কানাওলার ফাঁদ
ঘটনাটা কইবার আগে কয়েকটা কথা জানিয়ে রাখা প্রয়ােজন, নাহলে তােমরা ভয়টুকুর সাথে ঠিক একাত্ম হতে পারবে না। বিরক্ত হয়াে না যেন। প্রথমে কয়ে রাখি কানাওলা কাকে বলে। তােমাদের তেমনভাবে জানবার কথা নয়, তবে তােমার বাড়ির বড়ােরা ঠিক জানে। জানেই জানে। তারা এই নাম উচ্চারণ অবধি অপয়া বলে মানেন। তাদের আবার শুধােতে যেও না যেন। খুব বকা খাবে বৈ ত নয়।
তা বলে যে কেউ হুটপাট মরলেই কিন্তু কানাওলা হয় না। মানুষ সহ। বুদ্ধিমান জন্তুরা যখন মারা যায়, তখন তিথি অনুসারে তাদের মৃতদেহটা মাঝে মাঝে দোষ পায়। একপাদ দোষ নিয়ে ভাবনার কিছু থাকে না, কারণ একপাদ দোষ মৃতের সাথেই সহগমন করে। সমিস্যে হয় দ্বিপাদদোষ, ত্রিপাদদোষ আর অতীব মারাত্মক চতুষ্পদদোষকে নিয়ে। অনেক বিধি বিধান আর পুস্করা করে তাকে তাড়াতে হয়। পুস্করার গপ্পো তােমাদের অন্য দিন বলবােখন। সে আরেক ভয়ঙ্কর উপদ্রব, বাব্বাঃ।
যাই হােক, কি যেন বলছিলাম? তা এই দোষ পাওয়া মানুষের মধ্যে আবার যারা মৃত্যু কালে কারুর দ্বারা বেইমানি বা প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে মরে, তারাই হয় কানাওলা। এরা বহু ক্ষেত্রে ভূলাে বা নিশির মতাে আচরণ করে থাকে বলে এদের ঠিকঠাক চিনে নেওয়া বড়াে মুশকিল। বড়াে বড়াে তান্ত্রিক কাপালিকেরাই পারে না, আর আমি তুমি না চিনলে ততাে বড়াে কিছু লজ্জার কথা নয়।
ভূলাে বা নিশি কক্ষোণাে কারুর সরাসরি হত্যা করতে পারে না। তােমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথাও নিয়ে গিয়ে, তােমাকে দিয়েই তােমাকে হত্যা করবে। হয়তাে নদীর পাকদামে ভুলিয়ে নিয়ে ডুবিয়ে মারবে। নচেৎ কোনাে উঁচু জায়গা থেকে তােমাকে ঝাপ খাওয়াবে, তারপর ধরাে যাকে বলে বােবায় ধরা, অর্থাৎ নিজের হাতে গোঁ গোঁ করে নিজেরই গলা টিপে মরবে, আরাে কত কিছু। কিন্তু কানাওলা? সে তােমাকে ভুলাতেও পারে। নিজের হাতেও মারতে তার আটকাবে না। এমনকি সে মায়াজালও সৃষ্টি করতে পারে। ভয়ানক কুটিল আর ধূর্ত একটা প্রেতযােনী, যার সাথে চতুরতায় এঁটে উঠা প্রায় অসম্ভব। তাহলেই বােঝে দিকি, আমি তােমাদের কানাওলাকে চেনাবার জন্য যে এত এত লিখলুম, তা কি এমনি এমনি লিখেচি? তােমাদেরও তাে সতর্ক হওয়া দরকার। তােমরা শহর মুল্লুকে থাকো বলে তত বেশি আশ্বাস পাবার তেমন কোনাে কারণ নেই। যখন হয়তাে তুমি নিশ্চিন্দি চিত্তে ঘটনাখানা পড়চো, তখন তােমার জানালার কার্ণিশে, তােমার পাকাবাড়ির ছাতে তারা অপেক্ষা করছে তােমার আনমনা হবার জন্য।
এইবার বলতে শুরু করচি। মন দিয়ে শােনাে।
পতিত পাবনী গঙ্গা নদী যেইখানে ভােল বদলে সাগরে গিয়ে পড়েছে, তার থেকে ক্রোশ তিনেক উত্তুরে উজিয়ে এলে, গঙ্গা পাড়ে যে ঘাটে দেখবে একখানা দানবাকৃতি বটগাছ নদীর পানে ঝুঁকে যেন নিজের মুখ দেখচে, সেইটেই হল নেকড়েমারি গাঁ। নামটা কেন আর কোথা থেকে জুড়ে বসেচে তা কেউ জানে না, কিন্তু ওই গাঁয়ে কেউ কখনাে নেকড়ে দেখেনি। সুন্দরবন জিলা অঞ্চলের গড়পড়তা গাঁ গঞ্জগুলির মতাে এইটে কিন্তু সেই মাত্তর পনেরাে-বিশ ঘর নিয়ে তৈরি হওয়া বসতি নয়। কিছু না হােক ষাট-সত্তর ঘর বাগদী, ত্রিশ পঁয়ত্রিশ ঘর দুলে, তাঁতী, হাঁড়ি, আর তিন ঘর বামুন মিলে সেই যারে কয় একশাের আবাদি।
বেশিরভাগেরই জীবন-ব্যবসায় হল চাষ-আবাদ আর মাছ শিকার। কেউ কেউ কুমার আর পাটবােনার কাজও করতাে। যাকে নিয়ে আমাদের গল্পের আবর্তন, তার নাম হারাণ বাগদী। বয়স আন্দাজি আটাশ হবে। মা, বাপ বেঁচে নেই। হারাণ আর তার ছােটো ভাই নরেন একসাথে থাকতাে। স্বভাব চরিত্র তার ততাে সুখ্যাতি করার মতাে নয়। বেশিরভাগ সময়ে তাড়ি বা হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে, আর ধুত্তামি, নষ্টামি করে লােক ঠকিয়ে বেড়ায়। কিন্তু তা হলে হয় কি, তার একখানা ভালাে গুণও ছিল। হারাণ পাট দিয়ে চমৎকার দড়ি বুনতে পারতাে। আশপাশের তল্লাটের মধ্যে একমাত্র তার কাছেই পাটের দড়ি বােনার কল ছিল। অনেক রাত্তির অবধি সে জড়ানাে গলায় গুনগুনিয়ে গান গাইতাে আর সুতাকলে বসে দড়ি বুনতাে। এ ব্যবসায়ে তার হাত ছিল পীরের মতাে, আর তার তৈয়ারি দ্রব্যের চাহিদাও ছিল অন্য হাটুরেদের তুলনায় কিঞ্চিত বেশি।
আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা ফিরচিলাে, দুটো পয়সাকড়িও আসছিলাে। হয়তাে জীবনটা ভালাে ভাবেই কাটতে পারতাে, কিন্তু এমন সময়ে হারাণ প্রেমে পড়ল তার গায়ের তারাচরণ মুখুজ্জের কন্যা মানসীকে দেখে। মানসীর বয়স সতেরাে। ছােটবেলা থেকে শহর কলিকাতায় মাসির বাড়ি থাকে সে। বহু দিন পরে গাঁয়ের বাড়িতে ঘুরতে এসেছিলাে। হারাণের প্রেম কিন্তু যেমন তেমন ভালােবাসা নয়। এমনিতেই সে ছিল ভয়ানক একগুঁয়ে আর অপরিণামদর্শী, তাই প্রথম দেখাতেই হারাণ অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ল যেন। কয়েকটা দিন তুমুল আকাশকুসুম আর অসােয়াস্তির মধ্যে কাটিয়ে পরদিবসে হারাণ গুটিগুটি পায়ে মুখুজ্জেবাড়িতে গেল মানসীকে নিজের মনের কথা জানাতে।
ফল হল বিপরীত। তারাচরণ আর তাঁর পুত্রেরা হারাণের বাড়ি অবধি এসে তাদের দুই ভাইকে শাসিয়ে গেল যে, এই ধরনের ধৃষ্টতা না করাই একজন বাগদীর পক্ষে মঙ্গলের কথা। মানসী তাদের বাড়ির বড়ই আদরের ধন। তার বিবাহ স্থির হয়ে রয়েচে গাঁয়ের আরেক ঘর বামুন নিত্যানন্দ ঘােষালের ছেলে মাধবের সাথে। হারাণ নীচ জেতের ছেলে হয়ে কোন সাহসে ভর করে প্রেমনিবেদন করতে গিয়েচিলাে।
তারাচরণের দুই ছেলে বগলা আর রাধেও বেশ দু’খানা কটু কথা শুনিয়ে দিলে হারাণকে। বললে, ফের যদি কখােনাে এমন বেচাল চোখে পড়েচে, তবে ঘরের চালা কেটে মাটিতে সরষে বুনে দোবাে।
হারাণের এই বেহায়া বাতুলতায় এমনিতেই গ্রামের হাটতলায়, বটতলায় আর সর্বত্র একটা গেল গেল রব উঠেছিলাে। এবার তা সপ্তমে উঠল। গােটা গায়ে ঢি ঢি পড়ে গেল আর সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে রইলাে তার প্রতি। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় এই যে, এসবে হারাণের চালচলনে কোনাে বদল এল না। সে হাটে বাজারে বায়ুরােগীর ন্যায় নিজেকে মানসীর ভাবী স্বামী রূপে পরিচয় দিতে শুরু করেছিলাে।
অবশেষে মানসীর বিবাহের দিন ধার্য্য হল আর এগিয়েও এল। আজ আশীর্বাদ হয়ে গেল। আগামী পরশু শুকুরবার গায়ে হলুদ, শনিবার পরিণয়। এবারে হারাণ বাগদী এক অতি মারাত্মক কাজ করে বসল। বুধবারের সাঁঝবেলাতে যখন মুখুজ্জেবাড়িতে গাঁয়ের এয়ােস্ত্রীরা সব গিয়েচেন আচার অনুষ্ঠান ব্যাপারে কথা কইতে, সে সময়ে হারাণ একখানা লম্বা রামদা নিয়ে চড়াও হয় সেইভেনে। চক্ষু রক্ত বর্ণ, মুখে মদের গন্ধ। স্ত্রী লােকেরা যখন ভয়ে ছুটোছুটি আর আর্তনাদ করছে, এমন সময়ে কোনােগতিকে রাধেচরণ মুখুজ্জে তাকে পিছন থেকে জাপটে ধরে ফেলে। হাতের দা খসে যেতেই উপস্থিত পুরুষ মানুষেরা হারাণকে উত্তম মধ্যম প্রহার করে। মারের চোটে জ্ঞান হারায় হারাণ।
খবর পেয়ে হারাণের ভাই মুখুজ্জেবাড়িতে এসে কাঁদতে থাকে আর উপস্থিত সকলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে থাকে।
অজ্ঞান দাদাকে তার ভাইয়ের হাতে সমর্পণ করে বিদায় করে দেওয়া হয়।
পরের দিন জ্ঞান ফিরলে পর হারাণ তার ভাইকে শুধােয়-
– “এ কী রে, আমায় ঘরে আনলে কে?”
-“আমি দাদা। আমি এনেছি।”
-“মানসী কোথা? কাল তার গায়ে হলুদ না? আচ্ছা দাঁড়াও, আমিও দেখচি কেমন করে হয়।”
এবার তার ভাই হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
– “দাদা, তুই ও মেয়েকে ভুলে যা দাদা। ওকে আর তুই পাবিনে। আজ সকালে ঘাটের কাছে গিয়েছিলাম তাের শুকিয়ে রাখা পাট তুলতে। সেখানে গাঁয়ের বুড়ােরা সব বসে বসে কথা কইছিলাে। আমায় দেখে বেশ হেঁকে হেঁকেই বললে- ‘হারাণ ছোকরাকে বুঝি এদ্দিনে ভূতে পেয়েচে। হবে নে? আরে বাবা, শাস্তর তাে আর মিথ্যে হবার নয়। তবে আর ছোটোজেতের লােক বলেচে কেন? হতভাগার মন্দবুদ্ধি দেখাে একবার! যার তার নয়, বলে কিনা তারার মেয়েকে বিয়ে করবে। এঃ, ছেলের হাতের মােয়া আর কি! তাে যা, এখন কর গে বিয়ে। আজ সকালের গাড়িতেই তারাচরণ তার মেয়ে আর মাধবকে নিয়ে রওনা দিয়েচে কলকেতায়। সেখেনেই মাসির বাড়িতে বিয়ে, সেখেনেই সব। একবারে বিয়ে করে, কালীঘাট দেখে ফিরবে।”
নরেন একটানা শােনা কথাগুলাে কয়ে যাচ্চিলাে, কিন্তু এই অবধি শুনে হারাণ খাটের থেকে এক লাফ মেরে নীচে এসে দাঁড়ালে। তার ঠোট কাপচে, চুল উসকোখুসকো। বিড়বিড় করে আপনমনে বলতে থাকলাে-“কলকেতায় গিয়ে বে দেবে? দেওয়াচ্চি। হওয়াচ্চি মাধবের সাথে বে।”
এই বলতে বলতে পাের্টমেন্টো থেকে এক খাবলা নম্বরী নােট তুলে নিয়ে, পিরাণের বুকপকেটে গুঁজে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে হাজির হল রেলস্টেশনে, আর টিকিট খরিদ করে নয়টা আটের কলকাতাগামী রেলগাড়িতে চেপে রওনা হল সেই বিশাল শহরে, মানসীর বিবাহ আটকানাের কুটিল অভিসন্ধি নিয়ে।
এখন কথা হচ্ছে, তারা মুখুজ্জে বা নিতু ঘােযালের পরিবারের কেউই সকালের গাড়িতে কলকাতায় যায়নি। তারা লুকিয়েচিলাে পাশের গঞ্জের এক মহাজনের বাড়িতে, এবং যখন খবর পেলে যে, তাদের ছড়ানাে গুজব শুনে হারাণ কলকাতায় যাত্রা করেছে, তখন তারা হাসতে হাসতে ঘরে ফিরলাে।
এদিকে হারাণ একটানা চারদিন যাবৎ কলকাতার অলিতে গলিতে আতিপাতি করে খুঁজে চলল তাদের, কিন্তু কাকস্যপরিবেদনা। অবশেষে পাঁচদিনের মাথায় পড়ন্ত দুপুরে, এক গা ধুলাে মাটি নিয়ে হারাণ গ্রামে ফিরলাে, আর শুনলাে যে মুখুজ্জেবাড়ির সাথে ঘােষালবাড়ির জাঁকজমক করে বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে, আর বরবধূ পশ্চিমে মুঙ্গের প্রদেশে ঘুরতে চলে গিয়েচে। মাধবের নূতন কাজ লেগেচে উলুবেড়ের চটকলে। মুঙ্গের থেকে সােজা চলে যাবে সেথায়, আর আপিসের দেওয়া চালাবাড়িতেই সংসার পাতবে। এতদিন সকলকে ঠকিয়ে চলা কুটিল হারাণ এযাত্রা নিজেই ঠকে গিয়ে ক্রোধে, নিরাশায় অন্ধ হয়ে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করল নিজের ঘরে। তার ভাই নরেন তখন নদীর পরপারের গ্রামে কি একটা কাজে গিয়েছিলাে।
এ কি বিপর্যয় হল তার ভাগ্যে! তাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। তাকে উন্মাদের মতাে ভুল পথে এতদিন ধরে ঘােরানাে হয়েছে “আচ্ছা! আমিও… আমিও এর শেষ দেখে ছাড়বাে!”
কিন্তু কী ভাবে! ক্ষমতাই বা কতটুকু তার। কি উপায়ে সবাইকে জব্দ করা যায়! কী ভাবে?
“পেয়েচি! উপায় পেয়েছি।”
এমন ভয়ংকর প্রতিশােধ নেবাে যে এই নেকড়েমারী বহু যুগ মনে রাখবে এই হারাণ বাগদীকে!
নরেন নৌকা করে নিজের গ্রামের ঘাটে এসে ঠেকার পূৰ্বেই গলুইয়ে দাঁড়িয়ে সে আর বাকি সকল নৌযাত্রীরা শেষ বিকেলের পড়ে আসা আলােয় দেখতে পেলাে যে, ঘাটের গায়ে বিশাল বটগাছটার যে শাখাটা এগিয়ে এসেছে নদীর দিকে, সেই ডালখানাতে গলায় গামছা বেঁধে আত্মহত্যা করেচে হারাণ।
নরেন নৌকা ডাঙায় ঠেকার আগেই জলে ঝাপিয়ে পড়ল, আর চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মৃতদেহের পা জড়িয়ে ধরলাে। কিছু সময়ের মধ্যে পুরুষেরা সকলে জড়াে হল সেই বটতলায়। কেউ কেউ মুখে দুঃখ প্রকাশ করলে বটে, তবে মনে মনে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলে, ‘আপদ গিয়েছে।
মুরুব্বিরা নরেনকে পরামর্শ দিয়ে বলল, “তুমি তাে বাছা ছেলেমানুষ। তােমার উপর আমাদের কোনাে রাগ বা বিদ্বেষ নেই। আজ রাত্তিরে তােমার দাদার মৃতদেহ দাহ করা হবে। সকাৰ্য্য সম্পন্ন হলে পর কাল তােমাকে তােমার কোনাে স্বজনের বাড়ি পৌছিয়ে দেওয়া হবে। তুমি বাছা একলা একলা কেমন করে গাঁয়ে থাকবে বলাে। তােমাদের কোন এক পিসীমা নয়াচরের দিকে থাকে বলেছিলে না?”
অতঃপর কর্তব্য স্থির হয়ে গেল।
সেই রাতেই হারাণের শরীর কৃষ্ণচূড়া গাছের চিতেয় তুলে ভস্ম করে দেওয়া হল। রাত পােহালে পর নরেনকে পিসীমার গৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সে নিজের ঘরে কুলুপ এঁটে, চাবিকাঠি ধুতির খুঁটে বেঁধে, গাঁয়ের লােকেদের দেওয়া কুড়িটে টাকা নিয়ে নৌকা চেপে রওয়ানা হল নয়াচরের দিকে।
বৈকালে গঙ্গাপাড়ের সেই বটতলায় মাতব্বরদের গল্পগুজব চলাকালীন নানান রকমের আলােচনা হচ্ছিলাে। ঐ হারাণকে নিয়েই আর কি। একটু আধটু দুঃখ জানালেও সবার মনের ভাব ছিল একই। অর্থাৎ ‘যা হয়েছে ভালােই হয়েছে।
নিত্যানন্দ ঘােষাল কইলাে “ছােকরার মাথায় ভূত চেপেচিলাে হে। তা নইলে অমন একখানা দাউলি নিয়ে আমার ভায়ার ঘরে চড়াও হয়? বাপ রে বাপ। শুনে তাে আমার প্রাণপাখি উড়েই গিয়েছিলাে প্রায়। সত্য কথায় কষ্ট নেই ভায়া। হতভাগা মরেচে আপদ বালাই গিয়েছে। বেঁচে থাকলে গাঁয়ের হাড় জ্বালাতন করতাে সে বেটা।”
একাদিক্রমে সকলেই স্বীকার করলে যে, ‘কথাটা সত্য বটে। কখন বা খুনজখমই করে বসতাে ছোঁড়া। যাক, এতদিনে ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি পাওয়া গিয়েছে। এবার নিশ্চিন্দি।
কিন্তু এখানে গ্রামবাসীদের হিসেবে একটা মস্ত বড়াে ভুল ছিল। বিপদ শেষ হয়নি। সবে শুরু হয়েছিলাে মাত্র। হারাণ বেঁচে থাকতেই ছিল অতি বদ আর চতুর। অপঘাতের পরে সে পরিণত হল এক ভয়ানক ধুর্ত আর হিংস্র প্রেতাত্মায়। সুযােগের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে ঘুরে বেড়াতে লাগল গাঁয়ের আনাচে কানাচে। সেই কথাই আজ তােমাদের বলতে চলেচি। শােননা তবে।
এই গাঁয়ের দুলে পাড়ায় গােটা ত্রিশেক মধ্যবিত্ত ঘর। হরি দুলে ছিল কনকচূড় চালের ‘ফড়ে’ অর্থাৎ আড়ৎদার। এবার বলাে যে কনকচূড় চাল চিনিনে! তােমাদের নিয়ে আর পারিনে। কনকচূড় চালে দুনিয়ার সেরা খই তৈয়ারী হয়। হরি দুলে মধ্যে মধ্যে সেই চালের বােঝা মুটিয়াদের মাথায় চাপিয়ে কলকাতার বড়ােবাজার নামের কোন একটা জায়গায় চালান দিতে যেত।
সেদিন ফিরতি পথে মুটিয়াদের ইস্টেশান থেকে টাকাকড়ি দিয়ে বিদেয় করে, হরি দুলে রাত্তির নয়টা নাগাদ পথ ধরলাে বাড়ির। পথের দু’পাশে ঝিঝি পােকার গান ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ একটানা হাঁটার পর যখন শিবনগর ইস্কুলবাড়ির কাছাকাছি পৌঁচেছে, হঠাৎ হরি একটা অন্যরকম ব্যাপার খেয়াল করল। ইস্কুলবাড়ির যে কাঁচা রাস্তাটার কথা বলচি, সেটার বাঁ দিকে বড়াে বড়াে ঝুপসী গাছের সারি, আর অন্য দিকে একটানা ধানক্ষেত। এখান থেকে গ্রামের পথ আমাদের পায়ে আধা ঘণ্টা, আর হরির পায়ে বড়ােজোর মিনিট পনােরাে। তা, আপনমনে চলতে চলতে হরির মনে হল তার পাশে পাশে আরেকটা যেন কেউ পথ চলচে। ঠিক পাশ বরাবর নয়, যেন পথের গা ঘেঁষে ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কেউ সমান তালে পা ফেলে ফেলে এগুচ্চে।
হরির মনে খটকা লাগলেও সেই ভাবনাটা মন থেকে অচিরেই ঝেড়ে ফেলল। রাত ভিতে হাওয়া বাতাস লেগে ক্ষেতখামারি থেকে কতরকম আওয়াজই তাে আসে। হরি আবার পথ চলতে শুরু করল।
কিছু সময় চলার পর হরি আবার অসােয়াস্তি বােধ করলাে। আওয়াজটা যেন পিছু ছাড়ছে না। আবারও সে এই ধারণা উপেক্ষা করতে যাচ্চিলাে, কিন্তু একটা ব্যাপার এবার তার নজরে এল। সে ঠাহর করলাে, বেশ কিছু দূরের ক্ষেতের থেকে ঝিঝি পােকার ডাক কানে আসছে। বাঁ পাশের গাছগাছালি থেকেও তাই। কিন্তু আজব ব্যাপার এই যে তার গা ঘেঁষা ধানগাছের সারি থেকে কোনাে পােকা ডাকছে না।
এবার হরির ভয় করতে লাগলাে। কেন করতে লাগলাে জিজ্ঞেস করচো? তােমরা গাঁয়ের লােক হলে ঠিক বুঝতে পারতে। হরি এবার বুঝলাে যে তার মনের ভ্রম নয়, সত্যি সত্যিই ধানগাছের আড়া দিয়ে কোনাে মানুষ বা বড়াে কোনাে জানােয়ার চলাফেরা করচে। নাহলে পােকার দল কক্ষনাে ডাক থামাতাে না। তারা কাউকে একটা দেখতে পাচ্চে।
হরি হনহন করে পা চালিয়ে চলতে শুরু করলাে, আর খেয়াল করলাে যে সেই অদেখা বস্তুটিও ততােধিক দ্রুত চলতে শুরু করেছে। ধানগাছগুলাে শনশন করে উঠচে। একটা জায়গায় এসে ধানের সারি শেষ হয়ে একটা ছােট্টমতাে ডােবা পড়ে। তার পরে আবার ক্ষেত শুরু হয়েছে। এই স্থানটা পাশ কাটাবার সময়ে হরি স্পষ্ট টের পেলে যে, কি একটা যেন ডাঙা থেকে ডােবার মধ্যে নামলাে ঝুপ করে। হরি আতঙ্কে নিঃশ্বাস টেনে দৌড় লাগালাে, আর লক্ষ্য করলাে ডােবার মধ্যে দিয়েও একজোড়া পায়ের আওয়াজ ছপ ছপ ছপ করে দৌড়চ্চে।
এলােপাথাড়ি ছুটতে ছুটতে একটা পাথর না কিসে হোঁচট খেয়ে হরি আছাড় খেয়ে পড়লাে। মরিয়া হয়ে যেই উঠতে যাবে, এমন সময়ে মনে হলাে ঠিক তার পিছনবাগে কে যেন এসে দাঁড়িয়েচে। কাঁপতে কাঁপতে হরি ইষ্ট স্মরণ করে পিছনে চাইলাে, আর পিছনে আবছা আবছা চাঁদের আলােয় যাকে চোখে পড়লে তাকে দেখে হরি আতঙ্কে বুকফাটা চিৎকার করে উঠলাে।
প্রত্যুষকালে পড়শীরা আবিষ্কার করলে যে, নদীপাড়ের বটগাছের ডালে হরি দুলের কাঠ হয়ে যাওয়া মৃতদেহ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলচে। তার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যেন মরণকালে সে কোনাে কিছু দেখে ভয়ানক ভয় পেয়েছিলাে।
এই বীভৎস অপমৃত্যু প্রত্যক্ষ করার পর গােটা গাঁ সারা দিন থমথমে হয়ে রইলাে, আর সাঁঝবেলার পর থেকেই পথ ঘাট শুনশান হয়ে পড়লাে। শুধু ঝােপঝাড় থেকে পাতিশেয়ালগুলাে উয়ায়া উয়ায়া উয়ায়া করে ডেকে বেড়াতে থাকলাে। প্রায় সবার মনেই একটা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিলাে, কিন্তু মুখে কেউ কিছু প্রকাশ করলাে না। যে যার রাঁধা খাওয়ার কর্তব্য সাঙ্গ করে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লাে।
দুটো দিন কিছু হলাে না। লােকেদের মনের সন্দেহটাও উবে যেতে শুরু করেছিলাে। এমনটাও তাে হতে পারে যে হরি হয়তাে নিজেই গলায় দড়ি দিয়েছে, যদিও সম্ভাবনাটা আদপেই বিশ্বাসযােগ্য নয়। সে বেশ দুপয়সার মালিক। ঘরে তার শান্তিরও অভাব নেই। তবু নিজের নিজের চিত্তকে প্রবােধ দেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কি?
এমনি ভাবে একদিন, দুইদিন কাটার পর, তৃতীয় দিনই ঘটে গেল মর্মান্তিক অঘটনটা।
কেউ কারুকে কিছু প্রকাশ্যে না কইলেও, প্রায় প্রত্যেকেই সন্ধ্যাকালের পর ঘর থেকে বেরুনাে বন্ধ করে দিয়েচে বললেই চলে। খুব বিশেষ আবশ্যক না থাকলে কেউই সকালের পূর্বে বাইরে পা রাখছে না। তা, সেদিন রাত্তিরে আহারে বসার আগে তারাচরণ মুখুজ্জের বাইরে ‘খােলায়’ যাবার দরকার পড়লাে। বােছেলেকে কয়ে তিনি গাড় আর গামছাটি নিয়ে বাইরে বেরুলেন। কিয়দক্ষণ অতীত হবার পর বগলার মা আর ছােটোভাই খাবার ঘরে এসে সব কথা শুনে, বগলার নির্বুদ্ধিতায় তাকে বকাঝকা শুরু করলে এবং অগত্যা বাবার পাশে দাঁড়াবার জন্য সে বাড়ির থেকে বাইরে বেরুলাে। বেরিয়ে বগলা দেখলাে তার বাবা উঠানের ধানগােলার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের মূলিবাহশের বনের পানে সতর্কভাবে কি যেন দেখছে।
-“বাবা!”
হঠাৎ ছেলের এই ডাকে তারাচরণ চমকে উঠেই ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বললেন।
বগলা ফিসফিসিয়ে শুধােলাে “কী হয়েছে বাবা? আপনি এমন করচেন কেন?”
-“বড়াে খােকা, বেশ করে কান পেতে শােন দিকিনি, ঐ বাঁশবনের ভিতর থেকে যেন একটা মেয়েছেলের কান্নার আওয়াজ পেলাম!”
বগলা কিছু সময় কান খাড়া করে থেকেও কিছু শুনতে পেলাে না। যদিও ঝােপটা অনেকখানি দুরে, কিন্তু নিশুত রাত্তিরে সূক্ষ্ম রবও কানে ধরা দেয়। কিন্তু সে কিছু শুনতে পেলাে না।
-“কই, কিছু শুনলাম না তাে বাবা তা”
– “তারাচরণের কানকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয় রে বড়ােখােকা। আমার একটা জিনিস বড্ড সন্দেহ হচ্চে। তুই চট করে ভিতর থেকে আমার লাঠিগাছটা নিয়ে আয় দিকি। তােরটাও অমনি সঙ্গে আনবি।”
অগত্যা বগলা অন্দরে সব কথা কয়ে, লাঠি দু’গাছ নিয়ে বাইরে এল, আর বাপের সঙ্গে শব্দের উৎস খুঁজতে বাঁশবনের পানে চললাে। দুজনায় মিলে পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালাে সেই জঙ্গলের কিনারে।
কিছুক্ষণ সময় পরে তারাচরণ ঘরে ঢুকে, খাবার আসন শূন্য দেখে জিজ্ঞেস করলাে “রাধে, তাের বড়দা কোথা ত?”
রাধাচরণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাে
“একি! দাদা ফিরলাে না আপনার সঙ্গে ?”
– “আমার সঙ্গে মানে? আমি তাে গিয়েছিলাম পিছনের ডােবায়। সেথায় তাের দাদা কোথা?”
রাধে কাঁদো কাঁদো মুখে বললে – “তবে যে দাদা কইলাে আপনি তাকে লাঠি নিয়ে যেতে বলেচেন! আরাে কইলাে যে, আপনারা নাকি কোন এক..
আচমকা দূর বাঁশবাগানের দিক থেকে একটা তীব্র আর্ত চীৎকার কানে এল। রাধে আর তারা মুখুজ্জে এক দৌড়ে বাড়ির থেকে বাইরে এসে শুনলাে, চিৎকারটা আস্তে আস্তে দূরের দিকে সরে যাচ্ছে। আওয়াজ শুনে অনেকগুলি ঘর থেকেই পুরুষেরা বেরিয়ে এসেচিলাে। এবার সবাই মিলে দল বেঁধে সেই শব্দকে অনুসরণ করতে করতে এসে পৌঁছুলাে সেই নদীতীরের ঘাটের কাছে। ততক্ষণে আর্তনাদ স্তব্ধ হয়ে গিয়েচে। মাটির মধ্যে একটানা চলে গিয়েছে কোনাে একটা ভারী জিনিস ঘষটানাের দাগ। সেই রেখা বরাবর যেতে যেতে হঠাৎ তারা সভয়ে দেখলাে, বগলাচরণের দেহটা গাছের শাখায় দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঝুলচে। তার মুখচোখ কোনাে এক অজানা আতঙ্কে ফেটে পড়ছে। তারাচরণ তার বড়ােছেলের মৃতদেহের নীচে কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়লাে।
একটা ক্ষুধার্ত অভিশাপ এই গাঁ কে গ্রাস করলাে। আগে নদীর ঘাটের পাশে বিশাল চড়ায় অনেক বাইরের নৌকা এসে ঠেকত। কলকাতা, দমদম, শ্রীরামপুর থেকে আসা ব্যবসায়ীরা সাগরে যাবার পূর্বে রাত্তিরে এখেনেই নৌকা বাঁধতেন। রাত্রি যাপন করতেন। কিন্তু এই উপদ্রব শুরু হবার পর থেকে আর কেউই সেখানে টিহকতে পারতাে না। কাউকে ঘুমের মধ্যে টেনে জলে ডুবিয়ে মারা হতাে। কেউবা গাছে ঝুলে মরতেন। মােট কথা কেউ আর সেখানে নৌকা ভিড়াতাে না।
এরপর গাঁয়ের আরও দুটো না তিনটে লােক একইভাবে উদ্বন্ধনে মরার পর গােপন আশঙ্কাটি আর চাপা রইলাে না। গাঁয়ের মােড়ল স্বয়ং এক সভা ডেকে হারাণ বাগদীর কথা তুললেন এবং সেই অতৃপ্ত, কুচক্রী প্রেতই যে এ সবকয়টি অপঘাতের জন্য দায়ী তা সব্বাই একবাক্যে স্বীকার করে নিলাে। অবশেষে বিস্তর আলােচনা করে তারাচরণ, নিত্যানন্দ আর কয়েকজন মিলে গাে-যানে রওনা দিলাে বিনু তান্ত্রিকের ডেরার উদ্দেশে, আর পরদিবসে সেই তান্ত্রিক এসে হাজির হলাে নেকড়েমারীতে।
বিনু তান্ত্রিক নেহাৎ খেলাে তান্ত্রিক ছিলেন না। সাতগঞ্জে তাঁকে লােকে একডাকে চিনতাে। সে গাঁয়ে এসে ডেরা বাঁধলে নাটমন্দিরের পাশে। কিছুক্ষণ বিড়বিড়িয়ে কি সব বকবক করার পর নীচু হয়ে একতাল মাটি তুলে শুকতে লাগলাে, আর একটু পরে পৃথিবীকে সেই মাটি ফিরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বললাে,
-“তোদের গায়ে ভূলাে ঢুকেচে। বাসা বেঁধেচে নদীপারের বুড়াে বটগাছে। সেই মানুষ মারচে। একে এখনি না বিনাশ করলে গাঁ উজাড় করে দেবে সেই দুষ্টু আত্মা। আমি এখন সারাদিন ধরে ভূলাে ধরার উপযুক্ত দ্রব্যাদি তৈয়ারী করবাে। তােরা সন্ধ্যায় সবাই এখেনে এসে হাজির হবি। তখন আমি সেই পাপাত্মাকে বন্দী বানাবাে। এখন তােরা যাঃ।
সূর্য ডুবতেই প্রচুর লােকজন হাজির হলাে নদীপাড়ে। সবাই সাক্ষী থাকতে চায় এই আজব ঘটনার। সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিকে ওদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর বিনু তান্ত্রিক এসে স্থির হলাে মধ্যিখানে। হাতে একটা লােহার পেরেক নিয়ে কি সব মন্তর পড়ে সেটি বটগাছের গায়ে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। একটা ধূলাের ঝড় উঠলাে। চতুর্দিক ধূলায় ধূলায় আবিষ্ট হয়ে, কালাে অন্ধ হয়ে উঠলাে। যখন ঝড়ের তেজ প্রশমিত হলাে, তখন সবাই নজর করলে যে, গাছের থেকে একটু দুরে দাঁড়িয়ে রয়েচে হারাণ। হারাণ নয়, তার অশুভ, অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। সে সক্রোধে ফুসচে। সেই হারাণ বাগদী, যাকে গ্রামবাসীরা নিজ হস্তে পুড়িয়েছে।
তান্ত্রিক একটা সলতে পাকাননা প্রদীপ হাতে হারাণের পানে চেয়ে কইলাে
– “কেন মেরে বেড়াচ্চিস এঁদের? কী চাই তাের?”
উত্তরে হারাণ খিলখিল করে হেসে উঠলাে, যে হাসি কেবলমাত্র প্রেতের পক্ষেই হাসা সম্ভব। সে হাসিতে শকুনের কান্না, শেয়ালের ফুকার, ঝড়ের শব্দ, সব একাকার হয়ে গিয়েছে।
– “এখনাে কিছুই করিনি তান্ত্রিক, তবে করবাে। এই গাঁ’কে চিতেয় তুলে তবে আমি জুড়ােবাে। তুই ফিরে যা, ফিরে যা।”, এই বলে সে আবার ভয়ানক হাসি হেসে উঠলাে।
তান্ত্রিক এবার অস্ফুট স্বরে মন্তর বিড়বিড় করতে লাগলাে,
– “ওহ কালী কালী কালীকে, চন্ড মুন্ড খন্ড খন্ডী, রুদ্র দন্ড পালিকেঃ…
এটা শােনা মাত্র হারাণ চক্রাকারে হাওয়ায় ঘুরতে শুরু করলাে আর হাসতে থাকলাে। তান্ত্রিক মহা খাপ্পা হয়ে আবারও সেই মন্তর আওড়ালাে, কিন্তু একইভাবে আবারও হারাণ অস্থিরভাবে ঘুরতে শুরু করলাে।
“হাঃ হাঃ হাঃ… তুই নিজেকে বড়াে চালাক ভাবিস না রে তান্ত্রিক? ভাবচিস এই মন্তরখানা পড়ে প্রদীপখানা জ্বাললেই আমাকে জায়গাতেই বেঁধে ফেলবি? বাঁধাচ্চি। আমি এক জায়গায় স্থিতু না হলে তাে তাের এই জারিজুরি কাজ করবে নে। এবার দেখ আমি কী করতে পারি…”
হারাণ একটু থেমে নিজের বাঁ হাতের উপরিস্থলে নিজের ডান হাতখানা রেখে একটুক্ষণ কি যেন ফিস্ ফিস্ করলাে, পরক্ষণেই তার শরীর থেকে এক ভয়ঙ্কর হাওয়ায় ঝাপটা এসে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের বুকে সজোরে ধাক্কা দিলাে। সেই দানবীয় বাতাসের ঝাপটায় কেউ ছিটকে পড়ে গেল, কেউ নদীতে নিক্ষিপ্ত হলাে, আর তান্ত্রিক আছাড় খেয়ে পড়লাে মাটিতে।
লােকজন প্রাণভয়ে ছুটোছুটি শুরু করলাে, আর হারাণ এসে দাঁড়ালাে ভূপতিত বিনু তান্ত্রিকের শিয়রে। মুখে তার শয়তানের হাসি। বিনু আপন মনে অবিশ্বাসের সুরে বললাে – “এই প্রথম আমার ভুল হলাে। ভূলাে নয়, ভূলাে নয়। এ অন্য কিছু। ভূলাে বা নিশির থেকেও জবর কিছু। আমি কেন ধরতে পারচি নে! কিছুতেই পারচি নে!”
বিনু তান্ত্রিক মাটির থেকে উঠে হারাণের দিকে চেয়ে, অস্ফুট বিস্ময়ের স্বরে শুধােলেন – “কে? কে তুই শয়তান?”
পরের দিন প্রভাতে বিনুর দেহটা গাছের ডালে ঝুলতে দেখা গেল। এত বড়াে সাধকের এমন বেঘােরে মৃত্যুর পর বাইরের লােকেরা ঐ গ্রামে আসা অবধি বন্ধ করে দিলাে। একটা মরণান্তক কাল বিভীষিকা নিজের ধারালাে থাবা পেতে বসে রইলাে একটার পর একটা শিকারের অপেক্ষায়। মাঝে মাঝেই এক আধটা মানুষ, গােহালের গরু, ছাগল মরতে লাগল।
এমনিভাবেই দিন কাটছিলাে। এক রাত্তিরে গাঁয়ের লােকেরা মধ্যরাত্রি আন্দাজ নদীপাড়ের দিক থেকে একটা কোলাহল শুনতে পেলাে। কোলাহল ঠিক নয়। অনেকগুলি লােক যেন কিছু একটা দেখে ভয়ার্ত গলায় চেঁচামেচি করচে। গ্রামের লােকজন একটু অবাক হল। হারাণের প্রেতাত্মার খবর ছড়িয়ে পরার পর নদীতে আর কোনাে নৌকাই রাত্তিরে ভেড়ে না। যদিও বা মনভুলান্তে চলে আসে, তবে কিছু একটা দেখে ভয়ে পরিত্রাহী সে ঘাট পরিত্যাগ করে। তবে ঘাটে উঠে এই মাঝরাতে শব্দ করে কারা ?
প্রভাতে সূর্য উঠলে পর তারাচরণ, ঘােষাল, ভটচার্য, পরেশ নাপিত, আর দুই চারজন লােক নদীর ঘাটে গিয়ে গিয়ে দেখলাে ঘাটে একখানা ছােটো বজরা বাঁধা। চড়ায় অনেকগুলাে গাছ পড়ে আছে ইতস্ততঃ। খোঁজ নিয়ে জানলাে সেটা গতকাল রাত্তিরে এখানে ভিড়েচে। রাতে মাঝি খালাসীরা নদীর চড়ায় নেমে রান্না করে খেয়েছে। এমন সময়ে দেখলাে একটু দূরে বজরার মালিক। উবু হয়ে বসে মাটিতে কী যেন খুঁজচে। গাঁয়ের এদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালাে। তাঁর বয়স পঞ্চাশের আশপাশ। ঋজু দেহ, পরনে ধপধপে শুভ্র ধুতি আর কামিজ। তারাচরণের দল বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাে। পরেশ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “আজ্ঞা, আপনারা?”
-“ব্রাহ্মণ। আমার নাম কালীপদ মুখুজ্জে। নিবাস দীঘড়া।”
– “পেন্নাম কত্তা। তবে আপনারা… মানে গতকাল রাত্তিরে আপনারা এখেনেই ছিলেন আজ্ঞে ?”
– “তাই তাে ছিলুম। অচেনা অজানা মুলুকে এসে ঝুপ করে সাঁঝ নেমে গেল, তাে আমি কইলেম এখেনেই রাতটা পােহাক। সকালে যাত্রা করবাে খন।”
-“আপনারা সারা রাত্তির ঘাটে ছিলেন, মানে কিছু বুঝতে টুঝতে পারেননি?”
– “তা আর বুঝিনি? অতিথি সৎকারের তত দিব্য জোগাড় করে রেখে দিয়েচিলি তােরা। আর একটু হলেই পৈতৃক প্রাণটা হারিয়েছিলাে আরকি।”
-“আজ্ঞা ?”
-“অমন ন্যাকা সাজলে চলবে? হতভাগা সব জানিস তােরা। গাঁ খানাকে এক্কেরে ভূতের ডেরা বানিয়ে ফেলেছিস দেখছি।”
-“আপনারা চোখে দেখেছেন তাকে? তারপরেও…”
-“কী ? তারপরেও কী ? বেঁচে বর্তে কথা কইচি কেমন করে, তাইতাে? আসচে কাল আমার ছােটো মেয়েটির বিবাহ। আমি গিয়েছিলাম সেই উপলক্ষ্যে শহরে কিছু কাপড় চোপড় খরিদ করতে। আমার লােকলস্কর কাল সবে বেঁধেবেড়ে চাট্টি মুখে দিতে বসেছে, তার মধ্যেই কি ভয়ানক উৎপাতটাই না শুরু হল। থেকে থেকে ঝড় ওঠে, থেকে থেকে গাছের ডাল এসে আছড়ে পড়ে, সে কী কাণ্ড।”
তারাচরণ সরু চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শুধােলো,
– “আপনি ভয় পাননি?”
-“ও মা কথা শােনাে তার। পাইনি আবার? আমি তাে ভয়েই মরি, এ আবার কি উপদ্রব রে বাবা।”
-“তারপর !”
– “তারপর আবার কী? দু একখানা মন্তর শিখেছিলাম এককালে, তাই দিয়েই কোনােমতে ঠেকিয়ে রেখেছিলাম কাল। মাঝিমাল্লারা তাে ভয়েই সারা। চ্যাঁচাতে লাগল।”
এমন সময়ে মাল্লাদের সর্দার উত্তর করলে,
– “আজ্ঞা ভয় পাইনি কত্তাবাবা। আপনি খােদ যে মাটিতে রয়েছেন সেখেনে কারে ডরাই?”
এই বলে সে গ্রামের দলের দিকে মুখ ঘুরে কইলাে, “আপনারা হয়তাে জানেন না, আমাদের এই কত্তাবাবা একজন মস্তো বড়াে…?”
ব্রাহ্মণ হাঁ হাঁ করে বলতে বাধা দিতে যাচ্ছিলাে, এমন সময়ে পরেশ তাঁর পায়ের কাছে সটান শুয়ে পড়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠলাে, “আমাদের দয়া করুন ঠাকুরমশায়। আমরা ভূলাের পাল্লায় পড়েচি। বড় বিপদ। আপনি নিশ্চয়ই বুঝেচি সাধারণ লোেক নন। এ ঘাটের বাঁওড়ে আজ কতগুলাে নরহত্যা হয়েছে আপনি জানেন না। কেউ এই গাঁয়ে খােলা আকাশে রাত কাটাতে পারে না। আর আপনি তাকে ঠেকিয়ে অবদি রেখেছিলেন। আপনাকে আপনার ইষ্টদেবতার দিব্যি। আমাদের দয়া করুন, দয়া করুন।
কালীপদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে গাছের গুঁড়িতে বসল।
সে তার পুরাে পরিচয় এই লােকেদের দেয়নি। রায়দীঘড়ার নামকরা মুখুজ্জে বংশের সন্তান সে। নিজে একজন ডাকসাইটে গুণীন। স্বয়ং অঘােরী হংসী তান্ত্রিকের শিষ্য। এই হংসী তান্ত্রিকের একটা ভয়ংকর ঘটনা তােমাদের আমি সময়মতাে বলবােখন। যাই হােক, কালীপদ পড়ে গেল মহা দোটানায়। একদিকে মেয়ের কন্যাদানের দায়িত্ব, অন্য দিকে এতগুলাে মানুষের প্রাণ। গুরু হংসী তাঁকে শিষ্যাবস্থায় কয়েছিলেন, “অকারণে, তুচ্ছ স্বার্থে বা নাম অর্জনের জন্য এই বিদ্যে প্রয়ােগ করবিনে। আর অসহায়কে কক্ষণাে ফেরাবিনে।”
দোনামনা করে অবশেষে কালী নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেললাে। নিজের লােক লস্করের দিকে চেয়ে কইলাে,
“কী করা যায় বল দেখি কানাই। তােরা কি আর একটা দিন রইতে পারবি এখেনে?”
মাল্লাদের সর্দার কানাই উত্তর করল,
“তার আর সমিস্যে কি কত্তা। আপনি যেথায় রয়েছেন সেখানে ভয়টা কিসের। কী করতে হবে আজ্ঞা করুন।
“আমার সঙ্গে চল। গাঁয়ের ভিতর যেতে হবে। এবার বল দিকি কেউ কি অপঘাতে মরেছে এর মধ্যে?”
পথ চলতে চলতে নিত্যানন্দ ঘােষাল বলতে থাকলাে,
“মাস খানেক পূর্বে হারাণ বলে একটি লম্পট ছােকরা এই ভায়ার মেয়ের প্রেমে পড়ে বাতুল হয়ে উঠেছিল। এঁর মেয়ে এখন আমার ঘরের বধূ। আমরা তাকে বকাঝকা করে মানসীর বিয়ে আমার ছেলে মাধবের সঙ্গে দিয়ে দিই। সেই হতাশায় ঐ নদীঘাটের বটগাছে গলায় দড়ি দেয় হারাণ। বিপদ থেকে বাঁচতে সদর থেকে এনেছিলেম নামকরা বিনু তান্ত্রিককে, কিন্তু সেও…”
-“অঃ, তা যেন বুঝলুম। তা, সে মেয়ে এখন এ গাঁয়ে নেই নিশ্চয়ই।”
-“না মহাশয়। আমার পুত্র তাকে নিয়ে উলুবেড়ে থাকে।”
কথা কইতে কইতে তারাপদর দল আশায় বুক বেঁধে আগে আগে চললাে, আর পিছন পিছন কালীগুণীন আর কানাই। নাটমন্দিরের কাছাকাছি এসে কালী বললে, “আর নয়, এখানেই দাঁড়া।” কালী নাক তুলে বাতাসের থেকে কিসের যেন আঘ্রাণ নিলাে। থুথু ফেললাে। নীচু হয়ে একতাল মাটি তুলে । নাকের কাছে নিয়ে অনেকবার ধরে শুকলাে। তারপর মাটি ফেলে দিয়ে বললাে, “এ, এ যে সাঙ্ঘাতিক বিপদ। ভূলাে কোথা? তােদের গাঁয়ে দেখছি কানাওলায় বাসা করেছে। এ বিপদ আনলি কোত্থেকে!”
-“ঐ যে বললাম বাবাঠাকুর, ঐ হারাণ বাগদীই এখন…”
তাদের থামিয়ে দিয়ে কালী মাথা নেড়ে বললাে, “উহু, মিলছে না। তােরা যা যা বললি আমায়, তার মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আচ্ছা, তােরা কি ওকে কোনােভাবে ঠকিয়েচিলি বা ভুল পথে ঘুরিয়েচিলি?”
-“আমরা ঠকাইনি বাবাঠাকুর। তবে বিয়ের আগে আমরা পাশের গঞ্জে হরি দুলের চালের আড়তে একটা দিন লুকিয়েছিলাম, আর খবর রটিয়ে দিয়েছিলাম যে আমরা কলকেতা চলে গিয়েচি। সেই শুনে হারাণ ছুটে চলে গেল কলকেতায় আমাদের খুঁজতে। এ ছাড়া যে উপায় ছিল না।”
-“তবেই তাে বলি! এইবারে মিললাে। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমি হয়তাে এই ভয়ানক ধূৰ্ত্ত কানাওলার মােকাবেলা করতে পারবাে না বাছা। সে যখন এটা বুঝে গিয়েচে যে কি মন্তরে আর কি উপায়ে তাকে বন্দী করা যেতে পারে, তখন তাকে বন্দী বানানাে অসম্ভব। তাকে বাঁধার জন্য তাকে কিছুক্ষণ এক স্থানে স্থিতু করা আবশ্যক, কিন্তু সে আর এক জায়গায় স্থির হবেই না”, কালী উত্তর করল।
তারাচরণ কেঁদে ফেলে কইলাে, “দয়া করুন বাবাঠাকুর। আমাদের এইবারে সে হতভাগা একে একে নিকেশ করচে। আমার বড়াে ছেলেটাকে খেয়েছে। এই সেদিন রাত্তিরে শুনি আমার গরু বাছুরগুনাে দেদার দৌড়চ্চে। সে হতভাগা গরুগুলার দড়ি খুলে দিয়েছে। ভেবেচে সেগুলাে আটকাবার জন্যে আমি বা আমার ছােটোছেলে বাইরে বেরুবাে, আর সে টেনে নিয়ে যাবে, কিন্তু আমি বেরুতে দিইনি। সকালে গােটা গাঁ খুঁজে খুঁজে তাদের ধরে এনেছি।”
পরেশ নাপিত বললাে, “আমারও তাই হয়েছিলাে ঠাকুরমশায়। আমিও রাত্তিরে বাইর হইনি।”
শােনা গেল অনেকেরই এই একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। কালী আনমনে কি যেন একটা ভাবছিলাে। এই শেষ কথাটা শুনে সে চমকে উঠলাে।
-“কী বললে? তােমাদের অনেকেরই গরু খুলে দিয়েচে হারাণের প্রেত?”
-“আজ্ঞা হাঁ বাবা।”
-“আচ্ছা, গােরুগুলােকে যখন সে খুলে দিয়েছিলাে, সকালে গােরু বাঁধা দড়িগুলাে পেয়েছিলে? বেশ করে ভেবে বললা দিকি। কষে ভাবাে।”
– “একে একে সকলেই স্বীকার করলে যে, তারা কেউই দড়িগুলাে খুঁজে পায়নি। পরবর্তিতে নূতন দড়ি এনে গােরু বেঁধেছে।”
কালীগুণীন বহু সময় চুপ করে থেকে বললেন, “আমি নিশ্চিতরূপে বলতে পারছি না, তবে ঐ বদমায়েস কানাওলাকে ধরার একটা উপায় হয়তাে আমি পেলেও পেয়েছি।”
গ্রামের লােকেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে অধীরভাবে প্রশ্ন করল, “কী উপায়, কী উপায়!”
কালী মাথা নেড়ে বললে, “উঁহু, তা তােদের বলা যাবে না। আজ আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। আমি কাল বিকেলে আসবাে। যা হবার কাল হবে। আমার দুটো শক্ত পােক্ত আর চালাকচতুর ছেলে চাই। তাদের মধ্যে একজন আজই যাবে নয়াচরে, হারাণের ভাইয়ের থেকে তার বাড়ির চাবি আনতে, আর দ্বিতীয় জনকে সঙ্গে নিয়ে আমার কানাই সদ্দার এখনি রওয়ানা হবে শহরে। আছে কেউ?”
তারার ছেলে রাধাচরণ আর পরেশ নাপিতের যাওয়া স্থির হল। কালীপদ কানাইকে বেশ করে বুঝিয়ে দিলেন কি করতে হবে। আর নিজে নিত্যানন্দদের ডেকে কইলেন, “শােননা বাবা সকল, আমি যা করতে চলেছি তা অতি দূরূহ কাৰ্য। আমাকে আজ বাড়ি যেতেই হবে। তােমরা কোনােভাবেই সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরুবে না, আর দিন থাকতে থাকতে একটা আগুন জ্বেলে, গাঁয়ের যতাে কিছু দড়ি-দড়া, গামছা, পাটের ফেঁসাে আছে, সব পুড়িয়ে ফেলাে। একগাছিও যেন কোথাও অবশিষ্ট না থাকে। বেশ করে খুঁজবে। তবেই তােমাদের বাঁচাতে পারবাে। আমি চললুম। পরশু দেখা হবে।”
কালী মুখুজ্জে সকাল আটটা নাগাদ বজরা নিয়ে চলে গেলেন রায়দীঘড়া। বিকেলের আগেই পরেশ চাবি নিয়ে এসে গেল, আর কানাইকে নিয়ে রাধাও শহর থেকে ফিরে এল। গাঁয়ের যেখানে যত লােক ছিল, সবাই মিলে দ্বিপ্রহরের মধ্যেই সমস্ত দড়ি দড়া গামছা ভস্মীভূত করে ফেললাে।
যখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়, সে সময়ে নৌকা চেপে ঘাটে নামলাে তারাচরণের কন্যা মানসী ও তার স্বামী। বিয়ের পর এই প্রথম তারা ঘুরতে এসেচে গ্রামে।
তাদের দেখে লােকজন মহা কোলাহল শুরু করে দিলাে। তারাচরণ কন্যা ও জামাতাকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলেন। বললেন, “হায় হায়, তােমরা আজই কেন এসে পড়লে! তােমাদের উপরেই যে তার আক্রোশ সবচাইতে বেশি। এদিকে যে বড়াে বিপদ আমাদের।
মানসী আর তার স্বামী ধীরে ধীরে সকল কথা অবগত হলেন, কিন্তু এই সন্ধ্যাকালে তাে ফিরে যাবারও উপায় বন্ধ। অগত্যা রাত্তিরে মাধব আর মানসীকে শয়নঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে, নিত্যানন্দ আর তারাচরণ স্বয়ং কপাটের বাইরে বসে রইলাে। পরশু কালীগুণীন আসবে। সব ঠিক হয়ে গেলে ও যেতে পারে।
রাত্তির তখন মধ্যপ্রহর হবে। ঘােষালের গৃহের ভিতরে একটা হালকা বাতাস উঠলাে। সেই বাতাসের ঢেউ গায়ে লাগা মাত্র দুই বেহাই একসাথে নিদ্রায় অচেতন হয়ে পড়ল। কপাট ভেদ করে ঘরে ঢুকলাে হারাণ। মুখে তার পৈশাচিক হাসি।
-“মানসী! মানসীইইইইই!”
ঘুমন্ত মানসী এই ডাক শুনে উঠে বসল। তার চোখে নিশির ঘাের।
– “আমায় মনে আছে তাের মানসী?”
– “আছে হারাণদা।”
-“আমার সঙ্গে আসবি? ভারি মজা হবে।”
– “যাবাে হারাণদা, যাবাে।”
-“তবে আয়য়য়য়য়য়! আয় আয় আয় আয়।”
কুহকের এই আহ্বানে মানসী আলুথালু বেশে বাইরে বেরিয়ে এল। গােটা গাঁ তখন নিদ্রায় মগ্ন। মানসী এলােমেলাে পায়ে চলেছে তাে চলেচেই। কতক্ষণ চলেচে জানে না, হঠাৎ শীতল বাতাস চোখে মুখে লাগায় সে তাকিয়ে দেখলে, সে এসে দাঁড়িয়েচে নদীপারের বটগাছের তলায়।
-“আমি তােকে ভালােবেসে মরেচি, তা তুই জানিস মানসী?”
-“শুনেচি হারাণদা।”
হারাণ ফিসফিস করে বললাে, “আজ আমরা এক হয়ে যাবাে। চিরদিনের মতাে। তবে তার আগে তােকে একটা মজার কাজ করতে হবে। একগাছি দড়ি গলায় দিয়ে সুড়ুৎ করে ঝুলে পড়তে হবে। এ অবস্থায় তাের তিলমাত্তর বেদনা হবে না। পারবি তাে?”
-“খুব পারবাে। দড়ি দাও।”
হারাণ আবার প্রেতসুলভ হাসি হেসে উঠলাে।
– “দাঁড়া। দড়ি দিচ্চি।” এই বলে হারাণ ঝড়ের গতিতে হাজির হল ছেনু দুলের গােহালে।
শুধু ছেনুর কেন, গাঁয়ের কোনাে গােহালেই কোনাে দড়ি পেলাে না সে। ক্ষিপ্ত হয়ে গােটা গাঁ তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল, কিন্তু নাহ। নেহাৎ তার গাঁয়ের বাইরে যাবার সাধ্যি নেই, নাহলে একটা দড়ি তার এক্ষুনি দরকার। বেশি দেরী হলে মানসীর ঘাের কেটে যাবে। বুঝেছি, এ সবই ঐ হতভাগা গুণীনের বুদ্ধি। ভেবেচে এইভাবে তাকে জব্দ করা যাবে!
-“হয়েছে। উপায় হয়েছে।”
হারাণ নিজের মনেই হেসে ওঠে। বাতাসে ভর করে এসে দাঁড়ায় নিজের ঘরের সামনে। ঘরের দরজা খােলাই পড়ে আছে। ঘরের ভিতরে তার জীবিতকালের দড়ি বােনার পাট, দড়িকল, সবই মজুত রয়েছে। হারাণ নিবিষ্টচিত্তে দড়ি বুনতে বসে গেল। খুব মজবুত দড়ি চাই। আজ কি শুভক্ষণ। আজ তার জীবিতকালের ইচ্ছে পূরণ হবে। হতভাগা তান্ত্রিক ভেবেচিলাে, দড়ি না পেলে সে মানুষ মারতে পারবে না? সে যে নিজেই দড়ির কারিগর, তা তাে কালী জানে না।
পাকে পাকে দড়ি তৈরি হতে হতে, যখন প্রায় বােনা শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎ হারাণ শুনতে পেলাে এক ভরাট, গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ,
“ওঁ, চিত্তরূপিণী মহামায়েঃ, দিব্যঃ তেজঃ সমন্বিতেঃ,
তিষ্ঠ দেবী শিখা মধ্যে, তেজবৃদ্ধিং কুরুণ অহঃ মেঃ।”
হারাণ চমকে উঠে একলাফে উঠতে গিয়ে আবিষ্কার করল সে বন্দী হয়েছে। অদৃশ্য, অদেখা এক মন্ত্রপাশ তাকে পাকে পাকে বেঁধে ফেলেচে। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েচে শ দেড়েক গ্রামবাসী। তাদের সামনে কপাটের সুমুখে রয়েছে মানসী। তার চোখে আর ঘাের নেই। আর মানসীকে আড়াল করে কপাট জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কালী। কালীপদ গুণীন।। তার হাতে জ্বলচে এক মাটির প্রদীপ। মুহূর্তের মধ্যে কালীর সব চালাকি বুঝে ফেললাে হারাণ। হিংস্রভাবে বললাে,
-“তুই তবে জানতি যে আমি এখেনে আসবাে।”
-“উঁহু, জানতাম না। আন্দাজ করেছিলাম। আমিই কানাইদের দিয়ে মানসীকে আনিয়েছিলাম, কিন্তু একসাথে ঢুকলে তুই সন্দেহ করতি। তাই মানসী এল পরের নৌকায় সন্ধ্যাবেলায়। ওকে সব কয়ে রেখেচিলাে কানাই। সাহসী মেয়ে বটে একখানা। রাজী হতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি। কয়েচিলাে, ‘আমা হতেই যখন বিপদের শুরু, তখন একে শেষও করবাে আমিই। তাই আমি চলে গেলেও বিকেলের আগে বজরা নিয়ে পাশের গাঁয়ের ঘাটে ফিরে আসি, আর সেখান থেকে সাঁতরে এসে, লুকিয়ে থাকি ঘাটের বাঁওড়ের কাছে।
আমি আন্দাজ করেছিলাম যে তুই ঘাড় মটকাসনে, জলে ডুবাসনে, কেবলমাত্র নিজের মৃত্যুর কষ্ট বােঝাবার জন্য গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দিস। মানসীকেও নিশ্চয়ই তাইই করবি। এটাও বুঝেছিলাম যে দুড়ি তাে তুই মায়ামন্তরে তৈরি করতে পারবিনে। আমিই পারিনে তাে তুই। তাের দড়ির দরকার হবেই হবে, আর তিলমাত্র দড়িও না পেয়ে তুই নিজেই তা তৈয়ারী করতে বসবি, কারণ এ রাত চলে গেলে আর পাবিনে।
এই একটাই উপায় ছিল তােকে কিছুক্ষণ এক জায়গায় স্থির পাবার। এবার এই গাঁ শাপমুক্ত হবে।”
হারাণ তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলাে, আর সঙ্গে সঙ্গে কালী নিজের হাতের প্রদীপটা ছুঁড়ে দিলাে তার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে হারাণের গায়ে আগুন লেগে গেল। সেই ধোঁয়ার পিন্ড হতে গর্জন হতে হতে একসময়ে থেমে গেল। আগুন নিভে গেল।
গাঁয়ের লােকেরা লুটিয়ে পড়ল গুণীনের পায়ে। আর বিপদ নাই। মুক্তি!
তারাচরণ কুণ্ঠিত স্বরে বললাে, “আপনি আজ যে ত্যাগ স্বীকার করলেন, তার তুলনা জগতে মেলা ভার বাবামশায়। আমাদের রক্ষা করতে গিয়ে আপনি জীবনের সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব, আপন কন্যার কন্যাদান থেকে বঞ্চিত হলেন।”
-“আরে না না। আমার হয়ে কন্যা দান করেচে আমার বড়াে দাদা। আজ নয় কাল হারাণ তােমার মেয়ে আর জামাইকে মেরে ফেলতােই। সেটাই ছিল তার লক্ষ্য। আমি তােমার মেয়েকে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেবতার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মাধবের হাতে তুলে দিয়েছি। এও তাে একপ্রকার কন্যাদানই হল। কী। বলাে ঘােষাল?
সবাই একযােগে হেসে উঠলাে।
-সমাপ্ত-