কান্না নেই – জয়দীপ চক্রবর্তী
বারান্দার এককোণে ব্রজমোহন ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ আকাশ দেখছিলেন। আগেও দেখতেন, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে চোখ লাগিয়ে বিশেষ একটা নক্ষত্র অথবা গ্রহ-উপগ্রহের ওপর নজরদারি করবার জন্য। কিন্তু আজকের এই আকাশ দেখাটা একটু অন্যরকম।
ব্রজমোহন ষাট পেরিয়ে গেছেন ক’মাস হল। মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের চাকরি থেকে সদ্য অবসর নিয়ে চলে এসেছেন তাঁর এই গ্রামের বাড়িতে। এখন যেটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, বাড়ির ছোটো ল্যাবরেটরির মধ্যেই। ব্রজমোহন বাইরে বড়ো একটা বেরোন না, আসলে সময়ই পান না। শুধু সকালবেলার উঠি-উঠি রোদ্দুরের মধ্যে ঘন্টাখানেক হাঁটাচলা করার পুরনো অভ্যেসটা তিনি এখনো ছাড়তে পারেননি। আগে একাই বেরোতেন, আজকাল তাঁর সঙ্গী হয়েছে পিকু, এখানে বেড়াতে আসা তাঁর তোরো বছরের নাতি।
আজকে চুপচাপ বসে আকাশ দেখতে দেখতে ব্রজমোহনের পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।… তাঁর ঠাকুমার কথা। অনেকদিন আগে যখন তিনি পিকুর চেয়েও ছোটো, তাঁর ঠাকুমা আকাশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তাঁকে তারা দেখাতেন, তারা চেনাতেন। কোলের ওপর বসিয়ে নিয়ে বলতেন, ‘বিজু, মানুষ হ’ ভাই, মানুষকে ভালোবাসতে শেখ। যদি পারিস তবে, একদিন আকাশের তারা হয়ে জ্বলতে পারবি।’ ব্রজমোহনের ঠোঁটের কোণে এক অনির্বচনীয় হাসির ঝিলিক খেলে গেল। আত্মহারা হয়ে তিনি হঠাৎ তারাগুলির মধ্যে তাঁর ঠাকুমার মুখ খোঁজার অলীক খেলায় মেতে উঠলেন।
আকাশের গায়ে চোখ বুলতে-বুলতে এক জায়গায় এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন ব্রজমোহন। পশ্চিম আকাশে চাঁদের থেকে হাত পাঁচ-ছয় দূরে একটা বেশ বড়ো এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্রমাগত জ্বলছে, নিভছে, বড়ো হচ্ছে, ছোটো হচ্ছে. রং পালটাচ্ছে। ব্রজমোহন দূ’হাত দিয়ে চোখ রগড়ালেন। ভুল দেখছেন না তো? কিন্তু তারাটা একই রকম ব্যবহার করতে লাগল তাঁর দিকে চেয়ে। ভারি অবাক হলেন ব্রজমোহন। এমনটা তো কখনো ঘটতে দেখেননি। পড়ি-কি-মরি করে তিনি ছুটলেন তাঁর ল্যাবরেটরির দিকে। তড়িঘড়ি দিক ঠিক করে নিয়ে চোখ রাখলেন টেলিস্কোপের কাচে। কিন্তু কিছুই তাঁর চোখে পড়ল না আর। পশ্চিম আকাশ একেবারে ফাঁকা, শুনশান।
সারারাত ধরে আর ঘুম হল না ব্রজমোহনের। সারাজীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা জড়ো করেও ওই ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করতে পারলেন না তিনি। তবে একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত যে, ওটা কোনো নক্ষত্র বা গ্রহ-উপগ্রহ নয়। তবে কি…
অন্যদিনের মতো আজও ব্রজমোহন পিকুর হাত ধরে পথে বেরিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আজ তিনি কেমন যেন বিমনা। পথ চলতে প্রায়ই ঠোকর খাচ্ছেন। পিকু বেশ বুঝতে পারছিল, আজ তার দাদু ঠিক স্বাভাবিক নন। অন্যদিন দাদু হাঁটতে-হাঁটতে তার সঙ্গে অনর্গল কথা বলেন, অথচ আজ একেবারে চুপ। সকাল থেকেই গোমড়ামুখে কী যে ভাবছেন মানুষটি!—ব্যাপারটা পিকুর ভালো লাগে না। খানিকটা অভিমানভরেই দাদুর হাত ছাড়িয়ে সে অনেকখানি এগিয়ে যায়। রাস্তা পেরিয়ে টুক করে ঢুকে পড়ে পাশের জঙ্গলে। তারপর আনমনে এগিয়ে যেতে থাকে উদ্দেশ্যহীন, জংলি পথ ধরে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর পিকুর মনে হল যে, আজ দাদু তার সঙ্গে নেই। এদিকে খেয়ালবশে বনের অনেকটাই ভেতরে ঢুকে পড়েছে সে। এখানে জঙ্গল বেশ ঘন। বড়ো-বড়ো গাছ একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে সোজা ওপরদিকে উঠে গেছে। ঢেকে দিয়েছে আকাশ। এখানে কোনো পাখির ডাকও নেই। কেমন যেন অস্বাভাবিক থমথমে ওই জায়গাটা। পিকুর এবার গা-ছমছম করে উঠল। সে বুঝতে পারল জঙ্গলের এত ভেতরে ঢুকে পড়াটা তার ঠিক হয়নি। বেশ বিব্রত বোধ করল পিকু। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, দাদু নিশ্চয়ই এতক্ষণে চিন্তা শুরু করে দিয়েছেন তার জন্য। পিকু পেছন ফিরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
দু-এক পা এগিয়েই পিকু বুঝতে পারল যে, সে পথ হারিয়েছে। আর তখনই তার নজরে পড়ে গেল আশ্চর্য জিনিসটা। টেনিসবলের মতো দেখতে উজ্জ্বল আকাশি রঙের বলটা একটা নীচু ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি মারছিল। পিকু সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গেল জিনিসটার দিকে। কৌতূহলী হয়ে ঝুঁকে পড়ল ওটার ওপর। তারপর অবাক হয়ে দেখল একটা মৃদু বিপ-বিপ শব্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে ওই অদ্ভুত বলটা তার রং পালটাচ্ছে। পিকু দু’হাত দিয়ে তুলে নিল বলটা। চোখের কাছে এনে দেখল ওর ওপর রংবেরঙের অসংখ্য ছোটো-ছোটো বোতাম একটা অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশার আকারে সাজানো রয়েছে। কোনো কিছু না ভেবেই পিকু হঠাৎ একটা সবুজ বোতাম টিপে দিল।
ব্রজমোহনের হঠাৎ খেয়াল হল পিকু অনেকক্ষণ তাঁর সঙ্গে নেই। ঠিক কতক্ষণ আগে যে ছেলেটা একা হয়ে গেল, মনে করতে পারলেন না তিনি। তবুও মনে মনে হিসেব কষে দেখলেন অন্নত ঘন্টাখানের হয়ে গেছে পিকু তাঁর কাছছাড়া। অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন ব্রজমোহন। ছেলেটা তো এমন করে না কখনো! এদিকে রোদ চড়ে গেল, ফেরার সময়ও পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। রাস্তার দু’দিকে যতদূর চোখ যায় তার মধ্যে পিকুকে খুঁজে পেলেন না তিনি। দু’পাশের জঙ্গলের দিকে চেয়ে এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলেন ব্রজমোহন। ছেলেটা ওই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল না তো! যতটা গলা তোলা যায় ততখানি গলা চড়িয়ে জঙ্গলের দিকে চেয়ে তিনি ডাক ছাড়লেন, ‘পিকু-পিকা, ই…’
জঙ্গলের গাছে গাছে ঠোক্কর খেয়ে সেই ডাক প্রতিধবনি তুলল, কিন্তু পিকুর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে-দিতে বাড়ির পথ ধরলেন ক্লান্ত ব্রজমোহন। ভাবলেন, পিকু এতক্ষণে বাড়ি ফিরে গেছে নিশ্চয়ই।
বাড়ি ফিরে যখন শুনলেন তাঁর নাতি ফিরে আসেনি, আর ঘড়ির কাঁটাও চলতে-চলতে প্রায় এগারোটায় গিয়ে পৌঁছল, ব্রজমোহন রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন। চুপচাপ নিজের ল্যাবরেটরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর মাথা রেখে তিনি ভাববার চেষ্টা করলেন এর পর কী করা উচিত। হঠাৎ তাঁর কানের কাছে একটা অদ্ভুত একটানা আওয়াজ শুনতে পেলেন। একসঙ্গে কয়েকশো মশার সম্মিলিত ওড়ার শব্দের মতো তীক্ষ্ণ। ব্রজমোহনের মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। মনে হল এই একটানা শব্দের স্রোত তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকে কিছুক্ষণ ঘুরপাক খেতে লাগল। তারপর একসময় একেবারে থেমে গেল। ব্রজমোহন আবিষ্ট হয়ে ভাববার চেষ্টা করছিলেন ব্যাপারটা কী হল, এমন সময় তাঁর মাথার মধ্যে কে যেন সুরেলা গলায় কথা বলে উঠল, ‘ব্রজমোহনবাবু, নাতির জন্য কী আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে?’
ব্রজমোহন হঠাৎ মাথার মধ্যে এই কণ্ঠস্বর শুনে ভীষণ রকম চমকে উঠলেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি মনস্থির করে ফেললেন যে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না। কণ্ঠস্বর যারই হোক না কেন, সে তাঁর নাতির প্রসঙ্গে কথা বলছে।
ব্রজমোহন শান্ত গলায় বললেন, ‘তা তো একটু হচ্ছেই, হওয়াটাই স্বাভাবিক কিনা!’
কণ্ঠস্বর একই রকম সুরেলা গলায় বলল, ‘চিন্তা করে লাভ নেই, সে আর ফিরবে না।’
ব্রজমোহন থতোমতো খেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’
‘আমরা তাকে নিয়ে গেছি।’ তার মাথার মধ্যে থেকে উত্তর এল।
‘আপনার পরিচয় জানতে পারি?’ ব্রজমোহন কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
‘জানলেও বুঝতে পারবেন না।’
‘তবু জানতে চাই।’
‘আমরা মগজ। আপনাদের থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে আমাদের দেশ।’
ব্রজমোহন ঠিক ধরতে পারলেন না ব্যাপারটা। তাই প্রসঙ্গ থেকে সরে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘পিকুকে নিয়ে আপনারা কী করতে চান?’
‘পরীক্ষা।’ মগজ ছোট্ট উত্তর দিল।
‘কী পরীক্ষা?’ ব্রজমোহন জানতে চাইলেন।
‘আমি জানি না।’
‘কে জানে?’
‘মগজ ওয়ান।’
‘আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘বলুন।’ মগজ চুপ করে গেল।
কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা। তারপরেই ব্রজমোহনের মাথার মধ্যে সুরেলা কণ্ঠ আবার কথা বলে উঠল। ‘মগজ ওয়ান বলছি।’
ব্রজমোহন অবাক হলেন। আগের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে এর কোনো তফাত নেই।
‘আমাদের বৈশিষ্ট্যগত কোনো পার্থক্য আপনি খুঁজে পাবেন না।’ ব্রজমোহন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মগজ ওয়ান উত্তর দিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘আপনার নাতি সম্পর্কে কী জানার আছে, তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন।’
ব্রজমোহন মনে-মনে নিজেকে তৈরি করে নিলেন। তারপর বেশ কড়া সুরেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার নাতিকে নিয়ে আপনারা কী করতে চান?’
‘আপনার নাতিকে নিয়ে আমরা কিছু করতে চাই না।’ মগজ ওয়ান উত্তর দিল, ‘আমরা শুধু ওর হৃদয়টাকে নিয়ে আমাদের গবেষণাগারে রেখে দিতে চাই।’
‘মানে?’ বেশ ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ব্রজমোহন।
‘তা হলে শুনুন, আপনাকে বিস্তারিত বলি।’ মগজ ওয়ান তার কথা শুরু করল।
‘আমাদের ইতিহাস আপনাদের চেয়ে অনেকই প্রাচীন। আমাদের বিজ্ঞানও। আপনাদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আজ যে জায়গায়, আমরা সেই অবস্থা কাটিয়ে এসেছি কয়েক শতাব্দী আগেই। ক্রমাগত জ্ঞানচর্চার ফলে এখন আমাদের শরীর ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা আজ শুধুই মগজে রূপান্তরিত। আমাদের খাদ্যাভাব নেই। স্থানাভাব নেই। আমাদের অভাব নেই, হিংসা নেই। আমাদের কেবল চিন্তা আছে, বুদ্ধি আছে, আর আছে কাজ। কর্মপদ্ধতিতে আমরা যন্ত্রসভ্যতাকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। আমরা এক-একজন মগজ আপনাদের কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের চেয়েও দ্রুত চিন্তা করতে পারি।’
ব্রজমোহন এতক্ষণ অবাক বিস্ময়ে সব কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এবার গলাখাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা আমাদের চেয়ে সত্যিই যদি এতখানি এগিয়ে, তবে আমাদের এই পৃথিবীতে এসে হানা দিলেন কেন? আর কেনই বা জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের পিকুকে?’
মগজ ওয়ান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আমরা কোনো কিছুই জোর করে করি না ব্রজমোহনবাবু। আপনার নাতিকেও আমরা নিশ্চয়ই আপনার কাছে ফিরিয়ে দেব, যদি সে আমাদের সঙ্গে যেতে না চায়।’
ব্রজমোহনবাবু যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘ও কিছুতেই এই সোনা পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাইবে না। পৃথিবীর ভালোবাসার টান তার অভিকর্ষ বলের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। দেখবেন ওকে আপনারা কিছুতেই নিয়ে যেতে পারবেন না।’
পিকুর যখন জ্ঞান ফিরল, সে একেবারে হতভম্ব! কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবার পর আস্তে-আস্তে তার সংবিৎ ফিরল। মনে পড়ে গেল সবকিছু। জঙ্গলের মধ্যে পথ হারানো, রহস্যময় রঙিন বল, বোতাম টেপা…
বোতামটা টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী যেন হয়ে গেল—পিকুর মনে পড়ল। মনে হয়েছিল কে যেন টেনে ওকে শূন্যে তুলে নিয়েছিল। ব্যাস, তারপরেই সব ঝাপসা!
পিকু ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। ওর মনে হল ও যেন ঠিক থেমে নেই। পিকু সন্তর্পণে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। দেখল ধোঁয়ার মতো একটা স্বচ্ছ আবরণ তাকে ঘিরে রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ও সেই আবরণ ছুঁতে অথবা ভেদ করতে পারল না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল পিকু। তন্ময় হয়ে ভাববার চেষ্টা করল ও কোথায় আছে। হঠাৎ মাথার মধ্যে একটা একটানা তীক্ষ্ণ শব্দের স্রোত অনুভব করল ও। ক্রমশ সেই শব্দগুচ্ছ কথায় রূপান্তরিত হয়ে গেল।
‘পিকু তুমি ঠিক আছ তো?’
পিকু মজা পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কে, আমার নাম জানলেন কেমন করে?’
‘আমরা সব জানতে পারি।’ পিকুর মাথার মধ্যের শব্দতরঙ্গ কথা বলে উঠল।
‘আপনি কী জানেন আমি এখন কোথায় আছি?’ পিকু জিজ্ঞেস করল।
‘আমাদের গবেষণাগারে, তোমাদের পৃথিবী থেকে অনেক দূরে।’—উত্তর এল।
পিকুর ঠিক বিশ্বাস হল না। মনে হল সে বোধ হয় স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। মাথার মধ্যে সুরেলা কণ্ঠস্বর কথা বলে উঠল, ‘তুমি মোটেই স্বপ্ন দেখছ না পিকু, সামনে তাকাও—’ পিকু সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। অসংখ্য রঙিন তারা মিটমিট করছে তার সামনে, কিছুদূরে দু-দু’খানা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে আকাশেণ্ণ গায়ে। পিকুর ভালোলাগার মরে যেতে ইচ্ছে করল।
‘তুমি এখানে থাকতে চাও পিকু?’ তার মাথার মধ্যে থেকে প্রশ্ন ভেসে এল।
‘চাই।’ পিকু স্বপ্নাবিষ্টের মতো জবাব দিল।
ব্রজমোহনের কানের মধ্যে পিকুর গলায় এই ‘চাই’ শব্দটা যেন হঠাৎ প্রতিধবনিত হয়ে শুরু করল। খানিকটা অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘এটা কী পিকুর গলা?’
‘হ্যাঁ, এটা পিকুরই গলা। ও আমাদের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়েছে।’ মগজ ওয়ান উত্তর দিল।
হতাশ বলেন ব্রজমোহন। বিষণ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকে নিয়ে কী পরীক্ষা করতে চান আপনারা?’
মগজ ওয়ান বলতে শুরু করল—’আসলে দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটা জিনিসের বড়ো অভাব বোধ করছি, একটা অনুভূতি, যাকে আপনারা ভালোবাসা বলেন। আমরা মগজ, আমাদের হৃদয় নেই। তাই আমাদের দেশে ভালোবাসাও নেই। অথচ আমাদের মেধা আমাদের জানাচ্ছে যে, ভালোবাসা না থাকলে আমরাও হয়তো একদিন ধবংস হয়ে যাব। আমরাও আজ বুঝতে পারছি যে আমাদের দেশে প্রতিটি মগজের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি যোগ করা উচিত। তাই আমরা পৃথিবীতে এসেছিলাম ভালোবাসার উপাদান-মৌল সংগ্রহ করতে।’
ব্রজমোহন বিস্ময়-জড়ানো কণ্ঠে বললেন, ‘তারপর?’
মগজ ওয়ান বলে চলল, ‘পৃথিবীতে এসে আমরা কিছুটা হতাশই হলাম। দেখলাম ভালোবাসার আকাল শুরু হয়ে গেছে পৃথিবীতেও। দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণ করে আমরা বুঝলাম যেটুকু ভালোবাসা এখানে এখনও বেঁচে আছে তার সিংহভাগটাই লুকনো আছে ওই গ্রহের শিশুদের হৃদয়ে। আমরা প্রায় নিশ্চিত যে, প্রকৃত ভালোবাসার নির্যাস আমরা পেতে পারি কেবলমাত্র শিশুদের হৃদয় থেকেই।’ মগজ ওয়ান কয়েক মুহূর্ত চুপ করল। তারপর বলল, ‘পিকুর হৃদয় থেকে ভালোবাসার নমুনা সংগ্রহ করে আমাদের গবেষণাগারে তার বিশ্লেষণ করে আমরা আমাদের দেশে কৃত্রিম ভালবাসা তৈরি করতে চাই।’
ব্রজমোহনের মনটা বড়ো ভারী হয়ে গেল। বুকটা তাঁর টনটন করে উঠল পিকুর জন্য। তীব্র বেদনায় হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘পি—কু—’
পিকুর বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল জায়গাটা। একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধে মশগুল হয়ে উঠেছিল সে। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে থেকে তীব্রস্বরে কে যেন ডেকে উঠল, ‘পিকু—পিকা-ই—’
চমকে উঠল পিকু। এ ডাক চার চেনা ; এই কণ্ঠস্বর তার দাদুর। মুহূর্তে সব আনন্দ মুছে গেল তার। আকাশের সব রঙিন তারা একটার পর একটা খসে পড়ল তার চোখের সামনে থেকে। বুকের ভেতর থেকে এটা তীব্র কান্না পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে এসে মুহূর্তে ভাসিয়ে দিল দু’চোখ। কে যেন বুকের ভেতর ধাক্কা মারতে মারতে ক্রমাগত বলতে লাগল, ‘পিকু, তুমি একা,—পিকু তুমি একা—’
কান্নাভেজা গলায় চিৎকার করে উঠল পিকু, ‘আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমাকে ফিরিয়ে দাও, আমি পৃথিবী ছেড়ে যেতে চাই না—আমি আমার দাদুকে ছেড়ে যেতে চাই না—আমি আমার দাদুকে ছেড়ে যেতে চাই না—’
মগজরা এমনটা ভাবেনি। পৃথিবী থেকে তারা ভালোবাসা সংগ্রহ করতে এসেছিল। তারা ভাবতেও পারেনি ভালোবাসার জন্য মানুষকে কত কষ্ট পেতে হয়, কী পরিমাণ চোখের জল ঝরাতে হয়। কষ্টকে ওরা ভয় পায়, কান্নাকে ওরা ভয় পায়। ভালোবাসার লোভে পৃথিবীতে এসে ওরা ওদের দেশে কান্না বয়ে নিয়ে যেতে চায় না।
ব্রজমোহনের মাথার মধ্যে মধ্যে কথা বলে উঠল, ‘ব্রজমোহনবাবু, আপনার নাতিকে ফিরিয়ে নিন, ও কাঁদছে। আমরা কান্না সহ্য করতে পারি না।’
পিকুর চারপাশ থেকে স্বচ্ছ ধোঁয়ার আবরণটা ফিকে হতে-হতে একেবারে মিলিয়ে গেল। সে চোখ খুলে দেখল সামনে তার দাদু দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে জল। পিকু একছুটে তার দাদুকে জড়িয়ে ধরল দু’হাত দিয়ে।
পশ্চিম আকাশে একটা উজ্জ্বল আলো ক্রমশ ছোটো হতে-হতে একেবারে মিলিয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন ব্রজমোহন। তারপর পিকুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘দাদু, কান্না আছে বলেই আমরা একসঙ্গে আছি, দুঃখ আছে বলেই আমরা এত আনন্দে বেঁচে আছি।’