কানা মামুদের উড়ালকাব্য-২
এখন আমার রাত্রির ভিতর দিয়ে চলা।
অন্ধকারকে একটি সপ্রাণ জগতের মত মনে হয়। আলোর বিন্দু কোথাও নেই, একদা যখন আলোর জগতে ছিলাম তখন তোমার হাসির যে ছটা আমার রক্তকে মথিত করে তুলতো আঁধারের ভেতরে এসে সেই হাসিকে কল্পনায় ফিরিয়ে আনতে চাই।
কিন্তু হাসি যে কারণে হাসি হয়ে ওঠে সেই শব্দকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না।
আমি জানতাম আলোর পরেই অন্ধকার আছে।
কিন্তু সে অন্ধকারে পৌছুতে জীবনকে অন্য কোথাও রেখে আসতে হয়। আমি এসেছি জীবনের সমস্ত অনুভূতি অবিকল রেখে এই অন্ধকারের জগতে। এখানে কারো মুখ দেখা যায় না। না মানুষ, না প্রাণী, তবে আমি আন্দাজ করতে পারি। কারও মুখ না দেখলেও তার অবয়ব দেখে বুঝতে পারি যে এই আয়তনটা আমার চেনা। তবু বলব আমি চেনা জগতের বাইরে চলে এসেছি।
আগে বাতাসকে নিষ্প্রাণ ইথারের তরঙ্গ বলে ভাবতাম।
এখন কেন যেন মনে হয় আমি তাকে সালাম বললে সে উত্তর দেবে। থামতে বললে শিরশির শব্দ তুলে সে থেমে যাবে।
কোনও কিছুই যেন অনাত্মীয় নয়, বোবা বা বধির নয়।
আমি আগে গাছের সাথে কথা বলতাম সেটা ছিল দৃষ্টির জগত। অভ্যেস এখনো ত্যাগ করিনি। গাছের পাতারা সরসর শব্দ তুলে আমার কথার জবাব দিতে থাকে। আমাকে মানুষের মতই কানা বলে ভালোবেসে ঠাট্টা মশকরা করে, আমি গাছের কথায় আসি। পুকুরের মাছের কলকাকলি ও নিঃশ্বাসের শব্দ শুনি।
তবে সবার কাছে তো যেতে পারি না, কেউ হাত ধরে না নিয়ে গেলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার ভয়।
আগে যখন সাহিত্য করতাম, সাহিত্যের আড্ডায় বিতর্ক করতাম তখন অন্তদৃষ্টি বলে একটা কথা খুব উচ্চারিত হত। এখন অন্ধ হয়ে গিয়ে অন্তর্দৃষ্টি শব্দটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি। অন্তর্দৃষ্টি যেন হারপুন নিয়ে খেলা। যেন একটি দুর্ধর্ষ মাছকে বল্লম দিয়ে গেঁথে ফেলা।
হায় আল্লা। কানা মানুষেরও একটা জগত আছে। এর সবটুকু না দেখিয়ে আমাকে অন্য কোনও পর্দার অন্তরালে ঠেলে দিও না। আমি অন্ধত্বের জগত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাতড়ে হাতড়ে অতিক্রম করব। আমি হোঁচট খেয়ে আসবাবপত্রের ওপর পড়ে যাবো। হয়তোবা শক্ত ও কাঠিন্য পরখ করতে করতে কোনও এক কালে আমি সেই কোমল শিহরণের কাছে পৌছে যাবো যা কবিকেও অশ্রুজলে পরিবর্তিত করে দেয়। কবি হয়ে যান ভর বর্ষার মেঘ।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পানির ভেতর আছি। অবিশ্বাস্য হলেও এই অনুভূতি আমাকে আনন্দ দেয়। প্রশ্ন জাগে হযরত খিজির কি অকূল তরলের ভেতর দিয়ে জগতের ভবিষ্যৎ অবলোকন করেন?
আমি অবলোকন করি আমার ডানদিক দিয়ে অনুকূল এবং বায়ে প্রতিকূল তরঙ্গ বইছে। আমার চোখ দুটি হয়ে যায় মিষ্টিজলের স্বচ্ছ বড় চাঁদামাছ।
স্বচ্ছ তবু দৃষ্টি চলে। ভবিষ্যৎ দেখতে হলে কে বলেছে যে পরিচ্ছন্ন চোখই দরকার। ঘষা কাঁচের মত রহস্যময় চোখ চেয়েছিলাম আমি। আমার প্রভু আমাকে তা দিয়েছেন। কবি জীবনানন্দ দাশ বেতফলের মত ঘোলাটে দৃষ্টি পছন্দ করতেন কিন্তু রহস্যহীন বেদনা কবির কি কাজে লাগে?
আমি যখন স্বচ্ছ চোখের অধিকারী ছিলাম তখন আমার দুটি চোখকে যুক্তিহীন কৌতূহল ঘিরে রেখেছিল। আমি রোদকে দেখেছি গলিত সোনার মত। অন্ধকারের সাথে তুলনা দিয়েছি উল্টে যাওয়া দোয়াতের। এখন আর তা পারি না। কারণ আমি আলোর দিক থেকে রাত্রির দিকে যাত্রা শুরু করেছি। আলোর তো আয়ু শেষ হয় যেমন আমার চোখের আর আলো নেই কিন্তু রাত্রির কি অবসান আছে?
তবু আমি প্রার্থনা করি, আমার ধর্ম যে অন্তহীন জগতের কথা বলে, সেই পরকালে চলার শব্দ আমি শুনতে পাই। সেখানে কি সূর্যোদয় আছে, অস্ত ও অন্ধকার আছে, উষার উদয়ের প্রশান্তি আছে? এ সকল প্রশ্নের জবাব আমি আমার প্রার্থনার মধ্যে একটু একটু উচ্চারণ করি। আর মনে মনে ভাবি সব কিছু আছে। আছে, আছে, আছে…।
আছে শব্দটা আমার রক্ত-মাংসকে এতোটাই অভিভূত করে রেখেছে যে জীবনের সীমা পেরুতে আমি ক্রমাগত নির্ভীক ও নির্লিপ্ত হয়ে পড়েছি। কে আমাকে পর্দা পেরুনোর ভয় দেখায়! আমি তো জানি আমি সেখানে থাকব।
চোখ ছাড়াও তো আমার দেহ-দুর্গে আরও কয়েকটি ইন্দ্রিয় ছিল। তা একে একে ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অস্ত্রের মতো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন চোখও নেই, শুধু সেজদার জায়গাটুকু আন্দাজ করে লুটিয়ে পড়তে চাচ্ছি। যেখানেই আমার ললাট স্থাপিত হোক না কেন আমি জানি তা আমার প্রভুর ক্ষমার মঞ্জিলে গিয়ে উপচে পড়বে। আমাকে অন্ধ বলে তিনি তো আর এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০২