২
নাহিদা বিরক্ত গলায় বলল, চাপাবাজি মারার আর জায়গা পেলি না। এ যেন রূপকথার রাজপুত্র, কোনো দোষই নেই। এতবেশি ভালো বিশ্বাস হয় না। মানুষ মাত্রেই দোষ-গুণ থাকবে। তারপর বলল, গুণের কথা তো অনেক বললি, দেখতে কেমন তা তো বললি না। তোর যা রূপ, যেমন তেমন ছেলেকে তো তুই পছন্দ করবি না। মনে হয় রূপকথার রাজপুত্রের মতো নিশ্চয় সুন্দর? আর তা না হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।
শর্মিলা বলল, দুঃখের পালা শেষ হয়েছে। এবার সুখের পালা। তোর অনুমান ঠিক; তবে একেবারে রূপকথার রাজপুত্রের মতো দেখতে না হলেও প্রায় কাছাকাছি। ওকে দেখলে তোর মাথা ঘুরে যাবে। যা দারুণ দেখতে না, তোকে সে কথা ভাষায় বলতে পারব না। ওকে দেখার জন্য মন খুব উতলা হয়ে উঠেছে। মনে হয় এক্ষুনি তার কাছে ছুটে যাই। ওর জন্যে আমি সব করতে পারি। এমনকি প্রয়োজনে প্রাণও দিতে পারি। তুই তো জানিস, শর্মিলার সঙ্গে একটু আলাপ করার জন্য কত ছেলে পাগলের মতো পিছনে পিছনে ঘুরঘুর করত। এখন সেই শর্মিলা এমন একজনকে পেয়েছে যে, সে নিজেই তার পিছনে ঘুরঘুর করার জন্য পাগল হয়ে রয়েছে। তারপর বুকের জামার ভেতর থেকে একটা প্লাসটিকের খাম বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, মাথা ঠিক রাখবি কিন্তু।
নাহিদা খাম থেকে ছবিটা বের করে দেখেই চমকে উঠল। মনে হলো, তার হার্টবিট বুঝি বন্ধ হয়ে গেল। নাহিদ হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা সাঁতারের ড্রেস পরে সুইমিং পুলের উপর দু’হাত কোমরে রেখে ঝাঁপ দেবার আগেই ফটোটা তোলা হয়েছে। তার সুঠাম ও বলিষ্ঠ শরীরের দিকে চেয়ে নাহিদা নিশ্বাস নিতে ভুলে গেল। সে নাহিদের এত গুণের কথা জানত না। আরও জানত না, এমন সাদাসিধে ক্যাবলাকান্ত ঢিলে-ঢোলা প্যান্ট ও ঝোলা পাঞ্জাবি পরা পুরুষটার মধ্যে এরকম একটা চমৎকার শরীর লুকিয়ে থাকতে পারে। লোমে ভর্তি চওড়া বুক, সুগঠিত হাত পা, মরালের মতো গ্রীবা, যা দেখলে যে কোনো নারী প্রলুব্ধ না হয়ে পারবে না। সব মেয়েরাই এ রকম পুরুষ কামনা করে। তাই নাহিদাও নাহিদের শারীরিক সৌন্দর্য দেখে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল, বারান্দায় কলিং বেলের শব্দে হুঁশ হতে আস্তে আস্তে শর্মিলার মুখের দিকে তাকাল।
শর্মিলা বলল, খুব অবাক হয়েছিস না? ও একজন দক্ষ সাঁতারুও। ভাইয়ার কাছে শুনেছি, গত বছর সাফ গেমসে সাঁতারে দু’টো স্বর্ণপদক পেয়েছে।
নাহিদার তখন কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়ে গোসল করার ঘটনা মনে পড়ল-খালাতো ভাইবোনদের সঙ্গে গোসল করার সময় নাহিদা যখন নাহিদকেও গোসল করতে বলল, তখন নাহিদ বলেছিল, গোসলের সময় সাঁতার না কাটলে তৃপ্তি পাওয়া যায় না। নাহিদা বলল, সাঁতার কাটতে আপনাকে কে নিষেধ করছে? নাহিদ মৃদু হেসে বলেছিল, সাঁতারের ড্রেস আনতে ভুলে গেছি। ড্রেস ছাড়া আমি কখনো সমুদ্রে সাঁতার কাটি নি। সাঁতার কাটতে কাটতে সমুদ্রের ভিতর এক দেড় কিলোমিটার না গেলে তাকে সাঁতার বলে না। তার কথা শুনে নাহিদা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলেছিল, ঐরকম সাঁতারুরা কোনোদিন ড্রেস নিতে ভুল করে না। নাহিদ তখন মুখের অবস্থা এমন করেছিল, যেন সত্যি সত্যিই সে বিদ্রুপের পাত্র।
এখন শর্মিলার কথা শুনে ও নাহিদকে সাঁতারের পোশাকে দেখে বিশ্বাস হলো, সেদিন নাহিদ সত্যি কথাই বলেছিল। অথচ বিদ্রূপটা কেমন সহজে মেনে নিয়ে তা চেহারার মধ্যে প্রকাশ করেছিল। সেকথা মনে করে নাহিদা নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেল।
শর্মিলা তাকে এতক্ষণ ধরে ছবির দিকে চেয়ে থাকতে দেখে খুশি হলো। বলল, কিরে, ছবি দেখে কি মনে হচ্ছে, মানুষটার মধ্যে এত গুণ থাকতে পারে?
নাহিদা বলল, সব বিশ্বাস না হলেও কিছু কিছু হচ্ছে। তারপর শর্মিলা যাতে তার মনের অবস্থা বুঝতে না পারে, সেইরকম ভাব প্রকাশ করে বলল, এমন একটা সাধারণ ছেলের মধ্যে ভালো লাগার মতো কী আছে, যা দেখে তুই এত পাগল হলি? তুই বললি ছবি দেখে আমার মাথা ঘুরে যাবে। কিন্তু মাথা ঘোরা তো দূরের কথা, এতক্ষণ ধরে দেখেও আমি আকর্ষণীয় কিছু খুঁজে পেলাম না। তবে যে সব মেয়েরা শরীর ছাড়া কিছুই বোঝে না, সে সব মেয়েরা অবশ্য একে পেতে চাইবে। ভাবতে খুব অবাক লাগছে, তোর মতো মেয়ে এরকম একটা ছবি বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস।
শর্মিলা হাসি চেপে রেখে বুকের জামার ভিতর থেকে আর একটা প্লাস্টিকের খাম বের করে নাহিদার হাতে দেবার সময় বলল, তুই যে শরীরের চাওয়া পাওয়ার কথা বললি, তা অস্বীকার করব না। তবে একটা কথা বোধহয় তোর জানা নেই, কোনো শিক্ষিত ছেলেমেয়েই শুধু শরীরের চাওয়া পাওয়ার জন্য একে অপরকে ভালোবাসে না। যদিও শরীরের চাহিদা ও ভালোবাসা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তবুও তাদের মধ্যে তফাত অনেক। শরীরের চাহিদা আর ভালোবাসা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
নাহিদা দ্বিতীয় ছবিটা দেখে আরও অবাক হলো। নাহিদ সাদা রং-এর কাবলি স্যুট ও মাথায় সাদা গোল টুপি পরে একটা বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে আছে। নাহিদার মনে হলো, একজন যুবক দরবেশ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নাহিদের এই রূপ দেখে নাহিদার চোখ যেমন জুড়িয়ে গেল, তেমনি মনটা অজানা এক আনন্দে ভরে গেল।
শর্মিলা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, কিরে এবার কী রকম দেখছিস?
নাহিদা সংযত স্বরে বলল, তুই একে ভালোবাসিস, আমার দেখার সঙ্গে তোর দেখার মিল হবে না। তোর মনের মানুষ মিললেও আমার এখনও মিলে নি। মিললে তখন হয়তো তোর মতো আমার দৃষ্টিশক্তি হবে। আমি এই মানুষটাকে চিনি না, জানি না। শুধু ছবি দেখে মানুষের ভালো-মন্দ বোঝা যায় না। তবে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, তোর মতো সুন্দরী ও অত্যাধুনিকা মেয়ে একটা দরবেশ ধরনের ছেলের জন্য পাগল হয়েছিস। আবার পোশাক পরিচ্ছদও পরিবর্তন করেছিস। এই সব বিশ্বাস করতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে।
শর্মিলা বলল, দেখ নাহিদা, তোর সঙ্গে আমার অনেক দিন থেকে গভীর সম্পর্ক থাকলেও তুই আমকে পুরোপুরি বুঝেছিলি বলে মনে হয় না। আমি সব সময় হাসি-খুশি ও চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। বিভিন্ন ছেলেদের সঙ্গে ডেটিং করে বেড়াই। তাই তোর ধারণা, গভীরতা বলতে আমার কিছু নেই। আমি কোনোদিন কোনো ছেলেকে ভালোবাসতেই পারব না। তোর ধারণা কতটা সত্য বলব না, তবে একথা জেনে রাখিস, অক্সফোর্ডের শর্মিলা নামের যে ছাত্রীটি তোর বান্ধবী ছিল, সে এই শর্মিলা নয়। এই শর্মিলা অনেক বদলে গেছে। মানুষ কখন বদলাবে, তা কেউ জানে না। জানে শুধু সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্। “তারই ইশারায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলছে। তিনি যাকে ইচ্ছা হেদায়েত দান করেন। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত কেউ হেদায়েত প্রাপ্ত হয় না। এটা কোরআন পাকের কথা। মনে হচ্ছে তুইও অনেক বদলে গেছিস। তাই হয়তো আমরা একে অন্যকে চিনতে পারছি না, বুঝতে পারছি না। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপু করে থেকে বলল, তুই যে দরবেশ ছেলেটার কথা বললি, নদী যেমন সাগরে মিশবার জন্য অশান্তর মতো প্রবাহিত হয়, তেমনই ওকে পাবার জন্য আমার মনও অশান্ত হয়ে উঠেছে। তুই যদি কাউকে ভালোবাসতিস, তা হলে আমার কথাগুলো বুঝতে পারতিস। এবার থাক আমার কথা, যে তোকে লিফট দিচ্ছে তার কথা বল।
নাহিদা শর্মিলার কথা শুনে ক্রমান্বয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হচ্ছে। সেই সাথে তার প্রতি ঈর্ষায় নাহিদার মন ভরে উঠছে। তবু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তার কথা বলার মতো কিছু নেই। ঢিলে-ঢালা পোশাক পরা একটা সাধারণ ছেলে। দেখলে গেঁয়ো গেঁয়ো মনে হয়। তারপর ছবি দুটো ফেরত দিয়ে বলল, এর বেশি তার সম্বন্ধে কিছু বলার নেই।
শর্মিলা বলল, এবার চলি, ওরা সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
শর্মিলা চলে যাবার পর নাহিদার শরীর ও মন দুটোই খারাপ লাগতে লাগল। বার বার নাহিদের ছবি দুটো চোখে ভেসে উঠছে। ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করল। হঠাৎ মনে হলো, শর্মিলার সাথে কথা বলার সময় নাহিদ যদি এসে পড়ত, তা হলে কী হতো? কথাটা ভেবে চমকে উঠল। জীবনে এই প্রথম নিজের অজান্তে তার মুখ থেকে বিড়বিড় করে বেরিয়ে গেল, আল্লাহগো, নাহিদ ফিরে আসার আগে শর্মিলা যেন এখান থেকে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে শর্মিলা এসে বিদায় নিয়ে চলে যেতে নাহিদা অনেকটা স্বস্তিবোধ করল। একটা কথা তার বার বার মনে হতে লাগল, অমন গোবেচারা ছেলের মধ্যে এত গুণ কী করে থাকতে পারে? সিদ্ধান্ত নিল, সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখতে হবে।
নাহিদ মাগরিবের নামাযের পর ফিরে এসে নাহিদার দরজায় টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
নাহিদার কিছু ভালো লাগছিল না। সে রুমের পিছনের বারান্দায় চেয়ারে বসে রাস্তার যানবাহন ও লোকজনের চলাচল দেখছিল। দরজায় টোকা দেবার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে নাহিদকে দেখে স্বভাব বশতঃ চোটপাট দেখিয়ে দেরিতে ফেরার কৈফিয়ত চাইতে যাচ্ছিল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শর্মিলার কথাগুলো মনে পড়তে সামলে নিল। তখন নাহিদের দিকে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা বোধ করল। মাথা নিচু করে বলল, আপনি রুমে যান, আমি আসছি।
নাহিদ বেশ একটু অবাক হয়ে রুমে এসে কলিং বেলের সুইচে চাপ দিয়ে ভাবল, হঠাৎ মেয়েটার পরিবর্তন হলো কেন? দেরি করে ফেরার জন্য এটা কি তার রাগ, না অভিমান?
হোটেল বয় আসার পর তাকে চা-নাস্তার অর্ডার দিল।
সে চা-নাস্তা দিয়ে যাবার একটু পরে নাহিদা দরজার বাইরে এসে বলল, আসতে পারি?
: আসুন।
নাহিদা ভিতরে ঢুকে বলল, বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
: না হয় নি। তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে এত দেরি হলো। দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন নাস্তা খেয়ে নিই।
নাস্তা খাওয়ার সময় কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু মাঝে মাঝে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে ধরা পড়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে।
চা খেতে খেতে নাহিদ বলল, আপনাকে একা রেখে এতক্ষণ বাইরে থাকা আমার উচিত হয় নি। সে জন্য ক্ষমা চাইছি। বিশ্বাস করুন, বন্ধুটার সঙ্গে দেখা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
নাহিদা বলল, এতে ক্ষমা চাওয়ার কী আছে। আমি ফরেনে মানুষ হয়েছি। একা থাকা আমার অভ্যাস আছে। আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?
: গাজীপুর।
: আমার দিনাজপুর সদরপুর গ্রামে। আচ্ছা, ধর্ম সম্বন্ধে আপনার ধারণা কী?
: হঠাৎ ধর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছেন কেন?
: না, মানে এমনি হঠাৎ মনে হলো, তাই ….।
নাহিদ অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ধর্মের আভিধানিক অর্থ অনেক। তার মধ্যে প্রকৃত এবং প্রধান অর্থ হলো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ পাকের আইন। তিনি যুগে যুগে মানুষকে ভালোভাবে জীবন যাপন ও তাঁর উপাসনা করার জন্য যে সব আইন প্রেরণ করেছেন, সেইগুলোকে ধর্মীয় আইন বলে। যারা তাঁকে বিশ্বাস করে এবং তাঁর আইন মেনে চলে তাদেরকে ধার্মিক বলে। প্রত্যেক মানুষের উচিত, সৃষ্টিকর্তার আইন মেনে চলা।
: ধর্মের অর্থ যদি তাই হয়, তা হলে ধর্মে গোঁড়ামিত্ব এল কেন?
নাহিদ মৃদু হেসে বলল, আসলে ধর্মে যেমন গোঁড়ামি নেই, তেমনি জোর জবরদস্তিও নেই। যারা ধর্মের গোঁড়ামির কথা বলেন, তারা আসলে ধর্ম সম্বন্ধে খুব কম জ্ঞান রাখেন। যেমন ধরুন, আমরা সবাই বাজারের গরু, মহিষ ও খাসির গোশত কিনে এনে খাই। আর সেটা আমাদের জন্য হালাল। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বাজারের এইসব গোশত খায় না। তারা বলে, যারা ঐ সব পশু জবেহ করছে, তাদের মধ্যে অনেকে রোজা নামায করে না। এমনকি পেশাব করে পানিও নেয় না। পাক-নাপাক কী জিনিস তাও জানে না। তাদের হাতের গোশত খাওয়া ঠিক নয়। এখন আমরা ঐ সব লোকদের গোঁড়া বলি। কিন্তু আমরা যদি তাদের এই কথাগুলো বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে, তারা ঠিক কথাই বলেছে এবং আমরাই বরং তাদেরকে গোঁড়া বলে ভুল করছি। কারণ, যারা যে কাজই করুক না কেন, সবাইকেই ধর্মের আইন অনুসারে করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ ধর্মের আইনের তোয়াক্কা না করে, যে যার ইচ্ছামতো কাজ করছে। অনুরূপভাবে মানুষের গোঁড়ামির অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যা কিছু করছি, তা আল্লাহ পাকের আইন মোতাবেক নয়। তাই যারা মানুষকে আল্লাহপাকের আইন মোতাবেক সব কিছু করার জন্য ঐ সবের প্রতিবাদ করছে, তাদেরকে আমরা গোঁড়া বা মৌলবাদী বলি। আসলে আমরা যদি আল্লাহপাকের আইন সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতাম, তাহলে গোঁড়া বা মৌলবাদী ভেবে যাদেরকে ঘৃণা করি, তাদেরকে তা ভাবতাম না। কিছু মনে করবেন না, এবার আমি ধর্ম সম্বন্ধে আপনার ধারণা জানতে চাই।
নাহিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখুন, ধর্ম সম্বন্ধে আমি একরকম কিছুই জানি না, কী করে বলব বলুন।
: তবু ভালো না মন্দ এটাও তো বলতে পারেন।
: ধর্মকে আমি ভালো মনে করি; কিন্তু ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি আমি পছন্দ করি না।
: ধর্মও তাই বলে। কিন্তু আপনি ধর্ম ভালো জেনেও ধর্মীয় আইন মেনে চলবেন না, আর ধার্মিক লোকেরা আপনাকে কিছু না বলে চুপ করে থাকবে, এটা তো হতে পারে না। কারণ ধর্মগ্রন্থে আছে, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই।” এই ভাই যদি জেনে অথবা না জেনে ধর্মের আইনের নিষিদ্ধ কোনো কাজ করে, তা হলে অন্য ভাইয়ের কি বাধা দেওয়া উচিত না? তাছাড়া বাধা দেওয়াটাও ধর্মের আইন। অথচ কী আশ্চর্য কথা, যারা বাধা দিচ্ছে তাদেরকে আমরা গোঁড়া বলি। আবার কেউ যদি ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলে তখন যারা তার প্রতিবাদ করে, তা হলে সেটাকেও আমরা ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি বলি। এখন আমি যদি আপনাকে বলি, আপনি মুসলমান ঘরের মেয়ে হয়ে কেন নামায পড়েন না, রোযা রাখেন না, কোরআন হাদিসে মেয়েদেরকে যেভাবে কাপড় পরতে বলা হয়েছে, সেভাবে পারেন না, তা হলে নিশ্চয় আপনি আমাকে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করছি বলবেন অথবা গোঁড়া বলবেন। অথচ আপনি নিজেই বললেন, ধর্মকে ভালো বলে জানেন। আসলে মডার্ন শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা ধর্ম সম্বন্ধে পড়াশুনা না করে ধর্ম কী জিনিস জানে না। তাই তাদেরকে ধর্মের কথা শুনিয়ে কোনো অন্যায় করতে কেউ নিষেধ করলে, তাকে তারা গোঁড়া অথবা ধর্ম সম্বন্ধে বাড়াবাড়ি করছে বলে। এবার এসব কথা থাক, আপনি রুমে যান, আমি এশার নামায পড়ে নিই। তারপর ডিনার খাওয়া যাবে।
ঘুমোবার সময় নাহিদার নাহিদের কথা মনে পড়তে লাগল। কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারল না। ধর্ম সম্বন্ধে নাহিদ যে সব কথা বলেছিল, সেগুলো চিন্তা করতে করতে তার জ্ঞানের দুয়ার খুলে গেল। তার বিবেক বলে উঠল, ধর্মীয় বই পড়ে ধর্মকে জানা প্রত্যেকের কর্তব্য। এখন তার শর্মিলার কথা মনে পড়ল। যার নাকি চরিত্র বলতে কিছু নেই, তার মতো মেয়ে নাহিদকে পাবার জন্য কত চেঞ্জ হয়ে গেছে। সেইসাথে তার প্রতি ঈর্ষায় নাহিদার মন ভরে গেল। এই সব ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, তা জানতে পারল না।
পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে যাত্রা শুরু করল।
আড়াইটার সময় বগুড়ায় পৌঁছে হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে নাহিদ নাহিদাকে বলল, গাড়িতে গরম লাগবে, এখানেই বসুন। আমি যোহরের নামায পড়ে আসি।
সোয়া তিনটায় ওরা আবার যাত্রা শুরু করল।
সকাল থেকে ভীষণ গরম পড়েছে। দুপুরের পর থেকে কোদালে মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। একটুও বাতাস বইছে না। গরমে লোকজন আইঢাই করছে। অবশ্য ওদের কোনো কষ্ট হচ্ছে না। নব্বই পঁচানব্বই কিলোমিটার বেগে নাহিদ গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস ওদের গায়ে লাগছে।
রংপুর টাউনে এসে নাহিদা বলল, একটু চা খেতে পারলে ভালো হতো।
কিছুক্ষণ হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নহিদার কথা শুনে নাহিদ একটা হোটেলের কাছে গাড়ি পার্ক করে তাকে নিয়ে চা খেতে ঢুকল।
চা খাওয়ার সময় জোরে বৃষ্টি নামল। সেই সঙ্গে ঝড়ও শুরু হলো।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেও যখন ঝড়-বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখা গেল না তখন নাগিদ বলল, চলুন রওয়ানা দেওয়া যাক, নচেৎ দিনাজপুর পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।
নাহিদা বলল, তাই চলুন।
গাড়িতে উঠার সময় দু’জনেই ভিজে গেল। রাস্তার ওপারে গাড়ি ছিল। রাস্তা পার হয়ে আনতে যেতে নাহিদ বেশি ভিজেছে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে নাহিদ মাথা ও চোখ-মুখ মোছার সময় নাহিদাকেও মুছতে বলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
নাহিদা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মাথা ও চোখ-মুখ মুছে বলল, আপনার জামা কাপড় একদম ভিজে গেছে, পাল্টে নিলে হতো না?
নাহিদ মৃদু হেসে বলল, এতটুকুতে কিছু হবে না।
নাহিদ সেকেন্ড গিয়ারে গাড়ি চালাচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি ক্রমশঃ বাড়ছে। সৈয়দপুর পার হয়ে দশ পনেরো কিলোমিটার আসার পর এমন অবস্থা হলো, হেড লাইট জ্বেলেও রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। শেষে বাধ্য হয়ে রাস্তার এক পাশে গাড়ি থামাতে হলো। গাড়ির ভিতরের লাইট জ্বেলে ঘড়ি দেখল, সাড়ে পাঁচটা।
নাহিদ সব সময় অযুর সাথে থাকার চেষ্টা করে। বিশেষ করে যখন দূরে কোথাও যায় তখন অযু রাখার জন্য সজাগ থাকে। আজো বগুড়ায় জোহরের নামাজ পড়ে অযু রেখেছে। পরিচিত রাস্তা। কেবলা জানা আছে। নাহিদাকে সিট টপকে পিছনের সিটে যেতে বলে বলল, আমি নামায পড়ব। নাহিদা পিছনের সিটে গিয়ে বসার পর নাহিদ পাশের সিটে সরে এসে বসে বসে আসর, মাগরিব ও এশার নামাজ পড়ল। অবশ্য প্রত্যেক নামাযের বিরতি সময়ে নাহিদার সাথে এই পরিস্থিতির আলোচনা করেছে। এশার নামাযের পরও ঝড়-বৃষ্টি সমানে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জনের সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে এবং দূরে দূরে বজ্রপাতও হচ্ছে। বিদ্যুতের আলোতে দেখতে পেল, তারা মাঠের মাঝখানে রয়েছে। গ্রাম অনেক দূরে।
নাহিদ খুব চিন্তায় পড়ে গেল। নিজের জন্য তার কোনো চিন্তা নেই। সঙ্গে একজন যুবতিকে নিয়ে মাঠের মাঝখানে এই দুর্যোগপূর্ণ রাত কাটাবে কী করে? সেই চিন্তা তাকে অস্থির করে তুলল। মনে মনে দোওয়া ইউনুস পড়তে পড়তে আল্লাহ পাকের কাছে সাহায্য চাইতে লাগল।
এদিকে বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকে দুজনেরই পেশাব পেয়েছে। কিন্তু লজ্জায় কেউ তা প্রকাশ করতে পারছে না। শেষে নাহিদ যখন সহ্য করতে পারল না তখন দরজা খুলে গাড়ির পিছনের দিকে গিয়ে কাজ সারল। তারপর বুট খুলে তার ব্রিফকেস ও নাহিদার চামড়ার সুটকেস নিয়ে গাড়িতে উঠল।
নাহিদ ভিজে জাব হয়ে গেল। গাড়ির ভিতরে এসে নাহিদাকে তার দিকে চাইতে দেখে যা বুঝার বুঝে গেল। বলল, কষ্ট করে আমার মতো আপনিও কাজ সেরে আসুন।
নাহিদা সেই আড়াইটার সময় বগুড়ায় হোটেলে ভাত খাওয়ার পর বাথরুমে গিয়েছিল। তাছাড়া ঠাণ্ডার দিনে সবারই একটু বেশি পেশাবের বেগ হয়। এখন নাহিদার পেশাবের বেগে তলপেট টনটন করছিল। নাহিদের কথা শুনে লজ্জা পেলেও দরজা খুলে গাড়ির পিছনে গিয়ে কাজ সেরে এল।
ততক্ষণে নাহিদ ব্রিফকেস খুলে জামা কাপড় বের করে ভিজে জামা কাপড় খুলে সেগুলো পরে নিয়েছে।
নাহিদা ফিরে এলে তাকে তার সুটকেস দিয়ে বলল, ভিজে কাপড় পাল্টে ফেলুন। তারপর গাড়ির ভিতরের লাইট অফ করে দিল।
নাহিদা বসে বসে কোনো রকমে শুকনো কাপড় পরে ভিজে কাপড়গুলো সিটের নিচে রেখে দিল।
ভিজে গিয়ে দু’জনকেই শীত পাচ্ছে। নাহিদ বলল, চাদর থাকলে বের করে গায়ে দিন। ঠাণ্ডা লেগে অসুখ করতে পারে।
নাহিদার সুটকেসে চাদর ছিল না। তাই দু’টো শাড়ি বের করে দু’ভাজ করে একটা নিজে গায়ে দিল, আর অন্যটা নাহিদকে দিয়ে বলল, নিন আপনিও গায়ে দিন।
নাহিদ কোনো প্রতিবাদ না করে শাড়িটা নিয়ে চাদরের মতো গায়ে জড়াল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনার ভয় পাচ্ছে না-কি?
: পেলেও করার কিছু আছে কি?
: তা অবশ্য নেই। আমি কিন্তু ভয় টয় কী জিনিস জানি না। শুধু আপনি রয়েছেন বলে যা একটু দুশ্চিন্তা।
: দুশ্চিন্তা কীসের?
: আমরা লোকালয় থেকে দূরে রয়েছি। এ সময় যদি দুষ্কৃতিকারীরা হামলা করে? আমি একা থাকলে কোনো চিন্তাই করতাম না। আপনি মেয়েছেলে, তার উপর যুবতি। তবে আপনার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। অন্ততঃ আল্লাহ পাক যতক্ষণ পর্যন্ত আমাকে জীবিত রাখছেন ততক্ষণ কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
: কিন্তু ওরা যদি দলে বেশি থাকে এবং ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে?
: আমার কাছেও লাইসেন্স করা একটা পিস্তল সব সময় থাকে। যদিও দু’আড়াই বছরের চাকরি জীবনে একটিবারও সেটার দরকার পড়ে নি, তবুও সাহেবের অর্ডার মোতাবেক সেটা কাছে রাখি। ওসব কথা বাদ দিয়ে খাবার কথা চিন্তা করুন। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
নাহিদারও একই অবস্থা। তবু তার কথা শুনে হেসে উঠে বলল, কোনো। উপায় যখন নেই তখন আর কী করা যাবে? উপোস থাকতে হবে। আর তা না হলে বলে সুটকেস থেকে বিস্কুটের একটা প্যাকেট বের করে বলল, এগুলে খেয়ে খিদে নিবারণ করি আসুন। যদিও এগুলো খেয়ে কিছু হবে না, তবুও “সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং।”
দু’জনে বিস্কুটের প্যাকেট সাবাড় করল। তারপর নাহিদার পানির বোতল থেকে পানি খেল।
পানি খাওয়ার পর নাহিদা বলল, চা খেতে পারলে যা হতো না?
নাহিদ বলল, যা সম্ভব নয়, তার জন্যে হাপিত্যেশ করে লাভ নেই।
তারপর তারা গল্প করতে লাগল।
গত দুদিন থেকে নাহিদের শরীরটা ম্যাজ ম্যাজ করছিল। তার উপর আজ দু’বার বৃষ্টিতে ভিজে রাত বারোটার সময় কাঁপ দিয়ে জ্বর এল। সিটের উপর পা তুলে বসে কাঁপতে লাগল। খাওয়ার পর লাইট বন্ধ করে তারা গল্প করছিল। ক্রমশ কাঁপুনি বেশি হতে নাহিদ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, এবার একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন, রাত অনেক হয়েছে।
নাহিদার কাছে তার গলার স্বর স্বাভাবিক মনে হলো না। আতঙ্কিত হয়ে বলল, কী ব্যাপার আপনার গলার স্বর কাঁপছে কেন?
নাহিদ কোনোরকমে বলল, আমার বোধহয় জ্বর এসেছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ন।
নাহিদা বলল, সে কী? ভিতরের লাইটটা জ্বালান তো।
লাইট জ্বালানো সম্ভব নয়, নাহিদ বলল।
নাহিদা তার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল, এ কী, জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে!
নাহিদা সব সময় জ্বরের জন্য সিটালজিন, প্যারাসিটামল, নাপা এবং পেটের অসুখের জন্য ক্লীয়ন, মেট্রিল, নিলিগ্রাম, ফ্লাজিল আর মাথাব্যথার ও বমির জন্য স্টিমেটিল ট্যাবলেট সঙ্গে রাখে। দু’টো নাপা ও একটা প্যারাসিটামল নিয়ে সিট টপকে সামনের সিটে এসে লাইট জ্বেলে নাহিদকে খাইয়ে দিল। তারপর নিজের গায়ে যে শাড়িটা ছিল, সেটা তার গায়ে দিল। কিন্তু তাতেও নাহিদের কাঁপুনি থামল না।
নাহিদা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে। নাহিদের তখন কাঁপুনি আরও বেড়েছে। তবু কোনোরকমে বলল, প্লিজ, একটু সরে বসুন। কথা বলতে গিয়ে নাহিদের কাঁপুনির চোটে দাঁতে দাঁত লেগে ঠক ঠক করছে।
নাহিদা তার কথায় কর্ণপাত না করে নাহিদকে দুহাতে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বুকে চেপে ধরে কাঁপুনি থামাবার চেষ্টা করল।
নাহিদের বাধা দেবার মতো ক্ষমতা ছিল না। নাহিদা জড়িয়ে ধরার পরও কাঁপতে লাগল।
প্রায় আধঘণ্টা নাহিদা তাকে ঐভাবে জড়িয়ে রইল। তারপর যখন বুঝতে পারল, কাঁপুনি থেমে গেছে এবং তাকে ঘাম দিচ্ছে তখন আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে আঁচল দিয়ে নাহিদের কপালের ও মুখের ঘাম মুছে দিল। ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে তার বুকে মাথা রেখে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব গরম লাগাতে প্রথমে নাহিদের ঘুম ভাঙল। দেখল, ঝড়-বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশে এক টুকরোও মেঘের চিহ্ন নেই। পূর্ব দিগন্তে সূর্য টকটকে লাল রং ছড়িয়ে একটু উপরে উঠেছে। মাঠে বেশ পানি জমে গেছে। তারপর নাহিদাকে আলুথালু বেশে তার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তার মুখের দিকে চেয়ে নিষ্পাপ শিশুর মুখের মতো মনে হলো। মাথায় হাত রেখে আস্তে নাড়া দিয়ে বলল, উঠুন, সকাল হয়ে গেছে।
নাহিদার ঘুম ভেঙে গেল। সোজা হয়ে বসে গায়ের কাপড় ঠিকঠাক করে লজ্জিত স্বরে বলল, রাতে যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কপালে হাত রেখে বলল, জ্বর নেই দেখছি, এখন কেমন লাগছে?
নাহিদ গা থেকে শাড়ি দুটো খুলে তার হাতে দিয়ে বলল, সময় মতো ডাক্তারি বিদ্যা কাজে লাগিয়েছিলেন। ভালো না হয়ে কি পারি?
ততক্ষণে ছোট বড় বেশকিছু পথিক গাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রয়েছে।
তা লক্ষ করে নাহিদা ড্রাইভিং সিটে সরে বসে জানালার কাঁচ নামিয়ে তাদেরকে বলল, আমরা ঝড়-বৃষ্টির জন্য এখানে আটকা পড়েছিলাম, আপনারা সরে দাঁড়ান।
নাহিদও তার দিকের জানালার কাঁচ নামিয়ে তাদেরকে সরে যেতে বলল।
তারা সরে যাবার পর নাহিদা গাড়ি ছেড়ে দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিল।
জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকে নাহিদার এলোমেলো চুলগুলো অশান্ত বালকের মতো চোখ-মুখ ঢেকে দিচ্ছে। এক হাত দিয়ে চুলগুলো সরাতে সরাতে নাহিদকে উদ্দেশ করে বলল, জানালার কাঁচ তুলে দিন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে একবার চেয়ে দেখল সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, কী ভাবছেন?
: ভাবছি, এই ট্র্যাজেডিময় যাত্রাপথের ঘটনাটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
: শুধু ঘটনাটাই মনে থাকবে, যাকে নিয়ে ঘটনা, তার কথা মনে থাকবে না?
নাহিদ কিছুক্ষণ নাহিদার মুখের দিকে চেয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করে নিল।
নাহিদা গাড়ির আয়নায় তা দেখতে পেয়ে বলল, প্রশ্নের উত্তর দিলেন না যে?
নাহিদ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না।
দিনাজপুর টাউনে এসে একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে নাহিদা বলল, আসুন প্রথমে কিছু খেয়ে নিই, তারপর আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।