কানা নিতাই ও খোঁড়া অদ্বৈতের উত্তরাধিকারীরা
ইংরেজি সাহিত্যের শোভাসৌন্দর্য ভোগের জন্য বাঙালিরা ইংরেজি শেখে নি; পাকস্থলির প্ররোচনাই তাদের ওই ভাষাটি শিখতে উৎসাহ দিয়েছিলো। পলাশির যুদ্ধের কয়েক দশক আগেই বাঙালিদের দূরদর্শী একগোত্র ইংরেজি শিখতে থাকে; এবং ইংরেজ বণিকদের সাথে সম্পর্ক পাতিয়ে উজ্জ্বল রৌপ্যমুদ্রা আয় করে। প্রথম পর্যায়ে যে-কজন বাঙালি ইংরেজি শিখেছিলেন, তাঁদের দু-জন হচ্ছেন কলুটোলার কানা নিতাই সেন, ও খোঁড়া অদ্বৈত সেন। শিবনাথ শাস্ত্রী এদের সম্পর্কে লিখেছেন :
ইহারা ভাঙ্গাভাঙ্গা ব্যাকরণহীন ইংরাজি বলিতে পারিতেন এবং লিখিতে পারিতেন বলিয়া তৎকালীন কলিকাতা সমাজে ইঁহাদের খ্যাতিপ্রতিপত্তির সীমা ছিল না। ইঁহারা যাত্রা মহোৎসবাদিতে আপনাদের পদগৌরবের চিহ্নস্বরূপ কাবাচাপকান পরিয়া এবং জরীর জুতা পায়ে দিয়া আসিতেন। লোকে সম্ভ্রমের সহিত ইঁহাদের দিকে তাকাইত।
কানা নিতাই ও খোঁড়া অদ্বৈতের উত্তরপুরুষেরাই এখন সমাজনিয়ন্ত্রক; ‘লোকেরা’ তাঁদের দিকে এখন শুধু ‘সম্ভ্রমের সহিত’ তাকায় না, নতজানু হয়ে থাকে।
কী রকম ইংরেজি শিখতেন প্রথম পর্যায়ের ইংরেজিশিক্ষিতরা? তাঁরা শিখতেন শব্দ;– যিনি যতো বেশি ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করতে পারতেন, তিনিই গণ্য হতেন ততো বড়ো শিক্ষিত ব’লে। ব্যাকরণ, আর বাক্যরচনার কোন বালাই ছিলো না। তাঁরা ছেঁড়াছেঁড়া শব্দ উচ্চারণ ক’রেই মনের সমস্ত ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতেন। শ্রীরামপুরের মিশনারিরা তাঁদের ছাত্রদের ইংরেজিজ্ঞানের অভিজ্ঞানপত্রও দিতেন : লিখে দিতেন যে ক জানে আড়াইশো, খ জানে তিনশো পাঁচটি ইংরেজি শব্দ। শুভঙ্করীকেও তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন ইংরেজি শেখানোর কাজে। পুরোনো ভারতের ওই গাণিতিকের প্রক্রিয়ায় তখন শেখানো হতো ইংরেজি নামতা; যেমন-
ফিলজফার- বিজ্ঞলোক, প্লৌম্যান— চাষা।
পমকিন- লাউকুমড়ো, কুকুম্বার- শশা।
এ-ইংরেজি শিখে তাঁরা যে-কথোপকথন করতেন, তার অজস্র সরস গল্পে বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার ইতিহাসের পৃষ্ঠা পূর্ণ হয়ে আছে। ওই সব কাহিনীর একটি, শিবনাথ শাস্ত্রীর ভাষায়, এমন :
কোন ইংরাজের অধীনস্থ একজন বাঙ্গালী কর্মচারী প্রতিদিন দুপুরবেলা সাহেবের ঘোড়ার দানা খাইয়া টিফিন করিতেন। দুষ্ট সহিসগণ এই সুবিধা পাইয়া ঘোড়ার দানা চুরি করিয়া বেচিত। ক্রমে এ বিষয় প্রভুর কর্ণগোচর হইলে তিনি ভৃত্যদিগকে যখন তিরস্কার করিতে লাগিলেন, তখন তাহারা বলিল—“হুজুর! আপনার বাবু রোজরোজ ঘোড়ার দানাতে টিফিন করেন।” সাহেবের বড় আশ্চর্য বোধ হইল। তিনি বসুজ মহাশয়কে ডাকিয়া বলিলেন— “নবীন! তুমি নাকি আমার ঘোড়ার দানাতে টিফিন কর?” নবীন বলিলেন—”ইয়েশ শার মাই হাউস মাণিং এ্যাণ্ড ইবনি টুয়েন্টি লীভস ফল, লিটিল লিটিল পে, হাউ ম্যানেজ?”-অর্থাৎ আমার বাটীতে প্রাতে ও সন্ধ্যাতে কুড়িখানা পাত পড়ে এত কম বেতনে কিরূপে চলে!”
প্রথম পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষিত নবীন বসু এখন তাঁর উত্তরাধিকারীদের দেখে ঈর্ষিত হতেন : তাঁকে খেতে হতো ঘোড়ার দানা, কিন্তু তাঁর উত্তরাধিকারীরা খাচ্ছেন সমগ্র দেশ ও সমাজ।