কান্না এবং উচ্চহাসি [টিয়ারস এন্ড লাফটার]
সৃষ্টি
ঈশ্বর একটি আত্মাকে তার কাছ থেকে আলাদা করে ফেললেন এবং তা দিয়ে তৈরি করলেন সৌন্দর্য। তিনি তার ওপর বর্ষণ করলেন সমস্ত শোভনতা ও দয়ার আশীর্বাদ। তিনি তাকে প্রদান করলেন সুখের পেয়ালা এবং বললেন, ‘অতীত ও ভবিষ্যৎ ভুলে না যাওয়া পর্যন্ত এই পাত্র থেকে পান কোরো না, কারণ সুখ আর কিছুই নয় একটি মুহূর্ত মাত্র’ এবং তিনি তাকে আরও প্রদান করলেন দুঃখের পেয়ালা এবং বললেন, ‘এই পেয়ালা থেকে পান করো এবং তুমি জীবনের আনন্দের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তের অর্থ উপলব্ধি করতে পারবে, কারণ দুঃখ সবসময়ই উপচে পড়ে।’
ঈশ্বর তার ওপর ভালোবাসা প্রদান করলেন যা তাকে চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করবে এবং তার ওপর পতিত হবে জাগতিক পরিতৃপ্তির প্রথম দীর্ঘশ্বাস এবং একটা মধুরতা যা নিঃশেষ করবে তোষামোদ সম্পর্কে তার প্রথম সচেতনতাকে।
এবং ঈশ্বর তাকে বিচক্ষণতা দান করলেন স্বর্গ থেকে সমস্ত ন্যায়নিষ্ঠ পথের দিকে তাকে নেতৃত্ব দিতে এবং স্থাপন করলেন তার হৃদয়ের গভীরে একটা চোখ যা অদৃশ্যকে দেখতে পায় এবং তার ভেতরে সৃষ্টি করলেন মায়া-মমতা এবং ভালোত্ব সব জিনিসের প্রতি। তিনি তাকে আকাঙ্ক্ষার পোশাকে সজ্জিত করলেন স্বর্গের দেবদূতকে দিয়ে রঙধনুর প্রাণশক্তি থেকে এবং দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের ছায়া দিয়ে তাকে পরালেন ছদ্মবেশ, যা হচ্ছে জীবন ও আলোর ভোরবেলা।
তারপর ঈশ্বর ক্রোধের অগ্নিকুণ্ড থেকে গ্রহণ করলেন অপচয়কৃত অগ্নি, ক্ষতসৃষ্টিকারী বাতাস গ্রহণ করলেন অবহেলার মরুভূমি থেকে, গ্রহণ করলেন স্বার্থপরতার তীরভূমি থেকে ধারালো বালি এবং আরও গ্রহণ করলেন কালের পাদদেশ থেকে এবড়োথেবড়ো মাটি এবং তারপর সবগুলিকে একত্রিত করলেন এবং সৃষ্টি করলেন মানুষ। মানুষকে তিনি দান করলেন একটা অন্ধশক্তি যা হচ্ছে ক্রোধ এবং তাকে পরিচালিত করলেন পাগলামির দিকে, যার অবসান ঘটলো শুধুমাত্র আকাঙ্ক্ষার বাসনা পূরণের মুখোমুখি এবং তিনি জীবন স্থাপন করলেন তার ভেতরে যা হচ্ছে মৃত্যুর অপচ্ছায়া।
তারপর ঈশ্বর হাসলেন এবং কাঁদলেন। তিনি অনুভব করলেন মানুষের জন্য একধরনের নিমজ্জিত ভালোবাসা ও দয়া এবং আশ্রয় দিলেন তার নেতৃত্বের ছায়াতলে।
আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, হে আমার আত্মা
হে আমার আত্মা তুমি কাঁদছ কেন?
তুমি কি আমার দুর্বলতা জানো না?
তোমার অশ্রু তীক্ষ্ণভাবে আঘাত করে এবং আহত করে,
কারণ, আমি আমার ভ্রান্তিগুলি জানি না।
যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি আর্তনাদ করে না ওঠো।
আমার কিছুই নেই মানবিক শব্দাবলি ছাড়া
তোমার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা এবং
তোমার নির্দেশগুলি ব্যাখ্যা করতে।
হে আমার আত্মা আমার দিকে তাকাও, তোমার
শিক্ষার ভেতরে লুকিয়ে থাকা আমার সম্পূর্ণ জীবন
আমি অপচয় করে ফেলেছি। ভেবে দ্যাখো
কী পরিমাণ সংগ্রাম করেছি আমি। আমি নিঃশেষ
করেছি আমার জীবন তোমাকে অনুসরণ করতে গিয়ে।
আমার জীবন মহিমান্বিত হয়েছিল সিংহাসনের ওপর
কিন্তু এখন তার কাঁধে দাসত্বের জোয়াল,
আমার ধৈর্য আমার সঙ্গী হয়েছিল কিন্তু এখন
আমার বিরুদ্ধে সে প্রতিযোগিতায় নেমেছে;
আমার যৌবন ছিল আমার আকাঙ্ক্ষা, কিন্তু এখন
কঠোর তিরস্কার করে আমার অবহেলাকে।
হে আমার আত্মা, কেন তুমি সবকিছু চাও?
আমি অস্বীকার করেছি আমার আনন্দকে
এবং পরিত্যাগ করেছি জীবনের উল্লাসকে,
যা তুমি প্রবর্তন করেছ আমাকে তাড়া করতে।
যথাযথ হও আমার প্রতি অথবা আহ্বান জানাও
মৃত্যুকে আমাকে শৃঙ্খলিত করতে,
কারণ ন্যায়বিচারই হচ্ছে তোমার মহিমা
আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, হে আমার আত্মা।
ভালোবাসা দিয়ে তুমি আমাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছ
যতক্ষণ আমি আমার বোঝা বহন করতে না পারি।
তুমি এবং ভালোবাসা হতে পারো অবিচ্ছেদ্য, আমি এবং
বস্তুসমূহ হচ্ছে অবিচ্ছেদ্য দুর্বলতা। আমরাই কি হব তাহলে
দুর্বল ও শক্তিশালীর মাঝখানের সংগ্রামের বিরতিফল?
আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো হে আমার আত্মা।
তুমি আমাকে প্রদর্শন করেছ আমার ভাগ্যকে
আমার উপলব্ধির ওপরে। তুমি এবং ভাগ্য থাক
একসঙ্গে পাহাড়ের ওপরে, দুর্দশা এবং আমি একত্রে
পরিত্যক্ত হই উপত্যকার খানা-খন্দে। আমরা কি পাহাড়
এবং উপত্যকাকে একত্রিত করব?
আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো হে আমার আত্মা।
তুমি আমাকে সৌন্দর্য দেখিয়েছ, কিন্তু তারপর তাকে
গোপন করেছ। তুমি এবং সৌন্দর্য বসবাস করো
আলোর ভেতরে। অজ্ঞতা এবং আমি অন্ধকারে
একই বন্ধনে বাঁধা। আমরা কি সেই আলোতে পরিণত হব,
যা অন্ধকারে হানা দেয়?
সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই আসে তোমার উল্লাস
এবং তুমি আনন্দ করো এখন পূর্বাভাসের ভেতরে
কিন্তু এই শরীর সংগ্রাম করে জীবনের সঙ্গে, যখন
তা জীবনের ভেতরে থাকে।
এটাই হল ধাঁধার ভেতরে
ফেলে দেওয়া, হে আমার আত্মা।
তুমি অনন্তের দিকে চলেছ দ্রুত, কিন্তু এই শরীর
ধীর গতিতে চলে ধ্বংসের দিকে। তুমি তার জন্য অপেক্ষা
করতে পারো না এবং সেও যেতে পারে না দ্রুত।
হে আমার আত্মা, এই হল বিষণ্ণতা।
তুমি উচ্চতায় আরোহণ করো স্বর্গের আকর্ষণের মাধ্যমে,
কিন্তু এই শরীর পতিত হয় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ
শক্তির কারণে। তুমি তাকে সান্ত্বনা দাও না এবং
সেও তোমার প্রশংসা করে না।
হে আত্মা এই হল দুর্দশা।
বিচক্ষণতায় তুমি সম্পদশালী কিন্তু এই
শরীর উপলব্ধির ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল।
তুমি কখনও আপোসে মীমাংসা করো না
এবং সেও তোমাকে মান্য করে না।
হে আমার আত্মা, এটাই হল চূড়ান্ত সংগ্রাম।
রাত্রির নীরবতার ভেতরে তুমি পরিদর্শন করো তোমার
অত্যন্ত প্রিয় মানুষকে এবং উপভোগ করো তার
উপস্থিতির মধুরতা। এই শরীর চিরকালই থাকে
আকাঙ্ক্ষা ও পৃথকীকরণের তিক্ত শিকার হয়ে।
হে আমার আত্মা, এই হল যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতন।
আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো, হে আমার আত্মা।
.
ভালোবাসার জীবন
বসন্তকাল
এসো আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, চলো আমরা এই ছোট্ট
পাহাড়গুলির ভেতর দিয়ে হাঁটি। কারণ বরফ হচ্ছে পানি
এবং এর সুখনিদ্রা থেকে বেরিয়ে আসা জীবন হচ্ছে জীবন্ত
এবং চলো এই পাহাড় ও উপত্যকার ভেতরে আমরা লক্ষ্যহীনভাবে
ঘুরে বেড়াই।
চলো আমরা দূরবর্তী মাঠে অনুসরণ করি বসন্তের
পদচিহ্ন এবং আরোহণ করি পাহাড়ের চূড়ায় প্রেরণাকে ঠাণ্ডা সবুজ
সমতল ভূমির ওপরে তুলে নিতে।
বসন্তের ভোরবেলা তার শীতরক্ষাকারী পোশাক উন্মোচন করে
রেখেছে এবং তা স্থাপন করেছে শান্তি ও বাতাবিলেবু গাছের
ওপর এবং তারা পাখি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কদর* রাত্রির
আনুষ্ঠানিক রীতির ভেতরে।
আঙুরের ছোট্ট শাখাগুলি পরস্পরকে জড়িয়ে
ধরে প্রেমাস্পদের মতো এবং ছোট্ট নদী পাথরের ভেতরে নৃত্যকালে
বিস্ফোরিত হয়, পুনরাবৃত্তি করে আনন্দসংগীত,
এবং পুষ্পগুচ্ছ হঠাৎ করেই প্রস্ফুটিত হয় প্রকৃতির হৃদয়
থেকে ফেনার মতো, যা সমুদ্রের বিশাল হৃদয় থেকে পাওয়া।
এসো আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, চলো আমরা পান করি
শীতের শেষ অশ্রুবিন্দু পদ্মফুলের পেয়ালা থেকে
এবং ক্রোধ প্রশমিত করি আমাদের আত্মার
পাখির মধুর সংগীতের বর্ষণ থেকে এবং বিস্মিত হই
উল্লাসের ভেতরে মৃদুমন্দ বাতাসের উন্মত্ততায়।
চলো আমরা পাথরের পাশে বসি যেখানে বেগুনিরশ্মিকে
আড়াল করা যাবে, চলো আমরা তাদের চুম্বনের মধুরতার
বিনিময়ের পেছনে তাড়া করি।
[*শব-ই-কদর এর রাত]
.
গ্রীষ্মকাল
চলো আমরা শস্যক্ষেতে যাই হে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ,
কারণ ফসল তোলার সময় সমাগত এবং সূর্যের চোখ
পাকিয়ে তুলছে শস্যকণা।
চলো আমরা যত্ন নিই ফলগুলির যা মাটিতে উৎপন্ন হয়, যেমন
আত্মা পরিচর্যা করে আনন্দের শস্যকণা ভালোবাসার
বীজ থেকে। চলো সেই বীজ বপন করি আমাদের হৃদয়ের গভীরে।
চলো আমরা পূর্ণ করি আমাদের শস্যাধার প্রকৃতির পণ্য দিয়ে,
যেমন জীবন পূর্ণ করে পর্যাপ্তভাবে আমাদের হৃদয়রাজ্য
তার সীমাহীন উদারতা দিয়ে।
চলো আমরা ফুলকে আমাদের শয্যায় পরিণত করি
এবং আকাশকে পরিণত করি কম্বলে এবং
বাকি সবকিছুসহ মাথাকে জড়ো করি নরম খড়ের
বালিশের ওপর।
চলো আমরা শরীর এলিয়ে দিই দিনের কঠোর পরিশ্রমের
পর এবং তারপর মনোযোগ দিয়ে শুনি সেই
ছোট্ট নদীর বিরক্তিকর বিড়াবিড়ানি।
.
শরৎকাল
চলো আমরা আঙুরক্ষেতে যাই এবং আঙুর জড়ো করি
আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের জন্য এবং সেই মদ সংরক্ষণ করি
পুষ্পাধারে, যেমন আত্মা সংরক্ষণ করে
যুগের অভিজ্ঞতাকে অনন্তের আধারে।
চলো আমরা আমাদের বসতিতে প্রত্যাবর্তন করি, কারণ বাতাসই
ঝরিয়েছে হলুদ পত্রাবলি এবং অবগুণ্ঠন পরিয়েছে বিবর্ণ পুষ্পগুচ্ছে,
যা ফিসফিস করে গায় শোকগাথা গ্রীষ্মের কানে কানে।
ঘরে এসো হে চিরন্তন প্রেমিকা আমার, কারণ পাখিরা
তীর্থযাত্রা শুরু করেছে উষ্ণতার জন্য এবং পরিত্যাগ করেছে
ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া তৃণভূমি যা নির্জনতার অনুশোচনায়
ভুগছে। জুঁইফুল এবং চিরহরিৎ গুল্মদলের চোখে নেই বিন্দুমাত্র অশ্রুজল।
এসো আমরা সবকিছু থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিই,
কারণ ক্লান্ত ছোট্ট নদীটা থামিয়ে দিয়েছে তার গান এবং
তাদের প্রাচুর্যপূর্ণ কান্না নিষ্কাশিত হয়ে বুদের মতো উড়েছে বসন্তে
এবং সতর্ক বৃদ্ধ পাহাড়গুচ্ছ তাদের উজ্জ্বল পোশাকগুলিকে
সংরক্ষণ করেছে দূরে কোথাও।
এসো, হে আমার প্রিয় মানুষ, প্রকৃতি এখন যথাযথভাবে
ক্লান্ত এবং সে আদেশ দিচ্ছে প্রবল উৎসাহের বিদায়পর্বকে
শান্ত ও পরিতৃপ্ত গানের মাধ্যমে।
.
শীতকাল
আমার কাছে এসো হে আমার সারাজীবনের সঙ্গী,
আমার কাছে এসো এবং শীতের স্পর্শকে আমাদের ভেতরে
প্রবেশ করতে দিও না। আমার হৃদয়ের মুখোমুখি বসো,
কারণ আগুনই হচ্ছে শীতের একমাত্র ফল।
আমাকে তোমার হৃদয়ের মহিমার কথা বলো, কারণ তা
আমাদের দরজার ওপরে তীক্ষ্ণকণ্ঠে কথা বলার চেয়েও বৃহত্তর।
দরজা বন্ধ করো এবং সিলমোহরের ছাপ মারো কড়ি-বরগায়
কারণ স্বর্গের ক্রুদ্ধ সমর্থন আমার আত্মাকে দমিয়ে
রেখেছে এবং আমাদের শস্যক্ষেতের বরফ-বোঝাই মুখমণ্ডল
কাঁদাবে আমার আত্মাকে।
বাতিতে তেলের যোগান দাও এবং তাকে অনুজ্জ্বল হতে
দিও না এবং এটা তোমার পাশে রাখো, যেন অশ্রুসজল চোখে
আমি তা পড়তে পারি, তোমার জীবন আমার সঙ্গে মিলেমিশে
যা লিখেছে তোমার মুখের ওপর।
শরতের মদ নিয়ে এসো। চলো পান করি এবং গাইতে থাকি
বসন্তে ভাবনাহীন বীজ বপনের স্মরণসংগীত, গ্রীষ্মের
বিনিদ্র তত্ত্বাবধানে এবং ফসল-তোলার কালে গ্রহণ করি শরতের পুরস্কার।
কাছে এসো হে আমার আত্মার প্রিয় মানুষ, আগুন ঠাণ্ডা হচ্ছে
এবং লুকিয়ে যাচ্ছে ছাইয়ের তলায়,
আমাকে আলিঙ্গন করো, কারণ আমি একাকিত্বকে ভয় পাই,
বাতিটা অনুজ্জ্বল এবং সেই মদ যা আমরা নিংড়ে
নিয়েছি আমাদের চোখ বন্ধ করতে গিয়ে। চলো আমরা
একে অন্যের দিকে তাকাই তারা রুদ্ধ হওয়ার আগে।
আমাকে খুঁজে নাও তোমার দুই হাতের ভেতরে
এবং আলিঙ্গন করো, তারপর সুখনিদ্রায় যাও এবং তারপর
এসো আমাদের আত্মাকে আলিঙ্গন করি একজন অন্যজনের মতো।
হে আমার প্রিয় মানুষ আমাকে চুম্বন করো, কারণ শীত
আমাদের সবকিছুই চুরি করেছে শুধু আমাদের
ক্রিয়াশীল ওষ্ঠগুলি ছাড়া।
তুমি আমার আরও অন্তরঙ্গ হও চিরকালের জন্য।
সুখনিদ্রায় সমুদ্র যত গভীর এবং বিস্তৃত
এবং যতখানি কাছাকাছি ছিল ভোরবেলা।
.
সৌভাগ্যের গৃহ
আমার ক্লান্ত হৃদয় আমাকে বলল, ‘বিদায়’ এবং পরিত্যাগ করল সৌভাগ্যের গৃহে। যেভাবে সে সেই পবিত্র শহরে পৌঁছাল তার জন্য আত্মা আশীর্বাদ ও প্রার্থনা করেছিল। ফলে সে বিস্মিত হতে আরম্ভ করেছিল, কারণ সে কখনও তা খুঁজে পেত না সবসময় যা কল্পনা করত। শহরটা ছিল ক্ষমতা, অর্থ ও কর্তৃত্বশূন্য।
আমার হৃদয় ভালোবাসার কন্যাকে বলল, ‘হে ভালোবাসা, কোথায় আমি পরিতৃপ্তি খুঁজে পেতে পারি? আমি শুনলাম সে তোমার সঙ্গে যোগ দিতে এখানে এসেছিল।’
ভালোবাসার কন্যা উত্তরে বলল, ‘পরিতৃপ্তি ইতিমধ্যেই শহরে গেছে তার বাইবেল প্রচার করতে, যেখানে লোভ এবং দুর্নীতি ক্ষমতায় শ্রেষ্ঠতর। আমাদের তার কোনো প্রয়োজন নেই।’
সৌভাগ্য ব্যাকুলভাবে পরিতৃপ্তি কামনা করে না, কারণ এটা হচ্ছে একটা জাগতিক প্রত্যাশা এবং উদ্দেশ্যের ঐক্যই এই আকাঙ্ক্ষাকে আলিঙ্গন করে থাকে, যখন পরিতৃপ্তি আন্তরিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
চিরন্তন আত্মা কখনও পরিতৃপ্ত হয় না, সবসময়ই অনুসন্ধান করে পরমানন্দ। আর আমার হৃদয় সৌন্দর্যের দিকে তাকায় এবং বলে, ‘শিল্পকলা হল যাবতীয় জ্ঞান, আমাকে জ্ঞানদান করো যেভাবে নারীর রহস্যকে জ্ঞানদান করেছিলে।’ এবং সে উত্তর দিল, ‘হে মানব হৃদয়, নারী হল তোমার নিজস্ব প্রতিফলন এবং তুমি যেখানে আছ সেখানেই সে আছে, তুমি যেখানে জীবন্ত, সেখানে যেও জীবন্ত। নারী হচ্ছে ধর্মের মতো, যদি তাকে অজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা না করা হয় এবং সে চন্দ্রের মতো, যদি তা মেঘে অবগুণ্ঠিত না হয় এবং সে ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের মতো, যদি অশুদ্ধতা তাকে বিষাক্ত করে না তোলে।
আমার আত্মা জ্ঞান, ভালোবাসার কন্যা এবং সৌন্দর্যের দিকে হাঁটতে শুরু করল এবং বলল, ‘আমাকে, বিজ্ঞতা দান করো যেন তা মানুষের সঙ্গে আমি ভাগাভাগি করতে পারি।’
ভালোবাসার কন্যা উত্তরে বলল, ‘বিজ্ঞতার কথা বোলো না বরং বলো ভাগ্যের কথা, কারণ প্রকৃত ভাগ্য বাইরে থেকে আসে না, কিন্তু পবিত্রতার ভেতরে শুরু হয় জীবনের পবিত্রতাগুলি। তুমি নিজেকে ভাগাভাগি করো মানুষের সঙ্গে।’
.
ঢেউয়ের সংগীত
দৃঢ় তীরভূমি আমার অত্যন্ত প্ৰিয়
এবং আমিও তার প্রিয়তম।
আমরা সর্বশেষ একত্রিত হয়েছিলাম ভালোবাসার মাধ্যমে
এবং চাঁদ আমাকে তার কাছ থেকে তুলে নিল।
আমি দ্রুত তার কাছে যাই এবং অনিচ্ছার ভেতরে আলাদা হই অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদায়ের মাধ্যমে।
আমি নীল দিগন্তের পেছনে থেকে হরণ করি আমার
ফেনার রুপালি সৌন্দর্যকে একত্রিত করতে,
তার বালির সোনলি সৌন্দর্যের ওপর
এবং আমরা তা মিশ্রিত করি গলিত ঔজ্জ্বল্যের ভেতরে।
আমি তার তৃষ্ণা মেটাই এবং নিমজ্জিত করি তার হৃদয়,
আর সে আমার স্বরকে কোমল করে এবং মনের অবস্থাকে
করে নিয়ন্ত্রণ।
ভোরবেলায় আমি তার কানে কানে আবৃত্তি
করি ভালোবাসার নিয়মগুলি এবং সে আকুল আকাঙ্ক্ষার
সাথে আমাকে করে আলিঙ্গন।
সন্ধ্যায় আমি গাই তার কাছে প্রত্যাশার সংগীত এবং
চুম্বনের ছাপ এঁকে দিই তার মুখের ওপর। আমি দ্রুতগামী
এবং ভীত, কিন্তু সে শান্ত এবং ধৈর্যশীল এবং চিন্তাশীল।
তার বিশাল বক্ষ আমার ক্লান্তিহীনতাকে
দূর করে দেয়।
জোয়ার এলে আমরা পরস্পরকে আদর করি,
আবার ভাটার সময় আমি প্রার্থনার ভেতরে তার
পায়ের কাছে ঝরে পড়ি ফোঁটায় ফোঁটায়।
অনেক সময়ই আমি মৎসকন্যাদের চারপাশে
নৃত্য করেছি। তারা উদ্ভূত হয়েছে গভীরতা থেকে
এবং তারা বিশ্রাম নিয়েছে আমার শিরস্ত্রাণের
ওপর নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করতে,
বহু সময়ই আমি প্রেমিক-প্রেমিকার অভিযোগ শুনেছি
তাদের ক্ষুদ্রতার ভেতরে এবং আমি তাদেরকে সাহায্য
করেছি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে।
বহু সময়ই আমি বিশাল পাথরগুলিকে ঠাট্টা করেছি
এবং তাদেরই আবার আদর করেছি হেসে হেসে, কিন্তু
আমার দিকে তাকিয়ে তারা কখনও হাসেনি,
বহু সময়ই আমি উত্তোলন করেছি ডুবে যাওয়া আত্মাগুলিকে
এবং তাদেরকে বহন করেছি যত্নের সঙ্গে আমার
তীরভূমির কাছে। সে তাদেরকে দান করেছে সামর্থ্য
যেভাবে সে আমাকে গ্রহণ করে।
বহু সময়ই আমি গভীরতা থেকে হরণ করেছি মূল্যবান রত্নাবলি
এবং আমার প্রিয় তীরভূমিকে তা দিয়েছি উপহার।
নীরবতার ভেতরে সে তা গ্রহণ করেছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত
আমি তাকে উপহার দিই কারণ সবসময়ই সে আমাকে
অভ্যর্থনা জানায়।
রাত্রির বিমর্ষতার ভেতরে যখন সমস্ত প্রাণী
অনুসন্ধান করে সুখনিদ্রার ভূত, তখন আমি জেগে
বসে থাকি, একবার গান গাই এবং আর একবার দীর্ঘশ্বাস
ফেলি। আমি সারাক্ষণ জেগে আছি।
হায়, ঘুমহীনতা আমাকে জাগিয়ে রেখেছে!
কিন্তু আমি একজন প্রেমিক এবং ভালোবাসার সত্য
খুবই কঠিন।
আমি ক্লান্ত হতে পারি কিন্তু আমার মৃত্যু হবে না।
.
একজন কবির মৃত্যু হচ্ছে তার জীবন
রাত্রির পাখাগুলি উন্মোচিত করল শহরটাকে এবং তার ওপর প্রকৃতি বিছিয়ে দিল শুদ্ধ ও শুভ্র বরফের পোশাক এবং মানুষ রাস্তাগুলো পরিত্যাগ করল, কারণ তাদের বাড়িগুলি খুঁজে ফিরছিল উষ্ণতা, যখন উত্তুরে বাতাস ধ্যানের ভেতরে অনুসন্ধান করছিল বাগানে শুয়ে থাকা বর্জ্যগুলি। বরফে ভারাক্রান্ত একটা প্রাচীন কুঁড়েঘর দাঁড়িয়েছিল শহরতলিতে। যে- কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। কুঁড়েঘরের ভেতরে জীর্ণ বিছানায় শুয়েছিল মৃত্যুপথযাত্রী এক যুবক। তার বাতির অনুজ্জ্বল আলো বাতাসে মিটমিট করে জ্বলছিল। সে ছিল জীবনের বসন্তকালের এমন একজন মানুষ যে আগে থেকে পুরোপুরি জানত জীবনের দৃঢ়মুষ্টি থেকে নিজেকে মুক্ত করার শান্তিপূর্ণ সময় সম্পর্কে, যা দ্রুত তার কাছে আসছিল। সে মনোরম মৃত্যুর পরিদর্শনের অপেক্ষা করছিল এবং তার বিবর্ণ মুখের ওপর আবির্ভূত হচ্ছিল ভোরের প্রত্যাশা এবং তার ঠোঁটে ছিল দুঃখ-মেশানো হাসি এবং চোখে ছিল ক্ষমা।
সে ছিল একজন কবি এবং ধনীদের এই শহরে সে ক্ষয়ে যাচ্ছিল ক্ষুধার কারণে। মানুষের হৃদয়কে তার সৌন্দর্য ও প্রগাঢ় কথোপকথনের মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য তাকে এই জাগতিক পৃথিবীতে স্থাপন করা হয়েছিল। সে ছিল একটা মহৎ আত্মা। উপলব্ধির দেবী তাকে পাঠিয়েছে, মানুষের আত্মাকে কোমল ও শান্ত করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে সে আনন্দের সঙ্গে ঠাণ্ডা পৃথিবীকে বিদায় জানাল বিস্ময়কর দখলকারীর কাছ থেকে কোনো হাসি উপহার পাওয়া ছাড়াই।
সে তার শেষ শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করছিল এবং তারপাশে কেউ ছিল না বাতিটা রক্ষা করতে, যা ছিল তার একমাত্র সংগীত এবং লেখার উপযোগী করে তৈরি করা পশুচর্ম যার ওপর সে উৎকীর্ণ করেছিল হৃদয়ের অনুভূতিগুলি। সে তার ক্ষয়ে-আসা শক্তির অবশিষ্টাংশ উদ্ধার করতে দু’হাত স্বর্গের দিকে তুলল, আশাহত মানুষের মতো তাকাল চারদিকে, যেন সে মেঘের অবগুণ্ঠনের পেছন থেকে নক্ষত্র দেখার জন্য ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যেতে চায়।
সে বলল, ‘এসো হে মনোরম মৃত্যু আমার আত্মা তোমার অপেক্ষা করছে। আমার খুব কাছে এসো এবং জীবনের কঠোরতা থেকে আমাকে মুক্ত করো, কারণ আমি ওগুলি অনুসরণ করতে করতে ক্লান্ত। এসো হে আমার সুমধুর মৃত্যু, আমাকে সরবরাহ করো আমার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যারা আমাকে একজন আগন্তুক বলে মনে করে, কারণ আমি তাদেরকে দেবদূতের ভাষা ব্যাখ্যা করে থাকি। হে শান্তিময় মৃত্যু আরও দ্রুততার সঙ্গে এসো এবং আমাকে বহন করে নিয়ে যাও এই জনারণ্য থেকে যারা আমাকে বিস্মৃতির অন্ধকার কোনায় আমাকে অতিক্রম করে যায়। কারণ, আমি দুর্বলদেরকে রক্তাক্ত করি না, যা তারা করে থাকে। হে বিনয়ী মৃত্যু দ্রুত এসো এবং তোমার শুভ্র পাখা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরো, কারণ আমার সহকর্মীরা আমাকে চায় না। হে মৃত্যু, আমাকে আলিঙ্গন করো পরিপূর্ণ ভালোবাসা ও ক্ষমার ভেতরে, তোমার ওষ্ঠকে স্পর্শ করতে দাও আমার ওষ্ঠ যে কখনও মায়ের চুম্বনের স্বাদ গ্রহণ করেনি, স্পর্শ করেনি কোনো বোনের কপোল, আদর করেনি কোনো প্রেমিকার আঙুলের ছাপ। এসো এবং আমাকে গ্রহণ করো হে আমার অত্যন্ত প্রিয় মৃত্যু।’
তখন মৃত্যুপথযাত্রী এই কবির শয্যাপাশে একজন দেবদূত আবির্ভূত হল, যার ছিল অলৌকিক ও ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। তার হাতে ছিল একগুচ্ছ পদ্মফুল জড়ানো। সে তাকে আলিঙ্গন করল এবং বন্ধ করে দিল কবির চোখ যেন সে আর দেখতে না পায় শুধুমাত্র আত্মার চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া। দেবদূত, একটা কোমল, গভীর ও দীর্ঘ চুম্বনের ছাপ এঁকে দিল যা পরিত্যক্ত হল তার ওষ্ঠের ওপর পরিপূর্ণতার চিরন্তন হাসি হিসেবে। তারপর কুঁড়েঘরটি শূন্য হয়ে গেল এবং সেখানে কিছুই থাকল না শুধু কাগজ ছাড়া যা সে ছড়িয়ে দিয়েছিল তিক্ত নিষ্ফলতার মতো।
হাজার বছর পর, এই শহরের লোকেরা অজ্ঞতার রোগে আক্রান্ত সুখনিদ্রা থেকে জেগে উঠল এবং দেখতে পেল জ্ঞানের ভোরবেলা। তারা শহরের সবচেয়ে সুন্দর বাগানে স্থাপন করল একটা স্মৃতিসৌধ এবং প্রতিবছর সেই কবির সম্মানে আয়োজন করল ভোজ- উৎসবের, যার রচনা তাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। হায়! কী নিষ্ঠুর মানুষের অজ্ঞতা।
.
শান্তি
গাছের শাখাগুলি বাঁকা হয়ে যাওয়ার পর ঝড় থামল এবং শাখাগুলি নুয়ে পড়ল শস্যক্ষেতের ভেতরে। আলোর ভগ্নাংশ হিসেবে নক্ষত্র আবির্ভূত হল কিন্তু নীরবতা সাফল্যের সঙ্গে নেমে এল সবকিছুর ওপর যেন প্রকৃতির যুদ্ধ কখনই সংঘটিত হয়নি। সে সময় এক যুবতী নারী তার ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে প্রচণ্ডভাবে ফোঁপাতে লাগল। মর্মবেদনায় তার হৃদয় জ্বলে উঠল কিন্তু অবশেষে সে তার মুখ খুলল এবং বলল, ‘হে প্রভু, তাকে নিরাপদে আমার ঘরে, আমার কাছে ফিরিয়ে আনুন। আমি কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে গেছি। হে প্ৰভু, এখন আমি আর কাঁদতেও পারছি না। হে প্ৰভু আপনি ভালোবাসা ও ক্ষমায় পরিপূর্ণ। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে এবং চরম দুর্দশা আমার হৃদয়ে জায়গা অনুসন্ধান করছে। রক্ষা করুন তাকে হে প্রভু,যুদ্ধের লৌহকঠিন থাবা থেকে, দান করুন তাকে করুণাহীন মৃত্যু, কারণ সে দুর্বল। তাকে শাসন করুন শক্তিশালীর দ্বারা। হে প্রভু, আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষকে আপনি রক্ষা করুন, যে আপনার নিজের পুত্র, শত্রুর চেয়েও যে আপনার বড় শত্রু। রক্ষা করুন তাকে সেই পথ থেকে, যে পথে বাধ্য হয়ে মৃত্যুর দরজার দিকে যেতে হয়। আমাকে দেখতে দিন তাকে অথবা আসুন এবং আমাকে নিয়ে যান তার কাছে।’
শান্তভাবে একজন যুবক সেই ঘরে প্রবেশ করল। তার মাথা ছিল একটা ব্যান্ডেজে মোড়ানো যা রক্তে ভিজে গিয়েছিল পালানোর প্রচেষ্টার কারণে।
যুবকটি তার কাছাকাছি হল অশ্রু ও উচ্চহাসির সম্ভাষণের মাধ্যমে, তারপর তার হাত ধরল এবং স্থাপন করল তা নিজের জ্বলন্ত ওষ্ঠে এবং একটি কণ্ঠস্বর যা নির্দেশমাফিক তৈরি করল অতীতের দুঃখ এবং মিলনের উল্লাস এবং যুবতীর প্রতিক্রিয়ার অনিশ্চয়তা, সে বলল: আমাকে ভয় পেয়ো না, আমি তোমার কৈফিয়তের বিষয়বস্তু নই। আনন্দিত হও, কারণ শান্তি আমাকে নিরাপদে পেছনে নিয়ে গেছে তোমার কাছে এবং মানবতা সংরক্ষণ করেছে লোভ যা আমাদের কাছ থেকে পাবার চেষ্টা করে। বেদনার্ত হয়ো না, হাসো হে আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। বিভ্রান্তি সৃষ্টি কোরো না, কারণ ভালোবাসার ক্ষমতা আছে যা মৃত্যুকে দূর করে দেয়, প্রীতিকর বৈশিষ্ট্য আছে যা শত্রুকে জয় করে। আমি হলাম তোমার এবং একজন। আমাকে ভূত ভেবো না, যে মৃত্যুর বাসগৃহ থেকে উদ্ভূত হয়েছে তোমাদের সৌন্দর্যের গৃহ পরিদর্শন করতে।
‘ভীত হয়ো না কারণ আমি হলাম এখন সত্য যা অস্ত্রের থেকেও ক্ষতিকর এবং আগুন যা যুদ্ধের ওপর ভালোবাসার সাফল্যকে মানুষের কাছে প্রকাশ করে। আমি হলাম সেই শব্দাবলি যা শান্তি ও ভালোবাসার খেলায় উপস্থাপন করে ভূমিকা।’
তারপর যুবকটি বক্তব্যহীন হয়ে পড়ল এবং তার অশ্রু বলল তার হৃদয়ের কথা এবং দেবদূতের উল্লাস বসতির ওপরে বাতাসে স্থির হয়ে ভেসে থাকল এবং দুটি হৃদয় একত্বকে সংরক্ষণ করল যা তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল।
ভোরবেলা দুজনেই শস্যক্ষেতের মাঝখানে দাঁড়াল এবং গভীরভাবে চিন্তা করল প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্পর্কে যা ঝড়ে আহত হয়েছিল। একটা গভীর ও আয়েশী নৈঃশব্দের পর সৈনিকটি পূর্বদিকে তাকাল এবং তার প্রিয়তমাকে বলল, ‘অন্ধকারের দিকে তাকাও যে সূর্যের জন্ম দিচ্ছে।’
.
অপরাধী
শক্তিশালী এক যুবক ক্ষুধার কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সে বসেছিল মানুষ চলাচলের রাস্তার ওপর এবং হাতদুটো বাড়িয়ে রেখেছিল চলাচলরত মানুষের দিকে। সে ভিক্ষা করছিল এবং বারবার গাইছিল তার পরাজিত জীবনের বেদনার্ত সঙ্গীত, বিশেষ করে যখন সে ক্ষুধা এবং অপমানে কষ্ট পাচ্ছিল।
যখন রাত্রি এল তখন তার ঠোঁট এবং জিভ শুকিয়ে গেল, যদিও তার হাত ছিল পাকস্থলীর মতোই শূন্য।
সে নিজের সবকিছু একত্রিত করে শহর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর সে একটা গাছের নিচে বসে প্রচণ্ডভাবে কাঁদতে লাগল। সে তার অস্থির চোখ স্বর্গের দিকে তুলল যখন ক্ষুধা তার ভেতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। সে বলল, ‘হে প্রভু, আমি ধনীলোকদের কাছে গিয়ে একটা চাকরি চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই মুখ ফিরিয়ে নিল আমার মলিনতার জন্য। আমি স্কুলের দরজায় কড়া নেড়েছিলাম, কিন্তু সান্ত্বনাও আমার জন্য নিষিদ্ধ ছিল, কারণ আমার হাত ছিল শূন্য। আমি সন্ধান করেছিলাম যেকোনো পেশা যা আমার আহার জোগাবে, কিন্তু কোনোকিছুই অর্জিত হয়নি। বেপরোয়া হয়ে আমি ভিক্ষা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার প্রার্থনাকারীরা আমাকে দেখে ফেলল এবং বলল, ‘সে শক্তিশালী, অলস এবং তার ভিক্ষা করা উচিত নয়।’
‘হে প্রভু, এটা হচ্ছে তোমার ইচ্ছা যা আমার মা আমার ভেতরে জন্ম দিয়েছিল এবং এখন পৃথিবী আমাকে প্রস্তাব দেয় তোমাকে ফিরিয়ে দিতে সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই। তারপর তার অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হয়। সে উঠে দাঁড়ায় এবং তার চোখ এখন দৃঢ় সংকল্পে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে গাছের ডাল কেটে একটা মোটা ও ভারী ছড়ি তৈরি করে এবং তা শহরের দিকে তাক করে সে চিৎকার করে বলতে থাকে: ‘আমি আমার কণ্ঠের সমস্ত শক্তি দিয়ে একটা রুটি চেয়েছি এবং প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। এখন আমি তা অর্জন করব আমার পেশির শক্তি দিয়ে। আমি ভালোবাসা ও ক্ষমার নামে একটা রুটি চেয়েছিলাম কিন্তু মানবতা তাতে কর্ণপাত করেনি। আমি এখন শয়তানের নামে সবকিছু গ্রহণ করব।’
অতিক্রান্ত বছরগুলি একজন যুবককে উপস্থাপন করল ডাকাত, খুনী এবং আত্মার ধ্বংসকারী হিসেবে। যে তাকে অস্বীকার করেছে তাকেই সে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছে। সে পুঞ্জীভূত করেছে অবিশ্বাস্যরকমের সম্পদ এবং সেই সম্পদের সাহায্যে সে অর্জন করেছে ক্ষমতা। তার সহকর্মীরা তাকে প্রশংসা করে, অন্য চোররা হিংসা করে এবং জনগণ ভীত হয়।
তার ধনী হয়ে ওঠা এবং তার ভুয়া প্রতিষ্ঠা ও সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে শহরের আমির তাকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেন— এই বেদনার্ত প্রক্রিয়ায় একজন অজ্ঞ গভর্নর তাকে তাড়া করে ফেরে। তারপর চুরি বৈধ হয়ে গেল। নিপীড়ন সমর্থন পেতে শুরু করল কর্তৃপক্ষের, দুর্বলকে নির্যাতন করা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হল আর জনারণ্যে তোষামোদ অনুগ্রহ ও প্রশংসা পেল।
এভাবে মানবতার স্বার্থপরতার প্রথম স্পর্শ অপরাধীকে বিনয়ী করে তুলল এবং খুনীকে করে তুলল শান্তির পুত্রসন্তান। এভাবে মানবতার প্রাথমিক লোভ বেড়ে উঠল এবং আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তা ফিরে গেল মানবতার সহস্র ভাঁজের ভেতরে।
.
জীবনের খেলার মাঠ
একটি ঘণ্টা নিয়োজিত হয়েছিল সৌন্দর্যকে ধাওয়া করতে
এবং ভালোবাসা হচ্ছে একটি পূর্ণ শতাব্দীর মহিমার বিশিষ্ট মূল্য,
যা প্রদান করেছে আতঙ্কিত দুর্বল সবলের প্রতি।
সেই সময় থেকে এল মানুষের সত্য এবং সেই
শতাব্দী থেকে সত্য ঘুমায় বিঘ্নিত স্বপ্নের ক্লান্তিহীন
বাহুর ভেতরে।
সেই সময় থেকে আত্মা দেখতে শুরু করল নিজের জন্য
প্রাকৃতিক আইন এবং সেই শতাব্দীর সত্য
নিজেকে কারারুদ্ধ করল মানুষের আইনের পেছনে
এবং সে শৃঙ্খলিত হল লৌহকঠিন নিপীড়নের কাছে।
সেই সময় ছিল সলোমনের সংগীতের প্রেরণা এবং সেই
শতাব্দী ছিল অন্ধ ক্ষমতায় পরিপূর্ণ, যা বালবেক-এর
মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছিল।
সেই সময় ছিল পাহাড়ের ওপরে হিতপোদেশের কাল
এবং সেই শতাব্দী ধ্বংস করেছিল ব্যাবলিনের স্মৃতিস্তম্ভ এবং
পালমীরার প্রাসাদ।
সেই সময় ছিল মোহাম্মদ (সা.) -এর হিজরত এবং সেই
শতাব্দী ছিল আল্লাহ, গোলগোথা এবং সিনাইকে ভুলে যাওয়া।
একটি ঘণ্টা নিয়োজিত ছিল শোকে ও বিলাপে এবং
দুর্বলের চুরির সমযোগ্যতা লোভ ও জরবদখলে পরিপূর্ণ একটি
শতাব্দীর চেয়ে অধিক মহৎ।
এটা হল সেই সময় যখন দুঃখের অগ্নিশিখায় হৃদয়
পরিশুদ্ধ হয় এবং উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ভালোবাসার আলো।
এবং সেই শতাব্দীতে সত্যের জন্য আকাঙ্ক্ষা
সমাহিত হয় মৃত্তিকার বুকের ভেতরে
সেই সময় হল একটা শিকড় যা অবশ্যই বেড়ে ওঠে।
সেই সময় হল একটা গভীর চিন্তা ও ধ্যানের সময়,
প্রার্থনার সময় এবং সেই সময় হল ভালোবাসার নতুন যুগ।
এবং সেই শতাব্দী হল আত্ম-বিনিয়োগের ওপর নীরোর জীবন অতিবাহিত করার
কাল, এককভাবে যা গৃহীত
হয়েছিল জাগতিক বস্তুগুলি থেকে।
এই হল জীবন
মঞ্চের ওপর চিত্রায়িত হয়েছে যুগের জন্য,
গতিকভাবে নথিবদ্ধ শতাব্দীর জন্য,
বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার ভেতরে বেঁচেছে বছরগুলির জন্য
গীত হয়েছে স্ত্রোত্রগীত হিসেবে দিনগুলির জন্য।
এই সবকিছুই মর্যাদাসম্পন্ন হয়েছিল কিন্তু একটি ঘণ্টা,
মূল্যবান অলঙ্কার হিসেবে যা রক্ষিত হয়েছিল অনন্তকালের মাধ্যমে।
.
সৌভাগ্যসংগীত
মানুষ এবং আমি হচ্ছি প্ৰেমাস্পদ
সে আমাকে ব্যাকুলভাবে কামনা করে এবং
তার জন্য আমারও আকুল আকাঙ্ক্ষা,
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের ভেতরে
আবির্ভূত হয়েছে এক প্রতিন্দন্দ্বী
যে আমাদেরকে বহন করে নিয়ে যায়
দুর্দশার দিকে।
সে নিষ্ঠুর এবং তার চাহিদা প্রচুর
সে কেবলই দেখায় শূন্য প্রলোভন,
তার নাম বস্তুসমূহ
আমরা যেখানে যাই সেখানেই সে আমাদের
অনুসরণ করে এবং পাহারা দেওয়ার মতো
সারাক্ষণ করে পর্যবেক্ষণ,
বহন করে আনে ক্লান্তিহীনতা আমার
প্রেমিকার জন্য।
আমি প্রার্থনা করি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষের জন্য
বনভূমির ভেতরে, একটি গাছের তলায়
একটা লেকের পাশে।
আমি তাকে খুঁজে পাই না, কারণ বস্তুসমূহ
তাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে ভয়ংকর কোলাহলপূর্ণ
নগরীতে এবং তাকে স্থাপন করেছে হাতুড়ে বিদ্যার সিংহাসনে
যা লৌহে সমৃদ্ধ।
আমি জ্ঞানীর কণ্ঠস্বর এবং বিচক্ষণতার সংগীতে তাকে আহ্বান জানাই।
সে মোটেও কর্ণপাত করে না, কারণ বস্তুসমূহ
তাকে প্ররোচিত করেছে স্বার্থপরতার ভূগর্ভস্থ
অন্ধকারে নেমে যেতে, যেখানে বসবাস করে বিষয়লালসা
আমি তাকে অনুসন্ধান করি পরিতৃপ্তির মাঠে
কিন্তু আমি সেখানে একাকী, কারণ
আমার প্রতিদ্বন্দ্বী তাকে বন্দি করে রেখেছে লোভ এবং
অতিভোজনের গুহায় এবং বেঁধে রেখেছে
বেদনাদায়ক স্বর্ণের শৃঙ্খলে।
আমি তাকে আহ্বান জানাই ভোরবেলা যখন
প্রকৃতি হাসে,
কিন্তু সে তা শুনতে পায় না, কারণ অতিরিক্ত
বোঝা সুখনিদ্রায় পীড়িত চোখকে নেশাসক্ত করে তুলেছে।
সন্ধ্যায় আমি তাকে প্রতারিত করি যখন
নীরবতা শাসন করে এবং ফুলগুলি ঘুমায়।
কিন্তু সে কোনো উত্তর দেয় না, কারণ তার ভয়
আগামীকাল কী বহন করে আনবে?
তার চিন্তার ছায়াদেরকে?
আমাকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সে ক্লান্ত এবং
সে আমার জন্য প্রার্থনা করে নিজের কর্মকাণ্ডের ভেতরে,
কিন্তু ঈশ্বরের কর্মকাণ্ডের ভেতরে ছাড়া সে আমাকে
খুঁজে পাবে না।
সে তার মহিমার অট্টালিকার ভেতরে আমাকে
অনুসন্ধান করে, যা সে নির্মাণ করেছে অন্যদের হাড়ের ওপর,
সে তার রাশি রাশি সোনা ও রূপার মাঝখানে বসে
আমার কানে ফিসফিস করে।
কিন্তু সে আমাকে খুঁজে পাবে শুধুমাত্র সারল্যের
বাসগৃহে এসে, ঈশ্বর যা নির্মাণ করেছেন প্রেমের
স্রোতোধারার প্রান্তসীমায়।
তার আকাঙ্ক্ষা তার রত্নভাণ্ডারের সামনে আমাকে
চুম্বন করার, কিন্তু তার ঠোঁট কখনও আমার ওষ্ঠ
স্পর্শ করবে না ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসের প্রাচুর্য ছাড়া।
সে চায় আমি তার অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ তার সাথে
ভাগাভাগি করি, কিন্তু আমি ঈশ্বরের সৌভাগ্যকে খাতির
করব না, পরিত্যাগ করব না সৌন্দর্যের ছদ্মবেশ।
সে মাধ্যমের জন্য প্রবঞ্চনা অনুসন্ধান করে,
আর আমি অনুসন্ধান করি তার হৃদয়ের মাধ্যম
সংকীর্ণ কক্ষের ভেতরে সে তার হৃদয়কে ভেঙে ফেলে
আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার হৃদয়কে সমৃদ্ধ করব।
আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ শিখে গেছে কীভাবে আমার
শত্রুর জন্য তীক্ষ্ণকণ্ঠে কাঁদতে ও চেঁচাতে হয়। বস্তুসমূহ,
আমি তাকে শিক্ষা দেব কীভাবে প্রেম ও ক্ষমার জন্য
রক্ত ঝরাতে হয় আত্মার চোখ থেকে সবকিছুর জন্য
এবং উচ্চারণ করতে হয় পরিতৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ওইসব
অশ্রুজলের ভেতর দিয়ে।
মানুষ হচ্ছে আমার প্রেমাস্পদ
আমিও তার প্রেমাস্পদ হয়ে থাকতে চাই।
.
মৃতের শহর
গতকাল আমি পীড়াদায়ক ভিড়ের ভেতর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম এবং এগিয়ে যাচ্ছিলাম মাঠের দিকে যতক্ষণ-না ছোট্ট পাহাড়ের কাছে গিয়ে পৌঁছলাম, যার ওপরে প্রকৃতি তার মনোরম পোশাকগুলি ছড়িয়ে দিয়েছিল। এখন আমি শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারব।
আমি পেছনে তাকালাম, চমৎকার মসজিদগুলিসহ শহর আবির্ভূত হল আমার সামনে এবং দৃষ্টিনন্দন বাড়িগুলির ওপর অবগুণ্ঠন পরাল দোকানপাট থেকে উত্থিত ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
আমি বিশ্লেষণ করতে শুরু করলাম বিশেষ দায়িত্ব, কিন্তু শুধুমাত্র এই সমাধানে পৌঁছালাম যে, অধিকাংশের জীবন কেটেছে সংগ্রাম ও কঠোরতার ভেতর দিয়ে। তারপর আমি মোটেও ভাবতে চেষ্টা করলাম না আদমের পুত্র কী করেছিল এবং আমার চোখকে শস্যক্ষেতের দিকে ফেরালাম যা হচ্ছে ঈশ্বরের মহিমার সিংহাসন। ক্ষেতের নিভৃত এক কোণে আমি দেখতে পেলাম পপলার গাছে ঘেরা একটা সমাধিক্ষেত্র।
সেখানে মৃত ও জীবন্তের মাঝখানে—আমি চিন্তা করে দেখলাম প্রথম হচ্ছে চিরন্তন নীরবতা এবং দ্বিতীয় হচ্ছে সীমাহীন দুঃখ।
জীবন্তের শহরে আমি লক্ষ্য করলাম আকাঙ্ক্ষা ও হতাশা, ভালোবাসা ও ঘৃণা, আনন্দ ও দুঃখ, সম্পদ এবং দারিদ্র্য, বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতা।
মৃতের শহরে সেখানে, মৃত্তিকায় মৃত্তিকা সমাহিত যা প্রাকৃতিকভাবে রূপান্তরিত হয়, রাত্রির নীরবতায় বৃক্ষলতার ভেতরে এবং তারপর বন্য প্রাণীর ভেতরে এবং তারপর মানুষের ভেতরে। এরকম সৃষ্টিতে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, আমি দেখেছিলাম ধীরগতিতে এবং শ্রদ্ধাশীলভাবে একটা মিছিল চলছে, সেইসঙ্গে হালকা সংগীত যা আকাশকে বিষাদের সুরে পূর্ণ করে তুলেছিল। এটা ছিল একটা বিস্তৃত অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান। মৃতকে অনুসরণ করছিল জীবন্তেরা এবং কাঁদছিল ও বিলাপ করছিল তার চলে যাওয়ার জন্য। শবাধারের অনুগমনকারীরা যখন সমাধিস্থলে পৌঁছাল, যাজক তখন প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। পুড়তে লাগল ধূপ এবং সংগীতজ্ঞরা তুলে নিলেন তাদের যন্ত্র—বিলাপের চিহ্নমাত্র থাকল না। তারপর নেতারা একের-পর-এক সামনে এল এবং পছন্দমতো শব্দ বেছে নিয়ে প্রত্যেকেই উচ্চপ্রশংসা করল।
সবশেষে মানুষের ভিড় কমে গেল, পরিত্যাগ করে গেল মৃত্যুকে সবচেয়ে সুন্দর ভূগর্ভস্থ কক্ষে বিশ্রাম নেবার জন্য, যা নিপুণ হাতে লোহা এবং পাথর দিয়ে তৈরি এবং সবচেয়ে দামি ফুল দ্বারা বেষ্টিত।
বিদায় সংবর্ধনার আদেশদানকারী শহরে ফিরে গেল এবং আমি রয়ে গেলাম, দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম দিগন্তের ওপর সূর্যের নেমে আসা এবং প্রকৃতি সুখনিদ্রার জন্য গ্রহণ করছিল বহুধরনের প্রস্তুতি।
তারপর আমি দেখলাম দুজন শ্রমিক একটা কাঠের বাক্সের ওজন বহন করছে এবং তার পেছনে একজন জরাজীর্ণ চেহারার নারী একটা নবজাত শিশুকে বহন করছে তার বাহুতে। তাকে অনুসরণ করছে একটা কুকুর যে তার হৃদয়বিদারক চোখ দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে একবার নারীর দিকে, তারপর বাক্সের দিকে তাকাল।
এটা ছিল খুবই সাদাসিধে একটা অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান। মৃত্যুর অতিথি ঠাণ্ডা সমাজের উদ্দেশে জাগতিক পৃথিবী পরিত্যাগ করে যায় একজন দুস্থ স্ত্রী এবং নবজাতককে তার বেদনা ভাগাভাগি করার জন্য এবং একটি বিশ্বাসী কুকুর, যার হৃদয় তার সঙ্গীর চলে যাওয়া সম্পর্কে জানত।
তারা সমাধিক্ষেত্রে পৌঁছে বাক্সটাকে একটা গর্তের ভেতরে নামাল এবং এই গর্তটা ছিল পরিচর্যাকৃত ঝোপঝাড় এবং মর্মরপাথর থেকে বেশকিছুটা দূরে। তারপর তারা ঈশ্বরের উদ্দেশে কয়েকটি সামান্য শব্দ উচ্চারণ করে ফিরে এল। কুকুরটা শেষবার ঘুরে তাকাল তার বন্ধুর কবরের উদ্দেশে, তারপর ছোট্ট দলটি গাছের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি জীবন্তের শহরের দিকে তাকালাম এবং নিজেকে বললাম, ‘ওই জায়গাটা সামান্য কিছু লোকের জন্য।’ তারপর তাকালাম মৃত্যুর সুশৃঙ্খল শহরের দিকে এবং বললাম, ‘ওই জায়গাটাও সামান্য কিছু লোকের জন্য। হে প্রভু, সব মানুষের স্বর্গটা কোথায়?’ এসব বলার সময় আমি মেঘের দিকে তাকালাম যা ছিল সূর্যের সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সবচেয়ে সুন্দর সোনালি রশ্মিতে মিলেমিশে একাকার এবং আমি নিজের ভেতরে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলাম, সে বলছে, ‘ওইখানে।’
.
বৃষ্টির গান
আমি হলাম ঈশ্বর কর্তৃক স্বর্গ থেকে খসে পড়া চিহ্নিত রুপালি সুতো। তারপর
প্রকৃতি আমাকে গ্রহণ করে তার শস্যক্ষেত ও উপত্যাকাগুলি সাজাতে।
আমি হলাম ভোরবেলার কন্যা কর্তৃক ইসতার এর
রাজমুকুট থেকে আহরিত মুক্তা, বাগানগুলিকে সাজাতে।
যখন আমি কাঁদি তখন পাহাড়গুলি হাসে,
যখন আমি নিজের প্রতি বিনয়ী হই তখন পুষ্পগুচ্ছ আহ্লাদিত হয়,
যখন আমি অভিবাদন জানাই তখন অনুপ্রাণিত হয় যাবতীয় জিনিস।
শস্যক্ষেত এবং মেঘেরা হল প্রেমাস্পদ
এবং তাদের ভেতরে আমি হলাম ক্ষমার বার্তাবাহক।
আমি একজনের তৃষ্ণা নিবারণ করি,
অন্যজনের অসুস্থতা সারাই।
বিদ্যুতের ধ্বনি আমার আগমন ঘোষণা করে
রংধনু ঘোষণা করে আমার প্রস্থান,
আমি হলাম, জাগতিক ও জীবনের মতো, যা শুরু হয়
অপ্রকৃতস্থ উপাদানসমূহের পায়ের পাতায় এবং
সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর ঊর্ধ্বমুখী পাখার তলায়।
আমি উদ্ভূত হই সমুদ্রের হৃদয় থেকে এবং আকাশের
অনেক উঁচুতে উড়ি মৃদুমন্দ বাতাসে, যখন প্রয়োজনের
ভেতরে একটা শস্যক্ষেত দেখি তখনই নেমে আসি এবং
আলিঙ্গন করি ফুলগুলি এবং লক্ষ লক্ষ ছোট ছোট
পথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলোকে।
আমি আমার কোমল আঙুল দিয়ে মৃদু স্পর্শ করি জানালাগুলো
এবং আমার ঘোষণা হচ্ছে একটা অভ্যর্থনা-সঙ্গীত।
প্রত্যেকেই শুনতে পারে, কিন্তু
সংবেদনশীলরাই শুধুমাত্র তা উপলব্ধি করতে পারে।
যে উত্তাপ বাতাসের ভেতরে আমাকে জন্ম দেয়
কিন্তু পরিবর্তে আমি তাকে হত্যা করি, যেমন নারী
পুরুষকে অতিক্রম করে সেই শক্তি দিয়ে,
যা সে গ্রহণ করে পুরুষের কাছ থেকে।
আমি হলাম সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস,
শস্যক্ষেতের উচ্চহাসি,
স্বর্গের অশ্রুজল।
সুতরাং ভালোবাসার সঙ্গে-
প্রেমের গভীর সমুদ্র থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেল,
আত্মার রঙিন শস্যক্ষেত থেকে হাসো উচ্চহাসি
এবং স্মৃতির সীমাহীন স্বর্গ থেকে বেরিয়ে আসুক অশ্রুজল।
.
বিধবা এবং তার পুত্র
উত্তর লেবাননে রাত্রি নেমেছে এবং কাদিসা উপত্যকা-বেষ্টিত গ্রামগুলি ঢেকে গেছে বরফে এবং সশ্যক্ষেত ও তৃণভূমিকে এমন এক চেহারা দান করেছে যেন বিশাল একটা পার্চমেন্ট (লেখার উপযোগী করে তৈরি করা পশুর চামড়া), যার ওপর হিংস্র প্রকৃতি নথিবদ্ধ করছিল তার বহুধরনের চুক্তিনামা। রাস্তা থেকে মানুষেরা ঘরে ফিরে এল যখন নীরবতা রাত্রিকে গ্রাস করে নিল।
ঐসব গ্রামের কাছাকাছি একটা নির্জন বাড়িতে একজন নারী বসবাস করত, যে তখন আগুনের পাশে বসে উলের পোশাক বুনছিল এবং পাশেই ছিল তার একমাত্র সন্তান।
বজ্রের ভয়াবহ শব্দ হঠাৎ বাড়িটাকে প্রকম্পিত করে তুলল এবং ছোট্ট শিশুটা আতঙ্কিত হল। সে মায়ের উদ্দেশে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করল এবং প্রকৃতি থেকে সে নিরাপত্তা অনুসন্ধান করল মায়ের স্নেহের ভেতরে। ছেলেটিকে মা বুকে তুলে নিয়ে চুম্বন করল এবং তারপর কোলে বসিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়ো না হে পুত্র আমার, কারণ প্রকৃতি মানুষের দুর্বলতার সঙ্গে তার বিশাল শক্তিকে তুলনা করছে। এই ঝরে পড়া বরফের ওপরে আছে সর্বময় সত্তা, বিশাল মেঘমালা এবং প্রবহমান বাতাস এবং সেই সর্বময় ক্ষমতা জানেন পৃথিবীর প্রয়োজন, কারণ তিনি তা তৈরি করেছেন এবং তিনিই তার ক্ষমাসুন্দর চোখ দিয়ে দুর্বলদেরকে বিবেচনা করেন।
‘হে আমার পুত্র সাহসী হয়ে ওঠে। প্রকৃতি বসন্তে হাসে মৃদুহাসি এবং উচ্চহাসি হাসে গ্রীষ্মকালে এবং শরৎকালে হাই তোলে, কিন্তু এখন সে কাঁদছে এবং সেই অশ্রুজলে ভিজিয়ে দিচ্ছে জীবনকে যা মাটির ভেতরে লুকানো আছে।
‘ঘুমিয়ে পড়ো, হে আমার পুত্র, তোমার পিতা অনন্তকাল আমাদেরকে লক্ষ্য করছেন।
এই বরফ এবং বজ্রপাত এসময় আমাদেরকে তার খুব কাছে নিয়ে যাবে।
‘হে আমার প্রিয়পুত্র, ঘুমিয়ে পড়ো, কারণ এই সাদা চাদর যা আমাদেরকে ঠাণ্ডা করে তোলে, বীজগুলিকে উষ্ণ রাখে এবং এই যুদ্ধংদেহী কর্মকাণ্ড জন্ম দেবে অনেক সুন্দর ফুলের।
‘হে আমার শিশু, মানুষ ভালোবাসাকে চয়ন করতে পারে না যতক্ষণ-না দুঃখ, পৃথকীকরণ, ভয়াবহ ধৈর্য এবং বেপরোয়া কঠিন জীবনযাপন প্রকাশিত হয়। ঘুমিয়ে পড়ো হে আমার ছোট্ট শিশু, মধুর স্বপ্ন তোমার আত্মাকে খুঁজে নেবে যে এই রাত্রির ভয়াবহ অন্ধকার এবং ঠাণ্ডার কারণে সৃষ্ট ক্ষতের ব্যাপারে মোটেও ভীত নয়।’
ঘুমে ভারাক্রান্ত চোখ নিয়ে শিশুটা তার মায়ের দিকে তাকাল এবং বলল, ‘মা আমার চোখদুটো ঘুমে ভারী হয়ে গেছে কিন্তু প্রার্থনা না করে আমি ঘুমাতে যেতে পারছি না।’ নারীটি তখন তার ছেলের দিকে তাকাল যে অনেকটা দেবদূতের মতো। তার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে এল ধোয়াসাছন্ন চোখের কারণে এবং সে বলল, ‘আমার সঙ্গে বলো হে পুত্র— ঈশ্বর গরিবদেরকে ক্ষমা করুন এবং রক্ষা করুন তাদেরকে শীত থেকে, আপনার ক্ষমাশীল হাত দিয়ে তাদের পাতলা পোশাকে সজ্জিত শরীরটাকে গরম রাখুন, চেয়ে দেখুন এতিমদেরকে, যারা জীর্ণ কুটিরে ঘুমাচ্ছে এবং সংগ্রাম করছে ক্ষুধা ও ঠাণ্ডার সঙ্গে। ঈশ্বর, এটা হল একজন বিধবার আহ্বান যে অসহায় এবং ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে তার সন্তানের জন্য। হে ঈশ্বর, সমস্ত মানুষের হৃদয়কে উন্মুক্ত করুন যেন তারা সমস্ত দুর্বলের দুর্দশা দেখতে পারে। ভুক্তভোগীদের ক্ষমা করুন, যারা দরজায় কড়া নাড়ে এবং পথিকদেরকে উষ্ণ জায়গায় যেতে নেতৃত্ব দেয়। হে ঈশ্বর, লক্ষ্য করুন ছোট ছোট পাখিদের এবং রক্ষা করুন শস্যক্ষেত ও গাছপালাকে ঝড়ের ক্রুদ্ধতা থেকে, কারণ আপনার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা ক্ষমা ও ভালোবাসায় পূর্ণ।’
ছেলেটির আত্মাকে দখল করে নিল সুখনিদ্রা। তার মা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিল এবং তার শিহরতি ওষ্ঠ দিয়ে চুম্বন করল তার চোখে। তারপর সে ফিরে গেল এবং বসল অগ্নিকুণ্ডের পাশে এবং তার জন্য সে বয়ন করতে শুরু করল একটা গরম পোশাক।
.
কবি
সে হল বর্তমান ও আসন্ন পৃথিবীর মাঝখানের যোগাযোগ।
সে হল একটা খাঁটি বসন্ত যা প্রায় সব তৃষ্ণার্ত আত্মাই পান করতে পারে।
সে হল একটা বৃক্ষ যাকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেয়
সৌন্দর্যের নদী, বহন করে ফল যা ক্ষুধার্ত হৃদয়
ব্যাকুলভাবে কামনা করে।
সে হচ্ছে একটা নাইটিংগেল পাখি, বিষাদগ্রস্ত আত্মাকে
শান্ত করে তার চমৎকার সুর দিয়ে,
সে হচ্ছে একটা সাদা মেঘ, দিগন্তের ওপর আবির্ভূত হচ্ছে
আকাশের মুখমণ্ডল দ্বারা যতক্ষণ-না তা আরোহণ করছে
এবং বেড়ে উঠছে।
তারপর এটা পতিত হয় জীবনের শস্যক্ষেতের ফুলগুলির ওপর
পাপড়িগুলি খুলে আলোকে স্বীকার করে নিতে।
সে হচ্ছে একজন দেবদূত, যাকে ঈশ্বরীরা
পাঠিয়েছে গভীরভাবে বিশ্বাসকৃত ঈশ্বরদের নীতিমালা প্রচার করতে।
সে হচ্ছে একটা উজ্জ্বল বাতি অন্ধকারের ভেতরে
অজেয় এবং বাতাসের দ্বারা অনির্বাপণীয়। সে পরিপূর্ণ তেলে ইসতার
এর ভালোবাসার মাধ্যমে এবং এ্যাপোলন-এর সংগীতের মাধ্যমে
সে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে।
সে একজন নিঃসঙ্গ মানুষ। সারল্য ও দয়ার ভেতরে
অপহৃত হয়, প্রকৃতির কোলে সে বসে থাকে তার প্রেরণার জন্য
এবং রাত্রির নৈঃশব্দের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে
আত্মার নেমে আসার অপেক্ষায়।
সে একজন বীজ বপনকারী, যে তার হৃদয়ের বীজ বোনে
তৃণভূমিতে ভালোবাসার সাথে এবং মানবতা ফসল
তোলে তার পুষ্টিসাধনের জন্য।
এই হল কবি—যার জীবদ্দশায় মানুষ তাকে উপেক্ষা করে।
এবং সে শুধুমাত্র স্বীকৃত হয় বিদায়ের জাগতিক
শব্দাবলি উচ্চারণের পর এবং তারপর প্রত্যাবর্তন করে
স্বর্গের কুঞ্জবনে।
এই হল কবি—যে মানবতা সম্পর্কে কিছুই জিজ্ঞাসা করে না
মৃদু হাসি হাসা ছাড়া।
এই হল কবি—যার আত্মা মহাকালে আরোহণ করে এবং
তাকে পূর্ণ করে তোলে চমৎকার বাণীর সাহায্যে, যদিও মানুষ
তার বাণীর দীপ্তিকে অস্বীকার করে।
যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবে না,
যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ধারাবাহিকভাবে এসব বাণীকে মহিমান্বিত
করে তুলবে না,
মুহূর্তের সুবিধা তখন কে অর্জন করে?
ওই বাণীগুলিকে তারা কতদিন উপেক্ষা করবে
যে তাদের আত্মার সৌন্দর্য দেখতে সক্ষম,
সক্ষম তাদেরকে তাদের আত্মার সৌন্দর্য দেখাতে,
দেখাতে শান্তি ও ভালোবাসার প্রতীক?
যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ মৃতকে শ্রদ্ধা জানাতে
শিখবে না এবং জীবন্তদের ভুলে যাবে, যারা তাদের
জীবন কাটিয়েছে দুর্দশার বৃত্তের ভেতরে এবং যারা
মোমবাতির মতো জীবন নিঃশেষ করেছে অজ্ঞদের জন্য
অন্ধকারাচ্ছন্ন পথকে আলোকিত করতে এবং
তাদেরকে আলোর পথে নেতৃত্ব দিতে?
কবি, তোমার জীবন হচ্ছে এই জীবন এবং যুগের ওপর
তুমি সাফল্য অর্জন করেছ যুগের কঠোরতা সত্ত্বেও।
কবি, একদিন তুমি হৃদয় শাসন করবে এবং
অতঃপর, তোমার সাম্রাজ্যের কোনো সমাপ্তি নেই।
কবি, তোমার সিংহাসনের রাজমুকুটটা পরীক্ষা করো, তুমি
দেখবে একটা বিকাশোন্মুখ অর্জিত সম্মান তাতে লুকিয়ে আছে।
.
আত্মার গান
আমার আত্মার গভীরে একটা বাণীহীন সংগীত—যে সংগীত
আমার হৃদয়ের বীজগুলিকে জীবন্ত রাখে।
এটা পার্চমেন্টের ওপরে কালির সঙ্গে মিশতে চায় না,
এটা গ্রাস করে আমার ভালোবাসা একটা স্বচ্ছ
ছদ্মবেশের ভেতরে, কিন্তু তা আমার ওষ্ঠে আসে না।
কীভাবে তা আমার ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস হয়ে
বেরিয়ে যেতে পারে? আমি ভীত এটা জাগতিক
ইথারের সাথে মিশে যেতে পারে,
কার কাছে এ গান গাইব আমি? এ গান বসবাস
করে আমার আত্মার গৃহে কর্কশ শ্রবণইন্দ্রিয়ের ভয়ে।
যখন আমি আমার অন্তর্দৃষ্টির দিকে তাকাই
তখন দেখি আমি তার ছায়ার ছায়া,
আমার আঙুলের ছাপ যখন স্পর্শ করে
তখনই অনুভব করি এর স্পন্দন।
আমার হাতের চুক্তিগুলি তার উপস্থিতিকে
অবহিত করে, একটা লেক অবশ্যই
প্রতিফলিত করে উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলিকে,
আমার অশ্রুজল তা প্রকাশ করে দেয়, যেমন শিশিরের
উজ্জ্বল বিন্দুগুলি প্রকাশ করে শুকিয়ে যাওয়া
গোলাপফুলের গোপনীয়তা।
এই গানটি সৃজিত হয়েছিল গভীর চিন্তার সাহায্যে,
প্রকাশিত হয়েছিল নৈঃশব্দের মাধ্যমে,
পরিত্যক্ত হয়েছিল উচ্চ কোলাহলের সাহায্যে,
এবং মোড়ানো হয়েছিল সত্যের সাহায্যে,
পুনরাবৃত্ত করা হয়েছিল স্বপ্নের মাধ্যমে,
উপলব্ধি করা হয়েছিল ভালোবাসার দ্বারা,
লুকিয়ে রাখা হয়েছিল জাগরণের মাধ্যমে
এবং গীত হয়েছিল আত্মার সাহায্যে।
এটা হচ্ছে ভালোবাসার সংগীত,
কয়িন অথবা ইসাউ কি তা গাইতে পারে?
এটা জুঁইফুলের থেকেও অধিক সুরভিত
কোন্ কণ্ঠস্বর একে দাসত্বে পরিণত করতে পারে?
এটা হৃদয়ের বন্ধনে বাঁধা কুমারীর গোপনীয়তার মতো
কোন সেই তার এতে শিহরণ তুলতে পারে?
কে সেই সাহসী, যে সমুদ্রের গর্জনকে একত্রিত করতে পারে
এবং একত্রিত করতে পারে নাইটিংগেলের গানকে?
কে সেই সাহসী যে ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দের সাথে
নবজাতকের দীর্ঘশ্বাসের তুলনা করে?
কে সেই সাহসী যে, উচ্চৈঃস্বরে সেই শব্দাবলি উচ্চারণ করে যা
হৃদয়ের উদ্দেশে বলা হয়ে থাকে?
কোন্ সেই সাহসী মানুষ সেই কণ্ঠস্বরের ভেতরে গান গায়,
যা ঈশ্বরের গান?
.
উচ্চহাসি এবং কান্না
সূর্য বাগান থেকে তার শেষ আলোটুকু তুলে নেবার পর, চাঁদ ফুলগুলির ওপর ছুড়ে দিল তার আলোকধারা। আমি একটা গাছের নিচে বসে পরিবেশের এই বিস্ময়কর ঘটনার কথা ভাবছিলাম— গাছের শাখাগুলির ভেতর দিয়ে দেখছিলাম আলগাভাবে ছড়িয়ে দেওয়া নক্ষত্রগুলি যা একটা নীলরঙের কার্পেটের ওপর রুপার টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করছিল এবং আমি দূর থেকে শুনছিলাম ছোট্ট নদীর আলোড়িত মর্মরধ্বনি দ্রুত গান গাইছিল উপত্যকার পথে পথে।
যখন পাখিরা বৃক্ষশাখার ভেতরে আশ্রয় খুঁজে নিল এবং ফুলগুলি বন্ধ করল তাদের পাপড়ির ভাঁজ এবং সেইসঙ্গে ভয়াবহ নীরবতা নেমে এল, তখন ঘাসে পায়ের খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম একজোড়া যুবক-যুবতী আমার কুঞ্জবনের কাছাকাছি। তারা একটা গাছের নিচে বসল এবং জায়গাটা এমন যে, আমি তাদেরকে দেখতে পাব কিন্তু তারা আমাকে দেখবে না।
ছেলেটা চারদিক ভালো করে দেখার পর আমি শুনলাম সে বলছে, ‘হে আমার প্রিয়তমা, আমার পাশে বসো এবং আমার হৃদয়ের কথা শোনো। হাসো, তোমার সুখই হল আমাদের ভবিষ্যতের চিহ্ন। আনন্দিত হও, কারণ উজ্জ্বল দিনগুলিও আমাদের সাথে আহ্লাদিত।’
‘আমার আত্মা আমাকে সতর্ক করছে যে তোমার হৃদয়ে সন্দেহ আছে, কারণ ভালোবাসার সন্দেহ হচ্ছে পাপ।
‘খুব দ্রুত তুমি এই বিশাল ভূমির মালিক হবে যা এই চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। খুব দ্রুতই তুমি হবে আমার প্রাসাদের মিসট্রেস এবং ভৃত্যরা তোমার আদেশ মান্য করবে। ‘হাসো আমার প্রিয়তমা, আমার পিতার ধনভাণ্ডার থেকে আসা সোনার হাসির মতো।
।আমার হৃদয় এর গোপনীয়তাকে অস্বীকার করে। বারো মাসের আরাম-আয়েশ এবং ভ্ৰমণ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য, কারণ একবছর আমরা পিতার স্বর্ণমুদ্রা খরচ করব সুইজারল্যান্ডের ব্লু লেকে, ইটালির স্বপ্নসৌধের দৃশ্য দেখে এবং লেবাননের পবিত্র সিডার গাছের নিচে বিশ্রাম নিয়ে। অনেক রাজকুমারীর সঙ্গে তোমার দেখা হবে যারা তোমাকে হিংসা করবে তোমার অলংকার ও পোশাকের জন্য।
‘এই সবকিছুই আমি তোমার জন্য করব। তুমি তৃপ্ত হবে তো?’
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি দেখলাম তারা ফুলের ওপর পা ফেলে হাঁটছে যেভাবে ধনীলোকেরা গরিবের হৃদয়ের ওপর পা ফেলে হাঁটে। আমার দৃষ্টি থেকে তারা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরই আমি তুলনা করতে শুরু করলাম প্রেম এবং অর্থ এবং বিশ্লেষণ করলাম আমার হৃদয়ে তাদের অবস্থান। অর্থ! আন্তরিকতাহীন ভালোবাসার উৎস, বিভ্রান্ত আলো ও নিয়তির বসন্ত, বিষাক্ত পানির কূপ, বৃদ্ধ বয়সের বেপরোয়া স্বভাব।
আমি তখনও পর্যন্ত ধ্যানের বিশাল মরুভূমিতে বিস্মিত হচ্ছিলাম, যখন অসুখী ও অপচ্ছায়ার মতো এক দম্পতি আমাকে অতিক্রম করে গেল এবং ঘাসের ওপর বসল। একজন যুবক এবং একজন যুবতী, যারা কাছাকাছি মাঠের খামারবাড়ির চালাঘর ফেলে এসেছিল একটা ঠাণ্ডা ও নির্জন জায়গার সন্ধানে।
কয়েক মুহূর্ত পর পুরোপুরি নৈঃশব্দের ভেতরে আমি শুনতে পেলাম দীর্ঘশ্বাসের সাথে উচ্চারিত হল আবহাওয়া-পীড়িত ঠোঁট থেকে, ‘কেঁদো না প্রিয়তমা, ভালোবাসা তাকিয়ে থাক পরস্পরের দিকে এবং হৃদয়কে আমাদের দাসত্বে পরিণত করো, যা আমাদেরকে ধৈর্যের আশীর্বাদ দিতে পারে। সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করো আমাদের বিলম্বের জন্য, কারণ আমরা একটা শপথ নিয়েছি। আমার প্রবেশ করলাম ভালোবাসার তীর্থস্থানে, কারণ আমাদের ভালোবাসা দুর্ভাগ্যের ভেতরে বেড়ে উঠবে চিরদিন, কারণ ভালোবাসার নামে আমরা সংগ্রাম করছি, দারিদ্র্যের বাধা, দুর্দশার তীক্ষ্ণতা এবং পৃথকীকরণের শূন্যতাকে দূর করার জন্য। আমি এইসব কঠোর জীবনযাপনকে আক্রমণ করব যতক্ষণ-না আমার সাফল্য আসে এবং যতক্ষণ-না তোমাদের হাতে স্থাপন করি একটা শক্তি যা সবকিছুকে সাহায্য করবে জীবনের ভ্রমণ সম্পূর্ণ করতে।
‘ভালোবাসা, যা হচ্ছে ঈশ্বর—আমাদের দীর্ঘশ্বাসগুলিকে তিনি বিবেচনা করবেন এবং অশ্রুজলও ফেলবেন যেমন ধূপ পুড়ে যায় তার বেদিতে এবং তিনি আমাদের পুরস্কৃত করবেন আত্মসংযম দিয়ে। বিদায় প্রিয়তমা, আমাকে অবশ্যই যেতে হবে এই উল্লসিত চাঁদ অদৃশ্য হওয়ার আগেই।’
ভালোবাসার নিঃশেষিত শিখার সঙ্গে সমন্বিত এবং আকুল আকাঙ্ক্ষার নির্বোধ তিক্ততা এবং ধৈর্যের নিশ্চিত মধুরতার খাঁটি কণ্ঠস্বর বলল, ‘বিদায় আমার প্রিয়তমা’
তারা আলাদা হল এবং তাদের সম্মিলনের শোকগাথা ঢেকে ফেলা হয়েছিল আমার ক্রন্দনরত হৃদয়ের হাহাকার দিয়ে।
সুখনিদ্রায় মগ্ন প্রকৃতির দিকে তাকালাম এবং গভীর প্রতিফলনের মাধ্যমে আবিষ্কার করলাম বিশালতা ও অসীমতার বাস্তবতা- কিছু কিছু জিনিসের কোনো ক্ষমতা নেই কিন্তু তার চাহিদা থাকতে পারে। প্রভাব একটি অর্জিত আচরণ, ধনীরা তা কিনতে পারে না।
পারে না বিলুপ্ত হতে সময়ের অশ্রুজলে অথবা অনুভূতিহীন হয়ে পড়তে পারে দুঃখের কারণে, যা আবিষ্কৃত হতে পারে না সুইজারল্যান্ডের ব্লু লেক অথবা ইটালির স্বপ্নসৌধের সৌন্দর্যের মাধ্যমে।
এটা হচ্ছে সেই সব, যা শক্তি সঞ্চয় করে ধৈর্যের সঙ্গে, বাধা সত্ত্বেও বেড়ে ওঠে, শীতকালে উষ্ণ, বসন্তে পল্লবিত, গ্রীষ্মে সংগৃহীত মৃদুমন্দ হাওয়া এবং শরতে উলঙ্গ ফল— আমি এই সবকিছুর ভেতরে ভালোবাসা খুঁজে পাই।
.
ফুলের গান
আমি একটা দয়ার্দ্র শব্দ, প্রকৃতির কণ্ঠে
যা বারবার উচ্চারিত হয়।
আমি হলাম নীল তাঁবু থেকে সবুজ কার্পেটের
ওপর খসে-পড়া নক্ষত্র, আমি হলাম সেইসব
উপাদানসমূহের কন্যা যার কারণে গর্ভধারণ সম্ভব হয়।
বসন্ত আবার তাকে জন্ম দেয়। আমি লালিতপালিত
হয়েছিলাম গ্রীষ্মের কোলে এবং ঘুমিয়েছিলাম
শরতের বিছানায়
ভোরবেলায় আমি মৃদুমন্দ বাতাসের সাথে মিলিত হই
আলোর আগমন বার্তা ঘোষণা করতে।
সন্ধায় পাখিদের সঙ্গে যোগ দিই
আলোকধারাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে।
আমার বিভিন্ন রঙের বর্ণে
সজ্জিত সমতলভূমি এবং আমার সৌরভে
সুরভিত পৃথিবীর বাতাস।
যেমন আমি সুখনিদ্রাকে আলিঙ্গন করি,
রাত্রির চোখ আমাকে পর্যবেক্ষণ করে এবং
আমি যখন জেগে থাকি তখন স্থিরদৃষ্টিতে
সূর্যের দিকে তাকাই যা হচ্ছে দিনের
একমাত্র দৃষ্টি।
আমি মদের বদলে শিশির পান করি এবং
শ্রবণ করি পাখিদের কণ্ঠস্বর এবং ঘাসের
ছন্দোময় আন্দোলনের সঙ্গে নৃত্য করি।
আমি হলাম প্রেমিকার উপহার, বিয়ের জন্য
গেঁথে-তোলা মালা,
আমি হলাম সুখের এক মুহূর্তের স্মৃতি,
আমি হলাম মৃত্যুকালে জীবন্তের শেষ উপহার,
আমি হলাম আনন্দের অংশ এবং বেদনার অংশ।
কিন্তু আমি উপরে তাকাই শুধুমাত্র আলো দেখতে
এবং কখনই আমার ছায়া দেখতে নিচে তাকাই না।
এটাই হল বিচক্ষণতা যা মানুষের অবশ্যই শেখা উচিত।
.
দূরদৃষ্টি
মাঠের মাঝখানে অতিস্বচ্ছ একটা জলাধারার পাশে আমি একটা পাখির খাঁচা দেখতে পেলাম, যার শিক এবং কব্জা তৈরি করেছিল একটা বিশেষজ্ঞের হাত। খাঁচার একপাশে শুয়েছিল একটা মৃতপাখি এবং অন্যদিকে দুটি চীনামাটির পাত্র—একটা খালি, যেটা ছিল পানির জন্য এবং অন্যটিতে শস্যদানা। আমি শ্রদ্ধাবনত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, যেন প্রাণহীন পাখি ও নদীর কুলুকুলু ধ্বনি ছিল গভীর নৈঃশব্দে আচ্ছন্ন এবং শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য—কিছু একটা যা হৃদয়বৃত্তি ও নীতিচেতনার মাধ্যমে ধ্যান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার যোগ্য।
আমি সবসময় নিজেকে বিভিন্ন দৃশ্য দেখা ও চিন্তাভাবনার কাজে নিয়োগ করে রাখি। আমি দেখলাম যে, দরিদ্র প্রাণীরাই তৃষ্ণায় মারা গিয়েছিল পানির স্রোতের কাছে এবং ক্ষুধার্তরা শস্যক্ষেতের মাঝখানে। এই হল জীবনের দোলনা। ধনীমানুষের মতো তার লোহার আলমারিতে তালাবদ্ধ এবং ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে সোনার স্তূপের মাঝখানে।
হঠাৎ আমি দেখলাম খাঁচাটা মানুষের কঙ্কালে পরিণত হল এবং মৃতপাখিটি পরিণত হল মনুষ্যহৃদয়ে যার গভীর ক্ষত থেকে রক্তধারা প্রবাহিত হচ্ছিল, যা দেখে মনে হচ্ছিল একটা বেদনার্ত নারীর ঠোঁট। আহত হৃদয় থেকে একটা কণ্ঠস্বর কথা বলল, আমি হলাম মনুষ্যহৃদয়, বস্তুসমূহের কারাগারে বন্দি এবং জাগতিক আইনের শিকার।
‘ঈশ্বরের সৌন্দর্যের মাঠে, জীবনের স্রোতোধারার প্রান্তসীমায় আমি মানুষের তৈরি আইনের খাঁচায় বন্দি হয়ে ছিলাম।
‘চমৎকার সৃষ্টির কেন্দ্রে আমি অবহেলিত হয়ে মারা গিয়েছিলাম, কারণ আমি ছিলাম ঈশ্বরের উদারতার বিচক্ষণতা উপভোগ করার জন্য।
‘সৌন্দর্যের সবকিছুই যা অসম্মানজনক অবস্থার মধ্যেও আমার ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে রেখেছে, মানুষের ধারণা অনুসারে ও সবকিছুর ভালোত্ব যা আমি ব্যাকুলভাবে কামনা করি তা কিছুই নয় তার বিচার অনুযায়ী।
‘আমি হলাম হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যহৃদয়, মানুষের নির্দেশিত ভূগর্ভস্থ অন্ধকারে দূষিত কারাকক্ষে বন্দি, জাগতিক কর্তৃপক্ষের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত, হাস্যস্পদ মানবতার দ্বারা মৃতপ্রায় ও বিস্তৃত এবং তাদের জিভে বাঁধা যারা চোখের জল ফেলার ক্ষেত্রে নিঃশেষ হয়ে গেছে।’
সবই আমি শুনলাম এবং দেখলাম তাদেরকে, একটা পাতলা রক্তের স্রোতের সাথে উত্থিত হচ্ছে আহত হৃদয় থেকে।
আরও বেশি কিছু বলা হয়েছিল কিন্তু আমার ধোঁয়াশাচ্ছন্ন চোখ এবং আত্মার কান্না আমাকে পুনরায় তা দেখতে এবং শুনতে দিল না।
.
ভালোবাসার গান
আমি হলাম প্রেমিকার চক্ষুযুগল
এবং আত্মার পানীয় মদ্য,
হৃদয়ই করে আমার পুষ্টিসাধন।
আমি হলাম একটি গোলাপ। আমার হৃদয়
উন্মোচিত হয় ভোরবেলায় এবং কুমারীর চুম্বনে
সিক্ত হই আমি এবং সে আমাকে স্থাপন
করে বক্ষের ওপর।
আমি হলাম প্রকৃত ভাগ্যের গৃহ এবং আনন্দের উৎস
এবং শান্তি ও প্রশান্তির শুরু। আমি হলাম সৌন্দর্যের
ঠোঁটের ওপরের কোমল হাসি। যখন যৌবন আমাকে দখল করে তখন
সে তার কাঠের পরিশ্রমের কথা ভুলে যায় এবং তারা সারা জীবন
পরিণত হয় মধুর স্বপ্নের বাস্তবতায়।
আমি হলাম কবির অনুপ্রেরণা,
চিত্রশিল্পীর গুপ্ত প্রকাশ,
এবং সংগীতজ্ঞের প্রেরণা।
একটি শিশুর হৃদয়ে আমি হলাম ঐশ্বরিক তীর্থস্থান,
ক্ষমাশীল মায়ের দ্বারা সম্মানিত।
হৃদয়ের কান্নায় আমি আবির্ভূত হই, পরিহার করি চাহিদা,
আমার পরিপূর্ণতা তাড়া করে ফেরে হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে,
কণ্ঠস্বরের শূন্য দাবিকে আকাঙ্ক্ষাও পরিহার করে।
আমি ইভের মাধ্যমে আদমের কাছে আবির্ভূত হলাম
এবং নির্বাসন ছিল তার নিয়তি,
যদিও আমি সলোমনের কাছে আমাকে উন্মোচন করেছিলাম
এবং আমার উপাস্থতিতেই তিনি বিচক্ষণতাকে উপরে তুলে
ধরেছিলেন।
আমি হেলেনের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলাম
এবং সে ধ্বংস করেছিল তারাওয়াদা নগরী,
যদিও আমি ক্লিওপেট্রাকে মুকুট পরিয়েছিলাম
এবং শান্তির শাসন এসেছিল নীল উপত্যকায়।
আমি হলাম যুগের মতো—নির্মাণ করছি আজকের
দিনকে এবং ধ্বংস করছি আগামীকালকে।
আমি হলাম ঈশ্বরের মতো, যে সৃষ্টি এবং ধ্বংস করে।
আমি অধিকতর মিষ্টি একটা ভায়োলেট-এর দীর্ঘশ্বাসের চেয়ে
এবং উন্মত্ত ঝড়ের চেয়ে অধিকতর হিংস্র।
শুধুমাত্র উপহার আমাকে প্ররোচিত করে না
বিভক্তি সৃষ্টি আমাকে নিরুৎসাহিত করে না
দারিদ্র্য তাড়া করে না আমাকে,
স্পর্শকাতরতা আমার সচেতনতাকে প্রমাণ করে না,
পাগলামি আমার উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় না।
হে অনুসন্ধানকারীরা, আমি হলাম সত্য, বিনয়ী সত্য
এবং তোমাদের সত্য অনুসন্ধান করছে, গ্রহণ করছে
এবং রক্ষা করছে আমাকে এবং আমার আচরণ
সম্পর্কে সে নিশ্চিত হবে।
.
মানুষের গান
আমি এখানে ছিলাম সেই প্রারম্ভের মুহূর্ত থেকে
এবং এখানে আমি ছিলাম স্থির এবং
আমি এখানে থাকব পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত,
কারণ আমার মর্মবেদনার পীড়িত সত্তার ভেতরে
সমাপ্তি বলে কিছু নেই।
আমি অসীম আকাশের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াই
এবং আদর্শ পৃথিবীর অনেক উঁচুতে উড়তে পারি,
মহাকাশের ভেতর দিয়ে ভেসে বেড়াই,
কিন্তু এখানে আমি পরিমাপের কাছে বন্দি।
আমি কনফুসিয়াসের শিক্ষা সম্পর্কে শুনেছি,
মনোযোগ দিয়ে শুনেছি ব্রহ্মার বিচক্ষণতা,
আমি জ্ঞানের বৃক্ষতলে বুদ্ধের পাশে বসেছিলাম।
যদিও আমি এখানে বিরুদ্ধ বিশ্বাস ও অজ্ঞতার
সঙ্গে অস্তিত্ব রক্ষা করছি।
আমি সিনাইতে ছিলাম যখন জিহোভা মুসাকে
প্রস্তাব দিয়েছিল।
আমি জর্দানে দেখেছিলাম নাজারেতবাসীদের
অলৌকিকতা।
মোহাম্মদ (সা.) যখন মদিনা পরিদর্শন করেন
তখন আমি সেখানে ছিলাম
যদিও আমি এখানে বিভ্রান্তির বন্দি হয়ে আছি।
তারপর আমি প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলাম ব্যাবিলনের
পরাক্রমশালীদের।
জেনেছিলাম মিশরের মহিমা।
আমি জেনেছিলাম যুদ্ধকালে রোমের বিশিষ্ট ক্ষমতা
যদিও আমার প্রাথমিক শিক্ষা প্রদর্শন করেছিল
ওইসব সাফল্যের বেদনা এবং দুর্বলতা।
আইন দৌর-এর জাদুকরদের সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম।
ওসিরীয় যাজকদের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়েছিলাম বিতর্কে,
আমি প্যালেস্টাইনের নবীদের গভীর থেকে টুকরো টুকরো
তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম,
যদিও আমি এখনও পর্যন্ত অনুসন্ধান করছি সত্য।
আমি সম্পূর্ণ ভারত থেকে জড়ো করেছিলাম বিচক্ষণতা,
আমি অনুসন্ধান করেছিলাম আরবের মহৎ যুগের
যা শোনা যায় তার সবই আমি শুনেছিলাম,
যদিও, আমার হৃদয় অন্ধ ও বধির।
আমি কষ্ট পেয়েছি স্বৈরাচারী শাসকের হাতে
আমি কষ্ট পেয়েছি অপ্রকৃস্থ হামলাকারীর দাসত্বের বন্ধনে,
আমি কষ্ট পেয়েছি নিপীড়নের মাধ্যমে আরোপিত ক্ষুধায়।
যদিও এখনও পর্যন্ত আমার কিছু অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা রয়েছে
যার সঙ্গে আমি সংগ্রাম করি প্রতিটি
দিনকে সম্ভাষণ জানাতে।
আমার মন পরিপূর্ণ কিন্তু আমার হৃদয় শূন্যতায় ভরে আছে,
আমার শরীর বৃদ্ধ কিন্তু আমার হৃদয় হচ্ছে নবজাতক।
সম্ভবত যৌবনে আমার হৃদয় বেড়ে উঠবে কিন্তু
আমি প্রার্থনা করি বৃদ্ধ হতে এবং পৌঁছে যেতে চাই
ঈশ্বরের কাছে আমার প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তে। শুধুমাত্র
তখনই আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
এখানে আমি ছিলাম সেই প্রারম্ভের মুহূর্ত থেকে
এবং এখানে আমি ছিলাম স্থির এবং
আমি এখানে থাকব পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত,
কারণ আমার মর্মবেদনার পীড়িত সত্তার ভেতরে
সমাপ্তি বলে কিছু নেই।
.
দুটি আকাঙ্ক্ষা
রাত্রির নীরবতার ভেতরে মৃত্যু ঈশ্বরের কাছ থেকে নেমে এল পৃথিবীর দিকে। সে একটা শহরের ওপর পাখা না-নাড়িয়ে বাতাসে ভেসে থাকল এবং দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করল সমস্ত বসতিকে। সে দেখতে পেল স্বপ্নের পাখায় ভর করে আত্মারা ভেসে বেড়াচ্ছে এবং মানুষ সুখনিদ্রার ক্ষমার কাছে করেছে আত্মসমর্পণ।
চাঁদ যখন দিগন্তের নিচে নেমে এল এবং অন্ধকারে ঢেকে গেল শহর, মৃত্যু তখন নীরবে হেঁটে বেড়াতে লাগল শহরের বাড়িগুলির ভেতর দিয়ে—সতর্কতার সঙ্গে কোনোকিছুই স্পর্শ করল না রাজপ্রাসাদে না-পৌঁছানো পর্যন্ত। হুড়কো লাগানো দরজার ভেতর দিয়েই সে প্রবেশ করল কোনোরকম বাধা ছাড়াই এবং ধনী মানুষের বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াল এবং যেই মৃত্যু তার কপাল স্পর্শ করল তখনই ঘুমন্তের চোখ খুলে গেল, যা প্ৰদৰ্শন করছে আতঙ্ক।
যখন সে অপচ্ছায়া দেখতে পেল তখনই সে ক্রুদ্ধতা ও ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে হুকুম করল, ‘পালিয়ে যাও, হে বীভৎস স্বপ্ন, আমাকে পরিত্যাগ করো হে ভয়ংকর ভূত। কে তুমি? কীভাবে এখানে প্রবেশ করেছ? কী চাও তুমি? এখনই এ জায়গা পরিত্যাগ করো, কারণ আমি এই গৃহের কর্তা। আমি আমার ভৃত্য ও পাহারাদারদের ডাকব এবং তাদেরকে নির্দেশ দেব তোমাকে হত্যা করতে।’
তারপর মৃত্যু বলল অত্যন্ত কোমলস্বরে কিন্তু ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা বজ্রের মতো, ‘আমি হলাম মৃত্যু। উঠে দাঁড়াও এবং মাথা নুইয়ে আমাকে অভিবাদন জানাও।’
লোকটা উত্তরে বলল, ‘তুমি কী চাও? কেন তুমি এখানে এসেছ যখন আমার কোনো কাজই শেষ হয়নি? কী তুমি অনুসন্ধান করো সামর্থ্যের কাছে, যেমন এই আমার কাছে দুর্বল লোকের কাছে যাও এবং তাদেরকে গ্রহণ করো।’
‘তোমার ফাঁপা মুখমণ্ডলে রক্তাক্ত থাবার দৃশ্য আমি অপছন্দ করি। তোমার মরার মতো শরীর ও বীভৎস পাঁজরযুক্ত পাখা দেখলে আমার চোখ অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ভীতি উপলব্ধির একটি মুহূর্ত কেটে যাবার পর সে আরও বলল, ‘না, না, হে ক্ষমাশীল মৃত্যু। আমার কথায় কিছু মনে কোরো না, কারণ আতঙ্ক প্রকাশিত হয় যা হৃদয় নিষিদ্ধ করে থাকে।’
‘যে-কোনো পরিমাপের সোনা তুমি গ্রহণ করো অথবা আমার ভৃত্যদেরসহ হাতভর্তি আত্মা, কিন্তু আমাকে পরিত্যাগ করো। প্রয়োজনীয় বসতিসহ আমাকে জীবনের সঙ্গে হিসাব করা হয়েছে। মানুষের কাছে আমার অনেক ঋণ রয়েছে। আমার জাহাজ এখনও পোতাশ্রয়ে পৌঁছায়নি। আমার গম এখনও মাঠে রয়ে গেছে, তা গোলায় তোলা হয়নি। যা চাও তাই গ্রহণ করো কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি কোরো না। হে মৃত্যু, আমার অন্তঃপুরে অলৌকিক সৌন্দর্যসম্পন্ন নারী আছে, তুমি যাকে পছন্দ করবে তাকেই আমি তোমাকে উপহার দেব। মনোযোগ দিয়ে শোনো হে মৃত্যু- আমার একটিমাত্র সন্তান এবং আমি তাকে খুবই ভালোবাসি, কারণ সে হল আমার এই জীবনের একমাত্র উল্লাস। আমি তোমাকে সর্বময় আত্মত্যাগের প্রস্তাব দিচ্ছি- তুমি তাকে গ্রহণ করো কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি কোরো না।’
মৃত্যু ফিসফিস করে বলে, ‘তুমি মোটেও ধনী নও, সকরুণভাবে তুমি দরিদ্র।’ তারপর মৃত্যু সেই জাগতিক দাসের হাত নিজের হাতে তুলে নিল, তার বাস্তবতাকে অস্বীকার করল এবং দেবদূতদের প্রদান করল শুদ্ধতার বিশাল কর্মকাণ্ড।
মৃত্যু ধীরগতিতে হেঁটে গেল গরিবদের বসতির মাঝখান দিয়ে তার দেখা সবচেয়ে দুর্গত মানুষের কাছাকাছি না-পৌঁছানো পর্যন্ত। সে প্রবেশ করল এবং একটা বিছানার কাছাকাছি হল যার ওপর ঘুমিয়ে ছিল এক যুবক। মৃত্যু তার চোখ স্পর্শ করল। সে এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যেন সে মৃত্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।
ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ কণ্ঠে সে বলল, ‘আমি এখানে হে আমার চমৎকার মৃত্যু। আমার আত্মাকে গ্রহণ করো, কারণ তুমি আমার স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষা। সেখানে সমাপ্তিতে পরিণত হও। আমাকে আলিঙ্গন করো হে প্রিয় মৃত্যু আমার! তুমি ক্ষমাশীল, আমাকে পরিত্যাগ কোরো না। তুমি হলে ঈশ্বরের বার্তাবাহক, আমাকে তার কাছে সরবরাহ করো। তুমি হলে সত্যের ডান হাত এবং দয়ার হৃদয়। আমাকে অবহেলা কোরো না।
‘তোমার জন্য আমি বহুবার ভিক্ষা করেছি কিন্তু তুমি আসো নাই। আমি সন্ধান করেছি তোমাকে কিন্তু তুমি আমাকে অস্বীকার করেছ। আমি তোমাকে আহ্বান জানিয়েছি কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো নাই। এখন তুমি আমার কথা শোনো—আলিঙ্গন করো আমার আত্মাকে হে আমার প্রিয় মৃত্যু।’
মৃত্যু তার কোমল হাত রাখল শিহরিত ওষ্ঠের ওপর, অপসারিত হল সমস্ত বাস্তবতা এবং জড়িয়ে ধরল তার পাখার তলায় নিরুদ্বেগ চরিত্রের জন্য এবং আকাশে প্রত্যবর্তন করতে করতে মৃত্যু পেছনে তাকাল এবং ফিসফিস করে উচ্চারণ করল তার সতর্কবাণী :
শুধুমাত্র তারাই প্রত্যাবর্তন করে অনন্তকালে
পৃথিবীতে যারা অনুসন্ধান করে অনন্তকাল।
.
গতকাল এবং আজ
সোনার মজুতদার তার প্রাসাদের পার্কে হাঁটছিল এবং তার সঙ্গে হাঁটছিল তার অসুবিধাগুলি এবং দুশ্চিন্তা তার মাথার ওপর স্থির হয়েছিল যেমন একটা শকুন একটা পাখির মৃতদেহের ওপর পাখা না নাড়িয়ে স্থির হয়ে বাতাসে ভেসে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে চমৎকার মর্মরপাথরের ভাস্কর্যে ঘেরা মনোরম লেকের কাছে না পৌঁছাল।
সে সেখানে বসে ভাবতে লাগল ভাস্কর্যের মুখ দিয়ে যে পানি পড়ছে তা অনেকটা চিন্তার মতো, যেন কোনো প্রেমাস্পদের অলীক কল্পনা এবং গভীরভাবে আরও চিন্তা করল তার প্রাসাদ সম্পর্কে যা দাঁড়িয়েছিল একটা ছোট্ট পাহাড়ের ওপর একটা তরুণীর কপোলের জন্মদাগের মতো। তার অলীক কল্পনা তার জীবননাটকের পৃষ্ঠাগুলিকে তার সামনে উন্মোচিত করল, যা সে পাঠ করে ঝরে পড়া অশ্রুজলের সঙ্গে, যা তার দৃষ্টিকে অবগুণ্ঠন পরায় এবং প্রকৃতির প্রতি মানুষের দুর্বল-সংযোগের দৃশ্য তাকে দেখতে দেয় না। সে তার প্রথম জীবনের প্রতিমূর্তির দিকে ফিরে তাকায়, যা ঈশ্বর কর্তৃক একটা নির্দিষ্ট ধরনে বয়ন করা। সে উচ্চৈঃস্বরে বলল, ‘গতকাল সবুজ উপত্যকায় আমি আমার ঘুম খেয়ে ফেলছিলাম। উপভোগ করছিলাম আমার অস্তিত্ব, শব্দ তুলছিলাম আমার বাঁশিতে এবং মাথাটা উঁচু করে রেখেছিলাম। আজ আমি লোভের কাছে বন্দি। সোনা সোনার দিকে নেতৃত্ব দেয় তারপর নেতৃত্ব দেয় ক্লান্তিহীনতার দিকে এবং সবশেষে দুর্গত অবস্থাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে।
‘গতকাল আমি ছিলাম গান গাইতে থাকা একটি পাখির মতো, যে মাঠের এখানে – সেখানে অনেক উঁচুতে মুক্ত ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আজ আমি প্রায়ই পরিবর্তনশীল সম্পদ, সামাজিক শাসন ও নিয়মের দাস এবং বন্ধুদের কিনে ফেলেছি, খুশি করছি আগন্তুকদের আয়েশ দেওয়ার মাধ্যমে। আমি জন্মেছিলাম স্বাধীন হওয়ার জন্যে এবং জীবনের অকৃপণদান উপভোগ করতে। আমি নিজেকে দেখতে পাই একটা বোঝা বহনকারী পশুর মতো, সোনার বিশাল এবং ভারী বোঝায় যার পিঠ ভেঙে যাচ্ছে।
‘কোথায় সেই প্রশস্ত সমতল ভূমিগুলি, গান গাইতে থাকা ছোট্ট নদী, বিশুদ্ধ মৃদুমন্দ বাতাস, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠতা? কোথায় আমার ঈশ্বর? আমি সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছি। কিছুই নেই শুধু একাকিত্ব ছাড়া, যা আমাকে দুঃখভারাক্রান্ত করেছে। সোনা আমাকে ব্যঙ্গ করে, ভৃত্যরা আড়ালে আমাকে অভিশাপ দেয় এবং একটা প্রাসাদ যা আমি গড়ে তুলেছি সমাধি হিসেবে আমার সুখের জন্য এবং এর বিশালত্বের ভেতরে আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার হৃদয়।
‘গতকাল আমি বেদুইন কন্যার সঙ্গে একত্রে তৃণভূমি ও পাহাড়ের যত্রতত্র ঘুরে বেড়িয়েছি, আমাদের সঙ্গী ছিল সদ্গুণগুলি। ভালোবাসো আমাদের উল্লাস এবং চাঁদকে, যে আমাদের অভিভাবক। আজ আমি অসাড় সৌন্দর্যের নারীদের ভেতরে, যারা নিজেদেরকে বিক্রি করে সোনা ও হীরার বিনিময়ে।
‘গতকাল আমি ছিলাম বেপরোয়া, জীবনের সমস্ত উল্লাস ভাগাভাগি করেছি মেষপালকের সঙ্গে। খেয়েছি, খেলা করেছি, কাজ করেছি, গান গেয়েছি এবং একত্রে নৃত্য করেছি হৃদয়ের সত্যের গীতবাদ্যসহ। আজ আমি নিজেকে দেখতে পাই সেইসব মানুষের মধ্যে যারা নেকড়ের ভেতরে মেষপালকের মতো ভীত। আমি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটি তখন তারা ঘৃণায় স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় এবং আমাকে চিহ্নিত করে অশ্রদ্ধা ও হিংসা দিয়ে এবং আমি পার্কের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলার সময় দেখতে পাই সবগুলি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করছে।
‘গতকাল আমি সুখের ভেতরে ধনী ছিলাম, আজ আমি সোনার ভেতরে দরিদ্র।
‘গতকাল আমি ছিলাম একজন সুখী মেষপালক, ক্ষমাশীল রাজার মতো চেয়ে চেয়ে দেখেছি আমার পশুর পালকে আনন্দের সঙ্গে তার অভ্যন্তরস্থ বিষয় সম্পর্কে। আজ আমি একজন দাস, দাঁড়িয়ে আছি নিজের সম্পদের মুখোমুখি। আমার সম্পদ আমার জীবনের সৌন্দর্য থেকে আমাকে অপহরণ করেছিল, যা আমি একসময় জানতাম।
‘মাননীয় বিচারক আমাকে ক্ষমা করুন, আমি জানতাম না যে ধনীরা আমার জীবনটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে এবং নেতৃত্ব দেবে রূঢ়তা ও বোকামির ভূর্গভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষের দিকে। আমি যা ভেবেছিলাম তা মহিমা ছিল না, একটা চিরন্তন নরক ছাড়া।’ সে ক্লান্তির ভেতরে নিজেকে জড়ো করল এবং ধীরগতিতে হেঁটে গেল প্রাসাদের দিকে; দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে এবং বারবার বলতে বলতে, ‘এসবকেই মানুষ সম্পদ বলে? এই কি সেই ঈশ্বর আমি যার প্রার্থনা ও সেবা করছি? এটা কি সেই জিনিস আমি যা পৃথিবীতে সন্ধান করি? পরিতৃপ্তির একটা উপাদান হিসেবে আমি কেন এর ব্যবসা করতে পারি না? একটন সোনার জন্য কে আমাকে একটা চমৎকার স্বপ্ন বিক্রি করবে? হাতভর্তি রত্নের জন্য কে আমাকে দান করবে ভালোবাসার একটি মুহূর্ত? কে আমাকে একটা চোখ দান করবে যা অন্যদের হৃদয়কে দেখতে পায় এবং বিনিময়ে আমার সমস্ত ধনভাণ্ডার গ্রহণ করে।’
প্রাসাদের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে সে ঘুরে দাঁড়াল এবং শহরের দিকে তাকাল যেমন জেরেমিয়া নগর জেরুজালেমের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। সে বিলাপ করতে করতে তার হাত তুলল এবং চিৎকার করে বলল, ‘হে কদর্য নগরীর মানুষেরা, কারা অন্ধকারে বসবাস করছে, দ্রুততার সঙ্গে চলেছে দুর্গতির দিকে, প্রচার করছে মিথ্যা এবং নির্বোধের মতো কথা বলছে। … যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা উপেক্ষিত না হও, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা জীবনের অশ্লীলতাকে মেনে না নাও এবং ধারাবাহিকভাবে এর বাগানকে মরুভূমিতে পরিণত না করো। কেন সংকীর্ণতার জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করো, যখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রেশমি পোশাক তোমাদের জন্য তৈরি হয়েছিল? বিচক্ষণতার বাতি অনুজ্জ্বল হয়ে আসছে, এখনই সঠিক সময় তাকে তেল দিয়ে সজ্জিত করে তোলা। প্রকৃত ভাগ্যের গৃহ ধ্বংস হতে চলেছে, এখনই সময় তা পুনর্নির্মাণ এবং প্রহরার ব্যবস্থা করা। অজ্ঞতার চোরেরা তোমার শান্তি চুরি করেছে, এখনই সময় তা ফিরিয়ে নেওয়ার!
সেই মুহূর্তে একজন গরিব লোক তার সামনে এসে দাঁড়াল এবং ভিক্ষার জন্য সামনে হাত বাড়াল। ভিক্ষুকের দিকে তাকালে তার ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল, কোমলতায় জ্বলে উঠল দুই চোখ এবং তার মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হল দয়ার বিকিরণ। সে ভিক্ষুককে আলিঙ্গন করল স্নেহের সঙ্গে এবং তার হাত সোনায় পরিপূর্ণ করে দিল। তারপর ভালোবাসার মধুরতায় আন্তরিক কণ্ঠে বলল, ‘আগামীকাল আবার আসুন এবং সঙ্গে নিয়ে আসুন আপনার মতোই যারা অর্থকষ্টে ভুগছে।’
সে তার প্রাসাদে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘জীবনের সবকিছুই সুন্দর, এমনকি সোনাও, কারণ এটা একটা পাঠ শিক্ষা দেয়। টাকা হচ্ছে একটা তারযুক্ত যন্ত্র, সে জানে না কীভাবে তাকে ব্যবহার করতে হয় যথাযথভাবে, সে কেবলই শুনবে ফিরে আসা গানগুলি। টাকা হচ্ছে ভালোবাসার মতো, এটা হত্যা করে ধীরে ধীরে এবং বেদনার সঙ্গে, যে তাকে পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে এবং এই অর্থই অন্যকে প্রাণবন্ত করে, যে তার মুখকে ঘুরিয়ে দেয় পাশের মানুষের দিকে।
.
সৌন্দর্যের সিংহাসনের মুখোমুখি
এক কর্মক্লান্ত দিনে আমি সমাজের কঠোরতা এবং নগরের হতবিহ্বল কোলাহল থেকে পালিয়ে গেলাম এবং আমার ক্লান্তিকে নির্দেশ দিলাম এক প্রশস্ত উপত্যকায় পা ফেলতে। আমি তাড়া করলাম ছোট্ট নদীর গতিপথ এবং পাখির কলকাকলি, যতক্ষণ পর্যন্ত একটা নির্জন স্থানে না-পৌঁছালাম, যেখানে দুলতে থাকা বৃক্ষশাখারা মাটি স্পর্শ করা থেকে সূর্যালোককে প্রতিরোধ করছিল।
আমি সেখানে দাঁড়ালাম, এটা ছিল আমার আত্মাকে আপ্যায়ন করা- আমার তৃষ্ণার্ত আত্মা কিছুই দেখছিল না এর মধুরতার পরিবর্তে জীবনের মরীচিকা ছাড়া।
আমি গভীরভাবে চিন্তায় মগ্ন ছিলাম এবং আমার আত্মা পাল তুলেছিল মহাকাশে যখন এক হুরি আঙুরলতার একটা ছোট্ট ঝোপ দিয়ে তার আংশিক নগ্নশরীর ঢেকেছিল এবং তার সোনালি চুলে জড়ানো ছিল পপিগাছ ( যার নির্যাস দিয়ে আফিম তৈরি হয়) এবং সে হঠাৎ করেই আমার সামনে উপস্থিত হল। সে আমার মহাবিস্ময়কে উপলব্ধি করল এবং আমাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলল, ‘আমাকে ভয় পেয়ো না। আমি হলাম এই জঙ্গলের পরী।’
‘তোমার মতো সৌন্দর্যসম্পন্ন কোনো মানুষ কীভাবে এখানে থাকতে সম্মত হয়? দয়া করে আমাকে বলো তুমি কে এবং কোথা থেকে তুমি আসো?’ আমি জানতে চাইলাম। সে মার্জিতভাবে ঘাসের ওপর বসল এবং বলল, ‘আমি হলাম প্রকৃতির চিহ্ন। আমি হলাম চিরকুমারী যার পূজা করত তোমার পূর্বপুরুষ এবং আমার সম্মানে তারা বালবেক ও ডিজাবেইলে অসংখ্য সমাধিমন্দির ও উপাসনাগৃহ স্থাপন করেছিল।’ আমি সাহসের সঙ্গে বললাম, ‘কিন্তু ঐ সমাধিমন্দির ও উপাসনাগৃহগুলি আবর্জনায় পরিণত হয়েছিল এবং আমার প্রেমময় পূর্বপুরুষের হাড়গুলি পরিণত হয়েছিল মাটির অংশে, কিছুই পরিত্যক্ত হয়নি তাদের ঈশ্বরীগুলিকে স্মরণীয় করে রাখতে, কিছু দয়ার্দ্র হৃদয় এবং ইতিহাস গ্রন্থের বিস্মৃত কিছু পৃষ্ঠা ছাড়া।’
সে উত্তর দিল, ‘কিছু কিছু ঈশ্বরী তাদের প্রার্থনাকারীদের হৃদয়ে বাঁচে এবং প্রার্থনাকারীদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারা মারা যায়। কিছু কিছু ঈশ্বরী চিরন্তন ও অসীম জীবনের ভেতরে বাঁচে। আমার জীবন টেকসই হয়েছে পৃথিবীর সৌন্দর্য দ্বারা। তুমি দেখতে পাবে যেখানে তুমি বিশ্রাম নাও সেখানেই তোমার চোখ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য নিজেই। এটা হল পাহাড়ের ভেতরে মেষপালকের উল্লাসের শুরু এবং শস্যক্ষেতে একজন গ্রামবাসীর সুখ এবং সমতলভূমি ও পাহাড়ের মাঝখানে আতঙ্কিত গোত্রগুলির আনন্দ। এই সৌন্দর্য জ্ঞানীদেরকে সত্যের সিংহসনে বসায়।’
তারপর আমি বললাম, ‘সৌন্দর্য হচ্ছে একটা ভয়াবহ ক্ষমতা।’ সে প্রতিবাদ করল, ‘মানুষ সবকিছুকেই ভয় করে এমনকি নিজেকেও। তুমি স্বৰ্গকে ভয় পাও, যা আধ্যাত্মিক শান্তির উৎস। তুমি প্রকৃতিকে ভয় পাও, যা বিশ্রামের স্বর্গ এবং প্রশান্তি, তুমি ভয় পাও ভালোত্বের ঈশ্বরকে এবং ক্রুদ্ধতার জন্য তাকেই অভিযুক্ত করো, যখন সে ক্ষমা ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ।’
কিছুক্ষণ গভীর নীরবতার পর মধুর স্বপ্নসজ্জিত অবস্থায় আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সৌন্দর্য সম্পর্কে আমাকে বলো, মানুষ যা ধারণা অনুসারে ব্যাখ্যা এবং সংজ্ঞায়িত করে তার প্রত্যেকটি, আমি দেখেছি, বিভিন্ন প্রথা ও নিয়ম অনুযায়ী তাকে সম্মানিত ও তার প্রার্থনা করতে দেখেছি।’
সে উত্তর দিল, ‘সৌন্দর্য হল তাই, যা তোমার আত্মাকে আকর্ষণ করে এবং ভালোবাসা দেয় কিন্তু তা গ্রহণ করে না। যখন সৌন্দর্যের সঙ্গে তোমার দেখা হয়, তুমি অনুভব করো তার হাতগুলি তোমার অভ্যন্তরীণ আত্মার গভীরে সামনের দিকে বাড়ানো তোমার হৃদয়রাজ্যে তাকে বহন করে আনতে। এটা বেদনা ও উল্লাসের একটা চমৎকার সমন্বয়, এটা অদৃশ্য, যা তুমি দ্যাখো এবং অস্পষ্টতা যা তুমি উপলব্ধি কর এবং নির্জনতা যা তোমার হৃদয়—এটা হল পবিত্রতার পবিত্রতা যা তোমার ভেতরে শুরু হয় এবং বিশাল সমাপ্তি ঘটে তোমার জাগতিক কল্পনারও অনেক ওপরে।
তারপর জঙ্গলের পরী আমার কাছাকাছি এল এবং তার সুগন্ধিযুক্ত হাত রাখল চোখের ওপর এবং যখন সে তার হাত তুলে নিল আমি উপত্যকায় নিজেকে দেখতে পেলাম একা। যখন আমি শহরে ফিরে এলাম তখন কোনো মানসিক উদ্বেগই অনুভব করলাম না। আমি উচ্চারণ করতে থাকলাম তার কথাগুলি :
সৌন্দর্য হল তাই যা তোমার আত্মাকে আকর্ষণ করে
এবং ভালোবাসা দেয় কিন্তু তা গ্রহণ করে না।
.
আমাকে পরিত্যাগ করো, হে আমার নিন্দুক
আমাকে পরিত্যাগ করো, হে আমার অভিযোগকারী
ভালোবাসার খাতিরে যা তোমার আত্মাকে ঐক্যবদ্ধ করে
তোমার প্রিয় মানুষের সঙ্গে।
কারণ তার জন্য, যা মায়ের ভালোবাসাকে আত্মার সঙ্গে যুক্ত করে
এবং তোমার হৃদয়কে বাঁধে সন্তানোচিত ভালোবাসার
শক্ত বন্ধনে। যাও, আমাকে আমার ক্রন্দনরত হৃদয়ের কাছে রেখে
আমাকে পরিত্যাগ করে যাও।
আমার স্বপ্নের সমুদ্রে আমাকে পাল তুলতে দাও, অপেক্ষা করো
যতক্ষণ পর্যন্ত না আগামীকাল আসে, কারণ আগামীকাল তার ইচ্ছামতো
আমার সঙ্গে খুবই খোলামেলা। তোমার উড়ে
যাবার ভঙ্গি, কিছুই নয় কিন্তু ছায়া, যা আত্মার
সঙ্গে ভ্রমণ করে কুণ্ঠিত সমাধি পর্যন্ত
এবং তাকে দেখায় ঠাণ্ডা ও কঠিন মাটি।
আমার একটা ছোট্ট আত্মা আছে আমার ভেতরে এবং আমি
পছন্দ করি তাকে তার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিতে
এবং তাকে বহন করে নিতে আমার হস্তরেখার ওপরে, তার
গভীরতা পরীক্ষার জন্য এবং টেনে বের করে আনতে
তার গোপনতা।
তীরগুচ্ছ তার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তোমার লক্ষ্য নয়, পাছে সে
আতঙ্কিত হয় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়, তার আগে সে
গোপনীয়তার রক্তগুলো ঢেলে দেয় তার নিজস্ব বিশ্বাসের বেদিতে
উৎসর্গ হিসেবে, যা তাকে ঈশ্বর কর্তৃক দেওয়া হয়েছে,
যখন ঈশ্বর তাকে ভালোবাসা ও
সৌন্দর্য হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
সূর্য উদিত হচ্ছে এবং গান গাইছে নাইটিংগেল
এবং চিরহরিৎ গুল্মদল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গ্ৰহণ
করছে এর সুগন্ধ মহাশূন্যের বাতাসে।
আমি নিজেকে মুক্ত করতে চাই ভ্রান্তির কাঁথা মোড়ানো
সুখনিদ্রা থেকে। আমাকে আটকে রেখো না
হে আমার অভিযোগকারী।
বনের সিংহের নাম উল্লেখ করে আমার খুঁত ধরতে
চেষ্টা কোরো না অথবা উপত্যকার সর্পদের নাম ধরে,
কারণ পৃথিবীর ভীতি সম্পর্কে আমার আত্মা
কিছু জানে না এবং গ্রহণ করে না শয়তান সম্পর্কিত
সতর্কতা শয়তান আবির্ভূত হওয়ার আগে।
আমাকে উপদেশ দিও না হে আমার নিন্দুক
কারণ চরম দুর্দশা আমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করেছে
এবং অশ্রুজল পরিচ্ছন্ন করেছে আমার চোখের অস্পষ্টতা
এবং ত্রুটি আমাকে হৃদয়ের ভাষা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছে।
কথা বোলো না নির্বাসন সম্পর্কে, কারণ বিবেকই হচ্ছে আমার
বিচারক এবং সে আমার সত্যতা প্রতিপাদন করবে এবং রক্ষা
করবে আমাকে যদি আমি নিষ্পাপ হই এবং জীবন আমাকে
অস্বীকার করবে যদি আমি অপরাধী হই।
ভালোবাসার মিছিল চলছে,
সৌন্দর্য আন্দোলিত করছে তার পতাকা
উল্লাসের তূর্যধ্বনি তুলছে যৌবন,
আমার অনুশোচনাকে বিরক্ত কোরো না, হে আমার নিন্দুক।
আমাকে হাঁটতে দাও, কারণ এই পথ গোলাপফুলে সমৃদ্ধ
এবং বাতাস পরিশুদ্ধতায় সুরভিত।
সম্পদ ও বিশালতার কাহিনীর সঙ্গে এটাকে সম্পৃক্ত কোরো না
কারণ আমার আত্মা ঈশ্বরের মহিমার বিশালতা
এবং তার অকৃপণ দানে সমৃদ্ধ।
জনগণ, আইন এবং রাজ্য সম্পর্কে কথা বোলো না। কারণ এই
পুরো পৃথিবীই আমার জন্মস্থান এবং সমস্ত মানবতা হল আমার ভাই।
আমার কাছ থেকে দূরে যাও, কারণ তুমি নিয়ে যাচ্ছ
জীবনদানকারী অনুশোচনা এবং বহন করে আনছ
অপ্রয়োজনীয় শব্দাবলি।
.
একজন প্রেমাস্পদের আহ্বান
হে আমার প্রিয় মানুষ তুমি কোথায়? তুমি কি সেই ছোট্ট স্বর্গে
ফুলগুলিকে জল দিচ্ছ, যারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে
জন্ম থেকে, তাকিয়ে আছে তারা তাদের মায়ের বক্ষস্থলের দিকে।
অথবা তুমি আছ তোমার শয়নকক্ষে, যেখানে
সদ্গুণের পূণ্যভূমি স্থাপিত হয়েছে তোমার সম্মানে এবং যার ওপরে
উৎসর্গ করার জন্য তুমি আমার আত্মা ও হৃদয়কে প্রস্তাব দাও?
অথবা অসংখ্য গ্রন্থাবলির ভেতরে অনুসন্ধান করছ মানুষের জ্ঞান,
যখন তুমি পরিপূর্ণ স্বর্গীয় বিচক্ষণতায়?
হে আমার আত্মার সঙ্গী, তুমি কোথায়? তুমি কি মন্দিরে
প্রার্থনা করছ? অথবা প্রকৃতিকে আহ্বান জানাচ্ছ শস্যক্ষেতে
তোমার স্বপ্নের ভেতরে?
তুমি কি গরিবের জীর্ণ কুটিরে আছ, হৃদয় ভেঙে যাওয়া মানুষদেরকে
সান্ত্বনা দিচ্ছ তোমার আত্মার মধুরতা দিয়ে এবং পূর্ণ করে দিচ্ছ
তাদের হাতগুলি তোমার অকৃপণ দানে।
সর্বত্র তুমি হলে ঈশ্বরের আত্মা
তুমি হলে যুগের চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী।
যেদিন আমাদের দেখা হয়েছিল সেদিনের স্মৃতি কি তোমার মনে আছে,
যখন তোমার আত্মার জ্যোতিশ্চক্র আমাদেরকে ঘিরে
রেখেছিল এবং ভালোবাসার দেবদূত ভেসে বেড়িয়েছিল এবং গেয়েছিল
আত্মার অলিখিত চুক্তির প্রশংসা-সংগীত?
তুমি কি পুনরুদ্ধার করতে পারো বৃক্ষশাখার ছায়ায় বসে থাকার স্মৃতি,
আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম মানবতার কাছ থেকে, যেভাবে পাঁজর
আহত হৃদয়ের ঐশ্বরিক গোপনীয়তাকে নিরাপত্তা দেয়?
তুমি কি স্মরণ করতে পার বনভূমির ভেতরে আমাদের
ভ্রমণের পদচিহ্ন এবং আমরা মাথা রেখেছিলাম পরস্পরের কাঁধে
যেন নিজের ভেতরেই আমরা নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলছি।
মনে করো সেই সময়ের স্মৃতি যখন তোমাকে
বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলাম এবং তুমি মিষ্টি চুম্বন স্থাপন
করেছিলে আমার ঠোঁটে? সেই চুম্বন আমাকে শিখিয়েছিল
ভালোবাসার ভেতরে ওষ্ঠের মিলন প্রকাশ করে স্বর্গীয়
গোপনতা, যা জিভ উচ্চারণ করতে পারে না।
সেই চুম্বন ছিল একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাসের ভূমিকা
সর্বময় ঈশ্বরের শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো যা পৃথিবীকে
মানুষের দিকে ফেরায়।
সেই দীর্ঘশ্বাস আমার পথকে নেতৃত্ব দেয় আধ্যাত্মিক
পৃথিবীর দিকে, আমার আত্মার উদারতা ঘোষণা করতে
করতে এবং সেখানে আমাদের আবার দেখা না-হওয়া
পর্যন্ত এটা স্থায়ী হয়ে থাকবে।
আমি স্মরণ করি, তুমি আমাকে যখন বারংবার
চুম্বন করেছিল। অশ্রুজলে ভেসে যাচ্ছিল তোমার কপোল
এবং তুমি বললে, প্রায়ই জাগতিক শরীরকে অবশ্যই জাগতিক
উদ্দেশ্য থেকে আলাদা হতে হবে এবং অবশ্যই তাকে বসবাস
করতে হবে একান্তে জাগতিক পরিতৃপ্তি দ্বারা প্ররোচিত হয়ে।
কিন্তু ভালোবাসার হাতের ভেতরে আত্মারা যুক্ত থাকবে নিরাপদে
যতক্ষণ পর্যন্ত মৃত্যু না আসে এবং যুক্ত আত্মাকে ঈশ্বরের কাছে
না নিয়ে যায়।
যাও, হে আমার প্রিয় মানুষ ভালোবাসা তোমাকে পছন্দ করেছে
তার প্রতিনিধি হিসেবে, তাকে মান্য করো, কারণ সে হল
সৌন্দর্য, যে তার অনুসারীদেরকে জীবনের মধুরতার কাপ থেকে
পান করার প্রস্তাব দেয়,
যেমন আমার নিজের শূন্যবাহুতে তোমার ভালোবাসা থাকবে
আরাম-আয়েশের মধ্যে- তোমার স্মৃতি, আমার অনন্ত বিবাহ।
হে আমার অন্য সত্তা, তুমি এখন কোথায়? রাত্রির নীরবতায়
তুমি কি জেগে আছ? মৃদুমন্দ বাতাসকে
বহন করে নিতে নেতৃত্ব দাও আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন
এবং ভালোবাসা।
তুমি কি স্মৃতির ভেতরে আমার মুখমণ্ডলকে আদর করছ? যা
আমার প্রতিমূর্তি নয়, কারণ দুঃখ তার ছায়া ফেলেছে অতীতের
সুখ ও প্রসন্নতার ওপর।
তোমার ফোঁপানি আমার দুচোখ শুকিয়ে ফেলেছে যেখানে
প্রতিফলিত হত তোমার সৌন্দর্য এবং শুকিয়ে ফেলেছে
আমার ঠোঁট যা তুমি চুম্বনে চুম্বনে মধুর করে
তুলেছিলে।
হে আমার প্রেমাস্পদ, তুমি কোথায়? তুমি কি আমার
কান্না শুনতে পাচ্ছ সমুদ্রের ওপারে? তুমি কি আমার চাহিদা
উপলব্ধি করতে পারো? তুমি কি জানো আমার ধৈর্যের বিশালতা?
মহাশূন্যে এরকম আত্মা কি আছে, যে এইসব যৌবনের মৃত্যুর
শ্বাসপ্রশ্বাসকে এই বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম? দেবদূতদের
ভেতরে কি কোনো গোপন যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে
যা আমার অভিযোগকে তোমার কাছে বহন করে নিয়ে যাবে?
হে আমার মনোমুগ্ধকর নক্ষত্র, জীবনের অজ্ঞতাগুলি
আমাকে এর বক্ষের ওপর একত্রিত করেছে, আমাকে দখল
করেছে দুঃখ,
বাতাসে তোমার হাসির পাল উড়িয়ে দাও, এটা পৌঁছে যাবে
এবং প্রাণবন্ত করে তুলবে আমাকে,
বাতাসে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করো তোমার সুগন্ধ,
এই সুগন্ধ আমাকে টিকিয়ে রাখবে!
হে আমার প্রেমাস্পদ, তুমি কোথায়?
আহ ভালোবাসা কী বিশাল!
এবং আমি কত ক্ষুদ্র!
.
মৃত্যুর সৌন্দর্য
এম. ই. এইচ-এর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীত
প্রথম পর্ব : আহ্বান
আমাকে ঘুমাতে দাও, কারণ আমার আত্মা ভালোবাসায়
আচ্ছন্ন হয়ে আছে,
আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও, কারণ আমার আত্মার ছিল
দিন ও রাত্রিগুলির অকৃপণ দান,
মোমবাতিগুলো জ্বেলে দাও এবং পোড়ার ধূপ
আমার বিছানার চারপাশে গোলাপ ও জুঁইফুলের পাতা
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঢেকে দাও আমার শরীর,
রজন দিয়ে সুবাসিত করো আমার চুল এবং পায়ে
ছিটিয়ে দাও সুগন্ধি,
এবং পাঠ করো মৃত্যুর হাত আমার কপালে কী লিখেছে।
সুখনিদ্রার বাহুতে আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও, কারণ আমার
খোলা চোখদুটো ক্লান্ত,
রুপালি তারের বীণাকে শিহরিত হতে দাও এবং
আমার আত্মাকে শান্ত করো।
বীণার সুর থেকে বয়ন করো একটি অবগুণ্ঠন আমার শুকিয়ে
যাওয়া হৃদয়ের চারপাশে।
অতীতের গান গাও, যেভাবে তুমি আকাঙ্ক্ষার ভোরবেলাকে তুলে
ধরো আমার দুচোখে, কারণ এর জাদুর অর্থই হল একটি
কোমল বিছানা, যার ওপর আমার হৃদয় বিশ্রাম নেয়।
বন্ধুরা চোখের জল মুছে ফ্যালো, উত্থিত হও ফুলের মতো,
যেভাবে তাদের মুকুট ভোরবেলাকে স্বাগত জানায়।
মৃত্যুর বরের দিকে তাকাও, আলোর স্তম্ভের মতো
দাঁড়িয়ে আছে আমার এবং অনন্তের মাঝখানে,
রুদ্ধশ্বাসে মনোযোগ দিয়ে আমার সঙ্গে শোনো, মৃত্যুর সাদা পাখার
ইশারায় ডাকাডাকি।
আমার কাছে এসো এবং আমাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাও,
হাসতে থাকা ওষ্ঠ দিয়ে স্পর্শ করো আমার চোখ।
শিশুদেরকে নরম এবং বেড়ে ওঠা আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরতে
দাও আমার হাত,
বৃদ্ধদেরকে দাও তাদের শির-ওঠা হাত আমার হৃদয়ের ওপর
রাখতে এবং আমাকে আশীর্বাদ করতে।
কুমারীদেরকে আরও কাছে আসতে দাও আমার চোখে
ঈশ্বরের ছায়া দেখতে এবং শুনতে দাও আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের ভেতরে
ঈশ্বরের ইচ্ছা পৌঁছে যাওয়ার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি।
দ্বিতীয় পর্ব : আরোহণ
আমি একটা পাহাড়চূড়া অতিক্রম করেছি এবং আমার আত্মা
জ্যোতির্মণ্ডলের যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে— পরিপূর্ণ এবং
বন্ধনহীন স্বাধীনতা।
আমি বহুদূরে হে আমার সঙ্গী এবং মেঘ
আমার চোখ থেকে পাহাড়গুলিকে
লুকিয়ে ফেলছে।
উপত্যকাগুলি প্লাবিত হচ্ছে নৈঃশব্দের সমুদ্রে এবং
বিস্মৃতির দুই হাত গ্রাস করছে সড়ক ও গৃহগুলি,
তৃণভূমি এবং শস্যক্ষেত অপসৃত হয়ে যাচ্ছে
সাদা অপচ্ছায়ার পেছনে, যা দেখায় বসন্ত মেঘের মতো,
মোমবাতির হলুদ আলোর মতো এবং গোধূলিবেলার
মতো লাল।
ঢেউয়ের সংগীত এবং স্রোতের স্তোত্রগীতি
সব ছড়ানো ছিটানো এবং ভিড়ের কণ্ঠস্বর
নীরবতায় নেমে আসা এবং আমি কিছুই শুনতে পাই না
অনন্তের গান ছাড়া, যার সঙ্গে যথাযথ মিল
রয়েছে আত্মার আকাঙ্ক্ষার,
আমি পরিপূর্ণ সাক্ষ্যপ্রমাণের ভেতরে ছদ্মবেশী,
আমি আছি আয়েশের ভেতরে, আমি আছি শান্তিতে।
তৃতীয় পর্ব : অবশিষ্ট
এই সাদা লিনেনের অবগুণ্ঠনে আমাকে জড়াবে না
এবং আমাকে জুঁই ও পদ্মফুলের পাতার পোশাক পরিয়ে
দাও। হাতির দাঁতের তৈরি বাক্স থেকে আমার শরীরটা
সরিয়ে নাও এবং তাকে বিশ্রাম নিতে দাও
কমলালেবু ফুটে থাকা বালিশের ওপর।
আমাকে নিয়ে শোক কোরোনা,গাও যৌবন ও উল্লাসের গান,
আমার ওপরে অশ্রুজল ফেলো না, গাও ফসল তোলার এবং
আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের গান,
মর্মপীড়ার কোনো দীর্ঘশ্বাস ফেলো না, কিন্তু তোমার আঙুল
দিয়ে আমার মুখখানা তুলে ধরো, যা ভালোবাসা ও উল্লাসের প্রতীক।
বাতাসের প্রশান্তিকে নষ্ট কোরো না জাদুমন্ত্র ও
মৃতব্যক্তির উদ্দেশে নিবেদিত প্ৰাৰ্থনায়,
কিন্তু তোমাদের হৃদয়কে গাইতে দাও অনন্ত জীবনের গান।
কালো পোশাক পরে আমার জন্য শোক কোরো না
বরং রঙিন পোশাক পরো এবং আমার সঙ্গে উল্লসিত হও।
হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে আমার প্রস্থানের কথা বোলো না,
তোমাদের চোখ এবং তোমরা আমাকে দেখতে পাবে চিরদিন।
আমাকে স্থাপন কর গুচ্ছ গুচ্ছ পাতার ওপরে এবং আমাকে
বহন করো তোমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ কাঁধের ওপর এবং ধীরগতিতে
হাঁটো পরিত্যক্ত বনভূমির দিকে,
জনাকীর্ণ সমাধিক্ষেত্রে আমাকে নেবে না, পাছে আমার
সুখনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে।
হাড় এবং খুলির দ্রুতগামিতায় চূর্ণবিচূর্ণ হও।
আমাকে বহন করে নাও সাইপ্রেস বনে এবং কবর খনন করো
যেখানে উদ্যান উদ্ভিদ এবং পাপিগাছ অন্যের ছায়ায় বাড়ে না।
আমার কবরকে আরও গভীর হতে দাও, তাহলে
বন্যা আমার হাড়গুলিকে খোলা উপত্যাকায়
বহন করে নেবে না।
প্রশস্ত হতে দাও আমার কবরকে, তাহলে আসবে গোধূলির ছায়া
এবং বসবে আমার পাশে।
জাগতিক সমস্ত পোশাক আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও
এবং আমাকে স্থাপন করো মাটিতে, যে আমার মা
এবং যত্নের সঙ্গে আমাকে স্থাপন করো আমার মায়ের বক্ষে।
আমাকে নরম মাটি দিয়ে ঢেকে দাও এবং প্রতি মুঠো মাটিতে
মিশ্রিত হতে দাও জুঁই, পদ্ম এবং চিরহরিৎ গুল্মের বীজ।
যখন তারা বেড়ে উঠবে এবং আমার শারীরিক উপাদানের সাফল্য
অর্জন করবে তখন তারা মহাশূন্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে
গ্রহণ করবে আমার হৃদয়ের সুগন্ধ।
এবং সূর্যের কাছে প্রকাশ করো আমার শান্তির গোপনীয়তা,
এবং মৃদুমন্দ বাতাসে উড়িয়ে দাও তোমার পাল এবং আয়েশ দাও
পথিকদেরকে।
তারপর আমাকে পরিত্যাগ করে যাও বন্ধুরা-আমাকে
পরিত্যাগ করে যাও এবং চলে যেতে দাও নৈঃশব্দের পদযুগে
এবং আপেল গাছের যত্রতত্র ফুল ফুটেছে মৃদুমন্দ
বাতাসের স্পন্দনের ভেতরে।
তোমরা তোমাদের বসতিতে ফিরে যাও এবং সেখানেই তোমরা
ভালো থাকবে, মৃত্যু তোমাদের ও আমার কাছ থেকে
সরে যেতে পারবে না।
এই স্থান পরিত্যাগ করো, কারণ তোমরা এখানে যা দ্যাখো
অর্থগতভাবে তা অনেক দূরে অবস্থান করে
জাগতিক পৃথিবী থেকে। আমাকে পরিত্যাগ করো।
.
রাজপ্রাসাদ ও কুঁড়েঘর
প্ৰথম পৰ্ব
রাত্রি নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল বাড়িটা আলোয় ঝলমল করে উঠল। ভৃত্যরা বিশাল দরজার কাছে অপেক্ষা করতে লাগল অতিথিদের আগমনের এবং তাদের মখমলের পোশাকের সোনালি বোতামগুলি জ্বলজ্বল করছিল।
চমৎকার একটা চার-চাকার ঘোড়ার গাড়ি প্রাসাদের পার্কের ভেতরে ঢুকে পড়ল এবং প্রবেশ করলেন মহৎ মানুষেরা। তাদের জমকালো পোশাকগুলো ছিল মূল্যবান রত্নে সজ্জিত। মনোমুগ্ধকর সুরে বাতাস পূর্ণ হয়ে উঠল, যখন কোমল বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে শুরু হল নাচ।
মধ্যরাতে সবচেয়ে রুচিকর ও চমৎকার খাবার পরিবেশিত হল খুবই সুন্দর একটা টেবিলে, যা বিভিন্ন রকমের দুর্লভ ফুল দিয়ে অলংকৃত। অতিথিরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ভোজন ও পান করলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না মদ তার নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে শুরু করল। ভোরবেলায় অতিথিদের ভিড় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ঝড়ের গতিতে রাত্রির দীর্ঘ সময় আচ্ছন্নতায় কাটানোর পর এবং অতিভোজন, যা তাদেরকে দ্রুত গভীর শয্যায় নিয়ে গেল অস্বাভাবিক ঘুমের কারণে।
দ্বিতীয় পর্ব
সন্ধ্যায় এক লোক এসে তার বাড়ির দরজায় দাঁড়াল। তার পোশাক দেখে বোঝা যায় সে প্রচুর পরিশ্রম করে এসেছে। সে দরজায় কড়া নাড়ল এবং খোলার সঙ্গে সঙ্গে সে ভেতরে প্রবেশ করল, মনোরোম ভঙ্গিতে অভিবাদন জানাল। তারপর শিশুদের ভেতরে বসে পড়ল যারা অগ্নিকুণ্ডের পাশে খেলছিল। অল্প সময়ের ভেতরেই তার স্ত্রী খাবার তৈরি করল। তারপর তারা একটা কাঠের টেবিলে বসল খাবার খেতে। খাবারের পর তারা জড়ো হল একটা বাতির চারপাশে এবং বলতে লাগল সারাদিনের ঘটনাবলি। রাত্রির প্রথম অংশ স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর তারা প্রত্যেকেই নীরবে উঠে দাঁড়াল এবং প্রশংসা- সংগীত গাইতে গাইতে আত্মসমর্পণ করল সুখনিদ্রার রাজার কাছে এবং কৃতজ্ঞতার একটি প্রার্থনাও তখন তাদের ঠোঁটে উচ্চারিত হচ্ছে।
.
একজন কবির কণ্ঠস্বর
প্ৰথম পৰ্ব
সহৃদয়তার শক্তি আমার হৃদয়ে বীজ বপন করে এবং আমি তা পাকিয়ে তুলি এবং আঁটি বেঁধে জড়ো করি গম, তারপর তা দান করি ক্ষুধার্তদের। আমার আত্মা আঙুরলতাকে জীবন দান করে এবং আমি এর শাখাগুলিকে পেষণ করি এবং নির্যাস পান করতে দিই তৃষ্ণার্তদের। স্বর্গ আমার বাতি তেলে পূর্ণ করে দেয় এবং আমি তা স্থাপন করি আমার জানালায় অন্ধকারের ভেতর দিয়ে আগন্তুকদের নির্দেশ দিতে।
আমি এই সবকিছু করি, কারণ আমি তাদের ভেতরে বসবাস করি এবং যদি ভাগ্য আমার হাতদুটো বেঁধে ফেলে এবং আমাকে প্রতিরোধ করে এসব করা থেকে তাহলে মৃত্যুই হবে আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। কারণ আমি একজন কবি, যদি আমি কিছু না দিতে পারি, তাহলে আমি গ্রহণেও অস্বীকৃতি জানাব।
মানবতা প্রচণ্ড ঝড়ের মতো উন্মত্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু আমি নীরবতার ভেতরে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, কারণ আমি জানি, একটি ঝড় অবশ্যই অতিক্রম করে যায় যখন একটি দীর্ঘশ্বাস ঈশ্বরের দিকে ধাবিত হয়।
জাগতিক জিনিসের সঙ্গে মানবতা সেঁটে থাকে, কিন্তু সবসময়ই অনুসন্ধান করি ভালোবাসার মশাল, তাকে আলিঙ্গন করতে, কারণ এটা আমাকে পরিশুদ্ধ করবে এর অগ্নি দিয়ে এবং আমার হৃদয়ের মানবতাহীনতাকে পোড়াবে আগুনে।
বস্তুগত বিষয় ভোগান্তি ছাড়াই একজন মানুষকে মৃত্যু এনে দিতে পারে, ভালোবাসা তাকে জাগিয়ে রাখে এবং প্রাণবন্ত করে তোলে বেদনায়। মানবজাতি বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত এবং তারা বিভিন্ন দেশ ও শহরের অধিবাসী। কিন্তু সমস্ত মানবগোষ্ঠীর কাছেই আমি নিজেকে দেখতে পাই আগন্তুক হিসেবে এবং আমার কোনো বসতি নেই। সমগ্র বিশ্বজগৎই আমার দেশ এবং মানব-পরিবারই আমার গোত্র।
মানুষ হচ্ছে দুর্বল এবং এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে তারা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত। পৃথিবীটা সংকীর্ণ এবং এটাও নির্বুদ্ধিতা একে সাম্রাজ্য, দেশ ও প্রদেশে বিভক্ত করা।
মানবপ্রজাতি শুধুমাত্র নিজেদেরকে একত্রিত করে আত্মার মন্দিরগুলো ধ্বংস করতে এবং আরও একত্রিত করে তাদের হাত দুখানা জাগতিক অস্তিত্বকে নির্মাণ করতে। আমি একাকী দাঁড়িয়ে শুনছি আমার নিজস্ব উচ্চারণের গভীরতার ভেতরে আকাঙ্ক্ষার কণ্ঠস্বর, ‘যেভাবে ভালোবাসা একজন মানুষের হৃদয়কে বেদনায় প্রাণবন্ত করে তোলে সেভাবেই অজ্ঞতা তাকে জ্ঞানী হতে শিক্ষা দেয়।’ বেদনা ও অজ্ঞতা বিশাল উল্লাস ও জ্ঞানকে নেতৃত্ব দেয়, কারণ সর্বময় অস্তিত্ব এমন কিছুই সৃষ্টি করেননি এই সূর্যের নিচে যা বিফলে যাবে।
দ্বিতীয় পর্ব
আমার এই চমৎকার দেশটা নিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এবং আমি এদেশের মানুষকে ভালোবাসি তাদের দুর্দশার জন্য, কিন্তু যদি আমার লোকেরা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং উদ্দীপিত হয় লুণ্ঠনের দ্বারা এবং হত্যা করতে, যাকে তারা ‘দেশপ্রেমমূলক উদ্দীপনা’ বলে তার দ্বারা উৎসাহিত হয় এবং সমস্ত বাহিনী নিয়ে হানা দেয় প্রতিবেশী দেশগুলিতে, তাহলে আমি ঘৃণা করব আমার দেশ ও মানুষকে।
আমি আমার জন্মস্থানের প্রশংসা-সংগীত গাই এবং প্রতীক্ষা করি আমার শৈশবের গৃহটাকে দেখতে, কিন্তু গৃহের লোকেরা যদি আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে এবং অস্বীকার করে ক্ষুধার্ত পথিকদেরকে আহার যোগাতে, তাহলে আমি আমার প্রশংসা-সংগীতকে ক্রোধে রূপান্তরিত করব এবং আকুল আকাঙ্ক্ষাকে রূপান্তরিত করব বিস্মৃতিতে। আমার অন্তর্নিহিত কণ্ঠস্বর বলবে, ‘এই গৃহ দুঃখী মানুষকে আয়েশ দেয় না, এখানে পাওয়ারও কিছু নেই ধ্বংস ছাড়া।’
আমি আমার গ্রামের বাড়িকে ভালোবাসি, তার ভেতরে আমার দেশের জন্যও কিছু ভালোবাসা আছে এবং আমি আমার দেশকে ভালোবাসি যার ভেতরে পৃথিবীর জন্যও আংশিক ভালোবাসা আছে- যার সবকিছুই আমার দেশ এবং আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে পৃথিবীকে ভালোবাসি কারণ এটা হল মানবতার স্বর্গ যা ঈশ্বরের আত্মাকে সুস্পষ্ট করে তোলে।
মানবতা হচ্ছে পৃথিবীর ওপর সর্বময় ক্ষমতার আত্মা এবং সেই মানবতাই ধ্বংসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, লুকোচ্ছে এর নগ্নতা ছেঁড়া বস্ত্রের পেছনে, অশ্রু ঝরাচ্ছে অন্তঃসারশূন্য কপোলের ওপর এবং তার সন্তানকে ডাকছে করুণাপূর্ণ কণ্ঠস্বরে। কিন্তু সন্তানেরা ব্যস্ত। তারা গাইছে তাদের গোত্রের স্তবগীতি। তারা আরও ব্যস্ত তাদের অস্ত্রগুলিকে ধারালো করে তুলতে এবং কখনও তারা তাদের মায়ের কান্না শুনতে পায় না। মানবতা তার জনগণের কাছেই তার আবদন জানায় কিন্তু তারা তা শোনে না। কেউ যদি তা শোনে এবং সান্ত্বনা হিসেবে একজন মায়ের চোখের জল মুছে দেয় তাহলে অন্যরা বলবে, ‘সে হচ্ছে দুর্বল, ভাবানুভূতি দ্বারা আক্রান্ত।’
মানবতা হচ্ছে পৃথিবীতে সর্বময় অস্তিত্বের আত্মা এবং সেই সর্বময় ক্ষমতা ভালোবাসা এবং শুভ-ইচ্ছা প্রচার করে। কিন্তু জনগণ এধরনের শিক্ষাকে হাস্যকর বলে মনে করে। নাজারেতবাসী যিশু তা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন এবং ক্রশবিদ্ধ হওয়া ছিল তার নিয়তি। সক্রেটিস কণ্ঠস্বরটি শুনেছিলেন এবং তা অনুসরণ করেছিলেন এবং তিনিও শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। নাজারেতবাসী এবং সক্রেটিস ছিল ঈশ্বরের অনুসারী এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদেরকে হত্যা করা হয়নি ততক্ষণ জনগণ উপহাস করেছে এবং বলেছে, ‘ব্যঙ্গ- বিদ্রূপ হত্যার চেয়েও কষ্টকর।’
জেরুজালেম নাজারেতবাসীদেরকে হত্যা করবে না, হত্যা করবে না এথেন্সের সক্রেটিসকে, যদিও তারা জীবন্ত হয়ে আছে এবং চিরকাল জীবন্ত থাকবে। ঈশ্বর- অনুসারীদের ওপর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ সাফল্য অর্জন করতে পারে না। তারা বাঁচে এবং বেড়ে ওঠে চিরকালের জন্য।
তৃতীয় পৰ্ব
হে আমার ভাই, সৌন্দর্যকে মূর্ত করে তোলার ক্ষমতা তোমার আছে, কারণ তুমি একজন মানুষ এবং আমরা দুজনেই একই পবিত্র আত্মার সন্তান, আমরা সমপর্যায়ের এবং একই মাটি দিয়ে তৈরি।
তুমি এখন আমার সঙ্গে আছ যেভাবে আমার সঙ্গী আমার পথে চলছে এবং উপলব্ধির ভেতরে আমার আনুকূল্য হচ্ছে গুপ্ত সত্যের অর্থগুলি। আমি তোমাকে ভাইয়ের মতো ভালোবাসি। তুমি তোমার পছন্দের কথা আমাকে বলতে পারো, কারণ আগামীকাল তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে এবং তোমার বক্তব্যকে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করবে বিচারের জন্য এবং তুমি নায্য বিচার পাবে।
তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারো যা যা আমার আধিকারে আছে তার সবকিছু থেকে, কারণ আমার লোভ আমাকে উস্কানি দিয়েছিল এসব সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে এবং এখন তোমাকে অধিকার দেওয়া হয়েছে আমার নিয়তির, যদি তা তোমাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে।
তোমার যেমন ইচ্ছা তেমনই আচরণ করতে পারো আমার সঙ্গে, কিন্তু তা আমার সত্যকে স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না। তুমি আমার রক্তপাত ঘটাতে পারো এবং পুড়িয়ে ফেলতে পারো আমার শরীর, কিন্তু তুমি হত্যা অথবা শিকার করতে পারবে না আমার আত্মাকে। তুমি আমার দুহাত শৃঙ্খলিত করতে পারো, পায়ে পরাতে পারো বেড়ি এবং আমাকে ফেলে রাখতে পারো অন্ধকার কারাগারে কিন্তু আমার চিন্তাকে তুমি দাসত্বে পরিণত করতে পারবে না, কারণ তা স্বাধীন, প্রশস্ত আকাশের মৃদুমন্দ বাতাসে। তুমি আমার ভাই এবং আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি ভালোবাসি তোমাকে চার্চে হাঁটু গেড়ে প্রনত এবং মসজিদে প্রার্থনারত অবস্থায়। তুমি, আমি এবং প্রত্যেকেই এক ধর্মের সন্তান, কারণ ধর্মের বিভিন্ন পথ রয়েছে কিন্তু সর্বময় অস্তিত্বের ভালোবাসার হাতের আঙুলগুলি সবার ওপর বিস্তৃত, আত্মার সম্পূর্ণতা দান করছেন সবাইকে, গ্রহণ করতে চাইছেন সবাইকে তীব্রভাবে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার সত্যের জন্য যা উদ্ভূত হয়েছে জ্ঞান থেকে, সেই সত্য যাকে আমি দেখতে পারি না আমার অজ্ঞতার কারণে। কিন্তু আমি তাকে ঐশ্বরিক বিষয় হিসেবে শ্রদ্ধা করি, কারণ এটা হল আত্মার দলিল। তোমার সত্য আমার সত্যের সাথে মিলিত হবে আগামী পৃথিবীতে এবং একত্রে মিশ্রিত হবে ফুলের সুগন্ধের মতো এবং সব পরিণত হবে এক এবং চিরকালীন সত্যে, তাকে চিরস্থায়ী করতে এবং বেঁচে থাকতে ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের অনন্তকালের ভেতরে।
আমি তোমাকে ভালোবাসি, কারণ শক্তিশালী নিপীড়কদের মুখোমুখি তুমি দুর্বল এবং লোভী সম্পদশালীদের মুখোমুখি দরিদ্র। এসব কারণে আমি আমার অশ্রু ঝরাই এবং তোমাকে আয়েশ দিই এবং আমার অশ্রুজলের ভেতর থেকে আমি দেখি ন্যায়বিচারের বাহুদুটি তোমাকে আলিঙ্গন করছে, হাসছে এবং ক্ষমা করছে তোমার শাস্তিপ্রদানকারীদেরকে। তুমি আমার ভাই, তোমাকে আমি ভালোবাসি।
চতুর্থ পৰ্ব
তুমি আমার ভাই, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে বিবাদ করছ কেন? কেন তুমি আমার দেশে হানা দাও এবং আমাকে পরাভূত করতে চেষ্টা করো তাদেরকে খুশি করতে, যারা মর্যাদা ও কর্তৃত্ব অনুসন্ধান করছে?
কেন তুমি তোমার সন্তানদের পরিত্যাগ করো এবং অনুসন্ধান করো মৃত্যুর দূরবর্তী ভূমি তাদরেকে খুশি করতে, যারা তোমার রক্ত দিয়ে মর্যাদা কেনে এবং তোমার মায়ের অশ্রু দিয়ে কেনে উচ্চ সম্মান। একজন পুরুষের জন্য তার ভাইকে হত্যা করা কি একটি সম্মানের বিষয়? যদি তুমি এটাকে সম্মানের মনে করো তাহলে তাকে প্রার্থনার দৃশ্য হতে দাও এবং মন্দির নির্মাণ করে তোলো, কারণ এর জন্য সে তার ভাই আবেল-কে হত্যা করেছিল।
প্রকৃতির প্রথম আইন কি আত্ম-সংরক্ষণ? তাহলে কেন তোমার লোভ আত্ম-উৎসর্গের জন্য তোমাকে তাড়া করে ফেরে, ভাইকে আঘাত করে শুধুমাত্র নিজের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে? হে আমার ভাই, সচেতন হও সেইসব নেতাদের সম্পর্কে যারা বলে, ‘অস্তিত্বের প্রতি ভালোবাসা আমাদেরকে বাধ্য করে জনগণকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে।’ আমি তোমাকে বলি : অন্যের অধিকার রক্ষা করা সবচেয়ে মহৎ কাজ এবং অধিকাংশ চমৎকার মানুষের কর্ম, যদি আমার অস্তিত্ব চায় তাহলে আমি অন্যদের হত্যা করি, তারপর মৃত্যু হল আমার কাছে অধিক সম্মানের যোগ্য এবং আমি যদি কাউকে খুঁজে না পাই আমাকে হত্যা করতে আমার সম্মান রক্ষা করার জন্য, তাহলে আমি নিজের হাতে নিজের জীবন নিতে দ্বিধা করব না অনন্তকালের জন্য, অনন্তকাল আসার আগেই। হে আমার ভাই, স্বার্থপরতা হল অন্ধ শ্রেষ্ঠতার কারণ এবং শ্রেষ্ঠত্ব তৈরি করে গোত্রপ্রথা এবং গোত্রপ্রথা তৈরি করে শ্রেষ্ঠত্ব যা মতানৈক্য ও দমননীতিকে নেতৃত্ব দেয়।
আত্মা বিশ্বাস করে জ্ঞানের ক্ষমতা এবং অজ্ঞতার ওপর ন্যায়পরায়ণতার সাফল্য। এটা অস্বীকার করে সেই কর্তৃপক্ষকে যে অস্ত্র সরবরাহ করে অজ্ঞতা ও নিপীড়নকে রক্ষা ও শক্তিশালী করতে—সেই কর্তৃপক্ষ যারা ব্যাবিলনকে ধ্বংস করেছিল, নাড়া দিয়েছিল জেরুজালেমের ভিত্তিভূমি এবং বিধ্বস্ত হতে দিয়েছিল রোমকে। এটা হল তা-ই যা জনগণকে তৈরি করে মহৎ মানুষকে অপরাধী বলে ভাবতে, লেখকদেরকে তৈরি করে নিজের নামকে সম্মান জানাতে এবং ঐতিহাসিকদেরকে তৈরি করে প্রশংসার রীতিতে তাদের মানবতার কাহিনীকে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে।
একমাত্র কর্তৃপক্ষ যাকে আমি মান্য করি তা হল ন্যায়বিচারের স্বাভাবিক আইনের ভেতরে সতর্ক প্রহরা ও সম্মত হওয়ার জ্ঞান।
কোন্ কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচারকে প্রদর্শন করে যখন তা হত্যাকারীকে হত্যা করে? কখন এটা বন্দি করে অপহরণকারীকে? কখন এটা প্রতিবেশী দেশে হামলা চালায় এবং হত্যা করে এর জনগণকে? ন্যায়বিচার কি চিন্তা করে সেই কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে, যার নিয়ন্ত্রণে একজন হত্যাকারী অন্য একজনকে শাস্তি দেয় যে হত্যা করেছে এবং একজন চোর একজনের দণ্ডাদেশ ঘোষণা করে যে চুরি করেছে?
তুমি আমার ভাই এবং আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তীব্রতা ও মর্যাদাসহ ভালোবাসা হচ্ছে একটি ন্যায়পরায়ণতা। যদি ন্যায়পরায়ণতা তোমার জন্য আমার ভালোবাসাকে সমর্থন না করে তাহলে তা তোমার গোত্র ও জনগোষ্ঠীর দায়িত্বহীনতা, আমি প্রতারকে পরিণত হব প্রকৃত ভালোবাসার বহিরাবরণের পেছনে স্বার্থপরতার কাদর্যতাকে গোপন করতে।
উপসংহার
আমার আত্মা হচ্ছে আমার বন্ধু, যে জীবনের দুর্দশা ও নিদারুণ বেদনায় আমাকে সান্ত্বনা দেয়। যে আত্মা মানবতার শত্রু তাকে সে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে না এবং সে নিজের ভেতরে মানুষের কোনো নির্দেশনা খুঁজে পায় না যা বেপরোয়াভাবে ধ্বংস করবে সবকিছু। আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম এবং এখন তা আমি বলব কিন্তু মৃত্যু যদি এই উচ্চারণকে প্রতিরোধ করে তাহলে তা উচ্চরিত হবে আগামীকাল, কারণ আগামীকাল কখনও পরিত্যাগ করে না সেই গোপনীয়তাকে, যা অনন্তকালের গ্রন্থে রয়েছে।
ভালোবাসার মহিমা ও সৌন্দর্যের আলোর ভেতরে আমি বাঁচতে এসেছিলাম, যা হচ্ছে ঈশ্বরের প্রতিফলন। আমি এখানে বেঁচে থাকছি এবং জনগণ আমাকে জীবনের রাজ্য থেকে নির্বাসন দিতে সক্ষম, কারণ তারা জানে আমি মৃত্যুর ভেতরে বেঁচে থাকব। যদি তারা আমার চোখ তুলে নেয় তাহলে আমি শুনতে থাকব ভালোবাসার ফিসফিসানি এবং সৌন্দর্যের গান।
যদি তারা আমার কান বন্ধ করে দেয় তাহলে আমি উপভোগ করব ভালোবাসার ধূপ এবং সৌন্দর্যের সুগন্ধমিশ্রিত মৃদুমন্দ বাতাসের স্পর্শ ।
যদি আমাকে শূন্যতার ভেতরে স্থাপন করে তারা তাহলে আমি একত্রে বসবাস করব আমার আত্মার সঙ্গে, যে ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের সন্তান।
আমি সবার জন্য এখানে এসেছিলাম এবং সবার সঙ্গে এবং আমার নির্জনতার ভেতরে আমি যা করি, আগামীকাল মানুষের কাছে তা প্রতিধ্বনিত হবে। এখন আমি যা বলি একটা হৃদয়ের সঙ্গে, সেই একই কথা আগামীকাল বলবে অনেকগুলি হৃদয়।
.
নববধূর শয্যা*
[* ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে উত্তর লেবাননে এই ঘটনা ঘটেছিল এবং আমার কাছে এটা পৌঁছেছিল এমন এক লোকের মাধ্যমে যে এই কাহিনীর একটা আদর্শকে সম্পর্কিত করেছিল এবং বর্ণিত অনুষ্ঠানে সে উপস্থিত ছিল। (কহলীল জিবরান)]
নববধূ ও বর মোমবাতি-বহনকারীদের সঙ্গে অগ্রবর্তী হলে তাদেরকে অনুসরণ করল যাজকবৃন্দ ও বন্ধুরা, মন্দির পরিত্যাগ করে তাদের সঙ্গী হল যুবক ও যুবতীরা যারা বর ও বধূর পাশে পাশে হাঁটছিল এবং গান গাইছিল এবং পরিপূর্ণ করে তুলছিল নভোমণ্ডলকে সুখী ও চমৎকার সুর-মাধুর্যে।
মিছিলটা কনের বাড়িতে পৌঁছালে নবদম্পতিকে একটা প্রশস্ত কক্ষে উঁচু আসনে বসানো হল এবং বিবাহ-উৎসব উদযাপনকারীরা বসল রেশমি কাপড়ে মোড়া গদি-আঁটা চেয়ার ও মখমলের ডিভানে, যতক্ষণ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক হিতাকাঙ্ক্ষীর কোলাহলে কক্ষটি পরিপূর্ণ না হল। ভৃত্যরা টেবিল সাজিয়ে দিল এবং অভ্যাগতরা বর ও নববধুর স্বাস্থ্য পান করতে শুরু করল, যখন বাদকেরা তাদের তারযুক্ত যন্ত্র দিয়ে আত্মার প্রশান্তি আনয়ন করছিল। যে কেউ কান পাতলেই খঞ্জনীর ধ্বনির সঙ্গে মদের গ্লাসের টুংটাং আওয়াজের ঐক্যবদ্ধ সংগীত শুনতে পাবে। তরুণীরা মার্জিতভাবে নাচতে শুরু করল এবং বিভিন্ন ভঙ্গির বাঁকানো ঢেউ তুলতে লাগল তাদের নমনীয় শরীরে গানের সুরের তালে তালে, আর দর্শক উল্লাসের সঙ্গে তা লক্ষ্য করছিল এবং মদ পান করছিল বেশি বেশি।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই উচ্ছল ও চমৎকার বিবাহ-উৎসবটি নিম্নমানের মাতলামির বন্য আনন্দ-উৎসবে পরিণত হল। এখানে একজন যুবক ঢেলে দিচ্ছে তার হৃদয়ের যাবতীয় অনুভূতি এবং প্রকাশ করছে এক আকর্ষণীয় তরুণীর প্রতি ক্ষণিকের প্রশ্নসাপেক্ষ ভালবাসা। সেখানে আরও একজন যুবক চেষ্টা করছে এক নারীর সঙ্গে কথা বলার এবং সে খুবই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার মাতাল জিভের একটা চমৎকার অভিব্যক্তি তুলে ধরতে, যা সে অনুসন্ধান করছে। এখন শোনা যাচ্ছে একজন বয়স্ক পুরুষ বাদকদেরকে পীড়াপিড়ি করছে একটা নির্দিষ্ট সঙ্গীত পুনরাবৃত্তি করার জন্য, যা তার যৌবনের দিনগুলিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই দলের ভেতরের এক নারী ফষ্টিনষ্টি করছিল এক পুরুষের সঙ্গে, যাকে প্রবল আবেগপূর্ণ মনে হলেও সে ছিল ঐ নারীর শত্রু। ঐ কোনায় ধূসর চুলওয়ালা এক মহিলা হাসিমুখে লক্ষ্য করছেন তরুণীদের, চেষ্টা করছেন তার ছেলের জন্য একটা বউ ঠিক করতে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক বিবাহিতা নারী, সে সুযোগ খুঁজছে তার প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটানোর, যখন তার স্বামী মদ্যপান করে মাতাল হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে প্রত্যেকেই বর্তমানের ফল তুলছে এবং ভুলে যাচ্ছে অতীত এবং ভবিষ্যৎ। এই সবকিছুই ঘটে যাচ্ছিল যখন সুন্দরী নববধূ খুবই বেদনার্ত দৃষ্টিতে তা পর্যবেক্ষণ করছিল। নিজেকে তার মনে হচ্ছিল কারাগারের লোহার শিকের পেছনে একজন দুর্গত বন্দির মতো এবং সে ঘন ঘন সেই কক্ষ অতিক্রম করে এক যুবককে দেখছিল যে বসেছিল একাকী ও শান্তভাবে আহত পাখির মতো, ঝাঁকের পাখিরা যাকে ফেলে রেখে গেছে। তার বাহুদুটি বুকের ওপর ভাঁজ করা, যেন সে চেষ্টা করছিল তার হৃদয়কে বিস্ফোরণ থেকে রক্ষা করতে। সে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিছু-একটার দিকে যা কক্ষের আকাশে দৃশ্যমান নয় এবং মনে হয় অন্ধকার পৃথিবীতে তা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
মধ্যরাত এল এবং জনতার কোলাহল আরও উপরে উঠে গেল যতক্ষণ পর্যন্ত তা লেলিয়ে দেওয়া পাগলামিতে পরিণত না হল, কারণ মন ছিল স্বাধীন এবং জিভ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন।
বর ছিল একজন বয়স্ক মানুষ। ইতিমধ্যেই সে মাতাল হয়ে পড়েছে এবং কনেকে তার নিজের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে বিচরণ করছে অতিথিদের ভেতরে। আরও মদ্যপান করছে অভ্যাগতদের সঙ্গে এবং জ্বালানির যোগান দিচ্ছে মাতলামির শিখায়।
কনের ইশারায় এক তরুণী কাছে এসে তার পাশে বসল, তারপর কনে চারদিকে ঘুরে ভালো করে তাকাল এবং ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তোমাকে ভিক্ষা চাই হে আমার সঙ্গী এবং আমাদের ভালোবাসার নামে আমি তোমার কাছে আবেদন করি, দয়া করে সালিমকে বলো আমার সঙ্গে বাগানে উইলোগাছের ছায়ায় মিলিত হতে। দয়া করে সুশান তাকে ভিক্ষা করো আমার জন্য এবং তাকে বলো আমার অনুরোধ রাখতে, তাকে মনে করিয়ে দাও আমাদের অতীতের দিনগুলি এবং তাকে বল যে যদি আমি তাকে দেখতে না পাই তাহলে মারা যাব। তাকে আরও বলো যে আমি অবশ্যই তার কাছে আমার পাপের স্বীকারোক্তি করব এবং তাকে বলো আমাকে ক্ষমা করতে। আরও বলো, আমি আমার হৃদয়ের সমস্ত গোপনীয়তাকে তার সামনে উন্মেচিত করব। তাড়াতাড়ি করো এবং ভয় পেয়ো না।’
সুশান আন্তরিকতার সঙ্গে কনের বার্তা দ্রুত পৌছে দিল, সালিম তার দিকে এমনভাবে তাকাল যেভাবে একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ দূর থেকে ছোট্ট নদীর দিকে তাকায়। সে শান্তস্বরে বলল, ‘আমি বাগানে উইলোগাছের নিচে তার জন্য অপেক্ষা করব।’ সালিম বাড়ি ত্যাগ করল এবং কয়েক মিনিট কেটে গেল কনে তাকে অনুসরণ করার আগে। তারপর সে কনের পানে এগিয়ে গেল মাতালদের মাঝখান দিয়ে। বাগানে পৌছে নববধূ একটা গাজলা হরিণকে তাড়া করল যে নেকড়ের ভয়ে পালাচ্ছিল এবং দ্রুত উইলোগাছের দিকে দৌড়াল যেখানে যুবকটা অপেক্ষা করছে। নিজেকে সালিম-এর পাশে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দুহাত বাড়িয়ে দেয় এবং অশ্রুসজল কণ্ঠে বলে, ‘প্রিয়তম আমার কথা শোনো, কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই তোমার সঙ্গে এত দ্রুত দেখা করার জন্য আমি দুঃখিত। আমি তোমাকে ছাড়া তারা কাউকে ভালোবাসি না। জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমাকে ভালোবেসে যাব। ওরা আমাকে মিথ্যা বলেছে যে তুমি অন্য একজনকে ভালোবাসো এবং নাজিবি আমাকে প্রতারণা করে বলেছিল তুমি তার প্রেমে পড়েছ এবং সে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিল তার খালাতো ভাইকে বর হিসেবে গ্রহণ করতে। এটা ছিল তাদের পরিবারের একটা দীর্ঘ পরিকল্পনা। এখন আমি বিবাহিতা এবং তুমিই একমাত্র পুরুষ যাকে আমি ভালোবাসি এবং তুমিই আমার বর। এখন আমার চোখ থেকে অবগুণ্ঠন সরে গেছে এবং সত্য নিকটবর্তী, আমি এখানে এসেছি তোমাকে অনুসরণ করতে জীবনের শেষ পর্যন্ত এবং আমি কখনও সেই পুরুষটির কাছে ফিরে যাব না, যে স্বামী হিসেবে আমার জন্য মিথ্যাচার এবং সংকীর্ণ নিয়মকানুন নির্ধারণ করেছে। প্রিয়তম, চলো আমরা দ্রুত এই স্থান পরিত্যাগ করি রাত্রির নিরাপত্তার সাহায্যে। চলো আমরা সমুদ্রতীরে যাই এবং একটা জাহাজে উঠি, যা আমাদেরকে দূরবর্তী কোনো ভূমিতে নিয়ে যাবে, যেখানে আমরা একত্রে বসবাস করব উপদ্রবহীন। চলো আমরা এখনই যাত্রা শুরু করি, তাহলে ভোরবেলায় আমরা শত্রুর আয়ত্তের বাইরে নিরাপদে থাকব। আমাদের বাকি জীবন চালানোর মতো যথেষ্ট অলংকারও আমার কাছে আছে… সালিম তুমি কথা বলছ না কেন? কেন আমার দিকে তাকাচ্ছ না? কেন চুম্বন করছনা আমাকে? তুমি কি আমার আত্মার হাহাকার এবং হৃদয়ের কান্না শুনছ? কথা বলো এবং চলো দ্রুত এই স্থান পরিত্যাগ করি। যে সময় আমরা এখানে ব্যয় করছি তা হীরার চেয়েও মূল্যবান এবং রাজাদের রাজমুকুটের চেয়েও অধিকতর প্রিয়।’
জীবনের ফিসফিসানির চেয়ে তার কণ্ঠস্বর ছিল অধিকতর প্রশান্তিদায়ক এবং অধিকতর যন্ত্রনাক্লিষ্ট মৃত্যুর কাতরানির চেয়ে এবং অধিকতর কোমল পাখার খসখস শব্দের চেয়ে এবং ঢেউয়ের বার্তার চেয়ে অধিকতর গভীর… এটা ছিল একটা কণ্ঠস্বর যা স্পন্দিত হয় আকাঙ্ক্ষা ও নিরাশার সাথে, আনন্দ ও বেদনার সাথে, সুখ ও দুর্দশার সাথে এবং জীবনের চাহিদা ও মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষার সাথে। যুবক সবই শুনছিল এবং তার ভেতরে যুদ্ধ চলছিল প্রেম এবং মর্যাদার … মর্যাদা, যা আত্মার মুখোমুখি হয় এবং ভালোবাসা, যা ঈশ্বর মানুষের হৃদয়ে স্থাপন করেন… দীর্ঘ নীরবতার পর যুবক মাথা তুলল এবং কনের দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিল যে দুশ্চিন্তায় শিউরে উঠছিল। সালিম শান্তভাবে প্রতিবাদ করল, ‘তুমি তোমার অদৃষ্টের কাছে ফিরে যাও, কারণ এখন আর সময় নেই। ঐকন্তিকতা সেইসব মুছে ফেলেছে যা আচ্ছন্নতা চিত্রায়িত করেছিল। অতিথিরা তোমাকে এখানে দেখার আগেই ফিরে যাও। নইলে তারা বলবে তুমি তোমার বিয়ের রাত্রেই স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করেছ, যেভাবে আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে প্রতারণা করেছিলে।’
কনে যখন এই কথা শুনল তখন সে প্রবল ঝড়ের মুখোমুখি শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মতো শিহরিত হতে লাগল এবং খুব বেদনাপূর্ণ কণ্ঠে সে বলল, ‘ঐ ঘরে আমি কখনও ফিরে যাব না যে-ঘর আমি চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করেছি। এখন নিজেকে মনে হচ্ছে একজন বন্দির মতো যে তার নির্বাসন পরিত্যাগ করে যায়… তোমাকে প্রতারণা করেছি এই বলে আমাকে দূরে ঠেলে দিওনা। যে হাত তোমার ও আমার হৃদয়কে সংযুক্ত করেছে তা আমির ও যাজকদের হাতের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী, যা আমার শরীর অঙ্গীকার করেছে হে আমার বিদ্রোহী বর। এমন কোনো ক্ষমতা নেই যা তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে… এমনকি মৃত্যুও পারে না আমাদের আত্মাকে আলাদা করতে, কারণ যেহেতু স্বর্গ এটা ইচ্ছা করেছে সেহেতু শুধুমাত্র স্বর্গের ইচ্ছায়ই এটা বদলাতে পারে।’
অনাগ্রহ এবং নিজেকে তার বাহু থেকে মুক্ত করার জন্য সালিম প্রতিবাদ করে উঠল, ‘আমার কাছ থেকে চলে যাও। আমি একজনকে তীব্রভাবে ভালোবাসি, সে আমাকে পৃথিবীতে তোমার অস্তিত্ব ভুলিয়ে দেবে। নাজিবিই সঠিক কথা বলেছিল যে, আমি তাকে ভালোবাসি। সুতরাং তোমার স্বামীর কাছে ফিরে যাও এবং বিশ্বস্ত স্ত্রীতে পরিণত হও, আইন যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে।
কনে সঙ্গে সঙ্গে বেপরোয়াভাবে প্রতিবাদ করল, ‘না, না! আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না সালিম। আমি জানি যে তুমি আমাকে ভালোবাসো এবং তোমার চোখে আমি তা পড়তে পারি, আমি তোমার ভালোবাসা উপলব্ধি করি যখন আমি তোমার ঘনিষ্ঠ হই। আমি কখনই তোমাকে পরিত্যাগ করে আমার স্বামীর বাড়িতে যাব না যতক্ষণ আমার হৃদয়ে স্পন্দন আছে। আমি এখানে এসেছি তোমাকে অনুসরণ করতে পৃথিবীর শেষ পর্যন্ত। এ পথে নেতৃত্ব দাও সালিম অথবা আমার রক্ত ঝরাও এবং এখনই আমার জীবন নিয়ে নাও।’
আগের মতোই জোরালো কণ্ঠে সালিম বলল, ‘আমাকে পরিত্যাগ করে যাও নাহলে আমি চিৎকার করে এই বাগানে লোক জড়ো করব এবং তোমাকে অপমান করব ঈশ্বর ও মানুষের সামনে, এবং আমার প্রিয়তমা নাজিবিকে তোমার প্রতি কটাক্ষ করে হাসতে সুযোগ করে দেব এবং গর্বিত হবে তার সাফল্য।’
সালিম তার আলিঙ্গন থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতেই সে আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ, দয়ালু এবং অভিযোগকারী নারী থেকে হিংস্র সিংহীতে পরিণত হল এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কেউ পারবে না আমার ওপর সাফল্য অর্জন করতে এবং আমার ভালবাসাকে ছিনিয়ে নিতে।’ এই কথা উচ্চারণ করেই সে তার বিয়ের পোশাকের তলা থেকে একটা ছুরি বের করল এবং বিদ্যুৎঝলকের মতোই দ্রুত যুবকের হৃদপিণ্ডে ঢুকিয়ে দিল। সে মাটিতে পড়ে গেল ঝড়ে ভেঙে যাওয়া একটা ছোট্ট শাখার মতো এবং সে তার হাতের ছুরিটা উঁচু করে ধরে তার শরীরের ওপর বাঁকা হয়ে উঠে এল। যুবকটি তার চোখ খুলল এবং তার ওষ্ঠ কাঁপছিল যখন সে স্খলিত কণ্ঠে বলল, ‘হে আমার প্রিয়তমা এখন এসো, এসো, লায়লা এবং আমাকে পরিত্যাগ কোরো না। জীবন মৃত্যুর চেয়ে অধিকতর দুর্বল এবং ভালোবাসার চেয়ে অধিকতর দুর্বল হচ্ছে মৃত্যু। বাড়ির ভেতরে অতিথিদের নিষ্ঠুর উচ্চহাসি শোনো এবং শোনো মদ্যপানের গ্লাসের টুংটাং আওয়াজ ও ভেঙে যাওয়ার শব্দ, হে আমার প্রিয়তমা। লায়লা তুমি আমাকে জীবনসংগ্রাম থেকে উদ্ধার করেছ। তোমার দুহাতে আমাকে চুমু খেতে দাও, যা ভেঙে ফেলবে শৃঙ্খলগুলি এবং আমাকে মুক্ত হতে দেবে। আমাকে চুম্বন করো এবং ক্ষমা করো, কারণ আমি সত্যপরায়ণ হয়ে উঠিনি। স্থাপন কর তোমার রক্তে পরিচ্ছন্ন হাত আমার শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়ের ওপর, যখন আমার আত্মা প্রশস্ত আকাশে আরোহণ করে তখন আমার ডানহাতে দিও ছুরিটা এবং বোলো আমিই আমাকে হত্যা করেছিলাম।’ একটু থেমে সে শ্বাস গ্রহণ করল এবং ফিসফিস করে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি লায়লা এবং কখনই অন্য কাউকে ভালোবাসব না। তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে আত্মোৎসর্গ অধিকতর মহৎ। আমাকে চুম্বন করো হে আমার প্রিয়তমা। চুম্বন কর আমাকে লায়লা…। তারপর সালিম তার হাত রাখল আহত হৃৎপিণ্ডের ওপর, শেষবারের মতো শ্বাস গ্রহণ করল। কনে তখন বাড়িটার দিকে তাকাল এবং মর্মপীড়ায় কেঁদে উঠল, ‘তোমার সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে জেগে ওঠো, কারণ এখানে বিবাহ-উৎসব। কনে তোমার অপেক্ষা করছে। এসো এবং দ্যাখো আমাদের কোমল বিছানা। জেগে ওঠো তোমরা পাগল ও মাতালেরা, দ্রুত এখানে চলে এসো যেন আমরা তোমাদের কাছে প্রকাশ করতে পারি জীবন, মৃত্যু ও ভালোবাসার সত্যকে।’ তার হিস্টিরিয়াগ্রস্ত কণ্ঠস্বর বাড়ির প্রতিটি কোনায় প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল অতিথিদের কানে। তারা মোহগ্রস্তের মতো দরজার দিকে এগিয়ে গেল এবং চারদিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল। তারা এই করুণ সৌন্দর্যের দৃশ্যের কাছাকাছি এসে দেখল, কনে সালিমের ওপর পড়ে কাঁদছে। তারা আতঙ্কে পিছু হটে যায় এবং কেউই কাছে আসতে সাহসী হয় না। মনে হয় যুবকের হৃৎপিণ্ড থেকে প্রবাহিত রক্তস্রোত এবং কনের হাতে ধরে রাখা ছুরি দেখে তারা ভীত হয়েছিল এবং তাদের শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
কনে তাদের দিকে তাকাল এবং তিক্তকণ্ঠে কাতরাতে কাতরাতে বলল, ‘হে কাপুরুষেরা, কাছে এসো। মৃত্যুর অপচ্ছায়াকে ভয় পেয়ো না, তাহলে তার বিশালত্ব তোমাদের ক্ষুদ্রতার কাছাকাছি আসতে অসম্মতি জানাবে এবং এই ছুরিকে ভয় পেয়ো না, কারণ এটা হচ্ছে একটা ঐশ্বরিক যন্ত্র, যা তোমাদের নোংরা শরীর ও শূন্য হৃদয়কে স্পর্শ করতে অস্বীকৃতি জানাবে। এই সুদর্শন যুবকের দিকে তাকাও সে হচ্ছে আমার প্রিয়তম এবং আমি তাকে হত্যা করেছি, কারণ আমি তাকে ভালোবাসি … সে আমার বর এবং আমি তার নববধূ। এই পৃথিবীতে আমাদের ভালোবাসায় মোড়ানো একটা শয্যার সন্ধান করেছিলাম আমরা, যা তোমাদের ক্ষুদ্র অজ্ঞতা ও প্রচলিত নিয়মকানুনের দ্বারা তৈরি করেছ। কিন্তু আমরা এই শয্যাটাই পছন্দ করেছিলাম। কোথায় সেই নষ্ট মেয়েমানুষটা যে আমার প্রিয়তমকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল এবং বলেছিল সে ঐ নারীকে ভালোবাসে? কোথায় সেই নারী যে বিশ্বাস করত আমার ওপর সে সাফল্য অর্জন করবে? কোথায় সেই নাজিবি, সেই নরক-নাগিনী যে আমাকে প্রতারণা করেছিল, কোথায় সেই নারী যে তোমাদেরকে জড়ো করেছে আমার প্রিয়তমের চলে যাওয়া উদ্যাপন করতে এবং উদযাপন না করতে আমার পছন্দ করা মানুষের বিবাহ-উৎসব। আমার কথা তোমাদের কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছে, কারণ নরক কখনও নক্ষত্রের সংগীত উপলব্ধি করতে পারে না। তোমরা তোমার শিশুদের বলবে যে, বিয়ের রাতেই আমি আমার প্রেমিককে হত্যা করেছিলাম। তোমাদের নোংরা ঠোঁটের ওপর উচ্চারিত হবে আমার নাম ঈশ্বরনিন্দার পাশাপাশি, কিন্তু তোমাদের নাতিনাতনিরা আশীর্বাদ করবে আমাকে, কারণ আগামীকাল হবে আত্মা ও সত্যের স্বাধীনতার জন্য। তুমি আমার অজ্ঞ স্বামী, যে আমার শরীর কিনেছিলে কিন্তু আমার ভালোবাসা নয়, আমার মালিকানা পেয়েছ কিন্তু কখনই আমি তার অধিকৃত হব না। তুমি হলে দুর্গত জাতির প্রতীক, অন্ধকারে যে আলো অনুসন্ধান করছে, এবং অপেক্ষা করছে পাথরের ভেতর থেকে জলপ্রবাহ বেরিয়ে আসার। তুমি সেই দেশকে প্রতীকায়িত করছ যা নির্বুদ্ধিতা ও অন্ধত্ব দ্বারা শাসিত হয়, তুমি একটা মিথ্যা মানবতার প্রতিনিধিত্ব করছ যা গলা ও বাহু কেটে ফেলে নেকলেস ও ব্রেসলেটের জন্য। আমি এখন তোমাদেরকে ক্ষমা করছি, কারণ প্রস্থানরত সুখী আত্মা সব মানুষের পাপকেই ক্ষমা করে দেয়।’
তারপর কনে তার ছুরিটা আকাশের দিকে তুলে ধরল। যেভাবে একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ গ্লাসের প্রান্ত তার ঠোঁটে তুলে ধরে ঠিক সেভাবেই সে নামিয়ে আনল ছুরিটা এবং তা রোপণ করল তার নিজের বক্ষে। সে তার প্রেমিকের পাশে পড়ে গেল একটা পদ্মফুলের মতো যা ধারালো কাস্তে দিয়ে কাটা হয়েছে। নারীরা স্থিরদৃষ্টিতে এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখল এবং আতঙ্কিত হয়ে কেঁদে ফেলল, কেউ কেউ মূর্ছা গেল এবং পুরুষদের হট্টগোল আকাশ পরিপূর্ণ করে তুলল। তারা খুবই লজ্জার সঙ্গে এবং শ্রদ্ধাশীলভাবে কাছে এগিয়ে গেল। মৃত্যুপথযাত্রী কনে তাদের দিকে তাকাল। তার আহত শরীর থেকে প্রবাহিত হচ্ছিল রক্তের স্রোত। সে বলল, ‘আমাদের কাছ থেকে দূরে যেও না, আলাদা কোরো না আমাদের শরীরকে, কারণ তোমরা যদি এ-ধরনের অপরাধ করো তাহলে আত্মা তোমাদের মাথার ওপর স্থির হয়ে ভেসে থাকবে, আঁকড়ে ধরবে তোমাকে এবং গ্রহণ করবে তোমাদের জীবন। ক্ষুধার্ত মাটিকে আমাদের শরীর গিলে ফেলতে দাও এবং আমাদেরকে লুকাতে দাও তার বক্ষে। তাকে রক্ষা করতে দাও আমাদেরকে যেভাবে বরফ থেকে সে বীজ রক্ষা করে বসন্ত না-আসা পর্যন্ত এবং ফিরিয়ে আনতে দাও পরিশুদ্ধ জীবন ও জাগরণ।’
সে তার প্রেমাস্পদের কাছে সরে এল, তার ঠোঁট স্থাপন করল সালিমের ঠাণ্ডা ঠোঁটের ওপরে এবং উচ্চারণ করল তার শেষ কথাগুলি, ‘চিরকালের জন্য আমার দিকে তাকাও… তাকাও আমার বন্ধুদের দিকে। আমাদের শয্যা সম্পর্কে কী পরিমাণ হিংসা একত্রিত হচ্ছে। শোনো তাদের দাঁত ও আঙুল চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার শব্দ। তুমি দীর্ঘসময় ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছ সালিম এবং আমি এখানে, কারণ আমি হাতকড়া ও বেড়ি ভেঙে ফেলেছি। চলো সূর্যের দিকে যাই, কারণ আমরা দীর্ঘসময় এই সীমাবদ্ধতার ভেতরে অপেক্ষা করছি যা একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী। সবকিছুই আমার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না প্রিয়তম। এই হলো আমার ঠোঁট, আমার বিশাল জাগতিক অধিকার… গ্রহণ করো আমার শেষ মনুষ্যপ্রশ্বাস। এসো সালিম, চলো আমরা এ স্থান পরিত্যাগ করি। ভালোবাসা তার পাখা উত্তোলন করেছে এবং আরোহণ করছে বিশাল আলোর ওপরে। তার মাথাটা সালিমের বুকের ওপর নেমে এল এবং দেখতে-না-পাওয়া চোখদুটো তখনও পর্যন্ত খোলা এবং তা সালিমের দিকে স্থির হয়ে চেয়ে আছে।
নীরবতা জয়ী হল, যেন মৃত্যুর মর্যাদা জনগণের সমস্ত শক্তিকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল এবং প্রতিরোধ করেছিল তাদের চলাচল। তারপর যে যাজক বিবাহ-উৎসব পরিচালনা করছিল সে সামনে এগিয়ে এল এবং তার তর্জনী তুলল মৃত দম্পতির দিকে এবং চিৎকার করে বলল, ‘অভিশপ্ত সেই হাত যে এই রক্ত ঝরতে থাকা শরীর স্পর্শ ও আদর করে যা পাপে ভিজে গেছে এবং অভিশপ্ত সেই চোখগুলি যারা এই মন্দ আত্মার ওপর বেদনার অশ্রু ঝরায়। সদোম-এর পুত্র এবং ঘমোরার কন্যার মৃতদেহকে এই দূষিত স্থানে পড়ে থাকতে দাও যতক্ষণ বন্য পশুরা লোভীর মতো তাদের মাংস না খায় এবং তাদের হাড়গুলি বাতাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে না ফেলে। বাড়ি ফিরে যাও তোমরা। পালাও এই পাপীদের দূষণ থেকে। দূরে সরে যাও তোমরা, নরকের অগ্নিশিখা তোমাদের গায়ে হুল ফোটানোর আগেই এবং যে এখানে থাকবে সে অভিশপ্ত হবে এবং বহিষ্কৃত হবে চার্চ থেকে এবং সে আর কখনই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে না, পারবে না খ্রিস্টানদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশে প্রার্থনা করতে।’
সুসান, যে ছিল কনে ও তার প্রেমাস্পদের মাঝখানে শেষ বার্তাবাহক, সে সাহসের সঙ্গে সামনে এগিয়ে এল এবং যাজকের সামনে দাঁড়াল। অশ্রুসজল চোখে সে যাজকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি এখানে থাকব এবং তুমি হলে নিষ্ঠুর নব্যতান্ত্রিক। আমি তাদেরকে পাহারা দেব ভোর না-হওয়া পর্যন্ত। আমি তাদের জন্য খনন করব একটা কবর এইসব ঝুলন্ত শাখার নিচে এবং সমাহিত করব তাদেরকে, তাদের সর্বশেষ জাগতিক চুম্বনের উদ্যানে। এক্ষুনি এই জায়গা সবাই পরিত্যাগ করুন, কারণ শুকরেরা ধূপের সুগন্ধ তীব্রভাবে ঘৃণা করে, চোরেরা গৃহকর্তাকে ভয় পায় এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠে আগত সূর্যোদয়ের ঔজ্জ্বল্যে। দ্রুত তোমাদের অন্ধকার বিছানায় ফিরে যাও, কারণ তোমাদের কর্ণকুহরে দেবদূতদের স্তোত্রগীতি প্রবেশ করবে না—নিষ্ঠুর ও নির্বোধ শাসকের কঠোরতায় তা বাধাপ্রাপ্ত হবে বারবার।’
কঠোর চেহারার যাজকের সাথে জনতার ভিড় ধীরে ধীরে প্রস্থান করল এবং সুসান সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল লায়লা ও সালিমের দিকে, যেভাবে একজন স্নেহময়ী মাতা রাতের নির্জনতায় তার সন্তানদের পাহারা দেয়। সব লোকজন চলে যাবার পর সে মাটিতে পড়ে গেল এবং ক্রন্দনরত দেবদূতদের সঙ্গে কাঁদতে থাকল।