কাঠুরের কপাল

কাঠুরের কপাল

জমিদার রত্নাকর সুন্দরবনে শিকার করতে গিয়ে, এক মস্তবড়ো গর্তে ঝুপ করে পড়ে গেল৷

যখন বাঘের উৎপাত বেশি হয়, কাঠুরেরা তখন বনের ভেতরে বড়ো বড়ো গর্ত খুঁড়ে রাখে৷ গর্তের মুখ খড়কুটো আর গাছের ডালপালায় ঢাকা থাকে, তার তলায় যে গর্ত আছে সেটা আর টের পাওয়া যায় না৷ বাঘেরা তখন সেই খড়কুটো আর ডালপালার উপর দিয়ে যেতে গেলেই হুড়মুড় করে গর্তের ভেতরে পড়ে যায়, তারপর কাঠুরেরা এসে বাঘটাকে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে৷

রত্নাকর মানুষ হয়েও দেখতে না পেয়ে এমনই এক গর্তের মধ্যে পড়ে গেছে৷ গর্তের ভেতরে-বাপ রে, কী ঘুটঘুটে অন্ধকার! যেন অমাবস্যার রাত্রি এসে সেখানে বাসা বেঁধেছে! তাকিয়ে দেখতেও গা শিউরে ওঠে!

খালি কি অন্ধকার? তাহলেও তো রক্ষে ছিল! অন্ধকারের ভেতরে যে আবার কতরকম ভয়ানক আওয়াজ হচ্ছে, তাও আর বলবার-কইবার নয়৷ ফোঁস ফোঁস,-কিচির-মিচির-হালুম-হুলুম-এমনি আরও কত কী!

ভয়ে রত্নাকরের প্রাণপক্ষী দস্তুরমতো খাবি খেতে লাগল-কাঁদবে কী, টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারল না-একেবারে ‘নট-নড়ন-চড়ন নট-কিচ্ছু’ হয়ে আড়ষ্টের মতো বসে রইল৷ সন্ধে হল, রাত হল, আবার ভোর হল৷ রত্নাকর কিন্তু তখনও ‘এই মরি, এই মরি’ করে ঠায় বসে আছে তো বসেই আছে-ছবিতে আঁকা মানুষের মতো!

দিনের আলো গর্তের ভেতরে যেন ভয়েই সেঁধুতে পারল না৷ কিন্তু গর্তের বাইরে মানুষের সাড়া পাওয়া গেল৷

রত্নাকর চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ওহে ভাই, ওহে ভাই, দয়া করে আমাকে বাঁচাও ভাই!’

বাইরে থেকে সাড়া এল-‘কে ও!’

‘আমি জমিদার রত্নাকরবাবু, গর্তে পড়ে বেজায় কাবু হয়ে আছি৷ তুমি কে ভাই?’

‘আমি কাঠুরে৷’

‘কাঠুরে হও আর যাইই হও, আগে আমাকে বাঁচাও! অনেক বকশিশ দেব৷’

‘বকশিশ দাও তো ভালোই, না দিলেও তোমাকে বাঁচাব’-এই বলে কাঠুরে লম্বা একটা গাছের ডাল ভেঙে এনে, গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ‘এসো, এই ডাল ধরে উঠে এসো!’

ডাল ধরে উঠে এল-ওমা, মস্ত এক রূপী বাঁদর! রত্নাকরের মতো সে-বেচারিও গর্তে পড়ে জব্দ হয়েছিল-এখন যাঁহাতক ডাল পাওয়া, তাঁহাতক উঠে আসা৷

‘তবে কি ওই বাঁদরটাই মানুষের মতো গর্তের ভেতর থেকে আমার সঙ্গে কথা কইছিল? বাপ, তাহলে ওটা তো বাঁদরও নয়, বাঁদরের চেহারায় আসল ভূত!’ এই ভেবে কাঠুরে চটপট লম্বা দিতে গেল৷

কিন্তু গর্তের ভেতর থেকে আবার মানুষের গলা এল, ‘ভাই, ডাল নামিয়ে তুলে নিলে কেন? আমাকে বাঁচাও ভাই, তোমাকে মুঠো মুঠো মোহর দেব!’

ভরসা পেয়ে কাঠুরে ফের লম্বা ডালটা গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল৷ এবারে সড়াৎ করে ডাল বেয়ে উঠে এল মস্ত এক গোখরো সাপ!

কাঠুরে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘বাপ রে বাপ, সাপে কথা কইল মানুষের মতো৷ এ যে বেজায় ভূতুড়ে কাণ্ড বাবা! আর এখানে থাকা নয়!’

গর্তের ভেতর থেকে আবার মানুষের গলায় শোনা গেল, ‘যেয়ো না ভাই, যেয়ো না- তোমার দুটি পায়ে পড়ি! আমাকে বাঁচাও, আমি জমিদার রত্নাকর, আমাদের অর্ধেক জমিদারি তোমাকে দেব!’

কাঠুরে কী আর করে, আস্তে আস্তে ডালটা আবার গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল৷ ডাল বেয়ে এবারে এক প্রকাণ্ড বাঘ উঠে এসে, বনের ভেতরে ল্যাজ তুলে দৌড় মারল!

কাঠুরে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে বলল, ‘নাঃ, এ ভূতুড়ে কাণ্ড ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে যে! আগে বাঁদর, পরে সাপ, তারপরে বাঘ! এখন প্রাণটা থাকতে থাকতেই প্রাণ নিয়ে পালানো যাক!’

গর্তের ভেতর থেকে কাকুতি-মিনতি করে রত্নাকর বলল, ‘আমাকে ফেলে পালিয়ো না ভাই, পালিয়ো না-ভগবান তোমার ভালো করবেন৷ আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব! দেব, দেব, দেব-এই তিন সত্যি করলাম!’

কাঠুরের দয়ার শরীর, কাজেই ভয়ে ভয়ে রাম-নাম জপতে জপতে আর একবার সে গর্তের মধ্যে ডালটা ঢুকিয়ে দিল৷

এবারে বাস্তবিকই মানুষকে উঠে আসতে দেখে কাঠুরে ‘দুর্গা’, বলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল!

রত্নাকর বলল, ‘কাঠুরে, তোমার উপকার আমি কখনো ভুলব না৷’

কাঠুরে হাত জোড় করে বলল, ‘জমিদারবাবু, আপনি কি সত্যিই আমাকে আপনার অর্ধেক জমিদারি আর মেয়েটিকে দেবেন?’

রত্নাকর বলল, ‘হ্যাঁ, দেব বই কী৷ তুমি আমার বাড়িতে যেয়ো, তারপর কথা হবে৷’

দুই

গরিব কাঠুরে, কখনো ধনদৌলতের মুখ তো দেখেনি! আজ তার প্রাণ যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেছে৷ নাচতে নাচতে সে জমিদার রত্নাকরবাবুর বাড়ির দিকে চলেছে৷ মনে মনে ভাবছে, ‘আঃ, বাঁচা গেল! আর কুড়ুল কাঁধে করে বনে বনে ঘুরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে না, অর্ধেক জমিদারি পেলে আমার আর ভাবনা কী! তার ওপরে আবার জমিদারের মেয়েও আমার গলায় মালা দেবে৷ জমিদারের মেয়ে, দুধ-ঘি খায়, কত আদরে থাকে, সে নিশ্চয়ই দেখতে পরমাসুন্দরী৷ আহা, আমার শ্বশুরমশায়ের ভারি দয়ার শরীর গো, ভগবান তাঁর ভালো করুন৷’

রত্নাকরবাবুর বাড়ির ফটকের সামনে এসে দারোয়ানকে ডেকে কাঠুরে বলল, ‘এই দারোয়ান, বাবুকে গিয়ে বলগে যা, আমি এসেছি৷’

দারোয়ান বাড়ির ভেতরে ঢুকে ফের যখন ফিরে এল, কাঠুরে তখন বলল, ‘কী রে, বাবু কী বলল?’

‘বাবুজি বললেন, লাঠি মেরে তোর মাথা ভেঙে দিতে৷’ এই বলেই গালপাট্টা নেড়ে বনবন করে লাঠি ঘুরিয়ে তেড়ে এল দারোয়ান৷

বেগতিক দেখে কাঠুরে ভোঁ-দৌড় দিয়ে সে যাত্রা কোনোগতিকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল বটে, কিন্তু তার বড়ো সাধের বাড়া ভাতে যেন ছাই পড়ল৷

মুখখানি চুন করে কাঠুরে বেচারি বনের মাঝে নিজের ভাঙা কুঁড়েঘরে ঢুকেই, থমকে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ওরে বাবা, ঘরের ভেতরে বসে আছে গর্তের সেই বাঁদর, গোখরো সাপ, আর ইয়া গোঁফওয়ালা মস্ত বাঘটা! দেখেই তো তার পেটের পিলে গেল চমকে! বুঝল, লাঠির ঘা থেকে আজ মাথা বাঁচলেও এদের খপ্পর থেকে আর কিছুতেই বাঁচোয়া নেই!

কাঠুরে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হা ভগবান, যাদের আমি বাঁচালাম, তাদের সবাই কিনা আমার শত্রু হয়ে দাঁড়াল!’

কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই বাঘ, সাপ আর বাঁদর কাঠুরেকে দেখে একটুও তেড়ে এল না, বরং তার পায়ের তলায় গড়িয়ে পড়ে আদর করে তার পা চেটে দিতে লাগল! কাঠুরে তো একেবারে গালে হাত দিয়ে অবাক!

তারপর বাঁদরটা তাড়াতাড়ি বনের গাছ থেকে ভালো মিষ্টি ফল পেড়ে আনল, বাঘটাও একছুটে বাইরে গিয়ে কোথা থেকে একটা নধর হরিণ মেরে এনে দিল, আর গোখরো সাপ তার জ্বলজ্বলে মাথার মণিখানা কাঠুরের পায়ের তলায় নামিয়ে রাখল!

কাঠুরে চোখের জল মুছে, তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘ওরে, তোরা দেখছি জন্তু হয়েও মানুষের চেয়ে ঢের ভালো, উপকার পেয়ে উপকার ভুলে যাস না! দুষ্টু রত্নাকর আমাকে আজ বড়ো দাগাটাই দিয়েছে, অর্ধেক জমিদারি আর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া চুলোয় যাক-উলটে কিনা লাঠি নিয়ে পেছনে তাড়া? ছি, ছি, মানুষকে ধিক!’

হরিণের মাংস আর ফলমূল পেট ভরে খেয়ে মণিটি ট্যাঁকে গুঁজে কাঠুরে শহরে গিয়ে হাজির হল৷

একটি জহুরির দোকান দেখে সে তার ভেতরেই ঢুকল৷ ঠিক করল মণিটি বেচে যে টাকা পাওয়া যাবে, তাই নিয়েই এ-জীবনটা সে কাটিয়ে দেবে, কুড়ুলে গাছ কুপিয়ে আর তাকে খেটে খেতে হবে না৷

জহুরিকে ডেকে সে বলল, ‘ওহে, এই মণিটি আমি বেচব!’

মণিটি দেখে জহুরি তো হতভম্ভ! এ যে সাত রাজার ধন এক মানিক! কাঠুরের কাছে এমন দামি মণি এল কেমন করে? নিশ্চয়ই চুরি করেছে! চোরাই মাল কিনে পাছে মুশকিলে পড়ে, সেই ভয়ে জহুরি তখনই চুপিচুপি শহর-কোটালের কাছে খবর পাঠাল৷ কোটাল এসে তখনই কাঠুরের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে, তাকে একেবারে রাজার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করল৷

রাজাও মণি দেখে বললেন, ‘যে রত্ন আমার ভাণ্ডারে নেই, তুই কাঠুরে হয়ে তা পেলি কোথায়?’

কাঠুরে তখন কাঁদতে কাঁদতে জমিদার রত্নাকরের কথা থেকে শুরু করে, মণি পাওয়া পর্যন্ত সব কথা খুলে বলল৷

রাজা বললেন, ‘আচ্ছা, জমিদার রত্নাকরকে ডেকে নিয়ে আয় তো রে, সে কী বলে শুনি৷’

রাজার হুকুমে তখনই জমিদার রত্নাকরকে সভায় ডেকে আনা হল৷

রাজা বললেন, ‘ওহে রত্নাকর, এই কাঠুরে তোমাকে গর্ত থেকে বাঁচিয়েছিল বলে তুমি কি একে তোমার মেয়ে আর অর্ধেক জমিদারি দেবে বলেছিলে?’

রত্নাকর হাত জোড় করে, চোখদুটো কপালে তুলে বলল, ‘মহারাজ, এ যে ডাহা মিছে কথা! এই কাঠুরেটাকে এর আগে আমি কখনো চোখেও দেখিনি৷’

রাজা রেগে টং হয়ে কাঠুরেকে বললেন, ‘তবে রে হতভাগা চোর! আমার সঙ্গে মিছে কথা? জহ্লাদ!’

জহ্লাদকে খাঁড়া কাঁধে করে আসতে দেখে কাঠুরে ভয়ে মাটির ওপরে আছড়ে পড়ে বলল, ‘মহারাজ, আমি সত্যি কথাই বলছি!’

রত্নাকর বলল, ‘মহারাজ, এর কথা যে সত্যি, তার সাক্ষী কোথায়?’

হঠাৎ সভাসুদ্ধ লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছোটছুটি, চ্যাঁচামেচি করতে লাগল! তারপরেই দেখা গেল, হেলতে-দুলতে এক মস্ত বাঘ এসে সভার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়াল,-তার পিঠে এক রূপী বাঁদর,-আর বাঁদরের গলা জড়িয়ে মাথার ওপরে কাছির মতো একটা মোটা গোখরো সাপ!

রত্নাকরের মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল! ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে পড়ল৷

কাঠুরে জোর পেয়ে বলল, ‘রত্নাকরবাবু, আপনি কি এদের চেনেন না?’

রত্নাকর আমতা আমতা করে বলল, ‘এগুলো যে সেই গর্তের জন্তু!’

কাঠুরে বলল, ‘মহারাজ! এরাই আমার সাক্ষী!’

বাঘ তখন এগিয়ে এসে ডাকল-‘হালুম!’

বাঁদর ডাকল-‘কিচ-কিচ, কিচির-মিচির-কোঁও!’

গোখরো সাপ ডাকল-‘স-স-স-র-র-র-ফোঁস-স!’

পাছে তারা পায়ে কামড়ে দেয় সেই ভয়ে রাজা তাড়াতাড়ি পা দুটো সিংহাসনের ওপর তুলে ফেলে বললেন, ‘বাছা কাঠুরে, তোমার সাক্ষীদের বাসায় ফিরে যেতে বলো৷ আমি বুঝেছি, তোমার সব কথাই সত্যি৷ রত্নাকর! দেখো, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে! যে লোক উপকার ভুলে যায়, আমার রাজ্যে সে আর থাকতে পাবে না৷ তোমার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে, তোমাকে গাধার পিঠে চড়িয়ে আজকেই শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ আর, তোমার সব জমিদারি আমি এই কাঠুরেকে দিলাম, তোমার মেয়েকেও কাঠুরেই বিয়ে করবে৷’

তার পর? তার পর আর কী, রত্নাকরের পরমাসুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে জমিদারির আয়ে কাঠুরের মনের সুখে দিন কাটতে লাগল৷ সুখের দিনে সে কিন্তু তার তিন-বন্ধুকেও ভুলে গেল না-বাঘ, বাঁদর আর সাপকেও আদর করে নিজের বাড়ির ভেতরে এনে রাখল৷ তার পর? নোটে-গাছটি মুড়োল কি না জানি না, কিন্তু আমার কথাটি ফুরোল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *