কালকূট
ওই যে উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়েটি তোমাদের হাসি-গল্পের আসর ছাড়িয়া হঠাৎ আড়ষ্টভাবে উঠিয়া বাড়ি চলিয়া গেল, শ্রীমতী পাঠিকা, তোমরা উহাকে চেন কি? কেন চিনিবে না? ও তো প্রফেসার হীরেন বাগচির স্ত্রী। গত পাঁচ বছর ধরিয়া তোমরা নিত্য উহার সঙ্গে মেলামেশা করিতেছ। ওর নাম কমলা, ওর একটি চার বছরের মেয়ে আছে, ওর বাপের বাড়ি চন্দননগরে, সবই তো তোমরা জান। কেন চিনিবে না?
কিন্তু তবু তোমরা কেহ উহাকে চেন না। ওর মনের সামনে একটা পর্দা পড়িয়া আছে; ওর সুন্দর টুলটুলে মুখখানিতে, ওর পরিপূর্ণ নিটোল দেহটিতে নারী-সৌন্দর্যের সব উপকরণই আছে, শুধু ভিতরকার মানুষটির পরিচয় নাই। পাঁচ বছরের ঘনিষ্ঠ মেলামেশাতেও তোমরা উহাকে সম্পূর্ণ বুঝিতে পার নাই; এই তো সেদিন তোমাদের মধ্যেই কথা হইতেছিল, একজন বলিয়াছিল, দেখ ভাই, কমলা যেন কেমনধারা। এই বেশ হেসে কথা কইছে, আবার এখনই কি রকম গম্ভীর হয়ে পড়ে। তারপরেই উঠে চলে যায়। ওর মনের কথা আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পেরেছিস?
আর একজন বলিয়াছিল, আমরা সবাই ওর কাছে বরের গল্প করে মরি, আর ও কেমন মুখ টিপে বসে থাকে দেখেছিস?
তৃতীয়া বলিয়াছিল, সেদিন দেখলি তো, প্রীতির বিয়ের গল্প শুনে যেন পাঙাশমূর্তি হয়ে গেল। আচ্ছা, প্রীতি আর তার বরের বিয়ের আগে থাকতে ভালবাসা হয়েছিল, তারপর দুজনের বিয়ে হল, এতে ভয়ে সিটিয়ে যাবার কি আছে ভাই?
তা নয়, স্বামীর কথা উঠলেই ওই রকম হয়ে যায়, তারপর একটা ছুতো করে উঠে পালায়। যা বলিস ভাই, আমার তো মনে হয়, ওর বর ওকে ভালবাসে না।
দূর! সে হলে মুখ দেখেই বোঝা যেত।
তা নয়। আসল কথা, প্রফেসারের গিন্নী, তাই আমাদের মতো মুখ্যুর সঙ্গে মন খুলে কথা কইতে লজ্জা করে।
ও কথা বলিস না। কমলার শরীরে এক ফোঁটা অহঙ্কার নেই, একেবারে মাটির মানুষ, কিন্তু তবু মাঝে মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকে।
এই সকল আলোচনা যখন হয়, তখন একটি মেয়ে কোনও কথা বলে না, হেঁট হইয়া ক্রুসে লেস তৈয়ার করে। কে জানে হয়তো সে কমলার ব্যথায় ব্যথী নিজের অন্তরের নিগূঢ় বেদনার দ্বারা অপরের মর্মের ইতিহাস বুঝিতে পারে।
কিন্তু মোটের উপর কেহই যে কমলার চরিত্র বুঝিতে পারে নাই, তাহাতে সন্দেহ থাকে না। বেশী কথা কি, তাহার স্বামী যে তাহাকে ভাল করিয়া চিনিয়াছে, এমন কথাও জোর করিয়া বলা চলে না! অথচ হীরেন তাহাকে ভালবাসে, এত বেশী ভালবাসে যে, এক এক সময়ে সে ভালবাসা বাহিরের লোকের চোখে উৎকট ঠেকে। তাহাদের এই ছয় বছরের দাম্পত্যজীবনে এমন একটা কলহও ঘটে নাই, যাহাকে অজাযুদ্ধ বা ঋষিশ্রাদ্ধের সহিত শ্রেণীভুক্ত করিয়াও উপহাস করা যাইতে পারে।
অন্য পক্ষে, কমলা তাহার স্বামীকে ভালবাসে না, হয়তো বিবাহের পূর্বে সে আর কাহাকেও ভালবাসিত—এমন একটা সন্দেহ অজ্ঞ ব্যক্তির মনে উদয় হইতে পারে। কিন্তু সে সন্দেহ একেবারেই অলীক। স্বামীকে ভালবাসে না, সাধারণ বাঙালীর মেয়ের পক্ষে এত বড় অপবাদ বোধ করি আর নাই। কমলাকে কিন্তু সে অপবাদ কেহ দিতে পারিত না। সে নিজের স্বামীকে ভালবাসিত মনের প্রত্যেক চিন্তাটি দিয়া, শরীরের সমস্ত স্নায়ু শিরা রক্ত দিয়া। কিন্তু তবু এত ভালবাসা সত্ত্বেও, হয়তো বা এত ভালবাসার জন্যই, সময়ে সময়ে দুইজনের মাঝখানে অপরিচয়ের পর্দা নামিয়া আসিত; কমলা মনের দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিয়া বিজনে একাকী বসিয়া থাকিত, তখন হীরেন কোনমতেই তাহার নাগাল পাইত না।
কাবার্ডের মধ্যে কঙ্কাল বলিয়া ইংরাজীতে একটা কথা আছে। সেই কথাটার ভাল তর্জমা যদি বাংলায় থাকিত, তাহা হইলে কমলার জীবনের ইতিহাস এক কথায় বুঝাইয়া দিতে পারিতাম। কারণ, ওই কঙ্কালটা যখন খটখট শব্দে নড়িয়া উঠিত, তখনই ভীত বিহ্বল কমলা ছুটিয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিত, তারপর কঙ্কালের সঙ্গে নিজেকে বন্দিনী করিয়া অশ্রুহীন শুষ্ক চক্ষু মেলিয়া নরকের দুঃস্বপ্ন দেখিত।
আসল কথা, শিশু যেমন অবহেলায় খেলাচ্ছলে বহুমূল্য দলিল ছিঁড়িয়া কুটি-কুটি করিয়া ফেলে, কমলাও একদিন তেমনই খেলাচ্ছলে নিজের ইহকাল পরকাল ছিঁড়িয়া ফেলিয়াছিল; তাই আজ বাহিরের সংসার যতই ফলে ফুলে ভরিয়া উঠিতেছে, মনের কঙ্কাল ততই তাহার পিছনে প্রেতের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
নারীদেহ যে পবিত্র, তাহার শুচিতা নষ্ট করিবার অধিকার যে তাহার নিজেরও নাই, এ ধারণা নারীর মনে কত বয়সে উদয় হয়? শৈশবে শুচিতা অশুচিতা কোনও জ্ঞানই থাকে না, কৈশোরে কিছু কিছু দেখা দেয়, পরিণত যৌবনে ইহা পরিপূর্ণরূপে বিকাশ পায়। তাই বুঝি যৌবনে নারী নিজ দেহকে অন্যের দৃষ্টি হইতেও রক্ষা করিবার জন্য সর্বদা লজ্জায় সন্ত্রস্ত হইয়া থাকে।
জ্ঞানী ব্যক্তিদের বলিতে শুনিয়াছি যে, মনের অগোচরে পাপ নাই; অর্থাৎ অপরাধ করিতেছি—এ জ্ঞান না থাকিলে অপরাধ হয় না। কথাটা কি সত্য? তাই যদি হয়, তবে অজ্ঞানকৃত দোষের জন্য আমরা লজ্জিত হই কেন? আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় একটা ইঁদুরছানা ধরিয়া তাহার ক্ষুদ্র শরীরটিকে অশেষভাবে নির্যাতিত করিয়া শেষে ভাঙা কাচ দিয়া পেঁচাইয়া পেঁচাইয়া তাহার গলা কাটিয়াছিলাম। সেই দুষ্কৃতির স্মৃতি এখনও আমাকে পীড়া দেয় কেন?
তেরো বৎসর বয়সে কমলা একটা অপরাধ করিয়াছিল। তখনও তাহার দেহের শুচিতাবোধ জন্মে নাই। কিন্তু কথাটা আরও স্পষ্ট করিয়া বলিতে চাই। যাঁহারা কদাচিৎ সত্য কথা শুনিতে ভয় পান, তাঁহারা কানে আঙুল দিতে পারেন।
ডাক্তারি বইয়ে হয়তো এক-আধটা ব্যতিক্রমের উদাহরণ পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু সাধারণত তেরো বছর বয়সে মেয়েদের যৌনক্ষুধা জাগ্রত হয় না। যাহা জাগ্রত হয়, তাহা যৌন-কৌতূহল। এই কৌতূহল প্রকৃতিদত্ত এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক সন্দেহ নাই; কিন্তু ইহারই অদম্য তাড়নায় কত কচি প্রাণ অঙ্কুরে নষ্ট হইয়া যায়, তাহা কে গুণিয়া দেখিয়াছে? এই কৌতূহলকে উত্তেজিত করিবার কারণেরও অভাব নাই। নিজের দৈহিক বিবর্তনই সবচেয়ে বেশী উত্তেজিত করিয়া তুলে। বয়ঃসন্ধিতে পদার্পণ করিয়া পরিবর্তনশীল শরীরই সর্বপ্রথম বিপ্লব বাধায়। অথচ ট্রাজেডি এই যে, দেহটাই গোড়ায় এই বিপ্লবের অবশ্যম্ভাবী ফল ভোগ করে।
কমলা তেরো বছরের অর্ধস্ফুট দেহে অনাগত সুখ-সম্ভাবনার ইঙ্গিত পাইত, অজ্ঞাতকে জানিবার সদা-জাগ্রত কৌতূহল অনুভব করিত; কিন্তু সত্যকার দৈহিক সুখ-লালসা তখনও তাহাকে অধীর করিয়া তুলে নাই। দূরাগত বনমর্মরের মতো সে আসন্ন যৌবনের চরণধ্বনি শুনিয়া উচ্চকিত হইয়া থাকিত, কিন্তু সে চরণধ্বনি আর নিকটে আসিত না। কমলার কৌতুহল তাহাতে আরও দুরন্ত হইয়া উঠিত।
কমলার দিদির বিবাহ হইয়া গিয়াছিল। সে লুকাইয়া বরকে চিঠি লিখিত, কমলাকে দেখিতে দিত না। জামাইবাবু যখন আসিতেন, তখন দিদির সকৌতুক প্রেমলীলার দৃশ্যমান অংশটুকু কমলা সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়া আত্মসাৎ করিত। কিন্তু তবু তৃপ্তি পাইত না। অনেকখানিই যেন বাকি থাকিয়া যাইত। শরীরের মধ্যে সে একটা উত্তপ্ত অস্থিরতা অনুভব করিত। অপ্রাপ্তির ক্লেশ তাহাকে চঞ্চল অসহিষ্ণু করিয়া তুলিত।
এইরূপ সঙ্কটপূর্ণ যখন তাহার অবস্থা, সেই সময় হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল একটি লোক। লোকটিকে কমলা যে এতদিন দেখে নাই তাহা নয়, প্রত্যহ দুইবেলা দেখিয়াছে। কিন্তু সে যে তাহার দিদির বর জামাইবাবুর স্বজাতি অর্থাৎ পুরুষমানুষ, এবং যে কৌতূহল অহরহ তাহাকে দগ্ধ করিতেছে তাহা তৃপ্ত করিবার ক্ষমতা যে ইহার আছে, এই সম্ভাবনার দিক দিয়া এতদিন সে তাহাকে দেখে নাই। হঠাৎ জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান-স্বরূপ এই ছোকরাকে দেখিয়া কমলার চক্ষু ঝলসিয়া গেল।
ছোকরার বয়স বোধ করি কুড়ি-একুশ; দেখিতে এমন কিছু নয় যে, দেখিবামাত্র কেহ মজিয়া যাইবে। রোগা চেহারা, গাল বসা, চোখের কোলে কালি, কিন্তু চুলের খুব বাহার। তাহার নাম প্রভাস-পাড়ারই কোনও ভদ্রলোকের ছেলে। ছেলেবেলা হইতেই তাহার এ বাড়িতে যাতায়াত ছিল এবং বড় হইবার পরও যাতায়াত অব্যাহত রহিয়া গিয়াছিল। মেয়েদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশাও বাড়ির লোকের সহিয়া গিয়াছিল, কেহ আপত্তি করিত না।
সে সময়ে-অসময়ে বাড়িতে ঢুকিত এবং কমলাকে একলা পাইলেই তাহার খোঁপা খুলিয়া দিত, কাপড় ধরিয়া টানিত, কখনও বা গাল টিপিয়া দিত। এক এক সময় সুবিধা পাইলে গলা খাটো করিয়া এমন দুই-একটা কথা বলিত যাহার ইঙ্গিত কমলা বুঝিত না, কিন্তু বুঝিয়াছে-এমনই ভান করিয়া মুখ টিপিয়া টিপিয়া হাসিত। পূর্বেই বলিয়াছি, কমলার তখনও শরীরের শুচিতাজ্ঞান জন্মে নাই, শুধু জীবনের অজ্ঞাত রহস্য জানিবার অদম্য লিপ্সা ছিল।
কিন্তু সহসা যেদিন প্রভাস কমলার চক্ষে সমস্যার মীমাংসারূপে দেখা দিল, সেদিন হইতে কমলা সর্বদা তাহার জন্য উৎসুক হইয়া থাকিত। তাহার স্পর্শ ও কথা কিসের ইঙ্গিত করিয়া গেল, তাহাই বুঝিবার চেষ্টায় গোপনে মনের মধ্যে সর্বদা আলোচনা করিত। চুম্বকের সামীপে যেমন লোহার চৌম্বক আবেশ হয়, প্রভাসের সংস্পর্শও তেমনই তাহাকে তদ্ভাবিত করিয়া তুলিত।
একদিন দুপুরবেলা, বাড়িতে কেহ কোথাও ছিল না—মা পাড়া বেড়াইতে গিয়াছিলেন, দিদি উপরের ঘরে দোর বন্ধ করিয়া বরকে চিঠি লিখিতেছিল, এমন সময় পা টিপিয়া টিপিয়া প্রভাস ঘরে ঢুকিল। কমলা আয়নার সম্মুখে দাঁড়াইয়া চুল আঁচড়াইতেছিল, প্রভাস পিছন হইতে হঠাৎ তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। কমলার ঘাড়ের উপর তাহার উষ্ণ নিশ্বাস পড়িয়া কমলার সর্বাঙ্গ কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সে অকারণে হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, ছাড়। ও কি করছ?
প্রভাস তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া চাপা গলায় বলিল, চুপ। আস্তে। কমলি, একটা ভারী মজা দেখবি? খিড়কিপুকুরের ওপারে পড়ো ঘরটাতে সব ঠিক করে রেখেছি, তুই কিছুক্ষণ পরে সেখানে যাস। চুপিচুপি যাস, কাউকে বলিসনি। আমিও সেখানে থাকব।
কমলার বুক ভয়ানক ধড়ফড় করিতে লাগিল, সে রুদ্ধস্বরে কহিল, আচ্ছা।
প্রভাস যেমন আসিয়াছিল তেমনই চোরের মতো বাহির হইয়া গেল।
এমনই করিয়া শিশু যেমন অজ্ঞানে খেলাচ্ছলে মহামূল্য দলিল ছিঁড়িয়া ফেলে, কমলা তেমনই করিয়া নিজের ভবিষ্যৎ সুখশান্তি নষ্ট করিয়া ফেলিল!
কিন্তু অমূল্য বস্তু খোয়া গেলেও তৎক্ষণাৎ ক্ষতির জ্ঞান জন্মে না। কমলারও সে বোধ জন্মিতে দেরি হইল। মাস-দুই এইভাবে চলিবার পর আর একটা ঘটনা ঘটিয়া তাহার নিমীলিত চেতনাকে বিস্ফারিত করিয়া খুলিয়া দিল।
সেদিন কমলার মা কমলাকে সঙ্গে লইয়াই পাড়া বেড়াইতে গিয়াছিলেন। বেলা সাড়ে তিনটার সময় ফিরিয়া বাড়িতে পা দিবামাত্র কমলার দিদি নির্মলা ছুটিয়া আসিয়া রোদনবিকৃত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, মা, ওই হতচ্ছাড়া পেভাকে বাড়ি ঢুকতে দিও না। ও—ও একটা শয়তান। আর—আর আজই আমাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দাও, আমি একদণ্ডও এখানে থাকতে চাই না।
কমলা অবাক হইয়া দেখিল, দিদির দুই চোখ জবাফুলের মতো লাল হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। তাহার চুল ও গায়ের কাপড় হইতে জল ঝরিয়া পড়িতেছে, মনে হইল, এইমাত্র সে পুকুর হইতে ডুব দিয়া আসিতেছে।
কমলার মা স্তম্ভিতভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর বলিলেন, কমলি, তুই ওপরে যা।
নির্মলার সঙ্গে মায়ের কি কথা হইল, কমলা শুনিতে পাইল না। কিন্তু দিদি যখন কিছুক্ষণ পরে উপরে আসিয়া সিক্তবস্ত্রেই বিছানায় শুইয়া পড়িল, তখন সেও পিছনে পিছনে তাহার পাশে গিয়া বসিল। একটু চুপ করিয়া থাকিয়া সঙ্কুচিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, কি হয়েছে দিদি?
বিছানা হইতে মুখ না তুলিয়াই নির্মলা বলিল, কিছু নয়। তুই যা।
মিনতি করিয়া কমলা বলিল, বল না দিদি; আমার বড্ড ভয় করছে।
নির্মলা উঠিয়া বসিয়া বলিল, ওই হতভাগা প্রভাস আমার গায়ে হাত দিয়েছিল।
অতিশয় বিস্মিত হইয়া কমলা কহিল, হাত দিয়েছিল তা কি হয়েছে?
নির্মলা গর্জিয়া উঠিল, কি হয়েছে! তুই কোথাকার ন্যাকা?
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে, কেরাসিন তেল ঢেলে গা পুড়িয়ে ফেলি। আমি আজই ওঁর কাছে চলে যাব, এক রাত্তিরও আর এখানে থাকব না। হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিল, আচ্ছা, তোর না হয় বিয়েই হয়নি, কিন্তু বয়স তো হয়েছে, বুঝতে তো শিখেছিস। বল দেখি, বর ছাড়া আর কেউ গায়ে হাত দিলে কি মনে হয়? এখনও আমার গা ঘেন্নায় শিউরে শিউরে উঠছে। যাই, আর একবার পুকুরে ডুব দিয়ে আসি।
তারপর কমলার বিবাহ হইয়াছে, স্বামীকে সে ভালবাসিয়াছে, নিজের দেহের অতুল মর্যাদা বুঝিয়াছে। কিন্তু স্মৃতির হাত হইতে নিস্তার নাই—ভুলিবার পথ নাই। ভোলা যায় না। তাহার মস্তিষ্কের উপর দুরপনেয় স্মৃতির কালি দিয়া ছাপ পড়িয়া গিয়াছে। নড়িতে চড়িতে প্রতি পদে তাহার মনে হয়—নাই, নাই, তাহার কিছু নাই। স্বামীকে সে প্রতি পলে বঞ্চনা করিতেছে, সন্তানের নির্মল ললাটে পঙ্কতিলক আঁকিয়া দিয়াছে। পত্নীত্বের, মাতৃত্বের অধিকার তাহার নাই। সে কলুষিতা।
জাগ্রতে স্বপ্নে সদাসর্বদা আশঙ্কায় কণ্টকিত হইয়া আছে—যদি কেহ জানিতে পারে, যদি কেহ সন্দেহ করে?
শ্রীমতী পাঠিকা, ওই যে দূর্ভাগিনী তোমাদের হাসি-গল্পের মজলিস ছাড়িয়া হঠাৎ উঠিয়া বাড়ি চলিয়া গেল, উহাকে তোমরা চিনিবে না। ব্যথার ব্যথী যদি কেহ থাকে হয়তো সন্দেহ করিবে, কিন্তু সেও মুখ ফুটিয়া কিছু বলিবে না।
অথচ ছদ্মবেশ পরিয়া যাহারা জীবনের পথে চলে, তাহাদের পদে পদে আশঙ্কা। দুর্দিনের ঝড়ো হাওয়ায় ছদ্মবেশ উড়িয়া যায়, তখন রিক্ত নগ্ন স্বরূপ লইয়া তাহাদের লোকচক্ষুর সম্মুখে দাঁড়াইতে হয়। সে দুর্দিন নারীর জীবনে যখন আসে, তখন সান্ত্বনা দিবার, প্রবোধ দিবার আর কিছু থাকে না।
মেয়েদের হাসি-গল্পের মজলিস হইতে ফিরিয়া কমলা মেয়ে কোলে করিয়া ভাবিতেছিল সেই কঙ্কালটারই কথা। মেয়ে নিজ মনে খেলা করিতেছিল, কথা কহিতেছিল, কিন্তু সে কথা কমলার কানে যাইতেছিল না।
স্বামীর জুতার শব্দে চমক ভাঙিয়া কমলা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। হীরেন আসিয়া মেয়েকে কোলে তুলিয়া লইয়া হাসিমুখে বলিল, তোমার বাপের বাড়ির দেশ থেকে একটি ভদ্রলোক এসেছেন—প্রভাসবাবু। তোমাদের সঙ্গে খুব জানা-শোনা আছে শুনলাম। তোমাকেও ছেলেবেলা থেকে জানেন বললেন; তাই তাঁকে ধরে নিয়ে এলুম।
ফিট হইলে যেমন মানুষের শরীর শক্ত হইয়া যায়, তেমনই ভাবে শরীর শক্ত করিয়া অস্বাভাবিক স্বরে কমলা বলিয়া উঠিল, তাড়িয়ে দাও, দূর করে দাও, ওকে বাড়িতে ঢুকতে দিও না। আমি—না—উঃ—। এই পর্যন্ত বলিয়া সে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল। তাহার কপাল স্বামীর জুতার উপর সজোরে ঠুকিয়া গেল।
২৯ আশ্বিন ১৩৩৯