উপন্যাস
গল্প

কাঠের পা

কাঠের পা

প্রথমে খোঁজ পেল হরিয়া মালি।

বেশ বেলা হয়েছে। এ সময়ে প্রফেসর উঠে পড়েন। সোজা রাস্তা ধরে বাদামতলা পর্যন্ত বেরিয়ে আসেন। তারপর বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দেন।

হরিয়াই চা তৈরি করে দেয়। বিস্কুট কেনা থাকে।

হরিয়া উঁকি দিল। দরজা বন্ধ, জানালাগুলোও।

এটা অবশ্য খুবই স্বাভাবিক, কারণ এই পাহাড়ে জায়গায় শীতের প্রকোপ বেশ বেশি।

একটু পরে হরিয়া দরজায় ধাক্কা দিল। কোনও সাড়া নেই।

আশ্চর্য কাণ্ড। এরকম তো হবার কথা নয়।

হরিয়া দরজায় কান পেতে রইল। না, নিস্তব্ধ। ক্রাচের কোনও শব্দ নেই।

ব্যাপারটা মোটেই ভালো ঠেকল না।

হরিয়া বেরিয়ে গেল।

একটু দূরে দীনবন্ধুবাবুর বাড়ি। অবসরপ্রাপ্ত নামজাদা সাবজজ। প্রফেসরের বিশেষ বন্ধু।

হরিয়া ডাকল, সরকারবাবু, সরকারবাবু।

বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে দীনবন্ধু সরকার একটা বই পড়ছিলেন, হরিয়ার চিৎকারে এগিয়ে এলেন।

কী রে হরিয়া?

আজ্ঞে, প্রফেসরকে এত করে ডাকছি, কোনও সাড়া পাচ্ছি না।

সে কী? চল, আমি যাচ্ছি।

দীনবন্ধু সরকার কোট গায়ে দিয়ে হিরার পিছন পিছন এ বাড়িতে এসে দাঁড়ালেন।

হরিয়া আবার দরজায় ধাক্কা দিল।

দীনবন্ধু সরকার চিৎকার করলেন। প্রফেসর, ও প্রফেসর।

কোনও সাড়া নেই।

দীনবন্ধু সরকার চিন্তিত হলেন।

আমি তো ভালো বুঝছি না হরিয়া। তুই সাইকেলে করে একবার থানায় চলে যা। আমার নাম করে ছোটো দারোগাকে আসতে বল।

বলবার সঙ্গে সঙ্গে হরিয়া সাইকেলে বেরিয়ে গেল।

দীনবন্ধু সরকার একটা গাছের গুঁড়িতে বসলেন।

প্রফেসর এখানে আছেন দশ বছরেরও বেশি। কোন এক কলেজে পড়াতেন। বিপত্নীক। ছেলে-মেয়ে নেই। রিটায়ার করে এখানে আস্তানা বেঁধেছেন। নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। হরিয়া দেখাশোনা করে। আদিবাসী একটা প্রৌঢ়া দু-বেলা রেঁধে দিয়ে যেত। মাঝে মাঝে কিছু লোক আসত।

প্রফেসর বলতেন, ছাত্রের দল মাঝে মাঝে জ্বালাতে আসে। আর বলেন কেন। কিছু কি আর মনে আছে? এখন কতরকম নতুন থিয়োরি হয়েছে। প্রফেসর বোটানি পড়াতেন। মাঝে মাঝে কখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে যান। গাছপালা সংগ্রহ করে আনেন।

প্রফেসরের একটা পা নেই। হাঁটু থেকে কাঠের পা লাগানো। বগলে ক্রাচ। এ অসুবিধায় প্রফেসর অভ্যস্ত। অবসর গ্রহণ করার পরই এক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন। রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের তলায় পা-টা থেঁতলে গিয়েছিল। যমে-মানুষে টানাটানি। পা কেটে বাদ দিয়ে প্রফেসর বাড়ি ফিরেছিলেন।

প্রফেসর দীনবন্ধুবাবুর দাবার সঙ্গী। রোজ সন্ধ্যায় দুজনে দাবার ছক পেতে বসেন। খেলা জমে উঠলে দুজনের কেউই উঠতে চায় না। হরিয়া ডেকে ডেকে প্রফেসরকে উঠিয়ে নিয়ে যেত।

সাইকেলের শব্দ হতে দীনবন্ধুবাবু ফিরে দেখলেন। হরিয়া সাইকেলে ফিরছে।

কী রে, কী হল?

ছোটো দারোগা জিপে করে আসছেন।

দীনবন্ধুবাবু রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। একটু পরেই পথের বাঁকে জিপ দেখা গেল। শুকনো পাতার স্তূপ উড়িয়ে দুরন্ত বেগে আসছে। ঠিক দীনবন্ধুবাবুর সামনে এসে জিপ থামল। জিপ থেকে ও.সি. মোহন সিং লাফিয়ে নামল।

নমস্কার সরকার সাব, কী ব্যাপার?

কিছু বুঝতে পারছি না। প্রফেসরের দরজায় ধাক্কা দিয়েও দরজা খুলতে পারছি না।

চলুন, দেখি একবার।

মোহন সিং-এর ইঙ্গিতে জিপ থেকে একজন কনস্টেবল নামল।

বন্ধ দরজায় সজোরে বুটের লাথি।

দরজার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

মোহন সিং হরিয়ার দিকে ফিরে বলল, বাড়িতে শাবল আছে?

হরিয়া একটা শাবল এনে দিল। কনস্টেবল দরজার ফাঁকে শাবল দিয়ে চাপ দিল। কয়েকবার চাপ দেবার পরই দরজার কবজা খুলে পাল্লা কাত হয়ে পড়ল। মোহন সিং টান দিয়ে দরজা খুলে ফেলল।

আগে মোহন সিং, তারপর কনস্টেবল, সবশেষে দীনবন্ধু সরকার আর হরিয়া।

বিছানার ওপর প্রফেসর শুয়ে। শোবার ভঙ্গিটা কারোই ভালো ঠেকল না। কাছে গিয়ে দেখল, দুটো চোখ বিস্ফারিত, মুখের দু-পাশে ফেনা।

মোহন সিং দেহের ওপর হাত রেখে বলল, অনেকক্ষণ সব শেষ হয়ে গেছে। দেহ বেশ শক্ত।

দীনবন্ধুর দিকে ফিরে মোহন সিং জিজ্ঞাসা করল, কত বয়স হয়েছিল ভদ্রলোকের?

তা প্রায় বাষট্টি হবে। বয়সের আগেই কলেজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

স্বাভাবিক মৃত্যু বলে তো মনে হচ্ছে না। দেখছেন মুখ-চোখের ভঙ্গি, যেন দমবন্ধ করে মেরেছে।

দীনবন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু কে মারল, সে বের হল কী করে? ঘর তো ভিতর থেকে বন্ধ।

মোহন সিং একটু চিন্তিত হল। এগিয়ে গিয়ে জানালাগুলো পরীক্ষা করল। জানালাগুলো সব ভিতর থেকে ছিটকানি দেওয়া।

কাঠের পা আর ক্রাচ কোণের দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা।

তাহলে আততায়ী এল কীভাবে?

মোহন সিং বলল, আগে ডেডবডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়ে দিই, রিপোর্ট কী বলে দেখি, তারপর কর্তব্য ঠিক করা যাবে।

কনস্টেবল জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

মোহন সিং ঘরে তালা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।

লোক এসে হাতের ছাপ নিয়ে যাবে। কলকাতা এখান থেকে খুব দূর নয়।

দরকার হলে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট থেকেও লোক আসতে পারে।

মোহন সিং দীনবন্ধু সরকারকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি শেষ কবে প্রফেসরকে দেখেছেন?

দীনবন্ধুবাবু শোকে মুহ্যমান হয়ে ছিলেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগছিল, এত দ্রুত একটা পরিচিত মানুষ চিরদিনের জন্য সরে যাবে।

মোহন সিং-এর প্রশ্নের উত্তরে বললেন, কাল রাত্রেও প্রফেসর আমার সঙ্গে দাবা খেলেছিলেন। তবে একটু যেন অন্যমনস্ক। উনি খুব পাকা খেলোয়াড়। কোনওদিন ওঁকে হারাতে পারি না, কাল দুবার মাত করে দিয়েছি।

আমি বলেছিলাম, কী হল প্রফেসর, মনটা কোনদিকে?

প্রফেসর চমকে উঠে বলেছিলেন, মন ঠিক আছে। দুপুর থেকে শরীরটা খুব জুত নেই। আজ তাড়াতাড়ি উঠব।

সাড়ে সাতটার মধ্যেই প্রফেসর উঠে পড়েছিলেন।

আমি ভেবেছিলাম, আমাদের তো বয়স হচ্ছে। শরীর সব দিন কি আর একরকম থাকে?

হরিয়াও প্রশ্নের উত্তরে নতুন কোনও আলোকপাত করতে পারল না।

কেবল বলল, দুপুরবেলা দুটি লোক এসেছিল, বোধহয় ছাত্রই হবে। দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কথা বলেছিল।

প্রফেসরের দেহ পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হল। লোক এসে হাতের ছাপও তুলে নিল। নানা দিক থেকে ঘরের ফোটো। কলকাতায় ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে পাঠাবে।

দীনবন্ধু সরকার যখন বাড়ি ফিরলেন, বেশ ম্রিয়মাণ অবস্থা।

বিশেষ কারো সঙ্গে মিশতেন না একমাত্র প্রফেসর ছাড়া। এই বয়সে নতুন করে বন্ধু সংগ্রহ করাও সম্ভব নয়।

দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী উদবিগ্নচিত্তে অপেক্ষা করছিলেন।

জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ গো, কী শুনছি?

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে দীনবন্ধুবাবু বললেন, প্রফেসর মারা গেলেন।

হঠাৎ?

মানুষ কি আর বলে-কয়ে মারা যায়?

আমার কিন্তু বাপু সন্দেহ হচ্ছে।

সন্দেহ, কীসের সন্দেহ?

জলজ্যান্ত লোকটা তা বলে এভাবে মারা যাবে!

দেখি, ডাক্তারের রিপোর্ট আসুক।

অন্যদিন দীনবন্ধুবাবু একটু বেড়িয়ে আসেন, আজ বাড়ির মধ্যেই বসে রইলেন। মনটা খুব খারাপ। কে বলেছিল, পরমায়ু পদ্মপাত্রে জল। ঠিক কথাই। বিকালে বেড়াতে বেড়াতে থানার দিকে গেলেন।

মোহন সিং থানায় ছিল। অভ্যর্থনা করে বলল, আসুন, আসুন, কী খবর?

খবর তো আপনাদের কাছে।

এই একটু আগে রিপোর্ট এসেছে, অবশ্য লিখিত রিপোর্ট নয়, ডাক্তার সেন ফোনে জানিয়েছেন যে মৃত্যু হয়েছে করোনারি অ্যাটাকে। যাক নিশ্চিন্ত। নয়তো এই নিয়ে ঝামেলা হত।

করোনারি অ্যাটাকে?

তা-ই তো বললেন। প্রফেসরের হার্টের অবস্থার কথা কিছু জানেন আপনি? উনি কোনওদিন কিছু বলেছেন?

না, হার্টের অবস্থা খারাপ, অমন কথা বলেননি। তবে খুব সাবধানি লোক ছিলেন। তিন মাস অন্তর রক্তপরীক্ষা করাতেন। শুগার, কোলেস্টেরল, ইউরিয়া সব চেক করাতেন।

মোহন সিং দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলল, আরে মশাই, যত চেক করান, মৃত্যু যখন থাবা বসায়, তখন কিছুর পরোয়া করে না। সব রিপোর্ট বানচাল করে দেয়।

আচ্ছা চলি।

দীনবন্ধুবাবু উঠে দাঁড়ালেন। মোহন সিংও সঙ্গে সঙ্গে উঠল।

স্যার, এ খবরের জন্য আপনি এতটা হেঁটে এলেন কেন? বাড়িতে ফোন রয়েছে, ফোন করে জেনে নিলেই পারতেন।

একটু হাঁটতেও বেরিয়েছিলাম, সেইসঙ্গে খবরটা নিয়ে গেলাম।

দীনবন্ধু সরকার বাড়ি ফিরে এলেন।

সামনের বাগানে স্ত্রী-র সঙ্গে দেখা হল।

স্ত্রী এগিয়ে এসে বসলেন।

আমি একটা কাজ করেছি।

কী কাজ?

পারিজাত বক্সীকে ফোন করে দিয়েছি।

দীনবন্ধু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।

পারিজাত বক্সীর নাম শোনোনি? বিখ্যাত শখের গোয়েন্দা।

দীনবন্ধুবাবুর মনে পড়ে গেল।

পারিজাতবাবুর সম্বন্ধে চমকপ্রদ সব কাহিনি এখানে-ওখানে শুনেছেন। খবরের কাগজের পাতায় পড়েছেন। বিখ্যাত গোয়েন্দা। ব্যোমকেশ বক্সীর ভাইপো।

আর-একটা কথাও মনে পড়ে গেল। গৃহিণীর সঙ্গে পারিজাতবাবুর লতায়-পাতায় কী একটা সম্পর্কও আছে।

কী বললেন পারিজাত বক্সী?

আজ রাত সাড়ে সাতটার মধ্যে পৌঁছে যাবেন।

দীনবন্ধু হাতঘড়ি দেখলেন। প্রায় ছ-টা। শীতের বিকাল। এর মধ্যেই সন্ধ্যার রূপ নিয়েছে।

তাহলে স্টেশনে কাউকে পাঠাতে হয়।

কাকে আর পাঠাবে? কেউ তো ওঁকে চেনে না। তা ছাড়া উনিও বলেছেন, কারো স্টেশনে থাকার দরকার নেই, উনি ঠিক চিনে আসতে পারবেন।

দুজনে অপেক্ষা করলেন। সাড়ে আটটা বাজল। পারিজাতবাবুর দেখা নেই। স্টেশন খুব দূরে নয়। মিনিট দশেকের পথ। রিকশায় মিনিট পাঁচেক। ট্রেন ঠিক সময়ে এসেছে। ট্রেনের শব্দ বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে।

ন-টা বাজল।

দীনবন্ধুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কই গো, তোমার পারিজাত বক্সীর কী হল?

কী জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে তো বললেন, নিশ্চয় আসব।

আর এসেই বা লাভ কী? প্রফেসরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

পৌনে দশ, দুজনে যখন শুতে যাচ্ছেন, বাড়ির সামনে রিকশা এসে থামল।

স্যুটকেস হাতে নিয়ে পারিজাত বক্সী নামলেন।

দীনবন্ধুবাবু পারিজাত বক্সীকে কোনওদিন দেখেননি। তিনি কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে দেখতে লাগলেন।

দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী এগিয়ে গিয়ে বললেন, খুব লোক যাহোক। এই আপনার সাড়ে সাতটা?

পারিজাত বক্সী হাতজোড় করে দুজনকে নমস্কার করে বললেন, দেরি করে আসার জন্য মাপ চাইছি। কতকগুলো কাজ সেরে এলাম।

কথা হল খাওয়ার টেবিলে।

দীনবন্ধুবাবুর ঠিক সময়ে খাওয়ার অভ্যাস। তিনি আগেই খেয়ে নিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী আর পারিজাত বক্সী একসঙ্গে খেতে বসলেন।

একটা চেয়ার নিয়ে দীনবন্ধুবাবু সামনে বসে রইলেন।

আমি বাড়িটা দেখে এলাম। করোনারি অ্যাটাক কি না জানি না, তবে হার্টফেল করে আপনাদের প্রফেসর মারা গেছেন, সেটুকু বোঝা যাচ্ছে। ভিসারায় বিষজাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি। দেহেও বিষের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।

কীভাবে মৃত্যু হয়েছে বলে আপনার বিশ্বাস?

দীনবন্ধুবাবুর প্রশ্নের উত্তরে পারিজাত বক্সী বললেন, এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা মুশকিল। আর দিনকয়েক সময় দিন।

খাওয়াদাওয়ার পর স্যুটকেস থেকে কোলের বালিশ আর একটা বিলাতি কম্বল বের করে পারিজাত বক্সী বললেন, আমি চলি।

দীনবন্ধুবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই অবাক।

এত রাত্রে আপনি আবার কোথায় যাবেন?

আমি প্রফেসরের বাড়িতে শোব।

কিন্তু সে বাড়ি তো তালাবন্ধ।

আমি থানায় গিয়ে মোহন সিং-এর সঙ্গে দেখা করে চাবি নিয়ে এসেছি। আচ্ছা গুড নাইট। কাল সকালে দেখা হবে।

পারিজাত বক্সী বেরিয়ে গেলেন।

বাড়ি খালি। হরিয়া মালিও নেই। প্রফেসরের মৃত্যু হবার পর তার আর এখানে রাত কাটাতে সাহস হয়নি।

তালা খুলে পারিজাত বক্সী ভিতরে ঢুকলেন। হাতড়ে হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। তারপর এ ঘর-ও ঘর ঘুরে বেড়ালেন।

দুটোমাত্র ঘর। একটা একটু বড়ো আর একটা ছোটো।

শোবার ঘরে একটা শেলফ। তাতে কিছু বোটানির বই, কিছু হালকা নভেল। মাঝখানে একটা গোল টেবিল। একটা খাট।

ভিতরের ঘরে একটা আলনা। তাতে কিছু জামাকাপড় ঝুলছে। একটা দেওয়াল আলমারি। তাতে কয়েকটা ওষুধের শিশি।

সেগুলো পেড়ে মনোযোগ দিয়ে পারিজাত বক্সী দেখলেন। ঘুমের বড়ি, মাথা ধরার অ্যানাসিন, ডায়াবিনিস। শেষের ওষুধটা দেখে মনে হল প্রফেসরের ডায়াবেটিস ছিল।

একদিকে একটা ফাইল। সেটা পেড়ে নিয়ে পারিজাত বক্সী বিছানায় বসলেন, পরপর রক্তের রিপোর্ট, প্রস্রাব, স্টুল যাবতীয় কিছু পরীক্ষা করিয়েছেন। সবই স্বাভাবিক, শেষদিকে ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু রক্তে শর্করার ভাগ খুবই সামান্য। ওষুধ খেয়ে প্রফেসর সেরে গেছেন।

পারিজাত বক্সী এবার আলনায় ঝোলানো জামাকাপড়গুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। লম্বা কোটের পকেটে কিছু গাছের পাতা, বোধহয় তাঁর বোটানিচর্চার জন্য। একটা রুমাল, নস্যির কৌটো।

সব দেখা হলে পারিজাত বক্সী প্রফেসরের বিছানাটা তুললেন। না, কিছু নেই।

এ ভদ্রলোকের বোধহয় কেউ কোথাও ছিল না। কোনও চিঠিপত্র নেই। এমনকী যে ছাত্ররা আসা-যাওয়া করত, তারাও কোনওদিন এক লাইন লিখে খোঁজ নেয়নি।

রীতিমতো আশ্চর্যজনক।

পারিজাত বক্সী হাতঘড়িতে সময় দেখলেন। রাত বারোটা বেজে গেছে। মাটিতে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন।

ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। পারিজাত বক্সী উঠে বসে ঘরের চেহারাটা আর-একবার দেখলেন। কোণের দিকে একটা ক্রাচ আর কাঠের পা।

তিনি আগেই শুনেছিলেন, দুর্ঘটনায় প্রফেসর একটা পা হারিয়েছিলেন। কাঠের পা ব্যবহার করতেন।

পারিজাত বক্সী উঠে গিয়ে ক্রাচ আর কাঠের পা-টা নিয়ে এলেন।

ক্রাচটা নামী বিলাতি কোম্পানির কেনা। চকচকে পালিশ। দামি কাঠ। বগলে চেপে রাখার জায়গাটা মোটা রবারের।

অবশ্য এটা খুব স্বাভাবিক। সারাজীবনের জিনিস। কাজেই এই নিত্যদিনের সঙ্গীটির পিছনে প্রফেসর পয়সা খরচ করবেন এটাই আশা করা যায়।

ক্রাচটি নাড়াচাড়া করতে করতে পারিজাত বক্সীর ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে এল। ক্রাচটির মাঝামাঝি জায়গায় একটা স্ক্রু। এখানে স্ক্রু থাকবার তো কোনও কারণ নেই।

স্ক্রু-টি নাড়াচাড়া করতে করতে ক্রাচটিও দু-ভাগ হয়ে গেল। ওপরের অংশ ছোটো, নীচের অংশ বড়ো। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, নীচের অংশ ফাঁপা। কাগজপত্র গুটিয়ে কিংবা অন্য কোনও জিনিস বেশ রাখা যায়।

ক্রাচটি কোলে নিয়ে পারিজাত বক্সী চুপচাপ বসে রইলেন।

জীবনে ক্রাচ অনেক দেখেছেন, কিন্তু ঠিক এভাবে ফাঁপা ক্রাচ এর আগে আর দেখেননি।

গোপনীয় দলিল, নিষিদ্ধ জিনিসপত্র রাখার পক্ষে আদর্শ ব্যবস্থা।

কিন্তু প্রফেসর কী ধরনের লোক ছিলেন যে এই প্যাটার্নের ক্রাচ করার তাঁর প্রয়োজন হয়েছিল?

রোদ পড়েছে। পারিজাত ক্রাচ আর কাঠের পা কোণের দিকে সরিয়ে রেখে উঠে পড়লেন।

মুখ-হাত ধুয়ে দরজায় তালা দিয়ে দীনবন্ধুবাবুর বাড়ি চলে গেলেন।

দীনবন্ধুবাবু বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।

পোশাক দেখে মনে হয়, প্রাতর্ভ্রমণ শেষ করে অপেক্ষা করছেন।

পারিজাত বক্সীকে দেখে বললেন, কাল অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছেন বলে আর ডাকতে পাঠাইনি।

পারিজাত বক্সী বললেন, আপনার সঙ্গে প্রফেসরের আলাপ কি এখানে আসার পর, না আগে?

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে দীনবন্ধুবাবু উত্তর দিলেন, না, আগে আলাপ ছিল না। এখানে আসার পর।

ভদ্রলোকের আসল নাম তো তারকনাথ রায়?

হ্যাঁ। কলেজে প্রফেসরি করতেন বলে সবাই প্রফেসর বলত।

কোন কলেজে পড়াতেন জানেন?

শুনেছিলাম মেট্রোপলিটান কলেজের বোটানির প্রফেসর ছিলেন।

দুর্ঘটনায় একটা পা কাটা যায়?

তা-ই শুনেছি।

আচ্ছা, আপনি প্রফেসরের বাড়িতে গেছেন?

হ্যাঁ, গেছি বই কী। তবে উনিই আমার বাড়ি বেশি আসতেন।

এমন কি কোনওদিন হয়েছে, আপনার সামনে ওঁর ছাত্রের দল এসেছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আপনার সামনে উনি তাদের সঙ্গে বোটানি নিয়ে আলোচনা করতেন?

না, ছাত্রদের বলতেন, তোমরা একটু বোসো, এঁর সঙ্গে কথা শেষ করে তোমাদের কথা শুনব।

চা-জলখাবার শেষ করে পারিজাত বক্সী বললেন, দীনবন্ধুবাবু, আমি আজ একবার কলকাতায় যাব।

কলকাতায়?

হ্যাঁ, আমার কতকগুলো কাজ আছে। সম্ভব হলে আজ রাত্রে ফিরব, কিংবা কাল। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।

কী বলুন।

আমি তালার ওপর আমার তালা দিয়ে যাচ্ছি। মোহন সিং যদি আসেন, বলবেন যেন প্রফেসরের বাড়ির মধ্যে ঢোকার চেষ্টা না করেন।

আপনার কী মনে হচ্ছে পারিজাতবাবু? দীনবন্ধু আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না।

এখন কিছু বলতে পারছি না, তবে মনে হচ্ছে, প্রফেসরের মৃত্যুর মধ্যে রহস্য আছে। সেই রহস্যের জট আমাকে ছাড়াতে হবে।

দীনবন্ধুবাবু চুপ করে শুনলেন।

হঠাৎ পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, হরিয়া মালি কেমন লোক?

হরিয়া! হরিয়াকে তো ভালোই মনে হয়। বাড়িওয়ালার লোক। প্রফেসর আসবার আগে থেকেই এ বাড়ির দেখাশোনা করে। মাঝে মাঝে হাঁড়িয়া খায়, এ ছাড়া আর কোনও দোষ নেই।

একটু পরেই পারিজাত বক্সী রওনা হয়ে গেলেন।

মোহন সিং এদিকে এল না। বিকালের দিকে বেড়াতে বেড়াতে দীনবন্ধুবাবুই থানায় গেলেন।

জিপ থেকে মোহন সিং নামছিল, দীনবন্ধুবাবুকে দেখে বলল, কী স্যার, কিছু বলবেন?

না, কী আর বলব।

কিছু মনে করবেন না স্যার। শখের গোয়েন্দাদের কাজই এই। সোজা কাজ আরও কঠিন করে তোলা। স্বাভাবিক একটা মৃত্যুকে নিয়ে মিস্টার বক্সী যা প্যাঁচ কষছেন। আমার অবশ্য কিছু বলার নেই। ডেপুটি কমিশনার ফোন করে আমায় নির্দেশ দিয়েছেন মিস্টার বক্সীকে সাহায্য করার জন্য। আমি সাহায্য করে যাব।

মোহন সিং-এর কথায় মনে হল, বাইরে থেকে পারিজাত বক্সী এসে এ কেসে হাত দেওয়াতে সে খুব সন্তুষ্ট নয়।

অবশ্য শখের গোয়েন্দা আর পুলিশ অফিসারের মধ্যে এই মানসিক সংঘর্ষ সব ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

পারিজাত বক্সীকে দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী ফোন করে জানিয়েছেন শুনলে হয়তো মোহন সিং মোটেই খুশি হবে না।

পারিজাত বক্সী ফিরলেন তার পরের দিন বিকালে। মুখ-চোখের চেহারা বেশ গম্ভীর। মনে হল, গম্ভীরভাবে কিছু চিন্তা করছেন।

দীনবন্ধুবাবু নন, তাঁর স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু হদিশ হল?

কীসের?

প্রফেসরের কেসের?

এখনও সব হয়নি তবে এইটুকু জেনে রাখুন, মেট্রোপলিটান কলেজে তারকনাথ রায় বলে, বোটানির কেন, কোনও বিষয়ের কোনও প্রফেসর ছিল না।

দীনবন্ধুবাবু আর তাঁর স্ত্রী সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন, সে কী?

হ্যাঁ। আর মোটর দুর্ঘটনায় প্রফেসরের সাংঘাতিকভাবে আহত হওয়ার কথাও ঠিক নয়। আমি বড়ো বড়ো হাসপাতালে বেশ কয়েক বছরের রেকর্ড দেখেছি।

তাহলে এ ধরনের মিথ্যা কথা বলে লাভ?

লাভের কথা মিনি বলতে পারতেন তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই। আচ্ছা, পুলিশের লোক কি প্রফেসরের বাড়িতে এসেছিল?

না।

এবার দীনবন্ধুবাবু প্রশ্ন করলেন, তাহলে যেসব ছাত্ররা প্রফেসরের কাছে আসত?

প্রফেসর যেমন ভুয়ো, ছাত্রেরা তেমনই ভুয়ো হতে পারে।

একটু থেমে পারিজাত বক্সী বললেন, আর প্রশ্ন নয়, আমাকে একটু চা দিন তো। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

লজ্জিত হয়ে দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ছি, ছি, আমি এখনই এনে দিচ্ছি।

রাত্রে পারিজাত বক্সী প্রফেসরের বাড়িতে চলে এলেন। ক্রাচটা নিয়ে আবার বসলেন।

ঘর অন্ধকার। বক্সীর হাতে জোরালো টর্চ। উলটে-পালটে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। না, আর কোথাও কিছু নেই। এবার কাঠের পা টেনে নিলেন। সাধারণ কাঠের পা। বিশেষ বৈশিষ্ট্য চোখ পড়ল না। পায়ের সঙ্গে আটকানোর জন্য চামড়ার স্ট্র্যাপ রয়েছে। স্ট্র্যাপটা নাড়াচাড়া করতে করতে ভাঁজ করা একটা কাগজের টুকরো মেঝের ওপর পড়ল।

পারিজাত বক্সী কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নিলেন।

সাধারণ ছোটো কাগজ। মাঝখানে কালো কালিতে দুটি অক্ষর লেখা। শি-ত।

কথাটা শীত নয়, সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। কারণ শীত বানান যে শিত নয় সেটুকু জানার মতো বিদ্যা প্রফেসরের ছিল। তা ছাড়া মাঝখানে হাইফেনই বা কেন?

শব্দটা মামুলি নয়, তাহলে এত যত্ন করে কাঠের পায়ের স্ট্র্যাপে বাঁধা থাকত না। যদি কিছু রহস্য থাকে তাহলে তা এই কাগজকে কেন্দ্র করেই।

এবারেও পারিজাত বক্সী মেঝের ওপর বিছানা পাতলেন।

চোখে ঘুম নেই। কেবল চিন্তা, শি-ত কথাটার কী অর্থ হতে পারে?

যদি অন্য কোনও ভাষার কথা হয় তাহলেই মুশকিল। সে ভাষা জানতে না পারলে জীবনে এর রহস্যোদ্ধার করা যাবে না।

রাত অনেক। একটু তন্দ্রার মতন এসে থাকবে, হঠাৎ খুট করে শব্দ!

পারিজাত বক্সীর ঘুম খুব সজাগ। মনে হল শব্দটা খাটের পাশের জানলার কাছ থেকে আসছে। কে যেন জানালা খোলার চেষ্টা করছে।

শুয়ে শুয়েই পারিজাত বক্সী ভিতরদিকে সরে গেলেন। খাটের আড়ালে।

সব দরজায় কাচ দেওয়া। ভারী, শক্ত কাচ। তার ওপর লোহার ক্রসবার। কাচ ভেঙে গেলেও ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়।

খুট, খুট, খুট।

দেয়ালে হেলান দিয়ে পারিজাত বক্সী দেখতে লাগলেন।

বাইরে ফিকে জ্যোৎস্না। সব অর্ধস্পষ্ট। একটা লোকের কালো কাঠামো দেখা গেল।

একটু পরেই কাচ খুলে গেল। লোহার ক্রসবারও বিচিত্র উপায়ে সরানো হল।

বিরাট আকারের একটি লোক ঘরে ঢুকল। লম্বায় বোধহয় সাড়ে ছ-ফিট। সবল চেহারা। নিগ্রো হওয়া আশ্চর্য নয়। মণিবন্ধে বাঁধা চ্যাপটা টর্চ। সেই আলোর সাহায্যে লোকটা সোজা ক্রাচ আর কাঠের পা নিয়ে খাটের ওপর বসল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ক্রাচের প্যাঁচ খুলে ফেলল। কাঠের পায়ের স্ট্র্যাপও। তারপর ভিতরে হাত দিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিছু না পেয়ে হতাশাব্যঞ্জক একটা শব্দ করল।

বাইরে শিয়াল ডেকে উঠতেই লোকটা চমকে উঠল। আস্তে আস্তে উঠে আবার জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। জানালার কাছে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তারপর আর দেখা গেল না।

পারিজাত বক্সী তাড়াতাড়ি খাটের ওপর উঠে বসলেন।

জানালার কাচ ঠিক আটকানো রয়েছে। লোহার ক্রসবারও।

জানালার কাছে মুখ রেখে পারিজাত বক্সী দেখলেন, দীর্ঘ লোকটা জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে।

এবার পারিজাত বক্সী নিঃসন্দেহ হলেন। লোকটা এই কাগজটার সন্ধানেই এসেছিল। কাগজটা কোথায় আছে সেটা তার জানা। কাগজটার মধ্যে লেখা শব্দ দুটো কোনও সংকেত ছিল।

বাকি রাত পারিজাত বক্সী পায়চারি করলেন। কী হতে পারে ওই শব্দ দুটোর অর্থ!

নিশ্চয় কোনও নিষিদ্ধ দ্রব্যের কারবারে প্রফেসর লিপ্ত ছিল। ছাত্র সেজে যারা আসত, তারা ছাত্র নয়, এই কারবারের অংশীদার।

এসব ব্যবসায়ে যা হয়ে থাকে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে রেষারেষি। একজন আর-একজনকে পৃথিবী থেকে হটিয়ে দেবার চেষ্টা করে।

দীনবন্ধুবাবুর শরণ নিতে হবে। এখানে শি-তে বলে কোনও সাঁওতালি মহিলা আছে কি না খোঁজ নিতে হবে। কিংবা এ দুটো অক্ষর কোনও লোকের আদ্যাক্ষর নয় তো!

ভেবে পারিজাত বক্সী কিছু কূলকিনারা পেলেন না।

ভোর হল। পারিজাত বক্সী আগে জানালাটা পরীক্ষা করলেন। অন্য কাজগুলো ঠিক আছে। একটা জানালার কাচ আলগা বসানো। ক্রসবারের স্ক্রুগুলোও খোলার ব্যবস্থা আছে।

তার মানে, রাতে সদর দরজা না খুলে, জানালার কাচ সরিয়ে প্রফেসরের নিজের পক্ষে বাইরে আসা-যাওয়ার সুবিধা ছিল। দরকার হলে রাতবিরাতে বাইরের আগন্তুককেও বাড়ির মধ্যে আনা চলত।

সকালে পারিজাত বক্সীকে দেখে দীনবন্ধুবাবু চমকে উঠলেন।

কী ব্যাপার? চেহারা এমন হয়েছে কেন? সারারাত ঘুমোননি?

পারিজাত বক্সী হাসলেন।

ঘুমোব কী! আপনাদের দেশে প্রহরে প্রহরে যা শেয়ালের হাঁক।

চা-পানের পর পারিজাত বক্সী বললেন, দীনবন্ধুবাবু, আপনার ফোনটা ব্যবহার করব।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, এর জন্য আপনি আবার জিজ্ঞাসা করছেন। আপনি তো আছেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী একটু হাটে যাব। আজ হাটবার।

পারিজাত বক্সী ডেপুটি কমিশনার গোয়েন্দা বিভাগের বাড়িতে ফোন করলেন।

আমাকে একটা খোঁজ দিতে হবে।

বলুন।

সাড়ে ছ-ফিট লম্বা লোক, বিদেশি হওয়াও বিচিত্র নয়, একটু খুঁড়িয়ে চলে। জাহাজের খালাসি হলেও হতে পারে।

গালের কাছে খুব বড়ো কাটা দাগ?

কী জানি, অন্ধকারে দেখেছি, অতটা লক্ষ করিনি।

ফোটো দেখলে চিনতে পারবেন?

বোধহয় পারব।

ঠিক আছে, আমার লোক গোটা চার-পাঁচ ফোটো নিয়ে আপনার কাছে যাবে। মোটরে পাঠাব। ঘণ্টা আড়াই-তিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে। আপনি দেখে বলবেন।

ঘণ্টাখানেক পর দীনবন্ধু দম্পতি হাট থেকে ফিরলেন।

দীনবন্ধুবাবুর হাতের ঝুড়িতে তরিতরকারি। দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী-র হাতে একটা শালপাতার ঠোঙা।

দীনবন্ধুর স্ত্রী বাইরের ঘরের টেবিলের ওপর রাখা রেকাবিতে ঠোঙা উপুড় করে দিলেন, একরাশ শিউলি ফুল পড়ল।

বসে বসে পারিজাত বক্সী দেখছিলেন।

জিজ্ঞাসা করলেন, এ ফুলও কি হাট থেকে কিনলেন?

দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী মাথা নাড়লেন।

না, না, এসব পয়সা দিয়ে কেনা নয়। প্রফেসরের বাগানে শিউলিতলায় পড়ে ছিল, কুড়িয়ে নিয়ে এলাম।

পারিজাত বক্সী চমকে সোজা হয়ে বসলেন।

মনে মনে বিড়বিড় করলেন, শিউলিতলা মানে শি-ত। তা-ই তো, এই সহজ কথাটা মনে আসেনি।

দীনবন্ধুবাবু প্রশ্ন করলেন, কী বললেন?

না কিছু না। একটা কথা মনে পড়ে গেল।

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পরে পারিজাত বক্সী প্রফেসরের বাড়িতে চলে এল।

দীনবন্ধু-দম্পতি দিবানিদ্রায় মগ্ন।

একটা খাটিয়ায় বসে হরিয়া দড়ি পাকাচ্ছিল।

পারিজাত বক্সী তার সামনে গিয়ে বসল।

হরিয়া, একটা কাজ করতে হবে।

বলুন বাবু।

একটা চিঠি থানার অফিসারকে দিয়ে আসতে হবে।

দিন।

পারিজাত বক্সী একটা চিঠি আর একটা পাঁচ টাকার নোট হিরয়ার হাতে দিলেন।

টাকা কী হবে বাবু?

রেখে দাও তোমার কাছে। এতটা পথ যাবে।

হরিয়া বেরিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের জন্য পারিজাত বক্সী নিশ্চিন্ত। সাঁওতালের হাতে টাকা এলে সে হাঁড়িয়া না খেয়ে ফিরবে না।

শিউলি গাছটা বাড়ির পিছনদিকে। তখনও শিউলিতলায় অনেক ফুল পড়ে রয়েছে। কে যেন সাদা আসন বিছিয়ে রেখেছে।

কোমরে বেল্টে বাঁধা যন্ত্র বের করে পারিজাত বক্সী কাজে লেগে গেলেন।

প্রায় এক ঘণ্টা এদিক-ওদিক খোঁড়ার পর একটা কাঠের বাক্সের সন্ধান মিলল। চন্দন কাঠের ছোটো বাক্স। তালাবন্ধ। তালা খুলতে অসুবিধা হল না। ওপরে কাগজের ফালি, সেগুলো সরাতেই পারিজাত বক্সীর চোখ ধাঁধিয়ে উঠল। গোটা দশেক হিরা। ঔজ্জ্বল্যে চকমক করছে।

আসল কি নকল পারিজাত বক্সীর পক্ষে বলা সম্ভব নয়। যদি আসল হয়, তবে তার দাম অনেক।

এবার বোঝা গেল প্রফেসর হিরার চোরাকারবারে লিপ্ত ছিলেন। বাইরে থেকে হিরা আসত, কিংবা এখান থেকে বাইরে চালান যেত।

এসব ব্যবসায়ে শেষ পর্যন্ত যা হয়, প্রফেসরের তা-ই হয়েছিল। ভাগ নিয়ে পয়সা, কিংবা দলপতি হবার স্পৃহা। একজন আর-একজনকে খতম করার চেষ্টা করে।

পারিজাত বক্সী বাক্সটা সাবধানে নিয়ে আবার ভালো করে মাটিচাপা দিলেন।

দীনবন্ধুবাবুর বাড়ি ফেরার একটু পরই একটা মোটর এসে দাঁড়াল। একটি লোক কয়েকটি ফোটো পারিজাত বক্সীর হাতে দিল। পারিজাত বক্সী গভীর মনোনিবেশ সহকারে ফোটোগুলি দেখলেন। প্রতিটি ফোটোর পিছনে নাম আর বিশেষত্ব লেখা। বিশেষত্ব অর্থাৎ লোকটা কী ধরনের ব্যবসায়ে লিপ্ত।

একটা ফোটো চোখে লাগল। লম্বা চেহারা। সাড়ে ছ-ফুটের কাছাকাছি। গালে কাটা দাগ। পিছনে নাম লেখা, আফজল ইরানি। বাঁ পায়ে গুলি লাগার পর একটু খুঁড়িয়ে চলে। পাথরের কারবার! পেশায় জাহাজ খালাসি।

পারিজাত বক্সী জিজ্ঞাসা করলেন, এ লোকটা কোথায় আছে এখন?

একবার জেল হবার পর খালাসির চাকরি আর নেই। কোথায় আছে রেকর্ড নেই।

জেল হয়েছিল কেন?

একটা লোককে ছোরা মেরেছিল। কী ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল।

ঠিক আছে, এই ছবিটা আমি রাখলাম। বাকিগুলো আপনি নিয়ে যান।

লোকটা চলে যেতে পারিজাত বক্সী হিরাগুলো বাক্স থেকে বের করে নিজের স্যুটকেসের গোপন পকেটে রেখে দিলেন। তারপর রাস্তায় বেরিয়ে ছোটো ছোটো পাথরের নুড়ি কুড়িয়ে বাক্সের মধ্যে রেখে দিলেন।

এবার প্রফেসরের ঘরের মধ্যে ঢুকে দুটো বইয়ের মাঝখানে বাক্সটা রেখে দিলেন।

দীনবন্ধুবাবুর স্ত্রী বললেন, কী ব্যাপার আপনার, দুপুরে ঘুমোন নি?

পারিজাত বক্সী হেসে উত্তর দিলেন, যে কাজের ভার দিয়েছেন, ঘুম চোখ থেকে পালিয়েছে।

দীনবন্ধুবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কিছু কিনারা হল?

মনে তো হয়, অদ্য শেষ রজনি। দেখা যাক।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামতেই তিনজন কনস্টেবল এসে সেলাম করে দাঁড়াল।

পারিজাত বক্সী তাদের সঙ্গে চাপা গলায় অনেকক্ষণ ধরে কথা বললেন।

তারপর রাত আর-একটু গভীর হতে চারজন বেরিয়ে পড়লেন।

খুব সুবিধা। অন্ধকার রাত। কোথাও একটি তারার ইশারাও নেই। বেশ শীত।

চারজনে প্রফেসরের বাড়ির পাশে ঝোপের আড়ালে রইল।

সময় যেন আর কাটে না। ঝোপে ঝোপে জোনাকির ঝাঁক। প্রহরে প্রহরে শিয়ালের চিৎকার। কনকনে পাহাড়ে ঠান্ডা।

হঠাৎ জঙ্গল থেকে দীর্ঘাকৃতি এক ছায়ার আবির্ভাব। খুব ধীর পদক্ষেপে একটা লোক এগিয়ে এল।

একটু দাঁড়াল। দেখল এদিক-ওদিক, তারপরে প্রফেসরের বাড়ির দিকে পা চালাল।

পারিজাত বক্সী খুব সাবধানে লোকটাকে অনুসরণ করলেন।

জানালা খুলে লোকটা ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। জোরালো টর্চের বাতি জ্বেলে সারা ঘর দেখল। এদিক-ওদিক খুঁজতে খুঁজতে বইয়ের ফাঁকে কাঠের বাক্সটা দেখতে পেয়ে সেটা বুকে তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের চিৎকার।

বাইকে পা দিতেই পারিজাত বক্সীর গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল।

আফজল ইরানি, মাথার ওপর দুটো হাত তোলো।

লোকটা চমকে উঠে পকেটে হাত ঢোকাবার আগেই দেখল পুলিশবাহিনী তাকে বেষ্টন করে ফেলেছে। ফগলাইটের উজ্জ্বল আলো তার ওপর।

বলো, তারক রায় তোমার কী ক্ষতি করেছিল?

দু-এক মিনিটের দ্বিধা, তারপর লোকটা চেঁচিয়ে উঠল। লোকটা বেইমান, আমার সঙ্গে নেমকহারামি করেছে।

আফজল বাকি কথা বলল থানার মধ্যে।

তারক রায়ের সঙ্গে আফজলের অনেকদিনের পরিচয়। সুদূর বর্মায়। ক্রমে অন্তরঙ্গতা হয়। দুজনে ব্যাবসা শুরু করে। আফজল দেশ-বিদেশ থেকে দামি পাথর নিয়ে আসে, তারক রায় সেইসব পাথর জহুরিদের কাছে বিক্রি করে পয়সা ভাগ করে নেয়। বর্মা থেকে তারক রায় দেশে আসার পরও ব্যাবসা চলে। খুব বড়ো শহরে আসা-যাওয়া করা একটু অসুবিধা। পুলিশের নজরে পড়ার ভয় ছিল, তাই তারক রায় এইরকম জায়গায় ডেরা বাঁধে।

বেশ চলছিল ব্যাবসা, কিন্তু তারক রায় নেমকহারামি শুর করে। একবার গোটা ছয়েক নীলা আফজল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, তারক রায় সেগুলো ফুটো বলে ফেরত দেয়। তারপরে দশটা পোখরাজের বেলাতেও তা-ই করে।

আফজলের সন্দেহ হয়। বুঝতে পারে, আসল পাথর সরিয়ে ফুটো পাথর আফজলকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে।

তারপর বিদেশে একটা হাঙ্গামায় আফজল জড়িয়ে পড়েছিল। ছ-বছরের জেল হয়। জাহাজের চাকরি পায়। তাও জেল থেকে বেরিয়ে একটি লোককে দিয়ে সে কিছু হিরা পাঠিয়ে দিয়েছিল। লোকটিকে বলতে বলেছিল, আফজল মারা গেছে। তার স্ত্রী-পুত্র খুব কষ্টে আছে। হিরা বাবদ টাকাগুলি হাতে হাতে দিতে।

তারক রায় দেয়নি। বলেছে, ইদানীং আমি নাকি তাকে ফুটো পাথর দিচ্ছিলাম, কাজেই হিরাগুলি যাচাই না করে সে একটি পয়সা দিতে পারবে না।

তারপর লোকটাকে অনেকবার পাঠিয়েছিলাম। তারক রায় এড়িয়ে গেছে।

আমি খবর পেয়েছিলাম, তারক রায় আর-একটা দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা নানা জায়গা থেকে তাকে পাথর জোগান দিচ্ছে।

আমি একদিন রাত্রে তারক রায়ের বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম। জানালা আলাদা ছিল সেটা জানা ছিল। এই পথেই আগে যাওয়া-আসা করেছি।

কী আশ্চর্য, আমাকে দেখে কথা বলবার আগেই তারক রায় আর্তনাদ করে শক্ত হয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেল।

তার ধারণা, আমি মারা গেছি। মরা মানুষকে চোখের সামনে দেখে বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছিল।

আমি জানতাম, ক্রাচের কোটরে পাথরগুলো থাকে, কিন্তু সেরাত্রে বেশিক্ষণ থাকতে সাহস হয়নি। তারপর আবার এসেছিলাম, খুঁজে পাইনি। ইতিমধ্যে খবর পেয়েছি, তারক রায় মারা গেছে। ভালো হয়েছে। হারামজাদা দোজখে যাক। আজ জিনিসগুলো পেয়েছি। এই চন্দনের বাক্সসুদ্ধুই আমি তাকে দিয়েছিলাম।

আফজল গভীর মমতায় চন্দনের বাক্সটা বুকে চেপে ধরল।

পারিজাত বক্সী মোহন সিং-এর দিকে বললেন, আমার কাজ শেষ, এবার আপনাদের কাজ শুরু। যা করবার করুন।

আফজল, একটা কথা শুধু তোমাকে বলতে যাই, আজও তুমি আসল জিনিস পাওনি।

আসল জিনিসের মালিক সরকার। এগুলো সেখানেই পৌঁছে দেওয়া হবে।

সে কী! আফজলের কণ্ঠ থেকে আর্তস্বর বেরিয়ে গেল।

সে তাড়াতাড়ি চন্দনের বাক্সটা খুলে দেখেই বাক্সটা মেঝের ওপর আছড়ে ফেলল।

পাথরের নুড়িগুলো থানার মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *