দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ৯

নয়

সুজয় অবাক হল। অচেনা এক যুবতী তাকে কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করছে। এই ডাক্তারবাবুর বাড়িতে কোনও মহিলা থাকেন না। সে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কালীচরণ ধমকাল, ‘না না, ওটা চলবে না। বাবু আসুক, কী কী করতে হবে তাঁর মুখ থেকে শুনি, তারপর—।’

হতাশ হয়ে সুজয় শুয়ে পড়ল আবার। সন্তান শিবানীকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল, ‘বসুন।’

শিবানী বলল, ‘না, বসব না। উনি কেমন আছেন তাই জানতে এসেছিলাম।’

কালীচরণ বলল, ‘আচ্ছা মেয়ে তো! এই প্রথম বাড়িতে এলে, শুকনো মুখে চলে গেলে এই বাড়ির অকল্যাণ হবে না? ভালো মেয়ের মতো ওখানে বসো। আমি চা নিয়ে আসছি।’ কালীচরণ চলে গেলে সুজয় মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘বসুন।’

শিবানী বসল। বলল, ‘আপনি এখানে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে আলাপ হয়নি। আপনি জয়েন করার আগে একজন টিচারের প্রয়োজন ছিল স্কুলের। আমি ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে কয়েকমাস কাজ করেছিলাম। এখানেই জন্মেছি কিন্তু পড়াশুনা করেছি শহরের স্কুলে। মামার বাড়িতে থেকে।’

‘তাহলে তো আমি এসে আপনাকে কর্মচ্যুত করেছি।’

‘আমি জানতাম কাজটা সাময়িক। যখনই একজন শিক্ষক পাকাপাকি জয়েন করবেন তখনই আমার মেয়াদ শেষ হবে। তাই হতাশ হওয়ার কোনও কারণ ছিল না।’ শিবানী বলল।

সন্তান শুনছিল কথাগুলো, বলল, ‘তাহলে আপনি আর দিদিমণি নন?’

হেসে ফেলল শিবানী, ‘না থাকারই কথা ছিল কিন্তু আরও কিছুকাল আমাকে পড়াতে বলা হয়েছে। তুমি তো নীচের স্কুলে পড়ছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কীরকম রেজাল্ট হচ্ছে?’

‘ভালো।’

‘স্কুল এখন বন্ধ?’

‘হ্যাঁ। সামনের সোমবারে খুলবে।’

শিবানী সুজয়ের দিকে তাকাল, ‘নিশ্চয়ই খুব কাহিল হয়ে আছেন।’

‘আর বলবেন না। এই প্রথম এত বড় অসুখে পড়লাম।’

‘বাড়িতে জানানো হয়েছে?’

‘মাথা খারাপ! বাড়ি বলতে তো শুধু মা। খবর পেলে ছুটে আসবে। আমি তো ভালো হয়ে যাচ্ছি।’ সুজয় হাসবার চেষ্টা করল, ‘ভালো লাগছে এই ভেবে যে আমার আসার কারণে আপনাকে স্কুল থেকে চলে যেতে হয়নি।’

এই সময় কালীচরণ চা নিয়ে এল। এক কাপ চা।

শিবানী জিজ্ঞাসা করল, ‘ওঁকে দেবেন না?’

‘না, একটু পরে কমপ্ল্যান দেব। শরীর সারাতে হবে না?’

সুজয় হাসল, ‘ইনি আমাকে একেবারে শিশু করে রেখেছেন।’

চা খেতে খেতে শিবানী জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে জয়েন করতে পারবেন?’

কালীচরণ আগ বাড়িয়ে জবাব দিল, ‘উনি কী করে বলবেন? বাবু যখন অনুমতি দেবেন তখন স্কুলে যাবেন।’

শিবানী মাথা নাড়ল, ‘এটা ঠিক কথা।’

চা খেয়ে উঠে দাঁড়াল শিবানী, ‘আচ্ছা, আমি এখন চলি।’

‘এই তো এলেন।’ সুজয় বলল।

‘একটু পরে অন্ধকার নেমে গেলে সমস্যা হবে।’

‘কীরকম সমস্যা? এখানে তো ভয়ের কিছু নেই!’ সুজয় আধশোওয়া হল।

‘না—না, অন্ধকারে আমার বেশ অস্বস্তি হয়। নমস্কার।’

‘পারলে আবার আসবেন।’

‘দেখি।’

শিবানীর সঙ্গে সন্তানও বেরিয়ে এল ঘর থেকে। পাশাপাশি হাঁটছিল সে। শিবানী বলল, ‘ওমা, তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

‘আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি।’

‘আরে না! তোমাকে আর যেতে হবে না।’

‘যদি মাঝরাস্তায় অন্ধকার নেমে আসে?’

শব্দ করে হাসল শিবানী, ‘আমি বাড়িতে পৌঁছাবার অনেক পরে অন্ধকার নামবে।’

‘তবু, যাই না আমি!’

‘যেতে ইচ্ছে করছে কেন?’

‘অনেকদিন বাজারের দিকে যাইনি। আমাকে যেতে দেওয়া হয় না।’

‘কিন্তু ফিরবে কী করে?’

‘দাদুর সঙ্গে ফিরে আসব।’

‘উনি যদি রাগ করেন!’ শিবানী বলল, ‘ওঁর চেম্বার তো অনেক দেরিতে বন্ধ হয়।’

এইসময় পেছন থেকে কালীচরণের ডাক ভেসে এল। শিবানী পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দ্যাখো, তোমাকে ডাকছে। এক কাজ করো। তুমি কবে নীচে যাবে?’

‘রবিবার সকালে।’

‘তাহলে শনিবারের সকালে আমি তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াব।’

‘ঠিক আছে।’

ওর মাথায় আঙুল ছুঁইয়ে শিবানী এবার জোরে হাঁটতে লাগল। সেদিকে তাকিয়ে ছিল সন্তান। শিবানীকে তার খুব ভালো লাগছিল। সুজয় স্যার বলেছেন পৃথিবীতে দুটোই জাত আছে। পুরুষ এবং স্ত্রী। এখন মনে হল স্ত্রীজাত যদি না থাকত তাহলে একটুও ভালো লাগত না। তাদের বাড়িতে কোনও স্ত্রীজাতির মানুষ নেই। থাকলে কী ভালোই না হত।

কালীচরণ সামনে এসে দাঁড়াল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘কোথাও না। এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘অ। আমি ভাবলাম দিদিমণির সঙ্গে কোথাও যাচ্ছ। আর বাইরে থেকো না, সন্ধে নামবে একটু পরেই। চলে এসো।’ কালীচরণ ফিরে গেল।

সন্তানের খুব রাগ হল। হোস্টেলে তাকে নিয়ম মেনে থাকতে হয়। কী কী করা যাবে না তা তাদের বলা হয়েছে। ফলে যা যা করা যাবে তা একেবারে নিয়ম মেনে করতে হয়। বাড়িতে এসেও সেই একই ব্যাপার। সে বড় হয়ে গেলে এসব একদম মানবে না।

যেন প্রতিবাদ জানাতেই সন্তান মাঠের মাঝখানে বসে পড়ল। ওদিকের বাড়িতে কারা যেন যাচ্ছে। দূর থেকে তাদের দেখল সন্তান। এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে একটা বাচ্চা ছেলে। নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছে। দূর থেকে ওদের দেখতে দেখতে সন্তানের মনে হল তারও তো মা ছিল। কালীচরণ বা বনবিহারী বলেন সেই মা আর নেই। মায়ের কোনও ছবিও বাড়িতে নেই। মা না হয় নেই, বাবা কোথায় গেল? তার জবাবে সে শুনেছে, বাবাও নেই। হঠাৎ বুকে ভার জমল তার। এই সময় কালীচরণের গলা ভেসে এল, ‘সন্ধে হয়ে গেছে। চলে এসো।’ সন্তান উঠে পড়ল।

কালীচরণের কাছে বনবিহারী জানতে পারলেন সকালে চেম্বারে বেরিয়ে গেলেই সন্তান পড়া ছেড়ে সুজয়ের ঘরে গিয়ে গল্প করে। আবার বিকেল থেকে সেই গল্প শুরু হয়। কালীচরণ ধমক দিয়ে ওকে পড়ার ঘরে নিয়ে যায়। এত কথা রুগির সঙ্গে বললে তার দুর্বলতা কাটবে কী করে!

বনবিহারী বললেন, ‘কী কথা বলে ওরা? পড়াশুনার বিষয়?’

কালীচরণ বলল, ‘আমি অতশত বুঝি না। মাঝে-মাঝে নতুন মাস্টার কবিতা বলে। দেহে প্রাণ যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ জঞ্জাল সরাবে। তাই শুনে আমি ঘরের দরজায় গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘জঞ্জাল সরানোর কাজ তো জমাদার করে, আপনি কেন করবেন?’ শুনে দুজনের কী হাসি! খোকা বলল, ‘এই জঞ্জাল সেই জঞ্জাল নয়।’ নতুন মাস্টার মাথা নাড়ল।’

বনবিহারীর চোয়াল শক্ত হল। নতুন মাস্টার নিশ্চয়ই সুকান্তর ছাড়পত্র কবিতাটি আবৃত্তি করেছিল। কিন্তু সন্তান কী করে বুঝল জঞ্জালের মানে? খুব অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। অমঙ্গলের গন্ধ পাচ্ছিলেন তিনি।

সকালে চা দিতে এসে কথাগুলো বলেছিল কালীচরণ। চা খেয়ে তিনি সন্তানের ঘরে গেলেন। সে তখন পড়ার টেবিলে। বনবিহারীকে দেখে অবাক হল, ‘কিছু বলবে?’

‘দেখতে এলাম কেমন পড়াশুনা হচ্ছে!’

‘ভালো।’

‘ফাঁকি দিচ্ছ না তো? ফাঁকি দিলে নিজেই বিপদে পড়বে।’

‘আমি জানি।’

‘শুনলাম নতুন মাস্টার নাকি তোমাকে কবিতা শোনান!’

‘হ্যাঁ। এসব আমি জানতামই না।’

‘তোমার বয়সে যা জানার তা নিশ্চয়ই স্কুলে জানছ, বইয়ে পড়ছ।’

‘না, না, পড়ার বাইরের কথা।’

‘যেমন?’

‘যেমন, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। আমি কতবার চাঁদ দেখেছি। চাঁদকে ঝলসানো রুটি বলে কখনও মনেই হয়নি।’

‘এর মানে তুমি বুঝতে পেরেছ?’

‘নিজে পারিনি, স্যার বুঝিয়ে দিয়েছেন।’

‘কী বুঝিয়েছেন?’

‘যাদের পেটে খিদে থাকে, যাদের খাবার জোটে না তাদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটির সমান।’

‘এটা জেনে তোমার কি লাভ হয়েছে?’

‘লাভ হয়নি। আমার আর চাঁদ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’

‘কেন?’

‘পৃথিবীতে গরিব মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাদের অনেকেই খেতে পায় না। তাদের কাছে চাঁদ দেখার কোনও মানে নেই। অথচ দ্যাখো, সেই ছেলেবেলায় চাঁদ নিয়ে লেখা কত ছড়া পড়েছি। এখন ওগুলোর কথা ভাবলে হাসি পায়।’

‘হাসি পায়? কোন ছড়ার কথা বলছ?’

‘ওই যে, চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে কদমতলায় কে? কী বোকা বোকা কথা!’ বলে সন্তান, ‘আমি ওই সুরে একটা ছড়া লিখেছি। শুনবে?’

‘তুমি যখন লিখেছ তখন অবশ্যই শুনব।’

সন্তান একটা খাতা বের করল। তারপর পাতা খুলে পড়ল, ‘চাঁদ ওঠেনি ফুল ফোটেনি, কদমতলায় কেউ যায়নি—!’

‘তারপর?’

‘তারপর ভাবছি। এখনও লিখিনি। কেমন হয়েছে?’

‘ভালোই তো। নাও, তুমি এখন পড়ো।’

বনবিহারী সন্তানের ঘর থেকে বেরিয়ে সুজয়ের ঘরের দরজায় এলেন, মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ কেমন আছেন?’

‘আমাকে এখনও আপনি বলছেন!’

‘ওটা আমার স্বভাব, বলেইছি তো।’

‘অনেকটা ভালো আছি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আজ বাড়ির সামনে একটু হাঁটাহাটি করব।’ সুজয় বিছানায় বাবু হয়ে বসল।

‘বেশ তো। যতক্ষণ শরীর দুর্বল না হবে, হাঁটবেন।’

‘আমার মনে হয় সামনের সপ্তাহে স্কুলে জয়েন করতে পারব।’

‘আপনার শরীরের উন্নতি যেরকম দ্রুত হচ্ছে তা পারবেন।’ বনবিহারী চেয়ারে বসলেন, ‘আপনার বাড়িতে কে কে আছেন?’

‘মা ছাড়া কেউ নেই।’

‘তিনি এখন একলা আছেন?’

‘হ্যাঁ। তবে আমার দুজন বন্ধু ওঁর দেখাশোনা করে।’

‘বাঃ, ভালো তো।’

‘বাবা?’

‘তিনি অনেককাল আগে গত হয়েছেন।’

‘শুনলাম আপনি সুকান্তর খুব ভক্ত। ওঁর কবিতা খুব ভালো লাগে?’

‘না, মানে, কবিতা হিসেবে হয়তো প্রথম শ্রেণির নয় কিন্তু ওঁর বক্তব্য খুব জোরালো। শিক্ষিত মানুষের হয়ে কথা বলেছেন তিনি।’

‘সেকথা রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, তাই না? ওঁর প্রশ্ন কবিতাটি পড়েছেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বড় নরম ভাষায় বলেছেন।’

‘আমি আপনার সঙ্গে একমত নই। ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো।’ এর মধ্যে নরম কী দেখলেন?’

সুজয় হাসল, ‘আসলে অ্যাপ্রোচটাই তো পৃথক। ভগবান কোথায় থাকেন? তাঁর কাছে আবেদন করে কী লাভ হবে? সরাসরি মানুষের কাছে মানুষের কথা না বললে তা জোরালো হয় না।’

‘আপনি কি কোনও বিশেষ রাজনীতিতে বিশ্বাসী?’

‘না। তবে যাদের নেই তাদের দলে, যাদের আছে তাদের নয়।’

‘এইখানেই মুশকিল হয়ে গেল। যাক গে, আমার মনে হয় আপনি কাল আপনার ভাড়া করা বাসায় ফিরে যেতে পারেন। অবশ্য আজ হাঁটাহাঁটি করে দেখুন শক্তি পান কিনা, তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।’

‘কিন্তু ওখানে খাওয়াদাওয়া মানে, সদানন্দবাবু বোধহয় রাজি হবেন না।’

বনবিহারী হাসলেন, ‘আপনি এখানে চাকরি করতে এসেছেন, ঘর ভাড়া করেছেন থাকার জন্যে, নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা তো আপনাকেই করে নিতে হবে। একজন পার্টটাইম রান্নার লোক রেখে দিলে তো সমস্যা থাকবে না।’

‘রান্নার লোক পাওয়া যাবে?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘কীরকম মাইনে নেয়?’

‘এই দেখুন, একটু আগে আপনি বললেন যাদের কিছু নেই তাদের সঙ্গে আছেন। অথচ একটা গরিব মানুষকে কাজ দিতে গিয়ে তার মাইনে নিয়ে চিন্তা করছেন।’ বনবিহারী মাথা নাড়লেন, ‘আপনার ক্ষমতার মধ্যেই কাজের লোক পেয়ে যাবেন।’

রবিবারের এখনও ক’দিন বাকি। বনবিহারী প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়লেন। তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিল সুজয়কে এই বাড়িতে নিয়ে আসা খুব ভুল হয়ে গেছে। স্কুলের নতুন মাস্টার অসুস্থ, দেখাশোনার কেউ নেই বলে তিনি মানবিক কারণে বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলেন। বামপন্থায় বিশ্বাস যে কেউ করতে পারেন। কিন্তু সেই পন্থার মাধ্যমে উগ্রতায় পৌঁছে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। চোখের সামনে তিনি নকশাল আন্দোলনের জন্ম ও মৃত্যু দেখেছেন। ভারতবর্ষের কোটি-কোটি সর্বহারা ওই আন্দোলন সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিল। নতুন মাস্টার যে ইতিমধ্যেই সন্তানের মনে প্রভাব ফেলেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এইটে তিনি কখনও চাননি।

মানুষ তার বাবা-মায়ের রক্তের ধারা বহন করে। চিকিৎসক হিসেবে তিনি এরকম কিছু অসুখের কথা জানেন। যার বাবা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে, যার মা নিজের শিশুকে পরিত্যাগ করে আবার ফিরে গিয়েছে পুরোনো জীবনে, যে জীবন শুধু অনিশ্চয়তায় ভরা, যে জীবন শুধু বিপ্লবের অলীক স্বপ্ন দেখায়, তার শরীরের রক্ত কি একই পথে তাকে নিয়ে যাবে? নইলে এত তাড়াতাড়ি সন্তান মুগ্ধ হয় কী করে? হয়তো ব্যাপারটা সাময়িক, সুজয়ের সান্নিধ্য না পেলে সে ভুলে যাবে। কিন্তু ওইটুকু ছেলে এতদিনের পুরোনো ছড়াকে নস্যাৎ করে লিখেছে, চাঁদ ওঠেনি ফুল ফোটেনি, কদমতলায় কেউ যায়নি? কী করে লিখতে পারল! তিনিও তো তাঁর বাল্যকাল থেকে ওই ছড়াটা শুনে আসছেন, তাঁর মাথায় তো এমন উলটো ভাবনা কখনও আসেনি।

বনবিহারীর মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে সন্তানকে নিয়ে নীচের শহরে চলে গেলে ভালো হত। কিন্তু রবিবারের আগে হোস্টেল খুলবে না। তিনি কালীচরণকে ডেকে কিছু নির্দেশ দিলেন। কালীচরণ প্রথমে বুঝতে পারছিল না। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওর বাপ-মা যে পথে গিয়েছে ও সে পথে যাক তা তুমি চাও?’

দুপাশে মাথা নেড়েছিল কালীচরণ, ‘না-না, কক্ষনো না।’

‘ওকে আটকাবার জন্যে তো চেষ্টা করতে হবে।’

‘বুঝে গিয়েছি। ওই নতুন মাস্টার সব সময় ওর কানে কীসব মন্ত্র ঢালে। ঠিক আছে, আমি সবসময় ওদের সঙ্গে থাকব।’ কালীচরণের গলার স্বর বদলে যায়।

সকালে চেম্বারে গিয়ে বনবিহারী খবর পাঠালেন সেক্রেটারিকে, দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। সেক্রেটারি তখন ব্যস্ত থাকলে সেটা বিকেলেও হতে পারে। তারপর রুগি দেখতে শুরু করা মাত্র একজন লোক দৌড়ে চেম্বারে এল, ‘ডাক্তারবাবু তাড়াতাড়ি চলুন, সদানন্দদার বউ কীসব খেয়ে ফেলেছে।’

‘কী খেয়েছে?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘তা জানি না। সদানন্দদা বললেন তাড়াতাড়ি আপনাকে নিয়ে যেতে।’

প্রয়োজনীয় জিনিসভরা ব্যাগটা নিয়ে লোকটির নিয়ে আসা রিকশায় উঠলেন তিনি।

লোকটি রিকশাওয়ালাকে তাড়া লাগাল, ‘যেখান থেকে এসেছিলাম সেখানে তাড়াতাড়ি চল।’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে?’

‘আমি সদানন্দদার খুড়তুতো ভাই। কাল এসেছি।’

‘কী হয়েছিল?’

‘আমি ঠিক জানি না।’

‘কিছু শোনেননি?’

‘ওই একটু-আধটু ঝগড়া, বকাঝকা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যা হয়ে থাকে।’

‘কী অবস্থায় দেখে এসেছেন?’

‘মাটিতে পড়ে আছে।’

আত্মহত্যা করার ঘটনা এখানে তেমন ঘটেনি।

বনবিহারী সদানন্দর বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখলেন কোনও ভিড় নেই। অর্থাৎ প্রতিবেশীরা এখনও কিছু জানতে পারেনি। এরকম ঘটনা ঘটেছে জানলে মানুষ কৌতূহলী হয়ে ছুটে আসে। সদানন্দ দাঁড়িয়েছিল ভেতরের দরজায়। তাঁকে দেখে ভেজা কাকের মতো বলল, ‘ওকে বাঁচান ডাক্তারবাবু, আমার একমাত্র ওয়াইফ চলে গেলে আমি কী করে থাকব! উঃ, কেন যে বকতে গেলাম, রাগলে কেন যে মাথার ঠিক থাকে না!’

ততক্ষণে মহিলার পাশে বসে পড়েছেন বনবিহারী। মুখ ফ্যাকাশে, চোখের মণিতে ঘোর। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী খেয়েছে?’

‘বিষ। আরশোলা মারার বিষ।’ সদানন্দ চাপা গলায় বলল।

‘কখন খেয়েছে?’

‘এই তো একটু আগে।’

‘বাড়িতে তেঁতুল আছে?’

‘আছে।’

‘একটা সমপ্যানে তাই জলে গুলে নিয়ে আসুন।

‘তেঁতুলগোলা জল খেতে চাইছিল না সদানন্দর স্ত্রী। দাঁতে দাঁত লেগে গেছে। ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করে দাঁত ছাড়িয়ে গ্লাসে সেই জল নিয়ে জোর করে খাইয়ে দিতে চাইলেন বনবিহারী। জল উপচে পড়ল চিবুকে, বুকে। কিন্তু হাল ছাড়লেন না বনবিহারী। একটু একটু করে খানিকটা খাওয়াতেই শরীর নড়ে উঠল। শোওয়া অবস্থাতেই বমি করল সদান্দর বউ। বমিটা ভালো করে দেখলেন বনবিহারী। বুঝলেন যা খেয়েছিল তা এখনও হজম হয়নি অথবা প্রায় অটুট রয়েছে। তিনবার বমি করালেন তিনি। তারপর ব্যাগ থেকে রবারের নল বের করে খানিকটা পরিষ্কার জল খাইয়ে গলার ভেতর দিয়ে পেটে ঢুকিয়ে দিলেন। হাঁফাচ্ছিল সদানন্দর বউ। গলার অস্বস্তি হচ্ছিল। পাম্প করে সেই জল বের করে দেখলেন তা প্রায় স্বাভাবিকের পর্যায়ে চলে এসেছে।

দুই গালে আলতো চড় মেরে বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন কেমন লাগছে?’

সদানন্দর বউ উত্তর দিল না।

বনবিহারী আবার জিজ্ঞাসা করলেন। এবার মাথা ওপর-নীচ হল।

বনবিহারী বললেন, ‘ইচ্ছে হলে ওকে নীচের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করাতে পারেন। নইলে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিন। যতক্ষণ ওর খিদে না হবে খেতে ডাকবেন না। একটু ঘুমিয়ে থাকুক। আপনার কপাল ভালো, এ যাত্রায় শ্রীঘরে যেতে হচ্ছে না।’

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় বন

বিহারী নিশ্চিত মেয়েটি বেঁচে যাবে। আরশোলা মারা বিষ যদি খেয়ে থাকে তা ও আধচামচের বেশি খায়নি। খেয়ে ভয়ে আধমরা হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *