দাউ দাউ আগুন
কাঠকয়লার আগুন
1 of 2

কাঠকয়লার আগুন – ১৯

উনিশ

স্কুলে চাকরি করতে গেলে প্রাত্যহিক যোগাযোগ প্রধান শিক্ষকের সঙ্গেই রাখতে হয়, প্রেসিডেন্ট অনেক উঁচু তলার লোক, একজন সাধারণ শিক্ষক অতি প্রয়োজন ছাড়া তাঁর সঙ্গে দেখা করেন না। অথচ খোদ প্রেসিডেন্ট লোক পাঠিয়ে দেখা করতে বলেছেন তাকে, সুজয় ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক বলে মনে করল না। কিন্তু ডাক যখন এসেছে তখন যেতেই হবে। সে দারোয়ানকে বলল, ‘তুমি যাও, আমি একটু পরে আসছি।’

দারোয়ান মাথা নাড়ল, ‘না বাবু, আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলেছেন। আপনি রেডি হন, আমি দাঁড়িয়ে আছি।’

ঘরে ঢুকে সুজয় তৈরি হয়ে নিল। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুতর। এভাবে তাকে তলব করার কারণ কী হতে পারে? সন্তান যে হোস্টেল থেকে পালিয়ে তার কাছে এসেছিল সেই খবরটা কি প্রেসিডেন্ট পেয়ে গেছেন? কোথায় পেলেন? পুলিশ কি ওঁকে খবরটা দিয়েছে? তাহলে সন্তানের খোঁজে তার কাছে পুলিশ এল না কেন? সুজয় বুঝতে পারছিল তার চাকরির আয়ু শেষ হতে যাচ্ছে। পুলিশ যখন আসেনি তখন চাকরিটাই যাবে, জেলে যেতে হবে না। ছেলেটা কেন যে এই বোকামিটা করল!

প্রেসিডেন্ট সাহেবের বাইরের ঘরে তেরো মিনিট বসে থাকতে হল সুজয়কে। তারপর প্রেসিডেন্ট এলেন। হাতজোড় করে বললেন, ‘আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্যে দুঃখিত। কীরকম লাগছে আমাদের স্কুল?’

সুজয় বুঝল এটা ভণিতা হচ্ছে। বলল, ‘ভালো। পরিবেশ ভালো, ছেলে-মেয়েরাও।’

‘আপনি বাইরে থেকে এসেছেন, আমাদের থেকে আপনি ভালো বুঝতে পারবেন।’ প্রেসিডেন্ট বললেন, ‘যেখানে আছেন সেখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘না, না।’

‘বলাইচাঁদবাবু যখন সুস্থ ছিলেন তখন তাঁকে চিনতাম। অমায়িক মানুষ। তিনি অসুস্থ হলেন, শয্যাশায়ী, শুনেছি হাঁটাচলা করতে পারেন না, আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে?’

‘প্রথমদিন তাঁকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছি, কথা হয়নি।’

‘ও। ওঁর স্ত্রী একটা লেডিস পার্লার চালান। আমাদের মতো এই গঞ্জ এলাকার মেয়েরা পার্লারের কথা তো আগে শোনেওনি, এখন খবর পাচ্ছি কেউ কেউ যাচ্ছে। ভালোই। অন্যায় কাজ না করে যদি কারও রোজগার হয়, হোক না।’

‘ভালোই ভিড় হয় সেখানে।’

‘ও তাই নাকি? আমি তাহলে খবর পাই না। ওঁর স্ত্রী শুনেছি খুব মুখরা।’

‘একটু জোরে জোরে কথা বলেন।’ সুজয় বলেই সামান্য ইতস্তত করল, ‘আমাকে যেন কী কারণে ডেকেছিলেন?’

‘আর বলবেন না। বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে।’

‘কীরকম?’

‘আপনি তো ডক্টর বনবিহারীকে বিলক্ষণ চেনেন, ওঁর বাড়িতে ছিলেন—!’

‘হ্যাঁ। উনি দয়া করে আমার অসুস্থতার সময় আশ্রয় দিয়েছিলেন।’

‘জানি জানি। তখন সন্তানের সঙ্গে আপনার কীরকম আলাপ হয়েছিল?’

‘ও আমার কাছে গল্প শুনতে আসত।’

‘কীরকম গল্প শুনতে চাইত?’

‘লীলা মজুমদারের গল্প, সুকুমার রায়ের কবিতা—।’

‘ও।’ প্রেসিডেন্টের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একটুও খুশি হলেন না।

সুজয় জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? কিছু কী হয়েছে?’

মাথা নাড়লেন প্রেসিডেন্ট, ‘সন্তান আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিল। তাকে ডাক্তারবাবু সদরের স্কুলে ভরতি করিয়েছিলেন আরও ভালো পড়াশুনার সুযোগ পাবে বলে। আজ সেখান থেকে সে পালিয়ে গিয়েছে।’

‘সেকী? কেন?’

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। যাক গে, যদি সে আপনার কাছে আসে তাহলে প্রশ্রয় দেবেন না। যত তাড়াতাড়ি পারেন পুলিশকে খবর দেবেন।’

পুলিশকে?’

‘হ্যাঁ। স্কুলের তরফ থেকে পুলিশের কাছে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে।’

‘ও।’

‘আপনি বোধহয় জানেন না গতকাল ওখানে কয়েকজন উগ্রপন্থী পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে।’ তাকালেন প্রেসিডেন্ট, ‘আর কয়েকদিন পরেই তো গরমের ছুটি শুরু হবে। আপনি কি তখন বাড়িতে চলে যাবেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘যাওয়ার আগে আমাকে জানাবেন।’

‘আচ্ছা—।’

বাইরে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটল সুজয়। ভদ্রলোক বেমালুম চেপে গেলেন সত্য ঘটনাটা। কিন্তু ইঙ্গিত দিলেন অনেকটাই। সন্দেহ হচ্ছিল সুজয়ের, সন্তান যে তার কাছে এসেছিল তাও ভদ্রলোক জানেন কি না। বোধহয় না। পুলিশ জানলে উনি জানতেন। কিন্তু কথা হল, পুলিশ তার কাছে কেন এল না? সুজয় বুঝতে পারছিল না তার কী করা উচিত!’

বনবিহারী বাড়িতে ফিরে এলেন বিধ্বস্ত হয়ে। দরজা খুলল কালীচরণ। বনবিহারী কোনও কথা না বলে নিজের ঘরে চলে এলেন। খাটে বসে শ্বাস নিলেন কিছুক্ষণ। প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, শরীর ঝিমঝিম করছে। একটু পরে কালীচরণ এক কাপ চা নিয়ে এল।

‘এটা খেয়ে স্নান করতে যান।’ নীচু গলায় বলল সে।

মাথা নাড়লেন বনবিহারী। খাবেন না। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও কি এ বাড়িতে এসেছে?’

‘কে?’

‘আঃ। সন্তানের কথা যে বলছি তা বুঝতে পারছ না?’

‘না তো। আমি এসে দেখিনি।’

‘সত্যি কথা বলছ?’

‘আমি আপনাকে কি মিথ্যে কথা কখনও বলেছি?’

‘বলেছ।’

মাথা নীচু হয়ে গেল কালীচরণের। তারপর বলল, ‘না, সে আসেনি।’

‘ওর মা কোথায়?’

‘নিজের ঘরে শুয়ে আছে।’

‘নিজের ঘর? এই বাড়িতে ওর নিজের ঘর কবে থেকে হল? শোনো, ওকে বলো, যেখান থেকে এসেছিল যেখানে চলে যেতে, আমি আর ঝুটঝামেলায় থাকতে চাই না।’

‘বাবু, কিছু কি হয়েছে?’ কালীচরণের মুখে চিন্তার ছাপ।

‘হ্যাঁ। সে হোস্টেল থেকে পালিয়েছে।’

‘সে কী! পালিয়েছে? কেন পালাল? কোথায় গেল?’

‘তা সে-ই জানে। রক্ত কথা বলে কালীচরণ।’

‘কালীচরণ উদ্বিগ্ন হল, ‘ওইটুকু বাচ্চা ছেলে পালাল কেন? পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? ওকে কি মাস্টাররা খুব মারধোর করত?’

‘তোমার বাচ্চা ছেলেটা আজ যাদের পুলিশ খুন করে নিয়ে এল তাদের সঙ্গীদের সঙ্গে মেশা শুরু করেছিল। বোধহয় বাপের পথে হাঁটতে চায়। তুমি কাক হয়ে ভেবেছিলে নিজের ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটিয়েছ, সে কোকিল হয়ে উড়ে গেল। যাক গে। এখন ওর মাকে চলে যেতে বলো।’

‘বাবু। এই বোবা মেয়েমানুষ কোথায় যাবে?’ করুণ গলায় প্রশ্ন করল কালীচরণ।

‘আমি বলব কী করে? যা করার অনেক করেছি, আর নয়। কেন? তার মা এসেছিল সুন্দরবন থেকে নিয়ে যেতে। আত্মীয়স্বজন নিশ্চয়ই রয়েছে। তা ছাড়া দলের লোকজনের তো সবাই মরে যায়নি। তাদের কাছে যাক!’ বনবিহারী খিঁচিয়ে উঠলেন।

‘কিন্তু—।’

‘কালীচরণ, তুমি কি চাও এই বয়সে পুলিশ আমাকে হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাক? উঃ, কেন যে মা আর বাচ্চাটাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম!’

কালীচরণ বলল, ‘বাবু, একটা কথা বলব?’

বনবিহারী কথা বললেন না, মুখও ফেরালেন না।

‘চলুন, আমরা অন্য কোথাও চলে যাই।’

‘অন্য কোথাও মানে?’

‘অনেকদিন আগে আপনি আপনার মাকে বলতেন হরিদ্বারের পাহাড়ে গিয়ে থাকতে চান। সেখানেই চলুন।’

‘খাবে কী?’

‘যা আছে তাতেই হবে। আপনি ডাক্তার, সেখানেও তো মানুষ অসুখে পড়ে।’

একবার জায়গা ছেড়েছি, আর নয়।’ বনবিহারী উঠে দাঁড়ালেন, ‘গেলে একাই যাব।’

কালীচরণের পরামর্শেই সম্ভবত, বনবিহারীর নাওয়াখাওয়ার সময় মামণিকে কাছাকাছি দেখা গেল না। বনবিহারী বিছানায় শরীর এলিয়ে দেওয়ার আগে কালীচরণকে বললেন, ‘তোমাকে চেম্বারে যেতে হবে। পাশের দোকানকে বলবে আজ আমি চেম্বারে যাব না। শরীর ভালো নেই।’

‘বলার দরকার নেই। লোকে দরজা বন্ধ দেখলেই বুঝে যাবে।’ কালীচরণ বলল।

বিরক্ত হলেন বনবিহারী, ‘লোকে কী বুঝবে তা জানি না, আমার কর্তব্য তাদের বুঝিয়ে দেওয়া। তোমার যদি যেতে আপত্তি হয় তাহলে আমি নিজেই যাচ্ছি।’

‘না—না—না। আমি এখনই যাচ্ছি।’

কালীচরণ বেরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়েই অবাক হলেন বনবিহারী। মামণি এসে কখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পেছনে, বুঝতে পারেননি। গম্ভীর মুখে নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিলেন, মামণি দৌড়ে এসে পথ আটকালো। তার দুটো হাত দুপাশে বাড়ানো।

বনবিহারী বললেন, ‘সরে যাও।’

মামণি নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

‘শোনো, তোমার এই বাড়িতে থাকা চলবে না। তোমার ছেলে স্কুল-হোস্টেল থেকে পালিয়ে গিয়েছে। তাকে পুলিশ উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মেলামেশার জন্যে ধরেছিল। পুলিশের নজর এখন এই বাড়ির ওপর পড়েছে। এখানে থাকলে তোমাকে যেমন ধরবেই আমাকেও ছাড়বে না। বুঝতে পেরেছ?’

মাথা নেড়ে না বলল মামণি। কিন্তু হাত নামিয়ে নিল। মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে চাইলেন না বনবিহারী। পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। কিন্তু তাঁর পিছু পিছু ঘরে এল মামণি।

বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কীরকমের মা? ছেলে এই বয়সে পুলিশের নজরে পড়েছে। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হতে চলেছে। মা হয়েও তুমি চুপ করে থাকবে?’

মামণি একটু ভাবল। তারপর এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে কাগজ কলম নিয়ে কিছু লিখে বনবিহারীর সামনে ধরল, ‘আমি মা হতে চাইনি। তাকে সুন্দরবনের পরে চোখেও দেখিনি। তার সম্পর্কে আমার মনে টান আসবে কী করে?’

কথাগুলো মানতে বাধ্য হলেন বনবিহারী। তাই কথা ঘোরালেন, ‘ভেবে দ্যাখো, তোমার কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে কিনা। তাহলে সেখানে কয়েকমাসের জন্যে চলে যাও।

মাথা নাড়ল মামণি, বোঝাল, কোনও জায়গা নেই।

বনবিহারী বিরক্ত হলেন, ‘নেই বলছ! হঠাৎ দেখব একজন মহিলাকে নিয়ে কোনও ছেলে এসে হাজির হয়েছে আর তুমি তাদের সঙ্গে উধাও হয়ে যাবে।’

দ্রুত মাথা দুপাশে নাড়তে লাগল মামণি।

‘এখন যাও, আমি বিশ্রাম করব।’ বনবিহারী তিক্ত গলায় বললেন।

বিকেলে কালীচরণ এসে বনবিহারীর ঘুম ভাঙাল। মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিলেন তিনি। চোখ মেলতে কালীচরণ বলল, ‘দারোগাবাবু এসেছেন।’

‘কী বলছেন?’

‘আপনাকে ডাকছেন।’

অগত্যা উঠতে হল। মনে মনে শঙ্কিত হলেন বনবিহারী, কিন্তু কিছু করার নেই।

হাসিমুখে ঘরে ঢুকে দারোগাবাবু বললেন, ‘ঘুমাচ্ছিলেন বুঝি! তা টায়ার্ড হওয়াই স্বাভাবিক। ছেলেটার জন্যে কম হ্যাপা পোয়াতে হচ্ছে না তো!’

‘বলুন, কী ব্যাপার?’ বনবিহারী জিজ্ঞাসা করলেন।

‘রুটিন চেক আপ। এসপি সাহেবের হুকুম হয়েছে আপনার বাড়িটা ঘুরে দেখতে। আমি বলেছিলাম, আপনি আমাদের সঙ্গে খুব সহযোগিতা করেন, আজও আপনার লোকের জন্যে দুজনকে পেয়েছি। কিন্তু তাঁর বক্তব্য হল অপত্যস্নেহ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। সন্তান এই বাড়িতে লুকিয়ে আছে কিনা দেখতে বলেছেন। সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।’ খুব নরম গলায় বললেন দারোগাবাবু।

‘তার দরকার হবে না, দেখুন।’

দারোগাবাবুর সঙ্গে দুজন সেপাই ছিল। তাঁর ইঙ্গিতে তারা ভেতরে ঢুকে গেল। তাতে একটু স্বস্তি পেলেন বনবিহারী। মামণিকে দেখে ওরা নিশ্চয়ই সন্দেহ করবে না, ওরা একটি অল্পবয়সি ছেলেকেই খুঁজবে।

চেয়ারে বসে দারোগাবাবু বললেন, ‘তাজ্জব কাণ্ড ডাক্তারবাবু! এইটুকু ছেলে এর মধ্যে উগ্রপন্থীদের সঙ্গে মেলামেশা করছিল? ধরে নিলাম সেটা অল্প বয়সের কৌতূহল, তাকে প্রিন্সিপাল বুঝিয়েছে, আপনি বুঝিয়েছেন, আমরাও বুঝিয়েছি, কিন্তু সেসব না বুঝে সে থানা থেকে পালিয়ে গেল? কত বড় সাহস! এ ছেলে তো পরে নির্মম উগ্রপন্থী হয়ে মানুষের পর মানুষ মারবে।’

‘আমিও খুব অবাক হয়েছি।’

‘আমাদের ধারণা সে ইতিমধ্যে আপনার এখানে যদি না এসে থাকে তাহলে পরে আসবেই। কোথায় যাবে সে? দেখুন ডাক্তারবাবু, এখনও সময় আছে। এখনও আপনার ছায়া থেকে দূরে সরে যায়নি। এখন সে পুলিশের কাছে ধরা দিলে শর্তসাপেক্ষে ছেড়ে দিতে পারি। আরে, ও তো থানা থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও ক্রাইম করেনি।’ দারোগাবাবু রুমালে মুখ মুছলেন।

এই সময় সেপাইরা ফিরে এল। একজন বলল, ‘নাঃ, পেলাম না। নেই।’

‘নেই?’ উঠে দাঁড়ালেন দারোগাবাবু, ‘ভালো করে দেখেছ তো?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘বাঃ। তাহলে এসপি সাহেবকে বলব আমার ধারণাই ঠিক।’ দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়ালেন দারোগাবাবু, ‘আচ্ছা, সুজয় মাস্টারকে তো আপনি কিছুদিন এবাড়িতে রেখেছিলেন, তাই তো?’

‘হ্যাঁ। উনি অসুস্থ ছিলেন। থাকার জায়গা ছিল না।’

‘তারপর সদানন্দবাবুর বাড়িতে ঘর ভাড়া নেয়।’

‘হ্যাঁ।’

‘সেখানে থাকতে পারে না। সদানন্দবাবুর স্ত্রী পছন্দ করেননি। ওর কাছে আর এক মাস্টারনি আসা-যাওয়া করত।’

‘সেইরকম শুনেছি।’

‘লক্ষ করুন। তারপর সুজয় মাস্টার বাড়ি ভাড়া নিল বলাইচাঁদবাবুর বাড়িতে। তিনি তো শয্যাশায়ী, নড়াচড়া করতে পারেন না। এখন আর চিকিৎসাও হয় না। তাঁর স্ত্রী পার্লার চালান। সে সম্পর্কে কোনও কমপ্লেন না থাকলেও মহিলা যে সুবিধের নন তা অনেকেরই জানা। সেই মহিলার কাছে ঘরভাড়া চাইলেন সুজয় মাস্টার এবং পেলেন। তা তাঁর মহিলাপ্রীতি নিয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই যতক্ষণ না কেউ কমপ্লেন করছেন। কিন্তু সুজয় মাস্টারের কাছে কি সন্তান যেতে পারে? ওদের মধ্যে তো বেশ ভাব ছিল বলে খবর আছে।’ দারোগাবাবু তাকালেন।

‘সন্তান এখন কী করছে, কী করবে তা আমার ধারণার বাইরে।’

‘আমার মনে হয় আপনার কিছুদিন বাইরে ঘুরে আসা উচিত।’

‘কেন?’

‘এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন। সন্তান যদি এসে দেখে বাড়ি বন্ধ তাহলে ফিরে যাবে। আপনাকেও অস্বস্তিতে পড়তে হবে না, চলি।’

দারোগাবাবুর গাড়ি চলে গেলে কালীচরণ বেরিয়ে এল, ‘বাবু, উনি শেষকথাটা ঠিকই বললেন।’

‘মানে?’

‘চলুন, আমরা সবাই কোথাও বেড়িয়ে আসি।’

‘আমরা মানে—!’

‘আপনি, আমি, মামণিকেও নিয়ে যেতে হবে। রেখে যাওয়া চলবে না।’

‘অসম্ভব। ওকে নিয়ে কোথাও যাব না।’ বনবিহারী মাথা নাড়লেন।

‘খালি বাড়িতে ও একা থাকলে কী হবে, ভাবুন? আর আমি যদি এখানে থাকি তাহলে সন্তান এলে ফিরিয়ে দিতে পারব?’

‘ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলে পুলিশ আমার বিরুদ্ধে বেশি যুক্তি পাবে।’

‘জানতেই পারবে না। এই যে সেপাই দুটো যখন ভেতরে গিয়েছিল তখন মামণি ঘোমটা মাথায় দিয়ে বাসন মাজছিল। জিজ্ঞাসা করল, ‘ঝি?’ আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। ওদের কোনও সন্দেহ হল না। নিয়ে চলুন, ঝি-এর মতো থাকবে।’ কালীচরণ পরামর্শ দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *