কানকাটা

গত ফাল্গুনের (১৩১৯) ‘সাহিত্যে’ শ্রীযুক্ত ঋতেন্দ্রবাবুর “কানকাটা” ঐতিহাসিক তথ্য নির্ণীত হইয়াছে। তথ্যটি সত্য কিংবা অসত্য আলোচিত হইবার পূর্বে একটা সন্দেহ স্বতঃই মনে উঠে, ঠাকুরমশাই প্রবন্ধটি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখেন নাই ত? কেননা, ইহা সত্য সত্যই সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা এবং যথার্থই সত্য, তাহা মনে করিলেও দুঃখ হয়। তবে যদি হাসাইবার অভিপ্রায়ে লিখিয়া থাকেন, তাহা হইলে প্রবন্ধটি নিশ্চয়ই সার্থক হইয়াছে। কিন্তু আর কোন উদ্দেশ্য থাকিলে বোধ করি ব্যর্থ হইয়াছে এবং হওয়াই মঙ্গল। যাহা হউক, উক্ত প্রবন্ধে ঠাকুরমশাই বলিয়াছেন, “কানকাটা, কন্দকাটা, বা উড়িষ্যার খোন্দ জাতিরা বাইবেল-কথিত কানানাইট জাতি ভিন্ন আর কিছুই নয়।” এই ‘কিছুই নয়’টি প্রমাণ করিবার জন্য তিনি এই উভয় জাতির মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করিয়াছেন এবং জাতিতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন। আমার এক আত্মীয় সেদিন বলিতেছিলেন, আজকাল বাঙ্গালাদেশে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের লেখক সবাই। কেবল ঝগড়া করিতে চায়—রামের আঁতুর-ঘর পশ্চিমমুখো কিংবা পূবমুখো ছিল। কথাটা তাঁহার নিতান্ত মিথ্যা নয় দেখিতেছি।

কিন্তু, জাতিতত্ত্ব জিনিসটি শুধু যদি খেলনার জিনিস হইত, কিংবা শখ করিয়া খান-দুই এ-ও-তা বই নাড়াচাড়া করিলেই ইহাতে ব্যুৎপত্তি জন্মিত, তাহা হইলে, আমার এ প্রতিবাদের আবশ্যকতা ছিল না। কিন্তু তাহা নহে। ইহা সত্য-উদ্ঘাটন—চুট্‌কি গল্প লেখা নহে। অতএব, জাতিতত্ত্ববিৎ বলিয়া প্রবন্ধ লিখিয়া খ্যাতি অর্জন করিবার পূর্বে কিছু ‘সলিড’ পরিশ্রমের আবশ্যক। সুতরাং যে দুর্ভাগারা অনেকদিন ধরিয়া গায়ের অনেক রক্ত জল করিয়া নীরস বইগুলি ঘাঁটিয়া মরিয়াছে, এ ভার তাহাদের উপর দিয়া নিশ্চিন্ত মনে সরস কবিতা এবং রসাল সাহিত্যিক প্রবন্ধে বা গল্পে মনোনিবেশ করাই বুদ্ধির কাজ। খান-দুই বই ভাসা ভাসা রকম দেখিয়া লইয়া এবং গোটা-দুই সাদৃশ্য উপরে উপরে মিলাইয়া দিয়া একটা অভিনব সত্য প্রচার করিতে পারা সাহসের পরিচয় সন্দেহ নাই; কিন্তু এ সাহসে কাজ হয় না, শুধু অকাজ বাড়ে। যেমন, তাঁহার দেখাদেখি আমার অকাজ বাড়িয়া গিয়াছে এবং যে হতভাগ্যেরা এগুলো পড়িবে, তাহাদের ত কথাই নাই। অবশ্য, পুরুষমানুষের সাহস থাকা ভাল, কিন্তু একটু কম থাকাও আবার ভাল। যা হউক কথাটা এই। ঠাকুরমশাই উড়িষ্যার (কলিঙ্গ) খোন্দ এবং বাইবেলের কানানাইটের মধ্যে গুটি পাঁচ-ছয় মিল দেখিয়াই উভয়কে সহোদর ভাই বলিয়া স্থির করিয়াছেন, কিন্তু গরমিলের ধার দিয়াও যান নাই। অবশ্য গরমিল দেখিতে যাইবার অসুবিধা আছে বটে, এবং এই অসুবিধা ভোগ না করিয়াও যা হউক একটা কিছু লেখা যায় সত্য, কিন্তু তাহাকে সত্য আবিষ্কার বলে না। যাহা বলে তাহা পিক্‌উইক পেপারের আরম্ভটা। তা ছাড়া, শুধু সাদৃশ্য দেখিয়াই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে কত বিপজ্জনক, তাহার একটা সামান্য দৃষ্টান্ত দিতেছি। এই সেদিন চন্দ্রগ্রহণ উপলক্ষে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা থালায় জল লইয়া হাঁ করিয়া বসিয়াছিল।

গ্রহণ লাগিলে তাহারা দেখিবে। হঠাৎ শাশুড়ী ঠাকরুন বলিলেন, “হাঁ বৌমা, কালীচরণ যে পাঁজি দেখে বলে গেল সাতটার পূর্বেই গেরণ লাগবে, সাতটা ত বেজে গেল, কৈ একবার ভাল করে পাঁজিটা দেখ দেখি গা!” দেখিলাম, পাঁজিতে লেখা আছে, ‘দর্শনাভাব’। বলিলাম, “গেরণ হয়ত লাগবে, কিন্তু দেখা যাবে না।” ঠাকরুন বিশ্বাস করিলেন না, বলিলেন, “সে কি কথা বৌমা? কালী যে বেশ করে দেখে বলে গেল, ‘দশানা ভাব’ দেখা যাবে, আর তুমি বলছ একেবারেই দেখা যাবে না? এ কি হয়? দশানা না হউক আটানা, আটানা না হউক চার আনাও ত দেখতে পাওয়া চাই!” কালীচরণকে ডাকানো হইলে আমি আড়ালে থাকিয়া বলিলাম, “সরকারমশায়, পাঁজিতে দর্শনাভাব লেখা আছে—গেরণ ত দেখতে পাওয়া যাবে না।” কালীচরণ হাসিয়া বলিল, “বৌমা, কর্তা স্বর্গে গেছেন—তিনি বলতেন, গাঁয়ের মধ্যে পাঁজি দেখতে যদি কেউ থাকে ত সে কালী। ঐ যার নাম দর্শনাভাব, তারই নাম দশানাভাব। শুদ্ধ করে লিখতে গেলে ঐ রকম লিখতে হয়। এ বড় শক্ত বিদ্যে বৌমা, পাঁজি দেখে দেওয়া যে-সে লোকের কাজ নয়!” আমি অবাক্‌ হইয়া গিয়া ‘রেফের’ উল্লেখ করিয়া বলিলাম, “শ’য়ের মাথায় ঐ খোঁচাটার মত তবে কি রয়েচে? ‘আ’-কার এদিকে না থেকে ওদিকে কেন?” কিন্তু আমার কোন কথাই খাটিল না। কালীচরণ সাদৃশ্য দেখিতে পাইয়াছে—সে হটিল না। বরং আরো হাসিয়া বলিল, “বৌমা, ওগুলো শুধু দেখবার বাহার। ছাপাড়েরা মনে করেছে, ঐগুলো দিলে বেশ দেখতে হবে। শোননি, লোকে কথায় বলে—যেন ছাপাড়ের বিদ্যে! ওগুলো কিছুই নয়।” এই বলিয়া সে ‘দর্শনাভাব’কে’ ‘দশানা ভাবে’ সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া জয়োল্লাসে হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া গেল। তবু, সে বাড়ির গোমস্তা—ব্যাকরণ পড়ে নাই। সে-রাত্রে যদি সে ঠাকুরমশায়ের মত ‘র-ল-ড-লয়োরভেদঃ’ শুনাইয়া দিতে পারিত, তাহা হইলে আমার আর মুখ দেখাইবার পথ থাকিত না। যাই হউক, এ-সব ঘরের কথা,—না বলিলেও চলিত এবং কালীচরণ শুনিলে হয়ত দুঃখ করিবে, কিন্তু সামান্য ‘রেফ’টাকে তুচ্ছ করিয়া, ‘দর্শনাভাব’টাও যে দশানাভাবে দাঁড়ায়, এমন কি সাদৃশ্যের জোরে এবং ‘র-ল-ড’য়ের সাহায্যে এশিয়া মাইনরের কানানাইটও যে কলিঙ্গের কানকাটায় ষোল আনা রূপান্তরিত হয়, এই তুচ্ছ কথাটাই আজ ঠাকুরমশায়কে সবিনয় নিবেদন করিবার বাসনা করিয়াছি। এখন কোন পাঠক যদি ধরিয়া বসে, দশানাটা বুঝি, ষোল আনাটা কি? তাহা এই। উক্ত প্রবন্ধে ঠাকুরমশায় শুরুতেই বলিতেছেন—“পাঠক শুনিয়া বিস্মিত হইবেন যে, এই কানানাইটদিগের সহিত [উড়িষ্যার] কানকাটার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ আছে’ (দশানাভাব)। পরেই বলিতেছেন—“কানানাইটরা ইস্রেল-প্রবাসী কানকাটা ছাড়া আর কিছুই নয়” (ষোল আনা ভাব)। পাঠকেরা যে রীতিমত বিস্মিত হইবে, তাহা তিনি ঠিক ধরিয়াছেন। এমন কি, চন্দ্রগ্রহণের রাত্রের অপেক্ষাও।

যাহা হোক, এই ষোল আনার স্বপক্ষে ঠাকুরমশায় বলিতেছেন—“ইহাদিগের উভয়ের দেবতা, উভয়ের আচার-প্রথার মধ্যে আশ্চর্য সাদৃশ্য। উভয় জাতির আচার-প্রথা উহাদিগের দেবদেবী ইত্যাদি সকল বিষয় আলোচনা করিলে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কানানাইট ও কানকাটা উহারা উভয়ে একজাতীয় জীব।…প্রথমে উহাদের দেবতা ও নরবলি-দানপ্রথা বিষয়ে যে কিরূপ ঐক্য, তাহাই দেখাইতেছি। ভারতের কানকাটা বা কন্দকাটারা যদিও নানা দেবদেবীর উপাসনা করে বটে, কিন্তু তাহাদের সর্বপ্রধান দেবতা—ভূমির উর্বরা-শক্তির দেবতা বা ভূ-দেবী ‘তরী বা ‘তাড়ী’। ভূমির উর্বরা-শক্তি এই দেবীর উপরেই নির্ভর করে বলিয়াই তাহাদের বিশ্বাস। এই দেবীর সন্তোষের জন্যই বিশেষ কর্মে তাহারা নরবলি বা শিশুবলি দিতে প্রবৃত্ত হয়।” এই উভয় জাতির দেবতা যে একই দেবতা, তাহা দেখাইবার জন্য ঋতেন্দ্রবাবু বলিয়াছেন, “কানানাইটদিগেরও প্রধান দেবতা—উর্বরা-শক্তির দেবী। Their chief deity Astart, the goddess of fertility”। “কন্দদিগের ভূ-দেবী তরী বা তাড়ী (Tari) ও কানানাইটদিগের দেবী Ishtar (স্টার) বা Astarte (আসটার্ট)—উহারা একই শব্দের বিভিন্ন রূপ মাত্র, কেবল দেশভেদে উচ্চারণভেদ ঘটিয়া সামান্য বৈলক্ষণ্য উৎপাদন করিয়াছে। যেমন, সংস্কৃত ‘তার’ বা ‘তারকা’ শব্দে পূর্বে ‘s’ যুক্ত হইয়া star হইতে দেখা যায়, সেইরূপ এই ‘তারী’ শব্দেরও পূর্বে ‘s’ বা ‘as’ যুক্ত হইয়া Ishtar বা Astarte-রূপে পরিণত হইয়াছে। উচ্চারণকালে ‘ট’য়ে ‘ড়’য়ে বিশেষ প্রভেদ নাই।” ইত্যাদি, ইত্যাদি, যেহেতু ‘র-ল-ড-লয়োরভেদঃ’। প্রথমে এই দেবীটির আলোচনা প্রয়োজন। ঐক্য যাহা থাকিবার, তাহা ত উনিই একরকম দেখাইয়াছেন, অনৈক্য কোথায়, তাহাই বলা আবশ্যক।

ঋতেন্দ্রবাবু যাই দেখিতে পাইলেন ‘উর্বরা-শক্তি’ অমনি দুইটাকে এক করিয়া ফেলিলেন। কিন্তু উর্বরা-শক্তি মানে কি জমিরই উর্বরা-শক্তি? নারীর সন্তান প্রসব করিবার শক্তিকে কি বলে? উহার কথাটা ঐ পর্যন্ত সত্য যে, উভয় জাতিই উর্বরা-শক্তির পূজা করিত, কিন্তু কানানাইটরা যে উর্বরা-শক্তির পূজা করিত তাহা জমির নয়, নারীর। কারণ, যে চিহ্ন (Symbol) দ্বারা আসটার্ট দেবীটিকে প্রকাশ করা হইত, এবং যে কারণে দেবীর মন্দিরে ‘temple prostitution’ প্রচলিত ছিল, এবং যেহেতু “the licentious worship of the devotees of Astarte in her temple in Tyre and Sidon rendered the names of these cities synonymous with all that was wicked” তাহা ভূমির উর্বরা-শক্তি হইতেই পারে না। পুরাতন ধর্ম-সম্বন্ধীয় ইতিহাসের যে-কোন একটা খুলিয়া দেখিলেই পাওয়া যায়, Astarte কে Venus-দেবীর সহিত তুলনা করা হইয়াছে। যথা—Astarte, the Syrian Venus। ‘ভীনস্‌’ ভূ-দেবী নয়। আরো একটা কথা, এই খোন্দদিগের তাড়ী দেবীর মত কানানাইটদের আসটার্ট সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ছিলেন না। ইনি ‘বাল’ দেবতার পত্নীরূপেই পূজা পাইতেন। দেশে যতগুলি ‘বালিম’ ছিলেন ততগুলিই বিভিন্ন আসটার্ট ছিলেন।

এমন কি, এই দেবীটিকে কোন কোন স্থানে ‘শেম্বাল’ পর্যন্ত বলা হইয়াছে। ‘শেম্বাল’ অর্থে বালদেবতার ছায়া। ইনি পরে পরে অনেকগুলি নামে অভিহিত হইয়াছিলেন। (2. Kings 23. 13)। বাইবেলে আল্টারথ বলা হইয়াছে। আলেন সাহেব একস্থানে বলিয়াছেন, “The Astarte given to Hellas under the alias of Aphrodite came back again as Aphrodite to Astarte’s old Sanctuaries”। কিন্তু ইহার সাবের নাম ছিল ‘আশেরা’ সুতরাং ‘তাড়ী’র সহিত যদি কাহারো সম্বন্ধ থাকা উচিত ত এই আশেরার, আসটার্টের নয়। আমার ব্যাকরণে তেমন বোধশোধ নাই, থাকিলেও যে এই ‘আশেরা’ শব্দটাকে ‘র-ল-ড’ইয়ের জোরে ‘তাড়ী’ করিয়া তুলিতে পারিতাম, সে ভরসা ত জোর করিয়া পাঠককে দিতে পারিলাম না। তারপরে নরবলির কথা। পৃথিবীর যে-সমস্ত প্রাচীন জাতি ভূ-দেবীর পূজা করিত এবং প্রসন্ন করিতে নরবলি দিত, তাহাদের মধ্যে না পাই কোথাও আসটার্ট দেবীকে, না পাই তাঁহার ভক্ত কানানাইটদিগকে। পাইলেও ত মনে হয় না, এমন কিছু প্রমাণ করিত যে, খোন্দ এবং কানানাইট একই ধর্মের আইন-কানুন মানিয়া চলিয়াছিল। দক্ষিণ-আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা (Indians of Guayaquil) জমিতে বীজ বপন করিবার দিনে নরবলি দিত। প্রাচীন মেক্সিকোর অধিবাসীরা “Conceiving the maize as a personal being who went through the whole course of life between seed time and harvest, sacrificed new-born babes when the maize was sown, older children when it has sprouted and so on till it was fully ripe when they sacrificed old men.” পাউনিরা ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করিতে প্রতি বৎসর নরবলি দিত। দক্ষিণ-আফ্রিকার প্রাচীন কঙ্গোর রানী “used to sacrifice a man and woman in March; they were killed with spades and hoes.” গিনি প্রদেশের অনেক স্থানেই “It was the custom annually to impale a young girl alive soon after the spring equinox in order to secure good crops. A similar sacrifice is still annually offered at Benin.” বেচুয়ানা জাতিরাও ভাল ফসল পাইবার জন্য নরবলি দিত। আমাদের ভারতবর্ষের গোঁড়েরাও এক সময়ে ভূমির উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধি করিতে ব্রাহ্মণশিশু চুরি করিয়া আনিয়া ভূ-দেবীর সম্মুখে বিষাক্ত তীর দিয়া বিদ্ধ করিয়া হত্যা করিত। অস্ট্রেলিয়ার অসভ্য অধিবাসীরাও একটি কন্যাকে জীবন্ত পুঁতিয়া ফেলিয়া ভূ-দেবীকে প্রসন্ন করিত এবং সেই গোরের উপর সমস্ত গ্রামের শস্যবীজ চুপড়িতে করিয়া রাখিয়া যাইত।

তাহারা বিশ্বাস করিত, মেয়েটি দেব্‌তা হইয়া ঐ সমস্ত বীজের মধ্যে প্রবেশ করিবে এবং শস্য ভাল হইবে। প্রাচীন মিশরেও “sacrificed red-haired men to satisfy corn-god.” সাইবেরিয়াতেও এই রকম বলির প্রথা ছিল। ইহারা কেহ আমেরিকার, কেহ আফ্রিকার, কেহ এশিয়ার, কেহ অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা।

একই রকমের ভূ-দেবী পূজা। ঐক্য দেখিয়া মনে হয়, ইহারা সকলেই এক-একবার কানকাটার দেশে আসিয়া শিখিয়া গিয়াছিল। কিন্তু, কবে কেমন করিয়া আসিয়াছিল, সে কথা ইতিহাসে লেখে না, অতএব বলিতে পারিলাম না। ঠাকুরমশায় Encyclopaedia Britannica হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন “কানানাইটের দেশে numerous jars with the skeletons of infants পাওয়া গিয়াছে, এবং we cannot doubt that the sacrificing of children was practised on a large scale among the Cananites.” এ ঠিক কথা। কানানাইটরা শিশু বলি দিয়া কটাহের মধ্যে আশেরা দেবীকে নিবেদন করিত; কিন্তু তিনি কোথায় পাইলেন—খোন্দেরাও শিশু বলি দিয়া ভূ-দেবীকে নিবেদন করিত? তাহারাও শিশুহত্যা করিত সত্য, কিন্তু সে হত্যা দেবতার নৈবেদ্যের জন্য নয়। অনেকটা দারিদ্র্যের ভয়ে, অনেকটা ভূত-প্রেতের দৃষ্টি লাগিয়াছে এই কুসংস্কারে। হত্যা করা মানেই বলি দেওয়া নয়। তবে, কানানাইটের কটাহের (jars) সঙ্গে এইটুকু মাত্র ঐক্য আছে যে, কন্দকাটারাও বড় বড় জালা জলপূর্ণ করিয়া তাহাতে শিশুটিকে ডুবাইয়া মারিত। কারণ, আর কোনরূপে হত্যা করা তাহারা বিধিসঙ্গত মনে করিত না। কথাটা কোথায় পড়িয়াছি, মনে করিতে পারিতেছি না, কিন্তু কোথায় যেন পড়িয়াছি, কে একজন এক বৃদ্ধ খোন্দকে প্রশ্ন করিয়াছিল, “বাপু, তোমরা এমন যন্ত্রণা দিয়া শিশুবধ কর কেন, আর কোন সহজ উপায় অবলম্বন কর না কেন?” সে জবাব দিয়াছিল, “এ ছাড়া আর কোন উপায়ে মারা ভয়ঙ্কর ‘পাপম্‌’। কটাহের ঐক্য এই যা। সে দশ আনাই হউক আর ষোল আনাই হউক।

ঋতেন্দ্রবাবু বাইবেলের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন, “শিশুঘাতক কানানাইটরা যে সকলকে কিরূপ বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কলিঙ্গের খোন্দেরা কবে কাহাকে এমন করিয়া বিপন্ন করিয়া তুলিয়াছিল, এবং কোন্‌ দিন কাহার ছেলেমেয়ে চুরি করিয়া আনিয়া দেবতার পূজা দিয়াছিল, তাহা আমার জানা নাই। তাহারা যাহাকে ভূ-দেবীর নিকটে বলি দিত, তাহাকে ‘মিরিয়া’ বলিত, এবং এই ‘মিরিয়া’, তা সে নর-নারী যেই হউক, যৌবনপ্রাপ্ত না হইলে কিছুতেই দেবতাকে উৎসর্গ করা হইত না। তাহারা কানানাইটদের মত ছেলে চুরি করিয়া আনিয়া যে বলি দিত না, তাহার একটা বড় প্রমাণ এই যে, তাহারা মরণাপন্ন ‘মিরিয়া’র কর্ণমূলে এই কথা উচ্চৈঃস্বরে আবৃত্তি করিতে থাকিত, “তোমাকে দাম দিয়া কিনিয়াছি—আমাদের কোন পাপ নাই—কোন পাপ নাই—আমরা নির্দোষ।” কিন্তু কানানাইটদের সম্বন্ধে এরূপ কিছু আবৃত্তি করিবার নিয়ম ছিল কি? ছিল না। ঋতেন্দ্রবাবু নিজেও প্রবন্ধের এক স্থলে ম্যাকফার্সন সাহেবের উক্তি উদ্ধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন, খোন্দেরা আর যাহাই হউক, চোর-ডাকাত ছিল না। তা ছাড়া, কানানাইটদের দেবমন্দিরে শিশুর পঞ্জর দেখিতে পাওয়াটা ঠাকুরমশায়ের স্বপক্ষে সাক্ষ্য দেয় না, বরং বিপক্ষে দেয়।

তিনি লিখিয়াছেন, “কানানাইটদের দেবমন্দিরাদি খনন করিতে করিতে পুরাতত্বানুসন্ধানীরা এমন সব বৃহদাকার পাত্র আবিষ্কার করিয়াছেন, যাহার মধ্য হইতে শিশুর সমগ্র পঞ্জর প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। এ-সকলই দেবোদ্দেশে শিশু-বলিদানের নিদর্শন বলিয়া পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন।”

আমিও করি। কিন্তু, তিনি একটু নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেই দেখিতে পাইতেন, ইহাদের বলির শিশুগুলি ভূমির উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধিকল্পে ভূ-দেবীকে উৎসর্গ করা হইলে তাহাদের সমগ্র অস্থিপঞ্জর পাওয়া ত ঢের দূরের কথা, এক টুকরা হাড়ও মিলিত না। কারণ, পূর্বেই দেখিয়াছি, যাহারাই ভূ-দেবীর প্রীত্যর্থে নরবলি দিয়াছে, তাহারাই মৃতদেহটাকে কোন-না-কোন রকমে ভূমির সঙ্গেই মিশাইয়া দিয়াছে। প্রত্নতত্ত্বানুসন্ধানীর জন্য কটাহে করিয়া তুলিয়া রাখিয়া যায় নাই। উড়িষ্যার কন্দকাটারাও রাখে নাই। তাহারা মৃতদেহটাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া গ্রামের সকলে মিলিয়া ভাগ করিয়া লইয়া যে যাহার নিজের ক্ষেতে পুঁতিত। এমন কি, অবশিষ্ট নাড়িভুঁড়ি হাড়গোড়গুলোকেও ছাড়িত না। দগ্ধ করিয়া জলে গুলিয়া জমিতে ছিটাইয়া তাহার উর্বরা-শক্তি বৃদ্ধি করিয়া তবে ক্ষান্ত হইত। এত দূর ত দেবীমাহাত্ম্যে এবং তাঁহার পূজার নৈবদ্যে কাটিল। ইহাতে ঐক্য এবং অনৈক্য যাহা আছে, তাহা বিচার করিবার ভার পাঠকের উপরে।

ঋতেন্দ্রবাবু এইবার দ্বিতীয় ঐক্যের অবতারণা করিয়াছেন। বলিতেছেন, “যে যেখানে থাকে, তাহার সেই আবাসস্থানের তুল্য প্রিয় আর কি হইতে পারে? তালগাছ কানাকাটাদের আবাসবৃক্ষ; এই কারণে তালগাছ ত উহাদের প্রিয় হইবেই। আবার এই তালগাছপ্রিয়তা কানানাইটের মধ্যেও বড় অল্প লক্ষিত হয় না। কানানাইটরাও বড় তালগাছভক্ত জাতি। তালজাতীয় বৃক্ষ উহাদের এতই প্রিয় যে, কানানাইটদের অন্যতম শাখার নাম ফিনীসিয়। (শব্দের উৎপত্তি তালজাতীয় গাছের নাম হইতে আসিয়াছে। ফিনীসিয় শব্দের উৎপত্তি ‘ফইনিক’ শব্দ হইতে, উহার অর্থ ‘তালের দেশ’—Phoenike signify the land of palms)”—যদিও ‘ফইনস’ অর্থাৎ লাল রং (scarlet) হইতেও ফিনীসিয়া হওয়া অসম্ভব নয়। যা হউক, ঋতেন্দ্রবাবুর এ যুক্তিটা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ, দেশের ভাল গাছটিকে ভালবাসার মধ্যে লওয়াতে আশ্চর্য হইবার বিষয় ত কিছুই দেখিতে পাই না। কন্দকাটাদের দেশে বিস্তর তালগাছ। তাহারা তালের কড়ি বরগা করে, পাতায় ঘর ছায়, চাটাই বুনিয়া শয্যা রচনা করে। বাইবেলের কানানাইটরাও পাম (palm) বড় ভালবাসে। কারণ, ‘পাম’ তাহাদের দেশের একটি অতি উপকারী বৃক্ষ এবং দেশে আছেও বিস্তর। কিন্তু ইহাতে কি প্রমাণ করে? আমাদের হুগলি জেলার আমগাছ, তা ফলও ভাল, কাঠও ভাল, আছেও অনেক। আমরা আমগাছ ভালবাসি। বর্ধমান জেলায় কাঁঠালগাছ বিস্তর। তারা ওটা খায়ও বেশি, গাছটাকেও স্নেহ করে—ইহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে? কিন্তু ঋতেন্দ্রবাবু বলিতেছেন, “কারণ কি?

উভয়েরই জাতিগত একতা ও উভয়ের এক আদিম বাসভূমিই উহার কারণ।” কিন্তু কেন? দেশের উপকারী গাছকে ভালবাসাই ত সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। বরং উনি যদি দেখাইতে পারিতেন, কোন একটা বৃক্ষকে ভালবাসিবার ঠিক হেতু দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না, অথচ, উভয় জাতিই ভালবাসিয়াছে, তাহা হইলে একটা কথা হইতে পারিত। যেমন, শেওড়া গাছ। যদি দেখান যাইত, ঠাকুরবাড়ির (জগন্নাথ) লোকেও গাছটাকে শ্রদ্ধা করে এবং উড়িষ্যার কানকাটারাও করে, অথচ, কেন করে বলা যায় না, তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহাদের একজাতীয়তা সন্দেহ হইতে পারিত, কিন্তু এ স্থলে কৈ, কিছুই ত চোখে ঠেকে না। আরো একটা কথা। কলিঙ্গ দেশের কানকাটার ‘পাম’ তালগাছ, কিন্তু বাইবেলের কানানাইটদের দেশের ‘পাম’ খেজুরগাছ। দুটোকেই সাহেবেরা ‘পাম’ বলে, কিন্তু বাস্তবিক তাহারা কি এক? ফলের চেহারাতেও একটু প্রভেদ আছে, ওজনেও একটু কম-বেশি আছে। তাল ফলটা খেজুর ফলটার চেয়ে একটু বড়। একসঙ্গে রাখিলে মিশিয়া যায় না, তাহা বোধ করি ঋতেন্দ্রবাবুও অস্বীকার করিবেন না। ভোজন করিতেও একরকম মনে হয় না। অতএব গাছ দুটোকে সাহেবরা যা ইচ্ছা বলুক, এক নয়। একটা তাল একটা খেজুর।

ঋতেন্দ্রবাবুর চতুর্থ ঐক্য। বলিতেছেন, “এইবারে পাঠকগণ আর একটি বিষয়ে কলিঙ্গ বাসী কানকাটা ও কানানাইটদিগের মধ্যে একতা লক্ষ্য করুন। সেটি উহাদের উভয়ের জাতিগত রক্তবর্ণপ্রিয়তা।…তাহারা কি পুরুষ, কি রমণী, সকলেই ঘোর লাল রঙের কাপড় পরিতে পারিলে অন্য কাপড় চায় না। বিশেষতঃ গঞ্জাম, বিশাখাপত্তন প্রভৃতি তাল কলিঙ্গ বা কানকাটার দেশের লোকেরা কাপড়ের পাকা লাল বেগুনি রঙ করিতে সিদ্ধহস্ত। কানকাটারাও ঠিক কলিঙ্গবাসীদের ন্যায় বড় লাল রঙের প্রিয়। কানানাইটদের অন্যতম শাখা ফিনীসিয়েরা কাপড়ের ঘোর লাল রঙ করিবার জন্য এতটা প্রসিদ্ধ হইয়া উঠিয়াছিল যে, অনেকে অনুমান করেন যে, ‘ফইনস’ শব্দ হইতে তাহাদের ফিনীসিয়া নামের উৎপত্তি হইয়াছে।” ঘোরতর একতা আছে, তাহা অস্বীকার করিতে পারিলাম না। কিন্তু দুই-একটা নিবেদনও আছে। প্রথম, এই যে ফিনীসিয়রা যে লাল রঙের কাপড় তৈরি করিত, তাহা ঘরে পুরিয়া রাখিত না, দেশে-বিদেশে বিক্রয় করিত। যাহারা দাম দিয়া কিনিত, তাহারাও লাল রঙটা পছন্দ করিত, এ অনুমান বোধ করি খুব অসঙ্গত নয়। বস্তুতঃ তখনকার লোকেরা লাল রঙটার এত অধিক আদর করিত যে ফিনীসিয়দের ঐশ্বর্য মুখ্যতঃ লাল রঙের কারবারেই। তাহারা, যে সমস্ত জাতি বলিদান দিয়া ঠাকুর পূজা করিত, ঠাকুরকে রক্তপান করাইত, তাহার সকলেই লাল রঙ ব্যবহার করিতে ভালবাসিত। কেন বাসিত, কেন দেব-দেবীকে লাল রঙের কাপড় পরাইত, কেন লাল ফুল, লাল জবা, লাল চন্দন দিয়া সন্তোষ করিতে চাহিত, সে আলোচনা করিতে গেলে অনেক কথা বলিতে হয়। এ প্রবন্ধে তাহার স্থান নাই, আবশ্যকও নাই।

সুদ্ধ এই স্থূল কথাটা বলিয়াই ক্ষান্ত হইতে চাই যে, কেবল এই দুটো জাতিই ঘোর লাল রঙ ভালবাসিত না, সে সময়ে জগতের বার আনা লোকেই ভালবাসিত। তার পরে রঙ তৈরির কথা। বিদ্যাটা খুব সম্ভব ফিনীসিয়েরাও কানকাটার কাছে শিখে নাই, কানকাটারাও ফিনীসিয়ের কাছে শিখে নাই। কানকাটারা অর্থাৎ কলিঙ্গ বাসী খোন্দেরা, গাছের রস এবং তৃণমূল দিয়া রঙ তৈরি করিত, কিন্তু ফিনীসিয়েরা মুরে মাছের (Murex-purple shell-fish) মাংস সিদ্ধ করিয়া রঙ করিত। সুতরাং, বিদ্যাটা একত্র অর্জন করা হইয়া থাকিলে একরকম হওয়াই সম্ভব ছিল। ও মাছটা কানকাটার দেশের সমুদ্রেও দুষ্প্রাপ্য নয়। আর লাল রঙ ভালবাসাবাসিটা কি একটা তুলনার বস্তু হইতে পারে? উভয়ে জাতির চেহারায় সাদৃশ্য ছিল কি না, এ-সব কোন কথাই উঠিল না। কথা উঠিল উভয়েই লাল রঙ ভালবাসিত। এ-রকম ঐক্য আরো আছে। উভয় জাতিই চোখ বুজিয়া ঘুমাইতে ভালবাসিত, হাতে কিছু না থাকিলে হাত দুলাইয়া চলিতে পছন্দ করিত,—এ-সব ঐক্যের অবতারণাই বা না করিলেন কেন?

ঠাকুরমশায়ের পঞ্চম ঐক্য—নামে। এটি সবচেয়ে চমৎকার। বলিতেছেন, “কানানাইট-বংশীয় যে লোকটা ইস্রেলরাজ ডেভিডের শরীররক্ষী ছিল, তাহার নাম ছিল উড়িয়া (Uriha) এবং এই উড়িয়া নামটি কাকতালীয়বৎ হয় নাই। কেননা, কানানাইটেরা যে কলিঙ্গ বা উড্র-দেশীয় লোক, সেকালে সকলেরই জানা ছিল। সেই কারণেই যেমন নেপালী বা ভুটিয়া ভৃত্য থাকিলে তাহার নিজ নামের পরিবর্তে নেপালী বা ভুটিয়া নামেই পরিচিত হয়, এ-ক্ষেত্রেও সেইরূপ হইয়াছে। উড্র হইতে উড়িয়ার উৎপত্তি। ইস্রেলী ভাষায় কি দেশের নামে, কি নামে, ‘ইয়া’-অন্ত শব্দের প্রচলন বড় অধিক। যথা—জোসিয়া, জেডেকিয়া, হেজেকিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি।” এই কারণেই ‘উড্র’ শব্দের উপর ‘ইয়া’-অন্ত শব্দ লাগাইয়া ইস্রেলী ভাষায় উড়িয়া হইয়াছে। আমারও ছেলেবেলায় ডেভিড কপারফিল্ডের উড়িয়া হিপকে উড়ে মনে হইত। ভাবিতাম, লোকটা বিলেত গেল কিরূপে? এখন দেখিতেছি কিরূপে গিয়াছিল! আরও ভাবিতেছি, স্কানডেনেভিয়া, বটেভিয়া, সাইবিরিয়া প্রভৃতিও সম্ভবতঃ এমনি করিয়াই হইয়াছে। কারণ, এগুলোও একটা শব্দ কিনা দারুণ সন্দেহ। বরং ইস্রেলী ‘ইয়া’ প্রত্যয়ে নিষ্পন্ন হওয়াই সঙ্গত এবং স্বাভাবিক। অতএব, ‘উড়িয়া’ যে একটা শব্দ নয়, ইহা “উড্র+ইয়া” তাহাও যেমন নিঃসংশয়ে অবধারিত হইল, সেকালে সকলেই যে জানিত কানানাইটরা উড্রদেশীয়, তাহাও তেমনি অবিসংবাদে স্থিরীকৃত হইল। বেশ! তবে, একটা তুচ্ছ কথা এই যে, উড়িয়া লোকটা ছাড়া আরও বিস্তর ‘উড়িয়া’ কানানাইট তথায় ছিল। ইস্রেলদের সঙ্গে অনেক দিন অনেক রকমেই তাহাদের আলাপ।

লড়ায়েও বটে, বিয়াসাদিতেও বটে। আনন্দেও বটে, নিরানন্দেও বটে। বাইবেল গ্রন্থে নাম করা হইয়াছেও অনেকবার, কিন্তু এমনি আশ্চর্য যে, তাহাদের কোন স্বদেশীয়কেই আর ‘উড়িয়া’ বলিয়া আদর করিতে শুনিলাম না। বোধ করি ইস্রেলরাজ ডেভিডের নিষেধ ছিল। বলা যায় না—হইতেও পারে। ষষ্ঠ ঐক্যের অবতারণা করিয়া ঠাকুরমশায় বলিতেছেন, “রাজা ডেভিড যে উড্র-সন্তান কানানাইটাকে তাঁহার শরীররক্ষক প্রহরীর পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাহা সম্ভবতঃ তাহাদের জাতিগত গুণ দেখিয়া। বর্তমান কালে সে কানানাইট জাতির অস্তিত্ব লুপ্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু সেই একই গোষ্ঠীর কন্দকাটা এখনও ভারতের কলিঙ্গ বা উড্রদেশে বিদ্যমান। এই কন্দকাটার শারীরিক সুদৃঢ় গঠন দেখিলেই বুঝা যায় যে, বাস্তবিক তাহার শরীররক্ষক-পদে নিযুক্ত হইবার যোগ্য! সুদ্ধ ইহাই নহে, রাজপ্রহরীর যে-সকল গুণ থাকা আবশ্যক, সে-সকলও তাহাদের জাতির সাধারণ ধর্ম বলিয়া গণ্য। কাপ্তেন ম্যাকফার্সন লিখিয়াছেন’,—’মিথ্যা কথা, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ, গোপনীয় কথার প্রকাশ, এ-সকল কন্দেরা অধর্ম এবং বীরত্বের ন্যায় যুদ্ধে প্রাণত্যাগ ও যুদ্ধে শত্রুনাশ ধর্ম বলিয়া গণ্য করে’।” বেশ কথা। এই জন্য আমিও ইতিপূর্বে বলিয়াছি, খোন্দেরা কানানাইটদের মত পরের ছেলে চুরি করিয়া বলি দিত না। কিন্তু খোন্দেরাই কি কানানাইটদের গোষ্ঠী, ফিনীসিয়রা নয়? ঋতেন্দ্রবাবুও ইতিপূর্বে দেখাইয়াছেন, এবং আমিও তাহার প্রতিবাদ করি নাই যে, কানানাইটরা ফিনীসিয়দের উপশাখা মাত্র। এবং এইজন্যই তিনি লাল রঙ – প্রিয়তা, লাল রঙ তৈরির ক্ষমতা, তালগাছ বা খেজুরগাছে স্নেহ, ‘ফাইনস’ শব্দ ইত্যাদি প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া ফিনীসিয়দের সহিত অভিন্নতা প্রমাণ করিতে যত্ন করিয়াছেন। বস্তুতঃ ফিনীসিয় ও কানানাইটে প্রভেদ নাই। প্রবন্ধের শেষে তিনি নিজেও স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, “ফিনীসিয়রা কানানাইট জাতির অন্যতম শাখা।” কিন্তু এই ফিনীসিয়দের নৈতিক চরিত্রটা কিরূপ? ইস্কুলের ছেলেরাও জানে, ফিনীসিয়রা চুরি–ডাকাতি, বিশ্বাসঘাতকতা, নরহত্যা প্রভৃতি সর্বপ্রকার পাপেই সিদ্ধহস্ত ছিল। বাণিজ্য করিতে বিদেশে গিয়া নিজেদের নৌকা বা জাহাজ কোথাও লুকাইয়া রাখিয়া মাল–মসলা বিদেশী ক্রেতাদের সম্মুখে খুলিয়া ধরিত এবং যখন তাহারা নিঃসন্দিগ্ধ –চিত্তে কেনা–বেচায় মগ্ন থাকিত, সুবিধা বুঝিয়া এই ফিনীসির ডাকাত বণিক তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া লুটপাট করিয়া লইত এবং যাহাকে পারিত ধরিয়া লইয়া নিজেদের জাহাজে উঠিয়া পাল তুলিয়া দিত।

ইহাদিগকেই অন্যত্র দাসরূপে বিক্রয় করিয়া অর্থ অর্জন করিত। বাস্তবিক, এমন অন্যায়, এমন অধর্ম, এমন নিষ্ঠুরতা ছিল না, যাহা এই ফিনীসিয়রা না করিত। দিনে যাহারা অতিথি হইত, রাত্রে তাহাদের গলাতেই ছুরি দিত। এ-সব ইতিহাসের প্রমাণ-করা কথা। অনুমান বা কল্পনা নহে। এমন জাতির জ্ঞাতি হইয়াও উড়িষ্যার কন্দকাটারা এত বড় ধার্মিক হইল কিরূপে? এবং এই ফিনীসিয় শরীররক্ষী উড়িয়াই বা এমন যুধিষ্ঠির হইলেন কি মনে করিয়া? ঋতেন্দ্রবাবু যদি এতটুকু বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি অবলম্বন করিতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন, ফিনীসিয়রা বা কানানাইটরা উড়িষ্যার খোন্দ জাতি হইলে নৈতিক চরিত্রে এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান হইত না। ইহার পরে তিনি রথের প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিয়াছেন, “ইস্রেলরাজ [সলোমন] যে-সকল বিষয়ে কলিঙ্গবাসীদের অনুসরণ করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে রথ ও মন্দিরাদি নির্মাণই প্রধান উল্লেখযোগ্য।… কলিঙ্গবাসীরা চিরদিন রথের আড়ম্বরে আকৃষ্ট, রথের ধুমধাম, রথের জাঁকজমক কলিঙ্গের চারিদিকে।…সলোমনের এক সহস্র চারি শত রথ নির্মিত হইয়াছিল।” হয় নাই এ কথা কেহ বলে না। রাজা সলোমন অনেকগুলি লড়াই করিবার রথ প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। ঋতেন্দ্রবাবু বলিয়াছেন, কলিঙ্গসন্তানেরা সেগুলি গড়িয়া দিয়াছিল। তাহা হইতে পারে এবং না হইতেও পারে। হইতে পারে এইজন্য যে, ঠাকুরমহাশয়ের নিশ্চিত বিশ্বাস হইয়াছে যে, ফিনীসিয়রা উড়ে-দেশের লোক। উড়ে-দেশের জগন্নাথের রথ আছে, সুতরাং তাহারাই সলোমনের রথ তৈরি করিয়াছিল। আমার বিশ্বাস হয় না যে এইজন্য যে, একে ত ফিনীসিয়রা উড়ে নয়, তা ছাড়া রথ গড়িবার লোক আরও আছে। সলোমনের সময়ে, অর্থাৎ যীশুখ্রিস্টের হাজার বৎসর পূর্বে কলিঙ্গে রথের ধুমধাম কিরূপ ছিল এবং তাহারা কিরূপ রথ তৈরি করিতে পারিত, আমার তাহা জানা নাই। দ্বিতীয় কারণ, রাজা সলোমনের প্রতিবাসী মিশরীয়েরা বহু পূর্ব হইতে সুন্দর এবং মজবুত রথ করিবার জন্য বিখ্যাত ছিল। তাহাদিগের রথাদি কিরূপে তৈরি হইত, তাহা দ্বিবিধ কি ত্রিবিধ, কি কাঠের চাকা তৈরি হইত, সারথিরা কি কি জায়গীর প্রাপ্ত হইত, রথ চালানো তাহাদিগকে জিমন্যাস্টিকের মত কিরূপে রীতিমত অভ্যাস করিতে হইত, ইত্যাদি অনেক কথা বাল্যকালে মিশরের ইতিহাসে পড়িয়াছি। তাহা মনে নাই। মনে রাখিবার আবশ্যকও তখন দেখি নাই। কিন্তু এটা মনে আছে যে, প্রাচীন মিশরীয়েরা চমৎকার রথ গড়িতে পারিত। এবং ইহাও মনে হইতেছে, কিছুদিন পূর্বে Struggle of the Nations পুস্তকের দ্বিতীয় কি তৃতীয় অধ্যায়ে দেখিয়াছি, একজন আসীরিয় রাজা ফারাওর (মিশরের রাজা) নিকট পরাজিত হইয়া এই বলিয়া দুঃখ করিয়াছিল, “যদি উহাদের মত লড়াই করিবার রথ থাকিত, তাহা হইলে এ দুর্দশা ঘটিত না।”

ফল কথা, তখনকার লোক রথের উপকারিতা বুঝিত এবং সলোমনের মত বুদ্ধিমান ও ভুবনবিখ্যাত নরপতিও তাহা বুঝিয়াছিলেন এবং সেইজন্যেই অত রথ তৈরি করাইয়াছিলেন। কিন্তু কথা এই, কে গড়িয়াছিল? উড়িষ্যাবাসীরা কিংবা মিশরবাসীরা?

বাইবেল গ্রন্থে লেখা আছে, রাজা সলোমন মিশরের রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং মিশরের সহিত আত্মীয়তা-সূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন। “(1. Kings-3.1. and Solomon made affinity with Pharaoh, king of Egypt and took Pharaoh’s daughter &c)”। এমন অবস্থায় কেমন করিয়া নিঃসংশয়ে স্থির করা যাইতে পারে, রথগুলি কুটুম্ব এবং প্রতিবাসী মিশরীয়েরা গড়িয়া দেয় নাই, দিয়াছিল কলিঙ্গবাসীর জ্ঞাতি কানানাইটরা। অতঃপর ঋতেন্দ্রবাবু প্রমাণ দিতেছেন, “রাজা সলোমন-প্রতিষ্ঠিত নগরের নাম ‘তাড়মর’—এটি সংস্কৃতমূলক কলিঙ্গ নাম। অর্থাৎ ‘তাল’ বা ‘তাড়’ একই কথা।’ তা হইতে পারে। কেননা, র-ল-ডয়ের জোরে ইতিপূর্বে ‘আশেরা’ ‘তাড়ী’, হইয়াছে। এখন ‘তাল’কে ‘তাড়’ করিতে আপত্তি করিলে লোকে আমাকেই নিন্দা করিবে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ঐ শব্দটা কি কলিঙ্গ ছাড়া আর কোন উপায়েই ইস্রেলী ভাষায় ঢুকিতে পারে না? তা ছাড়া, ‘তাল’টা না হয় ‘তাড়’ হইল, কিন্তু ‘মর’টা কি? যাই হউক, ‘তাড়মর’ সম্বন্ধে আমার কিছুই জানা নাই, সুতরাং এ বিচার ভাষাবিদেরা করিবেন—আমি চুপ করিয়া রহিলাম। কিন্তু, পরিশেষে আমার একটু বক্তব্যও আছে। সেটা এই যে, “কানকাটা বলে, আমি তালগাছে থাকি, যে ছেলেটা কাঁদে তার কাঁধটি ধরে নাচি” ছড়া—কবির এই গানটির উপর নির্ভর করিয়া ঋতেন্দ্রবাবু টানিয়া বুনিয়া যে-সব ঐক্য সংগ্রহ করিয়া বাইবেলের কানানাইটকে উড়িষ্যার কানকাটা বানাইয়াছেন, তাহার অনৈক্যও আছে। সেইগুলিকে অস্বীকার করা উচিত হয় নাই। হইতে পারে তাঁহার কথাই ঠিক, আমার ভুল, কিন্তু মিল-অমিল যখন দু-ই আছে, তখন উভয়কেই চোখের সুমুখে রাখিয়াই তাঁহার বৈজ্ঞানিক সত্যে উপনীত হওয়া উচিত ছিল। আমি এতক্ষণ এই কথাটাই বলিবার প্রয়াস পাইয়াছি মাত্র, আর কিছুই নয়। তবে বাংলা ভাষায় আমার কিছুমাত্র দখল নাই, তাই হয়ত কথাগুলাও গুছাইয়া বলিতে পারি নাই এবং ঠাকুরমহাশয়ের কাছে তেমন শ্রুতিমধুর ও সুখপাঠ্য করিয়াও তুলিতে পারি নাই। তথাপি আশা করিতেছি, এই অকিঞ্চিৎকর প্রতিবাদ যদি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ত, তিনি নিজগুণে এ ত্রুটি মার্জনা করিয়া লইয়া পড়িবেন, এবং ভবিষ্যতে আর কখন এমন ত্রুটি না করিতে হয়, সে ব্যবস্থাও দয়া করিয়া করিবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *