প্রথম খণ্ড (শ্রদ্ধেয় ফণিভূষণ আচার্যকে)
1 of 2

কাঠের ঘোড়া

কাঠের ঘোড়া

জনসাধারণ বললে ঠিক যেন বলা হয় না। পাবলিক শব্দটির অনুবাদ হয় না। অনুবাদে কেমন যেন এলিয়ে পড়ে। ভার কমে গিয়ে হালকা হয়ে যায়। ঠাস বুনোট আর থাকে না। জ্যালজেলে গামছার মতো নিরীহ এক অবয়ব। পাবলিক বললে চরিত্রটি ঠিক-ঠিক ফুটে ওঠে। দার্শনিক কিরকেগার নিজেকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, পাবলিক কি বস্তু?

উত্তরটি চমৎকার।

পাবলিক বলতে যে কোনও একটি ব্যক্তিকে কল্পনা করার চেষ্টা করলে চোখের সামনে কি চেহারা ভেসে ওঠে! বিশাল চেহারার এক রোমান সম্রাট। বেঁচে থাকার একঘেঁয়েমিতে ক্লান্ত, বীতশ্রদ্ধ। সব সময় ইন্দ্রিয়ের সুখ খুঁজছে। প্রচুর আমোদ চাই, হাসি-তামাশা চাই। বুদ্ধি বড় ঐশ্বরিক জিনিস। সূক্ষ্মতায় ভরা। স্থূল ইন্দ্রিয়কে স্পর্শ করে না। অতএব এই পাবলিক নামক রোমান সম্রাটের অন্বেষা কি? তিনি ঘুরে-ঘুরে বেড়ান। তাঁকে বদ বলা চলে না, তবে ভীষণ উদ্ধত। একটা নেতিবাচক স্পৃহা সব সময় কাজ করে চলেছে ভেতরে। কিসের ইচ্ছা! না আমি সকলকে দাবিয়ে রাখব। সে যুগের গ্রন্থাবলী যাঁরা পড়েছেন তাঁরা অবশ্যই জানেন, প্রবল প্রতাপান্বিত সিজার সময় কাটাবার জন্যে কিনা করেছেন? বেঁচে থাকার একঘেঁয়েমি কাটাবার জন্যে পাবলিক তাহলে কি করবে? তারা একটা কুকুর পুষবে। সেই কুকুরই তাদের আনন্দ দেবে। কি ভাবে দেবে?

ধরা যাক, যে কেউ একজন আর পাঁচজনের চেয়ে সর্বক্ষেত্রে বড় হয়ে উঠল। ধীরে-ধীরে তিনি মাননীয়ের স্তরের দিকে এগিয়ে চলেছেন নিজের সাধ্য ও সাধনার বলে, সঙ্গে-সঙ্গে সেই মানুষটির দিকে লুলু করে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হল। শুরু হয়ে গেল মজা। কুকুর ঘেউ-ঘেউ করছে, আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, কোটের ন্যাজ ধরে টানাটানি করছে। যত রকমের অসভ্যতা আছে সব কিছু করার স্বাধীনতা সেই কুকুরকে দেওয়া হয়েছে। এই আনন্দে ক্লান্ত হয়ে পাবলিক এক সময় বলবে, যাক খুব হয়েছে। এবার বন্ধ হোক। কুকুর তুমি ফিরে এস।

অনেক উদাহরণের একটি উদাহরণ মাত্র। পাবলিক কি ভাবে টেনে নামায়। কেউ বড় হচ্ছে, শক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিতে এগিয়ে চলেছে, এ যেন সহ্য করা যায় না। যেমন করেই হোক টেনেটুনে খামচে খুমচে নামাতে হবে। কুকুর কিন্তু কুকুরই রয়ে গেল। কাজ শেষ হয়ে যাবার পর ওই পাবলিক তাকে আদর নয় ঘৃণাই করল।

এই কুকুর হল তৃতীয় দল, থার্ড পার্টি। এদের অস্তিত্ব কোনও সম্মানের আসনে নয়। একেবারেই তুচ্ছ। অনেক আগেই এদের সর্বনিম্ন স্তরে নামান হয়েছে। প্রয়োজনে নীচ আর হীন কাজে শিস দিয়ে ডাকা হয়। এদের কোনও মালিক নেই। পাবলিকের আদেশ পালন করলেও এদের প্রভু পাবলিক নয়। পাবলিকের কাজ শুধু লেলিয়ে দেওয়া। ব্যক্তিবিশেষকে দেখিয়ে তারা স্পষ্ট লুলুও করে না আবার অত্যাচার অসভ্যতার চরম মুহূর্তে শিস দিয়ে ডেকেও নেয় না। এই হল মজা। যদি প্রশ্ন করা হয় কুকুর কার? কেউই বলবে না আমার। যদি বলা হয় অসভ্য জানোয়ার কুকুরটাকে মেরে ফেললে কেমন হয়! পাবলিক বলবে খুব ভালো হয়। ওই বদমেজাজী অসহ্য কুকুর গেলেই বাঁচা যায়।

বললে কী হবে? মালিকানাহীন কুকুর পাবলিককে কত আনন্দ দেয়! সামান্য একটু উসকানির চাঁদায় লাফিয়ে-লাফিয়ে ছুটে যায়। যারা এর প্রতিপালক তারাও মৃত্যু কামনা করে। কুকুর কিন্তু মরে না।

দেশ এখন পাবলিকের হাতে চলে গেছে। জোর করে আইন খাটাতে গেলে গদি টলে যাবে। আততায়ীর বুলেটে শরীর ঝাঁজরা হয়ে যাবে। বন্ধে সারা দেশ অচল হয়ে যাবে। ‘আমার দেশ’ যে কোনও কারণেই হোক এই কথাটি ভাবতে শেখান হল না। দেশের আমি নই, দলের আমি। এ যেন বিশাল এক ফুটবল খেলা। দেশ হল বল। দুপাশে দুই গোল পোস্ট। দলে-দলে লাথালাথি। বিদেশি রেফারির ঠোঁটে বাঁশি। খেলার টিকিট হল হরেক রকম ট্যাকস। আজকাল অধিকাংশ মানুষই উদাসীন নির্লিপ্ত। সকলেরই মনে একটিমাত্র প্রশ্ন, ‘কি হবে।’ ছেলের পড়াশোনার পেছনে কাঁড়ি টাকা খরচ করে কি হবে? জীবিকার অবস্থা শোচনীয়। ভবিষ্যতের জন্যে সঞ্চয় করে কি হবে? বিশ বছর পরে একশো টাকার দাম হবে এক টাকা। আমেরিকায় এখন যেমন ধনী হওয়া মানেই মাফিয়ার শিকার হওয়া, এদেশেও তাই হবে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, বলাৎকার, সার দেওয়া বেগুনের মতো স্ফীত হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির স্বাস্থ্য ক্রমশই ভালো হচ্ছে। আরও ভালো হবে। এক শ্রেণির মানুষ সহজে বড়লোক হবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন। সেই রাস্তায় কোনও নীতি নেই। লেনা-দেনা’র চাকা নি:শব্দে ঘুরছে। একটিমাত্র শব্দ এ জাতির বাইবেল, কোরাণ, ভাগবত। শব্দটি হল, ম্যানিপুলেসান।

প্রাচীনকালে সেনাবাহিনীতে একটি নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন ছিল। শাস্তিটি হল কাঠের ঘোড়ায় চড়া। ঘোড়ার পিঠটা অসম্ভব ধারাল। শরীরের ওজন চাপিয়ে হতভাগ্য অপরাধীকে সেই ধারালো কাঠের ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হত। বসে থাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কুচকাওয়াজের মাঠে যখন এই নিদারুণ শাস্তির যন্ত্রণায় অপরাধী কাতরাচ্ছে, তখন মাঠের চারপাশের পরিখা দর্শনার্থীতে ভরে গেছে। সকলেই দাঁত বের করে হাসছে।

অপমানিত যন্ত্রণাকাতর অপরাধী সকলের মুখে বোকা-বোকা অসহ্য হাসি দেখে চিৎকার করে বলছে, ‘বোকার মতো দেখার কি আছে? তোমাদের লজ্জা করে না।’

দর্শনার্থীর দল চিৎকার করে বলছে, ‘আমরা দেখলে তোমার যদি বিরক্তি লাগে তুমি অন্য পথ ধরে ঘোড়া ছোটাও।’

আমরা সকলেই তীক্ষ্ণপৃষ্ঠ কাঠের ঘোড়ায় চেপে বসে আছি আর বিভিন্ন দল আমাদের করুণ, যন্ত্রণাকাতর অবস্থা দেখে হাসছে আর বলছে, এই পথ নয়, ওই পথ, ওই পথ নয় সেই পথ। আরোহী জানে, এ হল যন্ত্রণা দেবার ঘোড়া। পথ পাড়ি দেবার ঘোড়া নয়। এই যন্ত্রণাময় অচল আরোহণের পাশ দিয়ে একে-একে চলে যাচ্ছে জীবনের দিন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *