1 of 2

কার্তিক-পুজোর ভূত – হেমেন্দ্র কুমার রায়

কার্তিক-পুজোর ভূত – হেমেন্দ্র কুমার রায়

নতুন মেস-বাড়ি। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে এখনও ব্যবসাদারির গন্ধ বিকটভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি। এখনও মাছের ঝোলে কেবল আঁশ বা কাঁটার বদলে সত্যিকার মৎস্য পাওয়া যায়, এখনও ডাল বলতে বোঝায় না কেবল ঘোলাটে জল এবং এখনও আলুর দম বা কালিয়ায় তৈলের ব্যবস্থা হয়নি ঘৃতাভাবে।

তেতলায় পাশাপাশি তিনখানা ঘর ভাড়া নিয়ে তিন বন্ধুতে দিব্য আরামে হাত-পা ছড়িয়ে বাস করছিল। তিন বন্ধু—অর্থাৎ অটল, পটল ও নকুলের কথা বলছি। কিন্তু একটু গোলমাল বাধল। চাঁদের আলো এবং ফুলের গন্ধের মতন মানুষের সুখ—শান্তিও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। ভগবানের সৃষ্টির এই সব অসংগতি ও অপূর্ণতা নিয়ে অটল, পটল ও নকুল একসঙ্গে বিলক্ষণ মাথা ঘামিয়েছে, কিন্তু সংগত কারণ খুঁজে পায়নি।—ব্যাপারটা এই।

সেদিন সকালবেলায় মেসের কর্তার ঘরে বসে অটল, পটল ও নকুল চা—পান ও হালুয়া ভক্ষণ করছে, এমন সময় একটি নতুন লোকের আবির্ভাব।

লোকটির মাথায় বাবরি—কাটা চকচকে চুল, গোঁফটির দুই প্রান্ত সুচারুরূপে পাকানো, গায়ের পালতা ফিনফিনে পাঞ্জাবির তলা থেকে রাঙা গেঞ্জির রং ফুটে বেরুচ্ছে, পায়েও রঙিন মোজা ও বাহারি জুতো। কিন্তু বেচারার শৌখিনতা প্রকাশের এত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে একটিমাত্র কারণে। তার ডান চোখটি কাণা!

কিন্তু তার সেই একটিমাত্র চক্ষু যেমন তীক্ষ্ন, তেমনি চটুল ও চটপটে। ঘরে ঢুকেই বোধ হয় আধ—সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে বিরাজমান চার মূর্তির আপাদমস্তক সে ভালো করে দেখে নিলে।

মেসের কর্তা শুধোলেন, ‘মশাই কি চান?’

—’আমার নাম ননীনাথ নাগ। এই মেসে বাসা বাঁধতে চাই। এখানে আগেও একবার বাসা বেঁধেছিলুম।’

—’তা কী করে হবে? আমার এ—মেসের জন্ম হয়েছে মোটে একমাস।’

—’তা হতে পারে। কিন্তু এখানে আগেও একটি মেস ছিল, তার মৃত্যু হয়েছে তিন বৎসর।’

—’ও, বটে বটে? এ—খবরটা আমি জানতুম না।’

—’মশাই তাহলে নতুন মালিক? বেশ, বেশ! বলি, এখানে একখানা ঘর—টর খালি পাওয়া যাবে?’

—’দোতলার সব ঘর ভরতি। তেতলার একখানা ঘর খালি আছে—’

ননী একেবারে আঁতকে উঠে একটিমাত্র চক্ষুকে দুইগুণ বাড়িয়ে তুলে বললে, ‘ওরে বাপরে, তেতলায়? অসম্ভব!’

—’অসম্ভব? কি অসম্ভব?’

—’তেতলায় থাকা।’

—’কেন?’

—’আগে এখানকার তেতলায় কেউ থাকত না। অর্থাৎ থাকতে চাইত না।’

—’কেন?’

—’আগে তেতলায় ওঠবার সিঁড়ির দরজায় লাগানো থাকত তালা—চাবি।’

—’কেন মশাই, কেন?’

—’আগে সন্ধের পর কেউ এখানে তেতলার নাম পর্যন্ত মুখে আনত না।’

—’আরে মশাই,—কেন, কেন কেন? নিজের মনে খালি বকবকই করে যাচ্ছেন, আসল কথা বলবার নাম নেই!’

ননী মালিকের মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে একটিমাত্র চক্ষু মুদে বললে, ‘নিতান্তই শুনবেন তাহলে?’

—’নিশ্চয় শুনব। আলবত শুনব! না শুনে আপনাকে ছাড়ব না। এমন খাসা তেতলার চারিদিক—খোলা ঘর, কেন এখানে কেউ থাকত না?’

ননী কণ্ঠস্বর নামিয়ে, অদ্বিতীয় চক্ষুটিকে প্রাণপণে বিস্ফারিত করে বললে, ‘আজ্ঞে, তেতলায় যে একজন আছেন!’

অটল চায়ের পেয়ালা নামিয়ে এতক্ষণ পর বললে, ‘একজন আছেন মানে?’

পটল বললে, ‘কে বলে একজন? আমরা হচ্ছি তিনজন।’

ননী হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘ভালো কাজ করেননি।’

মালিক খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘এসব কথার মানে? আপনি কি আমার মেসের লোক ভাঙাতে এসেছেন?’

—’তাতে আমার লাভ?’

—’তবে এত বাজে বকছেন কেন?’

—’বেশ মশাই, আমি আর কিছু বলতে চাই না। একতলার কোনো ঘর যদি খালি থাকে তো বলুন। না থাকে, পোঁটলা—পুঁটলি নিয়ে ধুলো—পায়েই প্রস্থান করব।’

—’একতলার তিনখানা ঘর খালি আছে, আপনি যেখানা খুশি নিতে পারেন।’

অটল বললে, ‘কিন্তু মহাশয়, আপনি আমাদের কৌতূহল জাগ্রত করেছেন। আমাদের কৌতূহল আবার যতক্ষণ না নিদ্রিত হয়, ততক্ষণ আপনাকে এইখানেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে।’

পটল বললে, ‘তেতলা আপাতত আমাদের অধিকারে। সুতরাং আসল কথা জানবার অধিকার আমাদের আছে।’

নকুল মাথা নাড়তে নাড়তে বললে, ‘তেতলায় একজন আছেন মানে কী?’

ননী একখানা ‘মোড়া’ টেনে নিয়ে বসে পড়ে নাচার ভাবে বললে, ‘তবে সব কথাই শুনুন মশাই। এর মেস—বাড়ির তেতলায় বাস করেন গদাধর গাঙ্গুলী।’

মালিক বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি কি পাগল?’

অটলও বিস্মিত কণ্ঠে বললে, ‘গদাধর গাঙ্গুলী! তিনি থাকেন তেতলায়, অথচ আমরা কেউ জানি না। আমাদের তিন—জোড়া চোখ কি অন্ধ?’

ননী বললে, ‘লক্ষজোড়া চর্মচক্ষু থাকলেও গদাধর গাঙ্গুলীকে দেখা যায় না। তিনি অশরীরী।’

পটল ও নকুল চমকে উঠে বললে, ‘কী বললেন?’

—’তিনি অশরীরী। আহা, একদা তিনিও শরীরী ছিলেন। তিন বছর আগে আমি যখন এই মেসে ছিলুম, তার কিছু আগেই তিনি শরীর ত্যাগ করেছেন।’

অটল, পটল ও নকুলের দেহ রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

মালিক হতভম্বের মতো কেবল বললেন, ‘মানে?’

ননী বললে, ‘মানে হচ্ছে এই। আমি এই মেসে আসবার কিছুকাল আগে তেতলার একটি ঘরে দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে গদাধর গাঙ্গুলী নামে একটি ভদ্রলোক আফিম খেয়ে দেহত্যাগ করেছিলেন।’

মালিক বললেন, ‘এতক্ষণ পরে তবু কিছু হদিস পাওয়া গেল। তারপর?’

—’তারপর কিন্তু দেহত্যাগ করেও গদাধরবাবু এই মেসের তেতলার ঘরের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। অনেকেই তাঁকে তেতলার ছাদে বেড়িয়ে বেড়াতে দেখেছে—এমনকী তাঁর শখের গান গাইতেও শুনেছে।’

—’শখের গান?’

—’আজ্ঞে হ্যাঁ। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমিও দোতলা থেকে তাঁর শখের গানটি শুনেছি।’

—’সেই শখের গানটি কী?’

ননী সুরে বললে—

 ‘বাজে তালি, বাজে ধামা।

 ওরে যদু! আরে মধু!

 শোন গাই সা—রে—গা—মা!

 ধেড়ে—কেটে, তেড়ে—কেটে—লেগে যায় তাক!

 মোর গীতে ভেঙে যায় দুনিয়ার জাঁক!

 দীপকের তা—না—না—না,

 শুনে যাও মামী—মামা!

 গিটকিরি শুনে ডেকে ওড়ে কাক—চিল,

 উৎসাহে নিধু মারে যাকে—তাকে কিল!

 ছোটে গাধা, ছোটে ধোপা,

 ছোটে খোকা দিয়ে হামা।’

মালিক অভিভূতের মতন বললেন, ‘আহা, কী গান! শুনলে অশ্রুবর্ষণ করা অনিবার্য।’

অটল করুণভাবে বললে, ‘নিশ্চয়। আমারও পাষণ্ড চক্ষু সজল হবার চেষ্টা করছে। কারণ আমি ওই তেতলাতেই থাকি।’

পটল সায় দিয়ে বললে, ‘আমারও ওই অবস্থা—যদিও এখনও গদাধরবাবুর নিজের মুখের গান শোনবার সৌভাগ্য হয়নি।’

নকুল ম্রিয়মাণ ভাবে বললে, ‘বোধ হয় তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, আমরা রাত দশটা বাজবার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি।’

ননী বললে, ‘ঠিক আন্দাজ করেছেন! যাঁরা পৃথিবীর দেহত্যাগ করেও পৃথিবীতে বাস করেন, রাত বারোটা বাজবার আগে তাঁদের দেখা পাওয়া অসম্ভব।’

অটল বললে, ‘তাঁদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আমি কিছুমাত্র ব্যাকুল নই।’

ননী বললে, ‘ব্যাকুল না হতে পারেন, কিন্তু আমি শুনেছি গদাধরবাবু প্রতি বৎসরে একদিন পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে জোর করে আলাপ করবার চেষ্টা করেন। সেদিন নাকি ইচ্ছা করলেই সবাই তাঁকে দেখতে পায়।’

মালিক বললেন, ‘মানে?’

—’গঙ্গাধরবাবু প্রতি বৎসরে একরাত্রে তাঁর বাৎসরিক কর্তব্যপালন করতে আসেন।’

—’মানে?’

—’যে তারিখে তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন, প্রতি বৎসরে ঠিক সেই তারিখেই গদাধরবাবু আবার চর্মচক্ষুগোচর দেহ ধারণ করেন। আবার আফিম খান। আবার আর্তনাদ করেন এবং তারপর আবার মরেও মারা পড়েন।’

মালিক বললেন, ‘রাত বারোটার পরে?’

—’আজ্ঞে হ্যাঁ।’

—’রাত বারোটার পরে কলকাতার কোনো আফিমের দোকান খোলা থাকে না।’

—’মশাই, এসব হচ্ছে পরলোকের কথা। পরলোকে কোন দোকান কখন বন্ধ হয়, আমি তা কেমন করে বলব? ইহলোকের সমস্ত নখদর্পণে—কোন পাড়ায় ক—টা গাঁজা—আফিমের দোকান আছে তাও বলে দিতে পারি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরলোক সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।’

মালিক ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘এইসব গাঁজাখুরি গল্প বলে আপনি কি আমার মেসবাড়ির দরজা বন্ধ করতে এসেছেন?’

ননীও ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘গাঁজা? আমি ভদ্রলোক। গাঁজার দোকানের ঠিকানা জানি বটে, কিন্তু গাঁজা কাকে বলে জানি না। আমি এসেছি মেসের একখানি ঘর নিতে। একতলায় একখানি ঘর পেলেই আমি খুশি হব।’

মালিক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন। কিন্তু আপনাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি আগাম টাকা চাই।’

ননী বললে, ‘তাই নিন না। এ—বাড়ির তেতলার ঘর ছাড়া আর সব ঘরেই যেতে আমি প্রস্তুত। বিশেষ আজকের রাত্রে।’

মালিক বললেন, ‘আজকের রাত্রে? মানে?’

ননী বললে, ‘গদাধরবাবু মরদেহ ত্যাগ করে নাকি কার্তিক পুজোর রাত্রে। তিনি বাৎসরিক ব্রত পালন—অর্থাৎ আবার আফিম খেয়ে দেহত্যাগ করতে আসেন, ঠিক সেই রাত্রেই। এটা তাঁর কি খেয়াল জানি না, কিন্তু শুনেছি, কার্তিক—পুজোর রাত্রে তিনি আবার একবার দেহত্যাগ করবার অভিনয় না করে থাকতে পারেন না। অনেকটা সাপের খোলস ত্যাগের মতনই আর কি। চলুন মশাই, এসব বাজে কথা থাক। একতলায় আমাকে একখানা ঘর দেখিয়ে দিয়ে আসবেন চলুন।’

ননীকে নিয়ে মালিক প্রস্থান করলেন।

অটল কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শিস দিতে দিতে হঠাৎ থেমে বললে, ‘আজই কার্তিক—পুজো।’

পটল দুঃস্বপ্নাভিভূতের মতন বললে, ‘কিন্তু গদাধরবাবু যে কোন ঘরে দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে আফিম খেয়ে তাঁর বাৎসরিক ব্রত পালন করেন, সে কথা তো জিজ্ঞাসা করা হল না।’

অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে নকুল বললে, ‘জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই। যতটুকু শুনেছি, তাই—ই যথেষ্ট। আজ যদি সৌভাগ্যক্রমে গদাধরবাবুর সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলে কালকেই এ বাসাকে নমস্কার করে সরে পড়ব।’

অটল ও পটল একসঙ্গে দৃঢ়প্রতিজ্ঞের মতন বললে, ‘হ্যাঁ।’

সে—রাত্রে অটল, পটল ও নকুল এক—একখানা ঘরে একলা থাকা যুক্তিসংগত বা নিরাপদ বলে মনে করল না। পটল ও নকুল আপন আপন ঘর ত্যাগ করে অটলের বিছানায় ডান ও বাম পাশে নিজেদের বিছানা পেতে নিলে।

গদাধরবাবুকে বাধা দেবার জন্যে অটল ঘরের সমস্ত দরজা—জানালা ভালো করে বন্ধ করে দিতে লাগল।

পটল বললে, ‘অটল, ননীর কাহিনি বিশ্বাস করলে বলতে হয়, গদাধরবাবু হচ্ছেন সূক্ষ্মদেহধারী। সূক্ষ্মদেহের একটা মস্ত সুবিধা এই যে, ইট—কাঠ—পাথরও ভেদ করে আনাগোনা করা যায়।’

নকুল বললে, ‘পটল, স্তব্ধ হও। সাবধানের মার নেই।’

নিজের বিছানার উপর এসে বসে অটল বললে, ‘ঘড়িতে দেখছি রাত দশটা বাজে। ঘুমোবার সময় হল। কিন্তু আজ আমরা কি করব? ঘুমবো? না গদাধরের আগমন—প্রতীক্ষা করব?’

নকুল হাই তুলে বললে, ‘রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। মারাত্মক বললেও চলে।’

পটল লেপের ভিতর ঢুকতে—ঢুকতে বললে, ‘আমারও ওই মত। গদাধরবাবুর বাৎসরিক অভিনয় দেখবার ইচ্ছা আমার নেই। আমি ঘুমিয়ে তাঁকে ফাঁকি দিতে চাই।’

অটল বললে, ‘আমার বিশ্বাস, গদাধরবাবুর কথা হচ্ছে রীতিমতো উপকথা। উপদেবতার কথা মাত্রই উপকথা। সুতরাং অকারণে জেগে থেকে আত্মাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আলো নেবাও—ঘুমিয়ে পড়।’

মিনিট—পাঁচেক পরেই তিনটে তন্দ্রা—পুলকিত নাসা—যন্ত্রের প্রচণ্ড ঘড়র—ঘড়র—মন্ত্রে একান্ত সন্ত্রস্ত হয়ে দেওয়ালবাসী টিকটিকিরা পর্যন্ত ভেন্টিলেটারের ভিতর দিয়ে বাইরে পলায়ন করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তারা এতদিন একা অটলের নাসিকা—ধ্বনিকে কোনোক্রমে সহ্য করে ছিল। কিন্তু একসঙ্গে অটল—পটল—নকুলের তর্জনগর্জনময় নাসা—ভাসা! এ হচ্ছে দস্তুরমতো মেছোহাটার কোলাহল! যেকোনো জীবের পক্ষেই সহ্য করা অসম্ভব।

কার্তিক মাসের শেষ—তারিখের ভিজে হিমেল—হাওয়া। কনকন কনকন। পটলের ঘুম গেল ছুটে। ধড়মড় করে উঠে বসে সে বলে উঠল, ‘ওরে বাপ রে বাপ! কী ঠান্ডা!’

সবচেয়ে বেশি শীত—কাতুরে নকুল এর আগেই জেগে উঠেছিল। সে লেপের মাঝখানে ঢুকে গিয়ে ঘুম—জড়ানো স্বরে বললে, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমি এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরের উপরে আরোহণ করে আছাড় খেয়েছি।’

পটল বাক্যব্যয় করলে না। এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে শুলো।

অটল বললে, ‘বিস্মিত, হতভম্ব স্বরেই বললে, ‘কিন্তু হাওয়া আসে কোত্থেকে? আমি নিজের হাতেই সব জানালা বন্ধ করে দিয়েছি!’

নকুল একটিমাত্র চক্ষু উন্মোচন করে বললে, ‘সার্সিহীন পুরোনো জানলা, আলগা ছিটকিনি—হয়তো জোর—হাওয়া লাগলেই খুলে যায়।’

—’হতে পারে। কিন্তু এর আগে ওই উত্তুরে জানলাটা এমন অসময়ে আর কখনো খুলে যায়নি’—এমনি গজ গজ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে অটল সশব্দে আবার জানলাটা বন্ধ করে দিলে।

তারপর পুনর্বার ত্রিনাসিকা মুখর হয়ে উঠল—এবং খানিক পরে আবার ভালো করে ঘুমোতে না ঘুমোতেই ভেঙে গেল তাদের ঘুম। সেই ঠান্ডা হাড়—কাঁপানো বাতাস! উত্তরের জানলাটা আবার খুলে গিয়েছে।

অটল চিন্তিত ভাবে বললে, ‘ব্যাপারটা ভালো বলে বোধ হচ্ছে না।’

পটল বললে, ‘রীতিমত সন্দেহজনক! জানলার এমন ব্যবহারের কল্পনা করা যায় না।—নকুল, উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো তো?’

নকুল দৃঢ় কণ্ঠে বললে, ‘লেপের বাইরে যাবার ইচ্ছে আমার নেই।’

অটল বললে, ‘নকুল, তুমি দেখছি মহা কাপুরুষ! একটা জানলা বন্ধ করবার সাহসও তোমার নেই? রাবিস!’ সে শয্যাত্যাগ করবার উপক্রম করছে, এমন সময়ে গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল।

নকুল শীতার্ত কণ্ঠে বললে, ‘বারোটা!’

পটল ম্রিয়মাণ স্বরে বললে, ‘প্রেত—নগরের সিংহদ্বার এইবারে খুলে গেল।’

অটল জানলা বন্ধ করবার জন্যে আর শয্যাত্যাগ করবার চেষ্টা করলে না। ঝাঁ—ঝাঁ রাতে ডাকছে খালি ঝিঁঝিঁ পোকারা। শহরের আর সব শব্দই যেন ভয়ে চুপ মেরে গিয়েছে। কিন্তু নীরবতার বক্ষ ভেদ করে একটা সুর শোনা যাচ্ছে না?

সুরটা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল। কে যেন বাইরে ছাদের কোণ থেকে গুন—গুন করে গাইছে—

 ‘বাজে তালি, বাজে ধামা!

 ওরে যদু! আরে মধু!

 শোন গাই সা—রে—গা—মা।’

অটল আড়ষ্টভাবে বললে, ‘ইস, এ যে গদাধরবাবুর গান!’

পটল বললে, ‘নকুল, ভাই আমার! চটপট জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো তো।’

নকুল বললে, ‘পাগল! গদাধরবাবু এসে আমাকে টানাটানি করলেও আমি আর লেপের ভেতর থেকে বেরুব না।’

গান থামল। ছাদের উপরে শোনা গেল কার পায়ের শব্দ।

অটল ক্ষীণ স্বরে বললে, ‘আমার মনে হচ্ছে, গদাধরবাবু এই ঘরে এসেই আফিম খেতে চান।’

পটল আর নকুল একেবারে বোবা হয়ে গেল,—বোধ হয় তারা ভাবলে, বোবার শত্রু নেই।

পায়ের শব্দ থেমে গেল। খানিকক্ষণ সব নিঃসাড়। তারপরই একটা নতুনরকম ভয়াবহ শব্দ—ঠক, ঠক, ঠক! শব্দ হচ্ছে ঘরের ভিতরেই—পূর্বদিকে! এ যেন মাংসহীন অস্থিসার পায়ের শব্দ!

অটলের মাথার চুলগুলো তখন খাড়া হয়ে উঠেছে এবং দেহ হয়েছে অসম্ভব রকম রোমাঞ্চিত। তবু সে বালিশের তলা থেকে দেশলাই বার করে ফস করে একটা কাঠি না জ্বেলে থাকতে পারলে না।

ঘরের কোথাও কেউ নেই। পটল আর নকুল দুজনেই লেপের তলায় অদৃশ্য।

দেশলাইয়ের কাঠি নিবে গেল। তারপর আবার ঘরের ভিতরে শব্দ হল ঠক, ঠক, ঠক! ঠক ঠকাঠক, ঠকাঠক, ঠকাঠক!

শীতেও ঘর্মাক্ত কলেবর হয়ে অটল ভাবতে লাগল, অতঃপর কি করা উচিত?—হঠাৎ তার মনে পড়ল প্রেততত্ত্ববিদদের কথা। প্রেতেরা নাকি প্রায়ই শব্দের সাহায্যে মনের ভাব ব্যক্ত করে। গদাধরবাবুও কি শব্দ করে কোন কথা বলতে চাইছেন?

অত্যন্ত কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে অটল বললে, ‘এ—ঘরে যদি কেউ এসে থাকেন, তাহলে দয়া করে শুনুন। আমি প্রশ্ন করি, আপনি উত্তর দিন। আমার প্রশ্নের উত্তরে একবার শব্দ হলে বুঝব—’হ্যাঁ, আর দুবার শব্দ হলে বুঝব—’না’!

ঠক, ঠক, ঠক, ঠক, ঠক, ঠক!

—’মশাই’, অত—বেশি শব্দ করে ভয় দেখালে মারা পড়ব। শুনুন। আপনি কি গদাধরবাবু?’

একবার শব্দ হল—ঠক! অর্থাৎ—’হ্যাঁ’।

—’আপনি কি বেঁচে আছেন?’

দুবার শব্দ হলে—ঠক, ঠক! অর্থাৎ—’না’।

দুই হাতে চেপে নিজের হৃদকম্প থামাবার চেষ্টা করে অটল বললে, আপনি কি এখানে আফিম খেতে এসেছেন?’

—ঠক। ‘হ্যাঁ’।

—’আপনি কি আজ আফিম না খেয়ে থাকতে পারবেন না?’

—ঠক, ঠক। ‘না’।

—’আমরা এখানে থাকলে আপনি কি রাগ করবেন?’

—ঠক। ‘হ্যাঁ’।

—’আপনি নিশ্চয় আমাদের আক্রমণ করতে চান না?’

—ঠক। ‘হ্যাঁ’।

পরমুহূর্তেই অটলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাত—পা—ওয়ালা মস্ত একটা দেহ। অটল বিছানা থেকে ছিটকে মেঝেয় গিয়ে পড়ে হাঁউ—মাউ করে চেঁচিয়ে উঠল! এবং তার পরমুহূর্তেই পটল বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরে বাপরে, গদাধর আমার ঘাড়ে চেপেছে রে!’

তারপরেই দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা এবং সেই অবস্থাতেই অটল বেশ বুঝতে পারলে যে, পটল ও নকুল চ্যাঁচাতে—চ্যাঁচাতে দুমদাম শব্দে ছাদের উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, সেও তৎক্ষণাৎ গদাধরবাবুকে ফাঁকি দিয়ে শুয়ে শুয়েই সরীসৃপের মতন সড়াৎ করে দরজার কাছে সরে গেল, তারপর উঠেই বাইরের ছাদের দিকে মারলে এক লম্বা লাফ।

অটল, পটল আর নকুল হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলার বারান্দার উপর নেমে দেখলে, এত রাতে সাত—পাড়া কাঁপানো গোলমাল শুনে মেসের সমস্ত লোক এসে জড়ো হয়েছে। সকলেই ব্যস্ত কণ্ঠে একই জিজ্ঞাসা—ব্যাপার কী, ব্যাপার কী?’

বারান্দার উপরে তিনজোড়া পা ছড়িয়ে বসে পড়ে তিন—মূর্তি হাঁপাতে লাগল তিনটে হাপরের মতো। মেসের মালিক শুধোলেন, ‘ও অটলবাবু, কী হয়েছে বলুন না!’

অটল বাধো—বাধো গলায় বললে, ‘গদাধরবাবু আমার ওপরে লাফিয়ে পড়েছিলেন।’

পটল বললে, ‘না অটল। ভয়ের চোটে তোমার ওপরে ঝাঁপ খেয়েছিলুম আমিই। আর গদাধরবাবু লাফ মেরেছিলেন আমার পিঠের ওপরেই। আমার প্রতি তাঁর এই অন্যায় পক্ষপাতিতার মানে হয় না।’

নকুল বললে, ‘না পটল। পালাতে গিয়ে তোমার ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলুম আমিই। অন্ধকারে তুমি বুঝতে পারোনি।’

মালিক অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হা—হা করে হেসে বললেন, ‘এরই নাম রজ্জুতে সর্পভ্রম! গদাধরবাবু হচ্ছেন গাঁজাখুরি গল্পের নায়ক। যান মশাই, যে—যার ঘরে যান। মিথ্যেই আমাদের ঘুম ভাঙালেন।’

অটল প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বললে, ‘মাপ করতে হল মশাই! কে ঘরে যাবে? সেখানে গদাধরবাবু এতক্ষণে হয়তো আফিম গুলতে শুরু করেছেন।’

মালিক বিপুল বিস্ময়ে বললেন, ‘মানে?’

অটল বললে, ‘হতে পারে দুরাত্মা পটল নির্বোদের মতন আমার ওপরে ঝাঁপ খেয়েছিল, কিন্তু—’

পটল বললে, ‘হতে পারে কাপুরুষ নকুল ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমার ওপরে হোঁচট খেয়েছিল, কিন্তু—’

নকুল বললে, ‘কিন্তু আমাদের এই ভ্রমের দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, তেতলায় গদাধরবাবু নেই। কারণ আমরা সবাই স্বকর্ণে তাঁর মার্কা—মারা গান, তাঁর পায়ের শব্দ আর ঠক ঠক ভাষায় তাঁর কথা শুনেছি।’

মালিক মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘তাই তো, শুনেছেন নাকি?’

অটল বললে, ‘নিশ্চয়! শুনেছি বলেই তো ভয় পেয়েছি।’

মেসের আর কেউ ননীর গল্প শোনেনি। সকলের কণ্ঠে একই প্রশ্ন জাগল—গদাধরবাবু কে?

মালিকের ইচ্ছা নয় যে, গদাধরবাবুর কাহিনি আর কারোর কর্ণগোচর হয়। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘গদাধরবাবু হচ্ছেন আমার পিসেমশাই, তাঁকে নিয়ে আপনাকের কারোর মাথা ঘামাবার দরকার নেই। অটলবাবু, পটলবাবু, নকুলবাবু আপনারা আমার ঘরেই আসুন। পিসেমশাই এত রাত্রে আপনাদের ঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন বলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আফিমের মৌতাত মাথায় চড়লে পিসেমশাইয়ের আর কোনো জ্ঞান থাকে না,—আরে ছোঃ!’

সকালের আলো দেখে তাদের পলাতক সাহস আবার প্রত্যাগমন করলে। মেসের মালিককে নিয়ে অটল নিজের ঘরে এসে ঢুকল, পটল এবং নকুলও গেল নিজের ঘরে! বলাবাহুল্য, বাৎসরিক ব্রত পালন করে গদাধরও তখন অদৃশ্য হয়েছেন।

অটল কৌতূহলী ভাবে ঘরের এদিকে ওদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে, এমন সময় পটল ঝড়ের মতন ছুটে এসে বললে, ‘সর্বনাশ হয়েছে! আমার দরজার তালা ভাঙা! ট্রাঙ্কের তালা ভাঙা! আমার দশখানা দশ টাকার নোট চুরি গিয়েছে।’

তারপরে—প্রায় তার পিছনে—পিছনেই ছুটে এসে নকুলও সমাচার দিলে, তার বাক্সের ভিতর থেকে উধাও হয়েছে একশো পনেরো টাকা আট আনা।

অটল চমকে উঠে তাড়াতাড়ি বিছানার উপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার চাবির তোড়া থাকত মাথার বালিশের নীচে। বালিশ তুলে দেখা গেল, চাবি নেই—কিন্তু একখানা চিঠি আছে।

চিঠিখানা এই :

অটল—পটল—নকুলবাবু—

কাল সকালে গদাধর—কাহিনি বলে আমি বেশ একটি ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছিলুম—নয়? তারপর সেই আবহ রাত্রে ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল দুই—দুইবার খোলা জানালা দেখে,—কি বলেন?

কিন্তু একটু কম—ভীতু হলে আপনারা অনায়াসেই অনুমান করতে পারতেন যে, বাহির থেকে অনায়াসেই খড়খড়ির পাখি তুলে হাত দিয়ে ছিটকিনি সরিয়ে জানালা খোলা যায়।

এ—ঘরের ‘ভেন্টিলেটারে’র ছ্যাঁদা বড়ো হওয়াতে আমার ভারি সুবিধা হয়েছে।ওই পূর্বদিকের মাঝের জানালার উপরকার ‘ভেন্টিলেটারে’র ফাঁক দিয়ে ‘টোন’—সুতোর ডগায় একখণ্ড নুড়ি বেঁধে বাহির থেকে আমি ঘরের ভিতরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলুম, আর সুতোর অন্য প্রান্ত ছিল আমার হাতে। এই হচ্ছে ঠকঠক আওয়াজের গুপ্ত কারণ! বাহির থেকে কান পেতে আমিই সুতোয় টান মেরে অটলবাবুর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি।

গদাধরবাবুর গানটি এই অধীনেরই রচনা। ওটি কোনো মাসিকপত্রে ছাপিয়ে দিতে পারবেন?

আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আপনাদের তেতলা থেকে তাড়ানো। কেন, তা বলা বাহুল্য।

আর বোধ হয় মহাশয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না—বিদায়।

 ইতি—

 আপনাদের শ্রীননী

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *