কামিনী কাঞ্চন – আনন্দ বাগচী
সিঁড়ির বাঁকের মুখে হতবুদ্ধি সমীরণ লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল। নিচে থেকে অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে যে উঠে আসছিল, লণ্ঠনের অপ্রত্যাশিত আলোয় সেও বোধ হয় রীতিমত অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। দুই অসাবধান মানুষের মুখখামুখি সংঘর্ষটা একটুর জন্যে বেঁচে গেল। কিন্তু দুজনেই কিছু সময়ের জন্য অনড় আর আড়ষ্ট থমকে রইল।
সরু সিঁড়ি। দুটো মানুষের কোন রকমে জায়গা হয়। পথ ছেড়ে দাঁড়াবার প্রশ্ন নেই, যে কোন একজনকে উঠতে কিংবা নামতে হবে। সমীরণের স্বাভাবিক ভদ্রতার হুঁশ ছিল না। তার অবাধ্য চোখদুটো লণ্ঠনের অশালীন আলোর মতই ছড়িয়ে পড়েছিল মেয়েটির সর্বাঙ্গে। প্রথম ঝলকে মনে হয়েছিল মেয়েটি নির্বসন, চোখের ভুল ধরা পড়ে গেল পরের মুহূর্তেই। সদ্য স্নাতা তরুণীটির গায়ে কাচ কাগজের মত স্বচ্ছ কিছু লেপটে আছে। ভিজে পাতলা শাড়ির এক পোঁচর। কুচকুচে কালো আঙুরের থোকার মত কোঁকড়া চুলের ফ্রেমে নরম ডিমের মত মুখ, শাঁখের মত গ্রীবা ছুঁয়ে মোম-পাথরে গড়া একটি সুঠাম শরীর আলতা পরা পায়ের আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত। এরকম ফেটে পড়া রূপ এবং যৌবন একসঙ্গে প্রায় অবিশ্বাস্য। প্রতিটি রেখা, প্রতিটি বিপজ্জনক খাঁজ বাঁক বর্তুল ছায়াবৃত রন্ধ্রাভাস পৃথক করে দেখার মত মানসিক ভারসাম্য সমীরণের ছিল না। সব মিলিয়ে তার মনে হল রক্ত-মাংস-ত্বকে মোড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ফোরক একটি বোমা সদ্য সদ্য পলতের আগুন গিলে ফেলেছে। মাথাটা যেন ঘুরে গেল তার। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বিস্ময় আর লজ্জার ঘোর কাটিয়ে তরুণীটি তার পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেল। দু হাতে দুটি জলভরা পেতলের বালতি। যাবার সময় একটা ভিজে ছোঁয়া রেখে গেল সমীরণের দেহে। হিমেল বিদ্যুতের মত সেই স্পর্শ শিরদাঁড়ার মধ্যে ঢুকে থামোমিটারের ঊর্ধ্বমুখী পারদের মত মস্কিষ্কে গিয়ে পৌঁছল।
সমীরণের সর্বনাশ হয়ে গেল। তার আর কুয়োতলায় গা ধুতে যাওয়া হল না।
সব কাহিনীরই একটা আরম্ভ থাকে। অর্থাৎ যাকে বলে আরম্ভের আরম্ভ, শুরুর শুরু। এ কাহিনীরও শুরুটা খুঁজতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক ঘণ্টা আগে, বড়জোর একটা বেলা। ঠিক যখন অনিমেষ আর রাখাল চন্দ চলে যাবার পর খাটের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছিল সমীরণ। সকাল থেকে একটানা পিকনিক মুড়ে হৈচৈ হয়েছে। ওদের বয়স অল্প ওরা পারে, কিন্তু বয়স আর স্বভাবের উজানে চলতে গেলে সমীরণের হাঁফ ধরে যায়, দম ফুরিয়ে আসা কলের গানের মত বেসুরো বেতালা এক হাস্যকর আওয়াজ বেরোতে থাকে ভেতর থেকে। দম এবং উদ্যম দুইই ফুরিয়ে আসে আপনা থেকে। শরীর বয় না।
ওরা কিন্তু সকাল থেকে এই যাবার আগে পর্যন্ত একটানা চালিয়ে গেল। ওরা দুজনেই খুব কাজের। সকালে পৌঁছেই ঘরদোর সাফসুফ করে চা বানালো। চা শেষ করেই আবার ফার্নিচার টানাটানি। সেকেল ওজনদার কাঠের আসবাব, খাট-আলমারি, চেয়ার-টেবিল, একটা আলনা। পালিশ ফালিশ করে উঠে গেছে, শুধু আবলুস কালো রং লেগে আছে গায়ে। আর কোন আদ্যিকালের গন্ধ। রাখালের দিদিমার শ্বশুরের বিয়ের যৌতুক। সে কি আজকের কথা।
মালপত্র বলতে বিশেষ কিছু ছিল না সমীরণের। বিছানাপত্র, রান্নাবান্নার বাসন-কোসন আর চায়ের সরঞ্জাম, একটা কেরোসিন স্টোভ আর প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় টুকিটাকি কিছুকিঞ্চিৎ। বিছানা করে দিয়ে, মালপত্র বইফই গুছিয়ে দিয়ে ওরা বেরোল বাজার করতে, চাল-ডাল-নুন তেল চাই। একজন ঠিকে কাজের লোক চাই। ওরা বেরিয়ে গেলে সমীরণ তার আশ্রয় স্থলটা এক চক্কর ঘুরে দেখে নিল।
বাড়িটা বিরাট, এককালে জমিদার বাড়ি ছিল এটা। বিশাল দেউড়ি এখনো মাথা উঁচু করে সেই গৌরবের সাক্ষ্য দিচ্ছে। যদিও পলেস্তারা খসে ইঁট-সুরকি বেরিয়ে পড়েছে, জানলা-দরজার রং জলে ধুয়ে, রোদে জ্বলে ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। মূল বাড়িটা গায়ে গতরে দিনে দিনে বেড়ে উঠেছিল এক সময়, ঠিক যেন দুশো বছরের পুরোন বটগাছ ডালপালা ছড়িয়েছে আর থামের মত মোটা মোটা ঝুরি নেমেছে। পিলার তুলে তুলে আদি বাড়ির গায়ে গায়ে ঘর বাড়িয়েছিলেন কর্তারা, ফলে এক দেওয়ালের পিঠ ঠেলে ঘরের পর ঘর জুড়ে জুড়ে দুর্গের মত হয়ে গেছে বাড়িটা। শ্রী ছাঁদ আর নেই, গোলমেলে জ্যামিতির কাঠামো যেন, উঁচু নিচু ছাদের পরে ছাদ, এপাশ ওপাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠেছে, সুড়ঙ্গের মত ঢাকা বারান্দার অলিগলি পরস্পর কাটাকুটি খেলেছে।
জমিদারী গেছে, তবে বাড়িটা আছে, বাগান আছে, পুকুর আছে। সেই জাঁকজমক আর পয়সার গরমের দিন শেষ। কিন্তু বাঁশে কঞ্চিতে মিলে ঝাড় বেড়েছে, বংশ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ হয়ে গেছে মহলের পর মহল, শরিকী বাঁটোয়ারায় টুকরো টুকরো হয়েও কুলোয়নি। বার হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচির মত, বাড়ির তুলনায় উত্তরাধিকারী বেশি, ঘরের তুলনায় মালিকানা। তবে এই পাড়াগাঁয়ে সুরকি ঝুরঝুর বাড়িতে একআধখানা ঘরের মায়ায় রাখালের মাতুল পরিবারের অনেকেই আর বসে নেই, দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়েছেন। সফল এবং প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাই কেউ আর ভুলেও এপথ মাড়ান না। কেউ কেউ নিজের অংশ দান করে দিয়েছেন, কেউ জলের দরে বিক্রি করেছেন, শুধু যাদের কোন সঙ্গতি নেই, তারাই শেয়াল-ডাকা এই ভিটেমাটি কড়ি-বরগা আঁকড়ে পড়ে আছেন। ভাড়াটে বসিয়ে গেছেন কেউ কেউ। ফলে হতদরিদ্র অথচ মান খোয়াতে না পারা কিছু দুস্থ অনাথা বিধবা, বেকার ঘরজামাই আর প্রায় দিন-আনি দিন-খাই কিছু ভাড়াটে গোলা পায়রার মত এর খোপে ওর খোপে বাসা বেঁধে আছে। দিনমানে তাদের মন্থর গুঞ্জন শোনা যায়, ঘটি বালতি বাসনকোসনের ঝনঝন ঠুনঠান আর ভোলা উনুনের ছ্যাঁকছোঁক কানে আসে। সন্ধে হতে না হতেই সব এক রকম সানসুন হয়ে যায়, লণ্ঠন আর কুপির আলো আলেয়ার মত এখানে ওখানে সামান্য সময় নাচানাচি করে নিবে যায়। এ এক অদ্ভুত জীবন, জীবন্ত মানুষের ঘুমন্ত গোরস্থান যেন, কলকাতায় বসে কল্পনাও করা যায় না। অথচ কলকাতা থেকে কতই বা দূরে? শেয়ালদা লাইনে ঘণ্টা দুয়েকের পথ মাত্র।
শুয়ে শুয়ে অনিমেষ আর রাখালের কথাই ভাবছিল সমীরণ। সারাদিন ওরা এমন মাতিয়ে রেখেছিল যে এই নির্জনতা সে আন্দাজ করতে পারেনি। রান্নাবান্না সেরে হৈ হৈ করে পুকুরে স্নান করতে গেছে। ঝাঁপাঝাঁপি করে সাঁতার কেটেছে ওরা, মাছ ধরেছে। সমীরণ সাঁতার জানে না, কলের জলে ছাড়া জীবনে কখনো মাথা ভেজায়নি। ভয়ে ভয়ে ঘাটে কোমর জলের ধাপে নেমে গিয়েছে কখন। রাখাল চায়ের জল চাপিয়ে এসে আবার আসরে বসেছে, ‘আমার প্রপার্টি কি রকম দেখছু সমীরদা?’
‘ওয়ান্ডার ফুল! দোতলার পুব-দক্ষিণ খোলা, তার ওপর এই সাইজ, কলকাতার হিসেবে এক একখানা হলঘর। মেঝেতে আবার মার্বেল পাথরের টালি বসানো। না হে, মাতুল সম্পত্তি তোমার ফেলনা নয়। দু-এক হাজার টাকা খরচ করে একটু অদলবদল সারাই ফারাই করে নিলে আর দেখতে হবে না।’
রাখাল খুশি হল, ‘যাক, তোমার পছন্দ হয়েছে তা হলে?’
‘পছন্দ হবে না বল কি! কোথায় কিভাবে ছিলাম আর কোথায় এসেছি!’
তা সত্যি, মন-রাখা কথা বলেনি সমীরণ। মেসের এক চিলতে ঘরে বিশ বছর একটানা কাটিয়ে দিতে দিতে পাখা-মরে-যাওয়া পাখির মত অবস্থা হয়েছিল তার। শরীরের যেন কোন সাড় ছিল না। হাত-পা ছড়িয়ে আয়েস করা কাকে বলে ভুলেই গিয়েছিল একেবারে। সরু একফালি তক্তপোশ আর কেরোসিন কাঠের একজোড়া চেয়ার-টেবিল কোন রকমে পাতার পরে আরও একটা আস্ত মানুষের জায়গা হওয়া কঠিন। কোন রকমে শোয়া আর বসা চলে। ঘাড় গুঁজে লিখতে লিখতে যখন ঘাড়-পিঠ টনটন করতে থাকে, তখন দরজার সামনের সামান্য ফাঁকা মেঝেটুকুর ওপর আড়মোড়া ভেঙে দাঁড়াতে পারা যায়। তাও সাবধানে, মাথার ওপর হাত তোলা নিষেধ। ভাড়াটে সুদর্শন চক্রের মত একটা মান্ধাতা আমলের পুরোন সিলিং ফ্যান রড় ছাড়াই ছ’ফুটের মধ্যে নেমে এসেছে। নিচু ছাদ। তাই মেপেজুকে, বহুদিনের জানা অঙ্কের মত বাঁধা ছকে নির্ভুল ভাবে পা ফেলে হাত তুলে জীবনের দুর্লভ কুড়িটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে সমীরণ। মেসের সে প্রথম মেম্বার, বলতে গেলে লাইফ মেম্বার, সেই সুবাদে এখনো দশ টাকা ভাড়ায় একটা আস্ত ঘরের বাসিন্দা। যদি অবশ্য এটাকে আস্ত ঘর বলা যায়।
সমীরণের বয়স হয়েছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ, আজন্ম ব্যাচেলার। দীর্ঘকাল ধরে সংসারের প্রতি কর্তব্য করার পরে এখন একা। চার চারটে বোন ছিল। একে একে তাদের পার করেছে। মা-বাবা দুজনেই স্বর্গত হয়েছেন। সামনে পেছনে আর কোন টান নেই তার এখন। স্থায়ী বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। মেস বাড়িতে একদা যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল, তারা সকলেই যে যার মত মেস ছেড়ে চলে গেছে, যোগাযোগ ধীরে ধীরে ছিন্ন হয়েছে। এখন এই অনিমেষ আর রাখাল এসে জুটেছে। বয়সে যদিও অনেক ছোট, তবু একরকম বন্ধুর মতই হয়ে গেছে। বন্ধু এবং ভক্ত। অনিমেষ খবরের কাগজের অফিসে কাজ করে আর রাখাল দোকান নিয়েছে কলেজ স্ট্রীটে। বইয়ের দোকান। সে শুধু বই বেচে না, বই ছাপেও। খান পনের বই ইতিমধ্যেই সে প্রকাশ করেছে। শ্রীরামপুরে পৈতৃক বাড়ি। উইক এণ্ডে বাড়ি যায়। সমীরণ দস্তিদারের নিজের খবর বেশি কিছু নেই। বিশ বছর আগে এক রকম ঝোঁকের মাথায় গোঁয়ার্তুমি করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। একটা টিনের সুটকেশ, বিছানার বাণ্ডিল আর নিজের কলমটি সম্বল করে। আকাঙ্ক্ষা ছিল লেখক হবে। কিছুকাল আগেও বাঙালীর ছেলেরা যেমন বাড়ি থেকে পালাতে, বম্বে গিয়ে সিনেমার নায়ক হবার স্বপ্ন নিয়ে। সমীরণ অবশ্য লেখক হয়েছে। বাজারে খুব একটা রমরমা না থাকলেও গুটি পঞ্চাশ বইয়ের জনক। কলমই তার জীবন, কলমই তার জীবিকা। একটা সামান্য চাকরি করত এতদিন, সে নাম কো ওয়াস্তে চাকরিটাও ছেড়ে দিয়ে এখন পুরোপুরি স্বাধীন হয়েছে।
‘তা হলে এবার হাত-পা ছড়িয়ে সাধনায় বসে যাও। টপ গিয়ারে কলম চালিয়ে তোমার এপিক উপন্যাসখানা শেষ করে ফেললো। আমি ছাপব।’
অনিমেষ ধুয়ো ধরল, ‘হ্যাঁ, সমীরদা! এবার চাই তোমার মাস্টারপীস, বাংলা সাহিত্যকে তাক লাগিয়ে দেওয়া চাই। এরকম কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট জায়গা তুমি পোবনের আশ্রমেও পাবে না।’
রাখাল হাসল, ‘এখানে তুমি আমার গেস্ট। এক মাস লাগুক, দুমাস লাগুক, সব ইনভেস্টমেন্ট আমার। উইক এন্ডে এসে আমরা দেখে দেখে যাব। চাল ডাল নুন লকড়ির চিন্তা তোমাকে করতে হবে না, সেজন্যে আমরা রয়েছি। আর কাল থেকে ভবানীমাসী আসবে, সকালে বিকেলে তোমাকে বেঁধেবেড়ে দিয়ে যাবে।’
সমীরণ কিছু বলার আগেই রাখাল তার কথা শেষ করে চা আনতে চলে গেল। তারপর চা খেয়ে ওরা চারটে পঁচিশের গাড়ি ধরে চলে গেল। খাটের বিছানায় শুয়ে শুয়েই সমীরণ গাড়িটার চলে যাওয়ার শব্দ শুনল। রাখাল ছেলেটা খুব প্র্যাকটিক্যাল, অনিমেষও কম যায় না। খুঁটিনাটি সব দিকে নজর আছে। মোমবাতি আর দেশলাইয়ের বাণ্ডিল, চা বিস্কুট, টিনের দুধ, সিগারেটের কার্টন, একটা টর্চ, সব কিছু গুছিয়ে রেখে গেছে। মায় খবরের কাগজের বন্দোবস্ত পর্যন্ত করে দিয়ে গেছে।
আর সেই সঙ্গে রেখে গেছে নির্জনতা। এত নির্জনতা যে থেকে থেকে কানে তালা ধরে যাচ্ছিল সমীরণের।
বুকের ভেতরটা টিপটিপ করছিল সমীরণের, এরকম ঝুঁকি না নিলেই ভাল হত। মেয়েরা সব সময়েই আনপ্রেডিকটেবল, কখন কি করে বসবে মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না। যে মুহূর্তে মনে হবে গলে গেছে, সে মুহূর্তেই হঠাৎ জ্বলে উঠতে পারে। বোমার পলতের আগুন নিভে যাবার পরে গুটি গুটি আবার তার দিকে আগুন নিয়ে এগোবার সময় যেমন বুকের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক গুড় গুড় করতে থাকে। হয়তো কাছে পৌঁছনো মাত্র একটা আচমকা বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।
অবশ্য এরকম ঘটনা তার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। তার পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে মেয়েদের নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ আসেনি এর আগে। লেখক মানুষ, তবু মেয়েদের মুখের দিকে চোখ তুলে কখনো তাকায়নি সমীরণ। শ্রীভূমিকা বর্জিত জীবনটা একটানা নিরামিষ এবং একঘেঁয়েই কেটে গেছে, বাকি দিনগুলোও তাই যেত, যদি না এখানে এই অদ্ভুত নির্জন পরিবেশে কাঞ্চনের সঙ্গে ওভাবে দেখা হয়ে যেত তার। আর যদি না দেখামাত্র তার প্রেমে পড়ে যেত ওভাবে।
প্রথম দর্শনে প্রেম বলে একটা কথা আছে ইংরেজীতে। কিন্তু সমীরণের কেস তার চেয়েও জটিল। তার প্রেমে শুধু প্রথম দেখা নয়, প্রথম ছোঁয়াও লেগে আছে। ভিজে শরীরের একটা শীতল স্পর্শ তার ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এখন আর নিজের ওপরে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এই দুদিন ধরে সে কাঞ্চনকে কম করেও অন্তত বার তিরিশেক দেখেছে। এই জানলা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে, হ্যাংলা চোরের মত। যদিও একবারের জন্যেও কাঞ্চন তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি, তবু সমীরণের কেমন মনে হয়েছে এদিকে মুখ না ফিরিয়েও মেয়েটি সব টের পাচ্ছে। ওর মুখের ওই ঠোঁট টেপা হাসিটা নিশ্চয়ই সমীরণের উদ্দেশেই। একটা যুবতীসুলভ প্রশ্রয় আছে ওই হাসির মধ্যে। পুরুষকে মেয়েরা তো এই ভাবেই লাই দেয়। শুধু হাসিটুকু প্রমাণ নয়, ওর এই অকারণ আনাগোনাও মনে হয় বিশেষ উদ্দেশ্যপূর্ণ। কুয়োতলায় ওর এত কি কাজ যে দিনের মধ্যে ছত্রিশবার সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করতে হয়। শুধু হাতেই তো উঠছে নামছে বারবার।
প্রথম দেখার পর রাতটা ওর কথা ভেবে ভেবে প্রায় জেগেই কাটিয়ে দিয়েছে সমীরণ। কে এই তরুণী? কি এর পরিচয়? বছর চব্বিশ পঁচিশ বয়স হবে মনে হয়, যদিও দেখায় আরও কম। বিবাহিত। অবস্থা বোধ হয় খুব ভাল নয়। গায়ে গয়নাগাটি প্রায় নেই বললেই চলে। এই ধরনের রক্ষণশীল পরিবারে, আব্রুটানা অন্দরমহলে অনেক গোপনগল্প থাকে, অনেক গণ্ডগোল। বজ্র আঁটুনির তলায়ই ফসকা গেরো, ঘোমটার তলায় কি যেন বলে সেই নাচ, এ তো জানা কথাই। বাইরের লোক দেখানো বনেদীআনা আর আভিজাত্য তলায় তলায় কবে ফোঁপড়া ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তরুণীটি যে সংসারের বধু সেই গেরস্থালির চেহারা কি রকম সমীরণ জানে না, কিন্তু লেখক হিসেবে কিছুটা কল্পনা করতে পারে। জমিদার বংশের ভগ্নাংশ হলেও পড়তি অবস্থাতেও নীল রক্তের দাপট ছিল একদিন। গরীব ঘর থেকে তুলে আনার পর ছেলের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ রাখেনি এই পরিবার। বিয়ের পরদিন থেকেই কাঞ্চন অন্তরীণ হয়ে রয়েছে। শাশুড়ী এখন বাতে পঙ্গু, শ্বশুর গত হয়েছেন। স্বামীটি অপদেবতা বিশেষ। পৈতৃক যা কিছু ছিল নানান বদ খেয়ালে উড়িয়ে ফুরিয়ে এখন বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। মদ্যপ লম্পট রেসুড়ে মানুষের শেষ পরিণতি যেরকম। রাতে কোনদিন বাড়ি ফেরে, কোনদিন ফেরে না। অথবা গল্পটাকে আর একভাবে ভাবা যায়। বৃদ্ধ যক্ষ যক্ষিণীর মত শুশুর-শাশুড়ী নিয়ে কাঞ্চনের সংসার। স্বামী বিদেশে, আগে ঘনঘন আসত, এখন বাড়িতে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। অবিশ্যি মনিঅর্ডারের যোগসূত্রটা ছিঁড়ব-ছিঁড়ব করেও এখনো ছেঁড়েনি। ফিলমের গল্পের মত কে জানে সে গোপনে আর একটা সংসার পেতে বসেছে হয়তো। চোখের আড়ালেও প্রকৃতি তার আপন নিয়মে নির্ভুল অঙ্কের মত এগোয়। ন্যাড়া ডাল একদিন সবুজ পাতায় ছেয়ে যায়, কুঁড়ি আসে ফুল ফোটে। দেহের কানায় কানায় ভরা যৌবন একদিন উপচে পড়তে থাকে। নারীকে তার নিজের আগুন নিয়ে খেলতেই হয়। দীর্ঘ দিন দীর্ঘতর রাত জুড়ে তার নিঃসঙ্গতা অসত্য হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সমীরণ এসে পড়েছে একেবারে তার গায়ের কাছে আচমকা।
প্রথম রাত্তিরটায় সমীরণের খুব কষ্ট হয়েছিল এই সব ভেবে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেছে। তীব্র আপত্তি আর বেদনা বোধ করেছে কাঞ্চনের জন্যে। কাঞ্চন নামটা অবশ্য তখনো সে জানত না। কী নাম হতে পারে মেয়েটির? ভাবতে ভাবতে প্রথমে কামিনী নামটাই এসে গিয়েছিল মনের মধ্যে। তারপর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন।
আবছা ঘুমের মধ্যেই সমীরণ টের পাচ্ছিল দরজায় কেউ নক করছে। ঘুম ভেঙে যাবার পরেও ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসে আবার শুনতে পেল শব্দটা। ব্যাকুল এবং উত্তেজিত হয়ে কেউ মুহুর্মুহু দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। ঘুম জড়ানো চোখে দিশেহারা সমীরণ টেবিলের টাইমপীসটার দিকে তাকাল। ফসফরাস মাখানো ডায়ালে সাড়ে চারটে জ্বলজ্বল করছে। রাত পুইয়ে এসেছে। একটা জ্যালজেলে অন্ধকার এখনো ঘরের মধ্যে মশারির মত ফেলা। এই অসময়ে কে? কে এল তার কাছে এত জরুরী দরকার নিয়ে? নতুন জায়গা। ঝট করে দরজা খুলে দেওয়া ঠিক না। ছিটকিনিতে হাত রেখে সমীরণ জিজ্ঞেস করল, ‘কে? কি চাই?’
‘শিগগির খুলুন। আমি কাঞ্চন। মেয়েলী গলায় কাতর আহ্বান ভেসে এল ওপিঠ থেকে।
‘কাঞ্চন!’ নিজের মনেই প্রতিধ্বনি করল সমীরণ। এই নামের কাউকে মনে পড়ল না। না পড়ুক, কিন্তু যে এসেছে সে বোধ হয় খুব বিপন্ন। দরজা খুলে দিতেই সে হুড়মুড় করে সমীরেণের গায়ের ওপর এসে পড়ল। টাল সামলাতে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরেও দু পা ঘরের মধ্যে পিছিয়ে আসতে হল সমীরণকে। মেয়েটি হাঁপাচ্ছিল, বুকের ওঠা-পড়া টের পাচ্ছিল সে। বেশবাস আলুথালু, ভাল করে দাঁড়াবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে যেন। ভাঙা ভাঙা ধরা গলায় সে যেন কোন রকমে উচ্চারণ করল, ‘বাঁচান! আমাকে ও মেরেই ফেলবে! বাঁচান!’
লজ্জিত হতভম্ব সমীরণ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে নিতেই শুনতে পেল একটা মন্তু কণ্ঠের গর্জন, ভেতরের বারান্দা দিয়ে কেউ খ্যাপা ষাঁড়ের মত তার দরজার দিকেই ছুটে আসছে। অনিবার্য এবং আসন্ন বিপদের হাত থেকে বাঁচবার-জন্যে সশস্ত্র সমীরণ তাড়াতাড়ি দরজায় খিল তুলে দিতে গেল কিন্তু পারল না, তার ভীত কম্পিত হাত থেকে খিলটা পিছলে পড়ে গেল। আর সেই মুহূর্তেই একটা ঝনঝন শব্দে তার ঘুমটা সত্যি করে ভেঙে গেল।
চোখ খুলেও কিছুক্ষণ সমীরণ অসাড় হয়ে শুয়ে থাকল। সদ্য দুস্বপ্নের আঘাত কাটিয়ে উঠতে, বুকের ধকধকানি শান্ত করতে একটু সময় লাগল।
ভয় এবং একটা মধুর আবেশ এক সঙ্গে বুক চেপে ধরেছিল সমীরণের। তার শরীরে তখনও যেন তপ্ত কাঞ্চনের জীবন্ত স্পর্শ লেগে রয়েছে। এত বাস্তব, এত মুহূর্ত আগের, যে চোখ খুলেও তার জের কাটেনি। ভোরের আলোয় ঘর ভেসে যাচ্ছে, কিছুই আর অস্পষ্ট নয় এখন, দরজায় যেমন খিল বন্ধ ছিল তেমনি আছে, শুন্য নির্জন ঘরের শান্তি যেন চিড় খায়নি এক চুল। শুধু তার মনের মধ্যে সব উথাল পাথাল হয়ে গেছে। নিজের মনের অবচেতন আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই স্বপ্নটার জন্ম তাতে আর সন্দেহ নেই সমীরণের। নইলে লণ্ঠনের গায়ে হলুদ আলোয় যে যুবতীকে সে সন্ধেবেলা এক ন্যুড মডেলের দুর্লভ ভঙ্গিমায় দেখে ফেলেছিল সিঁড়ির মুখে, তাকেই সে নিজের আলিঙ্গনের মধ্যে পেয়ে গেল কি করে। যার নাম ভেবেছিল কামিনী, সেই স্বপ্নের মধ্যে বন্ধ দরজায় ঘা দিয়ে নিজের নাম জানিয়ে গেল—কাঞ্চন। কাঞ্চনই হয়তো মেয়েটির নাম, সত্যিকারের নাম, টেলিপ্যাথির মত কোন অজ্ঞাত প্রক্রিয়ায় তার কাছে পৌঁছে গেল। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল বুঝতে পেরে সমীরণ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে নামতে গেল, আর তক্ষুনি দেখতে পেল মেঝেটা জলে থৈ থৈ করছে। ঘুমের মধ্যে বোধ হয় হাত ছুঁড়েছিল সে, হাতের ধাক্কা লেগে টিপয়ের ওপর থেকে জলের জগটা মাটিতে পড়ে গেছে। জগের মুখটা একটা ডিশ দিয়ে ঢাকা ছিল, সেটা মাটিতে চার টুকরো হয়ে পড়ে আছে।
সমীরণ জল আর পোর্সিলিনের টুকরো বাঁচিয়ে মাটিতে পা রাখতে যাবে এমন সময় কি একটা নরম জিনিস তার কোলের ওপর এসে পড়ল। চমকে তাকিয়ে দেখল গোল গোল গোটা দুই পাতাসুদ্ধ একটা বেগনী রঙের ফুল, ডাঁটি থেকে সদ্য ছেঁড়া। অবাক কাণ্ড! ফুলটা শূন্য থেকে খসে পড়তে পারে না, কেউ নিশ্চয়ই ছুঁড়ে মেরেছে। কে মারল? তার সঙ্গে এই রসিকতা কে করল? চারপাশে তাকাতেই ওপাশের জানলাটা চোখে পড়ল, যেখান দিয়ে ফুলটা ছিটকে আসার সম্ভাবনা।
ফুলটা হাতে নিয়ে এক লাফে সমীরণ জানলার কাছে পৌঁছল আর তখনই প্রথম আবিষ্কার করল সিঁড়ির মাথা আর একচিলতে ভেতরের বারান্দা এই জানলার তল ঘেঁষে চলে গেছে। এপাশ ওপাশ তাকিয়ে কাউকে অবশ্য দেখা গেল না, শুধু রিনরিন ঝিনঝিন একটা শব্দ যেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল। ভুরু কুচকে বিভ্রান্ত সমীরণ কিছু মনে করবার চেষ্টা করল এক মুহূর্ত। কি একটা যোগসূত্র সে যেন ঠিক ধরতে পারছে না। যেন সুতোর দুটো প্রান্ত জট পাকিয়ে কোথায় মুখ লুকিয়েছে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, উল্টে টানাটানির ফলে ফাঁসটা আরও জটিল হয়ে উঠছে।
বিরক্ত সমীরণ চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে হাতের ফুলের দিকে ভাল করে তাকাল। আর সঙ্গে সঙ্গে গায়ে কাঁটা দিল, কাকতালীয় হলেও যোগাযোগটা বিচিত্র। ফুলটা গোলাপ নয়, গাঁদা নয়, কাঞ্চন। আবার সেই কাঞ্চন, সেই স্বপ্নের কাঞ্চন। দুয়ের মধ্যে একটা মিসিং লিঙ্ক আছে, আর সেটা ধরতে পেরেই লাফিয়ে উঠল সে। মেয়েটার নাম কাঞ্চন, আর সেটাই কাঞ্চন ফুল উপহার দিয়ে কৌশলে জানান দিয়ে গেল বোধ হয়। কাঞ্চন, কাঞ্চন, কাঞ্চন। শেষ বয়সে, এই অবেলায় প্রেম কি সত্যিই নিঃশব্দ চরণে তার দরজায় এসে দাঁড়াল, প্রায় অযাচিত ভাবে, প্রায় অনায়াসে। পরকীয়া প্রেমেরে একটা বাড়তি আকর্ষণ আছে, যাকে বলা যায় অবৈধ আকর্ষণ। সে তার রক্তের মধ্যে সেই দুর্বার টানটা অনুভব করছিল, মনে হচ্ছিল, অনুচিত অন্যায় পাপ কিংবা লোকনিন্দার দোহাই দিয়ে নিজেকে সে আর ধরে রাখতে পারবে না। এতক্ষণ পরে হঠাৎ রিনরিন ঝিনঝিন শব্দটা শনাক্ত করতে পেরে সব ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। কাল সন্ধেবেলা যখন কাঞ্চন সিঁড়ির মুখে তাকে পাশ কাটিয়ে উঠে গিয়েছিল, তখন সে এই শব্দটাই শুনতে পেয়েছিল। হাতের চুড়ি আর পায়ের নূপুর মিলিয়ে বোধ হয় এইরকম আওয়াজ উঠছিল। তাহলে এই ফুলটা নিশ্চয়ই কাঞ্চনই ছুঁড়ে দিয়ে গেল ঘরের মধ্যে। এই জানলাটাও তাহলে সেই খুলেছে, কারণ তার যতদূর মনে পড়ছে কাল রাতেও এটা বন্ধই ছিল।
চায়ে গোটাদুই চুমুক দেবার পর সমীরণের খেয়াল হল চা জুড়িয়ে একেবারে জল হয়ে গেছে।
চার ছড়িয়ে মাছ-শিকারী যেমন করে এক দৃষ্টিতে ফাত্নার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, সমীরণ সেই ভাবেই আধখোলা জানলার ফাঁকে দৃষ্টি রেখে বসেছিল, চায়ের কাপের কথাটা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। পনের বিশ মিনিট হতে পারে, আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিট হওয়াও বিচিত্র নয়। স্নায়ু ক্ষয়কারী উদ্বেগ নিয়ে সে কাঞ্চনের অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আজ দুপুর থেকে তার দেখা পাওয়া দূরে থাক, সেই রিনরিন ঝিনঝিন শব্দটাও দূর থেকে কানে আসেনি। দেওয়ালের ওপিঠে আজ কি হচ্ছে কে জানে, আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাসও হতে পারে, সব যেন নিঃশব্দ নিঃঝুম হয়ে গেছে। চিঠিটায় ঝোঁকের মাথায় এমন কতকগুলো কথা লিখে ফেলেছে, যা কাঞ্চন অসম্মানজনক মনে করলেই বিপদ। এখন মনে হচ্ছে, চিঠিটা লিখে খুবই মূর্খের মত কাজ করা হয়েছে। আসলে কাঞ্চনের স্বভাবচরিত্র সম্বন্ধে পরিষ্কার কোন ধারণায় আসা মুশকিল। যে কোন মেয়ের সম্বন্ধেই তাই, ঠমক গমক আর ঠোঁটের হাসি দেখে কিছুই বোঝা যায় না, পেণ্ডুলামের মত এই মুহূর্তে যে কাছে আসে, পরের মুহূর্তেই সে ততোধিক দূরে সরে যায়। গলে গেছে মনে করে গদগদ হতে না হতেই সে জ্বলে ওঠে। ছেলেবেলায় কালীপুজোর রাতে এরকম কিছু বোমা বা পটকা দেখার অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। পলতের আগুন হজম করে যে নিরীহ নষ্ট চেহারা নিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে শুধু কাছে যাওয়ার অপেক্ষায়, তারপর আচমকা ফেটে পড়ে। ভগবান না করুন, এখন কাঞ্চনও সে রকম একটা কাণ্ড বাধিয়ে তুলতে পারে। চিঠিটা যদি তার স্বামী কিংবা অন্য কারো হাতে তুলে দিয়ে থাকে, তাহলে মারাত্মক কেলেঙ্কারি ঘটতে আর দেরি নেই। মান-সম্মান খুইয়ে এখান থেকে তাকে বিনা নোটিশে পাততাড়ি গুটোতে হবে। মনে মনে অধৈর্য সমীরণ কাঞ্চনের উত্তরের অপেক্ষা করছিল। চিঠি যদি নাও আসে, একবার কাঞ্চনের দেখা পেলেও কিছুটা আঁচ পাওয়া যেত। বিপজ্জনক ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার আগেই মানে মানে এখান থেকে সরে পড়া যেত!
আকাশ পাতাল ভেবে সমীরণের বুকের ভেতরটা কি রকম গুড়গুড় করছিল। দুপুরে খেতে যাবার আগে চিঠিটা সুতোয় বেঁধে জানলায় ঝুলিয়ে রেখে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে চিঠিটা উধাও হয়েছে। অর্থাৎ যার উদ্দেশে চিঠি সে নিজে হাতে নিয়ে গিয়েছে। প্রথমটা মনটা আনন্দে উল্লাসে নেচে উঠেছিল কিন্তু এখন যত সময় যাচ্ছে, পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে, নানারকম বিশ্রী আশঙ্কায় মনের ভেতরটা কালো হয়ে উঠছে। চিঠিটা যে কাঞ্চনের হাতেই পড়েছে তারই বা ঠিক কি! কাঞ্চনের এই দীর্ঘ নীরবতা, এই অনুপস্থিতি সত্যিই ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দু’দিন এরকম ঘটনা ঘটেনি, কুড়ি মিনিট আধ ঘন্টা অন্তর অন্তর এই দুপুর বেলা তার সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। কারণে অকারণে সে এসেছে গেছে, প্রতিবারই ঠোঁটের হাসি, আড়চোখের দৃষ্টি তার বুকে আগুন ছড়িয়েছে। কাঞ্চন ফুলটি পাবার পরই প্রকৃতপক্ষে এই জানলাটা সে আবিষ্কার করেছে। তারপর জানলার সামনে বসে থাকার অজুহাত হিসেবে লেখার টেবিল এখানে সরিয়ে এনে ঘাঁটি গেড়েছে।
উদ্বেগের মধ্যে স্কুলেই রইল সমীরণ। ক্রমে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। আচ্ছন্ন ম্রিয়মান সমীরণ আলো জ্বালল না, এক মুহূর্তের জন্যেও টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে সাহস পেল না। পাছে সেই মুহূর্তে কাঞ্চন তার নজর এড়িয়ে চলে যায়। বসে থাকতে থাকতে কেমন একটা ঝিমুনির ভাব এসে গিয়েছিল, চোখদুটোও হয়তো বুজে এসেছিল কয়েক লহমার জন্যে। হঠাৎ একটা চেনা পারফিউমের গন্ধ আর সেই মিঠে শব্দটা তাকে এক মুহূর্তে সজাগ করে দিল।
দু’চোখ কচলে সমীরণ বাইরের অন্ধকারে তাকাল জানলা দিয়ে। রিনঝিন শব্দটা এগিয়ে আসছিল একটা অস্পষ্ট আলোর আভা নিয়ে। কাঞ্চন আসছে, সিড়ির ধাপে তার শরীরটা ক্রমে ক্রমে সম্পূর্ণ হচ্ছিল, মোমরঙা পায়ের পাতা থেকে শাড়ির পাড় বেয়ে সমীরণের চোখ লাফিয়ে লাফিয়ে থাই, ঢেউ দোলানো কোমর, শঙ্খমুটি অনাবৃত বাহুলতা, আঁচল হড়কানো উদ্ধত বুক ধরে নিচ্ছিল। হঠাৎ মুখের দিকে নজর পড়ল, এই প্রথম কাঞ্চন সরাসরি তাকিয়েছে, চোখে যেন বিদ্যুৎ এবং চুম্বক একই সঙ্গে খেলে গেল, ঠোঁটে অন্তঘাতী হাসি। জখম সমীরণের চোখের সামনে দিয়ে লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে তরতরিয়ে নেমে গেল, যাবার মুখে একটা চোখ টিপে যেন একটা টিপ্পনী ঝেড়ে গেল। মনে হল এক ঝলক বদ্ধ বাতাস হঠাৎ ছাড়া পেয়ে তার মুখের ওপর পাখা ঝাপটে উড়ে গেল। চেনা পারফিউমের সঙ্গে ফিসফিসানির মত একটা কথা জড়িয়ে গেল কিনা বোঝা গেল না। ঝাঁ ঝাঁ করা কানের মধ্যে হাওয়া ঢুকে হয়তো একটাকথার ইলিউশন তৈরি হল। সমীরণের মনে হল কাঞ্চন বাতাসের গলায় তাকে একটুকরো কথা উপহার দিয়ে গেল: আজ রাতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব।
সম্বিত ফিরে পাবার পর সমীরণের মনের মধ্যে একটিই কথা শুধু পাক খেতে লাগল, কখন, কোথায়? কখন, কোথায়? স্বস্তিতে, উল্লাসে উত্তেজনায় তার দু’চোখে যেন ঘুম জড়িয়ে আসবেন কত দিনের বাঁধভাঙা ঢল নেমে আসবে সারা শরীর বেয়ে। কিন্তু এখন ঘুম তো তুচ্ছ কথা, তার এখন মরবারও সময় নেই। এক বিচিত্র রূপকথার জগৎ এখন তার হাতের মুঠোয় এসে গেছে। কিংবা বলা যায়, এমন রহস্যপুরীর গোপন দরজার চাবিকাঠি, যেখানে সে এই প্রথম, তার নিঃশেষ হয়ে যাওয়া জীবনে এই প্রথম প্রবেশ করবার ছাড়পত্র মিলল। যে রহস্য যে রোমাঞ্চের স্বাদ থেকে সে চিরকাল বঞ্চিত থেকে গেছে। নারীর দেহ সে কোনদিন স্পর্শও করেনি, নারীর মন তার নিতান্তই কল্পনার সামগ্রী, শুধু গল্পের জন্যে বানিয়ে বানিয়ে এতদিন যা কিছু লিখেছে।
মানুষের মন এই রকমই। কয়েক মিনিট আগেও যে আশঙ্কায় আশঙ্কায় কন্টকিত হয়েছিল, এই যাত্রায় কোনক্রমে পার পেয়ে গেলে এমন কাজ আর কখনো করবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে, বলতে গেলে নাক কান মলেছে—সেই মানুষই আবার আরও বড় ঝুঁকি নেবার জন্যে উন্মাদের মত ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ঘন ঘন হাতঘড়ি দেখছে।
সমীরণ আবার ঘড়ি দেখল। রাত ন’টা।
গোটা বাড়িটাই কবরখানার মত নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বাইরের প্রকৃতি এখন আঁকা ছবির মত নিস্পন্দ। জলাজঙ্গল ঝোপঝাড় মাঠের ওপর মরা জ্যোৎস্নার সর জমে রয়েছে। ঘরের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল সে। শেয়ালের প্রহর ঘোষণার পর ধাতব শব্দের করাত টেনে আপ-ডাউন দুখানা ট্রেন পরস্পর কাটাকুটি খেলে চলে গেল।
সমীরণ আর পারছে না। এই বয়সে এই উত্তেজনা আর সহ্য হয় না। অপেক্ষা করার চেয়ে স্নায়ুঘাতক বোধ হয় আর কিছু নেই। মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে সে কাঞ্চনের অপেক্ষা করে আছে। একটা সঙ্কেত, দরজায় একটা ভীত চাপা হাতের টোকা পড়বে এরকমই আশা করে বসেছিল সমীরণ। কিন্তু কেউ এল না। মনে পড়ল, কাঞ্চন তার কাছে আসবে এরকম কোন প্রতিশ্রুতিই সে দেয়নি। বরং বলেছে, আজ রাতে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। তার মানে কাঞ্চনই অপেক্ষা করবে, সমীরণকেই যেতে হয় তার কাছে। কিন্তু কোথায়? কখন, ক’টার সময়? মেয়েদের স্বভাবই এই, কোনদিন যদি কোন কথা পরিষ্কার করে বলতে শিখল। সবই তাদের ঝাপসা, সব কিছুরই ওপর একটা রাখাঢাকা দেওয়া আছে।
এই সব ভাবতে ভাবতে সমীরণ কখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, খেয়াল করেনি। ভেতরের করিডোরে চাপা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বাঁকা হয়ে। বারান্দাটা পার্টিশান দিয়ে আধখানা করা। ওপাশে যেতে হলে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে অন্য সিঁড়ি ধরতে হবে। ওপথে কাঞ্চনকে বহুবার যে দেখেছে সে। আশা করেছিল কাঞ্চনকে দেখতে পেয়ে যাবে, কিন্তু ভেতর বারান্দাটা একেবারেই জনশূন্য। এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে থেকে পা টিপে টিপে সিঁড়ির বাঁকে নেমে ওপাশের রাস্তা ধরল। জায়গাটা কেমন অন্ধকার, কারণ চাঁদের আলো সিঁড়িতে পৌঁছয়নি। হাতে টর্চ ছিল, কিন্তু টর্চ জ্বেলে হঠাৎ কারো নজরে পড়ে যেতে রাজী নয় সমীরণ। প্রথম রাতের দুঃস্বপ্নটা ঝপ করে মনে পড়ে যেতেই গা’টা ছমছম করে উঠল। খ্যাপা ষাঁড়ের মত ছুটে আসা কাঞ্চনের স্বামী যদি সত্যি সত্যিই এখন দেখা দেয়। পরের মুহূর্তেই তার মন অভয় দিল, না, কাঞ্চনের স্বামী আজ বাড়ি নেই। বাড়িতে থাকলে কখনোই কাঞ্চন তাকে আসতে বলত না।
ধীরে ধীরে কখন সে ওপাশের বারান্দায় পৌঁছে গেল। বারান্দার দু’ধারে ছোট বড় মিলিয়ে গুটি চারেক ঘর। কিন্তু সবগুলোরই দরজা বন্ধ। গোটা কতক জানলা আছে অবশ্য, কিন্তু কাচের শার্সি বন্ধ থাকায় ভেতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে এটা ঠিক কোন ঘরেই আলো নেই। ঘরগুলো ঘুমে তলিয়ে আছে যেন। সমীরণের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছে, হাতের আঙুলের ডগাগুলো ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে যেন। এই বারান্দা তার নিষিদ্ধ জায়গা, এখানে তার এই অবৈধ অনুপ্রবেশের কোন যুক্তি নেই। সমীরণ মনে মনে তবু একটা যুক্তি খাড়া করে নিল। টর্চটা পকেটে লুকিয়ে ফেলল। কারো সামনাসামনি পড়ে গেলে বলতে পারবে, নতুন জায়গা, অন্ধকারে ঠাহর করতে না পেরে ভুল সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে। কথাটা ভেবে ইস্তক জোর পেল সমীরণ। কান খাড়া করে ঘরের বাসিন্দাদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শোনবার চেষ্টা করতেই চমকে উঠল। সেই চেনা পারফিউমের গন্ধটা যেন এক ঝলক নাকে এসে লাগল। সেই সঙ্গে রিনঝিন শব্দটা।
সমীরণ সেই মুহূর্তে একটা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ক্যাঁচ করে এক আবছা আওয়াজ করে ভেজানো পাল্লাটা যেন সামান্য ফাঁক হয়ে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল তার। ধোঁয়ার মত আবছা ফর্সা একখানা হাত কপাটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসে ইশারায় তাকে ডাকল। সম্মোহিতের মত সমীরণ বোবা গলায় শুধোল, ‘কান্চন্?’
সব কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল সমীরণের মগজের মধ্যে। কানের পাশে একটা মদালসা চাপা গলায় কেউ বলল, ‘এস…ভেতরে এস।’ কথাটা যেন ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে, অণুপরমাণুতে টুকরো টুকরো হয়ে কানের মধ্যে অনন্তকাল ধরে বেজেই চলল, এস…ভেতরে এস…
সপ্তার শেষে, শনিবারে রাখালরা যখন এসে পৌঁছল, তখন বাড়ি লোকে লোকারণ্য। পুলিশ এসেছে। উঠোনে সমীরণের পচে দুর্গন্ধ বেরোন লাশ সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা রয়েছে। পাশে একটা কঙ্কাল, তার দুটো পায়ের গোছে দু’গাছা নূপুর।