কামাল আতাতুর্ক (১৮৮১–১৯৩৮) – নব্য-তুরস্কের জনক
নব্য-তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্ক। আতাতুর্ক মানে জাতির পিতা। তাঁর প্রকৃত নাম মুস্তাফা কামাল পাশা। ইংরেজদের অধীনতা থেকে তিনিই ছিনিয়ে এনেছিলেন পরাধীন তুরস্কের স্বাধীনতা।
মুস্তফা কামাল তুরস্কের জাতির পিতা হলেও তিনি কিন্তু তুর্কি ছিলেন না। তাঁর জন্ম আলবেনিয়ায়। আলবেনিয়াই ছিল তাঁর স্বদেশভূমি। তিনি ১৮৮১ সালে আলবেনিয়ার সালোনিকায় জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর যখন মাত্র সাত বছর বয়স, তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তারপর তিনি লালিতপালিত হন চাচার কাছে। ছোটবেলা থেকেই একেবারে দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন কামাল পাশা। আর সেজন্যই পুঁথিগত বিদ্যা খুব একটা ফল দেয়নি তাঁর জীবনে।
তাঁর স্কুলজীবনের দুরন্তপনা সম্পর্কে নানা গল্পও প্রচলিত আছে। স্কুলে তিনি কখনও মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতেন না। বরং স্কুলের অন্য ছেলেদের সাথে ঝগড়াঝাঁটি মারামারি করতেন প্রায় সর্বক্ষণই। এজন্য স্কুলের কোনো ছেলেই তাঁর সাথে মিশত না। তাঁকে রীতিমতো এড়িয়ে চলত। এই দুরন্তপনার জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষক কামালকে ধরে একদিন আচ্ছা করে পিটুনি দেন। পিটুনি খেয়ে সেই যে তিনি দেয়াল টপকে স্কুল থেকে পালান, তারপর আর কোনোদিন স্কুলমুখো হননি। তাঁর স্কুলজীবনের সেখানেই ইতি ঘটে।
জন্ম আলবেনিয়ায় হলেও ২৪ বছর বয়সে আতাতুর্ক এসে যোগ দেন তুর্কি সেনাবাহিনীতে। তিনি যেমন ছিলেন আবাল্য দুরন্ত প্রকৃতির, তেমনই তাঁর গায়ে ছিল প্রচণ্ড শক্তি, বুকে ছিল অসীম সাহস। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। এই গুণাবলির জন্যই তিনি সেনাবাহিনীর চাকরিতে খুব দ্রুত সুনাম অর্জন করতে থাকেন।
এ সময় তুরস্ক সাম্রাজ্যের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। দেশটি তার অতীতের সমস্ত গৌরব হারিয়ে ফেলেছিল। রাশিয়ার জার এই সময় বিদ্রূপ করে তুরস্ককে ইউরোপের রুগ্ণ ব্যক্তি (The Sick man of Europe) বলে সম্বোধন করতেন।
প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তুরস্কের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খুব নাজুক হয়ে পড়ে। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে পুতুল সুলতান ওয়াহিদুদ্দিন ছিলেন ব্রিটিশ ও ফরাসিদের একান্ত তাঁবেদার। এই সময়ই তুরস্কের কিছু কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা ঠিক করেছিলেন—এই অপমানজনক পরিস্থিতি থেকে দেশটাকে বাঁচাতে হবে। প্রয়োজন হলে লড়াই করতে হবে। এই জাতীয়তাবাদী নেতাদের অন্যতম ছিলেন মুস্তাফা কামাল পাশা।
১৯১৯ সালের মে মাসে গ্রিস তুরস্কের অন্তর্গত এশিয়া মাইনরের স্মার্না আক্রমণ করে বসে। এই আক্রমণ ছিল ব্রিটিশ, ফরাসি ও আমেরিকার যৌথ প্ররোচনা ও সাহায্যে পরিচালিত। যুদ্ধে গ্রিকরা চালাতে থাকে প্রচণ্ড ধ্বংসলীলা ও নরহত্যা। ফলে তুরস্কবাসীর মনে জেগে ওঠে প্রবল ক্রোধ ও দেশাত্মবোধ। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এসে যোগ দিতে থাকে দেশের কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-জনতা। ফলে কামাল পাশার হাত আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
১৯১৯ সালে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসে কামাল পাশা প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা নির্বাচিত হন। এই কংগ্রেসেই একটি ন্যাশনাল প্যাক্টও গঠিত হয়। কিন্তু ব্রিটিশশক্তি এই জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দমন করার জন্য কংগ্রেসের অনেক সদস্যকে গ্রেফতার করেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। আন্দোলন স্তিমিত হওয়ার পরিবর্তে সারা দেশে তা আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো।
তখন পলাতক জাতীয়তাবাদীরা আংকারায় এসে নতুন পার্লামেন্ট গঠন করলেন। এই সময় ঘোষণা করলেন, এবার থেকে এই পার্লামেন্টই দেশ পরিচালনা করবে। তাঁবেদার সুলতানের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
এর ফলে তাঁবেদার সুলতান খেপে গেলেন। তিনিও কামাল পাশাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাঁর মৃতুদণ্ড ঘোষণা করলেন। ঘোষণা করলেন তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ। এভাবেই তুরস্কে শুরু হলো গৃহযুদ্ধ।
১৯২০ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ, ফরাসি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ওপর চাপিয়ে দিল সিভাস চুক্তি। সুলতানের প্রতিনিধিরা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও জাতীয়তাদীরা তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
চুক্তি প্রত্যাখ্যানের এই অপমানজনক ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা গ্রিসকে প্ররোচিত করে তুরস্ক আক্রমণে। আর এদিকে কামাল পাশাও গঠন করতে লাগলেন জাতীয়তবাদী সেনাদল। দেশের হাজার হাজার যুবক দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁর পাশার ডাকে সাড়া দেয়।
এই সময় ইংরেজদের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই রাশিয়া কামাল পাশাকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রচুর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে লাগল।
১৯২০ সালে গ্রিকদের হাতে তুরস্ক পরাজিত হলেও ১৯২১ সালের যুদ্ধে গ্রিকরা খুব সুবিধা করতে পারল না। কামালের অধীনস্থ দুর্ধর্ষ তুর্কি বাহিনীকে হটিয়ে পার্বত্য মালভূমি অধ্যুষিত আংকারা দখল করা তাদের পক্ষে সম্ভব হলো না। ফলে তারা পিছু হঠতে বাধ্য হলো। পিছু হঠার সময় তারা ব্যর্থ আক্রোশে প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে চালাতেই যায়। গ্রিকবাহিনী পিছু হঠতে গিয়ে দেখল তারা না পারে এগুতে, না পারে পেছোতে।
১৯২২ সালের আগস্ট মাসে এই অবস্থায় কামাল পাশা পাহাড় থেকে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে গ্রিকবাহিনীকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে দিলেন। গ্রিকরা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেল সমুদ্রপথে। এইভাবে কামাল পাশা তুরস্ক থেকে শুধু গ্রিকবাহিনী নয়, প্রতিটি গ্রিক নগরিককে পর্যন্ত তাড়িয়ে দিলেন। একজন ঐতিহাসিক কামাল পাশার এই বীরত্বের জন্য তাঁকে ধূসর নেকড়ে বলে অভিহিত করেছেন। কামাল পাশা শুধু গ্রিক নয়, তিনি ইংরেজদেরও পরাজিত করলেন। এরপর ১৯২৩ সালের জুলাই মাসে ইংরেজদের সাথে স্থাপিত হল সন্ধি। তুরস্ক স্বীকৃতি পেল একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।
তুরস্ক রূপান্তরিত হলো প্রজাতন্ত্রে। আংকারা হলো নতুন রাজধানী। কামাল পাশা হলেন দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট। দেশ শাসনের সর্বময় ক্ষমতা থাকলো তাঁর হাতে।
দেশবাসী তাদের ত্রাণকর্তা ও স্বাধীনতার বীর বিজয়ীকে উপাধি দিল আতাতুর্ক অর্থাৎ জাতির পিতা। আর সেই থেকেই মুস্তফা কামাল পাশা হলেন কামাল আতাতুর্ক।
দেশশাসনের ভার হাতে নিয়েই কামাল আতাতুর্ক দেশের সামাজিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের দিকে মন দিলেন। তিনি দেশকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে লাগলেন। কাজির বিচার তুলে দিয়ে বিচার বিভাগের ভার দেওয়া হলো শিক্ষিত বিচারকদের হাতে। স্কুল-কলেজে চালু করা হলো আধুনিক উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। আগে তুর্কিরা প্রাচীন তুর্কি ফেজ পরত, তিনি তুর্কি ফেজের পরিবর্তে ইউরোপীয় কায়দায় হ্যাট পরার প্রচলন করলেন। তুরস্কের মেয়েরা আগে কঠোর পর্দাপ্রথা মেনে চলত, কামাল আততুর্ক এই পর্দাপ্রথা তুলে দিলেন। এর পর থেকেই তুর্কি মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা, স্কুল- কলেজে পড়াশোনা এবং অফিস-আদালতে চাকরি করার সুযোগ পায়।
তুর্কি ভাষা তখন আরবি হরফে লেখা হতো। তিনি এই হরফের পরিবর্তে ল্যাটিন হরফে তুর্কি ভাষা লেখার প্রবর্তন করলেন।
দেশের প্রাচীন খলিফা পদ বিলোপ করে সমাজের সংস্কার সাধন করে আধুনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় দেশের এক শ্রেণীর গোঁড়াপন্থি মৌলবাদীরা খেপে গেল। তারা কামালকে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি বা বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে, কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেনি। কামাল পাশা কঠোর হাতে এই বিদ্রোহ দমন করলেন। তা ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে দেশের যুবসমাজ কামালের এই আধুনিকায়নকে স্বাগত জানায়। তারা মনেপ্রাণে গ্রহণ করে তার প্রবর্তিত আধুনিক ব্যবস্থাকে।
শুধু শিক্ষা আর সমাজ সংস্কার নয়, কামাল আতাতুর্ক অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগ করলেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করতে লাগলেন কলকারখানা, রাস্তাঘাট। গড়ে তুললেন ব্যাপক বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধাও। পাশাপাশি তিনি কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতির যান্ত্রিক উপায়ে চাষাবাদ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করলেন। এতে দেশের উৎপাদন বেড়ে গেল। দেশ হলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কামাল আতাতুর্ক যত দিন বেঁচে ছিলেন, ততদিনই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই বীর সেনানী ও নব্য-তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের মৃত্যু হয় ১৯৩৮ সালে। আজও তিনি তুরস্কে সর্বাধিক জনপ্রিয় নেতা।