কালকেতু ও ফুল্লরা – ২০

২০.

লিটন অদশ্য হ’লে দু’জনে মোড়ের মূর্তির পাদবেদিতে জিরাতে বসেন।

এই মূর্তিটির ইতিহাস চাঞ্চল্যকর।

মহাপ্লাবনের পানি সরে যাবার পর এটিকে এখানে, একেবারে পাদবেদি- সমেত, স্থাপিত অবস্থায় দেখা যায়। তার পর থেকে এই মূর্তিটি দেশের বিভিন্ন এলিট ও প্রলেতারিয় মহলে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছে।

প্রথমেই সমস্যা তৈরি হয় মূর্তিটির উচ্চতা নির্ণয় করতে গিয়ে। কেন্দ্ৰীয় জাদুঘর, নিজস্ব যন্ত্রপাতিতে মূর্তিটিকে মাপে, এবং এর উচ্চতা, পোডিয়াম – সহ, একশ’ ফুট ব’লে নির্ধারণ ক’রে। পরে পোডিয়ামটিকে আলাদা মাপা হয় এবং তার উচ্চতার বিশ ফুট বাদ দিয়ে মূর্তিটির একক উচ্চতা দাঁড়ায় আশি ফুট।

এক বৎসর পর সরকারি জরিপ বিভাগ প্রথমে মূর্তির উচ্চতা মাপে তখন দেখা যায়, যে, মূর্তির নিজেরই উচ্চতা একশ’ ফুট এবং সোডিয়াম-সহ একশ’-কুড়ি ফুট।

পরে, উবিনিগ-এর প্রস্তাবে, মূর্তিটিকে বহুকষ্টে শোয়ানো হয়, এবং তার উচ্চতা না-মেপে দৈর্ঘ্য মাপা হয়। এক্ষণে দৈর্ঘ্য একশ’-কুড়ি ফুট দেখা যায়। নানা মহলের চাপে, সরকার অতঃপর একটি মর্মর ফলকে, পোডিয়ামের উপর লিপিবদ্ধ ক’রে :

‘উচ্চতা ৮০/১০০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট’

মূর্তিটিকে নিয়ে দ্বিতীয় যে-বিতর্কটি সর্বস্তরে সঞ্চারিত হয় তা, স্বাভাবিকভাবেই, এর পরিচিতি-সঙ্ক্রান্ত।

প্রথম তত্ত্বটি আসে বিটিভির সংবাদপাঠক নাড়ুয়াল হকের ‘অফ দ্য রেকর্ড’ মন্তব্য থেকে; তিনি নিজস্ব ধারণা জানান যে, মূর্তিটি সম্ভবতঃ ইসা খাঁ-র।

এই মন্তব্যকে ব্যঙ্গ ক’রে, বেতারের গরমপত্র-পাঠক মুলুকরাজ আনন্দ সম্প্রচার করেন যে, মূর্তিটি তাঁর মতে, ইয়াহিয়া খাঁ-র। তিনি এই সূত্রে ‘টাকুয়া’(sic)-কে ‘ছদ্ম রাজাকার’ বলেন, এবং তাঁকে ‘কেচকি মার’ দিয়ে দেশ থেকে ভাগিয়ে দেবার প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেন।

গ্রেকো-ইজিপ্টোলজির অধ্যাপক ডঃ আহসান-উল হক অবশ্য নানা পুথি-পাঁজি ঘেঁটে প্রমাণের প্রয়াস পান, যে, এটি আসলে প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম, কলোসাস নামে যশস্বী, হেলিয়সের পিত্তল-মূর্তিটিরই রোমক প্রাস্তরিক অনুকরণ।

সাহিত্যাচার্য বদর-উদ-দীন উমর তখন, আর কে নারায়ণের বরাত দিয়ে বলেন, যে, এটি আদৌ নারায়ণ-বর্ণিত ‘মালগাড়ি’ শহরে স্থাপিত ললি সাহেবের মূর্তি, এবং, যে, মালগাড়ির মেয়র, ঢাকার মহাপ্লাবনের সুযোগে সেটিকে এখানে পাচার ক’রে থেকে থাকবে।

অধ্যাপকদের সঙ্গে-সঙ্গে ছাত্ররাও তাদের মতামত দিতে শুরু ক’রে। বুয়েটের জনৈক মেধাবী ছাত্র, প্রণবকুমার দাস, ‘মনুর জন্ম’ নামক প্রবন্ধে দাবি করেন, যে, মূর্তিটি শেষ ইনকা সম্রাট্ আতাহুয়ালপার।

পক্ষান্তরে, ভাস্কর রাশিয়া, মূর্তিটিকে তাঁরই গড়া, চিয়াং কাইশেকের প্রতিকৃতি ব’লে দাবি ক’রে অনশন ধর্মঘটে মারা যান।

সরকার অবশ্য এত মতের কোনওটিকেই গ্রহণ না-ক’রে, মূর্তিটির নাম দেয় ‘অজ্ঞাতকুলশীল দণ্ডায়মান মূর্তি’, বা, সংক্ষেপে, এডিএম; ফলে লোকমুখে এর নাম দাঁড়ায় ‘আদম বাবা’।

দু’জনের চোখের সামনে কিরিকো মার্গ (প্রাক্তন শান্তিনগর রোড), তার সমস্ত বিষমানুপাতিক ঘরদোর-সমেত, বয়ে চলেছে কাকরাইল চৌরাস্তার মোহানার দিকে।

কিরিকা মার্গের ক্যালসিয়াম বাতিগুলিকে এমন অদ্ভুত কায়দায় বসিয়েছে ফিলিপস, যে তাতে লোকজন এবং বাড়িঘরের (এবং অন্যান্য বস্তু বা প্রাণীর) ছায়াগুলি উল্টাপাল্টা জায়গায় উল্টাপাল্টা ধরনের প’ড়ে। যেমন, এখন যখন কালকেতু ও ফুল্লরা হাঁটছেন পাশাপাশি, তাঁদের ছায়াগুলি পড়েছে তাঁদের পাঁচ ফুট সামনে থেকে, পরন্তু কালকেতুর ছায়ার জায়গায় ফুল্লরার ছায়া পড়েছে, এবং ভাইসি ভার্সা। রাস্তার ধারের একটা এক-তলা বাড়ির ছায়া পড়েছে প্রায় দু’শ’ গজ, প্রত্যুত একটা বিশ-তলা ইমারতের ছায়া পড়েছে দেড় ফুট।

এ-সবের মধ্যে দিয়েই একটি বালিকা একটা চাকা চালাতে-চালাতে দৌড়ে যায়, এবং একটা ইটের ছায়ায় অদৃশ্য হয়।

হঠাৎ তাঁদের ভুল-ছায়াদু’টির মাঝখানে তৃতীয় একটা মনুষ্য-ছায়াকে হেঁটমুণ্ড পায়চারিরত দেখা যায়। দু’জনে পিছন-ডান কোণে, পাঁচশ’-তেতাল্লিশ গজ দূরে একটা দোতলা বাড়ির ছাদে জনৈক আবছায়া মূর্তিকে দেখতে পান।

কালকেতু বলেন, ‘চিনতে পেরেছো?’

‘চিনব না মানে?” ফুল্লরা বলেন, ‘উনি তো আমার খালু হ’ন।”

‘বলো কী!’ কালকেতু চমৎকার হ’ন—”ওঁকে তো আমি “ভাই” ডাকি! তোমার-আমার সম্পর্কটা তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে?’

‘এ-সব তো কোনও ব্যাপার না,’ ফুল্লরা হাসেন—’ভবানন্দ আমাকে কী ব’লে ডাকে জানো? ফু.পু.—মানে কিনা ফুল্লরা পুরকায়স্থ।’

কালকেতু নাতিদীর্ঘশ্বাস ছাড়েন—’অল ইজ ভ্যানিটি!

কাকরাইল মোড়ে এসে ঊর্ধ্ব-ডান কোণে দৃষ্টিপাত করলে মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রালের সূচ্যাকার চূড়াটি আবছা দেখা যায়। তার ডগায় একটা লালবাতি, পথভ্রষ্ট বিমান, ইউএফও, ও ভূতপ্রেতদেরকে সতর্ক করার জন্য।

কালকেতুর, ক্যাথিড্রাল-সংলগ্ন মিশনারি স্কুলটির কথা মনে প’ড়ে, এবং তিনি ফুল্লরাকে বলেন, ‘ছেলেবেলার কথা মনে প’ড়ে?

ফুল্লরা বলেন, ‘আমার কোনও ছেলেবেলা নাই।’

কালকেতু বলেন, ‘আমরা দু’জন এক-হাঁটু বৃষ্টির পানি ভেঙে, ভিজে- ভিজে স্কুলে যেতাম… আমি আমার টিনের বাকশোটিতে তবলা বাজাতে- বাজাতে, আর তুমি তোমার ফ্রকটিকে বাঁচাতে-বাঁচাতে—বরং প্যান্টি ভেজাবে কিন্তু ফ্ৰক নৈব নৈব চ—পনি-টেল আর আমার হৃদয় দুলিয়ে, যাত্রার উদ্দেশ্য এবং রাস্তার গর্ত ভুলিয়ে…’

ফুল্লরা বলেন, ‘তুমি অন্য কারুর সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছো।’

‘তাই নাকি? তা হ’তে পারে, এমনকি অন্য কারুর সঙ্গে আমাকে ও গুলিয়ে ফেলে থাকতে পারি,’ কালকেতু বলেন, ‘আমার বুকের ‘পরে ফের অযুত মস্তক শুয়ে ঠায়।’

রাস্তা পেরোতে তাঁদের কিছু বিলম্ব হয়। এক অভূতপূর্ব, রমণীয় শোভাযাত্রার সামনে তাঁদেরকে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগে। শত-শত, বা সহস্র- সহস্র, বালিকা/কিশোরী, তেরো থেকে সতেরো, নীল বা সেরকমই কোনও রঙের স্কার্ট-ব্লাউজে রুচিরা (‘এদের কেউ-কেউ নির্ঘাত নিম্ফোমেনিয়াক, কেউ-কেউ বা সরাসরি নিম্ফ’—ভাবেন কালকেতু), বাম-ডান করতে-করতে এগুচ্ছে—এক মনোহরতম পিলগ্রিমজ প্রোগ্রেস।

‘এরা সব চলেছে কোথায়? আজ কি কুমারী-পূজা নাকি?’

ফুল্লরা শুধান ‘আজ অল সোলজ,’ কালকেতু বলেন।

ফুল্লরা বলেন, ‘সরি, ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু, এরা কি এদের পূর্বজনমের প্রথম প্রেমিকদের জন্যে রোদন করতেই যাচ্ছে?’

‘শুধু পূর্ব না, পূর্ব পশ্চিম বর্তমান আগামী ভূত—সকল জনমের সকল শহিদ প্রেমিকের জন্যে এরা রাতভর প্রার্থনা করবে মাতৃমূর্তি-ক্যাথিড্রালে,’ বলেন কালকেতু।

২১.

‘আচ্ছা কালকেতু, তোমার কি মনে হয় না, এই-যে আমরা দু’টিতে যদৃচ্ছ ঘোরাঘুরি করছি, বা যা-ই করছি আর না-ই করছি—এ-সকলই একটা-কোনও ডিজাইনের, বা ডাজাইনের, অন্তর্গত?’—ফুল্লরা বলেন, ‘এক অদ্ভুত ফ্লোচার্টের একেকটা ঘর আমরা যেন? আমি যেমন তোমার ভূত- ভবিষ্যৎ জানি, তেমনি আমারটি জানেন ইচক, তুমি কারটি জানো তা আবার আমি জানি না, এবং ইচকেরটা কে জানে তাও জানি না। এই ফ্লোচার্টের নিম্ন, কিংবা উচ্চতম ব্যক্তিরা কারা, আন্দাজ করো তো?”

‘মনে হয়, উভয়ই সম্রাট্ ইসপ,’ কালকেতু বলেন, ‘তাঁর থেকেই চক্রের শুরু, তাঁতেই শেষ।’

‘তা হ’তে পারে, আবার না-ও পারে,’ ফুল্লরা বলেন, ‘তিনি পুরাপুরি এ-সবের বাইরেও থাকতে পারেন, আবার থাকতে পারেন প্রত্যেকটা ধাপেই—প্রত্যেকটা জীবন এবং মৃত্যু তিনি যাপন করতে পারতে পারেন, হয়তো।’

তাঁরা অবশ্য কাকরাইল রো ধরেন না, কেননা কালকেতু বলেন, ‘শর্টকাট মারি, এসো।

তাঁরা কাজেই সোজা রাসমণি সিনেমা এবং নানকাশাহি গুরুদ্বারের মাঝখান দিয়ে গড়িয়ে-যাওয়া গঙ্গারিড্ডি লেন ধ’রে হাঁটতে মনঃস্থ করেন।

সিনেমা হলের বাইরে বিশাল প্ল্যাকার্ডে প্রায় বস্ত্রহীন গতরে নৃত্যপর, জনগণমনোমোহিনী মঞ্জু ঘোষ। পাশেই সিলিয়াস কুঞ্চনের অষ্টাবক্র অস্থিসার মুরতি।

‘ফিল্মের নায়িকারা এখন পয়সা নেয় কাপড় অনুযায়ী,’ ফুল্লরা বলেন, ‘যত বেশি কাপড়, তত বেশি টাকা। এই “বদের বেটি হোসনা” ছবিতে মঞ্জু নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়েছেন, কাজেই তুমি খুবই উপভোগ করবে। একটা সিম্বলিক যৌনদৃশ্যও আছে—সিম্বলিক এভাবে যে, ঐ দৃশ্যটিতে কুঞ্চনের জায়গায় নাসের ভুলুকে দেখানো হয়েছে।

(সিনেমা-বিষয়ক ফুল্লরার দেওয়া আরও কিছু তথ্য কেটে দেন জনাব হক। তিনি বলেন, খামখা তাঁর, খলনায়ক জিসম বা ইফ্রিদের মার খাবার বাসনা নেই; তাছাড়া, রুশ নৃত্যশিল্পী বরিস ইয়েলৎসিনের তিনি নিজেই একজন ভক্ত।)

রাস্তার ওপারেই গুরুদ্বার। বস্তুতঃ, রাসমণি-কর্তৃপক্ষ বহুদিন-যাবৎ এই গুরুদ্বারটিকে স্থানান্তরণের আবেদন জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারকে বোঝানো যায় নাই, আর সকলেই সিনেমাদিরসে আকণ্ঠ হ’তে পারলে, শুধু শিখ গুরুগণ কেন এ-রসে বঞ্চিত হবেন।

সিং-দরোজায় কৃপাণপাণি দণ্ডায়মান দ্বাবান-যমজ, লক্কড় সিং এবং ছক্কড় সিং। তাদের ধনুক-বাঁকা, তালীদ্রমবৎ, পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, ভিতরে, গভীর ধর্মালোচন-রত মহাগুরু জগজিৎ সিং এবং কর্নেল কর্নেল সিং (প্রথমটি সামরিক পদবী, দ্বিতীয়টি নাম)।

তাঁদের খানিক দূরে, ঘোড়ায় চড়ে ঘুমাচ্ছেন (বীরেরা এভাবেই ঘুমায় কিনা) কর্নেল কর্নেল-পুত্র, স্কাইল্যাব সিং—তেত্তিরিশতম স্কাইল্যাব ভূপাতিত হবার দিনে যে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। স্কাইল্যাব অবশ্য ঘুমাবার আগে তাঁর পরচুলা ও পরদাড়ি খুলে রেখেছেন, এবং আকাশের চাঁদকে তাঁর মাকুন্দ মুখ-চাঁদ দেখাচ্ছেন।

ফুল্লরা বায়োনিক কান পেতে শোনেন, জগজিৎ বলছেন—’মাজারে কায়েসে-পর যব রুহি লায়লা এক দিন আয়ি, তো… কুছ ফুলভি লায়ি; লাগি যব ফুল রাখনে, তো কবর-সে আওয়াজ য়ে আয়ি: “চঢ়ানা ফুল, জানে-মন, মগর আহিস্তা আহিস্তা।

ফুল্লরা হিহিহিহি হাসেন, কালকেতুকে বলেন, ‘কালকেতু, মাই লাভ, জানে-মন, মন্-আমি, মা কুরু গুলিগুহারি—প্লিজ ডু নট রাশ, আহিস্তা আহিস্তা।’

কালকেতু বলেন, ‘হ্যাড উই বাট ওয়ার্ল্ড ইনাফ, অ্যান্ড টাইম

পঞ্চাশ গজ-মতো এগুতেই, রাস্তার দু’পার জুড়েই এক বিবিশাল প্রপ্রাসাদ। রাস্তাটি বরং প্রাসাদের তলা দিয়ে কায়দা ক’রে বেরিয়ে গেছে।

মাথার উপরে পঞ্চকোণ ব্রজ-প্লেটে লোহিতাক্ষরে মুদ্রিত :

‘মহামান্য আর্চডিউক, হিজ ইম্পিয়রিয়াল হাইনেস,
জেনারেলিসিমো ডন ফানলার, বীরেন্দ্রকেশরী,
বিএ, বিএমএস, পিসিপি, কাব্যতীর্থ, ডি লিট, এমআরসিপিএস।

ডন ফানলার নাম আমার, যে-আমি রাজা রাজন্যবর্গের,
আমার কীর্তিসমূহ দ্যাখো, অহে বীর, ত্যাজো ভূষণ গর্বের!’৬২

‘মহামান্য আর্চডিউক এ-মুহূর্তে কী করছেন বলো তো?” ফুল্লরা ধাঁধা দেন।

‘আপন রুহের মাগফেরাত কামনা করছেন,’ কালকেতু বলেন, ‘কেননা কালই তাঁকে আততায়ীর হাতে মরতে হবে। সো ইজ ইট রিটন, সো শ্যাল ইট বি ডান।’

‘তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী কে জানো?” ফুল্লরা আবার ধাঁধা দেন। ‘এখন কেউ নেই, একমাত্র কন্যা কিছুদিন আগে অবীরা-অবস্থায় ইন্তেকাল করায়,’ কালকেতু বলেন।

ফুল্লরা হেসে বলেন, ‘তুমি মানকচু জানো। ডন ফানলারের একমাত্র উত্তরাধিকারী, বা কারিণী, ভিখারিনি জনা।’

‘লিটনের বরাত!” কালকেতু বলেন, ‘তোমার—বা আমার—অর্থাৎ আমাদের, আংটিটা পলাশীর আমবাগানে মারা গেল।

ফুল্লরা ছড়া কাটেন :

‘আদেখলের আংটি হ’ল,
দেখতে দেখতে প্ৰাণটি গেল।’

২২.

দেখতে-দেখতে সম্মুখে গহন বন। গণ্ডবন। প্রাগুলিখিত, সুন্দরবনের অন্যতম তোগলকি স্ট্রিপ। স্ট্রিপ-পথে তাঁরা শর্টকাট মারবেন ব’লে ধারণা হয়। কিন্তু সামনে দু’টি বনপথ। একটি, সরকারি বুশ-ওঅক, ইট-বিছানো। অপরটি, প্রায় কোনওরূপ পথচিহ্নহীন। কপট পাঠক, তুমি বলতে পারো, কোন পথটি তাঁরা নেবেন? আমি জানি তুমি জানো না। কিন্তু কালকেতু জানেন। তিনি বলেন, ‘আই শ্যাল টেক দ্য ওয়ান লেস ট্র্যাভেল্ড বায়।’৬৩ এবং তাঁরা দুর্গম বনপথে চলতে শুরু করেন।

একটা বেতসকুঞ্জের সামনে ফুল্লরা দাঁড়ান এবং বলেন, ‘কালকেতু, মাই স্লেভ, আমাকে একটা বেতফল ছিঁড়ে এনে দাও, আমার চোখের সঙ্গে মিলিয়ে দেখব।’

কালকেতু বলেন, ‘বাতুল হয়েছো? বেতুলের তুলনায় প্রিকলি-পেয়ার আহরণ ঢের সহজ।’

এই-না শুনে ফুল্লরা গা’ন :

‘Here we go round the prickly pear
Prickly pear prickly pear
Here we go round the prickly pear
At two o’clock in the morning.’[৬৪]

‘একটা সিগরেট হবে কি?’ গান থামিয়ে শুধান ফুল্লরা।

‘তোমার ব্র্যান্ড তো জানি না,’ কালকেতু পকেট হাতড়ে একটা আধ-ফোঁকা গোল্ডলিফ বা’র করেন—’এতে চলবে কি?’

ফুল্লরা হাসেন—’এটা আমার ব্র্যান্ড অবশ্য না। আমার ব্র্যান্ড খুব কড়া। তার ধোঁয়া এত ঘন, যে, তা প্রায় তরল। কিন্তু বিপদে পড়লে বাঘেও তো ঘাস খায়।’

‘ঘাস পায় কোথায় সেটা অবশ্য এক রহস্য—সুন্দরবনে তো ঘাস হবার কথা না,’ ফুল্লরার ঠোঁটে (বা, ঠোঁটের) সিগারেট, দু’টি ছোট্ট চকমকি পাথর ঠুকে-ঠুকে ধরিয়ে দিতে-দিতে কালকেতু বলেন।

এক ফুসফুস ধোঁয়া ছেড়ে ফুল্লরা তখন—’তুমি এত পাগলামি কেন করো বলো তো? উইল য়্যু নেভার এভার গ্রো আপ?’

কালকেতু বলেন, ‘যথা?”

‘যথা ভবানন্দর গাড়ির ফ্যুয়ল-ট্যাংকে চিনি ঢালবার ভীতি প্রদর্শন—’

‘হোয়াট!’ কালকেতু চমকান।

‘কেন, পান্থশালার চেয়ার-টেবিলও জানে,’ ফুল্লরা বলেন। ‘অপিচ, ‘ ফুল্লরা পুনশ্চ—’অদুনা-পদুনাকে প্রেমপত্র।

কালকেতু হো হো হাসেন—’সেটা ছিল আমার তপস্যার দ্বিতীয় বছর। দু’বোনকেই আমি পড়াতাম। তো মেয়েরা সবাই এসেনশিয়ালি একই বস্তু কিনা জানবার জন্যে, এবং জীবনের প্রথমতম প্রেমপত্র লেখার অভিজ্ঞতার জন্যে, দু’জনকেই লিখেছিলাম হুবহু পত্র—“সুচরিতাসু…” ইত্যাদি।’

‘তো কী জানতে পেলে?”

‘জানতে পেলাম, যে, মেয়েরা সবাই একই, কেননা দু’জনেই আমাকে রমণায় আসতে বলল, একই দিন, একই সময়। গিয়ে, সেখানে তাদের ভাই- বেরাদরদের হাতে মার খেয়ে এলাম। পরে অবশ্য দু’জনেই ক্ষমা চেয়ে খৎ দিল, এবং আবারও একই দিনে ও ক্ষণে রমণায় দাওয়াত দিল।’

‘গেলে?’

‘আমার দু’জন বেৎ-নোয়ার বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলাম সেদিন—তারাই পরে ওদেরকে সাঙ্গা ক’রে,’ কালকেতু বলেন।

‘আর কাজের মেয়ে তরঙ্গিণী?’ ফুল্লরা জেরা চালিয়ে যান।

‘দ্যাখো, আমার ব্রহ্মচর্যর তখন চতুর্থ বৎসর,’ কালকেতু জানান।

‘তাই ব’লে তার বুকে হাত?’

‘একই কাজ গান্ধীজি করলে তা “এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ”, আর কালকেতু করলে লুচ্চামি, তাই না?’ অভিমানে বলেন কালকেতু।

কাল যায়। আকাশে কালপুরুষ, তাঁর পায়ের কাছে লুব্ধককে নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। নীচে ফুল্লরা, কালকেতুকে নিয়ে। তাঁরা (কালকেতু ও ফুল্লরা) গা’ন :

‘Starry starry night
Portraits hung in empty halls,
Frame-less head on name-less walls
with eyes that watch the world and can’t forget…’ [৬৫]

‘জানো,’ কালকেতু বলেন, ‘কতদিন-যে আমি নিজেকে ভ্যান গখ ভেবে চিঠি লিখেছি থিও-র কাছে :

ভাই থিও,

তোমার পাঠানো নেক্টারিনগুলি অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছিল। অমি অবশ্য একটাই-মাত্র খেতে পেরেছি। বাসায় ফেরার আগেই বাকিগুলোকে সাবড়ে দিয়েছে শালা পল (গোগ্যাঁ—ওকে তো জানো)। উপস্থিত আমার হাত খালি। অচিরাৎ হাজার-খানেক ফ্রাঁ পাঠিয়ে উদ্ধার কোরো। ভালো কথা, একটা গোপন সত্য তোমার কাছে ফাঁস করি কাউকে বোলো না— মনে-র ছবি আমার সত্যিই ভালো লাগে না। ইতি।
তোমার ভিনসেন্ট।

নিজের হাত খালি হ’লেই আমার ভ্যান গখকে মনে প’ড়ে, মনে হয়, থিও-র মতো একটা ভাই থাকত যদি। একদিন বড়বাবুকেই লিখলাম শ’পাঁচেক টাকা পাঠাতে। তিনি উত্তর দিলেন, যে, আমি তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা করতে রাজি থাকলে, আমার জানাজার যাবতীয় খরচ তিনি বহন করবেন, তাতে পাঁচশ’ লাগুক কিংবা পাঁচ-হাজার।’

ফুল্লরা হাসেন—’আমার কিন্তু মনে হয় বড়ুবাবু তোমাকে বেশ স্নেহই করেন।’

‘তাই নাকি? তা আর কে-কে স্নেহ করেন আমায়?’ কালকেতু শুধান। ‘সব্বাই,’ ফুল্লরা বলেন, ‘এমনকি ভবানন্দও।’ তারপর বলেন, “তবে আমার মনে হয়, কী কারণে জানি না, সবচেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসেন সম্রাট্ ইসপ।’

‘তিনি তো সবা’কেই ভালোবাসেন,’ কালকেতু বলেন।

‘তা-ও ঠিক। তবে একদিন পান্থশালায় এসে তিনি আমায় শাসিয়ে গেলেন জানো? বললেন, ইস্তেক্রায় আমাকে দরকার না-হ’লে, আমাকে ডাইন ঘোষণা ক’রে তিনি পুড়িয়ে মারতেন। আর আমার কী-যে ভালো লাগল – কী সুন্দর মানুষ তিনি যে, কী সুন্দর!’

কালকেতু সম্রাট্ ইসপের চিন্তায় এমন মশগুল হ’য়ে যান, যে, কিয়ৎকালের জন্য বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত তাঁর হয়। ফুল্লরার অন্তিম কথাগুলিও তিনি শোনেন কিনা বলা যায় না। আপন মনোভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি সগৌরবে সালাম জানান তাঁর সম্রাট্-কে।

ইসপ ঘুমের ভিতরে সেই সালাম গ্রহণ করেন, ঘুমের ভিতরে ডেকে ওঠেন—’ইৎ্যুৎ! ইৎৎ!’ তারপর হঠাৎ উঠে বসেন শয্যায়,—’ইৎৎ! ইৎ!’—ডেকে তোলেন পার্শ্ববর্তিনীকে।

সম্রাজ্ঞী উঠে বলেন, ‘রাজা!’

‘তোমার দুঃখ এবার ঘুচবে দেখো, তোমার কোল ভরবে,’ বলেন সম্রাট্।

তারপর তিনি ইৎতের কোলে মাথা রেখে আবার ঘুমিয়ে পড়েন।

সম্রাজ্ঞী, সম্রাটের ঘুমন্ত মুখের পানে তাকিয়ে সম্মোহিত হ’ন। ঘোর- লাগা গলায় ব’লে তিনি চলেন, ‘আমার কোল এমনিতেই ভরে আছে, রাজা, আমার রাজা! আমার কোল ভরে গেছে, আমি ভরে গেছি, ব্রহ্মাণ্ড ভরে গেছে, রাজা!’

তাঁর অমূল্য অশ্রুধারায় শনৈ শনৈ অভিষিক্ত হ’তে থাকেন ঘুমন্ত সম্রাট্

২৩.

ফকিরাপুল ঝুলসেতু পেরুতে-পেরুতে ফুল্লরা বলেন, ‘সম্রাট ইসপের সবকিছু জানতে ইচ্ছা আমার ক’রে, তুমি জানো?”

কালকেতু, ইসপের এইরূপ ইতিহাস বলেন :

ইতিহাসের শুরু সিন্ধুনদতীরে। সেই আদিযুগে, ইয়োরাপীয়রা, মায় গ্রিকরা, তখনও হোমো-হ্যাবিলিস-পর্যায়ভূত, সিন্ধুর দুই তীরে দু’টি সুসভ্য জাতির বাস ছিল। পশ্চিমতীরে ‘ইন্নায়িন্নিয়ুল’, এবং পূর্বতীরে ‘নায়কঃ”। প্রথমটির সার্বভৌম রাজ্ঞী ইব্বা, এবং দ্বিতীয়টির রাজা অস্তিনাগ। ইব্বা-যে নিশ্চিতভাবেই বাইবেল-কথিত ইভা, বা ইভ, বা হহ্বা, বা হাওয়া, তা নৃতাত্ত্বিক রোমান ওয়াংচুক-এর আমরণ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।

ভাষা-দার্শনিক জি সি স্পিভাক আবার প্রমাণ করেন, যে, অস্তিনাগই আদিতম মানবরূপে কথিত আদম (অস্তিনাগ> অখিনা> অদ্দিমা> আদিম> আদম)। শ্রীমতী স্পিভাক এমতো ইঙ্গিতও দেন, যে, ইব্বা এবং তাঁর প্রজাপুঞ্জ ছিলেন প্রাকশামী (Proto-Semetic), এবং অস্তিনাগ-সহ নায়ন্নকঃ জাতি, প্রাগার্য (Proto-Aryan)।

কিন্তু এরূপ ইঙ্গিতে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা ও তর্কবিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। শান্তির জন্য শ্রীমতী স্পিভাককে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হ’লেও, বিশ্বের নানা স্থানে অশান্তি বেড়েই চ’লে। তালিবান সরকার তাঁর (স্পিভাকের) জিহ্বা কর্তনের জন্য মূল্য ঘোষণা ক’রে, অন্যদিকে বজ্রং অন্তঃসরকার তাঁকে জীবন্ত চিতায় জ্বালানোর রায় দেয়।

এমনকি অস্তিনাগের নাম নিয়ে আর্যাবর্তে এবং নানা ম্লেচ্ছাবর্তে পণ্ডিতদিগের মধ্যে অনেককাল টিকি-ছেঁড়াছিঁড়ি চ’লে। আচার্য শঙ্কর প্রথমেই বলেন, যে, অস্তিনাগ নয়, নামটি হবে ‘হস্তিনাগ’। রাজনীতিক বালগঙ্গাধর টিলক এই মতের বিরোধিতা ক’রে বলেন, যে, হস্তী এবং নাগ উভয়েরই অর্থ হাতি, এবং হাতি-হাতি কোনও মানুষের নাম হতেই পারে না। অনন্তর তিনি নিজমত জানিয়ে বলেন যে, নামটি হবে ‘অস্থিনাগ’, অর্থাৎ নাগাস্থি, আইভরি।

শ্রীশঙ্কর, আপন সাকরেদের সমালোচনায় কুপিত হ’য়ে জানান যে, গুরু- মারা বিদ্যেয় গুরু নয়, শিষ্যই শেষপর্যন্ত মরে। তিনি আরও জানান, হস্তিনাগ শব্দটিকে ‘হস্তী+নাগ’ এইরূপে না-ভেঙে ‘হস্তিনা+গ’ এইরূপে ভাঙতে হবে, ফলে তার মানে দাঁড়াবে, ‘হস্তিনাগামী’; ফলে এও প্রমাণিত হবে, যে, হস্তিনা নগরী পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীনতম।

পক্ষান্তরে জর্মন পণ্ডিত মোক্ষমূলর তাঁর গবেষণা উজাড় ক’রে জানান, যে, নামটি, নিশ্চিতভাবেই, ‘অস্থির নাগ’, মানে কিনা মত্ত হাতি। তিনি চণ্ডীমঙ্গল গ্রন্থ থেকে উদাহরণ দিয়ে জানান, যে, ভারতবর্ষে পুরুষদেরকে হাতি, বা মত্ত হাতির সঙ্গে তুলনা করার একটা রেওয়াজ আছে, যথা :

‘দিনে দিনে বাড়ে কালকেতু।
জিনিয়া মাতঙ্গগতি        যেন নব রতিপতি
সভার লোচনসুখ-হেতু।।’[৬৬]

আর, তাছাড়া, (মোক্ষমূলর জানান) নারীদের হাতির সঙ্গে তুলনা করা তো ভারতীয় কবি/অকবিদের একটা সনাতন বদ-অভ্যাস, যথা: ‘হস্তিনী নারী’, ‘গজেন্দ্রগামিনী’, ইত্যাদি ইত্যাদি।

(এখন ফুল্লরা, কালকেতুকে একটু সংক্ষেপে বলতে অনুরোধেন।)

তো এই ইব্বা এবং অস্তিনাগ স্ব-স্ব-রাজ্য শাসন ক’রে আসছিলেন- হ্যাড বিন রুলিং হ্যাপিলি এভার বিফোর—একদা কী করিয়া মিলন হ’ল দোঁহে, কী ছিল বিধাতার মনে, সিন্ধুতে সাঁতরাচ্ছিলেন দু’জনে, নিজ-নিজ পারের দিকে। সহসা, কোনও অকারণে, অস্তিনাগ, নদীর মাঝামাঝি নিউট্রাল টেরিটরিতে গিয়ে একটা দহে প’ড়ে ডুবে যান এবং ইব্বা তা দেখতে পেয়ে ডুবসাঁতার দিয়ে তাঁকে রেস্ক্যু করেন।

পরে অস্তিনাগ, ইব্বার আতিথ্য ও পরিচর্যায় বারো বৎসর কাটান। সে- সময় তাঁদের ছয় পুত্র ও ছয় কন্যা ভূমিষ্ঠ হয়। পরে, সিন্ধুর বন্যার অত্যাচারে ইন্নায়িন্নিয়ুল জাতি পশ্চিমে, এবং নায়ন্নকঃ জাতি পূর্বদিকে ছড়িয়ে প’ড়ে, এবং ইব্বা ও অস্তিনাগের পুত্রগণ উভয় জাতির বিভিন্ন অংশকে শাসন করেন। এই রাজবংশের বিখ্যাত নৃপতিবর্গের মধ্যে ছিলেন মিনোস, সলোমন, হাম্মুরাবি, আলেকজান্ডার, অশোক, এবং শশাঙ্ক। শশাঙ্করই সরাসরি উত্তরপুরুষ সম্রাট্ ইসপ, ইব্বা-অস্তিনাগের শেষ বংশধর, মানুষের মনোভূমিতে যাঁর রাজত্ব।

‘ইসপের ঠিকুজি-কুলজিতে আমার অনাগ্রহ,’ ফুল্লরা বলেন, ‘আমি জানতে চাচ্ছিলাম তাঁর নিজের সম্বন্ধে—মানুষটিকে।’

‘কী আশ্চর্য! মানুষটি কে তুমি জানো না?’ কালকেতু বলেন।

ফুল্লরা হাসেন। ফুল্লরা আঙুল মটকান। ফুল্লরা, পথ-চলতি, একটা ঘাসের গোড়া উৎপাটন করেন। তা চর্বণ করেন। তিনি খুশি হ’ন। ব্যালে-নর্তকীর ভঙ্গিতে এক-পাক ঘোরেন। গা’ন—’আজি যে-রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে?’

কালকেতু কিছু অন্যমনস্ক হ’ন। কী যেন আছে বলার, কিন্তু মনে পড়ছে না এখন, তারপর, ‘ফুল্লরা, আমি তোমার কে?’—এই কথা জিজ্ঞাসা করেন, এত আলতোভাবে যে, মনে হয়, তিনি জিজ্ঞাসা করেন নাই, বা করলেও, রক্তমাংসের এই ফুল্লরাকে করেন নাই, বা হয়তো ঠিক এই প্রশ্নটিই তাঁর জিজ্ঞাস্য ছিল না, কিংবা এই প্রশ্নটিকে, এটিই মূল প্রশ্নটি কিনা এটা পরখ করবার জন্যেই ছাড়া হয়েছে। ফুল্লরা কাজেই তাতে কর্ণপাত না-ক’রে গান গেয়ে চলেন—’ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর? যদি যেতে হ’ল হায়, প্রাণ কেন চায় পিছে আর?’

তারপর, যেন খুঁজে-ফিরতে-থাকা কথাটা এই পড়ল মনে, কালকেতু, ফুল্লরাকে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলেন, ‘ফুল্লরা, আমি তোমার কে?’

ফুল্লরা কিয়ৎক্ষণ কালকেতুর মুখে কিছু খোঁজেন, চোখে, নাকে, ঠোঁটে—কী বুঝি বুঝে নিতে চান, হয়তো হিসাব কোনও কষেন, এবং নীরব রহেন।

কালকেতু আবার শুধান, ‘আমি তোমার কে?’ আবার শুধান, ‘আমি তোমার কে?’ আবার, ‘আমি তোমার কে?

ফুল্লরা, কালকেতুর মুখ চেপে ধরেন, কোনও একটি অন্ধকারের দিকে তাকান, অন্ধকারের আত্মার ভিতরে তাকান, আর শোনো! তিনি বলেন –

‘হ্যাঁ।’

ফুল্লরা এই কথা বলা-মাত্র, এক অকস্মাৎ ভূমিকম্পে শিউরে ওঠে ঢাকা। প্রেমিক-যুগল পরস্পরকে প্রবল আঁকড়ে ধ’রে নিজেদের অধঃপতন রোধ করেন। কিন্তু তাঁদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে, অনেক-অনেক-পিছনে-ফেলে- আসা, মাতৃমূর্তি-ক্যাথিড্রালের সহস্রাব্দ-পুরাতন মিনারটি মুহূর্তে ভূলুণ্ঠিত হয়—এবং ক্যাথিড্রালে প্রার্থনারত কুমারীরা জন্মজন্মান্তরের প্রেমিকদের স্মৃতির ভিতরে চিরকালের জন্য আটকা প’ড়ে যায়…

২৪.

অরণ্যদৃশ্যের রহস্য আরও ঘনীভূত (হয়)। এই অংশটির নাম দণ্ডক। রাজ্যের বিচিত্র গাছগাছালি তথা পশুপাখির আস্তানা। প্রথমেই, তাদের বিচিত্র দুর্গন্ধের উপচারে, আপনাকে স্বাগত জানাবে রেফ্লিজিয়া—পৃথিবীর বৃহত্তম পুষ্প। এই ফুল নিশ্চয়ই মানুষের জন্যে ফোটে না; ফোটে, ফুটত, সম্ভবতঃ ডাইনোসরদের জন্যে—তাদের (ডাইনোসরদের) নাকে এই মেছো গন্ধ পছন্দেরই হবার কথা। ফুলগুলির চোখ-কান খোলা না-থাকায়, ডাইনোসরদের বিলুপ্তি এরা টের পায় নাই সম্ভবপরতঃ।

‘জীবন্ত ফসিল,’ ফুল্লরা বলেন।

‘বনের এই অংশে বনরুই-ছাড়া অন্য কোনও প্রাণী বাস ক’রে না, ‘ জানান কালকেতু—’কেননা, স্থলচরদের মধ্যে একমাত্র তাদেরই, আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে রয়েছে জড়ায়ে। প্রথম প্রথম অবশ্য বিড়াল, উদবিড়াল, মাছরাঙারা উঁকিঝুঁকি দিত—কিন্তু এতদিনে, লকলক করিলেই সোনা হয় না বুঝে গিয়ে থাকবে।’

দু’জনে পরস্পরের নাক চেপে ধ’রে, পরস্পরের মুখে শ্বাস নিতে-নিতে (অর্থাৎ—পাছে মুখ দিয়ে পচা মাছের গন্ধ পশে, এই ভয়ে একে অপরের মুখে মুখ লাগিয়ে) অকুস্থল অতিক্রম করেন, এবং কায়ক্লেশে অদূরবর্তী লখ তিতিকাকার তীরে এসে উপনীত হ’ন।

এই হ্রদটির নামকরণ হয়, বলা বাহুল্য, বলিভিয়া-পেরুর তন্নামক হ্রদটির নামে, যে-হ্রদটি সম্ভবতঃ পৃথিবীর উচ্চতম। এই হ্রদটি অবশ্য পৃথিবীর নিম্নতম। এইটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উনিশশ’-সাতাশি ফুট নীচে অবস্থিত (গিনেস বুক অব রেকর্ডজ অবশ্য উনিশশ’-সাতাশি স্বীকার ক’রে না, যেহেতু, বুকটির ধারণা যে, বঙ্গোপসাগর, পৃথিবীর অন্যান্য সাগরসমূহের তুলনায়, কোনও অজানা কারণে, উচ্চতর)। ফলতঃ হ্রদটির পানি এত ঘন, যে এটি পায়ে হেঁটেই পেরোনো চ’লে; তদুপরি, লখ-বক্ষে অগণিত অ্যামাজন লিলি। এই বিশেষ গুণটির (মানে, পায়ে হেঁটে পেরোনোর ব্যাপারটির) কারণে কেউ-কেউ একে ‘ডেড সি’, কেউ-বা ‘গালিলি সাগর’ ব’লে থাকে। শেষোক্ত নামটির সূত্রের জন্য দ্য হোলি বাইবেল (‘নূতন সন্ধি’) পশ্য।

তিতিকাকার পানিতে ফুল্লরা কিছুকাল ফিগার-স্কেটিং করেন, এবং এক আচাভুয়া খোনা কণ্ঠে গান :

‘Pull out his eyes,
Apologize,
Apologize,
Pull out his eyes.’[৬৭]

হ্রদের ধারে ফুটে আছে কোটি-কোটি অ্যানিমোনি, অ্যাডনিসের রক্তে ছোপানো। দয়িতযুগল সেই অভাবনীয় সমারোহে এমন বিহ্বল হ’ন, যে, তাঁরা বেমালুম ভুলে যান, যে, ধরণীর এই কোণে, এই লঙ্গিট্যুড-ল্যাটিট্যুড কিংবা অল্টিট্যুডে, এই পুষ্প ফোটার কথা নয়; এবং উপরন্তু, এটা এই পুষ্প ফোটার মরশুমও নয়; এবং অধিকন্তু, এই ফুলগুলি বলতেকি ড্যাফোডিলও হ’তে পারে, অথবা ফ্ল্যর দ্য লি, যদিও সেসব পুষ্পেরও ফোটার উপযুক্ত স্থান এটা নয়—সর্বোপরি, ফুলগুলির বর্ণ-যে লাল, তাও এই কাজল-অন্ধকারে বুঝতে পারা উচিত নয়।

আবার সেই দুর্গম বনস্থলী-পথে তাঁরা ধাবমান হ’ন। নানা দিক্ হ’তে নানা প্রকারের অ্যাফ্রডিজিয়াক পরিমল উড়ে এসে তাঁদের নাসারন্ধ্রে মধুর সুড়সুড়ি দেয়। কালকেতু আরামদায়ক হাঁচেন, বলেন, ‘আহা!” তারপর বলেন, ‘বহু যুগের বহু তপস্যার ওপার থেকে আবার যেন উড়ে আসে সে—ঐ আসে ঐ আসে ভৈরব রভসে!’ অতঃপর ফুল্লরার চোখে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ ক’রে—’লাভ!’

‘লাভ নাই,’ ফুল্লরা বলেন, ‘তাছাড়া, তুমি পর-পুরুষ।’

‘এ-সব কাম তো পর-পুরুষেরই সঙ্গে হবার—রক্তসম্পর্ক নেই যার সঙ্গে,’ কালকেতু বলেন।

ফুল্লরা তাঁর (মাথার) একটা চুল ছিঁড়ে সযতনে নিজ নাকে ঢুকিয়ে কিয়ৎক্ষণ ঘোরানোর পর একটা মেয়েমানুষানুচিত দানবিক হাঁচি ফাটিয়ে বলেন, ‘না গো, কালকেতু। আমার যৌবনযাত্রা শুরু হয়েছিল নিজ-পুরুষদেরই হাতে। আমার রতন মামা নাম্বার ওয়ান, মাখন মামা টু, তস্য পুত্র লিখন থ্রি… আর ভবানন্দ-যে একভাবে আমার ভাতিজা, তা তো বলেইছি।’

‘গল্প শুনতে বাসনা হয়,’ কালকেতু আবদারেন।

ফুল্লরা ধরেন—’রতন মামা ছিলেন দেখনহাসি। তাঁর আশেপাশে লোকজন কেবলই হাসত, কেবলই কাশত। বিন্দুমাত্র মজা তিনি করলে, হিহি-র জ্বালায় ঢেঁকা হ’ত দায়। মজা না-করলে হোহো। প্রকৃত প্রস্তাবে, জীবনানন্দের সুবিনয় মুস্তফির পর তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, যিনি একই সঙ্গে বিড়াল, এবং তার মুখস্থ, বা উদরস্থ, ইঁদুরকে হাসাতে সক্ষম ছিলেন। তাঁর মায়ের, মানে আমার দিদার, মৃত্যু-সংবাদ দিতে এলেন যখন বড়মামা, তখন রতন মামার কান্না দেখে বড়মামা হাসতে-হাসতে অজ্ঞান হ’য়ে যান। বস্তুতঃ, আপন মায়ের মৃত্যুশোকে কাঁদবার সুবিধা করবার জন্য মা, রতন মামাকে ঐ অবস্থাতেই বাড়ি থেকে বা’র ক’রে দেয়—এমনকি অন্ত্যেষ্টিতে তাঁর অংশগ্রহণ রহিত করেন বড়মামা। ‘

‘এ-সব কী বলছো!’ কালকেতু হতবাক্’হাসির গল্প, বা “হাসির” গল্প কে শুনতে চেয়েছে?’

ফুল্লরা হাসেন। ‘রতন মামা একদিন ঘরে কেউ নেই দেখে হাসতে-হাসতে, এবং হাসাতে-হাসাতে, আমাকে করেন—আমার বয়স তখন তেরো।’

‘অ্যাঁ!’ আঁতকান কালকেতু।

‘তারপর আমার পনেরো পর্যন্ত আমার দেহভুবন, আমার মাইক্রোকজম, ছিল রতনময়, বা হাস্যময়। এর পরেই অবশ্য দাস্য শুরু হয়, যখন একদিন গ্রামে নানাবাড়ির পুকুর-পাড়ে, হোগলা-ঝোপে, আমাদের “মিথস্ক্রিয়া” মাখন মামার দৃষ্টিগোচর হয়।

জিরোন ফুল্লরা খানিক। তারপর একটা হেরোইনখোর-মার্কা দীর্ঘ দম নিয়ে ফের—’মাখন মামাকেই বলা যায় “আ পারফেক্ট স্পেসিমেন অব পদ্মলোচন-নামক কানা ছেলে”। যেমন, প্রথমতঃ তিনি ছিলেন খুনে। জমিজমা-সঙ্ক্রান্ত মামলা-টামলা প্রায়শঃ তিনি খুন-টুন ক’রে সামলাতেন। তাঁর হামলার ভয়ে সাপে নেউলে এক ঘাটে জল খেত। দ্বিতীয়তঃ তিনি নিজে ছিলেন অতিশয় অরসিক। তাঁকে ছাড়া আর কাউকে আমি, আপন পঞ্চদশী রূপসী ভাগ্নিকে অমন খেঁকিয়ে ধমকাতে দেখি নাই। যা হোক, তিনি পত্রপাঠ রতন মামাকে একটা লাথি মেরে পুকুরে ফেলে দেন, এবং বিনাবাক্যে আমার পিছনে ভর করেন (কেননা, তিনি মনে করতেন, যে, নারী ও কুক্কুরী একই শ্রেণির প্রাণী, এবং একই ধরনের ব্যবহার উভয়ের প্রাপ্য)। তারপর থেকে, মামলাবাজির জন্যে ঢাকায় হাজির হ’লেই, নানা অজায়গায় … একবার একটা বেবিট্যাক্সির ভিতরে (আমাকে চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছিলেন), এক হাতে চালকের গলায় ছুরি ধ’রে রেখেই, রোকেয়া সরণিতে…’

কালকেতু বলেন, ‘আসল জায়গাগুলিতে এলিপসিস দিচ্ছো কেন?’

ফুল্লরা বাতান, ‘এই দুই বিপরীতধর্মী মামা, আমার জীবনে একটা এলিপসিসের মতো। দু’জনকে একসঙ্গে একদিন পাওয়া যায়—একটা বস্তার ভিতরে, বটি-করা—কপোতাক্ষ-তীরে।

‘আই অ্যাম সরি,’ কালকেতু বলেন।

‘কিন্তু আই অ্যাম নট,’ ফুল্লরা সহজভাবেই বলেন, ‘এদের দু’জনেরই ভাঁড়ার হয়েছিল নিঃশেষিত। দেবার কিছু ছিল না আর পৃথিবীকে, আমাকে ছিল না কিছু নেবারও। মরবার আগে—রতন মামার হাসানোর, এবং মাখন মামার খুন করবার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছিল। তাঁদের সমস্ত পাৰ্থক্য-চিহ্ন লুপ্ত হয়েছিল, এমনকি আমার শরীরের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশগুলির কাছেও।’

কালকেতু সন্তপ্ত কণ্ঠে তবু বলেন, ‘ফুল্লরা, এসো আমরা তবে… জাস্ট ফর আ রিফ্রেশমেন্ট।

ফুল্লরা, কালকেতুকে বিরমানন্দিত ক’রে, কবুল করেন। ধীরে ধীরে আপনাকে অনাবৃত করেন তিনি। এত ধীরে, যে, বুঝি তাঁর আপন শরীরও পায় না টেরটি—হাওয়া অবধি যেন লাগে না আদুড় গায়ে।

ঘটনাটা প্রকৃতই ঘটমান, বুঝতে সময় লাগে কালকেতুর। তারপর, হঠাৎ-চৈতন্যোদয়ে, তিনি রকেট-বেগে প্যান্ট খুলতে লাগেন, সেরে ফেলতে চান… ফুল্লরা মত বদলানোর আগেই—প্যান্ট কিন্তু জুতায় আটকে যায়।

‘ওয়ান্ট মি টু গিভ য়্যু আ হ্যান্ড?’ একটা অশোকতরুর আড়াল থেকে প্রশ্নটা আসে, একটা রাত-জাগার সিগারেটের মতো।

কালকেতু জটিল গলায় বলেন, ‘আপনি আবার! এখানেও!”

বেরিয়ে আসেন মুজ লে হুডিন—’রাতের শেষ যামে এখানেই আমার ডিউটি। বাঘ-ভাল্লুকদের পাহারা দেওয়ার।’

কালকেতু তেতে উঠে ‘শালা’ বললে-পর মুজ লে শুধরে দেন—’মাইন্ড ইয়োর ভোক্যাব, ডিয়ার স্যর। সম্বন্ধে আমি আপনার সম্বন্ধী বটি।’

কালকেতুর, স্বীয় জুতা-প্যান্ট নিয়ে কিছুকাল অবিমৃশ্যকারী ধস্তাধস্তির পর ফুল্লরা বলেন, ‘ছোড়ো কালকেতু—বাদ দাও। ইনসেস্টের গল্পটাই রান করুক। (মুজ লে-কে) ভাইয়া, কাপড় খোলো।’

মুজ লে বিমর্ষ হ’য়ে বলেন, ‘কী বলছিস এ-সব! আমার কি… আমার কি…’

‘তোমার কি?” ফুল্লরা শুধান।

মুজ লে তাঁর বাক্য শেষ করেন——’সে-বয়স আর আছে? সে-খ্যামতা?’

ফুল্লরা অভয় দেন—’তোমাকে কিচ্ছুটি করতে হবে না নে—ব্যাপারটি গোটাগুটি আমিই সামলাব।’ তারপর হঠাৎ রক্ত-চ’ক্ষে হুকুম করেন, ‘কাপড়া উতারো!”

মুজ লে কাজেই, বাধ্য বৃদ্ধের মতো, তাঁর জামা কাপড় জুতা মোজা খুলে কালকেতুর হাতে দিয়ে, একবার নক্ষত্রের পানে, একবার ফুল্লরার পানে তাকিয়ে, শুয়ে পড়েন। কালকেতু রাগে-দুঃখে একটা শমী গাছের দু’টো ডাল ভেঙে এনে ঘ’ষে-ঘ’ষে মুজ লে-র কাপড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেন। মুজ লে কিন্তু প্রতিবাদ করবার অবস্থায় মোটে নেই, কেননা ফুল্লরা তাঁর বুকে বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে তখন পড়েছেন এবং তাঁর (ফুল্লরার, নিজের) অপ্রমেয় যৌন ক্রোধ, দেহের তাবৎ স্ল্যুস-গেট খুলে উজাড় করছেন বেচারার মরা-পদ্মায়…

ফুল্লরার উচ্চাবচে ইথারে বিচিত্র সব তরঙ্গ ওঠে, বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির তাদের একেকটি, একেক ধরনের প্রাণীর ইয়ার-ড্রামে দ্রিমিকি তোলে। ফলতঃ পুরোটা বনে যত ছিল ইঁদুর বাদুড় হেলে-সাপ কেঁচো কেন্নো বাঘ ভালুক ব্যাকটিরিয়া ভাইরাস, তাদের সকলেরই সহধর্মিণীরা নিমিষেই গর্ভবতী হয়। শুধু একটিমাত্র প্রাণী, কালকেতু—অভাগা কালকেতু!—সহধর্মিণীর অভাবে, আপন দক্ষিণ-হস্তের দ্বারস্থ হ’ন।

মিনিট পনেরো পরে তিনিই অবশ্য ফুল্লরাকে টেনে ওঠান—’ছোড়ো ফুল্লরা, টেঁসে যাবে।’

ফুল্লরা ধাতব চোয়ালে উঠে দাঁড়ানোর পরেই কালকেতু, মুজ লে-র রক্তাক্ত, থ্যাঁতলানো দেহটিকে দেখতে পান; তিনি বলেন, ‘এর বাপের সাধ্যি নয় আর একে শনাক্ত ক’রে; কাজেই অয়ি ফুল্লরে, চলো ফুটি।’

ফুল্লরা তখন শিস বাজিয়ে ‘আম্মা দেখ দেখ তেরা মুণ্ডা বিগড়া যায়’ গাইতে গাইতে শাড়ি-সায়া ইত্যাদি প’রে নিয়ে, কালকেতুর প্যান্টটা টেনে তুলে দিতে-দিতে বলেন, ‘ভালো কথা, কালকেতু, তুমি আন্ডারওয়ার পরো না?’

(ভবিষ্যৎ পাঠকের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, মুজ লে হুডিনের এই মৃত্যুস্থানটিকেই ভবিষ্যতে লোকে উদম বাবার মাজার হিসাবে জানবে, এবং সেটা তিনি উলঙ্গ অবস্থায় মারা যাওয়ার কারণেই শুধু নয়, বরং সরকারের, তাঁর কবরে ইউডিএম, অর্থাৎ ‘আনআইডেন্টিফায়েড ডেড ম্যান’, লিপিবদ্ধ করবার কারণেও। )

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *