কাব্যমদিরা
তোমরা কি জানো কবিতা কোথা থেকে এসেছে? আমরা যে গান গাই আর গল্প শোনাই, সেগুলো কোথা থেকে পেলাম? কখনো কি জানতে চেয়েছ, কীভাবে কিছু লোক সুন্দর সব স্বপ্ন দেখে আর সেই স্বপ্ন কবিতা আর গান আকারে দুনিয়াকে উপহার দেয়, আর সেই কবিতা আর গান যতদিন সূর্য উদিত হবে আর অস্ত যাবে, চাঁদ যতদিন কিরণ দেবে, ততদিন মানুষ গেয়ে যাবে? কখনো কি ভেবেছ, কিছু মানুষ মনোমুগ্ধকর গল্প, কবিতা আর গান বানাতে পারে যা অন্যরা পারে না?
এটা অনেক লম্বা একটা গল্প, এই গল্পের পরতে জড়িয়ে আছে প্রতারণা আর হত্যা, মিথ্যা আর বোকামি, প্রলোভন আর সাধনার কাহিনি। শোনো তাহলে।
সময়ের শুরুর দিকে, দেবতাদের মধ্যে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়- এসির আর ভানির দেবতাদের মধ্যে। এসিররা ছিল যোদ্ধা, যুদ্ধের দেবতা, অন্যদিকে ভানিররা ছিল নমনীয় স্বভাবের যারা মাটি উর্বর করত আর গাছপালা জন্মাত, কিন্তু তারা মোটেই এসিরদের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিল না।
এসির আর ভানির দেবতারা ছিল একে অপরের সমকক্ষ। কোনো পক্ষই যুদ্ধে জিততে পারছিল না। পরস্পর যুদ্ধ করতে করতে তারা বুঝতে পারল, তাদের একে অপরকে প্রয়োজন। যুদ্ধ জয় করে আসলে কোনো আনন্দ নেই, যদি না যুদ্ধ জয়ের পর খামার থেকে তুলে আনা অতুলনীয় খাদ্য দ্বারা ভোজ করা যায়।
তারা শান্তি আলোচনায় বসল, যখন আলোচনা শেষ হলো, প্রত্যেক দেবতা, এসির ও ভানির প্রত্যেকেই, একটা পাত্রে নিজ নিজ থুথু ফেলে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল। যখন তাদের সবার থুথু মিলিত হলো, তাদের চুক্তি স্থায়ী রূপ পেল।
তারপর তারা এক ভোজে মিলিত হলো। খাবার খাওয়া হলো, মদিরা পান করা হলো, তারা সারা রাত হৈচৈ, হাসাহাসি, নিজেদের গুণকীর্তন, আর গল্পগুজব করে কাটাল। আগুন জ্বলে কয়লা হয়ে গেল, রাত গড়িয়ে সকালের সূর্য ওঠার সময় হয়ে গেল। এসির আর ভানিররা যখন তাদের ফারের কোট আর কাপড়চোপড় গায়ে চড়িয়ে ঠান্ডা তুষার আর সকালের কুয়াশার মধ্য দিয়ে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো, ওডিন বলল, “আমাদের এই মিশ্রিত থুথু এখানে ফেলে যাওয়াটা খুবই লজ্জাকর হবে।”
ফ্রে আর ফ্রেয়া, ভানিরদের নেতা, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী এখন থেকে এসিরদের সাথে এসগার্ডে থাকবে। ফ্রে বলল, “আমরা এটা থেকে কিছু একটা বানাতে পারি।”
“আমরা একজন মানুষ বানাতে পারি,” বলল ফ্রেয়া, সে পাত্রটির কাছে গেল।
ফ্রেয়া বাতাসে তার হাত নাড়াল আর ক্রমশ একজন মানুষের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল, একজন মানুষকে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।
“তুমি হলে কাভাসির,” বলল ওডিন, “তুমি কি জানো আমি কে?”
“আপনি মহামান্য ওডিন,” বলল কাভাসির। “আপনি তৃতীয় গ্রিমনীর। আপনার আরো অনেক নাম আছে, যা এখানে বলে শেষ করা যাবে না। আমি তাদের সবগুলো জানি, আর এগুলোর সাথে জুড়ে থাকা গল্প, কবিতা, গান আর মন্ত্র সবই জানি।”
এসির আর ভানির, দুই গোত্রের দেবতাদের থেকে জন্ম নেওয়া কাভাসির ছিল দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী, সে একইসাথে ছিল মস্তিস্ক আর হৃদয়ের মিশ্রণ। দেবতারা তাকে প্রশ্ন করার জন্য জড়ো হলো, তারা তাকে একের পর এক প্রশ্ন করল, প্রতিবারই কাভাসির জ্ঞানীর মতোই উত্তর দিল। সে গভীরভাবে ভাবল আর তার কাছে যেটা যথার্থ মনে হয়, সেভাবেই উত্তর ব্যাখ্যা করে দিল।
একসময় কাভাসির দেবতাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “আমি এখন ভ্রমণে বের হব। আমি নয় দুনিয়ায় ঘুরব, মিডগার্ড দেখব। আমার এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুজতে হবে, যেগুলো আমি এখনো জানি না।”
“কিন্তু তুমি কি আমাদের কাছে আবার ফিরে আসবে?” জানতে চাইল তারা।
“আমি অবশ্যই ফিরে আসব,” বলল কাভাসির। “এই যে রহস্যের জাল, এটাকে একদিন ভেদ করতেই হবে।”
“কীসের জাল?” জিজ্ঞেস করল থর। কিন্তু কাভাসির মুচকি হাসল, দেবতাদের ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেই সে যাত্রার প্রস্তুতি নিল। সে যাত্রার পোশাক পরে নিল, রংধনু সেতু দিয়ে হেঁটে এসগার্ড ত্যাগ করে গেল।
কাভাসির শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াল, ঘুরে বেড়াল গ্রাম থেকে গ্রামে। সে সকল শ্রেণির মানুষের সাথে মিশল, তাদের সাথে ভালো আচরণ করল আর সবার প্রশ্নের জবাব দিল।
ঐ দিনগুলোতে সমুদ্রের পাশে এক দুর্গে দুই কৃষ্ণ এলফ বাস করত। তারা সেখানে জাদুমন্ত্র চর্চা করত, আর চর্চা করত আলকেমির। অন্য সব বামনদের মতোই তারা চমৎকার আর দুর্দান্ত সব জিনিস তাদের কারখানা আর কামারশালায় তৈরি করত। কিন্তু কিছু জিনিস তারা বানাতে পারত না, আর সেগুলো বানানোর জন্য তারা উদ্গ্রীব ছিল। তারা ছিল দুই ভাই, ফেলার আর গেলার।
যখন তারা শুনল কাভাসির নিকটস্থ শহরে এসেছে, তারা তার সাথে দেখা করতে রওয়ানা হলো। ফেলার আর গেলার কাভাসিরকে শহরের সুবিশাল হলে খুঁজে পেল, যেখানে সে শহরের লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, আর সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল। সে লোকদের বলল কীভাবে পানি বিশুদ্ধ করতে হয় আর কীভাবে নেটল গাছ থেকে কাপড় বুনতে হয়। সে একজন নারীকে বলে দিল, কে তার ছুরি চুরি করেছে আর কেন করেছে। যখন সে তার কথা শেষ করল আর শহরের লোকেরা তাকে খাওয়াদাওয়া করাল, বামনরা তখন সামনে এগিয়ে গেল।
“আমরা তোমাকে এমন একটা প্রশ্ন করব, যেটা তোমাকে কখনো করা হয়নি,” তারা বলল। “কিন্তু প্রশ্নটা একান্তে করতে হবে। তুমি কি একটু আমাদের সাথে যাবে?”
“আমি যাব,” উত্তরে জানাল কাভাসির।
তারা কাভাসিরকে নিয়ে দুর্গে ফিরে এলো। সীগাল পাখির ঝাক কিচিরমিচির করে সমুদ্রতীরে উড়ে বেড়াচ্ছিল আর ধূসর ঢেউগুলোর মতো আকাশের মেঘগুলোও ধূসর দেখাচ্ছিল। তারা কাভাসিরকে তাদের উঁচু দেওয়ালঘেরা দুর্গের ভিতরে তাদের কারখানায় নিয়ে গেল।
“এগুলো কী?” জানতে চাইল কাভাসির।
“এগুলো চৌবাচ্চা, এই দুটিকে আমরা সান আর বুন ডাকি।”
“আচ্ছা, ওখানে ওটা কী?”
“এগুলো কী না জেনে এত জ্ঞানী তুমি কীভাবে হলে? এটা একটা কেটলি। এটাকে আমরা ওড্রেরির বা ভাবাবেগ প্রদানকারী বলি।”
“আর এখানে দেখছি তোমরা বালতিভর্তি খাঁটি তরল মধু জমা করে রেখেছ।”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই,” বলল ফেলার।
গেলার অবজ্ঞাভরে তাকাল। “তারা যেমন বলে, তুমি যদি এতটা জ্ঞানী হতে, তুমি আমরা জিজ্ঞেস করার আগেই আমাদের কী প্রশ্ন, সেটা তুমি জেনে যেতে। আর তুমি এটাও জানতে এগুলো কী জিনিস আর এগুলো দিয়ে কী করে।”
কাভাসির হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।
“আমার মনে হচ্ছে,” বলল সে, “তোমরা দুজন বুদ্ধিমান আর শয়তান, তোমরা বোধহয় তোমাদের অতিথিকে হত্যা করবে, তার রক্ত নিয়ে সান আর বুন নামের দুই চৌবাচ্চা ভর্তি করবে। তারপর অড্রেরির নামক কেটলিতে সেটা ঈষৎ উষ্ণ করবে। এরপর সেটা বিশুদ্ধ মধুর সাথে মিলিয়ে গাঁজিয়ে মদিরা তৈরি করবে, সর্বোৎকৃষ্ট মদিরা, এটা যে পান করবে, তাকে মাতাল করে দেবে, কিন্তু একইসাথে তাকে কবিতা আর পাণ্ডিত্য দান করবে।”
“আমরা বুদ্ধিমান,” স্বীকার করার ভঙ্গিতে গেলার বলল। “ এবং অনেকেই আমাদের শয়তানও বলতে পারে।”
এই বলে সে কাভাসিরের গলা কেটে ফেলল আর চৌবাচ্চার ওপর তাকে পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখল, যতক্ষণ না তার শেষ রক্তবিন্দুটি ঝরে পড়ে। তারা সেই রক্ত আর মধু একসাথে মিশিয়ে ওড্রেরির নামক কেটলিতে মৃদু তাপে উত্তপ্ত করল। তারা সেটার সাথে বেরি যোগ করল আর হালকা নাড়ল। বুদ্বুদ উঠতে শুরু করল। একসময় বুদ্বুদ ওঠা বন্ধ হলে তারা সেখান থেকে চুমুক দিয়ে পান করল। তারা পরস্পর হাসাহাসি করল, মাতাল হলো, একই সাথে নিজেদের ভিতর থেকে কবিতা আর গান বেরিয়ে আসতে দেখল, যেটা এর আগে কখনো ঘটেনি।
দেবতারা পরদিন সকালে বামনদের দুর্গে এলো।
“কাভাসির কোথায়?” তারা জানতে চাইল। “তাকে সর্বশেষ তোমাদের সাথে দেখা গেছে।”
“হ্যাঁ,” জবাবে জানাল বামনরা। “সে আমাদের সাথে এসেছিল, কিন্তু সে যখন বুঝতে পেরেছি আমরা নিতান্তই বোকা আর জ্ঞানহীন বামন মাত্র, সে তার নিজের জ্ঞানে দম আটকে মরে গেছে। আমরা তাকে যদি ভালো কোনো প্রশ্ন করতে পারতাম!”
“তোমরা বলছো সে মরে গেছে?” বিস্মিত আর ব্যথিত হয়ে দেবতারা জানতে চাইল।
“হ্যাঁ,” ফেলার আর গেলার জবাব দিল। তারা দেবতাদের কাভাসিরের রক্তশূন্য দেহটি দিল। তারা দেহটি নিয়ে এসগার্ডে ফিরে চলল তার শেষকৃত্য করার জন্য অথবা তার পুনঃপ্রত্যাবর্তনের জন্য (কারণ দেবতারা অন্যদের মতো নয়, তাদের জন্য মৃত্যু কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়
এভাবে বামনরা জ্ঞান আর কাব্যের মদিরা পেয়ে গেল। কেউ যদি এটা পেতে চাইত, তাদের সেটা বামনদের কাছে চাইতে হতো। কিন্তু ফেলার আর গেয়ার শুধুমাত্র তাদের পছন্দের লোকদেরই সেটা পান করতে দিত আর তারা নিজেদের ছাড়া কাউকেই পছন্দ করত না।
কিন্তু তবুও কিছু লোকের কাছে তাদেরও দায়দেনা ছিল। যেমন ছিল দানব গিলিং আর তার স্ত্রী। বামনরা তাদের দুর্গে আসার নিমন্ত্রণ করল আর এক শীতের সকালে তারা এসে হাজির হলো।
“চলো, আমরা একটু নৌকা ভ্রমণ করে আসি,” বামনরা গিলিংকে বলল।
দানব গিলিং এর ওজনের কারণে নৌকাটি প্রায় পানিতে ডুবি ডুবি করছিল। তারা নৌকা বেয়ে এমন স্থানে নিয়ে গেল, যেখানে পানির তলের একটু নিচেই পাথরের পাহাড় আছে। অন্য সময় তাদের নৌকা পাথর থেকে একটু উপরে কোনোমতে ভেসে থাকে। কিন্তু আজ তা হলো না। পাথরে ধাক্কা লেগে নৌকো উলটে গেল আর দানব পানিতে গিয়ে পড়ল।
“সাঁতরে নৌকায় ফিরে এসো,” বামনরা গিলিংকে ডেকে বলল।
“আমি সাঁতার জানি না,” দানব শুধু এটুকুই বলতে পারল। সমুদ্রের ঢেউয়ে তার মুখে লোনা পানি ঢুকে গেল, তার মাথা পাথরে ঠুকে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে সে সমুদ্রের জলে তলিয়ে গেল।
ফেলার আর গেলার তাদের নৌকা ঠিক করে নিল আর দুর্গে ফিরে এলো।
গিলিং এর স্ত্রী তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
“আমার স্বামী কোথায়?” জানতে চাইল সে।
“তোমার স্বামী?” বলল গেলার, “সে মারা গেছে।”
“পানিতে ডুবে গেছে,” যোগ করল ফেলার।
এই খবর শুনে দানবের স্ত্রী কাঁদতে শুরু করল। সে চিৎকার করে কাঁদল, বিলাপ করল আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল, মনে হচ্ছিল তার অন্তর ফেটে কান্না আসছে।
সে তার মৃত স্বামীর নাম নিল আর শপথ করে বলল সে তাকে ভুলে যাবে না, চিরদিন ভালোবাসবে, সে আরো বিলাপ করল আর কান্না করতে থাকল।
“একটু কান্না থামাও,” বলল গেলার। “তোমার বিলাপ আর কান্না আমার কানে বিধছে। তুমি অনেক উচ্চস্বরে কাঁদছো। অবশ্য ঠিকই আছে, তুমি তো একটা দানবী, কান্নার আওয়াজ তো জোরে হবেই।”
কিন্তু দানবের স্ত্রী কান্না না থামিয়ে আরো জোরে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল।
“আচ্ছা,” বলল ফেলার, “যদি তোমাকে ওই জায়গাটা দেখাই যেখানে তোমার স্বামী ডুবে গেছে, তোমার কি একটু ভালো লাগবে?”
দানবী নাক টানল আর মাথা ঝাঁকাল আর মাটিতে মাথা ঠুকে তার স্বামীর জন্য বিলাপ করল, যে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।
“ঠিক এখানে দাঁড়াও, আমরা তোমাকে জায়গাটা দেখাচ্ছি,” বলল ফেলার, সে দানবীকে দেখাল ঠিক কোথায় দাঁড়াতে হবে। জায়গাটা ছিল দুর্গের প্রধান গেট দিয়ে বেরিয়ে উঁচু প্রাচীরের পাদদেশে। সে তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল, যে কি না দুর্গের উঁচু প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। দানবের স্ত্রী যেই না প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে এলো, গেলার তার মাথার ওপর একটা বড় পাথর ফেলল, দানবী মাটিতে পড়ে গেল, পাথরের আঘাতে তার মাথাটা প্রায় চেপ্টা হয়ে গেছে।
“ভালো কাজ করেছ,” বলল ফেলার। “এই কান্না দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।”
তারা দানবীর মৃতদেহটি ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দিল। ধূসর ঢেউয়ের আঙুলগুলো মৃতদেহটি টেনে সমুদ্রের গভীরে নিয়ে গেল। দানব গিলিং আর তার স্ত্রী, মৃত্যুর মাধ্যমে তারা আবার মিলিত হলো।
বামনরা হাঁপ ছাড়ল আর নিজেদের খুব চালাক বলে ভেবে নিল আর সমুদ্রের পাড়ে তাদের দুর্গে বাস করতে লাগল।
তারা প্রতিরাতে কাব্যমদিরা পান করত, পরস্পরকে সুন্দর আর চমৎকার সব কবিতা পড়ে শোনাত, গিলিং আর তার স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে বিরাট কবিতা ফেঁদে বসত, যেটা তার তাদের দুর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে পাঠ করত, অবশেষে প্রতি রাতেই তারা যেখানে থাকত, সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ত, সকালে উঠে দেখত তারা দুর্গের বিভিন্ন স্থানে এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে।
একদিন তারা অস্বাভাবিকভাবে জেগে উঠল, কিন্তু তাদের দুর্গে নয়।
তারা নিজেদের তাদের নৌকায় আবিষ্কার করল, দেখল একটা দানব নৌকা বাইছে, যাকে তারা চেনে না। আকাশ গাঢ় মেঘে ঢাকা ছিল আর সমুদ্রও আকাশের মতো কৃষ্ণকালো হয়ে ছিল। বড় বড় ঢেউ আসছিল আর নৌকায় আছড়ে পড়ে নোনাজল ছিটিয়ে তাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
“কে তুমি?” বামনরা জানতে চাইল।
“আমি সুটং,” বলল দানব। “আমি শুনেছি তোমরা বাতাস, ঢেউ আর দুনিয়াকে বলে বেড়াচ্ছ, তোমরা আমার মা আর বাবাকে হত্যা করেছ।”
“ওহ,” বলল গেলার, “এজন্যই তুমি আমাদের বেঁধে রেখেছ?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
“মনে হয় তুমি আমাদের একটা চমৎকার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছ,” বলল গেলার আশান্বিত কণ্ঠে, “যেখানে গিয়ে তুমি আমাদের বাঁধন খুলে দেবে আর আমরা বন্ধুর মতো ভোজ করব আর পান করব, আমরা বন্ধু হব।”
“আমার সেরকম মনে হচ্ছে না,” বলল সুটুং।
সময়টা ছিল ভাটা। পানির উপরে পাথরের মাথা বেরিয়ে ছিল। এটা সেই জায়গা যেখানে জোয়ারের সময় পাথরে ধাক্কা লেগে বামনদের নৌকা থেকে পড়ে গিলিং ডুবে গিয়েছিল। সুটুং একজন করে হাতপা বাধা বামনকে নিয়ে একটা করে পাথরের ওপর রাখল।
“জোয়ার এলে এই পাথরগুলো সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে। আমাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। আমরা সাঁতার কাটতে পারব না। যদি তুমি আমাদের এখানে রেখে যাও, আমরা সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাব।”
“আমি তো সেটাই চাই,” বলল সুটুং।
সে প্রথমবারের মতো হাসল। “তোমরা যখন ডুবে যেতে থাকবে, আমি তোমাদের নৌকায় বসে বসে সেটা দেখব। সমুদ্র যখন তোমাদের গ্রাস করবে, আমি যতুনহাইমে আমার ঘরে ফিরে যাব। আমি আমার ভাই বুগি আর আমার মেয়ে গুনলডকে বলব কীভাবে তোমরা মরলে আর তারা সন্তুষ্ট হবে অবশেষে আমার বাবা আর মায়ের খুনের বদলা নেওয়া হয়েছে।”
জোয়ারের পানি আসতে শুরু করল, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়তে লাগল। বামনদের পা ডুবে গেল, ক্রমে পানি তাদের কোমর পর্যন্ত চলে এলো। কিছুক্ষণ পরই বামনদের দাড়ি জলে ভাসতে লাগল আর তারা আতঙ্কিত হয়ে গেল।
“দয়া করো,” চিৎকার করল তারা, “আমাদের ছেড়ে দাও।”
‘যেমন দয়া তোমরা আমার বাবা-মায়ের সাথে করেছিলে?”
“আমরা তাদের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দেব! আমরা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেব।”
“আমি মনে করি না তোমাদের মতো বামনদের এমন কিছু আছে যেটা দিয়ে তোমরা আমার বাবা-মায়ের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ দিতে পারো। আমি একজন ধনী দানব। আমার পাহাড়ের ওপর দুর্গ আছে, আছে অনেক দাস-দাসী আর অনেক সম্পদ। আমার স্বর্ণ আছে, মণিমাণিক্য আছে, হাজার তলোয়ার বানানোর মতো পর্যাপ্ত লৌহ আছে। আমি মন্ত্রতন্ত্রও জানি। তোমরা আমাকে এমন কী দেবে, যেটা আমার কাছে নেই?” জানতে চাইল সুটুং।
বামনরা কিছুই বলল না।
পানি বাড়তে লাগল।
“আমাদের কাছে মদিরা আছে, কাব্যমদিরা,” বলল গেলার যখন সমুদ্রের লোনা জল তার ঠোটের কাছে এসে গেল।
“সবচেয়ে জ্ঞানী দেবতা কাভাসিরের রক্ত দিয়ে বানানো!” চিৎকার করল ফেলার। “দুই চৌবাচ্চা আর এক কেটলিভর্তি। এটা দুনিয়ায় আর কারো কাছে নেই, শুধু আমাদের কাছে ছাড়া!”
সুটুং তার মাথা চুলকাল। “আমাকে এই বিষয়ে ভাবতে হবে, চিন্তাভাবনা করতে হবে।”
“না না, চিন্তাভাবনার সময় নেই, যদি তুমি ভাবতে বসো, আমরা পানিতে ডুবে যাব!” ঢেউয়ের ওপর কোনোক্রমে মাথাটি তুলে রেখে চিৎকার করল ফেলার।
পানি আরো বাড়ল। ঢেউ তখন বামনদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল, বামনদের মাথা একবার পানিতে ডুবে যাচ্ছিল আবার ভেসে উঠছিল। তারা বাতাসের জন্য খাবি খাচ্ছিল আর তাদের চোখ ভয়ে বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। সুটুং এগিয়ে গেল আর ফেলার আর গেলারকে ঢেউয়ের ওপর থেকে তুলে তুলল।
“কাব্যমদিরা ক্ষতিপূরনের জন্য পর্যাপ্ত হতে পারে। তোমরা এটার সাথে আরো কিছু যোগ করলে এটা ভালো কিছু হতে পারে। আর আমি জানি তোমরা সেটা পারবে। আমি তোমাদের জীবন ভিক্ষা দিলাম।”
সে তাদেরকে নৌকায় ছুড়ে ফেলল, হাত-পা বাঁধা আর ভেজা, চিংড়ি মাছের মতো তারা অস্বস্তিতে মোচড়ামোচড়ি করল আর দানব তাদের নৌকা বেয়ে তীরে নিয়ে এলো।
সুটুং কাভাসিরের রক্ত থেকে তৈরি কাব্যমদিরা বামনদের কাছ থেকে নিয়ে গেল। সে তাদের কাছ থেকে অন্য অনেক কিছুই নিল আর দুই বামনকে ছেড়ে দিয়ে গেল, যারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে পেরেই অনেক সন্তুষ্ট ছিল।
ফেলার আর গেলার দুর্গের পাশ দিয়ে যাওয়া লোকদের জানাল সুটুং তাদের সাথে কেমন খারাপ আচরণ করেছে। তারা যখন বাজারে গেল, তারা বাজারের লোকেদের কাছে সব ঘটনা বলল। তারা যখন এসব ঘটনা বলছিল, দাঁড়কাকেরা সেটা শুনে ফেলল।
এসগার্ডে ওডিন তার সুউচ্চ সিংহাসনে বসা, তার দুই গুপ্তচর দাঁড়কাক হুজিন আর মুনিন তার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে গোপন সব কথা বলে গেল, পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তারা যা দেখেছে আর শুনেছে, সবই বলল। ওডিনের একচক্ষু জ্বলে উঠল, যখন সে সুটুং এর কাব্যমদিরার কাহিনি শুনল।
লোকজন যারা এই কাব্যমদিরার গল্প শুনল, তারা এটাকে ‘বামনদের জাহাজ’ নামে ডাকত, কারণ এটা ফেলার আর গেলারকে পাথরের ওপর থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তারা এটাকে ‘সুটুং এর মদিরা’ নামেও ডাকত, কেউবা ‘সন আর বুনের তরল’ নামেও ডাকত।
ওডিন তার দাঁড়কাকেদের কথা গুরুত্বের সাথে নিল। সে তার লম্বা কোট আর টুপি চেয়ে নিল। সে দেবতাদের ডেকে পাঠাল আর তাদের তিনটা বৃহৎ কাঠের চৌবাচ্চা বানাতে বলল- যতটা বৃহৎ তারা বানাতে পারে, আর সেগুলো এসগার্ডের প্রবেশদ্বারের কাছে প্রস্তুত রাখতে বলল। সে দেবতাদের বলল, সে পৃথিবী প্রদক্ষিণে বেরুচ্ছে, তার ফিরতে কিছুদিন সময় লাগবে।
“আমি আমার সাথে দুটো জিনিস সাথে নিয়ে যাব,” বলল ওডিন। “আমার একটা শানপাথর চাই, অস্ত্র ধারানোর জন্য। আমি সবচেয়ে ভালোটা চাই। আর আমি ‘রাতি’ নামের তুরপুনটি চাই।” রাতি অর্থ তুরপুন, আর রাতি দিয়ে যেকোনোকিছু ছিদ্র করা যেত, এটা ছিল দেবতাদের সবচেয়ে ভালো তুরপুন। এটা দিয়ে অনেক গভীরে ফুটো করা যেত, সবচেয়ে শক্ত পাথরও এটা দিয়ে ফুটো করা যেত।
ওডিন শানপাথরটা শূন্যে ছুড়ে দিয়ে আবার সেটাকে ধরে তার ব্যাগে তুরপুনের সাথে রেখে দিল আর হেঁটে এসগার্ড ত্যাগ করল।
“আমি ভাবছি, উনি কী করতে যাচ্ছেন?” বলল থর।
“কাভাসির থাকলে বলতে পারত,” বলল ফ্রিগা। “সে সবকিছু জানত।”
“কাভাসির মারা গেছে,” বলল লোকি। “বিশ্বপিতা কোথায় গেলেন আর কেন গেলেন, এসবে আমার কোনো আগ্রহ নেই।”
“বিশ্বপিতার নির্দেশমত আমি কাঠের চৌবাচ্চা বানাতে গেলাম,” বলল থর।
সুটুং অমূল্য কাব্যমদিরা নিয়ে দানব রাজ্যের কেন্দ্রভাগে নিটবর্গ নামের পাহাড়ের গভীরে লুকিয়ে রাখল আর তার মেয়ে গুনলডকে সেটির পাহারায় নিযুক্ত করল। ওডিন প্রথমে পাহাড়ের নিকটে গেল না। পরিবর্তে সে সোজা সুটুং এর ভাই বুগির খামারে গেল।
সময়টা ছিল বসন্তকাল, আর সমস্ত খামার উঁচু ঘাসে ঢাকা ছিল, যেগুলো কেটে খড় বানাতে হবে। বুগির নয়জন ক্রীতদাস ছিল, যারা তার মতোই বিশালাকৃতির ছিল। ওডিন দেখল নয়জন কৃতদাসই একেকটা গাছের মতো বড় বড় কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটছে।
ওডিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ করা দেখল। যখন সূর্য মাথার ওপরে উঠে গেল আর তারা খাবার খাওয়ার জন্য থামল, ওডিন ধীরেসুস্থে তাদের কাছে গেল আর বলল, “আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদেরকে কাজ করতে দেখছিলাম। আচ্ছা, তোমাদের মনিব তোমাদেরকে এত ভোঁতা কাস্তে দিয়ে ঘাস কাটতে দিয়েছে কেন?”
“আমাদের কাস্তে ভোঁতা নয়,” বলল এক ক্রীতদাস।
“কেন তোমার মনে হচ্ছে এগুলো ভোঁতা?” জিজ্ঞেস করল আরেকজন। “আমাদের কাস্তে সবচেয়ে ধারালো।”
“একটা ভালো ধারালো কাস্তে কী করতে পারে, তোমাদের দেখাচ্ছি,” বলল ওডিন।
সে তার ব্যাগ থেকে শান দেওয়ার পাথরটি বের করে একে একে সবগুলো কাস্তে ধার দিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল। দানবরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকে কাজ করতে দেখছিল। “এখন এই কাস্তে দিয়ে ঘাস কেটে দেখো।”
দানব ক্রীতদাসেরা ঘাসের মধ্যে তাদের কাস্তে চালিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। কাস্তেগুলো এত ধারালো হয়েছে যে, ঘাস কাটতে কোনো কষ্টই হচ্ছে না। কাস্তেগুলো ঘন ঘাসের ভিতর দিয়ে খুব সহজেই চালিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, কোনো বাধাই অনুভব হচ্ছে না।
“এটা খুবই চমৎকার,” তারা ওডিনকে বলল। “আমরা কি তোমার শানপাথরটা কিনতে পারি?”
“কিনতে চাও?” বলল বিশ্বপিতা। “মোটেই না। তারচেয়ে বরং একটা মজার কাজ করা যাক। সবাই এখানে আসো। গোল হয়ে দাঁড়াও, হাতে কাস্তে শক্ত করে ধরো। ঘন হয়ে দাঁড়াও।”
“আমরা এরচেয়ে কাছে দাঁড়াতে পারব না,” এক দানব বলল। “কাস্তেগুলো খুবই ধারালো।”
“তুমি বুদ্ধিমান,” বলল ওডিন। সে শানপাথরটা তুলে ধরল। “এখন শোনো, তোমাদের মধ্যে যে প্রথমে এই শানপাথরটা ধরতে পারবে, সে এটার মালিক হবে!” একথা বলেই ওডিন শানপাথরটা শূন্যে ছুড়ে দিল।
নয়জন দানবই পাথরটা ধরার জন্য লাফ দিল, তারা সকলেই তাদের খালি থাকা হাতে পাথরটি ধরতে চাইল, তাদের আরেক হাতে যে কাস্তে ধরা আছে, সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই ছিল না।
তারা লাফাল, পাথর ধরতে গেল আর তাদের কাস্তে সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল।
ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত ছুটল আর দানবদের দেহ একে একে কেটে রাখা ঘাসের ওপর লুটিয়ে পড়ল। ওডিন দেহগুলো ডিঙিয়ে তার শানপাথররের কাছে পৌঁছে সেটি তুলে নিল আর নিজের ব্যাগে রেখে দিল।
নয়জন দানব ক্রীতদাসই তার সঙ্গী দানবের কাস্তের আঘাতে গলা কেটে মরে পড়েছিল।
ওডিন সুটুং এর ভাই বুগির বাড়িতে গেল আর একরাত থাকার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করল। “আমার নাম বল্ভারকার,” বলল ওডিন।
“বভারকার,” বুগি বলল, “খুবই খারাপ নাম। এর অর্থ হলো, অনর্থকারী ব্যক্তি।”
শুধুমাত্র আমার শত্রুদের জন্য আমি অনর্থকারী,” বল্ভারভারকার নামধারী ব্যক্তিটি বলল। “আমার বন্ধুরা আমার কাজের প্রশংসা করে। আমি নয়জন লোকের কাজ একাই করতে পারি, লম্বা সময় ধরে কাজ করতে পারি, কোনো অজুহাত দেখাই না।”
“রাতটা তুমি এখানে থাকতে পারো,” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বুগি বলল, “কিন্তু তুমি এক দুঃখের দিনে এসেছ। গতকালও আমি একজন ধনী লোক ছিলাম। আমার অনেক ফসলি জমি আর নয়জন ক্রীতদাস ছিল যারা গাছ লাগাত, ফসল তুলত আর ঘরবাড়ি বানাত। কিন্তু আজ আমার শুধু জমিজমা আর পশুপাখি আছে, আমার ক্রীতদাসরা সবাই মরে গেছে, তারা একে অন্যকে কেটে দুভাগ করে ফেলেছে। আমি জানি না তারা এমন কেন করল!”
“খুবই দুঃখের কথা,” বলল বল্ভারকাররূপী ওডিন। “তুমি কি অন্য শ্রমিক জোগাড় করতে পারো না?”
“এই বছর আর লোক পাওয়া যাবে না,” দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বুগি জানাল। “ভালো ভালো শ্রমিকেরা ইতোমধ্যেই আমার ভাই সুটুং এর ওখানে কাজ করছে, আর এদিকে লোকজন খুবই কম আসে। অনেক বছরের মধ্যে তুমিই প্রথম ব্যক্তি যে আমার আশ্রয় প্রার্থনা করেছ।”
“আর তোমার ভাগ্য ভালো। আমি একাই নয়জন লোকের কাজ করতে পারি।”
“তুমি তো দানব নও,” বলল বুগি, “তুমি বরং একটা চিংড়ির মতো ছোট। তুমি কীভাবে আমার একজন ক্রীতদাসের সমান কাজ করবে, নয়জনের সমান কাজ করার কথা ছেড়েই দাও।”
“যদি আমি তোমার নয়জন লোকের সমান কাজ না করতে পারি,” বলল বভারকার, “তাহলে তুমি আমাকে কিছুই দেবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি যদি সেটা করতে পারি তাহলে…”
“তাহলে কী?”
“আমি অনেক দূর দেশ থেকে সুটুং এর অসাধারণ কাব্যমদিরার কথা শুনেছি। সবাই বলে, যে সেটা পান করবে, সে কাব্যপ্রতিভা লাভ করবে।”
“এটা সত্য। আমরা যখন যুবক ছিলাম, সুটুং মোটেই কবি ছিল না। পরিবারে আমি ছিলাম একমাত্র কবি। যখন থেকে সে বামনদের মদিরা নিয়ে এসেছে, সে কবি বনে গেছে।”
“যদি আমি তোমার জন্য কাজ করি, তোমার জন্য ফসল লাগাই আর কেটে দেই, তোমার মৃত দাসদের মতো সব কাজ করি, আমি তোমার ভাইয়ের মদিরার একটু স্বাদ নিতে চাই।”
“কিন্তু…” বুগির কপাল কুঁচকে গেল। “কিন্তু সেটা আমি তোমাকে দিতে পারি না। সেটা সুটুং এর সম্পত্তি।”
“দুঃখজনক,” বলল বল্ভারকার। “তোমাকে তোমাকে এ বছর একাই ফসল ফলাতে হবে। তোমাকে শুভকামনা জানিয়ে আমি বিদায় হচ্ছি।”
“থাম! কাব্যমদিরা আমার নয় সত্যি। যদি তুমি যা বলেছ, তেমন কাজ করতে পার, আমি তোমাকে আমার ভাই সুটুং এর কাছে নিয়ে যাব। তুমি যাতে কাব্যমদিরা পান করতে পারো, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
“ঠিক আছে তাহলে”, বলল বল্ভারকার। “তোমার সাথে এই কথাই থাকল। “ বভারকার কঠোর পরিশ্রম করল। নয়জন তো বটেই, একাই বিশজনের কাজ করল। একাই সব পশুগুলোর দেখাশোনা করল, সকল ফসল একাই কেটে গোলায় তুলে দিল। সে পরিশ্রম করল আর জমি থেকে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি ফসল পেল।
“বলভারকার”, পাহাড় থেকে শীতের প্রথম কুয়াশা যখন খামারে নেমে আসছে, বুগি বলল তাকে, “তোমাকে একটা ভুল নামে ডাকা হয়। তুমি অনিষ্ট তো করোই না, শুধু ভালো কাজই করো।”
“আমি কি নয়জনের সমান কাজ করতে পেরেছি?”
“অবশ্যই, শুধু নয়জন না, তুমি নয় দুগুণে আঠারোজনের কাজ করেছ।”
“তাহলে তুমি আমাকে কাব্যমদিরা এক চুমুক পান করতে সাহায্য করবে?”
“অবশ্যই!”
পরদিন সকালে তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাত্রা করল। তারা হাঁটল, হাঁটল আর ক্রমাগত হাঁটতে থাকল। ক্রমাগত হেঁটে বিকাল বেলা তারা সুটুং এর এলাকায় পৌঁছাল, যেটা ছিল পাহাড়ের পাদদেশে। সুটুং-এর প্রাসাদে পৌঁছাতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে গেল।
“শুভ সন্ধ্যা, ভাই সুটুং,” বলল বুগি, “এ হলো বভারকার, আমার বন্ধু আর এই গ্রীষ্মের শ্রমিক।” সে বলভারকারকে কী কথা দিয়েছে, সেটা বলল। “সুতরাং”, বলল সে, “আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি তাকে এক চুমুক কাব্যমদিরা পান করতে দাও।”
সুটুং শীতল দৃষ্টিতে তাকাল। “না”, সে এককথায় না করে দিল।
“না?”
“না, আমি কাব্যমদিরার এক ফোঁটাও দেব না। আমি সেটা সন আর বুন চৌবাচ্চা আর ওড্রেরির কেটলিতে ভরে নীটবর্গ পাহাড়ের গভীরে নিরাপদে রেখেছি, যেটা শুধুমাত্র আমার হুকুমে খুলবে। আমার মেয়ে গুনলড সেটা পাহারা দিচ্ছে। তোমার এই শ্রমিক সেটা কিছুতেই পান করতে পারবে না। এমনকি তুমিও সেটা পান করার জন্য পাবে না।”
“কিন্তু,” বলল বুগি, “কাব্যমদিরা তো আমাদের পিতা-মাতার হত্যার ক্ষতিপূরণ। আমি কি এটার কিছুটা পেতে পারি না, আমি কি বল্ভারকারকে দেখাতে পারি না, আমি একজন সম্মানিত দানব?”
“না,” জানিয়ে দিল সুটুং, “তুমি সেটা পাবে না।”
তারা ফিরে চলল।
বুগি খুবই আশাহত হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরপরই সে বলভারকারের কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল। “আমি কখনো ভাবিনি আমার ভাই এতটা অবিবেচক হবে,” বলল সে।
“সে আসলেই খুব অবিবেচক”, বলল বভারকারের বেশে থাকা ওডিন। “কিন্তু আমি আর তুমি মিলে দু-একটা কাজ করতে পারি, যাতে সে ভবিষ্যতে এতটা অহংকারীর মতো আচরণ না করে, আর পরবর্তীতে ভাইয়ের কথা শোনে।”
“আমরা সেটা করতে পারি,” বলল দানব বুগি। সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। “তুমি কী করতে চাও?”
“প্রথমে,” বলল বল্ভারকার, “আমরা নিটবর্গ পাহাড়ে চড়ব।”
তারা পাহাড়ে চড়তে শুরু করল। দানব বুগি আগে আগে আর পিছনে বলভারকার। আকারে দানবের তুলনায় তাকে একটা পুতুলের মতো ছোট লাগলেও বলভারকার পিছিয়ে পড়ল না, সমানতালে পাহাড়ে উঠতে লাগল। ভেড়া আর পাহাড়ি ছাগলের চলার পথ ধরে তারা উপরে উঠতে লাগল, তারপর তারা খাড়া পাথুরে অংশ পার হয়ে পাহাড়ের ওপর পৌঁছাল। গতবছরের না গলা বরফের ওপর এ বছরের প্রথম তুষারপাত হয়েছে। তারা পাহাড়ের ওপরে বাতাস শীষ কেটে যেতে শুনল, অনেক নিচে পাখিদের কিচিরমিচির শুনল, তারা আর একটা কিছুর শব্দও শুনতে পাচ্ছিল।
শব্দটা কিছুটা মানুষের গলার মতো। শব্দটা পাহাড় থেকে আসছে, কিন্তু মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে আসছে, যেন শব্দটা পাহাড়ের ভিতর থেকে আসছে।
“এটা কীসের শব্দ?” জানতে চাইল বল্ভারকার।
ভ্রু কুঁচকাল বুগি, “মনে হচ্ছে, এটা গুনলডের গলা, সে গান গাইছে।”
“তাহলে আমরা এখানেই থামব।”
চামড়ার থলে থেকে বল্ভারকার রাতি নামক তুরপুনটি বের করল। “এই নাও, ‘ বলল সে, “তুমি দানব, বৃহৎ আর শক্তিশালী। তুমি তুরপুনটা ব্যবহার করে পাহাড়ের মধ্যে একটা ছিদ্র করো।”
বুগি তুরপুনটা তুলে নিল। সে পাহাড়ের পাশ দিয়ে তুরপুনটা স্থাপন করল আর হাতলটা ঘুরাতে শুরু করল। তুরপুনের সুচালো মাথাটা স্ক্রুর মতো পাথরে ঢুকে যেতে শুরু করল। বুগি হাতলটা ক্রমাগত ঘুরাতে থাকল।
“হয়ে গেছে,” একসময় বলল বুগি। সে তুরপুনটা পাথরের ভিতর থেকে বের করে আনল।
বভারকার তুরপুন দিয়ে করা ছিদ্রটার ওপর ঝুঁকল আর জোরে ফুঁ দিল। পাথরের টুকরো আর বালি তার দিকে উড়ে এলো। “আমি এইমাত্র দুটো কথা বুঝলাম” বলল বল্ভারকার।
“কী বুঝলে?” জিজ্ঞেস করল বুগি।
“আমরা এখনো পাহাড় ছিদ্র করতে পারিনি,” বলল বল্ভারকার। “তোমাকে আরো ছিদ্র করতে হবে।”
গুহার শেষপ্রান্তে সুটুং এর মেয়ে গুনলড একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, যে দরজার পিছনে সন আর বুন চৌবাচ্চা আর অড্রেরির কেটলি রাখা ছিল। গুনলডের হাতে ছিল একটা ধারালো খোলা তরবারি, আর সে আপনমনে গান গাইছিল।
তোমার সাথে দেখা হয়ে আনন্দিত হলাম, সাহসী নারী,” বলল ওডিন।
গুনলড তার দিকে তাকাল। “তুমি কে আমি সেটা জানি না,” বলল সে। “তোমার পরিচয় দাও আর বলো কেন আমি তোমাকে এক্ষুনি হত্যা করব না? আমি গুনলড, এই স্থানের রক্ষক।”
“আমি বলভারকার,” বলল ওডিন। “আর আমি জানি, এই স্থানে আসার সাহস করার জন্য আমার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। কিন্তু একটু দাঁড়াও, তোমাকে দেখতে দাও।”
গুনলড বলল, “আমার বাবা সুটুং আমাকে এখানে কাব্যমদিরা রক্ষার জন্য নিযুক্ত করেছেন।”
কাঁধ ঝাঁকাল বল্ডারকার। “কাব্যমদিরা দিয়ে আমি কী করব? আমি শুধু সুটুং এর কন্যা গুলডের সৌন্দর্য্য, সাহস আর গুণের কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছি। আমি নিজেকে বলেছি, লোকজন যেমন বলে, সে যদি তেমন সুন্দর হয়, তাকে একনজর দেখলে আমার প্রাণ জুড়াবে।”
গুনলড তার সামনে দাঁড়ানো সুন্দর আর সুদর্শন দানবটির দিকে তাকাল। “ তোমার প্রত্যাশা কি পূরণ হয়েছে, বলভারকার যে মরতে চায়?”
“প্রত্যাশার চেয়ে বেশি,” বলল বল্ভারকার, “তোমাকে নিয়ে যত গল্প আর গান আছে, তুমি সেসবের বর্ণনা থেকে অনেক সুন্দর। তুমি পাহাড়ের চূড়ার থেকে সুন্দর, হিমশৈলের থেকেও সুশ্রী, সকালের নতুন তুষারের চেয়েও রূপসী।”
গুনলডের গাল লাল হয়ে গেল, সে চোখ নামিয়ে নিল।
“আমি কি তোমার পাশে বসতে পারি?” জানতে চাইল বলভারকার।
গুনলড কিছু বলল না, শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
পাহাড়ের গুহায় তার জন্য খাবার আর পানীয় রাখা ছিল। তারা খেলো, পান করল আর ভালোবেসে সময় পার করল।
“এটাতো একটা কথা হলো। আরেকটা কথা কী?” জানতে চাইল বুগি। বভারকার কোনো জবাব দিল না। পাহাড়ের বরফশীতল হাওয়া তাদের কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। বুগি আগের ছিদ্রটায় তুরপুনটা আবার ঢুকিয়ে হাতলটা ঘুরাতে শুরু করল।
বুগি যখন আবার ছিদ্রটা থেকে তুরপুনটা বের করে আনল, ততক্ষণে চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। “এবার পাহাড়ের ভিতর পর্যন্ত ছিদ্র হয়েছে,” জানাল সে।
বভারকার কিছুই বলল না। সে ছিদ্রে মুখ দিয়ে ফুঁ দিল, সে দেখল পাথরের টুকরো আর ধুলো ভিতরের দিকে উড়ে গেল।
ফুঁ দিতে দিতে সে লক্ষ করল, কেউ একজন পিছন থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বল্ভারকার নিজের রূপ পরিবর্তন করে ফেলল, সে নিজেকে একটা সাপে পরিণত করল। বুগি তুরপুনের সুচালো মাথা দিয়ে তাকে আঘাত করল, কিন্তু সাপটি মাথাটা সরিয়ে সে আঘাত থেকে বাঁচল। “দ্বিতীয় কথাটি হলো, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলছো”, হিসহিস করে সাপটি বলল রুগিকে, যে তুরপুনটি অস্ত্রের মতো ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। “আমি জানতাম তুমি আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।” মুহূর্তের মধ্যে সাপটি ছিদ্রের ভিতর দিয়ে পাহাড়ের গভীরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বুগি তুরপুনটি দিয়ে আবার আঘাত করল, কিন্তু সাপটি ততক্ষণে নাগালের বাইরে চলে গেছে। সে একবার ভাবল সুতুং এর কাছে গিয়ে সব খুলে বলবে। পরক্ষণেই ভাবল, সে যদি সুটুংকে গিয়ে বলে, সে একটা শক্তিশালী জাদুকরকে নিটবর্গ পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছে আর তাকে পাহাড়ের গভীরে ঢুকতে সাহায্য করেছে, সুটুং তাকে হত্যা করে ফেলবে।
বুগি পাহাড় থেকে নেমে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। তার ভাই আর তার অমূল্য কাব্যমদিরার কী হাল হলো, সে বিষয়ে সে কিছুই জানতে চায় না।
বলভারকার সাপের বেশে ছিদ্রের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে পাহাড়ের ভিতর এক বিরাট গুহায় গিয়ে হাজির হলো। গুহাটি চকমকি পাথরের আলোয় আলোকিত ছিল। ওডিন নিজেকে আবার মানুষের বেশে রূপান্তর করল- সাধারণ কোনো মানুষ নয়, এখন তাকে একজন দানবের মতো বড়, সুন্দর আর সুদর্শন দেখাচ্ছিল। ওডিন গানের শব্দ শুনে শুনে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল।
একসময় বলভারকার বলল, “আমি যদি সন থেকে এক চুমুক কাব্যমদিরা পান করতে পারতাম! আমি তোমার সুন্দর চোখ নিয়ে কবিতা লিখতে পারতাম।”
“শুধু এক চুমুক?”
“শুধু এক চুমুক, এত ছোট চুমুক যে কেউ কিছু বুঝতে পারবে না।”
এভাবে রূপের প্রশংসা করতে করতে ওডিন গুনলডকে তিনটি পাত্র থেকে এক চুমুক করে কাব্যমদিরা পান করতে দিতে রাজি করিয়ে ফেলল। শুনলড বভারকারকে সাথে নিয়ে দরজা খুলল, দরজার ওপাশে একটা কেটলি আর দুইটি চৌবাচ্চা রাখা ছিল। বাতাসে কাব্যমদিরার ঘ্রাণ ভেসে আসছিল।
“শুধু তিনটা পাত্র থেকে এক চুমুক করে, এর বেশি না,” গুনলড বল্ভারকারকে বলল।
“অবশ্যই, প্রিয়তমা,” অন্ধকারে হাসল বভারকার। যদি গুনলড সেসময় তার হাসি দেখতে পারত, সে বুঝতে পারত, কিছু একটা গোলমাল আছে।
প্রথম চুমুকে ওডিন ওড্রেরির কেটলির সবটুকু কাব্যমদিরা পান করে ফেলল।
দ্বিতীয় চুমুকে সে বুন নামক চৌবাচ্চা খালি করে ফেলল।
তৃতীয় চুমুকে সন নামের চৌবাচ্চা শূন্য হয়ে গেল।
গুনলড বোকা ছিল না। সে বুঝতে পারল, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। সে ওডিনকে আক্রমণ করল। কিন্তু ওডিন লড়াই করার জন্য অপেক্ষা করল না। সে দৌড়ে পালাল আর পিছন থেকে দরজা লাগিয়ে শুনলডকে বন্দি করে ফেলল।
মুহূর্তের মধ্যে ওডিন বিশাল এক ঈগলের বেশ ধারণ করল। সে তার বিশাল ডানা ঝাপটাল আর সে বাতাসের ধাক্কায় পাহাড়ের দরজা খুলে গেল আর সে মুক্ত আকাশে উড়ে গেল।
গুনলডের চিল চিৎকারে সকালের বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
চিৎকার শুনে নিজের প্রাসাদে সুটুন জেগে উঠল আর দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। সে ওপরে তাকিয়ে বিশাল ঈগলটিকে দেখতে পেয়ে বুঝে গেল কী ঘটেছে।
সুটুং ও নিজেকে একটা বিরাট ঈগলে রূপান্তর করে নিল।
ঈগল দুটি আকাশের এত উপরে উড়ে গেল যে, তাদের মাটি থেকে দেখতে একেকটা বিন্দুর মতো লাগছিল। তারা এত দ্রুত উড়তে লাগল, তাদের ডানার ঝাপটায় ঝড়ের শব্দ উঠছিল।
এসগার্ডে থর সবাইকে বলল, “এখনই সময়।”
সে বিশাল চৌবাচ্চা তিনটি খোলা জায়গায় টেনে আনল।
এসগার্ডের দেবতারা দুটি বিশাল ঈগলকে চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে উড়ে আসতে দেখল। দুজনে খুব কাছাকাছি উড়ছিল। সুটং ছিল খুবই দ্রুতগামী আর সে ওডিনকে প্রায় ধরে ফেলেছিল। তারা যখন এসগার্ডের কাছে পৌঁছাল, সুটুং এর চঞ্চু ওডিনের লেজ প্রায় ধরে ফেলেছিল।
ওডিন যখন কাছাকাছি পৌঁছাল, সে মুখ থেকে কাব্যমদিরা ফেলতে লাগল, তার চঞ্চু থেকে ঝরনার আকারে কাব্যমদিরা বেরিয়ে চৌবাচ্চা তিনটি ভরে গেল।
তখন থেকেই, আমরা জানি, যারা শব্দ দিয়ে জাদু করেন, যারা কাব্য-কবিতা আর গান লিখতে পারেন, তারা কাব্যমদিরার স্বাদ নিয়েছেন। যখন আমরা একটা সুন্দর কবিতা শুনি, আমরা বলি, সে ওডিনের উপহারের স্বাদ পেয়েছে।
এটাই হলো কাব্যমদিরার গল্প। এভাবেই দুনিয়া সেটা লাভ করেছে। এই গল্পের পরতে পরতে আছে অসততা আর ধোঁকা, হত্যা আর বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু এই গল্পের এখানেই শেষ নয়। তোমাদের গল্পের আরো একটি অংশ বলা বাকি।
গল্পের সবচেয়ে লজ্জাজনক অংশ এটি। যখন বিশ্বপিতা ওডিন ঈগলের বেশে উড়তে উড়তে চৌবাচার কাছে পৌঁছেছিল, সুটুং প্রায় তাকে ধরে ফেলেছিল। ওডিন তার পশ্চাৎদেশ থেকে দুর্গন্ধযুক্ত মদিরা সুটুং এর মুখে নিক্ষেপ করেছিল, তাতে সুটুং খেই হারিয়ে ফেলেছিল।
ওডিন এর পশ্চাৎদেশ থেকে বের হওয়া মদিরা কেউ পান করতে চায় না। কিন্তু যখন কোনো কবির মুখ থেকে খারাপ কোনো কবিতা শুনি, যার সুর-তাল-লয়ের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই, আমরা বুঝে যাই কোনো মদিরাটি সে পান করে এসেছে।