কাঠকয়লার আগুন – ২০

কুড়ি

সুজয় বাড়িতে না ঢুকে সোজা খুঁটিমারির জঙ্গলের ধারে চলে এল। জায়গাটা খুব নির্জন। বিকেল হতে না হতেই চরাচরে ছায়া ঘনায়। সামনের জঙ্গলটায় তখন কালো ছোপ। গঞ্জ থেকে আসা পিচের রাস্তাটা সোজা ওই জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে। চারধারে একটা থমথমে ভাব। জঙ্গলের মুখেই একটা কাঠের সাঁকো। তার তলা দিয়ে ঝরনার জল তিরতিরিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তার গায়েও গাছের ছায়া।

সুজয় সাঁকোর রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়াল।

সন্তানের কথা ভাবছিল সে। এতবড় বোকামি কী করে করল ছেলেটা? কী দরকার ছিল পুলিশের হেপাজত থেকে পালানোর? ওখানে সে কাদের সঙ্গে মিশত তার জানা নেই। সত্যি কথা বলতে, এই স্কুলে আসার পর তার সঙ্গে কারোরই যোগাযোগ হয়নি। দলের সক্রিয় সদস্য সে কোনওকালেই ছিল না। কিন্তু যারা অবস্থার পরিবর্তন চায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। পুলিশ যদি জানতে পারে সন্তান পালিয়ে এসে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাহলে ধরে নেবে সে উগ্রপন্থীদের সক্রিয় সদস্য। শহরে যাদের সে কাছ থেকে জানত তারা কেউই পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াত না। কিন্তু সুজয় বুঝত অ্যাকশনে যারা আছে তাদের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে। সে ঝরনার জলের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিল। সে যদি এখান থেকে চুপচাপ চলে যায় তাহলে তাকে উগ্রপন্থীদের একজন বলে ভেবে নিতে অসুবিধে হবে না পুলিশের। না গেলে তাকে জেরা করতে পারবে না। তা ছাড়া এই চাকরিটা তার দরকার।

সে সোজা হল। জঙ্গলের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল একটা সাইকেল দ্রুত এগিয়ে আসছে। সম্ভবত সন্ধে হয়ে আসছে বলে তাড়াতাড়ি জঙ্গল পেরোতে চাইছে লোকটা। সাঁকোর কাছে এসে ধীরে ধীরে সাইকেল থামিয়ে রেলিং-এ এক পা রেখে দাঁড়াল মধ্যবয়সি একজন। বলল, ‘চেনা লাগছে না। কে আপনি?’

একটু বিরক্ত হল সুজয়, ‘আপনি কি এখানকার সবাইকে চেনেন?’

লোকটি হাসল, ‘ওই জঙ্গলের গাছগুলোকে যেমন জানি তেমনি গঞ্জের মানুষগুলোকেও। আগে দেখিনি বলেই জিজ্ঞাসা করছিলাম।’

‘আমি এখানে বেশিদিন আসিনি। স্কুলে চাকরি নিয়ে এসেছি।’

‘তাই বলুন ভাই। নামটা কী?’

‘সুজয়। আপনি?’

‘আমাকে সবাই হারুদা বলেই চেনে। এই যে জঙ্গল দেখছেন, এটা পার হয়ে গেলে একটা বড় নদী পাবেন। তার ওপাশে থাকি। মাস দুয়েক জ্বরে পড়েছিলাম। তাই এদিকে আসা হয়নি।’

‘আপনি কী করেন?’

‘কিস্যু না। শাকসবজির খেত আছে। কয়েকটা গরু দুধ দেয়। নদীতে মাছ ধরি। সেগুলো বিক্রি করে চাল-ডাল কিনি। চলে যায়। ক’দিন থেকে শুনছিলাম এই জঙ্গলে কিছু ছেলে লুকিয়ে আছে আর পুলিশ তাদের গুলি করে মারছে। শুনে বিশ্বাস হয়নি। যদি ছেলেগুলো কোনও অন্যায় করে থাকে তাহলে তাদের ধরে বিচার করে শাস্তি না দিয়ে মেরে ফেলছে কেন? আজ ভাবলাম, যাই জঙ্গলটা সাইকেলে চেপে ঘুরে দেখি যদি কোনও ছেলের দেখা পাই। দেখা পেলে জিজ্ঞাসা করব কী অন্যায় করেছে তারা?’ মাথা নাড়ল লোকটা, ‘আমি তো ভাই কারও দেখা পেলাম না।’

‘যারা আপনাকে খবরটা দিয়েছে তারা নিশ্চয়ই মিথ্যে বলেনি।’

‘না, নদীর এপারের লোক আমাকে খবরটা দেয়নি। একা থাকি বলে তারা আমাকে এড়িয়ে চলে। আমি জানতে পারলাম একটা ছোঁড়ার কাছ থেকে। জ্বর গায়ে আমার ওখানে গিয়ে হাজির হয়েছিল। বলল, সে কোনও অন্যায় করেনি তবু পুলিশ ভুল বুঝে ওকে খুঁজছে শাস্তি দেওয়ার জন্যে। একলা পেলে মেরেও ফেলতে পারে। মুখ দেখে মনে হল মিথ্যে বলছে না। আরে! আপনাকে যে কথাটা বলে ফেললাম। সে আমার হাতে-পায়ে ধরেছে যেন কাউকে তার কথা না জানাই। আপনি পুলিশের লোক না তো?’ লোকটা চোখ ছোট করল।

হেসে ফেলল সুজয়, ‘না। ছেলেটার নাম কী?

‘নাম বলেনি। জিজ্ঞাসাও করিনি। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। জ্বর কমছে।’

‘নাম জিজ্ঞাসা করেননি?’

‘আরে বাবা! জিজ্ঞাসা করলে সে যে নাম বলবে তাই তো বিশ্বাস করতে হবে। কী হবে জিজ্ঞাসা করে! সত্যি যে বলছে তা বুঝব কী করে?’ লোকটি বলল, ‘এই ছেলেটার কথা শুনেছেন নাকি?’

‘কোন ছেলে বুঝতে পারছি না।’

‘জঙ্গলে এসে পুলিশ যে ছেলেদের মারছে এটা সত্যি না মিথ্যে?’

‘সত্যি।’

‘ও! কেন মারছে?’

‘ছেলেগুলো উগ্রপন্থী।’

‘হতেই পারে। কেউ নরমপন্থী, কেউ মধ্যমপন্থী, কেউ উগ্রপন্থী। যার মত যেরকম। তাহলে মারার কী আছে।’

‘সরকার বলছেন ওরা দেশের শত্রু। সংবিধান মানে না। জাতীয় সম্পত্তির ক্ষতি করে। মানুষ মারে। ধরতে গেলে পুলিশকেই খুন করে। ফলে জীবিত অবস্থায় পুলিশ ওদের ধরতে পারে না।’

‘বাব্বা! এসব হয়েছে! আমি যখন খুব ছোট তখন ওরকম আন্দোলন হয়েছিল একবার। অবশ্য আমাদের এই তল্লাটে হয়নি। যাই, গঞ্জে যেতে হবে। কয়েকটা জিনিস আর ছোঁড়াটার জন্যে ওষুধ কিনব।’ লোকটি সোজা হল সাইকেলের ওপর।

‘একটা কথা বলছি—।’ সুজয় বলল।

‘বলুন ভাই!’

‘আপনি যে ছেলেটিকে আশ্রয় দিয়েছেন, ওর জন্যে ওষুধ কিনছেন তা গঞ্জের কাউকে না বলাই ভালো।’

‘আরে ভাই, ওর নামই জানি না তো কী বলব। চলি।’

লোকটা চলে গেল গঞ্জের দিকে। সুজয়ের মনে হল ওকে যতটা সরল বলে মনে হচ্ছিল ঠিক ততটা নয়। কিন্তু সন্তানকে সে বলেছিল থানায় ফিরে যেতে। না গিয়ে এই বিশাল জঙ্গল পেরিয়ে সে অসুস্থ হয়ে নদীর ওপারে পৌঁছে গেছে। ভাগ্যিস লোকটা ওখানে ছিল তাই তার আশ্রয় মিলেছে। কিন্তু সন্তানের ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেল। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুজয়ের। সন্তানের যা বয়স তাতে এখনই এসব করা উচিত হয়নি। তার মনে হল ডাক্তার বনবিহারীকে খবরটা দিলে তিনি যদি গোপনে অসুস্থ সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে পারেন তাহলে হয়তো একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। একটু মিথ্যে বলতে হতে পারে। ডাক্তার বনবিহারী পুলিশের কাছে গিয়ে বলবেন সন্তান তাঁর বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পুলিশ হয়তো চট করে বিশ্বাস করবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিলতে বাধ্য হবে। খুব বেশি হলে তারা সন্তানকে জেরা করবে কিন্তু কোনও কেস ফাইল করতে পারবে না। হয়তো ওই স্কুলে তার আর জায়গা হবে না। না হোক, দেশে তো অনেক স্কুল রয়েছে।

হাঁটতে লাগল সুজয়। ডাক্তারবাবুর চেম্বার আগে পড়বে। সেখানেই যাচ্ছিল সে। হাঁটতে হাঁটতে তার খেয়াল হল। হারুবাবু যখন ফিরে যাবে তখন তো

জঙ্গলে রাত নেমে যাবে। ওইসময় সাইকেলে জঙ্গল পার হওয়াতে ঝুঁকি আছে। অথচ সেই ঝুঁকি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছে লোকটা। কীরকম অস্বস্তি হল।

ডাক্তার বনবিহারীর চেম্বার বন্ধ। কিন্তু খানিকটা এগিয়ে ওঁর বাড়ির কাছের রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। হাতজোড় করে নমস্কার করল সুজয়। বনবিহারী দাঁড়ালেন, ‘আপনি?’

‘আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম।’

‘আমি তো বাড়িতে পেশেন্ট দেখি না, চেম্বারে আসুন।’

‘আমি রোগ নিয়ে আসিনি ডাক্তারবাবু।’ সুজয় বলল।

‘তাহলে?’

জায়গাটা খুব নির্জন। তার ওপর সন্ধে নেমে আসছে। সুজয় যতটা সংক্ষেপে হারুবাবুর কাছ থেকে শোনা কাহিনি শোনাল।

শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন বনবিহারী। শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘আমি কী করতে পারি?’

‘সন্তান আপনার নাতি, ওকে বাঁচাবেন না?’

বনবিহারী ‘নাতি’ শব্দটা শুনে আরও বিব্রত হলেন। বললেন, ‘কেউ যদি আত্মহত্যা করতে চায় তাহলে তাকে চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দিয়ে রাখা যায় না।’

‘কিন্তু ও এখনও নাবালক। শুনলাম হারুবাবুর ওখানে কম্বলমুড়ি দিয়ে রয়েছে। গায়ে জ্বর। এখনই যদি ওকে তুলে নিয়ে এসে চিকিৎসা করেন, পুলিশকে জানান তাহলে ওর ভবিষ্যৎটা নষ্ট নাও হতে পারে।’ সুজয় বলল।

‘মাস্টার, ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট তো আপনি করেছেন।’ বনবিহারী বললেন।

‘আমি?’ চমকে উঠল সুজয়।

‘ওর কানে বিদ্রোহের কবিতাগুলো আপনি কি শোনাননি?’

‘সুকান্তর কবিতা, গোর্কির মায়ের গল্প কোটি কোটি কিশোর শুনেছে। শোনার পর তাদের ভবিষ্যৎ কি নষ্ট হয়ে গেছে?’ সুজয় প্রতিবাদ করল।

‘ভেজা ঘাসে জ্বলন্ত দেশলাইকাঠি পড়লে আগুন জ্বলে না। শুকনো খড়ে পড়লেই দাউ দাউ শিখা তৈরি হয়। ওর শরীরের রক্ত তো তৈরি হয়েই ছিল।’

সুজয় বলল, ‘যা হোক, এখনও সময় আছে বলেই ছুটে এলাম।’

‘ঠিক আছে। আমি ভেবে দেখি।’ বনবিহারী বললেন, ‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আচ্ছা চলি।’ যেদিক থেকে তিনি এসেছিলেন সেদিকে ফিরে গেলেন বনবিহারী। সুজয়ের মনে হল তার আর কিছু করার নেই।

বাড়ি ফিরে কালীচরণকে ডাকলেন বনবিহারী, ‘মামণি কোথায়?’

‘রান্নাঘরে বসে আছে। হঠাৎ চলে এলেন যে? শরীর খারাপ?’

‘না কালীচরণ। তার চেয়েও বেশি। দরজাটা ভেজিয়ে দাও।’

কালীচরণ দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এলে সুজয় মাস্টারের কাছ থেকে শোনা কথাগুলো তাকে বললেন বনবিহারী। মাটিতে উবু হয়ে বসে শুনছিল কালীচরণ। শোনার পর দু-হাতে মাথা চেপে ধরল, ‘সর্বনাশ।’

‘তুমি এখান থেকে কোনও তীর্থে বেড়িয়ে আসতে বলছ। গিয়ে তো শান্তি পাব না।

‘মাস্টারবাবু যা বলেছেন তাই করলে ছেলেটার ভালো হবে।’

‘কিছুই হবে না। আবার পালাবে। যে একবার খাঁচা ভেঙে পালায় সে আর কখনওই খাঁচায় থাকতে চাইবে না।’ বনবিহারী বললেন।

‘কিন্তু বেচারার জ্বর হয়েছে। হবেই তো। ওরকমভাবে থাকলে শরীর খারাপ হবেই।’ কালীচরণ নীচু গলায় বলতে লাগল।

‘দ্যাখো কালীচরণ, তুমি কয়েকদিনের বাচ্চাকে নিজের হাতে বড় করেছ বলে এখানে বসে বিড়বিড় করছ, আমার পক্ষে অ্যাডভেঞ্চার করে ওকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।’ বনবিহারী বললেন, ‘তোমার ইচ্ছে হলে তুমি চেষ্টা করো।’

মাথা থেকে হাত সরাল কালীচরণ। ‘জায়গাটা কোথায়?’

‘জঙ্গল পেরিয়ে নদীর ওপারে কে এক হারুবাবু থাকে তার ডেরায়। অনেকদিন আগে একটা লোক এসেছিল ওদিক থেকে, নাম মনে নেই, টাকা দিতে পারেনি, একটা লাউ দিয়ে গিয়েছিল। কে জানে সেই লোকটাই হয়তো। তার নিশ্চয়ই জোটে না, ছেলেটাকে আর কী দেবে? দ্যাখো, ভেবে দ্যাখো।’ বনবিহারী উঠলেন।

‘বাবু, সেই হারুবাবু কি গঞ্জে আছে?’

‘তাই তো বলল মাস্টার।’

‘আমি ছেলেটাকে নিয়ে আসি। যতই বয়স হোক এখনও হিম্মত মরে যায়নি। আপনি আর বের হবেন না। মেয়েটাকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব।’ কালীচরণ উঠে দাঁড়াল।

‘কোথায় যাচ্ছ তার তো কিছুই জানো না—।’ বনবিহারী দ্বিধায় ছিলেন।

‘আমি বুঝে গিয়েছি। জঙ্গলে থাকতে দুদিন নদীর ধারে গিয়েছিলাম। এখন নদীতে এক ফোঁটা জল নেই। ঠিক পৌঁছে যাব।’ কালীচরণ বলল।

‘কিন্তু তুমি ওকে এ-বাড়িতে নিয়ে আসছ জানতে পারলে পুলিশ তোমার সঙ্গে আমাকেও জেলে পুরবে।’

‘কেউ দেখতে পাবে না। আমি গঞ্জ দিয়ে আসবই না। এদিক দিয়ে যে শর্টকাট পথটা আছে সেটাই ধরব।’

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কালীচরণ বেরিয়ে গেল সাইকেল নিয়ে।

বাইরের ঘরের আলো নিভিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে এলেন বনবিহারী। আজ সন্ধেতেও ঠিক ছিল কাল সবাইকে জানিয়ে পরশু তীর্থদর্শনে বেরিয়ে যাবেন। নীচের শহর থেকে টেনে উঠবেন। সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল।

বাড়িটা নিঝুম হয়ে আছে। রান্নাঘরে নিশ্চয়ই বসে আছে মামণি। আশ্চর্য মা! ছেলের সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই। সে এই বাড়িতে নেই জেনেও কী নির্বিকার। মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে সত্যি কি ও সন্তানের মা?

হঠাৎ বনবিহারীর মনে হল প্রশ্নটা মামণিকে সরাসরি করবেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আর একটা ঘর পার হতেই রান্নাঘরের আলো দেখতে পেলেন তিনি। প্রায় নিঃশব্দে দরজার দিকে এগোতেই কান্নার আওয়াজ কানে এল। বনবিহারী অবাক হয়ে দেখলেন ডান হাত হাঁটুর ওপর রেখে তাতে মুখ চেপে কেঁদে চলেছে মামণি। একটি সুস্থ, কথা বলতে পারা মহিলার কান্নার সঙ্গে ওর কান্নার কোনও পার্থক্য নেই। বনবিহারী নিঃশব্দে ঘরে ফিরে গেলেন।

বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পেছনের পায়ে হাঁটা মেঠো পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে নদীর ধারে চলে এল কালীচরণ। ওপারের জঙ্গলের গায়ে যা ঝরনা হয়ে ছিল তা নীচে নেমে ছোট নদীর চেহারা নিয়েছে। হাঁটুর নীচে জল। সাইকেল হাতে নিয়ে সেটা পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। আসার সময় একটা ছোট টর্চ নিয়ে এসেছিল। মাঝে-মাঝে তার আলোয় পথ দেখে নিচ্ছিল কালীচরণ, একসময় সেই পথটাও শেষ হয়ে গেল।

এখন ঘন জঙ্গল সামনে যা নিকষ কালোয় ডুবে আছে। লতাগুল্মের আড়াল সরিয়ে কিছুটা দূর আসতেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের তৈরি কাঁচা রাস্তা পেয়ে গেল সে। যতটা সম্ভব জোরে সাইকেল চালাতে লাগল। নীচের দিক থেকে অনেকটা ডানদিকে যেতে হবে তাকে। খানিকটা সময় পরে কানে ডাল ভাঙার শব্দ বাজল। শিরশিরিয়ে উঠল শরীর। ওটা যে হাতির দলের কীর্তি বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ওদের সামনে পড়লে শরীরটাকে নিয়ে ফুটবল খেলবে।

প্রায় আধঘণ্টা পরে পিচের পথটাকে দেখতে পেল কালীচরণ। মাথার ওপর এখন অজস্র তারা জ্বলজ্বল করছে। তাদের আলো আকাশ চুঁইয়ে নেমে এসেছে জঙ্গলের বুকে। নামলেও পৃথিবী যেটুকু আলেকিত হয়েছে তাতে দৃষ্টি পরিষ্কার হয় না।

শেষ পর্যন্ত জঙ্গল শেষ হয়ে গেল। ডানদিকে জনবসতি, সামনে নদী। বিরাট নদী এখন হাড়জিরজিরে। নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে মানুষ এবং গৃহপালিত জন্তু পথের চেহারা বানিয়ে নিয়েছে। জনবসতি এলাকায় টিমটিমে আলো জ্বলছে।

হঠাৎ সেদিক থেকে চিৎকার ভেসে এল, ‘কে যায়?’

উলটোদিকে মুখ ফিরিয়ে কালীচরণ চটপট জবাব দিল, ‘হারু।’

চিৎকারে স্বস্তি মিশল, ‘ও হারুদা! সত্যি, তুমি পারো বটে।’

কালীচরণ দাঁড়াল না। লোকটা যে দূরত্বে আছে তাতে তাকে চেনা অসম্ভব। কিন্তু যদি বেশি কথা বলতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই বুঝে যাবে সে হারু নয়।

নড়বড় করতে করতে নদীর বুক পেরিয়ে এপারে চলে এল সে। এদিকে কোনও জনবসতি নেই। অন্ধকার দু-তিনটে কুঁড়ে ঘর দেখতে পেল কিন্তু তার ভেতরে আলো জ্বলছে না। আরও কিছুটা এগোনোর পর একটা টিনের চালওয়ালা কাঠের বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়ির ভেতর অনেকটা বাগান আছে। শাক-সবজির। টর্চের আলোয় সেটা দেখে কালীচরণ আন্দাজ করল এই বাড়ি হারু নামক লোকটির হলেও হতে পারে। সাইকেল একপাশে লুকিয়ে রেখে সে টিনের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে একটু জোরে চ্যাঁচাল, ‘কেউ আছ?’

কয়েক সেকেন্ড চলে গেল কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

বাড়িতে দুটো ঘর। ভেতরের দিকে এসে দেখল কোনও ঘরেই আলো জ্বলছে না। ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। হতাশ হল কালীচরণ। নিশ্চয়ই এটা হারুবাবুর বাড়ি নয়। লোকটা গঞ্জে গেছে, ফিরে আসার আগেই যদি সন্তানকে পেয়ে যেত—! সে ঠিক করল ওই কুঁড়ে ঘরের সামনে গিয়ে গৃহস্থকে জিজ্ঞাসা করে হারুবাবুর বাড়ি কোথায় জেনে নেবে। হাঁটতে হাঁটতে মিনিট চারেক গিয়ে একটা কুঁড়ে ঘরের দরজায় শব্দ করল সে। ভেতর থেকে একজনের গলা ভেসে এল, ‘কে?’

‘আজ্ঞে, হারুদার বাড়িটা কোথায় বলতে পারেন?’ কালীচরণ জিজ্ঞাসা করল।

‘ওই ওপাশে। টিনের গেটওয়ালা কাঠের বাড়ি।’ লোকটা জবাব দিল।

এরকম বাড়ি এই এলাকায় একটাই আছে যেখান থেকে সে বেরিয়ে এসেছে। কালীচরণ আবার ফিরে গেল। যে ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে সেখানে কেউ নেই ধরে নিয়ে দ্বিতীয় ঘরের দরজায় শব্দ করল। কোনও সাড়া না পেয়ে একটু জোরে ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল।

ঘর অন্ধকার। টর্চের আলো ফেলল কালীচরণ। ঘরে কোনও আসবাব নেই। একদিকে বস্তা বোঝাই করে রাখা আছে কিছু। উলটোদিকে বাঁশের খুঁটির ওপর তক্তা পাতা। কাছে গিয়ে কালীচরণ দেখতে পেল একটা আধছেঁড়া চাদর শরীরে কোনওরকমে জড়িয়ে শুয়ে রয়েছে সন্তান। চোখ বন্ধ। কপালে হাত রেখে বুঝতে পারল জ্বর থাকলেও তেমন বেশি নয়। সে ডাকল, ‘খোকা, ও খোকা। চোখ মেলো।’

চোখ খুলল সন্তান। অন্ধকারের মধ্যে থেকে আসা টর্চের আলো তার চোখ দুটোকে বিব্রত করল। চোখ বন্ধ করে দুর্বল গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কে?’

‘আমি, কালীকাকা। ওঠো।’

‘কালীকাকা!’

‘হ্যাঁ। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। ওঠো। উঠতে পারবে?’

ওঠার চেষ্টা করল সন্তান। কালীচরণ টর্চ সামলে ওকে ধরে সোজা করল। তারপর ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে এল। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে।

সাইকেলের রডে ছেলেটাকে বসিয়ে বলল কালীচরণ, ‘শক্ত করে হ্যান্ডেল ধরে রাখো।’ সন্তান হ্যান্ডেল ধরল। তার মাথা ঝুঁকে পড়ছিল। কালীচরণ মনে মনে বলল, ‘এই তো শক্তি, এই নিয়ে গেছে পুলিশের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।’

নদীর নুড়ির ওপর দিয়ে ডাবলক্যারি করে সাইকেল চালানো সম্ভব নয়। সন্তানকে সাইকেলে বসিয়ে নদীটা হেঁটে পার হয়ে যখন এপারে পৌঁছেছে সে তখন দূরে মানুষের গলা শুনতে পেল। বেশ উত্তেজিত হয়ে একজন কথা বলছে। কালীচরণ অনুমান করল সেই লোকটাই আগন্তুককে বোঝাবার চেষ্টা করছে কিছুক্ষণ আগে সে কী শুনেছিল।

অন্ধকারে দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। যাওয়ার আগে পেছন ফিরে দেখল একটা টর্চের আলো বেশ জোরে নদীর ওপারের দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওটা হারুবাবুর টর্চের আলো। কালীচরণ সাইকেলে উঠে জোরে প্যাডেল ঘোরাতে লাগল পিচের পথ দিয়ে। সন্তানের মাথা বারংবার ঢলে পড়ছে তার হাতে, শরীরটাও নড়বড় করছে। একটা বাঁক পার হওয়ার সময় কালীচরণ দেখল হাতির দলটা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে পথের ওপর। দ্রুত জায়গাটা পেরিয়ে গেল সে। কয়েক সেকেন্ড দেরি হলে আর দেখতে হত না।

গঞ্জের এলাকাটাকে এড়িয়ে ঘুরতি পথে যখন সন্তানকে নিয়ে বাড়ির পেছনে পৌঁছাল তখন কালীচরণের সব শক্তি প্রায় শেষ। বনবিহারী পেছনের দরজা খুলে হাত লাগালেন। সন্তানকে বয়ে নিয়ে এসে মাঝখানের ঘরের খাটে শুইয়ে দেওয়া হল। জ্বর দেখলেন বনবিহারী। তারপর ট্যাবলেট জলে গুলে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন।

ঘুমিয়ে পড়ল সন্তান। বনবিহারী মুখ তুলে দেখলেন মামণি পেছনের দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। চোখাচোখি হতেই ভেতরে চলে গেল।

বনবিহারী বললেন, ‘কালীচরণ, আজ তুমি ছেলেটাকে বাঁচাতে পেরেছ কিন্তু কাল কী হবে তা আমরা কেউই জানি না। এরা পাখির মতো, ডানায় জোর এলে বাচ্চা যখন আকাশে উড়ে যায় তখন সে আর মাকে যেমন চেনে না, মা-ও সন্তানকে চিনতে পারে না। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *