কালকেতু ও ফুল্লরা – ১

১.

গল্প এখান থেকে শুরু :

লোকায়ত পান্থশালা সরগরমরমা। কেননা, বিশেষতঃ, ফুল্লরা আছেন। ফুল্লরার টেবিলে আরও চারটি টেবিল জোড়া দেওয়া হয়েছে, এবং তাঁকে ঘিরে বয়স্য ও ভক্তেরা, ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ছবির স্টাইলে, নরক গুলজার করছেন। গান-ও গাইছেন তাঁদের কেঁউ-কেঁউ। টেবিলময় কাপ-ডিশ-গ্লাসে তাল বাজাচ্ছেন আরও কেঁউ-কেঁউ। কিন্তু ভবানন্দকে কোথাও না যায় দেখা। ব্যাপার কী? তবে কি, তবে কি তিনি টেবিলের নীচে ফুল্লরার পায়ের কাছে বসে হাসছেন? আর এইসব ভেদ ক’রে, রেস্তোরাঁর অডিও-সিস্টেমে অ্যাল স্ট্যুয়ার্টের কিন্নর-কণ্ঠ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত :

‘I went in search of alchemy
To resurrect the dead,
Sent my spies to fathom out
The secrets in your head,
They said they heard your laughter
Spinning through the summer night
In the company of strangers,
And your eyes were wild and bright…’ [১]

কালকেতু কোথাও সংবর্ধনা না-পেয়ে ইচকের টেবিলেতেই বসেন। ইচক গোমড়া-মুখে সিদ্ধির শেষ-চুমুকটি কুলকুচা ক’রে সময় নিয়ে গেলেন, এবং একটা মাপসই ঢেকুরের ইন্তাজারে সতর্ক বসে থাকেন।

কালকেতু শুধান, ‘কেমন আছেন, জনাব?’ ইচক হাত তুলে, একটু অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দেন। ফুল্লরার সঙ্গে এতক্ষণে একপলক চোখাচোখি কালকেতুর হয়। ফুল্লরা, কী বলার জন্য মুখ খুলেও, হুল্লোড়ের চড়ায় আটকে যান। কালকেতুও, স্টার্ট দিয়েও, ফুল্লরার মনোযোগ বিঘ্নিত হওয়ায়, এবং হয়তো লোকলজ্জায়, একটা হাসিকে গলার ভিতরে গিলে ফেলেন, এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে ইচকের ঢেকুরটি আরামদায়ক শব্দে বেরিয়ে আসে, কালকেতুরই ঢেকুর যেন, হাসির।

তাঁকে অবাক্ ক’রে দিয়ে ইচক বলেন, ‘হোয়াট য়্যু লাইক, জনাব? সফট অর হার্ড?”

কালকেতু ধুচ্চিনিছাড়া এক-কাপ চা বলতে বলেন, এবং বলেন, ‘সম্রাট্ ইসপের কী খবর? তাঁর কফের কী অবস্থা? তিনি কি এখনও নিয়মিত হার্বাকোষের কষ সেবন করছেন?’

এ-সময় বড়ুবাবু এগিয়ে এসে ইচককে শুধান পয়সাটা তিনিই দিচ্ছেন কিনা। কালকেতু অন্যথা তাকিয়ে থেকে অ্যাল স্ট্যুয়ার্টের অজর সঙ্গীত উপভোগেন:

‘Late at night
when reality’s failing
and nothing is prevailing
but the wind,
I come to you…’ [২]

রেস্তোরাঁর পূর্বদিকের দেয়াল জুড়ে ফ্রেস্কো-তুলুজ-লোত্রেক এবং আমানউল্লাহ-র যৌথ সংগ্রাম : ‘মহাভারত’। বিশিষ্ট দৃশ্যাবলির মাঝে আছে : গঙ্গা আপন সন্তানকে (কোনটিকে বোঝা যাচ্ছে না) গলা টিপে হত্যা করছেন, এবং রাজা শান্তনু তাঁর (গঙ্গার) সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান, তাঁর পাশে নৃত্যপর(া) শিখণ্ডী-রূপী অম্বা—যাঁর খোজাত্ব বোঝাতেই তাঁকে বস্ত্রহীন করা হয়েছে, তাতে অবশ্য, বিশেষতঃ তুলুজ-লোত্রেকের সালঁকৃত তুলির কল্যাণে, তাঁর নারীত্বই প্রকট হ’য়ে পড়েছে।

‘উরুভঙ্গ’ দৃশ্যটি কিন্তু অন্য দু’শিল্পীর আঁকা—ভীমসেনকে এঁকেছেন এস এম সুলতান, এবং ভগ্নোরু দুর্যোধনকে জর্জ ব্রাক।

গার্হস্থ্য দৃশ্যও আছে—শিশু শ্রীকৃষ্ণ ননি চুরি করছেন এবং রাধিকা গোদোহনরত। আমানউল্লাহ চেয়েছিলেন, ঐতিহ্যানুযায়ী, কৃষ্ণকে নীল রঙে আঁকতে, কিন্তু তুলুজ-লোত্রেক প্রেফার করেন হলুদ। আমানউল্লাহ তর্ক করেন না সিনিয়র শিল্পীর সঙ্গে, কিন্তু অঙ্কনান্তে ফরাসি শিল্পী ফ্রাঁ গুনে নিয়ে দেশে ফিরলে, কৃষ্ণের গায়ে তিনি নীল আরোপ করেন। ফলে, কৃষ্ণের গাত্রবর্ণ হ’য়ে প’ড়ে সবুজ—শ্যামনামের মাহাত্ম্য এবংপ্রকারে আরও-একবার প্রমাণ হয়।

‘বস্ত্রহরণ’ দৃশ্যটিকে ছবির ফ্রেমের আকার দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের একটি কোণে দ্রৌপদীর শাড়ি খোলা হচ্ছে, এবং কৌরবগণ প্যারেডের ভঙ্গিতে শাড়ির খোলা অংশ ধ’রে সারা ছবির চারিধার দিয়ে চ’লে যাচ্ছেন। এ-অংশটির মূল প্রকল্পক ব্রাত্য রাইসু। কিন্তু আর্ট কলেজের ডিগ্রি না-থাকায়, তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হয় নাই।

চায়ে কালকেতুর প’ড়ে আলতো চুমুক। এখানে চা-পাতার বদলে শুকনা কোকা-পাতা দিয়ে চা বানানো হয়। আগে মেস্কালের রসও দেওয়া খানিকটা হ’ত, কিন্তু এক কবি, এক বিষ্ণু বিশ্বাস, এক আত্মহত্যা-উদ্রেকী কবিতা লিখলে-পর সেটা বাদ দেওয়া হয়েছে। টেবিলে-টেবিলে পো-খানেক কাঁচা রশুন এখনও রাখা অবশ্য হয়। ক্যাসেটে বাজছে এবে ইগলজ :

‘She’s got the Mercedes Benz,
She’s got a lotta’ pretty pretty boys
She calls ‘friends…’ [৩]

ফুল্লরার সঙ্গে দুসরা দফা চোখাচোখি হয় এখন কালকেতুর। পূর্বে- গিলে-ফেলা হাসিটিকে ঢেকুর দিয়ে বা’র করতে-করতে তিনি ইচককে কহেন, ‘এ-খানকার টয়লেটটা যেন কোন দিকি?’ অতঃপর কৈফিয়ত দেন—’মেলাদিন আসি নাই কিনা।’

ইচক, ওয়েট্রেসকে ডাকেন—’নেফারটিটি, মাই ডিয়ার, কুড য়্যু পসিি শো দিস জেন্টলম্যান টু দ্য টয়লেট?’

নেফারটিটি নাচতে-নাচতে আসেন, এবং কালকেতুকে হাত ধ’রে নাচতে-নাচতে টয়লেটে নিয়ে যান। তথায় গিয়ে চোখ টিপে বলেন, ‘নিড এনি হেল্প ইনসাইড?’

কালকেতুর মনে প’ড়ে সেনাপতি হাসানুল বান্নার অমর বাণী: ‘নারীর আহ্বানের কদাপি অমর্যাদা করিও না।’ কাজেই কিঞ্চিৎ সাহায্যের প্রয়োজন বোধ তিনি করেন এবং তা বলেন। নেফারটিটি তখন ক’ন, ‘টুডে আই’ল শো য়্যু ওয়ান অব দ্য ইজিপশ্যন ওয়েজ অব ডুয়িং ইট; অ্যান্ড অন টপ অব দ্যাট, দ্য ফ্যর্স্ট শট উইল বি গ্রাটিস।’

কালকেতু পুলকিত হ’ন, হ’য়ে, তড়িঘড়ি প্যান্ট খুলতে ধরেন। প্যান্ট কিন্তু জুতায় আটকে যায়। তখন, ঐ অবস্থাতেই, আগে জুতা খুলে নেবেন, নাকি প্যান্টটা আবার পরে নিয়ে তারপর জুতা খুলে আবার প্যান্ট খুলবেন, এমনটি ভাবতে-ভাবতে বেকায়দা দাঁড়িয়ে তিনি আছেন, এবং নেফারটিটি বলছেন—’য়্যু’ভ গট টু টাইনি অ্যান ইন্সট্রুমেন্ট, মিস্টার। আই ওয়ান্ডার হোয়াট আই ক্যান ডু উইথ দ্যাট সিলি চিলি-থিং… ইভেন দ্য কনডম উইল বি লুজ অন ইট!’—ভবানন্দ মজুন্দার স্বয়ং এসে ঢোকেন টয়লেটে, হাসতে- হাসতে তিনি কালকেতুকে বলেন, ‘আমার ওয়াইফ একটু স্মরণ করেছেন আপনাকে, একটু যদি কাইন্ডলি—

কালকেতু তাঁকে বলেন, ‘আমায় একটু হেল্প করুন, প্লিজ!’

মজুন্দার মহোদয় তখন তাঁর (কালকেতুর) প্যান্টটি টেনে তুলে দিতে দিতে শুধান, ‘আপনি আন্ডারওয়্যার ইউজ করেন না? একজিমা আছে?” তারপর, হাসতে-হাসতে’মেথিশাক-বাটার সঙ্গে অ্যান্টিমোনি মিশিয়ে লাগিয়ে দেখতে পারেন। নিয়মিত তোকমা আর থানকুনি পাতার শরবত খেলেও উপকার পাওয়া যায়, হে হে।’

ভবানন্দ ও নেফারটিটিকে টয়লেটে রেখে কালকেতু বেরিয়ে এসে দেখেন, ফুল্লরা তাঁদের, অর্থাৎ ইচকের, টেবিলে বসে তাঁর অপেক্ষায়। ইচক ও তাঁর মধ্যে একটি বড় ঘোলা গ্লাস। তার মানে, ইচকের দ্বিতীয় (বা, কে জানে, হয়তো দশম) দফা সিদ্ধিসাধনা। ওদিকে ফুল্লরার নিজের টেবিল এবে কাকলিরহিত। সেখানে একপাল মেয়ে-ছেলে (ছেলেদেরকে মেয়ে, এবং মেয়েদেরকে ছেলে ভ্রম হওয়ায়, যাদেরকে যুগ্মলিঙ্গে ডাকা-ভিন্ন উপায় নাই) তীব্র সতৃষ্ণ নয়নে ফুল্লরাকে লক্ষ করছেন। চোখ দিয়ে চুম্বকের মতো (ফুল্লরাকে) আকর্ষণ করতে যেন। বড়ুবাবু বাংলা চাপিয়েছেন এখন। বাজছে :

‘আমি স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি,
রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া—’ [৪]

(ঢাকাইয়া গায়িকার মুখে প্রায় ‘ঢাইকা’ এসে যাচ্ছে বার-বার।)

কালকেতু বলেন, ‘ফুল্লরা, আছো তো ভালো?’

ফুল্লরা জবাব দেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

কালকেতু বলেন, ‘তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে।’

ফুল্লরা জানান, ‘আপনার চা এসছে।’

চায়ের কাপ মুখে দিলে (বা, চায়ের কাপে মুখ দিলে—অ্যাজ য়্যু লাইক ইট) জিহ্বা পুড়ে যাওয়ায়, কালকেতু বলেন, ‘উফ্! মহামতি ইচককে তো জানো? তিনি অবশ্য বাংলা আর বলেন না-

ফুল্লরা বলেন, ‘আপনি এলেন শেষ পর্যন্ত! আমরা ভেবেছিলাম—’  

ইতোমধ্যে ইচক, সিদ্ধিপান স্থগিত রেখে, ক্ষণে কালকেতুর ক্ষণে ফুল্লরার মুখপানে চেয়ে দেখতে লাগেন। তাঁর মাইনাস-পঁচিশ পরকলায় রেস্তোরাঁর ঔজ্জ্বল্য ঝলসায়। কালকেতু তাঁকে বলেন, ‘আরও এক-কাপ চায়ের জন্য ধন্যবাদ, জনাব।’

এমন সময় টয়লেটে একটা বিকৃত পুরুষ-কণ্ঠের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা যায়। কালকেতু ভাবেন, ‘ইজিপশ্যন’ শুরু হয়েছে—তখন, সহসা, ফুল্লরা লাফিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘রাস্কল’ বলেন এবং ইচকের সিদ্ধিপূর্ণ গ্লাসটি খালি ক’রে তাঁর মাথায় ঢেলে দেন। ইচক, কালকেতুর দিকে একটা কস্তুরি- আমোদিত রুমাল বাগিয়ে ধরেন। ফুল্লরা আবার ‘রাস্কল’ বলেন এবং আবার বলেন এবং আবার বলেন।

কালকেতু, ফুল্লরার হাত ধ’রে ক’ন, ‘ফুল্লরা!

ফুল্লরা গটগট ফিরে যান আপন টেবিলে, যেথা ভক্তবৃন্দ হাততালি ও হিপহিপহুরে দিয়ে তাঁকে জানান স্বাগত ও অভিনন্দন।

কালকেতু মাথার শরবত মুছতে-মুছতে ইচককে পুছেন, ‘আর এক-কাপ চা খাওয়াতে কি পারেন আমায়? এটাই শেষ, কথা দিচ্ছি।’

তখন বড়ুবাবুকে চা ব’লে, কালকেতুকে শুভরাত্রি জানিয়ে, ও ফুল্লরাকে বাও ক’রে, ইচক উপরে চ’লে যান।

কালকেতু কেমন একা বোধ করেন এতক্ষণে, এতদিনে। বাও মেলে না তাঁর। টেবিলের চারটি চেয়ারের সবক’টিতে পর্যায়ক্রমে তিনি বসেন, কিন্তু কোনওটিতেই ঠিক জুত পান না। চা এলে, একটু আগেই পুড়ে-যাওয়া জিহ্বাটিকে গরম চায়ে ডুবিয়ে তিনি দেন, চুবিয়ে রাখেন। তাঁর গায়ে সামান্য চার্জ আসে, কিন্তু সেটা স্থায়ী হবার আগেই, চা ঠান্ডা মেরে যায়। ফুল্লরার টেবিলে কলধ্বনি দ্বিগুণানন্দে বাড়ে। পাল্লা দিয়ে গানের আওয়াজ উঁচু করে চলেন বড়ুবাবু। পিলে-চমকানো, কানের-পোকা-বা’র-করা উচ্চকণ্ঠে গেয়ে চলেন আব্বাসউদ্দিন :

‘হাইলা লোকের লাঙ্গল বাঁকা,
জনম-বাঁকা চান,
তার চাইতে অধিক বাঁকা
যারে দিছি প্রাণ রে…’ [৫]

গানের বেদনা কালকেতুর মরমে প্রবেশ ক’রে, কিন্তু একইসঙ্গে, এর মহাঞ্ছব্দ তাঁর নার্ভে উঠে যায়। তিনি কাপ-হাতে কাঁপতে শুরু করেন, সারাটা শরীর-জুড়ে কাঁদতে শুরু করেন। তাঁর বজ্রমুষ্টির চাপে বলিউডি ঢঙে কাপ গুঁড়োগুঁড়ো ভেঙে প’ড়ে টেবিলে। বড়ুবাবু ক্রুদ্ধ ছুটে আসেন, কিন্তু কালকেতুর উদ্দৃষ্টি দেখে আবার ছুটে চ’লে যান, এবং দৃশ্যটিকে ভুলে যাবার চেষ্টায়, আব্বাসউদ্দিনের গলাকে আরও দেন চড়িয়ে, এমন-এক মাত্রায়, যে, তা সাক্ষাৎ দিলীপকুমার রায়ের রায়বেঁশে দার্ঢ্যে পর্যবসিত হয় :

‘সমরে নাহি ফিরাইব পৃষ্ঠে,
শত্রুকরে কভু হ’ব না বন্দি,
ডরি না, থাকে যা-ই অদৃষ্টে,
অধরম-সঙ্গে করি না সন্ধি;
হ’ব না, র’ব না শত্রুর ভৃত্য,
সম্মুখ সমরে জয় বা মৃত্যু…’ [৬]

কালকেতু কাঁপতে-কাঁপতে একটা চেয়ারে উঠে দাঁড়ান। সেখান থেকে তিনি টেবিলে উঠে যান। তারপর, মার্শালশিল্পীর ভঙ্গিতে, একটি পা মাথার উপর তুললে, তা সিলিং স্পর্শ ক’রে। তখন গায়ের তাবৎ তাকতকে ঘনীভূত করবার চেষ্টা ক’রে সিলিঙে ঠেলা দিলে… টেবিল ভেঙে প’ড়ে, এবং তিনি মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। লোকায়ত পান্থশালার সবগুলি চোখ এখন তাঁকে লক্ষ ক’রে অপলক, সবগুলি মুখে কুলুপ এঁটে যায়। বড়ুবাবু এমনকি গান বন্ধ ক’রে দেন। শুধু টয়লেটে উদ্ভূত এক উদ্ভুতুড়ে কুঁইকুঁই-রব উৎসন্ন জীবনযাত্রার টিমটিমে লণ্ঠন বহন ক’রে চ’লে।

কালকেতু নীরব উঠে দাঁড়ান, এবং ফুল্লরার টেবিল-পানে যান এগিয়ে। তাঁর চোখে চেয়ে ফুল্লরার বয়স্যরা ইতোমধ্যে অশ্মীভূত, এবং বিনাযুদ্ধে তিনি ফুল্লরাকে পাঁজাকোলা ক’রে দরোজা দিয়ে বেরিয়ে যান। এতক্ষণে চৈতন্য হয় সবার এবং এমন জোরে চিৎকার জোড়ে তারা, যে, নেফারটিটির সঙ্গে লতাবেষ্টিতক আসনে লগ্ন, নগ্ন ভবানন্দ টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নেফারটিটিকে চেঁচিয়ে বলেন, ‘দূর হ, পাপীয়সি! তোর বাপের…’

২.

পথে নেমে কালকেতু বলেন, ‘তোমাকে আগের চেয়ে ভারি লাগছে যেন! অবশ্য এ-কয় বছরের সিয়াম সাধনায় আমি শুকিয়েওছি তো খানিকটা— সে-জন্যেই বোধ হয়…’

তারপর, আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘তবে ভেবো না, খুব শিগগিরই আবার ফুলে-ফেঁপে উঠব। শতপুত্রের জনক আমি হ’ব। তাদের প্রত্যেকেরই নাম হবে ইকথিয়ান্ডর। এক অসাধারণ ‘রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠিত হবে আমার পুত্রদের হাতে। রামসাগরে।’

ফুল্লরা শুনেটুনে বলেন, ‘একশ’ ছেলে নেওয়াটা অশুভ হবে—গান্ধারীর কথা ভাবো। পঞ্চাশ বা এক হাজারও ভালো না, স্মরণ করো হেকুবা বা সগরকে। এমনকি দশটিও অনিরাপদ্, উদাহরণ হারাধন। আসলে আই বিলিভ ইন সেইফ সেক্স। ‘

তখন কালকেতু হেসে বলেন, ‘আরে শতপুত্রের ব্যাপারটা তো প্ৰতীক। আমিও সেইফ সেক্সে বিশ্বাসী, পরন্তু সাইবার-সেক্সে, এমনকি ব্রেইন-সেক্সে। শতপুত্র বলতে বোঝাচ্ছি, যে, তোমার আমার সেক্স-লাইফটা হবে ইটার্নাল। স্রেফ সেক্স-পারম্পর্যের অনিবার্যতার কারণেই অমর হ’ব আমরা, অজর হ’ব। এবার নেমে একটু হাঁটো, হাত ব্যথা হচ্ছে।’

নেমে ফুল্লরা বলেন, ‘আমি অবাক্ মানি, যে, জনসমক্ষে তোমাকে “তুমি” বলতে এখনও আমার সঙ্কোচ—’  

‘কিন্তু “আপনি” শুনতে আমার বিরক্তি,’ কালকেতু বলেন, ‘বরং “তুই” চালাতে পারিস এখন থেকে। আমি এনকারেজমেন্ট হিসাবে এখনই শুরু করলাম।

খুদিরাম স্কোয়ার (যেখানে খুদিরামের, ফাঁসিতে-ঝোলা বীভৎস একটা মূর্তি রয়েছে) ঘুরে, জিরো-পয়েন্ট টাওয়ার ছাড়িয়ে, তাঁরা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরেন। তিনটি ব্লক পার হ’য়ে, বাঁয়ে টিপু সুলতান রোড; তার ও-মাথায় দেখা যায়—মোচাকৃতি এক সিনাগগ।

‘সিনাগগে ভরে গেল শহরটা,’ ফুল্লরা বলেন।

‘যবে যে-বায়ু,’ বলেন কালকেতু।

তারপর তাঁরা হাত-ধরাধরি রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসেন। এ-রাস্তায় দু’দিন-যাবৎ, সাতদিনের জন্য, গাড়ি-ঘোড়া বন্ধ—আগামী পরশু স্বয়ং আর্চডিউক ডন ফানলার এ-পথে যাবেন, তাই। শুধু হবু আততায়ীরা সাদা পোশাকে রাস্তার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কে কোথায় পজিশন নেবেন তার মাপজোক কষছেন। তাঁদেরই একজন কালকেতুকে হেঁকে কহেন, ‘বঁ সোয়ার, ইয়ার! কুয়ো ভাদিস?”

কালকেতু আঙুল তুলে সিনাগগ দেখান।

‘বঁ ভোয়ায়াজ!’—তারপর, ফুল্লরার দিকে ইশারা ক’রে—‘বন্ আপেতি!’ ব’লে আততায়ী অন্ধকারে অদৃশ্য হ’ন।

ফুল্লরা শুধান, ‘তুমিও আছো নাকি এদের সঙ্গে? তুমিও আততায়ী?’

কালকেতু হাসেন। চাঁদের আলো তাঁর সাদা-সাদা দাঁতে পিছলে-পিছলে যায়। হঠাৎ চলা থামিয়ে কালকেতু চমকে ওঠেন—‘তাই তো! আমি কি আততায়ী?’

ফুল্লরা তাঁর হাত ধ’রে-থাকা কালকেতুর হাতের উপরে তাঁর অন্য হাতটি স্থাপন ক’রে বলেন, ‘ব্যস্ততার কিছু নেই—পরে ভাবলেও চলবে। আপাতত, সিজ দ্য নাইট।’

কালকেতু তখন আকাশের তারা দেখে নির্ধারণ করেন, কত হ’ল রাত।

‘রাত পোহাবার কত দেরি, পাঞ্জেরি?’[৭] শুধান ফুল্লরা।

‘আর দেড় যাম,’ কালকেতু বলেন।

বলধা গার্ডেন প’ড়ে এবার বাঁয়ে, মিনিট-তিনেক পর। মালিক, রাজা নবকৃষ্ণ রায়, তাঁর মালি, বনমালীকে নিয়ে সেখানে পর্যায়ক্রমে নানা জাতের ও বেজাতের ক্যাকটাস ও য়ুক্যালিপটাস চাষ শেষে, এখন এক নব-আবিষ্কৃত ফাঙ্গাস চর্চাচ্ছেন। এর মেডিসিনাল প্রপার্টিজ যা দেখা গেছে ইতোমধ্যে, তাতে এটি ঐতিহ্যবাহী ‘সোম’-এর প্রতিকল্প হবে ব’লে নিউরো-সার্জনগণ ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। হিজ হাইনেস, প্রস্তুয়মান আড়কটির নাম দিয়েছেন ‘মোম’, মোমের সঙ্গে আকৃতি,—এবং সোমের সঙ্গে প্রকৃতিগত সাদৃশ্যের কারণে। অষুধ তৈরিও হচ্ছে, গার্ডেনেই। এখন ডিএফপি, অর্থাৎ ড্রাগজ অ্যান্ড ফুড- পয়জনিং বিভাগের ছাড়পত্র পাওয়া গেলেই বাজারে চ’লে আসবে। ডিএফপি অবশ্য আগে হাতির শরীরে ড্রাগটি পরীক্ষা ক’রে দেখতে বলেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, হাতির দেহে ইনজেক্ট করার মতো কম্পাউন্ডার কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। এইচ এইচ নাচার হ’য়ে শেষে রমাকান্ত কামারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু কামারের ব্যাটা কামার সুযোগ বুঝে গগনচুম্বী পারিতোষিক হেঁকে বসে। পরে অবশ্য সমস্যার একটা সমাধান প্রস্তাব ক’রে নাসা…

(এইখানে সাই-ফাইয়ের অভিযোগে বেয়ালিশ লাইন কাটা প’ড়ে। বলা হয়, যে, সত্যজিৎ রায় অস্কার, এবং আদিত্য কবির ফিলিপস পাবার পর পাঠকরা আর সায়েন্স ফিকশন মোটেই পড়েন না। আমি অবশ্য তর্ক তুলি, যে, এটা তো ফিকশন না, খোদ সায়েন্স। তখন তাজুল হক বলেন, ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।’)

মোম তৈরি চলেছে বোধ হয়। বাতাস ঝাঁ-ঝাঁ করছে।

‘নেশা লাগিল রে
বাঁকা দু’ নয়ানে নেশা লাগিল রে…’[৮]

ফুল্লরা গেয়ে ওঠেন হাততালি দিয়ে।

সিনাগগের সামনে তাঁরা চ’লে আসেন এখন। এর নীচে সম্প্রতি একটা ভূগর্ভস্থ গোরস্তান আবিষ্কৃত হয়েছে। জাদুঘর সেটিকে কব্জা করবার তাল করা-মাত্র, বাংলাদেশ কপটিক চার্চেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিসিএ), নানারূপ আন্দোলন এবং নাশকতামূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে তা রোধ ক’রে। পুলিসের গুলিতে সাতজন সন্ত্রাসী, এবং সন্ত্রাসীর গুলিতে চৌদ্দজন কনস্টেবল নিহত হ’লে, সরকার হিসাবপত্র ক’রে গোরস্তানটি চার্চকে সোপর্দ ক’রে। সেই থেকে, মানে গতকাল থেকে (মানে গল্পের গতকাল থেকে), গোরস্তানটিতে ‘প্রাণ-প্রতিষ্ঠা’ করার কাজে চার্চের উদ্যমের ওর নাই। প্রধান বিশপ লুই কাহ্ন বিবৃতি দেন অবজারভার-এ : ‘দিস সিমেটরি ইজ ফার ফ্রম বিইং আ ডেড ওয়ান অ্যাজ, ফর ইন্সট্যান্স, দ্য ভ্যালি অব দ্য কিংজ্ ইজ। ইট ইজ, অন দ্য কন্ট্রারি, অলমোস্ট অ্যাজ মাচ অ্যালাইভ অ্যাজ ওয়্যার দ্য ম্যাস-গ্রেভজ অব দ্য জু’জ ডিউরিং দ্য সেকন্ড ওয়ার্ল্ড ওঅর।’

হিজ গ্রেস-এর এই বয়ানে বাংলাদেশ য়িহুদি-নাৎসি মিলন পরিষদ অবশ্য মৃদু আপত্তি জানায় ইয়াংকিল্যাব-এ।

‘ক্রিশ্চানরা মরবার জায়গা পায় নাই আর!’ ফুল্লরা বলেন।

সিনাগগটি আধ-পাক ঘোরার পর সাবটেরানিয়ান গোরস্তানের সুড়ঙ্গাকার প্রবেশ-পথটি দেখা যায়। উঁকি দিয়ে দজনে দেখেন, বহু নরনারী, এবং কৃষ্ণবর্ণ ক্যাসকে, মৌল্যাকার টুপিতে, এবং জেহোহ্বা-সুলভ দাড়িতে সুশোভন, বেশ ক’জন কপটিক পাদরি। কবরে-কবরে ক্রুশে-ক্রুশে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখা, তাঁদের (কালকেতু ও ফুল্লরার) চোখে-মুখে রক্ত ছিটিয়ে কাঁপে। তাঁদের চোখগুলি দপ ক’রে জ্বলে ওঠে। তাঁরা পরস্পরের চোখে তাকান, এবং, মুহূর্তে, মহাবিশ্বের নিজস্ব বয়সের ব্যাপ্তির ভিতর প্রবেশ করেন। কোটি-কোটি কল্পকাল পেরিয়ে যায় মুহূর্তে—কোটি-কোটি ঈয়ন— যে-মুহূর্ত ফ্রিজ হ’য়ে গেছে দুইজোড়া চোখের তারায়। হঠাৎ সংবিৎ ফেরে কালকেতুর, মনে প’ড়ে, আজ সামাইন, এবং তিনি ফুল্লরাকে বলেন, ‘আজ সামাইন।’

ফুল্লরা বলেন, ‘আমরা কি তবে প্রার্থনা করব?

‘না,’ কালকেতু বলেন, ‘শুধু বলো-

‘এই আমি ছিলাম সম্রাট,
এই আমি ছিলাম নফর,
বুদ্ধু, হারামি, বজ্জাত —
কিছু নাই মহীর উপর
যা-যা আমি না-ছিলাম, হায়,
আমার বুকের ‘পরে ফের
অযুত মস্তক শুয়ে ঠায়!
কিন্তু ফুল্লরা বলেন,
‘পেতে পারে বুড়ো প্রেমিকেরা
যা-কিছু সময় দেয় নাই,
কবরে কবর গাদি-করা
পুরাতে তাদের কামনা-ই,
কয়লা-কালো মাটিতে পুরানো
পল্টনের চ’লে কুচকাওয়াজ,
জন্মোপরি জন্ম জমে, যেন
সে কামান-দাগার আওয়াজ
খেদায় কালেরে, আর মেশে
জন্ম-মৃত্যু-লগ্ন, কিংবা, যথা
ঋষিগণ বলেন, ‘মানুষে
মৃত্যুহীন পায়ে নাচে সদা।’[৯]

তারপর তাঁরা পরস্পরকে চুম্বন করেন।

যাজকেরা সারিবদ্ধ উঠে আসেন নীচে থেকে এবার। চুম্বনাবদ্ধ দু’জনের মাথায় তাঁরা পরিয়ে দেন দু’টি কণ্টকময় টিয়ারা। বিশুদ্ধ রক্তে মুখমণ্ডল ভেসে যায় দু’জনের। তারপর তাঁরা বুকের বসনে একে-অন্যের মুখ মুছে দেন। একের বুকে অপরের মুখের আদল ফুটে ওঠে। আর তাঁরা পরস্পরকে প্রণাম করেন। আর তাঁরা প্রবেশ করেন…

(এখানে তিন পৃষ্ঠা সেন্সর করা হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, যে, এতদংশে বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে অবৈজ্ঞানিক তথা বিভ্রান্তিকর তথ্যাবলি অন্বিত হয়েছে। বিশেষতঃ, বলা হয়, এ-অংশটি পাঠ-করা পাঠকরা এমতো ধারণা পোষণ করতে পারেন, যে, ঈশ্বরের সঙ্গে বিশ্বের সম্পর্কটা দ্বন্দ্বমূলক নয়, বরং মিলনমূলক।

ফুল্লরা বলেন, ‘বলো, “তুমি কী সুন্দর”, “ডু বিস্ট জো শ্যোন।’

কালকেতু বলেন, ‘তুমি সুন্দর! ডু বিস্ট শ্যোন! [১০]

‘বলো, “আমি ভালোবাসি।’

‘আমি ভালোবাসি।’

কালকেতু এই কথা কওয়া-মাত্র, হাওয়া গভীর ফুলে ওঠে, পদ্মায় উদ্দাম বাদামের মতো। গুলশানের দেয়াল-ঘেরা বাগানে-বাগানে গোপন গোলাপের ঘ্রাণ এত বাড়ে এত বাড়ে, যে, দেয়াল টপকে রাস্তার ধুলায় এসে মেশে। গুলিস্তানের মুল্যাঁ রুজ নাইটক্লাবের ডান্স ফ্লোরে জোসেফিন বেকারের বয়স অর্ধেকে নেমে যায়, আর তাঁর সামনে উড়তে-থাকা, নওয়াব সরওয়ার হোসেনের ব্যাংকনোটগুলি চকিতে গিনিতে বদলে যায়। মির জুমলার কামানে একাশিবার তোপধ্বনির সঙ্গে-সঙ্গে, তুরাগ-তীরে বঙ্গত্র দুর্গের তেতলায় জাদু-বাতায়ন খুলে যায়, আর তার বাতাবরণটি পাল্টে যায় এক ছায়া-অরণ্যের দৃশ্যে। বাতায়ন-পথে কোনও অশরীরী পিয়ানোফোর্তের নন্দিত হয় চন্দ্রিকা-সনাটা, আর তার মিড়ে-মিড়ে তুরাগের ঢেউয়ে-ঢেউয়ে মাতাল হ’য়ে সাঁতরায় কাচের চেয়ে চকচকে চাঁদের আলোর মোজেইক পাগলা-ঘাটে হিপোক্রিন নদীর জল মুহূর্তে রঙিন হ’য়ে ওঠে। তার উত্তাল তরঙ্গভঙ্গে বুদ্বুদিয়ে ওঠে অজস্র গোলাপি মুক্তার পুঁতি। হিপোক্রিনেরই জলে আজানু নেমে যান দু’জন, শ্যামবাজারে, আর ফুল্লরা, পূর্ণাঞ্জলি সেই জল ছিটিয়ে-ছিটিয়ে দেন কালকেতুর মাথায়। এ-সময় আকাশে-আকাশে নেচে ওঠে মেরুজ্যোতি, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, আর—আহ্! আকাশটা আড়াআড়ি চিরে যায় সমান দু’ভাগে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে! আর, সেখান থেকে নেমে আসে এক অগ্নিমুখ বিহঙ্গম, যে তার ইথার-বিথারি ডানায় ঢেকে ফ্যালে জগতের সব মারী, সব অবসাদ… পথের মোড়ে-মোড়ে পুড়ে চ’লে অসুন্দরের কুশপুত্তলিকা, আর মার্চিং ব্যান্ডে ওঠে সুর : ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ।’১১ আর লালবাগ-কেল্লার কলোনেডে-কলোনেডে শোনা যায় ছায়াসেনার ধ্রুপদি কাওয়াজ—’কদম কদম বঢ়ায়ে যা কদম কদম বঢ়ায়ে যা।” আর এক ছায়া-সেতু নিমেষে নির্মিত হয় হিপোক্রিনের উপর—কেল্লা থেকে ছায়া-বাহিনীকে সরাসরি পার হ’য়ে যেতে দেখা যায়…

৩.

‘ফুল্লরা, তুমি কি ভালোবাসো আমায়?”

‘ফুল্লরা, তুমি কি ভালোবাসো আমায়?”

‘ফুল্লরা, তুমি কি ভালোবাসো আমায়?”

‘ফুল্লরা, তুমি কি ভালোবাসো আমায়?’

‘জানি না, এক কথা বার-বার বোলো না তো, মাথা ধ’রে যায়, ফুল্লরা বলেন।

কালকেতু তবু বলেন, ‘তুমি কি ভালোবাসো আমায়?”

‘জানি না,’ ফুল্লরা বলেন, ‘তবে, মনে হয় বাসি। কেননা, না-বাসলে মনে হয় জানতাম।’

কালকেতু তখন প্রায় স্বগত বলেন, ‘পাগল ভাবে সে সুস্থ, পাগল অন্যে। সুস্থও তা-ই ভাবে। আবার কোনও-বা সুস্থ মানুষও নিজেকে পাগল মনে ক’রে—সব মিলিয়ে পৃথিবীর অবস্থা জটিল গো!

‘তাই তো বলছি, এ-সবে যায় আসে না কিছু,’ ফুল্লরা বলেন, ‘আসল কথা হ’ল—’

‘সেই মুহূর্তটি,’ বলেন কালকেতু।

‘হ্যাঁ, যার জন্যে হাজার হিরোশিমা উড়ে যেতে পারে——কিন্তু তাতেও জগৎসংসারের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় না,’–ফুল্লরা।

কালকেতু—’জগৎসংসারের ক্ষতি কিছুতেই হয় না। ব্যাপারটা কভু- কভু বেদনাদায়ক। কভু-কভু এমনই মনে হয়, যে, এরও পরে-যে সবই আছে ঠিকঠাক, এটা খুবই অন্যায় খুবই অন্যায়।’

‘ওই মুহূর্তগুলি একেটা জীবনের পিনাকল। সেটা আনন্দেরও হ’তে পারে, কষ্টেরও, কিংবা কোনওটিরই নয়—’

‘অনুভূতি- -সকল পরস্পর ক্ল্যাশ ক’রে দানবীয় শক্তিতে, তারপর একে অপরে বদলে যায়, তারপর বাষ্পীভূত হ’য়ে মিলেমিশে একাকার মেঘ, তারপর জ’মে-জ’মে শক্ত করকা, তারপর ঠাস ক’রে প’ড়ে স্বয়ং অনুভাবকের মাথায়—তার মাথাটা ফাঁকা হয় মুহূর্তে।’

‘তারপর জ্ঞান সে হারায়। সংবিৎ ফিরলে দেখে—ষাট ষাট! সবই ঠিক আগেরই মতন! দেয়ার ইজ নাথিং নিউ আন্ডার দ্য সান। শুধু সে-ই আর খাপ খাচ্ছে না কিছুতেই। তখন সে কী করবে, কালকেতু? কী করবে সে এই ‘জাগরণ’ নিয়ে, এই অন্ধ, তিক্ত দেশে, যেখানে—

‘…men sit and hear each other groan;
Where palsy shakes a few, sad, last grey hairs,
Where youth grows pale, and spectre-thin, and dies;
Where but to think is to be full of sorrow
And leaden-eyed despairs;
Where Beauty cannot keep her lustrous eyes,
Or new Love pine at them beyond to-morrow.?’[১৩]

‘তুমি কী চাও, কালকেতু? কী চাও তুমি? কী তুমি চাও?’

‘আপথানেইন থেলো,’[১৪] কালকেতু বলেন, ‘আমি মরতে চাই।’

‘তথাস্তু,’ ফুল্লরা বলেন।

তারপর ফুল্লরা কাঁদেন। ‘ও-ও-ও-ও-ও’ অমানব ভাষায়, অপার্থিব সুরে আর্তনাদ করেন ফুল্লরা। দিদিগন্তে সকল চলা সকল বলা থেমে যায়। একটা পাতা নড়ে না বৃক্ষে, পাতা প’ড়ে না চ’ক্ষে। মেঘ থামে নদী থামে চাঁদ থামে রাত থামে—জগৎসংসার থেমে যায়।

ফুল্লরা বলেন :

‘যঃ কৌমারহরঃ স এব হি বরস্তাশ্চৈব চৈত্ৰক্ষপাঃ
তে চোন্মীলিতমালতীসুরভয়ঃ প্রৌঢ়াঃ কদম্বানিলাঃ।
সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ
রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেতঃ সমুৎকণ্ঠতে।।’[১৫]

কালকেতু বলেন :

‘দত্তোস্যা প্রণয়স্তয়েব ভবতা সেয়ং চিরলালিতা
দৈবাদদ্য কিল ত্বমেব কৃতবানস্য নবং বিপ্ৰিয়ম্।
মন্যুর্দুঃসহ এষ যাত্যুপশমং নো সান্ত্ববাদৈ স্ফুটং
হে নিস্ত্রিংশ বিমুক্তকণ্ঠকরুণং তাবৎ সখী রোদিতু।।’[১৬]

তারপর কালকেতু বলেন, ‘কিন্তু অব অল মেন, ভবানন্দকে তুমি বিয়ে করতে গেলে কেন?’

ফুল্লরা, চোখে-বুকে জল-সমেতই, হাসতে-হাসতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর হাসি আর থামে না। শেষে হাসি-কাশি-হেঁচকি-হাঁচি সব মিলিয়ে বলেন, ‘ফর “আ লিভিং ডগ ইজ বেটার দ্যান আ ডেড লায়ন।’[১৭]

কালকেতু বলেন, ‘তবে রে!’

তারপর তাঁদের কিছুকাল ছোটাছুটি ধরাধরি মারামারি খেলা চ’লে। খেলা-শেষে হাঁফাতে-হাঁফাতে ফুল্লরা বলেন, ‘কালকেতু, কবে থেকে, কখন থেকে, ভালোবাসো তুমি আমায়?”

‘সম্ভবতঃ’ কালকেতু চিন্তা করেন—’যেদিন ইলজাম টাওয়ারের ছাদে একটা কুকরি দিয়ে নখ-পালিশ তুমি তুলছিলে, আর হঠাৎ-হাওয়ার একটা ল্যাসো এসে তোমার হাত থেকে কুকরিটা ফেলে দিল নীচে, আর আমি বানজি-জাম্পারের মতো লাফ দিয়ে, নীচে পড়বার আগেই ছুরিটা ধ’রে ফেলে আবার শাঁ ক’রে উপরে উঠে এসে-

‘ফুল্লরা বলেন, ‘অত দীর্ঘবাক্যে কথা বোলো না তো!”

‘পঞ্চাশ-পঞ্চাশ একশ’ তলার ব্যাপার, দীর্ঘবাক্য ছাড়া উপায় কী?… হুঁ, তারপর ছাদে ল্যান্ড করবার পর তুমি বললে “থ্যাংক য়্যু।’

‘আমি বললাম! তুমিই তো বললে —

‘ও-হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম। একটা রিফ্লেক্স-রিঅ্যাকশন আরকি। অ্যান্টিসিপেশনটা ছিল-যে থ্যাংকসটা তোমার দিক থেকে আসবে; কিন্তু সেটা সময় মতো না-আসাতে, আমারই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এ-রকম হয়। পরন্তু তুমি বললে “য়্যু আর নট ওয়েলকাম!” তা সে যাক। কিন্তু তক্ষুনি আমার খেয়াল হ’ল—অ্যাঁ!!—আমার তো পায়ে দড়ি বাঁধা নাই কোনও! তবে? ইড়া-পিঙ্গলায় রক্ত জমে গেল তৎক্ষণাৎ, সুষুম্নায় স্নায়ু। তবু মনে হ’ল, মানে তখনই না, পরে মনে হ’ল, যে, সেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই ভালোবাসার ভেল্কিতে। এরকম হয়। তুমি—?’

‘জানি না। আমার পিসি কনসাল্ট করতে হবে।’

তারপর, সামনে তাকিয়ে, উদ্ভাসিতাস্য, ফুল্লরা বলেন, ‘আনটু রমণা দেন উই কাম!’

‘…the air of hell suffers no hymns! It was of
millions of enchanting creatures, a suave
spiritual harmony, strength and peace, noble
ambitions..’[১৮]

8.

সাবেক প্রেজিডেন্ট মোঃ তোগলকের আমলে বিশাল এক প্রজেক্টের বাস্তবায়ন সাধিত হয়। পুরাকালে রাজা-রাষ্ট্রপতিগণ খাল কেটে বড়-বড় নদীকে তাঁদের রাজধানীতে নিয়ে আসতেন, যথা মস্কো-ভোলগা ক্যানাল। নদীর সঙ্গে কখনও-সখনও কুমিরও চ’লে আসত, যথা ব্যাবিলন, যেথায় অমন একটি খাল-পথেই পারস্য সেনা প্রবেশ করেছিল নগর-প্রাকারের অভ্যন্তরে। কিন্তু কোনও অরণ্যকে টেনে রাজধানীতে নিয়ে আসবার ক্রেডিট এখন অব্দি শুধুমাত্র তোগলকেরই প্রাপ্য। পত্নী ফ্লোরা খাতুনের মরণোত্তর উপরোধে, সুন্দরবনকে একটা সরু স্ট্রিপে প্রসারিত ক’রে-ক’রে শহর ঢাকার উপকেন্দ্রে নিয়ে তিনি আসেন। বহু জায়গায় আন্ডারগ্রাউন্ডেও কাজ করতে তাঁকে হয়। যেমন, প্রায় গোটা পুরাতন ঢাকার মাটির নীচ দিয়ে বনকে টেনে তিনি আনেন—সেই ভূগর্ভস্থ অরণ্যে দিবারাত্র জ্বলে তেরো-হাজার ফ্লাডলাইট; তাছাড়া, কোটি-কোটি জোনাকিকে সার্বক্ষণিকভাবে মোতায়েন সেখানে রাখা হয়, বিদ্যুৎ-বিভ্রাট্-জনিত সমস্যার মোকাবেলায়। অধিকন্তু মতিঝিল-দিলখুশা এলাকায়, স্কাইস্ক্র্যাপারদের মাথায়-মাথায়, আকাশ-পথে অরণ্যকে টেনে তিনি আনেন রমণায়। ফলে রমণারণ্য (প্রাক্তন রমনা গ্রিন- এর বর্তমান নাম) সত্যই রমণীয় হ’য়ে ওঠে, এবং দেশের যাবতীয় স্ত্রী-পুরুষ (এবং স্ত্রী-স্ত্রী এবং পুরুষ-পুরুষ) এখানে রমণ করতে আরম্ভ ক’রে। অথচ এই রমণায় একদা ভ্রমণ করত শুধু শ্রমণ এবং খোজারা। পুরাতন কালীবাড়িটিকে সম্পূর্ণ তুলে নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় সুত্রাপুর শহিদ নাদিম লেনে। এই অসাধ্যটি সাধন ক’রে শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী ডিকনস্ট্রাকশন প্রাঃ লিঃ। অবশ্য এই বিনির্মাণ-অন্তে, মন্দিরের গোড়ার দিক চূড়ায় উঠে যাওয়াতে মন্দিরস্থ দেবী চণ্ডিকাকে বাধ্য হ’য়ে হেঁটমুণ্ড-ঊর্ধ্বপদ অবস্থায় বসবাস করতে হচ্ছে, এবং তাঁর নাম দাঁড়িয়েছে ‘লাকী মা’।

তোগলকের আরও ইচ্ছা ছিল, যে, মধুপুর গড় থেকে, উত্তর থেকে, আরেকটা স্ট্রিপ টেনে এনে জুড়ে দেবেন রমণায়। কিন্তু এই পরিকল্পনায় কলম দেওয়ার আগেই তিনি আপন পুত্র ঔরঙ্গের চক্রান্তে বঙ্গত্র দুর্গে বন্দি হ’ন। হিজ এক্সেলেন্সি এখনও জীবিত কিনা জানা যায় না, এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর স্বেচ্ছা-বন্দিনী কন্যা নাহারজানের ছবিও আর ছাপেন না এখন প্লেবয়- বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। তাঁকে (নাহারজানকে) শেষ চোখের দেখা দেখেছে, এমন লোক সারা দেশে এবে গুটিকয়, তন্মধ্যে প্রসিদ্ধতম নাড়ু পাগলা—সে-ও তার পাগলাত্ব-প্রাপ্তির আগে, তার (নাড়ুর) সেই সুন্দর চোর-জীবনের ক্লাইম্যাক্সে।

রমণারণ্যের বুক চিরে বয়ে-যাওয়া জর্ডান নদীর পাড়ে কালকেতু ও ফুল্লরা গিয়ে পৌঁছান। এ-নদীটির জন্ম, বলাবাহুল্য, মহাপ্লাবনের সময় পরে দ্রষ্টব্য)। নদীর নামকরণ হয়, জর্ডানের বাদশাহ হুসাইন শাহ পল্লবী, রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসে এই নদীতে নৌবিহার করবার পর। কিংবদন্তি আছে, যে, তিনি প্রমোদতরির নাম ‘বাংলার বাঘ’ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে উঠতে অস্বীকার করেন। তখন, অন দ্য স্পট, ওটির নাম পাল্টে রাখা হয় এমকে একেএম ফজলুল হক (‘এমকে’-র ব্যাখ্যার জন্য ‘মহাপ্লাবন’ পর্ব দ্রষ্টব্য)। তবে সুখের বিষয়, বাদশাহ, শেরে বাংলা বিষয়ে জানতেন না কিছুই জানলে হয়তো প্রোগ্রামটি বাতিল করা-ভিন্ন উপায় রইত না।

একটি সুন্দরী গাছের ছোট্ট ছায়ার নীচে ফুল্লরা হাসেন।

কালকেতু প্রস্তাবনা করেন, ‘এসো করি তবে, সবাই যখন করছে।’

বাস্তবিক, তাঁদের আশেপাশে, উপরে-নীচে, পা-ফেলবার জায়গা নাই। গোটা শহরের লোক যেন রমণার বীজখেতে আসিতেছে চ’লে… জর্ডানের পানিতেও, এমনকি, তিলধারণের জায়গা নাই, বীর্যধারণের ফুরসত নাই।

ফুল্লরা বলেন, “তার চেয়ে এসো আমরা এখানে বাদাম খাই, এবং নার্ভাস ধরনের রোমান্টিক কথাবাবার্তা বলি, যেমন করতেন আমাদের প্রপিতামাতামহমহীগণ। ‘

কালকেতু বলেন, ‘না, এসো আমরা পৈট্রি লিখি… রমণার সঙ্গে একটা মিল দাও তো দেখি—’

‘দো-মনা,’ ফুল্লরা বলেন। ‘তুমি?”

‘যমুনা,’ বলেন কালকেতু।

‘এটা তো হ’ল না,’ ফুল্লরা বলেন।

‘কেন হবে না? একে বলা হয় হাফ-রাইম, বা কনসন্যান্স।’

ফুল্লরা হাততালি দিয়ে বলেন, ‘রোমানা।’

কালকেতু—‘রিমানা।’

‘রোমেনা।’

‘রেমিনি।’

‘এটা কিছুতেই মানা যায় না,’ ফুল্লরা প্রতিবাদ করেন।

‘খুব যায়,’ কালকেতু জবাব দেন—~’এমিলি ডিকিনসনের কবিতা প’ড়ে দেখো।’

অতঃপর তাঁরা ঘুরে-ঘুরে সেই জনসঙ্ঘাতমদিরা চোখে চেখে দেখেন কিছুকাল। তারপর উক্ত আবালবৃদ্ধবনিতাজনতার উপর দিয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে-খেলতে বেরিয়ে আসেন কার্জন হলের সামনে, যার সরকারি নাম গুণাগার—বর্তমান প্রেজিডেন্ট বীরবলেন্দু গুণের বেসরকারি বাসভবন।

কলেজ রো ধ’রে মিটার-বিশেক যেতেই, রাস্তার পরপারে দেখা যায়, ‘কৌস্তুভরতন যথা মাধবের বুকে,১৯ চিল্কা লখ্-এর সিল্কি জলে ভাসমান, ইয়ত্তাহীন মশালালোকে জাজ্বল্যমান, সখাবাবার‍ পবিত্র দরগাহ শরিফ। ঢাকার তাবৎ সন্তানার্থিনী রমণীর কৈলাস—সকল ক্লীবলিঙ্গভর্তৃকার শিবলিঙ্গ। ঢাকার দশ-শতাংশ জনগণের পিতৃত্বের দাবিদার এই সখাবাবা। তাঁর অলৌকিক, এবং তৎপুত্র সৈয়দ বখিলের লৌকিক, মহিমায়, মহাপ্লাবনের মহামারীর পরে, ঢাকা আবার কাচ্চাবাচ্চার কিচিমিচিতে মুখ হয়েছে। বন্ধ্যা-অবন্ধ্যা-বালিকা-বৃদ্ধা-নির্বিশেষে, যে-কেউই তাঁর দরগাহ-য় সন্তানকামনায় যায়, সে-ই গর্ভিণী হ’য়ে ফেরে। বলতেকি, ঢাকার নববঢ়ারা ছাঁদনাতলা থেকেই সোজা রওয়ানা হ’ন সখাবাবার মাজারে, বাসর-শয্যার আগেই গর্ভাধান পাকা ক’রে আনেন—বরের সদ্যঃপাতী শুক্রাণুর ভরসা করেন থোড়াই।

ফুল্লরা বলেন, ‘অসঙ্খ্য পিঁপড়ে নাকি মাটির নীচ থেকে ‘বাবা”র ঐশী স্পার্ম তুলে আনে…’

‘তাতে আর আশ্চর্য কী,’ কালকেতু বলেন, ‘ভারতবর্ষীয়রা বহু মিলেনিয়া-যাবৎ পিঁপড়েদেরকে খনি-মজুর-রূপে ব্যবহার ক’রে আসছে। হেরোডোটসের হিস্টরিজে আছে, যে, তারা (ভারতীয়রা) পুরাকালে পিঁপড়েদের স্বর্ণ-উত্তোলনের কাজে লাগাত। আরও আছে, তৎকালে তারা ঘরে খেলাধুলা এবং রাস্তায় সঙ্গমাদি কাজ সারত। এর থেকেই বোঝা যায় “হিস্টরিজ” রিপিট দেমসেজ।’

খানিকক্ষণ বাদে কালকেতু অবশ্য জানান, ‘আমার কিন্তু ধারণা, যে, গোটা চিল্কাটাই আসলে সখাবাবার বীর্যব্যাংক, বা ট্যাংক। যে-কোনও রমণীরই, এখানে অবগাহনমাত্রই, গর্ভসঞ্চার অনিবার্য। এমনকি যে-রমণী পূর্বে পুরুষ কিংবা নপুংসক ছিলেন, তাঁরও। উদাহরণ ডঃ হোমায়া এজিদ, যিনি সম্প্রতি একটি অষ্টাবক্র সন্তানের জনক-জননী হয়েছেন।

হোমায়া এজিদের কাহিনি এই : তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন (সম্ভবতঃ) পুরুষ, এবং তাঁর পুণ্যনাম, হো. মো. এজিদ, তৎকালীন গে-সম্প্রদায়ের মুখে-মুখে ফিরত। ব্যাকরণে ডক্টর এজিদের এতাদৃক্ দখল ছিল, যে, শুধু সন্ধির উপরেই তিনি পাঁচ-পাঁচটি অমূল্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যথা : স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি, বিসর্গসন্ধি, বয়ঃসন্ধি, এবং উরুসন্ধি। এক বৈশাখী বৌমেলায়, কতিপয় চ্যাংড়া তাঁর শেষোক্ত গ্রন্থটিকে ভস্ম করলে পর তিনি ফজরের কাগজ-এ মন্তব্য করেন : ‘ইহারা জানে না, কোন পথে ইহারা আসিয়াছে, বা কোন পথে যাইবে।’ পরে, বায়ান্ন বৎসর বয়সে, সেই পথেরই সন্ধানে, হর্মোন বদলে তিনি স্ত্রীলিঙ্গ হ’ন এবং লিঙ্গ বিষয়ে একখানি সুবিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থটির কল্যাণে (এবং অবশ্য গ্রন্থটির, উমবের্তো একো- কৃত রিভিউ: ‘ফ্যালাস, ফ্যালেসি, ফেলেশিও : ডঃ এজিড’জ ওয়ার্ল্ড অব হলগ্রাফিক পর্নোগ্রাফি-রও সম্মানে) তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি, শতলিমা ফেমিনিস্ট ক্লাব-এর যুগ্ম সম্পাদক পদ, এবং মার্কিন দূতাবাসের তরফে ‘গোল্ডেন বানানা’ পদক লাভ করেন।

(এখানে ডঃ হোমায়া এজিদের জীবন-সঙ্ক্রান্ত দু’একটি তথ্য সেন্সর করা হয়, বাংলাদেশ সম্মিলিত ধাঙ্গর সমিতির প্রতিষ্ঠাত্রী সম্পাদিকা, অমর নেত্রী, স্বর্গতা গুরু মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে।

অতঃপর চিল্কার পবিত্র হাওয়া গায়ে মেখে, সখাবাবার উদ্দেশে গায়েবি সেলাম ঠুকে, তাঁরা চ’লে আসেন চানখাঁর পুল। নতুন পুলের মাঝখানে ফুল্লরা শুধান, ‘খাবে নাকি কিছু? এখানে গুঁইসাপের মাংসে চমৎকার কাচ্চি বিরিয়ানি পাকায়।

গুঁইসাপের উল্লেখমাত্রে কালকেতু নীল হ’য়ে যান, বলেন, ‘গোধা আমার অভক্ষ্যা।’

‘টোটেম?’ ফুল্লরা টিটকারি করেন।

তারপর, বলা কহা নাই, মুখের ভিতর আঙুল ভরে সিটি ফুল্লরা বাজান—আর মুহূর্তে, নানা দিক থেকে নানা পশু, যথা : কুকুর শূকর গোরু ঘোড়া বিড়াল শজারু আর্মাডিলো ভোঁদড় বাঁদর বাদুড় কমোডো-ড্রাগন খচ্চর গ্রিজলি-বেয়ার লামা আলপাকা ইয়াক জিরাফ গণ্ডার হাতি হায়েনা ইয়াহু ও খোদার-খাসি ছুটে আসে। ফুল্লরা তখন তাদের, ও তাঁর নিজের ভাষা মিশিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলেন, যথা : ‘ভৌ, কেমন আছিস?” ‘মিঞা, ভালো তো?” “হিনিনিনিনিম, কী করা হয় আজকাল?’ ইত্যাদি। তারাও উত্তর দেয়, তবে বাংলাটুকু বাদ দিয়ে। জাতীয়তাবাদী পশু!

কালকেতু বলেন, ‘!?!’

‘নারীর অপর নাম প্রকৃতি, জানো তো?’ ফুল্লরা জবাব দেন। ‘এই ইয়াকটা আমার বাধুক খুব। ওর পিঠে এসো কিয়ৎক্ষণ ভ্ৰমা যাক।’

তখন তাঁরা ইয়াক-বাহন হ’য়ে রওয়ানা হ’ন।

পথে জনৈক, সম্ভবতঃ পশুসংরক্ষণবাদী, তাঁদেরকে থামিয়ে শুধান, ‘এই-যে দাদা-দিদি, কাজটা কেমন হচ্ছে ক’ন দিনি?”

ফুল্লরা সপ্রতিভ হেসে বলেন, ‘আপনি কি ভাই জানেন না, যে, ইয়াকের পিঠে ওজন না-চাপালে তাদের হাঁটতে-চলতে কষ্ট হয়? ইয়াক হ’ল সাক্ষাৎ কলির সিন্দাবাদ, বা বিন্ধ্যপর্বত, বা মাউন্ট অ্যাটলাস, বা বাসুকি, বা ‘

বা-এর তোড়ে পশুদরদি ভেসে যান, এবং ফুল্লরা ও কালকেতু নির্বিঘ্নে ধর্মবনানীর পথে অগ্রসর হ’ন।

অভয়া ক্যানাল (প্রাক্তন অভয়দাস লেন) (ইয়াক-সমেত) স্বয়ংক্রিয় নৌকায় পার হ’য়ে, দক্ষিণ-পশ্চিমে একশ’-চল্লিশ কদম (ইয়াকের কদম, অবশ্যই) যেতেই দেখা যায়, রাজা বেদব্যাস-এর সুবিশাল (পৃথিবীর বৃহত্তম) বাঁশের কেল্লা। ভিতরের বংশপ্রাসাদের চিলেকোঠা থেকে রানি-মা’র সুরেলা গলায় ইংরেজি চর্চার ধুন ভেসে আসে- ‘এ ফর অ্যারো, বি ফর বো, সি ফর চাকমা…’

উয়ারি থানার পাশ দিয়ে বিশ-গজ-মতো এগিয়ে যেতেই, ধর্মবনানীর ঈশান তোরণ দেখা যায়।

ফুল্লরা বলেন, ‘এ-লাইনে চেষ্টা-টেষ্টা ক’রে দ্যাখো না, হয় কিনা কিছু।’

‘বাতুল হয়েছো!’ কালকেতু আঁতকান—’মামা-দাদায়ও কাজ হয় না এ-ধামে। স্বয়ং পোপ, আয়াতুল্লাহ, দালাই লামা, আগা খাঁ-দের রেফারেন্স লাগে। সাধু হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়া সহজ এখন। প্রেজিডেন্ট হওয়াও কঠিন কিছু না—ক’টি দেশাত্মবোধক, বা রোষাত্মবোধক, কবিতা, সামান্য দাড়ি বা গোঁফ, উর্দি বা খাদি—ব্যাস।’

‘ততঃ কিম্?” ফুল্লরা শুধান।

‘নাম-ধাম—’ কালকেতু বলেন।

‘ততঃ কিম্‌?’

‘আরও কবিতা।’

‘ততঃ কিম্‌?’

‘আরও কবিতা এবং আরও আরও আরও কবিতা, এবং আরও কবিতা। মঞ্চে কবিতা, মাইকে কবিতা, দৈনিকে সাপ্তাহিকে পাক্ষিকে মাসিকে কবিতা, রিকশায় কবিতা, রেস্তোরাঁয় কবিতা, নৌকায় কবিতা, লঞ্চে কবিতা, বন্দরে কবিতা, গঞ্জে কবিতা, টুপিতে কবিতা, টাকায় কবিতা, আপাদমস্তক কবিতা, আসমুদ্রহিমাচল।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *