কাঠের ঘোড়া

কাঠের ঘোড়া

—‘খিদে পেয়েছে, না তোর?’

মানুষটার হাতে ধরা মাংসের হাড়টার দিকে তাকিয়ে সজোরে ল্যাজ নাড়াতে থাকে কুকুরটা৷ পিছনের দিকের একটা পা নেই তার৷ বাসের চাকায় কাটা পড়েছে৷ কোনওরকমে তিন পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হয়৷ খাবারও জোটে না গায়ে জোর নেই বলে৷ দু-দিন হল ডাস্টবিন উলটে ফেলেও এক টুকরো এঁটোকাঁটার দেখা মেলেনি৷

এখন চোখের সামনে ঝুলন্ত খাবার দেখে চাপাস্বরে কুঁইকুঁই করে ওঠে৷ সজল চোখে তাকায় ঈশ্বরের মতো এসে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে৷ দু-এক পা এগিয়ে আসে৷

—‘আয়, খাবি আয়…’

হাড়টা ডান হাতের মুঠোতে বন্ধ করে হাত এগিয়ে দেয় মানুষটা৷ কুকুরটা সেই মুঠো একবার শোঁকে৷ আবার চাপা স্বরে যেন খুলতে অনুরোধ করে মুঠো৷ ল্যাজটা আরও জোরে নড়তে থাকে৷

—‘আয় জবাই হবি আজ…’

মানুষটার মুখে একটা হাসি ফোটে৷ ডান হাতের বদলে বাঁ হাতটা এগিয়ে আসে কুকুরটার গলার কাছে৷

(দুই)

আজ দরজা খুলে বেরোতেই ল্যান্ডিং-এর বারান্দা দিয়ে চোখে পড়ল দৃশ্যটা৷ কর্পোরেশনের লোক এসে রাস্তার উপর থেকে বস্তাবন্দি করে কিছু একটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ ফ্ল্যাটের বারান্দার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল তারা৷ আগ্রহ হতে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে বলুন তো? কী আছে বস্তায়?’

—‘কুকুর…’ বাহকদের মধ্যে একজন উত্তর দিল৷

—‘কুকুর! আবার মরেছে!’

—‘ধড়-মুড়ো আলাদা করে দিয়েছে৷ কী যে ফ্যাচাং হল…’

আমি একটু অবাক হলাম৷ গত সাত দিনে এই নিয়ে প্রায় চারটে কুকুর মরল এ পাড়ায়৷ এমনি মরলে তা-ও হত, কিন্তু এ যাকে বলে একবারে সিরিয়াল কিলিং৷ ছুরি দিয়ে বারবার গলায় কোপ মেরে খুন করা হচ্ছে৷ খুনের আগে একটা রাবারের ব্যান্ড জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গলায়, ফলে প্রাণীগুলোর আর্তনাদ কারও কানে যাচ্ছে না৷

এমনিতে এ পাড়ার কুকুরগুলো তেমন উৎপাত করে না৷ নিজেদের নিয়েই থাকে৷ কোনওদিন কাউকে কামড়েছে বলে তো শুনিনি৷ তা-ও কার যে হঠাৎ কুকুরের উপরে এমন রাগ জন্মাল, কে জানে৷

পাশের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নবদা আর তার ছেলে রন্টু বেরিয়ে এসেছে৷ রন্টুর বয়স কম৷ সে ভয়-ভয় চোখে রক্তের ছোপ-লাগা বস্তাটা দেখতে থাকে৷

—‘কী শুরু হল, বলুন দেখি…’ আমার দিকে চেয়ে ব্যাজার মুখে বলেন নবদা, ‘রোজ অফিসে বেরোনোর সময় রক্ত দেখতে হচ্ছে৷ অলুক্ষুনে ব্যাপার যতসব৷’

আমি মাথা নাড়ালাম, ‘এটা সেই ল্যাংড়া কুকুরটা মনে হচ্ছে৷ পাঁজরা বেরিয়ে গিয়েছিল, টিকে ছিল কোনওমতে৷ কে করছে বলুন তো?’

নবদা ঠোঁট উল্টালেন, ‘সে জানলে তো হয়েই যেত৷ কাল রাতে কী সব এনজিও-টেনজিও থেকে লোক এসে হম্বিতম্বি করছিল পাড়ায়… যে এইসব করছে, তাকে হাতে পেলে নাকি গণধোলাই দেবে ওরা…’

—‘হেঃ…’ আমি একটা বাঁকা হাসি হাসলাম, ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, এদিকে নিধিরাম সর্দার৷ দেশে খোলা বাজারে খুন হচ্ছে, দাঙ্গাহাঙ্গামা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকার কেলেঙ্কারি করে লোকে ভেগে যাচ্ছে, তাদের কিছু হচ্ছে না৷ আর সামান্য ক-টা কুকুর খুনের আবার সাজা৷ আপনিও হাসালেন মশাই!’ একটু থেমে বললাম, ‘সাজা পরের কথা… আমি ভাবছি, খুনগুলো হচ্ছে কেন৷ কুকুরগুলো তো ক্ষতি করেনি কারও…’

—‘আমার ছেলেটা তো রোজ খেতে দিত ওদের…’ রন্টুর দিকে ফিরে তাকালেন নবদা, ‘কাল রাতেও তো দিয়েছিলি, নারে?’

রন্টু কিছু একটা বলে৷ আমি পরিষ্কার শুনতে পাই না৷ অন্য একটা শব্দ এসে ঢেকে দিয়েছে কথাগুলো৷ রাস্তাটার একেবারে উলটোদিকে চাটাই পেতে একটা লোক বসেছে৷ সে-ই আমাদের লক্ষ করে ডেকে উঠেছে, ‘কাঠের পুতুল নেবেন? ভালো ভালো পুতুল আছে… হেঁ হেঁ…’

আমরা তিনজনেই ফিরে তাকিয়েছি তার সামনে রাখা চাটাইটার উপরে৷

সেটার উপর আপাতত সাজিয়ে রাখা আছে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক কাঠের পুতুল৷ পুতুলগুলোর দিকে একবার তাকালেই পছন্দ হয়ে যায়৷ নিখুঁত হাতের কাজ৷ তবে সব ক-টা পুতুলই জন্তুর৷ কোনওটা বাঘ, কোনওটা জিরাফ আবার কোনওটা ডাইনোসর৷ তাদের আবার নানারকম সাইজ৷ উপরে চকচকে পালিশ করা৷ সূর্যের আলো লেগে সাদাটে ঝলকানি একপাশ থেকে আর-একপাশে সরে যাচ্ছে৷

আমিই সিঁড়ি দিয়ে একতলায় একটু এগিয়ে গেলাম৷ পুতুল-টুতুলের শখ আমার কোনওদিনই ছিল না৷ তবে পরশু সুস্মিতা বাড়ি ফিরছে৷ তার বাপের বাড়িতে একসময় এমন কিছু পুতুল ছিল বলে শুনেছি৷ বিয়ের পর থেকে ওগুলোকেই নাকি সব থেকে বেশি মিস করত৷

‘কত করে?’ চাটাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম৷ লোকটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ফোকলা দাঁতে একবার হেসে বলল, ‘দেবেন, যা ইচ্ছা… কোনটা লাগবে বলুন-না…’

লোকটার কাছাকাছি যেতেই খইনি আর চুনের গন্ধ নাকে আসে আমার৷ জামাকাপড় নোংরাটে, গায়ের রংটাও ঠিক কাঠের মতোই৷ তবে মুখটা গোলগাল৷ মনে হয় লোকটা গরিব৷ খ্যাপাটে গোছের৷ তবে জাতশিল্পী মানেই মাথায় একটু ছিট থাকে শুনেছি৷

মনোযোগ দিয়ে পুতুলগুলো দেখতে লাগলাম৷ বাঘ নেব? উঁহু, কমন৷ একটা শিয়ালও আছে৷ তবে মেয়েরা বোধহয় শিয়াল পছন্দ করে না৷ হাতিটা চলবে?

মনে পড়ল, বিয়ের আগে আমার ওজন খানিক বেড়ে যাওয়ায় সুস্মিতা আমাকে হাতি বলে ভেঙাত মাঝেমধ্যে৷ নাঃ, হাতি নৈব নৈব চ… চাটাইয়ের একেবারে কোণের দিকে চাইতেই চোখ আটকে গেল আমার৷ অন্তত গোটা আটেক ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ কোনওটা মাথা নামিয়ে ঘাস খাওয়ার ভঙ্গিতে, কোনওটা যেন রেসের মাঠে চার পা হাওয়ায় মেলে দিয়ে উড়ে চলেছে৷ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম আমি৷ একটা আঙুল তুলে সেদিকে দেখিয়ে বললাম, ‘এগুলো তুমি বানিয়েছ?’

লোকটা মনে হয়, লজ্জা পেল একটু৷ উপরে নীচে মাথা দোলাল৷ বাবু হয়ে বসেছে সে৷ কিন্তু ডান পা-টা কেঁপে চলেছে ক্রমাগত৷ গুনগুন করে কিছু একটা দেশোয়ালি সুর ভাঁজছে৷

—‘বাবা! কাঠের উপরে তোমার হাত তো ফুটবলের উপর মারাদোনার পায়ের মতো চলে হে…’

—‘হেঁ হেঁ… আসলে ওগুলো একটু বেশি যত্ন নিয়ে বানিয়েছি স্যার…’ লাজুক গলাতেই বলে লোকটা, ‘অন্য পুতুলগুলো পয়সা রোজগারের জন্য বানানো, শুধু ওই ঘোড়াগুলো আমার মন থেকে আসে…’

—‘মিউজ! তা রেসের মাঠে-টাঠে যাও নাকি?’

—‘কী যে বলেন কত্তা…’ রাস্তায় একটা লোক হেঁটে যাচ্ছিল৷ তার দিকে উদ্দেশ্য করে লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘দেখে যান, দেখে যান বাবু৷ কাঠের পুতুল… হাতি আছে, গন্ডার আছে, কুমির আছে… একদম আসলি চিজ!’ আমি একটা ঘোড়া হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে থাকি৷ ঘোড়ার কোথাও একটাও ছেনির দাগও নেই৷ যেন কাঠ নয়, চামড়া৷

—‘এইটা কত পড়বে বলো তো?’ ঘাস-খাওয়া ঘোড়াটাকেই তুলে নিই আমি৷

লোকটা এবার জিভ কাটে, ‘আজ্ঞে না স্যার৷ ঘোড়াগুলো বিক্রি নেই৷ ওগুলো শুধু বিজ্ঞাপন… হেঁ হেঁ…’

—‘সে কী!’ আমি একটু হতাশ হলাম৷ এর আগেও দেখেছি বড় শিল্পীরা সাধারণত তাদের সেরা কাজটা বেচতে চায় না৷ তা-ও আমি একবার শেষ চেষ্টা চালালাম, ‘পাঁচশো টাকা দেব কিন্তু, ভেবে দ্যাখো৷’

—‘বিক্রি হবে না স্যার… আপনি বরঞ্চ মিসেসের জন্য এইটা নিয়ে দেখুন…’ লোকটা চাটাইয়ের মাঝখান থেকে একটা নাদুসনুদুস চেহারার শুঁড় চাগিয়ে-রাখা ঐরাবত তুলে দেয় আমার হাতে৷

—‘ধুর মশাই! হাতি চলবে না৷’

—‘আপনি নিয়ে যান-না৷ পছন্দ হলে পয়সা দিয়ে যাবেন৷ আমি এখানে কাল অবধি বসব৷’ গুনগুন করে আবার সেই সুরটা ভাঁজে লোকটা৷

মনে মনে হাসলাম৷ লোকটা কাঠের সঙ্গে ব্যবসাটাও ভালোই বোঝে৷ পয়সা দিতে এলে আবার অন্য কিছু গছিয়ে দেবে আমাকে৷ বললাম, ‘তার দরকার হবে না৷ দাম কত এটার?’

কালো প্যাকেট হাতে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফেরার সময়ে আবার নবদার সঙ্গে দেখা হতে তিনি প্যাকেটের দিকে ইশারা করলেন, ‘কিনলেন নাকি?’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ মরা হাতি শুনেছিলাম লাখ টাকা৷ কাঠের হাতি কিন্তু সস্তায় পেলাম মশাই৷’

—‘তুমি রাইস আদমি বলে কথা, বাড়িতে একটা হাতি পোষা কি চাট্টিখানি কথা রে ভায়া?’

দু-জনেই হেসে উঠলাম৷ নবদা সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন৷ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, লোকটা কবে থেকে বসছে এখানে?’

—‘এই ধরো দিন সাতেক৷’

—‘হুম! রোজই বসে?’

—‘হ্যাঁ, রোজই তো অফিস বেরোনোর সময় দেখি, চাটাই নিয়ে বসেছেন৷ রন্টু বলছিল বিকেলের দিকে কাস্টমার কমে এলে ফাঁকা সময়টায় একটা অদ্ভুত যন্ত্র বাজায়৷ অনেকটা হারমোনিকার মতো, তবে কাঠের৷ মনে হয় ওঁর নিজেরই তৈরি৷ ভারী সুন্দর সুর তোলে৷ তা ছাড়া সব সময় হাসিমুখ৷ আমার জীবনে দেখেছি, যেসব লোক অকারণেই সারাক্ষণ হাসে, তারা মোটেই সুবিধের নয়, একটু সামলে ভায়া…’

নবদা নীচে নেমে যেতে আমি নিজের ঘরে চলে এলাম৷ দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিয়ে প্যাকেট থেকে হাতিটা বের করে ডাইনিং টেবিলের উপরে বসিয়ে রাখলাম৷

এ ফ্ল্যাটটা আমি আর সুস্মিতা মিলে বিয়ের আগেই কিনেছিলাম৷ তবে এসে থাকতে শুরু করেছি সপ্তাহ দুয়েক হল৷ ফ্ল্যাটবাড়িতে পাড়াপড়শি বলে তেমন কিছু থাকে না৷ আমাদেরও এখানে কারও সঙ্গেই তেমন আলাপ হয়নি৷ ওই নবকিশোরবাবু ছাড়া৷ ভদ্রলোক আগে নৈহাটিতে থাকতেন৷ সেখানের বাড়ি বেচে মাসখানেক আগে ফ্যামিলি নিয়ে এসে উঠেছেন এই ফ্ল্যাটে৷ মানুষটা মিশুকে হলেও তাঁর ছেলে আর বউয়ের সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি আমার৷ দু-দিন আগে অফিসের কাজে বাইরে গিয়েছে সুস্মিতা৷ জায়গাটা একটু গ্রামের দিকে বলে সবসময় যোগাযোগ করা যাচ্ছে না৷ পরশু ফেরার কথা আছে৷ টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে মন দিয়ে গজরাজকে দেখতে দেখতে ভারী অদ্ভুত একটা খেয়াল এসে চেপে ধরল আমাকে৷ মনে হল, ঠিক এইরকম হাতি আমি আগেও দেখেছি৷ অবিকল এই ভঙ্গিমা৷ কাঠের উপরে ঠিক একই রকম হাতের কাজ৷ পুতুলটা যত দেখছি তত মনের ভিতরে বদ্ধমূল হচ্ছে ধারণাটা৷ আশ্চর্য!

অফিসে ছুটি চলছে৷ সাতসকালে করার কিছু নেই৷ ফলে এই উটকো ভাবনাটাই আমার মনটাকে ছেলেধরার মতো ব্যাগে ভরে ফেলল৷ কী মনে হতে আলমারি খুলে তার ভিতর থেকে পুরোনো ছবির অ্যালবাম বের করে আনলাম৷

ক-দিন আগেই সুস্মিতা বাপের বাড়ি থেকে কপি করিয়ে নিয়ে এসেছে এগুলো৷ বেশির ভাগই তার নিজের ছেলেবেলার ছবি৷

ছবিগুলো উলটে-পালটে দেখতে লাগলাম৷ অন্যসময় হলে আমার মুখে আলগা একটা হাসি ফুটত ছবিগুলো দেখে৷ তবে এখন কিছু খুঁজে চলেছে আমার চোখ৷ একটা পাতায় এসে আটকে গেলাম৷ সুস্মিতার বছর দশেকের একটা ছবি৷ একটা শোকেসের গায়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সে হাসছে৷

শোকেসের ভিতরে রাখা আছে কয়েকটা কাঠের পুতুল৷ কোনওটা বাঘ, কোনওটা জিরাফ আবার কোনওটা হাতি৷ ছবিটা চোখের কাছে এনে দেখলাম৷ একই হাতের কাজ, একই রকম নিখুঁত ফিনিশিং, একই রকম ল্যাজের গঠন… আমি শিল্পবিশারদ না হলেও নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমার সামনে রাখা কাঠের পুতুল আর ওই শোকেসের জন্তুগুলোর কারিগর কোনওমতেই আলাদা লোক নয়…

বাইরে রাস্তার উপর থেকে একটা সুরেলা শব্দ ভেসে আসছে৷ ভারী করুণ একটা সুর তুলেছে মানুষটা৷ একটু আগে এই সুরটাই গুনগুন করছিল মনে হয়৷ বুকের ভিতর অবধি যেন নিস্তব্ধ করে দিচ্ছে সেই আওয়াজ৷ মাথার ভিতরে ঝিমঝিমে একটা অনুভূতি খেলা করে চলেছে৷

(তিন)

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কল রিসিভ করল সুস্মিতা৷ সারাদিনে আমি অন্তত বার তিনেক কল করেছি৷ ফোন নট রিচেবল৷ এগারো নম্বর বারে ওপাশ থেকে তার অবসন্ন গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ বলো৷ আজ সারাদিন যা ধকল গিয়েছে, কী বলব…’

—‘তোমার সেই কাঠের পুতুলগুলোর কথা মনে আছে?’

আচমকা প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়েছে সুস্মিতা৷ থতমত খেয়ে বলল, ‘অ্যাঁ? পুতুল! সে মনে থাকবে না কেন? কিন্তু ওসব কথা…’

—‘কোথা থেকে কিনেছিলে ওগুলো?’

এবারে একটু রাগত গলা শোনা যায়, ‘সারাদিন পরে একবার ফোনে নেটওয়ার্ক এল আর তুমি পুতুল পুতুল করছ!’

—‘ব্যাপারটা ইম্পর্ট্যান্ট, প্লিজ একটু ভাবার চেষ্টা করো৷ কোথা থেকে কিনেছিলে ওগুলো?’

—‘আমি কিনব কী করে? যদ্দুর, মনে পড়ছে কেউ গিফট করেছিল৷ প্লাস্টিকের খেলনা নাকি হার্মফুল তাই কাঠের খেলনা…’

—‘কে গিফট করেছিল মনে নেই?’

সুস্মিতা এবার ভাবার চেষ্টা করে, ‘তোমাকে তো রাঙামাসির কথা বলেছি৷ উনি মনে হয় দিয়েছিলেন৷’

—‘ওঁর নম্বরটা পাঠাও তো আমাকে৷’

—‘আরে, সে তো মারা গেছে তিন বছর আগে৷ তবে… রাঙামেসো বেঁচে আছে৷’

—‘বেশ, সেটাই পাঠাও৷’

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে আমার ফোনে একটা মেসেজ ঢোকে৷ সেটা চেক করতে করতে বলি, ‘আচ্ছা বেশ৷ পরে কল করছি৷’

—‘তোমার কী হয়েছে বলোতো?’

—‘না না! কী হবে আবার… রাখলাম, হ্যাঁ?’

ফোনটা প্রায় মুখের উপরেই কেটে দিয়ে আমি নম্বরটা ডায়াল করলাম৷ কিছুক্ষণ রিং হবার পর একটা বয়স্ক ভারী কণ্ঠ শোনা গেল৷ আজেবাজে কথায় কিছুটা সময় নষ্ট হল৷ খানিক খেজুরে আলাপ করে আমি আসল প্রসঙ্গে গেলাম, ‘আচ্ছা পুতুলগুলো কোথা থেকে কিনেছিলেন বলুন তো?’

উত্তর দেওয়ার আগে খানিক স্মৃতি হাতড়ালেন ভদ্রলোক৷ তারপর টানাটানা স্বরে বললেন, ‘সে তো আজ প্রায় পনেরো বছর আগের কথা রে ভাই৷ আর কিনেওছিলেন তোমার মাসিমা…’

—‘আপনাকে বলেননি?’

ব্যঙ্গের হাসি মিশে যায় লোকটার কথায়, ‘তা মেয়েরা তো কতরকম কথা বলতে থাকে সারাদিন৷ সেসব কি আমি মন দিয়ে শুনেছি না তুমি মন দিয়ে শোনো?’

—‘মানে আর জানা যাবে না?’ আমি হতাশ গলায় বললাম৷

একটুক্ষণ পরে আবার কথা ভেসে আসে ওপাশ থেকে, ‘তোমার গলা শুনে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আর্জেন্ট৷ তোমাদের মাসিমা তো ডায়েরি লিখতেন৷ পুতুলগুলো কেনার কথাও তাতে লেখা থাকতে পারে৷ তবে তাতে একটু খুঁজতে হবে যে…’

—‘প্লিজ একটু দেখুন যদি থাকে৷’

—‘আচ্ছা বেশ৷ আমি রাতের মধ্যে জানাই তোমাকে, কেমন?’

ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ পায়চারি করলাম৷ জানি না কেন, এত ছোট একটা ব্যাপারে মনটা অস্থির হয়ে উঠছে বারবার৷ মনে হয় হাতে আর কোনও কাজ নেই বলেই৷ মাথার ভিতরে সেই খইনিখোর পুতুলওয়ালাটার মুখ ভেসে উঠছে বারবার৷ সুস্মিতার বাড়িতে তার তৈরি করা পুতুল থাকাটা মোটেই আশ্চর্যের কিছু না… তা-ও… জানি না কেন মনটাকে শান্ত করতে পারছি না কিছুতেই৷

অস্থির ভাবটা কাটাতেই নবদাকে ফোন করে নিমন্ত্রণ করলাম বাড়িতে৷ বললাম অফিস থেকে ফিরে সত্বর আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসতে৷ রাতের খাওয়া এখানেই সেরে নেওয়া যাবে৷ ভদ্রলোক মনে হয়, একটু অবাকও হয়েছেন৷

তিনি যখন দরজায় কলিং বেল বাজালেন, ততক্ষণে আমার রান্নাবান্নার পাট চুকে গিয়েছে৷ সুস্মিতার অ্যালবামের ছবিগুলো আরও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখছিলাম এতক্ষণে৷ নবদা আসতেই তার সামনে এগিয়ে দিলাম সেগুলো, বললাম, ‘দেখুন তো, মনে হচ্ছে না একই শিল্পীর কাজ?’

ভদ্রলোক আমার হাবভাব দেখেই হয়তো কথার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন৷ ছবিগুলো মিনিটখানেক সরেজমিন করে বললেন, ‘সিমিলারিটি একটা আছে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝছি না ভায়া…’ ছবি নামিয়ে রেখে আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, ‘ধরে নিলাম তোমার ছবির পুতুলগুলোও ওই লোকটারই বানানো৷ আজ থেকে পনেরো বছর আগে, মানে লোকটার তখন বয়স ছিল তিরিশের কাছাকাছি৷ তো ওই বয়সে একটা লোক যদি কাঠের পুতুল বিক্রি করে, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? ছবিটা কাল সকালে না হয় দেখিও লোকটাকে…’

—‘আপনি বুঝতে পারছেন না, নবদা…’ আমি হাতের উপরে একটা ঘুসি মেরে বললাম, ‘লোকটা কতদিন আগে এখানে এসেছে বলেছিলেন?’

—‘সাত দিন হবে…’

—‘কুকুর মরা কবে থেকে শুরু হয়েছে?’

একটু থমকে উত্তর দিলেন নবদা, ‘ওর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়৷ মানে তুমি বলতে চাইছ, লোকটাই খুন করছে কুকুরগুলোকে? কিন্তু কেন?’ আমি মাথা দোলালাম, ‘তা জানি না৷ কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, লোকটার পুতুল বেচা ছাড়াও অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে৷’

—‘কীরকম উদ্দেশ্য?’

—‘তা বলতে পারব না৷ তবে কাজটা সে রাতে করতে চায়৷ কুকুররা রাতে পাড়া পাহারা দেয়৷ ফলে সব ক-টা কুকুরকে খতম করে দিলে ওঁর কাজটা নির্বিঘ্নে হতে পারে…’

—‘আঃ৷ ভারী অ্যাবসার্ড কথা বলছ হে তুমি৷ গত এক সপ্তাহে এ পাড়ায় কারও বাড়ি চুরি হয়নি৷’ নবদা প্রতিবাদ করে ওঠেন৷

—‘হয়নি৷ হতে চলেছে৷ এবং আমার মনে হয় কাজটা সাধারণ চুরিজাতীয় কিছু নয়… এত আটঘাট বেঁধে কেউ চুরি করে না৷’

আমি নবদার পাশটায় এসে বসে পড়ি৷ দুটো হাতের মধ্যে মাথা রেখে মাটির দিকে চেয়ে থাকি৷ তিনি একটা হাত রাখেন আমার পিঠে৷ খানিক নরম গলায় বলেন, ‘সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে… সাধারণ একটা চুরির আশঙ্কায় তুমি এতটা ভেঙে পড়েছ বলে মনে হচ্ছে না…’

ধীরে ধীরে মাথা তুলি আমি, ‘জানি না কেন আমার বার-বার মনে হচ্ছে, এই লোকটার কাজের সঙ্গে সুস্মিতার কিছু একটা যোগ আছে৷’

—‘সুস্মিতার!’

—‘হ্যাঁ৷ ও এখন পাড়ায় নেই৷ তাই হয়তো অপেক্ষা করছে লোকটা৷ এ বাড়িতে এলেই কোনওভাবে আক্রমণ করতে চায়…’

—‘বেশ, তো তুমি ওকে আপাতত আসতে বারণ করো৷’

—‘কী বলে বারণ করব? যে একটা পুতুলওয়ালাকে ভয় পাচ্ছি?’

নবদা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন৷ এমন সময় আমার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল৷ অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসছে৷ আমি রিসিভ করে লাউডস্পিকারটা অন করে দিলাম, ‘ডায়েরিটা পেয়েছি, বুঝলে? আর গুড নিউজ হল, এতে তোমার পুতুলগুলোর কথাও লেখা আছে৷’

—‘কী লেখা আছে?’

—‘জন্মাষ্টমীতে আমাদের এখানে একটা মেলা হত৷ সেখানেই একটা অল্পবয়সি ছেলের থেকে কিনেছিল পুতুলগুলো৷’

‘অল্পবয়সি ছেলে? মানে বছর কুড়ির?’

‘না না, আর-একটু বেশি৷ তবে বয়স কম হলে কী হবে? ছেলের কাজ ছিল ভারী চৌকশ৷ তোমার মাসিমার এত পছন্দ হয়েছিল যে একসঙ্গে সব পুতুল কিনে নিয়েছিলেন৷ কেবল ঘোড়াগুলো সে বেচতে চায়নি৷’ ফোনের উপর আমার হাতের আগল আলগা হয়ে এসেছিল৷ তাকিয়ে দেখলাম, নবদার ভুরুও কুঁচকে গিয়েছে৷ বৃদ্ধ ভদ্রলোক ওদিক থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু কথা বলেই চলেছেন, ‘ছেলেটা তোমার মাসিমাকে বলেছিল, কিনতে চাইলে সে পরের দিন আরও কাঠের পুতুল নিয়ে আসবে, কিন্তু ওঁর আর পরের দিন যাওয়া হয়নি…’

—‘যাওয়া হয়নি কেন?’

কয়েক সেকেন্ড পরে উত্তর ভেসে আসে, ‘এখানে লেখা আছে, ওঁর পোষা কুকুরটা সেদিনই মরে গিয়েছিল, বুঝলে? ডাক্তার বলেছিল বিষক্রিয়া… ওদের আশপাশে নাকি বেশ কয়েকটা বাড়িতে… যাক গে৷ পরের বছর মেলায় গিয়ে তোমার মাসিমা আর দেখতে পায়নি ছেলেটাকে৷ এগুলো পড়তে পড়তে কত পুরোনো কথা…’

ফোনটা কেটে দিলাম আমি৷ ধপ করে বসে পড়লাম চেয়ারের উপরে৷ নবদা আমার কাঁধে দুটো হাত রাখলেন, ‘ব্যাপারটা আর অতটা স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না কিন্তু…’

—‘একটাই উপায় আছে আমাদের কাছে…’ আমি মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললাম৷

—‘কী উপায়?’

—‘লোকটা সাত দিনে চারটে কুকুরের গলা কেটেছে৷ এ পাড়ায় আরও দু-চারটে কুকুর ঘুরে বেড়ায়৷ হয়তো আজ রাতেও অভিযান চালাবে সে৷ আপনি আর আমি যদি আজ রাতটা একটু সতর্ক থাকি…’

নবদা মাথা নাড়ালেন, ‘পরশু সুস্মিতা ফিরছে৷ তার আগেই কিছু একটা করা দরকার৷ কিন্তু… লোকটার হাতে ছুরি থাকে নিশ্চিত…’

—‘আমাদের হাতেও থাকবে…’ আমি ডাইনিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা ধারালো ছুরিটা হাতে তুলে নিই, ‘কাঠের উপরে না-হোক, মানুষের মাংসে নির্ঘাত চালাতে পারব৷’

(চার)

ঝিঁঝি ডেকে চলেছে একটানা৷ সেই সঙ্গে শনশন করে হাওয়া দিচ্ছে ছাদ জুড়ে৷ ছাদের দুটো প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দু-জন৷ আমাদের ফ্ল্যাট এ পাড়ায় সব থেকে উঁচু৷ ফলে দু-প্রান্তে দু-জন দাঁড়ালে গোটা পাড়াটাই চোখে পড়ে৷ আজ ভরা চাঁদের আলো আছে আকাশে৷ সে আলোয় ফাঁকা পড়ে থাকা রাস্তা আর তার পাশে অন্ধকার ঝোপঝাড় মায়াবী জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছে৷

গত এক ঘণ্টায় দু-দিকের কোনও রাস্তাতেই মানুষের চিহ্ন দেখা যায়নি৷ কেবল কয়েকটা কুকুর-বিড়াল হেঁটে গিয়েছে৷ একপ্রান্ত থেকে হেঁটে এসে কোনও বাড়ির পাশ দিয়ে মিলিয়ে গেছে৷ ঘুম যাতে না আসে সেজন্য গান চালিয়ে রেখেছি আমি৷ মাঝে মাঝে অকারণেই প্রশ্ন করছি নবদাকে লক্ষ্য করে৷ ভদ্রলোক যাতে ঘুমিয়ে না পড়েন৷

—‘আপনাকে জাগিয়ে রাখা অন্যায় হচ্ছে, জানি৷ সারাদিন অফিস করে…’

—‘আরে, এ আর কী? পরের মাসে ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ শুরু হচ্ছে তো৷ তারই একটু প্যাকটিস হচ্ছে আর কী…’

ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি দু-জনে৷ ফলে নীচ থেকে আমাদের দেখতে পাবার কথা নয়৷ আমি রাস্তার দিকে দৃষ্টি রেখেই বললাম, ‘ভারী তাজ্জব ব্যাপার, না? আজ যদি রাস্তায় একটা জেল-পালানো খুনি, কিংবা মব বস গলা কেটে পড়ে থাকত তাহলে মিডিয়া-পুলিশের মেলা লেগে যেত… অথচ ক-টা নিষ্পাপ কুকুর খুন হচ্ছে বলে কারও হেলদোল নেই তেমন… খুনিকে ধরার চেষ্টাও করছে না কেউ…’

ওপাশ থেকে উত্তর এল না৷ ভদ্রলোক হয়তো ভেবেছিলেন, বিশ্বকাপের ব্যাপারটা নিয়েই কিছু বলব আমি৷ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ‘একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে, জানেন?’

—‘কী?’

—‘কুকুরজাতীয় প্রাণীর কগনিটিভ প্রিমোনিশন বলে একটা ক্ষমতা থাকে৷ খারাপ কিছুর সম্ভাবনা তারা আঁচ করতে পারে৷ ধরুন, যে পাঁঠা কোনওদিন কসাইখানা দেখেনি, সে-ও সহজে কসাইখানায় ঢুকতে চায় না৷ টানাটানি করে ঢোকাতে হয়৷ কুকুরগুলো কি লোকটাকে দেখে বুঝতে পারে না লোকটার উদ্দেশ্য ভালো নয়?’

—‘সে বুঝলেই বা, আদতে তো হ্যাংলা প্রাণী৷ হাতে খাবার দেখেই গলে যায় হয়তো…’

—‘সেখানেও একটা সমস্যা আছে… কুকুর রাতবিরেতে সাধারণত দল বেঁধে বড় কোনও রাস্তায় শুয়ে থাকে৷ ঝুন্ডের মাঝে একটা কুকুরকে খাবার দেখালে সবাই দেখতে পাবে৷ সবাই মিলে ছুটে এলে খুন করে পালানো সম্ভব নয়…’

—‘তাহলে?’

—‘আমার মনে হয় দিনের বেলা লোকটা একটা কুকুরকে টার্গেট করে নেয়৷ তাকে একাকী কোথাও ডেকে নিয়ে গিয়ে খেতে দেয়৷ সকালে কুকুর দল বেঁধে থাকে না৷ ফলে কাজটায় অসুবিধে হয় না৷ রাতে সে হাতে খাবার নিয়ে আসে বটে, কিন্তু প্রথমেই সেটা দেখায় না৷ দলের পাশ দিয়ে আওয়াজ করে হেঁটে চলে যায়৷ যে কুকুরটা সকালে খেতে পেয়েছিল সে-ই আবার খেতে পাবার আশায় পিছন পিছন যায়৷ বাকিরা আগের

মতোই শুয়ে থাকে….আর তারপরেই…’

—‘ওই… ওই যে…’ আমার কথার মাঝেই চাপা চিৎকার করে ওঠেন নবদা৷ আমি ফিরে তাকিয়ে দেখি, ওঁর সমস্ত শরীর স্থির হয়ে গেছে৷ যেন কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করছেন৷ আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, ‘একটা আওয়াজ আসছে৷ শুনতে পাচ্ছ?’

শনশন হাওয়ার শব্দ কানে আসছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে অন্য কিছু মিশে আছে কি? আমি কান খাড়া করে শুনতেই আওয়াজটা চিনতে পারলাম৷ আবার সেই যন্ত্রটা বাজছে৷ আবার সেই চেনা সুর৷ খুব ক্ষীণ, তা-ও সুরের উৎস লক্ষ্য করে অন্ধকারের বুকে কিছু খোঁজার চেষ্টা করলাম৷ তার আগেই নবদার একটা আঙুল উঠে এসে দূরে কিছু দেখানোর চেষ্টা করে আমাকে, ‘ওই একটা নড়ছে৷ ওই… রাস্তার উপরে দেখতে পাচ্ছ?’ নবদা উত্তেজিত গলায় বলেন৷

জিনিসটা আমারও চোখে পড়েছে৷ রাস্তাটা আমাদের থেকে একশো মিটারের বেশি দূরে না৷ বিড়বিড় করে বলি, ‘হাতে কিছু আছে মনে হচ্ছে৷ বস্তা জাতীয় কিছু…’

আমি আর অপেক্ষা করি না৷ ছাদ পেরিয়ে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকি৷ লোকটা বড় রাস্তার উপরেই আছে৷ তাড়াতাড়ি পা চালাতে পারলে ওকে এক্ষুনি ধরতে পারব৷

এতরাতে লিফট বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ আমি হাঁপাতে হাঁপাতে কোনওরকমে একতলায় নেমে আসি৷ উপরের তলায় পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারি, নবদাও আসছেন আমার পিছন পিছন৷ তাঁর হাতে একটা লাঠি আছে৷ আমি ডান হাতে ছুরিটাকে শক্ত করে ধরে ছুটতে থাকি বড় রাস্তার দিকে৷ লোকটা যে-ই হোক, তাকে কিছুতেই পালাতে দেওয়া যাবে না৷

পিছনে তাকিয়ে দেখি, নবদাও আমার ঠিক পিছনেই দৌড়ে আসছেন৷ ভদ্রলোকের বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি৷ এই বয়সেও তাঁর পায়ে বেশ জোর আছে৷ গলা তুলে বললেন, ‘মনে হয়, বস্তা নিয়ে এদিকেই আসছে৷ একবার ধরতে পারলে জানোয়ারটাকে…’

আমাদের পাড়ার রাস্তাটা যেখানে মেন রোডে মিশেছে ঠিক সেখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা৷ এখান থেকে সোজা সামনে তাকালে দেখা যায়, রাস্তার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা কালচে শরীর পা ছড়িয়ে বসে আছে৷ তার থেকে একটু দূরে একটা বড় সাইজের বস্তা৷ এতক্ষণ রাস্তার উপরে ঘষে ঘষে সেটাকে টেনে এনেছে সে৷

আমরা দু’জনে রাস্তার ধারের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়ালাম৷ ক-দিন হল পাড়ার ল্যাম্পপোস্টগুলো কারা যেন ভেঙে দিয়ে গিয়েছে৷ এখন অবশ্য সে উত্তর জানতে বাকি নেই আমাদের৷

সেই চেনা সুরটা এখন স্পষ্ট কানে আসছে৷ মনে হয়, বস্তাটা এত দূর টেনে এনে হাঁপিয়ে গেছে মানুষটা৷ দু-হাতে মুখের কাছে কিছু একটা যন্ত্র ধরে সুরটা বাজিয়ে চলেছে সে৷ যন্ত্রটা হাতে ঢাকা পড়ে গেছে বলে ঠিক দেখা যায় না৷ তাও মনে হল, শিঙে আর হারমোনিকা মিলিয়ে যেন তৈরি হয়েছে যন্ত্রটা৷ চাপাস্বরে বাজাচ্ছে লোকটা৷ যেন যন্ত্রের নলের ভিতর থেকেই বুকের ভিতর দম টেনে নিচ্ছে৷ এই রূপালি জ্যোৎস্নায় খোলা রাস্তা আর ঘুমস্ত বাড়িঘরগুলোকে যেন ঘুম পাড়াতে চায় সুরটা৷

—‘এ তো পুরো সাইকো৷ খুন করে বডির সামনে বসে হারমোনিকা বাজায়!’ নবদা ফিসফিস করে বলে৷

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইলাম৷ শক্ত করে ধরে রইলাম ছুরিটা৷ লোকটা পালানোর চেষ্টা করবে না হয়তো৷ কুকুর খুনের জন্য তেমন বড় সাজা তার হবে না…

খানিক পরে যন্ত্রটা পকেটে ঢুকিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায় লোকটা৷ একবার দু-হাতে চোখ মোছে৷ বস্তাটাকে হাতে ধরে এগিয়ে আসতে থাকে আমাদের দিকে৷ তার ক্লান্ত নিশ্বাসের শব্দ এখান অবধি শোনা যাচ্ছে৷ সে শব্দের মধ্যে মনে হল, মৃদু কান্না মিশে আছে৷

খইনির গন্ধ পাচ্ছি কি? নাকি মনের ভুল?

আবার সামনে এগোতে শুরু করেছে লোকটা৷ দশ মিটার… পাঁচ মিটার… এবার একেবারে আমাদের হাতখানেকের মধ্যে এসে পড়েছে৷

আমার পাশ থেকে একটা শরীর বিদ্যুতের মতো ছিটকে গেল তার দিকে, লোকটা আচমকা আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না৷ মুখ দিয়ে ক্ষীণ আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল রাস্তার একধারে৷ বস্তাটা রাস্তার মাঝখানেই পড়ে রইল৷ নবদা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছিটকে গেল মাটিতে পড়ে-থাকা লোকটার দিকে, ‘হারামজাদা, একটুও নড়েছিস কি পা একেবারে গুঁড়ো করে দেব…’

পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সামনে তুলে ধরলাম৷ লোকটার মুখের উপরে আলো গিয়ে পড়তেই একটা হাত দিয়ে আলোটা আটকানোর চেষ্টা করল সে৷

তিনটে প্রাণীর ক্লান্ত নিঃশ্বাসের শব্দে ভরে উঠল ফাঁকা রাস্তাটা৷ আলোটা একবার বস্তার উপর ফেলে দেখে নিলাম৷ চুঁইয়ে চুঁইয়ে কালচে লাল রক্ত পড়ছে সেটা থেকে৷

—‘নিরীহ অবলা প্রাণীগুলোকে খুন করতে হাত কাঁপে না শালা তোর?’ আমি ছুরিটা নিয়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে৷

নবদা লোকটার হাঁটুতে সজোরে একটা আঘাত করল লাঠি দিয়ে৷

—‘ওরে ওরে… মারিস না রে… আমি চলতে না পারলে…’ লোকটা একবার ককিয়ে উঠে হাঁটু চেপে ধরল৷ সঙ্গে সঙ্গে অন্য হাঁটুতে নেমে এল লাঠি৷ লোকটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে৷ যেভাবে লেগেছে, তাতে মালাইচাকি সরে গেছে হয়তো৷

—‘কেন খুন করিস কুকুরগুলোকে?’ লোকটার পেটের উপরে একটা পা রাখলাম৷

সে কোনও উত্তর দিল না৷ হাঁটুর যন্ত্রণায় কুকুরের মতো কুঁইকুঁই শব্দ করে চলেছে ক্রমাগত৷ নবদা আবার মারতে যাচ্ছিল৷ আমি বাধা দিলাম, ‘থাক, আবার পুলিশের হুজ্জুতি হবে৷ কাল সকালে একে পুলিশে দিয়ে দেব৷ ওরাই যা করার করবে…’

এতক্ষণ লোকটার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম৷ এবার জামার দিকে নজর যেতেই আমার গা শিউরে উঠল৷ গোটা পাঞ্জাবি জুড়ে কালচে শুকনো রক্তের ছিট-ছিট দাগ৷ সম্ভবত এই পাঞ্জাবিটা পরেই রাতে খুন করে সে৷ তার গালে সজোরে একটা চড় মারলাম আমি৷ আবার কঁকিয়ে উঠল লোকটা৷

—‘কাল সকালে এ মক্কেল তো হাওয়া হয়ে যাবে… অবশ্য পায়ে যা ডোজ দিয়েছি বেশি দূর যেতে পারবে না…’

—‘উঠে দাঁড়া৷’ আমি লোকটার দিকে চেয়ে বললাম৷ সে একবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কাদার মতো লুটিয়ে পড়ল মাটিতে৷

—‘বেশ৷ বসেই বসেই স্বীকারোক্তি দে…’

আমি ফোনের ভিডিয়ো রেকর্ডিং-এর বাটানটা চালিয়ে দিলাম, ‘বল শালা, কেন খুন করিস কুকুরগুলোকে?’

লোকটাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার লাঠির বাড়ি মারতে যাচ্ছিল নবদা৷ তার আগেই হাত দিয়ে সেটা আটকানোর চেষ্টা করে সে, ‘বলছি বলছি… কুকুর… কুকুর আমি সহ্য করতে পারি না… ওদের দেখলেই আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়…’

লোকটার গলায় কোনও অনুশোচনা নেই৷ যেন গায়ের ঝাল মেটাতেই কথাগুলো বলছে সে৷

—‘এ পাড়ায় যতগুলো কুকুর খুন হয়েছে, তাদের কে মেরেছে?’

—‘আমি…’

রক্তের দাগ-লাগা বস্তাটার দিকে ক্যামেরাটা একবার ঘোরালাম আমি৷ তারপর বন্ধ করে দিলাম রেকর্ডিংটা৷

—‘যা, ভাগ হারামজাদা৷ কাল সকালে হয় পুলিশের লোক তোর বাড়ি যাবে, না হয় পাগলাগারদের…’

লোকটার উঠে পালানোর ক্ষমতা নেই৷ তার বুকের উপরে একদলা থুতু ফেলে নবদা বাড়ির রাস্তা ধরল৷ আমিও তার পিছু নিলাম৷

এতটা দৌড়াদৌড়ি আর উত্তেজনার পরে শরীর ঝিমিয়ে আসছিল৷ পায়ে জোর পাচ্ছি না তেমন৷ তা-ও, মনের ভিতরে একটা গর্বের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল বারবার৷

নবদা মুখ দিয়ে চকচক করে একটা আওয়াজ করল, ‘আরও দু-ঘা দিয়ে এলে হত৷ কুকুর মারার জন্য পুলিশ আর কীই বা করবে… দু-তিনদিন কড়কানি খেয়ে আউট হয়ে যাবে…’

—‘ভাবছি, ভিডিয়োটা কাল সোশ্যাল মিডিয়ায় দেব৷ ভবিষ্যতে যদি এসব করার চেষ্টা করে…’

পাশে তাকিয়ে দেখি, নবদার ভুরুটা কুঁচকে আছে৷ আমি একটু ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’

—‘একটা ব্যাপার ভারী অদ্ভুত, বুঝলে?’

—‘কী?’

—‘লোকটা খুন করে ফিরছিল, কিন্তু কোনও ছুরি ছিল না কাছে৷ আমি তো ওর গায়ের উপরে গিয়ে পড়েছিলাম৷ গায়ের কোথাও ছুরি আছে বলে তো মনে হল না…’

আমি উত্তর দিতে গিয়েও দিলাম না৷ জানি না কেন মনে হল, লোকটা চাইলে অস্বীকার করতে পারত দোষটা৷ তাকে আমরা বস্তাটা টেনে আনতে দেখেছি৷ খুন করতে দেখিনি৷ যেন ইচ্ছা করেই দোষ স্বীকার করে নিল সে৷ তা ছাড়া আর-একটা ব্যাপার আজ রাত থেকেই মনের ভিতর খোঁচা দিচ্ছে৷ সুস্মিতার বাড়িতে কুকুরটাকে বিষ খাইয়ে খুন করা হয়েছিল, কিন্তু এ পাড়ারগুলোকে গলা কেটে মারা হয়৷ তাহলে কি এই পনেরো বছরে এমন কিছু ঘটেছে, যাতে কুকুরদের উপরে তার রাগ বেড়ে গেছে? নাকি দুটো লোক আলাদা? কিন্তু তা কী করে….

পিছন ফিরে দেখলাম কোনওরকমে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে সে৷ যন্ত্রণাময় দেহটা টেনে নিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরের দিকে…

(পাঁচ)

কাল বাড়ি ফিরে শুতে শুতেই চারটে বেজেছিল৷ সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন নবদা৷ তার আগে অবধি লোকটাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে৷ শেষে ভোরের ঘুম চোখে এসে লাগাতে তিনি উঠে গিয়েছেন৷ আমি আর ওঁকে এগিয়ে দিতে যাইনি৷

আজ ভেবেছিলাম, দেরি করে ঘুম থেকে উঠব৷ কিন্তু সকালের দিকেই দরজায় টোকা পড়ছে জোরে জোরে৷ কোনওরকমে ঘুম কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি, নবদার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন৷ মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, কোনও বিপদে পড়ে এসেছেন৷

—‘আমার নাম রেবতী… আপনার পাশের ফ্ল্যাটে…’

—‘হ্যাঁ… হ্যাঁ… চিনি আমি৷ কী ব্যাপার বলুন তো? এত সকালে…’

—‘আপনি একটু আমার ঘরে আসবেন?’

অনুরোধটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷ আপত্তিও করা যায় না৷ বললাম, ‘একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে যাই?’

মহিলা আর কিছু না বলে মাথা নেড়ে ফিরে গেলেন৷ কিছু একটা ঘটেছে নিশ্চয়ই৷ রেবতীদেবী সচরাচর নিজে এসে আমার সঙ্গে কথা বলেন না৷ খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়েই কলিং বেল বাজালাম৷ রন্টু দরজা খুলে দিল৷ আমাকে সোফাটা দেখিয়ে বলল, ‘মা আপনাকে বসতে বলেছে৷’

আমি বসতে সে নিজের ঘরে ঢুকে গেল৷ ওপাশ থেকে তার পড়ার শব্দ শুনে বুঝলাম, সে ইংরেজি পড়ছে৷

সুস্মিতার নম্বরটা ডায়াল করতে রিং হল৷ সে ফোন ধরেই বলল, ‘কাল কী হয়েছিল বলোতো তোমার? হুট করে কেটে দিলে ফোনটা…’

—‘তোমার জন্য একটা জিনিস কিনছিলাম৷ যদিও পছন্দ হবে না…’

—‘পছন্দ হবে না! কী জিনিস?’

—‘একটা হাতি৷ তবে জ্যান্ত নয়৷ কাঠের৷’

—‘বাঃ, ভালো তো৷ পছন্দ হবে না কেন?’

—‘হাতি তোমার পছন্দ নয়, তাই৷ আমি মোটা ছিলাম যখন, আমাকে হাতি বলে খ্যাপাতে না?’

—‘ও! তো বিয়েটা কাকে করেছি?’

মনটা নরম হয়ে এল আমার৷ লোকটা বলেছিল সুস্মিতার পছন্দ হলেই পয়সা দিতে৷ এতটা ভদ্র অথচ কী নৃশংস মানুষটা!

মিনিট তিনেক পরে হাতে একটা ফোটো নিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন রেবতী দেবী৷ একটু ইতস্তত করে ছবিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘দেখুন, আপনি আমার ভাইয়ের মতো৷ এ এলাকায় সাহায্য পাবার মতো আর কাউকে চিনিও না আমি৷ এসব কথা আর কাউকে আপনি বলবেন না, সেই বিশ্বাসেই আপনাকে বলছি…’

কথা বলার ভঙ্গিতে একটু থতমত খেলাম আমি৷ ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলাম একটা ফ্যামিলি পোট্রেট৷ চারটে মানুষ৷ এর মধ্যে তিনজনকে আমি চিনি৷ নবদা, রেবতী দেবী নিজে আর রন্টু… চতুর্থজন রন্টুরই বয়সি একটা ছেলে৷

—‘রন্টু আমাদের দ্বিতীয় সন্তান৷ এই আমার প্রথম ছেলে টিটো৷ মারা গিয়েছে আজ ছ-মাস হল৷’

—‘ওঃ৷’ মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ কথাটা এতদিন চেপে রেখেছিলেন নবদা৷

—‘একটা গাড়ির ধাক্কায় ও মারা যায়৷ স্পট-ডেড৷ স্কুল থেকে ফিরছিল, এমন সময় একটা কুকুর তাড়া করে ওকে…’

—‘কুকুর!’

—‘হ্যাঁ… ও ভয় পেয়ে পালাতে গিয়েই গাড়ির তলায়… ওর বাবা খুব বড় শক পায়৷ মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তখন থেকেই৷ নানারকম ডিলিউশনে ভুগতেন৷ আর ওই কুকুর একেবারে সহ্য করতে পারতেন না৷ এই পাড়ার সমস্ত কুকুরকে উনিই…’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ‘কী যা-তা বলছেন৷ এ কী করে সম্ভব?’

মহিলা শান্ত গলায় বলতে থাকেন, ‘সাধারণত কাজটা রাতে করতেন৷ আমি ঘুম থেকে উঠে দেখতাম উনি বিছানায় নেই৷ কাল অফিস থেকে ফেরার সময়ই ওঁর জামায় রক্তের দাগ দেখে বুঝি, ফেরার সময়েই খুন করেছেন৷’ আমার মাথার ভিতরে সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে৷ তা কী করে হয়? নবদাই যদি কুকুরগুলোকে খুন করে থাকেন তাহলে লোকটা দোষ স্বীকার করল কেন? মহিলা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলছেন৷ মাথার ব্যামো তাঁর নিজেরই আছে৷

—‘উনি কোথায় এখন?’ আমি কঠিন গলায় প্রশ্ন করলাম৷ মহিলা এই প্রথম মুখ তুললেন, ‘কাল রাতে উনি বাড়ি ফেরেননি৷ আজ সকালেও ফেরেননি৷ আমার খুব টেনশন হচ্ছে ভাই… তুমি যদি একবার বাইরে বেরিয়ে…’

অসহায়ের মতো আমার দুটো হাত চেপে ধরলেন তিনি৷ অস্বস্তি হল আমার৷ কাল রাতে নবদা বাড়ি ফেরেননি কেন, আমি জানি৷ কিন্তু আজ ভোরেও ফিরবেন না কেন? মন বলল ভোরের আগেই হয়তো উৎসাহে পুলিশে খবর করতে চলে গিয়েছেন৷

—‘আপনি শান্ত হোন, আমি দেখছি৷’

কথাটা বলে ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলাম৷ একটা জিনিসে চোখ পড়তে থমকে গেলাম৷ রন্টু যে ঘরে পড়ছে, সে ঘরের শোকেসে একটা কাঠের পুতুল রাখা আছে৷ একটা সিংহ৷ শিল্পী কে, সেটা আর বলে দিতে হল না৷

কৌতূহল হতে ঘরের ভিতরে ঢুকে এলাম আমি৷ রন্টু এখনও ইংরেজি পড়ে চলেছে৷ আমি সিংহটা হাতে নিয়ে তার দিকে দেখিয়ে বললাম, ‘এটা তোমার বাবা কিনেছে?’

রন্টু উপরে নীচে মাথা নাড়ল, ‘আমার সিংহ খুব ভালো লাগে৷’

আমি হাসলাম, ‘তা-ই? তাহলে এই কাঠের সিংহকে ইংরেজিতে কী বলবে বলোতো?’

রন্টু একটু ভেবে উত্তর দিল, ‘উড লায়ন৷’

—‘উঁহুঁ… হল না৷’ আমি তার কাছে গিয়ে গাল টিপে দিলাম, ‘উড না৷ উডেন, কাঠের সিংহ হল উডেন লায়ন৷ কাঠের হাতি উডেন এলিফ্যান্ট, আর কাঠের ঘোড়া হল উডেন…’

বাকি কথা আমার গলাতেই মরে গেল৷ মাথার ভিতরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল এক মুহূর্তে৷ মাথা চেপে ধরে মাটির উপরেই বসে পড়লাম৷

‘উডেন হর্স’ মানে কাঠের ঘোড়া৷ কিন্তু আমেরিকার সিভিল ওয়ারের সময় ওই শব্দ দুটো একসঙ্গে বসলে তার অন্য একটা মানে হত৷

উডেন হর্স পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে ভয়ংকর এক টর্চার ডিভাইস৷ আজ এত বছর পরে এর বর্ণনা শুনলেও মানুষের বুক শিউরে ওঠে৷

ঘোড়ার পিঠে যেমন স্যাডল থাকে, ঠিক তেমন আকারের একটা সরু কাঠের প্লাটফর্ম তৈরি করা হত৷ ঠিক যেন একটা ছোট পিরামিডকে দু-পাশ থেকে টেনে কেউ চওড়া করে দিয়েছে৷ উপরের দিকের সরু ধারটায় জেগে থাকত একটা লম্বা ধারালো ব্লেড৷ যাকে শাস্তি দেওয়া হবে, তার দু-পায়ে চেন দিয়ে ভারী কিছু বেঁধে দেওয়া হত৷ তারপর ঘোড়ার উপর অশ্বারোহী যেভাবে বসে, সেভাবে বসিয়ে দেওয়া হত ওই ব্লেডের উপরে৷ পায়ে বাঁধা ভারের টানে অপরাধীর শরীর ধীরে ধীরে মাঝখান থেকে চিরে দু-ফাঁক হয়ে যেত৷

চকিতে মাটি থেকে উঠে পড়লাম৷ কোনওদিকে না চেয়ে দ্রুত নেমে এলাম একতলায়৷ রাস্তায় এসে পড়তেই দেখলাম, লোকটা খোঁড়া পায়েই আজ আবার চাটাই পেতে বসেছে৷ আগের মতোই তার সামনে সাজিয়ে রাখা আছে কাঠের জন্তু-জানোয়ারগুলো৷

ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম তার দিকে৷ স্পষ্ট মনে আছে, কাল ঘোড়ার সংখ্যা ছিল আট৷ আজ ন-টা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে চাটাইয়ের একপাশে৷ আমি সেদিকে তাকাতে আমার নজর লক্ষ করে একগাল হাসল লোকটা, ‘হেঁ হেঁ… সুপ্রভাত৷ আজ সকালে এইটা বানিয়েছি স্যার৷ ভারী সুন্দর হয়েছে, না?’

—‘তুমি… তুমি কাল রাতে…’

লোকটার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে এল৷ আমার দিকে স্থির-দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে বলল, ‘যারা নিরীহ অবলা প্রাণীদের উপর অত্যাচার করে, তাদের উপর ভীষণ রাগ হয় আমার, খুব রাগ হয়, খুব৷ মনে হয়, আমার ভিতরে একটা ঘুণপোকা সব কুরে কুরে খেয়ে নিচ্ছে৷ যতক্ষণ না লোকগুলোকে শাস্তি দিচ্ছি, ততক্ষণ পোকাগুলো খেয়েই যায় আমাকে৷ কী করব বলুন স্যার? রাগ কমাতে আমি ওদের ধরে এনে ঘোড়ায় চড়াই৷ কাঠের ঘোড়া৷

কাল রাতে আপনার বন্ধু চড়েছে৷ ওই লোকগুলোকে ঘোড়ায় চড়তে দেখে আমার রাগ কমে, পোকাগুলো শান্ত হয়৷ ভারী শান্তি আসে মনে৷ ওদের ঘোড়ায় চড়তে দেখে প্রেরণা পেয়েই তো এই ঘোড়াগুলো বানাই আমি… নইলে এমন ভালো কাজ কি আর এমনিতে হয়… এই দেখুন-না…’

লোকটা একটা কাঠের ঘোড়া তুলে ধরে আমার দিকে, ‘এটা আমার বানানো নয় নম্বর ঘোড়া স্যার৷ যতদিন বেঁচে আছি, ততদিনে আরও বানাব৷ অন্য কোথাও…’

লোকটা উদাস হয়ে যায়৷ যেন স্মৃতির অতলে হারিয়ে যায় সে৷

—‘কাল রাতে তাহলে…’

—‘আমি কাল রাতে বাড়ি ফিরছিলাম, স্যার৷ কুকুরগুলোকে রোজ রাতে আমি খেতে দিই৷ ওদের সুর বাজিয়ে শোনাই৷ কাল শোনাতে গিয়ে দেখলাম একটা কুকুর নেই৷ বুঝলাম, কোথাও তার গলাকাটা দেহটা পড়ে আছে৷ আমি একটা ঝোপের ভিতর ওকে খুঁজে পেয়ে বডিটা চাপা দেব বলে টেনে আনছিলাম, এমন সময়…’

—‘আর তোমার পাঞ্জাবিতে যে শুকনো রক্তের দাগ…’

খলখল করে হেসে ওঠে লোকটা, ‘ওটা কুকুরের রক্ত নয় স্যার…’ আমার গা-টা গুলিয়ে ওঠে একবার, ‘কিন্তু তুমি যখন জানতে, নবদা খুনগুলো করছে তখন সবাইকে জানিয়ে দিলেই তো…’

দাঁতের ফাঁকে হাসে মানুষটা, ‘কুকুর-বিড়াল মারলে কত টাকা জরিমানা হয়, স্যার? ওর থেকে বেশি টাকায় তো আপনি আমার একটা ঘোড়া কিনতে চেয়েছিলেন…’

আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করি না, সে নিজেই বলতে থাকে, ‘এই যে আপনি যেমন বেঁচে আছেন, আমি যেমন বেঁচে আছি, তেমন ওই অবলা অসহায় জন্তুগুলোরও বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে, স্যার… হেঁ হেঁ৷ ওদেরও মরতে ব্যথা লাগে৷ যারা ওদের ব্যথা দেয় তাদেরও একই ব্যথা পাওনা হয়৷ এই যে আপনি কাঠের পুতুল কিনলে আমার যেমন পাওনা হয়…’

—‘আপনার বন্ধু গত রাতে যে কুকুরটাকে মেরেছিল, তার একটা পা ছিল না, জানেন৷ কত কষ্ট করে হাঁটত কুকুরটা৷ খেতে পেত না৷ গলা চুলকোতে পারত না৷ ধুঁকত, কষ্ট পেত, কিন্তু অবিশ্বাস করেনি, বলুন? খাবার দেখিয়ে ডাকতেই খুশি হয়ে কাছে গিয়েছে৷ খাবারের বদলে গলায় ছুরি চলছে কেন, বুঝতেই পারেনি কুকুরটা… হেঁ হেঁ…’

লোকটা এবার হাতের ঘোড়াটা তুলে ধরে আর-একটু উপরে, মুগ্ধ হয়ে যায় তার চোখ দুটো, ‘এইটা আমার সেরা কাজ হয়েছে, স্যার৷ আজ অবধি যত করেছি, তার মধ্যে একেবারে সেরা৷’

তার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম৷ ঠিক যেন কোনও আর্মি অফিসার তার সদ্য পাওয়া মেডেলের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে৷ আমি ফিরে যাচ্ছিলাম৷ সে পিছু ডেকে থামিয়ে দিল আমাকে, ‘ও দাদা, শুনছেন… শুনুন-না…’

আমি ফিরে তাকাতে সে খুশি মুখে ঘোড়াটা এগিয়ে দিল আমার দিকে, ‘এতদিন এ কাজ করছি, কেউ ধরতে পারেনি৷ আপনি পারলেন৷ নিন, এটা আমি আপনাকে দিলাম… পয়সা লাগবে না৷ এমনিই দিলাম…’

কথা না বাড়িয়ে হাতে তুলে নিলাম ঘোড়াটা৷ চকচকে মসৃণ পালিশের উপরে হাত পিছলে যায় যেন৷

—‘কাল থেকে আর এখানে বসব না আমি…’ সে বিড়বিড় করে বলে আমার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে দিল৷ মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর৷

আমার হাতে কাঠের ঘোড়াটাও জীবন্ত হয়ে উঠতে চাইছে৷ শিল্পীর দক্ষ হাতের টান আর প্রেরণা ছাড়া কাঠের ঘোড়ায় এমন প্রাণ ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয় হয়তো…

পিছন থেকে শুনতে পেলাম, সেই কাষ্ঠল যন্ত্রের করুণ সুর আবার বাজতে শুরু করেছে৷ মনে হল, আমার ঠিক পিছনে চাটাইটাকে ঘিরে একে একে জমা হচ্ছে কিছু অদৃশ্য চতুষ্পদ৷

স্থির, মুগ্ধ নয়নে তারা চেয়ে আছে বাঁশুরিয়ার দিকে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *