কান্তকবি
‘স্নেহ-বিহ্বল, করুণা-ছলছল,
শিয়রে জাগে কার আঁখিরে।
মিটিল সব ক্ষুধা সঞ্জীবনী সুধা।
এনেছে, অশরণ লাগিরে।’…
সেই রজনীকান্ত সেন। যিনি সেই বঙ্গভঙ্গের বছরে, উনিশশো পাঁচ সালে, গান বেঁধেছিলেন, ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’। রাজশাহির পল্লীকবি বাংলার জাতীয় কবি হয়েছিলেন।
রজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ছিলেন। পাবনা জেলায় বাড়ি, ওকালতি করতেন রাজশাহিতে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন, সাঁতারে ব্যায়ামে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। অসামান্য সংগীতস্রষ্টা, সুরকার, গায়ক রজনীকান্ত এখনও রবীন্দ্রনাথ-অতুলপ্রসাদ-নজরুলের সঙ্গে স্মরণীয়।
কিন্তু এই ‘শেষমেশ’ রচনামালায় আমরা তাঁকে এতকাল পরে স্মরণ করছি তাঁর কৌতুকবোধের জন্যে। মধ্যযৌবনে, তাঁর প্রতিভা সূর্য যখন মধ্যগগনে তখনই তিনি দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে দেহত্যাগ করেন। তবু তাঁর গানের মতোই কৌতুককুসুমগুলি বাঙালির মানস-সলিলে এখনও ভাসমান।
সে আমলে অনেকেই নানা কারণে, বিশেষত পুত্রার্থে একাধিকবার বিবাহ করতেন। আইনের বাধা ছিল না, সামাজিক বিধিনিষেধও ছিল না। শিক্ষিত ভদ্রলোকের দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ সমাজের চোখে গর্হিত অপরাধ ছিল না।
এক বন্ধুর দ্বিতীয় পক্ষের বিয়েতে রজনীকান্ত বরযাত্রী গিয়েছিলেন। এই দ্বিতীয় পক্ষের বিয়ে কিন্তু প্রথমা স্ত্রী বর্তমান অবস্থাতেই। বিয়ের পর বর-বউ নিয়ে ফেরার পথে নতুন বউয়ের জ্বর এল।
সে ছিল গভীর জ্বরের যুগ। কালাজ্বর, পালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, সান্নিপাতিক, পিলেজ্বর, তিলেজ্বর। বাঙালি সারা বছর ধরে জ্বরে ভুগত।
রজনীকান্তের বন্ধু নববধূর সঙ্গে সামনে নৌকায় ছিলেন। সেকালে বঙ্গজীবনের অঙ্গ ছিল থার্মোমিটার। নববধূর দেহতাপ থার্মোমিটারে মেপে উদ্বিগ্ন চিত্তে সামনের নৌকো থেকে বর পিছনের নৌকোয় বরযাত্রী রজনীকান্তকে বললেন, ‘নতুন বউয়ের খুব জ্বর।’
রজনীকান্ত জানতে চাইলেন, ‘কত জ্বর ?’
বন্ধুবর বললেন, ‘থার্মোমিটারে দেখছি একশো তিন।’
রজনীকান্ত বললেন, ‘আগেও এক সতীন। এখনও একশো তিন।’
রজনীকান্ত ওকালতি করতেন রাজশাহি আদালতে।
কিন্তু নিজের সম্পর্কে কিংবা নিজের জীবিকা বিষয়ে তাঁর কোনও মোহবোধ ছিল না।
এই প্রসঙ্গে রাজশাহি আদালতের বার লাইব্রেরিতে কথিত রজনীকান্তের অনেক গল্পই আজও স্মরণীয়। সংক্ষেপে দুয়েকটি গল্প বলি।
এক গ্রাম্য ব্যক্তি দুটো গোরু নিয়ে যাচ্ছে। একটি গোরু হৃষ্টপুষ্ট অন্যটি ক্ষীণ। সেই একই রাস্তা দিয়ে জনৈক ব্যবহারজীবী যাচ্ছিলেন। তিনি চাষিকে বললেন, ‘ওহে তোমার একটা গোরু এত মোটা আর অন্যটা দেখছি খুবই রোগা। তুমি ভাল করে ওটাকে খেতে দাও না কেন?’ সেই শুনে চাষি বলল, ‘না উকিলবাবু, তা নয়। আসলে আমার ওই যে মোটা ষাঁড়টা দেখছেন ওটা হল উকিল। আর, ওই রোগা ষাঁড়টা হল মক্কেল। বুঝলেন তো উকিলবাবু।’
উকিল-মক্কেল বিষয়ে রজনীকান্তের আর একটি অসামান্য কাহিনী; এই গল্পটি কথোপকথনের আকারে না লিখলে হবে না:—
উকিলবাবু: বিয়ের সময় তোমার বয়েস কত ছিল?
মক্কেল: আজ্ঞে, সতেরো বছর।
উকিলবাবু: তখন তোমার স্ত্রীর বয়েস কত ছিল?
মক্কেল: আজ্ঞে, তেরো বছর।
উকিলবাবু: এখন তোমার বয়স কত?
মক্কেল: আজ্ঞে, তিরিশ বছর।
উকিলবাবু: এখন তোমার স্ত্রীর বয়েস কত?
মক্কেল: আজ্ঞে, সে প্রায় ছেচল্লিশ, সাতচল্লিশ অন্তত হবে।
উকিলবাবু: সে কী হে? তোমার বউয়ের বয়স হঠাৎ বেশি হয়ে গেল কেমন করে?
মক্কেল: হুজুর, ওই কথাটাই যে কোনও ভদ্রলোককে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না। মেয়েমানুষের বাড় যে বড় বেশি।
সত্যিই এই কথোপকথনের কোনও তুলনা নেই। যে কোনও নাটকের যে কোনও দৃশ্যে এই কথোপকথনটা থাকলে শুধু এই বাক্যালাপের জোরেই সেই নাটকটি উতরিয়ে যাবে। উকিল রজনীকান্তের পরে অবশেষে কবি রজনীকান্তের কাছে যাই।
কবি রজনীকান্তের একটি কাহিনী বলি। সেটিও চমৎকার।
সে বছর রজনীকান্তের ‘অমৃত’ নামে কবিতার বই, নতুন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
এর মধ্যে একদিন সেকালের কবি রসময় লাহা কান্তকবির সমীপে এলেন, সেকালের পক্ষে রসময়বাবু খুবই আধুনিক, তাঁর সদ্যপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ছাইভস্ম’, তিনি সেই কবিতার বইটি রজনীকান্তকে উপহার দিলেন।
অতঃপর কান্তকবি তাঁর ‘অমৃত’ কাব্যগ্রন্থটি লাহাবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, ‘ছাইভস্ম দিয়ে অমৃত নিয়ে যান।’