কার্বন মিরাকল
বুকচাপা নীরবতা। সমস্ত হলঘর যেন বোবা… মন্ত্রবলে স্তব্ধ হয়ে গেছে সমস্ত তর্ক বিতর্কের ঝড়। অধীর উত্তেজনায় উশখুশ করছে সকলে। দপদপ করে আলোগুলো জ্বলছে আর নিবছে লেন্সের মধ্যে দিয়ে। চৌকো চৌকো ধাতব মাথাগুলো দুলছে অল্প অল্প করে।
প্রোব ৮৩১৪ থেকে জরুরি বার্তা এসেছে যে আমাদের গ্রহ অভিমুখে বিরাট অভিযানের তোড়জোড় শুরু করেছে পৃথিবীর মানুষ। ঘরের মধ্যে গমগম করে উঠল ঘোষকের আবেগবর্জিত কণ্ঠস্বর।
চকিতের মধ্যে কেমন যেন সাড়া পড়ে গেল উপস্থিত সকলের মধ্যে। সারি সারি সবাই বসে আছে অবিচল শৃঙ্খলায়। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার নিশ্চল হয়ে গেল সকলে৷ চোখের আলোগুলো আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। অথচ কোনও পরিবর্তন হল না ভাবলেশহীন মুখগুলোর।
অবশেষে সামনের সারির একজন নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল।
অবাক হবার কী আছে এতে? তিরিশ হাজার বছর আগেই তো সাবধান করে দিয়েছিলাম আমি।
কিন্তু সে তো কেবল সম্ভাবনার কথা। অগ্রগতির আরও অনেক সম্ভাবনার পথও তো খোলা ছিল তখন। গমগম করে উঠল বক্তার কণ্ঠস্বর।
কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ আবির্ভাবের আগে তো এটা একটা নেহাৎ সম্ভাবনাই ছিল। মানুষ আবির্ভাবের পরেই তো দেখা দিল যাবতীয় সমস্যা। মন্তব্য করল সামনের সারির আর একজন।
উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল আরও একজন উপদেষ্টা। যান্ত্রিকভাবে দ্রুত এগিয়ে গেল ডায়াসের দিকে। চিৎকার করে বলে উঠল, শুধু সম্ভাবনার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না মোটেই। আমরাই তো চেয়েছিলাম বায়োলজিক্যাল রোবট। আর তার ফলেই তো তৈরি হয়েছে পৃথিবীর মানুষ। এর জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমরা… হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরা।
উত্তেজিত হবেন না, শান্ত হন আপনারা। পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির উষা লগ্নে কে ভেবেছিল ওই দুর্বল, স্বল্পায়ু, ল্যাকপ্যাকে দেহগুলোর মধ্যে একে একে দেখা দেবে দুর্বার-শক্তি। যাদের জীবন কেবল কয়েকদিনের সমষ্টিমাত্র, তারাই কিনা বুদ্ধিমত্তায়–জ্ঞানের গভীরতায়–হারিয়ে দেবে আমাদের? এ শুধু অবিশ্বাস্যই নয়, মনে হয়–উন্মাদের প্রলাপ! চেয়ারম্যানের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়ের সুর।
এক্সপেরিমেন্টের শুরুতেই তো এমনটা ভাবা উচিত ছিল আমাদের। যারা দুর্বল, স্বল্পায়ু তাদের পক্ষেই তো সম্ভব এসব! ডায়াসের কাছে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে বলে উঠল সেই উপদেষ্টা।
এ তো প্যারাডক্স। কিন্তু প্যারাডক্সের তো কোনও স্থান নেই আমাদের বিজ্ঞানে। আমি তো কোনও লজিক খুঁজে পাচ্ছি না এর মধ্যে। দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠস্বর চেয়ারম্যানের।
লজিক নেই? এর চেয়ে, স্পষ্ট লজিক আর কী হতে পারে সেটা তো বুদ্ধিতে আসছে না আমার। ন্যাচারাল সিলেকসানের মাধ্যমেই ইভলিউশন চলেছে পৃথিবীতে। আর তার ফলেই আমাদের চেয়েও উৎকৃষ্ট নিখুঁত হয়ে উঠেছে মানুষের মস্তিষ্ক। এটাই তো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, যুক্তিগ্রাহ্য লজিক! উপদেষ্টার কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তার আভাস।
কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর আগেই তো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ন্যাচারাল সিলেকসানের মেকানিজম। কিন্তু তার পরেও কেন দ্রুত উন্নতি হচ্ছে পৃথিবীর ওই দুর্বল ক্ষীণ মানুষদের?
ধাতব গলায় হেসে উঠল উপদেষ্টা। অস্বস্তিতে ভরে উঠল সমস্ত হলঘর।
ভুলে যাচ্ছেন কেন চেয়ারম্যান-সাহেব, মানুষ তো অমর নয়, মানুষ যে মরণশীল। জীবন ওদের খুবই ছোট। তাই ওদের ব্যস্ততার সীমা নেই। তাড়াতাড়ি শেষ করতে চায় অনেক কিছু। আজ নয় কাল বলে দীর্ঘসূত্রতার কোনও অবকাশ নেই মানুষের জীবনে। আমাদের মতো একশো হাজার বছর পরে সমস্যার সমাধান খুঁজে বার করার বিলাসিতার সামান্যতম কোনও সুযোগ নেই পৃথিবীর মানুষদের। কারণ জীবন যে ওদের খুবই ছোট। আমাদের তুলনায় ওদের আয়ু যে একেবারে নগণ্য।
মানে… মানে আপনি কি আমাদের জীবনের মূল সূত্র সম্পর্কে কটাক্ষপাত করছেন। চেয়ারম্যানের কণ্ঠে ভেসে উঠল বিস্ময়ের চিহ্ন।
কটাক্ষপাত! একে কি আপনি কটাক্ষপাত বলেন? আমি শুধু যা ঘটেছে তাই বলার চেষ্টা করেছি মাত্র। সত্যি কথা বলা কি কটাক্ষপাত! গম্ভীর স্বরে বলে উঠল উপদেষ্টা।
চেয়ারম্যান কোনও কথা বলার আগেই গভীর ভরাট স্বরে বলে উঠল একজন একেবারে পেছন থেকে।
কটাক্ষপাত কেন বললেন চেয়ারম্যান-সাহেব? জীবনের মূল সূত্রগুলো সম্বন্ধে প্রশ্ন করা কি অন্যায়? শুধু কি মুখ বুজে মেনে চলতে হবে মূল সূত্রের কমা, সেমিকোলন আর ফুলস্টপ!
থমথমে হয়ে উঠল সমস্ত হলঘর। অচঞ্চল চোখের দীপশিখাগুলো নিষ্কম্প নিথর। বেশ কয়েক মুহূর্ত পরে বলে উঠলেন চেয়ারম্যান, কী… কী বলতে চাইছেন… আপনি… আপনারা?
বিশেষ কিছুই বলতে চাই না। শুধু পৃথিবীর মানুষের উপরে আমাদের তত্ত্বাবধানের ফলাফলগুলো জানাতে চাই সকলকে। বলতে চাই আসলে যা সেই ঘটনা।
কিন্তু আলোচ্য বিষয় থেকে সরে আসা কি উচিত হবে আমাদের। পালটা এক কুটনৈতিক চাল চাললেন চেয়ারম্যান।
না, না, আলোচ্য বিষয় থেকে মোটেই সরে যাচ্ছি না। আমরা… বরঞ্চ অঙ্গাঙ্গীভাবে এটাই জড়িয়ে আছে আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গে।
বলতে দিন। বলতে দিন চেয়ারম্যান সাহেব। বহু কণ্ঠের ধ্বনি একসঙ্গে।
বেশ–তাই হোক। তবে বেশি বিষয়ান্তরে যাবেন না কিন্তু…
এবার মাঝের সারি থেকে আর একটি ছোট রোবট এগিয়ে এল ডায়াসের কাছে।
পৃথিবীর বুদ্ধিমান জীব মানুষের ওপর নজর রাখতে গিয়ে আশ্চর্য এক বিষয়ের কথা জানতে পেরেছি। জানতে পেরেছি যে মানুষরা তাদের গবেষণায় শুধুমাত্র লজিক-এর উপর নির্ভর করে না। আবিষ্কারের ক্ষেত্রে আর এক শক্তিশালী মাধ্যমের আশ্রয় নেয় ওরা, অর্থাৎ কোনও অঙ্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এই মাধ্যমের। মানুষের ভাষায় এটা ইনটিউশন বা সহজাত অনুভূতি।
আমি বলি কী, যে বন্ধ করে দেওয়া হোক পৃথিবীর উপর পরীক্ষানিরীক্ষা। বেশ জোর দিয়ে বলে উঠল চেয়ারম্যান।
এত সব খরচপত্রের কী হবে তাহলে? প্রশ্ন করে উঠল আর একজন।
রাইট অফ করে দেব সব!
আমাদের স্যাটেলাইট, বেস আর স্পেশালি ট্রেন্ড ফোর্স-এর কী হবে?
অন্য কাজে লাগাতে হবে। নয় তো খুলে ফেলতে হবে।
তাহলে কী হবে পৃথিবীর মানুষদের?
যা অবশ্যম্ভাবী তাই হবে। আমাদের অভাবে কিছু দিনের মধ্যেই ভেঙে পড়বে মানুষদের ওই দুর্ভেদ্য সভ্যতা।
ভুল, ভুল, ভুল। পৃথিবী সম্বন্ধে সব লজিকই ভুল আপনাদের। বিশদভাবে বুঝিয়ে বলার সময় নেই এখন। তবে ওরা এতই এগিয়ে গেছে যে আমাদের মতো রোবট তৈরি করে ফেলেছে।
সে কী! আমাদের মতো… মানে আমাদের তৈরি করতে শুরু করেছে?
শুধু কি তাই? আমরা যে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে মড়কের সৃষ্টি করতাম, তাও অচল এখন। সব রকমের প্রতিষেধক করায়ত্ত ওদের। বার্ধক্য আর মৃত্যুকে জয় করার চেষ্টা চলছে অবিরত। গাছের কলম করার মতো মানুষের ক্লোনিং–এখন অতি সহজ ওদের কাছে। টেস্ট টিউব বেবি, ল্যাবরেটরি বেবি এখন আর নতুন নয় মোটেই। ক্রোমোজোম এর জিন পালটে এক নতুন মানব সভ্যতার জন্ম দিতে এগিয়ে চলেছে। রিমোট কন্টোল আর রোবট দিয়ে মহাকাশের দুরদুরান্তে গ্রহের সম্পদ আহরণে উদ্যত পৃথিবীর মানুষ। আমাদের গ্রহেও অভিযান শুরু করবে খুব শীগগীরই।
এ যে অবাস্তব! অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! সারা হল জুড়ে ধাতব কণ্ঠের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে গুমোট করে তুলল ঘরের বাতাস।
কিন্তু, এ সব হল কেমন করে? প্রশ্ন করল ছোট রোবট।
কে উত্তর দেবে প্রশ্নের? সকলেই নির্বাক, নিশ্চুপ। এই অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই।
বুক চাপা নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে প্রশ্ন করে উঠল একজন, তবে কে সৃষ্টি করেছে আমাদের। কারা আমাদের সৃষ্টিকর্তা?
উত্তেজনার ঝড় উঠল ঘরের মধ্যে। মুহূর্তে মুহূর্তে দারুণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠছে প্রত্যেকেই। নিষিদ্ধ… সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এ সব প্রশ্ন। এই প্রশ্নের আলোচনার অর্থই হল আইনবিরোধী কাজ করা–অমান্য করা দেশের আইনকে।
তীব্র লাল আলো জ্বলে উঠল চেয়ারম্যানের চোখে। বিপদসূচক নিশানা। কিন্তু এবার আর বাধা মানল না রোবট। ধীর পদক্ষেপে ছোট রোবট এগিয়ে গেল ডায়াসের উপর। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে দু-চোখের আলো। চ্যালেঞ্জের নিশানা জ্বালিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছোট রোবট। ওর দেখাদেখি আরও কয়েকজন যুবক রোবট চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
আর বাধা দেবেন না চেয়ারম্যান সাহেব। কোনও শাসনই আজ মানব না আমরা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা জানি যে আজকের আলোচ্য বিষয় নয় এটা। কিন্তু জাতির এই চরম মুহূর্তে শুধু আইন মেনে সর্বনাশের বোঝা মাথায় নেওয়ার কোনও যুক্তি নেই আর। ছোটখাটো সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে আমাদের মানতে হবে আসল সত্যি।
ঠিক আছে। তাহলে এই কাউন্সিলই বিচার করুক সব প্রশ্নের। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিরুপায় হয়ে প্রস্তাব করল চেয়ারম্যান।
শ্ৰোতৃমণ্ডলীর চোখে জ্বলে উঠল সবুজ আলো। সম্মতির চিহ্ন।
যুবক রোবটের দল উঠে পড়ল ডায়াসের উপর। উত্তেজনায় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে প্রত্যেকের চোখের আলো।
পৃথিবীতে প্রাণের সূত্রপাত ঘটিয়েছি আমরা। আমাদেরই বুদ্ধির জোরে মানুষের উদ্ভব হয়েছে পৃথিবীর বুকে। মানুষ আবার রোবট তৈরি করতেও শিখেছে। সব কিছুরই শুরু বা আরম্ভ আছে জগতে। আছে সূত্রপাত। আর তার মানেই হল আমাদেরও আছে কোনও সৃষ্টিকর্তা। কে সেই সৃষ্টিকর্তা?
আমরা… আমরা তো আদি অনন্ত কাল ধরে আছি এখানে। বক্তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠল চেয়ারম্যান।
এমনকী এই গ্রহসৃষ্টির আগেও! বিদ্রূপ করে উঠল এক যুবক রোবট।
এর অর্থ হল যেমন করেই হোক জন্ম হয়েছে আমাদের। রহস্যের গভীরে ঢাকা রয়েছে আমাদের সৃষ্টি-রহস্য। কিন্তু কেমন করে? আমরাই কি আমাদের সৃষ্টিকর্তা! আপনা থেকে মিলেমিশে কি অ্যাটম আর মলিকিউল তৈরি করতে পারে রেডিয়ো, ট্রানজিস্টার, ফোটোসেল। না, না, নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে এর মধ্যে!
এ আলোচনার কি শেষ আছে? কে জবাব দেবে তোমাদের প্রশ্নের? বরং আরও হতাশা আসবে এসব আলোচনায়। চেয়ারম্যানের কণ্ঠে নিস্তেজ ভাব।
তাই যদি হয় তবে বন্ধ করা হোক এক্সপেরিমেন্ট। বন্ধ হোক পৃথিবীর উপর পরীক্ষানিরীক্ষা। পেছন থেকে বলে উঠল অন্য একজন।
বেশ, ভোট নেওয়া হোক তাহলে। প্রস্তাব করল চেয়ারম্যান।
না, না, এক্সপেরিমেন্ট থামানো হবে না কোনমতেই। কয়েকজন বলে উঠল সামনের সারি থেকে।
কেন? কেন বন্ধ হবে না?
কারণ… কারণ অতি সহজ। এই এক্সপেরিমেন্ট আমরা পরিচালনা করছি না।
এ কথার অর্থ কী? নির্বোধের মতো কথা বলার কোনও মানেই হয়। বুঝিয়ে বলুন কী বলতে চাইছেন আপনি?
হলঘরের একবারে শেষ সারি থেকে উঠে দাঁড়াল বিশাল কুচকুচে কালো এক রোবট। বিশাল দেহের চারপাশের মরচে পড়ে মসৃণতা নষ্ট হয়ে গেছে। মহাকালের ছাপ সর্বাঙ্গে। অতি প্রাচীন বৃদ্ধ সেই রোবট ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এল ডায়াসের সামনে। গ্রহের প্রাচীনতম রোবট নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল চেয়ারম্যানের পাশে। আয়তাকার প্রকাণ্ড মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিল চারপাশে। উদগ্র বিস্ময়ে সকলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী যেন বলতে গিয়ে চুপ করে গেল চেয়ারম্যান।
আমিই বলেছি কথাগুলো। সমবেত সুধীমণ্ডলী, আপনাদের মনের মতো কথা বলতে পারব না বলে খুবই দুঃখিত। কিন্তু সত্য তো চিরকালই সত্য। আর সত্যকে মানার মতো সাহসই তো আমাদের একমাত্র সম্বল। আমরা তো আমাদের আলোচ্য পৃথিবীর মানুষের মতো বায়োলজিক্যাল ইমপাস দিয়ে গড়া নই। তাই কষ্টকর হলেও সত্যকে মানার সাহস নিশ্চয় আছে আমাদের।
এত ভণিতার প্রয়োজন কী? যা বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। আদেশের সুরে বলে উঠল চেয়ারম্যান।
পরিষ্কার করেই তো বলতে চাইছি চেয়ারম্যান সাহেব। তবে নির্মম সত্য বলার আগে একটু প্রস্তুত করে নিচ্ছিলাম আমার শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে। বেশ, শুনুন তবে। আপনারা নিশ্চয় জানেন যে প্রাণধারণের উপযোগী হবার সঙ্গে সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে বায়োলজিক্যাল এমব্রায়ো বা জৈব ভ্রূণ নিয়ে গেছিলাম আমরা পৃথিবীর বুকে। নিষ্প্রাণ কুমারী গ্রহে জীবনের সন্ধান জাগানোই ছিল আমাদের এক্সপেরিমেন্টের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু পৃথিবীতে চাষ করার হাজার দশেক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায় জৈব ভ্রূণগুলো। সামান্য একটি প্রাণকেও বাঁচাতে পারিনি আমরা।
না, না… এ কী অসম্ভব কথা! এক সঙ্গে চিৎকার করে উঠল অনেকে। বিচিত্র হাসির আভাসও ফুটল না দৈত্যাকার বৃদ্ধ রোবটের মুখে। ভাবলেশহীন মুখে মৃদু-মৃদু মাথা দোলাল মরচে পড়া রোবট। কেমন যেন ঝিকমিক করে উঠল চোখের আলো।
উত্তেজিত হয়ে সত্যকে অস্বীকার করা যায় না বন্ধুগণ। আমি যা বললাম তা একান্তই সত্য। আমার ওপরেই ভার ছিল জৈব ভ্রূণ চাষ এবং রক্ষণাবেক্ষণের। এ সম্বন্ধে আমার গোপন রিপোর্ট রয়েছে ন্যাশানাল আর্কাইভস ফর কালটিভেসন অফ বায়োলজিক্যাল সিভস-এ। শুধু কি তাই? মৃত জ্বণের বেশ কিছু স্যাম্পেলও সুরক্ষিত আছে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। খুব ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল বৃদ্ধ রোবট।
প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ ঘটল যেন হলঘরের মধ্যে। বিস্ময়ের আঘাতে স্তব্ধ হয়ে গেল সমস্ত গুঞ্জন।
তাহলে প্রাণের সৃষ্টি হল কী করে পৃথিবীতে। মানুষের উৎপত্তিই বা হল কী করে? অসহায়ের মতো প্রশ্ন করল চেয়ারম্যান।
সঠিক করে কিছু বলতে পারব না। তবে আমাদের ব্যর্থতায় মজা পেয়ে হয়তো বা অন্য কোনও উন্নত সভ্যতা জৈব ভ্রূণ বপন করেছিল পৃথিবীতে। এ সম্বন্ধে কিছু নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছিলাম তখন। হঠাৎ একদিন জলে স্থলে দেখা দিল প্রাণের প্রথম স্পন্দন। অবাক হয়েছিলাম আমি। আবার হয়তো বা কার্বন অণুর বিচিত্র লীলায় কোনও এক শুভ মুহূর্তে প্রাণ-কণিকার আবির্ভাব ঘটেছিল পৃথিবীর জলরাশির মধ্যে। কারণ জৈব জীবাণু তো মহাশূন্যে মেঘের আকারে ভেসে বেড়ায় যত্রতত্র। কালক্রমে প্রাকৃতিক কারণে ইভলিউশনের নির্দিষ্ট ধারায় মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে পৃথিবীতে উর্বর জমিতে।
এত দিন… এত দিন বলেননি কেন আপনি? সত্য গোপন করতে বিন্দুমাত্র লজ্জা হল না আপনার। বেশ কিছু ক্রুদ্ধ করে আওয়াজ উঠল সামনের সারি থেকে।
সত্য যে গোপন আমরা করতে পারি না, তা তো ভালো করেই জানেন আপনারা। তবে জাতীয় স্বার্থেই জনসাধারণের কাছে বলা হয়নি এতদিন। এক্সপেরিমেন্টের ওপর নির্ভর করেই এগিয়ে চলেছে আমাদের সভ্যতা। ভুলে যাবেন না, আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে গ্রহে গ্রহে জৈব প্রাণচাষের এক্সপেরিমেন্ট করা। এর উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। আমাদের রোবটিয় সাহিত্য সভ্যতা সংস্কৃতি।
মহাশূন্যের নীরবতা নেমে এল হলঘরের মধ্যে। মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল রোবট শ্রোতৃবৃন্দ। কঠিন সত্যকে জানার কষ্ট তো কম নয়। মনোভাবের আদান প্রদান হল শুধু দপদপানি-ভরা চোখের আলোয়। এক এক করে মুহূর্তগুলো খসে পড়ল মহাকালের বুকে।
অবশেষে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল সেই বিদ্রোহী যুবক রোবট।
আর কোনও রহস্য নেই। জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল সব। লজিক লজিকই, এর ব্যতিক্রম নেই কোনওখানে। স্বয়ং সৃষ্ট নই আমরা। এক্সপেরিমেন্টের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের। আমাদের নিয়েই এক্সপেরিমেন্ট করছেন আমাদের সৃষ্টিকর্তা। হয়তো বা দুর্বল ক্ষীণজীবি স্বল্পায়ু ওই পৃথিবীর মতো জৈব কোনও প্রাণ।
[প্রথম প্রকাশ: ফ্যানটাসটিক, বার্ষিকী ১৯৮২]