কামরূপী বনাম (?) ‘কামতাপুরি’

কামরূপী বনাম (?) ‘কামতাপুরি’

১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘The Origin and Development of the Bengali Language’ গ্রন্থে অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলা ভাষার কথ্য উপভাষাগুলিকে অঞ্চলভিত্তিতে চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন : রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বঙ্গালী ও কামরূপী। সেইসঙ্গে তিনি রাঢ়ী উপভাষার দুটি উপবিভাগও নির্দেশ করেছিলেন : পূর্বী ও পশ্চিমা। কিছুদিন পর সুনির্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে রাঢ়ীর পশ্চিমা উপবিভাগকে স্বতন্ত্র উপভাষা হিসাবে চিহ্নিত করে তার নাম দেওয়া হল ঝাড়খন্ডী। তারপর থেকে বিদ্বৎ সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বাংলা কথ্য উপভাষার সংখ্যা পাঁচটি বলেই স্বীকৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে এ-ব্যাপারে নতুন কথা শোনা গেল। প্রথম প্রথম কিছু মৌখিক প্রচার, তারপর নব্বইয়ের দশকে লিখিত প্রচার ও গ্রন্থপ্রকাশ। এ সমস্তই ঘটল কামরূপী উপভাষার শুধু ভারতীয় এলাকায়। ১৯৮১ সালের জনগণনার সময় দেখা গেল বেশ কিছু মানুষ, যারা আগের জনগণনায় নিজেদের মাতৃভাষা বাংলা বলে নথিভুক্ত করিয়েছে, এবার তারা মাতৃভাষার নাম বাংলার বদলে ‘কামতাপুরি’ বলে নথিভুক্ত করাতে চায়। এরপর ১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে জলপাইগুড়ি থেকে মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হল A Step to Kamata Bihari Language লেখক শ্রীধর্মনারায়ণ বর্মা এম.এ.বি.টি.। লক্ষণীয়, এই বইয়ের মলাটে লেখা আছে ‘Kamata Bihari Language’, কিন্তু মলাট ছাড়া বইয়ের ভিতরে কোথাও ‘কামতাবিহারী’ শব্দটি নেই, সর্বত্র আছে কামতাপুরি বা K.L. Language (!)। এ বইতে তথাকথিত ‘কামতাপুরি’ ভাষাকে কোথাও বলা হয়েছে সংস্কৃতের কাছাকাছি, কোথাও-বা বলা হয়েছে মৈথিলী ভাষার সঙ্গে এর ‘tremendous similarity’ (পৃ ৮)। বইয়ের গোড়াতে (পৃ ১) অবশ্য তিনি বলেছেন ওড়িয়া, বাংলা, অসমিয়া, কামতাবিহারী/কামতাপুরির মতো মুখ্য ভারতীয় ভাষাগুলির উদ্ভব মৈথিলী ভাষা থেকে। কামতাপুরির উদ্ভবকাল ও প্রচলন সম্পর্কে তাঁর মত :This language which dates its origin from the charuya (sic) pada of between 8th to 12 century, was the administrative and educational medium in the reign of Kamtapur Kings-from the 13th Century down to the 19th Century (পৃ ৩)। ইতিমধ্যে ‘কামতাপুরি’-র নাম করে ধীরে ধীরে কতকগুলি গণসংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত হল আকসু (AKSU-All Kamtapur Students’ Union)। ১৯৯৬ সালে এদের প্রচারিত ইস্তেহারে ধর্মনারায়ণবাবুর তত্ত্বকে মূলধন করেই তাতে কিছু আবেগের মাত্রা যোগ করা হল—সেআবেগ বঞ্চনার আবেগ। তাতে বলা হল : কামতাপুরি ভাষা বাংলা আর অসমিয়া ভাষার জননী। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা ও অসমিয়া ভাষা কামতাপুরিকে তাদের উপভাষা বলে দাবি করছে। প্রকৃত ঘটনা হল : কোচবিহারের রাজাদের আমলে ‘কামতাপুরী ছিলো রাজভাষা বড়ই আদরের। শৈবভূমি রত্নপীঠ কামতাপুর রাইজ্যত কামতাপুরী ভাষাত কত বই-পুস্তক অনুবাদ লেখা হইসে— লেখা আছে।’ পরে কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ‘১৯৪৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্য কোচবিহারকে ভারত সরকারের হাতে তুলে দেন। এরপর ১৯৫০ সালের পয়লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গভুক্তির কথা ঘোষণা করেন। এইভাবে একটি স্বাধীন রাজ্য হয়ে গেল একটি অঙ্গরাজ্যের জেলামাত্র। সেই থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কামতাপুরবাসীকে পরাধীন করে রেখেছে। এই সরকার কামতাপুরের ভাষা ‘কামতাপুরি’-র প্রচলন নিষিদ্ধ করে সেখানে বাংলা ভাষা চালু করেছে। ফলে কামতাপুরবাসীর ‘স্বাধীনতা—কামতাপুরী ভাষা-সাহিত্য’ সহ সমস্ত কিছুই চুরি হয়ে গিয়েছে (‘তামান গেইসে চুরি’)। কাজেই এই অন্যায় শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে সেই হৃত রাজ্যের স্বাধীনতা, সেই হৃত ভাষার স্বাধিকার। লড়াই করে এই রাজ্য উদ্ধার করতে পারলেই কোচবিহার/কামতাপুরবাসীর সমস্ত দুঃখকষ্ট ও লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসান হবে। তাই কামতাপুরবাসী ছাত্র, যুব ও সমস্ত জনগণের কাছে প্রকাশ্য আহ্বান : ‘চেতনা হঞা আগেয়া আইস।’ চারিদিকে আন্দোলন ছড়িয়ে যেতে দেখে কামতাপুর-তাত্ত্বিকেরা উৎসাহিত হলেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ চলিত বাংলা ছেড়ে ‘কামতাপুরি’-তে লিখতে লাগলেন। সাময়িকপত্র প্রকাশিত হল ‘কামতাপুরি’-তে, তাতে আবার বাংলা কবিতা ‘কামতাপুরি’-তে ‘অনুবাদ’ করে ছাপা হতে লাগল। ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’-র ভাষান্তর হল ‘কামতাপুরি’-তে। নাটকের ভিডিয়ো ক্যাসেট বাজারে ছাড়া হল ‘কামতাপুরি’ ভাষায় চিত্রায়িত করে। এরপর ধর্মনারায়ণ বাবু আর একখানি বই প্রকাশ করলেন ‘কামতাপুরী ভাষা সাহিত্যের রূপরেখা’ (নভেম্বর ২০০০)। বইখানি তথাকথিত ‘কামতাপুরি’ ভাষায় রচিত। এই বইতে ধর্মনারায়ণবাবু বাংলা-কামতাপুরির সম্পর্ক নিয়ে চমকপ্রদ কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘কামতাপুরি’-কে বাংলা ভাষার উপভাষা বলে অভিহিত করা অযৌক্তিক। কারণ কামতাপুরির তুলনায় বাংলা ভাষা অনেক অর্বাচীন। কামতাপুরির প্রচলন ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে, আর অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ‘বাংলা বুলি কুন ভাষা না আছিল’ (পৃ: ১২-১৩)। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ পড়েই বাঙালির মাতৃভাষা শিক্ষা। সুতরাং বলা যায় বিদ্যাসাগরের সময় থেকেই বাংলা ভাষার প্রকৃত প্রচলন। ধর্মনারায়ণবাবু চর্যা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে কামতাপুরি ভাষারই নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বাংলা বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, অনুবাদকাব্য ইত্যাদি সম্পর্কে একেবারে নীরব। ধর্মবাবুর এই উদ্ভট তত্ত্বে অনেকেই কৌতুক বোধ করে পুরো ব্যাপারটাই হেসে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কিছুতেই হেসে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ২০০১ সালের জনগণনায় আগের চেয়ে আরও সংগঠিতভাবে ‘কামতাপুরি’-কে মাতৃভাষা বলে নথিভুক্ত করার চেষ্টা দেখা গেল এবং এর সঙ্গে আরও যুক্ত হল একদিকে ভোটের সুবিধাবাদী রাজনীতি, অন্যদিকে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট সশস্ত্র সন্ত্রাস। সুতরাং বিষয়টি আর ভাষাতত্ত্বের কেতাবি সীমার মধ্যে আটকে রইল না, ছড়িয়ে গেল বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। ভোটের ফলাফলকে যদি জনমতের প্রকৃত সূচক বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে বোঝা যায় বিধানসভা ভোটে (মে, ২০০১-এর) উত্তরবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটদাতারা ‘কামতাপুরি’-র ভাষিক স্বাধিকারের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। তবু ওই বিধানসভা ভোটের ফলাফলের একটি বেসরকারি বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন নির্বাচনী ক্ষেত্রে কামতাপুরি প্রার্থীদের সাফল্যের হার ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ‘কামতাপুরি’ প্রসঙ্গটি উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও এখনও সজাগ আছে। আর সেইজন্যই বোধহয় কামতাপুরি সভাসমিতি বড়ো আকারে না হলেও এখনও অব্যাহত এবং খবরের কাগজে ‘কামতাপুরি’ ভাষার গৌরব এখনও ফলাও করে প্রচার করেন সংবাদপত্রের পত্র-লেখক :

বর্তমান বাংলায় ঋ ও ৯-এর ব্যবহার নেই বা একেবারেই কম। কিন্তু কামতাপুরি ভাষায় ঋ ও ৯-এর ব্যবহার যথেষ্ট। আর ঋ ও ৯-এর ব্যবহার দেখা যায় ‘ঋগ্বেদে’। এতে প্রমাণিত হয় কামতাপুরি ভাষা ঋগ্বেদের সমকালীন। এর থেকে আরও প্রমাণিত বাংলা ভাষার জন্ম কামতাপুরি ভাষার বহু পরে। তাই কামতাপুরি ভাষা বাংলা ভাষার উপভাষা নয়। বরং চর্যাচর্যের উচ্চারণবিধি ও আজকের কামতাপুরি জনজাতির শব্দ উচ্চারণের যথেষ্ট মিল আছে। এই মিল থাকায় বলতে হবে কামতাপুরি ভাষা থেকে হয়তো বা বাংলা ভাষার জন্ম। নয়তো একথা স্বীকার করতেই হবে কামতাপুরি ভাষা বাংলা ভাষার বড়দাদা।

মো: আশিক হোসেন চৌধুরি, কোচবিহার (উত্তরবঙ্গ সংবাদ : জনমত, ১৯.১০.২০০২)।

বলাবাহুল্য, এই অসংলগ্ন বক্তব্য ধর্মনারায়ণি তত্ত্বেরই অসংযত ও তথ্যভ্রষ্ট সম্প্রসারণ। বৈদিক স্বরধ্বনি ঋ ৯ বহুদিন আগেই লুপ্ত, শুধু বাংলা কেনো কোনও মধ্যভারতীয় ও নব্য ভারতীয় আর্যভাষাতেই এই দুটি ধ্বনির উচ্চারণ নেই, যা আছে তা হল ওই দুটি ধ্বনির লিখিত প্রতিরূপ বা বর্ণ, যা শুধু তৎসম শব্দের বানানে লেখা হয়, কিন্তু উচ্চারণ করা হয় না। যাই হোক, উত্তরবঙ্গ সংবাদের পাঠক-পাঠিকারা অবশ্য শ্রীচৌধুরির বক্তব্য মাথা পেতে মেনে নেননি। ওই পত্রিকার ৮ নভেম্বর, ২০০২ তারিখের ‘জনমত’ স্তম্ভে প্রকাশিত তিনটি পত্রে [লেখক : (১) সমীর দত্ত, চাউলহাটি রোড, জলপাইগুড়ি (২) শুভ্র সমাজদার, অরবিন্দনগর, জলপাইগুড়ি এবং (৩) সাধনা চাকি, ম্যাগাজিন রোড, কোচবিহার] এই বক্তব্যের বিরুদ্ধতা করা হয়েছে। কিন্তু এইসব বিরুদ্ধ বক্তব্যও যথেষ্ট তীক্ষ্ণ ও তথ্যসমৃদ্ধ নয়। ফলে বোঝা যাচ্ছে এ ব্যাপারে সকলের ধারণা সমান স্পষ্ট নয়—সঠিক তথ্য ও সঠিক যুক্তির জোগান এখনও অনেকের কাছে দুর্লভ হয়ে আছে। এ তো গেল উত্তরবঙ্গের কথা। এ ব্যাপারে বাংলার অন্যান্য এলাকার অবস্থাটা কেমন? বাংলার অন্যান্য এলাকা, বিশেষত যে এলাকার বুদ্ধিচর্চা বাংলার সামগ্রিক বুদ্ধিচর্চাকে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাবিত করে, আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় এই এলাকায় যাঁরা বাংলা ভাষার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন, তাঁদের অনেকের কাছেই বিষয়টি পরিষ্কার নয়। ফলে অনেক অবুঝ বিভ্রান্তি, অনেক অকারণ জল্পনা। এ অবস্থারও পরিবর্তন হওয়া দরকার। তা হলেই বাংলা ভাষার প্রতি যথার্থ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়া হবে।

দুই

বোঝা যাচ্ছে, ‘কামতাপুরি’কে ঘিরে নানারকম জট পাকিয়ে গিয়েছে। সেইসব জট ছাড়াতে পারলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা অনেকটা পরিষ্কার হতে পারে। প্রথমত ভাষার নাম হিসাবে প্রচলিত ‘কামতাপুরি’ শব্দটিই ধরা যাক। এই নামে কোনো ভাষার অস্তিত্বের কথা কোথাও কোনো নথি বা দলিলে কি পাওয়া যায়? কামতাপুরিদের মতে তো এই ভাষার প্রচলন অষ্টম শতাব্দী থেকে (ঋগবেদের সমকালীনতার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল), তাহলে এই ভাষার বয়স হাজার বছরেরও বেশি। কিন্তু হাজার বছরের কোনো দলিলেই তো ‘কামতাপুরি’ নামের কোনো ভাষার উল্লেখ পাওয়া যায় না। এমনকি কামতা-রাজ্যের কোচ রাজাদের আমলে কয়েক-শো বছর ধরে লিখিতভাবে অনেক সাহিত্যচর্চা হয়েছে, সেখানেও এই নামের কোনো ভাষার উল্লেখ নেই। কামতা-রাজ্যের ষোড়শ শতকের কবি পীতাম্বর সিন্ধান্তবাগীশ রাজার আদেশে সংস্কৃত মার্কন্ডেয় পুরাণের অনুবাদ করেছিলেন। কাব্যের গোড়ায় তিনি বলেছেন :

পুরাণাদি শাস্ত্রে জেহি রহস্য আছয়।

পন্ডিতে বুঝয় মাত্র অন্যে না বুঝয়।।

এ কারণে শ্লোক ভাঙ্গি সবে বুঝিবার।

নিজ দেষ ভাষাবন্দে রচিয়ো পয়ার।।

লক্ষণীয়, পীতাম্বর ভাষার নাম হিসেবে ‘কামতাপুরি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি, ব্যবহার করেছেন ‘নিজ দেষ ভাষাবন্দ’ অর্থাৎ নিজের দেশি ভাষাবন্ধ, যা ব্যাকরণ ও ভাষাতত্ত্বের বিচারে বাংলা ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা নয়। এইভাবেই কয়েকশো বছর চলে গিয়েছে, কিন্তু কোথাও ‘কামতাপুরি’ নামটি পাওয়া যাচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে (১৯০৩) গ্রিয়ার্সন যখন তাঁর ভারতীয় ভাষা সমীক্ষার বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক ৫ম খন্ড ও ১ম ভাগটি প্রকাশ করলেন তখন সেখানে তিনি এখন যেসব এলাকার ভাষাকে ‘কামতাপুরি’ বলা হচ্ছে সেইসব এলাকার ভাষার একাংশকে বাংলা ভাষার (গোয়ালপাড়া, রংপুর, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারে প্রচলিত) ‘রাজবংশী’ বা ‘রংপুরি’ উপভাষা ও অন্য অংশকে (দিনাজপুর, পুর্নিয়া ও মালদহ-এ প্রচলিত) বাংলার উত্তরাঞ্চলীয় উপভাষা (‘Northern Bengali’) বলে অভিহিত করেছেন। এরপর পঞ্চানন সরকার (বর্মা) রঙ্গপুর শাখা সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ১৩১৪ সনের (=১৯০৭) ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত ‘কথা ও ছিল্কা’ প্রবন্ধে এ প্রসঙ্গে ‘কমতাবিহারী’ শব্দ (পৃ ৮৫) ও ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গোবিন্দ মিশ্রের গীতা’ প্রবন্ধে ‘কামতাবিহারী’ (বিকল্পে ‘কুচবিহারী’) শব্দ (পৃ ১২৯) ব্যবহার করেছেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ১৩১৮ সনের (=১৯১১) ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘কামতাবিহারী ভাষা সম্বন্ধে যৎকিঞ্চিৎ’ প্রবন্ধে (প্রবন্ধটি উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের মালদহ অধিবেশনে পঠিত হয়েছিল) পূর্ণেন্দুমোহন সেহানবীশ পঞ্চানন সরকারের নামকরণ সমর্থক করে বলেছিলেন :

এই ভাষাকে কোচ বা রাজবংশী এই জাতিগত সংকীর্ণ আখ্যার পরিবর্তে প্রাচীন সেন (ক্ষেণ) ও আধুনিক কোচ রাজত্বের নামানুসারে কামতাবিহারী ভাষা নামে অভিহিত করাই যেন অধিকতর সমীচীন বলিয়া মনে হয় (পৃ ২২০)।

যাই হোক, রংপুরি, কামতাবিহারি বা কুচবিহারি—ভাষার নাম হিসাবে কোনো শব্দই বৃহত্তর জনমানসে খুব একটা রেখাপাত করেনি। এই অবস্থায় সম্ভবত একটা সুস্পষ্ট দিকনির্দেশের জন্যই সুনীতিবাবু ‘কামরূপী’ শব্দটি ব্যবহার করলেন (১৯২৬)। সুনীতিবাবু আগে ও পরে বিশ শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত ভাষার নাম হিসাবে কোথাও ‘কামতাপুরি’ শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে শব্দটি নতুন আমদানি এবং তারও বয়স মাত্র ২০/২৫ বছর। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে অর্বাচীন ‘কামতাপুরি’ শব্দটি ব্যবহার করে সুনীতিবাবু কোনো ভ্রম সংশোধন করতে চাওয়া হয়েছে ?

এ কথা ঠিক যে ‘কামতাপুরি’ শব্দটির যেমন কোনো প্রাচীন উল্লেখ নেই, সুনীতিবাবুর ‘কামরূপী’ শব্দটিরও তেমনি খুব প্রাচীন উল্লেখ নেই (অবশ্য রঙ্গপুর সাহিত্য পত্রিকার ১৩১৪ (=১৯০৭) সনের ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গোবিন্দ মিশ্রের গীতা’ প্রবন্ধে পঞ্চানন সরকার সুনীতিবাবুর আগেই ভাষার নাম হিসাবে ‘কামরূপী শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন)। তবে সুনীতিবাবুর নামকরণে একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্যানুগত্যের নীতি অনুসৃত হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন :

The dialects of Bengali fall into four main classes, agreeing with the four ancient divisions of the country : Radha; Pundra or Varendra; Vanga; and Ka-ma-ru-pa (p. ODBL, Vol-I, P. 138, বক্রাক্ষর বর্তমান লেখকের)।

পক্ষান্তরে কামতাপুর রাজ্যের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব তার কালসীমা ও স্থানসীমা সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা একমত নন। কিন্তু কামরূপের প্রাচীনতা ও ঐতিহ্যগৌরব প্রশ্নাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং অনিশ্চিত ‘কামতাপুরি’ দিয়ে সুনিশ্চিত ‘কামরূপী’র ভ্রম (?) সংশোধন কতটা যুক্তিসম্মত? তাছাড়া, সুনীতিবাবুর নামকরণে তো ঐতিহ্যপ্রীতির সঙ্গে শ্রদ্ধাও প্রচ্ছন্নভাবে জড়িয়ে আছে! সুতরাং নামকরণের ব্যাপারে সুনীতিবাবুর দোষটা কোথায়?

কেউ বলতে পারেন, সুনীতিবাবু যাকে, ‘কামরূপী’ বলেছেন তাকেই যে এখন ‘কামতাপুরি’ বলা হচ্ছে তার প্রমাণ কোথায়? প্রমাণ আছে সুনীতিবাবুর ODBL (১৯২৬) ও ধর্মনারায়ণবাবুর A step to Kamata Bihari language (১৯৯১) বইদুটিতে। প্রথম বইতে সুনীতিবাবু কামরূপী উপভাষার (পৃ. ১৪০) ও দ্বিতীয় বইতে ধর্মনারায়ণবাবু কামতাপুরি ভাষার (পৃ. ৬) সীমাসরহদ্দ নির্দেশ করেছেন। দুটি ক্ষেত্র তুলনা করলে দেখা যায় দুজনের বিবরণ বহুলাংশে এক ও অভিন্ন। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, সুনীতিবাবু যাকে ‘কামরূপী’ বলেছেন, ধর্মবাবু তাকেই ‘কামতাপুরি’ বলে প্রচার করেছেন। এখানে ধর্মবাবুর সপক্ষে একটা কথা উঠতে পারে যে, সুনীতিবাবু এই এলাকার ভাষাকে বাংলা ভাষার উপভাষা বলে অভিহিত করে এর মর্যাদাহানি করেছেন (কারণ ‘উপ’ উপসর্গে তো অবস্থানগত হীনতা বোঝায় : রাষ্ট্রপতি—উপরাষ্ট্রপতি, আচার্য—উপাচার্য; পত্নী—উপপত্নী ইত্যাদি), কিন্তু ধর্মবাবু এই ভাষাকে পূর্ণ গৌরব দিয়ে বাংলা থেকে স্বাতন্ত্র ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন (এবং বাংলার চেয়েও যে এর গৌরব বেশি তা প্রচার করতে গিয়ে ইদানীং এই ভাষাকে বাংলার চেয়েও অনেক প্রাচীন, এমনকী বাংলার জননী-স্থানীয় বলতেও দ্বিধা করছেন না)। সুতরাং ধর্মবাবুর উদ্দেশ্য তো সাধু! সাধু তো বটে, কিন্তু তা কতটা বিজ্ঞানভিত্তিক?

‘কামতাপুরি’ ভাষা না উপভাষা এ-ব্যাপারে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক নিষ্পত্তি করতে হলে দেখা দরকার আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা ও উপভাষার সংজ্ঞা কী এবং উভয়ের সম্পর্কের বিষয়টি ভাষাবিজ্ঞান কীভাবে দেখে। প্রায় একশো-সোয়াশো বছর আগে পাশ্চাত্য ভাষাবিজ্ঞানে এ-ব্যাপারে জটিল বিতর্কের সূচনা হয়। তখন ভাষাকে একটি পূর্ণাঙ্গ একক বলে মনে করা হত এবং উপভাষা তার ভগ্নাংশ। ভগ্নাংশ যেমন পূর্ণ থেকে ছোটো, উপভাষাও তেমনি ভাষার চেয়ে মর্যাদায় ছোটো বা খাটো (বস্তুত ‘উপভাষা’ শব্দটি ‘উপ’ উপসর্গেই এই ছোটোত্বের ব্যঞ্জনা প্রকাশিত)। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে এই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, অথচ আমাদের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের সূত্রে আমরা এখনও এই প্রাক্তন ভ্রান্ত ধারণার দায় বহন করে চলেছি। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাষা হচ্ছে সমাজে ভাববিনিময়ের একটা ব্যবস্থা (System)। এই ব্যবস্থার কোনো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তব চেহারা নেই, কিন্তু ভাববিনিময়ের জন্য যখন সেই ব্যবস্থার ব্যবহার করা হয় তখন তার একটা ব্যাবহারিক রূপ প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। অরূপ ‘ভাষার’ এই ব্যাবহারিক প্রত্যক্ষ রূপই হচ্ছে ‘উপভাষা’। এখানে ‘উপভাষা’-র ‘উপ’ উপসর্গটি হীনতা বা ছোটোত্ব প্রকাশ করছে না, প্রকাশ করছে প্রত্যক্ষতার ভাব। যেমন, স্থিত (=আছে)—উপস্থিত (=সামনে আছে বা সামনে হাজির)। স্থাপন (=রাখা)—উপস্থাপন (=সামনে রাখা), নীত (=নেওয়া হয়েছে এমন)—উপনীত (=সামনে বা কাছে আগত) ইত্যাদি। সুতরাং ‘উপভাষা’ হচ্ছে অরূপ বা বিমূর্ত ভাষার প্রত্যক্ষ ব্যাবহারিক রূপ। সাধারণভাবে প্রয়োগক্ষেত্র অনুসারে প্রায় প্রত্যেক উপভাষার দুটি প্রাথমিক রূপ : কথ্য ও লেখ্য (কোনো ভাষাগোষ্ঠীতে মাতৃভাষায় লেখাপড়ার চল না থাকলে সেখানে সংশ্লিষ্ট ভাষার শুধু কথ্য উপভাষাই পাওয়া যাবে)। কিন্তু উপভাষার রূপভেদ থাকলেও ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি উপভাষারই মূল্য সমান সমান, কেউ কারও চেয়ে ছোটোও নয়, বড়োও নয়। তবে উপভাষার নমুনা দিতে হলে তার লেখ্য উপভাষাকেই ওই ভাষার উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়। বলাবাহুল্য সেই উদাহরণও আংশিক। কোনো ভাষার সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে হলে তার কথ্য ও লেখ্য দুই রূপেরই পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। সুতরাং ভাষা=কথ্য উপভাষা+লেখ্য উপভাষা। বাংলা ভাষার উদাহরণ নিলে বাংলা ভাষা=বাংলার ৫টি কথ্য উপভাষা+৩টি লেখ্য উপভাষা (পদ্য+সাধু গদ্য+চলিত গদ্য)। ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে এই ৮টি উপভাষারই মর্যাদা সমান। সুতরাং কামরূপী তথা ‘কামতাপুরি’কে ‘উপভাষা’ বললে তার মর্যাদাহানি হয় না—বৈজ্ঞানিকভাবেই এ কথা সত্য।

তিন

তবে এখানে আরও কিছু প্রশ্নের অঙ্কুর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মানা গেল ‘কামতাপুরি’ একটি উপভাষা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীরকম উপভাষা—কথ্য না লেখ্য? বিচার করলে দেখা যায় ‘কামতাপুরি’ শেষপর্যন্ত একটি কথ্য উপভাষা। কারণ, লেখ্য উপভাষার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক উপাদান, অন্বয়, শব্দভান্ডার ইত্যাদির একরূপতা (uniformity) অর্থাৎ বিভিন্নতার সংখ্যা হ্রাস [যেমন, বাংলা কথ্য উপভাষায় কর্ম কারকে কে (রাঢ়ী), রে (বঙ্গালী), ক (কামরূপী)—এই তিনরকম বিভক্তি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু লেখ্য উপভাষায় এক্ষেত্রে বিভক্তি মাত্র একটি—‘কে’]। সুতরাং উপাদানগত অভিন্নতা লেখ্য উপভাষার মৌল লক্ষণ, আর উপাদানগত বিভিন্নতা কথ্য উপভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ধর্মনারায়ণবাবু স্বয়ং তাঁর ‘কামতাপুরী ভাষা সাহিত্যের রূপরেখা’ বইতে সুবিস্তৃত উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘‘দিনাজপুর, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, গোয়ালপাড়ায় শব্দরূপের খানেক ব্যাগলতা বিদ্যমান (পৃ. ৯৬)…দক্ষিণ দার্জিলিংয়ে ধাতুরূপক্ষেত্রত কামতাপুরী ভাষার অন্যান্য অঞ্চলের ব্যাগলতা লক্ষণীয় (পৃ. ১০৮)’’। এরপর বিস্তৃত তালিকার সাহায্যে তিনি ‘কামতাপুরি’-র বিভিন্ন রূপতাত্ত্বিক ‘ব্যাগলতা’ বা বিভিন্নতার পরিচয় দিয়েছেন (পৃ: ৯৬-১১৭)। এই ‘ব্যাগলতা’-বিশিষ্ট রূপান্তরগুলি আসলে কামতাপুরি উপভাষার বিভিন্ন বি-ভাষার (sub-dialects) রূপান্তরমাত্র। এই ‘ব্যাগলতা’-র বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য থেকেই বোঝা যায় ‘কামতাপুরি’-তে লেখ্য উপভাষার উপযোগী সর্বজনগ্রাহ্য ও অঞ্চলনিরপেক্ষ একরূপতা গড়ে ওঠেনি। ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘কামতাপুরি’ তাই একাধিক বিভাষা-বিশিষ্ট একটি কথ্য উপভাষা, যার মর্যাদা বাংলার লেখ্য উপভাষা ও অন্য কথ্য উপভাষা থেকে কোনো অংশে কম নয়।

এবার আর একটা প্রশ্ন উঠবে : বোঝা গেল ‘কামতাপুরি’ একটি কথ্য উপভাষা। কিন্তু তার সহোদরতুল্য লেখ্য উপভাষাটি কী? সুনীতিবাবু ও তাঁর অনুগামীরা লেখ্য উপভাষাটিকে ‘বাংলা’ বলে চিহ্নিত করেছেন, অন্যদিকে ধর্মবাবু ও তাঁর অনুগামীরা এই জায়গায় ‘মৈথিলী’-র কথা এনে ফেলেন। কিন্তু ধর্মবাবু মৈথিলীর সঙ্গে ‘কামতাপুরি’-র ‘tremendous similarities’-এর কথা বললেও তিনি বা তাঁর কোনো অনুগামীই সেই ‘similarities’-এর জায়গাগুলি উপযুক্ত তথ্য ও যক্তি দিয়ে পরিস্ফুট ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। সুতরাং মৈথিলীর সঙ্গে এর সম্পর্কের দাবিকে যুক্তিহীন ও অমূলক বলা ছাড়া আর উপায় কী? পক্ষান্তরে, লেখ্য (চলিত) বাংলা ও ‘কামতাপুরি’-র মধ্যে তুলনা করলে দেখা যায় দুই উপভাষার মূল স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনিগুলির সংখ্যা এক ও অভিন্ন এবং উভয়ের বাক্যগঠনের মূল কাঠামোও একরকম। পার্থক্য যা তা মূলত উচ্চারণে, রূপতত্ত্বে ও শব্দভান্ডারে—এ পার্থক্য তো এক উপভাষা থেকে অন্য উপভাষায় থাকবেই এবং এই পার্থক্য থাকে বলেই তা লেখ্য নয়, কথ্য। ধর্মবাবুর নিজের রচনা থেকে উদাহরণ নিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক। তাঁর ‘কামতাপুরী ভাষাসাহিত্যের রূপরেখা’-র প্রথম কয়েকটি বাক্য (এই বইটি তথাকথিত ‘কামতাপুরি’-তে রচিত বলে দাবি করা হয়েছে):

উত্তরপূর্ব ভারতের প্রধান ভাষাকে নিয়া পন্ডিত সমাজত বিতর্কের শ্যাষ নাই। ফাইক মানসিয়ে এই গৌরবোজ্জ্বল প্রাচীন ভাষাটাক উপভাষা আখ্যা দিয়া ওটি ঘুনায় উমার উমার কর্তব্যর ইতিরেখা টানিবার চান। সমাজ ইতিহাসের বিবর্তনের ধারাত এক ডাঙ্গর সত্যটাক উমরা মানি নিবার না চায় (পৃ ১)।

এখানে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি শব্দ ও বিভক্তিযুক্ত পদ ছাড়াও বাক্যগুলিতে সামগ্রিকভাবে চলিত বাংলা তথা আধুনিক বাংলা লেখ্য উপভাষার বাক্যগঠনের রীতি অনুসৃত হয়েছে। যেসব শব্দ/পদ চলিত বাংলার অনুরূপ নয় শতাংশের বিচারে তাদের অনুপাত খুব কম। তাছাড়া চলিত বাংলার শব্দভান্ডার-শব্দরূপ-ধাতুরূপের আদর্শে এক্ষেত্রে সমার্থক শব্দ-শব্দরূপ-ধাতুরূপ ব্যবহার করলেই বাক্যগুলি পুরোপুরি চলিত বাংলার বাক্যে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের জন্য বাক্যের অন্বয় বা বিন্যাসে কোনো গুরুতর পরিবর্তন করতে হয় না। এ থেকেই বোঝা যায় বাক্যগুলির মৌল কাঠামো চলিত বাংলার কাঠামোর অনুরূপ। ধর্মবাবু সেই কাঠামোর মধ্যে নিতান্ত কৃত্রিমভাবে কিছু আঞ্চলিক শব্দ-শব্দরূপ-ধাতুরূপ ভরে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাক্যগুলির কাঠামোতে কোনো অন্যনিরপেক্ষ স্বাতন্ত্র্যের লক্ষণ ফুটে ওঠেনি। এর কারণ, লেখ্য বাংলায় যাকে বাংলা ভাষার মান্য (standard) রূপ বলা হয়, তা থেকে ‘কামতাপুরি’-র কোনো মৌলিক স্বাতন্ত্র্য নেই। চলিত বাংলার সঙ্গে ‘কামতাপুরি’-র যে তফাত তা এক উপভাষার সঙ্গে অন্য উপভাষার ব্যাবহারিক তফাত। বলাবাহুল্য, এ তফাত বহিরঙ্গের, অন্তরঙ্গের নয়। এমনকি ধর্মবাবু নিজেও একথা স্বীকার করে বলেছেন : ‘রাঢ়ী উপভাষার সাথত এটিকার উচ্চারণের মিল আছে’ (পৃ ৩১)। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, ‘কামতাপুরি’ বাংলা ভাষার অন্যান্য উপভাষারই সহোদরতুল্য, তা ঋগবেদের (আনুমানিক ২০০০খ্রিস্টপূর্বাব্দ—১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) সমকালীন নয় বা বাংলারও ‘বড় দাদা’ নয়। একথা সত্য, ‘কামতাপুরি’-তে এমন কিছু ধ্বনিলক্ষণ, রূপবৈশিষ্ট্য ও শব্দভান্ডার অদ্যাবধি রক্ষিত যা হয়তো প্রাচীন চর্যাগান ও মধ্যযুগের কাব্যসাহিত্যে সুলভ কিন্তু আধুনিক লেখ্য বাংলায় লুপ্ত বা অপ্রচলিত। এই রক্ষণশীলতার কারণ এই এলাকার শিল্পায়নহীন কৃষি ও অরণ্যনির্ভর সামন্তযুগীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। সামন্ততান্ত্রিক প্রভাবে সমাজ যেখানে রক্ষণশীল ও আত্মসংবৃত, সেখানে অন্যতম সামাজিক আচরণ হিসাবে ভাষা-ব্যবহারেও সেই রক্ষণশীলতা অনিবার্য। তবে এই রক্ষণশীলতা অগৌরবের নয়, গর্বের এবং সেই গর্ব বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের সম্পদকে সজীবভাবে ধরে রাখার জন্য। ‘কামতাপুরি’ বাংলা ভাষার পুরাতাত্ত্বিক ভগ্নপ্রাসাদ নয়, আধুনিক বাংলা ভাষারই অভিন্ন অলিন্দ—যা সমসাময়িক হয়েও আঞ্চলিক বিশিষ্টতার দাবি রাখে। উত্তরবঙ্গের ঢেঁকি শাক, লাফা শাক, বোরোলি মাছ বা কুর্শা মাছ যেমন জীববিজ্ঞানীর কাছে (সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই) আঞ্চলিক জীববৈচিত্র্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, উত্তরবঙ্গের ‘কামতাপুরি’ ওরফে কামরূপীও তেমনি ভাষাবিজ্ঞানীর কাছে বাংলা ভাষার উত্তরবঙ্গীয় বাকবৈচিত্র্যের আদরণীয় নিদর্শন।

পরিশেষে আর একটি কথা। বোঝা গেল ‘কামতাপুরি’ বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক কথ্য ভাষা। তবে এই ভাষার অভ্যন্তরীণ সম্পদ তো কম নয়, সুতরাং কালক্রমে এই কথ্য ভাষাই একদিন লেখ্য ভাষায় পরিণত হতে পারে না কি? অতীতে তো দেখা গিয়েছে, এখন যেটি ‘অসমিয়া’ ভাষার স্বতন্ত্রে মর্যাদা পেয়েছে তার ভিত্তিতে তো ছিল বাংলারই কামরূপী উপভাষা। সুতরাং ‘কামতাপুরি’ই-বা একদিন স্বতন্ত্র লেখ্য ভাষায় পরিণত হবে না কেন? বিশেষ করে একালের ভাষাবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা ভাষা-পরিকল্পনা (Language planning)-র অন্তর্গত Status planning বা অবস্থান-পরিকল্পনা যখন শেখায় কীভাবে একটি কথ্য উপভাষা ধারাবাহিক ও ব্যাপক অনুশীলনের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত লেখ্য ভাষার সামাজিক মর্যাদা লাভের যোগ্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে উত্তরবঙ্গে এখন ‘কামতাপুরি’-কে ঘিরে এই অবস্থান-পরিকল্পনার কাজই সুকৌশলে চালানো হচ্ছে। এই কারণেই উত্তরবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ চলিত বাংলা ছেড়ে ‘কামতাপুরি’-তে লেখার চেষ্টা করেছেন, ‘কামতাপুরি’তে ব্যাপকভাবে পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা হচ্ছে, সংস্কৃতে লেখা ধর্মগ্রন্থের ভাষান্তর হচ্ছে ‘কামতাপুরি’তে। ‘কামতাপুরি’তে জনপ্রিয় ভিডিও সিনেমা তোলা হচ্ছে এই একই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবে। কিন্তু এইসব অনুশীলন কতদূর সফল হবে? কারণ কথ্য ভাষার পক্ষে লেখ্য ভাষায় রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত দুটি বাস্তব পরিস্থিতির সহযোগিতা দরকার। এর একটি হল ভাষার মূল স্রোতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কথ্য ভাষার সংযোগ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসা এবং আর একটি হল এই ক্ষীয়মাণতার মুহূর্তে উক্ত উপভাষার সঙ্গে অন্য কোনো প্রভাবশালী ভাষার সম্পর্কবৃদ্ধি (এই পরিস্থিতির আনুকূল্যেই একসময়ে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারের কামরূপী উপভাষা স্বতন্ত্র অসমিয়া ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছিল)। উত্তরবঙ্গে যাঁরা অবস্থান-পরিকল্পনা অনুসারে খানিকটা অজান্তেই ‘কামতাপুরি’-র লেখ্য অনুশীলন করছেন, তাঁদের কিন্তু এই দুটি বাস্তব প্রাকশর্তের কথা বলা হচ্ছে না। কারণ যারা এই পরিকল্পনার পেছনে থেকে বুদ্ধি জোগাচ্ছেন সেইসব নেপথ্য-নায়কের উদ্দেশ্য কিন্তু ‘কামতাপুরি’-র প্রকৃত উন্নয়ন নয়, ‘কামতাপুরি’-কে ঘিরে একটা অস্থির পরিস্থিতি তথা ঘোলা জল তৈরি করা, যাতে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে কিছু ফায়দা তোলা যায়। প্রকৃতপক্ষে, অতীতে কামরূপী-র একাংশ থেকে স্বতন্ত্র অসমিয়া ভাষার বিকাশ হলেও এখনকার ‘কামতাপুরি’র ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। কারণ, উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক কথ্য বাংলা নিয়ে ইদানীং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যতগুলি ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গিয়েছে এই এলাকায় অন্য ভাষার প্রভাব তো দূরের কথা, শিক্ষার প্রসার, পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমপ্রসারের ফলে এই এলাকার জনজীবনে লেখ্য চলিত বাংলার সম্পর্ক ও জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তির আরও ব্যাপক ব্যবহারের ফলে চলিত বাংলার প্রভাব প্রকারে ও পরিমাণে আরও বৃদ্ধি পাবে। এই অবস্থা শুধু ‘কামতাপুরি’-র ক্ষেত্রেই নয়, বাংলার অন্যান্য কথ্য উপভাষার ক্ষেত্রেও ঘটবে। ফলে আগামী দিনে কথ্য উপভাষাগুলির প্রয়োগ মৌখিক লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে ও পরিবারের ঘরোয়া পরিসরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে, কিন্তু ঘরের বাইরে চলিত বাংলা। অনেকটা ঘরে-বাইরে দুপ্রস্থ পোশাকের মতো। এই দুই প্রস্থের ব্যবস্থা রাখা হয় কাজের সুবিধার জন্য—এতে ঘরের ও বাইরের পোশাকের তুলনামূলক মর্যাদার প্রশ্ন অবান্তর। ঠিক তেমনি কথ্য ভাষা ও লেখ্য ভাষার ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুবিধার প্রশ্নটিই বড়ো, মর্যাদার প্রশ্ন নয়। উত্তরবঙ্গেও ‘কামতাপুরি’ তথা কামরূপী এবং লেখ্য বাংলা একই বাংলা ভাষার দুই রূপ, শুধু এদের প্রয়োগক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন। কাজের সুবিধার জন্যই এই আপাত-ভিন্নতা। কিন্তু এই আপাত-ভিন্নতা একদিকে যেমন বাংলা ভাষার সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা বা প্রভেদ প্রমাণ করে না, অন্যদিকে তেমনি তার সঙ্গে লেখ্য উপভাষা চলিত বাংলার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলে তার গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় না। বস্তুত এই সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হবে উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী জনগণের ভাষাগত আত্মবিকাশের পথ তত প্রশস্ত হবে। কারণ, ধর্মবাবুর দেওয়া হিসাব অনুসারে ‘কামতাপুরি’ তে কথা বলেন প্রায় এক কোটি ২০ লক্ষ মানুষ (A step to Kamta Bihari Language, পৃ: ৫), কিন্তু আন্তজার্তিক পরিসংখ্যান অনুসারে সারা পৃথিবীতে বাংলা যাদের মাতৃভাষা এখন তাদের সংখ্যা প্রায় ২২ কোটি (এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের মানুষেরাও অন্তর্ভুক্ত)। সুতরাং ঘরোয়া লোকসংস্কৃতি-চর্চায় কথ্য উপভাষার ব্যবহার প্রশস্ত হলেও বিশ্বমুখীন সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় লেখ্য উপভাষা চলিত বাংলার ব্যবহারই প্রশস্ততর। বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক জীবনের রূপকার তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ, অদ্বৈত মল্লবর্মন এবং আরও অনেকে এর ভালো উদাহরণ। এঁরা সকলেই চরিত্রের সংলাপে আঞ্চলিক কথ্য উপভাষা ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এঁদের বর্ণনা ও বিবরণে সর্বত্রলেখ্য সাধু বা লেখ্য চলিত ভাষার ব্যবহার।

__________________________________________________

প্রাসঙ্গিক টীকা

। বর্তমান প্রবন্ধকার ‘কামরূপী’ নামটিরই পক্ষপাতী। কিন্তু গণমাধ্যমে ‘কামতাপুরি’ শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত। তাই ‘কামতাপুরি’ শব্দটি এই প্রবন্ধে উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে রেখে ব্যবহার করা হয়েছে।

। বর্তমান লেখকের ‘উত্তরবঙ্গের ভাষাপ্রসঙ্গ’ (সাহিত্য বিহার, ২০০১) গ্রন্থের ‘কামতাপুরী ভাষা আন্দোলন’ প্রবন্ধে ইস্তেহারটির আরও অংশ মুদ্রিত হয়েছে এবং এ-সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক আলোচনা আছে।

। এ বিষয়ে বর্তমান লেখকের ‘উত্তরবঙ্গের ভাষাপ্রসঙ্গ’ গ্রন্থের ‘উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষার ঐতিসাহিক গুরুত্ব’ প্রবন্ধে বিস্তৃত আলোচনা আছে।

। ইদানীং (২০০৮) তিন-চার বছর হল দেখা যাচ্ছে, এইসব বিজ্ঞাপনে ও চিত্রসমালোচনায় রাজবংশী ছবি নামে অভিহিত করা হচ্ছে। এর পেছনে যে প্রযোজকের সুচতুর ব্যাবসাবুদ্ধি সক্রিয়, একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক বাংলাকে ‘রাজবংশী’ নামে অভিহিত করায় যে যুক্তির দিক থেকে ভ্রান্তি (fallacy) আছে সেবিষয়ে আমার ‘উত্তরবঙ্গের ভাষাপ্রসঙ্গ’ বইয়ের ‘উত্তরবঙ্গের ভাষা : রাজবংশী, কামতাপুরী না বাংলা’ প্রবন্ধে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে তার পুনরুল্লেখ করি। উত্তরবঙ্গের বাংলা ভাষাকে ‘রাজবংশী’ নামে অভিহিত করার মধ্যে একাধারে অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তি দোষ আছে। কারণ উত্তরবঙ্গে যারা এই কথ্য উপভাষা ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে রাজবংশী ছাড়াও অন্য তপশিলী জাতি (যথা, দেশি, পলিয়া, খ্যান ইত্যাদি), বর্ণহিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষও আছেন। সুতরাং একে ‘রাজবংশী’ নাম দিলে উত্তরবঙ্গের বাংলাভাষী বাচকগোষ্ঠীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বাদ পড়ে যায়। এখানেই ‘রাজবংশী’ নামকরণের অব্যাপ্তি-দোষ। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের Handbook on Scheduled Castes and Scheduled Tribes of West Bengal (Special Series No.8, Calcutta 1966) গ্রন্থে দেখা যায় দক্ষিণবঙ্গেও ‘রাজবংশী’ নামে এক সম্প্রদায় আছে। এঁরা মূলত মৎস্যজীবী, ভাষার দিক থেকে রাঢ়ী এঁদের কথ্য উপভাষা। কিন্তু উত্তরবঙ্গের কথ্য বাংলাকে ‘রাজবংশী’ নামে অভিহিত করলে দক্ষিণবঙ্গের রাঢ়ি-উপভাষী এই বাচকগোষ্ঠীও তাতে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। এখানেই ‘রাজবংশী’ নামকরণের অতিব্যাপ্তি-দোষ। ন্যায়শাস্ত্রের এই ভ্রান্তি ছাড়াও সামাজিক ইতিহাসের দিক থেকে এই নামকরণ অসংগত। কারণ, পৃথিবী-ব্যাপী বাংলা বাচকগোষ্ঠীর মধ্যে নানা ধর্ম, জাতি, বর্ণ বৃত্তির মানুষ আছেন, কিন্তু তাঁদের কখনও ধর্ম-জাতি-বর্ণ-বৃত্তির নামে চিহ্নিত না করে সাধারণভাবে তাঁদের সকলকে বাংলাভাষী বলা হয়। ঠিক সেইরকমভাবে উত্তরবঙ্গের বাংলা উপভাষার বাচকগোষ্ঠীকে সাধারণভাবে বাংলাভাষী না বলে নিতান্ত সংকীর্ণভাবে উত্তরবঙ্গের একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর নামে চিহ্নিত করলে বৃহত্তর বাংলাভাষী জনসমাজ থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় না কি? এটা কি প্রকারান্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদকেই প্রশ্রয় বা উসকে দেওয়া নয়? বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং সেইমতো লেখালেখি করবেন—এই আশা রাখি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *