কালকেতু ও ফুল্লরা – ১০

১০.

সাবেক কলাবাগান, যার বর্তমান নাম কদলী নগর, তার প্রভূত নৈশজীবন-সহ সানন্দে জাগ্রত। সোহো মলের দু’ধারে অসঙ্খ্য সেক্স-শপ, যা- সবে রক্তমাংসের যৌনতা-ছাড়াও নানাপ্রকার সিন্থেটিক বা রোবটিক সেক্সও নামমাত্র মূল্যে সুলভ। কানিলিঙ্গাস নামক একটি অপেক্ষাকৃত ভদ্র চেহারার দোকানে ফুল্লরার উপরোধে পশেন কালকেতু। একটি ভগাকৃতি দরোজা ঠেলে তাঁরা ভিতরে ঢুকতেই—মা গো!—এক বিশ্বরূপে বিশালাঙ্গী আশান্তি ভামিনী, শূন্যে ভাসমান, যার শরীরে, সম্ভবতঃ ইলেট্রোপ্লাস্টিক সার্জারির দ্বারা, আরোপিত হয়েছে অগণিত স্ত্রী-চিহ্ন,—উরুতে, ভুরুতে, জানুতে, বাহুতে, নিতম্বে, মুখে, বুকে, কপালে, কপোলে, পদতলে—কেবল যে-স্থলে তা স্বাভাবিকভাবে মানানসই, সেখানে একটা পয়সা ফেলবার যন্ত্র, যাতে লিপিবদ্ধ : ‘ফি-লেহন এক দ্রাখমা মাত্ৰ’

মুদ্রা না-থাকায়, কালকেতু ও ফুল্লরা, লেহন-বিহনে মন-মরা হ’য়ে বেরিয়ে আসেন এবং উইন্ডো-শপ করতে-করতে এগিয়ে চলেন। কাউন্টারফিট, মাস্টার অব মাস্টারবেশন, স্তনন, নিধুবন, ইটার্নাল ট্রায়াঙ্গল, পার এনাল, কোক্কাইন, প্রভৃতি একে-একে তাঁদের পিছনে চ’লে যায়।

জনৈক জিগোলো, গিটার বাজিয়ে ‘আই অ্যাম অব আয়ারল্যান্ড, অ্যান্ড দ্য হোলি ল্যান্ড অব আয়ারল্যান্ড’৩৮ গাইতে গাইতে তাঁদেরকে অতিক্রম করেন, এবং ফুল্লরার সম্মানে তাঁর ছেঁড়া টুপি খুলে নড করেন।

আপন-শ্রেণীর প্রান্তভাগে একটা দোকানের সামনে দু’জনে দাঁড়া মামা হালিম। ক্ষুধার্ত দু’জন সতৃষ্ণ, বুভুক্ষু চক্ষে খাদ্যসামগ্রীর তালিকায় তাকিয়ে লাফিয়ে ওঠেন :

হালিম বাটি-প্রতি :

রমণীদের জন্য চুম্বন
পুরুষদের জন্য মর্দন

তাঁরা অক্ষুণ্ণচিত্তে চুম্বন-মর্দন কবুল করেন, এক নয়, পর-পর দশ। তারপর ব্যথিত-হস্তপদ-অধরোষ্ঠে, পুলকিত-উদরে, আবার পথে নামেন।

১১.

ঐতিহ্যবাহী ধানমন্ডির নাম এই সেদিন পাল্টে রাখা হয়েছে তালপট্টি। তার মাঝখান দিয়ে বয়ে-যাওয়া (বা রয়ে-যাওয়া) লখ্‌ ধানমন্ডির নামটি অবশ্য অক্ষুণ্ণ

এতক্ষণে, অর্থাৎ লখের পাড়ে এসে, এই প্রথম, ফুল্লরা বলেন, ‘দ্যাখো, আমার পা ব্যথাচ্ছে।’

‘পায়ের দোষ কী। পিনোকিও-র পা হ’লেও ব্যথাত… তাহলে এসো কিয়ৎক্ষণ তারকা-গণনা করা যাক—’ কালকেতু প্রস্তাব রাখেন।

ফুল্লরা যোগ করেন, ‘হালিম-হালিম ঢেকুর তুলতে তুলতে।’

লখ্-তীরস্থ পার্কের ভিতরে একটা ডাস্টবিনের (পার্কে ডাস্টবিন থাকবে, নানা কারণে, এ তো প্রায় নিশ্চিত) পাশে বা সামনে তাঁরা থেবড়ে বসেন। কালকেতু বলতেকি প্রায় শুয়েই পড়েন, শুধু ঘাড় থেকে মাথাটিকে নব্বই ডিগ্রি চাগিয়ে রাখেন, শুয়ে পড়েন নাই বোঝাবার জন্যে।

ফুল্লরা বলেন, ‘ডাস্টবিন থেকে কেমন একটা পচা ধরনের সুগন্ধ আসছে।’ কালকেতু বলেন, ‘ব্যর্থ প্রেমিকদের ব্যর্থ রজনীগন্ধার তোড়া ফেলবার বিন ওটা তো, সেগুলিই পচে গিয়ে…’

ফুল্লরা বলেন, ‘লিলিজ দ্যাট ফেস্টার স্মেল ওয়ার্স দ্যান উইডজ।’[৩৯]

কালকেতু বলেন, ‘বাহ্বা, বাহ্বা।’

‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ক্রিকেট হচ্ছে আজ তালপট্টি স্টেডিয়ামে,’ ফুল্লরা জ্ঞাপন করেন।

কালকেতু বলেন, ‘ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান-যে ক্রিকেট খেলবে, এবং তালপট্টিতে, সে তো অবধারিত। তবে, বলবিন্দর সান্ধুর বোলিং দেখার তুলনায়, এই অ্যাঙ্গল থেকে তোমার মুখ দেখা—মাইনাস ইনফিনিটি টু প্লাস ইনফিনিটি।’

‘আদিখ্যেতা!” ফুল্লরা কপাল কোঁচকান।
কালকেতু আওড়ান :

‘ধানমন্ডির ঝিল করেছে আজীবন মাছের চাষ।
একদিন ডাস্টবিন টেনেছে পাড়ে তার প্রেমের রাশ!
এই ঝিল এই জল করেনি কোনওদিন এ-অভ্যাস—
মৎস্যের শম্পের স্বগত একতান অনুপ্রাস!

ধানমন্ডির ঝিল কিনেছে পুনরায় ধীবর-দল–
ছিপ আর ছত্রাক, অপিচ অবসর জগদ্দল।
আর সেই কষ্টের ছিঁড়েছে নাড়ি ঢের সবুজ জল,
আমলার বঁড়শির গেলেনি আজও টোপ সে-উৎপল।’

‘কার কবিতা?” ফুল্লরা শুধান।

‘কোন এক হতভাগার, আমার মনে নেই। তোমার মনে আছে?’

‘জন্মের আগের কোনও স্মৃতির মতো… যা হোক, ধন্যবাদ।’

‘আমাকে নয়, ধন্যবাদ দাও লখ্‌ ধানমন্ডিকে, যেখানে আমাদের জন্মের আগেই অভিনীত হ’য়ে গেছে কত-সব অসাধারণ নাটক, প’ড়ে গেছে কত কালো যবনিকা…’

ফুল্লরা বলেন :

‘মন্-আমি, কাহার লাগি বন ছেড়ে এলে
মন্-আমি, কাহার লাগি এলে’

কালকেতু বলেন :

‘ও-ও-ও-ও-ও

ফুল্লরা বলেন :

‘হারায়ে এয়েছো ভুঁই এয়েছো বিভুঁই
এখন কোথায় তবে শুই

কালকেতু বলেন :

‘ও-ও-ও-ও-ও’

ফুল্লরা বলেন:

‘মন-আমি, আমার তবে ঠিকানা কোথায়
কোথা কো-থা-হা-য়’

কালকেতু বলেন :

‘ও-ও-ও-ও-ও’

ফুল্লরা বলেন :

‘মন্-আমি, আবার চলো বনে ফিরে যাই
যৌবনে ফিরে যাই চলো’

কালকেতু বলেন :

‘ও-ও-ও-ও-ও’

‘পার্সটা আনলে তোমাকে আমার কলমের কালেকশনটা দেখাতে পারতাম—ওগুলির প্রত্যেকটিতে প্রথমে আমাকে প্রেমপত্র লেখা হয়েছে, পরে উপহার দেওয়া হয়েছে,’ ফুল্লরা বলেন।

কালকেতু বলেন, ‘রসভঙ্গ করা হচ্ছে, কিন্তু আমি যে-কলমটি তোমাকে দিয়েছিলাম, তা দিয়ে আমি তোমাকে, বা কাউকেই, কোনও প্রেমপত্র লিখি নাই। আমার ধারণা, ঐ কলমটির কারণেই আমি জীবনের শেষ পরীক্ষাটিতে ফেল মারি।

‘তা ঠিক,’ ফুল্লরা স্বীকার করেন, ‘প্রেমপত্র দূরে থাক, ডেথ-সার্টিফিকেট লিখবারও উপযুক্ত ঐ কলমটি নয়। ওটি দিয়ে একটাই শুধু কাজ কোনওমতে করা যায়….

বলতে-বলতে ফুল্লরা অকস্মাৎ, প্রকৃতি এবং আধো-আঁধিয়ারে গুলো- থাকা জনৈক মৎস্যশিকারীকে শনাক্ত করেন, কালকেতুকে চিমটিয়ে ওঠান, এবং ভদ্রলোকের কানের সামনে এসে বলেন, ‘তাতঃ!’

ভদ্রলোক ঘাড় না-ঘুরিয়েই জবাব দেন, ‘আজ্ঞা করুন, মাতঃ।

‘কী-কী মাছ পড়ল?’ ফুল্লরা শুধান।

ভদ্রলোক নিঃশব্দ হাসেন—’মাছ তো ধরছি না মোটে, একটা শিকোয়ার জবাব ধরবার চেষ্টায় আছি।’ কিন্তু দু’জনের কেউই সেটা না-জানতে চাওয়ায়, তিনি নিজেই খোলসা করেন, ‘ওই-যে পানির উপর চাঁদের টুকরোগুলির পাশাপাশি সাদা-পানা দোদুল্যমান বস্তুগুলি-যে দেখছেন, ওগুলি কী বলতে পারেন?’

কালকেতু ও ফুল্লরা যুগপৎ বলেন, ‘পুঁটিমাছ।’

ভদ্রলোক আবার নিঃশব্দ হাসেন, বলেন, ‘না জি, ওগুলি ফাৎনা। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে, ম্যালথাসের মৎস্যসঙ্খ্যা-তত্ত্ব অনুযায়ী,—অর্থাৎ কোনওখানে ফানা যদি বাড়ে গাণিতিক হারে তাহলে মাছ কমে জ্যামিতিক হারে, এই লখে একশ’ বৎসর পূর্বে যে-পরিমাণ মাছ ছিল, এখন সেই পরিমাণ ফানা থেকে থাকলে, মাছের পরিমাণ এখন মাইনাস কত?

কালকেতু ও ফুল্লরা গণনা শুরু করেন, কিছুদূর অগ্রসরও হ’ন, এমতো সময় ভদ্রলোক আবৃত্তি করেন :

‘খবর দিলাম মাছেদের, আর
বললাম, “এ-ই ইচ্ছে আমার!”

সাগরের খুদে মৎস্যেরা ঢের
জলদি পাঠাল জবাব তাদের।

মাছেরা বলল, “নমস্কারম্!
পারব না এটা আমরা, কারণ—”  

আবার বার্তা পাঠালাম—”শোনো,
কথাটা শুনলে ক্ষেতি নাই কোনও।”
শুনে রেগে গিয়ে মৎস্যেরা কয়,
‘নিজেকে কী ব’লে সন্দেহ হয়?’

একবার বলি, দু’বার বোঝাই,
মাছেরা তথাপি হ’ল না সোজা-ই।

নিলাম একটা বড়সড় হাঁড়ি
যেমনটি ঠিক হবে দরকারি।

দুরুদুরু বুক, উড়ুউড়ু মন
নলকূপে হাঁড়ি ভরছি যখন।

তখন কে যেন কানে-কানে গান গায়,
“মাছেরা এখন শুতে গেছে বিছানায়।
সোজাসুজি আমি বলে দিই,
“তবে তাদেরকে ফের ওঠাতেই হবে!”

বললাম আমি ভয়ানক জোরে
সরাসরি তার কানের ভিতরে।

লোকটি বেজায় একগুঁয়ে, হাঁদা,
বলল, “অমোন চেঁচিয়ো না, দাদা!”

লোকটিকে নিয়ে হয়েছে বিপদ্‌ই,
বলল, “ওদের তুলে দেব, যদি—”  
একটা খড়কে কাঠি নিয়ে বের
হলাম নিজেই ওঠাতে তাদের।

দরজা বন্ধ দেখে তড়িঘড়ি
টানি আর ঠেলি, গুঁতাগুঁতি করি।

বন্ধ দরজা দেখে রাগে কাঁপি,
হাতল ঘোরাতে গেলাম, তথাপি—’ [৪০]

ফুল্লরা বলেন, ‘চাচ্চু, আপনি এখানে ক’বছর?’

‘সেটার হিসাব বা’র করার জন্যেই তো মাছের সঙ্খ্যার হিসাবটা জরুরি। আর কোনও সূত্র আমার হাতে নাই—আর কোনও তত্ত্ব, তথ্য, পরিসঙ্খ্যান। ভালো কথা, দেশের প্রেজিডেন্ট কে এখন?’

দু’জনের কেউ-একজন, প্রেজিডেন্ট কে বলেন। তারপর তাঁরা সেই ফিশার কিং বা মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মছলিবাবাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ক’রে পুনরগ্রসর হ’ন। ‘খেলাটা দেখবেই না কি একটু?’ ফুল্লরা শুধান। তারপর বলেন, ‘টিকিট আছে দু’টো।’

কালকেতু বলেন, ‘কিন্তু তোমার পার্স তো ফেলে এসেছো রেস্তোরাঁয়।’

ফুল্লরা অপাঙ্গে বিদ্যুৎ হেনে, মুস্কুরিয়ে বলেন, ‘দরকারি জিনিসপত্র মেয়েরা ব্যাগে রাখে না আর।’

লথ্ পেরোবার জন্যে দু’জনে অতঃপর পুলসেরাত সেতুতে ওঠেন। ক্ষণেক দাঁড়ান। আহ্! এমন রাত পৃথিবীতে আর আসে নাই। আর আসবে না। ফুল্লরা, নীচে চন্দ্রিকাস্পৃষ্ট বীচিমালার পানে তাকিয়ে মোহিত হ’ন। কালকেতু সম্মোহিত হ’ন।

কালকেতু ভনেন :

‘মিরাবো সেতুর নীচে সেন বয়ে যায়
আমাদের প্রেম
কেবা মনে রাখে যায়-যে কোথায়
সুখ ভেসে আসে দুঃখের গায়ে-গায়ে’

ফুল্লরা ধুয়া দেন :

‘রাত্রি আগত প্রহর বেজেছে ঐ
দিনগুলি যায় চ’লে যায় আমি রই’

কালকেতু :

‘হাতে হাত এসো রই মুখে মুখে নত
এদিকে তো আমাদের
বাহুর সেতুর তলায় নিত্যায়ত
নেত্রে চলেছে ঢেউ-যে শ্রান্ত কত’

ফুল্লরা :

‘রাত্রি আগত প্রহর বেজেছে ঐ’

কালকেতু :

‘প্রেম চ’লে গেল যেন বা স্রোতের জল
প্ৰেম চ’লে গেল
জীবন যেমন মন্থর অচপল
অথবা যেমন আশা উচ্ছৃঙ্খল’

ফুল্লরা :

‘রাত্রি আগত প্রহর বেজেছে ঐ

কালকেতু :

‘দিনগুলি গত সপ্তাহ পায়ে-পায়ে
সময় চ’লে না
প্রেম তো ফেরে না হায়
মিরাবো সেতুর নীচে সেন বয়ে যায়’

ফুল্লরা :

‘রাত্রি আগত প্রহর বেজেছে ঐ
দিনগুলি যায় চলে যায় আমি রই

‘ফুল্লরা,’ কালকেতু ডাকেন, ‘ফুল্লরা, তুমি কি বড় একটা মাইন্ড করবে, যদি—যদি তোমাকে এখন গলা টিপে মারি?’

‘প্রশ্নই ওঠে না,’ ফুল্লরা বলেন, ‘কিন্তু আগে বলতে হবে, তারপর কী তুমি করবে।

কালকেতু আকাশ-পাতাল ভাবেন, তারপর বলেন,

‘ভুলে যাব সেই সাধ, যে-সাহস এনেছিল মানুষে কেবল,
যাহা শুধু গ্লানি হ’ল, কৃপা হ’ল, নক্ষত্রের ঘৃণা হ’ল, অন্য কোনও স্থল
পেল না কো।’[৪২]

তারপর বলেন ‘হাত থাকতে মুখে কী’ এবং ফুল্লরার কণ্ঠনালী চেপে ধরেন।

ফুল্লরা জীবন-মরণের খাইবারে, হেনকালে ওপার থেকে কে চেঁচিয়ে ওঠে—’প্রকাশ্য চন্দ্রালোকে এ-সব কী হচ্ছে? এ-সব কাজকাম ঘরে সারতে হয়, রাস্তায় না। আপনাদের জন্যে চাকরিটাই খোয়াব দেখছি।’

কালকেতু, ফুল্লরার কণ্ঠাগত প্রাণটিকে রেহা করেন। ফুল্লরা অল্প কাশেন, তারপর, যেন কিছুই হয় নাই, পাড়ে নেমে যান।

কালকেতু, ছায়ামূর্তির দিকে তাক ক’রে বলেন, ফুল্লরার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ, জনাব। একটু কাছাকাছি আসবেন কি?”

জনাব কাছাকাছি আসতেই বোঝা যায়, যে তিনি আর কেউ নন, ক্রিসেন্ট লেক, থুড়ি, ধোলাই খালের সেই ছায়া-পুলিস। ফুল্লরা ‘ভাইয়া!!!’ব’লে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর উপর। পুলিস মহাশয় টাল সামলাতে না-পেরে উল্টায়ে পড়েন, এবং মুক্তির জন্য অকটবিকট করেন।

একটু দূরে-দাঁড়ানো, কালকেতু গলা-খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘ফুল্লরা, ইনসেস্ট হ’য়ে যাচ্ছে নাকি?”

ফুল্লরা ঝাপ্টাঝাপ্টি করতে-করতে বলেন, ‘কী করব, আমার হাত-পা- গুলোকে মোটেই খুঁজে পাচ্ছি না যে। সেগুলির জায়গায় ভাইয়ার হাত-পা-ই শুধু পাওয়া যাচ্ছে।’

অতঃপর কালকেতুর সবল হস্তক্ষেপে, দু’জনের দেহকে আলাহিদা করা সম্ভব হয়, এবং দু’জনে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে দাঁড়ানোর পর দেখা যায়, যে, তাঁদের পোশাক অদলবদল হ’য়ে গিয়েছে—মায় অন্তর্বাস-সমেত। জায়গাটা অন্ধকার হওয়াতে, দু’জনে নিঃসঙ্কোচে—তাছাড়া ভাই-বোনের লজ্জা কী- জামা-কাপড় খুলে আবার নিজনিজগুলি পরে নেন।

ফুল্লরা অনুযোগ করেন, ‘ভাইয়া, আমার ব্রা-টা ঢিলা ক’রে দিয়েছো তুমি!’

‘ওটা আর পরিস না তাহলে,’ ভাইয়া বলেন, ‘বরং আমার বেল্টটা ধার নিতে পারিস, “ওগুলি”-কে বেঁধে রাখার জন্যে।

কালকেতু বলেন, “ওগুলি”-কে অবশ্য পুলিসি প্রহরায় রাখাটাই সমীচীন। ন নক্তং দধী ভুঞ্জীত।’

ফুল্লরা বলেন, ‘তোর মুখে কিরে পড়ুক!”

তখন কালকেতু (পুলিসকে) শুধান, ‘আমাদের ফলো করছিলেন নাকি?’

‘জি,’ পুলিস ওতরান, ‘শাহবাগ-তক আপনাদেরকে এসকর্ট করার দায়িত্ব আমার। এর পরে কে করবে তা অবশ্য সে-ই শুধু জানে।

ফুল্লরা বলেন, ‘কিন্তু এই ত্র্যহস্পর্শের পরিণতিটা কী হবে সেটাই ভাবনার বিষয়।’

পুলিস অবাক্ চোখে ফুল্লরার চোখে তাকান।

কালকেতু তাঁকে আশ্বস্ত করেন, ‘একটু ছিট-মতো আছে, সামান্য, ভয়ের কিছু নেই।

ফুল্লরা হাসেন। হাসেন কালকেতু। পুলিস হাসবেন কিনা বুঝতে পারেন না। শেষে কাজেই নির্বোধের মতো হাসেন তিনি—আর এক বীভৎস কঠিন নিষ্ঠুর হাসিতে আকাশময় কোটি-কোটি নক্ষত্রের দংষ্ট্রা-সকল ঝিকমিক জ্বলে ওঠে… পুলিস খেয়াল করেন না।

১২.

তিনজনে একত্রে পথ চলেন। কখনও আগুপিছু, কখনও পাশাপাশি। ফুল্লরা অবশ্য উভয়ক্ষেত্রেই মধ্যে থাকেন। স্থান-বদল হ’তে থাকে কেবল পুলিস এবং কালকেতুর

ফুল্লরা বলেন, ‘তো তোমার নাম কী, ভাইয়া?”

‘মুজ লে হুডিন, বোন।’

‘মুজ লে হুডিন—মুজ লে—মুজ—মুজ—’ ফুল্লরা কিছু মনে করবার চেষ্টা চালান এবং হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলেন, ‘তুমিই কি?’

‘জি বোন,’ মুজ লে হুডিন বলেন, ‘সে-যে আমি, এই আমি।’

ফুল্লরা উচ্ছল হ’য়ে ওঠেন—’কালকেতু! কালকেতু! চিনতে পারছো? এঁ-ই সেই মুজ লে হুডিন!’

কালকেতু বেরসিকের মতো ‘কোন মুজ লে হুডিন’ বললে, ফুল্লরা ক্ষিপ্ত হ’য়ে বলেন, ‘আরে ইডিয়ট! সেই-যে আপেলের মতো ইয়ে পাকিস্তানি নাকি কাশ্মিরীঝর্নাধারার পাশে নাকি মাঝখানে—মনে নেই?’

এমন দৃশ্য মনে করতে কার না-লাগে ভালো। কালকেতু সঙ্গে-সঙ্গে বলেন, ‘ও আচ্ছা, আপনিই তিনি! আগে বলতে হয়! কী সৌভাগ্য! আলোহা! খুশ আমদেদ! স্বাগতম! তা সেই আপেলিনি এবে কীরূপ আছেন? ওঁকেই তো বে করেছিলেন, নয়?’

মুজ লে বিমর্ষ হ’ন, বলেন, ‘তিনি আর আপেলিনি নেই গো বাপুরা, তিনি এখন গ্লোবিনি—মেদিনী; পরন্তু এখন তিনি পরের ঘরনি। বা, পরের পরের পরের ঘরনি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, এ-যাবৎ তিনবার ঘর-বর বদলেছেন তিনি।’

এক মিনিট নীরবতা পালন করেন ছায়া-পুলিস, তারপর গুনগুন ধরেন :

‘Said the apple to the orange:
“Oh I wanted you to come
close to me and kiss me to the core.
Then you might know me
like no other orange
has ever done before…’[৪৩]

‘লিখছেন আজকাল?’ কালকেতু শুধান।

‘সময় পাল্টে গেছে ভায়া,’ মুজ লে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন—’অন্যদের কালে বাস করছি। পুলিস ব’লে কিছুটা তাও রক্ষা, নইলে অ্যাদ্দিনে আন্দামান চালান হ’য়ে যেতাম।

‘আন্দামান তো এখন বাংলাদেশের আন্ডারে, তাই না?’ ইতি ফুল্লরা।

‘তা না,’ কালকেতু আলো দেন, ‘তবে, শুধু আন্দামানে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশীয়দের, ভারতীয় ভিজা লাগে না আর। আন্দামানের আদিবাসী হেড-হান্টারদের খাদ্য সরবরাহের এই চমৎকার ব্যবস্থাটি সম্প্রতি গ্রহণ করেছে ভারত সরকার। অবশ্য পশ্চিম বাংলায় যেতে হ’লে ভিজা এখনও লাগে—এবং সেই সঙ্গে ‘র’-এর বিশেষ অনুমতি।’

‘যুক্তবঙ্গ আন্দোলনের খেসারত,’ বলেন মুজ লে, ‘এক বাংলা দু’টি দেশে! বাঙালি জাতির উপর লানত নেমেছে সেই সত্যযুগেই—অভিশপ্ত জাতি!’

‘ফর ইয়োর ইনফর্মেশন,’ কালকেতু বলেন, ‘বাংলা, এখন দু’টি নয়, বরং পাঁচটি দেশে বিভক্ত। সম্প্রতি, অধুনা-স্বাধীন ত্রিপুরাকে তৃতীয়, বর্মার রোসাঙ্গকে চতুর্থ, এবং চীনের সিনকিয়াং বা পূর্ব তুর্কিস্তান বা তোখারিস্তানকে পঞ্চম বঙ্গ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া লাইনে আরও রয়েছে আসাম, মেঘালয়, চম্পা, ন্যুয়র্ক, নাগাল্যান্ড, সিকিম, গোরক্ষ রাজ্য, মালদ্বীপ, মালাগাছি, বলীদ্বীপ, যবদ্বীপ, শ্রীবিজয়া, এবং, সর্বোপরি, তিব্বত। তোখারি রাজ্যের বঙ্গ-সংজ্ঞা-প্রাপ্তির ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র মাস-ছয়েক আগে, যখন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এবং রাহুল সাংকৃত্যায়ন-এর যৌথ গবেষণায় প্রমাণিত হয়, যে, প্ৰাচীন তোখারি (বা তোখার বা তুষার) জাতি আসলে বাঙালি। এরা খ্রি.পূ. দু’শ’ চল্লিশ সাল নাগাদ, অসভ্য হৈহয় জাতির সার্বক্ষণিক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে প্রথমে তিব্বত, এবং পরে পামির পেরিয়ে তারিম নদীর উপত্যকায় একটি সমৃদ্ধিশালী জনপদ গড়ে তোলে। শাস্ত্রী মহাশয় এটাও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যে, প্রাচীন তোখারিয় ভাষাদ্বয়ের অন্যতম, ‘তোখারিয়ান এ’, পূর্বী, মানে বঙ্গালী, এবং অন্যটি, ‘তোখারিয়ান বি’, পশ্চিমী, মানে রাঢ়ীয় বাংলারই প্রাচীনতম রূপ। তাঁর এই আবিষ্কারের প্রধান সূত্র ছিল ‘চ’-কার। তিনি প্রথমেই লক্ষ করেন, যে, তোখারিয়ান এ-তে ‘চ’ বর্ণের যা ছিল সম্ভাব্য উচ্চারণ, তা বঙ্গালী উপভাষা-ব্যতীত পৃথিবীর আর কোনও ভাষাতেই শ্ৰাব্য নয়। দ্বিতীয় সূত্রটি ছিল, সলিল-অর্থে তোখারিয়ান এ-তে ‘পাইন’ (পানি), এবং বি-তে ‘চ্ছল’ (জল) শব্দের ব্যবহার। সাংকৃত্যায়ন মহাশয় অবশ্য জোর চেষ্টা চালান, তোখারিয়কে প্রাচীন হিন্দি ব’লে প্রমাণ করবার এবং তিনি এমন বলেন, যে, ‘তুষার’ শব্দটিকে মধ্য হিন্দিতে তোখার বলা হ’ত। কিন্তু, এর বাইরে আর কোনও সাবুদ হাতে না-থাকায়, চর্যাপদের ক্ষেত্রে যেমন তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, এক্ষেত্রেও তেমনই ভগ্নমনোরথ হ’ন। রাহুলজির প্রাণান্ত প্রচেষ্টার অবশ্য এমতো বাই-প্রডাক্ট উপজে, যে, ভারত সরকার হিন্দি ও মরাঠিকে ফিল্মি, ইংরাজি ও তামিলকে আদালতি, গুজরাটি ও রাজস্থানীকে ব্যবসায়িক, পঞ্জাবি ও অসমিয়াকে রাজনৈতিক এবং বাংলা ও মলয়ালি ভাষাকে ভারতের সাহিত্যিক ভাষারূপে মর্যাদা দেন। ‘উল্টো বুঝলি রাম’ এইরূপ ভেবে, রাগেদুঃখে, রাহুলজি চিরস্থায়ীভাবে লাদাখ চ’লে যান (শোনা যায় তিনি এখন তিব্বতিকে নিয়ে পড়েছেন) সর্বশেষ প্রমাণটি আবিষ্কার করেন বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয়। তিনি শালবন বিহারের একটি ইটের তলায়, শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের একটি চিঠির অনুলিপি পান, যা প্রাচীন বঙ্গভাষায় লিখিত, এবং যা অতীশ, তিব্বতে বসবাসকালে, তৎকালীন তোখারি সম্রাট চন্দ্রকেতুকে লিখেছিলেন। এই চিঠি নিশ্চিতভাবে প্রমাণ ক’রে, যে, শুধু-যে তোখারিরা জাতিগতভাবে বাঙালি তা-ই নয়, অতীশের জীবৎকাল পর্যন্তও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। চিঠিটা অনেকটা এরকম :

ভ্ৰাতঃ চন্দ্ৰকেতো,

আশীর্বাদ পুরঃসর। আমাদিগের ভগিনী লহনাকে বিবাহ করিয়া তুমি যদিচ অগম্যাগমনের কলঙ্ক আপন রাজশিরে কণ্টকমুকুটসম ধারণ করিয়াছো, তথাপি আমার তাদৃক্ ক্ষোভ ছিল না। কিন্তু সম্প্ৰতি আমাদিগের পিতুঃস্বসা শ্রীমতী ময়নামতী দেবীর প্রতি যে-কদর্য প্রস্তাবনা পাঠাইয়াছো, তাহাতে আমি যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হইয়াছি। ইহা বক্রকামেরই নামান্তর। কেননা, শ্রীমতী ময়নামতি নামেই দেবী, কার্যতঃ শিখণ্ডী-স্বরূপিণী।

অতএব এক্ষণে আমি তোমার যথাবিহিত প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিতেছি, অবধান করো : [“এখানে এক বিশাল লিস্টি”—কালকেতু বলেন।] এই প্রায়শ্চিত্তানুষ্ঠানে অপারগ হইলে, তোমাকে আমি অগত্যা ত্যাজ্যভ্রাতা ঘোষণা করিতে বাধ্য থাকিব। ইতি চৌঠা পৌষ …

ত্বদীয়াগ্রজ অতীশ।

‘আজকালকাল লেখালেখি কেমন লাগে, ভাইয়া?’ ফুল্লরা, মুজ লে-কে শুধান।

মুজ লে মুচকি হেসে বলেন, ‘কবিতায় বলি?’ তারপর বলেন :

‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জীবনানন্দ দাশ—
এ-তিনখানাই মুরলী এ-বাংলার,
বাদবাকি সব কাঁচা আর ফাটা বাঁশ।’

ফুল্লরা বলেন, ‘অঁকোর! অঁকোর! কবিতাও লিখছো আজকাল?

‘শওকত ওসমান-এর দীক্ষা। তাছাড়া কবিতা লেখার মতো কেউ তো আর বেঁচে নেই বাংলায়। কেননা, মাসুদ খান তো কবিতা লেখেন না, লেখেন পোইট্রি; তেমনি, সাজ্জাদ শরিফ লেখেন পোইজি। খাঁটি বাংলা কবিতা ওসমান সাহেবই শুধু লিখেছেন সাম্প্রতিক কালে।’ মুজ লে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন—”হে মোর দুর্ভাগা দেশ!

কালকেতু কিন্তু একটু কুপিত হয়েই বলেন, ‘এমনকি বিষ্ণু বিশ্বাসকেও আপনি স্বীকার করেন না! আশ্চর্য!’

মুজ লে বলেন, ‘হ্যাঁ, ছেলেটা লিখত ভালোই—সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু গেল কোথায় সে?’

জবান দেন ফুল্লরা :

“There was a naughty boy
And a naughty boy was he,
He ran away to Kolkata
For the people to see …

There he found
The Maidan grounds
Fulla’ she-men
Lacking semen-
The Monument being
One sad, last reminder
Of the real thing!

And then our naughty boy
Bitterly grated and prated,
But before he could make his way back home
Was castrated!’[৪৪]

‘ইনকাম কেমন আজকাল?” কালকেতু শুধান, মুজ লে-কে।

মুজ লে চাঁদিতে চোখ তোলেন—’ইনকাম! এক্সপেন্ডিচার বলুন। শালার ট্রাক-চালক সমিতির প্রেজিডেন্ট দেশের প্রেজিডেন্ট হবার পর থেকে বইয়ের রয়ালটির টাকায় কোনওমতে ভদ্রতা বজায় রাখছি।’

‘বেতন,—ইয়ে—উৎকোচ?’—কালকেতু।

‘উৎকোচ আছে বৈকি, বেতনও। তবে উৎকোচটা এখন দিতে হয় চোর – বদমাশদেরকে, বেতনের টাকাটা সেই খাতেই খরচ হয়।’

ফুল্লরা তখন বলেন, “ভাইয়া, তুমি কিন্তু কথাটা ঠিক বলো নাই, মানে গুণ-এর কথাটা। তিনি কখনওই ট্রাক-চালক সমিতির প্রেজিডেন্ট ছিলেন না। তিনি বরং ছিলেন ট্রাকে-চাপা-পড়তে-না-চাওয়া-অসহায়-জনতা পার্টির কোষাধ্যক্ষ। ‘

‘ওই হ’ল,’ মুজ লে বলেন, ‘যাঁহা বাহান্ন। ট্রাক-চালক এবং ট্রাকে-চাপা-পড়া ব্যক্তির পার্থক্য শুধু এইটুকু, যে, একজন চাকার উপরে এবং একজন নীচে—একজন মহাযান, একজন হীনযান।

কালকেতু কিন্তু মুজ লে-র তকমা-প্রভৃতির দিকে ইঙ্গিত ক’রে বলেন, ‘এতদিনে আপনি মাত্র সাব-ইন্সপেক্টর, বিষয় কী?”

‘বলবেন না,’ বলেন মুজ লে হুডিন। তারপর বলেন, ‘ছিলাম ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল। তো ম. রাফায়েলের আমলে সাজানো ব্যর্থ কু দেতার পর যখন একে একে জেনারেলদেরকে কতল করা হচ্ছে, তখন রাতারাতি আমি নেমপ্লেট থেকে জেনারেল শব্দটা ঘ’ষে তুলে ফেলি। সেই থেকে একবার নিজেকে ডিমোট করতে-করতে কনস্টেবল পর্যন্ত নামাই, আবার প্রমোট করতে-করতে ওঠাই ইনস্পেক্টর পর্যন্ত। তাছাড়া জেনারেল-গিরির তুলনায় কনস্টেবল-পনা অনেক ভালো—বিশেষত লেখকদের জন্যে।

এইসকল আলোচনা-রত নিশাচরত্রয় হাতিরপুল ওভারপাসে উঠে পড়েন, ক্ষণেক দাঁড়ান, কেননা, তক্ষুনি তূর্ণা এক্সপ্রেস, ‘রেলরেললাইন রেলরেললাইন ধ্বনিতে ওভারপাস প্রকম্পিত ক’রে, তিনজনের পায়ের নীচ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে, কিছু সামনে, ক্রৌঞ্চ টানেলে ঢুকে প’ড়ে।

মুজ লে বলেন, ‘কত দিন মনে ছিল আশা- এখান থেকে লাফিয়ে পড়ার। একদিন এমনকি নীচে নেমে শুয়ে ছিলাম লাইনের উপর। মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, বেলা যায়—ট্রেন আসে না। পরে বিরক্ত হ’য়ে উঠে গিয়ে শুনি সেদিন রেল-ধর্মঘট। বরং আমার উর্দি দেখে রেল-শ্রমিকরা মারতে আসে। আমি কোনওমতে জান হাতে নিয়ে পালাই।”

তারপর তাঁরা পুল থেকে অবতরণ ক’রে সবেমাত্র শাহবাগ আভন্যুর লালবাতির মোড়ে এসেছেন, মুজ লে দাঁড়িয়ে প’ড়ে (ফুল্লরাকে) বলেন, ‘এইবার বিদায় দে বোন, আমি আসি।’

ফুল্লরা ককান—’সে কী ভাইয়া!’

‘শাহবাগটা অন্তত পার করিয়ে দিয়ে যেতেন—’ কালকেতু অৰ্ধ-অনুরোধ করেন।

‘শাহবাগ যেতে আমার গুরুর নিষেধ আছে, বরাদরে আজীজে মন! ওখানে নারীবাদী কবিরা নাকি পেন্সিল শার্পনার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার তো পেন্সিল নেই, কী শার্প ক’রে দেয় কে জানে। পরন্তু, শোনা যায়, আমার ভূত-পূর্বা ভার্যাও নাকি হামেশা শাহবাগে আসেন, এবং সিলভানায় আড্ডা দেন ফরিদ কবিরের সঙ্গে। তাঁর অবশ্য বসতে আর চেয়ার লাগে না এখন। আপন নিতম্বের গদির উপরে বসেই চেয়ার-সমান উচ্চতায় থাকেন তিনি। সেলিম মোরশেদ শুনেছি তাঁকেই সোফা ভেবে, তাঁর কোলে বসেই একবার সারা রাত আড্ডা দেন—তিনি অবশ্য মোরশেদের মুরশিদি আলোচনায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর একবার নাকি হাসতে হাসতে উল্টে পড়ায়, আপন স্তনভারের চাপে তাঁর পাঁজরের দু’টি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ভাগ্যিস পিজি ছিল পাশেই।’

রকেটের ফ্যুয়েল-ট্যাংকের মতো, মুজ লে-কে খশিয়ে দু’জনে আবার দু’জনে-দু’জনায় হ’য়ে শাহবাগ-ধামে অবতীৰ্ণ হ’ন।

(শাহবাগ-সঙ্ক্রান্ত একটি ঐতিহাসিক বর্ণনা এখানে কেটে দেন তাজুল হক।)

১৩.

প্রণয়িযুগলকে দেখিবামাত্র, সডোমি ফ্রম সডোম অ্যান্ড গোমারা নামক পুস্তকালয় থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসেন শান্ত বল্লাল এবং তৎপার্শ্বচর, আঁকশি ইস্তফা। তাঁরা এসেই কালকেতু ও ফুল্লরাকে চকাস-চকাস চুমু খান।

আঁকশি (কালকেতুকে) বলেন—’কত দিন পর বঁধুয়া এলে, দেখা না হৈত পরান গেলে,’ ইত্যাদি—তারপর, ফুল্লরাকে :

‘আহ মা-শেরি! কী রূপ হেরি তোর!
কণ্ঠহারে গাঁথা আছি হাজার ইতর।
এতদিনে রচিলাঙ চরম পয়ার :
(sh)E=MC2!’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উতোর করেন শান্ত (তিনি কম কীসে?) :

‘একদিন জার নিকোলাস
দেখিলেন্ত এক কৃকলাস,
লম্ফ দিয়া ধরিবারে চাঁদ
ভূমিতলে উলটি পপাত—
তৎক্ষণাৎ বুঝিলেন্ত, আহা,
দিন শেষ হৈয়াছে তাহার।
“জারেভিচ, জারেভিচ, আয়!”
—গলা বুজে গেল কান্নায়।

শান্ত বলেন, ‘কালুদা, শাহবাগে আসেন না-যে আর?’

কালকেতু বলেন, ‘প্রথমতঃ, “কালুদা” সম্বোধনে আপত্তি আছে আমার। ইচ্ছে হ’লে আমাকে কালিদা, কালদা, কালভাই—যা খুশি ডাকা যায়, কিন্তু কালুদা নেভার এভার। দ্বিতীয়তঃ, আমি শাহবাগে আসি না ইদানীং গুলবাগে বসবাস করবার কারণে। স্যাটিসফায়েড?’

‘ফুলিদি—’ আঁকশি ইহা উচ্চারিবামাত্র, ফুল্লরা বলেন, ‘ফুলিদি” নেভার এভার।’

‘ঠিকাছে। তো ফুল্লরাপা, আপনি সহসা এই স্থলে যে?’

‘কেননা,’ ফুল্লরা ভেবে বলেন, ‘এখানে এ-সময় কালকেতুর থাকবার কথা ছিল না, আর কালকেতুর যেখানে থাকবার কথা থাকে না, সেখানেই আমার থাকে, ফলে কালকেতুর এবং আমার, দু’জনেরই যেহেতু এ-সময়ে শাহবাগে থাকবার কথা না, দু’জনেই তাই আছি।’

এই দীর্ঘবাক্যের অর্ধেকের মতো শুনে, শান্ত ও আঁকশি যেমন এসেছিলেন, তেমনি লাফিয়ে পালান।

ক’এক পা এগুতেই দ্বিত্ব কবির পথ রোধ ক’রে দাঁড়ান। দ্বিত্বর মাথার অর্ধেক চুল এবং এক পাশের গোঁফ এবং এক গালের দাড়ি কামানো, বা ওপড়ানো। তাই নিয়ে ফুল্লরা কটাক্ষ করলে তিনি (দ্বিত্ব) বলেন, ‘রোজ-রোজ কামানো ও না-কামানো আর পোষায় না।’

দ্বিত্ব তারপর কালকেতুকে বলেন, ‘লাগবে নাকি? জেসন আছে। কালকেতু বলেন, ‘জেসন দুইনম্বর হ’য়ে গেছে, ফার্মাদেশ থাকলে বলো।’

দ্বিত্ব বলেন, ‘ফার্মাদেশ বাংলাদেশে পাবেন না।’

অতঃপর, অধিক বাক্যক্ষেপ না-ক’রে, তিনি একটা ছোট্ট—– অতি- ছোট্ট-দোকানোর অন্ধকারে ঢুকে পড়েন, যার নাম মাইনকা চিপা।

ফুল্লরা বলেন, ‘তোমাদের রাসায়নিক কথোপকথনে হাসিনের কথা মনে প’ড়ে গেল।’

হাসিনের কাহিনি নিম্নরূপ :

হাসিন ছিলেন বৈজ্ঞানিক। বিশেষতঃ ভেষজবিদ্যা এবং রসায়নে তাঁর মাথা ছিল আর্যভট্ট এবং আইনস্টাইনের সম্মিলিত মগজের চেয়ে চোখা। তাঁর অসাধারণ মাথাটির প্রশংসাতেই (সম্ভবতঃ), তাঁর বন্ধু মিরোস্লাভ হোলুব নিম্নোদ্ধৃত কবিতাটি রচেন :

‘In it there is a space-ship
and a project
for doing away with piano lessons.

And there is
Noah’s ark
which shall be first.

And there is
an entirely new bird,
an entirely new hare,
an entirely new bumble-bee.
There is a river
that flows upwards.

There is a multiplication table.
There is anti-matter.

And it just cannot be trimmed.

I believe
that only what cannot be trimmed
is a head.

There is much promise
in the circumstance
that so many people have heads.’[৪৬]

তো এহেন হাসিন, সাকল্যে নয় মাসের গবেষণায়, অদৃশ্য হওয়ার অষুধ আবিষ্কার করেন, এবং তা পান ক’রে খোদ অদৃশ্য হ’ন। হাসিন, ফুল্লরাকে ভালোবাসতেন, এবং ফুল্লরা তাঁকে ডাকতেন পণ্ডিত আর্যভট্ট, বা কোনও- কোনও আদুরে মুহূর্তে, আরজু, বা হাসু। অদৃশ্য হওয়ার পর এই আরজু, বা হাসু, তাঁর কতিপয় পূর্বশত্রুকে হত্যা করবার পর (কালকেতু ভাগ্যিস বাসায় ছিলেন না), ফুল্লরার কাছে এসে তাঁর কানে-কানে বলেন, ‘প্রিয়তমে!

ফুল্লরা কাউকে দেখতে না-পেয়ে ফিট হ’ন। তখন, অদৃশ্য অবস্থাতেই, হাসিন, ফুল্লরার মাথায় পানি ঢেলে, পায়ে অলিভ অয়েল ডলে, নাকে জুতা ধ’রে, তাঁকে সুস্থ করেন, এবং ফুল্লরার ট্যারা-হয়ে-যাওয়া চোখ আবার সোজা হ’লে বলেন, ‘ফুল্ল, তোমার আমার মুক্তির পথ আমি আবিষ্কার করেছি। আমরা দু’জনে লোকচক্ষুর অন্তরালে অতঃপর অনন্তকাল প্ৰণয়স্বর্ণস্বর্গে অভিবাস করব। এই নাও, এই ড্রাগটি সেবন করো।’ ব’লে, তিনি একটি অদৃশ্য শিশি ফুল্লরার হাতে দেন।

ফুল্লরা, শিশিটির স্পর্শমাত্রে পুনরায় ফিট হ’ন, এবং শিশিটি চৌচির হ’য়ে তাঁর স্নানঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে প’ড়ে। (ফুল্লরা, কালকেতুকে বলেন, ‘ওই অদৃশ্য কাচে এখনও মাঝে-মাঝে পা কাটে আমার।’)

মুহুর্মুহু ব্যর্থতায় মুহ্যমান হাসিন, ফুল্লরার সংজ্ঞাহীন হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে চিরপ্রস্থান করেন :

‘আমি এক খোদার খাসি
তাই তোমারে ভালোবাসি
আজ তোমারে মুক্তি দিয়ে
চড়িলাম আমি ফাঁসি
ইতি হাসিন—পনেরো-বারো-অষ্টআশি (বাং)’

হাসিনের লাশটি, বলা বাহুল্য, পাওয়া যায় নাই। (কালকেতু জিজ্ঞাসেন, ‘সত্যি ফিট হয়েছিলে?” ‘পাগল!’ ফুল্লরা বলেন, ‘নারীর প্রধান দুই অস্ত্র, অশু ও মূর্ছা—এ-দু’য়েও কাজ না-হ’লে, হাসি।’ ব’লে তিনি হাসেন। কালকেতু বলেন, ‘হায় হাসিন!’ )

সামান্য এগুতেই, বইয়ের দোকান, ঠক সমাবেশ। নামটি সম্ভবতঃ ছিল পাঠক সমাবেশ, বাংলার রোদে-জলে-ঝড়ে ‘পা’-টি খসে গিয়ে থাকবে। অবশ্য তা না-ও হ’তে পারে। দোকানের ভিতর থেকে সংজিব চৌধুরীর কিম্পুরুষ-কণ্ঠ উড়ে আসে :

‘ভূতে ধরেছে আমারে ভূতে ধরেছে
ছাপাখানার ভূতে ধরেছে
মরি হায় হায় হায়
আয় খোক্কস আয় রাক্ষস
আয় আয়
তোরা আমার ভাই হোস
আমারে বাঁচা রে
ওঝা ডেকে আন গিয়ে
বাংলাবাজারে
তরুণকুমার মহলানবিসকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ফুসলিয়ে
তিনি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিসের নাতি রে
আসতেও পারেন রবিবাবুর কবিভ্রাতার খাতিরে…’

ফুল্লরা বলেন, ‘আমি কিন্তু সিলভানায় যাব না তা আগেই বলে রাখছি। সেলিম মোরশেদের চোখ যেন কেমন-কেমন, আমার গা ছমছম ক’রে।’

কালকেতু হো-হো হেসে বলেন, ‘আরে সেলিম তো কন্ট্যাক্ট-লেন্স পরেন, তাই-জন্যেই—’

‘তাছাড়া,’ ফুল্লরা আবার ঘ্যানঘ্যান করেন, ‘রামিয়াত ফেরল সরাসরি আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ওর চোখের উচ্চতা তোমার বুকের সমান হ’লে ওর কিবা দোষ? তুমি আরেকটু খাটো হ’লে পারতে। ‘

‘তাছাড়া মাসুদ সরকারের গান… তাছাড়া আমির খুসরৌর গালি… বিএলবিএল তর্কবাচস্পতির তুবড়ি… তাছাড়া…’

ফুল্লরা অনর্গল অভিযোগ জানিয়ে চলেন, এবং ক্লান্ত হ’য়ে কালকেতু বলেন, ‘তথাস্তু। সিলভানা-সন্দর্শন নাস্তি।’

তাঁরা তখন ঘুরে বরং পিজি-উদ্যানে প্রবেশ করেন।

সিলভানা এড়িয়ে দু’জনে এক সিলভান সিনে গিয়ে ঢোকেন, যেখানে মহাফ্যালিক কাপালিক জীমান হরনাম, তস্য মহাশিশ্নকে ভূমিতে সিকি- প্রোথিত ক’রে, শূন্যমার্গে জোঝুল্যমান। তাঁর মাথার উপর বসেছেন, বাই-নারী- বাদী, শায়ারন ঝা (পরনে লুঙ্গি এবং স্যান্ডো গেঞ্জি), এবং তাঁর (জীমানের পায়ের নীচের দিকে উপবিষ্টা, কাফ্রিকা-বাদী কবি-নী, অ্যালিস পরিজার (এঁর পরনে জেব্রার অজিন, এবং ব্লু-জিনস)—এবং তাঁরা সি-স খেলছেন। কেল্যানন্দে উভয় নারীর কণ্ঠ থেকে মুহুর্মুহু বিনির্গত হচ্ছে—’ও লা লা!’

এঁদের পিছনে মধুকূপী-তৃণাসনে পদ্মাসনে সমাসীন, অ্যাস্ট্রোনটিকস- মুগ্ধ কবি-শিল্পী-সমাবেশ। জাল জম্মু, নৃলাম খোঁজাগার, লিটনম খোঁজাগার, শিকা বকরা, এবং বীর হাম্বীর। এঁরা সমবেত জয় গোসাঞি’র কাব্য সমালোচন করছেন। বীর হাম্বীর, থেকে-থেকে হেঁকে উঠছেন ‘বন্দে মাতরম্!’ জাম্বুল, প্রায় নিয়ম-মাফিক, প্রতি-বার মাতরমের পর ‘গান্ধী-কা খড়ম’ ধ্বনি দিচ্ছেন। ফুল্লরা মুগ্ধ হ’ন এবং কবিশিল্পিবর্গের বর্গক্ষেত্রে প্রবেশ করেন এবং ফেমিনিস্ট ম্যানিফেস্টো উচ্চারেন :

‘সতীত্ব ছাড়া নারীর হারানোর কিছু নেই,
জয় করবার জন্যে আছে অসঙ্খ্য গর্দভ।’

সভা ‘হুআ হুআ’ ধ্বনিতে তাঁকে অভিনন্দিত ক’রে।

হাম্বীর বলেন, ‘আপনার এত জ্ঞান!”

লিটনম—’এত গুণ!’

নৃলাম—’এত রূপ!’

জয় গোসাঞি (জাম্বুলের গলায়) :

‘তোমার চটি,
তোমার মিষ্টি জুতো
আমার
চাটতে ভালো লাগে,
আমার
চাটতে ভালো লাগে
তোমার থুতু…’[৪৭]

জয় বা জাম্বুলের, এই রসভঙ্গের অবকাশে, কালকেতু, জাম্বুলের কানের পিছনে ভনভনান—

‘মাল কোথাকার?’

‘চাপাই—’ জাম্বুল অলখে বলেন।

কালকেতু বিরক্তে উঠে প’ড়ে ফুল্লরাকে বলেন, ‘চ’লে এসো।”

ফুল্লরা মুখ-ঝামটা দিয়ে বলেন, ‘আপনি যান।

ফুল্লরার এই কথায়, কালকেতু-ছাড়া আর সকলেই উৎফুল্ল, উল্লসিত, উচ্ছ্বসিত হ’ন। হাম্বীর বলেন, ‘আপনার এত জ্ঞান!’

লিটনম—’এত গুণ!’

নৃলাম—’এত রূপ!’

কেবল জামুল নীরব রহেন… সম্ভবতঃ ভুলে গিয়ে থাকবেন।

কালকেতু গজগজাতেগজাতে বিপ্রখ্যাত বুলবুল-বৃক্ষের তলায়, সাবদার বেদিতে যান। সেথায় আর-এক দল কবি-কথক, যাঁরা অ্যাস্ট্রোনটিকস- বিরোধী, এবং ডেক্সট্রোনটিকসের উপাসক, বসে (সকলে অবশ্য নয়), চেহারায় সুনিপুণ গাম্ভীর্য আনছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফিদর হম্মাদ, কাতির সওদাগর, জুজু মালহার, উজির আলাদিন, ঈশান জয়দ্রথ, এবং শিলা আমিষাশী। ফিদর অবশ্য বেদিতে নেই। তিনি বুলবুল-বৃক্ষের একটি ডালে বাদুড়ঝোলা হয়েছেন/রয়েছেন।

কাতির শুধান, ‘কালকেতু নাকি?”

‘জি-না,’ কালকেতু বলেন।

‘কালকেতু না!’ কাতির বিস্মিত হ’ন।

‘আজ্ঞে না,’ কালকেতু পুনশ্চ বলেন।

‘সত্যি বলো, তুমি কালকেতু নও?’ কাতির পুনরপি কাতরান।

‘নো! নো! নো!” কালকেতু চেঁচান।

শুনে, পিজির ক্যান্সার-ওয়ার্ডের চিলছাদে ঘুমানো একটা মোরগের ঘুম চটকে যায়, এবং সে তারস্বরে অভিযোগ ক’রে—’কোক্কড়কো! কোক্কড়কো! কোক্কড়কো!”

কাতির তখন, কোনওরূপ উস্কানি ছাড়াই, আবৃত্তি করেন :

‘ঘোড়া হাতে অশ্ব ছুটে যায়,
রজস্বলা হ’লে নাকি, মেয়ে?”

এ-পর্যন্ত শুনে, শিলা, বলেন, ‘আজকে? তুই রেতস্বল হবার প্রায় সাতশ ‘ বছর আগে—শালা আবাল!”

রমণী-মুখে অকথ্য শুনে কালকেতু অসহায় বোধ করেন, বলেন, ‘ভদ্ৰে, এই কি তোমার উচিত বাতচিত হইতেছে?’

শিলা বলেন (কালকেতুকে), ‘তোর তো এখনও হয়ই নাই—তুইই হয়েছিস কিনা এখনও, সন্ধ্যেয়।’

কালকেতু নিরুপায়ে ফিদরকে বলেন, ‘বাঁদরজি, অবতরণে আজ্ঞা হয়।’

ফিদর, পায়ে ঝুলে প’ড়ে, বগোল বাজিয়ে ধরেন :

‘দেখেছো নাকি তারার ফাঁকি
আকাশ আমি ঘোর একাকী
আয় রে লড়ি কাস্তে ধরি
মেঘের মাথায় হল্লা করি
ভ্যাংকুড়াকুড়
ভ্যাংকুড়াকুড়
‘না-নানানা না-নানানা
ঘোলাজলে আর না’ব না
আর যাব না প্রেতের পিছে
বিস্মরণীর নিতল নীচে
আয় রে লড়ি কাস্তে ধরি
আশাবরির বিভাবরী
ভ্যাংকুড়াকুড়
ভ্যাংকুড়াকুড়

‘প্রেমের চাপে কাঁপছে মাটি
গ্র্যানিট-কঠিন লাল-তামাটে
কে তুই এলি চোখ-দু’টিকে
দুধের বোঁটায় ঝুলিয়ে রেখে
 বুঝেছি গো বুঝেছি
তোমায় আমি খুঁজেছি

‘না-নানানা না-নানানা
আজ রাতে আর নয় শাহানা
নয় বাহানা হাস্নুহানা
তোমায় আমি মারব না
তোমায় আমি ছাড়ব না

‘হরির উপর হরি হরি
আয় রে লড়ি কাস্তে ধরি
আয় শকুনি পরম গুণিন
খোল রে ভূমার হিম-কবরী
ভ্যাংকুড়াকুড় ভ্যাংকুড়াকু

‘না-নানানা না-নানানা
দোলাচলে আর যাব না
মুণ্ডু-হাতে বেতাল ভোলা
বিজুলি-জালে বাদুড়-ঝোলা
ভ্যাংকুড়াকুড়
ভ্যাংকুড়াকুড়
ভ্যাংকুড়াকুড়
ভ্যাংকুড়াকুড়’

এরপর, সম্ভবতঃ ল্যাজ নেই ভুলে গিয়ে, এবং ল্যাজে ঝুলবার চেষ্টায়, তিনি পা ছাড়িয়ে নেন ডাল থেকে এবং তারপর যা হবার তা-ই হয়। তিনি অকালে, সাবদার বেদি-মূলে, শাহবাগের সাতশ’-সাততম, শহিদ হন।

কাতির এই মৃত্যুর দায় পুরাপুরি কালকেতুর শিরে অর্পণ-করতঃ বলেন, ‘তুমি দায়ী, তুমি আততায়ী!’

তারপর তিনি অকস্মাৎ, কালকেতুর বুকে একটা ফ্লাইং-কিক নেন। কালকেতু ধড়াধ্বড় ধরাশায়ী হ’ন। তখন শিলা এগিয়ে এসে, ‘গা তোলো, ভোজন করো, অহে প্রাণনাথ!’ ব’লে কালকেতুর হাঁ-মুখে বাগিয়ে ধরেন…

তন্মুহূর্তে ফুল্লরা দৌড়ে আসেন, বলেন, ‘অলমতি বিস্তরেণ।’ ফিদরের পানে তাকিয়ে বলেন, ‘আপচ্ছান্তি।’ এবং কালকেতুকে তুলে নিয়ে হাঁটতে লাগেন। পিছন থেকে শিলার ‘খেয়ে গেলিনি, বাপ! খিদে পাবে যে!’ এবং কাতিরের মনোডি-র ধ্বনি ভেসে আসে :

‘Here lies John Bun
Who was killed by a gun.
His name was not Bun, but Wood.
Wood would not rhyme with gun,
But Bun would.”

১৪.

কালকেতু এক হাতে (আপন) বুক ডলতে ডলতে, আন হাতে ফুল্লরার হাত ধ’রে, পুনশ্চ যাত্রা করেন হোরা-নির্ধারিত পথে। ক্রমে-ক্রমে তাঁরা সাকুরা শপিং কমপ্লেক্সের সমীপে উপনীত হ’ন। তথায় গমগমায়মান, ঢাকার খ্যাততম পানশালা-কাম-নাইটক্লাব—মধুবার।

অদ্য যদিও প্রিন্সেস শেহরাজাদের বেলি-নৃত্য নাই, তথাপি কালকেতু বলেন, ‘একটা ক্যামিকাজির শট নিয়ে আসি, না-হ’লে পাঁজরার ব্যথায় ঝাঁঝরা হ’ব।’

ফুল্লরা সম্মতি দেন, এবং উভয়ে ‘বার’-এ পশেন। ক্যামিকাজি অবশ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু দু’জনে ফটাফট তিন গ্লাস ক’রে ব্লাডি মেরি মারেন, এবং কালকেতু ‘মেরি হ্যাড আ লিটল ল্যাম’ এবং ফুল্লরা ‘মেরি মেরি কোয়াইট কন্ট্রারি’ গান করেন। তখন ‘বার’-স্থ সকল মধুপায়ীরই মনে বিলক্ষণ জোশ আসে। তারা কোরাসে ধ’রে :

“The Queen of Hearts, she made some tarts,
All on a summer day:
The knave of Hearts, he stole those tarts
And took them quite away!’ [৪৯]

গানান্তে, উপস্থিত কবি দবিরুল হায়দার ভনেন :

“There was an Old Man of Vesuvius,
Who studied the works of Vitruvius;
When the flames burnt his book,
To drinking he took,
That morbid Old Man of Vesuvius.’[৫০]

কবিতাটিকে পার্সোনালি নিয়ে কুপিত হন গল্পকার গঞ্জন হাবিব, তিনি জবাব দেন:

‘There was an Old Man of Bohemia,
Whose daughter was christened Euphemia;
But one day, to his grief,
She married a thief,
Which grieved that Old Man of Bohemia.’ [৫১]

তীরটি অবশ্য দরিবরুকে ঘায়েল ক’রে না, ক’রে বয়োজ্যেষ্ঠ কবি লা হাম্মদকে। তিনি খেপে, উঠে, ‘ইয়ালি’ ব’লে একটা টেবিল উল্টে দেন এবং গঞ্জনকে বলেন, ‘ব্লাডি বাগার!’

গঞ্জন সংশোধনের প্রয়াস পেয়ে বলেন, ‘ব্লাডি মেরি বলুন স্যার, ওসব আগার-বাগার এখানে চলবে নানে। ইটি পাকিস্তান না, বাংলা—’  

তাঁর কথা শেষ হবার আগেই তাঁর মুখের একমুঠো দাড়ি খসে যায় এবং বেগতিক দেখে ফুল্লরা, কালকেতুকে বলেন, ‘ওরে গুপি রে, এবার ভেগে পড়ি চুপিচুপি রে!’[৫২] এবং তাঁরা নিরাপদে সটকে পড়েন, যেহেতু, উপযাজক হ’য়ে, ‘বার’-স্থ জনৈক সরকারি কবি, রেজর স্টেনলেস, তাঁদের বিলটি আগেই চুকিয়েছেন। কেন, তা অবশ্য জানা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *