কান্দাই-এর পথে দস্যু বনহুর

কান্দাই-এর পথে দস্যু বনহুর – দস্যু বনহুর সিরিজ – রোমেনা আফাজ

ডবল স্পীডে গাড়িখানা ছুটে চলেছে। ড্রাইভ করছে স্বয়ং দস্যু বনহুর। গাড়ির পিছনের আসনে সংজ্ঞাহীন নুরী। মাঝে মাঝে বনহুর নূরীর দিকে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলো, আসনের নীচে গড়িয়ে পড়ে না যায়।

বনহুরের দৃষ্টি গাড়ির সম্মুখ পথে থাকলেও মনের মধ্যে নানা চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়ছিলো।…জ্যোছনা রায়কে হত্যার জন্য বনহুর হত্যা করলো আরফান উল্লাহকে। কারণ, আরফান উল্লাহই জ্যোছনা রায়ের হত্যাকারী। বনহুর যখন স্টুডিওতে প্রথম দিন পদার্পণ করেছিলো, সেই দিনই বিশ্রাম–কক্ষে জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে আলাপকালে দেখেছিলো দুটি চোখ। শার্শির ফাঁকে চোখ দুটো ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠে মিশে গিয়েছিলো তখনই। বনহুর জ্যোছনা রায়কে এ কথা না বলেই দ্রুত পদে গিয়েছিলো শার্শির পাশে। জানালার শার্শি খুলে লক্ষ্য করেছিলো বারান্দার চারপাশে কিন্তু কাউকেই নজরে পড়ে নি। বনহুরের সন্দেহ হয়েছিলো, জ্যোছনা রায়ের সঙ্গে তার মেলামেশা কেউ যেন ফলো করছে। এবং সে লোকটি অরুণ বাবু ছাড়া অন্য কেহ নয়। সেদিনের পর থেকেই বনহুর অরুণ বাবুর উপর গোপনে নজর রেখেছিলো তীক্ষ্মভাবে।

বনহুর জানতো, অরুণ বাবু জ্যোছনা রায়কে গভীরভাবে ভালবাসে, এবং সে জন্যই সে তার পিছনে লেগে রয়েছে ছায়ার মত। বনহুরের সঙ্গে জ্যোছনার মেলামেশা তার কাছে অসহ্যনীয়।

কিন্তু বনহুর শেষ পর্যন্ত সর্বান্তঃকরণে অনুভব করেছিলো, অরুণ বাবু জ্যোছনা রায়কে বার বার হত্যার হুমকি দেখালেও আসলে সে কোন দিন জ্যোছনা রায়কে হত্যা করতে পারতো না। কারণ, অরুণ বাবু তাকে। ভালবাসতো সত্যি করে। প্রেম-প্রীতি ভালবাসা দিয়েও যখন সে জ্যোছনা রায়ের কাছে এতোটুকু করুণা পায়নি, তখন সে ক্ষেপে উঠেছিলো চরম ভাবে। তখনই সে হত্যার হুমকি দেখাতেও কসুর করেনি জ্যোছনা রায়কে।

তারপর বনহুর আবিস্কার করেছিলো জ্যোছনা রায়ের আসল হত্যাকারীকে। শুধু আবিস্কার করেই সে ক্ষান্ত হয় নি, নিজ হস্তে জ্যোছনা রায়ের হত্যাকারীকে সমুচিত শাস্তি দিয়ে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছিলো।

পুলিশের হাতেও সঁপে দিতে পারতো বনহুর আরফান উল্লাহকে। কিন্তু তা সে করে নি। কারণ, হত্যাকারী কোটিপতি, লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে তার কিছুমাত্র কষ্ট হতো না। পুলিশের হাত থেকে অনায়াসে সে নিজেকে মুক্তি করে নিতো তাতে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই বনহুর স্বয়ং আরফান উল্লাহকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত দিয়েছিলো।

আরফান উল্লাহই যে জ্যোছনা রায়ের হত্যাকারী, এটাও বনহুর প্রমাণ করে দিয়েছিলো পুলিশের কাছে টেপ রেকর্ডের মাধ্যমে। কাজেই কে আসল খুনী সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।

আরফান উল্লাহকে হত্যার পূর্বে বুদ্ধিমান দস্যু বনহুর টেপ রেকর্ড রেখে কথোপকথন করেছিলো তার সঙ্গে এবং শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছিলো তাকে, এমন কি নিজের পরিচয়টাও আরফান উল্লাহকে দিয়েছিলো স্বয়ং দস্যু বনহুর।

পুলিশ যখন আরফান উল্লাহর লাশের পাশে আবিষ্কার করলো টেপ রেকর্ড, এবং টেপ রেকর্ড থেকে জানতে পারলো জ্যোছনা রায়ের আসল হত্যাকারীকে, তখন পুলিশ মহল শুধু বিস্মিতই হলোনা, স্তব্ধও হলো।

খুনীকে গ্রেপ্তারের পূর্বেই সে নিহত হয়েছে, এবং তাকে হত্যা করেছে যে ব্যক্তি, সে অন্য কেহ নয়–স্বয়ং দস্যু বনহুর।

এদিকে পুলিশ মহলে যখন জ্যোছনা রায় ও আরফান উল্লাহর হত্যাকাণ্ড নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো, ঠিক তখন দস্যু বনহুর সংজ্ঞাহীন নূরীকে নিয়ে কান্দাই-এর পথে ছুটে চলেছে।

নূরীকে সংজ্ঞাহীন করেছে বনহুর, না হলে সে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ এ ভাবে তার সঙ্গে রওয়ানা দিতে রাজি হতো না। একটা বিভ্রাট ঘটিয়ে বসতো হয়তো সে। সেই কারণেই বনহুর এই উপায় অবলম্বন করছে।

জ্যোছনা রায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে বনহুর যখন তার বাসায় ফিরে গিয়েছিলো তখন নূরী নিজের কক্ষের বিছানায় গভীর নিদ্রায় মগ্ন ছিলো।

বনহুর কিছু পূর্বে আরফান উল্লাহকে হত্যা করলেও ঠিক পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক ছিলো, এতোটুকু পরিবর্তন আসেনি তার মধ্যে। কারণ, বনহুরের নরহত্যা নেশা না হলেও এটা তার অভ্যাসগত ব্যাপার, কাজেই বিচলিত হবার কিছুই ছিলো না বনহুরের।

নূরীর কক্ষে প্রবেশ করে সোজা গিয়ে দাঁড়ালো নূরীর শয্যার পাশে। এই রাতেই তাকে এ শহর ত্যাগ করতে হবে। কাজ শেষ হয়েছে, এবার ফিরতে হবে কান্দাই-এ। যেখানে তার প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে আছে স্নেহময়ী জননী আর প্রেয়সী স্ত্রী মনিরা। কিন্তু নূরী আজ স্বাভাবিক জ্ঞানবতী নেই, তাকে পাগল বললেও ভুল হয় না। যাদুকরের কোন বিষময় ঔষধে আজ সে জ্ঞানশূন্য।

এই গভীর রাতে নূরী কিছুতেই তার সঙ্গে পালাতে রাজি হবে না সহজে। হয়তো একটা হট্টগোল বাধিয়ে বসতে পারে। তাই বনহুর নূরীকে অজ্ঞান করে তুলে নিলো হাতের উপরে।

সমস্ত বাড়িখানা ঝিমিয়ে পড়েছিলো, এমন কি বাড়ির চাকর বাকররাও ঘুমিয়ে ছিলো আরামে।

বনহুর নূরীর সংজ্ঞাহীন দেহটা হাতের উপর তুলে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো বাইরে।

অদূরে পাইন গাছের আড়ালে দণ্ডায়মান নতুন গাড়িখানার পাশে এসে একবার সচকিতভাবে তাকিয়ে দেখে নিলো বাড়ির খানার দিকে। আজ এক বছরের কত স্মৃতি জড়ানো রয়েছে ঐ বাড়িখানায়। ক্ষণিকের জন্য একবার বনহুরের মনে ভেসে উঠেছিলো আতিয়ার মুখখানা।

গাড়ির পিছন আসনে নূরীকে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভ আসনে এসে বসলো বনহুর। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিলো। বনহুর একবার পকেটে হাত দিয়ে রিভলভারখানার অস্তিত্ব অনুভব করে নিতে ভুললো না।

জনহীন রাজপথ বেয়ে বনহুর উল্কাবেগে গাড়ি চালিয়ে চললো। রাত ভোর হবার পূর্বেই তাকে শহরের বাইরে গিয়ে পৌঁছতে হবে।

০২.

পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে।

বনহুরের গাড়ি এখন শহর ছেড়ে একটা পাহাড়ের পাশ কেটে এগুচ্ছে। এতো স্পীডে গাড়ি চালিয়ে এসেছে বনহুর যে, মাত্র কয়েক ঘন্টায় শহর ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে।

বনহুরের ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। চুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে ললাটের চারপাশে।

এখনও নূরীর সংজ্ঞা ফিরে আসে নি। ছিন্ন লতার ন্যায় পিছন আসনে লুটিয়ে আছে নূরী। এক গুচ্ছ রজনী গন্ধার মতই সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।

বনহুর একটি নির্জন স্থানে গাড়ি রাখলো। দক্ষিণ পাশে উঁচু পাহাড়। ঝোপ-ঝাপ আর আগাছায় ভরা জায়গাটা। মাঝে মাঝে বৃহৎ বৃহৎ কৃক্ষ কালের প্রহরীর মত মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে। কোন কোন স্থানে বন আর গভীর জঙ্গল। এসবের পাশ কেটেই এগিয়ে গেছে একটা প্রশস্ত পথ সম্মুখের দিকে।

বনহুর ঐ পথ ধরেই গাড়ি চালাচ্ছিলো। এই এতোটা পথ আসতে তার তেমন কোন অসুবিধা বা কষ্ট হয়নি, কারণ পথটা সম্পূর্ণ পাকা না হলেও বেশ মসৃণ এবং সমতল ছিলো।

একটা শাল বৃক্ষের তলায় গাড়ি রাখলো বনহুর। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালখানা বের করে ললাটের ঘাম মুছে ফেললো সে। তারপর ড্রাইভ

আসন থেকে নেমে এলো নীচে।

ইতিমধ্যে নূরীও চোখ মেলে তাকাচ্ছে ধীরে ধীরে। বনহুর পিছন আসনে উঠে বসলো, নূরীর চুলে হাত বুলিয়ে ডাকলো–নূরী!

নূরী চোখ মেলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। উঠে বসতে গেলো। বনহুর নূরীকে শুইয়ে দিয়ে বললো–আর একটু শুয়ে থাকো। নূরী চারদিকে তাকিয়ে অবাক হলো, এটাতো তার শয়নকক্ষ নয়! ঘন বন আর পাহাড় ছাড়া কিছুই দেখতে পেলো না।

নূরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো বনহুর নূরী, এটা তোমার কক্ষ নয়, এটা মোটরগাড়ি।

আমি কোথায়? নূরীর কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো একটা শব্দ।

বনহুর আরও একটু ঝুকে পড়লো নূরীর মুখের উপর, বললো–তুমি এখন শহরের বাইরে।

উঠে বসলো নূরী এবার, পুনরায় চারদিকে তাকিয়ে বললো সে–এ আপনি আমায় কোথায় নিয়ে এসেছেন?

ভয় নেই, আমি তোমাকে ভাল জায়গায় নিয়ে যাবো।

না, আমি যাবো না আপনার সঙ্গে।

এতোদিন তো আমার সঙ্গেই আছো, কই কোনদিন তো আমার সঙ্গে কোথাও যেতে আপত্তি করোনি।

নূরী নিপ কিছু ভাবতে লাগলো।

বনহুর বললো-নূরী, যেখানে ছিলাম সেখানে আমাদের জন্য বিপদ দেখা দিয়েছিলো, ওখানে থাকা আর সম্ভব নয়, তাই…।

তাই আবার আপনি আমাকে পাহাড়ে জঙ্গলে নিয়ে এলেন। আমার কিন্তু ভয় করছে, আবার যদি ঐ যাদুকর শয়তানটা আমাকে ধরে নিয়ে যায়?

হাসলো বনহুর, কুঞ্চিত করে তাকালো–নূরী, সে, শয়তান আর বেঁচে নেই, যাদুকরকে আমি হত্যা করেছিলাম।

নূরী এতোদিনে যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো। বললো সে–সত্যি?

হাঁ নূরী, সত্যি। বনহুর নূরীর দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরলো। নির্নিমেষ নয়নে তাকালো সে নূরীর মুখের দিকে।

নূরীও তাকিয়ে ছিলো অপলক চোখে বনহুরের দিকে। বনহুর ব্যাকুল কণ্ঠে বললো–নূরী, আজও তুমি আমায় চিনতে পারলে না? গলার স্বর বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো তার।

নূরী অনেক বার একথা শুনেছে বনহুরের মুখে; অনেকদিন ভেবেছেস্মরণ করতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু কিছুই তার মনে পড়েনি। আজও নূরী ভাবে–কিছুতেই স্মরণ হয়না কোন কথা।

বনহুর হতাশভাবে নেমে যায় পিছন আসন থেকে। ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দেয়। আবার ছুটতে শুরু করে বনহুরের গাড়িখানা।

অবিরাম এগিয়ে চলে সম্মুখের দিকে। পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ। এবার সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে বনহুরকে; কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই আর কি-হাজার ফিট নীচে গাড়িখানা পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।

বনহুর নূরীকে সাবধানে চুপ করে বসে থাকতে বললো।

সত্যি, বনহুর যে পথে গাড়ি চালাচ্ছিলো সে পথ অতি দুর্গম, অতি ভয়ঙ্কর পথ। এই পথটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে কেউ জানেনা। বনহুর লোকমুখে শুনেছিলো, এ পথটা নাকি চলে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে বহু দুরে–কোন এক নগরের বুকে গিয়ে মিশেছে। আর সে পথ বেয়ে বনহুর অজানা নগরের দিকে ছুটে চলেছে।

এ পথে তেমন কোন গাড়ি বা লোকজনের আনাগোনা ছিলোনা, কাজেই বনহুরের গাড়ি চালাতে অন্য কোন বাধা সৃষ্টি হচ্ছিলো না।

বেলা ক্রমেই বেড়ে উঠছিলো, বনহুর নিজে বেশ ক্ষুধা অনুভব করলো। নূরীর যে ক্ষুধা পেয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গত রাতে তারা আহার করেছিলো আর আজ এতো বেলা হলো কোন কিছু মুখে পড়েনি।

এমন জায়গা,–পাহাড় আর পাথর ছাড়া কিছুই নেই কোনখানে। হঠাৎ দুএকটা বৃক্ষাদি নজরে পড়ে কিন্তু সেগুলো কোন ফলবৃক্ষ নয়। বনহুর নিজের জন্য চিন্তিত না হলেও নূরীর জন্য বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। কি করা যায়, একটু কিছু নূরীকে খাওয়াতে পারলে কতকটা নিশ্চিন্ত হতে পারতো সে।

বনহুরের গাড়ি এখন স্বাভাবিক গতিতে এগুচ্ছিলো। এখন পথটা আরও সঙ্কীর্ণ দুর্গম। অতি সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলো বনহুর।.

নূরী নিপ বসেছিলো পিছন আসনে। মুখে তার কোন কথা নেই। বনহুর মাঝে মাঝে নূরীর সঙ্গে দুএকটা কথাবার্তা বলে তাকে উৎসাহিত করছিলো। নূরী তার কথায় দুএকটা জবাব দিলেও তেমন কোন ভাব ছিলো

তার মধ্যে বনহুর যার মধ্যে কোন আনন্দ বা উৎসাহ খুঁজে পায় না। বনহুর ভাবছিলো, কোন রকমে একবার কান্দাই-এ নিজ আস্তানায় পৌঁছতে পারলে নূরীর চিকিৎসার সুযোগ আসবে। যাদুকর নূরীকে এমন কোন ঔষধ দ্বারা তার স্বাভাবিক জ্ঞান সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিয়েছিলো যার জন্য আজও নূরী তাকে চিনতে পারছে না বা পারেনি। যে নূরী তাকে এক মুহূর্ত

দেখলে ব্যস্ত হয়ে পড়তো, একটু কথা না বললে অভিমানে মুখ ভার করে থাকতো, আজ সে নূরী—

বনহুরের চিন্তাজালে বাধা পড়লো, একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কানে। দূরে বহু দূরে কোন মোটর গাড়ির শব্দ হচ্ছে যেন।

বনহুর বেশ চিন্তিত হলো। গাড়ির শব্দটা সম্মুখ দিক থেকেই যেন আসছে।

পথটা এতো সঙ্কীর্ণ, যে পাশাপাশি দুখানা গাড়ি চলা কঠিন। কাজেই সম্মুখ দিকে কোন গাড়ি এসে পড়লে বিপদ অনিবার্য।

শব্দটা ক্রমেই স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে আসছে, সম্মুখের গাড়িখানা যে অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বনহুর নিজের গাড়ি থামিয়ে ফেললো, এবং নূরীকে বললো–শিঘ্ৰ নেমে পড়ো নূরী।

বনহুর গাড়ি থেকে নেমে পিছন আসনের দরজা খুলে ধরলো–এসো নূরী।

নূরীকে নামিয়ে নিয়ে বনহুর পথের একধারে সরে দাঁড়ালো, শব্দটা অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে আসছে।

স্তব্ধ নিশ্বাসে বনহুর প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

গাড়ি ছেড়ে প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে একটা সমতল স্থানে নূরীসহ বনহুর দাঁড়িয়ে রইলো। জায়গাটা ঝোপ-ঝাড়ে আর আগাছায় ভরা, কাজেই পথ থেকে সহজে কেউ তাদের দেখতে পাবে না।

বনহুর আর নূরী হঠাৎ একটা প্রচণ্ড শব্দে চমকে উঠলো, সম্মুখে তাকিয়ে দেখলো—একটা মস্ত বড় ট্রাক সাঁ সাঁ করে ছুটে এসে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারলো পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের গাড়িখানায়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা একটা খেলনা গাড়ির মত ছিটকে পড়লো একেবারে হাজার ফিট নীচে।

নূরী গাড়িখানার এ মর্মান্তিক অবস্থা দেখে শিউরে উঠলো, দুহাতে চোখ ঢেকে ফেললো সে।

বনহুর নূরীর কানে মুখ নিয়ে বললো–আর একটু হলেই আমাদের অবস্থা কি হতো বলতো? ঐ গাড়িখানার মত চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতাম।

নূরী ভীত দৃষ্টি মেলে তাকালো হাজার ফিট নীচে গড়িয়ে পড়া চ্যাপটা গাড়িখানার দিকে।

বনহুর এবার বললো–খোদর কাছে হাজার শুকরিয়া নূরী, আমরা শোচনীয় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলাম।

বনহুর এবারে তাকিয়ে দেখলো–ট্রাকখানা তাদের গাড়িটায় ধাক্কা খেয়ে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে থেমে পড়েছে। বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলো বনহুরট্রাক বোঝাই করা কি সব জিনিসপত্র রয়েছে। সে সব জিনিসের উপর বসে রয়েছে কয়েকজন বলিষ্ঠ চেহারার মানুষ। লোকগুলোর দেহে অদ্ভুত ধরনের পোশাক। গায়ে বু রং এর প্যান্ট, শরীরে ঐ রং এরই সার্ট, মাথায় চোস্ত টুপি। টুপি দিয়ে সমস্ত মাথা আর মুখ টাকা, শুধু চোখগুলো জ্বল জ্বল করতে টুপির সম্মুখ ভাগের দুটো করে ফুটো দিয়ে।

ড্রাইভারের শরীরেও ঐ ধরনের ড্রেস। কিন্তু ড্রাইভ আসনের পাশে যে লোকটি বিশাল বপু নিয়ে বসেছিলো তার দেহের পোষাক সম্পূর্ণ আলাদা। গাঢ় সবুজ তার ড্রেস। মাথায় ক্যাপ ধরনের টুপি। চোখে গগলস। কানের এবং মুখের সংগে কোন যন্ত্র আঁটা রয়েছে বলে মনে হল বনহুরের!

প্রত্যেকটা লোকের বেল্টের সঙ্গে হোরা ঝুলছে, দেখতে পেল বনহুর। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝতে পারলো, লোকগুলো স্বাভাবিক নাগরিক বা জনগণ নয়। এরা কোন দস্যুদল নিঃসন্দেহে। শহর বা অন্য কোথাও ডাকাতি করে ফিরে চলেছে আস্তানায়।

বনহুর নূরীকে চুপ থাকতে বলে ঝোপের আড়াল থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ট্রাকের আরোহীদের কার্যকলাপ দেখতে লাগলো।

লোকগুলো ততক্ষণে ট্রাক ছেড়ে পথের উপর নেমে পড়ছে।

ড্রাইভ আসন ত্যাগ করে মোটা লোকটাও নেমে পড়েছে। লোকটা ঐ দলের নেতা বা দলপতি হবে।

ওরা সবাই ঝুকে পড়ে তাচে চূর্ণ-বিচূর্ণ গাড়িখানা দেখছে। নিজেদের মধ্যে কোন কথাবার্তাও চলছে বলে মনে হলো।

বনহুর নূরীকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে ঝোপ-ঝাড়ের আড়াল দিয়ে এগুলো, এবার আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে। বনহুর দেখলো, দুজন লোককে ওরা দড়ি দিয়ে মজবুত করে বেঁধে রেখেছে ট্রাকে মালপত্রের সঙ্গে।

প্রখর সূর্যের তাপে লোক দুটি কালো হয়ে উঠেছে। মুখ ও হাত পা বাধা থাকায় তারা নড়তে পারছে না বা চিষ্কার করে কাঁদতে পারছে না। মাঝে মাঝে পাকাল মাছের মত শরীরটা কুঁকড়ে নিচ্ছে।

সর্দার বা দলপতি গলায় ঝোলানো যন্ত্রটা মুখে লাগিয়ে কি যেন বললো, তারপর আবার চেপে বসলো গাড়িতে।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য লোকগুলি সবাই গাড়িতে চেপে বসলো। ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দেবার আয়োজন করছে, এমন সময় বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে গুলী চুড়লো ডাইভারটির বুক লক্ষ্য করে।

একটা তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো বনহুর আর নূরীর কানে। ট্রাক-চালক মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে গাড়ির হ্যান্ডেলের উপর। মুহূর্তে ট্রাক থেকে নেমে পড়লো দলপতি।

তৎক্ষণাৎ অন্যান্য অনুচরগণ ট্রাক থেকে লাফিয়ে নীচে পথের উপর নেমে দাঁড়ালো। সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় মনোভাব,–এই নির্জন স্থানে গুলী এলো কোথা থেকে।

দলপতির ইংগিতে সুতীক্ষ্ম ধার ছোরা হাতে খুলে নিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।

নূরী এ দৃশ্য লক্ষ্য করে ছুটে এসে বনহুরের বুকের মধ্যে মুখ লুকালো। বনহুর নূরীকে অভয় দিয়ে বললো–ভয় নেই, ওরা তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

নূরী থর থর করে কাঁপছে।

মুহূর্তের জন্য বনহুরের মনে পড়লো, নূরী এত সহজে ভীত হবার মেয়ে ছিল না, সেও দস্যু দুহিতা……আর আজ এতো সামান্যে নূরী হরিণ শিওর মতই দুর্বলমনা হয়ে পড়েছে। বনহুর নূরীকে সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় বললোনূরী, তুমি আমার পাশে থাকতে কোন ভয় নেই।

হঠাৎ বনহুর দেখলো, দুজন অদ্ভুত ড্রেস পরা লোক তাদের ঝোপটার দিকে এগিয়ে আসছে। বুঝতে পারলো, ওরা আন্দাজ করে নিয়েছে—গুলীটা এদিক থেকেই গিয়েছিলো।

কিন্তু আর কিছু ভাববার সময় নাই-বনহুর প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।

লোক দুটি এগিয়ে আসতেই বনহুর নূরীকে এক পাশে সরিয়ে ঝাপিয়ে। পড়লো একজনের ঘাড়ে। প্রচণ্ড এক ঘুষিতে লোকটিকে ধরাশায়ী করে পুনরায় আক্রমণ করলো দ্বিতীয় জনকে।

বনহুরের বলিষ্ঠ হস্তের মুঠ্যাঘাতে লোকদুটি কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো। তাদের হাতের ছোরা ছিটকে পড়েছিলো দূরে।

লোক দুটি উঠে তাড়াতাড়ি পালাতে পারলে যেন বেঁচে যায়। ভূতল শয্যা ত্যাগ করে প্রথম ব্যক্তি দিল ভোঁ দৌড়। দ্বিতীয় ব্যক্তিকে বনহুর পালাবার অবসর না দিয়ে পর পর তাকে ভূতলশায়ী করতে লাগলো।

ততক্ষণে অন্যান্য লোকগুলো দ্রুত এদিকে ছুটতে শুরু করছে-সকলের হস্তেই সুতীক্ষ্ণ ধার ছোরা। সূর্যের আলোতে ছোরাগুলো ঝকমক করে উঠছে। এক সঙ্গে যেন কতগুলো বিদ্যুৎ লহরী ছুটে আসছে এদিকে।

বনহুর দ্বিতীয় লোকটাকে শূন্যে তুলে ছুড়ে মারলো দূরে।

দলপতিসহ অন্যান্য লোকগুলো দ্রুত এগিয়ে আসছিলো। লোকটা ধপ করে এসে পড়লো তাদের সম্মুখে।

দলপতি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালো। বনহুর কালবিলম্ব না করে রিভলবার উদ্যত করে ধরলো খবরদারএগুলোই মারব।

এক সঙ্গে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো। দলপতি তার মুখোসের মধ্যের চোখ দুটি দিয়ে তাকালো। বনহুরের আজ পর্যন্ত বহু দস্যুর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটেছে কিন্তু কারো চোখ এমন অগ্নিগোলকের মত তীব্র মনে হয় নি।

বনহুরের হস্তস্থিত রিভলভারের দিকে তাকিয়ে দলপতি গর্জে উঠলো–কে তুমি?

বনহুর পাল্টা প্রশ্ন করলো–তুমি কে?

হাঃ হা করে হেসে উঠলো দলপতি–আমাকে চেনোনা? আবার নিরন্তু পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনিত হলো সেই হাসির শব্দ, বললো দলপতি–আমার নাম কে না জানে। ডাকু হাঙ্গেরুর নাম জানেনা! আমি সেই হাঙ্গেরু ডাকু।

বনহুর একটু হেসে বললো–ওঃ তা তোমার চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছি।

দলপতি গর্জে উঠলো–আমার গাড়ির চালককে তুমি হত্যা করলে কেন? কেন করেছি তার জবাব পাবে এই মুহূর্তে…….

বনহুরের কথা শেষ না হতেই দলপতির ছোরা এসে বিদ্ধ হল বনহুরের বাম বাজুতে।

ডাকু হাঙ্গেরুর ছোরা এতো দ্রুত গিয়ে বনহুরের শরীরে বিদ্ধ হয়েছিলো যে, বনহুর সরে দাঁড়াবার সুযোগ পায়নি।

আহত জন্তু যেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে, তেমনি হাঙ্গেরুর ছোরার আঘাতে হিংস্র হয়ে উঠলো দস্যু বনহুর। রিভলভার উচু করে গুলী ছাড়লো হাঙ্গেরুর বুক লক্ষ্য করে।

হাঙ্গেরু বিকট একটা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো ভূতলে, সঙ্গে সঙ্গে অবাক হলো বনহুর, হাঙ্গেরুর দলবল সব যে দিকে পারে অকস্মাৎ ছুটে পালাতে লাগলো।

দলপতির মর্মান্তিক অবস্থা তার অনুচরদের একেবারে হকচকিয়ে দিয়েছে। তারা ভাবতেও পারেনি তাদের দলপতির এ অবস্থা হতে পারে। যে দিকে পারলো ছুটে পালালো।

বনহুর এবার রিভলভার পকেটে রেখে দক্ষিণ হস্তে বাম বাজু থেকে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা খানা এক টানে তুলে ফেললো। সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।

নূরী এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলো, এবার এগিয়ে এলো। বনহুরের বাজু থেকে রক্ত ঝরতে দেখে দুহাতে চোখ ঢেকে ফেললো নূরী।

বনহুর বললো–ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করো নূরী। আমার রুমালখানা দিয়ে হাতটা শক্ত করে বেঁধে দাও।

নূরী বনহুরের নির্দেশ মত কাজ করলো।

বনহুর একবার ফিরে তাকালো ডাকু হাঙ্গেরুর মৃতদেহের দিকে। তারপর নূরীসহ এগিয়ে চললো অদূরস্থ ট্রাকখানার পাশে।

ট্রাকের উপরে হাত-পা-মুখ বাধা লোক দুটি তখনও ছটফট করছে। বনহুর নিজের ব্যথা ভুলে গেলো, ট্রাকের উপর উঠে গিয়ে লোক দুটির হাত পা আর মুখের বাধন মুক্ত করে দিলো।

লোক দুটি বনহুরের দয়ায় মুক্তি লাভ করে উঠে বসলো।

বনহুর ওদের দুজনাকে নীচে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকের ছায়ায় বসিয়ে দিলো।

লোক দুজনার মধ্যে একজন বললো–আপনি কে? আমাদের জীবন দান করলেন।

বনহুর বললো–আমি একজন মানুষ।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বললো–আপনি আমাদের রক্ষা না করলে আমরা মারা পড়েছিলাম আর কি। ঐ শয়তান ডাকাতের দল আমাদের সব লুটে নিয়ে, আমাদেরকেও বেঁধে আনছিলো। ওরা আমাদের আটক রেখে, আমাদের আত্মীয়-স্বজনের নিকট হতে আরও অর্থ সগ্রহ করতো।

বনহুর বললো এবার–সব খোদার দয়া, তার নিকটেই শুকরিয়া করুন।

লোক দুটির চেহারা দ্র এবং ব্যবসায়ী ধরনের। বনহুর বুঝতে পারলো, ট্রাকে যে মাল রয়েছে এদেরই। নিশ্চয়ই গতরাতে শয়তান ডাকু হাঙ্গেরু তার দলবল নিয়ে এদের উপরে হামলা চালিয়ে এ সব লুটে নিয়ে এসেছে।

লোক দুটির সঙ্গে আরও কয়েকটা কথাবার্তায় বনহুর বুঝতে পারলো, এখান থেকে শহর বহু দূরে। হেঁটে যাবার কোন উপায় নেই। এ পথে কোন যান-বাহন যাতায়াত করে না, এককালে লোক চলাচলের সুন্দর ব্যবস্থা থাকলেও আজ আর নেই, কারণ,এ পথটা দস্যু আর ডাকুতে ছেয়ে গেছে। কচিৎ কোন গাড়ি এদিকে আর চলে না।

কাজেই কোন যানবাহনের আশা নেই।

ট্রাকখানা কোনক্রমে ওদিকে ফেরাতে পারলেই উপস্থিত বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যেত, কিন্তু ফেরাববা কি করে সামান্য চওড়া জায়গা হলেও বনহুরের কাছে অসাধ্য ছিলো না।

এদিকে বনহুরের বাহু দিয়ে তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যন্ত্রণা যে না হচ্ছে তা নয়, কিন্তু এখন ব্যথায় মুষড়ে পড়লে চলবে না। নিজে বাঁচতে হবে আর এদেরকেও বাঁচাতে হবে।

বনহুর কিছু ভেবে নিলো, তারপর যে দিকে তারা এখন অগ্রসর হবে, মানে যে দিক থেকে ট্রাকখানা এসেছিলো সে দিকে এগুতে লাগলো।

হস্তপদ মুক্ত লোকদ্বয় ও নূরী দাঁড়িয়ে রইলো ট্রাকখানার পাশে।

বনহুর চলে গেলো, আর তার ফিরবার কথা নাই।

বেলা প্রায় গড়িয়ে আসছে, এমন সময় ফিরে এলো বনহুর। মুখভাব কিছুটা প্রসন্ন। প্যান্টের পকেট থেকে রুমালখানা বের করে মুখমন্ডল মুছে নিয়ে বললো, পেয়েছি, উপায় পেয়েছি, কিন্তু জীবন-মরণ সমস্যা।

প্রথম ব্যক্তি বললো–কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?

বনহুর একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে এক মুখ ধূয়া নির্গত করে বললো–গাড়ি ফেরানোর মত খানিকটা জায়গা আবিষ্কার করে তবেই ফিরলাম। নিন, আপনারা গাড়িতে চেপে বসুন, আমি গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে যাচ্ছি।

প্রথম ব্যক্তি বললো–যে দুর্গম পথ, গাড়ি ব্যাক করা কি সহজ হবে? হঠাৎ যদি পড়ে যায়?

তাহলে মৃত্যু। বললো বনহুর।

শিউরে উঠে বললো দ্বিতীয় ব্যক্তি কাজ নেই, হেঁটেই চলুন।

যে কদিন লাগে লাগবে।

বনহুর তার কথা শুনে হাসলো, তারপর বললো–আচ্ছা, আপনারা হাঁটতে শুরু করেন, আমি গাড়ি ব্যাক করে নিয়ে যাচ্ছি।

বনহুর গাড়ির ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো।

স্তব্ধ নিশ্বাসে লোক দুটি তাকিয়ে রইলো তাদের মূল্যবান সামগ্রী সহ গাড়িখানার দিকে।

বনহুর গাড়িখানা সাবধানে ব্যাক করে নিয়ে চললো। লোক দুজন ও নূরী চলতে লাগলো গাড়িখানাকে অনুসরণ করে।

অতি কৌশলে আঁকাবাঁকা উঁচু নীচু পাহাড়ে পথ দিয়ে বনহুর নিপুণতার সঙ্গে গাড়ি ব্যাক করে চালিয়ে চললো। হঠাৎ যদি একটু এদিক-ওদিক হয়ে যায় তাহলেই গাড়িখানা গড়িয়ে পড়ে যাবে হাজার ফিট নীচে, পাথরের উপরে।

অদ্ভুত সাহসী দস্যু বনহুর–এই দুর্গম পথে গাড়ি পিছন দিকে চালিয়ে নিতে এতোটুকু ঘাবড়ে গেলোনা বা বিচলিত হলোনা। নির্ভীক সৈনিকের মত সে স্থিরভাবে গাড়ি ড্রাইভ করে চললো।

পাহাড়ের গা ঘেষে সঙ্কীর্ণ পাথুরে পথ, তাও সমতল নয়, মাঝে মাঝে বেশ উঁচু নীচু। একবার হঠাৎ গাড়িখানা কাৎ হয়ে গিয়ে ছিলো আর কি, বনহুর অতি সাবধানে কোন রকমে সামলে নিলো। সমস্ত শরীর ঘেমে উঠেছে ওর। সুন্দর মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে উঠেছে ভীষণ ভাবে। জীবনে বনহুর অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করেছে, কিন্তু আজকের মত এমন সঙ্কটময় পথ তার জীবনে এই যেন প্রথম।

প্রায় ঘন্টা কয়েক চলার পর তার নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছতে সক্ষম হলো।

গাড়িখানা রেখে নেমে দাঁড়ালো বনহুর, জায়গাটা আর একবার তাকিয়ে দেখে নিলো। এ স্থানে পাহাড়ের গা কিছুটা ঢালু তবে সম্পূর্ণ প্রশস্ত নয়। গাড়ি কোন রকমে ব্যাক করে ঘুরিয়ে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু হঠাৎ যদি গড়িয়ে পড়ে তাহলে আর রক্ষা নাই।

বনহুর যখন ভাবছে–কিভাবে গাড়িখানা ব্যাক করে সামনের দিকে মুখ ফেরাবে, ঠিক তখন কতগুলো অসভ্য জংলী লোক হুম হুম করে এগিয়ে এলো পাহাড়ের গা বেয়ে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্য থেকে।

বনহুর এই মুহূর্তে এমন কিছু আশা করে নেই। কিন্তু তাকে তখনই প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াতে হলে, বিলম্ব করার সময় ছিল না।

কতগুলো জংলী এক সঙ্গে ছুটে এলো তার দিকে। বনহুর রিভলভার উদ্যত করে গুলী ছুঁড়লো একজন জংলীর বুক লক্ষ্য করে।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো, তারপর গড়াতে গড়াতে এসে পড়লো বনহুরের পায়ের কাছে।

বনহুর আর একজনকে লক্ষ্য করবার পূর্বেই অসংখ্য সূতীক্ষ্ম ধার বর্শা এসে গেঁথে যেতে লাগলো তার চার পাশের মাটিতে।

আশ্চর্য কৌশলে নিজকে বাঁচিয়ে নিতে লাগলো বনহুর। ভাগ্যিস, তখনও ট্রাকের সেই লোকদ্বয় ও নূরী একটু দূরে একটা ঝোপের আড়ালে এসে পৌঁছেছিলো।

জংলী লোকগুলো তাদের কাউকেই দেখতে পায়নি। কাজেই সকলে একযোগে আক্রমণ করেছে বনহুরকে।

জংলীগণ আরও নিকটে এসে পড়েছে।

একখানা তীক্ষ্ম বর্শা সাঁ করে চলে গেলো বনহুরের কানের পাশ কেটে। আরও দুখানা এক সঙ্গে ছুটে এলো, বনহুর চট করে সরে দাঁড়ালো। বর্শা দুখানা গিয়ে বিদ্ধ হলো পিছনের ট্রাকের গায়ে।

বনহুর এবার দ্রুত হস্তে প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভার বের করে গুলী ছুড়তে শুরু করলো।

বনহুরের গুলীর আঘাতে এক একজন জংলী ভূতলশায়ী হতে লাগলো। কিন্তু আশ্চর্য, জংলীরা এতে এতটুকু বিচলিত হলো না, বরং আরও উন্মত্ত হয়ে আক্রমণ করলো বনহুরকে।

এতোগুলো হিংস্র জংলীর কবলে বনহুর একা, মরিয়া হয়ে সে লড়াই করে চললো।

রিভলভারের গুলী শেষ হতেই একখানা বর্শা তুলে নিলো বনহুর হাতে। কিছুক্ষণ পূর্বে তার বাম বাহুতে দুষ্ট ডাকু হাঙ্গেরুর ছোরা বিদ্ধ হওয়ায় যদিও বেশ কষ্ট পাচ্ছিলো, তবু সে এতটুকু দুর্বল হলো না।

বনহুর জংলীদের বর্শার আঘাত তার হস্তস্থিত বর্শা দিয়ে প্রতিরোধ করে চললো, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার নিকটস্থ আক্রমণকারী জংলীদের ভূতলশায়ী করতে লাগলো। কেউ বা বনহুরের বর্শার আঘাতে ছিটকে পড়লো নীচে; কেউ বা আহত হলো, কেউ বা হলো নিহত।

বনহুরের অসীম শক্তির কাছে জংলীর দল কিছুক্ষণের মধ্যেই পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হলো। কতগুলো জংলী নিহত হলো, কতক আহত অবস্থায় ছুটে পালালো, এমন কি যারা অক্ষত অবস্থায় ছিলো তারা দৌড় দিল উদ্ধশ্বাসে, ফিরে তাকালো না আর।

এতগুলো জংলীর সঙ্গে বনহুর একা প্রাণপণে লড়াই করে অত্যন্ত হাঁপিয়ে পড়েছিলো। ট্রাকের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছতে লাগলো।

ওদিকে লোক দুটি আর নূরী এতোক্ষণ একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ঠক্ ঠক করে কাঁপছিলো। এবার জংলীদের পালাতে দেখে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো তারা।

বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো। লোক দুজন বনহুরকে অনেক সহানুভূতিজনক কথা বলতে লাগলো। নূরী আজ স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন হলে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়তো বনহুরের বুকে। আজকের এ বিপদ মুহূর্তে বনহুরকে ফিরে পেয়ে তার আনন্দের সীমা থাকতো না। কিন্তু নূরী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো, একটি কথাও সে বললো না!

বনহুর কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে বললো–আপনারা আর বিলম্ব করবেন না, গাড়িতে উঠে বসুন। তারপর নূরীকে লক্ষ্য করে বললো সে–নূরী, এসো আমার পাশে।

বনহুরের কথায় নূরী ট্রাকের ড্রাইভ আসনের পাশে উঠে বসলো।

আর ব্যবসায়ী লোক দুজন ট্রাকের পিছনে উঠে বসলো।

বনহুর গাড়ি স্টার্ট দিলো।

এই সে জীবনের প্রথম ট্রাক চালকের ভূমিকা গ্রহণ করলো।

০৩.

পথে আর কোন বিপদ দেখা দিল না।

বনহুর ট্রাক সহ এসে পৌঁছলো ঝাঁম শহরে।

ব্যবসায়ী লোক দুজন বনহুরের দয়ায় নিজেদের জীবন ও তাদের লুষ্ঠিত দ্রব্যাদি ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হলো। নিজেদের বাড়িতে বনহুর আর নূরীকে নিয়ে গেলো তারা অতি সমাদর করে।

লোক দুজন অত্যন্ত ধনবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিরাট বাড়িগাড়ি, শহরের মধ্যে বড় বড় দোকান-পাট অনেক রয়েছে তাদের। ব্যবসায়ী লোক হিসাবে শহরময় তাদের অনেক নাম রয়েছে।

হঠাৎ গত দুদিন আগে ব্যবসায়ীদ্বয় নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় শহরময় একটা ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছিলো। পুলিশ হন্তদন্ত হয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলো। কিন্তু এ লোক দুজনার কোন সন্ধান করে উঠতে পারেনি।

ব্যবসায়ীদ্বয়ের বাড়িতে কান্নাকাটি শুরু হয়ে গিয়েছিলো। এমন দিনে আবার ফিরে পেলো তারা তাদের হারানো ধনকে। ব্যবসায়ীদ্বয়ের আত্মীয়স্বজন সবাই বনহুরের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলো। শহরের বহু ব্যক্তি এলেন দেখা করতে বনহুরের সঙ্গে।

এদের মধ্যে শহরের এক অভিজ্ঞ ডাক্তারও এলেন, ব্যবসায়ী প্রথম ব্যক্তির বন্ধুলোক তিনি।

ব্যবসায়ীদ্বয়ের প্রথম ব্যক্তির নাম কামরান আলী ও দ্বিতীয় জনের নাম জামশেদ মিয়া, উভয়ে আপন সহোদর ভাই না হলেও তারা উভয়ে উভয়ের পরম আত্মীয়।

অভিজ্ঞ ডাক্তার জামরুদী কামরানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

জামরুদী বনহুরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন।

কামরান বনহুরকে নিয়ে একটা ভোজের আয়োজন করলেন, কাজেই এক দিনের জন্য বনহুরকে ঝাম শহরে বাধ্য হয়ে থেকে যেতে হলো।

কথায় কথায় ডাক্তার জামরুদী ও বনহুর অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো। একথা সে কথায় বনহু জানতে পারলো–ডাক্তার জামরুদী শুধু ডাক্তারই নন, তিনি মস্তবড় বৈজ্ঞানিক। জীবনে তিনি বহু দেশ ঘুরেছেন এবং বহু রোগের ঔষধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।

ভাজার জামরুদীর কথায় বনহুরের মনের আকাশে একটা আশার আলো উঁকি দিয়ে গেলো। নূরী আজ জ্ঞান-শূন্যা। যাদুকরের কোন ঔষধ তা স্বাভাবিক জ্ঞান লুপ্ত করে দিয়েছে।

বনহুর এক সময় ডাক্তার জামরুদীর নিকটে নূরীর সম্বন্ধে সমস্ত কথা খুলে বললো।

বনহুরের কথায় জামরুদী গভীরভাবে কিছু চিন্তা করলেন, তারপর হেসে বললেন তিনি–আমি তাকে দেখতে চাই।

বনহুর সেই মুহূর্তেই নূরীকে ডেকে আনলো ডাক্তার জারুদীর সম্মুখে।

নূরীকে কিছু সময় পরীক্ষা করে জামরুদী বললেন–মিঃ চৌধুরী, আপনি চিশ্চিন্ত থাকুন, আমি আপনার বোনকে সুস্থ করে দেবো। আবার সে স্বাভাবিক জ্ঞান শক্তি ফিরে পাবে।

বনহুর নিজের নাম মিঃ ইউসুফ চৌধুরী ও নূরীকে বোন বলে পরিচয় দিয়েছিলো এখানে। সত্যি পরিচয় দিলে বনহুরকে তারা নিশ্চয়ই সুনজরে দেখবে না, কাজেই তাকে এই মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। ডাক্তারের কথায় বনহুর খুশি হলো। মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানালো বনহুর।

কামরান আলী ও জমশেদ মিয়ার বাড়িতে বনহুর আতিথ্য গ্রহণ করবার পর বিদায় নিয়ে ডাক্তার জামরুদীর বাড়িতে গেলো। জামরুদী অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে বনহুর আর নূরীকে নিজ আবাসে নিয়ে রাখলেন।

নূরীর চিকিৎসা করবেন স্বয়ং জামরুদী।

যেদিন নূরীকে জামরুদী নিজের চেম্বারে নিয়ে গেলেন। সঙ্গে বনহুর।

জামরুদী বললেন–মিঃ ইউসুফ, আপনার বোনকে আমি এমন একটা ঔষধ সেবন করাবো, যে ঔষধ সেবনের পর আপনার বোন সম্পূর্ণ জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে কয়েক দিন আমি রাখবো।

বনহুরের মনে একটা দুশ্চিন্তার ঝড় বইলেও সে বিচলিত হলো না। কারণ, একদিনে ডাক্তার জামরুদীকে চিনতে বাকী রাখেনি বনহুর। লোকটা মহৎ এবং নিষ্ঠাবান তাতে কোন ভুল নেই। বয়স তার পঞ্চাশের বেশি হবে, ধীর-স্থির সৌম-সুন্দর পুরুষ। ডাক্তার জামরুদীকে কথা দিলো বনহুর, তিনি যে ভাবে নূরীকে সুস্থ করতে চান তাতেই রাজি আছে সে।

বন আর নূরী এসে বসলো ডাক্তার জামরুদীর চেম্বারে। কক্ষটা খুব প্রশও নয়, মাঝারি গোছের। কক্ষের চারদিকে আলমারী আর টেবিল সাজানো। প্রত্যেকটা আলমারীতে নানাবিধ শিশি সুন্দরভাবে রাখা হয়েছে। সবগুলো শিশিতে তরল পদার্থ। টেবিলে নানারকম বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি থরে থরে সাজানো রয়েছে। এক পাশে একটি রবারের শয্যা পাতা রয়েছে।

এ শয্যায় রোগিগণকে শোয়ানো হয়।

বনহুর কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে নিপুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।

হেসে বললেন ডাক্তার জামরুদী, খুব বিস্ময় লাগছে আমার এ সব দেখে, না?

হাঁ, সত্যি আমি অবাক হচ্ছি ডক্টর, ইতিপূর্বে আমি কোন বৈজ্ঞানিকের চেম্বারে প্রবেশ করিনি।

ডাক্তার জামরুদী বললেন–ইতিপূর্বে আমার চেম্বারেও কোন বাইরের আগন্তক প্রবেশে সক্ষম হয় নি মিঃ চৌধুরী, আপনিই সর্ব প্রথম …….

তাহলে আপনি আমাকে যথেষ্ট বিশ্বাস করেছেন?

হাঁ, আপনার কথাবার্তা ও ব্যবহারে আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি। আমি রোগির কোন আত্মীয়কে আমার চেম্বারে প্রবেশে অনুমতি দেই না।

ডাক্তার জামরুদী কথা শেষ করে পাশের দরজার পর্দা ঠেলে চলে গেলেন। কোথায় গেলেন কে জানে।

বনহুর আর নূরী দুটি আসনে বসে রইলো চুপচাপ। বনহুরের বিস্ময় তখনও কমেনি, সে নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিলো সব।

নূরী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো এদিকে ওদিকে।

বনহুর বললো–নূরী, জানো এখানে কেনো এসেছি?

নূরী মাথা দোলালো, বললো-জানি, আমার চিকিৎসার জন্য!

কি করে বুঝলে তোমার চিকিৎসার জন্য?

ডাক্তারের কথা আমি কি বুঝতে পারিনি ভাবছেন?

নূরী, এসব যদি বুঝতে পারো, তবে আমার মনের ব্যথা কেনো বুঝতে পারো না? আজও কেনো তবে আমাকে চিনতে পারো না?

নূরী মাথা নাড়লো, কিছু স্মরণ করতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারছে না। ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলো।

বনহুর নূরীর দক্ষিণ হাত মুঠায় চেপে ধরলো–নূরী, তোমাকে ডাক্তার কয়েক দিনের জন্য…..

কথা শেষ হয় না বনহুরের, কক্ষে প্রবেশ করেন ডাক্তার জামদ–মি চৌধুরী, আসুন, আপনার সঙ্গে আমার কয়েকটা নিভতে কথা আছে।

বনহুর নূরীকে লক্ষ্য করে বললো–বসো তুমি, এক্ষুণি ভাসছি। ডাক্তার জামরুদীকে অনুসরণ করলো বনহুর।

পাশের কামরায় প্রবেশ করে বনহুর আরও বিস্মিত হলো! সমস্ত কক্ষ গাঢ় রক্তাভ আলোকে আলোকিত।

মনে হলো সমস্ত কক্ষটায় রক্ত ছড়িয়ে আছে। এ কক্ষে পূর্বে কফ চেয়ে অনেক বেশি শিশি ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। নানা রকম জং ও কাচপাত্র ঔষধপূর্ণ। রক্তাভ আলোতে কাচ পাত্র ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপতি কেমন যেন লাল টক টকে দেখাচ্ছে।

বনহুরকে বসতে বললেন ডাক্তার জামরুদী।

বনহুর ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আসন গ্রহণ করলো বটে, কিন্তু তার মধ্যে একটা আশঙ্কা দোলা জাগালো। কক্ষটার মধ্যে একটা উট ঔষও গন্ধ ছড়িয়ে ছিলো। বনহুরের যেন নিশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগলো।

ডাক্তার জামরুদী সম্মুখের কাচের টেবিলে একটি কাচ পাত্রে গাঢ় সবুজ রং এর ঔষধ রেখে পরীক্ষা করছিলেন। সবুজ তরল ঔতার উপরে ভাল আলো কেমন যেন কালো রঙ এর সৃষ্টি করছিলো। বললো ভ্রামদী মিঃ চৌধুরী, আপনিও ঘাবড়ে গেছেন?

ব্যস্তভাবে বলে উঠলো বনহুর–না না, আপনি ভুলে বুঝছেন ডক্টর। ডাক্তার জামরুদী বনহুরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন–দেখুন মিঃ চৌধুরী, আমি আপনার বোনের উপর এখনই ঔষধ প্রয়োগ করবো, এবং আপনার সাক্ষাতে করবো।

ধন্যবাদ ডক্টর।

এই আমার জীবনে প্রথম কোন আত্মীয়ের সম্মুখে রোগিকে তার স্বাভাবিক জ্ঞান থেকে বিলুপ্ত করা। আপনি কোন রকম বিচলিত হবেন না তো?

হাসলো বনহুর–আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন ডক্টর।

থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ চৌধুরী, যান, আপনার ভগ্নিকে নিয়ে আসুন এ কক্ষে।

বনহুর চলে গেলো। একটু পরে ফিরে এলো নূরী সহ।

এ কক্ষে প্রবেশ করে নূরী বেশ ঘাবড়ে গেলো। কক্ষটা সত্যি অত্যন্ত ভীতিকর ছিলো।

বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো নূরী আমাকে আপনারা হত্যা করবেন না তো?

বনহুর হেসে বললো–উনি দস্যু বা ডাকু নন যে, তোমাকে হত্যা করবেন।

বনহুরের কথায় গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ডাক্তার জামরুদী–চৌধুরী, আপনি ভুল করছেন, কারণ দস্যু বা ডাকু হলেই তারা বিনা কারণে হত্যা করে না।

আপনিই ভুল করছেন ডক্টর, দস্যু বা ডাকুদের হত্যা করা একটা নেশা।

ওকথা আপনি জানেন না বলেই বলছেন মিঃ চৌধুরী, দস্যু বনহুরের কথা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে।

হাঁ, শুনেছি তার নাম। বললো বনহুর।

ডাক্তার জামরুদী বললেন–দস্যু হলেও সে এক মহান ব্যক্তি। যদিও তাকে কোনদিন চোখে দেখবার সৌভাগ্য আমার হয়নি, কিন্তু তার নাম আমি অন্তরে গেথে রেখেছি।

ডক্টর!

হাঁ মিঃ চৌধুরী, আমি তাকে শ্রদ্ধা করি! দস্যু হলেও সে মানুষ, কিন্তু আজ শত শত মানুষরূপী ব্যক্তি, যারা সমাজের বুকে স্বনামধন্য হয়ে জেকে বসে আছেন, তারা দস্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর,

ডক্টর, আপনার অন্তরকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। পৃথিবীতে এমন জনও আছে, যারা মানুষের নকল রূপের পিছনে আসল রূপটা দেখতে পায়।

জামরুদী দস্যু বনহুরের কথায় বেশ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন, তাড়াতাড়ি স্বাভাবিকভাবে কণ্ঠে বললেন–ওঃ এবার কাজ শুরু করবো।

বনহুর নূরীর দিকে তাকালো–ভয় নেই, আমি আছি নূরী।

ডাক্তার জামরুদী নূরীকে নিয়ে একটি সোফায় বসালেন। সোফার চারদিকে কয়েকটা বৈদ্যুতিক আলোর সুইচ ছিলো। পাশেই একটা রবারের শয্যা।

জামরুদী সুইচ টিপে আলো জ্বাললেন।

সঙ্গে সঙ্গে কক্ষটা গাঢ় লালে ভরে উঠলো। নূরীকে দেখে মনে হলোতার সমস্ত দেহে কে যেন একপোঁচ রক্ত মাখিয়ে দিয়েছে। বনহুর নূরীর অদূরে এসে দাঁড়ালো। চোখে-মুখে তার একটা ভীতির ভাব ফুটে উঠলো, আজ তার নিজের এ অবস্থা হলে এতোটুকু ঘাবড়ে যেতোনা সে। কিন্তু নূরীর জন্য আশঙ্কা–যদি নূরীর জ্ঞান আর ফিরে না আসে।

ডাক্তার জামরুদী টেবিল থেকে সবুজ তরল পদার্থ সহ কাচপাত্রটা হাতে উঠিয়ে নিলেন।

বনহুর তাকিয়ে আছে নির্বাক নয়নে নূরীর মুখের দিকে।

ডাক্তার জামরুদী কাঁচ-পাত্রটা নূরীর মুখের কাছে নিয়ে এলেন।

নূরী নিঃশব্দে পান করল তরল সবুজ পদার্থটুকু।

জামরুদী এবার দ্রুত হস্তে কাঁচ-পাত্র টেবিলে রেখে নূরীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

বনহুর তাকিয়ে আছে তখনও নূরীর দিকে অপলক নয়নে। ধীরে ধীরে নূরীর চোখ দুটো যেন মুদে আসছে।

মাথাটা নুয়ে আসছে সম্মুখের দিকে।

বনহুর স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে….. হঠাৎ বনহুর নূরীকে ডাকতে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে জামরুদী ঠোঁটে আংগুল চাপা দিয়ে বারণ করল তাকে কথা বলতে।

নৃরী টলে পড়ে যাচ্ছিলো, জামরুদীর ইংগিতে নূরীকে ধরে ফেললো বনহুর। তুলে নিলো সে নূরীর ছিন্ন লতার মত সংজ্ঞাহীন দেহটা হাতের উপর।

ডাক্তার জামরু এবার কথা বললেন–ঐ বিছানায় শুইয়ে দিন।

বনহুর নূরীকে ওপাশের রবারের বিছানায় শুইয়ে দিলো ধীরে ধীরে। তারপর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো শিয়রে।

ডাক্তার জামরুদী বললেন–আজ থেকে পরশু পর্যন্ত অজ্ঞান থাকবে। তারপর চতুর্থ দিনে জ্ঞান ফিরে আসবে। মিঃ চৌধুরী ঐ দিন আপনার ভগ্নি আপনাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

ডক্টর, আপনার দয়ায় আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।

প্রবল আগ্রহ নিয়ে বনহুর নূরীর পাশে বসে আছে। তাকিয়ে আছে সে। তার মুদিত আঁখি দুটির দিকে।

০৪.

আজ চতুর্থ দিন। কক্ষে যে গাঢ় লাল আলো জ্বলছিলো, প্রতি দিন একটি করে সুইচ টিপে এক একটি আলো নিভিয়ে দিচ্ছিলেন ডাক্তার জামরুদী। আজ শেষ বাবের সুইচ টিপলেন ডাক্তার।

কমধ্যে আজ কোন লাল রঙের আলো নেই।

একটা উজ্জ্বল আলো কক্ষটিকে আলোকিত করে রেখেছিলো। এতদিন কক্ষটা গভীর আলোতে আলোকিত থাকায় বনহুরের চোখে ধাধা লেগে গিয়েছিলো।

মাঝে মাঝে বাইরে গিয়েছে বনহুর আহার ও স্নানের জন্য। কিন্তু সর্বক্ষণ সে নূরীর শয্যার পাশ থেকে সরে যায়নি। কোন কোন সময় ডাক্তার জামরুদীর অন্দরে পাশের চেম্বারে একটু বিশ্রাম করে নিয়েছে সে, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসেনি। নানা দুশ্চিন্তায় মনটা সর্বক্ষণ ভরে থাকতো। নূরীকে বনহুর শুধু ভালই বাসেনা নূরী বনহুরের একজন জীবন-সঙ্গিনী।

নূরীর অমঙ্গল আশঙ্কা বনহুরকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো। কখন জ্ঞান ফিরে আসবে কে জানে ফিরবে কি না তাইবা কে বলতে পারে।

আজ চতুর্থ দিবস। নূরীর শিয়রে বসে উত্তেজিত হয়ে প্রতীক্ষা করছে বনহুর।

ডাক্তার জামরুদীও উন্মুখ হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছেন, একটা কি যেন ঔষধ সহ পাইপ ধরে আছেন নূরীর নাকের কাছে। মাঝে মাঝে নার্ভ পরীক্ষা করে দেখছেন তিনি।

চতুর্থ দিনও প্রায় শেষ হয়ে এলো।

ডাক্তার জামরুদীর ললাট কুঞ্চিত হলো, মুখভাবে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তার ছাপ। কেমন যেন বিহ্বল মনে হচ্ছে তাকে।

বনহুর বুঝতে পারলো–নূরীর জীবন আশঙ্কাজনক। ডাক্তার জামরুদীর মুখভাব লক্ষ্য করে বনহুরের মনের মধ্যে আলোড়ন শুরু হলো। তাহলে নূরীকে ও হারালো এবার।

ক্রমেই বনহুরের মুখ কঠিন হয়ে উঠতে লাগলো। একটা জীবন নিয়ে। ছিনিমিনি খেলা, এ মুহূর্তে ডাক্তার জামরুদীকে সমুচিত শাস্তি দিতে পারে। বনহুর তবু ধৈর্য সহকারে বললো—ডক্টর, কেমন দেখছেন?

জামরুদী বললেন–আমি ইতিপূর্বে আরও অনেকগুলো এ ধরণের কেস সুস্থ্য করেছি, কিন্তু–থেমে যান ডাক্তার জমরুদী।

বনহুর ডাক্তারের কলার চেপে ধরলো–থামলেন কেনো বলুন? বলুন ডক্টর, নূরীর জ্ঞান ফিরবে তো?

ডাক্তার জমাদী বলে উঠেন–হাঁ হাঁ ফিরবে–কিন্তু—কিন্তু—

কিন্তু কি? বলুন, বলুন ডাক্তার?

এমন তো কোনদিন হয়নি!

কি বলছেন! বনহুর যেন আর্তনাদ করে উঠলো।

ডাক্তার জামরুদীর ললাটে ফুটে উঠলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। মুখ মণ্ডল অন্ধকার হলো, অস্ফুট কণ্ঠে বললেন তিনি–পারলাম না মিঃ চৌধুরী ….

জামরুদীর কথা শেষ হতে না হতে গর্জে উঠলো বনহুরের হাতের রিভলভার।

একটা আর্তনাদ করে ডাক্তার জামরুদী পড়ে গেলেন তার ল্যাবরেটরীর মেঝেতে। জামরুদীর বুকের রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো ল্যাবরেটরীর মেঝের কার্পেট।

বনহুর রিভলভার পকেটে রেখে ফিরে তাকালো শয্যায় শায়িত নূরীর দিকে। নূরীর মুদিত আঁখি কোণে দুফোটা অশ্রু মুক্তা বিন্দুর মত চক্ চক্

করছে।

বনহুর নিজেকে কিছুতেই সংযত রাখতে পারলো না। নূরীর দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে বালকের ন্যায় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে ল্যাবরেটরীর বাইরে শোনা গেলো দ্রুত পদ শব্দ। রিভলভারের গুলীর শব্দ বাইরে গিয়ে পৌঁছেছে, তারই শব্দে ছুটে আসছে ডাক্তার জামরুদীর কর্মচারীগণ।

বনহুর একবার তাকালো ল্যাবরেটরীর পিছন শার্শির দিকে। ক্ষিপ্র হস্তে খুলে ফেললো পিছন শার্শিটা।

পুনরায় ফিরে এলো নূরীর শয্যার পাশে।

ল্যাবরেটরীর বাইরে দাঁড়িয়ে উচ্চ কণ্ঠে কেউ ডাকছে–স্যার, স্যার কি হলো? স্যার…

বাইরে এসে সবাই জড়ো হয়েছে কিন্তু ল্যাবরেটরীর ভিতরে প্রবেশের কেউ সাহস পাচ্ছে না।

বনহুর হাতের উপর তুলে নিলো নূরীর মৃতবৎ দেহটা। এক বার তাকালো ভুলুণ্ঠিত ডাক্তার জমরুদীর রক্ত মাখা দেহটার দিকে।

জামরুদীর মুখে এখনও গভীর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। রোগিকে হত্যার করার অভিপ্রায় তার ছিলো না, তিনি চেয়েছিলেন রোগিকে নতুন জীবন দান করতে।

বনহুর নূরীর এলিয়ে পড়া দেহটা নিয়ে পিছন শার্শি দিয়ে লাফিয়ে পড়লো। বাইরে।

নির্জন নদীর তীর।

নূরীর নিস্তব্ধ দেহটার পাশে পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বনহুর। গোটা রাত এমনি ভাবে কেটে গেছে বনহুরের, একবারও সে নূরীর দেহের পাশ থেকে সরে যায়নি কোথাও। সত্যি কি নূরী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য চলে গেলো? কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয়না বনহুরের। কত বার নূরীর নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখেছে সে, মনে হয়েছে অতি ধীরে মৃধু ভাবে নিশ্বাস বইছে। একটা ক্ষীণ আশা এখনও ত্যাগ করতে পারেনি বনহুর। উন্মুখ হৃদয় নিয়ে ব্যাকুল আঁখি মেলে নূরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সে।

ভোরের হাওয়া বইছে।

পূর্ব আকাশ রাঙা করে উঁকি দিলো অরুণ আলো। গোটা বিশ্ব নতুন জীবন লাভ করলো যেন।

বনহুর নিৰ্ণিমেষ নয়নে তাকালো নুরীর স্থির-নিশ্চল মুখমণ্ডলের দিকে। গাছে গাছে পাখির কলরব জেগে উঠলো। নদীর কুল কুল ধ্বনির সঙ্গে ভেসে এলো ভোরের আযানের শব্দ।

হঠাৎ বনহুরের চোখে মুখে ফুটে উঠলো এক অপূর্ব আনন্দ উচ্ছ্বাস। নূরী ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো।

বনহুর ব্যাকুল আগ্রহে ঝুঁকে পড়লো নূরীর মুখের কাছে। গভীর আবেগে ডাকলো–নূরী! নূরী।

নূরীর সমস্ত দেহটা নড়ে উঠলো, হাতখানা উঁচু করতে গিয়ে আবার পড়ে গেলো এক পাশে।

বনহুর হাতখানা ধরে ফেললো হাতের মুঠোয় পুনরায় ডাকলো–নুরী।

নূরীর ঠোঁট দুখানা কেঁপে উঠলো, অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো–পানি।

বনহুর ব্যস্তভাবে নদীর দিকে এগিয়ে গেলো, দুহাতে খানিকটা পানি নিয়ে দ্রুত ফিরে এলো নূরীর পাশে।

হাটু গেড়ে বসে পানিটুকু নূরীর মুখে দিলো।

এতোক্ষণে নূরীর গলা কিছুটা যেন ভিজে শব্দ বেরিয়ে এলো, অস্ফুট কণ্ঠে বললো–আমি কোথায়?

বনহুর নূরীর কপালে মুখে হাত বুলিয়ে বললো–তুমি আমার পাশে, নূরী।

নুরী দুহাতে চোখ দুটো একবার মুছে নিলো–আমি তোমায় দেখতে পাচ্ছি না, তুমি …………তুমি…….

বলো, বলো……. বলো নূরী?

তুমি আমার হুর ……. হুর……..

বনহুর উচ্ছ্বসিত আনন্দে নূরীকে ভূতল থেকে তুলে নেয় হাতের উপর, : আকুলভাবে বলে সে–নূরী আমি, আমি তোমার বনহুর!

নূরী ক্ষীণকণ্ঠে বললো–আমি কেনো তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনা হুর?

 জানিনা, জানিনা নুরী কেনো, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছো না!

নূরী, দুহাতে চোখ রগড়ে ভাল করে তাকালো–আমার চোখে পানি, দাও! পানি দাও!

বনহুর আবার নূরীকে নদী তীরস্থ দূর্বাকোমল শয্যায় শুইয়ে দিয়ে পানি আনতে ছুটলো। এবার রুমাল ভিজিয়ে পানি নিয়ে এলো সে। নূরীর চোখ মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো।

নূরী এবার তাকালো মুক্ত আকাশের দিকে। আজ নূরী নব জীবন লাভ। করলো। আকাশের নীল রঙ তার দৃষ্টিকে উজ্জ্বল করে তুললো। নূরী তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। মুহূর্তে নূরীর চোখে-মুখে এক খুশির উচ্ছাস ফুটে উঠলো। দুহাত বাড়িয়ে দিলো বনহুরের দিকে বনহুর তুমি…. তুমি….

বনহুর গলাটা এগিয়ে দিলো নূরীর দিকে, নিজের হাত দুখানা দিয়ে নূরীর অবশ হাত দুখানা তুলে নিলো।

 নব জীবন লাভ করলে নূরী। বহুদিন পর আজ প্রথম বনহুরের নাম ধরে ডাকলো আর চিনতে পারলো তাকে।

বনহুর এতো খুশি হয়েও ব্যথায় মুষড়ে পড়লো, ভুল করে সে ডাক্তার জামরুদীকে হত্যা করেছে। ভুল শুধু বনহুরেরই হয়নি, ভুল করেছিলো জামরুদী-তার ঔষধ তিন দিনের স্থানে চার দিন সময় নিয়েছিলো, কারণ ঔষধের মাত্রা সামান্য একটু বেশি হয়ে গিয়েছিলো সেবনকালে। এবং সে জন্যই নূরীর সংজ্ঞালাভে বিলম্ব ঘটেছিলো। ডাক্তার জামরুদী হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, মনের দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলো বনহুরের নিকটে।

বনহুরের ধৈর্যের বাধ ভেংগে গিয়েছিলো সে মুহূর্তে। জামরুদী ইচ্ছা করেই তার নূরীকে হত্যা করেছে মনে হয়েছিলো তার। তাই বনহুর হত্যা করেছিলো ডাক্তার জামরুদীকে।

এখানে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ব্যথায় বনহুরের অন্তর জর্জরিত হলো।

নূরী তখন বনহুরের মুখে-মাথায়-গলায় হাত বুলিয়ে গভীরভাবে অনুভব করছিলো, সত্যি তার বনহুর ফিরে এসেছে কিনা তার পাশে।

বনহুর অশ্রু ছলছল চোখে তাকিয়ে দেখছিলো নূরীকে। কত দিনের প্রতীক্ষার পর আজ যেন সে তার আকাঙ্খিত জিনিসটিকে খুঁজে পেয়েছে।

বনহুর নূরীকে নিবিড়ভাবে টেনে নিলো কাছে। আবেগভরা কণ্ঠে বললোনুরী!

বলো?

তুমি কি হয়ে গিয়েছিলে নূরী? কেন তুমি অমন হয়ে গিয়েছিলে? কেনো এতোদিন তুমি আমায় হুর বলে ডাকোনি?

আমি তো এ সব কিছুই জানিনা। আমি কি ছিলাম তোমার পাশে?

হাঁ নূরী, কিন্তু পাশে থেকেও তুমি ছিলে অনেক দূরে। কোন দিন আমি তোমার নাগাল পাইনি।

বনহুর, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। কিন্তু আমার মনি-মনি কই? ওকে কোথায় রেখেছো? ব্যাকুল কণ্ঠে নূরী বনহুরকে প্রশ্ন করে বসলো।

হঠাৎ নূরীর প্রশ্নের জবাব দিয়ে উঠতে পারলো না বনহুর। কেমন যেন থ মেরে গেলো। একটু চিন্তা করে বললো সে–মনি আছে।

কোথায়? কোথায় সে বলো? বনহুর এবার বিপদে পড়লো, মনি কোথায় সে-ই জানেনা। বেঁচে আছে

মরে গেছে কে জানে। কিন্তু হঠাৎ এখন মনি নেই কথাটা বলা ঠিক হবে না নূরীর কাছে। হয়তো আবার তার মস্তিষ্কে কোন গণ্ডগোল হয়ে যেতে পারে। ভয় হলো বনহুরের, একটু হাসবার চেষ্টা করে বললো–দেখছো না এটা অন্য দেশ? তোমার মনি আস্তানায় আছে।

আনন্দভরা কণ্ঠে বললো নূরী–সত্যি বলছো তো?

হাঁ-হাঁ, নূরী। বনহুর, আমাকে নিয়ে চলো, আর বিলম্ব সইছে না। কখন আমি মনিকে বুকে পাবো। চলো চলো হুর……….

চলো।

বনহুর আর নূরী উঠে দাঁড়ালো।

নূরীর শরীর অত্যন্ত দুর্বল, কাজেই বনহুর নূরী সহ একটি বড় হোটেলে কয়েক দিনের জন্য আশ্রয় গ্রহণ করলো। শহরের সবচেয়ে সেরা এবং উৎকৃষ্ট হোটেল-বনহুর ও নুরীর কোন অসুবিধা হলো না এখানে। নানা রকম ফল-মূল ও ঔষধ-পত্রের ব্যবস্থা করে দিলো বনহুর নূরীর জন্য।

নূরীকে নিয়ে মাঝে মাঝে বনহুর শহর ভ্রমণে বের হতো। কখনও পার্কে বা লেকের ধারে গিয়ে বসতো।

কিন্তু এতো করেও নূরীর মনে বনহু শান্তি আনতে পারলো না। নূরী সব সময় মনির জন্য ব্যস্ত উক্তষ্ঠিত হয়ে রয়েছে। নূরীর মুখের হাসি যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে।

বনহুর আবার নূরীর জন্য চিন্তিত হলো। কোথায় মনি কে জানে আর কি তাকে কোন দিন ফিরে পাবে। অসম্ভব সে আশা–নূরীর জন্য বনহুর বেশ আশঙ্কিত হয়ে পড়লো। এখন মিছেমিছি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে রাখছে–মনি তাদের আস্তানায় আছে, কিন্তু আস্তানায় ফিরে যখন নূরী মনিকে খুঁজে পাবেনা, তখন কি বলবে বনহুর তাকে?

বনহুরও চিন্তিত হয়ে পড়লো, এখানে মিথ্যা বলে নূরীকে ভুলিয়ে রাখলেও কান্দাই পৌঁছে তাকে কিছুতেই মিথ্যা ছলনায় ভুলানো যাবে না।

০৫.

সেদিন হোটেলের ক্যাবিনে নিজের বিছানায় বনহুর আপন মনে চিন্তা করছিলো।

নূরী এসে দাঁড়ালো তার পাশে, বনহুরের চুলের ফাঁকে আংগুল চালাতে চালাতে বললো–হুর, আর আমি থাকতে পারছিনা।

বনহুর একটু হেসে বললো–কেনো?

নূরী এবার বসে পড়লো বনহুরের পাশে–মনিকে না দেখে।

ওঃ এই কথা! আচ্ছা নূরী!

বলো?

মনিকে তুমি বেশি ভালবাসো, না আমাকে?

নূরী গম্ভীর কণ্ঠে বললো–এ প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য?

দেখো নূরী, মনিকে তোমার ছাড়তে হবে, নয় আমাকে……

কি বললে? নূরী যেন আর্তনাদ করে উঠলো।

বনহুর কথাটা বলে ভুল করছে বুঝতে পারলো। তাড়াতাড়ি কথার মোড় ফিরিয়ে নিয়ে বললো–নূরী, তোমার মন বুঝলাম। তুমি কান্দাই পৌঁছেই তোমার মনিকে পাবে।

নূরীর গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো ফোটা ফোটা অশ্রু।

বনহুর ওকে টেনে নিলো কাছে। স্নেহ ভরা কণ্ঠে বললো–নূরী, এতো অল্পে তুমি ভেংগে পড়ো, কই আগে তো এমন ছিলেনা?

বনহুরের প্রশস্ত বুকে মাথা রেখে বললো নূরী-. আর কোন দিন তুমি ওরকম প্রশ্ন আমাকে করোনা।

না, আর করবো না, কথা দিলাম তোমাকে।

নূরীর চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে দিলো বনহুর, বললো–যাও, তৈরি। হয়ে নাও নূরী, আজই আমরা কান্দাই এর পথে রওয়ানা হবো।

খুশিতে নূরীর মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো–সত্যি বলছো?

হুঁ।

নূরী আনন্দে মেতে উঠে, ছুটে চলে যায় সে নিজের কামরায়।

ঝাম শহর থেকে প্লেনযোগে কান্দাই পৌঁছানো যায়। বনহুর প্লেনের দুখানা টিকিট কেটে নিলো। কত দিন পর বনহুর আর নূরী কান্দাই ফিরে চলেছে–কত আনন্দ হবার কথা, কিন্তু বনহুরের মনে পূর্বের সে আনন্দ নেই। নূরীকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়েছে সে–মনিকে কান্দাইয়ে তাদের আস্তানায় গিয়েই দেখতে পাবে। সে সান্ত্বনা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বনহুর ভিতরে ভিতরে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।

মেঘের বুক চিরে প্লেনখানা এগিয়ে চলেছে। পাশ কেটে ভেসে যাচ্ছে পেঁজা তুলার মত খণ্ড খণ্ড মেঘের স্তুপগুলো। বনহুর নিজের আসনে বসে তাকিয়ে ছিলো পাশের শার্শী দিয়ে নীচের দিকে।

খণ্ড খণ্ড মেঘের ফাঁকে পৃথিবীটাকে ঠিক ছবির মতই মনে হচ্ছিলো। ছোটবড় দালান-কোঠা আর নদী-নালাগুলো যেন রূপকথার স্বপ্নপুরীর মতই মনে হচ্ছিলো।

নূরী বসেছিলো বনহুরের পাশে। প্লেনে সে কোনদিন উঠে নি, বিস্ময় জাগছিলো তার মনে। অবাক হয়ে সব দেখছিলো নূরী।

বোয়িং বিমান এটা।

অগণিত যাত্রী নিজ নিজ আসন দখল করে নিয়ে বসে আছে।

বনহুরের সম্মুখ আসনে বসে ছিলে কয়েকজন মহিলা, একটি যুবতিও ছিলো বয়স্ক মহিলাদের মধ্যে। যুবতীর শরীরে আধুনিক আটসাট পোশাক।

যুবতী বার বার বনহুরের দৃষ্টি তার দিকে আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করছিলো।

বনহুরের চোখ দুটো শার্শির ফাঁকে নিবদ্ধ থাকলেও যুবতীর গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। মনে মনে হাসলো বনহুর। যুবতীর কণ্ঠে একটা মূল্যবান লকেট জ্বলজ্বল করছে।

বনহুরের চোখ দুটো ধক করে জ্বলে উঠলো, ঐ মূল্যবান লকেটখানা তার চাই।

প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের কেসটা বের করে একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো বনহুর।

প্লেনখানা তখন মেঘের মধ্য দিয়ে বাম্পিং করে এগোচ্ছিলো।

একটা সমুদ্রের উপর দিয়ে যাচ্ছিলো প্লেনখানা।

বনহুর সিগারেটের ধুম্ররাশির ফাঁকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলো যুবতীটিকে।

যুবতীটিও তাকাচ্ছিলো বার বার বনহুরের দিকে।

দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছিলো বনহুর আর যুবতীর মধ্যে।

যুবতীর হৃদয়ে এক অপলক আনন্দের লহরী দোলা জাগাচ্ছিলো।

এক সময় বোয়িং কান্দাই শহরের আকাশে এসে পৌঁছলো। বনহুর নূরীকে লক্ষ্য করে বললো–কতদিন পর কান্দাইয়ের হাওয়া গ্রহণ করলাম, নুরী।

নূরীর চোখে আনন্দের দ্যুতি ফুটে উঠেছে।

যুবতী বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেই বসলো–আপনি কি কান্দাইয়ে নামবেন?

বনহুর হেসে জবাব দিলো–হাঁ, কান্দাই আমার গন্তব্য স্থান।

যুবতী প্রফুল্ল কণ্ঠে বললো–কান্দাই আমিও নামবো।

যুবতীর গায়ে পড়ে আলাপ ভালো লাগলো না নূরীর। যুবতী পুনরায় বলে উঠলো–ওনি বুঝি আপনার…….

আমার আত্মীয়া।

ওঃ–যুবতীর বুক থেকে একটা জমাট অন্ধকার পরিষ্কার হয়ে গেলো। যুবতী নিজেই বলে উঠলো–গুলবাগ হোটেলের মালিক আমার আব্বা। আসবেন একদিন গুলবাগে, দেখা হবে আমার সঙ্গে।

বনহুর বললো–মহব্বৎ আলী আপনার আব্বা?

হাঁ, ফুলবাগের পাশেই আমাদের বাড়ি।

যুবতী যখন বনহুরের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় রত, তখন মাইকে ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ শোনা গেলো–আপনারা নিজ নিজ আসনে স্থির হয়ে বসুন। এবং বেল্ট বেধে নিন। কান্দাই এরোড্রামে এসে গেছি আমরা।

প্লেনের যাত্রীগণ আসনের সঙ্গে নিজ নিজ বেল্ট বেধে নিলো।

কান্দাই এরোড্রামের উপরে চক্রাকারে উড়ে বেড়াতে লাগলো প্লেনখানা। আশায় আনন্দে উফুল্ল সমস্ত যাত্রীগণ। এক সময় রানওয়েতে প্লেন অবতরণ করলো। এরোড্রামে উনখ জনতা স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে। যার যার আত্মীয়-স্বজন এসেছে তাদের রিসিভ করে নিতে। প্লেন এসে এবোড্রামে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে যাত্রীগণ।

যুবতী বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে দেখা করবেন?

হেসে বললো বনহুর–নিশ্চয়ই।

একসঙ্গে সারিবদ্ধভাবে যাত্রীগণ প্লেন থেকে অবতরণ করছে। যুবতী ইচ্ছা করেই একটু পিছিয়ে পড়লো, বনহুরের পাশে গা ঘেষে সিঁড়ি। বেয়ে নামতে লাগলো।

বনহুর এ সময়টুকুর প্রতীক্ষাতেই ছিলো।

আলগোছে কখন যুবতীর কণ্ঠ থেকে মূল্যবান লকেটখানা বনহুরের পকেটে গিয়ে পৌঁছলো।

বনহুর আর নূরী যুবতীর নিকটে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো এরোড্রাম থেকে।

যুবতী এগিয়ে গেলো তার আত্মীয়-স্বজনের দিকে।

অনেকেই এসেছে যুবতী পারভিনকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে। তার পিতা মহব্বৎ আলীও এসেছেন।

কন্যাকে দেখেই এগিয়ে গেলেন মহব্বৎ আলী–হ্যালো পারভিন, প্লেনে কোন কষ্ট হয়নি তো?

আব্বা, কোন কষ্ট হয়নি।

মহব্বৎ আলী বললেন–তোমার লকেটটা খুলে রেখেছো কেনো মা?

লকেট! অস্ফুট ধবনি করে নিজের গলায় তাকালো পারভিন। সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠলো। আমার পকেট গেলো কোথায়?

এখানে যখন মহব্বৎ আলী এবং পারভিন লকেট খোজা নিয়ে তোলপাড় শুরু করলো, বনহুর আর নূরী তখন ট্যাক্সিতে চেপে বসেছে।

কান্দাই এর একটা হোটেলে গিয়ে উঠলো বনহুর ও নুরী।

বনহুর জানে, দিনের আলোতে কান্দাই শহরে সে নিরাপদ নয়।

কান্দাই এর পুলিশ মহলের অনেকেই দস্যু বনহুরের আসল রূপ দেখেছেন। তারা অতি সহজেই বনহুরকে চিনে নিতে পারবেন।

রাতের অন্ধকারে নূরীকে আস্তানায় নিয়ে যেতে হবে।

নূরী কিন্তু অস্থির হয়ে পড়লো, মনিকে দেখার জন্য ভীষণ ভাবে ছটফট করতে লাগলো।

বনহুর কান্দাই পৌঁছে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলো না। আস্তানায় গিয়ে কি জবাব দেবে নূরীকে যখন নূরী তার মনিকে চাইবে?

০৫.

কান্দাই শহরে সাড়া পড়ে গেছে–মতি মহল সিনেমা হলে আজ মহা সমারোহে মুক্তিলাভ করবে নতুন ছবি কুন্তিবাঈ। দেয়ালে দেয়ালে, দোকান-পাটে, গাড়িতে কুন্তিবাঈ ছবির পোষ্টার লাগানো হয়েছে।

বছরের সেরা ছবি কুন্তি বাঈ।

ছবি এসেছে দূর দেশ থেকে শুধু কান্দাই শহরেই নয়, আরও কয়েকটি শহরেও এক সঙ্গে মুক্তি লাভ করছে ছবিটা।

সেদিন মনিরা নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলো, অদূরে একটা ছোট্ট গাড়ি নিয়ে খেলা করছিলো নূর।

এমন সময় নকিব কক্ষে প্রবেশ করে–আপামনি!

ই থেকে চোখ না তুলেই বলে মনিরা কিছু বলবি?

নকিবের হাতে একটা বিজ্ঞপ্তি, বলল নকিব–আপামনি, দেখুন মতি মহল ছবিঘরে নতুন একটা ছবি এসেছে। শুনলাম, ছবিটা নাকি খুব ভাল। নায়কটা কিন্তু ঠিক আমাদের দাদা মনির মত।

কথাটা শুনে মনিরা চোখ তুলে তাকালো নকিবের দিকে।

নকিব এগিয়ে গিয়ে বিজ্ঞপ্তিটা তুলে দিলো মনিরার হাতে–সত্য করে

বলছি আপামনি, দেখুন নিজের চোখে।

মনিরা নকিবের হাত থেকে বিজ্ঞপ্তি নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সামনে। পাশা-পাশি দুখানা মুখ হিরো আর হিরোইনের। একি? এ যে তার স্বামীর চেহারা! না না, ভুল নেই–ঠিক সেই নাক-মুখ সব। মনিরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে বিজ্ঞপ্তিখানার দিকে।

নকিব মনিরার মনোভার বুঝতে পেরে বললো–তাইতো আমি বিজ্ঞপ্তিটা পথের একটা ছেলের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এলাম।

মনিরার চোখের সম্মুখে তখন স্বামীর মুখখানা ভাসছে। অনেক দিন স্বামীর কোন সন্ধান না পেয়ে মুষড়ে পড়েছিলো মনিরা। আজ আবার নতুন করে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো স্বামীর স্মৃতি।

মনিরা বই রেখে বিজ্ঞপ্তি হাতে উঠে দাঁড়ালো, কি যেন চিন্তা করে বললো নকিব, সরকার সাহেবকে পাঠিয়ে দে। আমি মামীমার ঘরে রয়েছি।

নকিব চলে গেলো, মনিরা বিজ্ঞপ্তিটা আবার মেলে ধরলো চোখের সামনে, নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মানুষের মত কত মানুষ আছে, কিন্তু তার মন এমন করছে কেনো! মামীমাকে এ বিজ্ঞপ্তি দেখাবে না–বলবে না এ সম্বন্ধে কোন কথা। ছবি দেখতে নিয়ে যাবে তাকে, হাজার হলেও মা আর সন্তান। যদি সত্যিই সে হয়, তাহলে মায়ের চোখে ধরা না পড়ে যাবে না। যত লোকেরই ভুল হোক, মায়ের কোন দিন ভুল হবে না সন্তানকে চিনতে।

মনিরাকে একটা কাগজ তন্ময় হয়ে দেখতে দেখে গাড়ি রেখে ছুটে এলো নূর, বললো–আম্মা, কি দেখছো অমন করে?

 কিছু না বাবা, কিছু না। তাড়াতাড়ি বিজ্ঞপ্তিটা লুকিয়ে ফেললো মনিরা জামার ফাঁকে। তারপর নূরকে কোলে তুলে নিয়ে বললো মনিরা–বাপু, ছবি দেখতে যাবে? সিনেমা?

ইতিপূর্বে একদিন মনিরা নূরকে নিয়ে মতি মহল হলে ছবি দেখতে গিয়েছিলো। নূর তাই কিছুটা পরিচিত হলো সিনেমা সম্বন্ধে। বললো নূরদাবো আম্মা। আমি দাবো, সত্য নিয়ে দাবে তো আমাকে?

হাঁ বাবা, নিয়ে যাবো।

তারপর নূরকে কোলে করে মামীমার কক্ষে প্রবেশ করলো মনিরা।

মামীমা কোন একটা কিছু করছিলেন মনিরাকে দেখামাত্র সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন–কি দাদু, খুব যে। মায়ের কোলে চাপা হয়েছে। বলি ব্যাপার কি?

মনিরা নূরকে লক্ষ্য করে বললো–বলোনা বাবা, তুমি কি বলবে তোমার দাদীমাকে?

এগিয়ে এলেন মরিয়ম বেগম, নূরের গাল টিপে দিয়ে বললেন–বলো দাদু? বলো?

নূর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো–দাদীমা, আজ আমলা ছবি দেখতে যাবো।

ছবি!

মনিরা বললো এবার মামীমা, নূর সখ করেছে, আজ নাকি সে ছবি দেখতে যাবে!

বেশ তো, সরকার সাহেবকে বলো, নিয়ে দাবেন উনি।

মামীমা।

বলো মা?

মতি মহল হলে সুন্দর একটা নাকি ছবি হচ্ছে, নতুন ছবি।

তাই নাকি? নতুন ছবি? যাও, মা-ছেলে দেখে এসো গে। নকিবকে বলে, সবার সাহেবকে ডেকে দেবে খন।

এমন সময় সরকার সাহেব প্রবেশ করলেন কক্ষ মধ্যে–আমাকে ডেকেছেন?

মরিয়ম বেগম বললেন–সরকার সাহেব, মতি মহল হলে নাকি নতুন ছবি এসেছে?

জি হ্যাঁ। বললেন সরকার সাহেব।

বললেন মরিয়ম বেগম–মনিরা ও নূর ছবি দেখতে যাবে, ওদের নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে।

মনিরা বলে উঠে–মামীমা, তোমাকেও যেতে হবে। মান হাসলেন মরিয়ম বেগম–আমার ও সব সখ মিটে গেছে মা, তোমরা যাও।

মনিরা পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো–আজ নূর তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবেনা। নূর, সত্যি বলো তো, তোমার দাদীমাকে ছাড়া তুমি ছবি দেখতে যাবে?

মাথা দোলালো নূর–দাদীমা, আজ তোমাকে দেতে হবে। তুমি না দেলে আমি দাবোনা।

শুনলে মামীমা, শুনলে তো?

পাগলা দাদু, আমি বুঝি ছবি দেখতে যাবো?

কোনো দাবেনা দাদীমা? আমি তোমাকে ধলে নিয়ে দাবো। কথাটা বলে নূর মায়ের কোল থেকে নেমে মরিয়ম বেগমের হাত ধরে টানাটানি শুরু করলো।

সরকার সাহেব হেসে বললেন–আজ নূর আপনাকে না নিয়ে গিয়ে ছাড়বে না বেগম সাহেবা।

মরিয়ম বেগম হাসতে লাগলেন।

মনিরা বললো–চলুন না মামীমা, নূর যখন সখ করেছে!

শেষ পর্যন্ত মরিয়ম বেগম মনিরা ও নূরের সঙ্গে ছবি দেখতে যাওয়ার। জন্য রাজি হলেন।

০৬.

অগণিত জনতায় মতিমহল হলের সম্মুখভাগ ভরে উঠেছে। পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত মোটর গাড়ি। নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীর অসংখ্য ভীড়।

শো শুরু হবার আর বেশি বিলম্ব নেই।

মতিমহল হলে আজ প্রথম শুভমুক্তি কুন্তি বাঈ-হল ফুল। বক্সের আসনে বসে আছে মরিয়ম বেগম আর মনিরা। সরকার সাহেব অদূরে নূরকে কোলে করে বসে আছেন, ফিস ফিস করে কথা বলছেন তিনি তার সঙ্গে।

মরিয়ম বেগম অনেক দিন হতে সিনেমা দেখেন না, কাজেই তিনি অস্বস্তি বোধ করছিলেন।

মনিরা উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলো। ছবি দেখা তার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য তার ছবির নায়ককে দেখবে–সত্যই অন্য কেহ না, তার স্বামী দুস্য বনহুর।

পাশের আসনে এক যুবতী বসেছিলো।

মরিয়ম বেগম যুবতীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন, কারণ শো শুরু হবার এখনও কয়েক মিনিট বাকি।

বললেন মরিয়ম বেগম–তোমার বাড়ি কোথায় মা?

যুবতী অন্য কেহ নয়, গুলবাগ হোটেলের মালিকের কন্যা মিস পারভিন; যার লকেট এখন বনহুরের পকেটে।

তার বহু মূল্যবান লকেট খানা হারিয়ে যাওয়ায় যদিও মন মোটেই ভাল নয়, তবু নতুন ছবি দেখবার সখ দমিয়ে রাখতে পারেনি সে। এসেছে মা ও বোনের সঙ্গে।

মা ও বোন এক পাশে বসেছিলো, পারভিন কয়েকটা সিট সরে এসে বসেছে, এখান থেকে ছবি নাকি তার চোখে ভাল লাগে।

কথায় কথায় অনেক কথা বললো পারভিন, তার লকেট হারিয়ে যাওয়ার কথাও বললো সে মরিয়ম বেগম ও মনিরার কাছে।

শো শুরু হলো।

টাইটেল দেখানো হচ্ছে।

মরিয়ম বেগম অনিচ্ছা সত্বেও তাকিয়ে আছেন পর্দার দিকে। মনিরা পর পর চরিত্র ও নামগুলো পড়ে যাচ্ছিলো।

আতিয়া ফ্লিমের দ্বিতীয় অবদান কুন্তি বাঈ, প্রযোজক আরফান উল্লাহ, পরিচালক…………

মনিরা দ্রুত চরিত্র ও নামগুলো পড়ে যাচ্ছিলো।

আতিয়া ফ্লিমের দ্বিতীয় অবদান কুন্তি বাঈ। প্রযোজক আরফান-উল্লাহ। পরিচালক নাহার চৌধুরী। শ্রেষ্ঠাংশেঃ জ্যোছনা রায় ও মকছুদ চৌধুরী………

মনিরার কণ্ঠ দিয়ে অস্ফুট শব্দ বের হলো–মকছুদ চৌধুরী….

পাশের চেয়ার থেকে পারভিন বলে উঠলো–নতুন কোন নায়ক হবে।

মনিরা কোন জবাব দিলো না।

শো শুরু হলো।

কয়েকটা দৃশ্যের পরই ছবির হিরোর আবির্ভাব হলো।

সঙ্গে সঙ্গে মনিরা স্তব্ধ হয়ে গেলো–না না, তার মন যা বলেছিলো সেই সত্য। মকছুদ চৌধুরী নয়তার স্বামী বনহুর।

মরিয়ম বেগম কি বলেন শোনার জন্যে উন্মুখ হৃদয় নিয়ে প্রতীক্ষা করে মনিরা। পর্দায় তাকিয়ে থাকলেও মন তার পড়ে রইলো মামীমার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য।

মরিয়ম বেগম বললেন–একি, আমি কি চোখে ধাঁ ধাঁ দেখছি? মনিরা, কি দেখছিস মা?

মামীমা, তুমি যা দেখছো তাই দেখছি।

এযে আমার মনির ছাড়া কেউ নয়। সরকার সাহেবকে লক্ষ্য করে ডাকলেন এখানে আসুন তো!

মরিয়ম বেগম আর মনিরার কথাবার্তায় বিরক্ত বোধ করছিল পারভিন। সেও কম আশ্চর্য হয়নি, এই যুবকই আজ সকালে তাদের প্লেনে কান্দাই এলেন। নিশ্চয়ই তিনি কুন্তি বাঈ ছবির হিরো। পারভিন স্বচক্ষে এই হিরোকে দেখেছে, এমন কি তার সঙ্গে আলাপ আলোচনাও করেছে সে। পারভিন ভুলে গেলো তার লকেটের শোক। কৃন্তি বাঈ ছবির হিরোর সঙ্গে তার প্রকাশ্য আলাপ হয়েছে–এ কম কথা নয়। মনিরাকে লক্ষ্য করে গর্ব করে বললো–আজই আমি কুন্তি বাঈ ছবির হিরো মকছুদ চৌধুরীর সঙ্গে একই প্লেনে এলাম।

কথাটা কানে যেতে মনিরা ছবি দেখা বন্ধ করে তাকালো পারভিনের মুখের দিকে মকছুদ চৌধুরীকে আপনি চেনেন?

হাঁ, তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। আজই তিনি তার এক বান্ধবী সহ কান্দাই এসে পৌঁছেছেন।

সত্যি! মনিরা পারভিনের হাত মুঠোয় চেপে ধরলো।

পারভিন মনিরার ব্যাকুলতা লক্ষ্য করে বিস্মিত হলো। এ এমন করছে কেন? মকছুদ চৌধুরীর অপরূপ রূপ একে একবারে উন্মুক্ত করে তুলছে। কিছুটা রাগও হলো পারভিনের, ছবি দেখায় অসুবিধা হচ্ছে, কাজেই পারভিন উঠে চলে গেলো, যেখানে বসে ছবি দেখছিলো তার মা আর বোন।

মরিয়ম বেগম তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে আছে পর্দার দিকে। দুচোখে তার অপলক চাহনী। নিশ্বাস পড়ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। বিড় বিড় করে হঠাৎ বলে উঠেন–আমার মনির ছাড়া ও কেউ নয়। মকছুদ চৌধুরী ও নয়। আমার মনির… দেখছোনা সেই?

সরকার সাহেব চশমাটা খুলে মুছে নিয়ে আবার বললেন–তাই তো মনে হচ্ছে বেগম সাহেবা!

মনিরা কিন্তু নিশ্চুপ স্থির হয়ে পর্দায় তাকিয়ে আছে। বেঁচে আছে, সুখে আছে, দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে চিত্রনায়ক হয়েছে আর এক বারও মনে পড়ছে তার কথা। কোথায় মা, কোথায় মনিরা আর কোথায় নূর। পুরুষ জাতটাই কি হৃদয়হীন!

ক্রমেই মনিরার অন্তর অভিমানে ভরে উঠে।

নায়িকার সঙ্গে স্বামীর এই ঘনিষ্ঠতা মনিরার হৃদয়ে একটা তীব্র জ্বালা ধরিয়ে দিলো। অসহ্য-অসহ্য এ দৃশ্য। বাসর কক্ষের দৃশ্যে মনিরা দুহাতে চোখ ঢেকে ফেললো, না না, এসব সে নিজ চোখে দেখতে পারবে না। উঠে দাঁড়ালো মনিরা, নূরকে সরকার সাহেবের কোল থেকে টেনে নিয়ে বললোচলো মামীমা, আর দেখবো না।

মরিয়ম বেগম তার হারানো ধন ফিরে পেয়েছেন, তিনি হাঁ করে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখছেন আর বিড় বিড় করে বলছেন–আমার মনির বেঁচে আছে। আমি আগেই বলেছিলাম–সে আবার ফিরে আসবে।

মনিরা উঠে দাঁড়াতেই বললেন মরিয়ম বেগম–চলে যাচ্ছিস মা?

হাঁ, চলো মামীমা, ভাল লাগছে না।

মরিয়ম বেগম বললেন–আর একটু বস্ মা, ওকে দেখতে দে। প্রাণভরে একটু দেখতে…….

অগত্যা মনিরা বসতে বাধ্য হলো।

ইচ্ছে করেই মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো মনিরা। কিন্তু বেশিক্ষণ মুখ ফিরে থাকতে পারলো না সে। বহুদিন পর স্বামীকে দেখার লোভটুকু সংযত রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ালো।

ছবি শেষ হলে হল থেকে বেরিয়ে এলো তারা।

মরিয়ম বেগমের চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। তিনি গাড়িতে বসে বললেন–আমার মনির বেঁচে আছে, খোদার কাছে আমি লাখো শুকরিয়া করছি।

মনিরা কোন কথা বললো না, নিশ্চুপ বসে রইলো স্থবিবের মত গাড়ির এক পাশে।

নূর তখন সরকার সাহেবকে একটির পর একটি প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে।

বাড়ি ফিরে মরিয়ম বেগম শোকরানার নামায আদায় করলেন। চাকরবাকরদের ডেকে বললেন–ওরে তোরা শুনছিস–আমার মনির বেঁচে আছে। ভাল আছে সে। হাঁ, ভালই আছে, যেখানেই থাক সে, ভাল আছে।

মনিরা যে খুশি হয়নি তা নয়, স্বামী বেঁচে আছে, সুস্থ আছে–এতে কি তার আনন্দ নয়? অন্তরে আনন্দের হিল্লোল বইলেও মুখে তা প্রকাশ পেলোনা। একটা অভিমান দানা বেধে উঠলো তার মনের গহনে। তার স্বামী সুস্থ্য থেকেই তাকে ভুলে আছে, আজ দুবছর হলো একটি দিনের জন্যও কি মনে পড়েনি একবার তাকে। পুরুষ-প্রাণ ঐ রকমই পাষাণ হয়।

নূরু ঘুমিয়ে পড়েছে কখন–পাশের ঘরে ঘুমিয়েছেন মরিয়ম বেগম। গোটী চৌধুরী বাড়ি ঝিমিয়ে পড়েছে। একটি প্রাণীও জেগে নেই।

শুধু চৌধুরী বাড়িই নয়, সমস্ত শহর সুপ্তর কোলে ঢলে পড়েছে। মাঝে মাঝে দুএকটা প্রাইভেট মোটর-কার এদিক থেকে ওদিকে চলে যাবার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো।

মনিরা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছিলো, কিছুতেই ঘুম আসছিলো না তার চোখে।

এ কি হলো! এমন তো কোন দিন হয়নি, আজ এতো অস্থির লাগছে। কেনো। সেই যে ছবি দেখে আসার পর একটি বারের জন্য তার চোখের সম্মুখ হতে মুছে যায়নি স্বামীর মুখখানা। সেই পৌরুষ ভরা কণ্ঠস্বর। সেই দীপ্ত সুন্দর নীল চোখ দুটি। সেই কুঞ্চিত কেশ রাশি। প্রশস্ত ললাট, বলিষ্ঠ বাহু, মিষ্টি হাসি, সব যেন আজ আবার বেশি করে মনটাকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। কিছুতেই নিজকে সংযত রাখতে পারছে না, স্বামীর বুকে মুখ রাখবার জন্য আকুল হয়ে উঠলো মনিরার প্রাণ।

নূরের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে বসে রইলো।

রাত বেড়ে আসছে।

দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে কুকুরের গলার আওয়াজ।

মনিরা নিদ্রাহীন চোখে ঠিক তেমনি করে বসে আছে। যেমন সে বসেছিলো নূরের শিয়রে।

আলোটা ডিম করা ছিলো। মনিরা ভাবছিলো, তার স্বামী যার সঙ্গে অভিনয় করলো কে সে মেয়ে, কে সে জ্যোছনা রায়। সত্যি কি তার স্বামীর সঙ্গে জ্যোছনা রায়ের কোন সম্বন্ধ ঘটেছে। হয়তো তাই হবে নইলে এতোদিন কি করে সে ভুলে থাকতে পারে তাকে, আর স্নেহময়ী জননীকে।

মনিরার গণ্ড রেখে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা।

ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন শার্শি খুলে গেলো আচম্বিতে।

মনিরা চমকে উঠলো, মশারীর বাইরে বেরিয়ে এলো, সে ভয় বিহ্বল চোখে তাকালো শার্শির দিকে।

পর মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। সমস্ত শরীরে জমকালো ড্রেস। মুখে কালো রুমাল বাধা। দক্ষিণ হস্তে রিভলভার।

বনহুরকে দেখেই মনিরার চোখ দুটো ক্ষণিকের জন্য আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়লো সে তার বুকে। অস্ফুট কণ্ঠে বললোএসেছো?

বনহুর নিজের মুখের রুমাল খুলে ফেললো, গভীর আবেগে মনিরাকে বুকের মধ্যে নিবিড়ভাবে চেপে ধরে বললো–এসেছি। মনিরা কেমন ছিলে?

মনিরা ভুলে গিয়েছিলো অভিমান, ভুলে গিয়েছিলো কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো। স্বামীর প্রথম দর্শনে সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছিলো সে।

এবার মনিরার মনে উঁকি দেয় রাগ, ক্ষোভ আর অভিমান। স্বামীর বাহুবন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে মনিরা। কেনো এলে তুমি!

বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে উঠে বনহুর–সেকি মনিরা?

হাঁ, না এলেই খুশি হতাম বেশি। মনিরা!

ব্যাকুল কণ্ঠে বললো বনহুর।

মনিরার অভিমান মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ভীষণভাবে। এতোদিনের স্বামীর বিরহ-বেদনা আজ একযোগে ধাক্কা মারলো তার বুকে। কঠিন গলায় বললো–আমি বেশ ছিলাম, আবার কেনো আমাকে বিরক্ত করতে এলে বলো তো?

মনিরা, এ তুমি কি বলছে?

না, না, তুমি চলে যাও, আমি চাইনা তোমাকে।

বনহুরের মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠেছে। কত আশা আর আকাখা নিয়ে সে আজ হোটেল থেকে রাতের অন্ধকারে চলে এসেছে। এখনও সে আস্তানায় গিয়ে পৌঁছে নাই। নূরীকে হোটেলে রেখে সে এই রাতের প্রতীক্ষায় ছিলো। সব বাসনা মুহূর্তে ধুলিস্মাৎ হয়ে গেলো।

বনহুর টেবিলের পাশে চেয়ারটায় ধপ করে বসে পড়লো। দু হাতে মাথার চুলগুলো টেনে ছিড়তে লাগলো সে। অধর দংশন করতে লাগলো।

মনিরা নিশ্চল পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বনহুরের অন্তরের দাহ মনিরার হৃদয়ে যে আঘাত করছেনা, তা নয়। তার মনটাও ব্যথায় গুমড়ে কেঁদে উঠছে। কতদিন পর স্বামীকে পেয়েও সে যেন পাচ্ছে না, কোথায় যেন বাধা।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো, টেবিল থেকে রিভলভারটা হাতে তুলে নিয়ে বললো–বেশ, আর আসবোনা।

মনিরার অন্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু একটা দারুণ অভিমান তাকে যেন সংজ্ঞাহারা করে ফেলেছিলো। স্বামী চলে যাচ্ছে, তবু এক পাও এগুতে পারছে না।

বনহুর যেমন এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো মনিরার কক্ষ থেকে।

বনহুর বেরিয়ে যেতেই মনিরা ছুটে গিয়ে ঘুমন্ত নূর কে বুকে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেনো সে এমন ভুল করলো, কেনো সে স্বামীকে অমন বিমুখ করে ফিরিয়ে দিলো। কেনো বলতে পারলো না মনের গোপন কথা। সে তো কিছুই জানলোনা বা বুঝতে পারলোনা। মনিরা যা বললো সে তার মনের কথা নয়। সে ভুল বুঝলো তাকে, হয়তো আর কোন দিন সে আসবেনা। একি করলো মনিরা, কত আরাধনার পর তবেই না তাকে ফিরে পেয়েছিলো। কেনো সে এমন কাজ করলো। ব্যথা-বেদনায় ভেংগে পড়লো মনিরা।

০৭.

মনিরার নিকট থেকে বিমুখ হয়ে ফিরে চললো বনহুর। বহুদিন পর কত আশা আকাংখা আর বাসনা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলো সে মনিরার পাশে। মনিরা আজ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে–ভাবতেও পারেনি সে।

মনিরাকে একটু দেখবার জন্য কতদিন ধরে মন তার অস্থির হয়ে পড়েছিলো। মনিরার বিরহ-বেদনা তাকে অহঃরহঃ উদ্বিগ্ন করে রাখতো, আর আজ সেই মনিরা তাকে …….না, না, মনিরা তো এমন ছিলনা কোনদিন। আজ সে এতোদিন পর তাকে কাছে পেয়েও এতোটুকু খুশি হলো না। কেনো, কেনো মনিরা এমন হলো…

বনহুর আপন মনে পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ তার কানে এলো কোন এক করুণ কণ্ঠের বিলাপ ধ্বনি।

–মায় ভূখা হু, খোদা কে ওয়াস্তে মুঝে কুছ খানা দো–মায় ভূখা ই–

থমকে দাঁড়ালা, বনহুর, কান পেতে শুনলো শব্দটা কোন্ দিক থেকে আসছে।

তখনও করুণ আর্তকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে–খোদা কে ওয়াস্তে মুঝে কুছ খানা দো।

বনহুর অন্ধকারে এগিয়ে গেলো, দেখতে পেলো–অদূরে ফুটপাতে এক বৃদ্ধ বসে বসে ধুকছে, আর বিলাপ করছে।

বনহুর বৃদ্ধের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, পকেটে হাত দিয়ে বিমর্ষ হলোপকেট শূন্য। দ্বিতীয় পকেটে হাত দিতেই হাতে উঠে এলে সেই লকেটখানা, যে লকেটখানা বনহুর কৌশলে পারভীনের কণ্ঠ থেকে আত্মসাৎ করেছিলো।

বনহুর বেশি কিছু চিন্তা করবার অবসর পেলো না, লকেটটা খুঁজে দিলো বৃদ্ধের হাতের মুঠায়।

দুহাত তুলে বৃদ্ধ দোয়া জানাতে লাগলো।

বনহুর তখন নিজের গন্তব্য পথে পা বাড়িয়েছে।

০৮.

হোটেল কক্ষে প্রবেশ করে এগিয়ে গেলো শয্যার দিকে। চমকে উঠলো বনহুর নূরী তার বিছানায় শায়িত। শিয়রের টেবিলে ডিম লাইট জ্বলছে।

বনহুর নূরীর ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।–মনিরার মুখখানা ভেসে উঠলো তার চোখের সম্মুখে। নূরীর মুখ মুছে গেলো ধীরে ধীরে।

বনহুর নূরীর পাশে বসে হাত রাখলো নূরীর হাতে।

চমকে জেগে উঠলে নূরী, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে চোখ রগড়ে বললো নূরী–হুর, কখন এলে?

নুরী জেগে উঠতেই বনহুর উঠে দাঁড়িয়ে ছিলো, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে বললো–এখনই এলাম।

কোথায় গিয়েছিলে?

বনহুর কোন জবাব না দিয়ে ওদিকের খোলা জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।

নূরী শয্যা ত্যাগ করে উঠে আসে বনহুরের পাশে–ও ঘরে আমার বড়। ভয় করছিলো।

বেশ, তুমি এ কক্ষেই শোও।

আর তুমি?

আমার ঘুমের কোন প্রয়োজন হবে না।

সেকি হুর?

নূরী! বনহুর নূরীকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নিলো। কিন্তু মুহূর্তে নূরীকে সরিয়ে দিয়ে বললো বনহুর–তুমি শুয়ে পড় নূরী, আমি মেঝেতে শুচ্ছি।

বনহুর একটা চাদর আর বালিশ নিয়ে হোটেল কক্ষের মেঝেতে শুয়ে পড়লো

নূরী দাঁড়িয়ে রইলো স্তব্ধ হয়ে।

বনহুর পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে বললো–রাত বেশি নেই। খুব ভোরে আমরা আস্তানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো। একটু ঘুমিয়ে নাও।

নূরী বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

০৯.

বনহুর যখন আস্তানায় পৌঁছলো তখন তার অনুচরগণের মধ্যে একটা আনন্দমুখর সাড়া পড়ে গেলো। সর্দারকে ফিরে পেয়েছেএ যেন তাদের রাজ্যজয়ের আনন্দ। সর্দার তাদের শুধু মনিব নয়, পরম আপন জনের চেয়েও অধিক।

সমস্ত আস্তানাটা ঝিমিয়ে পড়েছিলো যেন। কারো মনে ছিলোনা এতটুকু খুশি। সবাই খেতো–ঘুমাতো-বেড়াতো। দরকার মত দস্যুতা করতেও বের হতো কিন্তু তবু যেন কারো মনে শান্তি ছিলোনা।

রহমান তাদের পরিচালনা করতো বটে, তা হলেও সর্দারের অভাব সকলের মনে একটা হাহাকার জাগাতো। কি যেন ছিলো, কি যেন নেইএমনি লাগতো সকলের। যদিও অনুচরগণ দস্যু বনহুরকে ভয় করতো ভীষণ ভাবে, তবুও শ্রদ্ধা করতো অনেক।

বিশেষ করে অশ্ব তাজকে নিয়ে আস্তানার সকলের মনে একটা দুঃশ্চিন্তার ঝড় বয়ে চলেছিলো।

তাজের শরীর দিনদিন ক্ষীণ হয়ে পড়ছিলো। প্রভুর অন্তর্ধানে পশু হলেও তাজ মানুষের মত ব্যথায় মুষড়ে পড়েছিলো। বনহুর যেবার কারাগারে বন্দী হয়েছিলো সেবারও তাজকে নিয়ে বনহুরের অনুচরগণ বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো।

বনহুরের অনুপস্থিতিতে. তাজ কিছুই খেতোনা, সব সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতো, কার যেন প্রতীক্ষায় সর্বক্ষণ উন্মুখ থাকতো। রহমান নিজে জোর করে তাজের মুখে তুলে ভোলা আর ধান খাইয়ে দিতো। পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতো। গা ঘেষে দিত।

আজ বনহুরকে পেয়ে তাজ যেন আনন্দে আপ্লুত হলো। মুখ মাথা ঘষতে লাগলো সে বনহুরের শরীরের সঙ্গে। শুকতে লাগলো নাক দিয়ে বনহুরের গোটা শরীর। সম্মুখের পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলো তাজ।

বনহুরও তাজের মনোভাব বুঝতে পারলো–পিঠ ঘাড় নেড়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগলো।

তাজ যে সম্মুখের পা মাটিতে আঘাত করে প্রভুকে পিঠে উঠার জন্য ইংগিত করছে, বুঝতে পারলো বনহুর।

বনহুর যখন তাজকে আদর করছিলো তখন বনহুর দাঁড়িয়ে ছিলো তার পাশে। অদূরে দাঁড়িয়ে বনহুরের আদেশের প্রতিক্ষা করছিলো আরও কয়েকজন অনুচর। আজ সকলের মুখমণ্ডলই আনন্দোজ্জ্বল।

শুধু আস্তানা আর অনুচরগণের মনেই খুশির জোয়ার বয়ে চলেনি, সমস্ত বনভূমি যেন আনন্দে আপ্লুত হয়ে উঠেছে। বসন্ত ফিরে এলে বসুন্ধরা যেমন নতুন রূপ ধারণ করো তেমনি বনহুরের আগমনে গাছের শাখায় শাখায় দোলা জাগলো, ফুল ফুটলো, বাতাস বইলো, ডালে ডালে পাখি গান গাইলো।

বনহুরের মনেও যে খুশির দোলা লাগেনি তা নয়। বহুদিন তার পর তার মনে এক অফুরন্ত আনন্দ দ্যুতি খেলে যাচ্ছিলো, কিন্তু এতো খুশির মধ্যেও বনহুর সম্পূর্ণ তৃপ্তি অনুভব করছিলো না। মনিরার কঠিন বাক্যগুলো তার হৃদয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানছিলো। যতই সে ভুলে যাবার চেষ্টা করছিলো, ততই আরও বেশি করে মনে হচ্ছিলো মনিরার মুখখানা। এদিকে নূরীকে নিয়ে আর একটা বিভ্রাট শুরু হলো। আস্তানায় পৌঁছেই আমার মনি কই, মনি কই বলে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো।

বনহুর আস্তানায় পৌঁছেই রহমানকে বলে দিয়েছিলো, তারা যেন নূরীকে বলে–তার মনি আছে, এক ধাত্রীর কাছে তাকে লালন-পালনের জন্যে দেওয়া হয়েছে। এবার ফিরিয়ে আনা হবে।

বনহুর এক সময় রহমানকে নিকটে ডেকে নিয়ে নিভৃতে সব কথাই বললো। চলে যাবার পর থেকে তার জীবনে কি ঘটেছে সমস্তই বললো সে রহমানের কাছে। নূরীর হারিয়ে যাওয়া এবং তাকে উদ্ধার করা কোন কথাই বাদ দিলো না। তারপর নূরী কি ভাবে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ছিলো, কিভাবে তার জ্ঞান লাভ হলো, বললো বনহুর। অনুচরদের মধ্যে সে রহমানকে সব চেয়ে বিশ্বাস করতো এবং মনের কথা সব বলতো তার কাছে।

রহমানের মুখে বনহুর শুনলো মনিরার সংবাদ।

ছদ্মবেশে রহমান প্রায়ই শহরে গিয়ে মনিরার সন্ধান নিতো, মনিরা সর্দারের জন্য কত চিন্তিত-ব্যথিত, জানতো সে। মনিরার মুখে রহমান কোনদিন হাসি দেখে নি, যেদিনই সে তাকে দেখেছে অশ্রু ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি।

রহমান সব খোলসা করে বললো সর্দারের নিকট।

রহমানের কথা শুনে হেসে বললো বনহুর রহমান, তুমি যা বললে, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে আমার মনে হচ্ছে।

রহমান মনিবের মুখে এমন উক্তি শুনবে আশা করেনি, বললো সে-সর্দার, আপনার সম্মুখে মিথ্যা বলার দুঃসাহস আমার নেই।

বনহুর ললাট কুঞ্চিত করে বললো–বৌ রাণীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে রহমান। আমি গত রাতে তার নিকটে গিয়েছিলাম।

রহমানের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উন্মুখ হৃদয় নিয়ে পরবর্তী কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে।

বনহুর বসেছিলো, উঠে দাঁড়ালো, নিজের চুলের মধ্যে আংগুল চালাতে চালাতে বললো–তার কাছে যে ব্যবহার আমি কাল পেয়েছি, বলবার নয়।

সর্দার! অস্ফুট কষ্ঠে প্রতিধ্বনি করে উঠলো রহমান।

বনহুর কিছুক্ষণ আপন মনে পায়চারী করতে লাগলো। মুখভাব গম্ভীর।

রহমান নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে।

হঠাৎ পায়চারী বন্ধ করে থমকে দাঁড়িয়ে বললো বনহুর রহমান!

সর্দার!

রহমান, বিয়ে আমি করিনি, আমার মায়ের আদেশ পালন করেছি মাত্র…

সর্দার!

ওখানে আর কোন দিন তুমি যাবে না রহমান, আমার আদেশ।

সর্দার আপনি ভুল করছেন। বৌ-রাণীর উপর আপনি অযথা রাগ করছেন। সর্দার, বৌ-রাণীই শুধু নেই সেখানে, সেখানে রয়েছে আপনার সন্তান,…

বনহুর রাগত কণ্ঠে গর্জে উঠলো–আমার সন্তান?

হাঁ, বৌ রাণী নূরকে খুজে পেয়েছে।

নূর!

সর্দার, নূর আপনার সন্তানের নাম। ভুলে গিয়েছেন আপনি?

ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকালো বনহুর রহমানের মুখের দিকে।

রহমান অন্যদিন হলে ভড়কে যেতো, আজ এতটুকু বিচলিত হলো না, গলায় জোর দিয়ে বললো–সর্দার, নূর–সে যে আপনারই প্রতিচ্ছবি। নূরের মধ্যে আমরা খুঁজে পেয়েছি আপনাকে! সর্দার বৌ-রাণীর প্রতি আপনি বিমুখ হবেন না।

০৯.

রহমান দস্যু হলেও তার মন উন্নত ছিলো এবং জ্ঞান গরিমাতেও সে কম ছিলো না। বনহুরকে নানা ভাবে বুঝাতে লাগলো রহমান।

বনহুর যখনই একা বসে বিশ্রাম করতো তখনই পাশে গিয়ে দাঁড়াতে রহমান-সর্দার!

বনহুর মনের চঞ্চলতাকে গোপন করবার জন্য মুখভাব স্বাভাবিক করে বলতে–কে রহমান?

হাঁ সর্দার?

কি খবর বলো?

সর্দার, আপনি বৌ-রাণীকে…

বৌ-রাণী–বৌরাণী তোমাকে বলেছি, ও নাম আমার সম্মুখে আর মুখে আনবে না।

সর্দার, আমি জানি বৌ-রাণীকে আপনি ভুল বুঝছেন। বৌ রাণীকে আজও আপনি চিনতে পারেননি।

বনহুর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে আমার চেয়ে তোমরাই তাকে বেশি চেনেনা বলতে চাও?

সর্দার, কিন্তু বলছিলাম যে বৌ-রাণীর উপর আপনি অযথা রাগ করেছেন। তিনি এমন কোন কারণে আপনার উপর …

রহমানকে কথা শেষ করতে দেয় না বনহুর, হুঙ্কার ছাড়ে সে–বনহুর নারী জাতিকে করুণা করে, সমীহ নয়। আমি মনিরাকে করুণা করেই গ্রহণ করেছিলাম।

সর্দার, আপনি বলতে চান বৌ-রাণীকে আপনি ভাল না বেসেই বিয়ে করেছেন? করুশাই আপনাকে এতদূর অগ্রসর করতে সক্ষম হয়েছে?

রহমান আজ ভুলে গেলো–সে সর্দারের সঙ্গে কথা বলছে। যে সর্দারের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কোনদিন কথা বলতে পারেনি–আজ রহমান চোখ-মুখ বন্ধ করে জলস্রোতের মতই বলে চললো। সর্দার, আপনি আজ কদিন এসেছেন, কই একটি দিনও তো আপনাকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখলাম না। অহঃরহ অন্তরে আপনার মনে একটা ঝড়ের তাণ্ডব বয়ে চলেছে, এটা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পেরেছি। সবার চোখে ধুলো দিলেও আমার চোখে ধুলো দিতে পারবেন না। বলুন সর্দার, বৌরাণীকে আপনি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন না করুণা করে? বলুন?

শক্তিতে বনহুর শক্তিমান হলেও রহমানের কথায় সে পরাজিত হলো তার কাছে। সত্যিই তো মনিরাকে সে করুণা করে বিয়ে করেনি। বিয়ে করেছে। মায়ের অনুরোধে আদেশে। মনিরাকে ভালবাসতো বনহুর–সে কথা মিথ্যা নয়। তাই বলে ভালবাসার বিনিময়ে কি বিয়ে,

বনহুরের চিন্তায় বাধা দিয়ে বলে উঠলো রহমান সর্দার।

বনহুর এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললো–রহমান, আমি স্বীকার করলাম, মনিরাকে আমি ভালবাসি। তাই বলে কোন নারীর রূঢ় আচরণ দস্যু বনহুর সহ্য করবে না।

এরপর রহমান আর কোন কথা বলতে পারলো না, ধীরে ধীরে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো নূরী।

বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–রহমান ভাইকে অমন করে বকলে কেনো হুর?

বনহুর আর একটা কঠিন উক্তির জন্য অপেক্ষা করছিলো। ভেবেছিলো, নূরী আড়াল থেকে সব শুনেছে কিন্তু এখন বুঝতে পারলো, রহমান আর তার মধ্যে যে আলোচনা হলো,কিছুই শুনতে পায়নি নূরী। শুনতে পেলে একটা ঝড়-ঝাপটা শুরু হতো এতোক্ষণ। কারণ, বৌ-রাণী নামটা নূরী কিছুতেই ভালভাবে গ্রহণ করতে পারবে না।

নূরী বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে পড়লো–মনিকে কবে আনবে বলো?

বনহুর শান্ত কণ্ঠে বললো–সে জন্যই তো রহমানকে বকলাম।

কেনো?

মনিকে আজও সে আনতে যায়নি বলে?

আচ্ছা, আমিও ওকে দেখাচ্ছি মজাটা। নূরী উঠতে গেলো, বনহুর অমনি হাতখানা চেপে ধরলো নূরীর।

-বসো নূরী।

না, আমার মনির জন্য মন কেমন করছে। হুর, আমার মনিকে কেনো তোমরা এনে দিচ্ছো না?

বলেছি তো সে তার ধাত্রীমাতার নিকটে আছে।

আমি কোন কথা শুনবো না, আমার মনিকে এনে দাও। আমার মনিকে এনে দাও। হু, আমার মনিকে এনে দাও…… মনিকে এনে দাও…..

নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরে আমি কোন কথা শুনবো না। আমার মনিকে এনে দাও। প্রবলভাবে ঝাকুনি দিতে লাগলো নূরী।

বনহুরের মনের অবস্থা আজ মোটেই ভাল ছিলো না, নূরীর হাত দুখানা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো–আমি জানিনা কোথায় তোমার মনি।

সঙ্গে সঙ্গে নুরী পাথরের মূর্তির মত বন্ধ হয়ে পড়লো, ঠোঁট দুখানা একটু নড়ে উঠলো মাত্র। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো বনহুরের দিকে।

বনহুর অধর দংশন করতে লাগলো, বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠলো তার ললাটে।

কিছুক্ষণ দ্রুত পায়চারি করে ফিরে তাকালো বনহুর নুরীর দিকে। নূরী তখনও স্থির ভাবে বসে আছে কেমন যেন চিত্রাপিতের মত।

নূরীকে এভাবে পুতুলের মত নিশ্চুপ বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলো বনহুর। দুশ্চিন্তায় মনটা ভরে উঠলো, আবার ওর মাথাটা গুলিয়ে যাবে না তো! ভিতরে ভিতরে আশঙ্কিত হলো সে। এগিয়ে গেলো বনহুর, নূরীর চিবুক ধরে উঁচু করে তুলে বললো–নুরী।

নূরী, তোমার মনিকে আমি এনে দেবো। এনে দেবো নূরী……

নূরীর গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু।

বনহুর নূরীর পাশে বসে ওকে টেনে নেয় কাছে, চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। সান্ত্বনার কণ্ঠে বলে–লক্ষ্মীটি কেঁদোনা, তোমার নূরীকে আমি এনে দেবোকথা শেষ করে বনহুর আনমনা হয়ে যায়। সত্যি কি সে মনিকে এনে দিতে পারবে? কোথায় মনি, সে এমন কত বড় হয়েছে। বেঁছে আছে না মরে গেছে কে জানে। এতো বড় মিথ্যা বলে বনহুর চিন্তিত হয়ে পড়লো।

নূরীর মাথায় হাত বুলিয়ে চললো বনহুর।

নূরী বনহুরের বুকে মাথা গুঁজে উচ্ছ্বসিত ভাবে কেঁদে উঠলো। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো মনি ছাড়া আমি বাঁচবো না। বাঁচবো না হুর।

নূরী! কেঁদোনা লক্ষ্মীটি …..

১০.

মনিবের মনের অস্থিরতা অন্তরে অন্তরে উপলব্ধি করতে লাগলো রহমান। বহুদিন পর সর্দারকে তারা ফিরে পেয়েছে কত আনন্দ! কিন্তু সর্দার যদি সব সময় চিন্তিত থাকে তবে কিভাবে তাদের কাজ হবে।

শহরের নানা স্থানে আবার দেখা দিয়েছে নানা রকম অরাজকতা। পুলিশের চোখে ধুলি দিয়ে শয়তান লোকগুলো আবার কেঁপে উঠেছে বেলুনের মত। গোপনে তারা অসহায় জনগণের রক্ত শুষে নিচ্ছে নীরবে।

রহমান সব সন্ধানই নিয়েছে। তাদের যতটুকু সম্ভব সায়েস্তাও করেছে কিন্তু আরও প্রয়োজন। এবং ওদের সায়েস্তা করতে হলে চাই সর্দারের সহায়তা।

রহমান প্রায়ই ছদ্মবেশে শহরে প্রবেশ করতো। গোপনে সন্ধান নিয়ে ফিরতো সে! বনহুরের প্রধান অনুচর রহমান, বনহুরের মতই তার মহৎ উদেশ্য। ধনীর ধন লুটে নিয়ে ধনহীন অনাথাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াই তার ব্রত।

আজও রহমান ভাল বাসেননি কোন নারীকে, নূরীই ছিলো তার একমাত্র স্বপ্ন। কিন্তু যখন সে জানতে পেরেছে নূরী ভালবাসে তার মনিব দস্যু বনহুরকে–সে দিন থেকে রহমান নূরীকে এড়িয়ে চলতো। নূরীর স্মৃতির হৃদয় সিংহাসনে সংগোপনে রেখে ভুলে থাকতো মানবদেহী নূরীকে। দূর থেকে নূরীকে রহমান পূজা করতো, কিন্তু কোনদিন বিরক্ত করতে না সে তাকে।

একদিন বনহুর আর রহমান বসেছিলো নির্জন ঝর্ণার ধারে। অদূরে তাজ আপন মনে ঘাস খাচ্ছিলো।

বনহুর একটা ঘাসের খন্ড নিয়ে দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলছিলো। মুখভাব গম্ভীর ভাবাপন্ন। তাকিয়ে ছিলো সে সম্মুখস্থ বয়ে চলা ঝরণার পানির দিকে।

বনহুরের অদূরে রহমান বসেছিলো, তার মুখমণ্ডলও বেশ চিন্তাযুক্ত। বললো রহমান সর্দার বহুদিন আপনি দেশছাড়া। এতো দিন দেশে আপনি না। থাকায় নানা রকম অনাচার শুরু হয়েছে। পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে কতগুলো চোরাকারবারী যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে। কত নিরীহ জনগণের রক্ত যে তারা শোষণ করছে তার ঠিক নেই।

বনহুর সোজা হয়ে বসলো–তুমি এতোদিন কি করেছিলে রহমান?

সর্দার, আমি যতটুকু সম্ভব শয়তানদের সায়েস্তা করতে চেষ্টা নিয়েছি। কিন্তু বেশি কিছু করে উঠা সম্ভব হয়নি। কারণ পুলিশের সহায়তায় তারা বেঁছে গেছে। পুলিশ মনে করেছে, তারা হৃদয়বান লোক, কাজেই……..

বুঝতে পেরেছি। কিন্তু কারা সেই দুষ্ট শয়তানদের দল?

সর্দার, সবচেয়ে দেশের জনগণের বিস্তর ক্ষতি সাধন করছে একটি ধনবান ব্যক্তি, নাম তার মহব্বৎ আলী। সে শুধু জনগণের ক্ষতিই সাধন করছে না, দেশের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কি করেছে সে?

মহব্বৎ আলী প্রচুর অর্থবান লোক। শহরে এবং বিদেশে তার বহু কারবার আছে, যে সব কারবারে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন হয়ে থাকে। একটা হোটেল আছে–যেখানে শহরের সৎ ব্যক্তিদের প্রলোভন দেখিয়ে অসৎ পথে আনা হয়। মদ পান, জুয়া খেলা এবং বাঈজী নাচ সব হয়ে থাকে সে হোটেলে। হোটেলের অভ্যন্তরে আরও অনেক কুৎসিৎ কাজ সমাধা হয়ে থাকে।

হু। বনহুর একটা শব্দ করে উঠলো।

রহমান বুঝতে পারলো, তার মনিবের চিন্তাধারা বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়েছে। সব সময় সর্দারের বিমর্ষতা অন্যান্য অনুচরদের তেমন করে ভাবিয়া

তুললেও, রহমান বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলো। এবার ঔষধ ধরেছে, রহমান মহব্বৎ আলীকে সায়েস্তা করতে না পেরে ভীষণভাবে ক্ষেপেছিলো।

বনহুর কুঞ্চিত করে কিছু ভাবতে লাগলো।

রহমানের অতি পরিচিত সর্দারের এ. মুখভাব, মনে মনে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো সে।

বনহুর বললো–রহমান, প্রস্তুত থেকো, আজ রাতেই একবার শহরে যাবো।

আচ্ছা, সর্দার।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো—চলো।

রহমানও নীরবে অনুসরণ করলো।

বনহুরের অশ্ব আর রহমানের অশ্ব তখন পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে।

উভয়ে উঠে বসলো নিজ নিজ অশ্বে।

১১.

রহমান এক সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজ অশ্ব নিয়ে রওয়ানা দিলো। কাউকে সে কোন কথা বললো না–কোথায় যাচ্ছে, কেনো যাচ্ছে। বনবাদাড় আর জঙ্গল ছেড়ে রহমানের অশ্ব শহরের পথ ধরে এগুলো। রহমানের শরীরে আজ পাহারাদারের শুভ্র ড্রেস।

একটা বড় দোকানের সামনে অশ্ব রেখে নেমে পড়লো রহমান। কিছু খাবার আর খেলনা নিয়ে উঠে বসলো আবার অশ্বপৃষ্ঠে।

সোজ গিয়ে পৌঁছলো রহমান চৌধুরী বাড়ির বাগানের পাশে।

আজ কদিন থেকে মনিরার মনের অবস্থা অত্যন্ত অবর্ণনীয়। নাওয়াখাওয়া সব সে ত্যাগ করেছে। এমনকি নূরকে আদর করাও সে ভুলে গেছে যেন।

হঠাৎ মনিরার এ অবস্থা দর্শন করে মরিয়ম বেগম অত্যন্ত চিন্তিত এবং বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভেবে পান না কেনো সে এমন হলো।

সেই ছবি দেখার দিন হতে মনিরার মধ্যে এ পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। মরিয়ম বেগম। বুঝতে পেরেছেন স্বামীর কথাই মনিরাকে এভাবে চিন্তাক্লিষ্ট ও ভাবাপন্ন করে ফেলেছে।

তাই মরিয়ম বেগম তেমন করে কোন কথা না বললেও মাঝে মাঝে বলতেন–মা মনিরা, ভাবিসনে, আমার মন বলছে–সে আসবে। আমি মা, ওর কিছু হলে আমার মন বলতো। কিন্তু আমার মনে সান্ত্বনা আছে সে আসবে…

মরিয়ম বেগমের কথার কোন জবাব দেয় না মনিরা। সে আসবে—মায়ের মনে কত আশা। জানেন না তিনি। যার আসার আশায় তিনি পথ চেয়ে আছেন, সে এসেছিলো। এসে আবার সে চলে গেছে, তাঁকে বিমুখ–করে ফিরিয়ে দিয়েছে মনিরা নিজে।

মরিয়ম বেগম যতই মনিরাকে সান্ত্বনা দিতেন ততই মনিরার হৃদয়ের ব্যথা না কমে আরও বেড়ে যেতো। কোন রকমে মামীমার দৃষ্টির আড়ালে চলে এসে বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদতো।

হয়তো নূর দেখে ফেলভো, ছুটে এসে মায়ের পাশে বসে কাঁদো কাঁদো মুখে বলতো–আম্মা, তুমি কাঁদতো কেনো? আম্মা, বলো না তুমি কাঁদতে কেনো?

মনিরা শিশু-পুত্রের হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করতো।

নূর কিছু বুঝতে না পেরে ছুটে যেতো মরিয়ম বেগমের কাছে। গলা জড়িয়ে ধরে বলতো নূর–দাদীমা, আমাল আম্মার কি হয়েতে? আমাল আম্মা কাঁদতে কেনো?

মরিয়ম বেগম অবাক হয়ে বলতেন–সেকি! আম্মা কাঁদছে? চলো তো দেখি।

ছোট্ট নাতীর হাত ধরে মরিয়ম বেগম আসেন মনিরার কক্ষে।

মনিরা তখন বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে।

মরিয়ম বেগম মনিরার পিঠে হাত রেখে বললেন–ছি ও মা, অমন করে কাঁদতে নেই! আমি মা হয়ে দেখতে, বুকে কেমন পাষাণ চাপা দিয়ে আছি। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে তার, গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন আবার তিনি–ওর সঙ্গে তোকে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে আমি ভুল করেছি মনিরা। ভেবেছিলাম তোকে দিয়ে ওকে আমি আটকে রাখবো, কিন্তু সে আশা আমার বিফল হয়েছে। বনের পাখিকে কেউ কোনদিন খাচায় আবদ্ধ রাখতে পারেনা, তাকে যতই দুধ কলা খাওয়ানো যায়…..

মামীমা! মামীমা……. মনিরা মরিয়ম বেগমের কোলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে উচ্ছ্বসিত ভাবে কেঁদে উঠে।

মনিরা, যে ভুল আমি করেছি তার প্রতিকার নেই। একটা জীবন এমনি করে আমার চোখের সম্মুখে বিনষ্ট হয়ে যাবে, আর আমি তাই সহ্য করবে। মা, আমাকে তুই তিরস্কার কর, তিরস্কার কর মা।

মনিরা সোজা হয়ে বসলো, আঁচলে চোখের পানি মুছে বললো মামীমা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। কে বললো, তোমাকে, আমার জীবন বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে?

আমি কি কিছুই বুঝিনা মনিরা? তোর অন্তরের ব্যথা আমি কি কিছুই। উপলব্ধি করতে পারিনা? মা হলেও আমি নারী। নারীর সর্ব যে তার স্বামী……….

মামীমা!

মনিরা, কি করবো বল, আমি তোকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছি। এ বয়সে কে তার স্বামীকে পাশে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়। কাঁদ, আরও কাঁদ, কেঁদে কেঁদে তবু যদি বুকটা তোর হালকা হয়।

একটু থেমে কঠিন কণ্ঠে বললেন মরিয়ম বেগম–আমি মা হয়ে ওকে অভিসম্পাত করছি, ওর যেন…….

মনিরা দক্ষিণ হস্তে মরিয়ম বেগমের মুখ চাপা দিয়ে বলে উঠলো– না না, তাকে তুমি অভিসম্পাত করোনা। অভিসম্পাত করোনা মামীমা। মায়ের অভিশাপ সবচেয়ে মন্দ। ওর কোন অমঙ্গল হবে এ আমি সইতে পারবো না। তিলে তিলে আমি মরণ বরণ করবো, কিন্তু ওকে আমি অভিশাপ দিতে দেবব না–মামীমা–মামীমা–

 মরিয়ম বেগমের গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রুধারা। নীরবে তিনি মনিরার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে চললেন।

নূর তখন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মা-ই বা কাঁদছে কেনো, আর দাদীমা-ই বা কাঁদছে কোননা, কিছুই বুঝতে পারে না অবুঝ শিশু নূর।

এমন সময় নকীব এলো; যদিও সে মরিয়ম বেগম ও মনিরাকে অশ্রুরা নয়নে দেখতে পেলো তবু না বলে পারলো না, বললো সে আপামনি সেই লোকটা এসেছে, ঐ যে নূরকে যে ভালবাসে, খেলনা দেয়:…

মনিরা জানে রহমান আসে–সে-ই নূরের জন্য খেলনা আর খাবার নিয়ে। আসে। অনেক করে বারণ করা সত্বেও সে এ কাজ করে। অনেক দিন মনিরাকে বলেছে রহমান-বৌ-রাণী, আমি তো নিজের টাকায় এ সব করছিনা, ওর বাপের টাকার জিনিস। কেনো আপনি রাগ করেন বৌ-রাণী?–নকীবের কথায় রহমানের কথাগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠে মনিরার।

আঁচলে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায় মনিরা, হঠাৎ যেন তার মুখের ভাব বদলে যায়। মরিয়ম বেগমকে লক্ষ্য করে বলে সে মামীমা, রহমান : এসেছে। আয় নূর-নূরকে কোলে করে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যায় মনির।

মরিয়ম বেগম আশ্বস্ত হন। রহমানের পরিচয় তিনি জানেন। মনিরা মামীমাকে সব খুলে বলেছেন–রহমান তার স্বামীর প্রধান অনুচর। এ বাড়ির আর একজন জানেন রহমানের আসল পরিচয়–তিনি হলেন বৃদ্ধ সরকার সাহেব। মনিরা মরিয়ম বেগম ও সরকার সাহেব ছাড়া কার কেউ জানেনা–রহমান কে। এমন কি বিশ্বাসী চাকর নকীবও না।

পুত্রের প্রধান অনুচর এবং বিশ্বাসী জন বলেই মরিয়ম বেগম মনিরাকে কোনদিন রহমানের সম্মুখে যেতে বারণ করেননি। মনিরা প্রায়ই রহমানের মুখে তার স্বামীর আস্তানার সংবাদ শুনতো। আরও কত কথা বলতো রহমান, সর্দারের গুণগানে মুখর হয়ে উঠতো সে।

মনিরার শুষ্ক প্রাণে স্বামীর কাহিনী কিছুটা শান্তি দান করতো। আজ কতদিন রহমান বনহুরের পাশে রয়েছে, বনহুরকে সে যেমন করে জানতো আর কেউ তেমন করে জানতো না। তাই রহমানের কাছে মনিরা সন্ধান পেতো তার স্বামীর।

নূরকে কোলে করে মনিরা এসে দাঁড়ালো হল ঘরে।

রহমান যেমন করে কুর্ণিশ জানায় তার সর্দারকে, তেমনি করে কুর্ণিশ জানাতো বৌ-রাণীকে।

কুর্ণিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রহমান।

নূর মায়ের কোল থেকে ছুটে গিয়ে জাপটে ধরলো রহমানকে–আমার জন্যে কি এনেতো সিপাহী?

মনিয়া রহমানকে সিপাহী বলে সম্বোধন করতো। নূরও মায়ের কাছে এ উক্তিটাই শিখে নিয়েছিলো।

নূরকে রহমান তুলে নিলো কোলো, হেসে বললো–ছোট সর্দার, তোমার জন্য অনেক জিনিস এনেছি।

কই, দাও?

রহমান পাশের টেবিলে রাখা প্যাকেটগুলো তুলে দিলো নূরের হাতেএই নাও ছোট সর্দার।

রহমান নূরকে ছোট সর্দার বলতো।

মনিরা অবশ্য প্রথম প্রথম রাগ করত। বলতো–ও নাম ধরে ডেকোনা সিপাহী।

রহমান হেসে বলতো–কেন বৌ-রাণী?

না, ও নাম আমার সহ্যের বাইরে। তোমাদের সর্দার অমানুষ বলে, আমার নূর অমানুষ হবে?

হাঃ হাঃ করে হেসে উঠছিলো রহমান, বলেছিলো–আমাদের সর্দার অমানুষ কে বললো এ কথা আপনাকে? মানুষ যদি থাকে তবে মানুষ আমার সর্দার। ভয় কাকে বলে জানে না সে। শয়তান জানোয়ার যারা নিরীহ মানুষের বুকে বসে রক্ত শুষে খায়, তাদের টুটি ছিঁড়ে ফেলতে কসুর করেনা। দুষ্ট লোকদের বুকে গুলী করতে এতটুকু হাত কাঁপেনা। শয়তানের শত্রু,

অনাথার বন্ধু–তাকে আপনি অমানুষ বলেছেন বৌ-রাণী?

এর পর থেকে আর কোনদিন মনিরা রহমানকে ছোট সর্দার বলে ডাকতে আপত্তি করতে পারেনি।

নূর রহমানের হাত থেকে খাবার আর খেলনা হাতে নিলো। মনিরা বললো–যাও বাবা, দাদীমার কাছে যাও।

নূর খুসী হয়ে চলে গেলো উপরে।

মনিরা স্থির হয়ে দাঁড়ালো, দৃষ্টি রইলো রহমানের মুখে।

বললো রহমান–বৌ রাণী, কি হয়েছে আপনাদের? আমাদের?

হাঁ সর্দারকে আমরা ফিরে পেয়েছি বটে, কিন্তু তার আসল রূপ কোথায় অন্তর্ধান হয়েছে। সব সময় গম্ভীর ভাবাপন্ন। কি হয়েছে বৌ-রাণী?

মনিরা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো–জানিনা।

না, আপনাকে বলতেই হবে?

আমি বললাম জানিনা।

বৌ-রাণী, আমার কাছে আপনি কোন কথা গোপন করবেন না। জানেন তো, সর্দার আমাদের সর্বস্ব। তার বিষণ্ণ মলিন ভাব আমাদের মনে অহঃরহ যন্ত্রণা দিচ্ছে। বলুন বৌ-রাণী, কি হয়েছে?

তোমরাই কি শুধু তাকে ভালবাসো, আমি কি তাকে একটুও ভালবাসি না? সিপাহী, আমি-আমিও কম মনঃকষ্ট ভোগ করছিনা। আমার হৃদয়েও দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে,–আজ কদিন আমি এতটুকু শান্তি পাইনি। এতটুকু না। সিপাহী, আমি তাকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছি, আমি তাকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছি–গলা ধরে আসে মনিরার।

রহমান নতমুখে দাঁড়িয়ে ছিলো, এবার চোখ তুলে তাকালো সে মনিরার মুখের দিকে।

মনিরা বলে চললো–আমিই অপরাধী। আমিই অপরাধী সিপাহী। আমি তাকে ভুল বুঝে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিয়েছি….

এবার বললো রহমান–বৌ-রাণী, সর্দার বড় জেদী মানুষ। এক বার অভিমান হলে সহজে তাকে খুশি করা মুসকিল। আমি তাকে অনেক করে বলেছি, আপনার এখানে আসার জন্য অনেক অনুরোধ করেছি।

কিছুক্ষণ চিন্তা করলো মনিরা, তারপর বললো–আমাকে একবার তার কাছে নিয়ে যেতে পারো?

সর্দারের কাছে!

হাঁ সিপাহী, তার কাছে একবার আমি যেতে চাই।

কিন্তু •••

না না, কিন্তু নয়, তুমি আমাকে তার কাছে যাবার ব্যবস্থা করে দাও সিপাহী! নইলে আমি আত্মহত্যা করবো।

বৌ-রাণী–

জানো–নারীর স্বামী না হলে সে জীবনের কোন দাম নেই। স্বামীই যে সব। আমি ভুল করেছি রহমান, আমি ভুল করেছি। 

তাহলে আপনি…

হাঁ, আমাকে যেমন করে পারো একবার তার কাছে নিয়ে চলো।

আস্তানায় যাওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয় বৌ-রাণী। একটু চিন্তা করে বসলো রহমান–আজ সর্দার ব্যস্ত থাকবেন। এর পর যেদিন সুযোগ আসবে আপনাকে আমি সর্দারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেবো।

সিপাহী।

বৌ-রাণী, আপনি আমার উপর ভরসা রাখবেন, সর্দারের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হবেই।

সিপাহী।

চলি বৌ-রাণী।

এসো সিপাহী!

রহমান পুনরায় মনিরাকে কুর্নিশ জানিয়ে বলে–খোদা হাফেজ।

মনিরা অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করে–খোদা হাফেজ।

বেরিয়ে যায় রহমান।

মনিরা তাকিয়ে থাকে রহমানের চলে যাওয়া পথের দিকে।

ছাদের উপরে তখন মরিয়ম বেগম আর নূরের আনন্দ ভরা কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

১১.

হোটেল গুল বাগের সম্মুখে এসে একটা গাড়ি থামলো। গাড়ি থেমে নেমে এলো দুটি যুবক। শরীরে তাদের মূল্যবান কোট প্যান্ট-টাই। প্রথম যুবকের চোখে কালো চশমা।

যুবকদ্বয় হোটেলের মধ্যে প্রবেশ করতেই একজন বয় এগিয়ে এলো।

প্রথম যুবক একটা কার্ড হাতে দিয়ে বললো–মিস পারভিনকে দাও।

কার্ড হাতে বয় চলে গেলো।

যুবকদ্বয় নিম্ন স্বরে কিছু আলাপ করতে লাগলো।

বয়ের বিলম্ব দেখে প্রথম যুবক একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো। সিগারেট থেকে ধূম নির্গত করতে করতে হোটেল-কক্ষের চারদিকে সূতীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো সে।

এমন সময় পারভিন এসে দাঁড়ালো তাদের সম্মুখে।

প্রথম যুবককে দেখতে পেয়ে আনন্দে দীপ্ত হয়ে উঠলো তার চোখ দুটো, উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো–হ্যালো, আপনি! আসুন আমার সঙ্গে।

যুবকদ্বয় অন্য কেহ নয়, প্রথম জন দস্যু বনহুর দ্বিতীয় জন তার প্রধান অনুর রহমান।

বনহুর আর রহমান অনুসরণ করলো পারভিনকে।

হোটেল কক্ষ হলেও এটা পারভিনের নিজস্ব কক্ষ।

সুন্দরভাবে সজ্জিত এ কক্ষে প্রবেশ করে বনহুর বললো–মিস পারভিন, অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করলাম।

মোটেই আমি বিরক্ত হইনি, আপনারা বসুন।

বনহুর চোখের চমশাটা খুলে টেবিলে রাখলো, তারপর আসন গ্রহণ করলো।

রহমান যদিও কোনদিন প্রভুর সম্মুখে আসন গ্রহণ করে নাই, আজ তার ইংগিতে আসন গ্রহণ করলো।

পারভিনের চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। সেদিনের পর পারভিন মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি প্লেনের সেই যুবকটিকে। তার পর ছবিতে যখন তাকেই সে দেখলো তখন আরও মুগ্ধ হলো। শয়নে-স্বপনে জাগরণে-সব সময় ঐ মুখানা ভাসছিলো তার মানস পটে। এই ক্ষণে তার কামনার জনকে পেয়ে কি যে আনন্দ হলো!–পারভিন যেন আত্মহারা হয়ে পড়লো। 

পারভিন আসন গ্রহণ করতেই বললো বনহুর রহমানকে লক্ষ্য করে বন্ধু, তোমার সঙ্গে এর পরিচয় নেই। ইনি গুলবাগ হোটেলের মালিক মহব্বৎ আলীর কন্যা মিস পারভিন আর এ আমার বন্ধু রহমান।

পারভিন হেসে বললো–আপনার পরিচয় আজও কিন্তু আপনি বলেননি। আপনি কি কুন্তি বাঈ ছবির নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন?

হাঁ, আপনার অনুমান সত্যি। আমিই মুকছুদ চৌধুরী।

আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সত্যি, আপনার অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করেছে।

খুশি হলাম শুনে।

আপনি নিশ্চয়ই ছবিটা দেখেছেন মিঃ চৌধুরী।

না, সে সুযোগ এখনও আমার হয়নি।

সে কি?

হাঁ মিস পারভিন, সুটিং শেষ করেই আমাকে বিদায় নিতে হয়েছিলো।

বনহুর, রহমান আর পারভিন যখন হোটেল-কক্ষে বসে আলাপ করছিলো। তখন হোটেলে একটা হট্টগোল শোনা গেলো।

অল্পক্ষণ পর একটা বয় ব্যস্তভাবে কক্ষে প্রবেশ করে পারভিনকে লক্ষ্য করে বললল–আপা, আপ কা লকেট মিল গিয়া।।

পারভিন অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো–সকেট পাওয়া গেছে। পর মুহূর্তে পারভিন বললো–আপনারা কয়েক মিনিটের জন্য বসুন এক্ষুনি আসছি।

আপ কো লকেট মিল গিয়া কথাটা শুনে চমকে উঠেছিলো বনহর। পারভিনের কথায় বললো–আচ্ছা, আসুন।

বেরিয়ে গেলো পারভিন।

বনহুর রহমানের কানে মুখ নিয়ে বললো–রহমান, আর একটা বিভ্রাট ঘটলো।

বিভ্রাটঃ

হাঁ, পারভিনের লকেট আমিই নিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন পথে একটা বৃদ্ধ ভিখারীকে দিয়েছিলাম ওটা, ভুল করেই ওটা আমি দিয়েছিলাম…… কারণ, আমার পকেটে তখন ঐ লকেট ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।

ঠিক সেই মুহূর্তে হোটেল থেকে ভেসে এলো এক বৃদ্ধের ব্যথা কাতর কণ্ঠস্বর—মায় নেহি জানতা, কাওন আদমী মেরে হাত মে ও চীজ দিয়া….

সঙ্গে সঙ্গে শুনা গেলে কর্কশ কন্ঠে–শালা বদমাশ বুড়হে, তুম লকেট বেচনে গিয়া, আর লকেট তুম চোরায়ে নেহি?

বুড়োকে আঘাতের শব্দ ভেসে এলো সেই সঙ্গে।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো।

রহমান উঠে গিয়ে উঁকি দিয়ে ফিরে এলো–সর্দার, কয়েকজন পুলিশ একটা বৃদ্ধকে প্রহার করছে।

বনহুর পা বাড়ালো দরজার দিকে।

রহমান বললো–সর্দার, ঠিক হবে না আপনার যাওয়া, বরং বৃদ্ধকে মুক্তির উপায় করতে হবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে পদশব্দ শোনা যায়।

বন আর রহমান আসন গ্রহণ করে।

বনহুর সিগারেট কেসটা বের করে উল্টে পাল্টে নাড়াচাড়া করতে থাকে, নিজকে স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে সে।।

পারভিন কক্ষে প্রবেশ করে আনন্দ ভরা গলায় বলে উঠে–মিঃ চৌধুরী, আমার লকেট ফিরে পেয়েছি। এই দেখুন।

বনহুরের সম্মুখে মেলে ধরে পারভিন লকেটখানা।

বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে বলেন–এ লকেটখানাই বুঝি প্লেনের মধ্যে আপনি হারিয়ে ছিলেন মিস পারভিন?

হ্যাঁ, সত্যি আমার লকেটখানা কি করে যে বুড়োটা পেয়েছিলো সেই জানে। নিশ্চয়ই সে চুরি করেছিলো ওটা।

বলে বনহুর-বুড়োটা কি সেদিন প্লেনে ছিলো?

ছিলো না কিন্তু একটু চিন্তা করে বলে উঠলো পারভিন–হয়তো লোকটা আদতে বুড়ো মানুষ নয়, কোন চোর।

তখনও বাইরে থেকে বুড়োর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে–মায় নেহি জানতা বাবুজী…… মায় নেহি জানতা…

পুলিশের কণ্ঠস্বর-হাজত মে ভরনে ছে তুম ঠিক হোগা, নেহি তো সাচ বাত বোলো।

পুলিশের হান্টারের আঘাত গিয়ে পড়লো বৃদ্ধের কোঁকড়ানো পিঠে!

অমনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো বৃদ্ধ-খোদা তু দেখ মেরা কিয়া কসুর…

একটা হাসির শব্দ শোনা গেলো, অট্টহাসির শব্দ। গোটা হোটেলটা যেন প্রকম্পিত হয়ে উঠলো, হাসি বন্ধ করে বললো লোকটা–তুমহারি জান নেকাল লেঙ্গে। মেরা নাম মহব্বৎ আলী–হাঃ হাঃ হাঃ বুড়হে, তুম মেরা পারভিকা লকেট লিয়া

নেহি নেহি হাম নেহি—

বনহুর অধর অংশন করতে লাগলো।

পারভিন বনহুরের মনোভাব বুঝতে পেরে উৎকণ্ঠিত হলো। বললো রহমান–আজ আমাদের আর এক জায়গায় যাওয়ার কথা ছিলো যে?

বনহুর আনমনা ভাবে উঠে দাঁড়ালো–মিস পারভিন, চলি, গুডবাই।

পারভিন কিছু বলার পূর্বেই বেরিয়ে গেলো বনহুর আর রহমান।

১২.

বনহুর ড্রাইভ আসনে বসে গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো।

রহমান বললো–সর্দার, মহব্বৎ আলীকে চিনেছেন?

হাঁ রহমান, কিন্তু তার পূর্বে চিন্তা বৃদ্ধ ভিখারীকে বাঁচিয়ে নেওয়া। কি করে ওকে বাঁচাননা যায়!

আমি সে কথাই ভাবছি। দেখ রহমান, এ বৃদ্ধের পরাভোগের জন্য দায়ী। আমি। আমিই দায়ী।

আপনিতো ওর অমঙ্গল চিন্তা করে ওটা দেননি!

কিন্তু বেচারী–কথা শেষ না করে বনহুর হোটেল ছেড়ে কিছুটা দূরে একটা গলির মধ্যে গাড়ি রাখলো। প্রতীক্ষা করতে লাগলো।

অল্পক্ষণ পরে দুজন পুলিশ আর দুজন লোক–বোধহয় একজন কোন স্বর্ণকার, দ্বিতীয় জন হোটেলের কোন ব্যক্তি। সঙ্গে বৃদ্ধ ভিখারী। ভিক্ষারীর হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি পুলিশদ্বয় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে বৃদ্ধ ভিখারীটিকে।

যেমন গলির পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলো, আর ঠিক সে মুহূর্তে বনহুর ঝাপিয়ে পড়লো পুলিশদের উপর।

রহমানও প্রচণ্ড ভাবে আক্রমণ করলো।

এক এক মুষ্টিঘাতে এক একজনকে ধরাশায়ী করলো বনহুর ও রহমান।

পুলিশ রাইফেল তুলে ধরবার মত অবসর পেলো না।

বনহুর আর রহমান বৃদ্ধ ভিখারীকে মুক্ত করে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হলো গাড়ি নিয়ে।

পুলিশ ও লোক দুজন শরীরের ধূলো ঝেড়ে ছুটলো কেউ পুলিশ অফিসে, কেউ হোটেল গুলবাগে।

১৩.

বেটা, তুম্ কাওন? বৃদ্ধ কুঁকড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে সোজা হয়ে বসলো। চোখে-মুখে তার কৃতজ্ঞতার ছাপ।

বনহুর বৃদ্ধের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো।

রহমান বৃদ্ধের হাত এবং কোমরের বন্ধন মুক্ত করে দিয়ে বললো–তুম্ ডাকু বনহুরকে সামনে।

কিয়া? বৃদ্ধের চোখে মুখে একটা বিষ্ময় ভাব ফুটে উঠলো। আনন্দ বিচলিত গলায় বললো বৃদ্ধ–ডাকু বনহুর, মুঝে খালাস কিয়া?

হাঁ, আব উসিকে পাশ রাহোগে, তুমহারা খানা পিনা কই তকলিফ নেহি হোগি।

বাপুজী সাচ?

হাঁ, সাচ।

এবার বৃদ্ধ রহমানের মুখে তাকিয়ে বললো–খোদা তেরি ভালা করে।

রহমান বললো, এবার বাবা, হাম নেহি ডাকু বনহুর। তুম্ হারা সামনে খাড়া অহি আদমী–

তুম্‌! আংগুল দিয়ে বনহুরকে দেখায় বৃদ্ধ।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে–হাঁ, বাবা। মুঝে তুম্ মাফ করদো। লকেট তুমহে মায় দিয়া থা।

তুম্ মুঝে লকেট দিয়াথা?

হাঁ, হাম্‌ ভুল কিয়া। তুম মুঝে মাফ করদো বাবা?

খোদা তুঝে মাফ কিয়া বেটে।

সেদিনের পর থেকে বৃদ্ধ ভিখারী বনহুরের আস্তানায় স্থান লাভ করলো।

বনহুর জানে, এর পর বৃদ্ধকে শহরের পথে দেখলে কোন পুলিশ তাকে ক্ষমা করবেনা। নিরপরাধ ভিখারী কেনো কষ্ট পাবে। তার চেয়ে তার আস্তানায় থাকাই শ্রেয়।

বৃদ্ধ ভিখারী হলেও দরবেশ ধরণের লোক ছিলো। বনহুরের দয়ায় আর তাকে ভিক্ষার জন্য চিন্তা করতে হয় না, এখানে খায়-দায়, গজল গান গায়, আর খোদার এবাদত করে।

বৃদ্ধকে ভালই লাগে বনহুরের, মাঝে মাঝে বৃদ্ধের পাশে গিয়ে বসে বনহুর–নানা রকম ধর্ম আলোচনা করে সে।

বৃদ্ধ যখন গজল গায় তখন বনহুর তস্ময় হয়ে শোনে, মন প্রাণ ভরে উঠে অনাবিল এক আনন্দে।

একদিন বৃদ্ধ নির্জন স্থানে বসে গজল গাইছিলো। জ্যোছনা রাত, অদুরে নিঝরিনী ঝর্ণাধারা ছল ছল শব্দ করে বয়ে চলেছে। আপন মনে গজল গাইছিলো বৃদ্ধ দুচোখ তার মুদিত।

অদূরে একটা পাথরাসনে বসে দস্যু বনহুর।

অন্য একটা পাথরে ঠেস দিয়ে সেও দুচোখ বন্ধ করে ছিলো। জ্যোছনার আলোতে বনহুরকে দেব কুমারের মত সুন্দর লাগছিলো। শরীরে তার শুভ্র পোশাক।

বনানী ঢাকা পাথরাসনে পাতার ফাঁকে ফাঁকে জ্যোছনার আলো খেলা করছিলো; খানিকটা জ্যোছনার আলো এসে পড়ছিলো বনহুরের চোখেমুখে। তন্ময় হয়েছিলো বনহুর বৃদ্ধের গজল গান।

এমন সময় অদূরে একটি নারীমূর্তি এগিয়ে আসে, পাশে একটি লোক। গাছের ছায়ায় আধো অন্ধকারে অতি লঘু পদক্ষেপে এগুচ্ছিলো তারা।

পুরুষ লোকটি এবার বললো–বৌ-রাণী, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি বাবাজীকে আস্তানায় নিয়ে যাই। তারপর আপনি ……….

নারীমূর্তি অন্য কেহ নয়, দস্যু বনহুরের পত্মী মনিরা।

পুরুষ ব্যক্তিটি রহমান।

রহমানের কথা বললো মনিরা–যাও সিপাহী, আমি এখানে অপেক্ষা করছি।

এখানে আপনি একা থাকবেন বৌ-রাণী? কোন জীব……

ভয় নেই সিপাহী, হতভাগিকে কেউ খাবেনা। তুমি যাও।

মনিরা দাঁড়িয়ে পড়লো।

রহমান চলে গেলো সম্মুখের দিকে।

বৃদ্ধের গজল প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো।

রহমান বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো।

বৃদ্ধের গজল শেষ হলে বললো–সর্দার!

বনহুর যেমন বসেছিলো তেমনি বসে রইলো, বললো–বসসা রহমান।

আজকাল মাঝে মাঝে বনহুর রহমানকে নিয়ে এই নির্জন ঝর্ণার ধারে এসে বসতো, কাজেই আজও বললো তাকে বসতে।

রহমান অন্যদিন হলে বসে পড়তো নীচের কোন পাথরখণ্ডে। আজ বসলোনা, বললো রহমান বাবাজীর শরীর আজ ভাল নয়, ওকে আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে আসি।

আচ্ছা যাও।

রহমান একবার বৃদ্ধের পাশে এসে বললো–বাবাজী, আভি তুম চলল। রাত বহুং হুয়ে……।

আচ্ছ, চলো বাপু।

বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালো।

রহমান বৃদ্ধের হাত ধরে নিয়ে চললো বনপথ ধরে।

বনহুর আবার পাথরখণ্ডে ঠেস দিয়ে ভাল হয়ে বসলো। বনানী ঢাকা ঝর্ণার ধারে ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়ায় আজ তার বড় ভাল লাগছে। আজ সে কোথাও যায়নি, অবশ্য রহমানের বিশেষ অনুরোধেই সে রয়ে গেছে। আগামীকাল মহব্বৎ আলীর হোটলে আবার সে পদার্পণ করবে। কাল কি করতে হবে–রহমানের সঙ্গে এ নিয়েই আলোচনা হবে এখানে। রহমান বৃদ্ধকে আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবে, সেজন্য বনহুর অপেক্ষা করছে এখানে।

কোমল একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো বনহুর নিজের মাথার চুলে।

বনহুর চোখ মেলে তাকিয়ে চমকে উঠলো–কে তুমি? 

ঘোমটায় মনিরা মুখটা অর্ধেক ঢেকে রেখেছিলো, বনহুরের কণ্ঠস্বরে বুকটা ধক ধক করে উঠলো। একটু সরে দাঁড়িয়ে রইলো, কোন কথা বললোনা।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো বিদ্যুৎ গতিতে; গম্ভীর কঠিন কণ্ঠে বললো কে? এক ঝটকায় মনিরার মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিলো বনহুর। সঙ্গে সঙ্গে জ্যোছনার এক খণ্ড আলো এসে পড়লো মনিরার মুখে। বনহুর বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলে উঠলো–তুমি!

মনিরা দুহাতে জড়িয়ে ধরলো বনহুরের পা দুখানা–ওগো, আমায় তুমি মাফ করে দাও। মাফ করে দাও ……

পাথরের মূর্তির মত নিশূপ দাঁড়িয়ে রইলো বনহুর, কোন কথা বললোনা। মুখমণ্ডল কঠিন, দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো।

মনিরার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে উঠলো বনহুরের পা দুখানা।

তবু নীরব বনহুর।

সেদিন মনিরার উপেক্ষা বনহুরের হৃদয়ে শেল বিদ্ধ করেছিলো। জীবনে সে বুঝি এতোবড় আঘাত আর কোনদিন পায়নি।

মনিরার হাতের মধ্য হতে পা দুখানা সরিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো বনহুর, কঠিন কণ্ঠে বললো–রহমান তোমাকে পথ দেখিয়ে এনেছে বুঝি? এর জন্য ওকে শাস্তি পেতে হবে।

না না, ওর কোন দোষ নেই, আমি–আমিই এসেছি। আমাকে তুমি মাফ করো। যে ভুল আমি করেছি সেদিন, তার জন্য অহঃরহ আমি জ্বলে মরছি। আমাকে তুমি মাফ করো ……..

আর কোনদিন বিরক্ত করবোনা তোমাকে মনিরা।

এ তুমি কি বলছো? মনিরা অশ্রুসিক্ত নয়নে উঠে দাঁড়ালো।

হাতের মধ্যে হাত রগড়ে আবার বললো–তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারিনা। আমাকে তুমি হত্যা করো …….

বনহুর রাগত কণ্ঠে বললো—তুমি তো বেশ ছিলে, বরং আমার উপস্থিতি তোমাকে বিরক্ত করে তুলেছিলো …।

উঃ আজও তুমি মনে রেখেছো সব কথা? তুমি বিশ্বাস করো, ওগুলো আমার মনের কথা নয়…….. তুমি বিশ্বাস করো….

মনিরা বনহুরের হাত দুখানা মুঠায় চেপে ধরলো।

বনহুর তখনও নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখমণ্ডল গম্ভীর কঠিন। মনিরার অশ্রু যে তাকে বিচলিত করেনি তা নয়, এর চেয়ে আরও কত কঠিন কথা মনিরা বনহুরকে বলেছে কতদিন, কিন্তু সেদিনের কথাগুলো বনহুরের মনে তীরফলকের মতই বিদ্ধ হয়ে আছে যেন।

মনিরা স্বামীর বুকে মাথা ঠুকতে লাগলো–তুমি বিশ্বাস করো, ও আমার মনের কথা নয় ……. ও আমার মনের কথা নয় …

বনহুর তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

মনিরার বিলাপধ্বনি ওর কানে পৌছোচ্ছে কিনা কে জানে।

হঠাৎ মনিরা ছুটে চললো ঝর্ণার দিকে, যাবার সময় বললো মনিরা বেশ, ক্ষমা না করতে পারো, এ জীবন আমি বিসর্জন দেবো, তবু ফিরে যাবো না।

মনিরা ছুটে গিয়ে ঝর্ণার পাশে দাঁড়ালো।

বনহুর আর নিজকে সংযত রাখতে পারলো না, উচ্চ কণ্ঠে বললো–মনিরা শোন।

অভিমানে মনিরার বুক ভরে উঠেছে, এ মুহূর্তে সে নিজ জীবন বিসর্জন করতে কিছুমাত্র কুষ্ঠিত হবে না। ঝাপিয়ে পড়বে মনিরা কিন্তু আর পারলো না, বনহুরের কণ্ঠস্বর তার কানে যেন মধু বর্ষণ করলো। থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে তাকালো।

বনহুর ততক্ষণে মনিরার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

মনিরা, এবার লুটিয়ে পড়ে স্বামীর বুকে।

বনহুর ভুলে যায় যত অভিমান।

১৪.

রাত যত বেড়ে আসে নূরী ততই বনহুরের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বনহুর আজ বাইরে কোথাও যায়নি জানে সে। আস্তানার আশেপাশে কোথাও আছে কিংবা বৃদ্ধের গজল শুনছে সে ঝর্ণার পাশে বসে। কিন্তু এতোক্ষণে ও ফিরে আসছেনা কেনো। নূরী আস্তানার বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই রহমান পথ রোধ করে দাঁড়ালো–কোথায় যাচ্ছো?

নূরী গম্ভীর কণ্ঠে বললো–বনহুরের সন্ধানে। পথ ছেড়ে দাও।

না, পথ ছাড়বোনা।

কেনো?

সর্দার ওদিকে নেই।

হাঁ, আমি শুনলাম, সে ঝর্ণার পাশে বসে বাবাজীর গজল শুনছিলো।

কে বললো তোমাকে?

কায়েস।

ও জানেনা।

আমি বাবাজীর কাছে শুনে আসছি, দাঁড়াও।

নূরী চলে গেলো বাবাজীর কক্ষের দিকে।

বৃদ্ধ তখন শোবার আয়োজন করছিলো।

নূরী প্রবেশ করলো সেখানে।

রহমান চিন্তিত হলো এবার। সর্দার ঝর্ণার ধারেই আছে, এবং সে একা নেই-তার পাশে আছে বৌ-রাণী।

নূরী কক্ষে প্রবেশ করতেই বললো বৃদ্ধ—কাওন্‌?

নূরী।

তুম্ এনা রাত পর এঁহা?

এক বাত কইয়ে বাবাজী?

বোলো?

সর্দার কাহা তুম্ জানতে হো বাবাজী?

হাঁ মায় জানতা হু, সর্দার বেটা ওহি ঝর্ণাকে কিনারে।

রহমান যেন হাবা বনে গেলো।

নূরী রহমানের মুখে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো–এতো মিথ্যা বলতে পারো তুমি রহমান।

নূরী যেওনা। আমিই সর্দারকে ডেকে আনছি।

না, আমিই যাবো।

এতো রাতে সর্দার তোমাকে ওখানে দেখলে খুশি হবে না।

কিসে সে খুশি হবে না হবে শুনতে চাইনা রহমান।

একাই যাবে?

যদি মনে করো এসো আমার সঙ্গে। নূরী কথা শেষ করে এগিয়ে চললো।

এদিকে নূরী আর রহমান যখন বনপথ ধরে এগিয়ে আসছে, তখন বনহুর আর মনিরা উঠে দাঁড়িয়েছে। বললো বনহুর–চলো মনিরা, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

মনিরা আর বনহুর এগুলো, অদূরে একটা গাছের সঙ্গে বাধা ছিলো তাজ।

বনহুর মনিরাকে তাজের পিঠে উঠিয়ে দিয়ে নিজেও বসলো। মনিরা স্বামীর বুকে নিবিড় ভাবে ঠেস দিয়ে বললো–আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এই তো আমার বেহেস্ত।

বনহুর মনিরার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর তাজের লাগাম টেনে ধরলো।

ধমকে দাঁড়ালো নূরী, তাজের খুঁড়ের শব্দ তার অতি পরিচিত। বললো নূরী–রহমান, তাজের পদশব্দ না?

রহমান মনে মনে হাজার শুকরিয়া করে বললো–সর্দার বুঝি শহরে গেলো।

শহরে?

হাঁ, কাজ আছে সেখানে।

কই, তুমি তো গেলেনা?

সর্দারের গোপন কাজ কিনা।

তুমি জানো রহমান, কোথায় গেলো সে?

না নূরী, আমি জানিনা।

ঐ চৌধুরী বাড়ি গেলো না তো?

রহমান সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বললো–নূরী, অনেক দিন বলেছি, আজও বলছি–মিছামিছি সর্দারের পথ চেয়ে কোন ফল হবে না।

নূরী মুখ গম্ভীর করে ফেললো, বললো–রহমান, আমি যে তারই কাঙ্গাল।

কিন্তু সে যদি তোমাকে কোনদিন …….

চিরদিন আমি তার পথ চেয়ে থাকবো।

জীবনটা নষ্ট করে দিবে নূরী?

না না, আমার জীবন নষ্ট হবার নয়, আমার হুর–সেই তো আমার সব।

কিন্তু …

না, কিন্তু নয় রহমান। হুর আমার, আমি তার–আমি তার–আনমনা হয়ে যায় নূরী!

রহমান অলক্ষ্যে রুমাল দিয়ে নিজের চোখ মুছে নেয়।

বলে রহমান–চলো নূরী।

চলো–

নূরী নিজের কক্ষে প্রবেশ করে শয্যা গ্রহণ করে, কিন্তু মন তার চলে গেছে দূরে বহু দূরে সুদূর অতীতে–বনহুরের সঙ্গে ছোট বেলার স্মৃতিগুলো হাতড়ে চলে একটির পর একটি করে। ছোট বেলায় দুজনে বনে বনে লুকোচুরি খেলা। তীর ধুন নিয়ে শিকার করা। নদীতে দুজনে মিলে সাঁতার কাটা। নূরী পাথরখণ্ডে বসে বাঁশি বাজাতো, বনহুর চুপি চুপি পিছন থেকে এসে চোখ দুটো টিপে ধরতো ওর। দুজনে হাসতো খিল খিল করে। কত দিন বন থেকে ফুল তুলে নিয়ে গুঁজে দিয়েছে বনহুর নূরীর খোপায়–এসব কি ভুলবার। শুধু আজ নয়, যেদিন নূরীর চোখে ঘুম আসতো না বা কোন চিন্তার বেড়াজাল তাকে জড়িয়ে ধরতো সে দিন নূরীর মনের পর্দায় ভেসে উঠতো ছোট বেলায় তার আর বনহুরের স্মৃতিগুলো।

১৪.

জানো আর একজন আছে এ কক্ষে? বললো মনিরা।

বনহুর তাকালো কক্ষের চারদিকে, কোথাও কাউকে না দেখে বললো–মশারীর নীচে তো?

হাঁ। বলতো কে?

তোমার নূর।

কি করে জানলে তুমি?

রহমান সব বলেছে।

এসো নূরকে দেখো। মনিরা বনহুরের দক্ষিণ হাত ধরে নিয়ে আসে খাটের পাশে। মশারী উচু করে বলে মনিরা চিনতে পারছো?

নূর পাশ ফিরে এদিকে মুখ করে শুয়ে ছিলো। হাত-ছোট গেঞ্জি গায়েদক্ষিণ হাতখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হাতের বাজুতে সেই চিহ্ন।

বৈদ্যুতিক আলোতে স্পষ্ট দেখলো বনহুর নূরকে, সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো। এ শিশুকেই একদিন সে কাপালিক সন্ন্যাসীর কবল থেকে রক্ষা করে নূরীর কোলে অর্পণ করেছিলো। যদিও কয়েক বছরের ব্যবধান ঘটেছে, তবু বনহুর চিনতে পারে নূরকে। বনহুরের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে অতীতের কয়েকটা ছবি। নূরী শিশুকে কোলে করে খুসীতে আত্মহারা, বলে–হুর, জানো এর নাম রেখেছি মনি! চমকে উঠেছিলো বনহুর, কারণ, তার মা তাকে ঐ নাম ধরে ডাকতো। বড্ড অপেয়া নাম ওটা–বলেছিলো বনহুর। নূরী খোকনের গালে-মুখে চুমো দিয়ে ভরে দিয়েছিলো। তারপর আর একদিন নূরী খোকনটিকে কোলে করে প্রবেশ করেছিলো তার কক্ষে। বনহুরকে লক্ষ্য করে বলেছিল–দেখো দেখো হুর, তোমার দক্ষিণ বাহুর মত আমার মনির হাতেও একটা চিহ্ন।–আজ বনহুরের চোখের সম্মুখে সবগুলো দৃশ্য একের পর এক ফুটে উঠতে লাগলো। নূরীর মনিই মনিরার নূর! আশ্চর্য!

বললো মনিরা–কি ভাবছো?

উঁ।

কি ভাবছো?

নূরকে তুমি কোথায় পেলে মনিরা?

শুনবে, শুনবে তুমি সে কাহিনী?

হাঁ বলো, শুনবো।

বসো।

পাশাপাশি বসলো মনিরা আর বনহুর। মনিরা কিভাবে নূরকে পেয়েছে, সব কথা খুলে বললো বনহুরের কাছে।

অবাক হয়ে সব শুনলো বনহুর, এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো–এ শিশুই সেই মনি, যার জন্য নূরী দিন রাত অশ্রু বিসর্জন করেছে।

মনিরা যখন সব বলছিলো, তখন বনহুর চিন্তা করেছিলো, কথা দিয়েছে সে তার মনিকে এনে দেবে।

বনহুরের মনে নতুন এক অভিসন্ধি উঁকি দিয়ে যায়।

মনিরা বনহুরের জামার বোতাম লাগিয়ে দিতে দিতে বলে–নূরকে আদর করলেনা তো?

আনমনা হয়ে পড়েছিলো বনহুর, বললো–ঘুমুচ্ছে–ঘুমুতে দাও।

বললো মনিরা–সত্যি আমার নুর তোমারই প্রতিচ্ছবি। ওকে নিয়েই আমি বেঁচে আছি।

বনহুরের কানের কাছে ভেসে উঠে নুরীর করুণ কণ্ঠস্বর–মনি যে আমার জীবন। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা।

বনহুর যখন চিন্তা করছিলো নূরীর কথা তখন মনিরা হেসে বললোএকটা কথা বলবো তোমাকে রাখবে?

রাখবো, বলো?

সত্যি?

হুঁ।

মতি মহল হলে ভাল একটা ছবি হচ্ছে, আমাকে নিয়ে যাবে সঙ্গে?

চমকে উঠলো বনহুর, জানে সে মতি মহল হলে এখন কুন্তি বাঈ ছবি চলছে। যদিও সে ছবিটা এখনও দেখেনি কিন্তু শুনেছে এবং পথে স্থানে স্থানে পোষ্টার নজরে পড়েছে। আরও শুনেছে বনহুর-পুলিশ মহলে ভীষণ ভাবে আলোড়ন শুরু হয়েছে। কুন্তিবাঈ ছবির হিরোকে তারা চিনতে পেরেছে এবং এ নিয়ে পুলিশ মহল বেশ উদ্বিগ্ন রয়েছে।

কথাটা জনগণের কানে এখনও পৌঁছেনি, দস্যু বনহুরকে তারা কোনদিন চোখেও দেখেনি, কাজেই তারা কোন রকম দ্বিধা না করে ছবির হিরোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছে।

মনিরার কথায় বনহুর গম্ভীর হয়ে পড়লো, বললো–সে–মনিরা, এ ছবি নাই বা দেখলে।

অভিমান ভরা কণ্ঠে বলে মনিরা। কেনো, এ ছবি দেখতে তোমার আপত্তি কিসে?

না, আপত্তি ঠিক নয়। তবে শুনেছি, এ ছবি নেহাত মন্দ।

মানে আমার দেখার অনুপযোগি, এইতো? কিন্তু তুমি যতই বলল। ছবিটা আমি দেখবো-তুমি নিয়ে যাবেনা আমাকে?

এতোই যদি সখ তাহলে আমার সঙ্গে না গিয়ে আর কারো সঙ্গে যাও।

উঁ হুঁ, তোমার সঙ্গে কোনদিন ছবি দেখিনি।

আমাকে তুমি বিপদে ফেলতে চাও?

তোমার বিপদ সে তো আমার মাথায় বজ্রাঘাত—

তবে কেনো জেদ করছো মনিরা?

বড় সখ এ ছবি তোমাকে সঙ্গে করে দেখবো।

বেশ। গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর।

মনিরা খুশি হলো-সত্যি তো? কথা দিলে?

দিলাম।

এর পর বিদায় চাইলো বনহুর মনিরার কাছে।

আজ মনিরা খুশি মনে বিদায় দিলো বনহুরকে।

১৫.

নূরের গায়ের উপর হাত রেখে ঘুমিয়ে আছে মনিরা।

আজ মনিরার মুখে নেই কোন বিষাদের কালো ছায়া। উজ্জ্বল দীপ্ত মুখে ঘুমিয়ে আছে সে। স্বামীর চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে হয়তো মনিরা।

এমন সময় পিছনের জানালা দিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর। অতি সন্তর্পণে এগিয়ে গেলো সে মনিরা আর নূরের বিছানার পাশে।

আজ শরীরে বনহুরের দস্যু ড্রেস।

জমকালো পোশাকে দেহ আচ্ছাদিত। মাথায় কালো পাগড়ি মুখে গালপট্টি বাধা। পায়ের জুতোও জমকালো পালিশ করা।

বনহুর মনিরার শিয়রে এসে দাঁড়ালো।

প্যান্টের পকেট থেকে বের করলো একটা রুমাল.। রুমালখানা ধীরে ধীরে মনিরার নাকের কাছে ধরলো, তারপর নূরের নাকে।

এবার রুমালখানা পকেটে রেখে নূরের দেহের উপর থেকে মনিরার হাতখানা আলগোছে সরিয়ে ফেললো বনহুর। তারপর দ্রুত নূরকে তুলে নিলো কোলে।

মনিরার দেহের চাদরখানা সরে গিয়েছিলো ফেললো এক পাশে।

বনহুর বাম বাহুতে নূরকে বুকের সঙ্গে এটে ধরে, দক্ষিণ হস্তে মনিরার গায়ে চাদরখানা টেনে দিলো। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

চৌধুরী বাড়ির অদূরে অন্ধকারে অপেক্ষা করছিলো তাজ।

বনহুর নূরকে নিয়ে তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো, কৌশলে উঠে বসলো : তাজের পিঠে।

সঙ্গে সঙ্গে তাজ ছুটতে শুরু করলো।

সূচিভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে বনহুর নূরকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। শহর ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে এগুচ্ছে বনহুর–তারপর বনাঞ্চল।

আস্তানায় পৌঁছতে প্রায় ভোব হয়ে এলো বনহুরের। নূরী তখনও ঘুম থেকে উঠেনি। বনহুর প্রবেশ করলো নূরীর কক্ষে, ধরে ধীরে নূরকে শুইয়ে দিলো নূরীর পাশে।

জেগে উঠলো নুরী, চোখ মেলে তাকিয়ে বিস্মিত হলো–তুমি! সঙ্গে সঙ্গে পাশে নজর পড়তেই আশ্চর্য কণ্ঠে বললো–এটা কে?

বনহুর হেসে বললো–তোমার মনি।

মনি।

হাঁ।

নূরী উঠে বসে ভাল করে লক্ষ্য করলো–তার মনি যখন হারিয়ে গিয়েছিলো, তখন ছিলো সে ছোট্ট এক রত্তি। এক পা দুপা করে কেবল হাটতো। আর আজ বেশ বড়সড় হয়ে গেছে। নূরী তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক করে দেখতে লাগলো–দক্ষিণ হাতের বাজুতে নজর পড়তেই নিসন্দেহ হলো সে। ঘুমন্ত নূরকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো, আদর করে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো ওকে।

বনহুর মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো।

নুরী যখন নূরের ঘুম ভাঙ্গনোর জন্য ভীষণ ভাবে চেষ্টা করছে তখন বললো বনহুর সময় হলে নিজেই জাগবে। এখন ওকে ঘুমোতে দাও।

নূরী আলগোছে বালিশে শুইয়ে দিয়ে নিষ্পলক নয়নে তাকিয়ে রইলো নূরের মুখের দিকে।

১৬.

মনিরার যখন জ্ঞান ফিরে এলো, দেখলো তার শয্যার পাশে মরিয়ম বেগম, সরকার সাহেব, নকীব আরও বাড়ির চাকর-বাকর সবাই অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম বেগম বসে আছেন তার শিয়রে, বার বার তিনি আচলে, চোখ মুছছেন।

মনিরা চোখ মেলে তাকিয়ে বিস্মিত হলো। মামীমা, সরকার সাহেবএরা সব এখানে কেনো! সবাই কাঁদছে–ব্যাপার কি? তবে কি তার কোন অসুখ হয়েছিল? তাই হয়তো হবে, মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব।

বললো মনিরা–কি হয়েছে আমার?

ডাক্তার একটু পূর্বে বারণ করে গেছেন–যতক্ষণ রোগি সম্পূর্ণ সুস্থ না হয় ততক্ষণ ওর কাছে কোন রকম কথা বলবেন না। নূরকে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে–একথা একেবারে চেপে যাবেন।

ডাক্তারের কথাগুলো স্মরণ করে কোন কথাই বললেন না মরিয়ম বেগম।

সরকার সাহেব শুধু বললো–কিছুই হয়নি, তুমি ঘুমোও মা।

মনিরা চোখ বন্ধ করলো বটে কিন্তু ঘুম আর এলো না।

মনিরা সম্পূর্ণ সুস্থ হলো এক সময়।

উঠে বসলো শয্যায়, মামীমাকে ডেকে বললো আমার কি হয়েছিলো মামীমা?

কিছু হয়নি।

আমার নূরকে দেখছিনা কেনো?

মরিয়ম বেগমের দুচোখ ছাপিয়ে পানি আসছিলো, অতিকষ্টে নিজেকে সংযত রেখে বললেন–সরকার সাহেব ওকে বাইরে নিয়ে গেছেন।

এ অসময়ে নূরকে পাঠালে কেনো মামীমা?

তুই সুস্থ নস, তাই ও বিরক্ত করবে বলে……মিথ্যা বলতে বড় কষ্ট হচ্ছিলো মরিয়ম বেগমের–তবু বললেন, না বলে যে কোন উপায় ছিলোনা।

কিন্তু কতক্ষণ ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখবে বা রাখতে পারবে। এদিকে মনিরা পুত্র নূরের জন্য অস্থির হয়ে পড়লো।

মরিয়ম বেগম কি করে বলবেন, রাতে নরকে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। সরকার সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করলেন, এবং তাকেই বললেন। কথাটা বলতে।

মনিরা নকীবকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো–হারে নকীব, আমার নূর কোথায়? ওকে দেখছিনা কেনো?

নকীব কাঁধের গামছাটায় চোখ মুছে নিয়ে তাকালো এদিক ওদিক, তারপর ফিস ফিস করে বললো নকীব–বলতে মানা করে দিয়েছেন ডাক্তার সাহেব….

নকীবের কথায় মনিরা ভীত হয়ে পড়লো–ওর বলার ভঙ্গী দেখে বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই তার নূরের কোন অমঙ্গল ঘটেছে। আর্তকণ্ঠে বললো মনিরা আমার কাছে লুকোচ্ছিস কেনো, বল্ বল্ নকীব, আমার নূর কোথায়? কি হয়েছে তার? বল্ বল্‌…..

নকীবের জামার খানিকটা অংশ চেপে ধরলো মনিরা।

নকীব না বলে আর পারলো না–আপামনি, নুরকে কাল রাত কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে।

চীৎকার করে উঠলো মনিরা–আমার নূরকে চুরি করে নিয়ে গেছে ….. পাশের কক্ষ থেকে ছুটে এলেন মরিয়ম বেগম এবং সরকার সাহেব। মনিরা তখন মাথা ঠুকছে খাটের সঙ্গে, নূর–নূর–নূর….আমার নূর–

মরিয়ম বেগম দ্রুত এসে মনিরাকে ধরে ফেললেন, বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–একি করছিস মা? শোন, শোন–

না না, বলল আমার নূর কোথায়, আমার নূর কোথায়। বলো মামীমা, আমার নূর …..

জানিনা মা–কিছুই জানিনা।

বলো মামীমা, আমার নূর কই?

মরিয়ম বেগম বললেন–ভোরে অনেক বেলা হয়ে গেলো তবু তুই দরজা খুলছি না। আমি মনে করলাম, ঘুমোচ্ছিস বুঝি–তাই নকীবকে বললাম তোকে জাগাতে। নকীব তো দরজায় অনেক ডাকাডাকি করেও তোকে জাগাতে পারলোনা। শেষ পর্যন্ত আমিও অনেক করে তোকে ডাকলাম, তখনই মনে আমার ভয় আর দুর্ভাবনা উঁকি দিয়ে গেলো। সেকি, আজ নরও তো জাগছেনা, ব্যাপার কি হলো! তারপর সরকার সাহেব এলেন, সবাই এলো। দরজা ভেংগে ভিতরে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হতবাক হলাম, তুই একা বিছানায় অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছিস্–পাশে নূর নেই। ওদিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম–পিছন শাসী খোলা।

মনিরা চীৎকার করে কেঁদে উঠলো–মামীমা, মামীমা আমার নূর তাহলে চুরি হয়ে গেছে! আমার নুরকে কে নিয়ে গেছে, কে নিয়ে গেছে—

গোটাদিন কাঁদা-কাটা করে কাটলো মনিরার। এ বাড়ির সবাই শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়লো।

সবাই অনেক করেও মনিরাকে কিছু খাওয়াতে পারলোনা।

সরকার সাহেব থানায় ডায়রী করে দিয়ে এলেন।

থানা অফিসার নতুন লোক, তিনি আশ্বাস দিলেন, নূরকে খুঁজে বের করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।

এদিকে মনিরা যখন নূরের জন্য উন্মাদিনী প্রায় হয়ে পড়েছে, বনহুরের আস্তানায় তখন নূরী মনিকে নিয়ে মেতে উঠেছে–আনন্দে আজ সে আত্মহারা।

মনি যতই কাঁদছে, আমাল মাল কাছে দাবো–আমার মাল কাছে দাবো–নূরী ততই এটা-ওটা খেলনা–খাবার দিয়ে তাকে ভোলাতে চেষ্টা করতে লাগলো।

বনহুর আনন্দে আপ্লুত হলো, নূরীর মুখে হাসি ফুটেছে।

নূরী মনিকে নিয়ে দোলনায় দোল দিতে লাগলো, গান গাইতে লাগলো। ফুলের মালার মুকুট তৈরি করে মাথায়-গলায় পরিয়ে দিতে লাগলো। নূরী মনিকে পেয়ে খুশিতে ডগমগ।

মনি কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁদা ভুলে অবাক হয়ে নূরীর কাণ্ড কলাপ দেখতে লাগলো।

সেই ফাঁকে সরে পড়লো বনহুর। মনিরার হৃদয়ে ব্যথা দিয়ে বনহুর নূরকে চুরি করে এনেছে। বাপ হয়ে পুত্রকে হরণ করে এনেছে সে মায়ের বুক থেকে। শুধু নূরীকে খুশি করবার জন্যই একাজ করেনি বনহুর, নূরীর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এটা একটা উপায়।

নুরী ভুলে থাকবে তার মনিকে নিয়ে, বনহুরের চলার পথে সে আর বাধার সৃষ্টি করবেনা।

নুরী যখন মনিকে নিয়ে মেতে আছে তখন বনহুর রহমানকে সঙ্গে করে দরবার কক্ষে প্রবেশ করলো।

সেখানে রহমান ও তার অন্যান্য অনুচরদের সঙ্গে কিছু আলাপ আলোচনা হলো।

রহমানকে আরও কিছু বললো বনহুর। রহমান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।

বনহুর একবার নিজের কক্ষে প্রবেশ করে স্বাভাবিক ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নিলো। স্যুট প্যান্ট-টাই, মাথায় ক্যাপ পরে নিলো সে।

রহমান দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো, তার শরীরে সাধারণ ভদ্র ড্রেস। অদূরে অপেক্ষা করছিলো তাজ আর দুলকি।

বনহুর আর রহমান অশ্বদ্বয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। বনহুর চেপে বসলো তাজের পিঠে, আর দুলকির পিঠে রহমান।

বনবাদর, জঙ্গল-মাঠ অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে বনহুর আর রহমান। বনপথ শেষ হতেই পথের বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মোটরকার।

বনহুর আর রহমান নিকটে পৌঁছতেই ড্রাইভার আসন ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো।

বনহুর তাকে জিজ্ঞাসা করলো—যে ভদ্রলোকদ্বয় হোটেল গুল বাগে ছিলো, তাদের সরানো হয়েছে?

হাঁ, সরানো হয়েছে।

কিভাবে এ কাজ তোমরা করলে মহসীন?

সর্দার। অনেক কৌশলে তাদের সরিয়েছি, তাদের ড্রাইভারকে সরিয়ে আমি ড্রাইভার সেজে গাড়িতে বসেছিলালাম।

তারপর?

লোক দুজন বাইরের কোন কাজে বেরুবে বলে তখনকার মত গাড়িতে এসে বসলো। আমি জানতাম তারা এ শহরে নতুন-কাজেই পথঘাট তাদের তেমন চেনা নাই। সেই সুযোগ নিয়ে আমি তাদের আমাদের শহরের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রেখেছি।

সাবাস! বললো রহমান।

বনহুর বললো–ওদের কোন কষ্ট দাওনি তো?

না সর্দার।

এবার বনহুর আর রহমান গাড়িতে চেপে বসলো।

ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো মহসীন।

বনহুরের শহরেও একটা গোপন বাড়ি ছিলো। এ বাড়িখানা পূর্বের সেই বাড়িখানার চেয়ে অন্য ধরনের। শহরের প্রায় মাঝামাঝি কতগুলো দোকানপাট আছে, তারই পিছনে বাড়িটা।

বাড়িখানার আশে-পাশে আরও কতগুলো বাড়ি আছে। সেগুলোতে লোক বসবাস করে। কাজেই এ বাড়িখানা যে দস্যু বনহুরের একটা গোপন আস্তানায়, এটা কেউ সন্দেহ করতে পারে না।

এখানেও বনহুরের কিছু সংখ্যক অনুচর গুপ্তভাবে লুকিয়ে থাকে। অবশ্য একেবারে গোপনভাবে থাকে না, ছদ্মবেশে শহরে তারা ছড়িয়ে থাকে এখানে সেখানে। নানা ভাবে এরা নানা ধরনের সংবাদ সংগ্রহ করে এবং সেভাবে কাজ করে তারা।

রহমান এদের দ্বারাই সংবাদ সংগ্রহ করতে পেরেছে হোটেল গুলবাগে নানা রকম অনাচার ও দুষ্কর্ম সংঘটিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বিদেশি লোকরা এখানে গোপনে নানা রকম ভেজাল ঔষধ পত্র পরিবেশন করে থাকে।

চোরের সঙ্গেই চোরের বন্ধুত্ব, কাজেই যত শয়তান আর দুষ্কর্মকারীর দল এখানে আনাগোনা করে থাকে।

মহসীন ও আর কয়েকজন অনুচর আজ যে লোক দুটিকে তাদের আস্তানায় আটক করেছে তারা মারাত্মক ঔষধ ব্যবসায়ী। বাইরের দেশ থেকে নানা ধরনের বিষাক্ত ঔষধ এনে এদের হাতে তুলে দেয় এবং প্রচুর অর্থ নিয়ে যায় এরা এসব দেশ থেকে।

কান্দাই শহরে এ ধরনের নানা ব্যবসায়ীর আমদানী হয়ে থাকে গুলবাগ হোটেলে।

আজ দুজনাকে আটক করতে সমর্থ হয়েছে বনহুরের দল। লোক দুটির একজনের নাম ডক্টর হংকিং রাও, দ্বিতীয় জন ডক্টর মং লাও। এবার এরা প্রচুর বিষাক্ত এবং ভেজাল ঔষধ এনেছিলো, মহব্বৎ খ এসব ঔষধ রেখেছে। পরে শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রে পাঠানো হবে। ইতিমধ্যে হসপিটাল ও অনেক চিকিৎসা কেন্দ্রে বহু রোগি এ সব ধরনের ঔষধ সেবনে এবং ইনজেকশানে মৃত্যু বরণ করেছে।

সব সংবাদই বনহুরের কানে এসে পৌঁছেছে।

তাই বন আজ স্বয়ং বের হয়েছে এসব সন্ধানে।

বনহুর আর রহমানের গাড়ি এসে পৌঁছলো তার শহরের গোপন আস্তানায় সম্মুখে।

বনহুর আর রহমান নেমে পড়লো।

অন্তপুরে প্রবেশ করতেই দুজন রাইফেলধারী অনুচর বনহুরকে অভিবাদন জানালো।

বাড়িটা বাইরে থেকে স্বাভাবিক মনে হলেও ভিতরে স্বাভাবিক ছিলোনা। পর পর কয়েকখানা ঘর পেরিয়ে একটা ভোলা ছোট্ট উঠান–তার পরই আর একটা বড় ঘর। ঘরটা সুন্দর করে সাজানো। কিছু সংখ্যক বই পুস্তক থরে থরে সাজানো আলমারীতে। এরই একটা আলমারীর পিছনে রয়েছে। গুপ্ত সিঁড়ি।

বনহুর আর রহমান সহ মহসীন এই আলমারীটার পাশে এসে একটা স্থানে পা দিয়ে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে আলমারীটা একদিকে সরে গেলো। ধীরে ধীরে।

বেরিয়ে এলো সুন্দর একটা সিঁড়ি পথ।

বনহুর আর রহমান এ পথে অগ্রসর হলো। মহসীন পিছনে চললো। সিঁড়িটা বৈদ্যুতিক আলোতে আলোকিত রয়েছে, কোন অসুবিধা হলোনা, বনহুর আর রহমানের।

সিঁড়ি বেয়ে নীচে একটা কক্ষে এসে উপস্থিত হলো তারা। কক্ষটা বেশ বড়, কক্ষ মধ্যে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। এক পাশে লৌহ শিক পরিবেষ্টিত খানিকটা জায়গা। সে জায়গায় বন্দী রয়েছে দুজন ভদ্রলোক।

লোক দুজনের চোখে মুখে দুর্ভাবনার ছাপ ফুটে উঠেছে। দুখানা চেয়ারের সঙ্গে লোক দুজনাকে বেধে রাখা হয়েছে মজবুত করে।

বনহুর এসে দাঁড়ালো এদের সম্মুখে।

রহমান বললো-সর্দার, এর নাম ডক্টর হংকিং আর ওর নাম মং লও।

বনহুর তীব্র চোখে তাকিয়ে দেখছিলো দুজনাকে। বললো সে-হুঁ।

মহসীন বললো এবার-সর্দার, এরা শুধু ঔষধের কারবারই করেনা, নিজেদের কোম্পানিতে এরা নানা রকম ভেজাল, বিষাক্ত ঔষধ তৈরি করে।

দাঁতে দাঁত পিষে বললো বনহুর অত্যন্ত লাভকর ব্যবসা।

বনহুর আর রহমানকে দেখে ডক্টর হংকিং রাও আর মং লাও খুশি হয়েছিলো, মনে করেছিলো মহব্বৎ আলীর লোক এরা। পর মুহূর্তে ভীত ভাবে তাকাতে লাগলো ওরা, বনহুর আর রহমানের দিকে।

বনহুর বললো-রহমান, এদের আমার গুম্ ঘরে নিয়ে চলো, সেখানে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করবো।

বনহুর দাঁড়িয়ে রইলো, রহমান ওদিকের একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের মেঝেটা দুলে উঠলো। তারপর মেঝেটা সাঁ সাঁ করে নেমে গেলো কয়েক ফিটু নীচে।

বৃন্দীদ্বয় এবং রহমান ও বনহুর যেমন দাঁড়িয়ে ছিলো তেমন রয়েছে। মহসীনও আছে তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে।

বনহুরের আদেশে বন্দীদ্বয়কে লৌহ শিক বেষ্টিত স্থান থেকে বের করে আনা হলো।

বনূহুর একটা আসনে উপবেশন করলো।

বন্দীদ্বয় সম্মুখে দন্ডায়মান।

রহমান হাতে তালি দিতেই দুজন বলিষ্ঠ লোক হাজির হলো।

বনহুর ইংগিৎ করতেই বলিষ্ঠ লোক দুজন ডক্টর হংকিং ও মং লাও এর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। লোক দুটির হস্তে দুটি সুতীক্ষ্ণ লৌহদন্ড।

বনহুর বললো–ডক্টরদ্বয়, আমি যা জিজ্ঞাস করছি তার সঠিক জবাব দাও, নচেৎ…ঐ লৌহ শলাকা দিয়ে তোমার জিহ্বা ছেদন করা হবে।

ডক্টর হংকিং এর মুখে কোন ভীত ভাব ফুটে না উঠলেও ডক্টর মং লাও এর মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠলো।

বনহুর কিছু ভাববার অবসর না দিয়ে গর্জে উঠলো–মহববৎ আলীর সঙ্গে কত দিন হলো তোমাদের যোগাযোগ?

হংকিং কিছু বলবার পূর্বেই বললো মং লাও-সত্য কথা বললে ছেড়ে দেবেন তো?, বনহুর বললো নিশ্চয়ই দেবো। আর মিথ্যা বললে ঐ লৌহ শলাকা দিয়ে তোমাদের জিহ্বা ছেদন করবো।

না না, আমাদের জিহ্বা ছেদন করবেন না, সব সত্য কথা বলবো-যা জিজ্ঞাসা করবেন, সব বলবো।

ডক্টর হংকিং রক্তচক্ষু মেলে তাকাতে লাগলো মং লাও এর দিকে। রহমান এবার বললো–জবাব দাও, যা জানতে চাওয়া হলো?

মংলাও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, হংকিং বলল–আমাকে বলতে দাও মংলাও।

মং লাও যে কথা বলতে যাচ্ছিলো তা আর বলা হলো না। বললো হংকিং–মহববং আলীকে আমরা চিনি না–

গর্জে উঠলো বনহু–চেনো না! মহববৎ আলীর সঙ্গে তোমাদের যোগাযোগ নেই বলতে চাও–

হাঁ আমি-মানে আমরা তাকে চিনি না। আমরা অন্য কাৰ্য্য উপলক্ষে তার হোটেলে উঠেছিলাম।

বেশ, সেখানে থেকে ফিরে এসে তোমার সত্যতার পুরস্কার দেবো।

বনহুর উঠে দাঁড়াল।

রহমান ইঙ্গিত করতেই লৌহ শলাকা হস্তে বলিষ্ঠ লোকদ্বয় বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে হংকিং রাও ও মংলা বন্দী হলো লৌহ আবেষ্টনীর মধ্যে।

রহমান একটা মেসিনে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটা সাঁ সাঁ করে উঠে আসতে লাগলো উপরের দিকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে পূর্বের স্থানে মেঝেটা এসে স্থির হলো।

বনহুর আর রহমান বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

মহসীন কৌশলে লৌহ দরজা বন্ধ করে দিলো।

বনহুর আর রহমান গাড়িতে এসে বসলো।

রহমানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর-আমার ব্যাগটা গাড়ির মধ্যে আছে তো?

হাঁ, সর্দার, আছে।

হোটেল কক্ষে প্রবেশ করলো বনহুর আর রহমান।

এখন তাদের শরীরে ভিন্ন ড্রেস। বনহুরকে দেখলে ঠিক ডক্টর হংকিং রাও এবং রহমানকে ঠিক ডক্টর মং লাও বলে মনে হবে।

বনহুর আর রহমান যখন হোটেল গুলবাগে এসে পৌঁছলো তখন হোটেলের দারোয়ান ছালাম জানিয়ে বললো-সাহাব, আপ-লোক কাহা গিয়াথা। হুজুর আপ লোক কা খাতির মে বহুত পেরেশান হওয়া ….

বনহুর আর রহমান কোন কথা না বলে মহববৎ আলীর ক্যাবিনে প্রবেশ করলো।

মহববৎ আলী তার নিজস্ব কামরায় ব্যস্তভাবে পায়চারী করছিলো।

ডক্টর রাও ও মংলাওকে দেখে মহববৎ আলী থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো-আপনারা কোথায় ডুব দিয়েছিলেন বলুন তো? এতো রাত হলো, আপনাদের টাকা-পয়সা চুকিয়ে দিয়ে বাসায় যাবো। আমার মেয়ে পারভিনের অসুখ কিনা!

বনহুর ইতিপূর্বে ডক্টর হংকিং রাও এর কণ্ঠস্বর নকল করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো, মাথার ক্যাপটা আর একটু সম্মুখে টেনে দিয়ে বললো-একটা বিপদে পড়েছিলাম, বেঁচে গেছি।

আশ্চর্য হলো মহববৎ আলী-বিপদ! কি বিপদে পড়েছিলেন আপনারা?

দস্যু বনহুর আমাদের সন্ধান পেয়েছে–আমরা এ হোটেলে আছি।

দস্যু বনহুর?

হাঁ,দস্যু বনহুর। সে-ই আমাদের আটক করেছিলো, অতি কষ্টে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।

বলেন কি, দস্যু বনহুর তাহলে….

হাঁ, আবার তার আবির্ভাব ঘটেছে। মংলাও–বেশি রহমান বনহুরের কথায় খুশি হরত পারলো না, কারণ এ কথাটা বলায় দেশবাসী আবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তাছাড়া পুলিশ মহলেও সাড়া পড়ে যাবে। বনহুর এখন তবু ছদ্মবেশে শহরের নানা স্থানে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে তখন রাতের অন্ধকার ছাড়া আর উপায় থাকবেনা।

কিন্তু সর্দার যা ভাল বুঝবে তাই তো করবে। রহমান উসখুস করছিলো। বনহুর তার পায়ে মৃদু আঘাত করলো।

কাজেই আজ রাতের প্লেনেই আমরা কান্দাই ত্যাগ করতে চাই।

বনহুর বার বার ভীত ভাবে বাইরের দরজার দিকে তাকাতে লাগলো।

মহববৎ আলী বললো-তাহলে তো ভয়ঙ্কর কথা। দস্যু বনহুর যদি আপনাদের কিছু নিয়ে থাকে তাহলে আমার হোটেল অবধি ধাওয়া করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

তাই তো আমার মনে হচ্ছে….

আসুন, আপনাদের টাকা-পয়সা সব গুছিয়ে নিন।

চলুন, আর মোটেই বিলম্ব করতে পারছিনা।

মহববৎ আলী হংকিং বৈশি বনহুর এবং মংলাওবৈশি রহমান সহ পাশের কামরায় গেলো। এ কক্ষেই ঔষধের বাক্সগুলো থরে থরে সাজানো ছিলো।

মহববৎ আলী যখন টাকার ব্যাগটা হংকিং রাও এর হাতে তুলে দিচ্ছিলো তখন হংকিং বেশি বনহুর চারদিকে এক নজর দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলো।

টাকার ব্যাগ হাতে নিয়ে বনহুর দরজার দিকে পা বাড়ালো, মহববৎ আলী বলে উঠলো –আপনাদের স্যুটকেস এবং বেডিং–পত্র রইলো যে…

হংকিং রাও বললো-যেতে দিন ও সব। দস্যু বনহুর যদি এসে পড়ে তাহলে প্রাণ নিয়ে পালানো মুস্কিল হবে…।

হংকিং বেশি দস্যু বনহুর আর মংলাও বেশি রহমান গাড়িতে চেপে বসলো।

হোটেলের দরজায় দাঁড়িয়ে মহববৎ আলী হাত নেড়ে তাকে বিদায় সাষণ জানিয়ে বললো–আবার আসবেন তো?

বনহুর বললো ড্রাই আসন থেকে অচিরেই আবার দেখা হবে বন্ধু…

গাড়ির শব্দে আর কিছু শোনা গেলনা।

পিছন আসনে রহমান আর ড্রাইভার বসে রইলো শুদ্ধ হয়ে।

সর্দারের কান্ডকলাপ দেখতে লাগলো তারা নির্বাক নয়নে।

শহরের পথ ধরে বনহুরের গাড়ি উল্কা বেগে ছুটে চললো।

১৭.

কেঁদে কেঁদে মনিরা নাজেহাল হয়ে পড়েছে। একেবারে পাগলিনীর মত। সেদিনের পর থেকে কেউ তাকে দানা-পানি খাওয়াতে পারেনি। অহঃরহ। চোখের পানি বিসর্জন করে চলেছে মনিরা।

গভীর রাত।

মনিরা ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। কদিন অবিরত কাঁদাকাটা করে একেবারে যা তা হয়ে গেছে।

পাশের কক্ষে মরিয়ম বেগম-এখনও তার চোখে ঘুম আসে নি। নানা চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন তিনি। স্বামীর কাছ থেকে আজ পর্যন্ত যা ঘটেছে বা ঘটছে সব স্মরণ হচ্ছে একটির পর একটি করে। মরিয়ম বেগম কোন দিন কি ভেবেছিলেন-তার অমন মহানুভব স্বামী তোক চক্রান্তে নিহত হবেন। কে তাকে হত্যা করেছিলো, কেনই বা করেছিলো–আজও জানেন না তিনি। তারপর নিজ সন্তান আজ সভ্য সমাজের সৎ ব্যক্তি না হয়ে হয়েছে দস্যু-ডাকু। লোক সমাজে তার স্থান নেই। মনিরাকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিলেন, ওকে বিয়ে দিয়ে সন্তানকে আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে আশাও তার পুর্ণ হয়নি। দস্যু সন্তানকে মায়ার বন্ধনে বাঁধতে চেয়েও পারেনি। মরিয়ম বেগমের চোখের পানিতে বালিশ সিক্ত হয়ে উঠলো।

এশার আযান থেমে গেছে অনেকক্ষণ। দেয়াল ঘড়িটা টিক্ টিক শব্দে এগিয়ে চলেছে সীমাহীন অজানার পথে।

মরিয়ম বেগমের নিদ্রাহীন আঁখি দুটি অন্ধকারে ছল ছল করে উঠে বুক চীরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মনে মনে খোদার নাম স্মরণ করেন–হে দয়াময়, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক…

হঠাৎ মরিয়ম বেগম চমকে উঠেন, শুনতে পান মনিরার কক্ষে একটা চাপা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর। মরিয়ম বেগমের চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, তিনি কান পেতে চুপ করে রইলেন।

পাশের কক্ষ থেকে ভেসে এলো আবার–মনিরা, মনিরা আমি এসেছি—মনিরা—

মনিরার কণ্ঠস্বর কে–কে তুমি–ওগো তুমি এসেছো?–সঙ্গে সঙ্গে মনিরার কান্নার শব্দ শোনা গেলো। পর মুহূর্তেই ক্রন্দন রত কণ্ঠ মনিরার আমার নূর নেই, কে তাকে চুরি করে নিয়ে গেছে….

আমার নূর নেই….

নীরব নিস্তব্ধ বনহুর, কোন কথা বললো না সে।

মনিরা স্বামীর বুকে মাথা ঠুকতে লাগলো। আমার নূর নেই। ওকে কারা সুরি করে নিয়ে গেছে—ওগো আমি কি নিয়ে বাঁচবো–আমি কি নিয়ে বাঁচবো–কান্নায় ভেংগে পড়ে মনিরা।

এতোক্ষণে কথা বলে বনহুর–মনিরা, এতো ভেংগে পড়লে চলবে কেনো? নূর তোমার সন্তান, কেউ তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে ধরে রাখতে পারবেনা। একদিন সে ফিরে আসবে তোমার পাশে…

আমি সে কথা শুনতে চাইনা, বলো আমার নূরকে তুমি খুঁজে এনে দেবে? বললা……ওগো বলো? বনহুরের জামা চেপে ধরে মনির।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো–মনিরা, একটা কথার জবাব দাও আমাকে?

বলল, বলো তুমি? নূরকে চাও না আমাকে?

চিত্রাপিত্যের ন্যায় তাকায় মনিরা স্বামীর মুখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *