কার্তিক পুজোর ভূত

কার্তিক পুজোর ভূত

নতুন মেসবাড়ি৷ খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে এখনও ব্যাবসাদারির গন্ধ বিকট ভাবে প্রকট হয়ে ওঠেনি৷ এখনও মাছের ঝোলে কেবল আঁশ বা কাঁটার বদলে সত্যিকার মৎস্য পাওয়া যায়, এখনও ডাল বলতে বোঝায় না কেবল ঘোলাটে জল এবং এখনও আলুর দম বা কালিয়ায় তৈলের ব্যবস্থা হয়নি ঘৃতাভাবে৷

তেতলায় পাশাপাশি তিনখানা ঘর ভাড়া নিয়ে তিন বন্ধুতে দিব্য আরামে হাত-পা ছড়িয়ে বাস করছিল৷ তিন বন্ধু-অর্থাৎ অটল, পটল ও নকুলের কথা বলছি৷ কিন্তু একটু গোলমাল বাধল৷ চাঁদের আলো এবং ফুলের গন্ধের মতন মানুষের সুখশান্তিও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না৷ ভগবানের সৃষ্টির এই সব অসংগতি ও অপূর্ণতা নিয়ে অটল, পটল ও নকুল একসঙ্গে বিলক্ষণ মাথা ঘামিয়েছে, কিন্তু সংগত কারণ খুঁজে পায়নি৷-ব্যাপারটা এই৷

সেদিন সকাল বেলায় মেসের কর্তার ঘরে বসে অটল, পটল ও নকুল চা পান ও হালুয়া ভক্ষণ করছে, এমন সময়ে একটি নতুন লোকের আবির্ভাব৷

লোকটির মাথায় বাবরি-কাটা চকচকে চুল, গোঁফটির দুই প্রান্ত সুচারুরূপে পাকানো, গায়ে পাতলা ফিনফিনে পাঞ্জাবির তলা থেকে রাঙা গেঞ্জির রং ফুটে বেরোচ্ছে, পায়েও রঙিন মোজা ও বাহারি জুতো৷ কিন্তু বেচারার শৌখিনতা প্রকাশের এত চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে একটিমাত্র কারণে! তার ডান চোখটি কানা!

কিন্তু তার সেই একটিমাত্র চক্ষু যেমন তীক্ষ্ণ তেমনই চটুল ও চটপটে৷ ঘরে ঢুকেই বোধ হয় আধ-সেকেন্ডের মধ্যেই সেখানে বিরাজমান চার মূর্তির আপাদমস্তক সে ভালো করে দেখে নিল৷

মেসের কর্তা শুধোলেন, ‘মশাই কী চান?’

‘আমার নাম ননিনাথ নাগ৷ এই মেসে বাসা বাঁধতে চাই৷ এখানে আগেও একবার বাসা বেঁধেছিলাম৷’

‘তা কী করে হবে? আমার এ-মেসের জন্ম হয়েছে মোটে একমাস৷’

‘তা হতে পারে৷ কিন্তু এখানে আগেও একটি মেস ছিল, তার মৃত্যু হয়েছে তিন বৎসর৷’

‘ও, বটে বটে? এ-খবরটা আমি জানতাম না৷’

‘মশাই তাহলে নতুন মালিক? বেশ, বেশ! বলি, এখানে একখানা ঘর-টর খালি পাওয়া যাবে?’

‘দোতালার সব ঘর ভরতি৷ তেতলায় একখানা ঘর খালি আছে-‘

ননি একেবার আঁতকে উঠে একটিমাত্র চক্ষুকে দুইগুণ বাড়িয়ে তুলে বলল, ‘ওরে বাপরে, তেতলায়? অসম্ভব!’

‘অসম্ভব? কী অসম্ভব?’

‘তেতলায় থাকা৷’

‘কেন?’

‘আগে এখানকার তেতলায় কেউ থাকত না৷ অর্থাৎ থাকতে চাইত না৷’

‘কেন?’

‘আগে তেতলায় ওঠবার সিঁড়ির দরজায় লাগানো থাকত তালা-চাবি৷’

‘কেন মশাই, কেন?’

‘আগে সন্ধের পর কেউ এখানে তেতলার নাম পর্যন্ত মুখে আনত না৷’

‘আরে মশাই-কেন, কেন, কেন? নিজের মনে খালি বকবকই করে যাচ্ছেন, আসল কথা বলবার নাম নেই!’

ননি মালিকের মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে এসে একটিমাত্র চক্ষু মুদে বলল, ‘নিতান্তই শুনবেন তাহলে?’

‘নিশ্চয় শুনব৷ আলবত শুনব! না শুনে আপনাকে ছাড়ব না৷ এমন খাসা তেতলার চারিদিক খোলা ঘর, কেন এখানে কেউ থাকত না?’

ননি কন্ঠস্বর নামিয়ে অদ্বিতীয় চক্ষুটিকে প্রাণপণে বিস্ফারিত করে বলল, ‘আজ্ঞে, তেতলায় যে একজন আছেন!’

অটল চায়ের পেয়ালা নামিয়ে এতক্ষণ পরে বলল, ‘একজন আছেন মানে?’

পটল বলল, ‘কে বলে একজন? আমরা হচ্ছি তিনজন!’

নকুল বলল, ‘হ্যাঁ, তিনখানা ঘরে আছি আমরা তিনজন৷’

ননি হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘ভালো কাজ করেননি৷’

মালিক খাপ্পা হয়ে বললেন, ‘এ-সব কথার মানে? আপনি কি আমার মেসের লোক ভাঙাতে এসেছেন?’

‘তাতে আমার লাভ?’

‘তবে এত বাজে বকছেন কেন?’

‘বেশ মশাই, আমি আর কিছু বলতে চাই না৷ একতলায় কোনো ঘর যদি খালি থাকে তো বলুন৷ না থাকে, পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে ধুলো-পায়েই প্রস্থান করব৷’

‘একতলার তিনখানা ঘর খালি আছে, আপনি যেখানা খুশি নিতে পারেন৷’

অটল বলল, ‘কিন্তু মহাশয়, আপনি আমাদের কৌতূহল জাগ্রত করেছেন৷ আমাদের কৌতূহল আবার যতক্ষণ না নিদ্রিত হয়, ততক্ষণ আপনাকে এইখানেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে৷’

পটল বলল, ‘তেতলা আপাতত আমাদের অধিকারে৷ সুতরাং আসল কথা জানবার অধিকার আমাদের আছে৷’

নকুল মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তেতলায় একজন আছেন মানে কী?’

ননি একখানা মোড়া টেনে নিয়ে বসে পড়ে নাচার ভাবে বলল, ‘তবে সব কথাই শুনুন মশাই৷ এই মেসবাড়ির তেতলায় বাস করেন গদাধর গাঙ্গুলি৷’

মালিক বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘আপনি কি পাগল?’

অটলও বিস্মিত কন্ঠে বলল, ‘গদাধর গাঙ্গুলি! তিনি থাকেন তেতলায়, অথচ আমরা কেউ জানি না! আমাদের তিনজোড়া চোখ কি অন্ধ?’

ননি বলল, ‘লক্ষজোড়া চর্মচক্ষু থাকলেও গদাধর গাঙ্গুলিকে দেখা যায় না৷ তিনি অশরীরী৷’

পটল ও নকুল চমকে উঠে বলল, ‘কী বললেন?’

‘তিনি অশরীরী৷ আহা, একদা তিনিও শরীরী ছিলেন৷ তিন বছর আগে আমি যখন এই মেসে ছিলাম, তার কিছু আগেই তিনি শরীর ত্যাগ করেছেন৷’

অটল, পটল ও নকুলের দেহ রীতিমতো রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল৷

মালিক হতভম্বের মতো কেবল বলল, ‘মানে?’

ননি বলল, ‘মানে হচ্ছে এই-আমি এই মেসে আসবার কিছুকাল আগে তেতলায় একটি ঘরে দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে গদাধর গাঙ্গুলি নামে একটি ভদ্রলোক আফিম খেয়ে দেহত্যাগ করেছিলেন৷’

মালিক বললেন, ‘এতক্ষণ পরে তবু কিছু হদিশ পাওয়া গেল৷ তার পর?’

‘তার পর কিন্তু দেহত্যাগ করেও গদাধরবাবু এই মেসের তেতলার ঘরের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি৷ অনেকেই তাঁকে তেতলার ছাদে বেড়িয়ে বেড়াতে দেখেছে-এমনকী তাঁর শখের গান গাইতেও শুনেছে৷’

‘শখের গান?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমিও দোতলা থেকে তাঁর শখের গানটি শুনেছি৷

‘সেই শখের গানটি কী?’

ননি সুরে বলল-

‘বাজে তালি, বাজে ধামা৷

ওরে যদু! আরে মধু!

শোন গাই সা-রে-গা-মা

ধেড়ে-কেটে, তেড়ে-কেটে-লেগে যায় তাক!

মোর গীতে ভেঙে যায় দুনিয়ার জাঁক!

দীপকের তা-না-না-না,

শুনে যাও মামি-মামা!

গিটকিরি শুনে ডেকে ওড়ে কাক-চিল,

উৎসাহে নিধু মারে যাকে-তাকে কিল৷

ছোটে গাধা, ছোটে ধোপা,

ছোটে খোকা দিয়ে হামা৷’

মালিক অভিভূতের মতন বললেন, ‘আহা, কী গান! শুনলে অশ্রুবর্ষণ করা অনিবার্য৷’

অটল করুণভাবে বলল, ‘নিশ্চয়৷ আমারও পাষণ্ড চক্ষু সজল হবার চেষ্টা করছে৷ কারণ আমি ওই তেতলাতেই থাকি৷’

পটল সায় দিয়ে বলল, ‘আমারও ওই অবস্থা-যদিও এখনও গদাধরবাবুর নিজের মুখের গান শোনবার সৌভাগ্য হয়নি৷’

নকুল ম্রিয়মান ভাবে বলল, ‘বোধ হয় তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, আমরা রাত দশটা বাজবার আগেই ঘুমিয়ে পড়ি৷’

ননি বলল, ‘ঠিক আন্দাজ করেছেন! যাঁরা পৃথিবীর দেহ ত্যাগ করেও পৃথিবীতে বাস করেন, রাত বারোটা বাজবার আগে তাঁদের দেখা পাওয়া অসম্ভব৷’

অটল বলল, ‘তাঁদের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আমি কিছুমাত্র ব্যাকুল নই৷’

ননি বলল, ‘ব্যাকুল না হতে পারেন, কিন্তু আমি শুনেছি গদাধরবাবু প্রতি বৎসরে একদিন পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে জোর করে আলাপ করবার চেষ্টা করেন৷ সেদিন নাকি ইচ্ছা করলেই সবাই তাঁকে দেখতে পায়!’

মালিক বললেন, ‘মানে?’

‘গদাধরবাবু প্রতি বৎসরে এক রাত্রে তাঁর বাৎসরিক কর্তব্যপালন করতে আসেন৷’

‘মানে?’

‘যে তারিখে তিনি দেহত্যাগ করেছিলেন, প্রতি বৎসরে ঠিক সেই তারিখেই গদাধরবাবু আবার চর্মচক্ষুগোচর দেহ ধারণ করেন৷ আবার আফিম খান৷ আবার আর্তনাদ করেন৷ এবং তারপর আবার মরেও যান৷’

মালিক বললেন, ‘রাত বারোটার পরে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

‘রাত বারোটার পরে কলকাতার কোনো আফিমের দোকান খোলা থাকে না৷’

‘মশাই, এ-সব হচ্ছে পরলোকের কথা৷ পরলোকে কোন দোকান কখন বন্ধ হয়, আমি তা কেমন করে বলব? ইহলোকের সমস্ত নখদর্পণে-কোন পাড়ায় কটা গাঁজা-আফিমের দোকান আছে তাও বলে দিতে পারি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পরলোক সম্বন্ধে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই৷’

মালিক ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘এইসব গাঁজাখুরি গল্প বলে আপনি কি আমার মেসবাড়ির দরজা বন্ধ করতে এসেছেন?’

ননিও ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলল, ‘গাঁজা? আমি ভদ্রলোক৷ গাঁজার দোকানের ঠিকানা জানি বটে, কিন্তু গাঁজা কাকে বলে জানি না৷ আমি এসেছি মেসের একখানি ঘর নিতে৷ একতলায় একখানি ঘর পেলেই আমি খুশি হব৷’

মালিক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন৷ কিন্তু আপনাকে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না৷ আমি আগাম টাকা চাই৷’

ননি বলল, ‘তাই নিন না৷ এ-বাড়ির তেতলার ঘর ছাড়া আর সব ঘরেই যেতে আমি প্রস্তুত৷ বিশেষ আজকের রাত্রে৷’

মালিক বললেন, ‘আজকের রাত্রে? মানে?’

ননী বলল, ‘গদাধরবাবু মরদেহ ত্যাগ করেন নাকি কার্তিকপুজোর রাত্রে৷ তিনি বাৎসরিক ব্রত পালন-অর্থাৎ আবার আফিম খেয়ে দেহত্যাগ করতে আসেন ঠিক সেই রাত্রেই৷ এটা তাঁর কী খেয়াল জানি না, কিন্তু শুনেছি, কার্তিক পুজোর রাত্রে তিনি আবার একবার দেহত্যাগ করবার অভিনয় না করে থাকতে পারেন না৷ অনেকটা সাপের খোলস ত্যাগের মতনই আর কী৷ চলুন মশাই, এ-সব বাজে কথা থাক৷ একতলায় আমাকে একখানা ঘর দেখিয়ে দিয়ে আসবেন চলুন৷’

ননিকে নিয়ে মালিক প্রস্থান করলেন৷

অটল কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে শিস দিতে দিতে হঠাৎ থেমে বলল, ‘আজই কার্তিক পুজো৷’

পটল দুঃস্বপ্নাভিভূতের মতন বলল, ‘কিন্তু গদাধরবাবু যে কোন ঘরে দাঁড়িয়ে বা বসে বা শুয়ে আফিম খেয়ে তাঁর বাৎসরিক ব্রত পালন করেন, সে-কথা তো জিজ্ঞাসা করা হল না৷’

অশ্রুভারাক্রান্ত কন্ঠে নকুল বলল, ‘জিজ্ঞাসা করবার দরকার নেই৷ যতটুকু শুনেছি, তাই-ই যথেষ্ট৷ আজ যদি সৌভাগ্যক্রমে গদাধরবাবুর সঙ্গে দেখা না হয়, তাহলে কালকেই এ-বাসাকে নমস্কার করে সরে পড়ব৷’

অটল ও পটল একসঙ্গে দৃঢ়প্রতিজ্ঞের মতন বলল, ‘হ্যাঁ৷’

সে-রাত্রে অটল, পটল ও নকুল এক-একখানা ঘরে একলা থাকা যুক্তিসংগত বা নিরাপদ বলে মনে করল না৷ পটল ও নকুল আপন আপন ঘর ত্যাগ করে এসে অটলের বিছানার ডান ও বাম পাশে নিজেদের বিছানা পেতে নিল!

গদাধরবাবুকে বাধা দেবার জন্যে অটল ঘরের সমস্ত দরজা-জানলা ভালো করে বন্ধ করে দিতে লাগল৷

পটল বলল, ‘অটল, ননির কাহিনি বিশ্বাস করলে বলতে হয়, গদাধরবাবু হচ্ছেন সূক্ষ্মদেহধারী৷ সূক্ষ্মদেহের একটা মস্ত সুবিধা এই যে, ইট-কাঠ-পাথরও ভেদ করে আনাগোনা করা যায়৷’

নকুল বলল, ‘পটল, স্তব্ধ হও৷ সাবধানের মার নেই৷’

নিজের বিছানার উপরে এসে বসে অটল বলল, ‘ঘড়িতে দেখছি রাত দশটা বাজে৷ ঘুমোবার সময় হল৷ কিন্তু আজ আমরা কী করব? ঘুমোব? না গদাধরের আগমন-প্রতীক্ষা করব?’

নকুল হাই তুলে বলল, ‘রাত বারোটা পর্যন্ত জেগে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব! মারাত্মক বললেও চলে৷’

পটল লেপের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘আমারও ওই মত৷ গদাধরবাবুর বাৎসরিক অভিনয় দেখবার ইচ্ছা আমার নেই৷ আমি ঘুমিয়ে তাঁকে ফাঁকি দিতে চাই৷’

অটল বলল, ‘আমার বিশ্বাস, গদাধরবাবুর কথা হচ্ছে রীতিমতো উপকথা৷ উপদেবতার কথা মাত্রই উপকথা৷ সুতরাং অকারণে জেগে থেকে আত্মাকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই৷ আলো নেবাও- ঘুমিয়ে পড়ো৷’

মিনিট-পাঁচেক পরেই তিনটি তন্দ্রা-পুলকিত নাসাযন্ত্রের প্রচণ্ড ঘড়র ঘড়র মন্ত্রে একান্ত সন্ত্রস্ত হয়ে দেয়ালবাসী টিকটিকিরা পর্যন্ত ভেন্টিলেটারের ভিতর দিয়ে বাইরে পলায়ন করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল৷ তারা এতদিন একা অটলের নাসিকাধ্বনিকে কোনোক্রমে সহ্য করে ছিল৷ কিন্তু একসঙ্গে অটল-পটল-নকুলের তর্জনগর্জনময় নাসা-ভাসা! এ হচ্ছে দস্তুরমতো মেছোহাটার কোলাহল! যে-কোনো জীবের পক্ষেই সহ্য করা অসম্ভব৷

কার্তিক মাসের শেষ তারিখের ভিজে হিমেল হাওয়া৷ কনকন কনকন! অটলের ঘুম গেল ছুটে৷ ধড়মড় করে উঠে বসে সে বলে উঠল, ‘ওরে বাপ রে বাপ! কী ঠান্ডা!’

সবচেয়ে বেশি শীতকাতুরে নকুল এর আগেই জেগে উঠেছিল৷ সে লেপের মাঝখানে ঢুকে গিয়ে ঘুম-জড়ানো স্বরে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, আমি এভারেস্টের সর্বোচ্চ শিখরের উপরে আরোহণ করে আছাড় খেয়েছি৷’

পটল বাক্যব্যয় করল না৷ এপাশ থেকে ওপাশে ফিরে শুলো৷

অটল বলল,-বিস্মিত, হতভম্ব স্বরেই বলল, ‘কিন্তু হাওয়া আসে কোত্থেকে? আমি নিজের হাতেই সব জানলা বন্ধ করে দিয়েছি৷’

নকুল একটিমাত্র চক্ষু উন্মোচন করে বলল, ‘শার্সিহীন পুরোনো জানলা, আলগা ছিটকিনি- হয়তো জোর হাওয়া লাগলেই খুলে যায়৷’

‘হতে পারে৷ কিন্তু এর আগে ওই উত্তুরে জানলাটা এমন অসময়ে আর কখনো খুলে যায়নি,’-এমনই গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে অটল সশব্দে আবার জানলাটা বন্ধ করে দিল৷

তারপর পুনর্বার ত্রিনাসিকা মুখর হয়ে উঠল-এবং খানিক পরে আবার ভালো করে ঘুমোতে না ঘুমোতেই ভেঙে গেল তাদের ঘুম৷ সেই ঠান্ডা হাড়-কাঁপানো বাতাস! উত্তরের জানলাটা আবার খুলে গিয়েছে৷

অটল চিন্তিত ভাবে বলল, ‘ব্যাপারটা ভালো বলে বোধ হচ্ছে না৷’

পটল বলল, ‘রীতিমতো সন্দেহজনক! জানলার এমন ব্যবহার কল্পনা করা যায় না৷ নকুল, উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো তো!’

নকুল দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘লেপের বাইরে যাবার ইচ্ছে আমার নেই৷’

অটল বলল, ‘নকুল, তুমি দেখছি মহা কাপুরুষ! একটা জানলা বন্ধ করবার সাহসও তোমার নেই? রাবিস!’ সে শয্যাত্যাগ করবার উপক্রম করছে, এমন সময় গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল৷

নকুল শীতার্ত কন্ঠে বলল, ‘বারোটা!’

পটল ম্রিয়মান স্বরে বলল, ‘প্রেত-নগরের সিংহদ্বার এইবারে খুলে গেল৷’

অটল জানলা বন্ধ করবার জন্যে আর শয্যাত্যাগ করবার চেষ্টা করল না৷ ঝাঁ-ঝাঁ রাতে ডাকছে খালি ঝিঁঝিঁ পোকারা৷ শহরের আর সব শব্দই যেন ভয়ে চুপ মেরে গিয়েছে৷ কিন্তু নীরবতার বক্ষ ভেদ করে একটা সুর শোনা যাচ্ছে না?

সুরটা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ কে যেন বাইরে ছাদের কোণ থেকে গুনগুন করে গাইছে-

‘বাজে তালি, বাজে ধামা!

ওরে যদু! আরে মধু!

শোন গাই সা-রে-গা-মা!’

অটল আড়ষ্ট ভাবে বলল, ‘ইস, এ যে গদাধরবাবুর গান!’

পটল বলল, ‘নকুল, ভাই আমার! চটপট জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে এসো তো৷’

নকুল বলল, ‘পাগল! গদাধরবাবু এসে আমাকে টানাটানি করলেও আমি আর লেপের ভেতর থেকে বেরোব না৷’

গান থামল৷ ছাদের উপরে শোনা গেল কার পায়ের শব্দ৷

অটল ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, গদাধরবাবু এই ঘরে এসেই আফিম খেতে চান৷’

পটল আর নকুল একেবারে বোবা হয়ে গেল,-বোধ হয় তারা ভাবল, বোবার শত্রু নেই৷

পায়ের শব্দ থেমে গেল৷ খানিকক্ষণ সব নিঃসাড়৷ তার পরই একটা নতুনরকম ভয়াবহ শব্দ-ঠক, ঠক, ঠক! শব্দ হচ্ছে ঘরের ভিতরেই-পূর্বদিকে! এ যেন মাংসহীন অস্থিসার পায়ের শব্দ!

অটলের মাথার চুলগুলো তখন খাড়া হয়ে উঠেছে এবং দেহ হয়েছে অসম্ভবরকম রোমাঞ্চিত৷ তবু সে বালিশের তলা থেকে দেশলাই বার করে ফস করে একটা কাঠি না জ্বেলে থাকতে পারল না৷

ঘরের কোথাও কেউ নেই৷ পটল আর নকুল দু-জনেই লেপের তলায় অদৃশ্য৷

দেশলাইয়ের কাঠি নিবে গেল৷ তারপর আবার ঘরের ভিতরে শব্দ হল ঠক, ঠক, ঠক! ঠক ঠকাঠক, ঠকাঠক, ঠকাঠক!

শীতেও ঘর্মাক্ত কলেবর হয়ে অটল ভাবতে লাগল, অতঃপর কী করা উচিত?-হঠাৎ তার মনে পড়ল প্রেততত্ত্ববিদদের কথা৷ প্রেতেরা নাকি প্রায়ই শব্দের সাহায্যে মনের ভাব ব্যক্ত করে৷ গদাধরবাবুও কি শব্দ করে কোনো কথা বলতে চাইছেন?

অত্যন্ত কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে অটল বলল, ‘এ-ঘরে যদি কেউ এসে থাকেন, তাহলে দয়া করে শুনুন৷ আমি প্রশ্ন করি, আপনি উত্তর দিন৷ আমার প্রশ্নের উত্তরে একবার শব্দ হলে বুঝব- হ্যাঁ, আর দু-বার শব্দ হলে বুঝব-না৷

ঠক, ঠক, ঠক, ঠক, ঠক, ঠক!

‘মশাই, অত বেশি শব্দ করে ভয় দেখালে মারা পড়ব! শুনুন৷ আপনি কি গদাধরবাবু?’

একবার শব্দ হল-ঠক! অর্থাৎ-‘হ্যাঁ’৷

‘আপনি কি বেঁচে আছেন?’

দু-বার শব্দ হল-ঠক, ঠক! অর্থাৎ-‘না’৷

দুই হাতে চেপে নিজের হৃদকম্প থামাবার চেষ্টা করে অটল বলল, ‘আপনি কি এখানে আফিম খেতে এসেছেন?’

ঠক৷ ‘হ্যাঁ’৷

‘আপনি কি আজ আফিম না খেয়ে থাকতে পারবেন না?’

ঠক, ঠক৷ ‘না’৷

‘আমরা এখানে থাকলে আপনি কি রাগ করবেন?’

ঠক৷ ‘হ্যাঁ’৷

‘আপনি নিশ্চয় আমাদের আক্রমণ করতে চান না?’

ঠক৷ ‘হ্যাঁ’৷

পরমুহূর্তেই অটলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হাত-পা-ওয়ালা মস্ত একটা দেহ৷ অটল বিছানা থেকে ছিটকে মেঝেয় গিয়ে পড়ে হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল! এবং তার পর-মুহূর্তেই পটল বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরে বাপরে, গদাধর আমার ঘাড়ে চেপেছে রে!’

তারপরেই দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা এবং সেই অবস্থাতেই অটল বেশ বুঝতে পারল যে, পটল ও নকুল চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে দুমদাম শব্দে ছাদের উপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে৷ বলা বাহুল্য, সেও তৎক্ষণাৎ গদাধরবাবুকে ফাঁকি দিয়ে শুয়ে-শুয়েই সরীসৃপের মতন সড়াৎ করে দরজার কাছে সরে গেল, তারপর উঠেই বাইরের ছাদের দিকে মারল এক লম্বা লাফ!

অটল, পটল আর নকুল হুড়মুড় করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলার বারান্দার উপর নেমে দেখল, এত রাত্রে সাত-পাড়া কাঁপানো গোলমাল শুনে মেসের সমস্ত লোক এসে জড়ো হয়েছে৷ সকলেরই ব্যস্ত কন্ঠে একই জিজ্ঞাসা-ব্যাপার কী, ব্যাপার কী?

বারান্দার উপরে তিনজোড়া পা ছড়িয়ে বসে পড়ে তিন মূর্তি হাঁপাতে লাগল তিনটে হাপরের মতো৷ মেসের মালিক শুধোলেন, ‘ও অটলবাবু, কী হয়েছে বলুন না!’

অটল বাধো-বাধো গলায় বলল, ‘গদাধরবাবু আমার ওপরে লাফিয়ে পড়েছিলেন৷’

পটল বলল, ‘না অটল৷ ভয়ের চোটে তোমার ওপরে ঝাঁপ খেয়েছিলাম আমিই৷ আর গদাধরবাবু লাফ মেরেছিলেন আমার পিঠের ওপরেই৷ আমার প্রতি তাঁর এই অন্যায় পক্ষপাতিতার মানে হয় না৷’

নকুল বলল, ‘না পটল৷ পালাতে গিয়ে তোমার ওপরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমিই৷ অন্ধকারে তুমি বুঝতে পারনি৷’

মালিক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে হা-হা করে হেসে বললেন, ‘এরই নাম রজ্জুতে সর্পভ্রম! গদাধর হচ্ছেন গাঁজাখুরি গল্পের নায়ক৷ যান মশাই, যে-যার ঘরে যান৷ মিথ্যেই আমাদের ঘুম ভাঙালেন৷’

অটল প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, ‘মাপ করতে হল মশাই! কে ঘরে যাবে?’ সেখানে গদাধরবাবু এতক্ষণে হয়তো আফিম গুলতে শুরু করেছেন৷’

মালিক বিপুল বিস্ময়ে বললেন, ‘মানে?’

অটল বলল, ‘হতে পারে দুরাত্মা পটল নির্বোধের মতন আমার ওপরে ঝাঁপ খেয়েছিল, কিন্তু-‘

পটল বলল, ‘হতে পারে কাপুরুষ নকুল ভয়ে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে আমার ওপরে হোঁচট খেয়েছিল, কিন্তু-‘

নকুল বলল, ‘কিন্তু আমাদের এই ভ্রমের দ্বারা প্রমাণিত হয় না যে, তেতলায় গদাধরবাবু নেই৷ কারণ আমরা সবাই স্বকর্ণে তাঁর মার্কা-মারা গান, তাঁর পায়ের শব্দ আর ঠক ঠক ভাষায় তাঁর কথা শুনেছি৷’

মালিক মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘তাইতো, শুনেছেন নাকি?’

অটল বলল, ‘নিশ্চয়! শুনেছি বলেই তো ভয় পেয়েছি৷’

মেসের আর কেউ ননির গল্প শোনেনি৷ সকলের কন্ঠে একই প্রশ্ন জাগল-গদাধরবাবু কে?

মালিকের ইচ্ছা নয় যে, গদাধরবাবুর কাহিনি আর কারুর কর্ণগোচর হয়৷ সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘গদাধরবাবু হচ্ছেন আমার পিসেমশাই, তাঁকে নিয়ে আপনাদের কারুর মাথা ঘামাবার দরকার নেই৷ অটলবাবু, পটলবাবু, নকুলবাবু! আপনারা আমার ঘরেই আসুন৷ পিসেমশাই এত রাতে আপনাদের ঘরে অনধিকার প্রবেশ করেছিলেন বলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত৷ আফিমের মৌতাত মাথায় চড়লে পিসেমশাইয়ের আর কোনো জ্ঞান থাকে না,-আরে ছোঃ!’

সকালের আলো দেখে তাদের পলাতক সাহস আবার প্রত্যাগমন করল৷ মেসের মালিককে নিয়ে অটল নিজের ঘরে এসে ঢুকল, পটল এবং নকুলও গেল নিজের নিজের ঘরে! বলাবাহুল্য, বাৎসরিক ব্রত পালন করে গদাধরও তখন অদৃশ্য হয়েছেন৷

অটল কৌতূহলী ভাবে ঘরের এদিক-ওদিক দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে, এমন সময় পটল ঝড়ের মতন ছুটে এসে বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে! আমার দরজার তালা ভাঙা! ট্রাঙ্কের তালা ভাঙা! আমার দশখানা দশ টাকার নোট চুরি গিয়েছে!’

তার পরে প্রায় তার পিছনে পিছনেই ছুটে এসে নকুলও সমাচার দিল, তার বাক্সের ভিতর থেকে উধাও হয়েছে একশো পনেরো টাকা আট আনা৷

অটল চমকে উঠে তাড়াতাড়ি বিছানার উপরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল৷ তার চাবির তোড়া থাকত মাথার বালিশের নীচে৷ বালিশ তুলে দেখা গেল, চাবি নেই-কিন্তু একখানা চিঠি আছে৷

চিঠিখানা এই :

অটল-পটল-নকুলবাবু,-

কাল সকালে গদাধর-কাহিনি বলে আমি বেশ একটি ভৌতিক আবহ সৃষ্টি করেছিলাম- নয়? তারপর সেই আবহ রাত্রে ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল দুই-দুইবার খোলা জানলা দেখে,-কী বলেন?

কিন্তু একটু কম-ভীতু হলে আপনারা অনায়াসেই অনুমান করতে পারতেন যে, বাহির থেকে অনায়াসেই খড়খড়ির পাখি তুলে হাত দিয়ে ছিটকিনি সরিয়ে জানলা খোলা যায়৷

এ-ঘরের ভেন্টিলেটারের ছ্যাঁদা বড়ো হওয়াতে আমার ভারি সুবিধা হয়েছে৷ ওই পূর্বদিকের মাঝের জানলার উপরকার ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে টন-সুতোর ডগায় একখণ্ড নুড়ি বেঁধে বাহির থেকে আমি ঘরের ভিতরে ঝুলিয়ে দিয়েছিলাম, আর সুতোর অন্য প্রান্ত ছিল আমার হাতে৷ এই হচ্ছে ঠক ঠক আওয়াজের গুপ্ত কারণ! বাহির থেকে কান পেতে আমিই সুতোয় টান মেরে অটলবাবুর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি৷

গদাধরবাবুর গানটি এই অধীনেরই রচনা৷ ওটি কোনো মাসিকপত্রে ছাপিয়ে দিতে পারবেন?

আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আপনাদের তেতলা থেকে তাড়ানো৷ কেন, তা বলা বাহুল্য৷

আর বোধ হয় মহাশয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না-বিদায়৷

ইতি-

আপনাদের শ্রীননি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *