কাদাংচু কমিশনের নেপথ্য-চিত্র
পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসী দল ওরফে ২১৬ জন এম এল এ-র যুক্তফ্রন্টের সদস্যগণ যেভাবে পরস্পর পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন তাতে মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বলে বিশ্বস্তসূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছে।
‘তোমরা সব ভেবেছ কী? তোমরা যদি ভেবে থাকো যে তোমরা তোমাদের খুশিমতন কেবল এলোপাতাড়ি কাদাই ছুড়ে যাবে আর কেউ তোমাদের কিছু বলবে না, তাহলে তোমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছ।’
প্রকাশ, এই ধরনের স্পষ্ট কথা মুখ্যমন্ত্রী একদিন বলে ফেলবেন বলে তৈরি হচ্ছেন।
‘আমি যতদিন মুখ্যমন্ত্রী আছি,’ মুখ্যমন্ত্রী টেবিলে ঘুষি মেরে বলে উঠবেন, ‘ফর নাথিং আর কাদার অপচয় হতে দেব না। জানো তোমরা কী করেছ? আমাদের দু বছরের রাজত্বকালে তোমরা পশ্চিমবঙ্গের শতকরা ৭৮ ভাগ কাদা এলোপাতাড়ি ছুড়ে নষ্ট করেছ। এখন যে-টুকু কাদা অবশিষ্ট আছে (রাজ্য পরিসংখ্যান দফতরের মতে ২২%। জাতীয় স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট মতে কিছু বেশি। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের কাদার বর্তমান মজুত : এঁটেল কাদা ১২%, পলি কাদা ৯.৫%, নর্দমার খিঁচ ৪.৫% বিল, পুকুর এবং পচা ডোবার শাক ৭% এবং অন্যান্য ২% একুনে ৩৫%) তাও যদি সব বেহিসাবীর মত ছুড়ে শেষ করে দাও তাহলে ফিউচার জেনারেশন ছুড়বে কী? তারা আর কখনো কংগ্রেসকে ভোট দেবে? তারা আমাদের বলবে কী? দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে আমরা কী করে মুখ দেখাব? অ্যাঁ!’
‘তোমরা কী দেশটাকে কাদাশূন্য করে ছাড়বে?’ মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি এই প্রশ্নটি ছুড়ে মারেন। প্রথমে মন্ত্রিসভার বৈঠকে, তারপর এম এল এ-দের বৈঠকে, তারপর প্রদেশ কংগ্রেসের সভায়, তারপর জেলা কংগ্রেসীদের সভায়। দফায় দফায়।
‘এমনিই তো পশ্চিমবঙ্গ ঘাটতি রাজ্য। চাল বল, গম বল, ডাল বল, তরকারি বল, তেল বল, কাপড় বল, মাছ মাংস বল, সবই আমদানি করতে হয়। এতদিন একমাত্র কাদাটাই যা আমাদের উদ্বৃত্ত ছিল যার আমদানির দরকার হত না। বুঝে শুনে ছুঁড়তে পারলে টারগেটে তাক মতো কাদা লাগাতে পারলে অল্প কাদাতেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হত। তা নয়, যত্তো সব আনাড়ি জুটেছে দলে! নিশানা ঠিক নেই, হাতের টিপ ঠিক নেই, দমাদম কাদা ছুড়ছে! ছোড়াচ্ছি কাদা! কালই সকালে দিল্লি যাচ্ছি। তারপর দেখি এলতাবড়ি বেলতাবড়ি কাদা ছোড়া বন্ধ করতে পারি কি না?’
মুখ্যমন্ত্রী জানালেন এই ব্যাপারে তিনি কড়া ব্যবস্থা নেবার পক্ষপাতী। সেই রাতেই তিনি হটলাইনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু ক্রস কানেকশন হয়ে যাওয়ায় জনৈক সাংবাদিক সেই কথোপকথন শুনে ফেলেন। (সাংবাদিকটি তাঁর রুটিন ডিউটি অনুসারে হাওড়া পুলিশ কনন্ট্রোলে ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন)।
‘হ্যালো পি এম, আমি সি এম ওয়েস্ট বেঙ্গল!’
‘হ্যালো, কী খবর?’
‘ভালো। আপনাকে একটু বিরক্ত করছি। পরামর্শ চাই।’
‘ব্যক্তিগত, না রাজ্যগত?’
‘আজ্ঞে অফিসিয়াল। আমি এই রাজ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি কনট্রোল করতে চাই।’
‘হ্যালো, হাওড়া কনট্রোল?’
‘না রং নাম্বার, আমি সি এম ওয়েস্ট বেঙ্গল, পি এম-এর সঙ্গে হট লাইনে জরুরি কথা বলছি। খুবই কনফিডেনসিয়াল। ছেড়ে দিন।’
‘হাঁ, ক্যারি অন।’
‘আমি পশ্চিমবঙ্গে কাদা ছোড়াছুড়ি কনট্রোল করতে চাই। কেন না আমাদের কাদার মজুত মারাত্মকভাবে কমে এসেছে।’
‘আসাম ক্যান সাপলাই ইউ। ওদের যথেষ্ট মজুত আছে।’
‘না, এখন নেই। বিহার হাই রেট দিয়ে সব আমদানি করে ফেলেছে।’
‘হ্যালো ত্রিকমদাসজী, হ্যালো।’
‘নো, রঙ নামবার। ছোড় দিজিয়ে।’
‘হ্যালো, ইয়ে ক্যায়া ত্রিকমদাস ভাগওয়ান দাস পেটরোল পামপ হ্যায়?’
‘নেহি। ইয়ে হট লাইন হ্যায়। সি এম ওয়েস্ট বেঙ্গল স্পিকিং টু পি এম। ছোড় দিজিয়ে। ‘আউর কোই স্টেট কা স্টক হ্যায় ইয়া নেহি।’
‘না নেই খোঁজ নিয়েছি। ইন ফ্যাক্ট মহারাষ্ট্র আর ইউ পি আমার কাছেই লোক পাঠিয়েছিল, আমরা ওদের কিছু কাদা গম বা সিদ্ধ চালের পরিবর্তে সাপ্লাই করতে পারি কি না।’
‘হ্যালো, তাহলে তো মালুম হচ্ছে কি, এটা সর্বভারতীয় শরটেজ। তাহলে?’
‘হ্যালো, আমি তাই তো বলছি, কনট্রোল ইজ দি ওনলি সলিউশন।’
‘বাট হাউ টু কনট্রোল?’
‘আমি ভাবছি, ‘কমিশন বসাব।’
‘হোয়াট কমিশন?’
‘কাদাংচু কমিশন।’
‘কাদাংচু কমিশন? সেটা আবার কী?’
‘আজ্ঞে যে-কমিশন কাদার বাজে খরচ বাঁচাবার উপায় বাতলাবে তাই কাদাংচু কমিশন।’
‘হ্যালো, ভাগওয়ানদাসজীকা পেটরৌল পামপ? আরে ম্যয় হুঁ নগদমল। ভাই কমিশন কী বাত ক্যায়া হোতা হ্যায়? মুঝসে ভি বোলো। কিতনা কমিশন, কিসকা কমিশন? হ্যালো হ্যালো।’ ভাগওয়ানবাবু!
‘নেহি। সি এম ওয়েস্ট বেঙ্গল টু পি এম অন দি হট লাইন। ছোড় দিজিয়ে।’
‘হ্যালো। বড্ড ডিসটারব হচ্ছে। তাহলে কাদাংচু কমিশনের খবর প্রেসে ছেড়ে দিই।’
‘হ্যালো, ওতে তোমার ইমেজ বাড়বে তো?’
‘বাড়বে। বাড়বে। তাহলে কাল দিল্লিতে কথা হবে। আমি প্রেসে দিচ্ছি?’
‘ও,কে।’
তারপর মুখ্যমন্ত্রী প্রেসকে ডাকলেন।
‘হ্যালো প্রেস?’
‘হাঁ, হাওড়া কনট্রোল? হ্যালো।’
‘না না চিফ মিনিস্টার বলছি। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসীদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমি কাদাংচু কমিশন বসাচ্ছি।’
‘হালো, কী কমিশন বললেন?’
‘কাদাংচু কমিশন। কে ফর কৃষ্ণকালী, এ ফর এক্কাগাড়ি, ডি ফর
‘বুঝেছি। কাদাংচু।’
‘রাইট। এই কাদাংচু কমিশনের কাজ হবে: (১) তদন্ত করে দেখা এই রাজ্যে কাদার মজুত প্রকৃত কত, (২) কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে মজুত কাদাকে প্রফিটেবলি ইউজ করা যাবে, (৩) কাদার মজুত বাড়াবার উপায় নির্ধারণ, (৪) রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে ছোড়ার জন্য কাদার কোনও বিকল্প উদ্ভাবন এবং (৫) কংগ্রেস সদস্যদের হাতের টিপের উন্নতিবিধানের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ।
মুখ্যমন্ত্রী আন-অফিসিয়ালি প্রেসকে আরও জানান যে, কাদাংচু কমিশন গঠনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গিয়েছে।
২৬ জুন ১৯৭৪