কাপ্তেন মতি (অর্থাৎ নোট জালকারীর অদ্ভুত রহস্য)
প্রথম পরিচ্ছেদ
প্রায় সাত বৎসর অতীত হইল, একদিবস সন্ধ্যার কিছু পূর্ব্বে সংবাদ পাইলাম যে, খিদিরপুরে একজন মুসলমান কয়েকখানি জাল করেন্সি নোট সহিত ধৃত হইয়াছে। আরও জানিতে পারিলাম,—যে সকল নোট তাহার নিকট পাওয়া গিয়াছে, সে সকল কি প্রকারে তাহার অধিকারে আসিয়াছে, তাহার সন্তোষজনক উত্তর প্রদান না করায়, সেই অনুসন্ধানের ভার পরিশেষে আমার উপরই পতিত হইয়াছে।
সংবাদ পাইয়া আর ক্ষণমাত্র বিলম্ব করিতে পারিলাম না। যে থানার এলাকায় সে ধৃত হইয়াছিল, সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেইস্থানে গিয়া জানিতে পারিলাম যে, সেইদিন দিবা দুইটার সময় সমসের উদ্দিন নামক একটি মুসলমান যুবক খিদিরপুরের বাজারস্থিত একখানি ছাতার দোকানে একটি ছাতা ক্রয় করে, এবং তাহার মূল্যের নিমিত্ত পাঁচ টাকার একখানি করেন্সি নোট বাহির করিয়া দোকানদারের হাতে প্রদান করে। দোকানদার সেই ছাতার মূল্য বাদে বক্রী টাকা তাহাকে প্রত্যর্পণ করিলে, সে সেইস্থান হইতে অন্য দোকানাভিমুখে গমন করে।
দোকানদার উক্ত নোটখানি আপন বাক্সের ভিতর বন্ধ করিতে যাইতেছিল, এমন সময়ে জনৈক ইংরাজ কোন দ্রব্য ক্রয় করিবার বাসনায় তাহার দোকানে গিয়া উপস্থিত হন। দোকানদার সাহেবকে দেখিয়া উক্ত নোটখানি বাক্সের ভিতর বন্ধ করিবার পরিবর্তে, তাঁহাকেই হস্তে প্রদান করিয়া কহে, “দেখুন দেখি মহাশয়! এই নোটের নম্বর ঠিক আছে কি না?”
সাহেব নোটখানি আপন হস্তে লইয়া একটু বিশেষ মনোযোগের সহিত প্রথমে দর্শন করিলেন ও পরিশেষে কহিলেন, “এ নোট তুমি কোথায় পাইলে?”
উত্তরে দোকানদার সমসের উদ্দিনকে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “ঐ ব্যক্তি আমাকে এই নোট প্রদান করিয়াছে। কেন মহাশয়! এই নোটে কোনরূপ নম্বরের গোলযোগ ঘটিয়াছে কি?”
সাহেব কহিলেন, “গোলযোগ নিতান্ত সামান্য নহে। তবে যদিচ আমি ঠিক চিনিতে পারিতেছি না, তথাপি আমার বোধ হইতেছে যে, এই নোট গবর্ণমেন্টের প্রকৃত নোট নহে, ইহা জাল নোট।”
দোকানদারের সহিত সাহেবের যখন এইরূপ ভাবে কথাবার্তা হইতেছিল, তখন হঠাৎ একজন কনষ্টেবল আসিয়া সেইস্থানে উপস্থিত হইল। সে উভয়ের কথা শুনিতে পাইয়াই দ্রুতপদে সমসের উদ্দিনের নিকট গমন পূর্ব্বক তাহাকে ধৃত করিয়া, সেই দোকানদারের সম্মুখে আনয়ন করিল। সেইস্থানে সমসের উদ্দিনের অঙ্গের উত্তমরূপে তল্লাসি লওয়া হইল। তল্লাসিতে তাহার নিকট হইতে আরও পাঁচ টাকা করিয়া পাঁচখানি নোট পাওয়া গেল। সাহেব সেই নোটগুলি উত্তমরূপে মিলাইয়া দেখিয়া সেই কনষ্টেবলকে বলিয়া দিল, “উহার নিকট যে সকল নোট পাওয়া গেল, তাহার সমস্তগুলিই জাল। অনুকরণ যদিচ অতি উৎকৃষ্টরূপে করা হইয়াছে, তথাপি সমস্ত নোটের নম্বর একই হইয়া গিয়াছে। দুইখানি নোট কখনই যখন এক নম্বরের হইতে পারে না, তখন সমস্ত নোটগুলিই একই নম্বরের হইবে কি প্রকারে? সুতরাং ইহা জাল নোট ভিন্ন কখনই আসল নোট হইতে পারে না।”
সাহেবের এই কথা শুনিয়া কনষ্টেবল আর কোন কথা না বলিয়া, সেই দোকানদার ও সমসের উদ্দিনকে আপনার থানায় লইয়া গেল। থানার ইনস্পেক্টরবাবু সেই সময় থানায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি কনষ্টেবল-প্রমুখাৎ সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া, সমসের উদ্দিনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমস্ত স্থান উত্তমরূপে পুনরায় অনুসন্ধান করিলেন। শরীরের কোন স্থানে আর কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না। কিন্তু তাহার পরিধেয় জুতার ভিতর হইতে আরও পাঁচখানি নোট বাহির হইল।
এই ব্যাপারের পর ইনস্পেক্টরবাবু তাহাকে বিশেষ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন যে, এই নোট সে কোথায় পাইল? ইনস্পেক্টরবাবুর কথার উত্তরে সমসের উদ্দিন যাহা কহিল, তাহার কিন্তু কিছুই বিশ্বাস করিতে পারা যায় না। সমসের উদ্দিন কহিল, “অদ্য প্রাতঃকালে কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে আমি মেছুয়াবাজার অভিমুখে গমন করিয়াছিলাম। নানাস্থান ঘুরিয়া ফিরিয়া আমি অতিশয় ক্লান্তি বোধ করি, ও বড় মসজিদের সম্মুখে একস্থানে গিয়া উপবেশন করি। সেই সময় একজন মুসলমান আমার নিকটে আগমন করে ও কহে, “আমি দেশে যাইতেছি, আমার সহিত কতকগুলি পাঁচ টাকা করিয়া নোট আছে। আমাদিগের দেশে নোট যে কি পদার্থ, তাহা কেহ বুঝে না। এরূপ অবস্থায় এই নোটগুলি বদল করিয়া, তাহার পরিবর্তে নগদ টাকার সংগ্রহ করিতে হইবে। কয়েকটা দোকানে আমি গমন করিয়াছিলাম, কিন্তু নগদ টাকা প্রদান করিতে কেহই সমর্থ হয় নাই। এরূপ অবস্থায় আপনার সহিত যদি নগদ টাকা থাকে, তাহা হইলে যতদূর পারেন, নোটের পরিবর্তে যদি আমাকে নগদ মুদ্রা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমার বিশেষ উপকার হয়। ইহার নিমিত্ত আমি শতকরা এক টাকা বাট্টা দিতেও প্রস্তুত আছি।”
“আমার নিকট কতকগুলি নগদ টাকা ছিল, তাহাই জানিতে পারিয়া বোধ হয়, ঐ ব্যক্তি আমাকে ঐরূপ কথা কহিল। আমিও দেখিলাম, আমার নিকট প্রায় পঞ্চাশ-ষাট টাকা আছে; সুতরাং আট আনা বাট্রার লোভ আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে পঞ্চান্ন টাকা প্রদান করিতে সম্মত হইলাম। আমার কথা শুনিয়া সে অতিশয় সন্তুষ্ট হইল। আমাকে বার বার ধন্যবাদ দিয়া, এগারখানি পাঁচ টাকা হিসাবে নোট ও একটি আধুলি আমাকে প্রদান করিলে, আমি পঞ্চান্নটি টাকা তাহাকে প্রদান করিলাম। সে টাকা লইয়া সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও খিদিরপুর অভিমুখে আগমন করিলাম, ও পরিশেষে এই স্থানেই আমি ধৃত হইলাম। আমি সে লোকটিকে চিনি না, বা কোথায় থাকে, তাহাও আমি জানি না। ইহার পূর্ব্বে আর কখন আমি তাহাকে দেখি নাই। কলিকাতায় দ্রব্যাদি ক্রয় করিবার নিমিত্ত আমি যাহা কিছু অর্থ আনয়ন করিয়াছিলাম, এইরূপে উক্ত চোরের হাতে পড়িয়া তাহার সমস্তই নষ্ট করিয়াছি, এবং এখন দেখিতেছি, আমাকে বিনা অপরাধে জেলে পর্য্যন্তও বা গমন করিতে হয়।”
সমসের উদ্দিনের কথা শুনিয়া, ইনস্পেক্টর সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বাসস্থান কোথায়? কত দিবস হইল, দেশ হইতে এখানে আগমন করিয়াছ? এবং কোন স্থানেই বা অবস্থিতি করিতেছ?”
উত্তরে সমসের উদ্দিন কহিল, “আমার বাসস্থান বাখরগঞ্জ জেলায়। অদ্যই আমি আমার দেশ হইতে আগমন করিয়াছি। এখন পর্য্যন্ত থাকিবার স্থানের কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই।”
সমসের উদ্দিনের এই কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টরবাবু তাহাকে আরও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; কিন্তু কোন কথারই সন্তোষজনক উত্তর না পাইয়া, উক্ত কর্ম্মচারীর আদেশ মত অনুসন্ধানের ভার পরিশেষে আমারই উপর অর্পণ করিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
এই সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে অবগত হইয়া, পরিশেষে আমিও তাহাকে দুই একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। সেও তাহার উত্তর প্রদান করিতে লাগিল।
প্রশ্ন। তুমি অদ্যই তোমার দেশ হইতে আগমন করিয়াছ?
উত্তর। আজই আসিয়াছি।
প্রশ্ন। তোমার পরিধানে যে সকল বস্ত্রাদি আছে, তাহা ব্যতীত অন্য বস্ত্রাদি কিছুই তোমার নিকট দেখিতেছি না, সে সকল দ্রব্য কোথায় তুমি রাখিয়া দিয়াছ?
উত্তর। যাহা আমার সহিত আছে দেখিতেছেন, ইহা ব্যতীত আমার আর কোন দ্রব্যাদি নাই।
প্রশ্ন। বাখরগঞ্জ হইতে কলিকাতায় আসিতে হইলে প্রথমে শিয়ালদহ ষ্টেশনে আসিয়া নামিতে হয়। সেইস্থান হইতে যে মেছুয়াবাজারে তুমি প্রথম গমন করিয়াছিলে কহিলে, সেইস্থান রেলওয়ে ষ্টেসন হইতে খিদিরপুর অপেক্ষা অনেক নিকটবর্তী, এরূপ অবস্থায় তুমি খিদিরপুরে আসিলে কেন?
উত্তর। মেছুয়াবাজারে থাকিবার উত্তমরূপ স্থান না পাওয়ায়, বাসা অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত খিদিরপুরে আসিয়াছিলাম।
প্রশ্ন। ইহার পূর্ব্বে যখন তুমি কলিকাতায় আসিয়াছিলে, সেই সময় কোন্ স্থানে আসিয়া বাস করিতে?
উত্তর। পূর্ব্বে আমি কখন কলিকাতায় আসি নাই।
প্রশ্ন। তোমার দেশের কোন লোক কলিকাতার কোন স্থানে আছে?
উত্তর। তাহা আমি জানি না।
এইরূপ তাহাকে যত প্রশ্ন করিলাম, সে তাহার উত্তর এইরূপেই প্রদান করিতে লাগিল। তখন তাহাকে আর অধিক কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া, সেই সময় তাহাকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভাবিলাম, মেছুয়াবাজারের সন্নিকটবর্তী যে মসজিদের কথা সে বলিতেছে, সেইস্থানে একবার লইয়া গিয়া দেখি, যদি কেহ কোন কথা বলিতে পারে। এই ভাবিয়া সমসের উদ্দিনকে সঙ্গে লইয়া মেছুয়াবাজারে গমন করিলাম। যে স্থানে সে সেই সকল নোট প্রাপ্ত হইয়াছিল বলিয়াছে, তাহাকে সেইস্থান দেখাইয়া দিতে কহিলাম। সে এদিকে ওদিক ঘুরিয়া ফিরিয়া পরিশেষে কহিল, “আমি সেইস্থান চিনিয়া উঠিতে পারিতেছি না।”
আমরা এখন কোথায় যাইব, এবং কি প্রকারেই বা সমসের উদ্দিনের থাকিবার স্থানের ঠিকানা করিব, সেইস্থানে দাঁড়াইয়া এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় হঠাৎ একটি লোক তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল “তুমি কবে আসিয়াছ?”
সমসের উদ্দিন এই কথা শুনিয়াও যেন শুনিল না, বা তাহার কোন উত্তরও প্রদান করিল না; অধিকন্তু তাহার দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া লইল।
আমি কিন্তু এই সকল দেখিলাম, দেখিয়া সেই আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি ইহাকে কত দিবস হইতে জানেন?”
উত্তরে আগন্তুক কহিল, “প্রায় দুই মাস পূর্ব্বে কলিকাতায় আসিয়া আমি যে বাসায় থাকিতাম, সেই বাসায় কিছুদিবস অবস্থিতি করিয়াছিলেন। আমি সেই সময় হইতে ইহাকে চিনি।”
আগন্তুকের কথা শুনিয়া আমি আবার তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পূর্ব্বে আপনি যে বাসায় থাকিতেন, এখন কি আর সে বাসায় থাকেন না?”
“না, আমি প্রায় সাত দিবস হইতে সেইস্থান পরিত্যাগ করিয়া, অপর আর একস্থানে অবস্থিতি করিতেছি।”
“আপনি পূর্ব্বে যে বাড়ীতে অবস্থিতি করিতেন, বা দুই মাস পূর্ব্বে এই ব্যক্তি আসিয়া যে বাড়ীতে ছিল, সেই বাড়ী কোথায়, আমাকে উহা একবার দেখাইয়া দিতে পারেন কি?”
“কেন পারিব না? নিকটেই মেছুয়াবাজার ষ্ট্রীটের উপর সেই বাড়ী। আমার সহিত আসুন—আমি এখনই উহা দেখাইয়া দিতেছি।”
এই বলিয়া আগন্তুক আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া একটি বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল। ভিতরে গিয়া দেখিলাম যে, এই বাড়ীটি এক প্রকার আড়ত বিশেষ। উত্তর এবং পূর্ব্বদেশের মুসলমান বেপারীগণ, যাহাদিগের এখানে থাকিবার নির্দ্দিষ্ট স্থান নাই, তাহারা, কারবার করিবার মানসে কলিকাতায় আগমন করিলে প্রায়ই এইস্থানে অবস্থিতি করিয়া থাকে। সুতরাং ইহা কারবারী লোকের বাসা-বাড়ী স্বরূপ।
আমরা সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার পর, আমাদিগের সমভিব্যাহারে সমসের উদ্দিনকে দেখিয়া সেই বাড়ীর একজন বলিলেন, “আজ সমস্ত দিবস তুমি কোথায় ছিলে? আহার করিতে আসিলে না কেন?”
এই কথা শুনিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এবার কয়দিবস পর্য্যন্ত ইনি এইস্থানে অবস্থিতি করিতেছেন? এবং ইহার দ্রব্যাদিই বা কোন্ গৃহে আছে?”
উত্তরে সেই ব্যক্তি কহিল, “দোতালার উপর পূর্ব্বদিকের গৃহে ইনি থাকেন, ও কেবলমাত্র পরশ্ব তারিখে ইনি বাটী হইতে আগমন করিয়াছেন।”
এই কথা শুনিয়া আর কালবিলম্ব না করিয়া, আমরা দোতালার উপর সমসের উদ্দিনের থাকিবার স্থানে গমন করিলাম। আমাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অনেক লোকেই সেই গৃহের ভিতর গমন করিলেন। সেই গৃহের ভিতর সমসের উদ্দিনের দ্রব্যাদি অধিক কিছুই ছিল না, শয়ন করিবার উপযোগী কেবলমাত্র একটি শয্যা এবং চামড়ার একটি পোর্টমেণ্ট ব্যতিরেকে তাহার অপর আর কোন দ্রব্য যে সেইস্থানে আছে, ইহা আর কেহই বলিল না।
সেইস্থানে উপস্থিত সমস্ত লোকের সম্মুখে প্রথমে আমি সেই শয্যার ভিতর অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু আমার আবশ্যকোপযোগী কোন দ্রব্যই তাহার ভিতর পাইলাম না। কিন্তু পরিশেষে যখন সেই চামড়ার পোর্টমেণ্ট খুলিলাম, তখন দেখিলাম, উহার ভিতর দুই তিন তাড়া নোট রহিয়াছে। সৰ্ব্বসমক্ষে উহা বাহির করিয়া গুণিয়া দেখিলাম যে, ২৭৯ খানি পাঁচ টাকার হিসাবে নোট; নোটগুলির আকার অবয়বের কোন ব্যতিক্রম নাই, কিন্তু সমস্তগুলির নম্বর একই।
এই অবস্থা দেখিয়া বাটীর সমস্ত লোকই অতিশয় বিস্মিত হইল, ও সকলেই উহাকে অজস্র গালিবর্ষণ করিতে লাগিল। সমসের উদ্দিন সমস্ত কথাই চুপ করিয়া শ্রবণ করিতে লাগিল, কাহারও কথায় কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না।
অনুসন্ধানে জানিতে পারিলাম যে, সমসের আমাদিগের নিকট তাহার যে নাম বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছে, তাহাই তাহার প্রকৃত নাম, এবং বাসস্থানের কথাও যাহা বলিয়াছে, তাহাও প্রকৃত। বাখরগঞ্জ জেলার ভিতর চৌঠাই মহল নামক স্থান উহার জন্মস্থান।
এইরূপে আশাতীত নোট তাহার নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়া, এবং তাহার প্রকৃত নাম ও ঠিকানা অবগত হইতে পারিয়া, তাহার সমস্ত দ্রব্যাদির সহিত আমরা সেই স্থান পরিত্যাগ করিলাম, এবং যে থানার মোকদ্দমা, সেই থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। যখন আমরা সেই থানায় প্রত্যাগমন করিলাম, তখন রাত্রি বারটার ন্যূন নহে।
সমসের উদ্দিন যখন বেশ বুঝিতে পারিল যে, তাহার পরিত্রাণের আর কোন উপায় নাই; তখন তাহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সে তখন তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিতে লাগিল।
তখন কহিল, “আমার নিকট হইতে যত নোট পাওয়া গিয়াছে, উহার একখানিও গবর্ণমেন্টের প্রকৃত নোট নহে, সমস্তই জাল নোট। এই নোটের পরিবর্তে যাহাতে অর্থ সংগ্রহ করিতে পারি, সেই বাসনাতেই এইস্থানে আসিয়া সাধ্যমত তাহার চেষ্টা করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ধৃত হইয়া, এখন আপনাদিগের হস্তে বন্দী হইয়াছি। এই সমস্ত নোট আমার নিকটে পাওয়া গিয়াছে সত্য, কিন্তু ইহা আমার দ্বারা প্রস্তুত নহে; নোট প্রস্তুত করিবার ক্ষমতা আমার নাই। আমাদিগের দেশের মতিলাল দত্ত নামক একজন কায়স্থের দ্বারা ইহা প্রস্তুত হয়। তবে তাহার সহায়তা যে আমি করিয়াছিলাম, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। মতি এ বিষয়ের একজন অতিশয় উপযুক্ত লোক। ইহা প্রস্তুত করিতে যে কিছু যন্ত্রাদির আবশ্যক, মতি প্রথমে তাহা আপনার হাতে প্রস্তুত করে, এবং সেই যন্ত্রের সাহায্যে পরিশেষে এই নোট প্রস্তুত করিয়াছে। আরও অনেক নোট এবং যন্ত্রাদি এখন তাহারই গৃহে আছে। তাহার বাসস্থান আমার গ্রামের সন্নিকটস্থ রায়নগর গ্রামে। যদি আপনারা সেইস্থানে গমন করিয়া তাহার গৃহ অনুসন্ধান করিতে পারেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন যে, আমার কথা সত্য, কি মিথ্যা।” সমসের উদ্দিন মতি দত্তের বিপক্ষে এইরূপ আরও অনেক কথা বলিল, এবং পরিশেষে ইহাও কহিল যে, সে মধ্যে মধ্যে দেশের ভিতর টীকা দিয়া বেড়ায় বলিয়া, সেইস্থানের পুলিসের সহিত তাহার চেনা পরিচয়ও আছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সমসের উদ্দিনের এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া মনে কতক পরিমাণে বিশ্বাস হইল যে, সে এখন প্ৰকৃত কথা বলিতেছে। অতএব যত শীঘ্র পারা যায়, রায়নগরে গমন করিয়া যাহাতে মতিলাল দত্তের খানা-তল্লাসি করা যাইতে পারে, তাহার বন্দোবস্ত করা শীঘ্রই কর্তব্য। এই সকল বিষয় মনে মনে স্থির করিয়া, আমার মনের ইচ্ছা—আমার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারীকে জানাইলাম। তিনি সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া আমার মতেই মত দিলেন। সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস মেলট্রেনে আমাকে বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত রায়নগর গ্রামে গিয়া মতিলালকে ধৃত, এবং তাহার গৃহে খানা-তল্লাসি করিতে হইবে।
আদেশ-মত পরদিবস সন্ধ্যার পর খুলনা মেলে শিয়ালদহ ষ্টেশন পরিত্যাগ করিলাম। অতি প্রত্যূষে মেলট্রেন খুলনায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেইস্থানে ষ্টেশনের সন্নিকটবর্তী নদীতে একখানি ষ্টীমার সজ্জিত ছিল, তাহাতেই আরোহণ করিয়া বাখরগঞ্জ-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
যে স্থানে আমাকে গমন করিতে হইবে, সেইস্থান বাখরগঞ্জ জেলার মধ্যবর্তী হইলেও, নিজ বরিশাল হইতে অনেক দূর ব্যবধান। উক্ত গ্রাম পিরোজপুর সবডিবিজানের, এবং পিরোজপুর থানার এলাকায় স্থাপিত। কিন্তু পিরোজপুর হইতে জলপথে প্রায় বিশ ক্রোশের ন্যূন হইবে না।
পিরোজপুর থানার এলাকাভুক্ত হইলেও, উক্ত গ্রাম সেইস্থানের নিকটবর্ত্তী একটি ফাড়ীর অধীন। সেই ফাঁড়ী নামে ফাঁড়ী, কিন্তু কাৰ্য্যে থানা অপেক্ষাও উহা শ্রেষ্ঠ। একজন উপযুক্ত সব-ইনস্পেক্টরকে সর্ব্বদাই এই ফাঁড়ীতে থাকিতে হয়। পিরোজপুর সবডিবিজানের ইনস্পেক্টরের থাকিবার স্থানও পিরোজপুরে।
দিবা প্রায় বারটার সময় ষ্টীমার আসিয়া পিরোজপুরের ঘাটে উপস্থিত হইল। ষ্টীমারের ঘাটে একজন কনষ্টেবল পাহারা দিতেছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, ইনস্পেক্টরবাবু সে সময় বাসাতেই আছেন। এই সংবাদ জানিতে পারিয়া আমার সমভিব্যাহারী আরদালীকে সঙ্গে লইয়া, তৎক্ষণাৎ ইনস্পেক্টর বাবুর বাসার অভিমুখে গমন করিলাম।
যে সময় আমরা ইনস্পেক্টরবাবুর বাসায় গিয়া উপনীত হইলাম, সেই সময় তিনি বাড়ীর ভিতরে ছিলেন; সংবাদ পাইবামাত্র তিনি বাহিরে আগমন করিলেন, ও আমাদিগকে বসিতে কহিলেন। আমি সেইস্থানে উপবেশন করিয়া তাঁহাকে আমার পরিচয় প্রদান করিলাম, ও যে কার্য্যের নিমিত্ত আমি আমি সেইস্থানে গমন করিয়াছি, তাহাও তাঁহাকে কহিলাম। তিনি আমার কথা শ্রবণ করিয়া প্রায় দশ মিনিটকাল চুপ করিয়া রহিলেন। পরিশেষে কহিলেন, “যে অনুসন্ধানে আপনি রায়নগর গ্রামে গমন করিতেছেন, তাহার নিমিত্ত আপনি আমার নিকট কিরূপ সাহায্য প্রার্থনা করেন?”
আমি। আমি যেরূপে তাহাকে সহজে ধরিতে পারি, এবং অনায়াসেই তাহার খানা-তল্লাসি করিয়া উঠিতে পারি, এরূপ বন্দোবস্ত করুন। এ সম্বন্ধে যেরূপ সাহায্য করিবার প্রয়োজন বিবেচনা করেন, সেইরূপেই আমাকে সাহায্য করুন।
ইনস্পেক্টর। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম। সরকারী কর্ম্ম করিতে হইলে যেরূপেই হউক, আমাকে তাহা নিৰ্ব্বাহ করিতেই হইবে। কিন্তু—
আমি। ইহার ভিতর আবার কিন্তু কি? কিন্তুর কোনও কারণ আমি দেখিতে পাইতেছি না।
ইনস্পেক্টর। আপনি এ প্রদেশের লোক নহেন, এবং এই প্রদেশে কখন আপনাকে থাকিতেও হয় নাই। সুতরাং আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না যে, আপনি কিরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।
আমি। কেন মহাশয়! আমি যে কার্য্যের নিমিত্ত আপনার নিকট হইতে সাহায্য পাইবার প্রার্থনা করিতেছি, তাহা ত নূতন নহে। এরূপ কার্য্যে সৰ্ব্বদাই আমি হস্তক্ষেপ করিয়া থাকি। কিন্তু আজ আপনি যেরূপ কহিলেন, সে প্রকার কথা ইতিপূর্ব্বে আমি আর কাহারও নিকট কখনও শ্রবণ করি নাই।
ইনস্পেক্টর। আপনি যাহা বলিলেন, তাহা সত্য; কিন্তু মতি দত্তকে আপনি চিনেন কি?
আমি। না মহাশয়! আমি তাহাকে চিনি না। কিন্তু যাহাকে না চিনি, পল্লীগ্রামে তাহাকে চিনিয়া লইতে সবিশেষ কোন কষ্ট হইবে না; ইহা আমার বহুদিবসের বিশ্বাস।
ইনস্পেক্টর। আপনি তাহাকে চিনেন না কহিলেন, কিন্তু ইতিপূর্ব্বে তাহার নাম কি কখনও আপনি শ্রবণ করিয়াছেন?
আমি। না মহাশয়! তাহার নামও আমি পূর্ব্বে কখন শুনি নাই।
ইনস্পেক্টর। দেখুন মহাশয়! আপনার অপেক্ষা আমার বয়ঃক্রম অনেক অধিক। সুতরাং আমি যে আপনার অপেক্ষা অনেক দেখিয়াছি, এবং অনেক সময়ে অনেক প্রকার ভোগ করিয়াছি, তাহার আর সন্দেহ নাই। আপনি যে কার্য্যের জন্য আসিয়াছেন, সেরূপ অসমসাহসিক কার্য্যে আর কখন প্রবৃত্ত হইবেন না। আপনার প্রাণরক্ষা করিতে পারিলে, অনেক চাকরি পাইবেন, এবং অনেক অর্থ উপার্জ্জন করিতে পারিবেন। মতি দত্তের বিষয় আমি যতদূর অবগত আছি, তাহা এই সময়ে আপনাকে বলিয়া দেওয়া, বোধ হয়, আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম। তাহার ব্যাপার আপনি প্রথম শ্রবণ করুন; পরিশেষে যাহা বিবেচনা হয়, করিবেন।
“মতিলাল দত্ত”—এ প্রদেশে মতিলাল দত্ত নামে পরিচিত নহে। এ প্রদেশে মতিলাল দত্ত বলিয়া তাহার অনুসন্ধান করিলে, হয় ত কেহই তাহাকে চিনিতে পারিবে না। এ প্রদেশীয় সমস্ত লোক তাহাকে “কাপ্তেন মতি” বলিয়া জানে।
আমি। “কাপ্তেন মতি” এ নাম কি প্রকারে প্রাপ্ত হইল?
ইনস্পেক্টর। আপনি যে প্রকার শুনিয়াছেন, মতি সে প্রকার লোক নহে, সে তিন চারি শত লোকের দলপতি। এ প্রদেশে যত বদমায়েস আছে, যত জালিয়াৎ আছে, যত লাঠিয়াল আছে, সকলেই মতির দলভুক্ত, এবং মতির আজ্ঞাকারী। মতি ইহাদিগকে যাহা বলিবে, প্রাণের ভয় না করিয়া, তৎক্ষণাৎ তাহার সেই আদেশ প্রতিপালন করিবে এই জেলায় জমিদারে জমিদারে যত মোকদ্দমা হইয়া থাকে, যত দাঙ্গা, যত খুন হইয়া থাকে, সেইরূপ আর কোন জেলাতে হয় বলিয়া আমার বোধ হয় না। কিন্তু এমন কোন দাঙ্গাই নাই; যাহাতে মতি সদলবলে কোন না কোন পক্ষ অবলম্বন না করে। জমিদারে জমিদারে দাঙ্গা উপস্থিত হইলেই, উভয় পক্ষ হইতেই প্রথমে মতিকে হস্তগত করিবার বাসনা করে। কারণ, এ প্রদেশীয় জমিদারমাত্রেই অবগত আছেন যে, মতি যে পক্ষ অবলম্বন করিয়া থাকে, সেই পক্ষেরই প্রায় জয়লাভ হয়। মতিও সুযোগ বুঝিয়া আপনার মনোবাঞ্ছা উত্তমরূপে পূর্ণ করিয়া লয়। যে পক্ষ হইতে অধিক অর্থ তাহাকে দেওয়া হয়, সে সদলবলে সেই পক্ষই অবলম্বন করিয়া থাকে। এইরূপে দাঙ্গা ফুরান করিয়া যে সকল ব্যক্তি উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে, তাহাদিগের দলপতিকে ধৃত করিয়া নিতান্ত সামান্য কথা বিবেচনা করিবেন না। যে সকল ব্যক্তি সামান্য অর্থলোভে হাসিতে হাসিতে এইরূপ দাঙ্গায় প্রবৃত্ত হইয়া অবলীলাক্রমে অপর পক্ষীয় ব্যক্তিদিগকে হত ও আহত করিয়া থাকে, তাহাদিগের সর্ব্বপ্রধান দলপতিকে ধৃত করা যে কিরূপ কঠিন কাৰ্য্য, তাহা আপনিই বিবেচনা করিয়া দেখুন।
“ইহার পূর্ব্বে কত দাঙ্গা মোকদ্দমায় যে মতি দত্ত আসামী হইয়াছে, তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু এ পৰ্য্যন্ত এই জেলার ভিতর এমন কোন পুলিস-কৰ্ম্মচারী আসেন নাই, যে তিনি কোন মোকদ্দমায় উহাকে ধৃত করিয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেবের সম্মুখে বিচারার্থ লইয়া যাইতে পারিয়াছেন, বা কোন সাক্ষীর দ্বারা কোন কথা উহার বিপক্ষে বলাইতে সমর্থ হইয়াছেন। এই জেলার মধ্যে জমিদারই বলুন, প্রজাই বলুন, বা সরকারী কর্ম্মচারীই বলুন, এমন একটি ব্যক্তি আপনি পাইবেন না যে, মতির বিপক্ষে কোন কথা বলিতে পারে। সকলের মনে ভয় যে, যিনি উহার বিপক্ষাচরণ করিবেন, প্রথমে তাঁহার যথাসর্বস্ব নষ্ট হইবে, ও পরিশেষে তাঁহার প্রাণ লইয়া টানাটানি পড়িবে; অথবা তাহার উপর যে সকল অত্যাচার হইবে, তাহা প্রমাণ করিবার নিমিত্ত অপর কোন সাক্ষীই পাওয়া যাইবে না।
“এই ত মতির প্রধান গুণ! ইহা ব্যতীত তাহার মত জালিয়াৎ, এ জেলায় কেন, অপর জেলায়, আছে কি না, তাহাও সন্দেহ। যে সকল ভাষা সে অবগত আছে, তাহাতে লিখিত দলিল-পত্রের কথাই নাই; যে সকল বিদেশীয় ভাষা সে কখনও দেখে নাই, আবশ্যক হইলে সেই সকল ভাষায় লিখিত দলিল পত্রও এরূপ ভাবে জাল করিয়া দিতে পারে যে, জাল দলিল দেখিয়া প্রকৃত দলিল-লেখকও সহজে বলিতে পারে না যে, উহা তাহার হাতের লেখা, কি না?
“এই ত মতির চরিত্র! এরূপ ব্যক্তিকে আপনি ধৃত করিবার নিমিত্ত কলিকাতা হইতে এখানে আগমন করিয়াছেন। আপনি যদি বুদ্ধিমান্ কর্ম্মচারী হয়েন, তাহা হইলে আমার পরামর্শ গ্রহণ করুন। এইস্থানে দুই একদিবস অতিবাহিত করিয়া, কলিকাতায় প্রত্যাগমন করুন। সেইস্থানে গিয়া বলুন, মতি দত্তের অনেক অনুসন্ধান করা হইয়াছে; কিন্তু তাহার কোনরূপ সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই, বা তাহার গৃহের খানা-তল্লাসি করিয়া নোট জাল সম্বন্ধীয় কোন দ্রব্যই প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই।
ইনস্পেক্টরবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া, এবং তাহার সাহসিকতার পরিচয় পাইয়া যদিও আমার মনে মনে একটু ভয়ের উদ্রেক হইল, তথাপি ভাবিলাম, যে কার্য্য আমাদ্বারা এ পর্য্যন্ত কখনই ঘটে নাই, তাহা নিমকহারামের ন্যায় কি প্রকারে ঘটাইব? কি প্রকারে আপনার প্রধান কর্মচারীর নিকট গমন করিয়া, তাঁহার সম্মুখে এরূপ মিথ্যাকথা বলিব? ইহা আমার দ্বারা কখনই হইবে না। যখন এতদূর আসিয়াছি, তখন প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া দেখিব, কোনরূপে আপন কার্য্য উদ্ধার করিতে পারি, কি না? কার্য্যে সফল হইতে পারি, ভালই; নচেৎ এরূপ প্রাণের মায়া করিয়া নিতান্ত কাপুরুষের ন্যায় আমি কখনই কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিতে পারিব না। এই প্রকার ভাবিয়া আমি ইনস্পেক্টরবাবুকে পুনরায় কহিলাম, “মহাশয়! যে কার্য্যে আসিয়াছি, মরি বাঁচি, তাহার শেষ পর্য্যন্ত দেখিয়া যাইব। আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম—আপনার নিকট আগমন করা, এবং আপনার সাহায্য গ্রহণ করা। ইহাতে যদি আপনি আমাকে সাহায্য প্রদান করেন, ভালই; নচেৎ আমি একাকী যতদূর পারিব, সাধ্যমতে তাহার চেষ্টা করিব। কৃতকার্য্য হইতে পারি, ভালই; নচেৎ যাহা আমার অদৃষ্টে ঘটিবার—ঘটিবে।”
আমার কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টরবাবু কহিলেন, “আপনি সরকারী কর্ম্মচারী। আমার নিকট সাহায্যের নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন, সাহায্য প্রার্থনা করিলেই ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় হউক, আমায় সাহায্য প্রদান করিতে হইবে। কিন্তু আপনি এখন বুঝিতে পারিতেছেন না, পরে আপনাকে বলিতে হইবে, কেন আপনি আমার কথা শুনিলেন না?”
আমি। যাহা হউক, মহাশয়! যখন আমি এতদূর আগমন করিয়াছি, তখন আমি বিশেষ করিয়া একবার না দেখিয়া কোনক্রমেই গমন করিতেছি না। ইহাতে যদি সাহায্য দেওয়া আপনার বিবেচনা হয়, দিউন; নচেৎ যাহা ঘটিবার ঘটিবে।
ইনস্পেক্টর। আপনি যখন এরূপভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইতেছেন, তখন আমাকে সাহায্য প্রদান করিতেই হইবে। কিন্তু মহাশয়! আমি নিজেই আপনার সাহায্যার্থ গমন করিব, এবং যেরূপভাবে গমন করিলে মতি দত্ত সহজে আমাদিগকে পরাভূত করিতে পারিবে না, সেইরূপ ভাবে গমন করিব। আপনি আজ এইস্থানে আপেক্ষা করুন, আমি তাহার উপযুক্তরূপ বন্দোবস্তে প্রবৃত্ত হই।
আমি। কি প্রকার বন্দোবস্ত করিতে আপনি মনস্থ করিতেছেন?
ইনস্পেক্টর। চৌকিদার, কনষ্টেবল, দারোগা, জমাদার প্রভৃতি যতদূর সংগ্রহ করিতে পারি, এবং ঈশ্বর না করুন, যদি তাহার সহিত দাঙ্গাই উপস্থিত হয়, তাহা হইলে আমরা তাহার সম্মুখীন থাকিতে পারি, এইরূপ লোকজন সংগ্রহ করিয়া, পুলিসের রীতিমত বস্ত্রাদি পরিধান করিয়া, এবং উপযুক্ত পরিমিত অস্ত্রাদি লইয়া রায়নগরে প্রবেশ করিব। যদি মতি দত্তকে প্রাপ্ত হই তাহা হইলে তাহাকে একেবারে ধৃত করিয়া এইস্থানে আনয়ন করিব। ইহা অপেক্ষা অন্য উত্তম বন্দোবস্ত আর কিছুই হইতে পারে না।
ইনস্পেক্টরবাবুর কথা শুনিয়া আমি কহিলাম, “এরূপভাবে যুদ্ধ আয়োজন করিয়া পল্লীগ্রামের ভিতর প্রবেশ করিলে আমাদিগের মনস্কামনা পূর্ণ হইবার আশা অতি অল্প! কারণ, আমাদিগের দলবল দূর হইতে দেখিতে পাইলেই মতিলাল বুঝিতে পারিবে, তাহাকেই ধৃত করিবার নিমিত্ত আমরা গমন করিতেছি; সুতরাং তাহার বাড়ীতে আমাদিগের উপস্থিত হইবার পূর্ব্বেই সে পলায়ন করিবে। আর যদি পলায়ন করিতেই না পারে, তাহা হইলেও তাহার গৃহে জাল নোট প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য আছে, আমরা উপস্থিত হইতে না হইতেই সে সমস্ত দ্রব্যই বিনষ্ট করিয়া ফেলিবে। তখন তাহাকে ধৃত করিয়া কলিকাতায় লইয়া যাওয়া বা না যাওয়ায় ফল একই হইবে। এরূপ অবস্থায় এরূপ কোন উপায় উদ্ভাবন করুন, যাহাতে মতি দত্তকে অনায়াসে ধৃত করিয়া তৎক্ষণাৎ তাহার গৃহ তল্লাসি করিতে সক্ষম হই।”
আমার কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টরবাবু কহিলেন যে, এরূপ উপায় আমি কিছুই দেখিতে পাই না, বা রীতিমত লোকজন না লইয়া, আমি আপনাকে সাহায্য প্রদান করিতে সমর্থ হইব না।
ইনস্পেক্টরবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া আমার মনে তাঁহার উপর একটু ঘৃণার উদয় হইল। তখন আমি তাঁহাকে কহিলাম, “মতিলালকে চিনিতে পারে, এবং তাহার গ্রামের পথ সকল উত্তমরূপে অবগত আছে, এরূপ যদি কোন কনষ্টেবল আপনার থাকে, তাহা হইলে আমার সাহায্যে তাহাকেই নিযুক্ত করুন। ঈশ্বরানুগ্রহে আমি তাহারই সাহায্য অবলম্বন করিয়া কার্য্য উদ্ধার করিয়া আসিব। কষ্ট স্বীকার করিয়া আপনাকে আমার সহিত গমন করিতে হইবে না।”
আমার কথা শুনিয়া ইনস্পেক্টরবাবু একটু আনন্দিত হইলেন এবং কহিলেন, “এই থানায় নিবারণ নামক একটি কনষ্টেবল আছে; সে মতিকে ও তাহার ঘর বাড়ী পর্যন্ত উত্তমরূপে চিনে। আপনি তাহাকেই সঙ্গে লইয়া যাউন; সে অতিশয় বিশ্বাসী এবং উপযুক্ত কনষ্টেবল। যাহাতে আপনি নিবারণের সাহায্য প্রাপ্ত হয়েন, আমি এখনই তাহার সবিশেষ বন্দোবস্ত করিতেছি। আমি নিজে গিয়া দারোগা বাবুকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিতেছি।”
ইনস্পেক্টরবাবুর কথা শুনিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, “এ সকল আর কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। আমি যে পুলিস-কৰ্ম্মচারী, এবং কলিকাতা হইতে আগমন করিয়াছি, একথা কেবল আপনি জানিলেন। কিন্তু আমার সবিশেষ অনুরোধ যে, একথা আর কাহারও নিকট এমন কি দারোগা বাবুর নিকটও প্রকাশ করিবেন না, বা তাহার নিকটেও গমন করিবেন না, কেবল দারোগা বাবুর নামে এই মৰ্ম্মে একখানি পত্র লিখিয়া দিউন যে, “কোন সরকারী কার্য্যোপলক্ষে এই বাবুটি আপনার নিকট সাহায্যার্থ গমন করিতেছেন, নিবারণ কনষ্টেবলকে ইহার সাহায্যার্থে নিযুক্ত করিবেন।” আমার কথায় ইনস্পেক্টরবাবু সম্মত হইলেন, এবং দারোগা বাবুর নামে পত্র লিখিয়া দিলেন। পত্ৰ লইয়া আমি থানা-অভিমুখে প্রস্থান করিলাম।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ইনস্পেক্টরবাবুর বাসা হইতে পিরোজপুরের তানা বহু দূরবর্তী নহে। আমি আমার আরদালীকে সঙ্গে লইয়া থানা-অভিমুখে গমন করিতে লাগিলাম। পথিমধ্যে আমি আমার আরদালীকে বলিয়া দিলাম যে, এখন হইতে এখানকার পুলিস বা অপর কেহ যেন তোমাকে ও আমাকে পুলিস-কৰ্ম্মচারী বলিয়া জানিতে না পারে। যাহার সহিত কোনরূপ কথা কহিবার প্রয়োজন হইবে, সবিশেষ সতর্কতার সহিত তাহার সঙ্গে কথা কহিবে। যদি কেহ . আমার পরিচয় জানিতে চাহেন, তিনি যে কেহই কেন হউন না, আমার প্রকৃত পরিচয় কখনই তাহার নিকট প্রকাশ করিবে না। সকলের নিকট আমাকে টীকার সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট বলিয়া পরিচয় প্রদান করিও। আরও বলিবে, আমাকে টীকা পরিদর্শন করিয়া নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়; এবং তুমি আমার আরদালীর কার্য্য কর।” আমার কথা শুনিয়া আরদালী আমার মনের ভাব বুঝিতে পারিল, এবং আমার উপদেশ-মত কার্য্য করিতে সম্মত হইল।
ক্রমে আমরা থানায় গিয়া উপবেশন করিলাম। দারোগাবাবু সেই সময় থানাতেই উপস্থিত ছিলেন। তাঁহার হস্তে ইনস্পেক্টরবাবুর পত্রখানি প্রদান করিলে, তিনি আমাকে বসিতে আসন প্রদান করিলেন। আমি বসিলে, দারোগাবাবু ইনস্পেক্টরের পত্রখানি পাঠ করিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি, আপনি কে! এবং কি কার্য্যের নিমিত্ত কোথায় গমন করিবেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “আমি কলিকাতায় টীকা দেওয়ার হেড আফিসে থাকি। সময় সময় নানা জেলার ভিতর আমাকে পরিদর্শন করিয়া বেড়াতে হয়, কোন জেলায় কিরূপভাবে টীকা দেওয়া হইতেছে। সম্প্রতি আপনার জেলায় আগমন করিয়াছি, আমার সহিত একজন কনষ্টেবল প্রদান করুন।”
উত্তরে দারোগাবাবু কহিলেন, “নিবারণ কনষ্টেবলকে আমি আপনার সাহায্যার্থ প্রদান করিতেছি। যে কয়েক দিবস আবশ্যক হয়, আপনি তাহাকে আপনার সঙ্গে রাখিবেন। কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়া গেলে, তাহাকে এইস্থানে ফেরত পাঠাইয়া দিবেন। আপনি কোন সময়ে নিবারণকে চাহেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “এইস্থান হইতে আমি এখনই রওনা হইতে বাসনা করি।” আমার কথা শুনিয়া দারোগাবাবু নিবারণ কনষ্টেবলকে ডাকাইয়া আমার সাহায্যার্থ আমার সহিত গমন করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। নিবারণ একটু অসন্তুষ্ট হইয়া তাহার পোষাক পরিচ্ছদ লইয়া, আমার নিকট উপস্থিত হইল ও কহিল, “চলুন মহাশয়! কোথায় গমন করিতে হইবে।”
দারোগা বাবু নিবারণকে আমার সহিত গমন করিতে আদেশ দিয়া তাঁহার ষ্টেশন ডায়ারীতে লিখিয়া রাখিলেন “কলিকাতা হইতে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় নামক জনৈক টীকার সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট এইস্থানে আসিয়া এই প্রদেশে কিরূপে টীকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা দেখিবার মানসে সাহায্য প্রার্থনা করায়, তাঁহার সাহায্যের নিমিত্ত নিবারণ কনষ্টেবলকে নিযুক্ত করা হইল।”
সরকারী কার্য্যের অনুরোধে সরকারী কাগজপত্রে মিথ্যা কথা লেখাইয়া নিবারণকে সঙ্গে লইয়া, সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। থানা হইতে নদী দূরবর্তী নহে, সেই নদীতীরে গমন করিয়া নাজিরপুরের ফাঁড়ীতে গমন করিবার নিমিত্ত একখানি নৌকা ভাড়া করিলাম, ও আমাদিগের তিনজনের উপযুক্ত কিছু আহারীয় দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া লইয়া, নৌকায় আরোহণ পূর্ব্বক সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। মাঝি সেই প্রদেশীয় প্রবল তরঙ্গ পরিপূর্ণ নদী। সকলের মধ্য দিয়া গমন করিতে লাগিল।
নিবারণ কনষ্টেবল যদিও তাহার ঊর্দ্ধতন-কৰ্ম্মচারী কর্তৃক আদিষ্ট হইয়া আমার সাহায্যার্থ আমার সমভিব্যাহারে গমন করিতেছিল, তথাপি সে যে আমার সহিত বিশেষ সম্মান সহকারে ব্যবহার করিয়াছিল, তাহা আমি বলিতে পারি না। ইহাতে আমি নিবারণের উপর কিছুমাত্র দোষারোপ করিতে পারি না। কারণ, পুলিস কনষ্টেবলগণ টীকাদার ব্রাহ্মণের সহিত সর্ব্বদা যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকে, এও আমার সহিত সেইরূপ ব্যবহার করিয়াছিল মাত্র।
নদীবক্ষে আমরা সেইদিবস অতিবাহিত করিলাম। সমস্ত রাত্রিও অতিবাহিত হইয়া গেল। মাঝি পারিতোষিকের প্রত্যাশায় প্রাণপণে সমস্ত রাত্রি নৌকা বাহিতে লাগিল। পরদিবস প্রাতঃকালেই আমাদিগের নৌকা নাজিরপুর থানায় নিম্নে গিয়া উপস্থিত হইল। আমরা সকলে নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া ফাঁড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। ফাঁড়ীর দারোগা ফাঁড়ীতেই উপস্থিত ছিলেন, নিবারণকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “কিহে নিবারণ! হঠাৎ কি মনে করিয়া?” উত্তরে নিবারণ কহিল, “এই টীকাদারবাবুর সাহায্যের নিমিত্ত এই স্থানে আসিয়াছি।”
নিবারণের কথা শ্রবণ করিয়া, দারোগা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কি এখন এই জেলায় টীকা পরিদর্শনকার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছেন?”
আমি। না মহাশয়! আমি এই জেলার কর্মচারী নহি। আমি কলিকাতায় থাকি।
দারোগা। আপনি যদি এই প্রদেশীয় কৰ্ম্মচারী নহেন, তবে এই জেলার কার্য্যের নিমিত্ত এখানে আসিয়াছেন কেন?
আমি। উপরিতন কর্মচারীর আদেশ! কাগজপত্রে প্রকাশ যে, এ বৎসর এ জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে টীকা দেওয়া হয় নাই। কেন এরূপ হইল, তাহারই অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাকে এই প্রদেশে আসিতে হইয়াছে।
দারোগা। এই জেলার ভিতরস্থিত অপর কোনস্থান আপনার দেখা হইয়াছে, না প্রথমেই আপনি এখানে আগমন করিয়াছেন?
আমি। আপনার এখানেই আমার প্রথম আগমন।
দারোগা। আমার নিকট হইতে আপনার কোনরূপ সাহায্যের যদি প্রয়োজন হয়, বলুন—আমার যতদূর সাধ্য, তাহা করিতে আমি প্রস্তুত আছি।
আমি। আপনার সমস্ত এলাকার মধ্যে এ বৎসর কয়জন কর্ম্মচারী টীকা দেওয়ার নিমিত্ত নিযুক্ত আছেন? দারোগা। তিনজন কর্ম্মচারী বরাবরই নিযুক্ত ছিলেন; কিন্তু রায়নগরের একজন কর্মচারী, কয়েকমাস হইল, মরিয়া গিয়াছেন। তাঁহার স্থানে অপর কোন লোক সরকার হইতে নিযুক্ত হন নাই। অপর দুইজন আপন-আপন কৰ্ম্ম করিতেছেন?
আমি। যে কর্ম্মচারীর মৃত্যু হইয়াছে, তাহার এলাকার ভিতর এ বৎসর আদৌ টীকা দেওয়া হয় নাই?
দারোগা। টীকা দিতে বাকি নাই। তিনি যাঁহার বাড়ীতে থাকিয়া টীকা দিতেন, কি প্রকারে টীকা দিতে হয়, তাহা তিনি উত্তমরূপে শিখিয়াছিলেন। কর্ম্মচারীর মৃত্যু হইলে, আমাদিগের সরকারী কার্য্য বন্ধ থাকে না; গবর্ণমেণ্ট হইতে নিযুক্ত না হওয়াতে এ বৎসর তিনিই টীকা দিয়াছেন।
আমি। মৃতব্যক্তির স্থানে যিনি এখন কার্য্য করিতেছেন, তাঁহার নাম কি—এবং নিবাস কোথায়?
দারোগা। তাঁহার বাসস্থান রায়নগর গ্রামে। নাম—মতিলাল দত্ত।
আমি। মতিবাবুর বাড়ী চিনে, আপনার এমন কোন লোক আছে কি?
দারোগা। তা’ আছে বৈকি? কিন্তু অপর লোকের আর প্রয়োজন কি, আপনার সঙ্গে যে কনষ্টেবল আসিয়াছে, সে তাঁহাকে ও তাঁহার বাড়ী উত্তমরূপে চিনে।
নিবারণ সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, দারোগাবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া সে কহিল, “আমারই দ্বারা আপনার সকল কাৰ্য্য সমাপন হইবে। অপর লোকের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।”
আমি। দেখুন দারোগাবাবু! মতি দত্তের বাড়ীতে নিবারণের সাহায্যে যখন গমন করিতে পারিব, তখন ইহার নিমিত্ত আপনাকে আর অপর লোক দিতে হইবে না। কিন্তু যদি আপনি আমার আর একটু কার্য্য করেন, তাহা হইলে আমি বিশেষ বাধিত হইব, এবং সরকারী কার্য্যেরও অনেক সুবিধা হইবে। আমি এখনই মতি দত্তের গ্রামে গমন করিতেছি, তাহার কার্য্য সকল পরিদর্শন করিয়া দিবা দশটা এগারটার মধ্যেই প্রত্যাগমন করিতে পারিব। ইহার মধ্যে যদি আপনি কোন লোক দ্বারা অপর দুইজন টীকাদারকে এইস্থানে ডাকাইয়া আনিতে পারেন, তাহা হইলে যেমন আমি প্রত্যাগমন করিব, আহারাদি করিয়া অমনি তাঁহাদিগকে সঙ্গে লইয়া, যতদূর সম্ভব—তাঁহাদিগের কার্য্য সকলও দেখিয়া লইব। ইহাতে কাৰ্য্য অনেক সুগম্য হইয়া পড়িবে।
আমার আন্তরিক ইচ্ছা যে কি? তাহা দারোগাবাবু কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া, আমার প্রার্থনায় সম্মত হইলেন, এবং সেই দুইজন কর্মচারীর উদ্দেশে তখনই দুইজন কর্ম্মচারী পাঠাইয়া দিলেন। আমি, আমার আরদালী ও নিবারণ তিনজনেই মতি দত্তের উদ্দেশে তাঁহার গ্রামাভিমুখে গমন করিবার নিমিত্ত নৌকায় আরোহণ করিলাম। সেইস্থান হইতে রায়নগর বহুদূরবর্তী স্থান নহে; প্রায় দুই ঘণ্টার মধ্যেই আমাদিগের নৌকা রায়নগর গ্রামের নিম্নে উপস্থিত হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আমরা তিনজনেই নৌকা হইতে অবতরণ করিয়া, রায়নগর গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। নিবারণ আমাদিগের অগ্রে অগ্রে যাইতে লাগিল। নিবারণের গতি দেখিয়া মনে মনে ভাবিলাম যে, আমার রায়নগরে আগমন করিবার প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি নিবারণ জানিতে পারিত, তাহা হইলে সে এইরূপ লম্বা লম্বা পাদনিক্ষেপে সেই গ্রামের ভিতর প্রবেশ করিত, কি না?
নিবারণের গতি দেখিয়া মনে মনে যদিও এই প্রকার চিন্তার উদয় হইল, তথাপি নিজের মনের ভিতর যেন কেমন একরূপ ভয়ের সঞ্চার হইল। ভাবিলাম, ইনস্পেক্টরবাবুর কথা অবহেলা করিয়া যেরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি না জানি, ভবিষ্যতে তাহার কি ফল ফলিবে? মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু মনের ভাব উত্তমরূপে গোপন করিয়া নিবারণের অনুবর্তী হইয়া চলিতে লাগিলাম।
ক্রমে নিবারণ একটি বাড়ীতে গিয়া উপনীত হইল। সেইস্থানে একটি যুবক বসিয়াছিল, নিবারণকে দেখিয়া সে কহিল, “কি হে নিবারণ! এমন সময় কোথা হইতে তোমাদিগের আগমন?”
উত্তরে নিবারণ কহিল, “যাঁহার জন্য এখানে আগমন তাঁহারই নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। ইনি আপনাদিগের সুপারিন্টেণ্ডেন্ট। আপনাদিগের কার্য্য পরিদর্শন করিবার নিমিত্ত ইনি কলিকাতা হইতে আগমন করিয়াছেন।” এই বলিয়া আমাকে কহিল, “মহাশয়! ইনিই মতিলাল দত্ত।”
নিবারণের এই কথা শ্রবণ করিয়া মতিলাল আমাকে বসিতে আসন প্রদান করিল ও পরিশেষে কহিল, “মহাশয়! আমি সরকার হইতে এই কার্য্যে এখনও নিয়োজিত হই নাই। কিন্তু লোকাভাবে সরকারী কার্য্যের ক্ষতি হয় বলিয়া, আমি কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি।”
আমি। ভালই করিয়াছ। যাহাতে তুমি এই কার্য্যে নিযুক্ত হও, আমি তাহার সবিশেষ চেষ্টা করিব। কিন্তু এবার কি আদৌ টীকা দেওয়া হয় নাই?
মতি। কেন হইবে না মহাশয়! অন্যান্য বৎসর অপেক্ষা এবার আমি অধিক লোককে টীকা দিয়াছি।
আমি। যদি টীকা দেওয়া হইয়াছে, তবে রিটরণ যায় নাই কেন? নিয়মিতরূপে রিটরণ প্রেরিত হইলে, আমাকে এই কষ্ট ভোগ করিতে হইত না। কোন কোন গ্রামে কত লোকের টীকা দিয়াছ, তুমি তাহার কোনরূপ হিসাব রাখিয়াছ কি?
মতি। হাঁ মহাশয়! আমি তাহার দস্তুর মত হিসাব রাখিয়াছি।
এই বলিয়া মতি সেইস্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, তাহার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল, ও কয়েকখানি খাতাপত্র আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিয়া কহিল, “দেখুন মহাশয়! আমি যাহা বলিলাম, তাহা সত্য, কি মিথ্যা?”
সেইস্থানে বসিয়া কিয়ৎক্ষণ বিশেষ মনোযোগের সহিত আমি সেই খাতাখানি দেখিলাম, এবং মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, স্থলপথে নাজিরপুরের ফাঁড়ীতে গমন করিতে হইলে, কোন কোন গ্রামের মধ্যে বা নিকট দিয়া গমন করিতে হয়। পরিশেষে আমি মতিকে কহিলাম, “তোমার খাতা দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম; কিন্তু ইচ্ছা—গ্রামে গিয়া কিরূপভাবে টীকা উতরাইয়াছে, তাহা একবার দেখিয়া আসি।”
মতি। সে উত্তম কথা, এখনই যাইতে চাহেন, ঢলুন। আমি এক এক করিয়া সমস্ত গ্রাম আপনাকে দেখাইয়া দিব।
আমি। সমস্ত গ্রাম যে একদিবসেই দেখিয়া উঠিতে পারিব, তাহা বোধ করি না। তবে চল; অধিক বেলা না হইতে হইতে যে কয়েকখানি গ্রাম দেখিতে পারি, দেখিয়া লই।
দেখিলাম, আমার কথায় মতিলাল সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিল। তখনই একখানি চাদর স্কন্ধে ও খাতাগুলি বগলে করিয়া বাড়ী হইতে বহির্গত হইল। আমরাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলাম।
প্রথমে সেই রায়নগর গ্রামের অপর পাড়ায় আমাদিগকে লইয়া গিয়া একস্থানে বসিতে কহিল, ও নিজের পাড়ার ভিতর গমন করিয়া প্রায় পনরটি বালক-বালিকা সমভিব্যাহারে সেইস্থানে প্রত্যাগমন করিল। কিরূপভাবে উহাদিগের টীকা উঠিয়াছে, এক এক করিয়া তাহা দেখিলাম, এবং যে যেরূপ জিজ্ঞাসা করিল, তাহাদিগের প্রত্যেককেই সেইরূপভাবে ব্যবস্থা প্রদান করিলাম। কাহারও উপর ব্যবস্থা হইল, টীকার উপর জল প্রদান; কাহারও চন্দনের প্রলেপ; কাহারও নাভি দেখিয়া দুই এক দিবসের নিমিত্ত উপবাস ব্যবস্থা করিলাম; কাহারও বা পথ্যের বন্দোবস্ত করিয়া দিলাম। এইরূপ ভাবে সেই গ্রাম হইতে অপর গ্রামে, অন্য গ্রাম হইতে অপর আর এক গ্রামে ভ্রমণ করিয়া, ক্রমে মতি দত্তের কার্য্য সকল দেখিতে লাগিলাম, এবং বিশেষ উপযুক্ত কর্ম্মচারী বলিয়া তাহাকে বার বার প্রশংসা করিতে লাগিলাম।
মতি দত্তকে সঙ্গে লইয়া এইরূপ নানা গ্রাম পরিদর্শন করিতে লাগিলাম সত্য; কিন্তু আমার লক্ষ্য রহিল—নাজিরপুরের ফাঁড়ীর উপর। এইরূপে গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া ফাঁড়ী অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। দিবা প্রায় একটার সময় আমরা যে গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই গ্রাম ফাড়ীর অতি নিকটবর্তী; কেবল একটি নদীর ব্যবধানমাত্র।
এইস্থানে আমি মতিলালকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “মতিবাবু! আমার আর চলিবার ক্ষমতা নাই। ক্ষুধায় ও তৃষ্ণায় শরীর অবসন্ন হইয়া পড়িতেছে। স্নান আহ্নিক করিয়া একটু জল পান না করিয়া, আমি আর কোন কাৰ্য্যই করিতে সমর্থ হইব না। এখানে যদি গবর্ণমেন্টের কোন আফিস, স্কুল বা ডাকঘর প্রভৃতি কোনস্থান নিকটে থাকে, তাহা হইলে সেইস্থানে চল। কারণ, আমি সরকারী কার্য্যোপলক্ষে বাহির হইলে, কোন অধিবাসীর বাড়ীতে আমি উপবেশন করি না।
মতিলাল আমার কথাই বুঝিল। পূৰ্ব্বে যে আমি জানিয়া আসিয়াছিলাম, ডাকঘর ও স্কুল নাজিরপুর ফাড়ীর সন্নিকট, তাহা মতিলাল জানিত না। আমার কথা শ্রবণ করিয়া একটু ভাবিল ও পরিশেষে কহিল, “সরকারী কোনস্থানই নদীর এপারে নাই, সমস্তই ওপারে। একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া যদি ওপারে যাইতে পারেন, তাহা হইলে আপনার পক্ষে বিশেষ সুবিধা হইবার সম্ভাবনা। কারণ, স্কুল, ডাকঘর, থানা ওপারেই আছে। যদি আপনি ওপারে যাইতে পারেন, তাহা হইলে থানাতেই উপবেশন করিলে আপনার পক্ষে সুবিধা। কারণ, থানার দারোগাবাবু অতিশয় ভদ্রলোক।”
মতির কথা শুনিয়া আমি অন্তরে একটু হাসিলাম ও ওপারে গমন করার পক্ষে নিতান্ত অনিচ্ছা দেখাইয়া পরিশেষে কহিলাম, “তোমার বিবেচনায় ওপারে গমন করিলে, যদি একটু কষ্ট হইলে, সুবিধা হয়, তাহা হইলে, আর কি করিব? চল দেখি, পার হইবার উপযোগী কোন নৌকা এইস্থানে পাওয়া যাইতে পারে, কি না?”
এই বলিয়া আমরা নদীতীরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, সেইস্থানে একখানি নৌকাও রহিয়াছে। আমাদিগকে অপর পারে পৌঁছিয়া দিতে নৌকার মাঝি প্রথমে অসম্মত হইল; পরিশেষে একটি মুদ্রার প্রলোভন দেখাইলে, সে সন্তুষ্টমনে আমাদিগকে অপর পারে পৌঁছিয়া দিল! নৌকা হইতে উঠিয়া আমরা সকলে ফাঁড়ীর ভিতর গিয়া উপবেশন করিলাম। মতিলালও আপন ইচ্ছায় আমাদিগের নিকট গিয়া উপবেশন করিল। বলা বাহুল্য, যে নৌকায় আমরা রায়নগরে গমন করিয়াছিলাম, সে নৌকা সেইস্থানেই রহিয়া গেল।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ফাঁড়ীর সম্মুখে নদীর উপরেই একটি প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষ আছে। যখন আমরা সেইস্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় দারোগাবাবু সেই আম্রবৃক্ষতলে বসিয়া স্নান করিতেছিলেন। সুতরাং তাঁহার অপেক্ষায় কিছুক্ষণের নিমিত্ত দাঁড়াইয়া ফাঁড়ীর ভিতর গিয়া উপবেশন করিলাম। কিন্তু যখন দেখিলাম, স্নান করিতে তাঁহার অতিশয় বিলম্ব হইতেছে, তখন আমি একাকী তাঁহার নিকট গমন করিলাম; তখনও তিনি স্নান করিতেছিলেন। একট চৌকিদার নদী হইতে জল আনিয়া দিতেছিল। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি তাঁহাকে কহিলাম, “এমন স্রোতস্বিনী নিকটে থাকিতে আপনি ডাঙ্গায় বসিয়া স্নান করিতেছেন কেন?” উত্তরে তিনি কহিলেন, “আপনি কি এ প্রদেশে কখনও আইসেন নাই? এ প্রদেশীয় নদীর অবস্থা কি আপনি কিছুমাত্র অবগত নহেন? এ দেশের নদীমাত্রই কুম্ভীরে পরিপূর্ণ। স্নান করিবার নিমিত্ত উহার গর্ভে অবতরণ করিলে, আর তাহাকে ফিরিতে হয় না।”
দারোগাবাবুর কথা শুনিয়া আমারও একটু জ্ঞানোপার্জ্জন হইল। ভাবিলাম, এই অবস্থা জানিতে না পারিলে আমিও হয় ত স্নান করিবার সময় নদীগর্ভে অবতরণ করিতাম। এইরূপ ভাবিয়া পরিশেষে আমি দারোগাবাবুকে কহিলাম, “আপনার স্নান সম্পূর্ণ হইতে আর কত বিলম্ব আছে?” উত্তরে তিনি কহিলেন, “আর অধিক বিলম্ব নাই। কেন? আপনার কোন প্রয়োজন আছে কি?”
আমি। বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে, আপনাকে একথা জিজ্ঞাসা করিতেছি কেন?
দারোগাবাবু। কি প্রয়োজন আপনি বলুন না কেন, আমরা সাধ্যমত তৎ-সম্পাদনের চেষ্টা করিব।
আমি। আমি আপনাকে পূর্ব্বে আমার যে পরিচয় দিয়াছি, তাহা আমার প্রকৃত পরিচয় নহে। টীকা বিভাগীয় কর্ম্মের সহিত আমার কোনরূপ সংস্রব নাই। আমি কলিকাতা ডিটেকটিভ পুলিসের একজন সামান্য কর্ম্মচারী। আপনার এলাকাবাসী মতিলাল দত্ত অনেক গবর্ণমেন্ট করেন্সি নোট জাল করিয়াছে বলিয়া অভিযুক্ত হওয়ায়, তাহাকে ধরিবার নিমিত্ত আমিই নিযুক্ত হইয়া এইস্থানে উপস্থিত হইয়াছি, ও যতদূর সম্ভব আমার কার্য্যও শেষ করিয়াছি। এ প্রদেশীয় সমস্ত লোকের অজ্ঞাতসারে আমি মতি দত্তকে ধৃত পূর্ব্বক সঙ্গে করিয়া আপনার থানার ভিতর পর্যন্ত আনয়ন করিয়াছি, এবং আপনার আফিসের ভিতরেই তাহাকে বসাইয়া রাখিয়াছি। এখন আমি উহাকে আপনার হস্তে অর্পণ করিলাম। যেরূপ বিবেচনা করেন, এখন আপনি উহাকে সেইরূপেই আবদ্ধ করুন। আমার কার্য্য আমি করিয়াছি, এখন আপনার কার্য্য আপনি করুন। এখন যদি সে পলায়ন করে, তাহা হইলে আপনি তাহার জন্য দায়ী।
আমার কথা শ্রবণ করিয়া দারোগাবাবুর মুখ হইতে কিয়ৎক্ষণ কোন কথাই বাহির হইল না, কিয়ৎক্ষণ স্থিরভাবে থাকিয়া পরিশেষে নিতান্ত চিন্তিতান্তঃকরণে তিনি কহিলেন, “আপনি দেখিতেছি, আমাকে বিশেষ বিপাকেই ফেলিলেন। মতিলাল দত্তকে আমি কিরূপে আবদ্ধ করিয়া রাখি। তাহার দলের লোকজন যদি জানিতে পারে যে, মতি দত্ত আমার এখানে আবদ্ধ অবস্থায় আছে, তাহা হইলে উহারা থানার ঘরে অগ্নি প্রদান করিয়া, উহাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাইবে। যাহা হউক, যখন আপনি উহাকে থানার ভিতর আনয়ন করিয়াছেন, ও আমার হস্তে অর্পণ করিতেছেন, তখন যেমন করিয়াই পারি, উহাকে আবদ্ধ করিতেই হইবে। ইহার পরে যাহা ঘটিবার ঘটিবে, তাহা আর এখন ভাবিয়া কি করিব?” এই বলিয়াই তিনি তাঁহার স্নান সেই অবস্থাতেই বন্ধ করিলেন, এবং শীঘ্র শীঘ্র পরিধেয় আর্দ্র বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া, কনষ্টেবল প্রভৃতি যাহারা সেইস্থানে উপস্থিত ছিল, তাহাদের সকলকেই ডাকিলেন। দারোগা—বাবুর নিকট তাহারা আগমন করিলে, তিনি চুপি চুপি সকলকে কি বলিয়া দিলেন। তাঁহার কথা শুনিবামাত্র একজন কনেষ্টবল কোথা হইতে এক জোড়া হাতকড়ি ও একটি শিকল আনিয়া উপস্থিত করিল। যে গৃহে মতি দত্ত বসিয়াছিল, সেই গৃহের যতগুলি দ্বার আছে, সেই সকল দ্বার দিয়া সকলে একেবারে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিল। আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলাম। সকলে মতি দত্তকে ঘিরিল ও সহজেই তাহাকে ধরিয়া ফেলিল। মতি একে নিরস্ত্র, তাহাতে সে যে পুলিস কর্তৃক ধৃত হইবে, সে সন্দেহ তাহার মনে কিছুমাত্র ছিল না; অগত্যা সে পুলিসের হাতে বন্দী হইল। তাহার হাতে হাতকড়ি পড়িল, এবং কোমরে সেই শিকল দিয়া অফিসের মধ্যস্থিত লোহার সিন্দুকের সহিত সে আবদ্ধ হইল। এই সময়ে মতি দত্তের যে কিরূপ ক্রোধের উদয় হইল, তাহা তাহার আকার দেখিয়াই অনুমিত হইতে লাগিল। সে কাহাকেও কিছু না বলিয়া হঠাৎ পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের ন্যায় কেবল গৰ্জ্জন করিতে লাগিল।
সেই সময় মতি আমাকে সেইস্থানে দেখিতে পাইয়া কহিল, “প্রবঞ্চক! তুমি প্রবঞ্চনা করিয়া আমার এই দশা করিলি? এখন আর তোকে কি বলিব? যদি আমি পূর্ব্বে জানিতে পারিতাম, –তুই পুলিস কর্মচারী হইয়া আমাকে ধৃত করিবার অভিপ্রায়ে আগমন করিয়াছিস, তাহা হইলে দেখিতাম—কেমন করিয়া আমার হস্ত হইতে তুই তোর মস্তক এখানে ফিরাইয়া আনিতিস্।”
মতির কথায় কোনরূপ উত্তর না দিয়া, আমি সেইস্থান হইতে বাহিরে আসিলাম। দারোগাবাবু উহাকে এইরূপে আবদ্ধ করিয়া উহার উপর চারিজন প্রহরীকে পাহারা দিতে নিযুক্ত করিলেন।
এই সময় আমি দারোগাবাবুকে কহিলাম, “মহাশয়! মতিলাল ধৃত হওয়ায় আমার কার্য্য অতি অল্পই সম্পন্ন হইয়াছে; কিন্তু যাহা প্রধান কাৰ্য্য, তাহা এখনও বাকি আছে। এখন এই মতিলালকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাড়ীতে গমন করিতে হইবে, এবং প্রকাশ্যরূপে তাহার খানা-তল্লাসি করাও আবশ্যক হইবে। যেরূপ বন্দোবস্ত করিলে এই সকল কার্য্য বিনাক্লেশে সম্পন্ন হইতে পারে, এখন আপনি তাহার বন্দোবস্ত করুন।” দারোগাবাবু আমার এই কথা শ্রবণ করিয়া আরও চিন্তিত হইলেন। পরিশেষে উভয়ে পরামর্শ করিয়া এই সাব্যস্ত হইল যে, কনষ্টেবল, চৌকিদার প্রভৃতি যতদূর সম্ভব সংগ্রহ করিয়া দস্তুরমত পুলিসের সকলে মিলিয়া উহার গ্রামে গমন করিয়া, উহার খানা—তল্লাসি করিতে হইবে। অধিক লোককে পুলিসের সাজে সজ্জিত দেখিলে, মতিলালের দলস্থিত কোন লোক সহজে আমাদিগের নিকট আসিতে সমর্থ হইবে না।
সেইদিবস দিবা একটার পর সেই থানার এলাকাস্থিত চৌকিদারদিগের হাজিরা দিবার দিন ছিল। ইহাতে আমাদিগের যে কিরূপ সুবিধা হইল তাহা বলিতে পারি না। কারণ, হাজিরা দিবার নিমিত্ত ক্রমে ক্রমে প্রায় তিনশত চৌকিদার সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ইহা ব্যতীত থানার কনষ্টেবল, রাইটার কনষ্টেবল, হেডকনষ্টেবল এবং দারোগা প্রভৃতি যাঁহারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁহারা সকলেই আপন আপন সাজে সজ্জিত হইলেন। তখন সকলে একত্র হইয়া মতি দত্তকে বন্ধনাবস্থায় সঙ্গে লইয়া রায়নগর গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলাম। মতি যে ধৃত হইয়াছে, এ সংবাদ গ্রামের লোক বা মতির বাড়ীর লোক কেহই ইহার পূর্ব্বে প্রাপ্ত হন নাই। আমরা গিয়া একেবারে মতি দত্তের বাড়ী ঘিরিয়া ফেলিলাম, এবং গ্রামস্থ দুই চারিজন ভদ্রলোকের সম্মুখে মতি দত্তের গৃহ-তল্লাসি আরম্ভ করিলাম। যে গৃহে মতি শয়ন করিত, সেই গৃহস্থিত একটা বাক্সের ভিতর হইতে কতকগুলি জাল নোট বাহির হইল; পূর্ব্বে যে নোট পাওয়া গিয়াছিল, ইহাও সেই প্রকারের ও একই নম্বরের নোট। নোট পাইবার কিয়ৎক্ষণ পরেই অপর আর একটি বাক্সের ভিতর হইতে নোট তৈয়ার করিতে যে সমস্ত যন্ত্রের আবশ্যক হয়, তাহার সমস্তই পাওয়া গেল। নোটের উপর যে যে প্রকারের কালীর আবশ্যক হয়, সেইরূপ রঙ্গের কালী এবং নোটের উপযুক্ত সাদা কাগজ অনেক বাহির হইল। সেই সকল দ্রব্যাদি সংগ্রহ করিয়া লইয়া সেইস্থানে আর কালবিলম্ব করিলাম না। দিন থাকিতে থাকিতেই পুনরায় নাজিরপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম।
যে জিজ্ঞাসা করিল, তাহাকেই কহিলাম, ‘মতি দত্তও আমরা সকলে নাজিরপুরের থানাতেই অদ্য রাত্রি অতিবাহিত করিব, এবং কল্য প্রাতঃকালে উহাকে নৌকা করিয়া একেবারে বরিশালে লইয়া যাইব।” এই কথা, সকলের নিকট বলিলাম সত্য; কিন্তু ঠিক তাহার বিপরীত করিলাম। কারণ, মনে মনে ভয় হইল—রাত্রিকালে মতির দলবল আসিয়া যদি থানাতেই আমাদিগকে আক্রমণ করে, তাহা হইলে আমাদিগের উপায় কি হইবে?
এই কথা প্রচার করিয়া দিয়া যেমন আমরা নাজিরপুর থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, অমনি আমার নৌকা ব্যতীত অপর আর একখানি নৌকা, উপযুক্তরূপ অস্ত্র শস্ত্র এবং আটজন প্রহরী লইয়া বরিশালে গমন করিব বলিয়া, সেইস্থান পরিত্যাগ করিলাম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বরিশালে না গিয়া, পুনরায় পিরোজপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম।—যেরূপ ভয় করিয়াছিলাম, পথে সে প্রকার কোনরূপ প্রতিবন্ধক প্রাপ্ত না হইয়া আমরা পিরোজপুরের থানায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। কিন্তু পরে শুনিলাম, মতি দত্তের কয়েকজন অনুচর আমাদিগের অনুসন্ধানের নিমিত্ত বরিশালে গিয়া উপস্থিত হয়, কিন্তু সেইস্থানে আমাদিগের কোন সন্ধান প্রাপ্ত হয় নাই।
পিরোজপুরের থানার দারোগাবাবু মতি দত্তকে বন্ধনাবস্থায় দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন। তখনই তাহাকে ফাটকের ভিতর বন্ধ করিয়া দিলেন। কেবল বন্ধ নহে, সেই ফাটকের ভিতর একটি লোহার সিন্ধুক ছিল, তাহারই সহিত মতিকে আবদ্ধ করিলেন। তদ্ব্যতীত ফাটকের ভিতর চারিজন, ও ফাটকের বাহিরে চারিজনের পাহারা পড়িল।
সংবাদ পাইয়া ইনস্পেক্টরবাবুও সেইস্থানে উপস্থিত হইলেন। কিরূপে আমি মতিকে ধৃত করিলাম, তাহা শ্রবণ করিয়া তিনি আমাকে ধন্যবাদ প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু এরূপ দুঃসাহসিক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা যে নিতান্ত অন্যায়, তাহাও আমাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন।
মতি দত্ত ধৃত হইয়াছে, এই কথা ক্ৰমে চতুৰ্দ্দিকে প্রচারিত হইয়া পড়িল। মতিকে দেখিবার নিমিত্ত গ্রামের প্রায় সকল লোক চতুৰ্দ্দিক্ হইতে আসিয়া থানায় উপস্থিত হইল। স্কুল হইতে একে একে সমস্ত বালকগণ পলায়ন করিয়া মতিকে দেখিবার প্রত্যাশায় থানায় আগমন করিল; শিক্ষকগণ ছাত্রদিগের অনুপস্থিতিতে অনন্যোপায় হইয়া স্কুল বন্ধ করিয়া দিলেন, এবং তাঁহারাও মতিকে দেখিবার নিমিত্ত থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন; বিচারালয় প্রভৃতি স্থানে এই সংবাদ পৌঁছিবামাত্র বাদী, প্রতিবাদী, সাক্ষী, দর্শক, উকীল, মোক্তার প্রভৃতি যিনি যেদিক্ দিয়া সুবিধা পাইলেন, তিনি সেইদিক্ দিয়া থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। থানার ভিতরে সমস্ত লোকের সঙ্কুলান না হওয়ায়, তাহার চতুষ্পার্শ্বের ময়দান সকল পূর্ণ হইয়া গেল।
হাকিমগণ মোকদ্দমা করিবেন কি, কাছারির ভিত কোন লোককে এমন কি আপন আপন চাপরাসীগণকে পৰ্য্যন্ত না পাইয়া, তাঁহারাও থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এক মতি দত্তকে আবদ্ধ অবস্থায় দেখিবার নিমিত্ত সেই থানার ভিতর যেরূপ দৃশ্যের আবির্ভাব হইল, সেরূপ দৃশ্য আমার ভাগ্যে আর কখনও ঘটে নাই, এবং আরও যে কখন ঘটিবে—তাহাও বোধ হয় না।
মাজিষ্ট্রেট সাহেবকে থানার ভিতরেই পাইয়া তাঁহাকে কহিলাম, “আমার কর্তব্য কৰ্ম্ম—এই ধৃত আসামীকে অদ্য আপনার সম্মুখে উপস্থিত করা। আমিও তাহার বন্দোবস্ত করিতেছিলাম, কিন্তু যখন আপনি স্বয়ং আসিয়া এইস্থানে উপস্থিত হইলেন, তখন আমি ইহাকে কাহার নিকট লইয়া যাইব?”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেব কহিলেন, “যখন আমি নিজচক্ষে উহাকে দেখিলাম, তখন আর আমার নিকট লইয়া যাওয়ার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। আমি তোমাকে আদেশ প্রদান করিতেছি, আমার এলাকা হইতে তুমি অনায়াসে ইহাকে কলিকাতায় লইয়া যাইতে পার।”
সেই সময় একজন বৰ্দ্ধিষ্ণু উকীল আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কবে এইস্থান পরিত্যাগ করিতে চাহেন?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “ সুযোগ পাইলে অদ্যই আমি এইস্থান হইতে প্রস্থান করিব।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া সেই উকীল ও অপর আরও কয়েকজন মিলিত হইয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেবকে কহিলেন, “মতি দত্তকে বন্ধনাবস্থায় দেখিবার নিমিত্ত সকলেরই ইচ্ছা। তাহার দৃষ্টান্ত আপনি স্বচক্ষে দেখিতে পাইতেছেন। এই নিমিত্ত আপনার নিকট আমাদিগের সকলের এই নিবেদন যে, মতি দত্তকে অভাবপক্ষে সাত দিবসকাল এইস্থানে রাখিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে সকলের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। সকলেই আসিয়া ইহাকে দেখিয়া যাইতে পারিবে।”
উকীলদিগের কথা শ্রবণ করিয়া মাজিষ্ট্রেট সাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ইহাতে তোমার অভিমত কি?”
উত্তরে আমি কহিলাম, “আপনি আমাকে যেরূপ আদেশ দিবেন, আমি তাহাই প্রতিপালন করিব। তবে আমার বক্তব্যের ভিতর কেবল এই আছে যে, যদি মতিলালকে এইস্থানে রাখিতে চাহেন, তাহা হইলে অনুগ্রহ পূৰ্ব্বক এই আদেশ প্রদান করিবেন যে, যেন আমার জিম্মায় না থাকে। কারণ, ইহার মধ্যে যদি কোনরূপ ভাল মন্দ ঘটে, তাহার নিমিত্ত যেন আমাকে দায়ী হইতে না হয়।”
আমার কথা শ্রবণ করিয়া ম্যাজিষ্ট্রেট কহিলেন, “যখন সকলেরই ইচ্ছা—মতি এখানে দিনকয়েক থাক্, তখন আমি চারিদিবসের নিমিত্ত উহাকে এইস্থানে রাখিবার আদেশ দিলাম।” এই বলিয়া একখানি কাগজে হুকুম লিখিয়া আমার হস্তে অর্পণ করিলেন।
সেই সময়ে পিরোজপুর থানার দারোগাবাবু কহিলেন, “মহাশয়! এই চারিদিবস মতি যাহাতে জেলের ভিতর থাকিতে পারে, তাহার আদেশ প্রদান করুন। কারণ, উহার উপর উপযুক্ত পাহারা দিতে পারে, এমত লোক আমার নাই!”
দারোগাবাবুর কথা শ্রবণ করিয়া উকীলবাবু কহিলেন, “না মহাশয়। তাহা হইতে পারে না। মতি যদি জেলের ভিতরই আবদ্ধ থাকিবে, তাহা হইলে ইহাকে রাখিবার প্রয়োজনই বা কি? সকলে যাহাতে উহাকে দেখিয়া যাইতে পারে, এরূপ স্থানে রাখিতে হইলে—থানায় রাখাই কর্তব্য।”
এই প্রকার কথাবার্তার পর, পরিশেষে মতিকে থানায় দারোগাবাবুর জিম্মায় রাখাই সাব্যস্ত হইল, এবং আবশ্যক হইলে অন্য স্থান হইতে চৌকিদার ও কনষ্টেবল আনাইয়া উহার পাহারার বন্দোবস্ত করিবেন, তাহাও সাব্যস্ত হইল।
এই বন্দোবস্ত হইবার পর ক্রমে হাকিমগণ সকলে চলিয়া গেলেন। দারোগাবাবু উকীলদিগকে সহস্ৰ গালি দিয়া, উহার পাহারার বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন।
সেই রাত্রি এইরূপেই অতিবাহিত হইয়া গেল। পরদিবস অতি প্রত্যূষে সেই স্থানের সব রেজিষ্ট্রার আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি মতি দত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিরূপে তাঁহার অফিসের বই ও একখানি দলিল পরিবর্তিত হইল। এখন বোধ হয় এ কথা বলিতে আপনার কোন আপত্তি নাই?”
উত্তরে মতি যাহা কহিল, তাহা শ্রবণ করিয়া তিনি অতিশয় আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। মতি কহিল, “অর্থে না হইতে পারে কি? অর্থের সাহায্যে যখন বৃহৎ বৃহৎ কাৰ্য্য সকল সমাপন হইতেছে, তখন আপনার অফিস হইতে সামান্য একখানি খাতা আনিয়া ও ইচ্ছামত উহার পরিবর্তন করিয়া যদি মতি দত্ত দিতে না পারিবে তবে আর তাহার বাঁচিয়া লাভ কি?” এই কথা শ্রবণ করিয়া সব-রেজিষ্ট্রার তাহাকে আর কোন কথা না বলিয়া, দূরে গিয়া উপবেশন করিলেন
ইহার কিছুক্ষণ পরেই সেইস্থানের দুইজন মুন্সেফ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সব-রেজিষ্ট্রার মতিকে যে কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, এবং উত্তরে মতি যাহা বলিয়াছিল, তাহা প্রথম মুন্সেফ বাবু শ্রবণ করিয়া অতিশয় বিস্মিত হইলেন। তিনি মতিকে কহিলেন, “মতি! আমি তোমাকে অন্যান্য দুই একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাহি; আশা করি, এ সময়ে তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে।”
মতি। আমি এখন কয়েদী। আমার অদৃষ্টে কি ঘটিবে, তাহা আমি বলিতে পারি না; এরূপ অবস্থায় আমি কখন মিথ্যা কথা বলিব না।
প্রথম মুন্সেফ। আমার এজলাসে এখন উপস্থিত মোকদ্দমার মধ্যে কোন জাল দলিল আছে কি?
মতি। আছে।
প্রথম মুন্সেফ। কোন্ কোন্ মোকদ্দমায় জাল দলিল দাখিল আছে, তাহা তুমি বলিতে পার কি?
মতি। বলিতে পারি বইকি; যাহার যাহার মোকদ্দমায় সম্প্রতি জাল দলিল প্রস্তুত হইয়াছে, তাহাদিগের নাম আমি আপনাকে বলিয়া দিতেছি আপনি লিখিয়া লউন।
এই বলিয়া মতি দত্ত প্রায় আট দশটি লোক মুন্সেফবাবুকে লিখাইয়া দিল। তিনি নামগুলি লিখিয়া লইয়া পরিশেষে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এই সকল মোকদ্দমার কোন পক্ষে জাল দলিল দাখিল হইয়াছে?”
উত্তরে মতি কহিল, “উভয় পক্ষ হইতেই জাল দলিল প্রস্তুত হইয়াছে।”
মুন্সেফ। এ সকল দলিল কাহার দ্বারা প্রস্তুত?
মতি। যে দেশে মতি দত্ত এখনও জীবিত আছে, সে দেশে জাল দলিল প্রস্তুত হওয়া সবিশেষ কঠিন কাৰ্য্য নহে।
মতির কথা শ্রবণ করিয়া মুন্সেফদ্বয় বিষণ্ণ মনে সেইস্থান হইতে প্রস্থান করিলেন।
এইরূপে ক্রমে চারি দিবস অতীত হইয়া গেল। পঞ্চম দিবস আমি উহাকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় আগমন করিলাম। যেরূপ ভাবে উহাকে ধৃত করিয়াছিলাম, আদ্যোপান্ত সমস্ত কথা আপন ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট প্রকাশ করিলাম। আমার কথা শ্রবণ করিয়া তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন, ও পরিশেষে কিছু পারিতোষিকও প্রদান করিলেন। ইহার দুই দিবস পরেই সমসের উদ্দিন ও মতিলালের মোকদ্দমা আলিপুরের মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরিত হইল। সময়-মত মোকদ্দমার ডাক হইলে মতি কহিল, “এই মোকদ্দমার বিষয় আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে আমার দুই একটি কথা বলিবার আছে, যদি অনুগ্রহ করিয়া প্রথম শ্রবণ করেন, ভালই; নতুবা পরে বলিব। কিন্তু প্রথম শুনিলে আমার বিশ্বাস যে, আপনার শ্রমের অনেক লাঘব হইবে।”
মাজিষ্ট্রেট। কি বলিতে চাহ—বল।
মতি। আমার উপর কি নালিস রুজু হইয়াছে, তাহা আমি জানি না। কিন্তু বোধ হয়, আমার অধিকারে জাল নোট এবং জাল নোট প্রস্তুত করিবার সরঞ্জাম যন্ত্রাদি পাওয়া গিয়াছে বলিয়া আমি অভিযুক্ত।
মাজিষ্ট্রেট। তুমি যাহা বলিলে, ইহাই তোমার উপর নালিস। অপরের উপর নালিস—জাল নোট চালান এবং জাল নোট অধিকারে প্রাপ্ত হওয়া।
মতি। সত্য মিথ্যা জানিনা, কিন্তু আমি শুনিয়াছি যে, খিদিরপুরে নোট চালাইবার সময় সমসের উদ্দিন ধৃত হইয়াছে; সুতরাং যদি সে কোনরূপ দোষ করিয়া থাকে, তাহা আপনার এলাকার ভিতরেই করিয়াছে; সেই জন্য সেই মোকদ্দমার বিচার করিতে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। কিন্তু এ মোকদ্দমার সহিত আমার মোকদ্দমার কোন সংস্রব নাই। যে কৰ্ম্মচারী আমাকে ধৃত করিয়া আনিয়াছেন, এবং আমার অধিকারে যে সকল দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে তিনি বলিতেছেন, তাহা তিনি কোথায় পাইয়াছেন? আপনার এলাকার ভিতর পাইয়াছেন, কি, অপর কোন এলাকায় পাইয়াছেন? তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি নিশ্চয়ই বলিবেন যে, এই সকল দ্রব্য বাখরগঞ্জ জেলার ভিতর আমার অধিকারে তিনি পাইয়াছেন। আর আমাকেও বাখরগঞ্জ জেলা হইতে ধরিয়া আনিয়াছেন। এরূপ অবস্থায় আমার বিশ্বাস যে, সমসের উদ্দিনের সহিত এক সঙ্গে আমার মোকদ্দমা চলিতে পারে না, বা আমার মোকদ্দমার বিচার করিবার ক্ষমতা আপনার নাই।
মতির এই কথা শ্রবণ করিয়া মাজিষ্ট্রেট একটু চিন্তিত হইলেন এবং সেই দিবসের নিমিত্ত সেই মোকদ্দমার বিচার স্থগিত করিয়া, এরূপ অবস্থায় দুইজনের বিচার একত্র ও এইস্থানে হইতে পারে, কিনা, তাহা হাইকোর্টে জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠাইলেন। কয়েক দিবস পরে হাইকোর্ট হইতে আদেশ আসিল যে, সমসের উদ্দিনের মোকদ্দমা আলিপুরে হইবে। কিন্তু মতি দত্তের মোকদ্দমা বাখরগঞ্জে হইবে।
পরিশেষে তাহাই হইল। লাভের মধ্যে আমাকে দুই স্থানে দৌড়াদৌড়ি করিতে হইল। যাহা হউক, উভয় স্থানেই মাজিষ্ট্রেটের বিচারে উভয়েই পাঁচ পাঁচ বৎসরের নিমিত্ত কারাবদ্ধ হইল।
[আষাঢ়, ১৩০২]