ছয়
রাতের অন্ধকারে আকাশটা কালো হয়ে গেল। তিরতিরিয়ে মেঘগুলো চারপাশ থেকে চুপিসাড়ে চলে এসে যেই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল অমনি বাতাসে হিম মিশল। মাটির বুক থেকে উঠে আসা শ্বাস সেই মেঘের দঙ্গলকে ছুঁতে চাইল। টিমলিং পাহাড়ের চুড়োর টানে সেই মেঘেরা জমাট হল এই ছোট্ট জনপদের ওপর। তারপর রাগি বাইসনের চেহারা নিয়ে পরস্পরকে এত আঘাত করতে লাগল যে আকাশে আগুন ঝলসাল। শব্দ বাজল ভয়ংকর। এবং তারপরেই বৃষ্টি নামল। যেন আকাশ ফুটো করে জলের ধারা ক্রমাগত নেমে আসছিল আজকের মাঝরাতে।
মেঘের আওয়াজে ঘুম ভেঙেছিল বনবিহারীর। ভাবলেন ভুল শুনেছেন। বাড়ি ফেরার সময়েও তো মনে হয়নি আকাশে মেঘ রয়েছে। অবশ্য তিনি মুখ তুলে আকাশ দেখেননি, অকারণে আকাশ দেখার কথাও নয়। তারপরেই বৃষ্টির আওয়াজ কানে আসতেই খাট থেকে নেমে জানলা বন্ধ করতে গেলেন। এখনও ঘরে ছাঁট আসছে না, কিন্তু আসবেই। ভাসিয়ে দেবে ক’দিন ধরে।
দরজায় আওয়াজ হল। কালীচরণ ডাকছে। বনবিহারী দরজা খুললেন, দেখলেন লণ্ঠন হাতে কালীচরণ দাঁড়িয়ে, ‘জানলাটা বন্ধ করে দিতে হবে।’
‘দেব। কিন্তু হাতে লণ্ঠন কেন?’
‘লাইন চলে গিয়েছে।’
‘অ। সন্তানের ঘরে গিয়ে দ্যাখো—।’
‘আমি জানলা বন্ধ করে দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে। ঘুমাতে যাও।’
‘লণ্ঠনটা এখানে রেখে যাচ্ছি। দরজা বন্ধ না করলেই ভালো।’
ঠিক সেই সময় কোথাও বাজ পড়ল। শব্দটা এত জোরে এবং আকস্মিকভাবে হল যে চমকে উঠেছিলেন বনবিহারী! কালীচরণ আলো কমিয়ে লণ্ঠন নামিয়ে রাখতেই সন্তানের গলা শোনা গেল, ‘দাদু!’
‘বলো!’
‘আমি তোমার ঘরে শুতে পারি?’
‘এসো।’
সন্তান দ্রুত বনবিহারীর ঘরে ঢুকে গেল। কালীচরণ চলে গেলে বনবিহারী ঘরে ঢুকে দেখলেন সন্তান খাটের ওপাশে দেওয়াল ঘেঁষে শুয়েছে। অর্থাৎ যথেষ্ট জায়গা রেখেছে তাঁর শোওয়ার জন্যে।
বনবিহারী শুয়ে পড়লেন। পড়তেই মনে পড়ল জানলাটা বন্ধ করা হয়নি। সেদিকে তাকাতেই বিদ্যুতের ঝলসানি দেখতে পেলেন। এর একটা অন্যরকম সৌন্দর্য আছে। বুনো সৌন্দর্য। জল যখন ঘরে আসছে না তখন না হয় একটু অপেক্ষা করা যাক। একটু শীত-শীত ভাব ঘরে ছড়িয়েছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গায়ে চাদর দেবে?’
‘না।’ উলটোদিকে মুখ করে বলল সন্তান। তারপর বলল, ‘প্রকৃতির শক্তির কাছে মানুষ কিছু নয়, না?’
‘ঠিক। মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করেও পুরোটা জিততে পারেনি। নদীতে বাঁধ দিয়ে বন্যা বন্ধ করেছে তবু নদী মাঝে-মাঝেই সেই বাঁধ ভাঙে। যখন খরা হয়, ফসল জ্বলে যায় অথবা হয় না তখন মানুষ চেষ্টা করলেও বৃষ্টি নামবে না। ভূমিকম্প হওয়ার আগে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন না ওটা হবে। আগ্নেয়গিরির মুখ থেকে যখন লাভার স্রোত নেমে আসে তখন মানুষকে পালিয়ে যেতে হয়, সেটা আটকাতে পারে না।’ কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ বনবিহারীর মনে হল সুজয়ের কথা। এই নতুন জায়গায় ভয়ংকর বৃষ্টিতে অসুস্থ ছেলেটা একা পড়ে আছে। সদানন্দ বা তার স্ত্রী নিশ্চয়ই ওর পাশে এখন নেই। ছেলেটার জ্বর না কমলে কাল সেক্রেটারিকে অনুরোধ করবেন নীচের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে। এখানে প্রথম বৃষ্টি নামলে সহজে বন্ধ হতে চায় না। একা পড়ে থাকলে নির্ঘাত মারা যাবে ছেলেটা।
এবার কথাটা না বলে পারলেন না বনবিহারী, ‘ঘুমিয়ে পড়েছ?’
‘না।’
‘কিছু ভাবছ?’
‘না।’
‘ওই যে নতুন মাস্টার; যাঁকে তুমি এ-বাড়িতে নিয়ে এসে সাহায্য করেছিলে, তিনি বেশ অসুস্থ। আমি তাঁকে ওষুধ দিয়ে এসেছি।’
‘কী হয়েছে ওঁর?’
‘সম্ভবত টাইফয়েড।’ বনবিহারী হালকা হলেন, ‘বেশ জ্বর এসেছে।’
উঠে বসল সন্তান, ‘কোথায় আছেন উনি?’
‘সদানন্দবাবুর বাড়িতে ঘরভাড়া করে আছেন।’
‘সঙ্গে কেউ আছে তো?’
‘একা লোক, সঙ্গে কে থাকবে! কাল অবস্থা বুঝে নীচের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব।’
সন্তান কয়েক সেকেন্ড কিছু ভাবল। তারপর আবার শুয়ে পড়ল। বনবিহারী শ্বাস ফেললেন। খবরটা শোনামাত্র ছেলেটা যেভাবে উঠে বসল, প্রশ্ন করল তা তাঁর ভালো লাগল না। কেন লাগল না তা তিনি নিজেই জানেন না।
সকাল হল কিন্তু সূর্য উঠল না। জল ঝরছে ঝমঝমিয়ে। টিমলিঙের পাহাড় কুয়াশায় ঢাকা বলে মনে হচ্ছে। এখানে জল জমার কোনও সুযোগ নেই বলে পথ পরিষ্কার। এই জল ঢালু জমি বেয়ে হু-হু করে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। নীচের নদীগুলো খানিক বাদেই ফুলে ফেঁপে উঠবে।
সকাল দশটা নাগাদ বর্ষাতি এবং ছাতা নিয়ে বাইরে বেরুবার আগে বনবিহারী কালীচরণের সামনে সন্তানকে ডেকে বললেন, ‘যতক্ষণ বৃষ্টি পড়বে ততক্ষণ বাড়ির বাইরে পা দেবে না।’
‘কেন?’ মুখ তুলল সন্তান।
‘এই জলে ভিজলেই তোমার অসুখ করবে। স্কুল খুলতে বেশি দেরি নেই।’ বনবিহারী বললেন, ‘উপায় নেই বলে আমাকে যেতে হচ্ছে। নইলে পাগলেও বের হবে না।’
‘কেউ কেউ হবে।’
‘মানে? কাদের কথা বলছ?’
‘যাদের খাবার নেই, খুব খিদেতে আছে, তারা।’
চমকে উঠলেন বনবিহারী। গলার স্বরে অস্বস্তি হল তাঁর। কিন্তু আর কথা না বাড়িয়ে তিনি বাইরে পা বাড়ালেন। বৃষ্টির যা জোর তা ছাতি আটকাতে হিমসিম খাচ্ছে। সঙ্গে হাওয়ার তেজ মেশায় ছাতি ধরে রাখাও মুশকিল হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ছাতি বন্ধ করে বর্ষাতির ওপর নির্ভর করলেন বনবিহারী। এখন রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। মেঘ-বৃষ্টিতে পৃথিবী জুড়ে ঘন ছায়া। যাদের খাবার নেই, খুব খিদেতে আছে তাদের কথা সন্তানের মনে কেন এল! নাঃ, এটা ঠিক নয়। তবে কি ওর ক্ষেত্রে রক্ত কথা বলছে? যে ছেলেগুলো পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল তারা তো সমাজ এবং রাষ্ট্র#য় ব্যবস্থা পালটাতে উন্মাদ হয়েছিল! বনবিহারীর মনে খচখচ করছিল কথাগুলো।
গঞ্জের কাছাকাছি যেতেই পেছনে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পেলেন তিনি। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দেখলেন নীচ থেকে রোজকার মতো বাস ওপরে উঠে আসছে। ওটা যখন পাশ দিয়ে গেল তখন বুঝলেন বাসে যাত্রীর সংখ্যা খুবই কম।
চেম্বারে না গিয়ে সোজা সদানন্দের বাড়িতে চলে এলেন বনবিহারী। বাড়ির সব জানলা-দরজা বন্ধ। কয়েকবার কড়া নাড়লেন কিন্তু ভেতর থেকে কোনও আওয়াজ এল না। বাঁ-দিকের টিনের দরজা খুলে বাগানে ঢুকলেন তিনি। তারপর উঠোন পেরিয়ে যে ঘরে সুজয় ছিল সেই ঘরের দিকে এগিয়ে দেখলেন দরজা খোলা।
দরজায় দাঁড়াতেই দেখতে পেলেন সদানন্দের স্ত্রী হাতপাখা নাড়ছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে দ্রুত সরে গেল ওপাশে, বলল, ‘খুব জ্বর তাই ভাবলাম বাতাস করি।’
বনবিহারী বিছানার পাশে বসে কপালে গলায় হাত রেখে বুঝলেন জ্বর বেশ ভালোই। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রাত্রে কোনও অসুবিধে হয়েছিল?’
‘জানি না।’
শুনে বনবিহারী তাকাতেই সদানন্দর স্ত্রী বলল, ‘উনি বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। রাত্রে এদিকে আসেননি। বৃষ্টি পড়ছিল তো!’
‘ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। সকালে খাইয়ে দিয়েছি।’
‘খালি পেটে? কিছু খেয়েছিল?’
‘বিস্কুট। খেতে চাইছিল না।’
‘ঠিক আছে, আমি দুপুরে ফেরার পথে এসে দেখে যাব।’
বনবিহারী বাইরে বেরুবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন, সদানন্দের স্ত্রী পেছন থেকে ডাকল, ‘ডাক্তারবাবু!’
বনবিহারী দাঁড়ালেন। সদানন্দের স্ত্রী বলল, ‘আপনি যে এসেছিলেন, এসে এ-ঘরে আমাকে দেখেছেন তা যদি ওকে না বলেন—।’ বেশ কাতর শোনাল গলা।
বনবিহারী একটু ভাবলেন। তারপর মাথা নেড়ে বেরিয়ে এলেন। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টির জলের কথা খেয়াল থাকল না তাঁর। কেবলই মনে হতে লাগল মানুষের মতো বিচিত্র প্রাণী সৃষ্টি করে ঈশ্বর কী আনন্দ পেয়েছিলেন? সদানন্দকে দেখে মনেই হয় না যে ওর মনে এত অন্ধকার আছে।
বাস থেকে নেমেছিল জনাতিনেক লোক। দুজন স্থানীয় মানুষ, তৃতীয়জন নবাগত। মধ্যতিরিশের সেই লোকটির পরনে জিনস আর টি-শার্ট, কাঁধে ভারী ঝোলা। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে দৌড়ে একটি মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়ল সে। তাতেই ভিজে গেছে চুল, টি-শার্টের কিছুটা। আঙুল দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে সে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানকার স্কুলটা কতদূরে?’
দোকানদার বলল, ‘মিনিট দশ-পনেরো হাঁটতে হবে।’
নবাগত বাইরে তাকাল, ‘বৃষ্টি না থামলে তো যাওয়া যাবে না।’
‘আজ বৃষ্টি থামবে না।’ গম্ভীর মুখে বলল দোকানদার।
‘মানে?’
‘সবে গতরাত্রে বৃষ্টি নেমেছে। প্রথম বৃষ্টি একবার নামলে তিন-চারদিনে থামে না। পড়তেই থাকে। ব্যবসা লাটে ওঠে।’
‘সর্বনাশ!’
‘এই বৃষ্টিতে স্কুল বসবে না। ছুটি দিয়ে দিয়েছে। কার কাছে যাবেন?’
‘ওখানে আমার পরিচিত একজন সবে কাজে জয়েন করেছেন। মাস্টারির।’
‘তাই নাকি? হয়তো হবে। শুনিনি আমি। এখানে কিছু হলে সবাই জানতে পায়। তা কার বাড়িতে উঠেছেন জানেন?’
‘না।’
দোকানদার আর একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁরে, কোনও নতুন মাস্টার স্কুলে এসেছে কিনা জানিস?’
‘না তো!’
একজন বসে সিঙাড়া খাচ্ছিল, বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সদানন্দের হোটেলে ওকে দেখেছি। এখনও ক্লাস শুরু করেনি।’
দোকানদার বলল, ‘আপনি সদানন্দর হোটেলে চলে যান।’
‘কোথায় সেটা?’
‘এই তো, তিনমিনিট দূরে।’
‘একটু চা পাওয়া যাবে?’
‘চা বিক্রি হয় না এখানে। বসুন, আনিয়ে দিচ্ছি।’
ঘণ্টাখানেক পরে বৃষ্টির জোর সামান্য কমলে দোকানদার দয়া করে একজনকে বললে, ছাতার তলায় নবাগতকে সদানন্দর হোটেলে পৌঁছে দিতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল দোকানে মাত্র দুজন কর্মচারী আছে। সদানন্দ নাকি বাড়িতে চলে গেছে। জানা গেল ওর বাড়িতে একজন খুব অসুস্থ। সেই লোকটা হয়তো নতুন মাস্টারও হতে পারে।
নবাগত আর দেরি করল না। ছাতাধারীকে অনেক অনুরোধ করে আধাভেজা হয়ে চলে এল সদানন্দর বাড়িতে।
দরজা খুলল সদানন্দ। নতুন লোক দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী চাই?’
‘আপনার এখানে সুজয় আছে?’
‘হ্যাঁ। কেন?’
‘আমাকে সুজয় দাদা বলে। আমার নাম পরিমল।’
‘পরিমল কী?’
‘মুখার্জি।’
‘অ। ওপাশের টিনের গেট খুলে বাগান পেরিয়ে ঘর দেখতে পাবেন।’
‘অনেক ধন্যবাদ।’
‘আপনি কোথায় থাকেন?’
‘কলকাতায়।’
‘অ। আপনার ভাই খুব অসুস্থ। আমার মনে হয় ওকে এখনই হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। আপনি যখন এসেই পড়েছেন তখন ওকে নিয়ে যান।’
‘কিন্তু যা বৃষ্টি পড়ছে, নিয়ে যাব কী করে?’
‘বৃষ্টি?’ আরে মশাই, ভাই বেঘোরে মারা পড়ুক নিশ্চয়ই চান না?’
‘না।’
‘গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, তাতেই নিয়ে যান।’
ছাতাধারীর সঙ্গে বাগান পেরিয়ে সুজয়ের দরজায় পৌঁছে ছেড়ে দিল পরিমল। ভেজানো দরজা খুলে সুজয়কে দেখে চমকে উঠল সে। পাশে বসে কপালে হাত রেখে বুঝল জ্বর ভালোই। সে ডাকল, ‘সুজয়, এই সুজয়?’
চোখের পাতা নড়ল। শেষ পর্যন্ত অনেক ডাকাডাকির পর চোখ খুললে সুজয়। লাল চোখ। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিস্তেজ গলায় বলল, ‘পরিমলদা—!’
‘কোনও ভয় নেই। আমি এসে গেছি। ওষুধ খেয়েছিস?’
মাথা নাড়ল সুজয়। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল। পরিমল ওষুধগুলো দেখল। তিনটি ক্যাপসুল, দুটো করে প্রত্যেকটা। চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ জ্ঞান নেই পরিমলের। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। এই ঘরে সুজয় এল কী করে? ও কি ঘরটা ভাড়া নিয়েছে?
ছাতা মাথায় সদানন্দ এল, ‘এখন কীরকম? চোখ তো খুলছে না।’
‘না। আমার ডাকে খুলেছিল।’
‘অ। দেখুন, আমি ওর ভালো করতে চেয়েছিলাম। সেই দূরের কলোনিতে ঘর ভাড়া করতে চেয়েছিল, আমি আমার এখানে নিয়ে এলাম যাতে আরামে থাকতে পারে। তখন কি জানতাম এসেই অসুখ বাধাবে!’ সদানন্দ বলল।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ডাক্তার এসেছিলেন বুঝতে পারছি।’
‘হ্যাঁ। আমিই ডেকে এনেছিলাম। ওষুধপত্র আমিই কিনে দিয়েছি। প্রচুর খরচ হয়ে গেছে মশাই। অসুস্থ লোকের কাছে তো দাম চাইতে পারি না।’
‘ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
‘না পারার কিছু নেই। তবে এই বৃষ্টিতে তিনি বাড়ি থেকে বের হবেন বলে মনে হয় না। ও হ্যাঁ, ওর জন্যে সাবু তৈরি করেছে আমার স্ত্রী, ওকে
যদি খাইয়ে দিতে পারেন তাহলে এনে দিতে পারি। তারপর ডাক্তারের কাছে যাবেন।’
মাথা নাড়ল পরিমল, ‘বেশ তো!’
বনবিহারী বুঝলেন আজ চেম্বার খুলে কোনও লাভ নেই। কোনও অসুস্থ মানুষ অথবা তার বাড়ির লোক বৃষ্টিতে ভিজে তাঁর চেম্বারে আসতে চাইবে না। অতএব তিনি আর চেম্বার না খুলে সেক্রেটারির বাড়ির দিকে গেলেন। এখন হাওয়া বন্ধ আছে তাই ছাতা খুলতে পেরেছেন। বর্ষাতি থাকা সত্ত্বেও পাঞ্জাবির অনেকটা ভিজে গেছে, টের পাচ্ছেন।
সেক্রেটারি সব শুনে বললেন, ‘খুব কঠিন ব্যাপার। চাকরি করতে এসে ছেলেটা বেঘোরে মারা যাবে, এটা হতে দেওয়া যায় না। আপনি বলছেন সদানন্দর ওখানে ওর কোনও সেবাযত্ন হচ্ছে না?’
‘সেটা অস্বাভাবিক নয়। উনি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। নার্সিংহোম খোলেননি। নিজের হোটেল ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রী একজন অপরিচিত যুবকের সেবা করতে সংকোচ বোধ করতেই পারেন। আমার মনে হয় নীচের শহরের হাসপাতালে ওকে ভর্তি করে বাড়িতে খবর দেওয়া উচিত কাজ হবে।’ বনবিহারী বললেন।
‘এখন তো গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে না। আমার ড্রাইভারকে বলি, ও পৌঁছে দিয়ে আসুক।’
‘ড্রাইভারের ওপর ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে? আমাদের একজনের যাওয়া উচিত।’
‘ও। বেশ তো, আপনিও আমার সঙ্গে চলুন। রতন ড্রাইভারকে বলো গাড়ি বের করতে।’ চেঁচিয়ে হুকুম দিয়ে সেক্রেটারি উঠলেন, ‘আপনি একটু বসুন। আমি তৈরি হয়ে আসি।’
কিন্তু তিনি ঘর থেকে বেরুবার আগেই ড্রাইভার রতন এসে দাঁড়াল দরজায়, ‘কোথায় যাবেন বাবু?’
‘শহরে।’
‘বোধহয় যেতে পারবেন না। একটু আগে শুনলাম ঝড়ে গাছ পড়ে ব্রিজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নদীর জলও খুব বেড়েছে।’ রতন জানাল।
‘সর্বনাশ! তাহলে কী হবে ডাক্তারবাবু?’ সেক্রেটারি বললেন।
‘একটা বাস দেখলাম নীচ থেকে উঠে এল। ইম্পর্টেন্ট রাস্তা কি সরকার বেশিক্ষণ আটকে থাকতে দেবে? গিয়েই দেখা যাক।’
সেক্রেটারির গাড়িতে চেপে ওঁরা সদানন্দের বাড়িতে এলেন। দরজা খুলে সদানন্দ খুব আপ্যায়ন করে বলল, ‘একটু চা নিশ্চয়ই খাবেন?’
‘আমরা এসেছি সুজয়বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কোথায় তিনি?’ সেক্রেটারি জিজ্ঞাসা করলেন। সদানন্দ তাঁদের নিয়ে গেল সুজয়ের ঘরে। ঘরে ঢুকে বলল, ‘ইনি নতুন মাস্টারের দাদা। একটু আগে কলকাতা থেকে এসেছেন।’
সেক্রেটারি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করে এলেন? রাস্তা তো বন্ধ।’
পরিমল বলল, ‘বাস তো এল। আপনারা?’
পরিচয় করিয়ে দিল সদানন্দ। বনবিহারী আবার পরীক্ষা করলেন সুজয়কে। বললেন, ‘জ্বর এখন আগের থেকে কমেছে। যদি এখানে প্রপার সেবাযত্ন দেওয়া যেত তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার দরকার হত না।’
পরিমল বলল, ‘আমার হাতে কিছুদিন সময় আছে। ওর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা ছাড়া বাকিটা আমি করতে পারব।’
বনবহারী বললেন, ‘বাঃ। তাহলে তো কোনও সমস্যাই নেই। সেক্রেটারি সাহেব, আপনি ওষুধগুলো দোকান থেকে আনিয়ে দিন। আমি বিকেল থেকে লোক মারফত খাবার পাঠাব।’
সেক্রেটারি বললেন, ‘বেশ তো। সদানন্দবাবু, আপনি এদের এবেলার খাওয়ার ব্যবস্থা দয়া করে করবেন। খরচ স্কুল দেবে।’
সদানন্দ হাতজোড় করল, ‘অবশ্যই, অবশ্যই।’