কাঠুরিয়া
আমিও সেই কাঠুরিয়া, জগৎকারণ বোঝার চেষ্টা করেও বুঝি না। বিধাতাকে না মেনে প্রশ্ন করি, কেন এমন করছেন। ওই যিনি কাঁচা ডাল কাটছিলেন, তিনি তো ঈশ্বর। কত বৃদ্ধ, মৃতপ্রায় মানুষ বেঁচে থাকে, আর ঝরে যায় টাটকা সবুজ প্রাণ। কার যে কখন দিন শেষ হয়, কেউ কি বলতে পারে!
ওই যে বৃদ্ধ, বিদ্যুৎগতি হরিণীর পেছনে ছুটছে, ও তো মানুষের আদি স্বভাব, কামনা বাসনা। যা আয়ত্তের বাইরে তার পেছনে ছোটাটাই মানুষের ধর্ম। আর যারা ওই জাঁতাটা তোলার চেষ্টা করছিল, ওরা মানুষের নিয়তি। মানুষের সভ্যতার নিয়তি। উঠবে, আবার পড়বে, পড়বে আবার উঠবে। অনন্তকাল এই খেলাই চলবে। এই খেলারই এক খেলোয়াড় আমি। জীবন মানেই এক দীর্ঘ স্বপ্ন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেনঃ
‘সকলই ঈশ্বরাধীন। তাঁরই লীলা। তিনি নানা জিনিস করেছেন। ছোট, বড়, বলবান, দুর্বল, ভালো, মন্দ! ভালো লোক, মন্দ লোক। এসব তাঁর মায়াখেলা। এই দ্যাখো না, বাগানের সব কিছু সমান হয় না।
যতক্ষণ ঈশ্বরকে লাভ না হয়, ততক্ষণ মনে হয় আমরা স্বাধীন। এ ভ্রম তিনিই রেখে দেন, তা না হলে পাপের বৃদ্ধি হত। পাপকে ভয় হত না। পাপের শাস্তি হত না।
যিনি ঈশ্বরলাভ করেছেন, তাঁর ভাব কী জানো? আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর তুমি ঘরনি; আমি রথ, তুমি রথী; যেমন চালাও তেমনি চলি। যেমন বলাও তেমনি বলি।
সে কেমন বিশ্বাস! না, এই রকম, এক জায়গায় একটি মঠ ছিল। মঠের সাধুরা রোজ মাধুকরী করতে যায়। একদিন একটি সাধু ভিক্ষা করতে করতে দেখে যে, একটি জমিদার একটি লোককে ভারী মারছে। সাধুটি বড় দয়ালু; সে মাঝে পড়ে জমিদারকে মারতে বারণ করলে। জমিদার তখন ভারী রেগে রয়েছে, সে সমস্ত কোপটা সাধুটির গায়ে ঝাড়লে। এমন প্রহার করলে যে সাধুটি অচৈতন্য হয়ে পড়ে রইল। কেউ গিয়ে মঠে খবর দিলে, তোমাদের একজন সাধুকে জমিদার ভারী মেরেছে। মঠের সাধুরা দৌড়ে এসে দেখে, সাধুটি, অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে। তখন তারা পাঁচজনে ধরাধরি করে তাকে মঠের ভিতর নিয়ে গিয়ে একটি ঘরে শোওয়ালে। সাধু অজ্ঞান, চারিদিকে মঠের লোক ঘিরে বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। কেউ কেউ বাতাস করছে। একজন বললে, মুখে একটু দুধ দিয়ে দেখা যাক। মুখে দুধ দিতে দিতে সাধুর চৈতন্য হল। চোখ মেলে দেখতে লাগল। একজন বললে, ‘ওহে, দেখি জ্ঞান হয়েছে কিনা? লোক চিনতে পারছে কিনা?’ তখন সে সাধুকে খুব চেঁচিয়ে জিগ্যাসা করলে, ‘মহারাজ! তোমাকে কে দুধ খাওয়াচ্ছে?’ সাধু আস্তে আস্তে বলছে ‘ভাই! যিনি আমাকে মেরেছিলেন, তিনিই দুধ খাওয়াচ্ছেন।’
সুখ দু:খ, বঞ্চনা, গঞ্জনা, সবই সেই এক হাত থেকে আসছে।
While mankind remains more baggage in the World
It will be swept along, as in a boat, asleep.
What can they see in sleep?
What real merit or punishment can there be?
ছ’টা মাস একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল। সংসার। নতুন সংসার। নতুন মুখ, নতুন স্বভাব, মন, কণ্ঠস্বর। নতুন গন্ধ, নতুন বর্ণ, নতুন জীবনধারা। তারপর! সব বিবর্ণ। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। লোক, লৌকিকতা। আত্মীয়স্বজনের উৎপাত। নতুন জীবনের আগমন। ট্যাঁ, ভ্যাঁ, চ্যাঁ। নিত্য অসুখ, নিত্য ডাক্তার। মাথার চুল খাড়া। শেষে ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। বললেই তো হল না। সংসার হল বটের আঠা। যতই ছাড়াতে চাইবে, ততই জড়িয়ে ধরবে। শেষে সেই গল্প। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেনঃ
‘যেমন জাল ফেলা হয়েছে পুকুরে। দু-চারটে মাছ এমন সেয়ানা যে কখনও জালে পড়ে না, এরা নিত্য জীবের উপমাস্থল। কিন্তু অনেক মাছই জালে পড়ে। এদের মধ্যে কতকগুলি পালাবার চেষ্টা করে। এরা মুমুস্যজীবের উপমাস্থল। কিন্তু সব মাছই পালাতে পারে না। দু-চারটা ধপাং ধপাং করে জাল থেকে পালিয়ে যায়, তখন জেলেরা বলে, ওই একটা মস্ত মাছ পালিয়ে গেল! কিন্তু যারা জালে পড়েছে, অধিকাংশই পালাতেও পারে না; আর পালাবার চেষ্টাও করে না। বরং জাল মুখে করে, পুকুরের পাঁকের ভিতরে গিয়ে চুপ করে মুখ গুঁজড়ে শুয়ে থাকে—মনে করে, আর কোনও ভয় নাই, আমরা বেশ আছি। কিন্তু জানে না যে, জেলে হড়হড় করে টেনে আড়ায় তুলবে। এরাই বদ্ধজীবের উপমাস্থল।
সেই সংসারের পাঁকে জাল মুখে নিয়ে পড়ে আছি। ভাবছি, এইতেই আমার যতেক সুখ। এই ভয়, এই আতঙ্ক। আজ গেলে কাল আমার কী হবে! একটাই হবে, আমার জ্ঞান বাড়বে। গল্পটা এই রকম, একদা এক গ্রামে এক কাঠুরিয়া ছিল। রোজই সে গ্রামের উত্তরদিকে এক জঙ্গলে কাঠ কাটতে যেত। দিনের শেষে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে ফিরে এসে দোরে দোরে বিক্রি করত। এই ছিল তার জীবিকা। দশ-বারো বছর ধরে সে এইভাবে কষ্টেসৃষ্টেই তার সংসার চালাচ্ছে। একদিন তার মনে হল, আর পারা যায় না। দিনের পর দিন এই একই কষ্ট। এর জন্যে দায়ী সেই প্রথম পুরুষ আদম। সমস্ত মানবের যিনি আদি পিতা। মানুষের সমস্ত দুর্ভাগ্যের তিনি আদি কারণ। কাঠুরিয়া সিন্ধান্ত করল, আজ জঙ্গলে গিয়ে সমস্ত কাঠকুঠো এক জায়গায় জড় করব, তারপর আদমের হাড় কখানা খুঁজে বের করে আগুন ধরিয়ে দেব।
কাঠুরিয়া জঙ্গলে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে স্তূপাকার করছে। এমন সময় ভগবান এক দেবদূতকে পাঠালেন। দেবদূত জিগ্যেস করলেন, এখানে তুমি কি করছ ভাই! এত কাঠ।
আমি কাঠ জোগার করছি, আমাদের আদিপিতা আদমের হাড় কখানা জ্বালিয়ে দোবো।
তার জন্যেই মানুষের আজ এই এত কষ্ট।
দেবদূত বললেন, ‘আচ্ছা ধরো, আমি যদি এমন করে দিই, তোমাকে আর কোনও পরিশ্রমই করতে হবে না, তাহলে কেমন হয়।
‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়, আমি আপানাকে অজস্র ধন্যবাদ দেবো।’
‘তাহলে আমি তোমাকে এখুনি একটা মনোরম উদ্যানে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে তুমি খাবে দাবে আর মনের সুখে ঘুরে বেড়াবে। কেবল একটাই শর্ত, তুমি সেখানে যা দেখবে, দেখেই যাবে। কোনও প্রশ্ন করা চলবে না।’
‘বেশ তাই হবে।’
দেবদূত দুহাতে তালি বাজালেন, কাঠুরিয়া সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন স্বর্গোদ্যানে। স্বর্গোদ্যান। স্বর্গোদ্যান যেমন হয়, ফলে ফুলে ভরা চিরবসন্ত। সেখানে তিনটে চারটে দিন কাঠুরিয়ার বেশ মনের আনন্দেই কাটল। পঞ্চম দিনে দেখে কী, একটা লোক। তার হাতে একটা কুড়ুল। লোকটি গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরছে আর মরা ডালগুলো বাদ দিয়ে সবুজ পাতাওয়ালা টাটকা ডালগুলো কেটে ফেলেছে। কাঠুরিয়া এই কাণ্ড দেখে মনে মনে ভাবছে, এ কী কাণ্ড! আর তো পারা যায় না, যদিও প্রশ্ন করা বারণ, তবুও যে জানতে ইচ্ছা করছে। এই পাগলামির কী মানে! ‘আরে মশাই, এটা কী হচ্ছে! কাটতে হলে, মরাডালগুলো কাটুন, কচিকাঁচা ডালগুলো কাটছেন কেন?’ লোকটি হেসে বললে, ‘কতদিন আসা হয়েছে এখানে?’
এই তিন-চার দিন।’
বলা মাত্রই কাঠুরিয়া দেখলে সে আর স্বর্গোদ্যানে নেই। সেই জঙ্গল, ভাঙা কাঠকুটো ডালপালা, তার সেই কুঠার। কাঠুরিয়া বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল।
দেবদূত এসে বললে, ‘তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলুম, দেখবে কিন্তু প্রশ্ন করবে না।’
‘আমি কথা দিচ্ছি প্রভু, আর এ ভুল করব না, আমাকে ফিরিয়ে দিন।’
দেবদূত আবার তালি বাজাতেই কাঠুরিয়া ফিরে গেল স্বর্গোদ্যানে। তিন চারদিন সুখেই কেটে গেল। তারপর হঠাৎ একদিন দেখে কী, এক থুত্থুড়ে বুড়ো একটা হরিণীর পেছনে তাড়া করেছে। হরিণী ছুটছে, বিদ্যুংবেগে আর বৃদ্ধ অনেক চেষ্টায় এক পা হয়তো এগোতে পারছে।
এ আবার কী! যাকে ধরা যাবে না তাকে ধরার জন্যে বুড়োটা গলদঘর্ম হচ্ছে কেন? এই প্রশ্নটা না করে থাকি কী করে! এই পাগলকে তো সমঝানো দরকার। কাঠুরিয়া প্রতিজ্ঞা ভুলে প্রশ্ন করলে, ‘মশাই কেন ছুটছেন, পারবেন ওকে ধরতে?’
বৃদ্ধ বললে, ‘কদিন এসেছ এখানে?’
কাঠুরিয়াকে উত্তর আর দিতে হল না, আবার পতন। সেই জঙ্গল, সেই কাঠের তাড়া। কাঠুরিয়া আবার বুক চাপড়াতে লাগল। দেবদূত এসে বললে, ‘কী হল আবার?’
‘আবার সেই ভুল, প্রশ্ন করে ফেলেছি! আমি কথা দিচ্ছি, এ ভুল আর করব না, প্রভু।’
‘দেখা যাক, বারবার তিনবার।’
দেবদূত তালি বাজাতেই কাঠুরিয়া আবার স্বর্গে। এইবার সে খুব সাবধান। যাই দেখুক, প্রশ্ন আর করবে না। তিন চারদিন গেল। আবার এক ঘটনা। এক জায়গায় ভারি একটা জাঁতা পড়ে আছে আর চার-পাঁচ জন লোক ধরাধরি করে সেটাকে তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সবাই একদিকটা ধরে তোলার চেষ্টা করছে, ফলে হচ্ছে কী, এদিক থেকে উঠে ওদিকে পড়ে যাচ্ছে ধপাস করে।
কাঠুরিয়া মনে মনে হাসছে, এরা কী কিছুই জানে না, একেবারেই গাধা! এদের কিছু না বলে কেমন করে থাকা যায়! বোকার দল মিছিমিছি খেটে মরছে। ‘আরে ভাই, জাঁতাটাকে যদি তুলতেই চাও তবে সবাই মিলে চারপাশ থেকে ধরো।’
লোকগুলি বললে, ‘ক’দিন এসেছ এখানে?’
আর সঙ্গে সঙ্গে কাঠুরিয়া দেখলে সে আর স্বর্গে নেই, ফিরে এসেছে জঙ্গলে, সেই কাঠের গাদার সামনে। আবার কান্নাকাটি।
দেবদূত এসে বললে, ‘ শোনো বাপু, আর হবে না, তোমাদের পিতা আদম মাত্র একটি পাপের জন্যে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল, আর তোমার, পাপের পর পাপ, তার পরেও পাপ। তোমার আর কোনও উপায় নেই। যত দিন না মরছ, এই কাঠ কেটেই তোমাকে খেতে হবে।’