৬
নাহিদ পরের দিন মাগরিবের নামাযের পর নাহিদাদের বাড়ি রওয়ানা দিল। আবুল হোসেন সাহেব বিকেলে বেরিয়ে গেছেন। এখনও ফিরেন নি।
আজ নাহিদা নিজেই রান্না করেছে। ফুল আনিয়ে ড্রইংরুম, ডাইনিংরুম ও বারান্দা সাজিয়েছে। সব কাজ সেরে গোসল করে মাগরিবের নামায পড়ল। তারপর হালকা আকাশি কালারের সালওয়ার, কামিজ ও সাদা ওড়না গায়ে দিল। মাথাটা কালো রুমাল দিয়ে চুলসহ বাঁধল। উত্তর বাংলায় শীত একটু আগে নামে। গোসল করার ফলে নাহিদার শীত লাগাতে ওড়না রেখে শাল গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে রেলিং ধরে নাহিদের আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইল। সন্ধ্যার পর থেকে ছাদের কার্নিসের নিচে একটা ফ্লাড লাইট সারারাত জ্বলে। তার আলোতে বাড়ির সামনের অংশটা দিনের মতো আলো হয়ে থাকে। গেট থেকে নাহিদের গাড়ি ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এল।
সে আসার আগে বাড়ির চাকর আজাদ দরজা খুলে দিয়েছে। নাহিদ ঢুকে নাহিদাকে দেখে সালাম দিল।
নাহিদা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, উপরে চলুন।
নাহিদ তার পিছনে যেতে যেতে বলল, এই, আপনি করে বলছ কেন?
: এ বাড়িতে যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ আমরা আপনি সম্বোধনে কথা বলব। আঙ্কেল ও আন্টির সামনে তুমি করে বলতে আমার ভীষণ লজ্জা করবে। তাছাড়া আঙ্কেল হয়তো তোমার সামনেই এমন ইয়ার্কি করবে, যা আমি সহ্য করতে পারব না।
নাহিদ বলল, তোমার আঙ্কেল ও আন্টির সামনে আপনি করে বললেও অন্য সময় কিন্তু তুমি করেই বলব।
উপরে এসে নাহিদা বলল, কোথায় বসবে, ঘরে না বারান্দায়?
: বারান্দায়।
: শীত করবে তো?
: তেমন শীত পড়ে নি।
নাহিদা বারান্দায় এসে নাহিদকে বসতে বলে চীক ফেলে দিয়ে তার সামনের সোফায় বসল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এখন কী খাবে বল।
: তুমি যা খাওয়াবে।
: একটু বস আমি অন্টিকে খবরটা দিয়ে নাস্তা নিয়ে আসছি। আঙ্কেল এখনও ফিরে নি।
নাহিদা যাবার কয়েক মিনিট পরে জোহরা বেগম এলেন।
নাহিদ দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন চাচি আম্মী।
জোহরা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, থাক বাবা থাক, বস। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। আমি একবার মাত্র তোমাকে দেখেছিলাম। তোমার চাচা একবার তোমাদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সে সময় তুমি বেশ ছোট ছিলে। উনি পরে তোমাকে আরও দু’একবার দেখেছেন। তোমাদের কথা প্রায় বলেন। তোমার মা-বাবা কেমন আছেন?
নাহিদ বলল, মাসখানেক আগে বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন ভালো দেখে এসেছিলাম। সিলেট যাবার পথে বাড়ি হয়ে যাব ভেবেছি। চাচা কোথায় গেছেন?
: উনি বিকেলে বেরিয়েছেন, এবার এসে পড়বে। তুমি বস, আমি নাহিদার হাতে নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
জোহরা বেগম চলে যাবার দুতিন মিনিট পর নাহিদা একজন কাজের মেয়ের সঙ্গে নাস্তা নিয়ে এল।
নাহিদ দেখল, লুচি, মুরগির ঝোল, পাঁচমিশালি ভাজি, হালুয়া ও দুতিন পদের মিষ্টি এবং কয়েক পদের ফল। কাজের মেয়েটা চলে যেতে বলল, আরও কয়েকজন মেহমান আসবেন নিশ্চয়?
নাহিদা বলল, না।
: তাহলে বাড়ির সবাই নিশ্চয় খাবেন?
: তাও না। শুধু তুমি।
: আচ্ছা, তুমি আমাকে কী মনে কর?
: কেন একজন শক্তিশালী ও সামর্থবান ইয়াংম্যান, যিনি জুডো, ক্যারাট, ফুটবল ও সাঁতারে পারদর্শী।
: এসব খবর জানলে কেমন করে?
: যেভাবেই জানি না কেন, মিথ্যা তো আর বলি নি।
: তাই বলে পাঁচ-ছয় জনের খাবার একা খাব ভাবলে কী করে?
নাহিদা মৃদু হেসে বলল, সব খাবার খেতে হবে বলেছি নাকি? যতটা পার খাবে।
এমন সময় আবুল হোসেন সাহেব সেখানে এসে বললেন, কী হে ইয়াংম্যান, তাহলে সত্যি সত্যি বাবার বন্ধুর বাড়িতে এলে?
নাহিদ সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে এলে বললেন, আমার মতো লোককে সালাম করলে নেকি হবে না, বস। তারপর তোমার মা-বাবার খবর কী? নিয়াজকে কতবার চিঠি লিখে জানালাম, সবাইকে নিয়ে কয়েকদিন বেড়িয়ে যেতে। বেড়াতে আসা তো দূরের কথা, একটা চিঠিরও উত্তর দিল না।
নাহিদ বলল, আব্বা স্কুলের হেডমাস্টার। স্কুল নিয়েই সব সময় মেতে থাকেন। উনি মনে করেন, গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গেলে স্কুলের ক্ষতি হবে। তবে গত মাসে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম তখন আমাকে বললেন, খুব শিগগিরই আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, তোমার বাবার কথা আমার জানা আছে। দেখছ না, তার খুব শিগগির এক মাস পর হয়ে গেছে। এক বছর পার হলেও অবাক হব না। এখন তার কথা থাক। দেখছি ইয়াং গার্ল নাস্তা পরিবেশন করে রেখেছে। তারপর নাহিদার দিকে চেয়ে বললেন, কিরে আমি এখানে খাব, না ভিতরে খাব?
নাহিদা মিষ্টি ধমকের সুরে বলল, আঙ্কেল, বাঁচালরাই কিন্তু বেশি কথা বলে। কথা না বাড়িয়ে খেতে বস।
: শুনলে হে ইয়াংম্যান, তোমার সামনেই বাপের বড় ভাইকে বাঁচাল বলছে। বিদেশে লেখাপড়া করে মেয়েটা একদম ভেঁপো হয়ে গেছে। তারপর খেতে বসে নাহিদাকে উদ্দেশ করে বললেন, দাঁড়া, আমার এই বন্ধুর ছেলেটাকে দিয়ে তোকে শায়েস্তা করতে হবে।
নাহিদার কণ্ঠে আবার মিষ্টি ধমকের সুর বেজে উঠল, দাঁড়াও আন্টিকে ডেকে নিয়ে আসি। সে ছাড়া কেউ তোমার মুখে লাগাম পরাতে পারবে না। এই কথা বলে ডেকে আনার ভান করে দরজার বাইরে এসে পর্দার আড়ালে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইল, তার অনুপস্থিতিতে আঙ্কেল নাহিদকে কী বলে শোনার জন্য।
আবুল হোসেন সাহেব নাহিদকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটা যেন কী?
: নাহিদ।
হেসে উঠে আবুল হোসেন সাহেব বললেন, নাহিদ আর নাহিদা, খুব মজার ব্যাপার তাই না?
নাহিদ ওঁর মনোভাব বুঝতে পেরে খুব লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে খেতে লাগল।
: কী হে ছোকরা কিছু বলছ না কেন? এত লজ্জাই বা পাচ্ছ কেন? নাহ, তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তারপর দরজার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, আমি তোমাদের দুজনের ইয়ে-টিয়ে জেনে মনে করেছিলাম, তোমরা বেশ খানিকটা এগিয়েছ, কিন্তু সে রকম কিছু বুঝতে টুঝতে পারছি না।
নাহিদ লজ্জা ঢাকা দেবার জন্য বলল, আপনি কী সব বলছেন, বুঝতে পারছি না।
: নাহ্, সত্যিই তুমি একটা হোপ্লেস মার্কা ছেলে। আরে বাবা, আমি তোমার বাবার মতো গাধা চরিয়ে গরু হই নি। এই কথার মানেও বোধহয় বুঝতে পার নি? আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি শোন, স্কুলের ছাত্ররা হলো গাধা, আর সেই গাধাদেরকে যারা মানুষ করতে করতে বারো বছর পার করে দেয় তারা গরু হয়ে যায়। তারপর নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠে বললেন, আমি মানুষ চরিয়ে বুড়ো হয়েছি। কারো চোখ-মুখের দিকে তাকালে তার মনের খবর বুঝতে পারি। আমার ভাইঝি একটু রাগি হলে কী হবে, এতদিন ধর্মীয় গুণ ছাড়া সর্বগুণে গুণান্বিতা ছিল। মনে হচ্ছে ইদানিং তোমার পাল্লায় পড়ে সেই গুণও অর্জন করতে শুরু করেছে। খুব তেজী মেয়ে। পোষ মানাতে একটু সময় লাগবে। তুমি নিয়াজের ছেলে, পোষ মানাতে যে পারবে সে বিশ্বাস আমার আছে। একটা কথা মনে রেখ হে ছোকরা, তেজী ঘোড়াকে পোষ মানান যেমন পৌরুষ, তেমনি আনন্দও কম না।
নাহিদা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্কেলের কথা শুনে যেমন রেগে যাচ্ছিল, তেমনি আনন্দও পাচ্ছিল। আন্টিকে আসতে দেখে ফিরে এসে একটা চেয়ারে বসল।
আবুল হোসেন সাহেব তার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বললেন, মেহমানকে খেতে দিয়ে চলে যাওয়া খুব অভদ্রতা। এতদিন ফরেনে থেকে এলি, অথচ এই সাধারণ ভদ্রতা জ্ঞানটুকুও শিখিস নি।
জোহরা বেগম এসে স্বামীর কথা শুনতে পেয়ে তাকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি কী বল তো? বন্ধুর ছেলের সামনে ওকে বকাঝকা করছ?
: করবো না মানে, একশোবার করব। কেউ অন্যায় করলে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানে অপরাধীকে প্রশয় দেওয়া। ততক্ষণে খাওয়া শেষ হয়েছে, হাতমুখ ধুয়ে বললেন, চা দাও।
জোহরা বেগম বললেন, সারাজীবন আমাকে লেকচার শুনিয়ে পোষাল না, এবার ওকে দিতে শুরু করেছ। লেকচার বন্ধ করে ঘরে যাও, আমি চা নিয়ে আসছি।
আবুল হোসেন সাহেব নাহিদকে উদ্দেশ করে বললেন, শুনলে বাবা তোমার চাচির কথা? ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি, তবে তোমাকে যা বললাম মনে রেখ, তারপর তিনি চলে গেলেন।
জোহরা বেগম স্বামীর জন্য এক কাপ চা তৈরি করে নিয়ে চলে গেলেন।
ওঁরা চলে যাওয়ার পর নাহিদা বলল, আঙ্কেলকে কেমন মনে হলো?
: যা শুনেছিলাম তার চেয়ে বেশি দেখলাম। উনি যা বললেন, তাতে লাইন যে অল ক্লিয়ার, তা স্পষ্ট।
: এবার তাহলে কী করবে?
: তুমি বললে, এক্ষুনি প্রস্তাবটা দিতে পারি।
: লজ্জা করবে না?
: করত, যদি তোমার আঙ্কেলের সঙ্গে আলাপ না হতো। কী বলব নাকি?
নাহিদা লজ্জিত স্বরে বলল, কাল বললাম না সিলেটে যাবার পর যা করবার করবে?
: এরপর তোমাকে না দেখে বেশিদিন থাকতে পারব না, তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করবে।
: থাকতে না পারলে চলে আসবে।
: তুমি তো বলেই খালাস, আমি চাকরি করি না।
: তাহলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে।
: আচ্ছা, আমাকে না দেখে তুমি থাকতে পারবে?
: না।
: তাহলে আমাকে বললে যে?
: তোমার মতো আমিও চাকরি করি, তাই।
: তুমি দেখছি সাংঘাতিক মেয়ে। তোমার আঙ্কেলের কথাই ঠিক, তোমাকে পোষ মানাতে বেশ বেগ পেতে হবে।
নাহিদা বড় বড় চোখ বের করে বলল, কী বললে?
: আঙ্কেল তো তাই বললেন। আরও অনেক কিছু বলেছেন, শুনবে নাকি?
: এবার হেসে ফেলে বলল, আমি সব পর্দার আড়াল থেকে শুনেছি।
: তাহলে বাধা দিচ্ছ কেন? দু’একদিনের মধ্যে বিয়ে করে নিয়েই যেতে পারি?
: এটা তুমি চাইলেও আমি চাই না।
: কেন?
: ভীষণ লজ্জা পাবে।
: লজ্জা তো নারীর ভূষণ। হাদিসে আছে, “লজ্জা ঈমানের অর্ধেক।” হাদিসে আরও আছে “যার লজ্জা নেই, তার ঈমানও নেই।”
: তবে এখন কিছু বলতে পারছি না।
: ঠিক আছে, যখন বলবে তখন করব।
: রাগ করলে?
: না, বরং খুশি হয়েছি।
: শুনে আমিও খুশি হলাম। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, সাড়ে নটা বাজে। এবার ভাত খেলে হতো না?
: হ্যাঁ খাব।
সবাই এক সঙ্গে খেতে বসেছে। নাহিদা নাহিদের পাতে এটা সেটা তুলে দিচ্ছে।
জোহরা বেগম দেখেও দেখছেন না। কিন্তু আবুল হোসেন সাহেব এক সময় ভাইঝিকে বললেন, কী ব্যাপার? এখানে কি শুধু মেহমানই আছে? বুড়ো আঙ্কেলের দিকে চোখ পড়ছে না বুঝি? তারপর নাহিদকে উদ্দেশ করে বললেন, তোমার পছন্দ খুব ভালো। আমার ভাইঝির মতো মেয়ে আর পাবে না। তবে তার একটাই দোষ….
আঙ্কেলকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে নাহিদা মেকী রাগ দেখিয়ে আন্টিকে বলল, তুমি আঙ্কেলকে কিছু বলবে, না আমি চলে যাব?
জোহরা বেগম স্বামীর কাছ থেকে তাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই শুনেছেন। নাহিদকে ওঁরও খুব পছন্দ। স্বামীর কথা শুনে মনে মনে খুব হাসছিলেন। নাহিদার কথা শুনে কপট রাগের সঙ্গে স্বামীকে বললেন, তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান কোনোদিন হবে না?
আবুল হোসেন সাহেব বললেন, তা নাই হোক, তবু ওকে আজ বলতে হবে কেন ও এতদিন আমাকে বলে এল বিয়ে করবে না? স্বীকার করলাম, নাহিদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে না হয় ওর মত পাল্টেছে। সে কথা আমাকে না জানিয়ে ওর সঙ্গে ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছে কেন? এটাই বুঝি ওর বুদ্ধিমত্তার পরিচয়?
তারপর নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে মিস্টার নাহিদ, তোমারও অনেক কিছু জানি, সে সব আর বললাম না। এখন ভালো ছেলের মতো বল দেখি, এই ভেঁপো মেয়েটাকে বিয়ে করে শায়েস্তা করতে পারবে, আমার মতো সারাজীবন বউয়ের কথায় উঠবে আর বসবে? খুব সাবধান, বউয়ের কথা শুনেছ কি মরেছ; ওদেরকে একদম লাই দিবে না, ওরা হল বানরের জাত। বানরকে আদর করে কাঁধে নিলে আর নামতে চায় না। তেমনি বউকে লাই দিলে সে আর তোমার কথামতো চলবে না। বরং সেই তোমাকে তার কথা মতো চালাবে। তবে আমার মনে হয়, তুমি ওকে শায়েস্তা করতে পারবে। তোমার সাথে আলাপ হবার পর থেকে ওর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বিয়ের পরও যদি একটু শক্ত থাক, তাহলে বাকিটুকুও হয়ে যাবে।
ওঁর কথা শুনে সবারই খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, তা লক্ষ করে হাত মুখ ধুয়ে চলে যেতে যেতে বললেন, খেয়ে আর দরকার নেই বাবা; কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো
কী সব বলে ফেললাম। ভেঁপো মেয়েটা আবার কী করতে কী করে বসে?
এরপর জোহরা বেগম সেখানে থাকতে পারলেন না। তিনিও হাত মুখ ধুয়ে স্বামীর পথ ধরলেন।
ওরা দু’জন পরস্পরের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল।
আঙ্কেলের উপর রাগে ও অভিমানে নাহিদার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।
তাই দেখে নাহিদ নরম সুরে বলল, আঙ্কেলের উপর খুব রাগ হয়েছে না? আমার কথা শোন, ওঁর কোনো ছেলেমেয়ে নেই। আর উনি খুব সহজ সরল মানুষ। সেজন্য বন্ধু-বান্ধবও তেমন নেই। তোমাকে ও আন্টিকে নিয়ে তার জীবন। তাই তিনি স্ত্রী ও ভাইঝিকে বন্ধু-বান্ধবী মনে করে সেই রকম ইয়ার্কি ফাজলামি করেন। আমার মনে হয়, উনি বোধহয় নিজের জীবনের চেয়ে তোমাকে বেশি ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। তোমার ভবিষ্যতের ভালোমন্দ নিয়ে ভীষণ চিন্তা করেন।
নাহিদা চোখ মুছে বলল, তা আমি জানি নাহিদ। কিন্তু কথাগুলো খাওয়ার পরেও বলতে পারত। সারাদিন কত পরিশ্রম করে নিজের হাতে রান্না করলাম তা কারো ভালোমতো খাওয়া হলো না। জান, আঙ্কেল আমার হাতের রান্না খুব ভালোবাসে। যেদিন আমি রান্না করব, সেদিন খেতে বসে মুখে দিয়ে আন্টিকে। বলবে, তুমি তো সারাজীবন আধপেটা খাইয়ে রেখেছ। এই ভেঁপো মেয়েটা যেদিন রাধে সেদিন তবু পেট পুরে খেতে পাই। আমি তখন বলি, ছি আঙ্কেল, অমন করে বলতে নেই, আন্টির মনে কষ্ট হবে। শুনে আঙ্কেল হো হো করে হেসে উঠে বলে, নারে পাগলি না। আমি যে ইয়ার্কি করছি তা তোর আন্টি জানে। তবে এটা ঠিক, তার চেয়ে তোর রান্নার হাত ভালো। দেখিস নি যেদিন তুই রাধিস, সেদিন বেশি খেয়ে হাইফাই করি। এমন অ্যাকটিং করে বলবে, যা শুনে আমি আর আন্টি হাসি চেপে রাখতে পারি না।
নাহিদ বলল, সত্যিই তোমার আঙ্কেলের মতো মানুষ হয় না। তারপর বলল, ওঁরা না খেলেও আমি খেয়ে পুষিয়ে দেব। কাদুর বাপের রান্না খেতে আর ভালো লাগে না।
কথাটা শুনে নাহিদার মন ব্যথায় ভরে গেল। ভাবল, বেচারা কতদিন মেয়েদের হাতের রান্না খায় নি। বলল, আমার আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি ধীরে ধীরে খাও। দেখে আমি তৃপ্ত হই।
রাত প্রায় এগারোটার সময় নাহিদ তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরল। আসবার সময় নাহিদাকে বলে এসেছে, কাল চলে যাচ্ছি। তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করবে। তারপর একা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বলল, চিঠি ও ফোনের অপেক্ষায় থাকব।
নাহিদা জিজ্ঞেস করেছিল, প্রথমে কোথায় উঠবে?
: কেন? তোমার খালার বাসায়। আর যদি বুকের পাটা থাকে, তাহলে আমার বাসায় উঠতে পার।
: পারব না কেন? তুমি কি বাঘ ভালুক যে, আমাকে খেয়ে ফেলবে।
: তার চেয়েও ভয়ংকর।
নাহিদা হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে দেখা যাবে।
তাই দেখ-বলে নাহিদ সালাম বিনিময় করে চলে এসেছে।