চার
ওপাশ থেকে বৃদ্ধার গলা ভেসে এল, ‘বললাম তো সে ওই ঘরে আছে। আমার কথা অবিশ্বাস করে আবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, নতুন মাস্টার কি এখানে থাকেন?’
পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘না, না, অবিশ্বাস করব কেন? হুট করে ঘুরে ঢুকব তাই জানান দিলাম।’
‘ঘরে কোনও মেয়েছেলে নেই যে অত ভদ্রতা করবে। এই যে ভালো-মানুষের ছেলে, বেরিয়ে এসো। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই লোক আসছে খোঁজ করতে।’ বৃদ্ধার গলা শুনতে পেল সুজয়। সে টেবিল ছেড়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হোটেলওয়ালাকে দেখতে পেল। দোকানে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে ছিলেন। এখন ধুতি আর লংক্লথের পাঞ্জাবি যেটা চর্বি বৃদ্ধির কারণে শরীরে সেঁটে রয়েছে। সুজয় বলল, ‘আরে! আপনি? আসুন, আসুন।’
ঘরে ঢুকে চেয়ারটাকে এগিয়ে দিল সে, ‘বসুন।’
চেয়ারে বসে ভদ্রলোক বললেন, ‘ঘরটি মন্দ নয়। তবে—। যাক গে আমার পরিচয় দেওয়া হয়নি দুপুরবেলায়। আমার নাম সদানন্দ দত্তগুপ্ত। ভাগ্যান্বেষণে বাবা এসেছিলেন হাওড়া থেকে এখানে। ভালো নাম লোকে ভুলে গেছে, সদুবাবুর হোটেল বললে একশো মাইলের মধ্যে সবাই চেনে। হোটেলের খ্যাতি বাড়ে ভালো রাঁধুনি থাকলে আর বাসি খাবার না খাওয়ালে। ওই কর্মটি আমি কখনই করি না। চিংড়ি, ইলিশ, চেতল ইত্যাদি দামি মাছ হলে আমি নিজে হেঁসেলে ঢুকি। লোকে খেয়ে সুখ্যাতি করে।’ হাসলেন সদানন্দবাবু।
‘বলুন এত কষ্ট করে কেন আসতে হল?’
‘আর আপনি বলতে পারছি না। বয়সে অনেক ছোট, তুমি বলছি ভাই!’
‘নিশ্চয়ই! আপনি তো আমার বাবার বয়সি।’
‘তাই? বাঃ। সুখের কথা।’ মাথা নাড়লেন সদানন্দ, ‘আজ খুব বকুনি খেয়েছি ভাই!’
অবাক হল সুজয়! সেটা লক্ষ করে সদানন্দ বললেন, ‘তুমিই ছিলে আজ দুপুরের শেষ খদ্দের। হোটেল বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে স্নান সেরে খেতে বসে তোমার কথা বলেছি গিন্নিকে। নতুন মাস্টারিতে এসেছ, রোজ সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে হোটেল থেকে দুটো ভাত খেয়ে যাবে। এখানে আমাদের জাতের কেউ নেই, তুমিই দ্বিতীয় হলে। ব্যস, শোনামাত্র ফোঁস করে উঠল, ‘তুমি ছেলেটার কাছে দাম নিলে?’ যত বলি দাম নিয়েছি নাম শোনার আগে। তা ছাড়া খদ্দেরের কাছ থেকে দাম নিয়ে কি অপরাধ করেছি?’ তা সে কী বলল জানো? বলল, এইজন্যেই লোকে তোমাকে সদানন্দ দত্তগুপ্ত না বলে সদু হোটেলওয়ালা বলে। হরির কাছে সব শুনেছি। খেয়েছে তো নিরামিষ। মাস্টার বলে কথা, প্রথম দিন এল, একটু খাতির করবে না?’
‘হরি কে?’
‘তাঁর খোচ। হাতাও বলতে পারো। হোটেলে কখন কী হচ্ছে তার সব সে বাড়ি গিয়ে লাগায়। কতবার ভেবেছি ছাড়িয়ে দেব, শুধু অশান্তির ভয়ে দিইনি। তা নতুন মাস্টার, দয়া করে যে দামটা দিয়েছ তা ফেরত নিয়ে আমাকে উদ্ধার করো।’ পকেট থেকে টাকা আর খুচরো বের করতে চেষ্টা করলেন সদানন্দবাবু।
‘ছি, ছি, এ কী করছেন!’
‘ফেরত দেওয়ার জন্যে সে-ই আমাকে পাঠিয়েছে।’
‘বুঝতে পারছি। আপনি ফেরত দিলেন, আমিও নিয়ে নিলাম।’
‘মানে?’
‘উনি তাই জানবেন।’
‘কিন্তু এ তো মিথ্যে কথা।’
‘একটু ঘুরিয়ে বলবেন যুধিষ্ঠিরের মতো।’
‘বলবেন, নিতে চাইছিল না কিছুতেই, কেরোসিন কিনছিল, তার দামটা দিয়ে দিলাম।’
‘কেরোসিন?’ সদানন্দ হতভম্ব, ‘ভাতের দাম যা দিয়েছ তাতে তো কেরোসিন কেনা যাবে না। এক বোতলের দাম—!’
‘আহা আপনাকে দাম দিতে কে বলেছে। আপনি বলবেন কিনে দিয়েছেন। ব্যস!’
‘তোমার কেরোসিন লাগবে?’
‘লাগবে না? স্টোভ কিনে এনেছি। জ্বালব কী করে?’
‘তা বটে। বাড়ি কোথায়?’
‘কলকাতায়।’
‘সংসারে কে কে আছেন?’
‘মা, বাবা, ভাই, দাদা।’
‘দাদার নামটা ভাইয়ের পরে বললে কেন?’
‘আমরা কেউ কাউকে পছন্দ করি না। তাই।’
‘কেন?’
‘উত্তর দিতে হলে ব্যক্তিগত কথা বলতে হবে।’
‘অ।’ সদানন্দ এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ে করেছ?’
‘পাগল!’
‘হু! শোনো, এই জায়গাটা তোমার স্কুল থেকে বেশ দূরে। এখন যে আবহাওয়া দেখছ তা কিছুদিনের মধ্যেই বদলে যাবে। শীতের সময় আর বর্ষার সময় রাস্তায় কুকুর দেখা যায় না। কয়েকটা বাঁধা খদ্দের আছে বলে আমি বেঁচে আছি। সে সময় এখানে থাকলে তুমি সমস্যায় পড়ে যাবে।’
‘খুব ঠান্ডা পড়ে?’
‘মারাত্মক। হাত-পায়ের চামড়া ফেটে যায়।’ সদানন্দ বললেন, ‘বর্ষার সময়ে একবার বৃষ্টি শুরু হলে সাতদিন চলে। কী তার দাপট! তা ছাড়া এখানে আর একটা কারণে থাকা ঠিক হবে না।’
‘বলুন।’
‘দুপুরে বলেছিলাম এখানে বামুন, কায়েত, বদ্যি একজনও খুঁজে পাবে না। এই কলোনির সবাই নীচের শ্রেণির মানুষ। অবশ্য চাকরির বাজারে এরা অনেক বেশি সুযোগসুবিধে পাচ্ছে। কিন্তু তুমি এখানে থাকলে লোকে বলবে নাম ভাঁড়িয়ে আছ। তোমার পদবি সেনগুপ্ত নয়।’
‘বলে বলুক, আমি ওসব কেয়ার করি না।’
‘আজ করছ না, কাল করবে। যেমন স্কুলের সব মাস্টার প্রাইভেট টিউশুনি করেন, কোচিং ক্লাস করেন। তাতে মোটা রোজগার হয়। এখানে থাকলে তোমার সম্পর্কে সন্দেহ হবেই। তখন দেখবে কেউ তোমাকে ছাত্র পড়াতে ডাকছে না।’
‘কেন?’
‘নীচু জাতের মাস্টারের কাছে ছেলেমেয়েকে দেবে না।’
‘আশ্চর্য! স্কুলের খাতায় তো আমার পদবি লেখা থাকবে।’
‘কে দেখতে যাচ্ছে। তা ছাড়া কোর্টে গিয়ে তো পদবি বদলানো যায়। পি ডব্লু ডি-তে দত্ত বলে একটা লোক কাজ করত। তার সিডিউল কাস্ট সার্টিফিকেট থাকায় তাড়াতাড়ি প্রমোশন হয়ে গেল। তার মানে ওর আসল পদবি অন্য ছিল। যাক গে, তোমার ভালো হবে যদি আমাদের ওদিকে ঘর ভাড়া নাও।’ সদানন্দ বললেন।
‘ওদিকে ঘর পাওয়া যাবে?’
‘খোঁজ করেছ?’
‘না। তবে রিকশাওয়ালা বলেছে দু-হাজারের নীচে পাওয়া যায় না।’
‘তোমার তো বড় বাড়ির দরকার নেই। একটা কি দুটো ঘর হলেই চলে যাবে। তাই তো?’
‘একটাতেই হয়ে যাবে।’
‘না। তোমার আত্মীয়স্বজন এলে কি রাস্তায় থাকবে? মনে হচ্ছে আমাদের পাড়াতেই ওরকম দুটো ঘর পেয়ে যাবে। তবে একটা মুশকিল, তোমার সঙ্গে কোনও মহিলা নেই।’
‘মহিলা না থাকলে আমি বদলোক হয়ে যাব?’
‘লোকে ভরসা পায় না। বিশেষ করে যে বাড়িতে মহিলারা আছেন।’
‘তাহলে আর ভেবে লাভ কী!’
‘কোনও লাভ হত না যদি শুধু আমি ভাবতাম। চলো!’
‘যাব? কোথায়?’
‘ঘর দেখতে। আহা, তোমার ভালোর জন্যে বলছি!’
বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তবু যেতে হল।
ওপাশে মূলবাড়ি। তার গায়ে বাগান। বাগানের একপ্রান্তে দুটো ঘর, বাথরুম, টয়লেট এবং ছোট রান্নার ঘর। সবচেয়ে সুবিধে হল বাড়িতে ঢোকার পথ দুটো। একটা ওপাশের রাস্তা দিয়ে বড়বাড়ির পাশ দিয়ে বাগান পেরিয়ে এই বাড়িতে আসা, নয়তো সরাসরি দরজা খুলে এপাশের রাস্তায় পা দেওয়া।
সদানন্দ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পছন্দ হল?’
‘পছন্দ হলেই তো চলবে না, ভাড়াটা কত তার ওপর নির্ভর করছে।’
‘হাজারখানেক পারবে?’
‘দেখুন, হাতে পাব বড়জোর হাজার সাতেক।’
‘তাতে কী হয়েছে। খাটলে আরও সাত টিউশুনি, কোচিং থেকে পাবে।’
‘হুঁ। কয় মাসের অ্যাডভান্স দিতে হবে? আমার কাছে কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু নেই।’
‘তুমি তো আশ্চর্য ছেলে। সব ব্যাপারে হাত তুলে বসে আছ!’
‘যা সত্যি তাই বললাম। যেখানে আছি তাঁদের বলেছি কাল স্কুলে জয়েন করে অ্যাডভান্স নিয়ে টাকা দেব।’
‘ও। তাই এখানে দিও।’
‘সেটা নির্ভর করছে কত টাকা স্কুল অ্যাডভান্স দেয়, তার ওপর।’
‘আমার মাথা খারাপ করে দেবে তুমি। যাক গে, মালপত্র নিয়ে এসো।’
‘বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথা বলুন আগে।’
‘বাড়িওয়ালা বলে কিছু নেই। এই বাড়ির শেষ কথা বলেন বাড়িওয়ালি। মানে আমার স্ত্রী। কিন্তু ওখানে রাত্রিবাস করলে তোমাকে মাসের ভাড়া দিয়ে আসতে হবে। আর কাল স্কুলে গিয়ে হেডমাস্টারের সামনে আমাকে কথা দেবে স্কুল থেকে টাকা পেলেই আমাকে ভাড়ার টাকা মিটিয়ে দেবে।’ সদানন্দ গম্ভীর গলায় বললেন।
কলোনি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে আসার সময় অবাক হল সুজয়। ভেবেছিল বাধা পাবে, খুব ঝগড়াঝাঁটি হবে। পাড়ার লোকজন ভিড় করে আসবে। কিন্তু ঘর লাগবে না শুনে বৃদ্ধ বললেন, ‘বেশ তো, বাঁচালে, চলে যাও।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘বাঁচা মানে বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়া। আইবুড়ো ব্যাটাছেলে নাকের ডগায় থাকলে চিন্তায় ভালোভাবে ঘুমাতে পারতাম না।’
সন্ধের মুখে বনবিহারী চেম্বারে ছিলেন। নন্দলালবাবু উদ্বিগ্ন মুখে তাঁর কাছে এলেন। ‘আপনাকে একবার বাড়িতে যেতে হবে ডাক্তারবাবু।’
বনবিহারী একজনের প্রেসক্রিপশন দেখছিলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন? কী হয়েছে?’
‘আর বলবেন না! আমার মেয়ে স্কুলে পড়াচ্ছিল এতদিন। ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে। খুব ভালো পড়াচ্ছিল, সুনামও হয়েছিল বেশ।’
‘জানি, দেখেছি তাকে।’
‘তা আজ হঠাৎ আকাশ ফুঁড়ে একজন নতুন মাস্টার এসে হাজির হয়েছে সরকারি চিঠি নিয়ে, তাকে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ফলে মেয়ের চাকরি খতম। এটা শোনামাত্র মেয়ে সেই যে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করেছে আর চোখ খোলেনি। বার বার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন ওর মা খুব ভয় পেয়ে গেছেন।’ নন্দলালবাবু বললেন।
‘সে কী!’
‘আর আমাদের সেক্রেটারি সাহেবের কাণ্ড দেখুন, চিঠি দেখে লোকটাকে পাঠিয়ে দিলেন হেডমাস্টারের কাছে। লোকটা জাল কিনা তার খোঁজখবর করলেনই না। বললেন, জাল হলে পরে ধরা পড়বেই। বুঝুন। যাচাই করা পর্যন্ত ছেলেটা যদি অপেক্ষা করত তাহলে আমার মেয়ের মনে ধাক্কাটা এভাবে লাগত না। ও হ্যাঁ, এই নতুন মাস্টার বলেছে আপনার বাড়ি থেকে পোশাক বদলে এসেছে।’
‘আমার বাড়ি থেকে?’ অবাক হয়ে তাকালেন বনবিহারী।
‘তাই তো বলল। সত্য-মিথ্যা জানি না। কিন্তু সত্য হলে আপনি জানতেন, তাই না? আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে খবরটা এই প্রথম শুনলেন?’
‘হ্যাঁ। বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হবে।’
‘ওঃ। তাহলে চলুন—।’
‘আমার যাওয়া না যাওয়াতে কোনও তফাত হবে না নন্দলালবাবু। ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এমনটা হয়েছে। জোর করে তুলে খাওয়াদাওয়া করতে বলুন। একটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি, খাইয়ে দেবেন।’
‘আপনি গেলে ভালো হত।’ নন্দলালবাবু হাল ছাড়ছিলেন না।
হেসে ফেললেন বনবিহারী। তারপর বললেন, ‘আপনার মানসিক শান্তির জন্যে আমাকে যেতে হচ্ছে।’
রিকশায় চেপে নন্দলালবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখলেন তাঁর মেয়ে বিছানায় উঠে বসেছে। পাশে চেয়ার টেনে বললেন বনবিহারী, ‘কী হয়েছে মা?’
মুখ নামাল মেয়ে। কোনও কথা বলল না।
‘জীবনে চড়াই-উৎরাই সবসময় আছে। মেঘ দেখে ভেবো না সব অন্ধকার হয়ে গেল, মনে রেখো ওই মেঘের আড়ালে সূর্য রয়েছে। তুমি তো জানতে ডেপুটেশন ভ্যাকেন্সিতে ঢুকছ। ভ্যাকেন্সিটা তিন মাস হতে পারে আবার নয় মাসও। এটা তোমার তো অজানা ছিল না। আমি বলছি এবার পাকা চাকরি পেয়ে যাবে তুমি। আমরা সবাই চেষ্টা করব তোমার জন্যে।’
‘কিন্তু—, আমি এখন কী করব?’
‘টিউশুনি করবে। কোচিং স্কুলে গিয়ে কোচ করবে! তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
‘আমার চাকরি খুব দরকার।’ দুর্বল গলায় বলল মেয়ে। বনবিহারীর ইশারায় মেয়ের বাবা-মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে কথাটা ভাঙল মেয়ে। সে বাকি জীবনটা অবিবাহিতা থাকতে চায়। কারও ওপর নির্ভর করবে না। সেকারণে একটা চাকরির খুব প্রয়োজন।
বনবিহারী অবাক হলেন, ‘কেন মা? স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার ইচ্ছে কেন? সব মেয়েই তো চায় বিয়ে করে স্বামীর সংসারে গিয়ে ছেলেমেয়ের মা হতে!’
‘আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। মরে গেলেও নয়। চাকরি না থাকলে বাবা জোর করবেন বিয়ে করতে। পয়সা না থাকলে তখন কোথায় যাব আমি?’
‘ঠিক কথা। আমাকে যখন এসব কথা বললে তখন কিছুদিন সময় দাও। একটা কিছু ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দেখি।’
ডাক্তার বনবিহারী পেশেন্ট দেখার জন্যে এখন কোনও টাকা নিলেন না। বাইরে বেরিয়ে এসে নন্দলালবাবুকে বললেন, ‘ওকে কিছুদিন বিয়ে-থা-র কথা বলবেন না। থাক না।’
রাত্রে বাড়ি ফিরে এসে জামাকাপড় ছেড়ে কালীচরণকে ডাকলেন, ‘সন্তান কোথায়?’
‘পড়ছে।’
‘কে এসেছিল আজ?’
‘কে? ও, এখানে মাস্টারি করতে এসেছেন একজন, ভালোমানুষ।’
‘চেনো?’
‘না। আজই প্রথম দেখলাম।’
‘তাতেই মনে হল ভালো মানুষ? কীভাবে এল?’
‘খোকন, এই রে, সন্তান নিয়ে এসেছিল।’
‘এই রে মানে?’ অবাক হলেন বনবিহারী।
‘সে আমাকে নিষেধ করেছে খোকন বলে ডাকতে।’
‘হুঁ। তা লোকটার সঙ্গে ওর পরিচয় কী করে হল? আর সে নিয়ে এল বলে তাকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিলে? চোর-ডাকাত কিনা জানতে?’
‘আমি তো আপত্তি করেছিলাম। সন্তান জোর করতে আমি বলেছিলাম বাইরের ঘরে গিয়ে জামা বদলে নিতে। বলেছিলাম, উটকো লোকের তো কত বদ মতলব থাকতে পারে। তাতে সে বলল, আমার মন ভালো না বলে সবাইকে খারাপ ভাবি। লোকটা এখান থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি কেচে চা খেয়ে স্কুলে গেল।’ কালীচরণ বলল।
রাত্রের খাবার খেতে খেতে বনবিহারী সন্তানকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নতুন মাস্টারের সঙ্গে কোথায় দেখা হল তোমার?’
‘জঙ্গলের দিকের রাস্তায়। ভুল করে বাস থেকে নেমে পড়েছিলেন।’
‘তাঁকে বাড়িতে আনলে কেন?’
‘ওঁর জামাকাপড় খুব ময়লা হয়ে গিয়েছিল। জার্নি করে আসলে যেমন হয়। ওই পোশাকে গেলে স্কুলের সেক্রেটারি খুব অপছন্দ করতেন। তাই পালটে নিতে বলেছিলাম। উনি পোশাক কেচে নতুন পোশাক পরে গিয়েছেন।’
‘লোকটা যদি স্কুলমাস্টার না হয়ে ডাকাত হত?’
‘মানে?’
‘বাড়ির ভেতর ঢুকে সে যদি রিভলভার বের করে সব লুঠ করে নিয়ে যেত তাহলে তুমি তো কিছুই করতে পারতে না। এরপর কোনও অজানা মানুষকে গায়ে পড়ে সাহায্য করতে যেও না। ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লেগেছে।’ বনবিহারী বললেন।
‘বেশ। কিন্তু উনি সত্যি মাস্টার তো?’
‘সেটা দিনের বেলায় যাচাই করতে পারতে। করোনি কেন?’
‘আমি এখানকার স্কুল ছাড়ার পর বাজারের দিকে যাই না।’
‘কেন?’ অবাক হলেন বনবিহারী।
‘এখানে আমার সঙ্গে পড়ত এমন কয়েকটা ছেলে খুব টিজ করার চেষ্টা করে।’
‘তোমাকে টিজ করে? কেন?’
‘জানি না।’
‘কী বলে তারা?’
‘গুডি বয়! মা-বাপ নেই।’
‘ওরা মন্দ ছেলে তাই তোমাকে গুডি বয় বলে। তাতে উত্তেজিত হবে কেন?’
‘আমার মা বা বাবা নেই তাতে ওদের কী?’
‘ওদের সৌজন্যবোধ না থাকায় এসব বলে।’ দ্রুত খাওয়া শেষ করলেন বনবিহারী, ‘আমি উঠছি।’
‘একটা কথা তুমি আমাকে কখনওই স্পষ্ট করে বলো না—!’
বনবিহারী জানেন সেই অস্বস্তিকর মুহূর্তটা আসছে। বেশ কয়েকবার যে প্রশ্ন সন্তান তাঁকে করেছে এখন তার জবাব দিতে হবে। যখন ওর বয়স কম ছিল তখন একটা কিছু বলে ম্যানেজ করেছেন।
‘খেয়ে নিয়ে হাত ধুয়ে আমার ঘরে এসো।’ বনবিহারী দাঁড়ালেন না।
আধঘণ্টা চলে গেল তবু সন্তান এল না দেখে বেশ অবাক হলেন বনবিহারী। বয়স বাড়ছে, বেশিক্ষণ ট্রেনশন সহ্য করতে পারেন না। কেউ সমস্যায় পড়েছে দেখলে আগবাড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে শান্ত করেন। পরে কীভাবে সমাধান করবেন ভেবে কূল পান না। আজ যেমন নন্দলালবাবুর মেয়েকে শান্ত করতে তাঁর ওপর ভরসা রাখতে বলে এলেন কিন্তু ওকে একটা চাকরি পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। এখন যত দিন যাবে তত ট্রেনশন বাড়বে তাঁর। কী দরকার ছিল—!
শেষ পর্যন্ত নিজের ঘর থেকে গলা তুলে বনবিহারী ডাকলেন, ‘সন্তান!’
আধমিনিটের মধ্যে সন্তান এসে দাঁড়াল দরজায়।
‘তোমাকে এখানে আসতে বলেছিলাম—!’
‘হ্যাঁ। আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম বলে—, পরে মনে হল ওটা জিজ্ঞাসা করার কোনও মানে হয় না।’ সন্তান বলল।
‘কেন?’
‘কারণ তুমি উত্তর দিতে পারবে না। জানলেও পারবে না।’
‘বেশ। তবে জেনো, উত্তরটা যখন দেওয়ার সময় আসবে তখন আমি নিজেই দেব। তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে না।’
‘বেশ। শুধু একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, ওঁদের ঠিকানা কি তুমি জানো?’
‘না। আমি জানি না।’
‘আমাদের ঠিকানা ওঁরা জানেন?’
‘বোধহয়।’
সন্তান চলে গেল তার ঘরে। চুপচাপ বসে রইলেন বনবিহারী। মুখ ফুটে আজ বলতে পারলেন না, বলতে ইচ্ছে করল না, ওর বাবা পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। কোনওদিন তার দেখা পাওয়া যাবে না।
কিন্তু ছেলেটার মুখের অভিব্যক্তি তাঁর ভালো লাগল না। অন্যরকম একটা অস্বস্তি আচমকা বুকে জন্ম নিল।