কামারপুকুরের সেন পরিবার
পূর্ববঙ্গের প্রাচীন ও প্রখ্যাত এই বৈদ্য পরিবারটির ইতিহাসের সূত্রপাত হরিনারায়ণ সেনের পুত্র নীলাম্বর সেনের সময়।
কবিরাজ হিসাবে নীলাম্বর ছিলেন অত্যন্ত যশস্বী। কবিরাজী ব্যবসায়ে উন্নতিলাভের জন্য নয়, জীবনের অবশিষ্ট অংশ পবিত্র গঙ্গাতীরে অতিবাহিত করার উদ্দেশ্যে তিনি (কলকাতার) কুমারটুলিতে বসবাস করতে চলে আসেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ও কুশলতা সম্পর্কে কলকাতাবাসী প্রথমে অবহিত ছিলেন না; কিন্তু রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুর, কে সি এস আই কর্তৃক কুমারটুলিতে মুমুর্ষুদের জন্য নির্মিত ভবনে তিনি মানবতার খাতিরে চিকিৎসা করে সময় সময় কয়েকজন মুমূর্ষু রোগীকে নিরাময় করেন। ফলে নীলাম্বরের খ্যাতি অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে, আর কলকাতা এবং আশপাশের ধনী দরিদ্র বহু মানুষ তাঁর কুমারটুলির চিকিৎসালয়ে ভিড় করে আসতে থাকেন। অল্পকালের মধ্যে তিনি বাংলার ধন্বন্তরীরূপে পরিচিত হন। মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে থেকেই তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র গঙ্গাপ্রসাদ সেনকে কলকাতার ধনী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন যাতে তাঁর অবর্তমানে গঙ্গাপ্রসাদ এঁদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সমর্থ হন।
গঙ্গাপ্রসাদ যখন চিকিৎসা ব্যবসা আরম্ভ করেন তখনও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল নাঃ কিন্তু পিতার যশ ও পসারের ফলে তাঁর ব্যবসায়ও ব্যাপকতা লাভ করে। ত্রিশ বছর কালব্যাপী চিকিৎসাকালে বহু দুরারোগ্য রোগীকে নিরাময় করে তিনি বর্তমান দেশীয় চিকিৎসক (কবিরাজ)-দের মধ্যে সর্বাধিক খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন। বস্তুত তাঁকে রোগী খুঁজে বেড়াতে হয় না, রোগ-গ্রস্তরাই তাঁর কাছে ভিড় করে আসেন। লক্ষ লক্ষ টাকা যেমন তিনি উপার্জন করেছেন, তেমনি উদারভাবে দান খয়রাত্ত করে থাকেন। চিকিৎসার জন্য তাঁর কাছে দৈনিক সমাগত বহু রোগীকে তিনি সকল প্রকার ঔষধ বিনামূল্যে দান করে থাকেন। তাঁর গ্রাম-দেশ থেকে আগত অনেক ছাত্র তাঁর কলকাতার বাড়িতে থেকে খেয়ে তাঁর কাছে আয়ুর্বেদ শিক্ষা করেন। ঐ অঞ্চল থেকে এসে বহু ছাত্র তাঁর বাড়িতে থেকে খেয়ে কলকাতার স্কুল কলেজে পড়বার সুযোগ পেয়েছে। মহামান্যা মহারাণী কর্তৃক ভারত-সম্রাজ্ঞী পদবী গ্রহণ উপলক্ষে কলকাতায় ১৮৭৭-এর ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দরবারে কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ সেন ও সমযশস্বী কবিরাজ রমানাথ সেন হিন্দু চিকিৎসা-শাস্ত্রে অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য সাম্মানিক প্রশংসাপত্র লাভ করেন।
গঙ্গাপ্রসাদের অনুজ দূর্গাপ্রসাদ ও অন্নদাপ্রসাদ সংস্কৃত ভাষা ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী। চিকিৎসক হিসাবেও তাঁরা অভিজ্ঞ। স্বাস্থ্যহীনতার জন্য দূর্গাপ্রসাদ অগ্রজের কাছ থেকেই চিকিৎসা ব্যবসায়ে নিযুক্ত আছেন; কিন্তু কনিষ্ঠ অন্নদাপ্রসাদ হোগল কুড়িয়ায় আলাদাভাবে কবিরাজী করছেন। পূজাঅর্চনাতেই দুর্গাপ্রসাদের অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়; অনেকাংশে তিনি সন্ন্যাসী প্রকৃতির মানুষ।
হরিমোহনের কনিষ্ঠ পুত্র রামলোচন সেন জ্যেষ্ঠ নীলাম্বর সেন অপেক্ষা জ্ঞান ও চিকিৎসা বিদ্যায় কম ছিলেন না। রামলোচনের পুত্র রামকুমার ছিলেন সংস্কৃত, ফার্সী ও বাংলা ভাষায় প্রগাঢ় পান্ডিত্যের অধিকারী। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও তিনি গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শারীরিক কারণে চিকিৎসা ব্যবসায়ে তিনি আর্থিক সাফল্যভাবে সমর্থন হন নি। তৎসত্ত্বেও দরিদ্র রোগীদের প্রতি তাঁর দয়ার অন্ত ছিল না। অমায়িক স্বভাবের এই মানুষটির সর্বশ্রেণির মানুষের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক ছিল। তাঁর কথাবার্তায় থাকত বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা। সংস্কৃতে তিনি কবিতাও রচনা করতেন। এঁর প্রতিবেশী ছিলেন ডা: মুনিশ্বর ঘোষ। মহৎহৃদয়, দানশীল ও মানবহিতৈষী খ্যাতিমান এই মানুষ দুটির মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে দুজনেই মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ায় এই বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।
মৃত্যুকালে রামলোচন সেন রেখে গেছেন শিক্ষিত পুত্র কালীপ্রসন্নকে। এঁর চিকিৎসালয় কম্বুলিটোলায়। এঁর বয়স অল্প, মাত্র ২৬ বছর, কিন্তু সংস্কৃত ও আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ইনি সুপন্ডিত, ইংরেজিও জানেন। মুল সংস্কৃত থেকে তিনি চক্রদত্তের মতো কয়েকখানি চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। চিকিৎসক হিসাবেও তাঁর যথেষ্ট পসার আছে। তাঁর কাকা গঙ্গাপ্রসাদ, দূর্গাপ্রসাদ ও অন্নদাপ্রসাদের মতো তিনিও বহু নিরাশ রোগীকে নিরাময় করেছেন। কয়েকজন ছাত্র তাঁর কাছে আয়ুর্বেদ শিক্ষা করেন। আবার প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকগণও অনেক সময় তাঁর পরামর্শ নেন।
ঢাকায় সেন পরিবারের একটা তালুক আছে। কলকাতাতেও তাঁদের ভূসম্পত্তি আছে। এখানেই তাঁরা সাধারণত বসবাস করেন।