কাদম্বরীচিত্র

প্রাচীন ভারতবর্ষের অনেক বিষয়ে অসামান্যতা ছিল সন্দেহ নাই। অন্য দেশে নগর হইতে সভ্যতার সৃষ্টি, আমাদের দেশে অরণ্য হইতে; বসনভূষণ-ঐশ্বর্যের গৌরব সর্বত্রই আছে, আর বিবসন নির্‌ভূষণ ভিক্ষাচর্যের গৌরব ভারতবর্ষেই; অন্যান্য দেশ ধর্মবিশ্বাসে শাস্ত্রের অধীন, আহার-বিহার-আচারে স্বাধীন; ভারতবর্ষ বিশ্বাসে বন্ধনহীন, আহার-বিহার-আচারে সর্বতোভাবে শাস্ত্রের অনুগত। এমন অনেক দৃষ্টান্তদ্বারা দেখানো যাইতে পারে সাধারণ মানবপ্রকৃতি হইতে ভারতবর্ষীয় প্রকৃতি অনেক বিষয়ে স্বতন্ত্র। সেই অসামান্যতার আর-একটি লক্ষণ এই দেখা যায় যে, পৃথিবীর প্রায় সকল জাতিই গল্প শুনিতে ভালোবাসে; কিন্তু কেবল প্রাচীন ভারতবর্ষেরই গল্প শুনিতে কোনো ঔৎসুক্য ছিল না। সকল সভ্যদেশই আপন সাহিত্যে ইতিহাস জীবনী ও উপন্যাস আগ্রহের সহিত সঞ্চয় করিয়া থাকে, ভারতবর্ষীয় সাহিত্যে তাহার চিহ্ন দেখা যায় না; যদি বা ভারতসাহিত্যে ইতিহাস-উপন্যাস থাকে, তাহার মধ্যে আগ্রহ নেই। বর্ণনা তত্ত্বালোচনা ও অবান্তর প্রসঙ্গে তাহার গল্পপ্রবাহ পদে পদে খণ্ডিত হইলেও প্রশান্ত ভারতবর্ষের ধৈর্যচ্যুতি দেখা যায় না। এগুলি মূল কাব্যের অঙ্গ, না প্রক্ষিপ্ত সে আলোচনা নিষ্ফল; কারণ, প্রক্ষেপ সহ্য করিবার লোক না থাকিলে প্রক্ষিপ্ত টিকিতে পারে না। পর্বতশৃঙ্গ হইতে নদী যদি বা শৈবাল বহন করিয়া না আনে, তথাপি তাহার স্রোত ক্ষীণবেগ হইলে তাহার মধ্যে শৈবাল জন্মিবার অবসর পায়। ভগবদ্‌গীতার মাহাত্ম্য কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে না, কিন্তু যখন কুরুক্ষেত্রের তুমুল যুদ্ধ আসন্ন তখন সমস্ত ভগবদ্‌গীতা অবহিত হইয়া শ্রবণ করিতে পারে, ভারতবর্ষ ছাড়া এমন দেশ জগতে আর নাই। কিষ্কিন্ধ্যা এবং সুন্দর-কাণ্ডে সৌন্দর্যের অভাব নাই এ কথা মানি, তবু রাক্ষস যখন সীতাকে হরণ করিয়া লইয়া গেল তখন গল্পের উপর অত বড়ো একটা জগদ্দল পাথর চাপাইয়া দিলে সহিষ্ণু ভারতবর্ষই কেবল তাহা মার্জনা করিতে পারে। কেনই বা সে মার্জনা করে? কারণ, গল্পের শেষ শুনিবার জন্য তাহার কিছুমাত্র সত্বরতা নাই। চিন্তা করিতে করিতে, প্রশ্ন করিতে করিতে, আশপাশ পরিদর্শন করিতে করিতে, ভারতবর্ষ সাতটি প্রকাণ্ড কাণ্ড এবং আঠারোটি বিপুলায়তন পর্ব অকাতরচিত্তে মৃদুমন্দগতিতে পরিভ্রমণ করিতে কিছুমাত্র ক্লান্তি বোধ করে না।

আবার, গল্প শুনিবার আগ্রহ-অনুসারে গল্পের প্রকৃতিও ভিন্নরূপ হইয়া থাকে। ছয়টি কাণ্ডে যে গল্পটি বেদনা ও আনন্দ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, একটিমাত্র উত্তরকাণ্ডে তাহাকে অসংকোচে চূর্ণ করিয়া ফেলা কি সহজ ব্যাপার? আমরা লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত এই দেখিয়া আসিলাম যে, অধর্মাচারী নিষ্ঠুর রাক্ষস রাবণই সীতার পরম শত্রু, অসাধারণ শৌর্যে ও বিপুল আয়োজনে সেই ভয়ংকর রাবণের হাত হইতে সীতা যখন পরিত্রাণ পাইলেন তখন আমাদের সমস্ত চিন্তা দূর হইল, আমরা আনন্দের জন্য প্রস্তুত হইলাম, এমন সময় মুহূর্তের মধ্যে কবি দেখাইয়া দিলেন– সীতার চরম শত্রু অধার্মিক রাবণ নহে, সে শত্রু ধর্মনিষ্ঠ রাম; নির্বাসনে তাঁহার তেমন সংকট ঘটে নাই, যেমন তাঁহার রাজাধিরাজ স্বামীর গৃহে। যে সোনার তরণী দীর্ঘকাল যুঝিয়া ঝড়ের হাত হইতে উদ্ধার পাইল, ঘাটের পাষাণে ঠেকিবামাত্র এক মুহূর্তে তাহা দুইখানা হইয়া গেল। গল্পের উপর যাহার কিছুমাত্র মমতা আছে, সে কি এমন আকস্মিক উপদ্রব সহ্য করিতে পারে? যে বৈরাগ্য-প্রভাবে আমরা গল্পের নানাবিধ প্রাসঙ্গিক ও অপ্রাসঙ্গিক বাধা সহ্য করিয়াছি, সেই বৈরাগ্যই গল্পটির অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুতে আমাদের ধৈর্য রক্ষা করিয়া থাকে।

মহাভারতেও তাই। এক স্বর্গারোহণপর্বেই কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধটার স্বর্গপ্রাপ্তি হইল। গল্পপ্রিয় ব্যক্তির কাছে গল্পের অবসান যেখানে মহাভারত সেখানে থামিলেন না– অতবড়ো গল্পটাকে বালুনির্মিত খেলাঘরের মতো এক মুহূর্তে ভাঙিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন; সংসারের প্রতি এবং গল্পের প্রতি যাহাদের বৈরাগ্য তাহারা ইহার মধ্য হইতে সত্য লাভ করিল এবং ক্ষুব্ধ হইল না। মহাভারতকে যে লোক গল্পের মতো করিয়া পড়িতে চেষ্টা করে সে মনে করে অর্জুনের শৌর্য অমোঘ, সে মনে করে শ্লোকের উপর শ্লোক গাঁথিয়া মহাভারতকার অর্জুনের জয়স্তম্ভ অভ্রভেদী করিয়া তুলিতেছেন– কিন্তু সমস্ত কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের পর হঠাৎ একদিন এক স্থানে অতি অল্প কথার মধ্যে দেখা গেল, একদল সামান্য দস্যু কৃষ্ণের রমণীদিগকে অর্জুনের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া গেল, নারীগণ কৃষ্ণসখা পার্থকে আহ্বান করিয়া আর্তস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন, অর্জুন গাণ্ডীব তুলিতে পারিলেন না। অর্জুনের এমন অভাবনীয় অবমাননা যে মহাভারতকারের কল্পনায় স্থান পাইতে পারে তাহা পূর্ববর্তী অতগুলো পর্বের মধ্যে কেহ সন্দেহ করিতে পারে নাই। কিন্তু কাহারো উপর কবির মমতা নাই। যেখানে শ্রোতা বৈরাগী, লৌকিক শৌর্য বীর্য মহত্ত্বের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম স্মরণ করিয়া অনাসক্ত, সেখানে কবিও নির্মম এবং কাহিনীও কেবলমাত্র কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য সর্বপ্রকার ভার মোচন করিয়া দ্রূতবেগ অবলম্বন করে না।

তাহার পর মাঝখানে সুদীর্ঘ বিচ্ছেদ পার হইয়া কাব্যসাহিত্যে একেবারে কালিদাসে আসিয়া ঠেকিতে হয়। ইতিপূর্বে ভারতবর্ষ চিত্তরঞ্জনের জন্য কী উপায় অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারি না। উৎসবে যে মাটির প্রদীপের সুন্দর দীপমালা রচনা হয় পরদিন তাহা কেহ তুলিয়া রাখে না; ভারতবর্ষে আনন্দ-উৎসবে নিশ্চয়ই এমন অনেক মাটির প্রদীপ, অনেক ক্ষণিক সাহিত্য, নিশীথে আপন কর্ম সমাপন করিয়া প্রত্যুষে বিস্মৃতিলোক লাভ করিয়াছে। কিন্তু প্রথম তৈজস প্রদীপ দেখিলাম কালিদাসের; সেই পৈতৃক প্রদীপ এখনো আমাদের ঘরে রহিয়া গেছে; আমাদের উজ্জয়িনীবাসী পিতামহের প্রাসাদশিখরে তাহা প্রথম জ্বলিয়াছিল, এখনো তাহাতে কলঙ্ক পড়ে নাই। কেবল আনন্দদানকে উদ্দেশ্য করিয়া কাব্যরচনা সংস্কৃতসাহিত্যে কেবল কালিদাসে প্রথম দেখা গেল। (এখানে আমি খণ্ডকাব্যের কথা বলিতেছি, নাটকের কথা নহে।) মেঘদূত তাহার এক দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত সংস্কৃতসাহিত্যে বোধ করি আর নাই। যাহা আছে তাহা মেঘদূতেরই আধুনিক অনুকরণ, যথা পদাঙ্কদূত প্রভৃতি, এবং তাহাও পৌরাণিক। কুমারসম্ভব রঘুবংশ পৌরাণিক বটে, কিন্তু তাহা পুরাণ নহে, কাব্য; তাহা চিত্তবিনোদনের জন্য লিখিত, তাহার পাঠফলে স্বর্গপ্রাপ্তির প্রলোভন নাই। ভারতবর্ষীয় আর্যসাহিত্যের ধর্মপ্রাণতা সম্বন্ধে যিনি যেমন মতবাদ প্রচার করুন, আশা করি, ঋতুসংহার-পাঠে মোক্ষলাভের সহায়তা হইবে এমন উপদেশ কেহ দিবেন না।

কিন্তু তথাপি কালিদাসের কুমারসম্ভবে গল্প নাই; যেটুকু আছে সে সূত্রটি অতি সূক্ষ্ম এবং প্রচ্ছন্ন, এবং তাহাও অসমাপ্ত। দেবতারা দৈত্যহস্ত হইতে কোনো উপায়ে পরিত্রাণ পাইলেন কি না-পাইলেন সে সম্বন্ধে কবির কিছুমাত্র ঔৎসুক্য দেখিতে পাই না; তাঁহাকে তাড়া দিবার লোকও কেহ নাই। অথচ বিক্রমাদিত্যের সময় শক-হূন-রূপী শত্রুদের সঙ্গে ভারতবর্ষের খুব একটা দ্বন্দ্ব চলিতেছিল এবং স্বয়ং বিক্রমাদিত্য তাহার একজন নায়ক ছিলেন; অতএব দেবদৈত্যের যুদ্ধ এবং স্বর্গের পুনরুদ্ধারপ্রসঙ্গ তখনকার শ্রোতাদের নিকট বিশেষ ঔৎসুক্যজনক হইবে এমন আশা করা যায়। কিন্তু কই? রাজসভার শ্রোতারা দেবতাদের বিপৎপাতে উদাসীন। মদনভস্ম, রতিবিলাপ, উমার তপস্যা, কোনোটাতেই ত্বরান্বিত হইবার জন্য কোনো উপরোধ দেখি না। সকলেই যেন বলিতেছেন, গল্প থাক, এখন ঐ বর্ণনাটাই চলুক। রঘুবংশও বিচিত্র বর্ণনার উপলক্ষমাত্র।

রাজশ্রোতারা যদি গল্পলোলুপ হইতেন তবে কালিদাসের লেখনী হইতে তখনকার কালের কতকগুলি চিত্র পাওয়া যাইত। হায়, অবন্তীরাজ্যে নববর্ষার দিনে উদয়নকথাকোবিদ গ্রামবৃদ্ধেরা যে গল্প করিতেন সে-সমস্ত গেল কোথায়? আসল কথা, গ্রামবৃদ্ধেরা তখন গল্প করিতেন, কিন্তু সে গ্রামের ভাষায় । সে ভাষায় যে কবিরা রচনা করিয়াছেন তাঁহারা যথেষ্ট আনন্দদান করিয়াছেন, কিন্তু তাহার পরিবর্তে অমরতা লাভ করেন নাই। তাঁহাদের কবিত্ব অল্প ছিল বলিয়া যে তাঁহারা বিনাশ পাইয়াছেন এমন কথা বলি না। নিঃসন্দেহ তাঁহাদের মধ্যে অনেক মহাকবি জন্মিয়াছিলেন। কিন্তু গ্রাম্যভাষা প্রদেশবিশেষে বদ্ধ, শিক্ষিতমণ্ডলীকর্তৃক উপেক্ষিত এবং কালে কালে তাহা পরিবর্তিত হইয়া আসিয়াছে– সে ভাষায় যাঁহারা রচনা করিয়াছেন তাঁহারা কোনো স্থায়ী ভিত্তি পান নাই। নিঃসন্দেহ অনেক বড়ো বড়ো সাহিত্যপুরী চলনশীল পলিমৃত্তিকার মধ্যে নিহিত হইয়া একেবারে অদৃশ্য হইয়া গেছে।

সংস্কৃত ভাষা কথ্য ভাষা ছিল না বলিয়াই সে ভাষায় ভারতবর্ষের সমস্ত হৃদয়ের কথা সম্পূর্ণ করিয়া বলা হয় নাই। ইংরাজি অলংকারে যে শ্রেণীর কবিতাকে লিরিক্‌স্‌ বলে তাহা মৃত ভাষায় সম্ভবে না। কালিদাসের বিক্রমোর্বশীতে যে সংস্কৃত গান আছে তাহাতেও গানের লঘুতা ও সরলতা ও অনির্বচনীয় মাধুর্যটুকু পাওয়া যায় না। বাঙালি জয়দেব সংস্কৃত ভাষাতে গান রচনা করিতে পারিয়াছেন, কিন্তু বাঙালি বৈষ্ণব কবিদের বাংলা পদাবলীর সহিত তাহার তুলনা হয় না।

মৃত ভাষায়, পরের ভাষায় গল্পও চলে না। কারণ, গল্পে লঘুতা এবং গতিবেগ আবশ্যক– ভাষা যখন ভাসাইয়া লইয়া যায় না, ভাষাকে যখন ভারের মতো বহন করিয়া চলিতে হয়, তখন তাহাতে গান এবং গল্প সম্ভব হয় না।

কালিদাসের কাব্য ঠিক স্রোতের মতো সর্বাঙ্গ দিয়া চলে না; তাহার প্রত্যেক শ্লোক আপনাতে আপনি সমাপ্ত, একবার থামিয়া দাঁড়াইয়া সেই শ্লোকটিকে আয়ত্ত করিয়া লইয়া তবে পরের শ্লোকে হস্তক্ষেপ করিতে হয়। প্রত্যেক শ্লোকটি স্বতন্ত্র হীরকখণ্ডের ন্যায় উজ্জ্বল এবং সমস্ত কাব্যটি হীরকহারের ন্যায় সুন্দর, কিন্তু নদীর ন্যায় তাহার অখণ্ড কলধ্বনি এবং অবিচ্ছিন্ন ধারা নাই।

তা ছাড়া, সংস্কৃত ভাষায় এমন স্বরবৈচিত্র্য, ধ্বনিগাম্ভীর্য, এমন স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে, তাহাকে নিপুণরূপে চালনা করিতে পারিলে তাহাতে নানাযন্ত্রের এমন কন্সর্ট্‌ বাজিয়া উঠে, তাহার অন্তর্নিহিত রাগিণীর এমন একটি অনির্বচনীয়তা আছে যে, কবিপণ্ডিতেরা বাঙ্‌নৈপুণ্যে পণ্ডিত শ্রোতাদিগকে মুগ্ধ করিবার প্রলোভন সম্বরণ করিতে পারিতেন না। সেইজন্য যেখানে বাক্যকে সংক্ষিপ্ত করিয়া বিষয়কে দ্রুত অগ্রসর করিয়া দেওয়া অত্যাবশ্যক সেখানেও ভাষার প্রলোভন সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হয় এবং বাক্য বিষয়কে প্রকাশিত না করিয়া পদে পদে আচ্ছন্ন করিয়া দাঁড়ায়; বিষয়ের অপেক্ষা বাক্যই অধিক বাহাদুরি লইতে চেষ্টা করে এবং তাহাতে সফলও হয়। ময়ূরপুচ্ছনির্মিত এমন অনেক সুন্দর ব্যজন আছে যাহাতে ভালো বাতাস হয় না, কিন্তু বাতাস করিবার উপলক্ষমাত্র লইয়া রাজসভায় কেবল তাহা শোভার জন্য সঞ্চালন করা হয়। রাজসভার সংস্কৃত কাব্যগুলিও ঘটনাবিন্যাসের জন্য তত অধিক ব্যগ্র হয় না; তাহার বাগ্‌বিস্তার, উপমাকৌশল, বর্ণনানৈপুণ্য রাজসভাকে প্রত্যেক পদক্ষেপে চমৎকৃত করিতে থাকে।

সংস্কৃতসাহিত্যে গদ্যে যে দুই-তিনখানি উপন্যাস আছে তাহার মধ্যে কাদম্বরী সর্বাপেক্ষা প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে। যেমন রমণীয় তেমনি পদ্যেরও অলংকারের প্রতি টান বেশি, গদ্যের সাজসজ্জা স্বভাবতই কর্মক্ষেত্রের উপযোগী। তাহাকে তর্ক করিতে হয়, অনুসন্ধান করিতে হয়, ইতিহাস বলিতে হয়, তাহাকে বিচিত্র ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হয়– এইজন্য তাহার বেশভূষা লঘু, তাহার হস্তপদ অনাবৃত। দুর্ভাগ্যক্রমে সংস্কৃত গদ্য সর্বদা ব্যবহারের জন্য নিযুক্ত ছিল না, সেইজন্য বাহ্যশোভার বাহুল্য তাহার অল্প নহে। মেদস্ফীত বিলাসীর ন্যায় তাহার সমাসবহুল বিপুলায়তন দেখিয়া সহজেই বোধ হয় সর্বদা চলা-ফেরার জন্য সে হয় নাই; বড়ো বড়ো টীকাকার ভাষ্যকার পণ্ডিত বাহকগণ তাহাকে কাঁধে করিয়া না চলিলে তাহার চলা অসাধ্য। অহল হউক, কিন্তু কিরীটে কুণ্ডলে কঙ্কণে কন্ঠমালায় সে রাজার মতো বিরাজ করিতে থাকে।

সেইজন্য বাণভট্ট যদিচ স্পষ্টত গল্প করিতে বসিয়াছেন, তথাপি ভাষার বিপুল গৌরব লাঘব করিয়া কোথাও গল্পকে দৌড় করান নাই; সংস্কৃত ভাষাকে অনুচরপরিবৃত সম্রাটের মতো অগ্রসর করিয়া দিয়া গল্পটি তাহার পশ্চাতে প্রচ্ছন্নপ্রায়ভাবে ছত্র বহন করিয়া চলিয়াছে মাত্র। ভাষার রাজমর্যাদা বৃদ্ধির জন্য গল্পটির কিঞ্চিৎ প্রয়োজন আছে বলিয়াই সে আছে, কিন্তু তাহার প্রতি কাহারো দৃষ্টি নাই।

শূদ্রক রাজা কাদম্বরী গল্পের নায়ক নহেন, তিনি গল্প শুনিতেছেন মাত্র, অতএব তাঁহার পরিচয় সংক্ষিপ্ত হইলে ক্ষতি ছিল না। আখ্যায়িকার বহিরংশ যদি যথোপযুক্ত হ্রস্ব না হয় তবে মূল আখ্যানের পরিমাণসামঞ্জস্য নষ্ট হয়। আমাদের দৃষ্টিশক্তির ন্যায় আমাদের কল্পনাশক্তিও সীমাবদ্ধ; আমরা কোনো জিনিসের সমস্তটা একসঙ্গে সমান করিয়া দেখিতে পাই না– সম্মুখটা বড়ো দেখি, পশ্চাৎটা ছোটো দেখি, পৃষ্ঠদেশটা দেখি না, অনুমান করিয়া লই– এইজন্য শিল্পী তাঁহার সাহিত্যেশিল্পের যে অংশটা প্রধানত দেখাইতে চান সেইটাকে বিশেষরূপে গোচরবর্তী করিয়া বাকি অংশগুলিকে পার্শ্বে পশ্চাতে এবং অনুমানক্ষেত্রে রাখিয়া দেন। কিন্তু কাদম্বরীকার মুখ্য-গৌণ ছোটো-বড়ো কোনো কথাকেই কিছুমাত্র বঞ্চিত করিতে চান নাই। তাহাতে যদি গল্পের ক্ষতি হয়, মূল প্রসঙ্গটি দূরবর্তী হইয়া পড়ে, তাহাতে তিনি বা তাঁহার শ্রোতারা কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহেন। তথাপি কথা কিছু বাদ দিলে চলিবে না; কারণ, কথা বড়ো সুনিপুণ, বড়ো সুশ্রাব্য– কৌশলে মাধুর্যে গাম্ভীর্যে ধ্বনিতে ও প্রতিধ্বনিতে পূর্ণ।

অতএব মেঘমন্দ্র মৃদঙ্গধ্বনির মতো কথা আরম্ভ হইল। আসীদ্‌ অশেষনরপতি-শিরঃসমভ্যর্চিতশাসনঃ পাকশাসন ইবাপরঃ– কিন্তু, হায় আমার দুরাশা। কাদম্বরী হইতে সমগ্র পদ উদ্ধার করিয়া কাব্যরস আলোচনা করিব আমার ক্ষুদ্রায়তন প্রবন্ধের এমন শক্তি নাই। আমরা যে কালে জন্মিয়াছি এ বড়ো ব্যস্ততার কাল, এখন সকল কথার সমস্তটা বলিবার প্রলোভন পদে পদে সংযত করিতে হয়। কাদম্বরীর সময়ে কবি কথাবিস্তারের বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন, এখন আমাদিগকে কথাসংক্ষেপের সমুদয় কৌশল শিক্ষা করিতে হয়। তখনকার কালের মনোরঞ্জনের জন্য যে বিদ্যার প্রয়োজন ছিল এখনকার কালের মনোরঞ্জনের জন্য ঠিক তাহার উল্‌টা বিদ্যা আবশ্যক হইয়াছে।

কিন্তু এক কালের মধুলোভী যদি অন্য কাল হইতে মধু সংগ্রহ করিতে ইচ্ছা করেন তবে নিজকালের প্রাঙ্গণের মধ্যে বসিয়া বসিয়া তিনি তাহা পাইবেন না, অন্য কালের মধ্যে তাঁহাকে প্রবেশ করিতে হইবে। কাদম্বরী যিনি উপভোগ করিতে চান তাঁহাকে ভুলিতে হইবে যে আপিসের বেলা হইতেছে; মনে করিতে হইবে যে তিনি বাক্যরসবিলাসী রাজ্যেশ্বরবিশেষ, রাজসভা মধ্যে সমাসীন এবং “সমানবয়োবিদ্যালংকারৈঃ অখিলকলাকলাপালোচনকঠোরমতিভিঃ অতিপ্রগল্‌ভৈঃ অগ্রাম্যপরিহাসকুশলৈঃ কাব্যনাটকাখ্যানাখ্যায়িকালেখ্যব্যাখ্যানাদিক্রিয়ানিপুণৈঃ বিনয়ব্যবহারিভিঃ আত্মনঃ প্রতিবিম্বৈরিব রাজপুত্রৈঃ সহ রমমাণঃ’। এইরূপ রসচর্চায় রসিকপরিবৃত হইয়া থাকিলে লোকে প্রতিদিনের সুখদুঃখসমাকুল যুধ্যমান ঘর্মসিক্ত কর্মনিরত সংসার হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। মাতাল যেরূপ আহার ভুলিয়া মদ্যপান করিতে থাকে তাহারাও সেইরূপ জীবনের কঠিন অংশ পরিত্যাগ করিয়া ভাবের তরলরস-পানে বিহ্বল হইয়া থাকে; তখন সত্যের যাথাতথ্য ও পরিমাণের প্রতি দৃষ্টি থাকে না; কেবল আদেশ হইতে থাকে, ঢালো ঢালো, আরো ঢালো। এখনকার দিনে মনুষ্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণ বেশি হইয়াছে; লোকটা কে এবং সে কী করিতেছে ইহার প্রতি আমাদের অত্যন্ত কৌতূহল। এইজন্য ঘরে বাহিরে চতুর্দিকে মানুষের ক্রিয়াকলাপ জীবনবৃত্তান্ত আমরা তন্ন তন্ন করিয়া পর্যালোচনা করিয়াও পরিতৃপ্ত হই না। কিন্তু সেকালে পণ্ডিতই বল, রাজাই বল, মানুষকে বড়ো বেশি-কিছু মনে করিতেন না। বোধ করি স্মৃতিবিহিত নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকর্মে এবং একান্ত অবহিতভাবে শাস্ত্রাদি-আলোচনায় তাঁহারা জগৎসংসারে অনেকটা বেশি নির্লিপ্ত ছিলেন। বোধ করি বিধিবিধান-নিয়মসংযমের শাসনে ব্যক্তিগত সাতন্ত্র্যের বড়ো একটা প্রশ্রয় ছিল না। এইজন্য রামায়ণ-মহাভারতের পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে লোকচরিত্রসৃষ্টি এবং সংসারবর্ণনার প্রাধান্য দেখা যায় না। ভাব এবং রস তাহার প্রধান অবলম্বন। রঘুর দিগ্বিজয়-ব্যাপারে অনেক উপমা এবং সরস বর্ণনা প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু রঘুর বীরত্বের বিশেষ একটা চরিত্রগত চিত্র পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা দেখা যায় না। অজ-ইন্দুমতী-ব্যাপারে অজ এবং ইন্দুমতী উপলক্ষ মাত্র– তাহাদের ব্যক্তিগত বিশেষ মূর্তি সুস্পষ্ট নহে, কিন্তু পরিণয় প্রণয় ও বিচ্ছেদশোকের একটি সাধারণ ভাব ও রস সেই সর্গে উচ্ছলিত হইতেছে। কুমারসম্ভবে হরপার্বতীকে অবলম্বন করিয়া প্রেম সৌন্দর্য উপমা বর্ণনা তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছে। মনুষ্য ও সংসারের বিশেষত্বের প্রতি সেকালের সেই অপেক্ষাকৃত ঔদাসীন্য থাকাতে ভাষা– বর্ণনা– মনুষ্যকে ও ঘটনাকে সর্বত্র আচ্ছন্ন করিয়া আপন রস বিস্তার করিয়াছে। সেই কথাটি স্মরণ রাখিয়া আধুনিক কালের বিশেষত্ব বিস্মৃত হইয়া কাদম্বরীর রসাস্বাদে প্রবৃত্ত হইলে আনন্দের সীমা থাকিবে না।

কল্পনা করিয়া দেখো গায়ক গান গাহিতেছে, “চ-ল-ত-রা-আ-আ-আ-আ’ ফিরিয়া পুনরায় “চ-ল-ত-রা আ আ আ’ সুদীর্ঘ তান– শ্রোতারা সেই তানের খেলায় উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে গানের কথায় আছে “চলত রাজকুমারী’, কিন্তু তানের উপদ্রবে বেলা বহিয়া যায়, রাজকুমারীর আর চলাই হয় না। সমজদার শ্রোতাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলে, রাজকুমারী না চলে তো না’ই চলুক, কিন্তু তানটা চলিতে থাক্‌। অবশ্য, রাজকুমারী কোন্‌ পথে চলিতেছেন সে সংবাদের জন্য যাহার বিশেষ উদ্‌বেগ আছে তাহার পক্ষে তানটা দুঃসহ; কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে যদি রস উপভোগ করিতে চাও, তবে রাজকুমারীর গম্যস্থান-নির্ণয়ের জন্য নিরতিশয় অধীর না হইয়া তানটা শুনিয়া লও। কারণ, যে জায়গায় আসিয়া পড়িয়াছ এখানে কৌতূহলে অধীর হইয়া ফল নাই, ইহা রসে মাতোয়ারা হইবার স্থান। অতএব স্নিগ্ধজলদনির্ঘোষে আপাতত শূদ্রক রাজার বর্ণনা শোনা যাক। সে বর্ণনায় আমরা শূদ্রক রাজার চরিত্রচিত্র প্রত্যাশা করিব না। কারণ, চরিত্রচিত্রে একটা সীমা-রেখা অঙ্কিত করিতে হয়– ইহাতে সীমা নাই– ভাষা কল্লোলমুখর সমুদ্রের বন্যার ন্যায় যতদূর উদ্‌বেল হইয়াছে তাহাকে বাধা দিবার কেহ নাই। যদিও সত্যের অনুরোধে বলিতে হইয়াছে শূদ্রক বিদিশা নগরীর রাজা, তথাপি অপ্রতিহতগামিনী ভাষা ও ভাবের অনুরোধে বলিতে হইয়াছে, তিনি “চতুরুদধিমালামেখলায়া ভুবো ভর্তা’। শূদ্রকের মহিমা কতটুকু ছিল সেই ব্যক্তিগত তুচ্ছতথ্যালোচনায় প্রয়োজন নাই, কিন্তু রাজকীয় মহিমা কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে সেই কথা যথোচিত সমারোহসহকারে ঘোষিত হউক।

সকলেই জানেন, ভাব সত্যের মতো কৃপণ নহে। সত্যের নিকট যে ছেলে কানা, ভাবের নিকট তাহার পদ্মলোচন হওয়া কিছুই বিচিত্র নহে। ভাবের সেই রাজকীয় অজস্রতার উপযোগী ভাষা সংস্কৃত ভাষা। সেই স্বভাববিপুল ভাষা কাদম্বরীতে পূর্ণবর্ষার নদীর মতো আবর্তে তরঙ্গে গর্জনে আলোকচ্ছটায় বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু কাদম্বরীর বিশেষ মাহাত্ম্য এই যে, ভাষা ও ভাবের বিশাল বিস্তার রক্ষা করিয়াও তাহার চিত্রগুলি জাগিয়া উঠিয়াছে। সমস্ত প্লাবিত হইয়া একাকার হইয়া যায় নাই, কাদম্বরীর প্রথম আরম্ভ-চিত্রটিই তাহার প্রমাণ।

তখনো ভগবান মরীচিমালী অধিক দূরে উঠেন নাই; নূতন পদ্মগুলির পত্রপুট একটু খুলিয়া গিয়াছে, আর তার পাটল আভাটি কিঞ্চিৎ উন্মুক্ত হইয়াছে।

এই বলিয়া বর্ণনা আরম্ভ হইল। এই বর্ণনার আর-কোনো উদ্দেশ্য নাই, কেবল শ্রোতার চক্ষে একটি কোমল রঙ মাখাইয়া দেওয়া এবং তাহার সর্বাঙ্গে একটি স্নিগ্ধ সুগন্ধ ব্যজন দুলাইয়া দেওয়া। একদা তু নাতিদুরোদিতে নবনলিনদলসম্পুটভিদি কিঞ্চিদুন্মুক্তপাটলিম্নি ভগবতি মরীচিমালিনি– কথার কী মোহ! অনুবাদ করিতে গেলে শুধু এইটুকু ব্যক্ত হয় যে, তরুণ সূর্যের বর্ণ ঈষৎ রক্তিম, কিন্তু ভাষার ইন্দ্রজালে কেবলমাত্র ঐ বিশেষ্যবিশেষণের বিন্যাসে একটি সুরম্য সুগন্ধ সুবর্ণ সুশীতল প্রভাতকাল অনতিবিলম্বে হৃদয়কে আচ্ছন্ন করিয়া ধরে।

এ যেমন প্রভাতের, তেমনি একটি কথার তপোবনে সন্ধ্যাসমাগমের বর্ণনা উদ্‌ধৃত করি।– দিবাবসানে লোহিততারকা তপোবনধেনুরিব কপিলা পরিবর্তমানা সন্ধ্যা। দিনশেষে তপোবনের রক্তচক্ষু ধেনুটি যেমন গোষ্ঠে ফিরিয়া আসে, কপিলবর্ণা সন্ধ্যা তেমনি তপোবনে অবতীর্ণা। কপিলা ধেনুর সহিত সন্ধ্যার রঙের তুলনা করিতে গিয়া সন্ধ্যার সমস্ত শান্তি ও শ্রান্তি এবং ধূসরচ্ছায়া কবি মুহূর্তেই মনের মধ্যে ঘনাইয়া তুলিতেছেন।

সকালের বর্ণনায় যেমন কেবলমাত্র তুলনাচ্ছলে উন্মুক্তপ্রায় নবপদ্মপুটের সুকোমল আভাষটুকুর বিকাশ করিয়া মায়াবী চিত্রকর সমস্ত প্রভাতকে সৌকুমার্যে এবং সুস্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছেন, তেমনি বর্ণের উপমাচ্ছলে তপোবনের গোষ্ঠেফেরা অরুণচক্ষু কপিলবর্ণ ধেনুটির কথা তুলিয়া সন্ধ্যার যত-কিছু ভাব সমস্ত নিঃশেষে বলিয়া লইয়াছেন।

এমন বর্ণসৌন্দর্যবিকাশের ক্ষমতা সংস্কৃত কোনো কবি দেখাইতে পারেন নাই। সংস্কৃত কবিগণ লাল রঙকে লাল রঙ বলিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছেন, কিন্তু কাদম্বরীকারের লাল রঙ কতরকমের তাহার সীমা নাই। কোনো লাল লাক্ষালোহিত, কোনো লাল পারাবতের পদতলের মতো, কোনো লাল রক্তাক্ত সিংহনখের সমান। একদা তু প্রভাতসন্ধ্যারাগলোহিতে গগনতলে কমলিনীমধুরক্তপক্ষসংপুটে বৃদ্ধহংসে ইব মন্দাকিনীপুলিনাদপরজলনিধিতটমবতরতি চন্দ্রমসি, পরিণতরঙ্কুরোমপাণ্ডুনি ব্রজতি বিশালতাম্‌ আশাচক্রবালে, গজরুধিররক্তহরিসটালোমলোহিনীভিঃ আতপ্তলাক্ষিকতন্তুপাটলাভিঃ আয়ামিনীভিরশিশিরকিরণদীধিতিভিঃ, পদ্মরাগশলাকাসম্মার্জনীভিরিব সমুৎসার্যমাণে গগনকুট্টিমকুসুমপ্রকরে তারাগণে– একদিন আকাশ যখন প্রভাতসন্ধ্যারাগে লোহিত, চন্দ্র তখন পদ্মমধুর-মতো-রক্তবর্ণ-পক্ষপুট-শালী বৃদ্ধহংসের ন্যায় মন্দাকিনীপুলিন হইতে পশ্চিমসমুদ্রতটে অবতরণ করিতেছেন, দিক্‌চক্রবালে বৃদ্ধ রঙ্কুমৃগের মতো একটি পাণ্ডুতা ক্রমশ বিস্তীর্ণ হইয়াছে, আর গজরুধিরক্ত সিংহজটার লোমের ন্যায় লোহিত এবং ঈষৎ তপ্ত লাক্ষাতন্তুর ন্যায় পাটলবর্ণ সুদীর্ঘ সূর্যরশ্মিগুলি ঠিক যেন পদ্মরাগশলাকার সম্মার্জনীর ন্যায় গগনকুট্টিম হইতে নক্ষত্রপুষ্পগুলিকে সমুৎসারিত করিয়া দিতেছে।

রঙ ফলাইতে কবির কী আনন্দ। যেন শ্রান্তি নাই, তৃপ্তি নাই। সে রঙ শুধু চিত্রপটের রঙ নহে, তাহাতে কবিত্বের রঙ, ভাবের রঙ আছে। অর্থাৎ, কোন্‌ জিনিসের কী রঙ শুধু সেই বর্ণনামাত্র নহে, তাহার মধ্যে হৃদয়ের অংশ আছে। তাহার একটি দৃষ্টান্ত উদ্‌ধৃত করিলে কথাটা পরিষ্কার হইবে। কথাটা এই যে, ব্যাধ গাছের উপর চড়িয়া নীড় হইতে পক্ষিশাবকগুলিকে পাড়িতেছে– সেই অনুপজাত-উৎপতনশক্তি শাবকগুলির কেমন রঙ? কাংশ্চিদল্পদিবসজাতান্‌ গর্ভচ্ছবিপাটলান্‌ শাল্মলিকুসুমশঙ্কামূপজনয়তঃ, কাংশ্চিদুদ্‌ভিদ্যমানপক্ষতয়া নলিনসংবর্তিকানুকারিণঃ, কাংশ্চিদর্কোপলসদৃশান্‌, কাংশ্চিল্লোহিতায়মানচঞ্চুকোটীন্‌ ঈষদ্‌বিঘটিতদলপুটপাটলমুখানাং কমলমুকুলানাং শ্রিয়মূদ্‌বহতঃ, কাংশ্চিদনবরতশিরঃকম্পব্যাজেন নিবারয়ত ইব, প্রতিকারাসমর্থান একৈকশঃফলানীবতস্য বনস্পতেঃ শাখাসন্ধিভ্যঃ কোটরাভ্যন্তরেভ্যশ্চ শুকশাবকানগ্রহীৎ, অপগতাসূংশ্চ কৃত্বা ক্ষিতাবপাতয়ৎ। কেহ বা অল্পদিবসজাত, তাহাদের নবপ্রসূত কমনীয় পাটলকান্তি যেন শাল্মলিকুসুমের মতো; কাহারো পদ্মের নূতন পাপড়ির মতো অল্প-অল্প ডানা উঠিতেছে; কাহারো বা পদ্মরাগের মতো বর্ণ; কাহারো বা লোহিতায়মান চঞ্চুর অগ্রভাগ ঈষৎ উন্মুক্তমুখ কমলের মতো; কাহারো বা মস্তক অনবরত কম্পিত হইতেছে, যেন ব্যাধকে নিবারণ করিতেছে; এই-সমস্ত প্রতিকারে-অসমর্থ শুকশিশুগুলিকে বনস্পতির শাখাসন্ধি ও কোটরাভ্যন্তর হইতে এক-একটি ফলের মতো গ্রহণপূর্বক গতপ্রাণ করিয়া ক্ষিতিতলে নিক্ষেপ করিতে লাগিল।

ইহার মধ্যে কেবল বর্ণবিন্যাস নহে, তাহার সঙ্গে করুণা মাখানো রহিয়াছে; অথচ কবি তাহা স্পষ্টত হাহুতাশ করিয়া বর্ণনা করেন নাই– বর্ণনার মধ্যে কেবল তুলনাগুলির সৌকুমার্যে তাহা আপনি ফুটিয়া উঠিয়াছে।

কিন্তু এমন করিলে প্রবন্ধ শেষ হইবে না। কারণ, কাদম্বরীর মধ্যে প্রলোভন রাশি রাশি; এই কুঞ্জবনের গলিতে গলিতে নব নব বর্ণের পুষ্পিত লতাবিতান, এখানে সমালোচক যদি মধুপানে প্রবৃত্ত হয় তবে তাহার গুঞ্জনধ্বনি বন্ধ হইয়া যাইবে। বাস্তবিক আমার সমালোচনা করিবার উদ্দেশ্য ছিল না; কেবলমাত্র প্রলোভনে পড়িয়া এ পথে আকৃষ্ট হইয়াছি। যে উপলক্ষে এই প্রবন্ধ লিখিতে বসিয়াছিলাম, মনে করিয়াছিলাম অমনি সেই প্রসঙ্গে কাদম্বরীর সৌন্দর্য আলোচনা করিয়া আনন্দলাভ করিয়া লইব। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হইয়াই বুঝিতেছি এ পথ সংক্ষিপ্ত নহে, এই রসস্রোতে আত্মসমর্পণ করিলে লক্ষ্যপথে আর শীঘ্র ফিরিতে পারিব না।

বর্তমানসংখ্যক “প্রদীপে’ যে চিত্রটি মুদ্রিত হইয়াছে সেই চিত্র অবলম্বন করিয়া কিছু লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়াছিলাম। ইহার মূল পটটি বর্ণতৈল-অঙ্কিত, বিষয়টি কাদম্বরী হইতে গৃহীত এবং চিত্রকর আমার স্নেহাস্পদ তরুণবয়স্ক আত্মীয় শ্রীমান্‌ যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়।

এ কথা নিশ্চয়, সংস্কৃত-সাহিত্যে আঁকিবার বিষয়ের অভাব নাই। কিন্তু শিল্পবিদ্যালয়ে আমাদিগকে অগত্যা য়ুরোপীয় চিত্রাদির অনুকরণ করিয়া আঁকিতে শিখিতে হয়। তাহাতে হাত এবং মন বিলাতী ছবির ছাঁচে প্রস্তুত হইয়া যায়, তাহার আর উপায় থাকে না। সেই অভ্যস্ত পথ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া দেশী চক্ষু দিয়া দেশী চিত্রবিষয়কে দেখা আমাদের পক্ষে বড়ো কঠিন। যামিনীপ্রকাশ অল্প বয়সেই সেই কঠিন ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, এবং তাঁহার প্রথম চেষ্টার যথেষ্ট সফলতা দেখিয়াই “প্রদীপের’ শিল্পানুরাগী বন্ধু ও কর্তৃপক্ষ-গণ আগ্রহের সহিত এই চিত্রের প্রতিকৃতি মুদ্রিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন এবং আমাকে ইহার ভূমিকা লিখিতে অনুরোধ করিয়াছেন।

কাদম্বরীর যে প্রসঙ্গটি চিত্রে বিবৃত হইয়াছে সেইটি সংস্কৃত হইতে বাংলায় ব্যাখ্যা করিলেই ইহার উপযুক্ত ভূমিকা হয়। সেই প্রসঙ্গটি কাদম্বরীর ঠিক প্রবেশদ্বারেই। আলোচনা করিতে করিতে ঠিক সেই পর্যন্তই আসিয়াছিলাম, কিন্তু লোভে পড়িয়া নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম, পুনর্বার সেইখানে ফেরা যাক। —

নবপ্রভাতে রাজা শূদ্রক সভাতলে বসিয়া আছেন এমন সময় প্রতিহারী আসিয়া ক্ষিতিতলনিহিতজানুকরকমলা হইয়া নিবেদন করিল,”দক্ষিণাপথ হইতে চণ্ডালকন্যা একটি পিঞ্জরস্থ শুক লইয়া কহিতেছে যে, মহারাজ সমুদ্রের ন্যায় সকল ভুবনতলের সর্বরত্নের একমাত্র ভাজন, এই বিহঙ্গটিও একটি পরমাশ্চর্য রত্নবিশেষ বলিয়া দেবপাদমূলে প্রদান করিবার জন্য আমি আগত হইয়াছি, অতএব দেবদর্শনসুখ অনুভব করিতে ইচ্ছা করি।’

পাঠকগণ মনে করিবেন না প্রতিহারী এত সংক্ষেপে নিষ্কৃতি পাইয়াছে; অকৃপণা কবিপ্রতিভা তাহার প্রতিও অজস্র কল্পনাবর্ষণ করিয়াছে– তাহার বামপার্শ্বে অঙ্গনাজনবিরুদ্ধ কিরীচাস্ত্র লম্বিত থাকাতে তাহাকে বিষধরজড়িত চন্দনলতার মতো ভীষণরমণীয় দেখিতে হইয়াছে, সে শরৎলক্ষ্মীর ন্যায় কলহংসশুভ্রবসনা এবং বিন্ধ্যবনভূমির ন্যায় বেত্রলতাবতী; সে যেন মূর্তিমতী রাজাজ্ঞা, যেন বিগ্রহিণী রাজ্যাধিদেবতা।

সমীপবর্তী রাজগণের মুখাবলোকন করিয়া উপজাতকুতূহল রাজা প্রতিহারীকে কহিলেন, তাহাকে প্রবেশ করিতে দাও। প্রতিহারী তখন চণ্ডালকন্যাকে সভাস্থলে উপস্থিত করিল।

সেখানে অশনিভয়পুঞ্জিত-শৈলশ্রেণীমধ্যগত কনকশিখরী মেরুর ন্যায় নরপতিসহস্রমধ্যবর্তী রাজা। নানা রত্নাভরণকিরণজালে তাঁহার অবয়ব প্রচ্ছন্নপ্রায় হওয়াতে মনে হইতেছে যেন সহস্র ইন্দ্রায়ুধে অষ্টদিগ্‌বিভাগ আচ্ছাদিত করিয়া বর্ষাকালের ঘনগম্ভীর দিন বিরাজমান। লম্বিতস্থূলমুক্তাকলাপ ও স্বর্ণশৃঙ্খলে-বদ্ধ মণিদণ্ডচতুষ্টয়ে অমল শুভ্র অনতিবৃহৎ দুকূলবিতান বিস্তৃত, তাহারই অধোভাগে ইন্দুকান্তমণিপর্যঙ্কে রাজা নিষণ্ন; তাঁহার পার্শ্বে কনকদণ্ড চামরকলাপ উদ্ধয়মান্‌; পরাভবপ্রণত শশীর ন্যায় বিশদোজ্জ্বল স্ফটিকপাদপীঠে তাঁহার বামপদ বিন্যস্ত; অমৃতফেনের ন্যায় তাঁহার লঘুশুভ্র দুকূলবসনের প্রান্তে গোরোচনার দ্বারা হংসমিথুনমালা অঙ্কিত; অতি সুগন্ধ চন্দনানুলেপনে তাঁহার উরঃস্থল ধবলিত, তাহারই মধ্যে মধ্যে কুসুমচর্চিত হওয়াতে স্থানে স্থানে নিপতিত প্রভাতরবিকিরণে অঙ্কিত কৈলাসশিখরীর ন্যায় তিনি শোভমান; ইন্দ্রনীল অঙ্গদযুগলে তিনি দুই বাহুতে চপলা রাজলক্ষ্মীকে যেন বাঁধিয়া রাখিয়াছেন; তাঁহার কর্ণোৎপল ঈষৎ আলম্বিত, মস্তকে আমোদিত মালতীমালা, যেন উষাকালে অস্তা চলশিখরে তারকাপুঞ্জ পর্যন্ত। সেবাসংগতা অঙ্গনাগণ দিগ্‌বধূর ন্যায় তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া আছে। তখন প্রতিহারী নরপতিকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য রক্তকুবলয়দলকোমল হস্তে বেণুলতা গ্রহণ করিয়া একবার সভাকুট্টিমে আঘাত করিল। তৎক্ষণাৎ তালফল-পতনশব্দে বনকরীযূথের ন্যায় রাজগণ মুখ আবলিত করিয়া তদভিমুখে দৃষ্টিপাত করিলেন।

তাঁহারা দেখিলেন, আর্যবেশধারী ধবলবসন একটি বৃদ্ধ চণ্ডাল অগ্রে আসিতেছে, তাহার পশ্চাতে কাকপক্ষধারী একটি বালক স্বর্ণশলাকানির্মিত পিঞ্জরে বিহঙ্গকে বহন করিয়া আনিতেছে। এবং তাহার পশ্চাতে নিদ্রার ন্যায় লোচনগ্রাহিণী এবং মূর্ছার ন্যায় মনোহরা একটি তরুণযৌবনা কন্যা-অসুরগৃহীত অমৃত অপহরণের জন্য কপ্‌টপটুবিলাসিনীবেশধারী ভগবান হরির ন্যায় সে শ্যামবর্ণা, যেন একটি সঞ্চারিণী ইন্দ্রনীলমণিপুত্তলিকা; আগুল্‌ফবিলম্বিত নীলকঞ্চুকের দ্বারা তাহার শরীর আচ্ছন্ন এবং তাহারই উপরে রক্তাংশুকের অবগুণ্ঠনে যেন নীলোৎপলবনে সন্ধ্যালোক পড়িয়াছে; একটি কর্ণের উপরে উদয়োন্মুখ-ইন্দু-কিরণচ্ছটার ন্যায় একটি শুভ্র কেতকীপত্র আসক্ত; ললাটে রক্তচন্দনের তিলক, যেন কিরাতবেশা ত্রিলোচনা ভবানী।

আমাদের সমালোচ্য চিত্রের বিষয়টি কিঞ্চিৎ সংক্ষেপে অনুবাদ করিয়া দিলাম। সংস্কৃত কবিদের মধ্যে চিত্রাঙ্কনে বাণভট্টের সমতুল্য কেহ নাই, এ কথা আমরা সাহস করিয়া বলিতে পারি। সমস্ত কাদম্বরী কাব্য একটি চিত্রশালা। সাধারণত লোকে ঘটনা বর্ণনা করিয়া গল্প করে; বাণভট্ট পরে পরে চিত্র সজ্জিত করিয়া গল্প বলিয়াছেন; এজন্য তাঁহার গল্প গতিশীল নহে, তাহা বর্ণচ্ছটায় অঙ্কিত। চিত্রগুলিও যে ঘনসংলগ্ন ধারাবাহিক তাহা নহে; এক-একটি ছবির চারিদিকে প্রচুর কারুকার্যবিশিষ্ট বহু বিস্তৃত ভাষার সোনার ফ্রেম দেওয়া, ফ্রেম-সমেত সেই ছবিগুলির সৌন্দর্য আস্বাদনে যে বঞ্চিত সে দুর্ভাগ্য।

মাঘ, ১৩০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *