে ধরে ওটা তুলে আনল রানা। ক্ষত থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। অবশ্য গভীর নয় কাটা জায়গা। বুঝে গেল, মেঝে থেকে ভাঙা গ্লাস সরাবার সময় রয়ে গেছে স্ফটিকের টুকরো।

রানা মেঝেতে বসে খুঁজতে লাগল ধারাল আরও টুকরো রয়ে গেছে কি না। ঘড়ঘড় আওয়াজে ঠেলে দিল আর্মচেয়ার। মেঝেতে এক জায়গায় মদ পড়লেও আশপাশে কোন ভাঙা স্ফটিক নেই।

অবশ্য তার বদলে রয়েছে অন্যকিছু।

আর্মচেয়ারের তলায় হাত ভরে ওটা বের করল রানা।

জিনিসটা চামড়ার একটা পাউচ।

ভুরু কুঁচকে ওটার দিকে চেয়ে রানার মনে পড়ল, গতকাল বিকেলে কাঠের চেয়ারের কাঁধে ভেজা ব্যাগ ঝুলিয়ে রেখেছিল বেলা। চলে যাওয়ার আগে মদের প্রভাবে চেয়ারের ওপরে টলে পড়লে ব্যাগসহ মেঝেতে পতন হয় চেয়ারটার। চারপাশে ছড়িয়ে যায় ব্যাগের ভেতরে জিনিসপত্র। তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে নিয়ে বিদায় নেয় বেলা। জানত না আর্মচেয়ারের নিচে রয়ে গেছে মোবাইল ফোনের পাউচ।

গেস্ট-হাউসের দিকে যাওয়ার সময় ব্যাগে পাউচ নেই সেটা টের পায় বেলা। তখন ছুটতে ছুটতে আসে রানার কটেজের কাছে। কিন্তু সে-সময় ওকে ধাওয়া করছে দুই খুনি।

পাউচ দৈর্ঘ্যে সাড়ে সাত ইঞ্চি, চওড়ায় চার ইঞ্চি। ভেড়ার চামড়া দিয়ে তৈরি। মূল পকেট ছাড়াও সামনে আছে চেইন দেয়া ছোট পকেট। রানা আগেই জানে, পাউচে কী আছে। প্রমাণ হিসেবে ওটা পুলিশের হাতে তুলে দেবে কি না, সেটা ভাবতে গিয়ে সময় নিল ও। তারপর বুঝে গেল, কাজটা করা উচিত হবে না।

দ্বিধা না করে পাউচের বড় পকেট থেকে নিল বেলার নোটবুক। চোখ বোলাল লেখাগুলোর ওপরে। বেলা টুকে রখেছে কয়েক পৃষ্ঠা নোট, আয়ারল্যাণ্ডের কিছু জায়গা আর ‘জন মানুষের নাম। নোটবুক সরিয়ে রেখে পাউচের সামনের পকেটের চেইন খুলল রানা। ভেতর থেকে নিল দুটো স্মার্টফোন। দুটোর একটা নোকিয়ার দামি মোবাইল ফোন, অন্যটা কমদামি স্যামসাং। শেষেরটা মাত্র ক’দিন আগে কেনা। স্ক্রিন থেকে খোলেনি প্রোটেকটিভ প্লাস্টিক শিট।

রানার মনে পড়ল, গতকাল এদিকে আসার সময় চামড়ার পাউচ থেকে স্মার্টফোন নিয়ে মেসেজ এসেছে কি না দেখেছে বেলা। খুব হতাশ হয়েছিল তখন। বলেছিল, একলোকের কাছ থেকে মেসেজ পাবে বলে আশা করছে। ওটা ওর রিসার্চের সঙ্গে জড়িত। দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল মুখে। অবশ্য এ- ব্যাপারে সে-সময় আর কিছু বলেনি।

তখন কিছু না ভাবলেও এখন বেলার মৃত্যুর পর প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে রানা। ভাবল: গতকাল কোন্ ফোনটা ব্যবহার করেছিল বেলা?

পাশাপাশি দুই ফোন দেখার পর ওর মনে পড়ল, বেলার হাতে ছিল কমদামি স্যামস্যাং।

ওটা চালু করল রানা। কনট্যাক্ট লিস্টে বোধহয় থাকবে গুরুত্বপূর্ণ লোকটার নাম।

যদিও কনট্যাক্ট লিস্ট প্রায় খালি।

হয়তো আগেই বেশিরভাগ ডেটা ডিলিট করেছে বেলা।

ব্যাক কি টিপে এসএমএস মেন্যুতে গেল রানা।

তিনদিন আগে সার্ভিস প্রোভাইডারের ‘ওয়েলকাম, নিউ ইউয়ার’ মেসেজ ছাড়া অন্য কোন ডেটা নেই।

এ-ফোন আয়ারল্যাণ্ডের নানাদিকে যাওয়ার সময় দু’চার দিন আগে কিনেছে বেলা।

দ্বিতীয় ফোন কেন কিনল মেয়েটা? ভাবল রানা।

জরুরি তথ্য পাওয়ার সঙ্গে নতুন ফোন কেনার কি কোন সম্পর্ক আছে?

মেসেজ মেনু থেকে সরে কল হিস্ট্রি দেখল রানা।

প্রায় অব্যবহৃত ফোন থেকে তিনবার কল করেছে বেলা আর সেটা করেছে ফোন কেনার দিনে।

প্রথম কল স্থানীয় সময় বিকেল তিনটে পঁচিশে। ওটা গেছে আমেরিকার এক ল্যান্ডফোনে। কথা বলেছে মাত্র তিন মিনিট।

এরপর ফোন করেছে লণ্ডনের এক ল্যাণ্ডফোনে। তখন কথা বলেছে কয়েক মিনিট।

তৃতীয় ফোন আবারও আমেরিকায়।

সে-সময়ে কথা হয়েছে একচল্লিশ মিনিট।

কিন্তু বেলা কেন আবারও ফোন করল আমেরিকায়?

এর পেছনে নিশ্চয়ই জরুরি কোন কারণ ছিল?

রিসিভড্ কল চেক করে মাত্র একটা ফোনকল পেল, রানা। একই দিনে তিনটে চল্লিশ মিনিটে ফোন করেছে বেলা লণ্ডনে। কথা বলেছে তিন মিনিট। এরপর পাঁচটা একত্রিশ মিনিটে আমেরিকায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেছে। এরপর আর ব্যবহার করেনি স্যামসাং।

আমেরিকায় যে ল্যাণ্ডফোনে কল করেছিল বেলা, অপশন টিপে সে-নাম্বারে ফোন দিল রানা।

আয়ারল্যাণ্ডে এখন বিকেল তিনটে।

অর্থাৎ আমেরিকায় বাজে রাত তিনটে।

দু’বার রিং হওয়ার পরে আমেরিকার দক্ষিণের সুরে বলল এক মেয়ে, টুলসা সিটি হল। মেয়রের অফিস। আপনার জন্যে আমরা কী করতে পারি?’

মেয়রের অফিস? বিস্মিত হয়েছে রানা। চট করে ভেবে নিয়ে বলল, ‘লণ্ডন থেকে টনি ব্র্যাডম্যান বলছি। তিনদিন আগে আমার কলিগ বেলা ওয়েস আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।’

‘তা-ই? কিন্তু কী বিষয়ে?’ দ্রুত জানতে চাইল মেয়েটা।

এ-বিষয়ে নিজে কথা বলতে চাই মেয়রের সঙ্গে,’ বলল রানা।

‘আগে বলুন আপনি কোথায় জব করেন ..

‘শেরিফস ব্যাজ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক।’ লণ্ডনে রানার এক বন্ধু সেই ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি চিফ। ‘শুনুন, মিস, জরুরি কারণে কথা বলতে চাই মেয়রের সঙ্গে। আপনি কি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন, আপনার অফিসে তিনদিন আগে কল দিয়েছিল আমার কলিগ?’

বিষয়টি সিকিউরিটির বুঝতে পেরে মেয়েটা বলল, ‘দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন। আমি চেক করে দেখছি।’ মিনিটখানেক পর আবার লাইনে এল সে। ‘জী, তিনদিন আগে মেয়রের সঙ্গে কথা বলতে চান’ আপনার কলিগ কিন্তু …’

তাকে বাধা দিল রানা, ‘আমার কলিগ কি মেয়রের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছে?’

‘না, তিনি তখন অফিসে ছিলেন না। আপনি বলুন তো আসলে…’

আবারও বাধা দিল রানা, ‘আমার কলিগ নিশ্চয়ই বলেছিল, কেন মেয়রের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে?’ বুঝে গেছে এভাবে তথ্য আদায় করতে পারবে না। অবশ্য কিছু হারাবারও নেই ওর।

‘বলুন তো, আসলে কে আপনি?’ অধৈর্য সুরে বলল মেয়েটা।

আর কিছুই জানতে পারবে না বুঝে ‘ধন্যবাদ, আপনার রাত সুন্দর কাটুক,’ বলে ফোন রেখে দিল রানা।

কেন টুলসার মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছে বেলা? নিজেকে জিজ্ঞেস করল ও। এবার লিস্টের পরের নম্বরে কল দিল। ওটা লণ্ডনের। কিন্তু ওদিক থেকে জবাব দিল না কেউ। অ্যানসারিং সার্ভিসও নেই। এবার বেলার আমেরিকায় করা সেই মোবাইল ফোনে কল দিল রানা।

কিন্তু অফ করে রাখা হয়েছে ডিভাইসটা।

দ্বিতীয় ফোনের দিকে তাকাল রানা। প্রায় নতুন হলেও বহু ব্যবহার করা হয়েছে নোকিয়া। ভেতরে প্রচুর নম্বর। বাবা-মার কাছে নিয়মিত ফোন করত বেলা। এ-ছাড়া আছে অ্যাড্রেস বুকে আত্মীয়স্বজন ও বান্ধবীদের ফোন নম্বর। ফোন ঘেঁটে এমন কোন তথ্য পেল না রানা, যেটা থেকে বোঝা যাবে আসলে কী ধরনের কাজ কত বেলা। আরও কিছুক্ষণ পর অপরাধবোধে ভুগতে লাগল রানা। মৃত এক মেয়ের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। হতাশ হয়ে পাউচের পকেটে রেখে দিল কোনদুটো।

এবার পড়তে লাগল নোটবুক। ওটা শুধু নোটবুক নয়, ডায়েরির মত করে টুকটাক বহু কথাই লিখেছে বেলা। অনেক রিসার্চারের মত কখন কোথায় কী কাজে গেছে, তা টুকে রেখেছে। গুছিয়ে কাজ করত। যদিও হাতের লেখা বুড়ো ডাক্তারদের মতই জটিল। আগস্ট মাসে এক পাতা জুড়ে বেলা লিখেছে আইরিশ ট্রিপের বিষয়ে। গত কয়েক সপ্তাহে গ্রাম্য বেশ কিছু জায়গায় গেছে। সেগুলোর ভেতরে আছে ভেঙে পড়া পুরনো এবারডেন ম্যানশনের কথা। অতীতে সে এলাকায় বেশ কয়েকটা গ্রাম মিলে ছিল রিশাল এবারডেন এস্টেট। একটা নোটে বেলা লিখেছে:

কথা বলেছি সেইণ্ট ম্যালাচি চার্চের ফাদার ও-সুলিভানের সঙ্গে। জানলাম তাঁদের রেকর্ড অনলাইনে নেই।
বায়ার্ন ১৮০৯ সালে জন্মালে কীভাবে ১৮২২!!! এ তো অসম্ভব!!!!!

কিছুই জানা নেই বলে নাম, তারিখ ও সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে না রানার কাছে। আনমনে ভাবল, এবার বোধহয় বেলার মত আমাকেও উঁকি দিতে হবে অতীতে। সেক্ষেত্রে হয়তো জানব কেন খুন করা হয়েছে মেয়েটাকে।

নোটবুক রেখে কিচেনের দেয়ালের পেরেক থেকে টয়োটা প্রিমিয়োর চাবি নিল রানা। পায়ে বুট পরে নিয়ে কটেজ ছেড়ে বেরিয়ে চলে এল গ্যারাজে। ভাল করেই জানে, খুনের ব্যাপারে নতুন তথ্য পেতে হলে নিজে থেকে তদন্ত করতে হবে ওকে।

চোদ্দ

আমেরিকার ওকলাহোমা রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর টুলসায় এখন বাজে সকাল সাড়ে নয়টা। এরই মধ্যে সূর্যের তাপে চারপাশ হয়ে গেছে জ্বলন্ত উনুন। এমন কী অপেক্ষাকৃত শীতল শাটারবদ্ধ গ্যারাজেও দরদর করে ঘামছে জ্যাকি। ধুপ করে আটকে দিল গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্কের ডালা। মোমপালিশ করা মসৃণ বড়ি ঢাকল তারপুলিন দিয়ে। অন্তরের গভীরে শুনল বাবার আদুরে কণ্ঠস্বর: ‘ভুলিস না, মা, সবসময় কোন না কোন বিকল্প হাতে রাখবি।’

প্রায়ান্ধকার গ্যারাজে গাড়িটার কাছ থেকে সরে এল জ্যাকি। বারবার মনে হচ্ছে, কেউ না কেউ চোখ রেখেছে ওর ওপরে। কানে শুনছে কাদের পদশব্দ। আসলে পুরো দু’দিন বিশ্রী সেই মোটেলে লুকিয়ে থেকে শুরু হয়ে গেছে মানসিক সমস্যা। ভয় লাগছে ভীষণ। অবশ্য শেষমেশ নিতে পেরেছে জরুরি সিদ্ধান্ত। ওর ধারণা, সঠিক কাজই করছে। আসলে এ-ছাড়া আর কোন উপায়ও তো নেই।

গ্যারাজের শাটারের নিচের সরু ফাঁক দিয়ে আসছে এক চিলতে সোনালি রোদ। ওখানে থেমে বিশ্রী আওয়াজে শাটার তুলল জ্যাকি। গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে আবার টেনে বন্ধ করল শাটার। তালা মেরে দিল হ্যাণ্ডেলে। বাইরের ঝলমলে আলোয় কুঁচকে গেল ওর ভুরু। কপালে হাত রেখে দেখল ডানে-বামে। একসারিতে কিছু তালাবদ্ধ গ্যারাজের সামনে আছে ও। আশপাশে কেউ নেই। ফাঁকা পড়ে আছে ঝোপে ভরা বিশাল উঠনের মত জায়গা। দেয়ালে-দেয়ালে নানান নোংরা উক্তি।

আমার কপাল ভাল হলে শুক্রবার রাতে খুনিরা বুঝতে পারেনি তাদের কুকীর্তি দেখে ফেলেছি, ভাবল জ্যাকি। আর সেটা সত্যি হলে হাড়ে হাড়ে শয়তানগুলো বুঝবে, অন্যায় করে কখনও রেহাই পাওয়া যায় না।

গ্যারাজের উঠন পেরিয়ে রাস্তায় এল জ্যাকি। ওর জন্যে মিটার চালু করে বসে আছে এক ট্যাক্সি ড্রাইভার। ‘এবার কোথায় যাবেন, মিস?’ জানতে চাইল সে।

‘ডাউনটাউন,’ বলল জ্যাকি, ‘পুলিশ হেডকোয়ার্টারে।’

‘আচ্ছা।’

জ্যাকি পেছনের সিটে উঠতেই রওনা হলো ড্রাইভার। দু’চোখ বুজে মেয়েটা ভাবল, কী বলবে পুলিশকে। ওর ব্যাকপ্যাকে আছে ডিভিডি ও স্মার্টফোন। ও-দুটোর জন্যে এবার ফেঁসে যাবে লিঙার স্বামী।

ডাউনটাউনে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে সরাসরি মেইন ডেস্কে গেল জ্যাকি। ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসে আছে বয়স্ক এক সার্জেন্ট। তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে খুকখুক করে কাশল জ্যাকি। জবাবে মুখ তুলে ওকে দেখল গম্ভীর লোকটা। তার পরনে হাতকাটা কালচে-নীল শার্ট। বুক পকেটের ওপরে প্লাস্টিকের কার্ডে লেখা: টুলসা সিটি পুলিশ।

‘আমি জ্যাকুলিন সিলভেস্টার,’ অফিসারকে বলল জ্যাকি, একজন ডিটেকটিভের সঙ্গে কথা বলতে চাই। ভাল হয় সিনিয়র কেউ হলে। বিষয়টা খুবই জরুরি।’

ওর গলায় তাগিদ টের পেয়ে সতর্ক হলো অফিসার। পাঁচ মিনিটের ভেতরে রিসেপশন লবিতে জ্যাকির সঙ্গে দেখা করল ক্লান্ত চেহারার সাদা পোশাকের এক পুলিশের গোয়েন্দা। বড়জোর ত্রিশ হবে তার বয়স। নিজের নাম বলল জিম লিয়োনার্ড। ব্যস্ত লবি থেকে জ্যাকিকে নিয়ে গেল ছোট এক অফিসে। হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল চেয়ার। ওখানে বসে কোলের ওপরে ব্যাকপ্যাক রাখল জ্যাকি। নিজে টেবিলের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসল ডিটেকটিভ। তার ভাব দেখে জ্যাকির মনে হলো, কাজ ফেলে এসে মহাবিরক্ত সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল ডিটেকটিভ, ‘ঠিক আছে, বলুন, মিস…..

‘আমার নাম জ্যাকুলিন সিলভেস্টার।’

‘বেশ। ডেস্ক ডিউটিতে থাকা অফিসারকে বলেছেন, খুব দরকারি কাজে এখানে এসেছেন।’

আমার মনে হয় না গত একসপ্তাহে এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু আপনি শুনেছেন,’ বলল জ্যাকি।

‘তা হলে শুনি আপনার কী বলার আছে।’

‘প্রথম থেকে বলছি,’ বলল জ্যাকি। ওর কথায় ডায়েরিয়া আক্রান্ত রোগীর মত বিকৃত চেহারা করল ডিটেকটিভ। ‘আমি চাকরি করি রোয বাড ট্রাস্টে। আমরা টুলসার গরীব শিশুদের আবাসন ও খাবারের সুব্যবস্থা করি।’

‘আগেও এই ট্রাস্টের নাম শুনেছি, বলতে থাকুন,’ বলল ডিটেকটিভ। চট করে দেখে নিল হাতঘড়ি।

‘তা হলে তো আপনি জানেন রোয বাড ট্রাস্টের ডিরেক্টর আসলে কে,’ বলল জ্যাকি।

‘হ্যাঁ, জানি। টুলসার সবাই সেটা জানে।’

‘আমি লিণ্ডা কনারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। কাজ করি তাঁর সরাসরি নির্দেশে। অনেকের কাছ থেকে সম্মান পেলেও প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয় আমাকে। তাই কখনও কখনও বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়ি।’

ডিটেকটিভের চোখ বলছে: আসল কথায় আসুন, মিস!

‘আমার বস আর তাঁর স্বামীর উলোগাহ্ লেকের পুব তীরে একটা কটেজ আছে,’ বলল জ্যাকি। ‘তিনদিন আগে…’

চুপচাপ শুনতে লাগল ডিটেকটিভ। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে উধাও হলো তার মুখের বিরক্তি। এখন আর একটু পর পর হাতঘড়ি দেখছে না। থেমে গেছে পা দুলিয়ে অধৈর্য ভাব করা। পিঠ টানটান করে চেয়ে আছে জ্যাকির দিকে। কুঁচকে গেছে ভুরু। ওর কথা শেষ হওয়ার পর ডেস্ক থেকে নেমে পায়চারি শুরু করল সে। চোখে-মুখে দ্বিধা। মিনিট দুয়েক পর বলল, ‘আপনার কোন ভুল হচ্ছে না তো?’

‘আমার কথা অবিশ্বাস হলে নিজেই ভিডিয়ো দেখুন, ব্যাকপ্যাকে হাত রাখল জ্যাকি। ‘আমার বলা প্রতিটি ঘটনা ওটাতে পাবেন।’

তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ ওকে দেখল অফিসার লিয়োনার্ড, তারপর ‘একমিনিটের মধ্যে ফিরছি,’ বলে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। পেছনে আটকে দিয়েছে কবাট।

ঘরে একা বসে থাকল জ্যাকি

মিনিট পাঁচেক পর দড়াম করে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল বিশাল শরীরের একলোক। তার কাঁধ বাইসনের কাঁধের মত চওড়া। বয়স অন্তত পঞ্চাশ। মাথায় চুল রুপালি। পাথর কুঁদে তৈরি চেহারা। কপালে ও গালে লালচে সব শিরা। জীবনে অন্তত তিনবার ভেঙেছে তার নাক। পরনে জ্যাকেট নেই। শার্টের ওপর চামড়ার হোলস্টারে ঝুলছে কালো এক কোল্ট পাইথন রিভলভার। লোকটাকে দেখে জ্যাকির মনে পড়ল বুনো পশ্চিমের দুর্ধর্ষ মার্শালদের কথা। ওই যে, যারা সঙ্গে রাখত লম্বা নলের সিক্সগান। শার্টের হাতা গুটিয়ে রেখেছে অফিসার। পেশিবহুল বাহু কাঠুরেদের মত। তার পিছু নিয়ে আবারও ঘরে ঢুকেছে জিম লিয়োনার্ড। অবশ্য তাকে পাত্তা না দিয়ে জ্যাকির সামনে থামল বয়স্ক অফিসার।

‘আমি টুলসার পুলিশ চিফ রিপার রিগবি,’ ঘড়ঘড়ে গলায় বলল সে, ‘একটু আগে ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডকে যা বলেছেন, সেটা আমার সামনে আবারও বলুন।’

বিশালদেহী অফিসারের সামনে নিজেকে নগণ্য বলে মনে হলো জ্যাকির। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনি চান, আমি যেন আবার সবকিছু প্রথম থেকে বলি?’

‘একটু আগে বলেছেন উলোগাহ্ লেকে তাঁর কটেজে আপনাকে থাকতে দেন লিণ্ডা কনার। কিন্তু কেন সেটা তিনি দিলেন?’

‘কারণ তিনি খুবই বড় মনের মানুষ,’ বলল জ্যাকি।

‘হৃদয়বতী মহিলা। ঠিক আছে, বলতে থাকুন।

‘তাঁকে বলেছিলাম, কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। তখন তিনি বললেন, তাঁর স্বামী গেছেন বোস্টনে। তাই আমি চাইলে দু’এক দিন কাটিয়ে আসতে পারি তাঁর কটেজ থেকে। জানালাম, আমার গাড়ির ইঞ্জিনে গোলমাল ধরা পড়েছে। তাই ওটা নিয়ে দূরে যেতে পারব না। তখন তিনি বললেন তাঁদের ড্রাইভারকে বলবেন, যাতে সে রোদ্ রয়েসে করে আমাকে কটেজে পৌছে দেয়। এ-কথায় খুব খুশি হয়েছিলাম। ভাবলাম লেকের তীরে দুটো দিন বিশ্রাম নেব। সেই সঙ্গে দৌড় প্র্যাকটিস করে নেব ম্যারাথনের জন্যে। অবশ্য এসব আগেই ডিটেকটিভ লিয়োনার্ডকে জানিয়ে দিয়েছি।’

‘কীসের ম্যারাথন?’ গভীর সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল চিফ রিগবি।

‘গতবছর টুলসা সিটি মহিলা ম্যারাথনে দ্বিতীয় হয়েছি। তাই নভেম্বরের দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে চাই। এই ম্যারাথনের কল্যাণে লাখ লাখ ডলারের ফাণ্ড সংগ্রহ করে রোয বাড ট্রাস্ট। আমার যদিও মনে হচ্ছে না আপনি এসব জানতে চান।

‘ঠিকই বলেছেন, আমি জানতে চাই কটেজে কী ঘটেছে।’

‘ডিনারের পর শুয়ে পড়লেও মাঝরাতে ঘুম ভাঙল পুরুষ মানুষের গলার আওয়াজে। ভাবলাম বোধহয় ডাকাত পড়েছে কটেজে। বিছানা থেকে নেমে পিস্তল হাতে নিলাম। আর তারপর…’

‘আগ্নেয়াস্ত্রের পারমিট আছে আপনার?’ জানতে চাইল চিফ রিগবি।

বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকাল’ জ্যাকি। ‘আপনার কি ধারণা আমিই খুনি, নাকি কটেজে যারা গিয়েছিল, আসলে তারা? আমি এখানে আমার পিস্তলের গল্প বলতে আসিনি। আপনি কি আমার পিস্তল বা পারমিট দেখতে চান?’

‘পরে দেখব। বলতে থাকুন।’

‘কটেজে যে এল, তার সঙ্গে চাবি ছিল বলেই দরজা খুলে ঢুকতে পেরেছে। তখনই বুঝলাম, বোস্টনে যাননি লিণ্ডা কনারের স্বামী। তাঁর সঙ্গে ছিল ক’জন লোক। তাদের একজনের গালে চাপদাড়ি। মাথার কোঁকড়া চুল কালো। বয়স হবে চল্লিশ বা পঞ্চাশ

‘যে পরে খুন হয়, বলল ডিটেকটিভ লিয়োনার্ড।

‘তার নাম জেনেছেন?’ সহকারীর দিকে না চেয়ে জ্যাকির কাছে জিজ্ঞেস করল চিফ রিগবি।

‘একবারও তার নাম ধরে ডাকেনি কেউ,’ বলল জ্যাকি। তাদের ভেতরে কথাও হচ্ছিল না। একটু পর লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলল তারা। আর তারপর…

‘একমিনিট,’ বাধা দিল চিফ। ‘ওখানে ক’জন ছিল?’

‘মারধর করেছে ডাকাতের মত দুই যুবক। ব্যাটন দিয়ে পেটাল মধ্যবয়স্ক লোকটাকে। এসব ব্যাটন ব্যবহার করে পুলিশ ও সিকিউরিটি গার্ডেরা। তারপর লোকটাকে কটেজের বাইরে তাদেরকে নিয়ে যেতে বলল সে।’

‘এই সে-টা আসলে কে?’ জানতে চাইল চিফ রিগবি।

মাথা দোলাল জ্যাকি। ‘সে লিণ্ডা কনারের স্বামী। বলল, ‘এখানে নয়, বাইরে নাও, বার্ব।’ আমার মনে হলো, সে চাইছে না কার্পেটে রক্ত পড়ুক। সেই দুই যুবক দাড়িওয়ালা লোকটাকে ছেঁচড়ে দরজা পার করিয়ে নিয়ে গেল বারান্দায়। আর তখনই প্রথমবার গুলি করা হলো তাকে।

‘কতবার গুলি করা হয়েছে?’ জানতে চাইল চিফ রিগবি।

‘গুনিনি, তিন বা চারবার। প্রথমে তাকে খুন করেনি। অন্যরা মজা পাচ্ছিল ইঁদুর-বেড়াল খেলতে গিয়ে। আহত লোকটাকে শীতল চোখে দেখছিল তারা। তারপর অ্যারন কনার বের করল বড় এক রিভলভার। আপনার হোলস্টারের অস্ত্রটার মত। বোধহয় ফোর্টি-ফোর ক্যালিবারের রুপালি রঙের রিভলভার। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি।’

‘অস্ত্র তো দেখি ভালই চেনেন?’ নিষ্পলক চোখে জ্যাকিকে দেখছে চিফ রিগবি।

‘আমার বাবা ছোটবেলায় শিখিয়ে দিয়েছে কীভাবে চালাতে হবে পিস্তল,’ জবাবে বলল জ্যাকি।

‘তো অস্ত্র আপনার খুব পছন্দ, ঠিক কি না?’

পুলিশ চিফের চোখে সরাসরি তাকাল জ্যাকি। ওর মনে হচ্ছে, ওকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে লোকটা। ‘আমি একজন আধুনিক মহিলা,’ বলল ও। ‘তাই চাই না অসহায় হয়ে খুন হব একদল ডাকাতের হাতে।’

‘ঠিক আছে,’ বাতাসে হাত নাড়ল চিফ। ‘এই বিষয়ে কোন তর্কে যাব না। এবার বলুন, ওখানে আর কী ঘটল?

‘এরপর লোকটাকে গুলি করল অ্যারন কনার।’

 কথা শুনে ঠোঁট মোচড়াল চিফ। ‘অর্থাৎ আপনি বলছেন, নিজে গুলি করেছেন তিনি? নিজে ট্রিগার টিপে দিয়েছেন? জেনে-বুঝে?’

‘বলতে পারেন খুশিমনে খুন করেছে সে,’ বলল জ্যাকি। ‘মাত্র ক’ফুট দূর থেকে গুলি করেছে মাথার পেছনে। এরপর সঙ্গের লোকদুটোকে বলল, ‘টুকরো করে মাংসগুলো কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবে।

‘লাশ টুকরো করার কথা বলেছেন তিনি?’

‘তা-ই বলেছে,’ মাথা দোলাল জ্যাকি।

গম্ভীর হয়ে গেছে চিফ রিগবি। শুকনো গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। অন্য দু’জনকে নির্দেশ দেয়ার সময় কেমন ছিল তাঁর মনোভাব?’

‘ঠাণ্ডা গলায় কথা বলেছে।’

‘মাতাল ছিলেন?’

‘না। স্বাভাবিক কণ্ঠেই কথা বলেছে অ্যারন কনার।’

‘আপনি বলছেন, ঠাণ্ডামাথায় মানুষ খুন করেছেন তিনি?’ ওর প্রতিটি কথা এখন যাচাই করছে চিফ রিগবি, বুঝে গেল জ্যাকি। এমন ঘটনার কথা জানলে নিজেও তা-ই করত ও। চিফ রিগবির চেহারা নির্বিকার। ধীরে ধীরে মাথা দোলান জ্যাকি। ‘অবশ্যই! জেনে-বুঝেই খুন করেছে! এতে কোন ভুল নেই।’

‘আর আপনি মিথ্যা বলছেন না, সেটা শপথ করে বলতে পারবেন আদালতে?’

‘একই প্রমাণ আছে আমার তোলা ভিডিয়োতে,’ বলল জ্যাকি। ‘ওটাকে মিথ্যা অভিনয় বলে মনে করবে না কেউ।’

বড় করে শ্বাস নিল চিফ রিগবি। জ্যাকির সামনে থেকে সরে দু’বার মাথা নেড়ে বলল, ‘মিস সিলভেস্টার, আপনি কি এরই ভেতরে কাউকে এই বিষয়ে কিছু বলেছেন??

‘এখনও নয়। এমন কী বলিনি আমার বস লিণ্ডাকেও। গত দু’দিন ছিলাম জঘন্য এক মোটেলে। বারবার ভেবেছি লিণ্ডাকে ফোন দেব। কিন্তু পরে ভাবলাম ওটা করা ঠিক হবে না।’

‘আশা করি বুঝতে পেরেছেন, কত বড় অপরাধের দায় আপনি চাপিয়ে দিচ্ছেন টুলসা সিটির মেয়রের কাঁধে?’ জানতে চাইল পুলিশ চিফ।

‘দেখুন, আমি নিজেকে নির্বোধ মানুষ বলে মনে করি না,’ জবাবে বলল জ্যাকি। ‘জানি কী বলেছি। আর তার ফলে কী ঘটতে পারে, সেটাও আমার অজানা নয়। আসলে নিজের চোখে যা দেখেছি, আদালতে গেলেও সেটাই বলব। আমার বস লিণ্ডার স্বামী টুলসার মেয়র অ্যারন কনারকে নিজের চোখে ঠাণ্ডামাথায় মানুষ খুন করতে দেখেছি। আমার এই কথায় একবিন্দু মিথ্যা পাবেন না।

জ্যাকি চুপ করে যাওয়ায় পরস্পরকে দেখল ডিটেকটিভ জিম লিয়োনার্ড ও পুলিশ চিফ রিপার রিগবি। দু’জনের চেহারায় ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার ছাপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *