কারণ

কারণ

আগের চাকরিটা তাকে ট্রেনিং পিরিয়ডের মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয়েছিল। সুপারভাইজার লোকটা ছিল ভয়ানক বেয়াদপ আর জলজ্যান্ত কামুক। পনেরো দিন ধরে হেনস্থার চূড়ান্ত হয়ে যাজ্ঞসেনী রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরেছিল কাঁদতে কাঁদতে!

কিছুদিন চেষ্টাচরিত্রর পর এই বহুজাতিক সংস্থায় ঢুকেছিল সে আবার ট্রেনি হিসেবে। তখন থেকেই খুব সচেতন ছিল এখানে কী ধরনের আচারব্যবহার পাচ্ছে— সে ব্যাপারে। কিন্তু তাকে কোনও সমস্যায় পড়তে হয়নি। বরং ডাইরেক্ট বস পরমজিৎকে শুরু থেকেই ইমপ্রেসিভ মনে হয়েছিল তার। জেনডার বায়াস ছিল না কাজের পরিবেশে। তাই মন দিয়ে কাজ শিখে অনিবার্য কর্মী হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিল যাজ্ঞসেনী নিজেকে।

তার স্বীকৃতি হিসেবে এই মুহূর্তে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়ে প্রথমে তার এত আনন্দ হল যে, ইচ্ছে করল বসের চেম্বারেই এক পাক নেচে নেয়। বদলে লাজুক হেসে সে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়াল বসের দিকে।

তক্ষুনি সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে সে ভাবছিল যে, এই আনন্দটা মহুয়ার সঙ্গে ইমিডিয়েটলি ভাগ করা দরকার, তার প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলতে ইচ্ছে করল— ‘মহুয়া, আমি পেরেছি! সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করার মতো একটা আর্থিক সংস্থান একার প্রচেষ্টায় এবার করতে পেরেছি আমি!’ ট্রেনিং পিরিয়ডের দীর্ঘ দুটো মাস যে সংশয়ের মধ্যে দিয়ে এসেছে সে, তা আজ এক মুহূর্তে কেটে গেল। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে, বদলে এরা তাকে গ্রহণ করেছে। যে-অর্থ প্রতি মাসে এখান থেকে যাজ্ঞসেনী রোজগার করবে, তা দিয়ে পেয়িংগেস্ট থাকার খরচ, খাওয়ার খরচ, যাতায়াতের খরচ মিটিয়েও সামান্য শখ-শৌখিনতা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সিনেমা-থিয়েটারের আয়োজন সে করতে পারবে নিজের জন্য। এই সময়ে এর বেশি কী আর কিছু প্রয়োজন আছে তার? যথেষ্ট, যথেষ্ট! ছ’ মাসের যন্ত্রণা অপমানের এখানেই পরিসমাপ্তি, সে এবার বাঁচবে। নিশ্চিতরূপেই মাথা উঁচু করে বাঁচবে এখন।

হাত বাড়াতে বাড়াতে এত কথা ভেবেছিল সে। ফলে খেয়াল করতে একটু সময় নিল যে, বসের তর্জনীটা তার ডান হাতে তেলোর ওপর দু’-চারটে অপ্রয়োজনীয় বৃত্তাকার আঁচড় কাটছে। এক লহমায় সমস্ত আনন্দ শুকনো হয়ে ঝরে পড়ল তার বুকের ভেতর। কী মানে এর? মাথাটা দুলে উঠল যাজ্ঞসেনীর। না, না— নিশ্চয়ই তার কোথাও ভুল হচ্ছে! অবিশ্বাসে ছেয়ে গেছে তার নিজেরই অন্তরভূমি আসলে! আসলে করমর্দন একটা আদ্যন্ত পুরুষালি শব্দ!

করমর্দন শেষে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সপ্রতিভভাবে আরও দু’-তিনবার ধন্যবাদ জানিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এল সে। মন থেকে দ্বন্দ্বটা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে দ্রুত নিজের সিটে ফিরে গিয়ে ডায়াল করল মহুয়াকে। মহুয়ার গলা পাওয়া মাত্র সব ভুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল যাজ্ঞসেনী— ‘এক্ষুনি পেলাম অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা— পুরো বারো দেবে! দারুণ না?’

‘দারুণ, দারুণ!’ খুশিতে উথলে ওঠা গলা মহুয়ার।

মহুয়া তার কলেজ জীবনের বন্ধু। পলাশের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে, বেরিয়ে এসে যাজ্ঞসেনী যখন উদ্‌ভ্রান্তের মতো একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজছে, তখন ডিভোর্সি মহুয়াই একমাত্র মানুষ যে তার পাশে ছিল। মহুয়া নিজে যে ওয়ান রুম ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে থাকে তাতেই আশ্রয় দিয়েছিল যাজ্ঞসেনীকে।

‘আশ্রয়’— সত্যি কী মূল্যবান শব্দ এই ‘আশ্রয়’, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যার, সে যখন একটা ঘর পায়, একটা পরিচ্ছন্ন বিছানা পায়, ঝকঝকে বাথরুম পায় আর মহুয়ার মতো বন্ধু যখন তাকে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে গরম ভাত মেখে খাইয়ে দেয়, আর পাশে নিয়ে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে— ‘ঠিক একটা ব্যবস্থা হবে যোগী, এত পড়াশুনো সব বৃথা যাবে নাকি?’— তখন এই আশ্রয় শব্দটা গভীর হতে হতে কীভাবে ‘পুরো বেঁচে থাকা’ হয়ে ওঠে তা অনুভব করেছে যাজ্ঞসেনী নিজে। বন্ধু নয়, মহুয়া প্রায় মা হয়ে ছ’মাস ধরে আগলেছে তাকে।

জ্বালা করে ওঠা চোখদুটো মুছে নিয়ে, রিভলভিং চেয়ারে সে ঘুরে নিল একটু— কোথায় আছিস, মহুয়া, খুব চেঁচামিচির আওয়াজ আসছে!

সুমিতের ছেলে হয়েছে না! অফিস থেকে তাই আমরা বারোজন সুমিতের ঘাড় ভেঙে হইহই করে কফি খেতে এসেছি।

আমিও তোকে খাওয়াব আজ! ডিনার খাওয়াব!

ডিনার? কোথায় খাওয়াবি বল?

উম্, এই ধর ট্যামারিন্ডে? নন-ভেজ সাউথ ইন্ডিয়ান পাওয়া যায়।

এক্সক্লুসিভ ইন ক্যালকাটা।

বেশ, বেশ! মহুয়া থ্রিলড্‌। তা হলে অফিস থেকে বেরিয়ে আমার কাছে চলে যায়। এখান থেকে তো ওয়াকিং ডিসট্যান্স!

টু আর্লি মহুয়া। অফিস থেকে বেরিয়ে আগে বাড়ি যাব। আজ আমি পুরো সেলিব্রেট করতে চাই। প্রথমে দারুণ করে সাজব— তারপর খেতে যাব। তোর সঙ্গে। তুইও প্লিজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যা!

আবার বাড়ি যাব, আবার আসব!

কেন, এটা তো তোর রোজগারে, একঘেয়েমি ভরা মেট্রোরাইড নয়। আমরা তো ফ্যান্সি ড্রেস পার্টিতে যাওয়ার মতো ফুরফুরে মেজাজে, পারফিউম মেখে, কলকাত্তাই ক্যাব ধরে ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছব ট্যামারিন্ডে বাপু!

ওকে, যা বলিস, টুডে ইজ ইয়োর ডে মাই বিলাভেড! সাতটার মধ্যে ঢুকছি তা হলে!

সাতটার মধ্যে পৌঁছতে হবে ভেবে নিজে ছ’টার আগেই অফিস থেকে বেরোবে ভেবেছিল যাজ্ঞসেনী। কিন্তু হাতের কাজ তুলতে তুলতেই ছ’টা বেজে গেল। তাড়াহুড়ো করে কম্পিউটার অফ করতে যাবে এমন সময় বসের ঘরে ডাক পড়ল আবার। সেখান থেকে বেরিয়ে সে বুঝল আরও এক ঘণ্টা অফিসে তাকে থাকতে হচ্ছেই! ইন্টারনেট থেকে কিছু ডেটা ডাউনলোড করে চটপট তার প্রিন্ট বের করে সে যখন ফাইলটা বসের হাতে তুলে দিতে ছুটল তখন সাতটা বেজে গেছে। ভাগ্যিস মহুয়াকে ফোনটা করে দিয়েছিলাম! মনে মনে বলল যাজ্ঞসেনী। মহুয়া তখন মেট্রোয় ছিল। এতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। ভালই— মেয়েটা একটু রেস্ট নিয়ে নিক।

সে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল বসের চেম্বারে। ফাইলটা এগিয়ে ধরল। সে বসতে চেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই ঝুঁকল সামনে। যেই ঝুঁকল, পরমজিৎ তার সাদা শার্টের মধ্যে দিয়ে চোখ চালিয়ে দিয়ে খুঁজল কিছু। তারপর আঙুলের ইশারায় বসতে বলল তাকে।

অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা হাতে ধরিয়েই কী অদ্ভুতভাবে বদলে গেল পরমজিতের ব্যবহার। আজ যাজ্ঞসেনী বেশি কিছু তো চায়নি— যে-বন্ধু তার জন্য এত করল, ছ’ মাস ধরে, সেই বন্ধুকে একটু কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিল শুধু। চেয়েছিল সাফল্যের আনন্দ তার সঙ্গেই ভাগ করতে। বসতে বসতে সে ভাবল পরমজিৎকে সরাসরি জানিয়ে দেবে ব্যাপারটা। বলবে যে তার দেরি হচ্ছে। কিন্তু সে পারল না, চাকরিটা তার পক্ষে মারাত্মক দরকারি!

ফাইলটা উলটে-পালটে দেখে পরমজিৎ ভুরু তুলে তাকাল তার দিকে— আপনার তো আজ খুব খুশি থাকার কথা, অথচ দেখে মনে হচ্ছে ইউ আর নট সো হ্যাপি, কি, স্যালারির অ্যামাউন্ট পছন্দ হয়নি?

সে হাত নাড়ল— না, না, স্যার! আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি! বাট সো নাইস অফ ইউ স্যার! থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!

আরে, ডোন্ট বি সো ফরমাল ! ডু ওয়ান থিং, আমি বেরোচ্ছি, আপনি আমার সঙ্গে চলুন, অন দা ওয়ে উই ক্যান হ্যাভ আ কাপ অফ কফি। আজ তো এমনিতেই আপনার একটু সেলিব্রেট করা উচিত! বলে পরমজিৎ দাঁত বের করে হাসল।

পরমজিতের কথাগুলো কোনও অনুরোধ নয়। তার বুকটা কাঁপল। আগের চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার পর এসব ব্যাপারে মহুয়ার সঙ্গে অনেক আলোচনা হত যাজ্ঞসেনীর। মহুয়া তাকে বোঝাত যে, মেয়েরা যখন চাকরি করতে বাইরের জগতে পা দেয়, যতক্ষণ সে তার নিরপেক্ষ কর্মী আইডেনটিটি আদায় না-করে নিয়েও দ্বারস্থ হয় সংস্থার এবং এমপ্লয়ারের কাছে, তার দীর্ঘ কর্মদক্ষতাকে যতক্ষণ না প্রমাণ করে উঠতে পারে ততক্ষণ অন্য এক ধরনের সুবিধাজনক মূল্য তাকে দেয় পুরুষকুল। দেয় শুধু মেয়ের চামড়া গায়ে থাকার জন্যই। মেয়েদের কেরিয়ারের এই সময়টাই চূড়ান্ত আত্মক্ষয় ও অবমাননার সময়, মহুয়া তাকে বলেছে— এই সময়টাকে কাটিয়ে উঠতে হয় যোগী। সে যতই নারীলোলুপ কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ুক না কেন আসলে সেই পুরুষ বা পুরুষরাও তো লগ্নি ও লাভের মূল কাঠামো অনুসরণকারী কোনও ব্যবস্থারই অংশীদার, যা তাদেরও ব্যক্তিগত উন্নতির পথ। অতএব, নিজেকে কর্মনিপুণতা দিয়ে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সচেষ্ট থাকলে একসময় এই শরীরের প্রতি দুর্বল পুরুষদের কাছ থেকেও একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মী হওয়ার সম্মান পেতে বাধ্য সে। ততদিন সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। ‘আমাকে কি কম ঝামেলা নিতে হয়েছে? ধীরে ধীরে শিখেছি ট্যাকেল করা! তোকেও শিখতে হবে— নইলে ক’টা চাকরি বদলাবি তুই যোগী?’ বলেছে মহুয়া।

তাই এখন সে জানে, অন্যের এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, পরমজিতের বলা কথাগুলো কোনও অনুরোধ নয়। হতেও পারে না। বুকের কেঁপে ওঠাকে আমল না দিয়ে যাজ্ঞসেনী আলতো হাসে এবং বলে— আই উড লাইক টু স্যার!

এরপর পরমজিতের পাশে গাড়িতে বসে পরমজিতের মোবাইল ধার নিয়ে সে মহুয়াকে ফোন করল।— ‘আজ হচ্ছে না মহুয়া, ফিরতে একটু রাত হবে।’

কেন রে? কী হল? উৎকণ্ঠিত হয় মহুয়া।

পরে বলছি।

পলাশ কোনও ঝামেলা করল?

না, না সেসব কিছু নয়। সে চুপ করে যায়।

তবে?…

পরে বলব। সে পরমজিতের দিকে তাকিয়ে হাসে।

কীরে, এটা কার মোবাইল?

যাজ্ঞসেনী ফোনটা কেটে দেয়।

কফি নয়, পরমজিৎ হুইস্কি নেয়, সে পাইনঅ্যাপেল জুস। সঙ্গে চিকেন রেশমি কাবাব আর ফিস টিক্কার অর্ডার যায়। দু’ঘণ্টা ধরে নানা কথা বলে পরমজিৎ। ব্যবসার ভবিষ্যৎ, বউ-বাচ্চার গুণগান ছাড়াও মোবাইল ফোনের সর্বব্যাপী অগ্রসরতা, চার্লস-ক্যামিলার বিয়ে ইত্যাদি আসে প্রসঙ্গ হিসেবে। পরমজিৎ যাজ্ঞসেনীকে অতীত সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করে না।

শুধু ভবিষ্যতের প্ল্যান জানতে চায়। চাকরিতে টিকে থাকা সম্পর্কে পরামর্শ দেয়। কথাগুলোকে খুবই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় যাজ্ঞসেনীর। যদিও পরমজিতের ক্লিনশেভড গাল ক্রমশ বেশি চকচক হয়ে উঠছে বলে মনে হয় তার। চোখদুটো থেকেও এক ধরনের উত্তেজনার আভা ছড়াতে থাকে। সে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে!

রেস্তোরাঁয় ঢোকার সময় পরমজিৎ একবার তার কাঁধ স্পর্শ করেছিল, টেবিলে বসতে সাহায্য করার সময় স্পর্শ করেছিল কোমর, ফেরার পথে গাড়ির দরজা খোলার সময় নিতম্ব স্পর্শ করেছিল। যাজ্ঞসেনী বাড়ি ফিরে মহুয়াকে পরমজিতের প্রতিটা স্পর্শ সম্পর্কে জানাল। সঙ্গে এও জানাল যে স্পর্শগুলোকে সে কোনও সুযোগসন্ধানীর স্পর্শ বলে চিহ্নিত করতে পারছে না। তার রাগ হচ্ছে না!

সমস্তটা শুনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল মহুয়া। তখন সে মহুয়ার হাত চেপে ধরে প্রশ্ন করল— কেন, কেন, কেন তার কোনও রাগ হচ্ছে না?

মহুয়া বলল, যোগী, তুই ইনসিকিয়োর, তুই এবার আর কাজটা হারাতে চাইছিস না। তুই একটা গিভ অ্যান্ড টেকে বিশ্বাস করছিস। তাই রাগ হচ্ছে না তোর। শোন, মেয়েরা না পোষালে স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিতে পারে, ব্যর্থ সম্পর্কের হাত থেকে এভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু এই সমাজের সঙ্গে নারীর যে-চিরকালীন সম্পর্ক তার হাত থেকে মেয়েদের কোনও মুক্তি নেই! তুই এবার সেটা বুঝতে পেরেছিস!

প্রচণ্ড অসহায়ভাবে যাজ্ঞসেনী তখন জানতে চাইল— তা হলে এই সমাজের সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কটা কীরকম মহুয়া?

হাসল মহুয়া— দুটোই হতে পারে যোগী। এক, কোনও সম্পর্কই নেই, অথবা দুই, আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্পর্ক।

চাকরিটা পেয়ে যাজ্ঞসেনী কি নতুন জীবন পেল? পেল না, কিন্তু পেতে পারত। কেন না, এতদিন সে মহুয়ার এক কামরার ফ্ল্যাটেই শুধু ভাগ বসায়নি, সে মহুয়ার লাঞ্চ, ব্রেকফাস্ট, ডিনারেও ভাগ বসিয়েছে। সে মহুয়ার শ্যাম্পু, সাবানেও ভাগ বসিয়েছে। চাকরির প্রথম স্যালারিটা ড্র করা মাত্র সে এইসব খরচের অর্ধেকটা বহন করতে তৎপর হল। মাসের প্রথমে দুই বন্ধু মিলে বড় একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গিয়ে ঢুকল এবং একে অপরের পছন্দমতো অজস্র জিনিস কিনে আনল বাড়িতে। তার ভেতরের সংকোচ দূর হচ্ছিল যত, মহুয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা ততই বাড়ছিল। অতীতের যাজ্ঞসেনীর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে— সে বলেছিল নিজেকে। মহুয়াকে চা করে খাওয়াতে ভাল লাগল তার, আগে বাড়ি ফিরলে রান্নাটা সেই সেরে ফেলতে লাগল। সে আবিষ্কার করল নিজের মধ্যের এক সহিষ্ণু সত্তাকে, সম্পর্কের প্রতি যত্নবান সত্তাকে। ডিভোর্সি মহুয়া আর তার যৌথজীবন হল সুখের। বিপন্নতা ও অবসাদ কেটে যাচ্ছিল তার। কিন্তু পরমজিৎ তাকে শান্তিতে থাকতে দিল না।

একটা কোনও প্রেমের কথাও অবশ্য বলল না পরমজিৎ। তাকে, কোনও মিথ্যে সম্পর্ক তৈরির ছলনাটুকুও করল না— একদিন কাজের কথা বলতে বলতে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে চুমু খেল। একদিন চুমু খেতে খেতে যাজ্ঞসেনীর স্তনের ভার কত পরিমাপ করল। একদিন স্তনে হাত রেখে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরল যাজ্ঞসেনীর ঊরুতে।

উপোসি শরীর তার এই সফল, সুপুরুষের ছোঁয়া পেয়ে আনন্দও হয়তো পেল কিছু, কিন্তু সে টের পাচ্ছিল প্রেমহীন শরীর-ভোগে তার আত্মগ্লানি হচ্ছে। পরমজিতের চেম্বারে পরমজিতের সঙ্গে ঘষটাঘষটির পুরো সময়টাই সে পরমজিৎকে তার চাকরি থাকা, না-থাকার স্বার্থজনিত দৃষ্টি নিয়ে দেখছে এবং ভয় পাচ্ছে। এবং সে প্রতিবাদ করতে পারছে না যে শুধু তাই নয়, যেদিন পরমজিৎ তাকে বিকেল পর্যন্ত একবারও ডেকে পাঠাচ্ছে না, সেদিন এমনকী কাজে মন বসাতে পারছে না। সে!

মাস দুয়েক গড়াতে না গড়াতেই পরমজিৎ একদিন নিরিবিলি অফিস দেখে যাজ্ঞসেনীর স্কার্টের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল। হতচকিত যাজ্ঞসেনী এই প্রথমবার খুব আলতো করে বাধা দিল পরমজিৎকে। বলল— প্লিজ স্যার, আজ আমার অন্য অসুবিধে আছে!

পরমজিৎ চোখ টিপে মুচকি হাসল— কবে শেষ হচ্ছে?

ঢোক গিলল যাজ্ঞসেনী— তিন-চারদিন লাগবে!

ফাইন! এর পরের সময়টা তোমাদের পক্ষে খুব প্লিজিং সময়। শোনো, তা হলে এক কাজ করা যাক, শনিবার একটা-আধটা চেঞ্জ নিয়েই তুমি অফিসে এসে যেয়ো। আমরা এখান থেকেই হলদিয়া চলে যাব। আর সানডে ইভনিং-এ ফিরে আসব। কী, ভাল হবে না? দাঁড়াও, আমি হোটেল বুক করছি!

সেদিন পড়ন্তবেলায় কাউকে কিছু না বলে অকারণেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে সে হাঁটতে লাগল। বৃষ্টি হয়েছিল একটু আগে। রাস্তায় জলকাদা ছিল। অন্যমনস্ক যাজ্ঞসেনীর গায়ে পরপর দুটো গাড়ি নোংরা জল ছিটিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু সে টেরও পেল না। সে এমন নির্জীবভাবে হাঁটছিল যে, দেখে মনে হচ্ছিল সে সদ্য ধর্ষিত!

হাঁটতে হাঁটতে সে কখন যেন চৌরঙ্গি পৌঁছে গেল, তখনই কেউ পিছন থেকে খুব জোরে ডাকল তাকে— যাজ্ঞসেনী, দাঁড়াও! সে ঘুরে তাকাল— কিন্তু তার চিন্তাগুলোর সঙ্গে পথ হারিয়েছিল তার দৃষ্টিও। বেশ সময় লাগল চিনতে পলাশের বন্ধু অরিন্দমকে—

অরিন্দম? বলল সে।

হ্যাঁ। কিন্তু যাজ্ঞসেনী কী হয়েছে তোমার? তুমি তো পুরো মাতালদের মতো পথ হাঁটছ!

মাতাল? না, না, আমি মদ খাই না!

আমি তা বলতে চাইনি। আমি বলতে চাইছি, তুমি টলছ আর তোমাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে !

অসুস্থ? হ্যাঁ, তাই অরিন্দম। দাঁড়াও, একটু জল খেলে ঠিক হয়ে যাবে! জল খাবে? শোনো, এসো আমার সঙ্গে। এই কফিশপটায় একটু বসি চলো। তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা বলাও খুব দরকার। তোমাদের ডিভোর্সটা আমাকে, রণজিৎকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে যাজ্ঞসেনী। অথচ পলাশ কিছু বলছে না! কিন্তু উই মাস্ট নো উই আর সো মাচ কনসার্নড!

দু’গ্লাস জল খাওয়ার পরও সে চোঁ-চোঁ করে টেনে নিচ্ছিল লস্যিটা।

অরিন্দম একভাবে লক্ষ করছিল তাকে।

নাউ টেল মি! বলল অরিন্দম।

কী বলব?

কী বলব, মানে? তুমি এমন একটা মিষ্টি মেয়ে, এত গুণ তোমার, অন্যদিকে পলাশ আমাদের মধ্যে ব্রাইট মোস্ট। তোমাদের তো পারফেক্ট ম্যাচ বলতাম আমরা, কোথা থেকে এসব হয়ে গেল যাজ্ঞসেনী? অরিন্দম, তুমি আমাকে দেখে বুঝতে পারছ না যে আমি আজ ভীষণ টায়ার্ড?

প্লিজ ডোন্ট অ্যাভয়েড, শুনেছি তুমি অ্যালিমনি অ্যাকসেপ্ট করোনি? তা হলে, কী করে চলছে তোমার? আছই বা কোথায়? তোমার বাবা-মা তো ডিব্রুগড়ে থাকতেন, তাই না?

‘কী করে চলছে’ প্রশ্নটা শুনে, যাজ্ঞসেনী, যে নিজেকে একজন দক্ষ কর্মী বলে প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর, সে কেমন যেন ঘাবড়ে গেল। বমি বমিও পাচ্ছে, টের পেল। তখন এদিক ওদিক তাকাল আর একটু জলের প্রত্যাশায়। জল এল, সিগারেটে ঘনঘন টান দিল অরিন্দম কয়েকবার। তারপর আবার ঝুঁকে পড়ল প্রশ্ন নিয়ে— কী কারণে ভাঙল এমন বিয়ে? চমকে উঠে যাজ্ঞসেনী বলল— আঁ?

কী কারণে এরকম একটা বিয়ে ভেঙে গেল জানতে চাই আমি

যাজ্ঞসেনী?

কী কারণ?

কী কারণে ভাঙল, কী কারণে ভাঙল…। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল যাজ্ঞসেনী যেন ভাঙার কারণগুলো এই রেস্টুরেন্টেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারপর সে হাতব্যাগটা খুলে ফেলে ঘাঁটল কীসব!

অরিন্দম ভাবল ‘কারণটা’ যাজ্ঞসেনী ব্যাগেই পুরে রেখেছে। কিছুই বেরোল না যখন ব্যাগ থেকে তখন আবার অস্থির হয়ে উঠল অরিন্দম—বলো, যাজ্ঞসেনী, কারণটা বলো। এতবার জিজ্ঞেস করছি। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আমরা পলাশের বন্ধু। আমাদের জানার অধিকার আছে।

সে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল অরিন্দমের দিকে। আমার কারণটা মনে পড়ছে না অরিন্দম!

ডু ইউ মিন ইট? আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট? যে কারণে বিয়ে, যাজ্ঞসেনী, বিয়ে ভেঙে যায় সেই কারণটা তোমার মনে পড়ছে না? মন থেকে উবে গেছে? হতে পারে? ঠাট্টা করছ তুমি!

আমি সত্যি বলছি অরিন্দম, আমার মনে পড়ছে না, কোনও কারণ মনে পড়ছে না!

লুক!

অরিন্দম বিলিভ মি, আমার মনে পড়ছে না। তুমি বরং পলাশকে… বলতে বলতে বমি করার জন্য রেস্টুরেন্টের বাথরুমের দিকে ছুটল যাজ্ঞসেনী।

আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে মহুয়া দেখল যাজ্ঞসেনী বিছানায় কুঁকড়েমুকড়ে শুয়ে ছটফট করছে। সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে।

কী হয়েছে যোগী?

যাজ্ঞসেনী মহুয়ার বুকে মুখ গুঁজে পাগলের মতো মাথা নাড়তে লাগল।

মহুয়া অনুভব করল যাজ্ঞসেনীর গায়ে প্রবল জ্বর— জ্বর বাধালি কী করে, কী কষ্ট হচ্ছে তোর বল! বলল মহুয়া।

মহুয়াকে হাতড়ে হাতড়ে উঠে বসল যাজ্ঞসেনী— মহুয়া, পলাশের বন্ধু অরিন্দম আজ আমার কাছে জানতে চাইল যে কী কারণে বিয়েটা ভেঙে গেল আমাদের। আর আমি সেই বিকেল থেকে চুল ছিঁড়ছি, মাথা ঠুকছি, হাত কামড়াচ্ছি কিন্তু কিছুতেই কোনও কারণ মনে করতে পারছি না! মহুয়া তুই আমাকে হেল্প কর, তুই তো জানিস আমার বিয়ে ভাঙার কারণটা? তোকে তো বলেছি!

না, বলিসনি কখনও, আমিও জিজ্ঞেস করিনি!

হে ভগবান, এবার কী হবে মহুয়া— কে বলে দেবে কারণ?

শান্ত হ যোগী! বলে উঠে গেল মহুয়া। থার্মোমিটার হাতে ফিরে এল,— বহু যুগ ধরে আমরা লড়তে চেয়েছিলাম, আমরা লড়েছি! কারণে কী যায় আসে? মহুয়ার গলাটা নিষ্ঠুর শোনায়— ইভেন, আমার নিজেরও কোনও কারণ মনে পড়ে না এখন!

কারণটা না বুঝে লড়েছি বলেই কি আমাদের লড়াই কখনও শেষ হয় না, মহুয়া? বলল যাজ্ঞসেনী।

দেশ, ২ জুলাই ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *