কার্ল মার্কস
বিশ শতকের বিশ্বের বহু দেশের সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে যে- দার্শনিক মতবাদ সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে, তা মার্কসবাদ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও মার্কসবাদ আজ অতি পরিচিত শব্দ। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস এই মতবাদের জনক। তিনি ছিলেন দ্বান্দ্বিক ঐতিহাসিক বস্তুবাদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা। তিনি শুধু তাত্ত্বিকই ছিলেন না, ছিলেন একজন বিপ্লবীও। উনিশ শতকের শ্রমিক শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লেনিনের নেতৃত্বে রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং মাও জেডোঙের (প্রচলিত উচ্চারণ মাও সে-তুং) নেতৃত্বে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে মার্কসবাদ মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশে রাষ্ট্রীয়-দর্শনের মর্যাদা পেয়েছে মার্কসবাদ। সম্প্ৰতি পূৰ্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে ও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পরও আজো দেশে দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র মার্কসবাদ। মার্কসীয় দর্শনের ভিত্তিতে বহু দেশে গড়ে উঠেছে সংখ্যাহীন কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও মার্কসের মূল চিন্তাধারা থেকে অধিকাংশ দেশের কমিউনিস্ট নেতারা সুবিধা মতো দূরে সরে গেছেন, তবু আজো তিনি তাঁদের কাছে যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে আসীন। বিশ শতকের শিল্প-সাহিত্যেও মার্কসবাদের প্রভাব অসামান্য। মার্কসীয় দর্শনের সমর্থন ও বিরোধিতা করে যতো লেখালেখি হয়েছে, এ শতাব্দীতে আর কোনো দার্শনিক মতবাদ নিয়ে ততো আলোচনা হয় নি।
১৮১৮ খৃস্টাব্দের ৫ মে মোসেলে নদীর তীরে জার্মানির ট্রিয়ার শহরে কাল মার্কসের জন্ম। তাঁর পিতা হাইনরিখ মার্কস ছিলেন একজন প্রভাবশালী আইনজীবী। মার্কসের পূর্বপুরুষদের অনেকেই ছিলেন ইহুদি। তবে তাঁর জন্মের কিছুকাল আগে তাঁদের পরিবার নামেমাত্র খৃস্টধর্মে দীক্ষিত হয়। মার্কসের পিতামাতা ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট খৃস্টান। মার্কসের জন্মভূমি তৎকালীন প্রুশিয়ার রাইন জেলা ছিলো ফরাশিদেশের সীমান্তসংলগ্ন। সুতরাং সেখানে ফরাশিবিপ্লবের প্রভাব ছিলো জার্মানির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি। ১৭৯৫ সালে রাইন জেলার এক অংশ ফরাশিদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। মার্কস ফরাশি বিপ্লবের উদারনৈতিক চিন্তাধারার আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠেন।
হাইনরিখ ও হেনরিয়েটা মার্কসের ছিলো ন’ ছেলেমেয়ে : পাঁচ কন্যা ও চার পুত্র। পুত্রদের মধ্যে মার্কস ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বড় ভাই মরিস ডেভিড শৈশবেই মারা যান। বড় সংসারে তাঁর মা সন্তানদের দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
হাইনরিখ মার্কস ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের মানুষ। তিনি শুধু দক্ষ আইনজ্ঞ ছিলেন না, ছিলেন যথার্থই উচ্চশিক্ষিত, সৎ ও খর-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। দু’জন শ্রেষ্ঠ ফরাশি দার্শনিক ভলটেয়ার ও জাঁ-জাকস রুশোর রচনাবলির তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান পাঠক। মার্কসের চরিত্রে উদারচেতা বুদ্ধিজীবী পিতার প্রভাব ছিলো অসামান্য। শৈশবে মার্কস আর একজন মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হন, তিনি তাঁর বন্ধু এডগারের পিতা ব্যারন লুডভিগ ফন ভেস্টফালেন। তিনিও ছিলেন একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা সাঁ-সিমোঁ সম্পর্কে তিনিই মার্কসকে অবহিত করেন।
মার্কস মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ট্রিয়ারের মাধ্যমিক ইস্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন ১৮৩০ থেকে ১৮৩৫ পর্যন্ত। বড় হয়ে তিনি যে মানবজাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন সে-আভাস তাঁর শৈশবেই পাওয়া গিয়েছিলো। ইস্কুলের শেষবর্ষের পরীক্ষায় তাঁকে লিখতে হয়েছিলো একটি নিবন্ধ : ‘জীবিকা নির্বাচন সম্পর্কে যুবকের চিন্তা’। ওই লেখাটিতে তিনি নিঃস্বাথ মানবসেবার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
১৮৩৫-৩৬ সালে মার্কস বছরখানেক বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়েন। ১৮৩৬ সালে তিনি ভর্তি হন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তাঁর অধ্যয়নের প্রধান বিষয় ছিলো ইতিহাস ও দর্শন। তরুণ মার্কস এই সময় কিছুকাল মনোযোগ দেন গীতিকবিতা চর্চায়। বহুসংখ্যক প্রেমের পদ্য এই সময় রচিত হয়। তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতা ও গানের খাতা পাওয়া গেছে। সেই গীতিকবিতাগুলো তিনি নিবেদন করেন তাঁর বাগদত্তা জেনি ফন ভেস্টফালেনকে। বার্লিনে অবস্থানকালে তিনি ইংরেজি ও ইতালীয় ভাষা শেখেন। এ সময় তিনি ‘উলানেম’ নামে একটি বিয়োগাত্মক কাব্য ও ‘মাকড়সা ও ফেলিক্স’ নামে একটি উপন্যাস রচনায় হাত দেন। ছাত্রজীবনেই হেগেলের দর্শনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। বার্লিনের নব্য-হেগেল পন্থীদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অবশ্য ১৮৪১ সালে তিনি ডক্টরেট করেন প্রাচীন গ্রিক-দর্শনে। তাঁর থিসিসের বিষয় ছিলো : ‘ডেমোক্রিটাসের প্রাকৃতিক দর্শন ও এপিকিউরাসের প্রাকৃতিক দর্শনের পার্থক্য’।
মার্কস হতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশ ঘটে সাংবাদিক হিশেবে। ১৮৪২ সালের প্রথম দিকে তিনি ‘রাইনিশ সাইটুঙ’ নামের একটি পত্রিকায় যোগ দেন। এটি ছিলো প্রগতিশীলদের পত্রিকা। কয়েক মাস পর তিনি কাগজটির সম্পাদক হন। প্রুশিয়ার সরকার তখন সংবাদপত্রে নানা ধরনের সেন্সর আরোপ করতো। মার্কস সেন্সর প্রথার বিরুদ্ধে এবং বাক্ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে নিবন্ধ লেখেন। ‘রাইনিশ সাইটুঙ’ ছিলো জার্মানির প্রথম পত্রিকা, যাতে তুলে ধরা হতো শ্রমজীবী মানুষের দাবিদাওয়ার কথা। আসলে ওটি ছিলো শ্রমজীবীদেরই মুখপত্র। সে- জন্যই পত্রিকার ওপর রক্ষণশীল সরকার চটে যায়। একপর্যায়ে কিছুদিন বন্ধও থাকে পত্রিকাটি। ১৮৪৩ সালের মার্চে মার্কস ‘রাইনিশ সাইটুঙ’-এর সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর মতে, পত্রপত্রিকার লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘প্রথাগত সবকিছুর কঠোর সমালোচনা করা।’
১৮৪৩ সালের ১৯ জুন মার্কস ও জেনির বিয়ে হয়। সহধর্মিণী জেনি হয়ে ওঠেন একাধারে তাঁর বন্ধু, সহকর্মী ও সহযোদ্ধা। মার্কসের সংগ্রামী জীবনে জেনির উৎসাহ ও অবদান ছিলো অপার। তাঁর দুঃখের দিনগুলোয় অবিচলিতভাবে জেনি তাঁর পাশে ছিলেন আমৃত্যু।
অগ্রসর চিন্তাবিদদের জন্য ইউরোপের ভেতরে প্যারিস ছিলো তখন তুলনামূলকভাবে নিরাপদ নগরী। ১৮৪৩ সালের অক্টোবরে মার্কস ও জেনি প্যারিসে যান মূলত সমাজতন্ত্র বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে। সেখানে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রগতিশীল শ্রমিকনেতা, সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের। প্যারিস থেকে ১৮৪৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেরোয় ‘ডুয়েশ-ফ্রান্জোলিসে ইয়ারবুক’ নামের একটি সাময়িকী। এই জার্মান-ফরাশি বার্ষিকীর মাধ্যমেই ইউটোপীয় নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রবক্তারূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে মার্কসের। ‘হেগেলীয় আইন-দর্শনের গুণাগুণ বিচার’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ এতেই প্রকাশিত হয়।
জার্মানির একজন বিশিষ্ট শিল্পপতির পুত্র ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের (১৮২০- ১৮৯৫) সঙ্গে ১৮৪২ সালে মার্কসের পরিচয় ঘটে এবং ১৮৪৪ নাগাদ সে-পরিচয় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। আমৃত্যু মার্কস-এঙ্গেলস ছিলেন ঘনিষ্ঠতম বন্ধু, সহকর্মী ও সহযোদ্ধা। ১৮৪৪ সালের আগস্ট মাসে এঙ্গেলস ইংলন্ড থেকে জার্মানি আসার পথে প্যারিসে দশ দিন অবস্থান করেন। দুই বিপ্লবী ওই সময় দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ জীবনের যৌথ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা উঠলে আজ মার্কস-এঙ্গেলসের নাম এক সঙ্গেই উচ্চারণ করা হয়।
প্যারিসে অবস্থানকালে মার্কস ‘ফরওয়ার্টস’ (ফরওয়ার্ড) নামে একটি জার্মানভাষী বামপন্থী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। অবিলম্বে পত্রিকাটি সরকারের কোপানলে পড়ে। ফরাশি সরকার মার্কসসহ পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিককে প্যারিস থেকে বহিষ্কার করে। ১৮৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্যারিস থেকে ব্রাসেলস যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন পর ঘরের আসবাবপত্র বেচে রাস্তাখরচ জোগাড় করে শিশুকন্যাসহ তাঁর পত্নীত্ত ব্রাসেলসে চলে যান।
অজানা-অচেনা ও বন্ধুবান্ধববিহীন ব্রাসেলসে এসে বিত্তহীন মার্কস-পরিবার গভীর সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু তাঁর অভাব-অনটনের কথা অবগত হওয়া মাত্ৰ অর্থসাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেন বিত্তবান বন্ধু এঙ্গেল্স। কিন্তু আর্থিক অসুবিধা দূর হলেও প্রুশিয়া সরকারের প্ররোচনায় শিগগিরই বেলজিয়াম সরকারের সন্দেহভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হন মার্কস। তাই প্রুশিয়া সরকারের নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে ১৮৪৫ সালে তিনি প্রুশিয়ার নাগরিকত্ব বর্জন করেন। স্বদেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। নাগরিকত্ব ত্যাগ না করলে তিনি যেখানেই যান না কেন, প্রুশিয়া সরকার তাঁর পিছু লেগেই থাকতো। ব্রাসেলসে অবস্থানকালেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি করেন : ‘দার্শনিকেরা এই জগতের বিস্তর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু মূল ব্যাপার হলো তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’ অর্থাৎ তিনি উপলব্ধি করেন যে, শুধু গভীর দার্শনিকতত্ত্বের বিচার-বিশ্লেষণে মানবজাতির মঙ্গল হবে না, এমন একটি দার্শনিক মতবাদ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যা এই জগতের বৈপ্লবিক অগ্রগতির সূচনা করতে পারে।
১৮৪৭ সালে ব্রাসেলসে বসে তিনি লেখেন ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ গ্রন্থটি। এটি ছিলো প্রুধোর ‘দারিদ্র্যের দর্শন’ গ্রন্থের সমালোচনা। ১৮৪৮ সালে বেরোয় তাঁর আরেকটি গ্রন্থ : ‘মুক্তবাণিজ্য সম্বন্ধে আলোচনা’। এই সময় তিনি ব্রাসেলসে ‘জার্মান প্রবাসী শ্রমিকদের সমিতি’ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
মার্কস তাঁর বিপ্লবী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি গোপন ছোটো দলও গড়ে তোলেন। অনেক বিপ্লবী নেতা ও কর্মী জড়ো হয় তাঁকে কেন্দ্র করে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কাজ করা ছাড়াও এই সময় মার্কসকে লেখালেখি নিয়ে প্রচুর পরিশ্রম করতে হতো।
মার্কস ও এঙ্গেলস যৌথভাবে রচনা করেন বিখ্যাত ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ ১৮৪৭ সালে। এটির জার্মান-সংস্করণ লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এটি একটি চিরস্মরণীয় দলিল। শ্রেণীসংগ্রামের বিপ্লবীতত্ত্ব অত্যন্ত জোরালো ভাষায় প্রচারিত হয়েছে এই ইশতাহারে। বিপ্লবকে স্বাগত জানিয়ে এতে এক মহামন্ত্র ঘোষিত হয় এইভাবে : ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবের ভয়ে শাসকরা প্রকম্পিত হোক্ব। শেকল ছাড়া সর্বহারার হারাবার কিছু নেই, জয় করার আছে গোটা বিশ্ব। দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ কমিউনিস্ট ইশতাহার শিগগিরই নানা ভাষায় অনূদিত হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর সামন্ত ও পুঁজিবাদী সমাজে তখন বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মতো অবস্থা বিরাজ করছিলো। এই সময় ‘কমিউনিস্ট ইশতাহার’ প্রকাশিত হলে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে তীব্র ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফরাশিদেশে ঘটে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’। অস্ট্রিয়া, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে শ্রমিকশ্রেণী ও স্বৈরাচার-বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি সংগঠিত হতে থাকে। এই সময় মার্কস তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে যে-অর্থ পান, নিজের অভাব-অনটন সত্ত্বেও, তার একটা বড়ো অংশ শ্রমিকদের অস্ত্র সংগ্রহের জন্য দান করেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে খালি হাতে করা সম্ভব নয়। প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসকদের শাসনের দুর্গে আঘাত না হানলে বিপ্লব সফল হতে পারে না। সমগ্র বিশ্বের বিপ্লবীদের সঙ্গে তাই তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেন। তাঁর এই কর্মকাণ্ডে ভীত হয়ে বেলজিয়াম সরকার তাঁকে ১৮৪৮ সালের ৩ মার্চ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বেলজিয়াম ত্যাগের নির্দেশ দেয়।
এই সময় মার্কসকে স্বল্পসময়ের জন্য গ্রেফতারও করা হয়। স্বামীর সঙ্গে জেনিও গ্রেফতার হন। তবে জনসাধারণের প্রতিবাদের মুখে তাঁদের ছেড়ে দেয়া হয়। তারপর সরকারি নির্দেশ মতো তিনি সপরিবারে ব্রাসেল্স্ ত্যাগ করে প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট লীগের সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এঙ্গেল্সও মার্কসের সঙ্গে যোগ দেন। অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট নেতারাও তখন প্যারিসে সমবেত হন। মার্কস নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
জনসাধারণের মধ্যে বিপ্লবের বাণী ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে মার্কস একটি ভালো পত্রিকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এই সময়। ১৮৪৮ সালে জার্মানিতে সংঘটিত মার্চ-বিপ্লবের কিছুদিন পরে ১ জুন তারিখে কলোন থেকে মার্কস প্রকাশ করেন ‘নিউ রাইনিশ সাইটুঙ’। মার্কস হন এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন এঙ্গেল্স। পত্রিকার মাস্টহেডের নিচে ‘গণতন্ত্রের মুখপত্র’ লেখা থাকলেও এটি ছিলো কমিউনিস্ট লীগের অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের মুখপত্র। জার্মানি ও অন্যান্য দেশের সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী ও কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত হয় এই পত্রিকা। সকল ধরনের অন্যায়-অত্যাচার আর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ‘নিউ রাইনিশ সাইটুঙ’ আগুন ছড়াতে থাকে। অবিলম্বে সরকারি দমননীতির শিকার হয় এই পত্রিকা। মার্কসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়, তবে তিনি আদালতের বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হন।
সরকারের দমননীতির ফলে ‘নিউ রাইনিশ সাইটুঙ’ ১৮৪৯ সালের ১৯ মে বন্ধ হয়ে যায়। ১৩ জুন প্যারিসে এক বিক্ষোভ-মিছিল হয়। এর কয়েক সপ্তাহ পরে ফরাশি সরকার মার্কসকে দুটো প্রস্তাব দেন : হয় তাঁকে কারাবরণ, নয়তো ফরাশিদেশ ছাড়তে হবে। তিনি প্যারিস থেকে চলে যাওয়াই সমীচীন মনে করেন এবং চিরদিনের জন্য চলে যান লন্ডনে। এর আগে তাঁকে বহিষ্কার করা হয় একবার ১৮৪৫ সালে প্যারিস থেকে, ১৮৪৮ সালে ব্রাসেল্স্ থেকে এবং ১৮৪৯-এর মে মাসে কলোন থেকে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও লন্ডনেই জীবনের শেষ ৩৪ বছর কাটান মার্কস।
লন্ডনে গিয়ে মার্কস সীমাহীন দারিদ্র্যের মুখোমুখি হন। যেখানে সপরিবারে থাকতেন, সেই ছোটো ফ্লাটটির ভাড়া পরিশোধ করার সঙ্গতিও তাঁর ছিলো না। জেনি মার্কসের ভাষায়, একদিন ‘আদালতের দুই কর্মচারি এসে আমাদের সমস্ত সম্পত্তি-খাট, কাপড়-চোপড়,—সবকিছু, এমন কি আমার ছোটো বাচ্চার (পুত্র গুইডোর) খাট, মেয়েদের ভালো খেলনাগুলো ক্রোক করলো। আমার কন্যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু কাঁদছিলো…।
‘পরদিন আমাদের ফ্লাট ছেড়ে দিতে হলো। শীত আর বৃষ্টিবাদলার মধ্যে আমার স্বামী আমাদের জন্য ঘরের খোঁজ করলেন। কিন্তু চার ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের কেউ ঘর ভাড়া দেয় না। শেষটায় আমাদের এক বন্ধুর সাহায্য পাওয়া গেলো। বাড়িভাড়া শোধ করলাম। সম্পত্তি ক্রোক হতে দেখে অন্যান্য পাওনাদার—ওষুধের দোকানদার, রুটিঅলা, মাংশঅলা আর গোয়ালা বিল নিয়ে এসে হাজির। তাদের পাওনা মেটাতে আমি আমাদের শোবার সবগুলো খাট বেচে দিই।’
এই রকম সীমাহীন অভাবের মধ্যে মার্কসের এক বছর বয়স্ক ছেলে গুইডোর ১৮৫০ সালের নভেম্বরে এবং এক বছর বয়েসী মেয়ে ফ্রান্সিসকো ১৯৫২ সালে মারা যায়। তারা যে শুধু বিনা চিকিৎসায় মারা যায় তাই নয়, মেয়েটির লাশ দাফনের সঙ্গতিও তখন তাঁর ছিলো না। পরে অন্যের অর্থসাহায্যে ফ্রাৎসিকোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কিন্তু কোনো কিছুই মার্কসকে দমাতে পারে নি, শ্রমিকশ্রেণীর কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি ছিলেন দৃঢ়সঙ্কল্প। এই সময় এঙ্গেলস থাকতেন ম্যানচেস্টার-এ। তবে মাঝেমধ্যে লন্ডনেও আসতেন।
১৮৫১ সালের ডিসেম্বরে ফরাশিদেশে লুই বোনাপার্ট ক্ষমতা দখল করেন। মার্কস তাঁর সম্পর্কে রচনা করেন একটি গ্রন্থ। ‘লুই বোনাপার্টের আঠারই ব্রুমেয়ার’। ১৮৫৩ সালে বেরোয় তাঁর আর একটি গ্রন্থ, শিরোনাম ‘কলোনে কমিউনিস্টদের বিচারের ব্যাপারে তথ্য উদ্ঘাটন’। এঙ্গেল্স লিখেছেন, ‘কলোনে কমিউনিস্ট লীগের সদস্যদের শাস্তি হয়ে যাবার পর মার্কস রাজনৈতিক আন্দোলনমূলক কাজ থেকে অবসর নিয়ে দশ বছর অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করেন এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকায় লিখতে থাকেন। তাঁর গবেষণার ব্যাপারে বৃটিশ মিউজিয়াম গ্রন্থাগার বিশেষ সহায়ক হয়েছিলো। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত নিউইয়র্ক ট্রিবিউনে তাঁর স্বাক্ষরিত লেখা প্রকাশিত হতো।’
১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির বিচার’ (ক্রিটিক অব পলিটিক্যাল ইকোনমি)। এতে ছিলো মার্কসীয় অর্থনীতির মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
মার্কস ছিলেন ঔপনিবেশিক ও পরাধীন দেশগুলোর স্বাধিকার আন্দোলনের অবিচল সমর্থক। ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্যস্বরূপ তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানও ছিলো অসামান্য। উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে তিনি লেখেন ‘ভারতে বৃটিশ মালিকানার ভবিষ্যৎ ফলাফল’ প্রবন্ধ। চীনের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও রয়েছে তাঁর অনেকগুলো প্রবন্ধ। মিয়ানমার, আফগানিস্তান, ইরান ও তুরস্কের উপনিবেশবাদী দখলদারদের কার্যকলাপও আলোচনা করেন মার্কস তাঁর বিভিন্ন রচনায়। প্রতিটি নিপীড়িত জাতির মুক্তি-আন্দোলনের প্রতি তাঁর ছিলো গভীর ও সংগ্রামী একাত্মতার অনুভূতি।
মার্কসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’-এর (পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ) প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় হামবুর্গ থেকে জার্মান ভাষায় ১৮৬৭ সালে। এ গ্রন্থে তাঁর সমাজবাদী অর্থনীতি চিন্তাধারার মৌলিক বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। এতে আরো আছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা, পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে মার্কসের বিশ্লেষণ। ‘পুঁজি’র শেষ ফর্মার প্রুফ দেখা শেষ করে ১৮৬৭ সালের ১৬ আগস্ট মার্কস এঙ্গেলসকে লেখেন, ‘অবশেষে এই খন্ড শেষ হলো। এটি যে সম্ভব হলো সে-জন্য আমি একমাত্র তোমার কাছে ঋণী।’
এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘যে-সময় এই গ্রন্থ লেখার কাজ চলছিলো, তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক-আন্দোলন খুবই জোরদার হয়ে ওঠে। তাতে মার্কসের এই প্রত্যয় জন্মালো যে, তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত একটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত করা সম্ভব। তাঁর সেই স্বপ্ন ছিলো ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে একটি শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলা, যে-সংগঠন আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কার্যকারিতা শ্রমিকদের নিজেদের কাছে এবং ধনিকশ্রেণী ও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর কাছে তুলে ধরতে। যে- আন্দোলনের লক্ষ্য—শ্রমজীবী শ্রেণীকে উৎসাহিত ও শক্তিশালী করা এবং পুঁজিবাদীদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা। তখন জারশাসিত রাশিয়া পোল্যান্ডের ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছিলো। তার প্রতিবাদে ১৮৬৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের সেন্ট মার্টিন হলে একটি আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমিতি’ গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। গঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি। নির্বাচিত হয় এর একটি নির্বাহী সাধারণ পরিষদ। এই সমিতির প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় লন্ডনে। মার্কস এর সাধারণ পরিষদ ও হেগ সম্মেলনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিশেবে কাজ করেছেন।’
‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড এঙ্গেল্স প্রকাশ করেন মার্কসের মৃত্যুর পর ১৮৮৫ সালে। তৃতীয় খণ্ডটিও তাঁরই সম্পাদনায় বেরোয় ১৮৯৪ সালে। মার্কসের
অসমাপ্ত গ্রন্থটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে এঙ্গেলসকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। অর্থাৎ ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড মার্কস ও এঙ্গেলসের যৌথ সৃষ্টি। ‘পুঁজি’র চতুর্থ খণ্ড প্রকাশের পরিকল্পনাও ছিলো এঙ্গেলসের, যেটিতে তিনি উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব’ আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ১৮৯৫ সালে তাঁর জীবনাবসান ঘটায় সেটা আর সম্ভব হয় নি।
‘পুঁজি’ রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করে। রাজনৈতিক-অর্থনীতির ক্ষেত্রে পালাবদল ঘটে মার্কসের হাতে। লেনিনের মতে, ‘পুঁজিবাদী সমাজের সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরের অনিবার্যতা মার্কস পুরোপুরি এবং বিশেষ করে টেনেছেন আধুনিক সমাজের গতির অর্থনৈতিক নিয়ম থেকে।’
‘পুঁজি’ মূলত অর্থনীতির গ্রন্থ হলেও এতে মার্কসের দার্শনিক চিন্তাধারা ও স্থান পেয়েছে। এটির দ্বিতীয় সংস্করণের উপসংহারে মার্কস তাঁর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি মূলগতভাবে যে হেগেলীয় পদ্ধতির চেয়ে স্বতন্ত্র তাই নয়, তার সম্পূর্ণ বিপরীত।’ অর্থাৎ মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তত্ত্ব এ গ্রন্থেই পাওয়া যাচ্ছে। লেনিন যথার্থই বলেছেন, ‘মার্কস যদি ‘যুক্তিবিদ্যা’ নাও রেখে যান, তিনি রেখে গেছেন ‘পুঁজি’র যুক্তি। ‘পুঁজি’তে প্রযুক্ত হয়েছে একই বিজ্ঞানের প্রতি যুক্তিবিদ্যা, দ্বন্দ্বতত্ত্ব এবং বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব (তিনটি শব্দের প্রয়োজন হয় না : তাদের অর্থ একই), যা হেগেলের মূল্যবান সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করে নিয়ে যাবতীয় মূল্যবান বস্তুকে সামনে এগিয়ে দিয়েছে।’
ছাত্রজীবনে মার্কস ছিলেন হেগেলপন্থী। তবে তিনি কেবল হেগেলের দর্শনের প্রগতিশীল ভাবধারার প্রভাবেই প্রভাবিত হন। তাই তাঁকে বলা হতো ‘বামপন্থী হেগেলবাদী’। ধীরে ধীরে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার পর তিনি হেগেলীয় দর্শনের ভাববাদী প্রভাব সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলেন। তারপর জার্মান বস্তুবাদী দার্শনিক লুডভিগ ফয়ারবাখের (১৮০৪-৭২) চিন্তাধারায় সিক্ত হন। ফয়ারবাখ ছিলেন বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। মার্কসের দার্শনিক চিন্তাধারায় তাঁর প্রভাব অসামান্য।
মার্কসের চিন্তাধারা—’মার্কসবাদ’–তার স্রষ্টার জীবদ্দশায়ই বিভিন্ন বিপ্লবী ও তাত্ত্বিকের হাতে পড়ে নানাভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লিষ্ট হতে থাকে। মূল মার্কসবাদ থেকে সরে যান অনেকেই। আর সেটা লক্ষ্য করেই মার্কস একদা পরিহাস করে বলেছিলেন : Well, I am not a Marxist’.
শুধু ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, গণিত, বিজ্ঞান নয়, কাব্য, নাটক, উপন্যাস প্রভৃতিরও মার্কস ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন শেক্সপিয়ার, এস্কাইলাস, গ্যোয়েটে এবং দিদেরো। বিচিত্র বিষয়ে মার্কসের অধিকার ছিলো অগাধ। তাঁর সেই পাণ্ডিত্যের সামান্য অংশই পাওয়া যায় তাঁর রচনাবলিতে। ‘পুঁজি’ সন্দেহাতীতভাবে একটি অসামান্য কীর্তি, তা সত্ত্বেও, পল লাফার্গের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘না ‘পুঁজি’, না তাঁর অন্য কোনো গ্রন্থ, কোনোটাই তাঁর মনীষার, তাঁর জ্ঞানের সমগ মহিমা তুলে ধরে না। ‘
লন্ডনের একটি সাধারণ গৃহে বাস করতেন মার্কস। এঙ্গেলসের বাসগৃহও ছিলো অদূরে—হেঁটে দশ মিনিটের পথ। প্রায় প্রত্যেক দিনই এঙ্গেলস মার্কসের বাসায় যেতেন। আরো বহু বিপ্লবী ও সমাজতন্ত্রীও ভিড় করতেন সেখানে। মার্কসের ঘরখানা ছিলো বই আর পত্রপত্রিকায় ঠাসা। তিনি কাউকে তাঁর অগোছালো বই আর কাগজপত্রে হাত দিতে দিতেন না। দুই বন্ধু সেই ঘরে দীর্ঘ সময় ধরে মানবজাতির অতীত ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা বিষয়ে আলোচনা করতেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের মতামতের প্রতি দিতেন খুবই গুরুত্ব। মার্কসের মৃত্যুর পর আরো বারো বছর জীবিত ছিলেন এঙ্গেল্স। এই সময় তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে মার্কসের অগোছালো পাণ্ডুলিপিগুলো সম্পাদনা করে নিখুঁতভাবে প্রকাশ করেন, মার্কস নিজে করলে যে-ভাবে করতেন ঠিক সে-ভাবেই।
ব্যক্তি-মার্কস ছিলেন খুবই বন্ধু আর সন্তানবৎসল। প্রচণ্ড অভাবের ভেতরেও তাঁর সংসারে শান্তি বিরাজ করতো। মার্কসের পত্নী জেনি মার্কস ছিলেন একজন যথার্থই মহীয়সী নারী। এঙ্গেলসের ভাষায়, ‘মধুর স্বভাবের মহিলা’। মার্কসের হস্তাক্ষর ছিলো দুর্বোধ্য। ছাপাখানায় পাণ্ডুলিপি পাঠানোর আগে জেনি সেগুলো নিজে পরিষ্কার করে কপি করে দিতেন। বস্তুত তিনি ছিলেন মার্কসের অবৈতনিক সেক্রেটারি। মার্কসের মেয়েরাও ছিলেন তাঁদের বাবা-মা উভয়ের মতোই সংগ্রামী জীবনের সম-অংশীদার। তাঁরা তিন বোনই ছিলেন সুশিক্ষিত। তাঁরা প্রত্যেকেই অনেকগুলো বিদেশী ভাষা জানতেন। মার্কসের জার্মান ভাষায় রচিত লেখা তাঁরা অন্য ভাষায় অনুবাদ করেছেন। তাঁরা কিছু কিছু উপার্জন করেও বাবার দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করতেন। জেনি করতেন গৃহশিক্ষকতা এবং এলেওনোরা করতেন ইস্কুলে শিক্ষকতা। শুধু তাই নয়, তাঁরা বাবার লেখালেখির কাজেও নানাভাবে সাহায্য করতেন। নাতি-নাতনিদের নিয়ে শেষ বয়সে মার্কস অভাবের মধ্যেও সুখেই ছিলেন।
যৌবনে হারিয়েছেন দুটি সন্তান, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছেও মার্কসকে আরো দুটি শোকের আঘাত সইতে হয়। ১৮৮১ সালে ২ ডিসেম্বর জেনি যকৃতের ক্যান্সারে মারা যান। মার্কস নিজে তখন ভুগছিলেন পুরুসিতে। অতিশয় দুর্বলতার জন্য মার্কস তাঁর স্ত্রীর শেষকৃত্যে যোগদান করতে পারেন নি। তারপর ১৮৮৩ সালের ১২ জানুয়ারি, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মার্কসের অত্যন্ত প্রিয় বড় মেয়ে জেনি মারা যান। এই শোকে একেবারে ভেঙে পড়েন মার্কস। তাঁর ফুসফুসের প্রদাহ আরো বেড়ে যায়। চিকিৎসকেরা তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দেন। ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ তিনি লন্ডনে শেষ-নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এঙ্গেলসের ভাষায়, ‘মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্য তাঁকে একা রেখে আমরা একটু দূরে গিয়েছিলাম। এসে দেখি তিনি ইজিচেয়ারে শান্তিতে ঘুমুচ্ছেন—তবে ঘুমিয়ে পড়েছেন চিরদিনের জন্য।’ ১৭ মার্চ তাঁর মরদেহ লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
মার্কসের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে এঙ্গেল্স তাঁর নিকটতম ও শ্রদ্ধেয় বন্ধু সম্পর্কে বলেন, ‘… তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রোশ আর নিন্দার পাত্র হয়েছেন মার্কস। স্বৈরাচারী ও প্রজাতন্ত্রী দু’ধরনের সরকারই তাদের রাষ্ট্র থেকে তাঁকে নির্বাসিত করেছে। রক্ষণশীল বা উগ্ৰ- গণতন্ত্রী সকলেই প্রতিযোগিতা করে তাঁর কুৎসা রটিয়েছে। ও-সব কিছুই তিনি মাকড়সার জালের মতো অবহেলা করেছেন, নিতান্ত প্রয়োজনে বাধ্য না হলে তিনি তাঁর কোনো আক্রমণের জবাব দিতেন না। তাই আজ সাইবেরিয়ার খনি অঞ্চল থেকে ক্যালিফোরনিয়া পর্যন্ত, ইউরোপ ও আমেরিকার সমস্ত এলাকায় বিপ্লবীদের ভালোবাসার মধ্যে, শ্রদ্ধার মধ্যে, তাঁদের শোকাভিভূত করে তাঁর মৃত্যু হলো। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, মার্কসের বহু বিরোধী থাকা সম্ভব, কিন্তু সম্ভবত তাঁর কোনো ব্যক্তিগত শত্ৰু নেই।’ এঙ্গেল্সের এই উচ্চারণে কোনো অতিশয়োক্তি ছিলো না।