কালকেতু ও ফুল্লরা – ৫

৫.

ধর্মবনানী [২১], পুরাকালে যার নাম ছিল মিউনিসিপ্যাল চিলড্রেনজ পার্ক, এবং পরে যা বঙ্গভবনের এক্সটেনশনে পরিণত হয়েছিল, তার বর্তমান নাম পরিগ্রহ ক’রে এইরূপে :

তৎকালীন বনানী গোরস্তান (বর্তমানে ইলজাম অগ্নি-সিটি) অতি জনবহুল, মানে মুর্দাবহুল, হ’য়ে পড়লে, এই পার্কে গোরস্তানটি স্থানান্তরিত হয়। তখন এর নতুন নাম হয় নয়াবনানী। কিন্তু যা হয়, মুর্দার পিছু-পিছু প্রথমে আসে শকুন ও শৃগাল, তারপর সাধুসন্ন্যাসী-প্রভৃতি। প্রকৃত প্রস্তাবে, সাধুতার পরিমাণ এখানে বেড়ে যায় এমন যে, শকুন ও শৃগাল, এবং তত্তৎসহ সর্বপ্রকার পশুপাখি ও কীটপতঙ্গ, অচিরাৎ এই স্থল পরিহার ক’রে, এবং নয়াবনানী কালে ধর্মবনানী সংজ্ঞা লাভ ক’রে। পরে, অত্রকার ধার্মিকগণের নিরাপত্তা-বিধানের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদে ‘ধর্ম-বিল’ পাশ হয়, এবং সাধুজন-ব্যতিরেকে (এবং বলা বাহুল্য, মুর্দা-ব্যতিরেকে) অপরাপর সকলপ্রকার প্রাণিবর্গের জন্যে এই পুণ্যস্থানের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ হয়। সাধুদের মধ্যে, কেবলমাত্র পার্শি অগ্ন্যুপাসকদেরকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অবশ্য তা কেবলমাত্র অগ্নিকাণ্ড রোধ-কল্পেই।

শোনা যায়, বর্তমান প্রেজিডেন্ট বীরবলেন্দু গুণ একদা সভাকবি সাজ্জাদ শরিফ-সমভিব্যাহারে ধর্মবনানীতে বেড়াতে যান রাতে। গেটের সান্ত্রিদের অবশ্য তাঁকে (গুণকে) সাধু বলেই ভ্রম হয়, চেহারাগত কারণেই। তবু, স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার্থে তাদের জনৈক শুধান, ‘আফনি খে?’

প্রেজিডেন্ট বলেন, ‘হামি ঘুণ।’

শুনে তাঁরা চমকে উঠে দরোজা বন্ধ ক’রে দেন।

সাজ্জাদ বলেন, ‘দূর মিঞা! আপনি ঘুণ বললেন কেন?”

‘ওরা মহাপ্রাণ ধ্বনি ব্যবহার করছিল তো, ভাবলাম সেটাই দস্তুর এখানকার,’ প্রেজিডেন্ট গুণ বিব্রত হ’য়ে বলেন।

‘সিলেটি সেন্ট্রি রাখবার আক্কেলটা হ’ল তো?’ সাজ্জাদ টিপ্পনি কাটেন।

‘তা কী করব। ওরাই তো ধর্মের মর্ম বোঝে নাকি সবচেয়ে বেশি। তাছাড়া খোদ শামসুল উলেমা, কে আই ডিলভার সুপারিশ করলেন…

পরে সাজ্জাদ শরিফ রেগে গিয়ে ‘ধর্মবনানী, চলো সাবধানে’ নাম্নী একখানা ‘অশ্লীল’ কবিতা লিখলে পর ধর্মবনানী-মর্যাদা-রক্ষা কমিটি, তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা রুজু ক’রে। ফলে কবি সাজ্জাদ শরিফকে এক সহস্র এক দ্রাখমা জরিমানা দিতে হয়। জনশ্রুতি আছে যে, টাকাটা সাজ্জাদের হ’য়ে কবিতাপ্রেমী প্রেজিডেন্ট গুণই স্বয়ং দিয়ে দেন। কবিতাটিকে অবশ্য ব্যান করা যায় নাই, কেননা ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ এবং ‘ফ্রিডম অব দ্য প্রেস’ অ্যাক্ট-দু’টি পাশ হ’য়ে গেছে ততদিনে।

ইয়াক-পৃষ্ঠে কালকেতু বলেন, ‘আমাদের ঢুকতে দেবে তো?”

ফুল্লরা তাঁর দিকে ঘুরে (ফুল্লরা সামনে বসেছেন) বলেন, ‘ইয়াকের পিঠে আছি যতক্ষণ, ভয় নাস্তি। ভাববে তিব্বত থেকে আসা কোনও লামা-লামি।’

তখন কালকেতু বলেন, ‘পারডন মাই আইজ, কিন্তু তোমার বুকের দু’টো হুক খুলে আছে।’

‘লাগিয়ে দাও,’ ফুল্লরা প্রশ্রয় দেন। ‘বাট সাবধান, চোখের অপরাধের আইনগত শাস্তি নেই, হাতের আছে।’ পরে অবশ্য কালকেতু হুক লাগানোর উপক্রম করলে (ফুল্লরা) বলেন, ‘থাক তাহলে। ইয়াকেও কাজ না-হয় যদি…’

কাজ অবশ্য হ’ল। তবে সেটা ইয়াকে না হুকে তা ঠিক বোঝা গেল না, কেননা সান্ত্রিরা তাঁদেরকে প্রায় বিনাবাক্যেই ঢুকতে দিলেন। শুধু ইয়াকটির সাধুতা-বিষয়ে সন্দেহ থাকায় তাকে রুখে দেওয়া হ’ল। ইয়াক বেচারা মনের দুঃখে বনে গেল।

ফুল্লরা বলেন, ‘সাবধানে হেঁটো। কোনও মঁসিয়ো, কোনও মশায়ের পার্মানেন্ট রেজিডেন্স মাড়িয়ে দিয়ো না যেন লক্ষ্মিটি। ওঁরা কষ্ট পাবেন।

ফলে দু’জনে এঁকেবেঁকেবেঁকে, ঢাকার সড়কে রিকশা, কিংবা কলকাতার সরণিতে ট্যাক্সির মতো, এগুতে থাকেন। এতৎসত্ত্বেও, বরং ফুল্লরারই পা প’ড়ে যায় ত্র্যম্বক হিংলাজী নামক এক দুর্ধর্ষ ভদ্রলোকের কবরে (নামটি জানা যায় তাঁর অয়োময় এপিটাফ থেকে:

ত্র্যম্বক হিংলাজী
চিম্বুক পাহাড় থেকে পতন ২০৯৭ ইং
মৃত্যুবরণ ২০৭৯ ইং

(সম্ভবতঃ খোদাইখানার ভূত)।

কবরে পা-পড়া-মাত্র, ফুল্লরার দেড়হাত জিব বেরিয়ে প’ড়ে, তিনি আর হাঁটতে রাজি থাকেন না, এবং কালকেতু তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়ে অগ্রসরেন। শাড়ি পরিহিত থাকায়, দু’পা দু’দিকে ঝোলাতেই, ফুল্লরার কাপড় তাঁর কোমরে উঠে যায়, এবং কালকেতু সুড়সুড়ি অনুভব করেন ঘাড়ে-গলায়- বুকে। শেষোক্ত জায়গায় সুড়সুড়িটি অবশ্য সরাসরি স্পর্শজনিত নয়।

কালকেতুর সারা গায়ে অ্যালার্জি-দানা ফুটতে লাগে, চুলকাতে লাগে, এবং সহর্ষে তিনি বলেন, ‘ইতর প্রাণীদের মধ্যে স্কন্ধারোহণের একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু গাধারা, মানে, গাধাতুল্য সকল পশুই, কাজটা ক’রে বিপরীত- ক্রমে। ফলে তারা গাধাই থেকে যায়… ‘

‘ভ্যালেন্টাইনজ ডে-তে কী তুমি দেবে আমায়?’ পা দোলাতে-দোলাতে ফুল্লরা শুধান।

কালকেতু মনে-মনে গা চুলকাতে-চুলকাতে বলেন, ‘দু’টি নক্ষত্রবীথি— অ্যান্ড্রোমিডা এবং ক্যাসিওপিয়া। ফাউ হিসাবে বৃহস্পতি গ্রহটিও পাবে।

‘আমার কিন্তু শনিই বেশি পছন্দ,’ ফুল্লরা বাই ধরেন।

‘উঁহু, শনি দেওয়া যাবে না। ওটা আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি।’

‘কিন্তু তোমার অর্ধাঙ্গ তথা উত্তমাঙ্গ হিসাবে অন্তত অর্ধেক তো আমার হকের মাল,’ ফুল্লরা তর্ক জোড়েন।

‘কিন্তু শনি তো ভাগ হয় না। শনি অখণ্ডমণ্ডলাকার, অপিচ অখণ্ডনীয়। পৃথিবী ভাগ হয়, আমেরিকা যেমন করেছে, জাতিসঙ্ঘ ও বিজাতিসঙ্ঘে,

যাদের ব্র্যান্ড নেম যথাক্রমে WHO ও CIA; মঙ্গল গ্রহও ভাগ হ’ব-হ’ব করছে, নাসা এবং বাসায়।’

‘বাসা?’

‘বা”-টা বাংলাদেশের জন্যে,’ কালকেতু জানান।

‘তুমি যদি ভাগ করো পৃথিবীকে, কোন ভাগটা দেবে আমাকে?” ফুল্লরা পুনশ্চ ইনকয়ার করেন।

“তোমাকে দেব জলভাগ,’ বলেন কালকেতু।

‘আমার গভীরে লুকানো থাকবে অ্যাটলান্টিস!’

‘আর আমি তার খোঁজে যাব মেরি সেলেস্ট জাহাজে,’ কালকেতু বলেন। ‘কিন্তু —’ ফুল্লরা আবার ——’ভ্যান গখ হ’লে কী কেটে দিতে তুমি আমায়?’ কালকেতু এবার প্রকৃতপক্ষেই দেহের অংশবিশেষ চুলকে উতোর করেন, ‘আমি নিজে কিছুই কাটতে পারব না, জৈন ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে। তবে, তুমি যা-খুশি কেটে নিতে পারো।

‘তথাস্তু,’ বলেন ফুল্লরা আনমনে।

এ-সময়, একটা খোলামতো জায়গায়, সম্মিলিত সাধুবাহিনীকে, একটা বৃত্তে গোল হ’য়ে দণ্ডায়মান, সাধনোত্থিত দেখা যায়। তাঁদের মন্ত্রের সুরটি নবম সিম্ফনির। কথাগুলো——সম্ভবতঃ—তোখারিয়। ফুল্লরা একটা সামারসল্ট দিয়ে সাধব্যুহের ঠিক মাঝখানে ল্যান্ড করেন। কালকেতুও পোল-ভল্ট ক’রে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তবে, বানজি-জাম্পের সময়ে যেমন তাঁর পায়ে ছিল না দড়ি, এবার তেমনি হাতে ছিল না নড়ি।

প্রধান সাধুগণ অতঃপর আত্মপরিচয় দেন :
উদাস বাকাবিল্লাহ ও কেবলা ফানাফিল্লাহ (এঁরা দু’জন সিয়ামিজ যমজ);
সাবদার সিদ্দিকি (ইনি অদৃশ্য—তিরস্করণী-বলে);
ভগবান্ রজনীশ (ইনিও অদৃশ্য, দেহ পুড়ে যাওয়ায়);
এবং সন্ত টমাস অ্যাকুইনাস (ইনি মৃতদেহে);
এবং তাঁরা বলেন, যে, তাঁরা প্ল্যানচেট করছিলেন।

ফুল্লরা বলেন, ‘আপনাদের সাধনায় ব্যাঘাত ঘটালাম, দুঃখিত।’

‘না না, ঠিকাছে ঠিকাছে—তাছাড়া রমণীর সাতশ’ খুন মাফ, ‘ বাকাবিল্লাহ এবং ফানাফিল্লাহ যৌথ বলেন।

অনুমতি-প্রার্থনান্তে কালকেতু বলেন, ‘বুজুর্গ হুজুরগণ, আপনারা এখনও প্ল্যানচেটে প’ড়ে আছেন? আশ্চর্য! পৃথিবী কোথায় এগিয়ে গেছে…’

‘এগিয়ে কোথায় গেছে?’ সিদ্দিকি শুধান। তারপর ঘাবড়ে দিয়ে চেঁচান—’ওরে মূঢ়! ওরে মাছি! ওরে ধূলিকণা! ওরে গোরুর চোনা! ওরে নাথিং-বাট-ডান্সিং-ফোটন্‌জ! পৃথিবী কোথাও যায় নাই। এই দ্যাখ, ব্লাডি বাগার, এই-যে পৃথিবী!’—বলে তিনি তাঁর নাক দেখান।

কালকেতু নাক দেখেন, খুঁটিয়েই দেখতে চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পান না, অনুমানে বলেন, ‘সম্ভবতঃ নাকই দেখাতে চাচ্ছেন আপনার, না?’

‘ইয়েস, রাস্কল, মাই নোজ! লুক অ্যাট ইট, লুক!’

তারপর, সিদ্দিকি আবার ডিমান্ড করেন, ‘টেল মি হোয়াট য়্যু থিংক থিংক!’[২২]

কালকেতু অস্থির হ’য়ে বলেন, ‘মানে কী এর, আই মিন, আপনার নাকের?’

‘কোনও মানে নাই। নাই কোনও টীকা, ব্যাখ্যা, ভাষ্য, মর্মার্থ, ভাবসম্প্রসারণ, ইন্টারপ্রেটেশন, রিডিং। কিন্তু নাক আছেন। বিশ্বের বিস্ময়। এই নাকে আমি আছি। নাক আমাতে আছেন…’

ফুল্লরা কিন্তু প্ল্যানচেটে উৎসাহী হ’ন, বলেন, ‘কাকে ডাকছেন এবার? ইমরান খানকে ডাকুন না!’

রজনীশজি বলেন, ‘কিন্তু, মাতঃ, তিনি তো বেঁচে আছেন।’

‘সে তো এক বুড়ো ইমরান বেঁচে আছে। আমি আনতে বলছি তরুণ, ধরুন পঁচিশ-টচিশের ইমরানকে। মঈন চৌধুরীর প্যারাডাইম-তত্ত্ব সঠিক হ’লে, সেই ইমরান এবং এই ইমরান নিশ্চয়ই ভিন্ন দুই ব্যক্তি। তাছাড়া এ-দু’য়ের মধ্যে, এবং আগে-পরেও, আরও ক’এক কোটি ইমরান থাকবার কথা। কাজেই, একটা নাম্বার ফেল করলেও, আরও মেলাগুলি হাতে থাকবে, ‘ ফুল্লরা কথা থামিয়ে হাঁফান।

কালকেতু বলেন, ‘আমার বুকের ‘পরে ফের অযুত মস্তক শুয়ে ঠায়।” সাবদার সিদ্দিকি বলেন, “এই যে, তোমরা বেশি-বেশি ফাজলামি করলে তোমাদের আমি মূষিক বানিয়ে দেব!’ তারপর মন্ত্রপাঠ :

‘কা কা ঠ ও আ তো রা
ঠ ঠু বৃ মি মা খা
ঠো রি ক্ষ আ র ল
ক য়া তু ছি শা ভু
রা কে মি তো খা লা
কি উ ব মা য় নি
ং নে ড় র ছা য়া
বা ই হ কা য়া পা
– – ও ছা য় খি’[২৩]
– – – কা আ –
– – – ছি মি
– – – – এ
– – – – ক

সমবেত সাধুবৃন্দ কালকেতু-ফুল্লরাকে ঘিরে তুর্কি-নাচ শুরু করেন তারপর। তাঁদের বৃত্তটি ক্ষণে পুষ্প ক্ষণে তারকা ক্ষণে পেন্টাগণ ক্ষণে অক্টাগণ- ইত্যাদি নানাকার ধারণ করতে থাকে, এবং সেনাপতি হাসানুল বান্নার আরেকটি বাণী কালকেতুর স্মরণাগত হয় :

‘ডিয়ার প্রফেট, তুমি কি সত্যই বলিতে পারো,
যে মানুষ পাপ করিতে সক্ষম?’

প্রফেট বলতে অবশ্য কহলিল জিব্রানকেই মিন করেছিলেন তিনি।

নৃত্য-অন্তে সভাস্থলে সমাধির নীরবতা নামে। ফুল্লরার মুখই প্রথম খোলে,—হাজার হোক রমণীর মুখ—রমণীয় মুখ—তিনি এবার সন্ত অ্যাকুইনাসকে নিয়ে পড়েন, বলেন—’ইয়োর হোলিনেস, আপনার ব্যাপারটি কী বলুন তো? আপনার মাটির উপরে উঠবার দরকারটা কী ছিল? আর উঠলেও, মণখানেক ল্যাভেন্ডারের তেল, বা ও দ্য কোলন তো মেখে আসতে পারতেন অন্তত। আপনার গায়ের গন্ধে তো এখানকার সব ভূতও পালিয়ে গেছে। এখন প্ল্যানচেটে বরং তাদেরকেই ফিরিয়ে আনা দরকার…’

কালকেতু (ফুল্লরার) কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘এসেন্স-ফেসেন্সে কাজ হবে না। দরকার ক্যাস্টর অয়েল, বিষস্য বিষমৌষধম্।’

সন্ত টমাসের মৃতদেহের ওষ্ঠাধর খানিক সম্প্রসারিত হয়। হাসেনই বোধ হয় একটু তিনি। তারপর বলেন, ‘পৃথিবীতে মৃত আত্মা নিয়ে এত জীবিত-দেহ যদি চ’লে বেড়াতে পারে, তাহলে জীবিত-আত্মার একজন, মৃত দেহ নিয়ে ঘুরতে কেন পারবে না?’

ফুল্লরা বলেন, ‘আপনি কি ভ্যাম্পায়ার? আপনি কী খান?”

‘যিশুর দেহ ও রক্ত।’ সন্ত, একটু থেমে, আবার বলেন, ‘দাঁতগুলি সব খসে পড়ায়, দেহ আর খেতে পারি না অবশ্য এখন।’ একটু কাঁদেন যেন, বলেন, ‘শুধু রক্ত খেতে যা খারাপ লাগে না! নিজেকে ড্রাকুলা মনে হয়। হায়! আমি টমাস অ্যাকুইনাস, পয়োরোপের জ্ঞানীতম, ধার্মিকতম, শুদ্ধতম মৌলিক পদার্থ—আমারই প্রতি এই অন্যায়—সদাপ্রভু!—আমারই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হ’ল একটা মৃতদেহ, অনন্তকালের জন্য—অ্যাজ টু আ ডগজ টেইল! হোয়াট শ্যাল আই ডু উইথ দিস অ্যাবসার্ডিটি… দিস ক্যারিকেচার? কেন আমি তাহলে হিন্দু হ’য়ে জন্মালাম না——অন্তত নিজের মৃতদেহের হাত থেকে তো বাঁচতাম তাহলে, রজনীশজি যেমন বেঁচেছেন? নিজের মড়া কাঁধে ক’রে ঘুরে বেড়ানো—হা সদাপ্রভু! হা সদাপ্রভু!’

‘সদাপ্রভু সদাপ্রভু বলবেন না তো,’ ফুল্লরা অনুযোগ করেন, ‘য়িহুদি- য়িহুদি লাগে। বরং জীবনদেবতা বলতে পারেন। অবশ্য,’ মত পাল্টান তিনি, ‘আপনার ক্ষেত্রে আরও অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে মরণদেবতা, বা জীবন-মরণ- দেবতা, জীবনৃতের দেবতা, গড অব ডেথ-ইন-লাইফ অর লাইফ-ইন-ডেথ- তাম্মুজ, বা অ্যাডনিস, বা ওসিরিস, বা—’

কালকেতু ইন্টারাপ্ট করেন, (অ্যাকুইনাসকে) বলেন, ‘আপনি তো সমকামী ছিলেন, সেই দোষেই মনে হয়…’

‘আমি সমকামী ছিলাম!’ ভীষণ রেগে ওঠেন সন্ত। রাগের চোটে তাঁর ব্রহ্মতালুর ঠিক মাঝখানের ক’এক ইঞ্চি খুলি উড়ে চ’লে যায়।

পরে বহু-কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আই ওঅজ বিইং ইউজড়, বিইং অ্যাবইউজড! দেখতে সুন্দর ছিলাম, এই ছিল আমার দোষ।’

‘আপনি দেখতে সত্যিই ভালো,’ ফুল্লরা বলেন, ‘ওরকম গন্ধ গায়ে না থাকলে আপনাকে একটা চুমুই খেতাম।’

চুম্বনের প্রসঙ্গে সাধুসভায় সকলেরই মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায়। কে আগে—এই নিয়ে একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধের উপক্রম হয়; এমনকি উদাস এবং কেবলার জোড়া-দেহও আত্মঘাতী হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। তাঁরা মেরেও চিৎকার করেন, মার খেয়েও। এবংপ্রকার হুলাহুলি-চুলাচুলির ফাঁকে অ-সাধু দু’জন ঊর্ধ্বশ্বাসে ধর্মবনানী থেকে নিষ্ক্রান্ত হ’ন।

৬.

‘O Mystica! O Drastica! O Swastika!
Cut open my throat,
I’m Thy holy goat-
Come hither! Come hither! Come hither!’

কালকেতু বলেন, পুরানো ঢাকা স্টেডিয়াম, বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল কনসার্ট কলোসিয়াম-এর উল্টো দিক থেকে সদ্যোবিনির্মিত মুভিং পাথওয়ে- তে সওয়ার হতে-হতে, ফুল্লরাকে।

ফুল্লরা ওতরান :

‘And I have rehearsed all these years
And rehearse I shall
With the rest of my tears,
I shall and I will secure from thee
My immortalitie
And all?

পুরাতন নিউ এয়ারপোর্ট রোড, ওরফে কুইন এলিজাবেথ রোড— যার বর্তমান নাম উজুবাট, তারই দুই-তলা উঁচু দিয়ে তাঁরা চলতে থাকেন। পাথওয়ের চলন্ত মেঝে-র গতিবেগ, মানুষের স্বাভাবিক হণ্টন-বেগের সমান- প্রকৌশলী-কুলতিলক সুরজিৎ দত্ত-র ইথরিয় অবদান।

কোরিয়ান বাজার (প্রাক্তন কাওরান বা কারওয়ান বাজার) এলাকার কাছাকাছি আসতে দেখা যায়, জনৈক ভদ্রলোক, মধ্যবয়স্ক, মাথার চুল পাতলা, জুলফি ও গোঁফ পাকা-কাঁচা, চোখে তামার তারে সেলাই-করা চশমা, ধূসরিম পাম্পশু পায়ে, তেলচিটে কোট গায়ে—যার রঙ কী ছিল বা আছে, কোনওটিই স্পষ্ট নয়, দাঁড়িয়ে আছেন পাথওয়ের মাঝখানে; অবশ্য আসলে উল্টো দিকে হেঁটে আসছেন, কিন্তু তাঁর চলার, এবং পাথওয়ের গতি সমান হওয়ায়, তিনি আগেও বাড়ছেন না, পিছেও হঠছেন না—তাঁর পা-দু’টি চলছে, একই গতিতে, অক্লান্ত, যেন অনন্তকাল যাবৎ, কিন্তু তিনি চলছেন না।

‘পুরগাতোরিও-তে দৃশ্যটা ঢোকাতেই হবে,’ বিস্ফারিতনেত্র কালকেতু বলেন—’উমবের্তো একোকে খবর দিলে তিনি সানন্দেই তা করবেন। কাজটা নিরাপত্ত, কেননা ইতালিয়ানদের মধ্যে তিনিই একমাত্র দান্তে-পড়া লোক, বাঙালিদের মধ্যে যেমন অসীমকুমার দাস। দাসবাবুকেও বলা যেত, কিন্তু শোনা যায় তিনি গত চল্লিশ বৎসর যাবৎ মৌনব্রত ও “নির্জন” পালন করছেন।’

ফুল্লরা বলেন, ‘একটু খুঁটিয়ে দ্যাখো তো, এই ভদ্রলোকই অসীম কিনা।’

বলতে বলতে তাঁরা কায়দা ক’রে দু’দিক দিয়ে ভদ্রলোককে পাশ কাটিয়ে যান। ভদ্রলোকের সামান্য তালভঙ্গ হয়, প্রায় সাড়ে-তিন হাত পিছিয়ে আসেন তিনি, তারপর আবার শুরু করেন।

ফুল্লরা বলেন, ‘মহাকালের পথে ভদ্রলোককে সাড়ে তিন হাত পিছিয়ে দিলাম আমরা, অনন্তকালের জন্য।’

ইন্দিরা নদীর পাড়ে তাঁরা অবতরণ করেন। চলন্ত পাথওয়ের থেকে নামতে গিয়ে ছোট্ট একটা লাফ ফুল্লরা দেন। তাই-না দেখে কালকেতু মন্তব্য করেন, ‘ওয়ান স্মল জাম্প ফর আ উয়োম্যান, ওয়ান জায়ান্ট লিপ ফর ম্যানকাইন্ড!’

ঐতিহ্যবাহী ফার্মগেট। স্থানটির নাম-মাহাত্ম্য সপ্রমাণ করতে, অত্র একটি কোয়েলের ফার্ম-হাউস সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে। ফার্মগেট ব্রিজে নদী পেরোতেই, তাঁরা চ’লে আসেন প্রাগৈতিহাসিক মণিপুরী পাড়ায়। নামে জানা যায়, যে, প্রাগিতিহাসের কোনও একটি বিন্দুতে, অর্থাৎ একদা, এখানে অধুনা- বিলুপ্ত মণিপুরী জাতির লোকজন বসবাস করত। তাদের আচার-ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে যা জানা গেছে অধ্যাপক সুমনাতির নামুম-এর গবেষণায়, তা যেমন রোমহর্ষক, তেমনই কৌতূহলোদ্দীপক। অধ্যাপক নামুম এমনকি এমন তথ্যও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, যে, মণিপুরীরা—বিলিভ ইট অর নট—ভাত খেত!

.

এহেন মণিপুরী পাড়ার প্রধান রাস্তা দিয়ে ফার্লং-খানেক এগুতেই দেখা যায়, রাস্তাটি, ইম্ফল সরণি, আসলে কানারাস্তা; রাস্তার পথ রোধ ক’রে দাঁড়িয়ে- দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে একটি গণশৌচাগার।

তাঁরা অগত্যা প্রবেশ করেন। এবং উল্টো দিকের দরোজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে হাফলং মার্গ ধ’রে ঈশান—বা অগ্নি কোণ বরাবর কিছুক্ষণ চলেন। তারপর মুহুর্মুহু বায়ু, নৈঋত এমনকি ঊর্ধ্ব ও অধঃ (অর্থাৎ ফ্লাই-ওভার এবং সাব-ওয়ে) কোণে দিক বদল করতে-করতে এসে পড়েন খেজুরবাগান রোডজ (বহুবচনটা প্রশস্তিমূলক), পৃথিবীর একমাত্র রাস্তা, যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সমান। মানুষ হ’লে বলা যেত—অল স্কোয়ার। এই রাস্তাটিতে (বা রাস্তাগুলিতে ফি-সন মার্দি গ্রা প্যারেড হ’য়ে থাকে। তখনকার সেই নারকীয় সৌন্দর্য এবে অনুপস্থিত। ‘রোডজ’-এর একপাশ জুড়ে, আকাশের একটা বেশ বড়, বহুভুজ ফালিকে মসীলিপ্ত ক’রে দণ্ডায়মান কেন্দ্রীয় সংসদ ভবন—মিনোসের ল্যাবিরিন্থ, সেন্ট পিটারস চার্চ, উইন্টার প্যালেস, ভার্সাই প্রাসাদ, তাজমহল এবং পেন্টাগনের পর পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যয়বহুল অট্টালিকা।

বীরবলেন্দু গুণের আমলে যে-সকল অভূতপূর্ব পরিবর্তন প্রশাসনে আসে, তার প্রধানতম—সংসদ উৎকেন্দ্রীকরণ। তিনি এতদ্দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, ব্যবসায়িক, সাহিত্যিক ইত্যাদি মত, মতবাদ, বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের উপর ভিত্তি ক’রে, মোট তিনশ’-পঁয়ষট্টিটি আলাদা-আলাদা সংসদের প্রতিষ্ঠা করেন, যথা :

জাতীয়তাবাদী সংসদ

সাম্যবাদী সংসদ

নারীবাদী সংসদ

অস্তিত্ববাদী সংসদ

মৌলবাদী সংসদ (হিংস্র ও অহিংস)

ভাববাদী সংসদ

থেরবাদী সংসদ

আবাদী সংসদ (যাবতীয় আবাদের সঙ্গে জড়িত জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত)

বিবাদী সংসদ

সুবিধাবাদী সংসদ

বিসংবাদী সংসদ

সায়েদাবাদী সংসদ

কাঠামোবাদী সংসদ

উত্তরকাঠামোবাদী সংসদ

উত্তরোত্তরকাঠামোবাদী সংসদ

উত্তরাধুনিকতাবাদী সংসদ

ইত্যাদি। প্রত্যেকটি সংসদকে পর্যায়ক্রমে একদিন ক’রে রাষ্ট্র- পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়। মাত্র একদিন-মেয়াদি হওয়ার কারণে, জাতীয় সংসদের লৌকিক-মৌখিক নাম হয় ‘কচি সংসদ’। এতদ্ব্যতীত, রাষ্ট্র- পরিচালনা-যে কঠিন কাজ, তার প্রতীকী ধারণা দেওয়ার জন্য প্রেজিডেন্ট গুণ সংসদ ভবনের সামনের সিঁড়িগুলো সব ভেঙে ফেলেন এবং সাংসদদেরকে দড়ি বেয়ে ভবনে ঢুকতে বাধ্য করেন। ফলে রোজই গড়ে দশ-বারোজন সাংসদ শহিদ হ’ন। ভবনের পিছনের সিঁড়িটিকে অবশ্য নিজস্ব প্রয়োজনে রেহাই দেন গুণ।

এই সকল কারণে, গুণ-রাষ্ট্রপতিত্বে, দেশ পাকাপোক্তভাবে প্রবেশ ক’রে, দ্য স্পেক্টর-এর ভাষায়, ‘ইন আ স্টেট অব পারপেচুয়াল ইলেকশন’। ফলতঃ বাংলাদেশের প্রতিটি চা-পানের দোকান, সকল সালঁ, বার, পাব, ক্লাব, নাইট-ক্লাব, সর্বপ্রকার সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, ও বেসরকারি অফিস-আদালতে (এ-প্রসঙ্গে উলেখ করতে হয়, যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এখন একটি বহুজাতিক সংস্থা, ম্যাকডনাল্ডজ বাংলাদেশ- এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হ’য়ে, বঙ্গেতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে), সকল মসজিদ-মন্দির-গির্জা-গুরুদ্বার- সিনাগগ-জিগুরাত-বুৎকাদা-প্যাগোডায়, টিনের দান-বাকশের স্থলে এখন ব্যালট-বাকশো দেখা যায়। তাছাড়া জনগণ চাইলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব- এর মাধ্যমে ঘরে, অফিসে, বা টয়লেটে বসেও ভোট দান করতে পারে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধান কর্তা-ব্যক্তি জনাব ফরিদ আহমেদ আশা প্রকাশ করেছেন, যে, আগামী সাত বৎসরের মধ্যেই এই কমিশন একাই দেশের বেকার সমস্যা দূর করতে সম্পূর্ণ সক্ষম হবে—বাংলার ঘরে-ঘরে একজন ক’রে নির্বাচন-সহকারী নিয়োগের মাধ্যমে।

অপরদিকে, নির্বাচন-প্রচারণা নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে, ভোটাররা (এখন ভোট-দানের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ করা হয় বয়ঃসন্ধিক্ষণে; প্ৰতি-মাসে একবার ক’রে দেশের যাবতীয় দশ থেকে ষোলো বছরের বালক-বালিকার দেহ পরীক্ষা করা হয়) টিভিতে প্রার্থী-প্রার্থিনীদের ছবি, নাম, ও শারীরিক বিবরণ দেখে ভোট দিয়ে থাকে। এর একটি সুফল এই ফলে যে, কেবলমাত্র সুদর্শন ক্যান্ডিডেটগণই সাংসদ নির্বাচিত হ’ন। বস্তুতঃ প্রথম মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ তথা মহিলা প্রেজিডেন্ট, লাটোয়া জ্যাকসন, বাংলাদেশে সরকারি সফরে এসে এমপিদের দেখে অবাক্ হ’য়ে যান এবং বিনা-কারণে (বা সেই কারণেই সফরের সময়সূচি বাড়িয়ে-বাড়িয়ে প্রায় বৎসরাধিককাল বাংলাদেশে বসবাস করেন। এ-সময় তাঁর প্রথম শ্যামলাঙ্গ সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয়।

অবশ্য, এতসব-সত্ত্বেও, সাংসদ পদের জন্যে প্রার্থীর সঙ্খ্যা দিনকেদিন কমতে শুরু ক’রে। কেননা, মৃত্যুভয়ের কাছে বলতেকি লাটোয়া-ফাটোয়া কিছুই না। সম্প্রতি ফরিদ আহমেদ সাহেব তাই যাবজ্জীবন বা দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাবার সুপারিশ করেছেন ব’লে বাসস জানিয়েছে।

রাষ্ট্র-পরিচালনা-কার্য আরও মসৃণ করার লক্ষ্যে গুণ ক’একটি অতিরিক্ত মন্ত্রণালয়েরও জন্ম দেন, যার মধ্যে সর্বাধিক উলেখযোগ্য : মিনিস্ট্রি অব আর্টস অ্যান্ড লিটারেচার, এবং মিনিস্ট্রি অব লাভ সেক্রেড অ্যান্ড প্রফেন। প্রথমোক্ত মন্ত্রণালয়ে, আভাঁ-গার্দ প্রতিমন্ত্রী পদে বিতর্কিত ও বিতার্কিক চরিত্র, অধ্যাপক আশ্রাফ হোসেনকে নিয়োগ করা হ’লে, গাণ্ডীব (একমাত্র) লিটল- ম্যাগ গোষ্ঠী, তীব্র ধিক্কার ও ন্যক্কারে ফেটে প’ড়ে। মন্ত্রীর আশু অপসারণের দাবিতে তাঁরা এমনকি তিন ঘণ্টার প্রতীকী অনশনের হুমকি দিয়ে স্মারকলিপি পাঠান প্রেজিডেন্টের পাগলা কার্যালয়ে। প্রেজিডেন্ট পাল্টা-বিবৃতিতে বলেন, যে, একজন মন্ত্রীর অপসারণের জন্য অন্ততঃ তেত্রিশ ঘণ্টার অনশন আবশ্যিক। পরে, জোর দর-কষাকষির পর, অনশনের সময়সীমা তেরো-ঘণ্টায় নির্দিষ্ট হয়। কিন্তু (অনশনের) বারো-ঘণ্টার মাথায়, গাণ্ডীব গোষ্ঠীর অন্যতম পাণ্ডব, কবি ও সুগায়ক শোয়েব শাদাব, কোনওরূপ উস্কানি-ছাড়াই তাঁর পাণ্ডব ভ্রাতা, কবি ও তবলিয়া শান্তনু চৌধুরীর নাকে ঘুসি মারেন এবং বলা বাহুল্য। শেষে ডাক্তার ও গল্পকার মামুন হুসাইন, এবং কেমিস্ট ও গল্পকার সেলিম মোরশেদের পরামর্শে, অনশন-সময় বারো-ঘণ্টা ঊনষাট-মিনিটে, গাণ্ডীব গোষ্ঠী অনশন ভঙ্গ করেন, এবং অধ্যাপক হোসেনের মন্ত্রিত্বের উপর থেকে রাহুর ছায়া সরে যায়।

এরপর মুখ খোলেন মন্ত্রী স্বয়ং। স্বসম্পাদিত ত্রয়োবিংশ পত্রিকায় ‘শাভাকের বিটেলেরা’ নামে একখানি ল্যাম্পুন তিনি রচেন। পরে অশ্লীলতার দায়ে, এবং মন্ত্রিত্বের সুবাদে, তিনি নিজেই কবিতাটিকে ব্যান করলে-পর দেশে এবং পশ্চিমে ধন্য ধন্য প’ড়ে যায়। একই পত্রিকায় জনৈক রাশেদ সোলেমান মন্তব্য করেন, যে, এমন বিরাট আত্মত্যাগ দাতা কর্ণ, হযরত ইব্রাহিম (আঃ), এবং বিষাদসিন্ধু রমণ্যাসের আজর-এর পরে আর দেখা যায় নাই। এহেন মহান মন্তব্যের সূত্রে, ‘মাগন ঠাকুর পুরস্কার’ লাভ করেন তিনি, অর্থাৎ রাশেদ সোলেমান। তবে জানা যায়, যে, উক্ত লেখক সভায় উপস্থিত হ’তে না-পারায়, স্বয়ং মন্ত্রী মহোদয়, পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে, লেখকের তরফে পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।

(রাশেদ সোলেমানের প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এবং এতদিনকার গণসন্দেহ, যে, তিনি আসলে অধ্যাপক হোসেনেরই দ্বিতীয় সত্তা, ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাতে অবশ্য অধ্যাপক হোসেনের সুনাম বৃদ্ধি পায় নাই। মন্ত্রী মহোদয়ের বহু রচনার পিতৃত্ব বরং এখন সোলেমানে অসেছে। অনেকেই সেইসকল বিতর্কিত রচনাকে আশ্রাফ-সোলেমানি রচনা ব’লে উপহাস্য করছেন। বর্তমান রচয়িতার অবশ্য এ-বাবদে কোনও ‘সে’ নাই। তিনি ঘটনার বিবরণ-মাত্র দিচ্ছেন। এমনিতে তাঁর হোসেন বা সোলেমান কারুর রচনার সাথেই তাদৃক্ পরিচয় নাই।—তাজুল হক অবশ্য সম্প্রতি আমাকে মন্ত্রী মহোদয়ের একটা বই পড়তে দিয়েছেন, ‘ক্বাসিদা’ নাকি কী যেন, আরবি, ভাষা জানা না-থাকার কারণে তা পড়া অবশ্য সম্ভব হয় নাই।)

৭.

গনগনে চাঁদের আলোয় দাউ দাউ জ্বলছে খেজুরবাগান রোডজ। আমাদের নায়ক-নায়িকা তাতে পুড়তে পুড়তে গলতে-গলতে এগিয়ে চলেন। বাতাসের ঝাপটায়-ঝাপটায় শোনা যায় অসঙ্খ্য অশরীরী প্রেমালাপ, ব্যর্থ প্রেমালাপ, শ্লীল এবং অশ্লীল অভিযোগ, আর লক্ষকোটি রিকশার ক্রিংকার। এ-সবের মাঝখানে হঠাৎ উদ্ধত হয় এক সংশপ্তক কণ্ঠস্বর—চাঁদনির একটা ঢেউ সরে যেতে, দেখা যায়, বিশ্বামিত্র ঋষির মতো দেখতে একজন, হাতে ঝঙ্কৃত ম্যান্ডোলিন, কণ্ঠে মৌলানা ক্যাট স্টিভেনজ-এর :

‘I’m being followed by a moon shadow
moon shadow moon shadow
(I’m) leaping and hopping on a moon shadow
moon shadow moon shadow’[২৫]

চাঁদের আলোয় গায়কের চুলদাড়ির ডগাগুলি নীহারকণা-ঝিকমিক জ্বলে, আর তার চোখ-দু’টিতে খুব স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়, আকাশ- জোড়া চাঁদের উন্মাদনার প্রেক্ষাপটে কত-না উদ্ভ্রান্ত সোনালি রুপালি মেঘের সন্ত্রস্ত ছোটাছুটি। চাঁদের হাত থেকে আজ নিস্তার নাই নিস্তার নাই…

‘If I ever lose my eyes
if my colours all run dry
oh if I ever lose my eyes
I won’t have to cry no more’

ফুল্লরা আবার কাঁদতে শুরু করেন, কিন্তু এবার নীরবে। দীর্ঘশ্বাসে ভারি, বাতাসের ফোকরে-ফোকরে তাঁর পারদাশ্রু গলে-গলে প’ড়ে :

‘If I ever lose my mouth
(and) all my teeth north and south,
yes if I ever lose my mouth
I won’t have to talk no more :

হাত-ধরা অবস্থাতেই দু’জনে গায়ককে পেরিয়ে যান, তার ভিতর দিয়েই তাঁরা বেরিয়ে যান—যেন সে হয় এক আলোর শরীর,—অশরীরী এবং শরীরী। তাঁরা শোনেন :

‘Did it take long to find me?
I ask the faithful light.
oh, did it take long to find me.
and are you gonna’ stay the night?’

দু’জনে চলছেন, চলছেন—সহসা ফুল্লরা দু’হাত দু’দিকে মেলে দেন, আর তারপর, তারপর তিনি নেচে ওঠেন। তাঁর অঙ্গে-অঙ্গে, কত শত- শত শতাব্দীর নিরন্তরচর্চার চাঁচর চড়ায় এসে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে কত্থক। ওস্তাদ আল্লারাখার বোলগুলি পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায় : ধি ধা ক্রেত্তা ধিন্ ধিন্ ধা, ধাগে ক্রেতা ধিন্ ধিন্ ধা, তাক্ ধিন্ তাক্ ধিন্… কিছুক্ষণের জন্যে ফুল্লরাকে হারিয়ে ফেলেন কালকেতু, প্রকৃতি তাঁকে (ফুল্লরাকে) বেলমোক্তা কবল ক’রে নেয়। তাঁর (কালকেতুর) হাত-পা বেঁধে তাঁরই চোখের সামনে যেন ধর্ষণ করা হচ্ছে তাঁর প্রেমিকাকে—এমতো বোধ করেন। কিংবা তারও চেয়ে খারাপ বোধ তিনি করেন, কেননা, ফুল্লরা ঠিক ধর্ষিত হচ্ছেন এমন বলা যায় না। ঈর্ষা বোধ করেন কালকেতু, অসহায় বোধ করেন। তিনি সন্ত্রস্ত হ’ন। শশব্যস্ত হ’ন। পরাস্ত হ’ন। অবশেষে নিজের কাছেই যান হারিয়ে। অস্বচ্ছ হ’য়ে পড়েন। আপন গোলকধাঁধায় পথ হারান। ফুল্লরাকে, ফুল্লরা কে, এমনকি, মনে থাকে না আর। সংসদ ভবনের কংক্রিট বেয়ে নামে রাতুল রক্তের ধারা, দরবিগলিত। তাঁকে (কালকেতুকে) ভাসায়, ডোবায়। সেই লালিমায় কলঙ্কিত হয় এমনকি ও-চাঁদের চাঁদোয়া—কোনও ভূয়সী ভামিনীর স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো।

‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছো?২৬’–চূড়ান্ত মুহূর্তে, বা তার ঠিক আগে, ফুল্লরা শুধান। আর ফুল্লরা হাসেন আর হাসেন আর হাসেন—’কালকেতু! মাই লাভ! মাই লাভ! মাই উত্তীয়! য়্যু আর গুড! য়্যু আর ফানি! য়্যু আর দ্য বেস্ট! দ্য ফানিয়েস্ট!

কালকেতু কিশোর-কিশোর লজ্জিত অধোমুখ হ’ন। ফুল্লরা সোহাগ করেন তাঁকে, বলেন, ‘ও আমার সোনা, আমার ময়নাপাখি!’ এবং তাঁর থুতনি টিপে দেন। তাঁর চুলের ভিতরে আঙুল বোলান। কানে নাক ঘষেন। নাকে কান। তারপর, চোখের দিকে সাঁড়াশির মতো দু’টো আঙুল বাড়িয়ে দিলে, কালকেতু সভয়ে চোখ বন্ধ করেন।

‘এটা মিথ্যামিথ্যি বলেই ভয় পাচ্ছো— সত্যিসত্যি হ’লে পাবে না।’ কিছুক্ষণ পর ফুল্লরা আবার বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার চোখ তোমার বেশি প্রিয়, না আমি?”

‘তোমার চোখ,’ কালকেতু বলেন।

‘কেননা?’

‘কেননা তোমার চোখ আমাকে দেখে,’ কালকেতু বলেন।

‘এই নার্সিসিজমই তোমাকে মারবে,’ ফুল্লরা বলেন।

‘তোমাকেও,’ বলেন কালকেতু।

৮.

সংসদ ভবনের পিছনে চলেন আসেন তাঁরা তারপর। ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে এসে বসেন…

(তাজুল হক, তথ্য-বিষঙ্গতির কারণে, গোটা পরিচ্ছেদটিকে উচ্ছেদ করতে যাচ্ছিলেন হেথায়। আমি প্রায় সাত-ঘণ্টার আলোচনায় তাঁকে শেষে সমঝাতে সমর্থ হই যে—তা নয়। তিনি গোটা-পঁচিশেক টেলিফোন কল- শেষে, কায়ক্লেশে কাঁচি-সংবরণ করেন, তবে আটাশির মহাপ্লাবন, এবং তৎপরবর্তী কালে ঢাকার বিভিন্ন স্থানাস্থানের নাম-পরিবর্তন-বিষয়ে একটি ফুটনোট সংযোজনের আদেশ দেন, বিশেষতঃ আগামী প্রজন্ম-সকলের জ্ঞাতার্থে। কাজেই একটি নোট নীচে অন্বিত হ’ল। অবশ্য ফুটনোট, বা অক্সফোর্ড রেফারেন্সিং সিস্টেম, দু’শ’ বৎসর পূর্বে অচলিত হওয়ায়, এখানে তক্ষশিলা সিস্টেম ব্যবহৃত হচ্ছে।)

এই গল্পে ক্রিসেন্ট লেক যাকে বলা হচ্ছে, সেটি বর্তমান ধোলাই খাল। ইনফর্মেশন সুপার হাইওয়ের বরাতে জানা যায়, যে, মধ্যযুগে এই খালটির নাম ছিল ক্রিসেন্ট লেক, এবং এটি ছিল ঢাকার দ্বিতীয় মনুষ্য-কর্তিত ঝিল (প্রথমটি ছিল রমণায়, যা পরে জর্ডান নদীতে রূপান্তরিত হয়— গল্পের সামনের দিকে দ্রষ্টব্য)। মহাপ্লাবনের পর ক্রিসেন্ট লেক (সে-সময় যার নাম ছিল দালির নালা—শিল্পী সালভাদর দালির, বা তাঁর গোঁফের, সম্মানে), ঢাকার উত্তর-পূর্বস্থ কিশোরীগঙ্গা নদীর সঙ্গে যুক্ত হ’য়ে খাল-রূপ ধারণ করলে, তৎকালীন প্রেজিডেন্ট কুদ্বুদ্দিন আইবক প্রথমে এর নাম রাখেন দালাই খাল। কিন্তু মায়াকানন বৌদ্ধবিহার এতে আপত্তি জানিয়ে ব’লে, যে, এই নাম, দালাই লামাকে অপমান করবার একটা হীন চক্রান্ত। আইবক তখন নামটিকে এডিট ক’রে তাকে ধোলাই খাল করেন। তখন আবার আবিষ্কৃত হয়, যে, ঐ নামে একটি খাল স্মরণাতীত কাল থেকে শহর ঢাকায় বহমান যা কিনা অবশ্য ততদিনে একটি নদীর আকার ধারণ করেছে, এবং বেগুনবাড়ি নদীর সঙ্গে মিলিত হ’য়ে শহরের পূর্ব ও পশ্চিম ভাগের সীমান্ত নির্দেশ করছে। প্রত্যুৎপন্নমতি কুদ্বুদ্দিন, প্রাক্তন ধোলাই খালের নাম বদলে করেন ধলেশ্বরী নদী। কিন্তু, ছিদ্রান্বেষী, নিদ্রাপহারী, সরকারি জরিপ বিভাগ তখন জানায়, যে, ঐ নামে (ধলেশ্বরী, দ্যাট ইজ) একটি নদী ঢাকার কাছে বয়ে চলেছে। কুদ্বুদ্দিন দমবার পাত্র নন, তিনি পত্রপাঠ নদীটির (ধলেশ্বরী, দ্যাট ইজ) নাম পাল্টান ঢাকেশ্বরীতে। পরে ধলেশ্বরী (প্রাক্তন ধোলাই খাল, হুইচ ইজ) নদীর পারে, ঐতিহাসিক কাঠের পুলের ধারে, গেণ্ডারিয়া ভাট্টিখানার উঠানে, তিনি একটি দ্বিতীয় কুবমিনার স্থাপন করেন। কিন্তু উক্ত অস্থানের মাটি খানিক নম্র হওয়ার কারণে মিনারটি অচিরাৎ কাত হ’য়ে গিয়ে দ্বিতীয় পিসা-র হেলানো মিনারে পরিণত হয়। এটি এখন ঢাকার একমাত্র সরকার- অনুমোদিত আত্মহত্যার স্থান—আত্মহত্যা-প্রতি চার্জ একশত-এক দ্রাখমা হেলানো মিনারের বর্তমান নাম প্রহেলিকা

আইবকের পর এগারোতম প্রেজিডেন্ট, বীরবলেন্দু গুণ, নিজামলে, বাংলা একাডেমি এবং তৎসংলগ্ন শহীদে সুহ্রাবর্দি উদ্যানের পুকুর-দু’টিকে জোড়া লাগিয়ে দেন, এবং তন্মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় পুষ্প, কচুরিপানার ফুলের চাষ করেন। পূর্বে বাংলাদেশের জাতীয় পুষ্প ছিল শাপলা-নামক একপ্রকারের জলজ ফুল, যা প্লাবন-পরবর্তী দুর্ভিক্ষে বিলুপ্ত হয়। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, খাজা নাজিম-উদ্-দীন খান খানবাহাদুর সাহেব, নব্যকর্তিত ঝিলটির নাম রাখেন লখ্ বুমেরাং (ইংরাজির দাসত্ব ঘোচাতেই, ‘লেক’ শব্দের স্থলে ‘লখ্’ তখন থেকেই চালু হয়, যেমন বহু-শতাব্দী-যাবৎ ভারতীয় বাংলায় ‘একাডেমি’ বা ‘অ্যাকাডেমি’ শব্দের জায়গায় ‘অকাদমি ব্যবহৃত হ’য়ে আসছে)। কিন্তু প্রেজিডেন্ট গুণ অকস্মাৎ এই লখ্-এর নামটিকে নাকচ ক’রে এর নূতন নাম দেন ‘ক্রিসেন্ট লখ্’। এবং তাতে একটি দীর্ঘসূত্রী গোলমালের সূত্রপাত হয়।

প্রথমেই বাংলার পানি পত্রিকায় যথারীতি সন্দেহ প্রকাশ করা হয় যে, প্রথম বয়সে গুণ একবার অস্ট্রেলিয়ার ভিজার জন্য আবেদন ক’রে প্রত্যাখ্যাত হ’ন—এটি তারই প্রতিশোধ। বিশেষ সংবাদদাতা এমতো তথ্যও দেন যে, ভিজা পাওয়ার শেষ চেষ্টা হিসাবে গুণ তখন অস্ট্রেলিয় দূতাবাসের টাইপিস্ট পলিন হ্যানসনকে একশ’টি কবিতা উপঢৌকন দেন। বিনিময়ে মিস হ্যানসন তাঁকে, ভিজা নয়, ব্যানজো প্যাটারসন-এর রচনাবলি উপহার দেন—ভিতরে ছোট্ট চিরকুট: ‘Next time please come to the embassy with a reliable packet of condom and not your poetry.

গুণ অবশ্য আহ্নিক বাংলা পত্রিকায় প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, যে, কোনও অস্ত্র, তা যত প্রিমিটিভই হোক না কেন, একটি নির্মল পল্বলের সঙ্গে তুলনীয় হ’তে পারে না—ইত্যাদি।

কিন্তু গভীরতর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত আসে বাংলাহাট পত্রিকার কলাম থেকে : যে, প্রাক্তন ক্রিসেন্ট লেকের (বর্তমান ধোলাই খাল) নামটির পুনঃপ্রচলনের মাধ্যমে প্রেজিডেন্ট গুণ, ক্রিসেন্ট লেক-যুগের স্বৈরাচারের প্রতি পক্ষান্তরে নিজের পক্ষপাতের কথাই ঘোষণা করেছেন; তৎকালীন প্রেজিডেন্ট তোডরমলের আমলের সেই কুখ্যাত মাৎস্যন্যায় বা আয়ামে জাহিলিয়ায় বাংলাদেশের পুনঃপ্রত্যাবর্তনের এটি একটি স্পষ্ট আলামত। পরে সুবাহ্-র কাগজ পত্রিকার তরফ থেকে মৎস্য ও পানি উন্নয়ন বিভাগের মহাসচিব জনাব সানিউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হ’লে তিনি রহস্যময় হেসে বলেন, যে ব্যাপারটি কাকতালীয়। তবে, ক্রিসেন্ট লখে কিছুদিন আগে মৎস্যমানবী দেখা গেছে ব’লে যে-গুজবটি শোনা যায়, সেটি মৎস্য-বিভাগই রটিয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হ’লে হক সাহেব খেপে উঠে বলেন, ‘আমিই যদি রটাব, তাহলে আমিই কেন জালটাল নিয়ে…?’ তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে আরও জানান, যে, তিনি কলা খান না।

বাংলাহাট-এর অভিযোগের জবাবে প্রেজিডেন্ট প্রেসনোটে জানান, যে, ধোলাই খালের প্রাচীন নাম ক্রিসেন্ট লেক ছিল, এই তথ্যটিই ছিল তাঁর অজানা, ইতিহাসে তিনি তাঁর পুরো স্কুল-জীবনে কখনও ৬ (ছয়)-এর উপরে মার্ক পান নাই। তিনি আরও জানান, যে, সম্ভব হ’লে তিনি টোডরমলের (sic) ক্রিসেন্ট লেকের নামই বদলে দিতেন, কিন্তু কুতুবুদ্দিন (sic) সেটি আগেই ক’রে ফেলায়…।

মহাপ্লাবনের কাহিনি এই :

বিংশ শতকের দ্বিতীয় পাদে, ঢাকায়, মাটির নীচ থেকে ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি তুলে তা জনগণকে সরবরাহ করা হ’ত। ঢাকার তৎকালীন পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিভাগ, ওয়াপদার এই অনিষ্টকারী অভ্যাসের কুফল ফলতে দেরি হয় না। অচিরেই ঢাকার মাটির তলাকার সকল নদ-নদী শুকিয়ে যায়। সে-সময় একটি বিদেশি দাতা সংস্থা, নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, জাহাজ-ভর্তি পানির রিফিল, থুড়ি, রিলিফ দিয়ে ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখে, এবং ঢাকার রেশনশপ-গুলি থেকে উক্ত রিলিফের মাল জনগণ কার্ড-মারফত উত্তোলন করতে থাকে। এই সময় কিছু অসাধু কারবার অবশ্য হয়, দেশি- বিদেশি উভয় পক্ষেই—বিশেষতঃ, শোনা যায় যে, রিলিফের পানিতে প্ৰভূত পরিমাণে রাসায়নিক বর্জ্যপদার্থ মিশ্রিত থাকত। তবে বাঙালিকে পানিতে মারা শিবের সাধ্য নয়, এবং এ-সব তো হয়েই থাকে, তাছাড়া যে-গোরু দুধ বা পানি দেয় তার লাথি বা চোনা খেতে আপত্তি করলে চলবে কেন?

একবিংশ শতকের শেষদিকে, আরও সঠিকভাবে, দুই-হাজার-আশি সালে, একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। তৎকালীন বুড়িগঙ্গা নদীর নাব্যতা পাঁচ- এ এসে ঠেকলে, বিআইডল্যুটিএ, নদীতল গভীর করবার মানসে চারটি ড্রেজার মোতায়েন ক’রে। যান্ত্রিক গোলযোগ বা মানবিক অনবধানবশতঃ, একটি ড্রেজার আড়াআড়ি-ভাবে নদীতল খোদাই না-ক’রে, ক’রে বসে খাড়াখাড়ি- ভাবে, যার ফলশ্রুতিতে, বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে ভূগর্ভস্থ, অধনা-শুষ্ক, ফল্গু নদীর আত্মিক যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং ফল্গু, বুড়িগঙ্গা-বক্ষঃস্থ সকল নৌযান, সদর ঘাট এবং ওয়াইজ ঘাটের দু’টি ভাসমান টার্মিনাল, উপর্যুক্ত চারটি ড্রেজার, এবং দু’টি মৈত্রী সেতু-সমেত, বুড়িগঙ্গার সকল জল আত্মসাৎ ক’রে। রাতারাতি বুড়িগঙ্গা এবং ঢাকার আশেপাশের অপর সকল নদী শুকিয়ে কাঠ হ’য়ে যায় এবং দুরন্ত বালকেরা তাদের খাদে ফুটবল এবং কপাটি খেলতে শুরু ক’রে। দেশের, বিশেষতঃ ঢাকার, এহেন রোজহাশরে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হ’ন মহাপ্রকৌশলী, মহাকবি মাসুদ খান।

বস্তুতঃ, তিল থেকে তিনি তাল আবিষ্কার করেন।

ঢাকাই লেজেন্ড মোতাবেক, বুড়িগঙ্গা শুকিয়ে যাবার পর-পর, খান সাহেব একদা স-পরিবার তার (নদীর) বুকে হাওয়া এবং চিনাবাদম খেতে যান; সাথে একটা টুকরি—বলা যায় না, ডাঙাতেই মাছটাছ পান যদি। মাছেরা অবশ্য তাঁকে হতাশ ক’রে। তিনি তখন নদীর মাটিতে কান পাতেন, উদ্দেশ্য, মাটির তলায় দুয়েকটি মাছ ঘাপটি মেরে আছে কিনা ‘দেখবেন’। কিন্তু তিনি শুনতে পান—আহ্!—সমুদ্রকল্লোল! তাড়াতাড়ি উঠে প’ড়ে বৌকে বলেন, ‘দ্যাখো তো আমার কানে কোনও ঝিঁঝিপোকা-টোকা ঢুকেছে নাকি।

খানম কোনও পোকা দেখতে পান না। তখন খান সাহেব, কী ঘটেছে তা পত্নীকে বললে-পরে খানম বলেন, ‘পোকাটা বোধ হয় মাথার ভিতরে ঢুকে গেছে, সি.টি. স্ক্যান করানো দরকার।’

বৌয়ের তাচ্ছিল্যের জবাবে খান সাহেব সে-যাবৎ মেলাগুলি মহাকাব্য লিখেছেন। এবার কিন্তু অঙ্ক কষতে বসেন। এবং চার বৎসরের মধ্যে এমন এক যুগান্তকারী তথ্য আবিষ্কার করেন, যে, ভয় পেয়ে বাংলাদেশ সরকার কিছুকাল তাঁকে পাবনা স্যানাটরিয়ামে অন্তরিন ক’রে। কিন্তু তাঁর গবেষণা – বিষয়ে কীভাবে জেনে ফেলে রয়টার, এবং তারপর পশ্চিমা দেশগুলির চাপে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে, এবং স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে বাধ্য হয়।

খান সাহেব অঙ্ক কষে বা’র করেন যে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের পলি জমে- জমে সেই সিনোজোয়িক যুগে যখন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখন তার বাড়তি ওজনের চাপে মাটির বহু-নীচে, লিথোস্ফিয়ারে, একটা বিশাল, শাখাপ্রশাখাময় ফাটল দেখা দেয়, যে-ফাটলপথে সমুদ্রজল গিয়ে ঢোকে তারও আরও নীচে, নরম পাথরের অ্যাস্থিনোস্ফিয়ারে, এবং সেখানে একটা দানবীয় রেজারভোয়ার তৈরি ক’রে। খানের গবেষণায় এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, যে, লিথোস্ফিয়ারের একটা ফাটল ঠিক ঢাকার নীচ দিয়ে, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, বুড়িগঙ্গার নীচ দিয়ে, চ’লে গেছে।

কালবিলম্ব না-ক’রে খান সাহেব, ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দি আর্থ’ নামক একটি প্রকল্প চালু করেন বুড়িগঙ্গা-বক্ষে, এবং তাঁর এই মহৎ কর্মযজ্ঞে উদার হস্তে ইন্ধন জোগায় খনিজতৈল-উত্তোলক কোম্পানি শেল, এবং মরমি কবি ফরহাদ মজহার। প্রায় আড়াই বৎসর দিন-রাত কাজের পর মাসুদ খান শুষ্ক বুড়িগঙ্গা-বক্ষে একটি আর্টিজ্যন ওয়েল খননে সমৰ্থ হ’ন….

তারপর—হ্যাঁ, পানি উঠে আসতে থাকে। প্রচুর সিলিকন-মিশ্রিত, তরল রোদের মতো ঝকঝকে পানি। ঢাকার শত-শত গৌরী, পানিয়া ভরনে ছুটে যায় শ্যামবাজার, পোস্তগোলা, সোয়ারি ঘাট, জিঞ্জিরা, নলগোলা, ফতুল্লার ঘাটে। কবিবর মোহিত হ’ন, কবিতা লিখতে বসেন :

‘কেবল জাহাজ ডাকিয়া যায়,
ভূতে-ধরা অধ্যাপিকার প্রায়…’[২৭]

ইত্যাদি, আর বুড়িগঙ্গা নদীর নাম বদলে রাখেন হিপোক্রিন।

এবং পানি উঠে আসতে থাকে এবং উঠে আসতে থাকে এবং আসতে থাকে। খান সাহেবের কানে পানি গেলে তাঁর টনক নড়ে। কিন্তু এ-যৌবনজলতরঙ্গ রোধিবে কে? তাঁকে আবার গ্রেফতার ক’রে পাবনা পাঠাবার আগেই, তিনি নিজেই সেখানে গিয়ে হাজির হ’ন—উদ্দেশ্য, পানি কমাবার উপায় বা’র করবেন অঙ্ক কষে। একবার ভাবেন, যাবক্ষারজান বোমা মেরে, সুন্দরবনের কাছে সমুদ্র ও ভূগর্ভস্থ রেজারভোয়ারের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন ক’রে দেবেন; কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর পশু-দরদি হিয়া হাহাকার ক’রে ওঠে, যদিও সুন্দরবনে পশু বলতে ততদিনে রয়েছে শুধু তিনটি জাতের বানর। এদিকে ঢাকার আবালবৃদ্ধবনিতা বড় আনন্দিত। সোল্লাসে ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় তারা পিনেস চড়ে বেড়ায়, ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠে ওয়াটার- স্কি ক’রে, ঘরের ভিতরে টেবিলে বসে-বসে সিলভার কার্প মাছ ধ’রে। আর তরুণ-তরুণীর জলকেলি, আর কিশোর-কিশোরীর জলকেলি, আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জলকেলি। কিন্তু পানি আরও বাড়ে, আরও আরও বাড়ে। এক তলা, দুই তলা—লোকজন খেয়াল ক’রে না; চার তলা, পাঁচ তলা—তাদের আনন্দে ভাটা পড়ে; আট তলা, দশ তলা, বারো তলা, বাইশ তলা——ঢাকার পঁচাত্তর শতাংশ লোক খাবি খেতে-খেতে মারা প’ড়ে, আর বাকিরা গাজি, কিউই প্রভৃতি মধ্যযুগীয় প্রমোদতরিতে, এবং সচিবালয় প্রভৃতি ইমারতের ছাদে কষ্টেছিষ্টে দিন গুজার ক’রে, আর মৃত্যুর প্রহর গোনে, উইদ আ লিটল পেশেন্স।

সংসদ ভবনের ছাদে সরকারি ও বিরোধী-দলীয় সাংসদদের মধ্যে ঘোর বিতর্ক ও হাতাহাতির ফাঁকে স্পিকার, জনাব সেড মঁ-ঝুর-ইল-ইজ-লাম, একতরফাভাবে রায় দেন যে, মাসুদ খান-খনিত কূপটিকে বন্ধ করতে হবে। সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তখন নিঝুম দ্বীপস্থ বাংলাদেশ স্কুবাহিনীর সদর দপ্তরে বেতার যোগাযোগ করা হ’লে তাঁরা উদ্ধার নামক একটি জাহাজ, এবং ত্রাণ ১,২,৩—আদিক্রমে দশটি সি-প্লেনে ক’রে ঢাকায় আসেন। কিন্তু স্কুবাহিনীর সাতশ’ জোয়ান, এবং তেরোশত যুবতী, কূপের মুখে কুলুপ পরাতে ব্যর্থ হ’ন। নিন্দুকেরা অবশ্য ব’লে থাকে, যে, তাঁরা (স্কুবাহিনী সেরকম কোনও চেষ্টাও করেন নাই আদৌ। তাঁদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বরং, ডুবে-যাওয়া ঘরবাড়ি, দোকানপাট, ও ব্যাংক। নিন্দুকেরা আরও ব’লে, যে, তাঁরা (স্কুবাহিনী) প্রাগুক্ত কূপের মুখটিকে বরং আরও প্রশস্ত ক’রে দেন।

তো স্কুবাহিনী ‘ব্যর্থ’ হ’য়ে বিদায় নিলে, মাসুদ একটি গয়না-নায়ে ক’রে ঢাকায় আসেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক দ্বিতীয়গমনের সময়ে তাঁর নৌকা বোঝাই ছিল অঙ্ক আর কবিতার খাতায়। তাঁকে দেখামাত্র যদিচ বাংলাদেশ সরকারের সকল সদস্যের পিত্তি জ্বলে যায়, তিনি তবু ঘোষণা দেন যে, ঢাকাকে বন্যার কবল থেকে বাঁচাবার উপায় তিনি আবিষ্কার করেছেন; আর তা হ’ল, (মাসুদ খান অঙ্ক কষে দেখান যে) যেহেতু ভূগর্ভস্থ সমুদ্রাংশের একটা প্রশাখা চট্টগ্রামের নীচ দিয়ে গেছে, তাই, চট্টগ্রামে আরেকটি কূপ খনন করা হ’লে ঢাকা বেঁচে যাবে।

যে ভাবা সে কাজ। চট্টগ্রামের ফৌজ লেকে দ্বিতীয় কূপটি খনন করা হ’ল, এবং দেখতে-দেখতে গোটা বন্দর-নগরী সাত-হাত পানি-মে—যেন দ্বিতীয় রাঙামাটি। সীতাকুণ্ড, বাড়বকুণ্ড, আন্দরকিল্লা, বাটালি হিলের উপর থেকে ‘মাসুদ খান মুর্দাবাদ!’ স্লোগান সৃষ্টিকর্তার নির্বিকার কানের পানে ধাওয়া করল। কিন্তু ঢাকা বেঁচে গেল। জল নেমে গেল। স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রয়ে গেল শুধু, ঢাকা-ময়, অগণিত নদীনালাখালবিলহাওরবাঁওড়

মাসুদ খান অবশ্য বিবেকের দংশনে, সিএনএন-এ সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন যে, চট্টগ্রামকে মেরে ঢাকাকে বাঁচাতে হ’ল ব’লে তিনি দুঃখিত। সেই সঙ্গে এও বলেন, চাটগাঁকে বাঁচানোর বুদ্ধিও তিনি বা’র ক’রে ফেলবার পথে, এবং সম্ভবতঃ -সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন তিনি—সিলেটের কাছে আরেকটি কূপ খোঁড়া হ’লে চাটগাঁ বেঁচে যেতে পারে। ‘Hardly are those words out, when’[২৮]—সিলেট নগরী সুনশান। সিলেটের আবালবৃদ্ধবনিতা রাতারাতি সীমান্ত পেরিয়ে চেরাপুঞ্জি নগরে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে। তারা ব’লে, যে, ঊর্ধ্বগামী পানির চেয়ে নিম্নগামী পানি অনেক বেশি পবিত্র, কেননা, তা নেমে আসে জান্নাতের দিক থেকে, পাতাল, অর্থাৎ জাহান্নামের দিক থেকে নয়। আশ্চর্যজনকভাবে, এই একটি বিষয়ে অদ্ভুত মতৈক্য পরিলক্ষিত হয় সিলেটের দুই বিবদমান ধর্মীয় নেতা আল্লামা নজরুল ড্যু জাফরি এবং শ্রীসুবীরকুমার ভট্টাচার্য পরমহংসের মধ্যেও।

কিন্তু এতসব-সত্ত্বেও, ঢাকার মেয়র খাজা আহসান-উল্লাহ খানখানান দ্য সেকন্ড, খান সাহেবকে ‘নূহে ঢাকা’, এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আলতামাস, তাঁকে (মাসুদ খানকে) ‘জাতির মিতা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অপিচ, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে হিপোক্রিনের সকল লঞ্চের নামের আগের ‘এমভি’ মুছে ফেলে ‘এমকে’ লেখা হয়, এবং ঝড়ে-পড়া জাহাজের নাবিক-খালাসিরা ‘বদর! বদর!’ ধ্বনির পরিবর্তে ‘মাসুদ! মাসুদ!’ ধ্বনি ব্যবহার করতে শুরু ক’রে।

৯.

‘আইসো আমরা অবগাহন করি, ঝাঁপুই খেলি,’[২৯] ফুল্লরা প্রস্তাব রাখেন।

কালকেতু বলেন, ‘কিন্তু সুইমস্যুটটা তো আনা হয় নাই।

‘না না, আমরা এক্ষণে মাতৃগর্ভে শিশুর মতো সাঁতরাব,’ ব’লে, ফুল্লরা, একাদিক্রমে শাড়ি, ব্লাউজ, শায়া, ব্রা, প্যান্টি খুলতে শুরু করেন।

সেই অপার্থিব উদ্বোধন, কালকেতু প্রত্যক্ষ করেন পরম ধৈর্যে, বিনয়ে, প্রশংসায়। ফলে তাঁর চোখের জ্যোতি বাড়ে। কিংবা চোখই বাড়ে। তাঁর সারা শরীরে, বসন্তের গুটির মতো অসঙ্খ্য চোখ গজায়, যারা ফুল্লরার সারা শরীর অবলোকন করে। কালকেতুর চোখ ফুল্লরার চোখ, কালকেতুর নাক ফুল্লরার নাক, কালকেতুর ঠোঁট ফুল্লরার ঠোঁট দেখে। অথচ কালকেতু আসলে কিছুই দেখেন না, বোঝেন না। তিনি সংবিৎ হারান, এবং সংবিতে ফেরবার পরেই শুধু নিজেকে আবিষ্কার করেন, অনাবৃত ও নিঃসঙ্কোচ।

ফুল্লরা আনমনে গা’ন : ‘রূপ দেখিলাম রে নয়নে–আপনার রূপ দেখিলাম রে! তারপর ফুল্লরা বলেন, ‘আমার সব ইয়ার, সব খানসামার দেহই আমার দেখা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই হুবহু। একটার থেকে আরেকটার যা পার্থক্য, তা কেবল আকারে।’

কালকেতু ভনেন :

‘আর, মনে হয়, আমরা সবাই একই
জ্বলে না যখন কোনওই প্রদীপ সেথা,
আর, মনে হয়, আমরা সবাই একই
যখন শরীর, ঢাকা নয় পোশাকে তা—’[৩১]

ফুল্লরা ধুয়া দেন :

‘ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।’

তারপর ফুল্লরা বলেন, ‘কিন্তু তোমার দেহ তাদের মতো নয়।’

‘থ্যাংক য়্যু,’ কালকেতু বলেন।

‘একটি বৈশিষ্ট্যে তোমারটি সব পুরুষ-দেহের থেকে আলাদা—’ ফুল্লরা বলেন, ‘তোমার দেহ দেখে কোনওরূপ কামনা জাগে না।’

‘অ্যাঁ!’

‘প্রায় নপুংসক-দেহই বলা যেত, যদি-না যথাস্থানে ঘণ্টিটি ঝুলত। সত্যি কইতেকি, ঐ বস্তুটি তোমার শরীরে ভারি বেমানান। যদিও, ওটা এমনিতে খুবই ভালো—খুবই আদুরে। আমার নিজের একটা ঘণ্টি গজাবার সম্ভাবনা যদি থাকত, আমি ওরকম একটাই চাইতাম নিজের জন্যে। কিন্তু তোমার শরীরে ওটাকে মনে হচ্ছে একটা পরগাছা—একটা জোঁক। ওটার একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।

‘একশ’বার!” বলেন কালকেতু।

তারপর ফুল্লরার পশ্চাদ্দেশ অনুসরণ ক’রে পানিতে ঝাঁপান কালকেতু। এবং তলিয়ে যান, তলিয়ে যান, তলিয়েই চলেন -যেন ক্যারিবডিসের অতল গহ্বরে। ডুবন-বেগ একসময় স্থগিত হয়, এবং কালকেতু দেখতে পান তাঁর ফুসফুসের অবশিষ্ট বাতাসটুকুকে বুদ্বুদ হ’য়ে উড়ে যেতে। মনে প’ড়ে, খুবই অপ্রয়োজনীয় একটা তথ্যের মতো, সাঁতারটা শেখা হয় নাই। মনে-পড়া-মাত্র, শরীর, কালকেতুর তোয়াক্কা না-ক’রে, আপনাকে বাঁচাবার ভার আপন-হাতে তুলে নেয়; সম্পূর্ণ নিজগুণে, বা সহজাত প্রবৃত্তিবশত, এক আদিম সন্তরণরীতি স্মরণ করবার চেষ্টা পায়। কিন্তু সিপিয়ান্ধকার পানিতে দিগ্‌ভ্রান্ত কালকেতুর শরীর, উপরের দিকে যাত্রারম্ভ না-ক’রে, ক’রে নীচের দিকে। কালকেতু একঝলক দেখেন—পদ্মপলাশ-সমাসীনা রূপসী রমণী, ক্ষণে হাতি গিলছে ক্ষণে উগড়ে দিচ্ছে, আর এক জ্যোতির্ময়ী স্বর্ণগোধিকা তাঁকে (কালকেতুকে বলছে, ‘মাভৈঃ! মাভৈঃ!” তারপর ব্ল্যাকআউট।

অনন্তকাল পরে, আরও একবার, তিনি এই স্বাদ-গন্ধ-স্পর্শ-বর্ণ-শব্দের জগতে ফেড-ইন করেন, এবং খালের পরপারে, স্মৃতিবিস্মৃতির গিরিসঙ্কটে, ফুল্লরার কোলে, নিজেকে আবিষ্কার করেন, জড়পুত্তলীবৎ শয়ান। ফুল্লরার মুখের সুষমা, একটা ছত্রচ্ছায়ার মতো তাঁর মুখের ‘পরে ঝুঁকে আসে। ফুল্লরার মুখ বলে—’কালকেতু! কালকেতু! কালকেতু!’

নবজাতকের মতো, কালকেতু শোনেন (কিংবা শোনেন না), জীবজগতের আদ্যাধ্বনিকল্লোল। ‘কালকেতু’–এই শব্দ চরাচর-ব্যাপ্ত হয়, মিড়ে-মিড়ে মূর্ছনায়-মূর্ছনায় তাঁর সমগ্র সত্তাকে সহস্রজিহ্ব সর্পের মতো লেহন ক’রে, তোষণ ক’রে—জবাব দিয়ে সেই শব্দব্রহ্মকে মরীচিকার মতো উবিয়ে দিতে তিনি চান না, তিনি রা কাড়েন না, আর ফুল্লরা নাগাড়ে ব’লে চলেন, ‘কালকেতু! কালকেতু! কালকেতু! কালকেতু! কালকেতু!

অনন্তকাল যায়। অনন্তকাল আসে। অবণাগবণে কালকেতু বিমনা হ’ন। তারপর সুমর করেন, বলেন, ‘পা-নি—’

ফুল্লরা তখন তাঁর একটি স্তন গুঁজে দেন কালকেতুর মুখের ভিতর।[৩২] কালকেতু পান করেন অনন্তকাল। তাঁর দেহের প্রতিটি কোষ পুনরুজ্জীবিত হওয়া ইস্তক পান করেন। ফুল্লরা তাঁর (কালকেতুর) চুলে আঙুল বোলান। কানে নাক ঘষেন। নাকে কান। আর ওপারে যে-ছায়াটিকে ইতস্ততঃ করতে দেখা যায়, তাঁকে চেঁচিয়ে বলেন, ‘আপনি কে ভাই?’

ছায়াপিণ্ডের উত্তর আসে, ‘আমি কেউ না। মানে, ইয়ে, আমি পুলিস।’

‘আপনি কী করছেন পুলিস-ভাই?” ফুল্লরা পুনশ্চ চেঁচান।

‘কিছু না, ইয়ে—’ ছায়া আমতান’আমি শুধু দেখছিলাম যাতে আপনাদেরকে ডিস্টার্ব কেউ না-ক’রে।’

‘আপনার মতো লক্ষ্মী পুলিস আর হয় না!’

ছায়া বিগলিত হ’ন।

‘আমাদের কাপড়চোপড়গুলি একটু দেখবেন কি—যতক্ষণ না-ফিরি?’

নিশ্চয়ই। একশ’বার।

কালকেতুকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ চলেন ফুল্লরা, এবং শুধান তিনি এখন হাঁটতে পারবেন কিনা। তারপর, অনন্তকাল পরে, আবার দু’জনে হাত- ধরাধরি হাঁটেন, এবং ধোলাই-তীরে সুবিখ্যাত বনসাই গার্ডেনে প্রবেশ করেন। সেখানে, একটা ফলন্ত পাকুড়গাছকে মাঝখানে রেখে দু’জনে মুখোমুখি বসেন। গাছটা, অবশ্য, পাকুড় কিনা, তা দু’জনের কেউই ঠিক-ঠিক জানেন না।

কালকেতু বলেন, ‘কেন আমায় তুমি বাঁচালে?”

ফুল্লরা বলেন, ‘এ-জন্যেই।’ তারপর বলেন, স্বগত, ‘দ্য ম্যান হ্যাথ পেনান্স ডান, পেনান্স মোর উইল ডু।’[৩৩]

কালকেতু বিড়বিড় করেন :

‘My lips were wet, my throat was cold,
My garments all were dank;
Sure I had drunken in my dreams
And still my body drank!’[৩৮]

‘দ্য গেম ইজ ডান, আই’ভ ওয়ান, আই’ভ ওয়ান!’ ব’লে, ফুল্লরা, চোখ টিপে হাসেন, তারপর বলেন :

‘…he on honeydew hath fed,
and drunk the milk of paradise।’[৩৫]

কালকেতু লজ্জায় মাথা নোয়ান। যেন তিনি নববধূ, বাসররাতের পরে দিবালোকে প্রথম মুখ দেখিয়েছে যে তার স্বামীকে—ননদদেরকে- ভাসুরকে!—শ্বশুরকে নিজেকে!

একটা তালগাছ উপড়ে নিয়ে ফুল্লরা দাঁত খোঁটান, আর হাসেন আর হাসেন আর হাসেন।

কালকেতু আর সইতে না-পেরে একটা হেঁতালগাছ তুলে ফুল্লরাকে মারতে ছোটেন। ফুল্লরা সারি-সারি শাল্মলীবৃক্ষকে তাঁর ফুলদলসম পদনখরাঘাতে ছিঁড়তে-ছিঁড়তে, দলতে-দলতে লাফিয়ে পালান। পরে তাঁরা হাসতে-হাসতে জড়াজড়ি ক’রে খালে প’ড়ে যান, এবং কালকেতু, ফুল্লরার পৃষ্ঠে আরোহণ করেন। ফুল্লরা, কালকেতুকে পিঠে নিয়েই, সাঁতরে পার হ’য়ে যান। ছায়া- পুলিস তাঁদের সাহায্য করতে হাঁটুজলে নেমে আসেন, এবং তাঁরা দু’জনে টেরা ফার্মায় স্থিত হ’লে, তাঁদের কাপড়চোপড়গুলি ফিরিয়ে দেন সযত্নে, এমনকি তাঁদের গা মোছার জন্য আপন উর্দিটি পর্যন্ত দেন খুলে।

ফুল্লরা মোহিত হ’য়ে বলেন, ‘আর-জন্মে আপনি আমার ভাই ছিলেন, ভাই!’

তখন ছায়া-পুলিস কেঁদে ফেলেন এবং ফুল্লরা তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধ’রে আদর করেন।

কালকেতু সেই ফাঁকে কিছু খোলামকুচি খালের জলে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে মারেন, আর নিজের অজান্তে আবৃত্তি করেন :

‘ছোরাটি হৃদয়ে ঢোকে
যেন এক লাঙল
পোড়ো আবাদায়।
— না।
কোরো না আমায় ভেদ।
–না।
ছোরাটি
সূর্যের রশ্মির মতো
আগুন ধরাল ভয়ঙ্কর
গভীর খদে-খদে।
— না।
কোরো না আমায় ভেদ।
— না।’[৩৭]

ফুল্লরা চমকে উঠে ঘোরেন। পুলিস মুহূর্তে হাওয়ায় মিলান। ফুল্লরার ঠোঁটের কোনায় এক অদ্ভুত হাসি ছায়া ফেলে। ফুল্লরা নিজেই সেই হাসিকে চেনেন না। ফুল্লরার মুখে যেন ভর ক’রে হাসে এক অচেনা পুরুষ। কিন্তু সে কি সত্যিই অচেনা? ‘কে? কে?’ ফুল্লরা ফুকারেন, তারপর ডাকেন, ‘কালকেতু!’ যেন ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরতে চান পাশবালিশটিকে। কিন্তু হাতড়ে পাচ্ছেন না। মরা সাপের মতো কী-একটা ঠেকেছে যেন হাতে। ফুল্লরার রক্ত-মাংস-মজ্জা- মেদ গলে যায়—এক চিরন্তন জাগ্রত নিদ্রার ভিতর তলিয়ে তিনি যান, আর, অন্য এক জগৎ, অন্য এক ডিমেনশন থেকে, ভেসে আসে কালকেতুর আকুতি :

‘আমি ডাকি তোমায়
অপরাহ্ণবেলায়
সব অপদেবতার নাম ভুলে
স্বর্ণবর্ম খুলে
আমি ডাকি তোমায়
হঠ-চকিত আয়োনিত শৈশবের নামে
ভৈরোঁ-গাঢ় চোখ-তারা যেথায়
বেদন ছড়ায়
রৌদ্রসৌগন্ধময় রঙিন ধুলায়
নানাকার পদচ্ছাপে পদরজে বিচিত্রিত
জীবনের ট্যাপেস্ট্রিতে
এই মান্দালায়
বহু পথ চ’লে এসে ভুলে ফেলে এসে বহু পথ
যে-দিগন্তে সব নদী থামে
অব্যর্থের চির-বামে’

ফুল্লরা বসেন পাকা পাড়ের উপর। বাচ্চা মেয়ের, গল্প শোনার মতন গুটিসুটি। ঘুমের ভিতরে তিনি শোনেন, ঘুমের বাইরে থেকে। আর সেই অদ্ভুত পুরুষ তাঁর মুখে হাসতেই থাকে। কিংবা হয়তো, কে জানে, হাসিটিকে ফেলে রেখেই সে চ’লে গেছে কিনা—কোনও-কোনও বজ্জাতের প্রাণ যেমন হাসিটুকু রেখে দিয়ে দেহ ছেড়ে যায়….

‘ঘনিয়ে আসে ঘোর আমি মর্ফিয়াবিভোর
ঘনায় দোহদ
ঘন মদ
তরল ইরম্মদ
মধু মধু মনঃ কোকনদ
অপরাহ্ণবেলায়
হাওয়ার হাল্কা তবু হুশিয়ার তুলি
খুঁটিয়ে ক’রে পরিষ্কার
আলোর ভিতরকার উহ্য অন্ধকার
গৃহ্য অন্ধকার’

চিৎ হ’য়ে শুয়ে পড়েন ফুল্লরা। তাঁর উপর ঝাঁপ দেয় চাঁদ। তাঁকে তুলাধুনা ক’রে। তিনি চাঁদকে গ্রহণ করেন, দেহের নয় দরোজা আর রোমকূপের হাজার হাজার জানালায়…

‘আমি ডাকি তোমায়
আর তার সুঁৎ আর মিড়
তড়িত্তরঙ্গে ছুটে চ’লে রঙ্গে
কেলাসে কেলাসে এই শুদ্ধ আলোর
শুদ্ধ প্ৰতিভায়’

‘কালকেতু! কালকেতু!’ ফুল্লরা ডাকেন, নিজেকেই। নিজের ভিতরে। নিজের গোলকধাঁধায় তিনি ছুটাছুটি খেলেন নিজের কালকেতুর সঙ্গে— ‘কালকেতু! কালকেতু!’ কিন্তু কালকেতুকে কোথাও দেখা যায় না। ফুল্লরার মনে প’ড়ে না, কে খুঁজবে কাকে——নাকি কালকেতু ভুলেছে, যে খোঁজার কথা তারই, এবং নিজেই সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে! তবে কি দু’জনেই পালাচ্ছেন তাঁরা? দু’জনেই চোর?

‘আর আমি কত রাত কত দিন
তর্জনে গর্জনে তথা অর্জনে বর্জনে ক’রে দিয়ে পার
পাথেয়-ফতুর অপথে
সংশপ্তক শপথে
আহা
ঘুরেছি কত-না কত দিন কত রাত
আর কত নিরর্থক
কত নিরর্থক
কত নিরর্থক রক্তরেতঃপাত
কত নিপীড়ন
কত নিরর্থক নিপীড়নে
লোলজিহ্ব নমিতলাঙ্গল
পথের রেখাগুলি নিশ্চেতনার অবসরে
আমার সংশয়ের সুবর্ণ-সুযোগে
বার-বার চ’লে গেছে গোঁৎ খেয়ে-খেয়ে
লালফিতায় বাঁধা ঐ পশ্চিমের পিছনে পশ্চিমে
যেখানে কোনওই ময়লা হাবসি নখের বিলেখন
বা কোনও খোজার নৈমিত্তিক
মোমময় মস্তিষ্কের আগা কিংবা গোড়া
ভুঁইফোঁড় ভূয়োদর্শিতায়
জাহির করেনি কোনও গা-ঘিন্-ঘিন্ গোলাপের তোড়া
কান্নায় কি ঘামে প্রেমে কি কামে
অব্যর্থের চির-বামে
‘বুকে তবু বর্ম বাঁধা ছিল’

ফুল্লরা, মুহূর্তের তরে, কালকেতুর মাত্রার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটাতে পারেন, কিন্তু ‘কিন্তু আমি তো ঐ বর্মটিকে ভেবেছিলাম খোলা বুক, এমনকি খোলা বুকের চেয়েও খোলা বুক—’ বলতে-না-বলতেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়…

‘সারা কালীসন্ধ্যা বারদুপুর
এই বর্ম ছিল
এই বর্মে আমি ছিলাম
এই বর্ম আমি ছিলাম
এই বর্ম সুরক্ষিত করেছে আমাকে
যাবতীয় জাগতিক কল্যাণ-অকল্যাণ থেকে
এই বর্ম করেছে আমাকে আমার জাদুঘর
এই বর্ম অরক্ষিত করেছে আমাকে আপনার থেকে
এই বর্ম করেছে আমাকে
এই বর্ম করেছে আমাকে
তুমি সয়েছিলে আমার আত্মরতি আমার অন্তর্ঘাত তবু
তুমি তো ছিলে না ছিলে না এই বর্মের প্রভু’

এ-সময়, প্রায়-শুষ্ক আকাশের থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উড়ে নামে। ফুল্লরা উন্মত্ত উল্লাসে চিৎকার করেন, শীৎকার করেন, অসহ্য বেদনায় সংবিৎ হারান…

‘সাতশ’ বছর পর খোল ভেঙে বেরিয়েছে কচ্ছপের নরম হৃদয়
সাতশ’ বছর পর হাওয়া আর আলো ছুঁতে পেরেছে হৃদয়
সাতশ’ বছর পর
জানা গেছে আর কোনও সত্য নয় সত্য কোনও মিথ্যা মিথ্যা নয়

ফুল্লরা বলেন, ‘কোনও সত্য নয় সত্য, কোনও মিথ্যা মিথ্যা নয় –

‘অপরাহ্ণবেলায়
আলোহিম আলোর জলসায়
আমি ডাকি তোমায়
হাত রাখো এই-দু’টি দণ্ডিত হাতে
খণ্ডিত আঙুলে যার মুষ্টিন্ধয় হৃদয় ঝলসায়
‘আয়
‘আয়
‘আয়
‘আয় আয়
আয় আয় আয়
আয় আয় আয় আয় আয় আয় আয় আয় আয় আয় আয়
‘আয়’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *