কালকেতু ও ফুল্লরা – ১৫

১৫.

হেমিং ওয়ে, বা হেমিংওয়ে ওয়ে, নামক কানাগলিটি পার হ’য়ে দু’জনে এস্কালেটরে ভূগর্ভস্থ ক্যাটাকোমে নেমে যান।

এই ক্যাটাকোমটি ছিল আসলে একটি অন্তঃসলিলা খাল, যেটিকে তোগলক সরকার জল-নিষ্কাশনের মাধ্যমে ক্যাটাকোমে রূপান্তরিত ক’রে, এবং এর নামকরণ করেন স্বয়ং প্রেঃ তোগলক—লিম্বো। লিম্বো-পথে দু’জনে ধীরে অগ্রসর হ’ন। ভিতরে মৃত্যুগন্ধযুক্ত সোডিয়াম বাতি বিশ গজ দূরে-দূরে ভাতিমান। প্রাগৈতিহাসিক সোডিয়াম বাতির মাহাত্ম্য এই, যে এতে মানুষদেরকে ভূতের মতো দেখায়, ভূতদিগকে কীরূপ দেখায় তা অবশ্য এখনও বুঝতে পারা যায় নাই। ‘এই ক্যাটাকোমে ভূতেও ঢোকে না’—এই জনশ্রুতিটি সঠিক হ’য়ে থাকবে। তবে, লাশগুলিকে দেখাচ্ছে কিম্ভূত।

ক্যাটাকোমের উভয়পার্শ্বে সারি-সারি দণ্ডায়মান লাশ (পুনরুক্তবদাভাস?—সরি!), তাদের প্রত্যেকের মাথার উপর তাদের নামধাম বিবরণ লেখা রয়েছে ট্রান্সলুসেন্ট সেলুলয়েডের প্লেটে, লেজারাক্ষরে। এবড়ো- খেবড়ো মেঝেয়, দেয়ালে, সিলিঙে, অগণিত বিচিত্র ছায়ার কোলাহল। লাশেদের মৃত চোখে-চোখে সোডিয়ামের পোখরাজ-দ্যুতি।

‘সো মেনি!’ ফুল্লরা বলেন, ‘আই হ্যাড নট থট ডেথ হ্যাড আনডান সো মেনি!”

সোডিয়ামের অবাত্মনসোগোচর ভিন্নমাত্রিকতার ভিতর দিয়ে সূক্ষ্মশরীরিতাপ্রাপ্ত এগোন দু’জন।

কালকেতু বলেন :

‘নিরাপদ্ তাদের স্ফটিক-কুঠুরিতে
যাদের ছোঁয় না ভোর, আর
ছোঁয় না দুপুর—
পুনরুত্থানের নম্র সদস্যেরা ঘুমায় অগাধ
স্যাটিনের থাম তার,
পাথরের ছাদ।

‘হাল্কা হাসে হাওয়া
তাদের উপরে তার পেল্লায় কেল্লায়-
ভ্রমর বিড়বিড় ভনে নিরাসক্ত কানে,
মিষ্টি পাখিসব সাধে আসাধা গলায়
কী মহান সাধনা-যে নষ্ট এইখানে!’[৫৩]
ফুল্লরা বলেন :
‘নিরাপদ্ তাদের স্ফটিক-কুঠুরিতে—
যাদের ছোঁয় না ভোর,
ছোঁয় না দুপুর—
পুনরুত্থানের নম্র সদস্যেরা শুয়ে চিৎপাত—
স্যাটিনের থাম—আর পাথরের ছাদ!

‘শতবর্ষ অতিক্রান্ত তাদের উপরে—বাঁকা চাঁদে—
শতবিশ্ব সেচে চ’লে বুহিত তাদের
শত অন্তরিক্ষ বায় দাঁড়
শিরোপারা খসে পড়ে—নেতারা প্রণত হয় সবে—
তুষারের থালে—এক ফোঁটার মতন—সুনীরবে—‘[৫৪]

“08

গজ-চল্লিশেক পরে, দুদিকে দু’টি সুড়ঙ্গাকার সুড়ঙ্গ দেখা যায় – কালকেতু জানান, ‘একটা চ’লে গেছে ডিএমসি, এবং অপরটি পিজির মর্গে। লাশগুলিকে মর্গ থেকে সোজা এখানে চালান ক’রে দেওয়া হয়। অনেক সময়, পুরাপুরি-না-মরে-যাওয়া, অথচ ডাক্তাররা যাদেরকে ‘মৃত’ ঘোষণা ক’রে খালাস ক’রে দিয়েছে, তেমন দু’একজন এখানে এসে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় আর ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার ক’রে বাড়ির পথ ধ’রে।

‘সত্যি,’ ফুল্লরা বলেন, ‘এখানে না-এলে আজকের ষোল-আনাজ মাটি হ’ত।’

মেঝেয়, দেয়ালে, সিলিঙে অগণিত ছায়া ঐকমত্য জানিয়ে নড়ে।

জনৈক বৃহদায়তন লাশের সামনে এসে ফুল্লরা থামেন। এক সাক্ষাৎ কালাপাহাড়; পরনে, সকল বেনিআসহকলা-বরনের তকমা-সমেত, একজন সেনাপতির সবুজ উর্দি। তাঁর মাথার উপর দোঁহে পাঠ করেন :

বীর-বিক্রম জেনারেল তাপালিং (কুর দ্য লেয়)
ধূলিযুদ্ধ তথা বঙ্গ-ব্রহ্ম-বাগ্যুদ্ধের বীর সেনানী
জন্ম: (?), মৃত্যু: … ৮৮ (নৌকাডুবি)

কেনোত্তুঙ্গশিখাকলাপকপিলো বদ্ধঃ পটান্তে শিখী
পাশৈঃ কেন সদাগতেরগতিতা সদ্যঃ সমাসাদিতা।
কেনানেকপদানবাসিতসটঃ সিংহোপিতঃ পঞ্জরে
ভীমঃ কেন চ নৈকনক্রমকরো দোর্জ্যাং প্ৰতীর্ণোৰ্ণবঃ[৫৫]

ইত্যাদি। কালকেতু, তাপালিংকে একটা কেতাবি স্যালুট করেন, এবং ফুল্লরা কার্টসি করেন।

কালকেতু স্বগত ভনভনান—’হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান…’

ফুল্লরা আগে-আগে হেঁটে যেতে-যেতে হঠাৎ চিৎকার করেন, ‘কালকেতু! কালকেতু!”

কালকেতু বলেন, ‘কী? কী?’

‘শিগগির এসো!’

কালকেতু শিগগির আসবার পর ফুল্লরা তর্জনী তুলে একজন লাশকে দেখান—’দ্যাখো।’

কালকেতু দেখে বলেন, ‘সত্যিই সুপুরুষ। এমন সুগঠিত পুরুষ-দেহ আজকাল আর দেখা যায় না—হে মোর দুর্ভাগা দেশ!’

‘পুরুষ কী বলছো! এপিটাফটা পড়ো।’
কালকেতু পড়েন :
‘পশমিনা একা
দক্ষিণেশিয়ার দ্রুততমা মানবী
সরকার-কর্তৃক ‘জোয়ান অব সার্ক’ পদকে ভূষিতা
এশিয়াডে ব্রজ
সায়ানাইডে মৃত্যু
এসেছিলে তুমি
বসন্তের মতো মনোহর
প্রাবৃটের নবস্নিগ্ধ ঘনসম প্ৰিয় এসেছিলে তুমি
শুধু উজলিতে স্বর্গীয়
সুন্দর
কভু ভাবি মনে
তুমি নও সিত
ধরণীর
কোন সূর্যালোক হ’তে এসেছিলে নেমে
একবিন্দু কিরণ-শিশির
শুধু গাথা গীত
আলোক ও প্রেমে
লালিত ললিত
এক অমর স্বপনে…’ [৫৬]

‘একা কী সুন্দর নাম, না?’ ফুল্লরা শুধান।

‘এরাম দৈহিক স্ট্যাচারের রমণী-যে একা হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী। সাক্ষাৎ মিকেলাঞ্জেলোর ডেভিড। করিম আব্দুল জব্বর ছাড়া এর বর হ’তে পারে আর কে?

‘আচ্ছা?’ ফুল্লরা চটেন, ‘মেয়ে-মাত্রেরই হ’তে হবে রাফায়েলের ম্যাডোনা, তাই না?

‘তা না,’ কালকেতু বলেন, ‘মেয়েরা চাইলে মানের অলিম্পিয়াও হ’তে পারে, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ‘এ’-যে যে-কোনও দিক দিয়েই নারীত্বের অপমান। যেমন, এঁর বুকের পাটাটি দ্যাখো, পাটা শুধু এমন বুককেই বলা যায়—’  

‘বুক-পাছা-ছাড়া মন ওঠে না খোকাবাবুর,’ ফুল্লরা বলেন।

‘তা কী করব,’ কালকেতু কৈফিয়ত দেন, ‘বাসর-রাতে নববধূকে প্রেমালিঙ্গন দিতে গিয়ে যদি মনে হয় পাড়ার কসাই গফুরের সঙ্গে ঈদের কোলাকুলি করছি, তখন সেই পুণ্য রাখবার জায়গা কোথায়?”

দু’জনে কদম-কদম বাড়তে থাকেন। আরও গজ-সত্তর পরে, একজন উলঙ্গ লাশের সামনে দু’জনে যুগপৎ আঁতকে ওঠেন।

‘কালকেতু গো! এ-যে দেখি তোমার অ্যাল্টার ইগো!’ ফুল্লরা এক্সক্লেম করেন।

বস্তুতঃ কী চেহারা, কী আকৃতি—সকল বিষয়ে এত মিল তার (লাশের সঙ্গে কালকেতুর, যে, তিনি (কালকেতু) ঘন-ঘন আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিরীক্ষা করেন এবং আতঙ্কিত দীর্ঘহ্রস্ব নিঃশ্বাস মোচন করেন। লাশটির খুঁতের মধ্যে শুধু এই-যে তার চোখ-দু’টি ওপড়ানো, এবং তার মুষ্কভাণ্ড ও শিশুদণ্ডের কোনও চিহ্ন নেই—খুবই ধারালো কোনও শস্ত্রে, নিপুণ প্রযত্নে, ও-দু’টি বাড়তি বস্তুকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। দুঃস্বপ্নাতুর শিশুর মতো কালকেতু, সজোরে ফুল্লরাকে জড়িয়ে ধরেন, আর লাশের মাথার উপর ফুল্লরা পড়েন :

‘মানী’র রাখো মান

বাস, আর কিছু নেই। ফুল্লরা, লাশটিকে প্রণাম ক’রে, থরথরায়মান কালকেতুকে আদর করতে-করতেই এগিয়ে যান।

সহসা একটা প্রচ্ছায়ার ভিতর থেকে লাশাকৃতি এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ওঠে গেয়ে :

‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্ৰাণ,
তুমি করুণামৃতসিন্ধু, কর করুণাকণা দান।
শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণ-সম…’[৫৭]

ফুল্লরা ভিক্ষুককে বলেন, ‘বাবা, আপনাকে আলো, বা এখানকার মৃতদেরকে প্রাণ দেবার ক্ষমতা আমার নাই। ক্ষমতাটা অর্জন করবার পথে ছিলাম প্রায়—কিন্তু মধ্যে থেকে এই হারামজাদা সবকিছু ভেস্তে দিল। যা হোক, কালকেতু, পকেটে খুচরো থাকলে এঁকে দিতে আজ্ঞা হয়।’

কালকেতু বলেন, ‘ছাগল! আমার পকেটে পয়সা ঢুকেছে কবে, যে বেরুবে?’

ফুল্লরা চুকচুক ক’রে বলেন, ‘বাবা, দুঃখিত। আপনাকে খালি-হাতে ফেরাতেই হচ্ছে। তবে—’ ঈষৎ বঙ্কিম হাস্যে ফুল্লরা বলেন, “চাইলে আপনাকে একটা চুমু খেতে পারি।’ ব’লে, চাওয়ার তোয়াক্কা না-ক’রেই, ফুল্লরা, অন্ধ ভিক্ষুককে উন্মাদক চুমু খান।

আর দ্যাখো, ভিক্ষুকের সারা শরীর থির-থির কাঁপে, থর-থর কাঁপে, এবং দেখিতে-না-দেখিতে, চোখের সম্মুখেতে, তার গায়ের লোল চর্ম টান- টান হ’য়ে যায়, মাথার পলিত কেশ মেঘবর্ণ ধারণ ক’রে, প্রায়-অদৃশ্য মেট, শীতাবসানে গর্ত-থেকে-তড়াক-বেরিয়ে-আসা নবনির্মোকী অহিবৎ, প্ৰায় বারো-ইঞ্চি উজ্জিত হয়—এমনকি তার হাতের একতারাটি পর্যন্ত মুহূর্তে সেতারে বদলে যায়।

ফুল্লরা প্রফুল্লচিত্তে আবার চলতে শুরু করলে, পিছন থেকে ভিক্ষুকের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পান—’আমি তো ছিলাম জরাজীর্ণ, তুমি আমাকে নবযৌবন দান করলে—এখন আমি কী করতে পারি?’

তার অবিরল রোদনধ্বনিতে ক্যাটাকোমের বাতাস ভারি হ’য়ে আসে।

ফুল্লরা কিন্তু হাসতেই থাকেন, কালকেতু যদিও কাঁদতে শুরু করেন। তিনি (কালকেতু) বার-বার ঘুরে-ঘুরে, উন্মত্তবৎ রোরুদ্যমান ভিক্ষুকে অবলোকন করেন। সে (ভিক্ষুক) তখন টেনে-টেনে তার চুল ওপড়াচ্ছে, তার অয়স্কঠিন শিশুকে সেতারের তার দিয়ে কাটবার চেষ্টা করছে, ফলে তার অজ্ঞাতসারেই এক অমানবীয় সঙ্গীত রচিত হ’য়ে চলেছে।

(এখানে বিনাকারণে, কিংবা ফর্মার হিসাব ঠিক রাখতে, পঁচিশ লাইন সেন্সর করা হয়েছে।)

১৬.

বেলি বীথিকার মাথায় তাঁরা উঠে আসেন ক্যাটাকোম থেকে। রাস্তাটি ধীরে বয়ে চলেছে ইছামতি নদীর মতন। তাঁদের সহসা মনে হ’তে পারে, যে তাঁরা হাঁটছেন না মোটেই, বরং ভাটি-স্রোতে যাচ্ছেন ভেসে, যেন নৌকা- গামছার-পাল-তোলা, বৌ-বৌ কেরায়া নাও—হালটি পর্যন্ত ধরতে হয় নাই যার, এমনকি।

এতদঞ্চল ঢাকার সংস্কৃতি, ঢাকার কৃষ্টি, ঢাকাধিবাসিগণের সুস্থ অবিনোদনের মহাস্থান। ঢাকাইয়াদের সকল অদেখা নাটক, অশোনা গান এ-ক্ষেত্রেই মঞ্চস্থ, ধ্বনিত হয়। উপরন্তু ইহা দশাধিক বালিকা-কিশোরী-তরুণী- বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের পীঠস্থান। স্কুল-কলেজ ছুটির সময় এখানে বসে চাঁদের হাট—রিকশার বাজার। সেই রামা, সেই যোদ্ধা, কিছুই এখন নাই, কিন্তু হেথাকার বাতাস, তার আঁচলে-রুমালে ধ’রে রেখেছে অজস্র কলকাকলির উষ্ণ সুবাস। কালকেতু অত্যন্ত প্রফুল্ল বোধ করেন, প্রায় বালকে পরিণত হ’ন (যদিও তেত্তিরিশ) কালেকের তরে। খামখা হাসেন—সাঙ্ঘাতিক, প্ৰাণঘাতী, স্বতঃস্ফূর্ত, নিঃশব্দ, হাসি। একটা ফুলের ফুটে ওঠার সময়কে পনেরো সেকেন্ডে নিয়ে আসতে পারলে যা হয়। তাঁর সেই হাসিকে হাসিমুখে উপভোগেন ফুল্লরা, কালকেতুর ধ’রে-থাকা হাতে একটা গরম চাপ তিনি দেন। সাথে-সাথে বিদ্যুৎ খেলে যায় দু’জনের দেহে—আনখশির। আর প্রাণ-খোলা সশব্দ হাসিতে ফেটে তাঁরা পড়েন। সেই ইথার-বিথারি হাসির শব্দে ঘুম নষ্ট হয় এক কুকুরের। সে প্রায় লাফিয়ে উঠে তাঁদের দিকে ছুটে আসে। কালকেতু তৎক্ষণাৎ হাইজাম্প দিয়ে একটা মহিলা-মহাবিদ্যালয়ের প্রাচীরে উঠে পড়েন। কিন্তু ফুল্লরা হাসিমুখেই কুকুরকে শুধান, ‘ভৌ ভৌ-উ-উ, প্রে টেল মি স্যর, হুজ ডগ আর য়্যু?’

সারমেয়াত্মজ বিলক্ষণ প্রীত হ’য়ে জবাব দেয়, ‘ভৌ-উ-উ-উ, ভৌ-উ!” তারপর ফুল্লরার সোহাগ কাড়ে শিশুকুকুরসুলভ ‘কুঁই কুঁই’ রবে। ফুল্লরা বলেন, ‘নেমে এসো, কালকেতু-উ-উ—ভয় নাই! ও হিমুর কুকুর। সেই- যে হিমু, হিমালয়—যার বাবা চেয়েছিল সে মহাপুরুষ হোক, আর সে হ’ল অপৌরুষেয়।

কালকেতু কিন্তু নামেন না, বলেন, “হিমালয়ের হোক আর যুধিষ্ঠিরেরই হোক, ওকে দয়া করে আসতে, আই মিন, যেতে বলো। আই সর্ট অব ডিসলাইক দ্য কেনাইন কাইন্ড।

ফুল্লরা, কালকেতুর ব্যবহারে ঈষৎ ক্ষুণ্ণ হ’ন, এবং হিমুর কুকুরকে আদর ক’রে বলেন, ‘ভৌ-ভো-ভৌ।’

কুকুর ব্যথিত চিত্তে, মন্থর পদক্ষেপে, প্রস্থান ক’রে।

যে-প্রাচীরে কালকেতু আরোহণ করেছিলেন সেটি বিকার-উন-নিশা- নুন স্কুলেজের। নামেই জানা যায়, যে ইহা দুপুর এবং রাতে খোলা থাকে। তার মানে ক্লাস এখনও চলতে থাকতে পারে—এই-না ভেবে কালকেতু খানিকটা পিপিংটম-গিরি ফলান। কিন্তু স্কুলেজাভ্যন্তরে কেবলই বোরকা দেখেন—কালো-কালো, ভুতুড়ে। তাই-না দেখে কালকেতু প্রথমে সিদ্ধান্ত করেন যে, শুধুমাত্র পর্দানশিনগণই নৈশ ক্লাসে বিদ্যালাভ ক’রে থাকেন। কালকেতু খানিক হতাশ হ’ন। এমন সময়, একটা বোরকার একটা ফোকর দিয়ে যা দ্যাখেন, তাকে এক-জোড়া পাকানো গোঁফ-ব্যতিরেকে অন্য কিছুই বলবার উপায় নাই। তিনি সিদ্ধান্ত বদলান। তিনি ধারণা করেন যে, কেবলমাত্র শ্মশ্রুগুম্ফধারিণীরাই এ-সময় ক্লাস ক’রে। এমতো সম্ভাবনাও অবশ্য তাঁর মনের কোণে উঁকি দেয় যে, নিশাভাগে ক্লাস ক’রে এখানে পুরুষেরা—এবং বোরকা-সমূহ কাফ্লাজ-মাত্র। দোদুল্যমান হৃদয়ে, এবং ফুল্লরা সহায়তায়, অবতরণ করেন কালকেতু।

তখনই, স্কুলেজের গেট খুলে বেরিয়ে আসে এক পরমাসুন্দরী, পদ্মপলাশলোচনা রমণী। সুচিত্রা সেনের মুখের মতো তার মুখ, চোখের মতো চোখ; নেরেইদের হাত-পায়ের মতো হাত-পা; সোফিয়া লরেনের ঠোঁটের মতো ঠোঁট; সুলতানা রিজিয়ার নাকের মতো নাক; খাজুরাহোর ঊর্বশীর মতো সুগভীর নাভি; নিতম্ব—অদৃশ্য, কোকিলের চেয়ে কালো, রেপিডের চেয়ে উদ্দাম অলকের অলকানন্দায়, যা প্রায় তার পদতলে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু এ-সকল সৌন্দর্য ভালোভাবে দেখবার আগেই, বা পরেও, কালকেতুর চোখকে পাথরের মতো যা জমিয়ে রাখে, তা এই অসামান্যা রমণীর অসামান্য, আজানুলম্বিত, স্তনযুগল। পৃথিবীর সুন্দরতম দু’টি রম্ভোরুকে যেন কেটে এনে এর বুকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বা এর বক্ষ-নির্মাণকালে বিশ্বকর্মা নিজেই এর সৌন্দর্যে এমন মোহিত হ’য়ে পড়েন, যে, নির্মাণ-কাজ ছেড়ে আর উঠতেই পারেন না, এমন।

কালকেতু মনে মনে গা’ন :

‘যতনে আনিয়া যদি ছানিয়ে বিজুলি
অমিয়ার সাঁচে যদি রচিয়ে পুতুলি
রসের সায়র মাঝে করাই সিনান
তবু তো না হয় তোমার নিছনি সমান…’[৫৯]

কালকেতুর হাঁ দেখে ফুল্লরা বলেন, ‘ও জনা। লোকে ডাকে পাগলি জনা।’

লোকে কী ব’লে কালকেতু প্রায় শুনতে পান না, ঐ অপার্থিব স্ফটিকস্তম্ভ- যুগলের উপর একটা দ্রুতগতি জলীয় মাকড়শার মতন উপর-নীচ করতে লাগে দৃষ্টিশক্তি তাঁর। কত যুগের অমৃত ফোঁটায় ফোঁটায় জমে-জমে, মহাবিশ্বের কোন গোপন গিরিগহ্বরে, এই দু’টি হাতিশুঁড়ের জন্ম হয়েছে, ভেবে থৈ না- পান তিনি।

ফুল্লরা বলেন, ‘ওর মাই-দু’টিকে লক্ষ করেছো?’

‘না-ক’রে উপায় কী?’ কালকেতু উত্তর দেন।

‘না না, আরও ভালোভাবে খেয়াল করো।’

কালকেতু মহানন্দে আরও ভালোভাবে খেয়াল করতে থাকেন— দু’টি টর্নেডো যেন তাঁর সত্তাকে বেদম আকর্ষণ করতে শুরু ক’রে। তিনি প্রায় দুলতে থাকেন—উড়ে যাবেন-যাবেন, এমন সময় ফুল্লরা বলেন, ‘কী দেখলে?”

‘গান্ধারীর স্তন,’ কালকেতু বলেন, ‘শত-পুত্রকে স্তন্যদান করতে হ’লে এরকম দু’টি মাইয়েরই দরকার।’

ফুল্লরা বিরক্ত হ’য়ে কপাল কোঁচকান—’আরে ইল্লত, ওর বোঁটাগুলিকে দ্যাখো।’

কালকেতু মহোৎসাহে বোঁটা-আবিষ্কারে নামেন, এবং চরম বিস্ময়ে আঁতকে উঠে বলেন, ‘অ্যাঁ! বোঁটা নেইকো—একটিতেও!’ তিনি চোখ কচলান, নীচু হ’য়ে দেখতে চেষ্টা করেন——বৃথাই। শেষে ফুল্লরার দিকে জিজ্ঞাসু তাকান।

ফুল্লরা বলেন, ‘ওর গল্প শুনবে?’

১৭.

ফুল্লরা, জনার জীবনের এই কাহিনি কালকেতুকে বলেন :

জনার জননী ছিল ধনীর দুলালি। একদিন গোসলখানায়, গৃহপরিচারিকা, শারিকা, যখন তার কাঁচা-সোনার-বরণ গা থেকে ময়লা তুলছিল পরম যত্নে এবং রেক্সোনা সাবানে, সে তার (শারিকার) কাছে শুনতে পায় সখাবাবার অলৌকিক কীর্তির কথা, এবং শারিকাকে সে ব’লে, যে, ‘এ-সব’ সব সুপাহিস্টশন এবং, যে, সেটা সে প্রমাণ ক’রে দিতে পারে। এমনকি, ইঙ্গ- বঙ্গ যুদ্ধে তার পিতা-কর্তৃক লব্ধ, এবং তাকে উপহৃত, কোহিনুর নামক হীরকখণ্ডটি সে বাজি রেখে বসে।

ফলতঃ একদা কাউকে না-জানিয়ে, শুধু শারিকাকে সারথি ক’রে সে রওয়ানা হয় সখাবাবার মাজারে, এবং সেখানে গিয়ে একটি পুত্রসন্তান কামনা ক’রে। ভাগ্যবিধাতা, কিংবা সখাবাবার রুহ্, সম্ভবতঃ মেঘের আড়ালে হাসছিলেন। পরের মাসেই তার (জনার মাতার) সদ্যোজাগ্রত রজোধারা রুদ্ধ হ’লে সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, কিন্তু শারিকার কাছে হেরে যাবার ভয়ে সেটা কাউকে জানায় না। যথাকালে তার স্ফীতোদর কোনওরূপ কাপড় বা অছিলাতেই আড়াল করা অসম্ভব হ’য়ে দাঁড়ালে, তার একমাত্র পিতা (মানে, তার মাতা জীবিত ছিলেন না) চোখে সর্ষপুষ্প দ্যাখেন। কিন্তু ততদিনে ঐ গর্ভস্থ অমঙ্গলটি গর্ভপাতের আওতার বাইরে চ’লে গিয়েছে। অগত্যা যথাসময়ে এবং যথাসম্ভব গোপনীয়তায় শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়—কন্যা। শারিকাকে ধনীর দুলালি ব’লে, যে, কেউ জেতে নাই, কেননা, সে কামনা করেছিল পুত্র। কোহিনুর এইভাবে রক্ষা পায়।

পিতা এদিকে কষ্টেছিষ্টে এবং নানা ঝামেলায়, শিশুটিকে একটি অনাথাশ্রমে পাচার করতে সমর্থ হ’ন, এবং তাঁর সুকন্যা, একটা মার্বেল হারানোর দুঃখও অনুভব করে না—কোহিনুর দূরে থাক। শারিকাও উচ্চবাচ্যরহিত থাকে, কারণ, মেলা আগে থেকেই, মৃতদার গৃহস্বামীটি তাকে নানা-ভাবে ‘খুশি’ ক’রে আসছিলেন। শুধু আফসোস, যে-উপায়ে শারিকাকে সে-যাবৎ রক্ষা করেছেন, তা আপন কন্যার উপরে প্রয়োগে তিনি ব্যর্থ হলেন। এ-সংসারে এই কানীন শিশুটির কথা আরও অনেকদিন শুধু অবশ্য শারিকারই মনে থাকে, এবং এক বিশ্রী ভ্যাপসা চৈত্রের অপরাহ্ণে, কোহিনুর চুরির চেষ্টার দায়ে, কিংবা মন্থরা নাম্নী জনৈক সহপরিচারিকার (যার বয়স পনেরো) চক্রান্তে, যখন চাকরিটি তার যায়, সে প্রথমেই ছোটে সেই অনাথাশ্রমে, এবং শিশুটিকে (যার বয়স তখন তিন) নিজ কন্যা ব’লে দাবি ক’রে কান্নাকাটি জোড়ে।

আশ্ৰমাধ্যক্ষা, সুবিখ্যাত শিশু-দরদিনী ভগিনী নিবেদিতার মন গললে- পর শারিকা মহানন্দে শিশুটিকে (নিবেদিতা যার নাম রেখেছিলেন, জনা) কোলে ক’রে নারাঙ্গিপুর বস্তিতে গিয়ে ওঠে।

শারিকা নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ঝিয়ের কাজ, গার্মেন্টস, ইত্যাদি একটার পর একটা তার জুটে যায়—বয়স ছিল (মানে আঠারো), রূপ। কিন্তু যদিও প্ৰায় প্রতি-মাসেই গড়ে তিনবার ক’রে ধর্ষিত তাকে হ’তে হয়, দেহ-ব্যাবসায় সে কখনওই নামে নাই। ধর্ষণগুলোকেও আবার সে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিত। (প্রায়) কখনওই উপভোগ না-করলেও, সে একরকম বিনা-বাধায় ধর্ষণের শিকার হ’ত। এমনকি, অমোঘকে রুখবার চেষ্টা না-ক’রে, বরং নিরাপত্তা বাড়াবার (ভূতপূর্ব নিযোক্তাকে ধন্যবাদ) এবং শারীরিক কষ্ট কমাবার মানসে, সে সর্বদাই হাতের কাছে এক প্যাকেট কনডম ও এক শিশি ভ্যাসেলিন মজুদ রাখত। শিশু জনাও এ-সবে এমনই অভ্যস্ত হয়েছিল, যে, সে প্রায়শঃ, শারিকা সময়মতো কনডমের প্যাকেটটা হাতের নাগালে না-পেলে, তাকে তা এগিয়ে দিত, যেমন সে এগিয়ে দিত কোনও মশলার কৌটা, শারিকার রান্নার সময়ে।

এহেন শারিকাকে, যে ছিল ঐ বস্তির দ্বিতীয় প্রিয়তম মুখ (প্রথমটি তারই পালিতা কন্যা জনা, যার বয়স তখন সাত), একদা সুপ্রভাতে সচিবালয়ের বাইরে মৃত পাওয়া যায় ধর্ষণ করবার পর যাকে কণ্ঠরোধ ক’রে মারা হয়েছে।

প্রেসক্লাবের আলোকচিত্রীরা তড়িঘড়ি ছুটে এসে তার উলঙ্গতাকে সেলুলয়েড-বন্দি করেন (শারিকার, জাতীয় কোনও পত্রিকায় নিজের ছবি ছাপাবার আজীবন-ইচ্ছা এইভাবে পূরণ করা হয়)।

কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণ ও হত্যা অপ্রমাণিত হয়।

জনার পরিপোষণের ভার তখন স্কন্ধে নেয় বস্তিবাসীরা, যাদের মধ্যে তার পালয়িত্রী মাতার ক’একজন সাবেক ধর্ষকও ছিল। সে কিন্তু শিগগিরই সামলে ওঠে, এবং এখানে-সেখানে টুকটাক ছুটা ঝি-এর কাজও তার জোটে।

দিন যায়। দিন যায়। দিন যায়।

তেমনি এক বাসায়, আরও সঠিকভাবে, একটা সরকারি কলোনির ফ্ল্যাটে, একদা আষাঢ়ের প্রথম দিবসে, দিবসের প্রথম প্রহরে, সে যায় কাপড় ধুয়ে দিয়ে আসতে। দরোজা খোলেন জনৈক অচেনা পুরুষ, গৌরবর্ণ, সুদৰ্শন, তিরিশ-পঁয়তিরিশ।

‘কী চাই?’

জনা থতমত খায়—’আপা কোথায়?”

‘তুমি কে?”

‘আমি কাপড় ধুই। আপনি কে?’

‘ও আচ্ছা, তুমিই কাপড় ধোও—দেখে মনে হয় নাই। আমি তোমার আপার বর। আজ তোমার আপা নেই, বাপের বাড়ি গেছে বেড়াতে। আমার ছুটি আজকে। ঘরে কিছু কাজ আছে, সেরে আমিও যাব। তবে তুমি চাইলে কাপড় ধুতে পারো, নো প্রব্লেম।’

আপার স্বামী-ভদ্রলোকের সরল হাসি-কথায় জনার সঙ্কোচ কাটে। মানুষ ভালো। জনা কাপড় ধোয়। বাড়তি উৎসাহে, উদ্যমে। তারপর কাপড়গুলি যখন মেলে দিচ্ছে বারান্দায়, স্বামী-ভদ্রলোক সিগারেট খেতে (ঘরে খেতে বৌয়ের নিষেধ থেকে থাকবে) বাইরে এসে বলেন, ‘বাহ্! তুমি কাপড় ধোও তো খুব ভালো, আমার শার্টটা তো একেবারে ধবধব করছে। ভেরি গুড। ভেরি গুড।’

জনা খুশিতে নাচে, মনে-মনে। জীবনের প্রথমতম প্রশংসা, তাও চেহারার নয়, কাজের (ভালো চেহারার জন্যে অবশ্য নিন্দাই সে শুনে এসেছে বরাবর—এমন ‘পরীর বাচ্চা’-কে নিয়ে কী-বিপদে পড়তে সবার হবে জেনে এসেছে তা-ই)।

‘আর কিছু করতে হবে?”

‘তোমার সময় থাকলে আমার টেবিলটা একটু গুছিয়ে দে যাও।”

জনা টেবিল গোছায়, ঘরদোর ধোপদুরস্ত ক’রে, বাথরুম বেসিন ঝকঝকে তকতকে ক’রে, এবং কাজ কীভাবে আরও বাড়ানো যায় এমন চিন্তা ক’রে। ভদ্রলোক, কাজ শেষ হ’তে দুপুর বেজে যাবে ভেবে দু’টি ডিম ভাজবার উপক্রম-মাত্র করলে জনা তাঁর হাত থেকে ডিম কেড়ে নেয়, এবং ডিমের একটা তরকারি এবং ডাল (অপটু হাতে, কিন্তু অত্যধিক যত্নে) রান্না ক’রে। তারপর, ‘স্বামী’-র জন্য এক কাপ চা বানিয়ে, অনুমতি নিয়ে, সে মেঝেয় বসে-বসে ভদ্রলোকের ‘কাজ’ দ্যাখে।

আপার বর, তাঁর শেলফের বইগুলোকে বা’র ক’রে-ক’রে তাদের ভিতরে তাঁর নাম লিখে ফের শেলফে সাজিয়ে রাখছিলেন। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্ৰ, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, কমলকুমার, সেলিম মোরশেদ প্রমুখের নামের নীচে, রাবীন্দ্রিক হরফে, খান মুহম্মদ আজম, এই স্বাক্ষর মুদ্রিত হচ্ছিল। জনা বিস্ফারিত নেত্রে (তার চোখ-জোড়া এমনিতেই যথেষ্ট বিস্ফারিত, তাছাড়া তার বয়স তখন তেরো) সেই অভাবনীয় কর্মকাণ্ডের সাক্ষী হচ্ছিল। তারপর, ভদ্রলোক ক্লান্ত হ’য়ে ঘামতে শুরু করলে, জনা তাঁকে স্নান ক’রে আসবার পরামর্শ দেয় এবং পরিপাটি ভাত বাড়ে।

ভদ্রলোক খুশি হ’য়ে খান, জনা দ্যাখে। আহারান্তে ভদ্রলোক রান্নার প্রশংসা করেন। জনা আনন্দে, লজ্জায় কেমন হ’য়ে যায়। হঠাৎ ভদ্রলোক হাহাকার ক’রে ওঠেন—’হায় হায়! খাওয়া তো সব শেষ, তুমি খাবে কী?’

জনা মিথ্যা ব’লে, যে, সে বাসায় গিয়ে খাবে—মিথ্যা, কেননা, দুপুরে খাবার বিনিময়ে যে-ফ্ল্যাটটিতে এ-সময় তার কাজ করবার কথা, সেখানে যাওয়াই তো তার হ’ল না।

‘তা বললে কি হয়?’ ব’লে ভদ্রলোক রান্নাঘরে রওয়ানা হ’ন, জনার জন্য রাঁধবেন। জনা তাঁর হাত জড়িয়ে ধ’রে কাঁদতে-কাঁদতে কেমন হ’য়ে যায় (জীবনের প্রথম, এবং শেষবার)।

ভদ্রলোক অবাক্ হ’ন। তারপর জনাকে নিজের কোলে বসিয়ে আদর করেন। তার চোখ মুছে দেন, মুখ মুছে দেন, হৃদয় মুছে দেন।

হঠাৎ তাঁর কী হয়, তিনি অদ্ভুতভাবে জনার চোখে-মুখে তাকান, বলেন, ‘তুমি কী সুন্দর! ডু বিস্ট জো শ্যোন!’

জনাও অবাক্ চোখ তোলে এবং মহাবিশ্বের নিজস্ব বয়সের ব্যাপ্তির ভিতর প্রবেশ ক’রে।

যথাসময়ে সদ্যোজাগ্রত রজোধারা রুদ্ধ হয়। ত্রয়োদশী খেয়াল ক’রে না। ব্যাপারটা তার জানাই ছিল না। গর্ভলক্ষণ প্রকট হ’য়ে পড়ার পর, বস্তির অভিভাবকেরা, মায় তার পালিকা মায়ের ভূতপূর্ব ধর্ষকেরা, তাকে মারধর ক’রে, ‘কে দায়ী’ জানতে চায়।

জনা কারুর নাম ব’লে না, তাছাড়া নাম তো জানেই না সে। মারধর এবং গঞ্জনা চলতেই থাকে। অসহ্যতার একফাঁকে সে বস্তি ছেড়ে পালায়। একে- একে তার কাজগুলিও পালায়। সে অবশ্য ‘ওই’ ফ্ল্যাটটিতে কাজের জন্যে আর ফেরে নাই কখনও। সেখানে কোনও ফরিয়াদ জানানোর কথা স্বপ্নেও ভাবে নাই। কেননা, সে তো ধর্ষিত হয় নাই সেখানে, পূজিত হয়েছিল, জীবনে প্রথমবার, এবং শেষবার।

এই থিয়েটারের সামনেই নবজাতককে বুকে নিয়ে জনা বসত (ফুল্লরা ব’লে চলেন তাঁর গল্প), সংস্কৃতিমান্দের ছুঁড়ে-দেওয়া সিকি-আধুলি-দশ-পাঁচ অদ্ভুত ঠং ঠং শব্দে তাকে আমোদ দিত, তার বাচ্চাকেও। সেই চাকতিগুলি কীভাবে কখন ভাত রুটি আলুপুরি আলুভাজি এ-সবে পরিণত হ’ত, কখন সে-সব জনার উদরে রূপান্তরিত হ’ত, এবং দুধ হ’য়ে তাঁর বাচ্চার মুখের কাছে হাজির হ’ত, বাচ্চাটি এতশত জানত না। জনার স্তন-দু’টি তখনও যে-কোনও কিশোরীর, ছোট্ট দু’টি নরম বল। দু’টি আলতো বোঁটা যেন কচি দু’টো চোখ – অবাক্ হওয়ার, অবাক্ করার জন্যেই যার নূতন অস্তিত্বটুকু সদা-ছটফটে। সেখান থেকে দুধ বেরিয়ে আসতে দেখে জনা তার বাচ্চার চেয়ে বেশি আহ্লাদিত—কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত!

ছয় মাস পর জনার এপিফ্যানি ঘটে।

থিয়েটারের বারান্দায় কালকেতু ও ফুল্লরা বসেন। তাঁদের চোখের সামনে চাঁদে-পাওয়া হাওয়া উড়ে চ’লে, আর নিরবধি বয়ে চ’লে বেলি বীথিকা। রাস্তার ওপারে, একটা লাইটপোস্টে হেলান দিয়ে জনা বসে। কালকেতু ও ফুল্লরা কিছুক্ষণ তাকে লক্ষ করেন। তারপর কালকেতু—’জনার বাচ্চাটির কী হ’ল’ জিজ্ঞেস করতে গেলে ফুল্লরা তাঁর মুখ চেপে ধ’রে ফিসফিস করেন—

‘শ্‌শ্‌শ্‌!’

আর তখনই, পাগলা হাওয়ার সঙ্গে খুনসুটি করতে-করতে জনার গানের আওয়াজ দু’জনের প্রাণে এসে পশে :

‘ও সোনা    আমায় বাইরে ফেলে
ও সোনা     তুমি একাই গেলে
খেলতে ঝুলন-খেলা
জুঁই-চামেলির মেলে
ও সোনা     ঘুমের অন্ধকারে
ও সোনা     হৃদয়-হ্রদের ধারে
কোথায় তুমি বাছা
হারালে আমারে
ও সোনা     তোমার ঘুমের ঘোরে
ও সোনা     যদি আমার দোরে
ধাক্কা মারে মরণ
যাব কেমন ক’রে
ও সোনা     আমার রক্ত খেয়ে
ও সোনা     তুমি বেঁচে থাকো
আমার মরার আগে
মরে যেয়ো না কো…’

এই বারান্দাটিতেই সেদিন শুয়ে ছিল জনা (ফুল্লরা আবার তাঁর গল্প শুরু করেন)। পৌষ সবে এসেছেন ধরায়। কুকুর-কুণ্ডলি পাকিয়ে, বাচ্চাটিকে বুকের ভিতরে ঢুকিয়ে, জনা শীতনিদ্রা দিচ্ছে, এখন যত রাত তত রাতে। পাঁচ যুবক পথে হাঁটছিল, এবং তাঁরা সম্ভবতঃ এঞ্জেল ডাস্ট-এর তাঁবেতে ছিল, তাদের একজনা, জনাকে দেখে এগিয়ে যায়, তার মুখচুম্বন, চোখচুম্বন, স্তনচুম্বন ক’রে। জনা ইতোমধ্যে জেগে উঠে চিৎকারের চেষ্টা করতে গিয়েও বিরত হয়, কেননা, এটুকু সে জানে, যে তাতে তার বাচ্চাটির, এবং তার নিজের, বিপদ বরং বাড়বে। তার প্রায়শঃ—ধর্ষিতা পালিকা মাতার কথা তার মনে প’ড়ে কিনা বলা যায় না। যে-জন্যেই হোক, সে টু-টুকু ক’রে না।

কিন্তু নেশার ঘোরে, বা কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স-বশত, যুবকেরা ধ’রে নেয়, যে, জনা মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিরোধের। ফলে তারা রাগান্বিত হয়। তারা প্রথমতঃ শিশুটিকে মায়ের বুক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে রাস্তার পাশে নামিয়ে রাখে। একজন পিছমোড়া ক’রে তার হাত, একজন মুখ, এবং দুইজন তার দুই পা চেপে ধ’রে। বাকি জন… বলা বাহুল্য।

একাদিক্রমে পঞ্চম ব্যক্তি যখন তার উপরে সওয়ার, জনার ততক্ষণে ব্যাপারটা প্রায় সয়ে এসেছে, উপভোগই প্রায় করতে শুরু করেছে সে ব্যাপারটাকে—একটা ভারি ট্রাক ছুটে চ’লে যায় পাশ দিয়ে, আর একতাল কাদা ছিটকে এসে প’ড়ে পঞ্চম ধর্ষকের মুখের উপর। তার গনগনে উত্তেজনার হল্কায় সহসাই এক-ঘড়া ঠান্ডা পানি প’ড়ে যেন। মুহূর্তে তার মন্থনদণ্ডটি জনার ভিতরে মোমের মতো গলে যায়। ফুটন্ত তেলে জল পড়ার মতো ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে—’শালা বাঞ্চোত!’

মুখের কাদা মুছতে, পথের উপর উড়তে-থাকা জনার শাড়িটিকে ধরতে গেলে, প্রায় যুগপৎ, তাঁর মনে প’ড়ে, যে এটা শীতঋতু, কাজেই রাস্তায় কাদা জমবার কোনও কারণ নাই, এবং সে দেখতে পায় জনার সন্তানের দেহটিকে, রাস্তার মাঝখানে নিথর, মাথাটা একটা থালার মতো চ্যাপ্টা। ঐ ছোট্ট মাথার মগজটুকুই উড়ে এসে তার মুখে পড়েছে।

পাঁচ যুবকই নির্বাক্ দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তকাল। জনা-ই কোনওমতে উঠে দাঁড়ায়। টলতে-টলতে পুত্রের দিকে যায়, তাকে বুকে ক’রে নিয়ে আসে, নিজের শাড়িটিকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে ছোট্ট লাশটিকে জড়ায়। তারপর শান্ত হ’য়ে সে বাচ্চার পাশে বসে।

তখন পঞ্চম যুবক, মুখে মগজ-সমেত, দানবীয় চিৎকার ক’রে, চিৎকার ক’রে, করতেই থাকে ‘আ-আ-আ-আ-আ— ‘

বেকাবু বেগে সে ছুটে যায় রাস্তার আড়াআড়ি, ওপারের একটা দেয়ালের উপরে গিয়ে আছড়ে প’ড়ে, উল্টে প’ড়ে গিয়ে অন্ধের মতো হাচড়ে-পাছড়ে উঠে দাঁড়ায়, আবার ছোটে, একটা লাইটপোস্টে বাড়ি খেয়ে ঘুরে প’ড়ে যায়, আর নড়ে না।

বাকি চার যুবক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দ্যাখে, বন্ধুর সাহায্যে এগোয় না, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কাঁদে, নিঃশব্দে, অজান্তে। তাদের একজন প্যান্টের পকেট হাতড়ায়, একমুঠো কাঁচা-পাকা টাকা তার হাতে উঠে আসে। জনার সামনে বাড়িয়ে-ধরা তার মুঠির ভিতরে খুচরোগুলি ঝনঝন-ঝনঝন কাঁপে।

‘জনা কী করল তখন, কালকেতু? কী করল সে?’ ফুল্লরা আকুল হয়ে শুধান।

কালকেতু কাঁদতে-কাঁদতে কোনওমতে বলেন, ‘জানি না। জানতে চাইও না। তুমি চুপ করো। চুপ করো।’

‘কিন্তু তোমাকে জানতেই হবে-যে কালকেতু!’ ফুল্লরার বাঁধ ভেঙে যায়, কান্নার বন্যাধারায় খড়কুটোর মতো ভেসে আসে তাঁর একটা-দু’টো কথা- ‘জনা পয়সা… ছুঁড়ে দিল দাতার মুখে? বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর? কী… করল সে, কালকেতু? কী?’

তারপর, খানিকটা ধাতস্থ হয়ে তিনি তাঁর গল্পের বাকিটা বলতে আরম্ভ করেন, কালকেতুর নামতার মতো বলে-যাওয়া ‘চুপ করো! চুপ করো!’-র কোনও তোয়াক্কা না-রেখেই।

জনা শান্তভাবে টাকাটা নিলে, বাকি তিনজনও তাদের পকেট হাতড়ায়। আরও কিছু টাকা-পয়সা, একটা ময়লা রুমাল, একটা দাঁড়াভাঙা চিরুণি, একটা আধ-খাওয়া সিগারেট, আর একটা ছোট্ট, আজগবি ধরনের, পাথর রাস্তা থেকে কুড়ানো যাকে হয়েছিল—জনার বাচ্চার পাশে জমে

জনা উঠে দাঁড়ায়, রোরুদ্যমান চারজনকে হাল্কা-হাতে একটু আদর ক’রে দেয়। মানুষের ভাষা যদিও সে ভুলেছে ততক্ষণে, তবু, হয়তো কোনও পশুর ভাষাতেই, নিঃশব্দে ব’লে, ‘আর কাঁদে না।’ রুমালটা তুলে নিয়ে রাস্তার কলে সে ভেজায়, তারপর চ’লে যায় পথের উপর পড়ে-থাকা মানুষটার দিকে। তার মুখ মুছে দেয়। চোখ মুছে দেয়। হৃদয় মুছে দেয়।

‘সেদিনের পর জনা আর কাপড় পরে নাই কোনওদিন, আর সেদিন থেকেই তার মাই-দু’টি বড় হ’তে শুরু ক’রে—টাইফয়েডের মতো, এপিফ্যানিও একটা কোনও অভিজ্ঞান রেখে দিয়ে যায়।’

ফুল্লরা থামেন। রাস্তার ওপারে জনার শরীরটিকে দেখা যায় না আর। যেন সে গুলে গেছে জ্যোৎস্নায়—অথবা, নাকি সে, কালকেতুর চোখে, একটা নিরঞ্জন আত্মায় পরিণত হয়েছে, বা কালকেতু তার শরীরটাকে দেখতে পাচ্ছে না আর—যে-কারণেই হোক।

১৮.

কালকেতু, ভয়ের-গল্প-শুনতে-থাকা বালকের মতো আশা নিয়ে, বলেন, ‘গল্প তো শেষ, তাই না?’

ফুল্লরা, কালকেতুর ছেলেমানুষিতে হাসেন একটু। এক্ষুনি তাঁকে হতাশ করতে সরে না যেন মন। কিন্তু বলেন, ‘না’।

‘আমি আর শুনব না, কিছুতেই না,’ কালকেতু জেদ করেন।

ফুল্লরা বলেন, ‘প্রতিটি কদমই-যে তোমাকে হাঁটতে আজ হবে, মাই লাভ!’

ফুল্লরার গল্প আবার শুরু হয় :

মাস ছয় পর। জনার স্তন-দু’টিকে তখন সবে-মাত্র তার দেহের তুলনায় বেশ একটু বড় দেখাতে শুরু করেছে, যদিও মানবীয়তার সকল সীমা অতিক্রমের তখনও মেলা দেরি—খিদে পেলে সে তখন যে-কোনও খাবারের দোকানে ঢুকে পড়ত। কোনও কথাই হ’ত না কইতে (কইতে হ’লেও সে পারত না অবশ্য)। দোকানিরা যত-শীঘ্র-সম্ভব ওর হাতে কিছু দিয়ে ওকে বিদায় করত। হাহুতাশও করত কেউ-কেউ, কেননা, এমন ‘ফিগার’ নিয়ে একটা মেয়ে পাগল হ’য়ে যাবে, এটা খুবই দুঃখজনক—বিধাতার শক্তির নিষ্ঠুর অপব্যয়। অবশ্য পাগল না-হ’লে ঐ ফিগারটি দেখবার সুযোগও হ’ত না—মন্দের ভালো।

ঘুম পেলে চোখের সামনে যে-বারান্দা, রোয়াক, গাড়ি-বারান্দা, বা তেমনি কিছু দেখত জনা, তাতেই সে শুয়ে প’ড়ে ঘুমিয়ে পড়ত, আর ঘুমের মধ্যে তার শরীর নিয়ে কেউ কোনও গবেষণা ক’রে গেলেও ঘুম ভাঙত না তার, বা, ভাঙলেও, সে সে-সবকে খুবই স্বাভাবিক ভেবে, স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিত।

তেমনি একদিন—এখন যত রাত তত রাতে—চরাচর ব্যেপে লোডশেডিং, রাস্তার বাতিগুলি শুধু জ্বলছে টিমটিম, ঘরদোর ভুতুড়ে সব, এক সদ্য-তরুণের ঘুম ভেঙে যায় গরমে, বাড়ির দোতলায়। সে উঠে জানালা খোলে, আলমারির তলায় স্টিকি-টেপে-আটকে-রাখা সিগারেটের প্যাকেট বা’র ক’রে আনে। ধরায়। জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বাইরে ধোঁয়া ছাড়ে। কেননা, পাশের ঘরেই নিদ্রাবৃত পিতা, তার জীবধর্মের পৈতাহীন পুরোহিত। নেহাত দৈবাৎ, তাদের বাড়ির সামনে সে দেখতে পায় উলঙ্গিনী জনাকে। তার হাতের সিগারেট হাতে পুড়ে যায়। ফিল্টার গরম হ’য়ে আঙুলে ছ্যাঁকা লাগে। ঘাড় ব্যথা হ’য়ে গেলে একসময় সে ফেরে, বিছানায় ঢোকে। তারপর আবার উঠে যায়, আবার ছুটে যায়। শেষমেষ পা টিপে-টিপে নীচে সে নামে। টিকটিকি-সতর্কতায় গেট খোলে। পকেটে ক’রে নিয়ে আসা স্টিকি-টেপে আলগোছে জনার মুখ আটকায়, হাত-দু’টোকে আটকায় পরস্পরের সাথে, শুধু পা-দু’টির রিস্ক তাকে নিতেই হয়। এবং মাতৃস্তন ছাড়ার পর এই প্রথম সে আবার কোনও নারীস্তনে মুখ রাখে—আর তখনই! পিছনে গেট খোলার আওয়াজে গুলি খাওয়ার মতো লাফিয়ে ওঠে সে। খোলা গেটের সামনে একঝলক, পিতাকে দ্যাখে বা দ্যাখে না—অন্ধকারে হোঁচট খেতে-খেতে সিঁড়ি ভেঙে, পা ভেঙে, দোতলায় তার ঘরে গিয়ে আছড়ে প’ড়ে। প’ড়ে থাকে।

অনন্তকাল পরেই শুধু টের পায় সে, যে, তার মুখের ভিতরে তার জিহ্বা ছাড়াও আরও কিছু একটা রয়েছে। তবে কি জিহ্বাটি খণ্ডিত হয়েছে তার? মুখের থেকে বস্তুটিকে বা’র ক’রে হাতড়ে-টাতড়ে দেশলাইটা সে জ্বালে। প্রথমে বুঝতেই পারে না কী ওটা। নেড়েচেড়ে মেলাক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর বোঝে, যে, ওটি একটি স্তনবৃন্ত—অ্যারিওলা-সমেত, বক্ষচ্যুত।

‘মা-গো!” আর্তনাদে ছেলেটি প্রায় অজ্ঞান হ’য়ে যেতে শুরু ক’রে।

শেষরাতের দিকে আর থাকতে পারে না সে। তার ফার্স্ট-এড বক্সটি হাতে নিয়ে (এবার মানুষের মতোই) নীচে নেমে যায়। গিয়ে দ্যাখে, তেমনি স্টিকি-টেপে-বাঁধা-মুখে-হাতে হতচেতন প’ড়ে আছে জনা, রক্তে চেটালো তার বক্ষদেশ।

নিজের করা ক্ষতটিতে ব্যান্ডেজ বাঁধা হ’লে অন্য স্তনটির রক্ত মুছে দিতে যায় ছেলেটি, এবং টের পায়, যে, জনার অপর স্তনটিও ছিন্নবৃন্ত…

১৯.

কালকেতু এবার একেবারে উঠেই দাঁড়ান, বলেন, ‘কী নাটক হচ্ছে বলো তো?’

ফুল্লরা বলেন, ‘গডোর প্রতীক্ষায়।’[৬০] ফুল্লরা পুনশ্চ বলেন, ‘এতরাতে নাটক কারা দ্যাখে জানো?’ তারপর নিজেই জানান, ‘চোর আর পুলিস।’

হলের দরোজার কাছাকাছি যেতেই তাঁরা শুনতে পান একই সঙ্গে হাসি আর নাসিকাগর্জন। কালকেতু বলেন, ‘কারা হাসছে, কারা ঘুমাচ্ছে, বলতে পারো?”

ফুল্লরা বলতে পারার চেষ্টা করেন—’সম্ভবতঃ পুলিস ঘুমাচ্ছে, চোরেরা হাসছে। অবশ্য, অবশ্যই, উল্টোটাও সমান সম্ভাব্য।’ প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই আবার মত ফুল্লরা পাল্টান, বলেন, ‘আরও বেশি সম্ভবপর অবশ্য এই যে, দর্শকেরা ঘুমাচ্ছে এবং অভিনেতারা হাসছে।’

‘কনসিডারিং ইট ইজ বেকেট, মাই ডিয়ার,’ কালকেতু বোদ্ধা-ভঙ্গিতে বলেন, ‘এমনও হ’তে পারে যে, অভিনেতারা ঘুমাচ্ছে, দর্শকেরা হাসছে।’

‘আমাদের দু’জনারই ধারণা সঠিক হ’তে পারে—’ ফুল্লরা বলেন, ‘পালাক্রমে হয়তো একবার এ-দল ঘুমাচ্ছে ও-দল হাসছে, আবার ও-দল ঘুমিয়ে পড়ছে, এ-দল জেগে উঠে হাসছে, এইরকম।’

কালকেতু বলেন, ‘ও ডু নট আস্ক, “হোয়াট ইজ ইট?” লেট আস গো অ্যান্ড মেক আওয়ার ভিজিট।’

হলের দরোজার সামনে য়্যুনিফর্মাল গেটকিপার। তাকে অশ্বনিদ্রা দিতে দেখে দু’জনে চুপিচুপি সান্ধাতে যাবেন, হঠাৎ ঘুমন্ত গেটকিপারের হাত বাড়ানো হয়, তার মুখ বলে’টিকিট?’

কালকেতু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হ’ন, কিন্তু ফুল্লরা হেসে গেটকিপারের কানে-কানে কিছু বলেন। সঙ্গে-সঙ্গে হাত সরে যায়।

ঢুকে দেখা যায়, যা ভাবা গিয়েছিল, তা-ই। অর্থাৎ, পর্যায়ক্রমে দর্শক, ও অভিনেতাদের হাসি এবং ঘুমানো চলছে। দু’জনে অনন্তকাল ন তস্থৌ ন যযৌ দাঁড়িয়ে থাকেন। পরে একসময় ফুল্লরা ফিসফিসান, ‘আমার কী মনে হচ্ছে জানো? এই গোটা থিয়েটারটিই অন্য একটা ডিমেনশনে ঢুকে গেছে। দর্শক অভিনেতা সবাই এখন সত্যিসত্যি গডোর প্রতীক্ষায়।

কালকেতু সহসা সাদা হ’য়ে গিয়ে বলেন, ‘আমাদেরকে এরা গডো ভেবে বসলেই খেল খতম, পয়সা উসুল! অতএব যঃ পলায়তি

অতএব তাঁরা ঊর্ধ্বশ্বাস নিষ্ক্রান্ত হ’ন।

কালকেতু ‘এক্সকিউজ মি,’ ব’লে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প’ড়ে ব্লাডি মেরির খানিকটা খালাস করেন। খালাসান্তে সকাতরে বলেন, ‘আমার জিপটা ফেঁসে গেছে, ক্যা করু?

ফুল্লরা তখন তাঁকে টেনে নিয়ে ঢোকেন, রাস্তার পরপারে, স্টেশনারীবাদী নামক এক দোকানে, সেখানে তন্দ্রালস দোকানিকে বলেন, ‘ডিয়ার স্যর, উই বেগ মোস্ট রেসপেক্টফুলি টু স্টেট দ্যাট উই আর ইন ডায়ার নিড অব আ সেফটিপিন—’

দোকানি বিরক্তে এক চোখ খুলে বলেন, ‘তো?’

ফুল্লরা কন্টিনিউ করেন, ‘তো, মে উই প্রে অ্যান্ড হোপ দ্যাট ইয়োর অনারেবল সেলজপারসনশিপ উড বি জেনরাস ইনাফ টু গ্রান্ট আস সেম ফ্রি অব কস্ট অ্যান্ড অবলাইজ দেয়ারবায়?’

দোকানি তার পকেট থেকে একটা সেফটিপিন বা’র ক’রে ফুল্লরাকে দিয়ে বলেন, ‘এখানকার লোকজনদের প্রায়ই লাগে তো, সাথেসাথেই রাখি। শুভনিদ্রা।’

স্টেশনারীবাদীর পাশাপাশি এক-সার প্রেস্টিজিয়াস দোকান-পাট, যথা :

ভিডিয়াসাগর      (ভিডিও-র দোকান);

হিপোক্রেটিক       (ঔষধালয়);

হোমো পতি        (ঔষধালয়);

মলয়জ শীতলাং    (এসি-র দোকান);

ফুল’জ প্যারাডাইস       (ফুলের দোকান);

শুমাকার     (জুতার দোকান);

ক্রোম-আনিয়ন    (পেঁয়াজ-মরিচের দোকান);

হাহাকার     (কার-রেন্টাল);

ক্লিচ্ছবি      (ছবিঘর-শিল্পী Paul Klee-র নামে, সম্ভবতঃ);

পুলিপোলাও        (ঢাকার মহিলা পুলিস-পরিচালিত ট্র্যাভল এজেন্সি— আন্দামান স্পেশাল);

এবং (এটি দোকানের নাম নয়)

জ্যাকসন-অ্যাকশন       (আর্ট-গ্যালারি—এখানে জ্যাকসন পোলকের, শুধুমাত্র ‘অ্যাকশন পেন্টিং’-গুলিই বিক্রি হয়)।

শান্তিনগর মোড়ের দিকে (যার সরকারি নাম, মূর্তি প্লেস) যাওয়ার পথে কালকেতু বলেন, ‘সচরাচর সাহিত্যের বর্জ্য পদার্থগুলিই বিজ্ঞাপন-অলারা অর্জন ক’রে। বাংলাদেশে অবশ্য উল্টোটাও/-টাই হয়। সাহিত্যিকগণ, বা গণসাহিত্যিকেরা, বিজ্ঞাপনের বর্জ্যসমূহকে সাগ্রহে কর্জ করেন।’

ফুল্লরা হেসে শুধান (হাসিটা অবশ্য কালকেতুর কথায় নয়; কী যেন মনে পড়েছিল বুঝি; বা কে জানে, রমণীর মন…), ‘আচ্ছা, এখন কোন ইজম চলছে সাহিত্যে?’

‘সুররিয়ালিজম, হাইপার-রিয়ালিজম, মেটা-রিয়ালিজম, ভার্চুয়াল রিয়ালিজম শেষে এখন চলছে সিরিয়ালিজম, উভয়ার্থে। আভাঁগার্দের ভূত একেবারে নেমে গেছে, টু দ্য লং ডিনাইড কম্ফর্ট অব রিডারজ অ্যান্ড পাবলিশারজ। আজকাল লিসা-দৃষ্টান্ত, নাজের-বৃন্তান্ত, মাছি-গালা ধরনের গল্প আর লেখা হয় না মোটেই, হয় রমানাথ, ফুলবিষয়ক অবধারণ, কালকেতু ও ফুল্লরা—’

কালকেতুর সাহিত্যজ্ঞান অধিক-দূর অগ্রসর হবার আগেই, ঘাড়ের পিছনে ‘হ্যান্ডজ আপ’ শুনে দু’হাত আকাশে তিনি তোলেন—তুলেই, অত্যন্ত আশ্চর্য হ’ন। কেননা, বস্তাপচা গোয়েন্দা-কাহিনির বাইরেও-যে উক্ত পদবন্ধটির ব্যবহার রয়েছে, এ-তথ্যটি তাঁর জানাই ছিল না। ফলে, রসিকতা ভেবে তিনি হাত নোয়ান, এবং সঙ্গে-সঙ্গে স্বনিতম্বে আড়াইশ’ কিলো ওজনের লাথি খেয়ে ভূপাতিত হ’ন।

ফুল্লরা অবশ্য প্রায় নির্বিন্ন-বদন তাঁর হাত থেকে একটি অঙ্গুরীয় খুলে আগন্তুকের হাতে দিয়ে বলেন, ‘আর কিছু নেই, দুঃখিত।’

কালকেতু, পপাত চ মমার চ অবস্থাতেই, আংটিটিকে, সতেরোশ’- সাতান্ন বৎসর আগে তাঁরই উপহার-দেওয়া ব’লে শনাক্ত ক’রে মর্মাহত হ’ন—মনে মনে বলেন : ‘চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তকে!’ তবে তা ভাষায় ব্যক্ত করেন না।

‘ছিনতাই করছেন ভাই?” ফুল্লরা বলেন, ‘ছিনতাইয়ের সাজা কী জানেন বোধ হয়?”

‘জানি,’ ছিনতায়ী উত্তর দেয়, ‘কিন্তু আমি তো ছিনতাইকারী না, আমার ভয় নাই।

ফুল্লরা ও কালকেতুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে সে তখন একটু নওশা- লাজুক হেসে ব’লে, ‘আমি সামান্য একজন… খুনি।’

‘অ্যাঁ!” কালকেতু সরবে, এবং ফুল্লরা নীরবে আঁতকান।

‘তবে ভয় নাই,’ খুনি আশ্বস্ত ক’রে, ‘ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট উঠে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত খুনের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে নাই বিচার বিভাগ। কাজেই, খুনের কোনও শাস্তি এ-মুহূর্তে নাই।’ পরে ব’লে, ‘আমি আসলে একজনকে খুন করবার জন্য খুঁজছিলাম। ভদ্রলোকের নাম কালকেতু, উচ্চতা…, গাত্রবর্ণ…, চোখের রঙ…, নাকের আকৃতি…। তবে আপনাদেরকে আমি মোটেই সন্দেহ করি নাই। শুধু জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম, যে, ওরকম অদ্ভুত দেখতে কাউকে আপনারা দেখেছেন কিনা।

(‘গাধা ভবা-টা কোনওকিছুরই ঠিকঠিক বর্ণনা দিতে পারে না।’, ফুল্লরা ভাবেন। ‘একজিমার কথাটা ব’লে নাই ভাগ্যিস’, ভাবেন কালকেতু।

কালকেতু পাছা ডলতে-ডলতে উঠে দাঁড়ান’ও, তাই বলুন। হ্যাঁ দেখেছি বৈকি। লখ ধানমন্ডিতে মাছ ধরছেন ভদ্রলোক।”

অতঃপর আততায়ী, ফুল্লরাকে তাঁর অঙ্গুরীয় ফিরিয়ে দিতে চায়—’এটা তো ঠিক আমার প্রফেশনাল কারিক্যুলামের মধ্যে প’ড়ে না আপা…’

ফুল্লরা ‘আপা’-ডাকে বিগলিত হ’ন, বলেন, ‘ওটা উপহার হিসাবেই নাও ভাই। তোমার নামটি কী, জানতে পারি কি?

‘আমার নাম লিটন। আমার ভায়ের নাম ছিটন। এই এলাকার যাবতীয় খুনখারাপি আমরাই কন্ট্রোল করি। এখানে এসে কোনও বিপদে পড়লে বলবেন ‘আমি লিটন-ছিটনের বোন’। অন্য এলাকায় অবশ্য না-বলাই ভালো।’

কালকেতু বলেন, ‘আর আমি লিটন-ছিটনের ভাই? ফিটন?’

‘জি-না, সবাই জানে আমরা দু’ভাই—কিন্তু বোনের খবর কেউ জানে না। লাথির জন্য সরি, ব্রাদার!’ লিটন অ্যাপলজাইজ ক’রে।

কালকেতু বলেন, ‘না না, ছিঃ ছিঃ—আমি বরং গর্বিত, হে হে।’

লিটন (ফুল্লরাকে) ব’লে, ‘আংটিটা কাকে দেব জানেন, আপা? আমার প্রেমিকাকে। খুব খুশি হবে। ও একটু অন্যরকম। সবাই পাগল ভাবে। কিন্তু আমি জানি ও পাগল না।’

‘আমিও মনে হয় জানি,’ ফুল্লরা বলেন।

যুবক উদ্ভাসিত হয়, ‘চেনেন আপনি ওকে?’

‘জনা তো?’ ফুল্লরা মুচকি হেসে বলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *